স্বকৃত নোমান
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শ্রী অতনু ভট্টাচার্য 888sport appsে এসেছেন মূলত একটি গবেষণার কাজে। বছর দেড়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টির পুরনো একটি কাঠের আলমারিতে একটি ডায়েরি খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। বহু বছরের অব্যবহৃত আলমারি। ফ্যাকাল্টির দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির কোনায় কে কবে আলমারিটি রেখেছিল কেউ জানে না। দরজার কড়ায় জংধরা তালাটির চাবি কার কাছে তারও কোনো হদিস নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দপ্তরে চাবিটির খোঁজ করেছেন অতনুবাবু। কারো কাছে নেই। কোথায় আছে, তাও কেউ বলতে পারেনি। নিতান্ত কৌতূহলের বশে তালাচাবির মিস্ত্রি ডেকে তালাটি তিনি ভেঙে ফেললেন।
তিন তাকের আলমারি। ধুলায় আকীর্ণ। ওপরের তাকে একটি তোয়ালে, মাঝের তাকে শেক্সপিয়রের নাটকের বই টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস এবং চামড়ার মলাটের একটি ডায়েরি ছাড়া আর কিছু নেই। ধুলো ঝেড়ে বই ও ডায়েরিটা নামিয়ে নিলেন তিনি। ডায়েরিটা ব্রিটিশ আমলের। ১২৮ পাতার। মলাটটা ধুলো-ময়লায় বিবর্ণ। প্রথম ১২ পাতায় ইংরেজি হস্তলিপি, বাকি পাতাগুলো খালি। প্রথম পাতায় দার্জিলিং 888sport slot gameের টুকরো বর্ণনা। নিচে লেখকের নাম – কেভিন ব্রেনান। বাকি ১১ পাতার কোথাও লেখকের নাম না থাকলেও ধরেই নেওয়া যায় ডায়েরিটি কেভিন ব্রেনানের। ৭ নম্বর পাতায় কেভিন ব্রেনান লিখেছেন একটি হত্যাকা–র সংক্ষিপ্ত বিবরণ। ১৭৮৩ সালের ২২ অক্টোবর বিকেলে পূর্ববাংলার শ্রীহট্টের কোনো এক হাড়িয়াগড়ে রমেন্দ্র নারায়ণ ও নিখিল প্রহ্লাদ নামের দুই সন্ন্যাসীকে তিনি বন্দুকের গুলিতে হত্যা করে একটা শিরীষগাছের তলায় ফেলে রাখেন। দুই সন্ন্যাসীর চেহারা ও বসনের বর্ণনাও দেন সংক্ষেপে। গুলি করার আগে কীভাবে তারা নির্বিকার দাঁড়িয়েছিল সে-কথাও লিখেছেন। কিন্তু তাদের বাড়ি কোথায়, কী অভিযোগে তাদের হত্যা করা হয়েছিল, হাড়িয়াগড় জায়গাটা শ্রীহট্টের কোথায়, মি. কেভিন সেখানে কেন গিয়েছিলেন, এসবের কিছুই উলেস্নখ নেই।
অধ্যাপক অতনু ভট্টাচার্যের কৌতূহল এখানেই। মি. কেভিন যখন দুই সন্ন্যাসীকে হত্যা করেন বাংলার পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে তখন ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ চলছে। সংঘাত তুমুল আকার ধারণ করে 888sport appsের নাটোর ও রংপুর অঞ্চলে। শ্রীহট্ট অঞ্চলে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কথা ইতিহাসে নেই। অন্তত অতনুবাবু কোথাও পাননি। তাহলে মি. কেভিন শ্রীহট্টের হাড়িয়াগড়ে দুই সন্ন্যাসীকে কেন হত্যা করেছিলেন? বিদ্রোহের অভিযোগে, না অন্য কোনো কারণে? বিদ্রোহের অভিযোগ ছাড়া একসঙ্গে দুই সন্ন্যাসীকে কেনই-বা হত্যা করলেন? তবে কি শ্রীহট্ট অঞ্চলেও ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল?
ইতিহাসের অনুলিস্নখিত বিষয়গুলো নিয়েই অধ্যাপক অতনু ভট্টাচার্যের গবেষণা। ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার সূত্রপাত বিষয়ে একটি 888sport live লিখে কলকাতার বোদ্ধামহলে রীতিমতো তিনি বিতর্কের ঝড় তুলে দিয়েছিলেন। প্রমাণ করেছেন ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের চারা ব্রিটিশদের হাতে রোপিত হয়নি, হয়েছিল মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে। কীভাবে আওরঙ্গজেব এই বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করেছিলেন, ব্রিটিশরা কীভাবে চারাটির গোড়ায় জল ঢেলে বৃক্ষে রূপান্তরিত করেছিল, যুক্তি-প্রমাণসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন।
উদ্ধারকৃত ডায়েরিতে শ্রীহট্টের হাড়িয়াগড়ে কেভিন ব্রেনান কর্তৃক দুই সন্ন্যাসী হত্যাকা–র নোটে তিনি ইতিহাসের অনুলিস্নখিত অধ্যায়ের গন্ধ পেলেন। শুরু হলো তার অনুসন্ধান। নানা মাধ্যমে জানার চেষ্টা করলেন তৎকালীন শ্রীহট্ট তথা বর্তমান সিলেটের ইতিহাস। 888sport app থেকে প্রকাশিত সিলেটের ইতিহাসবিষয়ক একাধিক বই সংগ্রহ করলেন। কোথাও ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বা হাড়িয়াগড় গ্রাম বা দুই সন্ন্যাসী হত্যার কথা খুঁজে পেলেন না; কিন্তু তার কৌতূহল অদম্য। সরেজমিন এসে ঘটনাটা অনুসন্ধান না করা পর্যন্ত তার স্বসিত্ম নেই।
রবিউল মোরশেদ ছাড়া 888sport appয় তার বিশেষ পরিচিত কেউ নেই। রবিউলের সঙ্গে পরিচয় ফেসবুকে। প্রায় পাঁচ বছরের ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডশিপ। অতনুবাবু ফেসবুকে যে-স্ট্যাটাসই দেন, রবিউলের চোখে পড়লে লাইক ও কমেন্ট না দিয়ে যায় না। ইনবক্সে চ্যাটিংও হয় মাঝেমধ্যে। তিস্তার পানি চুক্তি, মুসলিম মৌলবাদীদের প্রতি মমতা ব্যানার্জির গোপন সমর্থন, গরু নিয়ে হিন্দু মৌলবাদীদের বাড়াবাড়ি, দুই বাংলার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিষয়ে কথা হয়। রবিউল একবার বলেছিল, ‘888sport appsে এসে একবার ঘুরে যান, দাদা।’ অতনুবাবু বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, একটাই তো দেশ ছিল একসময়। আমার জন্ম কলকাতায় হলেও দাদাবাড়ি ছিল বরিশালে। যাওয়ার ইচ্ছা আছে একবার। হুট করে চলে যাব একদিন।’
হুট করেই চলে এলেন অতনুবাবু। মৈত্রী এক্সপ্রেসে চড়ে সোজা 888sport appয়। আটদিনের 888sport slot gameে। 888sport app ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে নেমে একটা প্রি-পেইড সিমকার্ড কিনে ফেসবুক সাইন ইন করে ইনবক্স করলেন রবিউলকে, মোবাইল নম্বরটা দিয়ে তার 888sport appsে আসার খবরটা জানালেন। সঙ্গে সঙ্গেই রবিউলের ফোন – কী আশ্চর্য! আপনি 888sport appয়? আগে জানালেন না কেন?
ফার্মগেটে এসে অতনুবাবুর সঙ্গে দেখা করল রবিউল এবং পল্টনের একটি আবাসিক হোটেলে তাকে উঠিয়ে দিলো। পরদিন সকাল সাতটায় পারাবত এক্সপ্রেসে চড়ে দুজন রওনা হয়ে গেল সিলেটের উদ্দেশে। কলেজের চাকরি রবিউলের। কলেজ তখন বন্ধ ছিল, নইলে সঙ্গ দেওয়া সম্ভব হতো না। সিলেট শহরে তারা দুদিন থাকল। স্থানীয় সাংবাদিক, কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে দেখা করল, আলাপ করল, কিন্তু কেউ হাড়িয়াগড় গ্রামের সন্ধান দিতে পারল না। জেলা প্রশাসকের দপ্তরে গিয়ে সিলেট বিভাগের মানচিত্র ঘাঁটাঘাঁটি করল, তবু হদিস মিলল না। তৃতীয় দিন চলে গেল সুনামগঞ্জ। কেননা, সুনামগঞ্জ তো সিলেট বিভাগেরই অন্তর্ভুক্ত, হাড়িয়াগড় নামে কোনো গ্রাম থাকতেও তো পারে সেখানে। কিন্তু না, হাড়িয়াগড়ের সন্ধান দিতে পারল না কেউ। সুরমা নদীতে নৌ888sport slot game করে, মরমি সাধক হাছন রাজার বাড়িঘর দেখে সন্ধ্যায় আবার ফিরে এলো সিলেট শহরে। রবিউল বলল, ‘সিলেট যখন আসাই হলো, আরো একটা দিন থেকে জাফলং দেখে যাই। এখন তো বর্ষাকাল। বর্ষার জাফলং দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন।’ অতনুবাবু অমত করলেন না। পরদিন ভোরে একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে দুজন চলে গেল জাফলং, মুগ্ধতা নিয়ে ফিরল সন্ধ্যায়। রাতে অতনুবাবু জানতে চাইলেন, আচ্ছা এখানে মৌলভীবাজারটা কোথায়?
রবিউল বলল, সে তো অন্য জেলা। বহুদূর।
মৌলভীবাজার তো সিলেট বিভাগেরই একটি জেলা, তাই না?
তা বটে। সিলেট তো অনেক বড় বিভাগ।
চলুন মৌলভীবাজার যাই।
হাড়িয়াগড় কি খুঁজে পাবেন ওখানে? মনে তো হচ্ছে না। তার চেয়ে বরং শ্রীমঙ্গল যাই।
শ্রীমঙ্গল! বাহ, নামটা তো বেশ! কী আছে ওখানে?
কী নেই তাই বলুন। মৌলভীবাজারের সবচেয়ে বিখ্যাত একটি স্থান শ্রীমঙ্গল। পাহাড় ও ঘন বনাঞ্চল থাকায় দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ও শীত পড়ে ওখানে। রয়েছে প্রায় ৩৮টি চা বাগান। ইস্পাহানি, ফিনলের মতো বিখ্যাত সব চা বাগান তো ওখানেই। রয়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, বাইক্কা বিল। পার্শ্ববর্তী উপজেলা কমলগঞ্জে আছে ন্যাশনাল টি-গার্ডেন, মাধবপুর লেক, হামহাম ঝরনা। সবুজ কাকে বলে শ্রীমঙ্গল গেলে বোঝা যায়। এমন সুন্দর জায়গা 888sport appsে খুব কমই আছে।
রবিউলের বর্ণনা শুনে শ্রীমঙ্গল 888sport slot gameে আগ্রহী হয়ে উঠলেন অতনুবাবু। তিনি ধরেই নিয়েছেন হাড়িয়াগড় গ্রাম খুঁজে পাবেন না। কত বিশাল সিলেট বিভাগ! সিলেটের কোন জেলার কোন উপজেলার কোন ইউনিয়নে হাড়িয়াগড় গ্রাম, খুঁজে বের করা আসলেই জটিল। এই নামে কোনো গ্রাম আদৌ আছে কিনা সন্দেহ। কালে কালে তো জনপদের নাম পরিবর্তন হয়। অন্তত 888sport appsে হয়। কৃষ্ণনগর হয়ে যায় রসুলপুর, রামগঞ্জ হয়ে যায় নবীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে যায় বি-বাড়িয়া। হাড়িয়াগড় যে রহিমগড় হয়ে যায়নি তা কে বলবে। তবে সিলেটে যেহেতু এলেনই, শ্রীমঙ্গল এত সুন্দর জায়গা, না দেখে ফিরবেন কেন? জীবনে কি আর কখনো 888sport appsে আসা হবে? বয়স তো কম হয়নি। পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই। কদিনই-বা আর বাঁচবেন। রবিউল তার এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রীমঙ্গলে একটা কটেজ বুকিং দিয়ে দিলো। বিকাশ করে পাঠিয়ে দিলো এক হাজার টাকা। নিসর্গ- নীরব কটেজ। শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে, হোটেল গ্র্যান্ড সুলতানের পাশে। শনের ছাউনি, বাঁশের বেড়া – একেবারে গ্রামীণ পরিবেশ। ভাড়া পঁচিশশো টাকা প্রতিদিন।
শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকেই আজিজ লোকটা তাদের পিছু লাগল। অটোরিকশা ড্রাইভার। মধ্যবয়সী। মুখে সাদাকালো চাপদাড়ি। সারাক্ষণ পান চিবায় আর কতক্ষণ পরপর বিড়ি ধরায়। গায়ে পড়ে আলাপ-জমানো মানুষ। স্টেশন থেকে নিসর্গ-নীরব কটেজের ভাড়া দেড়শো টাকা। দুশো টাকা চেয়েছিল আজিজ, রবিউল একশ কুড়ি টাকা বলতেই রাজি হয়ে গেল। কটেজে পৌঁছে সে অতনুবাবুকে বলল, ‘আজই তো আর বারইতা নায় স্যার, নায়নি?’
উত্তর দিলো রবিউল, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আজ আর কোথায় যাব। কেন বলুন তো?’
আফনারার গাড়ি লাগত নায়নি?
গাড়ি কেন?
ঘুরতা নায়নি আফনারা? কততা দেখার আছে শ্রীমঙ্গলো।
ঘুরব তো বটেই।
গাড়ি লাগলে আমারে ডাখবা। আফনার নম্বরটা দেইন।
বরং আপনার নম্বরটাই দিন, দরকার হলে আমি ফোন দেব।
পরদিন সকালে লাউয়াছড়া উদ্যান দেখে মাধবপুর লেক দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো তারা। কটেজের ম্যানেজার একটা অটোরিকশার ড্রাইভারের সঙ্গে ফোনে কথা বলল। আটশো টাকা ভাড়া চাইল ড্রাইভার। রবিউল ফোন দিলো আজিজকে। লোকটা অনুরোধ করেছে, দেখা যাক কত টাকা চায়। আজিজ বলল, ‘স্যার, শ্রীমঙ্গলো দেখার বহুত্তা আছে। সারাদিনোর লাগি আমারে নেইনগি। ইচ্ছামতো ঘুরবা।’
কত দিতে হবে আপনাকে?
দেইন যে স্যার।
বলুন না কত?
গ্যাস পাঁশশো, মা’জনের পাঁশশো আর আমার রোজ চাইরশো। মোট ছউদ্দশো টেখা দিবা স্যার।
অনেক বেশি। বারোশো হলে আসতে পারেন।
দুই-এখশ কুনো বিষয় না স্যার। আমি আইয়ার, আফনারা রেডি অউক্কা।
সারাদিনই ঘোরাল বটে আজিজ। সকাল ৯টায় যাত্রা শুরু। প্রথমে লাউয়াছড়া ফরেস্ট, তারপর কমলগঞ্জের ন্যাশনাল টি গার্ডেন, মাধবপুর লেক। ওখান থেকে গৌরাঙ্গ বৈদ্যের বিখ্যাত সাত রঙের চায়ের দোকানে আসতে আসতে বেলা দেড়টা। শহরের এক হোটেলে দুপুরের লাঞ্চ সেরে বাইক্কা বিলের উদ্দেশে রওনা। বিল দেখেটেখে আবার যখন শহরের উদ্দেশে যাত্রা করল তখন বিকেল সাড়ে ৫টা। শহরে ঢোকার আগে আজিজ বলল, ‘সব তো দেখলা স্যার, এখটা জাগা বাকি থাকি গেলো।’
কোথায় সেটা? জানতে চাইল রবিউল।
তেরো নম্বর গরমটিলা।
গরমটিলা কি পাহাড়ের নাম?
জিঅয় স্যার।
কী আছে সেখানে?
পিরের আস্তানা।
পির-দরবেশদের মাজারের প্রতি রবিউলের বিশেষ আগ্রহ। দেশে যেভাবে গোঁড়া সালাফিজমের বিস্তার ঘটছে, সে মনে
করে, সালাফিদের মোকাবেলার অন্যতম উপায় হতে পারে মাজার-সংস্কৃতি। পির-দরবেশদের মাজারে কোনো ভেদাভেদ নেই, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান সবার জন্য উন্মুক্ত। মাজারভক্তরা সাধারণত ধর্মোন্মাদ হয় না। তারা তুলনামূলক সহনশীল। সবধর্মের প্রতি সহনশীল মনোভাব তাদের বিশেষ গুণ। সে বলল, চলুন, গরমটিলার মাজার দেখে যাই।
একটা সরু রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিলো আজিজ। প্রায় দশ মিনিট পর একটা রাবার বাগানের সামনে থামাল। পাকা রাস্তা থেকে একটা কাঁচা রাস্তা চলে গেছে পুবদিকে। রাস্তার মাথায় একটা সাইনবোর্ড। তাতে লেখা –
বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম
মগাছড়া ১৩ নং গরমটিলা
ওলি-আওলিয়াগণের আস্তানা
মোবাইল : ০১৭৩৪০০৩১৭
আস্তানা কমিটি।
আজিজ তো গায়েপড়া আলাপি, গরমটিলার নাম কেন গরমটিলা, তাকে জিজ্ঞেস করতে হলো না। গাড়িটা পাকা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে, দুই প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গরমটিলার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে শুরু করে। তখনো তার জন্ম হয়নি, তার বাবা তখনো নাবালক, মগাছড়া গ্রামের আবদুল বাতেন একদিন লাকড়ি কাটতে এসে টিলার মাথায় মাঝারি সাইজের একটা পাথর দেখতে পায়। মাটির নিচে অর্ধেক দেবে আছে। পাথরটার ওপর কু-লি পাকিয়ে ফণা ধরে বসে আছে মস্ত এক গোখরো। ফণায় বিচিত্র কারুকাজ। বিচিত্র রং ধারণ করেছে সূর্যকিরণে। এত বড় গোখরো জীবনে কখনো দেখেনি বাতেন। যুগপৎ ভয় ও মুগ্ধতায় সে সাপটির দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ তার চোখে বালি কি ঝরাপাতার কণা পড়লে পরে খানিকের জন্য চোখ বন্ধ করে। চোখ খুলে সাপটিকে আর দেখতে পায় না। এ কী আজব কা-! চোখের পলকে এত বড় একটা সাপ হাওয়া হয়ে গেল!
বাতেন ছিল সাহসী। নিশিরাতে বন-বাদাড়ে একাকী ঘুরে বেড়াত, খালে-বিলে একাকী মাছ ধরত। একটা শুকনো লাঠি কুড়িয়ে বুকভরা সাহস নিয়ে সে পাথরটির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। সাপটিকে দেখতে পায় না। ঘুরে খানিকটা পুবে গিয়ে দেখে, পাথরটির পেছনে মানুষের মাথার দুটি খুলি সামনে নিয়ে ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে সাপটি। কেঁপে উঠল বাতেন। দরদর করে ঘামতে শুরু করল। তখন হেমন্তকাল। শীত জেঁকে বসতে বেশি দেরি নেই। অথচ বাতেনের মনে হলো তার গায়ে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। চামড়া ঝলসে যাওয়ার মতো অবস্থা। মাথার ঘাম দরদর করে পায়ে নামছে। ভয় ও গরমে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে দ্রম্নত সে টিলা থেকে নেমে বাড়ি ফিরে যায়।
রাতে প্রচ- জ্বর ওঠে বাতেনের গায়ে। জ্বরের ঘোরে সে আবোল-তাবোল বকে আর খানিক পরপর ‘গরমটিলা গরমটিলা’ বলে হাঁক মারে। সিথানে বসে তার বাঁজা বউ মাথায় পানি ঢালে। সে ভেবে পায় না, গরমটিলা কথাটা কোত্থেকে পেল তার স্বামী। মগাছড়ায় তো এই নামের কোনো টিলা নেই। শেষরাতে জ্বরের ঘোরে ‘গরমটিলা গরমটিলা’ বলতে বলতে বাতেন ঘন ঘন হাঁক মারতে শুরু করলে তার বউ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। নিশ্চয়ই জিনে আসর করেছে। নইলে এমন করবে কেন লোকটা! কপালে হাত দিয়ে সে জানতে চায়, ‘কিতা অইছে আফনার?’
গরমটিলা গরমটিলা! বাতেন হাঁক মারতে থাকে। নিশ্চয়ই পির-আউলিয়ার কবর ছিল। নইলে খুলি এলো কোত্থেকে? নিশ্চয়ই তারা গরম পির। নইলে আমার গায়ে আগুন লাগল কেন? সে কী গরম! মাথার মগজ বলকাতে শুরু করল। গরমটিলা গরমটিলা!
সকালে জ্বর পড়ে গেল বাতেনের। দুপুরে পেটভরে খেয়ে সে আর বসে থাকতে পারে না, একটা ছেনি হাতে চলে যায় টিলার ওপর। পাথরটার কাছে গিয়ে সে তো অবাক। সাপও নেই, খুলিও নেই। সাদা ফুলে ঢেকে আছে পাথরটা। একরাতে এত ফুল এলো কোত্থেকে সে ভেবে পায় না। ওপরে তাকিয়ে দেখে একটা অচেনা গাছে ধরে আছে থোকা থোকা সাদা ফুল। টুপ করে একটা ফুল তার মুখের ওপর পড়ে। ফুলটা হাতে নিয়ে সে নেড়েচেড়ে দেখে। অচেনা ফুল। গাছটিও অচেনা। সব আজগুবি কা-কারখানা। এখানে যে পির-আউয়ালিয়ার কবর, তার আর সন্দেহ থাকে না। তার বুক ফেটে কান্না আসে। হাঁটুগেড়ে নামাজের ভঙ্গিতে বসে হাত তুলে সে মোনাজাত ধরে – হে দয়াল বাবা, হে কেরামতের ভা-ারি, আমি নিঃসমত্মান। এখটা বাইচ্চার লাগি আমার বউর বুকটা মরুভূমির মতো খাঁ-খাঁ করের। আর কিচ্ছু চাই না আমি, খালি এখটা বাইচ্চা চাই। দয়া খরইন, আমারে দয়া খরইন।
সে-রাতে বাতেনের যৌবনগাঙে ভরাকোটালের জোয়ার আসে। আশেস্নষে, চুম্বনে বউকে সে অস্থির করে তোলে। বউ তো বটেই, নিজের মর্দামির এমন তাকত দেখে বাতেন নিজেই অবাক হয়। কখনো সে দু-মিনিটের বেশি থাকতে পারে না। চড়ুইপাখির মতো ওঠে আর নামে। সে-রাতে দীর্ঘক্ষণ মেতে থাকল এবং বউকেও মাতিয়ে রাখল।
বাতেন ভাবতেই পারেনি সে-রাতে গরমটিলার দুই গরম পিরের কেরামতিতেই যে তার যৌবনগাঙে জোয়ার এসেছিল। টের পেল প্রায় তিন মাস পর, যেদিন তার বউ বলল, ‘আমার তলপেটে কিতা খালি লড়ের।’ বাতেন তো খুশিতে ডগোমগো। নিশ্চয় সমত্মান এসেছে তার বউয়ের পেটে। সহসা তার মনে পড়ে যায় সে-রাতের কথা, যে-রাতে বউকে সে জীবনে প্রথমবারের মতো পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিয়েছিল। আর কি দেরি করে বাতেন! সকালে গাভিটার দুধ দুইয়ে রেখেছিল। দুই সের। দুধের পাতিলটা নিয়ে রওনা হয়ে যায় গরমটিলার উদ্দেশে। পাতিলের সব দুধ দিয়ে পাথরটাকে ধুয়ে দেয়, চুমু খায়, হাত তুলে শুকরিয়া আদায় করে।
গ্রামে হামাগুড়ি দিতে লাগল গরমটিলার গরম পিরের কেরামতির খবরটা। নিশ্চয়ই পাথরটার নিচে পির-আউলিয়াদের আস্তানা রয়েছে। নইলে কী করে পূরণ হলো বাতেনের মনের বাসনা? মোমবাতি, আগরবাতি, গোলাপজল আর ঘটিভরা দুধ নিয়ে রওনা হয়ে গেল গ্রামের 888sport promo code-পুরুষ। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিশেষে। সপ্তাহের মাথায় গরমটিলার গরম খবর দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে মানুষ আসতে থাকে। দুধ দিয়ে পাথরটাকে গোসল করায়, পাথরটার পাশে ডুমুরগাছটাতে মানতের সুতা বাঁধে, পরম ভক্তিতে পাথরটা ছুঁয়ে মনের যত বসনা আছে সব ব্যক্ত করে।
ভেরি ইন্টারেস্টিং! বললেন অধ্যাপক অতনু ভট্টাচার্য।
রবিউল বলল, ইন্টারেস্টিং বটে। গ্রামবাংলায় এমন গল্প আমি আর শুনিনি।
আজিজ বলল, গল্প নায় স্যার, হাছা ঘটনা।
ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। চরাচরে আলো-আঁধারির খেলা। গরমপিরের আস্তানার সামনে এসে দাঁড়াল তিনজন। একপাশে একটা টিনের ঘর। খাদেমখানা। তারই পাশে মস্ত একটা পাথর। চারদিকে সিমেন্টের হাঁটুসমান দেয়াল। পাথরটার উত্তরপাশে পাশাপাশি দুটো ডুমুরগাছ। ছোট গাছটির ডালে ডালে নানা রঙের সুতো বাঁধা। ছাল-বাকল কিছু দেখা যাচ্ছে না সুতার কারণে। একটা কালো সালু কাপড়ে পাথরটা 888sport app। কাপড়টায় আরবি হরফের লেখা। ওপরে লাল শামিয়ানা টানানো। যেন সত্যি সত্যি কোনো পির-দরবেশের কবর।
রবিউল ডুমুরগাছটায় সুতা বাঁধে, আজিজ তার পেছনে দাঁড়িয়ে। অতনুবাবু সালু কাপড়টা একপাশে সরালেন। তেলাপোকারা ছোটাছুটি শুরু করল। মস্ত পাথর। জাফলংয়ে এমন বিস্তর পাথর তিনি দেখেছেন। স্থানীয় এক লোক বলেছিল, যত দিন যায়, পাথরগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়। অতনুবাবু পাথরটার গায়ে হাত বুলান। ঝিঙার আটির মতো অথবা মধুর চাকের মতো জালি জালি। সেসব জালিতে আঁটকে আছে দুধের সাদা সর। প্যান্টের পকেট থেকে স্মার্টফোনটি বের করে পাথরটির ছবি তুললেন তিনি। পেছন থেকে আজিজ হাঁক দিলো, ‘ছবি তুলা নিষেধ আছে স্যার।’ অতনুবাবুর মুখে মুচকি হাসি। আজিজ বলে, ‘এখবার ঢাখার এক ছাত্র ছবি তুলার সময় মোবাইলে আগুন ধরি গেছিলো। আতর আঙুল সব আঙ্গার অই গেছিল। ধরত না কেনে? ছবি তুলা শরীয়তে নিষেধ, পির-আউলিয়া হখলর অপছন্দ। অউ থাকি ছবি তুলা নিষেধ খরছে আস্তানা কমিটি।’
অতনুবাবুর হাসি মিলায় না। আজিজ বলে, ‘বুঝলা স্যার, পাত্থরটা আগে অনেখ ছুট আছিল। খেউ চাইলেই টানিয়া তুলতে পারত। বাড়তে বাড়তে অতো বড় অইছে। সব পিরর কেরামতি, বুঝলা স্যার। হা, আল্লাহ মালিক।’
এখানে কি ওরস হয়? জানতে চাইল রবিউল।
কেনে অইতো না? পউষ মাসর সতরো তারিখ মাজার কমিটি বিশাল ওরস খরে। দূরদূরান্ত থাকি শত শত মানুষ আয়। সাতটা গরু আর পনরোটা খসি জবো অয়। ইন্দু-মুসলমান-বউদ্ধ-খিষ্টান সব আয়। শ্রীমঙ্গলো তো ইন্দু-মুসলমান ফিফটি-ফিফটি। কেউ বাদ যায় না। হখলে তবাররক পায়। কোনো টান ফড়ে না। সব তারার ইশারা।
কে জানে হঠাৎ অতনুবাবুর মাথায় কী ঢুকল। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে তিনি কেভিন ব্রেনানের সেই ডায়েরিটা বের করলেন। ডায়েরির ৭ নম্বর পাতাটিতে চোখ বোলালেন কয়েকবার। ডায়েরিটা বুকে চেপে ধরে ওপরের দিকে তাকালেন। পাথরটার উত্তরে একটা প্রাচীন শিরীষগাছ। সঘন পত্রবিন্যাসে ছায়ানিবিড় বিশাল বৃক্ষ। আগাগোড়ায় তিনি চোখ বুলান। তারপর আবার ডায়েরিতে চোখ রাখেন। খানিক পর চোখ তুলে পাথরটা খুঁটিয়ে দেখেন এবং আবার ডায়েরিতে চোখ রাখেন। ৭ নম্বর পাতায় কেভিন ব্রেনানের লেখা সর্বশেষ লাইনটি বারবার পড়েন –
‘শেষ নিঃশ্বাসটি ছাড়ার আগে দুই সন্ন্যাসী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিল। ওই অবস্থাতেই তাদের মৃত্যু হয়। দৃশ্যটি আমার কাছে অসহ্য ঠেকেছিল। আমি দুই লাশের মধ্যবর্তী স্থানে পাথরটি রেখে দেওয়ার নির্দেশ দেই।’
ডায়েরিটা বন্ধ করে আবারো পাথরটার দিকে তাকালেন অতনুবাবু। তাকিয়ে থাকলেন খানিকক্ষণ। তারপর আজিজের দিকে ফিরে বললেন, আচ্ছা, আপনার বাড়ি কি আশপাশে কোথাও?
আজিজ বলল, বেশি দূরে নায়। ইখান থাকি মাত্র তিন কিলো।
এই জায়গাটার নাম কী?
সাইনবোর্ডে তো লেখা আছে, দেখছইননানি? মগাছড়া ১৩ নম্বর গরমটিলা।
গরমটিলা নাম হয়েছে তো পাথরটা আবিষ্কারের পরে, তাই না?
ইতা অবশ্য ঠিক খইছইন।
তার আগে জায়গাটার কী নাম ছিল বলতে পারেন?
আজিজ মাথা নাড়ে, না স্যার, খত বছর আগর খতা, আমি কিলা খইমু!
এই তথ্যটা আমার জানা দরকার।
এখজনের খাছে জানতা পারবা। গউরাঙ্গ দাস। যাইতানি তার খাছে?
গৌরাঙ্গ দাস! কোথায় থাকেন তিনি?
দুই কিলো দূরে, মগাছড়ার শেষ মাথাত।
একটানে গৌরাঙ্গ দাসের বাড়ির সামনে এসে গাড়ির ব্রেক কষল আজিজ। অন্ধকার ততক্ষণে আরো গাঢ় হয়ে উঠেছে। একটা মাটির ঘর। শনের ছাউনি। পরিচ্ছন্ন খোলা বারান্দায় একটা হারিকেন জ্বলছে। গলাখাঁকারি দিয়ে ‘গৌরাঙ্গবাবু গৌরাঙ্গবাবু’ বলে হাঁক দিলো আজিজ। খানিক পর বেরিয়ে এলো এক কিশোরী। জানাল, গৌরাঙ্গ দাস অসুস্থ, ভেতরে শুয়ে আছেন। আজিজ ভেতরে ঢুকে গেল। পেছনে অতনুবাবু ও রবিউল। তাদের দেখে শোয়া থেকে উঠে বসলেন গৌরাঙ্গ দাস। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে। একটা দাঁতও নেই মুখে। মাথার সব চুল পাকা।
কুশল বিনিময়ের পর দেরি না করে অতনুবাবু আসল কথাটি পাড়লেন। গৌরাঙ্গ দাস খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর চৌকি থেকে নেমে লাঠিতে ভর দিয়ে ভেতরঘরে চলে গেলেন। প্রায় পনেরো মিনিট পর ফিরলেন হাতে দুটো দলিল নিয়ে। বহু পুরনো দলিল। কালিঝুলিতে বিবর্ণপ্রায়। তিন পাতা করে ছয় পাতা। স্থানে স্থানে পোকায় খাওয়া। জলচৌকির ওপর দলিল দুটি রেখে পাতা উলটাতে লাগলেন। অতনুবাবু ঝুঁকে দলিলের হস্তলিপি পড়ার চেষ্টা করলেন। তৃতীয় পাতাটি উলটিয়ে গৌরাঙ্গ দাস বললেন, ‘শেষ জরিফ অনুযায়ী বর্তমান গরমটিলার নাম আছিল হাড়িয়াগড়।’
সোজা হয়ে বসলেন অধ্যাপক অতনু ভট্টাচার্য। উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখখানা। পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে দলিল দুটোর ছবি তুলে নিলেন। গৌরাঙ্গ দাসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে দাঁড়ালেন উঠানে। তখন দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আকাশে মেঘ করেছে বিস্তর। পাহাড় ও ঘন বনাঞ্চলের দেশে একটু পর বৃষ্টি নামবে। r


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.