মানবর্দ্ধন পাল
এ-কথা কে না জানে যে, বঙ্গীয় বদ্বীপ নদীমাতৃক অঞ্চল! যদিও প্রাচীনকালের মতো নাব্যতা নেই, অনেক নদীতে স্রোতের খরতা নেই, বেগের প্রাবল্য নেই, পরিবর্তিত হয়েছে বহমান ধারা-বাঁক-মোড়-গতি, হয়েছে দিক্ভ্রান্ত – তবু এ-কালের 888sport appsও নদীর জালে ঘেরা। কেবল ভৌগোলিক অর্থেই নয়, কৃষি-কৃষ্টি-সংস্কৃতি সমাজগঠন – সকল মৌলিক শর্তেই নদী 888sport appsের জননী, নদীই বাংলা ও বাঙালির গর্ভধারিণী। মধুকবি যে তাঁর শৈশবের নদী কপোতাক্ষকে উদ্দেশ করে 888sport sign up bonusকাতরতায় আক্রান্ত হয়ে লিখেছেন : ‘দুগ্ধস্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে’ – এ-কথা ধ্রুব সত্য ও প্রবাদপ্রতিম।
888sport appsে কত নদী আছে? এর শাখা-প্রশাখা এবং খাল-বিল মিলিয়ে 888sport free bet কত? হয়তো হিসাব আছে ভূগোল-বিশেষজ্ঞের কাছে। তবে প্রচলিত ধারণা, 888sport free betতাত্ত্বিক হিসাবে কমবেশি যা-ই হোক, 888sport appsে নদী আছে তেরোশো। শুধু ভূগোল নয়; সত্য-মিথ্যা জানি না, সৈয়দ শামসুল হকের 888sport app download apkয়ও আছে এরকম তথ্য। যা-ই হোক, এ-লেখায় তা যাচাই করার প্রয়োজন নেই।
দুই
888sport appsের নাম জানা-অজানা, ছোট-বড়, বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতির নদীর মধ্যে তিতাস একটি নদীর নাম। ঠিক এই নামে, তিতাস একটি নদীর নাম, অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন একটি 888sport alternative link। তিতাস তেমন কোনো বিখ্যাত নদী নয় – না-পৃথিবীর ভৌগোলিক বিবরণে, না-888sport appsে। তিতাস একটি ছোট্ট নদী। ঠিক নদীও নয়; ভূগোলতত্ত্বের ভাষায় এটি একটি উপনদী বা শাখানদী।
প্রাগৈতিহাসিককালে কেমন ছিল জানি না; এখন অনেকটা এরকমই তিতাসের আকৃতি-প্রকৃতি। তাই পৃথিবীজোড়া মানুষের জানার কথা নয় এ-নদীর নাম – 888sport appsের মানুষও জানে না তিতাসের ইতিকথা! যাঁরা জানেন, তাঁদের অধিকাংশই জানেন ভৌগোলিক বিবরণ থেকে এবং সে-জানা কেবল নামমাত্র জানাই।
তিতাস রূপের নদী, অপরূপের নদী, অরূপের নদী। তিতাস 888sport live chat ও স্বপ্নের নদী – সংক্ষুব্ধ জীবন-সংগ্রামের নদী। এই যে ক্ষীণতোয়া তিতাস, স্বচ্ছসলিলা তিতাস, ডাহুক-পানকৌড়ি আর মেছোবকের ওড়াউড়ি-কলকাকলিময় তিতাস, দুকূলে সবুজের সমারোহময় তিতাস, সুস্বাদু কেঁচকি, কাটারি আর কালবাউশ মাছের ডুবসাঁতারে সমৃদ্ধ ও প্রাণময় তিতাস – এর ভেতরেও আছে কত অন্তর্দাহের ইতিবৃত্ত। সেই দহন-দলন-দীনতার কুৎসিত রূপ দর্শনের জন্য প্রয়োজন দিব্যদৃষ্টি। দিব্যদৃষ্টি মানুষের থাকে না – যা থাকে কারো-কারো মধ্যে – তা অন্তর্দৃষ্টি। সেরকম অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অদ্বৈত দেখেছিলেন তিতাসকে আর এর তীরবর্তী বহুমাত্রিক যন্ত্রণাতাড়িত জনজীবনকে। তাই তো তিতাস নতুনভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে, বোধগম্য হয়েছে – লাভ করেছে পরিচিতি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে। কেবল অদ্বৈতের কালি-কলমের গুণে, বৃত্তি ও বোধের অনুভূতিশীলতায় তিতাস আঞ্চলিক ভূগোলের সীমাবদ্ধতা থেকে উন্নীত হয়েছে আন্তর্জাতিকতায় – সীমিত চাক্ষুষ সত্য পরিণত হয়েছে 888sport live chatের অসীম মানসসত্যে। রূপের নদী পেয়েছে অরূপের পারাবার, সীমিত সবুজ পেয়েছে অনন্ত প্রাণময়তার সুষমা। একটি অপরিচিত কিংবা অল্পপরিচিত নদী, একটি উপেক্ষিত স্রোতস্বিনী এবং এর তীরবর্তী ততোধিক উপেক্ষিত অন্ত্যজ জনজীবন, এর সৌন্দর্য-সুষমা-সুকুমারিত্ব, ক্লেদ-কুটিলতা-কৌৎসিত্য ধারণ করে অন্তর্ভেদী প্রত্যক্ষতায় উন্মোচন করেছেন। তাতে অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস হয়ে উঠেছে 888sport live chatময় ও সৌন্দর্যমন্ডিত রজতরেখার মতো প্রভাময়। অন্ধকার অলকরাশির মধ্যে সীমন্তিনীর শুভ্ররেখার ঔজ্জ্বল্য যেমন দীপ্তিমান, ঠিক তেমনি অদ্বৈতের অতুল-অনিবার্য শব্দযোগে তিতাস হয়ে উঠেছে স্বর্গনন্দন মন্দাকিনীর মতো।
তিন
পৃথিবীর ভূভাগে আছে অগণন নদ-নদী, অসংখ্য জলধারা – দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ছোট-বড়-মাঝারি। কত নদী কূলবিনাশী, কীর্তিনাশা, সভ্যতা-বিধ্বংসী কত নদী শান্ত-সুশীল। কত নদী প্লাবনে-জলোচ্ছ্বাসে খ্যাপা দুর্বাসা, আবার কত নদী মানুষের সভ্যতার প্রতি অপত্য স্নেহে সুধাসমৃদ্ধ ও পলিময়। ভূভাগে ভাঙনিকূলের বদনামবাহী নদীও আছে অনেক আবার সুজলা-সুফলাময় শস্যদাত্রী নদীর 888sport free betও কম নয়। রবীন্দ্রনাথের সেই স্বদেশ পর্যায়ের গানের মতোই ‘তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে, তুমি শীতল জলে জুড়াইলে’। নামগোত্রহীন নদী যেমন আছে তেমনি আছে নামজাদা নদীও। আমাদের উপমহাদেশের কথাই যদি মনে করি : সিন্ধু-গঙ্গা-নর্মদা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, গোদাবরি-সরস্বতী-ব্রহ্মপুত্র – আরো কত কি! বহির্বিশ্বে চোখ মেলে তাকালেই মনে পড়বে রাজাধিরাজের মতো কীর্তিমান কত নদীর নাম : চীনের হোয়াংহো, ইয়াংজে, জার্মানির রাইন, ব্রিটেনের টেমস, মধ্যপ্রাচ্যের ফোরাত, প্যারিসের সিন, পূর্ব ইউরোপের দানিয়ুব, মিশরের নীলনদ, রাশিয়ার ভলগা, চীন ও তিববতের বুক চিরে বয়ে যাওয়া মেকং, আমেরিকা-কানাডার বক্ষভেদী নদী মিসিসিপি-মিসৌরি, উত্তর আমেরিকা ও ব্রাজিলের বুকের ধন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বিরাট নদী আমাজন – আরো কত ইতিহাসখ্যাত নদী আছে পৃথিবীতে! কত অখ্যাত ছোট নদনদীও আছে, যেগুলোকে খ্যাতিমান করেছেন বিখ্যাত মনীষী-লেখকরা : কপোতাক্ষকে কীর্তিমান করেছেন মহাকবি মধুসূদন – দামোদরকে দীপ্তিময় করেছেন দিলদরিয়া দানবীর বিদ্যাসাগর। ধানসিড়ি আর জলসিড়ি নদীকে জীবনানন্দ দাশ। নইলে ওই অঞ্চলের মানুষ ছাড়া আর কে চিনত এই প্রবাদপ্রতিম নদীগুলোকে? গঙ্গা-পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, ফোরাত-গাঙুর-সরস্বতীর মতো কত নদী খ্যাতিমান হয়ে আছে পৌরাণিক ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে। এই উপমহাদেশের মানুষ এই নদীগুলোর নাম 888sport apk download apk latest versionর সঙ্গে 888sport app download for android করে। মহাভারতে আছে, পূর্বপুরুষের পাপমুক্তি ও স্বর্গলাভের আশায় স্বর্গীয় নদী গঙ্গাকে কঠোর সাধনার মাধ্যমে পৃথিবীতে আবাহন করে এনেছেন ভগীরথ। গাঙ্গেয় অববাহিকা এবং সিন্ধুনদের তীরবর্তী অঞ্চলে তো গড়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন মানবসভ্যতা। পৌরাণিক রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে যমুনার নাম। তাই বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পাই : ‘কে না বাঁশি বায়ে বড়াই কালিননৈ কূলে’ – শ্রীরাধার এরকম প্রেমাকাঙ্ক্ষার পঙ্ক্তি। ফোরাতের সঙ্গে মিশে আছে ইসলামি কাহিনিতে বর্ণিত কারবালাযুদ্ধের শোকাবহ ঘটনা। ইমাম হোসেইনের (আ.) ট্র্যাজিক ইতিহাস। পদ্মাপুরাণে বর্ণিত লখিন্দরের কালসাপ-দংশিত লাশ ভেসে গিয়েছিল গাঙুরের জলে। এই পুরাণখ্যাত নদীগুলো আবহমান কাল ধরে মানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী। ছোট হোক, অখ্যাত হোক, না-ই বা থাকুক গর্ব করার মতো ইতিহাস-ঐতিহ্য – তবু কেবল নামের চমৎকারিত্বেই অনেক নদী আকর্ষণ করে মনোযোগ। কীর্তনখোলা, কর্ণফুলী, ফুলজোড়, রজতরেখা, ধানসিড়ি, মধুমতী, ফুলেশ্বরী, ধলেশ্বরী – কী মায়াময় নাম এই নদীমাতৃক দেশে। আমাদের 888sport live footballেও উঠে এসেছে কত নদনদী – রচিত হয়েছে নদীনির্ভর 888sport alternative link। বেশি কিছু না-ভেবেই 888sport app download for androidে আসে : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি, সমরেশ বসুর গঙ্গা, তারাশঙ্করের হাসুলিবাঁকের উপকথা, বিভূতিভূষণের ইছামতি, আবু জাফর শামসুদ্দীনের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, হুমায়ুন কবিরের নদী ও 888sport promo code, রাহুল সংকৃত্যায়নের ভোলগা থেকে গঙ্গা, যাযাবরের ঝিলমনদীর তীরে, দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত ইত্যাদি নাম। বিশ্ব888sport live footballেও আছে অসংখ্য নদীভিত্তিক বিখ্যাত 888sport alternative link : সলোকভের কোয়াইট ফোডস্ দি ডন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিগ টু হার্টেড রিভার, টনি মরিসনের বিলাভড্ সোলা, নাগিব মাহফুজের এডরিস্ট অন দি নিল – আরো কত নাম। এসব নদীনির্ভর 888sport live footballে কখনো লেখক খ্যাতিমান হয়েছেন, আবার কখনো অনাসি নদীই আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়েছে লেখকের রচনার গুণে।
চার
ইতিহাসের আলোকে হোক কিংবা ভূগোলের বিচারে – তিতাসের তেমন কোনো খ্যাতি নেই 888sport appsে। তিতাস টাইগ্রিসের মতো নদী নয়, নয় তিস্তার মতোও। আঞ্চলিক ইতিহাস-ভূগোলের আলোকে সে কেবলই মেঘনার দুহিতা। দৈর্ঘ্যে সে হ্রস্ব, আকৃতিতে বক্র, স্রোতধারায় ক্ষীণতোয়া। কিন্তু এই নামগোত্রহীন নদীটিই সুনামের শিখর স্পর্শ করেছে, পেয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং তা পেয়েছে অদ্বৈতের বোধি-ঋদ্ধ অননুকরণীয় রচনার গুণে। বলেছি, তিতাস স্বপ্ন ও 888sport live chatের নদী। এই স্বপ্নময়তার বিস্তার ও 888sport live chatের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করার মাধ্যমেই অদ্বৈতের তিতাস অর্জন করেছে বৈশ্বিক পরিচিতি।
আক্ষরিক অর্থেই অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-৫১) তিতাসের সন্তান। তিতাসের কোলে তাঁর জন্ম, তিতাসের তীরে তাঁর বেড়ে ওঠা, তিতাসের উপকূলে তাঁর বিচরণ। তাঁর শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য কেটেছে তিতাসের সঙ্গে মিতালি করে। পুরুষানুক্রমে তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠী, আত্মীয়বান্ধব-সহচর – সকলেরই বসবাস ও বিচরণ তিতাসের তীরে। তাই তাঁর শোণিতে তিতাসের প্রবাহ, নাড়িতে তিতাসের ঢেউয়ের স্পন্দন আর চিত্তে তিতাসের জীবনপ্রবাহ। অন্তরে-বাইরে এই তিতাস-ঘনিষ্ঠতার জন্যেই তিতাস একটি নদীর নাম হয়েছে জীবনবোধে দাঢ্য ও 888sport live chatবোধে দীপ্র। তাই অদ্বৈত মল্লবর্মণ একাধারে তিতাসের সন্তান ও তিতাসের জনক। আর জন্মের দক্ষিণা তিনি দিয়েছেন তিতাস একটি নদীর নামের মাধ্যমে। কেবল এ-888sport alternative linkের কথাইবা বলি কেন, তাঁর 888sport live footballজীবনের সূচনায় তিতাস, সমাপ্তিতেও তিতাস। তাঁর জীবনই তিতাসময়। জানা যায়, নিতান্ত কৈশোরে বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে হাতে-লেখা দেয়ালিকা সবুজে তিনি ‘তিতাস’ নামে একটি 888sport app download apk লিখেছিলেন। এ-প্রসঙ্গে অদ্বৈত-গবেষক শান্তনু কায়সারের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন : ‘এটাই ছিল তাঁর বিখ্যাত 888sport alternative link তিতাস একটি নদীর নামের বীজ888sport app download apk।’ (‘জীবনপঞ্জি’, তিতাস একটি নদীর নাম, বুকক্লাব, ২০১৩)।
এ-কথা সত্য যে, তরুণকালেই অদ্বৈত তিতাসের তীর ত্যাগ করেছিলেন। যখন তাঁর বয়স উনিশ (১৯৩৩) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছেন, তখনই তিনি ত্যাগ করেছেন তিতাসের কোল। দৈহিকভাবে ফিরে আসেননি আর গোকর্ণঘাটের মালোপাড়ায়, জন্মভিটায় এবং তিতাসের স্বচ্ছতোয়া, স্ফটিকশুভ্র জলধারায়। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। আর সেখান থেকে শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই অভিবাসী হয়েছেন কলকাতায়। এই যে জল-জাল-জলা ছেড়ে, সবুজ দূর্বাঘাসঘেরা গ্রামীণ মায়াময় মেঠোপথ ছেড়ে কালো পিচঢালা কলকাতার প্রশস্ত পথে পা বাড়ালেন তিনি – ফেরেননি আর সশরীরে। কিন্তু অদ্বৈতের এই জন্মআবাস-বিচ্ছিন্নতা এবং তিতাসতীর-ত্যাগ কোনোভাবেই আত্মিক বিচ্যুতি নয়। আশানুরূপ না-হলেও কলকাতার কানাগলি তাঁকে ঠাঁই দিয়েছে, ব্যবস্থা করেছে কর্মসংস্থানের, ভরণ-পোষণের এবং ক্ষুণ্ণিবৃত্তির। তা সত্ত্বেও তাঁর 888sport sign up bonusতে-সত্তায়, করোটিতে-কলমে প্রবহমান ছিল পুণ্যবান তিতাসের ফল্গুধারা। তিতাসের তীর থেকে দৈহিক বিচ্যুতি অদ্বৈতের মানসবিচ্ছিন্নতা ঘটায়নি বরং তাতে তিনি তিতাসের সঙ্গে আরো বেশি মনস্তাত্ত্বিকভাবে সংলগ্ন হয়েছেন। তিতাসের সঙ্গে অদ্বৈতের যে জন্মঋণ ও নাড়ির টান, তা তিনি অবিরাম অনুভব করেছেন মনে-প্রাণে, অন্তরে-আত্মায় এবং 888sport sign up bonusসত্তায়। সংগত কারণেই শান্তনু কায়সার লিখেছেন :
অদ্বৈত যদিও কলকাতা ত্যাগ করে তিতাসের পারে আর কখনো ফিরে আসেননি, তবু অনন্তের মধ্য দিয়ে 888sport alternative linkে তাঁর ঐ মনো888sport slot game ঘটেছে। তাছাড়া নিজের সমগ্র জীবন ও সত্তাজুড়ে তিনি ছিলেন তিতাসের কবি ও কথাকার।
(ঐ, পৃ ৩১)।
প্রবাস-জীবনে অঙ্গে না-হলেও অন্তরে আত্মায় অদ্বৈতের এই তিতাস-সম্পৃক্ততা দেহের অতলে রক্তধারার মতো সত্য। এই সত্য রবীন্দ্রনাথের কাব্যবাণীর মতো : ‘কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান/ অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ তাই তিতাসের সন্তান হয়েও তিতাসের জনক তিনি। প্রকৃতির তিতাস এবং অদ্বৈতের সৃজন-বেদনের তিতাস – এ-দুয়ের মধ্যে সাযুজ্য-সদৃশ কত গভীর, কত বিস্তৃত ও কত বহুমাত্রিক – তা লক্ষ করা যায় তাঁর তিতাস একটি নদীর নামে। ভালোবাসা ও প্রেমময়তার নদী হিসেবে তিতাসকে তিনি কীভাবে অবলোকন করেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল মনশ্চক্ষে তা-ই আমরা তুলে ধরতে চাই এ-রচনায়।
পাঁচ
তিতাসের বর্ণনা দিয়েই অদ্বৈত মল্লবর্মণ এভাবে আরম্ভ করেছেন তাঁর 888sport alternative link :
তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণ ভরা উচ্ছ্বাস।
স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।
ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায় : রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে দিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। (পৃ ৩১)
তারপর তিনি এ-অঞ্চলের বড় নদীগুলোর সঙ্গে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। মেজাজ-মর্জিতে তিতাস সম্পূর্ণ আলাদা। পদ্মার মতো কীর্তিনাশা নদী সে নয়, মেঘনার মতো কূল-ভাঙনি স্রোত তার নেই। দামোদরের মতো উগ্রতা-ক্ষিপ্রতাও তিতাসের নেই, যা দুর্বাসা ঋষির চরিত্রের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। আবার ঠিক শান্ত-সুশীল-সুবোধ নদীও সে নয়। গ্রামবাংলার নিরিবিলি ছোট্ট একটি নদীর যে-বিবরণ আমরা পেয়েছিলাম শৈশবে, শিশুপাঠ্য বইয়ে : ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে-বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে,/ … সকালে-বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে/ অাঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোট মাছ ধরে।’ এরকম নিরীহ নদীও নয় তিতাস। সাত চড়ে রা’ নেই বলতে যে গোবেচারাকে আমরা বুঝি – এরকম নির্বিরোধ চরিত্রের নদীও নয় তিতাস। এ-বিষয়টি বোঝাতে অদ্বৈত লিখেছেন :
মেঘনা পদ্মা বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পন্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণ পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হইতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বউ নিয়া মাঝি কোনদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না। (পৃ ৩৯)
অদ্বৈতর তিতাস উগ্র ও শান্ত – এ-দুয়ের মাঝামাঝি চরিত্রের নদী। তিতাসে স্রোত আছে কিন্তু কূলভাঙা দাপাদাপি নেই, ঢেউ আছে কিন্তু ঢেউয়ের ধমকানি নেই। অদ্বৈতের বর্ণনা এরকম :
তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মত বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।
(পৃ ৩৯)
তিনি আরো লিখেছেন :
ঝরণা থেকে জল টানিয়া পাহাড়ি ফুলেদের ছুঁইয়া ছুঁইয়া উপল ভাঙিয়া নামিয়া আসার আনন্দ কোনকালে সে পায় নাই। অসীম সাগরের বিরাট চুম্বনে আত্মবিলয়ের আনন্দও কোনকালে তার ঘটিবে না। দুরন্ত মেঘনা নাচিতে নাচিতে কোনকালে কোন অসতর্ক মুহূর্তে পা ফসকাইয়াছিল : বা তীরটা একটু মচকাইয়া গিয়া ভাঙিয়া যায়। স্রোত আর ঢেউ সেখানে প্রবাহের সৃষ্টি করে। ধারা সেখানে নরম মাটি খুঁজিয়া, কাটিয়া, ভাঙিয়া, দুমড়াইয়া পথ সৃষ্টি করিতে থাকে। এক পাকে শত শত পল্লী দুই পাশে রাখিয়া অনেক জঙ্গল অনেক মাঠ-ময়দানের ছোঁয়া লইয়া ঘুরিয়া আসে – মেঘনার গৌরব আবার মেঘনার কোলেই বিলীন হইয়া যায়। এই তার ইতিহাস। কিন্তু সে কি আজকের কথা? কেউ মনেও করে না কিসে তার উৎপত্তি হইল। শুধু জানে সে একটি নদী। অনেক দূরপাল্লার পথ বাহিয়া ইহার দুই মুখ মেঘনায় মিশিয়াছে। পল্লীরমণীর কাঁকনের দুই মুখের মধ্যে যেমন একটু ফাঁক থাকে, তিতাসের দুই মুখের মধ্যে রহিয়াছে তেমনি একটুখানি ফাঁক – কিন্তু কাঁকনের মতই তার বলয়াকৃতি। (পৃ ৩৯-৪০)
কীর্তিমান-কীর্তিময়ী নদী তো 888sport free betতীত। কোনোটি পুরাণে খ্যাত, কোনোটি ইতিহাসে, কোনোটি সভ্যতা-বিকাশে খ্যাত, কোনোটি যুদ্ধবিগ্রহে। আবার কোনোটি 888sport live footballে খ্যাত, কোনোটি মৎস্যসম্পদে। তিতাসের তেমন কোনো সুনাম নেই। তাই অদ্বৈত লিখেছেন :
কত নদীর তীরে একদা নীল-ব্যাপারীদের কুঠি-কেল্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কত নদীর তীরে মোগল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়া আছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে – উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের রক্তে হাতিঘোড়ার রক্তে সেসব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়ত তারা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ্ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী।
তার তীরে বড় বড় নগরী বসানো নাই। সওদাগরের নৌকারা পাল তুলিয়া তার বুকে বিচরণ করিতে আসে না। ভূগোলের পাতায় তার নাম নাই।
অতি-সাধারণ নদী তিতাস। পৃথিবীর ইতিহাসে তিতাস নেই, ভূগোলে তিতাস নেই। প্রকৃতির তিতাসকে বিস্তৃত পরিসরে কোথাও তেমন খুঁজে পাওয়া যাবে না। আঞ্চলিক ইতিহাস-ভূগোলের তথ্যে তিতাসের জীবনবৃত্তান্ত যতটুকু পাওয়া যায় তা এরকম :
বর্তমান তিতাস নদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার (বর্তমানে জেলা) নাসিরনগর থানার অধীনে অবস্থিত চাতলপাড় নামক স্থানের নিকট মেঘনা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্বমুখে প্রবাহিত হয়ে চান্দোরা গ্রামের উত্তরে পশ্চিম-দক্ষিণমুখে অগ্রসর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নিকট পূর্ব-দক্ষিণ মুখে প্রবাহিত হয়ে আখাউড়া রেল জংশনের দক্ষিণে পশ্চিম-উত্তর মুখে গিয়ে নবীনগরের পশ্চিমে লালপুরের নিকট মেঘনা নদীতে পতিত হয়। নদীটি একটি ইংরেজী ‘এম’ আকারে বর্তমানে প্রবাহিত হচ্ছে এবং চাতলপাড় থেকে লালপুরের দূরত্ব মাত্র ১৬ মাইল হলেও সমগ্র নদীটি বর্তমানে প্রায় ১২৫ মাইল দীর্ঘ। এটিই বর্তমানে সরকারীভাবে তিতাস নদী নামে পরিচিত।
(কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, জেলা পরিষদ, কুমিল্লা, পৃ ৯)
কেবল আকারে-প্রকারে নয়, যে-নদীর সৃষ্টি-স্থিতি-বিসর্জনের ইতিহাস এত সংক্ষিপ্ত ও সাদামাটা তার আবার গৌরব কোথায়? এই আপাত-সত্য স্বীকার করেও এক কথায় বলা যায় : এর আছে নদীতীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী অন্ত্যজজনের ইতিহাস। আমরা জানি, প্রাচীনকালে মানবসভ্যতা বিকাশের ইতিহাস মূলত নদীকেন্দ্রিক। মানুষের বেঁচে থাকা ও বিকাশে নদীর বহুমুখী অপরিমেয় অবদান সভ্যতার নিয়ামক। তাই পৃথিবীর দেশে-দেশে সভ্যতা-বিকাশে সব নদীই জননীস্বরূপা – বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে এই সত্য আরো প্রকট ও জীবন্ত। অদ্বৈত মল্লবর্মণ মানবসভ্যতা বিকাশের এই সত্যটিকেই তাঁর 888sport alternative linkের চাবি হিসেবে গণ্য করেছেন। তাই ইতিহাসহীন তিতাসের অন্তঃপ্রবাহেও আছে পরম ইতিহাস। এই উপলব্ধি অদ্বৈত প্রকাশ করেছেন এভাবে :
তিতাস সাধারণত একটি নদী মাত্র। কোনো ইতিহাসের কেতাবে, কোনো রাষ্ট্রবিপ্লবের ধারাবাহিক বিবরণীতে এ নদীর নাম কেউ খুঁজিয়া পাইবে না। কেননা, তার বুকে যুযুধান দুই দলের বুকের শোণিত মিশিয়া ইহাকে কলঙ্কিত করে নাই। কিন্তু তাই বলিয়া তার কি সত্যি কোনো ইতিহাস নাই?
পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বৌ-ঝিয়ের দরদের অনেক ইতিহাস এর তীরে তীরে অাঁকা রহিয়াছে। সেই ইতিহাস হয়ত কেউ জানে, হয়ত কেউ জানে না। তবু সে ইতিহাস সত্য। এর পারে পারে খাঁটি রক্তমাংসের মানুষের মানবিকতা আর অমানুষিকতার অনেক চিত্র অাঁকা হইয়াছে। হয়ত সেগুলি মুছিয়া গিয়াছে। হয়ত তিতাসই সেগুলি মুছিয়া নিয়াছে। কিন্তু মুছিয়া নিয়া সবই নিজের বুকের ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছে। হয়ত কোনোদিন কাহাকেও সেগুলি দেখাইবে না, জানাইবে না। কারো সেগুলি জানিবার প্রয়োজনও হইবে না। তবু সেগুলি আছে। যে-আখর কলার পাতায় বা কাগজের পিঠে লিখিয়া অভ্যাস করা যায় না, সে-আখরে সে সব কথা লেখা হইয়া আছে। সেগুলি অঙ্গদের মত অমর। কিন্তু সত্যের মত গোপন হইয়াও বাতাসের মতো স্পর্শপ্রবণ। কে বলে তিতাসের তীরে ইতিহাস নাই। (পৃ ৪৭)
তিতাসের তীরে রাজা-বাদশার ইতিহাস নেই, সম্রাট-সামন্ত-প্রভুর ইতিবৃত্ত নেই, বাবু-বণিকের ইতিকথা নেই – যা আছে তা মানুষের ইতিহাস, জল-জাল-জলা-সংলগ্ন শ্রমজীবী মানুষের ইতিহাস। আমাদের প্রচলিত ইতিহাসে রাজ-রাজড়াদের বিলাসী জীবন ও নৃশংসতার যে-কাহিনি বর্ণিত তা মূলত ইতিহাস নয়। প্রকৃত ইতিহাস হলো মানুষের জীবনসংগ্রাম ও তার বিবরণ। মহামতি কার্ল মার্কস যে বলেছেন, মানুষের ইতিহাস মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস, এই সত্যেরই 888sport live chatিত প্রয়াস অদ্বৈতের তিতাস একটি নদীর নাম।
ছয়
অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস-ভাবনা বহুমুখী, সুবিস্তৃত ও সুগভীর। তাঁর তিতাস-সন্দর্শনের অতলান্তিকতা এমনই অন্তস্পর্শী যে, এর নাম নিয়েও তিনি ভেবেছেন। বাংলার 888sport app নদীর নামের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় তিতাস নামের সাধারণত্বের ভেতর থেকে এর অসাধারণ মহিমা উদ্ধার করেছেন। অদ্বৈতের অননুকরণীয় বাক্যবন্ধেই পড়ে নিই তিতাসের এই নাম-মাহাত্ম্য :
তিতাস একটি নদীর নাম। এ নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ তার তীরের লোকেরা জানে না। জানিবার চেষ্টা কোনদিন করে নাই, প্রয়োজন বোধও করে নাই। নদীর কত ভাল নাম থাকে – মধুমতী, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, সরস্বতী, যমুনা। আর এর নাম তিতাস। সে কথার মানে কোনোদিন অভিধানে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। কিন্তু নদী এ নামে যত প্রিয়, ভালো একটা নাম থাকিলে তত প্রিয় হইতই যে, তার প্রমাণ কোথায়।
ভাল নাম আসলে কি? কয়েকটা অক্ষরের সমষ্টি বৈ ত নয়। কাজললতা মেয়েটিকে বৈদুর্যমালিনী নাম দিলে, আর যাই হোক, এর খেলার সাথীরা খুশি হইবে না। তিতাসের সঙ্গে নিত্য যাদের দেখাশোনা, কোনো রাজার বিধান যদি এর নাম চম্পকবতী কি অলকানন্দা রাখিয়া দিয়া যায়, তারা ঘরোয়া আলাপে তাকে সেই নামে ডাকিবে না, ডাকিবে তিতাস নামে।
নামটি তাদের কাছে বড় মিঠা। তাকে তারা প্রাণ দিয়া ভালবাসে, তাই এই নামের মালা তাদের গলায় ঝুলানো।
শুরুতে কে এই নাম রাখিয়াছিল, তারা তা জানে না। তার নাম কেউ কোনদিন রাখিয়াছে, এও তারা ভাবে না। ভাবিতে বা জানিতেও চায় না। এ কোনদিন ছিল না, এও তারা কল্পনা করিতে পারে না। (পৃ ৪৬)
যে-নদীর প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক উপযোগিতার চেয়ে সাংস্কৃতিক খ্যাতি-পরিচিতি বেশি – সেই 888sport live chatপ্রেরণাদাত্রী নদীটির নামের অর্থ কার-না জানতে ইচ্ছে করে? যদিও অদ্বৈত লিখেছেন : ‘সে কথার মানে কোনোদিন অভিধানে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’ – তবু অবিশ্বাসীর মতো হাতের-কাছে-থাকা অভিধানগুলো হাতড়াই। সত্যি পাওয়া গেল না কোথাও – না-জ্ঞানেন্দ্রমোহনে, না-সংসদে, না-প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা অভিধানে, না-আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে।
তবে আমার উৎসাহের পালে লাগা হাওয়া কমে গেলেও অনুমান করি : তৎসম ‘তৃষ্ণা’ শব্দ থেকে তদ্ভব হয়েছে ‘তৃষা’ এবং তা থেকে আঞ্চলিক রূপ ‘তিয়াস’। আঞ্চলিক অভিধানে ‘তিয়াস’ শব্দটির অর্থ ‘শ্বাস’ কিংবা ‘তেষ্টা নিবারণের ইচ্ছা’ – যা কুমিল্লা অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। তাই মনে হয়, ওই শব্দটি থেকেই কালক্রমে ‘তিতাস’ শব্দটির উৎপত্তি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের প্রাচীন পুঁথিতে তিতাস সম্পর্কে লোকগাথা এবং কিংবদন্তিও কম নেই। তিতাসতীরের কৃতী কবি আল মাহমুদ এরকম একটি লোককথার উল্লেখ করেছেন :
মেঘনার কন্যা তৈতাস। তার প্রেমিক ঘুঘু পাখি। ঘুঘুর মনে সাধ জাগলে, প্রেমিকাকে নিয়ে দু-চোখ যেদিকে যায় চলে যেতে। মনের গোপন বাসনাটা একদিন সুযোগ বুঝে তৈতাসের কাছে ব্যক্ত করতেই সে (তৈতাস) সর্বাগ্রে অনেক দিনের লালিত অভিলাষ সাগর দেখাবার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়ে তবে প্রেমিকের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে তারা চুপিসারে বেরিয়ে পড়ল। বিহঙ্গকুলে জন্মলাভকারী ঘুঘু উড়ে উড়ে চলল আরমেঘনা-দুহিতা জলা তৈতাস চলল মাটির উপর দিয়ে বয়ে বয়ে। কিন্তু প্রেমিক-প্রেমিকার কপাল মন্দ। অনেক লোকালয়-অরণ্য-প্রান্তর অতিক্রম করে গিয়ে হঠাৎ সাগরের পথ ভুলে ক্লান্ত-শ্রান্ত-হতাশ ঘুঘু আবার সেই মেঘনার পাড়ে গিয়েই থমকে দাঁড়াল। আর বুকভাঙা প্রেমিকা তৈতাস? সে ভীতা-চকিতা অবস্থায় নাকের জলে চোখের জলে একসোর হতে হতে যে মাতৃক্রোড় ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল আবার সেই চিরশান্তিদায়িনী মাতৃবক্ষে গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার চলার পথ নদী হয়ে ‘তিতাস’ নাম ধারণ করল। (ব্রাহ্মণবাড়িয়া : সেকাল ও একাল, লুৎফর রহমান, পৃ ৪১, ১৯৯৮)
প্রাচীনকাল থেকেই তিতাস এমন গল্পগাথার নদী – একালেও তিতাসকেন্দ্রিক 888sport live chat-888sport live footballের চর্চা অবিরাম প্রবহমান। কিন্তু অদ্বৈতের তিতাস অনন্য – তিতাসের কত জল! কত স্রোত! কত নৌকা! সবদিক দিয়েই সে অকৃপণ।
888sport appsের বুকে জটাজালের মতো অসংখ্য নদী। শুভ্র জলের নদী, ঘোলাটে জলের নদী। কাকচক্ষু জলের নদী, তামাটে জলের নদী। কুলুকুলু ঢেউ-খেলানো নদী, ফুঁসে-ওঠা সাপের ফণার মতো উদ্ধত ঢেউয়ের নদী। কোনো নদী খ্যাপা দুর্বাসার মতো ভয়ংকর অভিশাপপ্রবণ আবার কোনো নদী বাল্মীকির মতো শান্ত ও শুভাশিসদাতা। কোনো নদীরই রূপের মহিমা এক নয়, চরিত্র অভিন্ন নয় – স্বতন্ত্র। কিন্তু তিতাস এই স্বতন্ত্রের মধ্যেও স্বতন্ত্রতম। এর ব্যতিক্রমতা অনন্য। নদীর এ-কূল ভাঙে, ও-কূল গড়ে – এই তো নদীর খেলা – এমন ধ্বংস ও সৃষ্টির আদিম খেলা তিতাসের চরিত্রে নেই। সুশীল তিতাস সমধারায় প্রবহমান নদী। এখানেই তিতাসের অনন্যতা। অদ্বৈতের রচনা থেকে জেনে নিই তিতাসের চরিত্রমাধুর্য :
জেলেদের বৌ-ঝিরা ভাবে অন্যরকম কথা – বড় নদীর কথা যারা শুনিয়াছে। যে-সব নদীর নামে মেঘনা আর পদ্মা। কি ভীষণ! পাড় ভাঙ্গে। নৌকা ডোবায়। কি ঢেউ। কি গহীন জল। চোখে না দেখিয়াই বুক কাঁপে! কত কুমীর আছেসে-সব নদীতে। তাদের পুরুষদের মাছ ধরার জীবন। রাতে-বেরাতে তারা জলের উপরে থাকে। এতবড় নদীতে তারা বাহির হইত কি করিয়া! তাদের নদীতে পাঠাইয়া মেয়েরা ঘরে থাকিতই বা কেমন করিয়া! তিতাস কত শান্ত। তিতাসের বুকে ঝড়-তুফানের রাতেও স্বামী-পুত্রদের পাঠাইয়া ভয় করে না। বউরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে, মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়েরই বুকে মাথা এলাইয়া দিয়া শান্ত মনে মাছ-ভরা জাল গুটাইতেছে।
নদীর রূপ আছে, গতি আছে, ছন্দ আছে। নদীর রূপ কখনো দৃষ্টিগ্রাহ্য, কখনো শ্রুতিগ্রাহ্য আবার কখনো মনোজাগতিক। নদীও জীবন ও সময়ের মতো চলমানতার প্রতীক। রবীন্দ্রকাব্যের গতিতত্ত্ব আছে নদীর প্রবহমানতায়। এই গতিতত্ত্বের দার্শনিক বিষয়টি অদ্বৈত মল্লবর্মণের মনন-ছুট হয়নি। তিতাসের মাধ্যমে তিনি নদীর এই দার্শনিক রূপটি বর্ণনা করেছেন এভাবে :
নদীর একটি দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে, কালও বহিয়া চলে। কালের বহার শেষ নাই। নদীরও বহার শেষ নাই। কতকাল ধরিয়া কাল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বহিয়াছে। তার বুকে কত ঘটনা ঘটিয়াছে। কত মানুষ মরিয়াছে। কত মানুষ বিশ্রীভাবে মরিয়াছে – কত মানুষ না খাইয়া মরিয়াছে – কত মানুষ ইচ্ছা করিয়া মরিয়াছে – আর কত মানুষ মানুষের দুষ্কার্যের দরুন মরিতে বাধ্য হইয়াছে। আবার কত মরণকে উপেক্ষা করিয়া কত মানুষ জন্মিয়াছে। তিতাসও কতকাল ধরিয়া বহিয়া চলিয়াছে। তার চলার মধ্যে তার তীরে তীরে কত মরণের কত কান্নার রোল উঠিয়াছে। কত অশ্রু আসিয়া তার জলের স্রোতে মিশিয়া গিয়াছে। কত বুকের কত আগুন, কত চাপা বাতাস তার জলে মিশিয়াছে। কতকাল ধরিয়া এ সব সে নীরবে দেখিয়াছে, দেখিয়াছে আর বহিয়াছে। আবার সে দেখিয়াছে কত শিশুর জন্ম, দেখিয়াছে আর ভাবিয়াছে। ভাবী নিগ্রহের নিগড়ে আবদ্ধ এই অজ্ঞ শিশুগুলি জানে না, হাসির নামে কত বিষাদ, সুখের নামে কত ব্যথা, মধুর নামে কত বিষ তাদের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে।
নদীর দার্শনিকতার কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অদ্বৈত এভাবে চলে এসেছেন তিতাসতত্ত্বে – যে-তত্ত্বে আছে তিতাস-তীরবর্তী দারিদ্র্যদগ্ধ মানুষের বঞ্চনার হাহাকার ও জীবনযন্ত্রণার জহর। অদ্বৈতের এই তিতাসতত্ত্বে আছে যে দার্শনিকতা তাতে রূঢ়তা আছে, ক্রূঢ়তা আছে, নির্মম বাস্তবতার উলঙ্গ প্রকাশ আছে; কিন্তু জীবনসত্যের বিচ্যুতি নেই।
সাত
কে না জানে এদেশের ষড়ঋতুর কথা – ঋতুবৈচিত্র্যের বার্তা? ভূগোলের বার্ষিক গতির ফলে ঋতুচক্রের বিবর্তন ঘটে প্রতি দুমাস অন্তর-অন্তর, তা নাতিশীতোষমন্ডলীয় আমাদের দেশে যেভাবে ও যতখানি প্রতিভাত হয় তা অন্য কোথাও নেই। সত্যি ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…’। এই ঋতুচক্রের আভাস কেবল বন-বনানীতে নয়, ফুলে-ফলে-ফসলে নয়, পরিবেশ-প্রতিবেশে নয়, আকাশে-আবহাওয়ায় নয়; মানবমনেও নিরন্তর প্রতিভাত হয়। বাংলার ঋতুচক্র প্রকৃতির পাশাপাশি সজীবপ্রাণেও দোলা দিয়ে যায়। ঋতুচক্র বাংলার নদীর জীবনেও ঘটায় পরিবর্তন। এই ঋতুচক্রের প্রভাবে কখনো মরা গাঙে বান আসে, আবার কখনো স্বাস্থ্যশীলা যৌবনবতী নদীতে নামে বার্ধক্যের নিষ্করুণ মুমূর্ষুতা। বিলোল-চঞ্চল নদী ঋতুর প্রভাবেই হয়ে যায় গতিহারা, ক্ষীণতনু, শীর্ণকায়া, আবার কখনো যৌবন-জোয়ারে দুকূলপ্লাবী। নদীর এই সাংবাৎসরিকরূপ-রূপান্তর সকলেরই দৃষ্টিগ্রাহ্য – যৌবন আসে বার্ধক্য যায়, বার্ধক্য আসে যৌবন যায়। এর মাঝেও আছে নানা রূপ, নানা বৈচিত্র্য – ঋতুভেদে বহুমাত্রিকতায় ভরা একটি প্রবহমান নদীর জীবন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস দেখেছেন, কেবল চর্মচক্ষে নয়, তৃতীয় নয়নে। মনশ্চক্ষেতাঁর তিতাস-দর্শন তাই হয়ে উঠেছে অপরূপ। নদীর দার্শনিকতা উন্মোচনের পাশাপাশি তিনি তিতাসের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন ঋতুচক্রে নদীর রূপ-রূপান্তরের চিত্রময়তা। চিত্ররূপময় বলে জীবনানন্দের 888sport app download apk-সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে-মন্তব্য করেছিলেন তা-ই যেন উঠে এসেছে অদ্বৈতের তিতাসের ঋতুভিত্তিক রূপবর্ণনায়। প্রকৃতি এখানে সজীব, প্রতিবেশ এখানে জীবন্ত, জীবন এখানে সুখ-দুঃখ-মিলন-বিরহে অম্লমধুর – বিষামৃতে ঐহিক। অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নামে নদীজীবন ও প্রকৃতিতে ঋতুচক্রের প্রভাব কীভাবে বর্ণিত-ব্যাখ্যাত হয়েছে তা অবশ্যই পরিলক্ষণীয় বিষয়। এ-অধ্যায়ে ধারাবাহিকভাবে আমরা তা প্রকাশ করব।
গ্রীষ্ম
ষড়ঋতুর আবর্তে 888sport appsে যে-ঋতুটি বঙ্গাব্দের প্রথমে আসে, সেটি গ্রীষ্ম। জলকণাহীন শুকনো তাপিত বাতাস, অগ্নিগিরির উত্তাপ-ঢালা রোদ, খরা-দাহ, অগ্নিবর্ষণ, প্রিয় ফসলি জমি ফেটে চৌচির। চাতক পাখির মতো হাঁ-করে থাকা উন্মুখ তৃষ্ণার্ত ধানক্ষেত। বজ্র-বিদ্যুৎ-ঝড়, টাইফুন-টর্নেডো-কালবৈশাখী – এসব গ্রীষ্মের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। রৌদ্রদগ্ধ লু-হাওয়া, দাবদাহে বুকফাটা তৃষ্ণা-পিপাসার্ত পথিক, ঈষাণকোণের ঘনকালো মেঘ, আচমকা ধূলিঝড়, ঘূর্ণাবর্ত – এসবও গ্রীষ্মের অনুষঙ্গ। বঙ্গাব্দের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসজুড়ে গ্রীষ্ম ঋতুর স্থিতিকাল। তবে বসন্তের শেষ মাস চৈত্র থেকেই এর আনাগোনা। অস্বস্তিকর গ্রীষ্ম আর তার অনুষঙ্গগুলো যেন প্রকৃতির অভিশাপ।তবে সমাজে-জীবনে-প্রকৃতিতে গ্রীষ্মেররূপ-রস-সুখ-সৌন্দর্যের আবহও কম নয়। কালিদাসে, রবীন্দ্র-নজরুলের 888sport app download apkয়-গানে এর মনোসমীক্ষণের ভাবমাধুরী বর্ণিত হয়েছে। সেসব প্রসঙ্গ উপেক্ষা করে আমরা অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাসে চোখ ফেরাই। তিনি গ্রীষ্মকে কীভাবে দেখেছেন তা সরাসরি জেনে নিই :
ধরিত্রীর সারাটি গা ভীষণ গরম। একমাত্র ঠান্ডা এই তিতাসের তলা। জল তার বহিরাবয়বে ধরিত্রীর উত্তেজনা ঠেলিয়া নিজের বুকের ভিতরটা সুশীতল রাখিয়াছে…। অনেকক্ষণ ঝাঁপিয়া ঝুপাইয়াও তৃপ্তি হয় না, জল হইতে ডাঙ্গায় উঠিলেই আবার সেই গরম। (পৃ ১৯৫)
গ্রীষ্মকালীন তিতাস ও তার তীরবর্তী জনজীবনের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন :
গত বর্ষার আগে চরটা ছিল ও-ই খানে। তারপর এইখানে। এখন যেখানে গা ডুবাইয়া আছি। পরের বছর দেখবি এখানেও চর। গা ডোবে না। এইবার যত পারি ডুবাইয়া নেই, জন্মের মত।
বছর ঘুরিতে মালোরা সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িল। নদীর দুই তীর ঘেঁষিয়া চর পড়িয়াছে। একটিমাত্র জলের রেখা অবশিষ্ট আছে তাতে নৌকা চলে না। মেয়েরা সণান করিতে যায়, কিন্তু গা ডুবে না। উবু হইয়া মাটি খুঁড়িতে খুঁড়িতে একটি গর্তের মত করিয়াছে। তাতে একবার চিৎ হইয়া একবার উপুড় হইয়া শুইলে তবে শরীর ডোবে। তাতেই কোন রকমে এপাশ ওপাশ ভিজাইয়া তারা কলসী ভরিয়া বাড়ি ফিরে। জেলেদের নৌকাগুলি শুকনাডাঙ্গায় আটকা পড়িয়া চৌচির হইয়া যাইতেছে। জলের অভাবে সেগুলি আর নদীতে ভাসে না। মালোরা তবু মাছ ধরা ছাড়ে নাই। এক কাঁধে কাঁধ-ডোলা অন্য কাঁধে-ঠেলা-জাল লইয়া তারা দলে দলে হন্যে হইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। কোথায় ডোবা, কোথায় পুষ্করিণী, তারই সন্ধানে। গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরিয়া কোথাও ডোবা দেখিতে পাইলে, শ্যেন দৃষ্টিতে তাকায়। দেহ হাড্ডিসার, চোখ বসিয়া গিয়াছে। সেই গর্তে ডোবা চোখ দুইটি হইতে জিঘাংসার দৃষ্টি ঠিকরাইয়া বাহির হয়। (পৃ ২৪৯)
গ্রীষ্মকালের আরেকটি বর্ণনায় তিনি তিতাসতীরের জেলেজীবনের দুঃখ-দারিদ্রে্যর কথা লিখেছেন এভাবে :
‘চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয়। একদিক দিয়া জল শুখায় আর একদিক দিয়া মাছেরা দমবন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় নাক জাগাইয়া হাঁপায়। মাছেদের মত জেলেদেরও তখন দম বন্ধ হইতে থাকে। সামনে মহাকালের শুষ্ক এক কঙ্কালের ছায়া দেখিয়া তারা এক সময় হতাশ হইয়া পড়ে…
জাল ফেলিবে কোথায়। তিন কোনা ঠেলাজাল কাঁধে ফেলিয়া আর এক কাঁধে গলা-চিপা ডোলা বাঁধিয়া এ-পাড়াসে-পাড়ায় টই-টই করিয়া ঘুরিতে থাকে, কোথায় পানা পুকুর আছে, মালিকহীন ছাড়া বাড়িতে। চার পাড়ে বন বাদাড়ের ঝুপড়ি। তারই ঝরাপাতা পড়িয়া, পচিয়া, ভারি হইয়া তলায় শায়িত আছে। তারই উপর দিয়া ভাসিয়া উঠিয়া ছোট মাছের ফুট দেয়। গলা-জল শুকাইয়া কোমর-জল, কোমল-জল শুকাইয়া হাঁটু-জল হইয়াছে। মাছেদের ভাবনার অন্ত নাই। কিন্তু অধিক ভাবিতে হয় না। গোপাল কাছা দেওয়া দীর্ঘাকার মালো কাঁধের জাল নামাইয়া শ্যেন-দৃষ্টিতে তাকাইতে তাকাইতে এক সময় খেউ দিয়া তুলিয়া ফেলে। মাছেদের ভাবনা এখানেই শেষ হয়, কিন্তু মাছ যারা ধরিল তাদের ভাবনার আর শেষ হয় না। তাদের ভাবনা আরও সুদূরপ্রসারী। সামনে বর্ষাকাল পর্যন্ত।’ (পৃ ৪১)
গ্রীষ্মের অন্যতম অনুষঙ্গ কালবৈশাখী ঝড়। কালবৈশাখী যেন বঙ্গাব্দের এই প্রথম ঋতুটির যমজ ভাই কিংবা মিতা। বাংলার কবিরা যাকে ঋতুরাজ বলেন, সেই বসন্তের সাংবাৎসরিক মৃত্যুহতে-না-হতেই শুরু হয়ে যায় কালবৈশাখীর আস্ফালন। সে ধ্বংস, ভাঙন, ছোবল ও মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে অতর্কিতে ধেয়ে আসে গোকূলে – কংসবাহিনীর মতো, কালাপাহাড়ের মতো, হালাকু খাঁর মতো। চুরমার করে, বিধ্বস্ত করে, লন্ডভন্ড করে শান্ত-সজীগ্রাম-গঞ্জ-লোকালয়। বোশেখির ঝড় যেন একাত্তরের কালরাত্রির মতোই – অতর্কিতে যেভাবে হামলা করেছিল পাক-সন্ত্রাসী সেনাদল এদেশের নিরপরাধ মানুষের ওপর। ধ্বংসলীলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারাই, যারা গরিব অথচ সৎ, দুস্থ অথচ দুর্নীতিহীন, পরিশ্রমী অথচ কপর্দকশূন্য – নুন আনতে পান্তা ফুরনো সাধারণ মানুষ। জল-জাল-জলার ওপর যাদের জীবন নির্ভরশীল, তিতাসপাড়ের নেংটিপরা উদোম-গায়ের মানুষেরা কালবোশেখির মতো প্রাকৃতিক নির্যাতনে কী করে, কেমন করে বাঁচে, তা অদ্বৈতের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই জেলেজীবনে কালবোশেখির বর্ণনায় তিনি লিখেছেন :
মাঝে মাঝে ঝড় হয়। কোনদিন দিনের বেলা, কখনো রাত্রিতে। দিনের ঝড়ে বেশি ভাবনা নাই; রাতের ঝড়ে বেশি ভাবনা। বাঁশের খুঁটির মাথায় দাঁড়ানো ঘরখানি কাঁপিয়া উঠে। মুচড়াইয়া বুঝিবা ফেলিয়া দেয়। কিন্তু তাতেও অত ভয় করে না। কোনো রাত্রে ঝড় আরম্ভ হইলে সহজে কমিতে চায় না। সারারাত্রি চলে তার দাপট। কোনো কোনো সময়ে প্রতি রাতে ঝড় আসে। সারাদিন খায় দায়, সন্ধ্যার দিকে আসন্ন ঝড়ের জন্য প্রস্ত্তত হয়। ঈশান কোণের কালো মেঘ সারা আকাশে ধোঁয়ার মত ছড়াইয়া গিয়া হু হু করিয়া বাতাস আসে। তারপর আসে ঝড়। ভয় হয় ঘরটা বুঝিবা এই রাতেই পড়িয়া যাইবে। পড়ে না কিন্তু আজই ত শেষ নয়। কালকের ঝড়ে যদি পড়িয়া যায়। পরশুর ঝড়ে। (পৃ ১৬১)
একই কালবোশেখির বর্ণনায় তিনি লিখেছেন :
ততক্ষণে ঝড়ের প্রচন্ড মাতামাতি শুরু হইয়া গিয়াছে। ঝড়ের এত বড় আলামত অনন্ত জীবনে কোনদিন দেখে নাই। চারিদিকে ঘরের চালগুলি কাঁপিতেছে, গাছগুলি মুচড়াইয়া এক একবার মাটিতে ঠেকিতেছে আবার উপরে উঠিতেছে, লতাপাতা ছিঁড়িয়া মাটিতে গড়াইতেছে, আবার কোথায় কোন দিকে বাতাস তাহাদিগকে ঝাঁটাইয়া লইয়া যাইতেছে। ঝড় খুব শক্তিশালী সন্দেহ নাই। কিন্তু এ 888sport promo codeও কম শক্তিশালী নহে। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া সমানে সে চেঁচাইয়া চলিয়াছে, ‘দোহাই রামের দোহাই লক্ষ্মণের, দোহাই বাণ রাজার; দোহাই ত্রিশ কোটি দেবতার।’ কিন্তু ঝড় নির্বিকার। দাম্ভিক অঙ্গুলিহেলনে ত্রিশ কোটি দেবতাকে কাত করিয়া বহিয়াই চলিল। এবার তার গলার আওয়াজ কাঁপাইয়া অন্য অস্ত্র বাহির করিয়া দিল, ‘এই ঘরে তোর ভাইগ্না বউ, ছুঁইস না ছুঁইস না – এই ঘরে তোর ভাইগ্না বউ, ছুঁইস না ছুঁইস না। কিন্তু ঝড় এ বাধাও মানিল না। পাশব শক্তিতে বিক্রম দেখাইয়া প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরটা কাঁপাইয়া দিয়া গেল। সে 888sport promo codeও দমিবার নয়। এবার সুর সপ্তমে চড়াইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘যা বেটা যা, পাহাড়ে যা, পর্বতে যা, বড় বড় বিরিক্ষের সনে যুদ্ধ কইরা যা!’ এ-আদেশ অগ্রাহ্য করিতে না পারিয়াই বুঝিবা ঝড়টা একটু মন্দা হইয়া আসিল এবং ঝিমাইয়া ঝিমাইয়া এক সময় তারও দম বন্ধ হইয়া গেল। …ঝড়ে মালোপাড়ার প্রায়ই সাংঘাতিক রকমের ক্ষতি করিয়া থাকে। তাদের অর্ধেক সম্পত্তি থাকে বাড়িতে, আর অর্ধেক থাকে নদীতে। যাদের ঘর বাড়ি ঠিক থাকে, তারা হয়ত তিতাসে গিয়া দেখে নাওখানা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। আর যারা নাওয়ে থাকিয়া সারারাত তুফানের সাথে যুঝিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছে, হয়ত বাড়িতে আসিয়া দেখে ঘর পড়িয়া গিয়াছে। (পৃ ১৬২)
অদ্বৈতের দৃষ্টিগ্রাহ্য ও শ্রুতিগ্রাহ্য কালবোশেখির বর্ণনা এমনই বাস্তবতাঋদ্ধ যে, বাঙালিমাত্রই এমন 888sport sign up bonus ধারণ করে। জীবন-বাস্তবতাকে 888sport live chatিত বর্ণনায় তুলে এনেছেন তিনি – একই সঙ্গে আছে লোকজ বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সংস্কার।
বর্ষা
গ্রীষ্ম ঋতুর গর্ভেই জন্ম হয় বর্ষাকালের। বর্ষা বাংলার দ্বিতীয় ঋতু কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তি বিবেচনায় বর্ষা প্রবলতম ঋতু। বঙ্গাব্দের বিচারে আষাঢ়-শ্রাবণ মাস জুড়ে এর স্থিতিকাল। তবে কালবোশেখি ও জ্যৈষ্ঠের ঝড়ের মাধ্যমে গ্রীষ্মে গর্ভধারণ হয় বর্ষার। গ্রীষ্মে ক্ষণে-ক্ষণে যখন আকাশের রং বদলায়, ছাইরঙা মেঘ রূপান্তরিত হয় ঘনকৃষ্ণ মেঘে তখন বর্ষার আগমনধ্বনি বেজে ওঠে জলধরের গর্জনে আর বজ্রের আলোকচ্ছটায়। তাই গ্রীষ্মের শেষ থেকে শরতের মধ্যপর্ব পর্যন্তই বর্ষার বিস্তার। বলা যায়, বর্ষার জন্ম-মৃত্যুর অবয়ব আমরা লক্ষ করি গ্রীষ্ম ও শরতে। বর্ষাকালের কালো মেঘ প্রায় প্রতিদিনই শক্তিমান সূর্যকে বিদায় জানায়। বর্ষার অসংখ্য প্রহরে সূর্যের মুখ এবং রোদের বিভা প্রায় দেখাই যায় না। সারাদিন টিপটিপ, ঝরঝর, কখনো ঢিমেতালে, কখনো দ্রুতলয়ে, আবার কখনো সঙ্গে থাকে শন্শন্ হাওয়া। অবিরাম এই বৃষ্টিপাতে সিক্ত হয় প্রকৃতি, পূর্ণ হয় মাঠ-ঘাট, স্ফীত হয় খাল-বিল-নদী-নালা। নদনদী ফিরে পায় পূর্ণ যৌবন। বর্ষা প্রকৃতির ক্লেদ-কালিমা ধুয়েমুছে দেয় সত্যি – নিসর্গকে রূপবতীও করে – গাছে নতুন পাতা জন্মায়, ফুল ফোটায়, ফল ধরায়, ফসল ফলায়। কিন্তু সমাজ-সভ্যতাকে ডোবায় এবং ভাসায়ও। সন্দেহ নেই, সভ্যতা-বিকাশে বর্ষা উপযোগী ঋতু – যেমন অন্নসংস্থানে, তেমনি সৌন্দর্য-সৃষ্টিতে। বর্ষার সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক মাছে-ভাতে বেঁচে থাকা বাঙালির। প্রকৃতির অন্য অনেক কিছুর মতো বর্ষা মাছেরও প্রজনন ঋতু। মিঠাপানির যে মাছ গ্রীষ্মে গর্ভবতী হয় তারা টইটম্বুর বর্ষাতে ডিম ছাড়ে – পোনারা বেড়ে ওঠে মহানন্দে। এসব বর্ষার সাধারণ রূপ, মৌলিক চরিত্র। কিন্তু অদ্বৈতের তিতাসে বর্ণিত বর্ষা ভিন্ন মেজাজে ধরা দেয় পাঠকের কাছে। যে-সমাজজীবন তিনি বিধৃত করেছেন তিতাসে তার মূলে আছে জল-জাল-জেলে আর নাও-মাঝি-মাছ। তাই বর্ষার সঙ্গে জেলেজীবনের সম্পর্ক নদীর সঙ্গে আত্মীয়তার চেয়ে কম নয়। এ-কারণে অদ্বৈতের তিতাসে বর্ষার বর্ণনার প্রাচুর্য। তিনি নদীর কাছ থেকে যেমন জীবনের পাঠ নিয়েছেন, তেমনি বর্ষার কাছ থেকেও। তাই তিতাসে বর্ণিত বর্ষাবিষয়ক কয়েকটি অনুচ্ছেদ উপর্যুপরি পাঠ করি :
ক) বর্ষাকাল আগাইয়া চলে।
আকাশ ভাঙ্গিয়া বর্ষণ শুরু হয়। সে বর্ষণ আর থামে না। তিতাসের জল বাড়িতে শুরু করে। নিরবধি কেবল বাড়িয়া চলে।
হু হু করিয়া ঠান্ডা বাতাস। বহে নদীর ঘোলা জলে ঢেউ তোলে। সে ঢেউ জেলেদের নৌকাগুলিকে বড় দোলায়। তার চাইতে বেশি দোলায় আলুর নৌকাগুলিকে। (পৃ ১৪৫)
খ) বর্ষার প্রশস্ত নদীর উপর মেঘভরা আকাশের ছায়া দৈত্যের মত নামিয়া পড়িয়াছে।… পরে এক সময় চারিদিক গাঢ় অাঁধারে ঢাকিয়া গেলে আর আর কিছু দেখা গেল না।
বর্ষাকালের বাড়তি জল কেবল পল্লীকে ছোঁয় নাই, চুপে চুপে ভরাইয়া দিয়াছে। পল্লীর কিনারায় প্রহরীর মত দাঁড়ানো কত বড় বড় গাছের গোড়ায় জল শুধু পৌঁছায় নাই, গাছের কোমর অবধি ডুবাইয়া দিয়াছে। সে গাছে ডালপালারা লতায় পাতায় ভরভরন্ত হইয়া জলের উপর কাত হইয়া মেলিয়া রহিয়াছে। (পৃ ১৭২-৭৩)
গ) রাঙা নাও। বর্ষার জলে চারিদিক একাকার। এদিকে ওদিকে কয়েকটা পল্লী যেন বিলের পানিতে সিনান করিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তিতাসের বুক সাদা, তার পারের সীমার বাইরে সাপলা-সালুকের দেশ, অনেক দূরে ধানতে, পাটতে, তাহাও জলে ভাসিতেছে।
ঘ) চৈত্রের খরার বুকে বৈশাখের বাউল বাতাস বহে। সেই বাতাস বৃষ্টি ডাকিয়া আনে। আকাশে কালো মেঘ গর্জায়। লাঙ্গল-চষা মাঠ-ময়দানে যে ঢল হয়, তে উপচাইয়া তার জল ধারাস্রোতে বহিয়া তিতাসের উপর আসিয়া পড়ে। মাঠের মাটি মিশিয়া সে-জলের রঙ হয় গেরুয়া। সেই জল তিতাসের জলকে দুই এক দিনের মধ্যেই গৈরিক করিয়া দেয়। সেই কাদামাখা ঠান্ডা জল দেখিয়া মালোদের কত আনন্দ। মালোদের ছোট ছোট ছেলেদেরও কত আনন্দ। মাছগুলি অন্ধ হইয়া জালে আসিয়া ধরা দেয়। ছেলেরা মায়ের শাসন না মানিয়া কাদাজলে দাপাদাপি করে। এই শাসন না মানা দাপাদাপিতে কত সুখ! খরার পর শীতলের মাঝে গা ডুবাইতে কত আরাম। (পৃ ৫১)
অদ্বৈতের তিতাস-দর্শন, নদীদর্শন কেবল চর্মচক্ষের অবলোকন নয়; তাঁর প্রত্যক্ষতার মধ্যে আছে মনোসমীক্ষণ, সমাজবীক্ষণ ও দার্শনিক বোধের আভা – এ-সত্য আমরা আগেই অনুধাবন করেছি। কিন্তু ওখানেই তাঁর দার্শনিকতার শেষ নয়। তাঁর নদী-পর্যবেক্ষণ ও বর্ষানুভূতির মধ্যেও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। বর্ষার জন্ম-মৃত্যু, অফুরন্ত জলের আগমন-নির্গমন, জোয়ার-ভাটা – তিতাসের এসব রূপ-রূপান্তর তিনি দেখেছেন জীবনের অনুষঙ্গে, দার্শনিকের দৃষ্টিতে। প্রাসঙ্গিক দুটি উদ্ধৃতি :
ক) এখনো জোয়ার আসে। চরটা তখন ডুবিয়া যায়। সারা তিতাস তখন জলে জলময়। নদীর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া মালোরা ভাবিতে চেষ্টা করে : এই তো জলে-ভরা নদী। ইহাই সত্য। একটু আগে যাহা দেখা গিয়াছিল ওটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু ভাঁটা আসিলেই সত্যটা নগ্ন হইয়া উঠে। মালোদের এক একটা বুকজোড়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস বাহির হয়। তিতাস যেন একটা শত্রু। নির্মম নিষ্ঠুর হইয়া উঠিয়াছে সেই শত্রু। আজ সম্পূর্ণ অনাত্মীয় হইয়া গিয়াছে। এতদিন সোহাগে আহাদে বুকে করিয়া রাখিয়াছে। আজ যেন ঠেলিয়া কোন গহীন জলে ফেলিয়া দিতেছে। যেন মালোদের সঙ্গে তার সম্পর্ক চুকাইয়া নিষ্করুণ কণ্ঠে বলিয়া দিতেছে, আমার কাছে আর আসিও না। আমি আর তোমাদের কেউ না। বর্ষাকালে আবার সে কানায় কানায় পূর্ণ হইয়া উঠে। সুদূরবর্তী স্থান হইতে ভাসিয়া আসে তার ঢেউ। তখন তার স্রোতের ধারা কলকল করিয়া বহিতে থাকে। আবার প্রাণচঞ্চল মাছেরা সেই স্রোতের তরী বাহিয়া পুলকের সঙ্গে উজাইয়া চলে। নতুন জলে মালোরা প্রাণ ভরিয়া ঝাঁপাঝাঁপি করে। গা ডোবায়, গা ভাসায়। নদীর শীতল আলিঙ্গনে আপনাদের ছাড়িয়া দিয়া বলে, তবে যে বড় শুখাইয়া গিয়াছিল। বলিতে বলিতে চোখে জল আসিয়া পড়ে, বড় যে তোমাকে পর পর লাগিত; এখন ত লাগে না। এত দিন স্নেহ, এত যদি মমতা, তবে কেন সেদিন নির্মম হইয়া উঠিয়াছিলে। এ কি তোমার খেলা ! এ খেলা আর যার সঙ্গে খুশি খেলাও, কিন্তু জেলেদের সঙ্গে নয়! তারা বড় অল্পেতে অভিভূত হইয়া পড়ে। তোমার ক্ষণিকের খেয়ালকে সত্য বলিয়া মানিয়া নিয়া তারা নিজেরাই আত্মনির্যাতন ভোগ করে। তারা বড় দীন। দয়াল তুমি, তাদের সঙ্গে ঐ খেলা খেলাইও না। ঐ রূপ দেখাইও না। তারা তোমার প্রসন্ন দৃষ্টি দেখিয়াই অভ্যস্ত। (পৃ ২৪২)
খ) নতুন বর্ষায় তিতাসে আবার নতুন জল আসিয়াছে। স্বপ্নের মত অবারিত এই জল। কি স্বচ্ছ। বুকজলে নামিয়া মুখ বাড়াইলে মাটি দেখা যায়। এই মাটিটাই সত্য। এই মাটিই যখন জাগিয়া উঠিত প্রথম প্রথম দুঃস্বপ্ন বলিয়া মনে হইত। এখন ঐ মাটিই স্বাভাবিক। জল যে আসিয়াছে ইহা একটা স্বপ্নমাত্র। মনোহর। কিন্তু যখন চলিয়া যাইবে ঘোরতর মরুভূমি রাখিয়া যাইবে। সে মরুভূমি রেণু রেণু করিয়া খুঁজিলেও তাতে একটি মাছ থাকিবে না। তবু সে জলেই গা ডুবাইয়া উদয়তারার খুশি উপচাইয়া উঠিল। সেই ঘাটে অনন্তবালাও গা মেলিয়া ধরিয়াছে। ছোট ঢেউগুলি তার চুলগুলিকে নাড়াচাড়া করিতেছে দেখিয়া উদয়তারা বলিয়া উঠিল, ‘জিলাপির পেচে-পেচে রসভরা, মন্ডা কি ঠান্ডা লাগে জল ছাড়া। যতই দেখ মেওয়া-মিছরি কিছু এই জলের মত ঠান্ডা লাগে না। অনন্তর ত অন্ত নাই। জলের তবু অন্ত আছে। লও, ভইন ডুব দেই। (পৃ ২৪৫)
শরৎ
গ্রীষ্ম ও বর্ষার পর বাংলার ঋতুচক্রে আসে শরৎ। আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিবিলাস, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ-বন্যার দাপট কমে গেলে আসে ভাদ্র-আশ্বিন মাস বুকে নিয়ে শরৎকাল। বাংলার ঋতুচক্রে মূলত তিনটি ঋতুরই প্রচন্ডতা – গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। এই তিন ঋতুই আমাদের প্রকৃতিতে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে জানান দিয়ে যায় – রেখাপাত করে যায় বাঙালির দেহে-মনে। অন্য তিনটি ঋতু নীরবে আসে, নিঃশব্দে যায়। গ্রীষ্ম গ্রাস করে বসন্তকে, শরৎ সমাহিত বর্ষায় আর শীতের চাদর হেমন্তকে আচ্ছাদিত করে রাখে। বাংলায় এই তিন ঋতুর স্বাতন্ত্র্য তেমন পরিলক্ষিত হয় না। এই তিন ঋতুই শান্ত, নিরীহ এবং সমর্পিত। তাই আবহাওয়া 888sport apkীদের কাছে অমৌলিক এই তিন ঋতুর তেমন কোনো বিশিষ্টতা নেই। শরৎ বর্ষার শেষ সিঁড়ি, হেমন্ত শীতের শৈশব আর বসন্ত গ্রীষ্মের পূর্বাভাস।
শান্ত-সুবোধ-সুশীল ঋতু শরৎ। নম্র-নিরীহ-নির্বিরোধ স্বভাব নিয়ে শরতের আসা-যাওয়া। শরতে নেই রৌদ্র দগ্ধতার হুংকার, নেই অতিবৃষ্টি, বজ্রপাত কিংবা বানভাসির ভয়াবহতা – নেই বাঘ-কাঁপানো শীতের তীব্রতা। শরৎ সব দিক থেকেই সুশীল। শরৎ শিউলি-শাপলা ও কাশফুল ফোটানোর ঋতু। তখন আকাশ থাকে ময়ূরকণ্ঠী নীল – জলকণাহীন শিমুল তুলার মতো সাদা মেঘ দল বেঁধে উড়ে বেড়ায়। কমতে-থাকা নদীর জল থাকে স্নিগ্ধ-শান্ত, প্রায় নিস্তরঙ্গ, স্রোতহীন। মাছমারার ঋতু শরৎ, রবিশস্য ফলানোর ঋতু শরৎ, ফসল রোপণের ঋতু শরৎ। অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাসে এই নির্বিরোধ ঋতুটিও চোখ এড়িয়ে যায়নি। তিনি তাঁর মতো করেই নদীনির্ভর জীবনদৃষ্টিতে শরতের বর্ণনা করেছেন এভাবে :
শরতে আকাশের মেঘগুলিতে জল থাকে না। কিন্তু তিতাসের বুকে থাকে ভরা জল। তার তীরের ডুবো মাঠময়দানে শাপলা-শালুকের ফুল নিয়া, লম্বা লতানে ঘাস নিয়া, আর বাড়ন্ত বর্ষাল ধান নিয়া থাকে অনেক জল। ধানগাছ আর শাপলা-শালুকের লতাগুলির অনেক রহস্য নিবিড় করিয়া রাখিয়া এ জল আরও কিছুকাল স্তব্ধ হইয়া থাকে। তারপর শরৎ হইয়া আসে। কে বুঝি বৃহৎ চুমুকে জল শুষিতে থাকে। বাড়তি জল শুখাইয়া দিয়া তিতাস তার স্বাভাবিক রূপ পায়। যে-মাটি একদিন অথৈ জলের নিচে থাকিয়া মাখনের মত নরম হইয়া গিয়াছিল, সে মাটি আবার কঠিন হয়।
হেমন্ত
কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে হেমন্ত ঋতুর বিস্তার। হেমন্ত বাঙালির জীবনে পূর্ণতা ও শূন্যতার ঋতু। হেমন্ত একদিকে আসে ঐশ্বর্যময় নতুন ফসলের বার্তা নিয়ে, অন্যদিকে শুনিয়ে যায় সে রিক্ততার পদধ্বনি। এ-ঋতুতে একাধারে থাকে নবান্নের স্বাদ, মাঠে-উঠোনে সোনালি ধানের সম্ভার, উলটো পিঠে থাকে ফসল-কাটা ক্ষেতের শূন্যতা। হেমন্ত প্রকৃতিতে আনে শীতের সংকেত, শুষ্কতা-রুক্ষতা আর তাপমাত্রা নিম্নগামিতার পূর্বাভাস। হেমন্ত যে শীতঋতুর সংকেত, তার পরিচয় পাওয়া যায় শিশিরপাতের মৃদু শব্দে। হেমন্তের শিশির যেন প্রকৃতির রোদন, নিসর্গের অশ্রুপাত। বাংলার এই ঋতু হাসিকান্নায় বিমিশ্র। হেমন্তে নদীর জল হ্রাস পায়। যে-ভাটার টান শুরু হয় শরতে তা পূর্ণতা পায় হেমন্তে। নদী তখন প্রস্থে হয়ে আসে সরু – ছোট নদীর জল নেমে আসে প্রায় তলদেশে। যেন পাড় হয়ে যায় গরু, পাড় হয় গাড়ি। নদীমুগ্ধ অদ্বৈতের হেমন্ত-ভাবনাতেও আছে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য। তাই তাঁর হেমন্ত-বিবরণী নদীনির্ভর, তিতাসের কোল-ঘেঁষা জনজীবন-সম্পৃক্ত এবং কৃষি ও কৃষকের উৎপাদনমুখী চেতনাবাহী। তাই হেমন্তের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন :
তীর ঘেঁষিয়া সব ছোট ছোট গ্রাম। গ্রামের পর জমি। অগ্রহায়ণে পাকা ধানের মৌসুম। আর মাঘে সর্ষেফুলের হাসি। তারপর আবার গ্রাম। লতাপাতা গাছগাছালির ছায়ায় 888sport app সবুজ গ্রাম। ঘাটের পর ঘাট। সে ঘাটে সব জীবন্ত ছবি! মা তার নাদুস-নুদুস শিশু ছেলেমেয়েকে চুবাইয়া তোলে। আর বৌ-ঝিয়েরা কলসী লইয়া ডুব দেয়। অল্প একটু দূর দিয়া নৌকা যায় একের পর এক।…
হেমন্তের মুমূর্ষু অবস্থায় কখন ধানকাটার মৌসুম শুরু হইয়া গিয়াছিল। পাড়ে সবখানেই গ্রাম নাই। এক গ্রাম ছাড়াইয়া আরেক গ্রামে যাইতে মাঝে পড়ে অনেক ধানজমি। জমির চাষীরা ধানকাটা শেষ করিয়া ভারে ভারে ধান এদিক ওদিকের গ্রামগুলিতে বহিয়া নিয়া চলে। তারা তিতাসের ঠিক পাড়ে থাকে না। থাকে একটু দূরে। একটু ভিতরের দিকে। সেখান হইতে মাঘের গোড়ায় আবার তারা তীরে তীরে সর্ষে বেগুনের চারা লাগায়। তীরের যেখানে যেখানে বালিমাটির চর, সেখানে তারা আলুর চাষ করে। এ মাটিতে সকরকন্দ আলু ফলায় অজস্র। (পৃ ৪৮)
হেমন্তকালে তিতাসের তীর থাকে হলুদে হলুদময়। সর্ষে ক্ষেতের চোখ-ধাঁধানো শোভা, দৃষ্টিনন্দন সোনালি সর্ষেফুলের গর্ভ থেকে ভেসে-আসা সুগন্ধ এবং মৌ-লোভী মৌমাছিদের বিচরণে সে-ফুলের গর্ভধারণ – সবকিছু মিলিয়ে তখন অপরূপ তিতাসের তীর। অদ্বৈতের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এরকম :
তীর-অবধি সর্ষে ফুলের হলদে জৌলুষে হাসিয়া উঠিয়াছিল। মনে হইয়াছিল কে বুঝি তিতাসের কাঁধে নক্সা-করা উড়ানি পরাইয়া রাখিয়াছে। অর্বাচীন গরুগুলি পাছে তাতে মুখ দেয়, তার জন্য কত না ছিল সতর্কতা।
শীত
হেমন্তের পর আসে শীত। কার্তিকের শুরুতে শীতের জন্ম। অগ্রহায়ণে তার শৈশব-কৈশোর। পৌষ-মাঘ মাসে শীতঋতুর তারণ্য ও যৌবন। গ্রীষ্ম ও বর্ষার মতো শীতও বাংলার মৌলিক ঋতু। ঘন কুয়াশার আস্তরণ ও হিমালয় থেকে আসা উত্তরের হিমেল বাতাস কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে প্রকৃতি ও মানুষের দেহে-মনে জানান দিয়ে যায় শীতের উপস্থিতি। যদিও তুষারপাত হওয়া ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর মতো শৈত্যপ্রবাহ আমাদের দেশে নেই, তবু শৈথিল্যের তীব্রতা উপেক্ষণীয় নয়। নাতিশীতোষ্ণ জল-হাওয়ার দেশ হলেও অভাব-দারিদ্র্য-দীনতার কারণে, ক্ষণস্থায়ী হলেও, শীত এদেশে সুতীব্রই। শীতকালে বিচিত্রবিধ শাক-সবজি, পিঠা-পুলি-পায়েশ, পূজা-পার্বণ-লোকাচার, ওয়াজ-জলসা-ওরস, বিচিত্র বিদেশি পাখির আনাগোনা ইত্যাদি প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গের প্রাচুর্য থাকলেও এ-ঋতুতে দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব কোনোভাবেই চোখ এড়িয়ে যায় না।
শীতকালে বাংলার নদীর রূপ সম্পূর্ণ অন্যরকম – শান্ত, রুগ্ণ, কৃশতনু, নির্জীব – ঘুমন্ত শিশুর মতো নিশ্চুপ। যে-নদী বর্ষায় থাকে বেগবান, শক্তিমন্ত, কোলাহলমুখর – শীতে সে-ই তপস্যামগ্ন বাল্মীকি কিংবা অহিংস বুদ্ধের প্রশান্ত মূর্তির মতো নিশ্চল। তিতাস-নিবেদিতপ্রাণ অদ্বৈত মল্লবর্মণ শীতের এমন নিরাসক্ত নদীরই বর্ণনা দিয়েছেন তিতাস একটি নদীর নামে। আমরা পড়ে নিই তাঁর শীতকালের নদী ও সংশ্লিষ্ট মানুষের বর্ণনার স্বরূপ :
আর সত্য তিতাস-তীরের লোকেরা তারা শীতের রাতে কতক কতক কাঁথার তলাতে ঘুমায়। কতক জলের উপর কাঠের নৌকায় ভাসে। মায়েরা, বোনেরা আর ভাই-বউয়েরা তাদের কাঁথার তলা থেকে জাগাইয়া দেয়। তারা এক ছুটে আসে তিতাসের তীরে। দেখে, ফরসা হইয়াছে; তবে রোদ আসিতে আরও দেরি আছে। নিস্তরঙ্গ স্বচ্ছ জলের উপর মাঘের মৃদু বাতাস ঢেউ তুলিতে পারে না। জলের উপরিভাগে বাষ্প ভাসে – দেখা যায়, বুঝি অনেক ধোঁয়া। তারা সে ধোঁয়ার নিচে হাত ডোবায়, পা ডোবায়। অত শীতেও তার জল একটু উষ্ণ মনে হয়। কাঁথার নিচের মায়ের বুকের উষ্ণতার দোসর এই মৃদু উষ্ণতাটুকু না পাইলে তারা যে কি করিত। (পৃ ৪৮)
জেলেজীবনে শীত বাহারি পোশাকের ঋতু নয়, রসনাবিলাসী ঋতুও নয়। শীত বেদনার ঋতু, বিষাদের ঋতু। কারণ জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না তেমনি জলের ফসল ছাড়া জেলেরা বাঁচে না। মীন-সন্তানেরাই মালোদের জীবন – বেঁচে থাকার অবলম্বন। তাই তিনি বলেছেন : ‘নাকের চারিদিক থেকে বায়ুটুকু সরাইয়া রাখিলে যা অবস্থা হয়, তাদের ঠিক সেই রকম অবস্থা হইত।’ শীতকালে জেলেজীবনে কেবল বস্ত্রহীনতার শারীরিক কষ্ট নয়, উপার্জনহীনতায় খাদ্য-সংগ্রহের কষ্টও। অদ্বৈত লিখেছেন :
শীতে বড় কষ্ট। গম গম করিয়া জলে নামিতে পারে না। জল খুব কম। সারা গা তো ডোবেই না; কোমর অবধিও ডোবে না। শীতের কন কনে ঠান্ডা জলে হুম করিয়া ডুবিয়া ভাসিয়া উঠিবার উপায় নাই; একটু একটু করিয়া শরীর ভিজে। মনে হয় একটু একটু করিয়া শরীরের মাংসের ভিতর ছুরি চালাইতেছে কেউ। চৈত্রের শেষে খরায় খাঁ খাঁ করে। এতদিন যে জলটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও একটু একটু করিয়া শুষিতে শুষিতে একদিন নিঃশেষ হইয়া যায়। ঘামের গা ধুইবার আর উপায় থাকে না। গরুরা জল খাইতে ভুল করিয়া আসিয়া ভাবনায় কাতর হয়। মাঘের মাঝামাঝি সরষে ফুলে আর কড়াই-মটরের সবুজিমায় দুই পারে নক্সা করা ছিল। নদীতেও ছিল একটু জল। জেলের তিনকোণা ঠেলা জাল ঠেলিয়া চাঁদা পুঁটি, টেংরা কিছু কিছু পাইত। কিন্তু চৈত্রের খরায় এ সবের কিছুই থাকে না। মনে হয় মাঘ মাসটা ছিল একটা স্বপ্ন। চারদিক ধূ-ধূ করা রুক্ষতায় কাতরায়। লোকে বিচলিত হয় না। জানে তারা, এ সময় এমন হয়। (পৃ ৪০-৪১)
বসন্ত
বাংলার ঋতুচক্রের শেষ ঋতু বসন্ত। বঙ্গাব্দের শেষ দুই মাস ফাল্গুন-চৈত্র মাসব্যাপী বসন্তের অবস্থান। এ-ঋতুতে বাংলার প্রকৃতি নতুন সাজে সজ্জিত হয়। গাছপালা, তরুলতা নতুন পত্র-পুষ্প-পল্লবে ভরে ওঠে। এ-সময় শীতের হিমেল উত্তুরে হাওয়ার বদলে বইতে শুরু করে জলকণাঋদ্ধ দক্ষিণের বাতাস। বসন্তে বাংলার আবহাওয়া থাকে নাতিশীতোষ্ণ ও মনোরম। বসন্তকে বলা হয়ে থাকে ঋতুরাজ। কবি ও ভাবুকপ্রকৃতির মানুষের প্রিয় এই ঋতু। বাংলার সৃষ্টিশীল মানুষেরা এ-ঋতুতে মুগ্ধ। তাই এর গুণগানে মুখর। আবহমানকাল ধরে বাংলার 888sport live chat-888sport live football, সংগীত ও চিত্রকলায় এর অজস্র পরিচয় পাওয়া যায়। কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাপতি থেকে নজরুল, চন্ডীদাস থেকে শামসুর রাহমানের রচনায় এর অফুরান সাক্ষ্য পাওয়া যাবে।
বসন্ত যেমন ফুলের ঋতু, রঙের ঋতু, রূপের ঋতু তেমনি ‘বসন্ত’ নামক ছোঁয়াচে রোগের ঋতুও। এ-ঋতুতে প্রতিকারহীন গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাবে একদা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে মড়ক লাগত। সে-যুগ আজ বাসি হলেও জলবসন্তের আক্রমণ একেবারে নিপাত হয়ে যায়নি। যা-ই হোক, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ – সবকিছু মিলিয়ে শীতের শেষ রাত, বসন্তের প্রথম দিন আবহমান কাল ধরে বাঙালির জীবনে অমরত্ব লাভ করেছে। ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক – বসন্তই ঋতুরাজ।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাসেও বসন্তের বর্ণনা এসেছে। তিনি নদী-নৌকা-জাল আর জেলে-মাঝি-মাছের অনুষঙ্গে তিতাসের তীরে যে-জীবনপ্রবাহ, তাকেই তুলে এনেছেন বসন্তের কালিক ভাবনায়। এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঙালির লোকসংস্কৃতি, প্রথা এবং লোকাচারের আবহ। তবে তিনি শতমুখী অভাব, সহস্র বঞ্চনা, অযুত অনটন এবং লাখো দারিদ্রে্যর মধ্যেও মালোসমাজের স্বপ্নময় প্রেমানুভূতির কথা জানাতে ভোলেননি। পরাগরেণুঋদ্ধ প্রেম, রঙিন স্বপ্ন ও রক্তিম সুখের আবিররঙা অনুভূতিগুলো তিনি বসন্তের আবহে প্রকাশ করেছেন এভাবে :
আসে বসন্ত। এই সময় মাঠের উপর রঙ থাকে না। তিতাসের তীর ছুঁইয়া যাদের বাড়িঘর তারা জেলে। তিতাসে মাছ ধরিয়া তারা বেচে, খায়। তাঁদের বাড়ি পিছু একটা করিয়া নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকে। বসন্ত তাদের মনে রঙের মাতন জাগায়।
বসন্ত এমনি ঋতু-এই সময় বুঝি সকলের মনে প্রেম জাগে। জাগে রঙের নেশা। জেলেরা নিজে রঙ মাখিয়া সাজে – তাতেই তৃপ্তি পায় না। যাদের তারা প্রিয় বলিয়া মনে করে তাদেরও সাজাইতে চায়। তাতেও তৃপ্তি নাই। যাদের প্রিয় বলিয়া মনে করে তারাও তাদের এমনি করিয়া রঙ মাখাইয়া সাজাক তাই তারা চায়। তখন আকাশে রঙ ফুলে ফুলে রঙ, পাতায় পাতায় রঙ। রঙ মানুষের মনে মনে। তারা তাদের নৌকাগুলিকেও সাজায়। বৌ-ঝিরা ছোট থলিতে আবির নেয়, আর নেয় ধানদূর্বা। জলে পায়ের পাতা ডুবাইয়া থালিখান আগাইয়া দেয়। নৌকাতে যে পুরুষ থাকে সে থালির আবির নৌকার মাঝের গুরায় আর গলুইয়ে নিষ্ঠার সহিত মাখিয়া দেয়। ধানদূর্বাগুলি দুই অঙ্গুলি তুলিয়া ভক্তিভরে আবির মাখানো জায়গাটুকুর উপর রাখে। এই সময়ে বউ জোকার দেয়। সে-আবিরের রাগে তিতাসের বুকেও রঙের খেলা জাগে। তখন সন্ধ্যা হইবার বেশি বাকি নাই। তখনো আকাশ বড় রঙিন। তিতাসের বুকের আরসিতে যে আকাশ নিজের মুখ দেখে সেই আকাশ। (পৃ ৫১-৫২)
আট
তিতাস অবর্ণনীয় রূপের নদী, অপার সৌন্দর্যের নদী আবার রোদনভরা জীবনের নদীও। তিতাসের বহমান জলধারার সঙ্গে এর তীরবর্তী মানুষের যে বহমান জীবনধারা – এরই নিষ্ঠাবান রূপকার অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তিনি তাঁর তিতাসকে রং-তুলি-ক্যানভাসে অাঁকেননি, তৈরি করেননি ফটোশপে কিংবা রচনা করেননি মনের মাধুরী মিশিয়ে। অদ্বৈতের তিতাস প্রকৃতি ও জীবনের প্রতিরূপ। তিতাসের জলে যেমন সুধা আছে, তেমনি আছে চোখের নোনাজল। তিতাস সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য : ‘সত্যের মতো গোপন হইয়াও বাতাসের মতো স্পর্শপ্রবণ।’ তিতাস একটি নদীর নামে সেই গোপন সত্যই উন্মোচন করেছেন তিনি। তবে অদ্বৈতের তিতাস নদী কেবল স্পর্শপ্রবণ নয়; তা রূপে দৃষ্টিগ্রাহ্য সুরেলা কল্লোলে শ্রুতিগ্রাহ্য, ঘ্রাণময়তায় নাসিকাগ্রাহ্য এবং স্বাদে রসনা-তৃপ্তিকরও। তাঁর তিতাসকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়েই অনুভব করা যায়। আর যদি থাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের স্বোপার্জিত অনুভূতি তবে তো অরূপের তিতাসকেও অনুভব করা যায়।
যুগে-যুগে, কালে-কালে কত ভাষ্য রচিত হয়েছে তিতাসকে নিয়ে – ছবি, 888sport app download apk, গান, গল্প, নাটক-সিনেমা। 888sport live chatরাজ্যে অপার উৎস ও সম্ভাবনার গঙ্গোত্রী যেন তিতাস। কিন্তু অদ্বৈতের তিতাস অপ্রতিদ্বন্দ্বী – যেমন 888sport live chatে, তেমনি জীবনযুদ্ধে। তিতাস একটি নদীর নাম এবং অদ্বৈত একজন 888sport live chatীর নাম। তাঁর নামটি পিতৃপ্রদত্ত কিনা কিংবা কে রেখেছিলেন জানি না। তবে ওই তৎসম শব্দটি যে-অর্থ প্রকাশ করে তা ঈশ্বরেরই মহিমান্বিত নাম – যিনি অদ্বিতীয়, যার কোনো দ্বিতীয় সত্তা নেই। অদ্বৈত তাঁর নামটিকে সার্থক করেছেন তিতাসের মাধ্যমে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ কথা888sport live chatী হিসেবে যেমন অদ্বিতীয়, তেমনি তাঁর তিতাস একটি নদীর নামও দ্বিতীয়-রহিত। পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে প্রকৃতির সুশীল সন্তান তিতাস নদী এক সময় না-ও থাকতে পারে। তার বদলে এখানে গড়ে উঠতে পারে ফসলি জমি, জেগে উঠতে পারে চর। বিস্তার হতে পারে নাগরিক সভ্যতা – কলকারখানা, অট্টালিকার। তার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। তিতাস না-থাকলে জল থাকবে না, জল না-থাকলে জলের ফসল মাছ থাকবে না। আর এসব না-থাকলে থাকবে না জেলে সম্প্রদায়, কৈবর্তসমাজ, মালোমানুষ। তাদের বংশধরেরা তখন হয়তো ভাগ্যবিড়ম্বিত ভাগচাষি হবে কিংবা সর্বহারা শ্রমিক। নদী-সংগ্রামী জলযোদ্ধারা তখন গতর খাটাবে পরের জায়গা, পরের জমিতে। জলপুত্ররা পরিণত হবে দিনমজুরে, ক্ষেতমজুরে, মিলশ্রমিকে। হায় তিতাস! হায় মৎস্যজীবী মালোসমাজ! তবে ভবিতব্যে তিতাস নদীর যা-ই হোক, অদ্বৈতের তিতাস স্বপ্ন, 888sport live chat ও সংগ্রামের আকর তিতাস অমর হয়ে থাকবে। লেখকের জবানিতেই আছে সেই অমরত্বের আভাস :
তিতাস নদী এখানে ধনুর মত বাঁকিয়াছে।
তার নানা ঋতুতে নানা রঙ নানা রূপ। এখন বর্ষাকাল। এখন রামধনুর রূপ। দুই তীরে সবুজ পল্লী। মাঝখানে সাদা জল। উপরের ঘোলাটে আকাশ হইতে ধারাসারে বর্ষণ হইতে থাকে। ক্ষেতের গৈরিক মাটিমাখা জল শতধারে সহস্রধারে বহিয়া আসে। তিতাসের জলে মিশে। সব কিছু মিলিয়া সৃষ্টি করে একটা মায়ালোকের। একটা আবেশ মধুর মরমী রামধনুলোকের।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.