অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে কিছু কথা

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অভিসন্দর্ভটি, যা নিয়ে আজকের আয়োজন, তা প্রায় ৭২ বছর আগে তিনি সম্পন্ন করেছিলেন। Political Parties in India নামে প্রকাশিত এই জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থটির জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদার্হ এর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউপিএল এবং এর স্বত্বাধিকারী মাহরুখ মহিউদ্দিন। অ্যাকাডেমিক প্রকাশনার ৪৬ বছর পর অভিসন্দর্ভটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলেও 888sport appsের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকাশনা। স্বল্পপরিসরে এ-গ্রন্থের প্রস্তুতি ও সারমর্ম অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে বিবৃত করেছেন এর সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহরার আহ্মেদ। এজন্য তাঁরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। সঙ্গে অধ্যাপক রওনক জাহানের মুখবন্ধ গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছে। 

ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কিত এই পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভটি অধ্যাপক রাজ্জাক তুলে দিয়েছিলেন রওনক জাহানের হাতে। অধ্যাপক রাজ্জাক এটি ১৯৫০ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে জমা দেন। অর্থনৈতিক পরিবর্তন কীভাবে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক চর্চায় প্রভাব ফেলেছিল সে-বিষয়ে সম্যক জ্ঞানার্জনের জন্য অধ্যাপক রওনক জাহানকে উৎসাহ দিতেন আব্দুর রাজ্জাক। এই অপ্রকাশিত অভিসন্দর্ভটির নয়টি খণ্ড উদ্ধার করতে পেরেছিলেন রওনক, যেখানে তুলে ধরা হয়েছে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা। যেমন – প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলির কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র আবশ্যক। কিন্তু ভারত স্বাধীনই হয়েছে ১৯৪৭ সালে। দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রয়োজন ছিল ওয়েস্টমিনস্টার (ব্রিটিশ গণতন্ত্র) ধরনের উদারনৈতিক রাজনীতি, যেখানে যে-কোনো দল ক্ষমতাসীন বা বিরোধীদলে থাকতে সর্বদাই প্রস্তুত। কিন্তু সে-সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির রাজনীতিতে অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রবলভাবে বিরাজ করায়, ওয়েস্টমিনস্টার ধরনের কোনো রাজনীতি এখানে গড়ে ওঠেনি। উল্টো সে-সময় রাজনৈতিক দলগুলিতে কতিপয় নেতার হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন এবং বংশপরম্পরার রাজনৈতিক ধারা প্রবল হয়ে উঠেছিল।

এই বিষয়গুলি আব্দুর রাজ্জাক চিহ্নিত করেছিলেন রওনক জাহানের পর্যবেক্ষণের জন্য।

আব্দুর রাজ্জাক 888sport appর বুড়িগঙ্গা নদী-তীরবর্তী কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া গ্রামে ১৯১৪ সালে জানুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মারা যান ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে। তিনি 888sport appর ডুফেরিন হোস্টেলে অবস্থান করে গভর্নমেন্ট মুসলিম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন করেন। কাকতালীয়ভাবে আমার পিতা ১৯৩৯-৪০ সালে ওই স্কুলেরই শিক্ষক এবং ডুফেরিন হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। 888sport app ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে অধ্যাপক রাজ্জাক প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩১ সালে তিনি 888sport app বিশ^বিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও রাষ্ট্র888sport apk বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাষ্ট্র888sport apk বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এর কিছুদিন পর বিভাগটি অর্থনীতি ও রাষ্ট্র888sport apk নামে দুটি আলাদা বিভাগে পরিণত হলে অধ্যাপক রাজ্জাক রাষ্ট্র888sport apk বিভাগে যোগদান করেন।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে বলা হয় জ্ঞানতাপস। এ-সম্পর্কে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘তিনি (অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক) জ্ঞানের তপস্যা ও সাধনা করে জ্ঞান অর্জনে সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন, সেজন্যই তাঁকে ‘জ্ঞানতাপস’ বলতে হয়।’ ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরপরই তিনি স্কলারশিপ (মেধাবৃত্তি) ও স্টাডি লিভ (শিক্ষা ছুটি) নিয়ে লন্ডনের স্কুল অব ইকোনমিক্সে গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষার জন্য যান। তাঁর রিসার্চ সুপারভাইজার (গবেষণা পর্যবেক্ষক) ছিলেন অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি।

হ্যারল্ড লাস্কি ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান (সভাপতি) ছিলেন। দুই বিশ^যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁকে মনে করা হতো সাম্যবাদ বিষয়ে ব্রিটেনের সবচেয়ে প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী।

আব্দুর রাজ্জাকের গবেষণার বিষয় ছিল ভারতের রাজনৈতিক দল। তবে অধ্যাপক রাজ্জাকের গবেষণা শেষ হওয়ার আগেই ১৯৫০ সালে হ্যারল্ড লাস্কি হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। গবেষণাকালে কিছু বিষয়ে অধ্যাপক লাস্কির স্থলাভিষিক্ত অধ্যাপকের মতের সঙ্গে মিল না হওয়ায় অধ্যাপক রাজ্জাক অভিসন্দর্ভটি শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন। এরপর ১৯৫৯ সালে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে যোগ দেন। দেশে ও বিদেশে তাঁর জ্ঞানসাধনা সবসময়ই অব্যাহত ছিল। ১৯৬৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরের বাল্লিওল কলেজে বেশ কিছু সময় ভিজিটিং ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিছু তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে অধ্যাপক রাজ্জাকের অভিসন্দর্ভটির ওপর একটি মনোজ্ঞ সারসংক্ষেপ লেখেন ভারতের স্বনামখ্যাত সাংবাদিক খুশবন্ত সিং। পরবর্তীকালে সেটি ভারতে সাপ্তাহিক ইলাস্ট্রেটেড উইকলি-তে প্রকাশিত হয়।

অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ আরো বলেছেন, ‘তাঁকে বাংলার মনীষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে অভিহিত করলে বোধহয় ঔদ্ধত্য হবে না। ইতিহাস, সমাজ888sport apk, অর্থনীতি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তিনি যে পড়াশোনা করেছেন সেটা দেখে মনে হয় তিনি একটি জীবন্ত জ্ঞানভাণ্ডার।’

আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন চিন্তাচেতনার দিক দিয়ে উদার, মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক। রাজনীতি পছন্দ না করলেও প্রথম জীবনে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এই কারণে যে, তিনি মনে করতেন তাঁর সময়কালের পশ্চাৎপদ মুসলমানদের উন্নতি একমাত্র স্বতন্ত্র রাজনীতি ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব। এটা অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীনের ভাষ্য। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি তাঁর গভীর 888sport apk download apk latest version ছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মুসলমানদের মোহমুক্তি ঘটল। প্রয়োজন অনুযায়ী রাজনৈতিক মতামত পরিবর্তন করা যেতে পারে – এ-কথা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তখন আমাদের রাজনীতিবিদদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাঁকে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে ভূষিত করেন। ওইদিন একসঙ্গে তিনজনকে এ পদবিতে সম্মানিত করা হয় – 888sport live chatাচার্য জয়নুল আবেদিন, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও ড. কাজী মোতাহার হোসেন।

১৯৫৬-৫৮ সময়কালে যখন আতাউর রহমান খান পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সে-সময় অধ্যাপক রাজ্জাক পূর্ব পাকিস্তান পরিকল্পনা বোর্ডের  সদস্য ছিলেন।

888sport app বিশ^বিদ্যালয়ের টিচার্স লাউঞ্জে স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় আমার প্রয়াত বন্ধু এ জেড এম ওবায়দুল্লাহর মাধ্যমে, দাবা খেলার টেবিলে। তিনি দাবা খেলা খুব পছন্দ করতেন। আমি কয়েকবার তাঁকে দেখেছি ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে দাবা খেলতে। ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি আমি পূর্ব পাকিস্তান অর্থ মন্ত্রণালয়ে সেকশন অফিসার হিসেবে পদায়িত হই। ১৯৬২ সালের গোড়ার দিকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করি। আমাকে তখন অর্থ বিভাগে উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে হতো। পূর্ব পাকিস্তান পরিকল্পনা বোর্ডের সঙ্গে তখন পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের কিছু সদস্য বছরে কয়েকবার কাজ করতে আসতেন। সে সময় আমি একবার অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে দেখা করতে যাই। দায়িত্ব পালনে কিছুটা সুনাম অর্জন করায় তিনি আমার কাজের বৃত্তান্ত সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, ‘স্যার, আমি যে কাজ করছি তা খুবই ইন্টারেস্টিং; কিন্তু এর সবকিছু আমি বুঝি না; যেমন – প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি, ইকোনমিক রেট অফ রিটার্ন, ফাইন্যান্সিয়াল রেট অফ রিটার্ন, বেনিফিট, প্রবৃদ্ধিতে তার প্রভাব – এগুলো খুব ভালোভাবে রপ্ত করতে পারছি না।’

শুনে স্যার আমাকে বললেন, ‘আপনি ইকোনমিক্স পড়েন না কেল্লেইগা?’

আমি বললাম, ‘স্যার, আমি তো ফিজিক্সের ছাত্র। আমি কি ইকোনমিক্স পড়তে পারব? আমি তো ইকোনমিক্স পড়ার যোগ্য নই।’

স্যার বললেন, ‘আপনি ফিজিক্স যখন পড়ছেন, তখন ম্যাথমেটিক্স অবশ্যই পড়ছেন। আমি আপনাকে বলব আপনি ইকোনমিক্স পড়েন।’

আমি বললাম, ‘স্যার, এগুলো তো মুশকিলের বিষয়, স্কলারশিপ লাগবে, গভর্নমেন্টের পারমিশন লাগবে।’

স্যার বললেন, ‘আপনার সিভি আমাকে দিয়ে যাবেন এবং গভর্নমেন্টের রুলসের মধ্যে ‘স্টাডি লিভ’ আছে, সেটা দেখে নেবেন।’

সে-সময় 888sport appয় অবস্থান করা হার্ভার্ড অ্যাডভাইজরি গ্রুপের একজন সদস্য এবং ইউএসএআইডির একজন কর্মকর্তা স্যারের পরিচিত ছিলেন। তাঁদেরকে তিনি আমার সিভি দিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দুই মাসের মধ্যে ইকোনমিক্স বিষয়ে পড়তে যাওয়ার জন্য আমি যে দরখাস্ত করেছিলাম তা গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রের চারটি কলেজ থেকে চিঠি এলো। এর মধ্যে ম্যাসাচুসেটসের উইলিয়ামস কলেজ ছিল নামকরা। (সম্প্রতি উইলিয়ামস কলেজ তাদের ২০০ বছরপূর্তি উদযাপন করেছে) অ্যাডভাইজররা আমাকে পরামর্শ দিলেন, আমার জন্য উইলিয়ামস কলেজ সবচেয়ে ভালো হবে। কারণ উন্নয়নশীল দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কলেজটি সে সময় অর্থনীতি বিষয়ে একটি নতুন কোর্স চালু করেছিল। অর্থনীতি বিষয়ে কলরাডো বোল্ডার ইউনিভার্সিটিতে আমি তিন মাসের জন্য ‘গ্রীষ্মকালীন ক্লাসে’ (Summer school) যোগদানের অনুমতি পেয়েছিলাম। সে-সময় আমি অর্থনীতির অনেক খ্যাতনামা অধ্যাপকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাই এবং অর্থনীতির নানা মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি।

১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আমি উইলিয়ামস কলেজে ভর্তি হই। সেটা ছিল আমার জন্য অত্যন্ত উদ্দীপনাপূর্ণ সময়। ১৯৬৩ সালের জুনে আমি উন্নয়নশীল অর্থনীতি বিষয়ে এমএ সম্পন্ন করি। আমরা ১৩ জন ছাত্র ছিলাম ওই ব্যাচে। উন্নয়নশীল দেশের সরকারি কর্মকর্তারা যেন উন্নয়নশীল অর্থনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে সেজন্য ১৯৬১ সালে এই কোর্সটি প্রবর্তন করেছিল উইলিয়ামস কলেজ। ১৯৬২ সালে আমি ছিলাম ওই কোর্সের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী। আমার সঙ্গে যাঁরা কোর্সটি করেছিলেন তাঁরা এসেছিলেন ভারত, পাকিস্তান, কোরিয়া, মিশর, নাইজেরিয়া, ইসরায়েল, যুগোসøাভিয়া, মেক্সিকো ও কলম্বিয়া থেকে, অর্থাৎ প্রতিটি মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশ থেকে শিক্ষার্থী এসেছিলেন।

আমি স্যারের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে নির্দেশ নয়, উপদেশ দিয়েছিলেন অর্থনীতি পড়ার জন্য। তাঁর সেই পরামর্শ আমার চাকরিজীবনকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিয়েছিল পাকিস্তান আমলে এবং পরবর্তীকালে 888sport apps-কালেও।

১৯৬৭ সালে আমি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে পদায়িত হই উপসচিব হিসেবে এক্সটার্নাল রিসোর্স ডিভিশনে। সেখানে আমার উপরস্থ সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ছিলেন এমএম আহমেদ। তিনি ছিলেন প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান। এই বিভাগটি রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের একটি অংশ ছিল। সেখানে বৈদেশিক সাহায্য বিষয়ে, বিশেষ করে পাকিস্তানকে যারা সাহায্য-সহায়তা করতেন, তাঁদের সঙ্গে আমাকে কাজ করতে হতো। প্রতিবছর দাতাদের জন্য একটি করে ডকুমেন্ট তৈরি করতে হতো, যেখানে উল্লেখ থাকত আমাদের কী কী সাহায্য প্রয়োজন।

১৯৬৯ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমি লন্ডনে ছিলাম নাফিল্ড ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ নিয়ে। সে-সময় 888sport apps (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) ও পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট চলছিল। উভয় পাকিস্তানে তখন প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম চলছিল। লন্ডনে রিজেন্ট পার্কের কাছে যে-বাড়িতে আমি থাকতাম সে বাড়ির কাছেই একজন ভারতীয় নাগরিকের বাড়ি ছিল। তাঁর নাম অর্জুন সেনগুপ্ত। সে-বাড়িতে এসে রাজ্জাক স্যার উঠলেন। এর আগে রাজ্জাক স্যার ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বাড়িতে। অধ্যাপক সোবহান দেশে ফিরে আসার পর রাজ্জাক স্যার ওই বাড়িতে উঠেছিলেন। সেখানে আরো একজন আসতেন, তিনি হলেন প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল যে, সে সময় বেশ কয়েক মাস আমি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাই। তিনি আমার বাসায় প্রায়ই আসতেন, আমিও যেতাম। তখন আমাদের মধ্যে অনেক কথা হতো। আমার স্ত্রীকে তিনি বেশ কিছু রান্নাও শিখিয়েছিলেন। তিনি কথা বলতেন রাজনীতি বিষয়ে, বিশেষ করে 888sport apps ও পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটত কথোপকথনে। মাঝে মাঝে তিনি আমাকে নিয়ে বাজারেও যেতেন।

লন্ডনে থাকাকালে স্যার বলেছিলেন, তিনি আমাকে নিয়ে একটি পুরনো বইয়ের দোকানে যাবেন। যতদূর মনে পড়ে দোকানটির নাম ছিল ‘ফয়েলস’। এটি ছিল পুরনো লন্ডনে। তিনি বলেছিলেন, যখন আগে তিনি লন্ডলে এসেছিলেন তখন প্রায়ই ওই বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতেন পুরনো বই কেনার জন্য। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যেটা স্যার বলেছিলেন তা হলো, ওই দোকান থেকে তিনি অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিক হায়েকের বই খুঁজে পেয়েছিলেন। ওই বইটির কয়েকটি পাতায় জন মেনার্ড কেইনসের হাতে লেখা কিছু মন্তব্য ছিল। বইটি কোথায় জানতে চাইলে স্যার বললেন, ‘ওটা মনে হয় 888sport appয় আমার বাড়িতে কোথাও আছে। খুঁজে দেখতে হবে।’

পাকিস্তানের রাজনীতি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীন 888sport apps আমাদের দরকার। তবে আমার মতে, স্বাধীন 888sport appsে কোনো সামরিক বাহিনী থাকতে পারবে না।’

১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে আমি পাকিস্তান থেকে 888sport appয় ফিরে আসি। এরপর আমি যখনই সময় পেতাম অধ্যাপক রাজ্জাকের বাড়িতে যেতাম। সে সময় আমার কিছু বন্ধু-বান্ধবকে, যেমন – আনিসুজ্জামান, নূরুল হক, প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান – এদের কাউকে কাউকে নিয়ে গেছি স্যারের বাড়িতে। 

স্যারের কাছে গেলেই বহু কিছু জানা যেত। একই সঙ্গে তিনিও আমাদের কাছে অনেক কিছু জানতে চাইতেন। এই আলাপচারিতা আমার কাছে খুবই ভালো লাগত। রাজ্জাক স্যারের অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান।

ফজলে হাসান আবেদ যখন প্রথম ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনজন – কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী। একসময় ফজলে হাসান আবেদ স্থির করলেন তিনি একটি বিশ^বিদ্যালয় করবেন। সে-সময় বিশ^বিদ্যালয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ভাবলেন এবং আমাকে বললেন, ‘চলুন আমরা আমেরিকা ঘুরে দেখে আসি।’ আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আর কে যাবে?’ তিনি বললেন, ‘ব্র্যাকের অ্যাডভাইজার বোর্ডের সদস্য ফারুক চৌধুরী আমাদের সঙ্গে যাবেন।’ কথা অনুযায়ী আমরা তিনজন যুক্তরাষ্ট্রে গেলাম। এটা সম্ভবত ১৯৯৫-৯৬ সালের কথা। আমরা হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইয়েল ইউনিভার্সিটি, পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটি, স্কিডমোর কলেজ ও অ্যামহার্স্ট কলেজে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা, গঠন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করলাম। দেশে ফেরার পর আমার স্ত্রী জানাল, আমাকে রাজ্জাক স্যার খুঁজেছিলেন। স্যারকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলে তিনি পরদিনই যেতে বললেন।

স্যারের বাড়িতে যাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘আমেরিকাতে গেছিলেন ক্যান?’

আমি বললাম, ‘স্যার, ব্র্যাক একটি ইউনিভার্সিটি করবে সেজন্য নানা বিষয়ে জানতে আমাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ফজলে হাসান আবাদ।’

শুনে স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ‘আবেদরে বলেন ইউনিভার্সিটি না কইরা একশটা ভালো হাইস্কুল করুক। সেইটা দেশের জন্য অনেক মঙ্গলজনক হইব।’

অনেকেই হয়তো জানেন, আবার অনেকেই জানেন না যে, রাজ্জাক স্যার 888sport appয় একটি হাইস্কুল করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি তিনজনকে ঠিকও করেছিলেন, যাঁরা তাঁর স্কুলে যোগদান করবেন। তাঁরা হলেন – বদরুদ্দীন উমর, সরদার ফজলুল করিম ও আনিসুজ্জামান। তাঁদেরকে স্যার বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার স্কুলে জয়েন করবে।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।

স্যারের সঙ্গে আমার বহু বিষয়ে আলোচনা হতো। এর মধ্যে কিছু বিষয় আমি উল্লেখ করতে চাই।

একবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রথম মিটিং হয় ১৮৮৫ সালে। সে-সময় সভাপতি ছিলেন উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জি। কিন্তু সে সময় মুসলমানরা রাজনীতি বিষয়ে কিছু করেনি। তখন তো আলীগড়ের স্যার সৈয়দ আহমেদ, মোহাম্মদ আলী, শওকত আলীরা ছিলেন।’

উত্তরে স্যার বললেন, ‘মাঝখানে একটা পরিবর্তন হয়েছিল। ১৯০৫ সালে যে অবিভক্ত বাংলা তৈরি হয়েছিল সেখানে 888sport app ছিল রাজধানী এবং কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। কিন্তু ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ দিল্লি সফরের সময় সেটা রদ করায় বঙ্গভঙ্গ হলো এবং ভারতের রাজধানী হলো নয়াদিল্লি। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা তখনই সম্ভব হয়নি। প্রথম বিশ^যুদ্ধের কারণে রাজধানীর অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সব কাজই আটকে যায়। ফলে রাজধানী কলকাতাতেই থেকে যায়। পরবর্তীকালে ১৯৩১ সালে রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নেয়া হয়।’

স্যার আরো বললেন, ‘১৯১১ সালে পঞ্চম জর্জের বঙ্গভঙ্গ করার পেছনে মূল কারণ ছিল ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুলস পলিসি। এই পলিসি ভারতে খুব বেশি করে প্রয়োগ করা হয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খান অল ইন্ডিয়া এডুকেশন কনফারেন্স করলেও তিনি খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। ১৯০৬ সালে 888sport appয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর প্রথম সভাপতি ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ পরিবর্তিত হওয়ার পর কলকাতা রাজধানী হিসেবে ভারতে রয়ে গেল। একমাত্র 888sport app বিশ^বিদ্যালয়ই থেকে গেল পূর্ব বাংলায়।’ এ-বিষয় সম্পর্কে তিনি আমাকে পরে আরো বিস্তারিত বলেছেন।

একটা বিষয় স্যার আমাকে বলেছিলেন, তা হলো, ‘দ্যাখেন, হিন্দু-মুসলমান হইলেও সবাই কিন্তু একরকম হয় না।’ যেমন – মওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতে রয়ে গেলেন দেশটির প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে। আল্লামা ইকবাল এক অর্থে ছিলেন পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা জিন্নাহর পিতা। কিন্তু সেটাও তখন হয়ে ওঠেনি। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গের পর মুসলিম লিগের মধ্যে রাজনীতি ছড়াতে শুরু করে। স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড়ে ১৮৮৬ সালে মুসলিম বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

রাজ্জাক স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণাটি কি ছিল স্যার সৈয়দ আহমদ খানের? তিনি মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক দেশ আশা করেছিলেন?’

স্যার বললেন, ‘ঠিকই ধরছেন। ওইটা থেকে পাকিস্তান-দাবির বিষয়টি আসছে।’

১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ গঠন হয়েছিল বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। পরবর্তীকালে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব এবং ১৯৪৬ সালে দিল্লি প্রস্তাবে ‘স্টেটস’ থেকে ‘স্টেট’ হয়ে গেল। এ-বিষয়ে স্যার আমাকে বিস্তারিত বলেছিলেন।

বদরুদ্দীন উমর আমাকে বলেছিলেন, ‘রাজ্জাক স্যারকে আমরা সক্রেটিস বলতে পারি।’

আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘কেন?’

তিনি বললেন, ‘কিছু না লিখেও অন্যদের বিদ্যা ও জ্ঞান চর্চার জন্য স্যার উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর শিক্ষা ছিল সক্রেটিসের মতোই মৌখিক শিক্ষাপদ্ধতি।’

রাজ্জাক স্যার তাঁর একমাত্র লিখিত বক্তব্য দিয়েছিলেন ১৯৮০ সালে 888sport appয়, এর শিরোনাম ছিল ‘স্টেট অব দ্য নেশন’। ১৯৮১ সালে এটি প্রকাশিত হয়। সে-সময় আমি 888sport appয় ছিলাম এবং স্যারের বক্তব্য শুনতে পাই। এটা নিয়ে স্যারের সঙ্গে আমার আলোচনাও হয়। এ বক্তব্যে দুটি অংশ ছিল। একটি ছিল ‘ডিসকাশন অন ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্স’। সেখানে স্যার বলেছিলেন, 888sport appsের সম্পদ হচ্ছে এর ভূমি, জনগণ, কর্মী, ভৌগোলিক অবস্থান, নদীসমূহ এবং কৃষি ও উৎপাদনে তাদের প্রভাব। তিনি বলেছিলেন, এই নদীগুলোকে ভবিষ্যতের জন্য এমনভাবে ব্যবস্থাপনা করা উচিত যাতে এগুলোকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। কারণ আমরা জানি না কখন বন্যা হবে, কখন ফসল নষ্ট হবে।

বর্তমান সরকার প্রণীত ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ মূলত সেই ১৯৮০ সালে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক যা ভেবেছিলেন, তারই প্রতিচ্ছবি।

অর্থনীতি সম্পর্কে অধ্যাপক রাজ্জাক বলেছিলেন, 888sport appsের প্রধান সম্পদ হলো ভূমি ও পানি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজনীতিতে যে-বিভক্তি সৃষ্টি হলো সে সম্পর্কে রাজ্জাক স্যার তাঁর ‘স্টেট অফ দ্য নেশন’ বক্তৃতায় বলেছেন, ‘What holds us together makes us a nation is the exclusive passion to identify ourselves with this nation and nothing else. This, I believe, is what makes Bangabandhu the central figure of our time.’ তারপর তিনি আবার বললেন, ‘The difference between Bangabandhu on the one hand and Jinnah and Gandhi on the other. The window had forced an indivisible fusion between himself and the nation.’ এই বিষয়টি আমার কাছে খুব আশ্চর্য লেগেছিল। তিনি আরো যোগ করলেন, মধ্য এশিয়া বা মিডল ইস্ট থেকে অনেকে 888sport appsে আসত কীসের জন্য? 888sport apps একসময় বাণিজ্যে খুব উন্নত ছিল, সেজন্যই তারা লাভের উদ্দেশ্যে এদেশে আসত।

888sport apps সম্পর্কে অধ্যাপক রাজ্জাক আরো এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘Even in Bangladesh, size of family goes down as the income goes on increasing. Population is the problem, but also its largest asset for productivity purposes.’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘The conditions of citizens is very poor in Bangladesh.’ যারা গ্রাম থেকে আসে তাদের জন্য মানিয়ে নেয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। অধ্যাপক রাজ্জাক আরো বলেছেন, ‘Public expenditure and education was not adequate.’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ÔThere is discrimination between men and women, between rural and urban population.Õ ওই বক্তৃতায় তিনি আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, সেটা হলো, ‘Most of the southern, most of the South and Southeast Asian countries in the Middle East and also in Latin America, majority of the people in the developing world were under military rule in some form or other, for some period, however short the period is. Military rule is a disaster, particularly in the legacies it leaves. I think such foresight was incompatible. That is what happened in Bangladesh in the eighties and in the nineties.’

(জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠের আয়োজনে ২৯শে জানুয়ারি ২০২২ তারিখে বেঙ্গল 888sport live chatালয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অপ্রকাশিত অভিসন্দর্ভ Political Parties in India গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে প্রদত্ত বক্তৃতার বাংলা পাঠ)