মুনতাসীর মামুন
অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের ৯২তম জন্মদিনে (সরকারি হিসাবে ৯০) দৈনিক জনকণ্ঠে আমি দীর্ঘ এক পাতার একটি 888sport live লিখেছিলাম। তিনি এত খুশি হয়েছিলেন যে, আমার মন ভরে উঠেছিল।তখন তিনি ছিলেন উপমহাদেশের বয়োজ্যেষ্ঠ ঐতিহাসিক। কর্মচঞ্চল। আমাদের সমাজে ক্রমেই 888sport apk download apk latest version করার মতো মানুষ কমে যাচ্ছে। যাঁরা ছিলেন কোনো না কোনো সময় শ্রদ্ধেয়, তাঁরা জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এমন কিছু করছেন যে, 888sport apk download apk latest versionর ভিতটা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। বাংলা প্রবাদ তো শত শত বছরের জীবনচর্যার অভিজ্ঞতা। এ কারণেই সেই প্রবাদের সৃষ্টি – ‘সব ভালো তার শেষ ভালো যার’।
জন্মদিনের এক মাস পর তিনি চলে গেলেন নীরবে। আজীবন নীরবে নেপথ্যে কাজ করেছেন, কারো কাজে হস্তক্ষেপ করেননি, কেউ তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত হোক, তাও তিনি চাননি। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে মনে হয় চলে যেতেই চেয়েছিলেন। কারণ, তাঁর পরিবারে স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। চলে গেলেন নীরবে। ওই বাংলা প্রবাদটি তাঁর বেলায়ই খাটে। এত দীর্ঘদিন খুব কম বাঙালিই শ্রদ্ধেয় থেকেছেন। সমাজে যে-কজন শ্রদ্ধেয় এখনো আছেন, অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ চলে যাওয়ার পর শ্রদ্ধেয়র 888sport free betও হ্রাস পেল।
আমি তাঁর পিএইচডির প্রথম ছাত্র। আমি যখন 888sport app বিশববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি, তখন তিনি রাজশাহী থেকে চলে এসেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন পর যোগ দেন 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। শিক্ষকতা করতে হলে পিএইচডি করতে হয়। আমার বিভাগীয় শিক্ষকরা নানা টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিলেন। সালাহ্উদ্দীন স্যারের সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ পরিচয় ছিল। বিভাগে যোগ দিলে আমি সিদ্ধান্ত নিই, তাঁর অধীনেই পিএইচডি করব। কেননা, সামাজিক ইতিহাসের নির্মাতা হিসেবে তাঁর স্থান উচ্চে। তিনি যখন আমাদের বিভাগে আসেন তখন তাঁকে বহিরাগত হিসেবেই দেখা হতো এবং তাঁর যোগদানের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমি লক্ষ করেছি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একধরনের আঞ্চলিকতা কাজ করে। যোগ্যতা থেকেও আঞ্চলিকতা প্রাধান্য পায়, যে-কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন ইনসুলার হয়ে যাচ্ছে।
আমার পিএইচডির রূপরেখা বিভাগে জমা দেওয়ার পর অ্যাকাডেমিক কমিটিতে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এক্ষেত্রে একজন সিনিয়র শিক্ষক উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পিএইচডি আর পাঠ্যপুস্তকের তফাৎ আছে। এই বিষয় পাঠ্যপুস্তকের।’ আমার বিষয় ছিল উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সমাজ, যা নিয়ে আগে কোনো কাজ হয়নি। মিটিং শেষে দেখি স্যার খুবই বিমর্ষ। বিষয়টি তাঁকে আহত করেছিল। খানিকটা অপমানিতও বোধ করেছিলেন। আমি তাঁকে হেসে বলেছিলাম, আপনি এখানে নতুন এসেছেন। এখানকার হালচাল আপনার শিষ্ট জীবনচর্যার বিপরীত। তারা বাধ্য হবে আমার রূপরেখা অনুমোদন করতে। দুই সপ্তাহ পর, আগের রূপরেখাটিই জমা দিলাম। জানালাম, তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেছি। বিনা বাক্যব্যয়ে তা পাশ হয়ে গেল।
তিন বছরেরও কম সময়ে পিএইচডি শেষ করি। সাধারণত পিএইচডি ডিগ্রি পেতে বছরখানেক সময় লেগে যায়। আমার পরীক্ষক ছিলেন অধ্যাপক এ.আর মল্লিক ও ভারতের অধ্যাপক সুমিত সরকার। সালাহ্উদ্দীন স্যার ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাসতিনেকের মধ্যে আমার রিপোর্ট এনে দিয়েছিলেন। মাসছয়েকের মধ্যে আমি ডিগ্রি পেয়ে যাই।
ছাত্রের কল্যাণের প্রতি এই যে পিতৃত্বসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ এটি তাঁর মধ্যে সবসময়ই ছিল। আমার সৌভাগ্য যে, আমি পড়ার সময় ও কনিষ্ঠ শিক্ষক থাকার সময় যেসব শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছিলাম, তা আমার মনন উন্নয়নে সহায়তা করেছে। আর এখনকার ছাত্রদের দুর্ভাগ্য, তাঁরা আমাদের মতো শিক্ষক পেয়েছেন, যাঁরা মনন উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। আমি সেই শিক্ষকদের কথা এখনো সুখে-দুঃখে 888sport app download for android করি যেমন, জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার, অধ্যাপক সাদ উদ্দীন, অধ্যাপক হাশেম খান প্রমুখ। আমার সৌভাগ্য তাঁদের অনেকে বেঁচে আছেন এবং এখনো আমার শুভ কামনা করেন।
অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্মদকে আমরা পছন্দ করি কয়েকটি কারণে – তাঁর মানবিক গুণাবলি, ইতিবাচক মনোভাব, নীতির ক্ষেত্রে আপসহীনতা, ছাত্রদের প্রতি অসীম ভালোবাসা। ভদ্রবোধের, শুদ্ধবোধের চূড়ান্ত প্রতীক তিনি। এ-কারণে তাঁকে মাঝে মাঝে বিব্রত হতে হয়নি, তা নয়। আমাদের অনেক আচরণ যা মাঝে মাঝে ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করে, তাও তিনি স্মিত মুখে উপেক্ষা করেছেন।
স্যারের জীবনকাহিনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি না তাঁর জীবনসঙ্গিনী হামিদা খানমের কথা উল্লেখ করি। আমার এই গুরুপত্নী প্রয়াত হয়েছেন আগেই। তাঁর প্রস্থান স্যারের জীবন বর্ণহীন করে তুলেছিল। তাঁরা ছিলেন পরস্পরের পরিপূরক। তাঁদের দীর্ঘ দাম্পত্য-জীবনে কখনো কোনো কলহ হয়েছে কিনা সন্দেহ। অনবদ্য ভাষায় হামিদা খানম তাঁর আত্মজীবনী লিখে গেছেন – ঝরা বকুলের পথে। আমাকেও তিনি অতীব স্নেহ করতেন।
সালাহ্উদ্দীন স্যার এত নিভৃতচারী ছিলেন যে, তাঁর সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। আমি এখানে তাঁর জীবনের অসম্পূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরছি।
দুই
আবুল ফয়েজ সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের জন্ম ১৯২৪ সালে, ফরিদপুরের এক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে। কিন্তু তাঁর ছেলেবেলা, যৌবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। তাঁর বাবার ছিল বদলির চাকরি এবং অধিকাংশ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছিল পূর্ববঙ্গ ছেড়ে। তাই সালাহ্উদ্দীন আহ্মদকে পড়তে হয়েছিল বাঁকুড়া জেলা স্কুল, বিষ্ণুপুর হাইস্কুল এবং কলকাতার তালতলা হাইস্কুলে। শেষোক্ত এই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন ১৯৩৮ সালে। আইএ পাশ করেছিলেন রিপন কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৩ ও ১৯৪৪ সালে ইতিহাসে লাভ করেছিলেন স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
এখানে উল্লেখ্য, সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের দাদা ‘আহমদ’ও উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে লাভ করেছিলেন স্নাতক ডিগ্রি। তাঁর বাবাও ছিলেন শিক্ষিত। ফলে তৎকালীন সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্যে তাঁর ছেলেবেলা কাটেনি। অপেক্ষাকৃত উদার পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ছাত্রজীবনে উৎসাহবোধ করেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। পরে ঝুঁকেছিলেন বামপন্থী আন্দোলনের দিকে, তৎকালীন অনেক মুসলমান যুবার মতো সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে নয়। হয়তো তিনি যোগ দিতেন কমিউনিস্ট পার্টিতেই, যদি না ১৯৪০ সালে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হতো মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (এম.এন রায়)। এ-যোগাযোগ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এম.এন রায়ের যুক্তিবাদী ও বুদ্ধিবৃত্তিক মনন ও চিন্তা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর ভাষায়, ‘আকৃষ্ট হয়েছিলাম পলিটিকসে ইনটেলেকচুয়ালি।’
১৯৪১ সালে যোগ দিয়েছিলেন তিনি রায়ের ‘র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’তে। সক্রিয়ভাবে এ-সময় তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনীতিতে। ১৯৪২-৪৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন তিনি ‘তিলজলা ইন্ডিয়ান সাইকেল ইউনিয়নে’র সভাপতি এবং ‘কলকাতা পোর্ট কমিশনারস শ্রমিক ইউনিয়নে’র সহকারী সম্পাদক। ১৯৪৫ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ‘অল বেঙ্গল পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ইউনিয়নে’র। ট্রেড ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর কাছে একধরনের শিক্ষার মতো।
১৯৪৬ সালে, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময়ে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দাঙ্গা রোধ ও দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যকল্পে যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় রেড ক্রসে। রায়ের লেখা পড়ে আগে ছিলেন তিনি গান্ধীবিরোধী, কিন্তু দাঙ্গার সময় গান্ধীর কর্মকান্ড এবং নোয়াখালী সফর তাঁকে করে তুলেছিল গান্ধীভক্ত। তাঁর মনে, গান্ধীর যে-দিকটা তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল তা হলো, সর্বধর্মের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা। তাই বলে, রায়ের ‘র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম’ যে তিনি একেবারে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তা নয়।
পাকিস্তান হওয়ার পর চলে এসেছিলেন তিনি 888sport appয়, এবং যোগ দিয়েছিলেন জগন্নাথ কলেজে শিক্ষক হিসেবে। এ-সময় তিনি এবং তাঁর কলকাতার কিছু বন্ধু – যাঁরা প্রায় একইসঙ্গে চলে এসেছিলেন 888sport appয়, যেমন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং হাবিবুর রহমান – সবাই মিলে গঠন করেছিলেন ‘র্যাশনালিস্ট ক্লাব’। শুধু তা-ই নয়, এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তি নামে একটি সাময়িকপত্রও।
১৯৪৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা করেছেন জগন্নাথ কলেজ, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, 888sport app, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাস পরিষদ, এশিয়াটিক সোসাইটি প্রভৃতি বিদ্বৎসভার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। গবেষণা-পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে 888sport slot game করেছেন এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য 888sport apps সরকার দেশের সর্বোচ্চ পদক 888sport cricket BPL rateে পদক (১৯৯১) ও স্বাধীনতা পদকে (১৯৯৯) তাঁকে ভূষিত করেছে। তিনি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। তাঁর স্ত্রী হামিদা খানমও ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তাঁরা দুজনই এখন পরলোকে। বলা যেতে পারে, এটিই সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের পরিপূর্ণ জীবনবৃত্ত।
অধ্যাপক আহ্মদ দীর্ঘসময় শিক্ষকতায় যুক্ত থেকেছেন এবং এই সময়ে বিভিন্ন সরকার তাঁকে উচ্চপদে (উপাচার্য বা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান) নিয়োগ করতে চেয়েছে। কিন্তু সবসময় তিনি এসব পদের মোহ প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সাধারণ একজন শিক্ষক হিসেবেই জীবনযাপন করতে চেয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে সহজ, নির্লোভ এবং নিপাট ভদ্রতার প্রতীক তিনি। আমাদের সমাজে, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির একজন সদস্যের পক্ষে জীবনের বিভিন্ন প্রলোভন ত্যাগ করে নিজ লক্ষ্যে থাকা কম কথা নয়। ‘সিম্পল লিভিং’ এবং ‘হাই থিংকিং’য়ে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর এই জীবনচর্যার ছাপ আমরা দেখি তাঁর বিভিন্ন রচনায়। বস্ত্তত তাঁর জীবনচর্যা, এর ফলে সৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও রচনার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। তাঁর জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, বাল্য ও যৌবনের পরিবেশ তৈরি করেছে তাঁর মনোজগৎ, যা নাগরিক, সাংস্কৃতিক ও যুক্তিবাদী এবং উদার মানবতাবাদী।
বলা যেতে পারে, ১৯৪৮ সালে জগন্নাথ কলেজে যোগ দেওয়ার সময় থেকেই সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের ইতিহাস-চর্চা শুরু। বহুলপ্রজ তিনি নন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি রচনা করেছেন প্রায় ২৫টি গ্রন্থ। কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনাও করেছেন। গত এক দশকে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে 888sport liveও লিখেছেন, যার কিছু কিছু আবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ওইসব গ্রন্থে।
তাঁর গবেষণার আগ্রহের বিষয় উনিশ শতকের বাংলা। পত্র-পত্রিকায় যেসব 888sport live লিখেছেন তার অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে। তবে, উনিশ শতকের গবেষণাই হোক বা বর্তমান শতক নিয়ে রচনাই হোক – সবকিছুতে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। সেটি হচ্ছে, মানবিকতা ও সব সংস্কৃতির সমন্বয়। তিনি একটি কথাই বারবার বলতে চেয়েছেন, তা হলো, উপমহাদেশের মানুষকে অবশ্যই সমন্বয়ের সংস্কৃতির ধারক-বাহক হতে হবে, না হলে তার পক্ষে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়।
সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ পিএইচডি করেছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাফল্যের সঙ্গে তিনি ষাটের দশকে অধ্যাপক বলহ্যাচেটের তত্ত্বাবধানে ‘সোশ্যাল আইডিয়াজ অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল (১৮১৮-১৮৩৫)’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আশির দশক পর্যন্ত তাঁর পুরনো গবেষণাকে ভিত্তি করেই আরো কিছু 888sport live লেখেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলো তাঁর অভিসন্দর্ভের কোনো না কোনো অংশ বা চিন্তার বিস্তৃতি। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই বৃত্ত থেকে তাঁর পক্ষে বেরোনো সম্ভব হয়নি। তিনি সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠেন গত শতকের নববইয়ের দশকে। এ সময় পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। বেশকিছু গবেষণা-888sport liveও রচনা করেন। সেগুলোর কিছু নিয়ে গত এক দশকে তাঁর বেশকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে (সম্পাদিত গ্রন্থসমূহ বাদে)। শ্রেণিকরণ করলে তাঁকে সামাজিক ঐতিহাসিকই বলতে হবে।
সামাজিক ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর খ্যাতির ভিত্তি পরবর্তী গ্রন্থসমূহ নয়, বরং প্রথম গ্রন্থটি। ১৯৬৫ সালে লাইডেন থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ঐতিহাসিক হিসেবে দেশে-বিদেশে তিনি যে-খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তার রেশ এখনো মুছে যায়নি।
কিন্তু এর কারণ কী? গ্রন্থটির গুণগত মান ও উৎকর্ষের কথা পরম নিন্দুকও অস্বীকার করবে না। তবে এর অন্য একটি দিক আছে। সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ যে-সময়ে এ-অভিসন্দর্ভটি রচনা করতে লন্ডন গিয়েছিলেন, সে-সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব গবেষক সেখানে গিয়েছিলেন, তাঁরা গবেষণার বিষয়বস্ত্ত হিসেবে মুসলমান সম্প্রদায়কেই বেছে নিয়েছিলেন। এর একটি কারণ হতে পারে যে, পাকিস্তানি হিসেবে হয়তো তৎকালীন শাসকদের ধ্যান-ধারণা বা আদর্শ তাঁদের খানিকটা প্রভাবিত করেছিল, অথবা লন্ডনের ইংরেজ গবেষণা পরিদর্শকদের কাছে বিষয়টি মনে হয়েছিল নতুন। কিন্তু সালাহ্উদ্দীন আহ্মদই বোধহয় তাঁর সমসাময়িক পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে প্রথম, যিনি তত্ত্বাবধায়কের দেওয়া এ-ধরনের কোনো বিষয়ের ওপর কাজ করতে অস্বীকার করেছিলেন এবং বিষয় হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটির বিষয় বেছে নিয়েছিলেন। হয়তো তাঁর মনে হয়েছিল, শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর অভিসন্দর্ভ রচনা সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারে। ফলে, গুণগত উৎকর্ষের কথা বাদ দিলেও ওই সময়ে একজন মুসলমান ঐতিহাসিকের এ-ধরনের রচনা সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
তিন
সোশ্যাল আইডিয়াস অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল (১৮১৮-৩৫) প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল লাইডেন থেকে ১৯৬৫ সালে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এর দ্বিতীয় সংস্করণ।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সমাজজীবনে যে-পরিবর্তন হয়েছিল তার কয়েকটি দিক আলোচনা করা হয়েছে এ-গ্রন্থে। ১৮১৮ থেকে ১৮৩৫ সালের মধ্যে প্রাধান্যবিস্তারকারী আদর্শ, তা গড়ে ওঠার কারণ এবং সরকারি নীতিতে এর প্রতিক্রিয়া – এককথায় সংস্কার আন্দোলনসমূহের সূত্রপাত, শিক্ষার বিস্তার এবং সবশেষে ভারত বিভাগ – এ সবকিছুর মূল খোঁজার চেষ্টা করেছেন সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ এ-গ্রন্থে।
বইটি বিভক্ত দুটি অধ্যায়ে। ভূমিকায় তিনি পুরো বইটির মূল বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, উনিশ শতকের প্রথমার্ধ ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ-সময় পাশ্চাত্যের অভিঘাত চ্যালেঞ্জ হেনেছিল দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থায়। ওই সময় এ-চ্যালেঞ্জ যেমনভাবে অনুভূত হয়েছিল, প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করেছিল তেমনি। ওই সময়ই সংস্কারের বার্তা নিয়ে আবির্ভাব ঘটেছিল রামমোহনের মতো ব্যক্তিত্বের। আবার তখনই মুসলমান সমাজের একাংশ, মূলত কৃষিজীবী যাঁরা, জড়িয়ে পড়েছিলেন তিতুমীরের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় আন্দোলনে। মুসলমান সম্প্রদায়ের পরবর্তী বিকাশে এ-আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল অভিঘাতের।
ভারতীয় প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরনো ভারতীয় স্বৈরাচারের ঐতিহ্যই অব্যাহত রেখেছিল। তবে কিছু গভর্নর জেনারেল যেমন হেস্টিংস (১৮১৩-২২) বা বেন্টিংকের (১৮২৮-৩৫) উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উৎসাহ জুগিয়েছিল নতুন আদর্শ বিকাশে। বিশেষ করে জনমত বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়তা করেছিল বেন্টিংক-প্রশাসন।
ভারতে বসবাসকারী সাধারণ ইংরেজ, যেমন মিশনারি ও অবাধ বাণিজ্যের প্রবক্তা ব্যবসায়ীরা নতুন আদর্শ বিস্তারে সাহায্য করেছিল, যা আবার পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল সামাজিক পরিবর্তনে। নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক আদর্শে জুগিয়েছিল উৎসাহ, তবে মুসলমানদের ‘সেপারিটজমে’র ভিত্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন, যার মূল কারণ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি দুই সম্প্রদায়ের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া।
উপসংহারে সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ লিখেছেন, ইংল্যান্ডের সংস্কার আন্দোলন, বিশেষ করে ‘ফ্রি ট্রেডার্স’দের, বাংলার সামাজিক-অর্থনৈতিক বিকাশে প্রচন্ড অভিঘাত এনেছিল। উপযোগবাদ ও মিশনারিদের প্রভাব বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সমাজসচেতনতা সৃষ্টিতে ছিল সহায়ক এবং এভাবে একইসঙ্গে সংস্কার ও প্রতিক্রিয়া-সংক্রান্ত মতামত সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিল। ওই সময়ের জনমত মানে প্রধানত শহুরে উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির অভিমত।
তাঁর মতে, জনমতে যে ভাবনাচিন্তা প্রতিফলিত হয়েছিল, তা-ই পরবর্তীকালে উপমহাদেশের ইতিহাস রচনায় সহায়তা করেছিল। পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়েই এগুলো বিকশিত হয়েছিল এবং অর্জন করেছিল অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য। বলতে গেলে, এসব আদর্শ পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধেই শুধু নয়, পাশ্চাত্যের চিন্তা ও সংস্কৃতিতে সৃষ্টি করেছিল এক ধরনের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ, হিন্দু পুনর্জাগরণ এবং ধর্মনিরপেক্ষ চরমপন্থী – এসব মিলেই নির্মিত হয়েছে উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যেগুলো ছিল বাংলায় ভ্রূণাবস্থায়।
সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের সমসাময়িক যাঁরা সামাজিক ইতিহাস রচনা করেছেন, তাঁরা প্রায় সবাই সমাজকে বিচার করেছেন খন্ডিতভাবে; অনেক ক্ষেত্রে একটি সম্প্রদায়ের ওপরই তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের গ্রন্থের শিরোনাম দেখে ধরে নেওয়া যায়, সামগ্রিকভাবে তিনি সমাজকে বিচার করতে চেয়েছেন।
বিশ শতকের শুরুতে, ভারতবর্ষে ইতিহাস রচনায় খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিল। পূর্ববর্তী সিভিলিয়ান বা ঐতিহাসিকদের রচনার সঙ্গে ছিল এই পার্থক্য। ভট্টাচার্যের ভাষায়, নতুন এই ফ্রেম ছিল ‘জাতীয় জাগরণের’ এবং এর বৈশিষ্ট্য ছিল ১. পাশ্চাত্য আদর্শ গ্রহণকারী এবং ইন্স্টিটিউশন হলো পরিবর্তনের ক্রিয়াশীল উপাদান (active agent), ২. বাংলার ‘রেনেসাঁসে’র ওপর গুরুত্ব, ৩. উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক-সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষের যুক্তকরণ।
পঞ্চাশের দশকে, রমেশচন্দ্র মজুমদার, কে.কে দত্ত, রায় চৌধুরী প্রমুখ যখন বাংলার (বা ভারতের) ইতিহাস রচনা করলেন, তখন ইংরেজি শিক্ষা এবং পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক আদর্শের গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সমাজ পরিবর্তন বা সংস্কারের কারণ হিসেবে দেখালেন, ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে অগ্রগামী ভারতীয় সংস্কারকদের সহযোগিতা। এটি ছিল ভারতীয় মনে ঔপনিবেশিক প্রভাব দূর করার আদর্শগত লড়াইয়ের একটি অংশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল অতীতের ‘স্বর্ণযুগে’র ওপর গুরুত্ব আরোপ।
কিন্তু এই ‘জাতীয় জাগরণ বা রেনেসাঁস’ ঔপনিবেশিক ইতিহাস-চর্চার প্রভাব পুরোপুরি এড়াতে পারেনি। উনিশ শতকী ইতিহাস-চর্চা (যেমন ব্রিটেন ভারতকে ক্রমে নিয়ে গেছে প্রগতির পথে) এই সময়ে (বা পরবর্তীকালে) উপরোক্ত ফ্রেমের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে গেল এবং বিলেতে যাঁরা গেলেন ডিগ্রি নিতে তাঁদেরও ওই ফ্রেম এগিয়ে দেওয়া হলো।
সালাহ্উদ্দীন আহ্মদকেও ফ্রেম নিতে হয়েছিল (যেমন বিদেশি সরকারের ভূমিকার বদলে ব্যক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ) এবং তাঁর তত্ত্বাবধায়ক কেনেথ বলহ্যাচেটের ভূমিকাও ছিল এক্ষেত্রে প্রধান। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে বলহ্যাচেটের বইয়ের নাম Social Policy and Social Change in Western India, 1817-1830 (London, 1961)।
অধ্যাপক আহ্মদের তথ্য-ব্যবহারেও ওই সময়ের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তা হলো, ইংরেজ প্রশাসনিক দলিলপত্রের (যা এখনো অনেকে মনে করে ইতিহাস রচনার প্রধান উপাদান) ওপর নির্ভরশীলতা। নির্বিচার এ-ধরনের তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের Social Ideas and Social Change in Bengal একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বইটির উৎকর্ষ এখনো অনেক গ্রন্থ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
সোশ্যাল আইডিয়াস অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল (১৮১৮-৩৫) প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল লাইডেন থেকে ১৯৬৫ সালে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এর দ্বিতীয় সংস্করণ। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বাঙালি সমাজ ও পাশ্চাত্যের অভিঘাত’। এ-অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, ইংরেজরা শাসক হলো ঠিকই কিন্তু ভারতীয় ও ইংরেজরা বিপরীত মেরুতে বসবাস করতে পারেনি। ব্যবসা ও প্রশাসনিক সম্পর্ক দুটি ভিন্ন জাতিকে ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল। প্রসঙ্গক্রমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রায়তদের ওপর চরম অবিচার করলেও বাংলার সমাজে তা একধরনের স্থায়িত্ব (stability) দিয়েছিল।
তিনি লিখেছেন, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের বিকাশ বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর মতে, প্রধানত জমিদারি ও ব্যবসা, (বিশেষ করে ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্কের ফলে) বাংলার শহুরে সমাজের জমিদার, ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকার তথা উচ্চশ্রেণির সৃষ্টি করেছে। এর নিচে ছিল বিভিন্ন পেশাগত গ্রুপ এবং এরাই ছিল মধ্যশ্রেণির মূল। এবং উল্লেখযোগ্য হলো, শুধু জন্মসূত্রেই নয়, সম্পদের ভিত্তিতেও অর্জন করা যেত আভিজাত্য।
উনিশ শতকের শুরুতে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অবাধ বাজারে সম্পত্তির অধিকার প্রাচীন বর্ণপ্রথায় সৃষ্টি করেছিল সচলতা। শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতার ফলে সাধারণভাবে সম্পদের মালিক হওয়া ছিল সম্ভব। কলকাতা তথা বাংলার ‘Indigenous social leadership’-এর আসল ভিত্তি তখন উত্তরাধিকার বা বর্ণ ছিল না।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালি সমাজ ছিল ‘Melting pot’। নৈতিকমান ছিল নিচু এবং গত শতাব্দীর রাজনৈতিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল সামাজিক বিশৃঙ্খলা।
ইংরেজ শক্তির প্রতিষ্ঠা শুধু নতুন রাজনৈতিক শক্তিই নয়, সঙ্গে এনেছিল পাশ্চাত্যের নতুন কিছু আদর্শ, যা বাঙালি সমাজে সৃষ্টি করেছিল গভীর প্রতিক্রিয়ার। মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক, কারণ তারা মনে করেছিল, ইংরেজরা তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে ক্ষমতা। এ-সময়ে মুসলমান ইংরেজদের সম্পর্কে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পারস্পরিক সন্দেহ। ক্ষমতা হারিয়ে মুসলমানরা সান্ত্বনা খুঁজেছিল ধর্মে। এ পরিপ্রেক্ষিতে উনিশ শতকের বেশির ভাগ সময়জুড়ে হয়েছিল কৃষক-বিদ্রোহ। এবং উল্লেখ্য যে, এগুলো প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল নিম্নবর্গের মধ্যেই। নিম্নবর্গ ছিল একধরনের ধর্মান্ধ প্রচারের শিকার। এ-পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লিখেছেন, তিতুমীর ও দুদু মিয়ার আন্দোলন ছিল সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয়। সাম্প্রদায়িক হওয়ার কারণ, জমিদার ছিল হিন্দু এবং রায়তরা ছিল মুসলমান।
সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের মতে, ইংরেজ প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপ্রত্যক্ষ ফল দেশীয় 888sport live footballের বিকাশ। এ-অধ্যায়ের উপসংহারে তিনি বলছেন, পাশ্চাত্যের অভিঘাত ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সমাজে সৃষ্টি করেছিল ফাটল। এই অভিঘাত যেমন বিভিন্নমুখী, প্রতিক্রিয়াও তাই। নতুন ভূস্বামী, ব্যবসায়ী, নতুন শিক্ষা-আন্দোলন – সবকিছু মিলে তৈরি করেছিল নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘কনজারভেটিভস অ্যান্ড রিফর্মার্স’। এ-অধ্যায়ে তিনি সামাজিক সংস্কার নিয়ে রক্ষণশীল ও সংস্কারবাদী দ্বন্দ্বের কথা আলোচনা করেছেন। লিখেছেন তিনি, পাশ্চাত্যের শাসন অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল পাশ্চাত্যকরণ। ফলে হিন্দুসমাজ মুখোমুখি হয়েছিল এমন এক চ্যালেঞ্জের যার মুখোমুখি আগে সে কখনো হয়নি। এ-চ্যালেঞ্জ ছিল, ‘as much from without as from within’। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি হিন্দু সমাজে সৃষ্টি হয়েছিল তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া – রক্ষণশীল, যারা বিশ্বাসী ছিল স্থিতাবস্থায় এবং এ-দলের নেতা ছিলেন রাধাকান্ত দেব : সংস্কারপন্থী বা মধ্যপন্থী, যার নেতা ছিলেন রামমোহন রায় এবং চরমপন্থী, যার নেতা ছিলেন মূলত ডিরোজিও এবং ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠী।
হিন্দুরা ইংরেজ শাসনকে বিদেশি আধিপত্যের আরেক যুগ বলে মেনে নিয়েছিল। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থান পরিবর্তন না করে (সমঝোতা) বিদেশি সরকার থেকে যতটুকু সুবিধা পাওয়া যায় তা আদায় করা। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করেছিল তারা, কিন্তু ইংরেজ ধ্যান-ধারণা গ্রহণে ছিল ভীত। এই পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ ও অন্যদিকে সামাজিক রক্ষণশীলতা হিন্দু রক্ষণশীলতার মধ্যে সৃষ্টি করেছিল বৈপরীত্যের, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাধাকান্ত দেব।
সংস্কারপন্থী বা মধ্যপন্থী নেতা রামমোহন বিশ্বাস করতেন তর্কে, ‘ব্যারিকেডে’ নয়। ‘ইয়ং বেঙ্গল’রা নিজেদের অভিহিত করত উদারনৈতিক হিসেবে। এদের লড়াই ছিল মূলত রক্ষণশীলদের সঙ্গে, যাদের ভিত নড়বড়ে করতে সাহায্য করেছিলেন রামমোহন রায়। বাংলার সংস্কার-আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়েছিল মধ্যপন্থী ও চরমপন্থীদের অন্তঃকলহের ফলে। এছাড়া বয়স ছিল চরমপন্থীদের বিপক্ষে (অর্থাৎ তাদের আচার-আচরণকে শিশুসুলভ মনে করা হতো)।
এভাবে অন্তিমে দেখা যায়, রক্ষণশীলরাই জিতেছে। তারাই পেরেছিল জনসমর্থন অর্জন করতে। তাদের জোর এমনই ছিল যে, সতীদাহের মতো একটি প্রথা লুপ্ত করতে হয়েছে বিদেশি সরকারের ওপর থেকে। সামাজিক সংস্কারের বিপক্ষে থাকলেও শিক্ষাবিস্তারে অবদান রেখেছিল রক্ষণশীলরা।
গ্রন্থের তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম – ‘দি বেঙ্গল প্রেস : অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’ এবং ‘দি বেঙ্গল প্রেস : ভার্নাকুলার অ্যান্ড পার্সিয়ান’। এ দুটি অধ্যায়ে তিনি ওই সময়ের (১৮১৮-৩৫), ইংরেজি ও দেশীয় ভাষার সাময়িকপত্রের বিকাশ ও প্রভাব এবং সরকারি নীতি নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। প্রথম দিকে কোম্পানি সংবাদপত্রসমূহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তাদের বিকাশ রোধ করা সম্ভব হয়নি। সংবাদপত্র সহায়তা করেছিল জনমত বিকাশে আবার সংবাদপত্র বিকাশে সাহায্য করেছিল শহুরে শিক্ষিত শ্রেণি ও আন্তর্জাতিক এবং বহির্বাণিজ্য। জনমতের বিভিন্ন ধারা প্রতিফলিত হতো সংবাদপত্রে।
১৮৩৫-এর মধ্যে দেখি হিন্দু উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির মতামত প্রতিফলিত হচ্ছে দেশীয় সংবাদপত্রে। এদের মতামত সংহতকরণেও সাহায্য করেছিল সংবাদপত্র। তবে যেখানে ভারতীয় কর্তৃত্বাধীন ইংরেজি পত্রিকাগুলো ছিল সংস্কারপন্থী, সেক্ষেত্রে দেশীয় ভাষার পত্রিকাগুলো ছিল রক্ষণশীল। সংস্কারবাদী ও রক্ষণশীলদের লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিল শেষোক্তরা এবং এটিই ওই সময়ের ঝোঁক প্রকাশ করে। কারণ, লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারেও সংস্কারপন্থীদের মধ্যে যেরূপ বিরোধ ছিল, রক্ষণশীলদের মধ্যে তা ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের ঝোঁক মূলত থেকে গিয়েছিল রক্ষণশীল এবং সংবাদপত্রেও তা-ই প্রতিফলিত হয়েছিল।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম – ‘দি গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক ওপিনিয়ন : দি রিঅ্যাকশন টু সোশ্যাল পলিসি’ এবং ‘দি গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক ওপিনিয়ন : দি রিঅ্যাকশন টু এডুকেশন পলিসি’। সরকারের সমাজ ও শিক্ষানীতি এবং এ-পরিপ্রেক্ষিতে জনমতের ধারা নিয়ে আলোচনা করেছেন সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ দুটি অধ্যায়ে।
তিনি লিখেছেন, জমিদারদের সঙ্গে যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, সে-ব্যাপারে ১৮১৮-এর মধ্যে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষ করা করা গিয়েছিল। এ-সময়ের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, কৃষকদের ওপর জমিদারদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুরুবিব হয়ে ইউরোপীয় ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কথা বলা। কিন্তু নিজেদের স্বার্থের সময় রক্ষণশীল এবং উদারনৈতিকরা আবার একত্রে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। সরকারের রাজস্বনীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে জমিদারশ্রেণি সচেতন হয়ে গঠন করেছিল ‘বেঙ্গল ল্যান্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন’। এবং সরকারও জমিদারদের স্বার্থে নীতি পরিবর্তন করেছিল। এর কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে ইন্ডিয়া হাউসের একজন কর্মকর্তা থমাস লাভ পিককের ভাষ্যে (১৮৩৪) – ‘… তরবারির জোর আমাদের যতদিন, ভারতে আমাদের সাম্রাজ্যের আয়ুও ততদিন আমাদের সামরিক শক্তিতে… সহায়তা করবে জনমতের একটি অংশ এবং তা জমিদারদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে আমাদের স্বার্থের সঙ্গে যাদের স্বার্থ অভিন্ন। এছাড়া, জনমতের কোনো অংশ আমাদের সহায়তা করবে না।’
সরকার হিন্দুদের ধর্মীয় সামাজিক ব্যাপারে প্রথমে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। কেউ কেউ (প্রশাসনিক কর্মকর্তা) প্রথমদিকে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল মানবিক কারণে। সতীদাহ দমনের (১৮২৯) পর স্বাভাবিকভাবেই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ ও মধ্যপন্থীরা তা সমর্থন করেছিল কিন্তু অপরদিকে রক্ষণশীলরা ‘did not react violently’, তাদের প্রতিবাদ সীমিত ছিল আবেদন বা স্মারকপত্রের মধ্যে এবং এক্ষেত্রেও সবসময় তারা নিজেদের উল্লেখ করেছিল অনুগত প্রজা হিসেবে। সতীদাহ আবার অন্যদিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে তুলেছিল রক্ষণশীলদের। যারা একই সঙ্গে সরকারি নীতির প্রতিবাদ করেছিল, সরকারি আনুকূল্য লাভ করেছিল। সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের ভাষায় – ‘This dual policy served to strengthen their hold upon Hindu society. later in the next decades, through the rapid growth of education. Hindu conservatism evolved a rational more in accord with the social ideas of the age. But it could not completely get away from the contradictions the lurked within it. The result was the rise of a Hindu revivalist movement which was to play an important part in the development of Indian nationalism.’ (p. 146)।
তবে এখানে লক্ষণীয় যে, জাতীয়তাবাদী ধারণা যদিও তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি, তবু দেখা গেছে ক্ষেত্রবিশেষে আবার বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ‘sections’ ঐক্যবদ্ধভাবে মতামত প্রকাশ করত ইংরেজ শাসনতান্ত্রিক নীতি অনুসারে। এর একটি উদাহরণ ১৯২৬ সালের ‘জুরি অ্যাক্ট’।
এছাড়া ষষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি দীর্ঘ আলোচনা করেছেন শিক্ষা বিষয়ে ‘অ্যাংলিসিস্ট’ ও ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’দের বিতর্ক নিয়ে।
চার
সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের উপর্যুক্ত গ্রন্থ পাঠকদের মনে কিছু প্রশ্ন তুলতে পারে। প্রথমে অধ্যায় হিসেবে, তারপর সামগ্রিকভাবে গ্রন্থটির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করা যেতে পারে।
প্রথম অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, ইংরেজরা শাসক হলেও ভারতীয় ও ইংরেজরা বিপরীত মেরুতে বসবাস করতে পারেনি, পারস্পরিক আদান-প্রদান তাদের ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? সামান্য কয়েকজন ইংরেজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মাত্র গুটিকয় উচ্চবর্গের বাঙালির। তাও সে-সম্পর্কের ভিত্তি ছিল অনুকম্পা (শাসক কর্তৃক শাসিতের প্রতি)। বাংলার 888sport free betগরিষ্ঠের সঙ্গে ইংরেজদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্ক যা ছিল তা হলো, শাসক-শাসিতের বা প্রভু-ভৃত্যের।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা এ-অধ্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করলেও তেমন গুরুত্বসহকারে তিনি তা আলোচনা করেননি। ওই সময়কালের বাংলার সমাজের অধিকাংশ ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই বন্দোবস্তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
তিনি এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রায়তদের ওপর চরম অবিচার করলেও সমাজে একধরনের স্থায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সমাজে একশ্রেণির ওপর অবিচার সমাজে স্থায়িত্ব (stability) এনে দেয় কীভাবে? বরং তা সমাজের অভ্যন্তরে সৃষ্টি করে একধরনের অসন্তোষের, যার বিস্ফোরণ সময় সময় ঘটতে বাধ্য। এর প্রমাণ, গোটা উনিশ শতক ধরে বাংলার অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ।
তাঁর মতে, প্রধানত জমিদারি এবং ব্যবসা, বিশেষ করে ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্কের ফলে জমিদার, ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকাররা শহুরে উচ্চবর্গের সৃষ্টি করেছিল। পেশাগত গ্রুপগুলো মধ্যশ্রেণির কেন্দ্রমূল। তার শ্রেণিবিভাজনে অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে। জমিদার ও ব্যবসায়ী ঠিক এক শ্রেণিভুক্ত ছিল না। আভিজাত্যের প্রতীক শুধু সম্পদই ছিল না, যদি না এর সঙ্গে যুক্ত হতো জমিদারি। যেমন, 888sport appর নবাব গনি বা তাঁর চাচা আলিমুল্লাহ। চামড়া এবং 888sport app ব্যবসায়ে তাঁরা যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু জমিদারি কেনার পূর্ব পর্যন্ত আভিজাত্য অর্জনে সমর্থ হননি। এর একটি মনস্তাত্ত্বিক দিকও বোধহয় ছিল। জমিদার ছিলেন কয়েক হাজার প্রজার দন্ডমুন্ডের কর্তা বা ‘মা-বাপ’। স্বভাবতই ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও জমিদার এক পর্যায়ভুক্ত হতে পারে না।
এ-অধ্যায়েই সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ উল্লেখ করেছেন, তিতুমীরের বা ফরায়েজী আন্দোলন ছিল ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক। তাঁদের সংগ্রামকে উল্লেখ করেছেন তিনি ‘plundering raids’ হিসেবে। বলেছেন, এঁদের আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল নিম্নবর্গের মধ্যে।
এ-কথা ঠিক যে, এ-আন্দোলন নিম্নবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং তা-ই স্বাভাবিক। কারণ, বাংলার অধিকাংশ মানুষের জীবিকাই ছিল জমির ওপর নির্ভরশীল এবং এ-অসন্তোষের মূল কারণ খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে, যে-কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এগুলো ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ। প্রাথমিকভাবে হয়তো রায়তদের ধর্মবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু যখন আমরা লক্ষ করি, রায়তদের কাছে হিন্দু-মুসলমান বা ইংরেজ জমিদারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই বা বিদ্রোহী রায়তদের মধ্যে যখন হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই আছে, তখন একে সাম্প্রদায়িক বলি কীভাবে?
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ ও অন্যদিকে সামাজিক রক্ষণশীলতা দুয়ে মিলে হিন্দু রক্ষণশীলদের মধ্যে বৈপরীত্যের সৃষ্টি করেছিল, যার উদাহরণ রাধাকান্ত দেব। ‘চরমপন্থী’ রাজনারায়ণ কি পরবর্তীকালে সনাতন হিন্দু ধর্মে আশ্রয় খোঁজেননি? বৈপরীত্য ছিল প্রথম দুই শ্রেণির মধ্যেই, কিন্তু এখানে এর এবং কেন এই বৈপরীত্য, তার সঠিক উত্তর মেলে না।
পঞ্চম অধ্যয়ে এর জের টেনে তিনি লিখেছেন, নিজেদের স্বার্থের সময় রক্ষণশীল ও উদারনৈতিকতা আবার জোট বেঁধে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। কেন? এর উত্তর নেই। এ ধরনের অনেক প্রশ্নেরই উত্তর এ-গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় না; কারণ, গ্রন্থকার সমাজ নিয়ে আলোচনা করার আগে সমাজ গঠন নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি। তিনি গ্রন্থের অনেক ক্ষেত্রে নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমূল পরিবর্তন বা বিপ্লব না হলে তা কীভাবে সম্ভব?
সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের সমসাময়িক যাঁরা সামাজিক ইতিহাস রচনা করেছেন, তাঁরা প্রায় সবাই সমাজকে বিচার করেছেন খন্ডিতভাবে; অনেক ক্ষেত্রে একটি সম্প্রদায়ের ওপরই তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের গ্রন্থের শিরোনাম দেখে ধরে নেওয়া যায়, সামগ্রিকভাবে তিনি সমাজকে বিচার করতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর গ্রন্থ পড়লে মনে হয় না ১৮১৮-৩৫ সালের মধ্যে বাংলায় বা কলকাতায় মুসলমান বলে কোনো সম্প্রদায় ছিল। সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমানরা পিছিয়ে থাকলেও যে ওই সময়ে একেবারে গুরুত্বহীন ছিল তা বোধহয় ঠিক নয়। আনিসুজ্জামান তাঁর মুসলিম-মানস ও বাংলা 888sport live footballে (888sport app, ১৯৬৪) উল্লেখ করেছেন, ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। ‘পরবর্তী বছরে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা স্কুল সোসাইটির দেশীয় সদস্যদের মধ্যে প্রথমে মুসলমান ছিলেন অধিক, পরে হিন্দু ও মুসলমান সদস্য 888sport free bet সমান করা হয়। সোসাইটি-পরিচালিত স্কুলসমূহে মুসলমান ছাত্রেরা হিন্দুর তুলনায় 888sport free betয় কমে হলেও পড়াশোনা করত। এমনকি, এ যুগে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা লাভও অজানা ছিল না।’ (পৃ ৩০-৩১) নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের গ্রন্থ কলকাতার হিন্দু উচ্চবর্গের ইতিহাস বা বলা যেতে পারে, তাঁর গ্রন্থ কলকাতার হিন্দু উচ্চবর্গের ভাবনার জগতের ইতিহাস।
এ-গ্রন্থে সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের ভাষায়, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সমাজে পরিবর্তনের কয়েকটি দিক, আধিপত্য বিস্তারকারী আদর্শ এবং সরকারি নীতিতে এর প্রতিক্রিয়া-প্রবৃত্তিই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, সমাজ পরিবর্তন বলতে তিনি কী বোঝাচ্ছেন? ‘আধুনিকীকরণ’ এবং ‘পরিবর্তন’ কি এক? তিনি যেগুলোকে ‘সোশ্যাল আইডিয়াজ’ বলছেন সেগুলো কি পাশ্চাত্য থেকে ধার করা? বা ‘সোশ্যাল আইডিয়াজ’ কীভাবে পরিশ্রুত হয়? এ-বিষয়ে তাঁর আলোচনায় প্রধানত দুজন ব্যক্তি রামমোহন ও রাধাকান্ত ঘুরেফিরে এসেছেন। তার মানে, ‘সোশ্যাল আইডিয়াজ’ ও কয়েকজন ব্যক্তি সমার্থক? সবচেয়ে বড় কথা, সামাজিক ইতিহাস হলেও তাঁর গ্রন্থে সমাজ গঠন সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই। এবং উত্তর পাওয়া যায় না এসব প্রশ্নেরও।
এর অন্য একটি দিকও আছে, যা উপেক্ষা করার মতো নয়। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে এসব প্রশ্ন জাগতে পারে, কারণ বর্তমানে উপমহাদেশে বিশেষ করে ভারতবর্ষে, সংজ্ঞা ও তত্ত্ব বা ভট্টাচার্যের ভাষায়, ‘The economic substructure of imperialist exploitation and the concurrent processes of the levels of culture, social institutions, politiciation processes and nation formation etc’ ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ইতিহাস রচনার প্রয়াস দেখা দিয়েছে। কিন্তু তিন দশক আগে ঘটনা তেমন ছিল না। আরো দেখতে হবে যে, সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ যখন বিলেত গিয়েছিলেন, তখন তাঁর সমসাময়িক 888sport appsের ঐতিহাসিকরা (যা আগে উল্লেখ করেছি) বা তাঁদের তত্ত্বাবধায়করা কী ঘরানার ইতিহাস রচনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন।
পাঁচ
সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের পছন্দের শহর কলকাতা। পূর্ববঙ্গের মানুষ হলেও তাঁর যৌবন কেটেছে কলকাতায়। অভিন্ন বাংলায়, পূর্ববঙ্গ ছিল তাঁর কাছে হিন্টারল্যান্ড এবং 888sport app মফস্বল। নাগরিক বৈদগ্ধ্যে তিনি বড় হয়েছেন, যে কারণে আজীবন দেখি জীবনচর্যায় সেই বৈদগ্ধ্যই জড়িয়ে ছিল তাঁকে। আমি কলকাতায় গেছি তাঁর সঙ্গে বা আমরা দুজন যখন ঘটনাচক্রে কয়েকবার একই সঙ্গে কলকাতায়, তখন দেখেছি এই অধ্যাপক দম্পতি প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছেন। যৌবনের বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। অধ্যাপক বরুণ দে ছিলেন তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ। তাঁর মারফতই এই গুণীজনদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়।
সেই কলকাতা ছেড়ে তাঁদের 888sport app চলে আসতে হয়। এটি মনেপ্রাণে মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিল। 888sport appয় সেই বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ, নাগরিক বৈদ্বগ্ধ্য ছিল না। তাছাড়া মন থেকে কখনো পাকিস্তানকে তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। পাকিস্তান একটি প্রতারণা – বলতেন তিনি। এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে তিনি শহীদ অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা প্রমুখ র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজমে আকৃষ্ট হন। এম.এন রায় তখন একবার 888sport appয় এসেছিলেন। 888sport appর বার লাইব্রেরিতে আয়োজিত সভায় অধ্যাপক আহ্মদ সভাপতিত্ব করেন। জগন্নাথ কলেজও তখন তরুণ প্রগতিশীলদের কেন্দ্র ছিল। এরপর তিনি চলে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও অধ্যাপক এ.আর মল্লিককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ‘রবীন্দ্র গ্রুপ’। লক্ষ করার বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দল নানা রঙে পরিচিত। সেখানে রবীন্দ্র গ্রুপটিই ব্যতিক্রম। এই ‘রবীন্দ্র’ ছিল বাঙালিত্বের প্রতীক পাকিস্তানবাদের বিরুদ্ধে। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, বদরুদ্দীন উমর জড়িত ছিলেন এই গ্রুপে। পূর্বমেঘ প্রকাশ করেছিলেন প্রথমোক্ত দুজন এবং লেখক নিজেই। বদরুদ্দীন উমরের সাড়া জাগানো সংস্কৃতিবিষয়ক 888sport live প্রথম এখানেই প্রকাশিত হয়।
ইতিহাসের ক্ষেত্রেও জাতীয়তাবাদী প্রেরণার উন্মেষ হচ্ছিল। অধ্যাপক এ.বি.এম হবীবুল্লাহ্র নেতৃত্বে ইতিহাস পরিষদ গঠিত হয় এবং বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার জন্য এর মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে ইতিহাস। অধ্যাপক আহ্মদ গোড়া থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত। এর বিপরীতে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদভিত্তিক ইতিহাস সমিতি গঠিত হয় অধ্যাপক মোহর আলী প্রমুখের নেতৃত্বে। এঁদের সবকিছুর চর্চা ছিল ইংরেজিতে। এই পটভূমি উল্লেখ করলাম অধ্যাপক আহ্মদের মনন বোঝার জন্য। এ-কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ঘোর সমর্থক ছিলেন তিনি এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অনড় থেকেছেন তাতে।
888sport appয় আসার পর তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। তিনি আমার সহকর্মী হিসেবে যোগ দেন এবং আমি তাঁর অধীনে পিএইচডির কাজ শুরু করি। সেই সময়ে তাঁর পুরনো গবেষণার ভিত্তিতে উনিশ শতকে মুসলমানদের মধ্যে র্যাডিক্যাল চিন্তাধারা ছিল কিনা তার খোঁজ করার চেষ্টা করেন। এ-পরিপ্রেক্ষিতে দেলওয়ার আহমদের রচনাবলি প্রকাশিত হয়। প্রকাশ করেছিলাম আমি। তিনি কলকাতার মাদ্রাসারও দু-একজন শিক্ষকের লেখা ও কর্মকান্ডের সন্ধান পান। তিনি ছিলেন র্যাডিক্যাল। তবে, এই দুই-একজন ছিলেন ব্যতিক্রমী। তাঁরা সামগ্রিকভাবে এবং নিজ সম্প্রদায়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি। অন্যদিকে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, হিন্দু র্যাডিক্যালরা তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রবল অভিঘাত হেনেছিলেন।
এই খোঁজার কারণটাও কিন্তু নিহিত পাকিস্তানবাদের বিরুদ্ধে কিছু একটা দাঁড় করানোর বা মুসলমান সম্প্রদায়কে যে স্থবির বিবেচনা করা হয় – তার বিপরীতে প্রগতিশীল চিন্তা খুঁজে বের করার জন্য।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পাকিস্তান যখন ফিরিয়ে আনা হয় স্বাভাবিকভাবে অধ্যাপক সালাহ্উদ্দিন আহ্মদ গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে পিএইচডি করার সময় আমি তাঁকে বাংলায় লেখার জন্য অনুরোধ করতে থাকি। এ কারণে যে, এ-সমস্ত চিন্তা, দর্শন যদি সাধারণের কাছে না পৌঁছে তাহলে এসব বৃথা। এ-চিন্তা থেকে আমি নিজেও বাংলায় ইতিহাস-চর্চা করতে থাকি। নববইয়ের দশকের শুরু থেকে তিনি দু-একটি করে বাংলা লেখা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকেন।
ছয়
নববইয়ের দশকে সালাহ্উদ্দিন আহ্মদের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন পেশাদারি সংস্থা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ প্রভৃতির কারণে তাঁর মনোজগতেও খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। একজন শিক্ষক হিসেবে শুধু নিজেকে অ্যাকাডেমিক চর্চায়ই আর তিনি আবদ্ধ রাখেননি, বরং সমাজের একজন বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হন। এ-কারণেই খুব সম্ভব তিনি বাংলা ভাষায় লেখা শুরু করেন। ভাষার ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁরা বাংলা ভাষায় গবেষণাটা কৌলীন্যের কাজ বলে মনে করেন না। ফলে তাঁরা যেমন দেশবাসীর কাছে অচেনা, তেমনি বিদেশি ভাষায়ও অচেনা। একজন গবেষক ও লেখক হিসেবে তাঁদের সামাজিক দায়বোধের ব্যাপারে সন্দেহ থাকার যথেষ্ট কারণ আছে।
নববইয়ের দশকে সালাহ্উদ্দিন আহ্মদের পাঁচটি গ্রন্থের মধ্যে চারটিই বাংলায়। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় 888sport appsে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ, পরের বছর বাঙালির সাধনা ও 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ, ১২টি 888sport liveের সংকলন। ১৯৯৩ সালে সাতটি 888sport live নিয়ে প্রকাশিত হয় 888sport apps : জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র। ইতিহাসের সন্ধানে প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। এতে সংকলিত হয়েছে ১১টি 888sport live।
এই চারটি গ্রন্থের 888sport liveসমূহকে দুভাগে ভাগ করা যায়। একটি নিছক অ্যাকাডেমিক, অন্যটি নানা বিষয়ে ভাবনা। কিন্তু দু-ধরনের 888sport liveেই অন্তর্নিহিত মিল আছে। তিনি মূলত চেয়েছেন, বাঙালির সমাজচিন্তা, মুসলমানদের আইডেনটিটি, ধর্মনিরপেক্ষতাবোধ প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরতে। অন্যদিকে অ্যাকাডেমিক 888sport liveের বিষয়, যেমন – উনিশ শতকে বাংলার মুসলমান : শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা, বাঙালি মুসলিম সমাজ, রাষ্ট্র, চিন্তা ও জনমত, 888sport appsের স্বাধীনতা আন্দোলন ঐতিহাসিক পটভূমি ১৯০৬-১৯৭১ ইত্যাদি। বই চারটির মধ্যে আমার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে – বাঙালির সাধনা ও 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ। এই গ্রন্থের 888sport liveগুলো বিশ্লেষণ করলে সালাহ্উদ্দিন আহ্মদের মননচর্চার দিকটি স্পষ্ট হবে।
সংকলনে প্রথম 888sport live ‘বাংলার সমাজচিন্তা : ঐতিহ্য ও বিবর্তন’। এটি বিশেষ উল্লেখযোগ্যের দাবি রাখে কারণ অধ্যাপক আহ্মদের পরবর্তী সব রচনাসমূহে এখানে বিবৃত দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর অভিসন্দর্ভে ব্যক্ত অনেক মতামতও দেখা যায় সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত হয়েছে। যেমন, এই 888sport liveে তিতুমীর সম্পর্কে তিনি লিখেছেন – ‘তিতুমীর যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেটা ছিল মূলত ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক। গ্রামাঞ্চলে কৃষক, তাঁতি ও 888sport app দরিদ্র জনসাধারণকে জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করা ছিল এই আন্দোলনের একটি প্রধান লক্ষ্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ধর্মীয় ও সামাজিক কারণ।’ একই মন্তব্য করেছেন তিনি ফরায়েজী আন্দোলন সম্পর্কে।
এ-888sport liveে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হলো – ‘বাঙালির মানসচেতনাকে ধর্মের, সে ধর্ম হিন্দু, বৌদ্ধ বা ইসলাম যে ধর্মই হোক না কেন – তার সনাতন আচার-বিচারের চেয়ে তার আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ ও অন্তর্নিহিত মর্মবাণী বেশি আকৃষ্ট করেছে এবং সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।’
সেই দৃষ্টিভঙ্গি আরেকটু বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে পরবর্তী 888sport live ‘আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মানবতাবাদী ও সমন্বয়ধর্মীয় ধারা’য়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সাংস্কৃতিক ধারাগুলো তিনি চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো হলো – প্রাক-আর্য এবং হিন্দু-বৌদ্ধ ধারা, ইসলাম বা মুসলিম ধারা এবং পাশ্চাত্যের ধারা। ‘এই তিনটি বিভিন্ন ধারা এই উপমহাদেশের মহামানবের সাগরে এসে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেছে। এই মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বিরোধ ও সংঘাত দিয়ে, তারপর এলো মিলন ও আদান-প্রদান পালা; পরিসমাপ্তি ঘটল আত্তীকরণ ও সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে।’ এবং আমাদের উচিত হবে, এই সমন্বয়ের ফলে যে-মানবতাবাদী ধারা তৈরি হয়েছে তা অব্যাহত রাখা।
তিনি যখন রামমোহন রায় সম্পর্কে (‘রামমোহন রায় ও ব্রাহ্মসমাজ’) আলোচনা করেন তখন তথ্যগুলো এভাবেই বিচার করেন এবং উপসংহারে পৌঁছান যে, রামমোহন একটি ‘সর্বজনীন বিশ্বধর্ম প্রতিষ্ঠা’ করতে চেয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের সংস্কারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিকল্প ধারা সৃষ্টি করেছিলেন কিনা এবং তাতে হিন্দু ধর্মের উপাদানগুলো কী পরিমাণে ছিল তা বিচার করেন না।
বাংলার মুসলমান ও তাদের আত্মপরিচয় নিয়েও তিনি চিন্তাভাবনা করেছেন। এ-সংকলনেও সে-বিষয়ে দুটি 888sport live আছে। এক্ষেত্রেও তিনি বাংলার মুসলমানদের অনগ্রসরতা, রক্ষণশীলতা বিষয়ে যেমন উল্লেখ করেছেন, তেমনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে ছিল ‘প্রগতিশীল সংস্কারবাদ’। এই শেষোক্ত ধারাটিকেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন, যে-কারণে দেলোয়ার হোসেনের রচনাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন, যদিও দেলোয়ার হোসেন তাঁর সময়ে উল্লেখযোগ্য কেউ ছিলেন না এবং তাঁর রচনা সে-সময়ে কাউকে উজ্জীবিতও করেনি।
আমাদের আত্মপরিচয়েরও (আত্মপরিচয়ের সন্ধানে : একটি ঐতিহাসিক সমীক্ষা) বিভিন্ন পর্বে তিনি আলো ফেলেছেন। ‘পাকিস্তান ছিল সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তাবাদের অপসৃষ্টি।’ তা মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়, স্বাধীন বাংলার (যা হতে পারত ধর্মনিরপেক্ষ) যে কনসেপ্ট ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান নেতৃত্ব একযোগে তুলে ধরেছিলেন, তা কংগ্রেস হাইকমান্ড কোন যুক্তিতে মানতে অস্বীকার করলেন? বা সাম্প্রদায়িকতা কি একতরফা একটি বিষয়? এর উদ্ভব কেন হয়? এসব প্রশ্ন অনুক্ত থেকে যায়। তাঁর মতে, এই দুর্বলতার কারণেই আমাদের নয়া জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় অন্তিমে, যা সহায়ক হয় 888sport apps গঠনে।
এসব 888sport liveের মূল সুর এক – তিনি বলেছেন – জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি হলো স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং শুধু ধর্মীয় একতার ভিত্তিতে বর্তমানে কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। পাকিস্তান আন্দোলন ছিল মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন বা ধর্মীয় কোনো স্লোগান দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। পরে অবশ্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছিল শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানের এবং নিজেকে তা একমাত্র প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারত গণতন্ত্রের ভিত্তিতেই, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
উল্লিখিত 888sport liveগুলোতে তিনি আরো লিখেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে 888sport appsের জনগণ তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যে-ঐতিহ্য কোনো বিশেষ ধর্মের বা বর্ণের সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যেটা সম্পূর্ণ লোকায়ত এবং ভূ-ভিত্তিক, সেই ঐতিহ্যকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগল এবং তাদের এই অন্বেষার পরিণতি 888sport appsের জন্ম। তিনি এ-প্রসঙ্গে বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেছেন তা আগের থেকে ভিন্ন। তিনি বলেছেন, বাঙালি মুসলমান ধর্মভীরু হওয়া সত্ত্বেও তাদের গণজীবনে একটি উদার ও মানবতাবাদী ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে এবং যার প্রমাণ পাওয়া যায় আউল-বাউলের মধ্যে। এই আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ পরবর্তীকালে বাঙালি জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করতে সাহায্য করছে। তাঁর মূল বক্তব্য, সমন্বয়ধর্মী, মানবতাবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমাজের মূল উপাদান মনে না করলে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা দুরূহ।
এ সমস্ত চিন্তাভাবনার নির্যাস নিয়ে তিনি রচনা করেছেন – Bengali Nationalism and the Emergence of Bangladesh : An Introductory (ICBS, Dhaka 1994). এখানেও তিনি একই মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। ভাষা শুধু আলাদা এই যা। বিভিন্ন পর্বের সমাজচিন্তা এবং সবশেষে বাঙালি জাতীয়তাবাদ (স্বাধীন 888sport apps গঠন) নিয়ে আলোচনা করে তিনি এই উপসংহারেই পেঁŠছান – ‘এই উপমহাদেশের জনজীবনে আবহমানকাল থেকে যে ধারাটি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে সেটি সমঝোতা ও সমন্বয়ের ধারা। এই সমন্বয় আমরা দেখতে পাই আমাদের সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন – সংগীতে, 888sport live chatে, 888sport live footballে এমনকি পোশাক-পরিচ্ছদে এবং আচার-বিচারে। তেমনি আবার এই সমন্বয় দেখা যায় আমাদের ধর্ম ও সমাজচিন্তায়, আমাদের সামগ্রিক জীবনবোধের মধ্যে। বস্ত্তত এই উপমহাদেশের মানুষ আমরা যৌথভাবে এক সুমহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী।’ (বাঙালির সাধনা ও 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ) এই উত্তরাধিকার যদি আমরা সংরক্ষণ করি তাহলেই 888sport apps কেন, উপমহাদেশজুড়ে শান্তি আসতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে ২০১২ সালে প্রকাশিত 888sport apps কোন পথের উল্লেখ করা যায়। এ-গ্রন্থেও পত্রিকায় প্রকাশিত সাতটি ছোট 888sport live সংকলিত হয়েছে। তাঁর সেই পুরনো চিন্তা থেকে আবারো উল্লেখ করেছেন – বাঙালি জাতির যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সেটি নির্মিত প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম এবং আধুনিক পাশ্চাত্য ধারার সমন্বয়ে। তাঁর মতে – ‘888sport appsের মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির মধ্যে এমন কতগুলি দিক আছে যেগুলি আমাদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলার মানুষকে ধর্মের বাহ্যিক আচার-বিচারের চেয়ে ধর্মের অন্তর্নিহিত মর্মবাণী বেশি আকৃষ্ট করেছে। তাই এদেশে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কখনো জনমনে দাগ কাটতে পারেনি।’
বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে বলছেন, ‘বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের জাগরণ ঘটেছে বলা যেতে পারে সাম্প্রতিক কালে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশে মুসলমান জনগণের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের ব্যাপক প্রসার ঘটে।’
এ-পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সুন্দর একটি তুলনা করেছেন। স্বদেশি যুগে বাঙালিরা স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছে। আর ১৯৪৭ সালের শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালিরা স্বাধীন 888sport appsের স্বপ্ন দেখেছে। তাঁর মতে, ‘বাঙালির সর্বকালের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়’… ‘বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক নেতৃত্ব ছাড়া এটা সম্ভব হতো না।’
রাজনৈতিকভাবে কোনো দলে সক্রিয় না হলেও আওয়ামী লীগের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল এবং শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অসীম। যে-কারণে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এর পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন। আওয়ামী লীগের অনেক কাজ পছন্দ করতেন না। তাই লিখেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করতে হবে যে, বিপক্ষ শক্তির প্রতি তোষণমূলক নীতি অনুসরণ করে তাকে নিষ্ক্রিয় করা যায় না।’
শেখ হাসিনার অনেক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া গড়তে চেয়েছিলেন। হয়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে মূল যে-পরিকল্পনা ছিল তা এখনও শেখ হাসিনা কার্যকর করেননি, বরং এটিকে জনসভার মাঠে পরিণত করেন, তখন তিনি অতীব দুঃখ পেয়েছিলেন। শেখ হাসিনার অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সঙ্গেও তাঁর দ্বিমত ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থনে তিনি ছিলেন অবিচল। আমাকে তিনি প্রায় বলতেন, শেখ হাসিনা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। তাঁকে হারালে আমাদের চলবে না। এই গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন – ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি আমি গভীর স্নেহ ও অসীম 888sport apk download apk latest version পোষণ করি। তাঁর মতো স্বজনহারা দুঃখী মানুষ আর কে আছে? জীবনের কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। তিনি যে দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন, 888sport appsের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা ভাবছেন, তাঁর সে স্বপ্ন সে ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার মহান উদ্যোগ সফল হোক এই কামনা করি।’
888sport app 888sport liveে ঘুরেফিরে একই বিষয় এসেছে। সাম্প্রতিক 888sport appsের ঘটনাবলি নিয়ে লেখা 888sport liveগুলোর ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য।
পরবর্তীকালে ইংরেজি ও বাংলায় তাঁর আরো কিছু 888sport live সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যেমন ইতিহাস ও ঐতিহ্য (২০০৭), Bangladesh : Tradition and Transformation, India Pakistan Bangladesh : Perspectives on History Society and Politics, বাঙালির সাধনা ও 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ, বরণীয় ব্যক্তিত্ব ও 888sport app download for androidীয় সুহৃদ প্রভৃতি।
বস্ত্তত সারাজীবন তিনি একটি বই-ই লিখেছেন, যার মূল কথা হলো বাঙালি মুসলমান সমন্বয়বাদী ধারায় বিশ্বাসী। তারা ধর্মসহিষ্ণু, ধর্মান্ধ নয়। মানুষের মুক্তি ধর্মনিরপেক্ষতায়। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতা তো মানববাদই।
সাত
নববইয়ের দশকে সালাহ্উদ্দিন আহ্মদ নতুন এক প্রকল্পে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তাহলো ‘ওরাল হিস্ট্রি’। তিনি এর বাংলা নামকরণ করেন ‘কথা ইতিহাস’। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, এ-নামকরণ যথাযথ নয়। পশ্চিমবঙ্গে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘মুখের কথার ইতিহাস’।
ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থানুকূল্যে 888sport apps জাতীয় জাদুঘরে তিনি এ-প্রকল্পের কাজ শুরু করেন এবং একশজনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকার বিবরণীসমূহের সারসংক্ষেপ কথ্য ইতিহাসের রূপরেখা নামে প্রকাশিত হয়। এরপর ‘তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক তিন বছরমেয়াদি একটি প্রকল্পও তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এ-প্রকল্পের আওতায় প্রায় এক হাজার ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এবং এর ভিত্তিতে কসবায় মুক্তিযুদ্ধ নামে একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়। ওই গ্রন্থে অবশ্য তাঁকে কোনোরকম সম্মানজনক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
ইতিহাসের এ-পদ্ধতি অনুসরণে কেন তিনি এত বেশি আগ্রহী তার একটি ব্যাখ্যা তখন তিনি দিয়েছিলেন –
১. 888sport apkসম্মত ইতিহাস চেতনার অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক দলিল দস্তাবেজের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি।
২. অধিকাংশ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে রাজনীতিবিদগণ নিজেদের 888sport sign up bonusকথা লিখে যান না।…
ইতিহাসের বিভিন্ন উৎসের বিশ্লেষণে এভাবে আমাদের কাছে সমকালীন ইতিহাসের উপাদানের দুষ্প্রাপ্যতা ও এর অব্যাহত সংকটের চিত্রটিই প্রকট হয়ে ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষণের জন্য মৌখিক তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা তর্কাতীতভাবে প্রতিপন্ন হয়।’
তবে, পদ্ধতিটি এখনো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বা সুশৃঙ্খলভাবে এগুলো উপস্থাপিত করার ব্যাপারেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ ও 888sport apps গবেষণা ইন্স্টিটিউট এই প্রকল্পটি গ্রহণ করেছিল এবং অধ্যাপক আহ্মদ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
আট
ঐতিহাসিকের কাজ কী? সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের ভাষায়, ‘নিরপেক্ষ ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে 888sport apkসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করে ইতিহাস সাধনা করা সকল ঐতিহাসিকের আদর্শ ও লক্ষ্য। ঐতিহাসিকরা ইতিহাস রচনা করেন কোনো বিশেষ মুষ্টিমেয় শ্রেণির জন্য নয়; তাদের রচনা সমগ্র পাঠক সমাজের জন্য।’ [ভাষণ] বস্ত্তত ‘নিরপেক্ষ’ ঐতিহাসিক হওয়া কি কারো পক্ষে সম্ভব?
তিনি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র তখন ইতিহাসের ছাত্রদের ওপর মার্কসবাদী ঐতিহাসিক সুশোভন সরকারের বেশ প্রভাব ছিল। সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ নিজেও তাঁর ছাত্র ছিলেন, বামপন্থী ঝোঁকও তাঁর ছিল; কিন্তু ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মার্কসবাদী পদ্ধতি তিনি কখনো ব্যবহার করেননি। এর কারণ, যৌবনেই তিনি আবার মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রচারিত ‘র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজমে’র দিকে ঝুঁকেছিলেন।
তাই ধরে নিতে পারি, তিনি যখন ঐতিহাসিককে ‘নিরপেক্ষ ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে কাজ করতে বলেন তখন তার উৎস উদারনীতি ও মানবতাবাদ। কিন্তু উদারতা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। তবে এখানে উল্লেখ্য, উদারতাবাদের ফলে যত বেশি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া উচিত সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের লেখায় তা হয়নি। সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের প্রথম বই-ই প্রমাণ করেছিল যে, তাঁর চিন্তা স্বচ্ছ, রচনা সংযমী ও পরিচ্ছন্ন বা এককথায় তিনি ক্ষমতাবান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা সত্ত্বেও বলতে হয়, ১৯৬৫ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর সক্রিয়ভাবে ইতিহাস-চর্চা থেকে তিনি নিজেকে বিরত রেখেছিলেন অনেকদিন। ফলে এখানে তাঁর পক্ষে কোনো অনুসারী তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সমাজ সম্পর্কে তাঁর যে-চিন্তা তা তাঁর অল্প কিছু ছাত্রকে হয়তো প্রভাবিত করেছে; কিন্তু ইতিহাস রচনাকে নয়। তিনি বলেছিলেন, ইতিহাস সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত। এ-কারণেই, খুব সম্ভব, গত শতকের নববইয়ের দশক থেকে সেভাবেই কাজ করতে শুরু করেছিলেন। বাংলা ভাষায় ইতিহাস-চর্চা করেছেন। তাঁর এ-প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকায় আমরা লাভবান হয়েছি।
স্যার এখন নেই। আমার কাছে তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। ছাত্র হিসেবে আমাকে নিয়ে গর্ব করার তাঁর কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু আমার গর্ব করার বিষয় যে, আমি তাঁর ছাত্র। এটিই আমার বড় পরিচয়।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.