যখন গভীর রাতে দুঃস্বপ্নের মধ্যে হঠাৎ আয়নার ভাঙা কাচে আমার শিরা কেটে যায়, রক্ত থামাতে গিয়ে ‘আমি’ নামের একাকী ক্ষতচিহ্নকে খুঁজতে কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাই আমি। সুদূর শতভিষা থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত নেমে এসে চুঁইয়ে পড়ে একটি বইয়ের গা বেয়ে। আমি চমকে উঠে দেখি, সেটি পাসকালের অসমাপ্ত নোট্স্ নিয়ে তৈরি বিখ্যাত গ্রন্থ পাঁসে (‘ভাবনা’, ১৬৭০)। যা ফরাসি গদ্যের কারুকার্যময় শৈলীর এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে আছে।
বেদ, উপনিষদ, বুদ্ধ, কনফুশিয়াস, সেন্ট অগাস্টাইন, অ্যাকুইনাস, স্পিনোজাকে পার হয়ে আবহমান স্বাতী নক্ষত্রের বেদনার পানে চেয়ে বলি, এসেছ, পাসকাল? উনচল্লিশ বছর বয়সে মরে যাওয়া তাঁর কঙ্কাল কাঁপে। এই সীমাহীন অসহায়তার ভেতর, পাসকাল, বলো, আজ মধ্যরাতে তুমি কি মৃত্যুর কথা বলবে, না জীবনের? ঈশ্বরহীনতার না ঈশ্বরের? পূর্ণতার সন্ধানে বেরিয়ে এ কী শূন্যতার মানচিত্র!
এক অসুখজর্জর, মৃত্যুপথযাত্রী পদার্থ888sport apkী ও গণিতবিদ স্পর্শ করতে চাইছেন অব্যক্ত যন্ত্রণার কম্পনরেখা। বেস্নজ পাসকাল (১৬২৩-১৬৬২)। বয়সে শ্রেষ্ঠ ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের-এর চেয়ে এক বছরের ছোট। এক 888sport apkীর মানবভাবনা ও দর্শনচিমত্মা কত দূর চলে যেতে পারে নৈঃশব্দ্য পেরিয়ে তার প্রতিধ্বনিগুলি ছুঁয়ে থাকি আমি। আমার অন্ত:স্তল জ্বলতে থাকে, এত লুকোনো প্রদীপ সেখানে ছিল, এত ক্লিন্ন মোমবাতি, কোনওদিন জেনেছি কি আমি? যারা রাত্রির পাকদণ্ডী বেয়ে হারিয়ে যেতে যেতে জ্বেলে দিতে চায় আলো যা বিপন্ন আঁধারে ঢেকে আছে! পাসকাল লিখছেন :
সত্যিকারের বিচারঃ আছে কি কোথাও?
মানুষের অবস্থাঃ বিশ্বাসঘাতকতা, বিরক্তি, উৎকণ্ঠা।
সকলেই সুখ খুঁজছে, একজনও ব্যতিক্রম নেই।
কত তুচ্ছ জিনিষ আমাদের দুঃখ দেয়, কত তুচ্ছ জিনিষ আনন্দ।
মানুষের মহত্ত্ব আর দুর্দশা এত স্পষ্ট। কী আশ্চর্য পরস্পরবিরোধিতা!
মানুষের দুর্দশা, যা নিয়ে পাসকালের উৎকণ্ঠা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে থাকে। ঈশ্বরহীন মানুষের দুর্দশা। মানুষের বিচ্যুতি ও নিঃস্বতা! মানুষ, যে সুবিচার করতে অক্ষম! মানু্ষ, যে সত্যের কাছে পৌঁছতে অক্ষম। মানুষ, যে সুখে অক্ষম।
না, কখনও একরৈখিক নয় পাসকালের চিমত্মা, তা শুধু চূর্ণ অভিজ্ঞান।
আমি তবে কী করব? আমার চারপাশে তো অন্ধকার। আমি কি বিশ্বাস করব আমি কিছুই নই? আমি কি বিশ্বাস করব আমি ঈশ্বর?
খ্রিস্টধর্মের সপক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে সেই বিপন্ন বয়ান এক রক্তদীপময় প্রশ্নময়তার মধ্যে হারিয়ে যায়। পাসকাল কি তবে মহান এক ক্লাসিক লেখক, না মগ্ন এক মানবপ্রেমিক? মানুষ নামক গ্রন্থের এক শ্বাসরোধকারী পাঠক? নাকি বিপজ্জনকভাবে মনোমুগ্ধকর এক কথা-জাদুকর? ১৬২৩ সালে যাঁর জন্ম। তিন বছরের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের শিশুটি মা’কে হারায়। অসুস্থতা তাঁকে মৃত্যুশীতের দিকে ঠেলে দেয় ১৬৬২ সালে ৩৯ বছর বয়সে। সমকাল তাঁকে চিনত বিরাট এক গণিতবিদ ও পদার্থ888sport apkী হিসেবে। যে পাসকালের ল’র কথা পদার্থবিদ্যার ছাত্রেরা জানে, যিনি অ্যারিস্টটলের শিষ্যদের সেই ধারণাকে নস্যাৎ করেন যে প্রকৃতি শূন্যতাকে ঘৃণা করে, যিনি তরলের ভারসাম্য, বা ব্যারোমেট্রিক প্রেসার নিয়ে গবেষণা করেছেন, ডিজাইন করেছেন প্রথম ক্যালকুলেটর, অথবা প্যারিসের প্রথম জন-পরিবহন, প্রভাবিত করেছেন আধুনিক অর্থনীতি ও সমাজ888sport apk, আবিষ্কার করেছেন ইউক্লিডের বত্রিশটি উপপাদ্য, তাঁকে আজ পৃথিবী চেনে দুটি বহুস্তর রচনার জন্যঃ ‘লেৎর প্রোভ্যাঁসিয়াল’ (‘প্রভিনসিয়াল লেটারস’) আর ‘পাঁসে’!
888sport apk ও জ্যামিতিকে প্রত্যাখ্যান করে মানুষকে নিয়ে যে আরো বড় অনুসন্ধান বাকি ছিল তাঁর। যদিও তিনি খ্রিস্টধর্মের হয়ে কথা বলছেন, সেই খ্রিস্টধর্ম যা মানুষকে বাঁচাতে পারে, তবু তিনি নির্জন একাকী! কেউ তাঁকে শান্তি দেয় না, মুক্তচিন্তক, অনৈতিক, নাসিত্মক, দার্শনিক, ধর্মযাজক …। কী তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে? আদিম পাপ?
পাসকাল কি মনস্তাত্ত্বিক? তার্কিক? না মিস্টিক? আমরা খুঁজেছিলাম এক লেখককে, পেলাম এক মানুষকে। যিনি সেই নিঃস্ব মানুষকে আতশ কাচের নীচে রেখে বুঝতে চাইছেন।
যাকে সারবত্তাহীন জ্ঞানচর্চা দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। নীরস জ্ঞানচর্চাকে অস্বীকার করেন পাসকাল। যেন সাধারণ মানুষকে জ্ঞানের ধাষ্টামো দিয়ে চমকে দেওয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসার জন্য এ এক উষ্ণ আবেদন। ‘S’abstenir de déconcerter un public profane par un langage savant’।
এই মধ্যরাতে আমি এলোমেলো ভাবে খুলে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলি পড়ি, যার কোনও ক্রম থাকে না।
সত্যিকারের ন্যায়ঃ আজ আর নেই।
খ্যাতি এত সুমিষ্ট যে যা কিছুতে এর রেশ থাকে তাকেই আমরা ভালবাসি, এমনকী মৃত্যুকেও।
হৃদয়ের আছে সেই সব যুক্তি যাকে যুক্তি দিয়ে বিশেস্নষণ করা যায় না।
যুক্তির সঙ্গে যে জিনিষটার মিল সবচেয়ে বেশি তা হলো যুক্তিহীনতা।
যা কিছু বুদ্ধির অতীত তার অসিত্মত্ব নেই এমন তো নয়।
সেই মানুষগুলির কী হবে যারা ছোট ছোট জিনিষকে ঘৃণা করে, অথচ বড় কিছুকে বিশ্বাস করে না?
চারপাশের অন্ধকার আমাদের অযোগ্যতা ছাড়া আর কীই বা প্রমাণ করে?
মানুষ জানে না কোন জায়গাটা তার, নিঃসন্দেহে সে পথ হারিয়েছে। তার প্রকৃত অবস্থান থেকে তার পতন হয়েছে, সে কিছুতেই তা খুঁজে পাচ্ছে না। সে সর্বত্র খুঁজে চলেছে, গভীর উৎকণ্ঠায়, কিন্তু ব্যর্থ ভাবে, দুর্ভেদ্য অন্ধকারের ভেতর।
দুটিই বাড়াবাড়িঃ যুক্তিকে অস্বীকার করা, অথবা যুক্তির জন্য বাকি সব কিছুকে অস্বীকার করা।
মানুষ যদি ঈশ্বরের জন্য তৈরি না হয়ে থাকে, তবে কেন সে শুধু ঈশ্বরেই আনন্দ পায়? মানুষ যদি ঈশ্বরের জন্য তৈরি হয়ে থাকে, কেন সে এত ঈশ্বরবিরোধী?
ঐ অনন্ত মহাকাশের অনন্ত শূন্যকে দেখে আমার ভয় করে।
আমাদের আর স্বর্গ্ননরকের মাঝখানে জীবন শুধু অর্ধেক, যা পৃথিবীতে সবচেয়ে ভঙ্গুর।
আমি আঘাত নয় আলিঙ্গনের যোগ্য, আমি ভয় পাই না কারণ আমি ভালবাসি।
পরিষ্কার হলেও টিয়াপাখি বারবার তার ঠোঁট মোছে।
মানুষ স্বভাবত বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, ভীরু ও সাহসী।
দুটি জিনিষ মানুষকে তার প্রকৃতি চিনতে শেখায়ঃ প্রবৃত্তি আর অভিজ্ঞতা।
যখন সে অতিরিক্ত গর্ব করে, আমি তাকে নীচে নামাই।
যদি সে বিনয় করে আমি তাকে উঁচুতে তুলি।
আর আমি নিরন্তর তার বিরোধিতা করে যাই,
যতক্ষণ না সে বোঝে যে
সে শুধুই এক দৈত্য যাকে বোঝা যায় না।
কত রাজ্যপাট আছে যা আমাদের কিছুই জানে না!
খুব বেশি মদ, আর খুব কম মদ।
ওকে একটুও মদ ঢেলে দিও না, তাহলে ও সত্যকে খুঁজে পাবে না। ওকে বেশি দাও, তাহলেও ও সত্যকে পাবে না।
যদি সে তোমাকে বিশ্বাস করে, পৃথিবী সত্যিই অন্ধ।
মানুষ দেবদূত বা পশু কোনওটাই নয়, দুর্ভাগ্যবশত দেবদূতের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে সে পশুর ভূমিকায় অভিনয় করে ফেলে।
তিনি বাস করেন জলের ওপারে।
মানুষ এতটাই নীচ যে সে পশুর কাছেও অবনত হয়, এমনকী তাকে পুজো করে।
মানুষের দুর্দশাকে না জেনে ঈশ্বরকে জানা থেকে জন্ম হয় দাম্ভিকতার। ঈশ্বরকে না জেনে মানুষের দুর্দশাকে জানা থেকে হতাশা। যিশুকে জানলে একটা ভারসাম্য আসেঃ আমরা ঈশ্বর আর আমাদের দুর্দশা দুটিকেই জানতে পারি।
মানুষের মহত্ত্ব এইখানেই যে সে জানে সে অসহায় গাছ তা জানে না।
মূর্খ, মূর্খ মানুষ। সে পাসকালকে সম্মান জানাতে গিয়ে পাঁচশ ফ্র্যাঙ্কের টাকায় তাঁর ছবি ছেপেছিল। হা ঈশ্বর! কত প–ত তাঁর চিমত্মার উৎস খুঁজেছেন মিশেল দ্য মঁতেন-এ, কিন্তু দেখেন নি পাসকাল তাকে দিয়েছেন দর্শনের আলোআঁধারি। ‘খ্রিস্ট ছাড়া ঈশ্বরকে বোঝা অসম্ভব, এমনকি অপ্রয়োজনীয়’, এমন কথা বলার পরও পাসকাল এক নিরালম্ব শূন্যে ঝুলে থাকেন।
সুষুম্না দিয়ে হাওয়া বয়, আর আমাদের কঙ্কাল থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো অক্ষর রেখা সারা রাত অন্ধকার ছিন্ন করে অনন্ত আকাশে ছড়িয়ে যায়, কেবল ছড়িয়ে যায়। r
[লেখকের বানানরীতি অপরিবর্তিত রেখে]


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.