আনিসুজ্জামান : এক মানবভাষার সন্ধানে

নক্ষত্রমালা থেকে এক অন্ধকার স্বচ্ছতা নেমে আসছে, সাদা বাষ্পে ঢেকে যাচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব, এক মারণ জীবাণু এসে আমাদের নিঃস্ব মৃৎপাত্র দিয়েছে ভেঙে। যখন আমরা পাসকালের মতো ভাবছি, আমরা এখন তবে কী করব, তখনই আমাদের সর্বনাশের পাল্লা ভারি হতে শুরু করছে, নিভে যাচ্ছে একটির পর একটি আলোকস্তম্ভ, যাদের একজন স্বয়ং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
আমাদের চারপাশে যখন ক্ষয় ও পতনের পদশব্দ, ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার চিহ্নগুলি, তখন প্রায় মায়াবীর মতো জাদুবলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সংস্কৃতির অভিভাবক। যেন আকাশের মতো সহজ, মহৎ, বিশাল। তাঁর সঙ্গে সহযোদ্ধা আরো কেউ কেউ ছিলেন, কিন্তু পারাপারের সেতুর ওপর তাঁর অনায়াস আত্মবিশ্বাসী চলাফেরা তাঁকে করে তুলেছিল সকলের মধ্যে স্বতন্ত্র। দুই বাংলাতেই তিনি ছিলেন অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে এক প্রতীক। সেটা এই ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসা পৃথিবীতে এক শক্তির অস্ত্র।
তাঁর সদাজাগ্রত ইতিহাসচেতনার জন্যই তিনি সমকালীন ইতিহাসহীন ও ইতিহাসচ্যুতদের থেকে আলাদা। বলা যতটা সহজ, এই অসহিষ্ণু সময়ে অভিভাবক হয়ে ওঠা তত সহজ ছিল না। প্রকৃত শিক্ষা তাঁকে আত্মানুসন্ধানের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, যা তাঁকে দিয়েছিল সুগভীর এক বিশিষ্টতা।
আনিসুজ্জামান উজ্জ্বল ও রক্তিম তিরিশের দশকে কলকাতায় জন্মেছিলেন, ওপার বাংলায় গিয়ে ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে থেকেছেন, তরুণ বয়সে শহীদুল্লাহ্ ও মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছেন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের শরিক, 888sport appsের সংবিধানের বাংলা ভাষ্যের রচয়িতা, আত্মপরিচয়ের শিলালিপি খোদাই করতে চাওয়া এই অনন্যসাধারণ মানুষটির হৃদয়ে সেই পারাপারের সেতু সারাজীবন অটুট ছিল। এই বিষয়ে আমি অন্যত্র লিখেছি। মূল কথা হলো, তিনি ঘর আর বিশ্বকে এক বীণার তন্ত্রীতে বেঁধে নিয়েছিলেন। এমন আন্তর্জাতিকতা সহজে আসে না, একে অর্জন করতে হয়, শরীরমনে ধারণ করতে হয়।
জ্ঞানচর্চা তো অনেকেই করি, কিন্তু জ্ঞান ও বৃহত্তর জীবনের মধ্যেকার সেতু নির্মাণ করতে পারি কজন? অন্নদাশঙ্কর রায়ের (বিবেকী বুদ্ধিজীবী হিসেবে যাঁর সঙ্গে তাঁর মিল) একটি গুরুত্বপূর্ণ 888sport liveের নাম ‘নীতিজিজ্ঞাসা’। আমার মনে হয়, এই শব্দবন্ধ দিয়ে আনিসুজ্জামানের জীবনবীক্ষাকে অনুধাবন করা যায়। তাঁর যাবতীয় গবেষণায়, আর ভাবনাচিন্তায় নৈতিকতার কাঠামোটি গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। এই নীতিজিজ্ঞাসা তাঁকে দিয়েছিল 888sport appsের ধুলোমাটিতে দাঁড়িয়ে বিশ্বকে দেখার চোখ। এমন চোখ সকলের থাকে না। নিজেকে উত্তরণ করে যাওয়া আমাদের সকলের স্বপ্ন। শুধু তাঁর বইগুলির নামের দিকে তাকালে এই উত্তরণ প্রয়াস স্পষ্ট হয় : স্বরূপের সন্ধানে, কাল নিরবধি, বিপুলা পৃথিবী।
আমি লক্ষ করেছি, 888sport appsের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ভাষাচর্চার একটা তুলনা 888sport appsে অনেকে করে থাকেন, ইতিহাস ও ভূগোল জ্ঞানের অভাবজনিত কারণে। আনিসুজ্জামানের মধ্যে এমন দেখিনি, ভাষাকে ভালোবেসে জন্ম নেওয়া 888sport apps এবং বৃহত্তর কাঠামোর অন্তর্গত একটি প্রদেশের মৌলিক পার্থক্য তিনি জানতেন। একটি বহুভাষিক ফেডারাল স্ট্রাকচারে পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েরা যে একটু বড় হয়ে অন্য ভাষাভাষী প্রদেশে বা অন্য দেশে চলে যেতে পারে, তা সম্পর্কে আনিসুজ্জামান অবহিত ছিলেন। সুতরাং দুটি দেশের ভাষাচর্চার সমাজতত্ত্ব এক নয়। আপন দেশের জাতিসত্তাকে অনুধাবন করেছিলেন বলেই তাঁর আত্মসত্তা নির্মাণের প্রয়াস এত যুগান্তকারী।
এই আশ্চর্য মানুষটি ইতিহাস খুঁড়ে বাঙালি মুসলমানের সত্তাপ্রাণ খুঁজেছেন, খুঁজেছেন মুসলমান 888sport promo codeর অবস্থান, এ-কাজের মূল্য অসীম। আঠারো শতকের চিঠি ভাষা ও 888sport live footballের নিরিখে এক আকরগ্রন্থ। অধ্যাপিকা ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের সঙ্গে (সম্প্রতি এপার বাংলার এক মূর্খ পল্লবগ্রাহী এই বাংলা ও ভাষা 888sport live footballে নিবেদিতপ্রাণ ফরাসিনীকে অযৌক্তিক আক্রমণ করে নিজেকে ক্ষুদ্র প্রতিপন্ন করেছেন, সৌভাগ্যের বিষয়, সম্ভবত আনিসুজ্জামান তা দেখে যাননি) সম্পাদিত আঠারো শতকের ওগুস্ত্যাঁ ওসাঁর ফরাসি-বাংলা অভিধান আর একটি স্বর্ণফলক।
এই স্বর্ণফলকগুলি কি তবে পড়ে থাকবে মাটিতে, ধুলোয়?
এত দীর্ঘকায়, অথচ নিরহংকার একজন মানুষ। নিজে এগিয়ে এসে কালি ও কলমের জন্য লেখা চেয়েছেন, হতভাগ্য আমি, পেরে উঠিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের চাপে। হয়তো ভেবেছেন, আমি দাম্ভিক, অথবা সময় করে উঠতে পারব না, যা প্রশংসনীয় নয়। কিন্তু বিরক্তির ভগ্নাংশ মাত্রও কখনো দেখাননি। পরে তাঁর সম্পাদিত একটি গ্রন্থের জন্য কার্যনির্বাহী সম্পাদক আমার একটি লেখা সংগ্রহ করে তাঁকে জানালে তিনি অবাক হন, এবং আলাদা করে মুগ্ধতার কথা ব্যক্ত করেন। বিপুলা পৃথিবী পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, আমার দুর্ভাগ্য, বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত এই সর্বার্থে প্রকৃত বাঙালির কাছে কত কিছু শেখার ছিল।
তিন বছর আগে শ্রদ্ধেয় আবুল হাসনাতের আমন্ত্রণে আমি কালি ও কলম যুব 888sport app download bdের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছিলাম, এই আশায় যে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে। ‘888sport cricket BPL rateে’র বইমেলার উদ্বোধনেও তিনি আসতে পারেননি। তাঁর শরীর মোটেই ভালো ছিল না।
আমরা এক মৃত্যুলাঞ্ছিত অন্ধকারে নিজেদের খুঁজে চলেছি। আসল যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো আপন শিকড়ের প্রতি বিশ্বাস আর দায়বদ্ধতা। এবং ঘর আর বাহিরের মধ্যে অনিবার্য এক সেতু নির্মাণ। প্রথমটি না থাকলে দ্বিতীয়টি রূপকথার মতো অলীক হয়ে ওঠে। আনিসুজ্জামান সারাজীবন তাঁর প্রজ্ঞা, নম্রতা আর ভালোবাসা দিয়ে এই গভীর বার্তাটি আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।