আবু সয়ীদ আইয়ুবের রবীন্দ্রভাবনা

আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-৮২) বাংলা কাব্য-সমালোচনার ইতিহাসে অন্যতম রবীন্দ্র-কাব্য সমালোচক। তিরিশোত্তর কবিদের চোখে – রবীন্দ্রনাথ চারপাশের ক্লেদাক্ত বাস্তবতার যথার্থ রূপকার হতে পারেননি। সমকালীন বৈশ্বিক অমঙ্গলবোধও তাঁর মধ্যে অনুপস্থিত ছিল, ঠিক এমন অনুযোগের জবাবে অনেক বিলম্বে হলেও আবু সয়ীদ আইয়ুব রচনা করেন আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮) নামক উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থ। এ-গ্রন্থে রবীন্দ্র-কাব্যধারার বিচার-বিশ্লেষণে তিনি যে সর্বাত্মক, নির্মোহ ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেছেন এবং যে-মীমাংসা পেশ করেছেন তাতে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় অভিষিক্ত হয়েছেন, উপস্থাপিত হয়েছেন ভিন্নতর তাত্ত্বিক মানদ–। সেইসঙ্গে আবু সয়ীদ আইয়ুব নিজেও তাঁর এই তন্নিষ্ঠ প্রজ্ঞাশাণিত সমালোচনার দৌলতে অর্জন করে নেন ‘সৃষ্টিশীল সমালোচকের’১ অভিধাও। আবু সয়ীদ আইয়ুবের রবীন্দ্র-ভাবনার স্বরূপ অন্বেষা এ-সন্দর্ভের লক্ষ্য।

এক (এক)
আবু সয়ীদ আইয়ুবের রবীন্দ্র-ভাবনা বেশ কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানত দুটো কারণ উলেস্নখ্য। এক. বাংলা ভাষা আইয়ুবের মাতৃভাষা ছিল না। তাঁর নিজের স্বীকারোক্তি, ‘ইংরেজিতে ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে মুগ্ধ হয়ে মূল বাংলা ভাষায় ‘গীতাঞ্জলি’ পড়বার দুর্দম আগ্রহই আমাকে বাংলা শিখতে বাধ্য করে।’২ কার্যত বাংলা ভাষার ওপর তাঁর দখল ও দক্ষতা, অশ্রম্নকুমার সিকদারের ভাষায় বিশেষভাবে ‘স্বোপার্জিত’। রবীন্দ্রকাব্য ব্যাখ্যায় তাঁর পরিমিত, বলিষ্ঠ ও সংহত প্রয়োগে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন। দুই. আধুনিক বাংলা কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য শার্ল বোদলেয়ার (১৮২২-৬৭)-প্রবর্তিত ‘অমঙ্গলবোধ’ রবীন্দ্রকাব্য-চিন্তায় কীভাবে বিসত্মৃত এবং তার প্রকৃতি কেমন সেটা শনাক্ত করতে গিয়ে আইয়ুব অন্যসব অগ্রজ ও সমকালীন রবীন্দ্র-আলোচকের অনুধাবন, মন্তব্য ও মীমাংসা অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথকে দাঁড় করিয়ে দেন সমহিমায়, তুলনামূলক বিচারে অনেক ওপরে, ‘রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ’৩ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিরিশের এবং আরো অনেকের অভিযোগ ছিল উনিশ শতকীয় ‘ভরপুর রোমান্টিকতা’ দ্বারা তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন। বিশ শতকের গোড়ার দিককার বৈশ্বিক অমঙ্গলবোধ তাঁকে পীড়িত করেনি। ‘বিশুদ্ধ কাব্যের আবেগ’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাধনা করেছেন যা মূলত অধরা সৌন্দর্য পিপাসায় আর্ত ছিল। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ‘কারও-কারও অভিযোগ হল এই যে তিনি ঐশ্বর্যশালী লোক ও জনসাধারণের আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন,
তিনি আধ্যাত্মিক সত্যে বিশ্বাসী ও বুর্জোয়া প্রতীক।’৪ রবীন্দ্রনাথকে ‘সব্যসাচী’ ও ‘তপস্যাকঠিন’ আখ্যা দিয়েও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
রবীন্দ্র-888sport live football সম্পর্কে বলেন, ‘রবীন্দ্র 888sport live footballে যে দেশ ও কালের প্রতিবিম্ব পড়ে, তার সঙ্গে আজকালকার পরিচয় এত অল্প যে তাকে পরীর দেশ বললেও, বিস্ময় প্রকাশ অনুচিত।’৫ এ বিবৃতির সারাংশ – রবীন্দ্রনাথ কাললগ্ন ছিলেন না।
অমঙ্গলবোধ ও দেহাত্মবোধ যে কালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সেটা বিশ শতকের গোড়ার দিকের আধুনিক কাল। অমঙ্গলবোধের বিশিষ্টার্থক ব্যাখ্যা অন্বেষায় সেই আধুনিক কালের স্বরূপ চিহ্নিতকরণ প্রাসঙ্গিক। যেহেতু রবীন্দ্র-জীবন ও কাব্যের ভাব ঐশ্বর্যের পূর্ণ বিকাশ ঘটে আধুনিককালে, তিনিই আধুনিক বাংলা কাব্যের একটি পরিপূর্ণ যুগ। বৈশ্বিক পরিবর্তনগুলো তাঁর যুগেই সম্পন্ন হয়েছিল। আধুনিক কাল ও কাব্য সম্পর্কে আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত, অন্তত মুক্তিপ্রয়াসী কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করছি।’৬ এই সংজ্ঞায়নের মধ্যে যুক্ত রয়েছে আধুনিকতার অনেক যুগ-লক্ষণ। দীপ্তি ত্রিপাঠী বাংলা কাব্যে আধুনিককালের অনেক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেন। একটা বিশেষ সময়কে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সেগুলো প্রণিধানযোগ্য। ‘যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাত’, ‘আত্মবিরোধ’ ও ‘অনিকেত যন্ত্রণা’, ‘বিশ্বসংস্কৃতি-ঐতিহ্য পরিগ্রহণ’, ‘সত্য-সুন্দরের বদলে দেহজ-কামনা ও প্রেমের শরীরী রূপের প্রাধান্য’ ‘অবচেতন মানস্ক্রিয়া’, ‘ভগবান ও প্রথাগত নীতিধর্মে অবিশ্বাস’।’৭ এসব লক্ষণযুক্ত আধুনিকতার উদ্ভাবক শক্তি হিসেবে সক্রিয় ছিল তিনটি আন্দোলন যা আধুনিকতার আগমনকে বেগবান করেছিল। এক. ডারউইনের উদ্ভববাদ, দুই. মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ, তিন. ফ্রয়েড ও ইয়ুংয়ের মনস্তত্ত্ববাদের বিশেষ বিশেষ প্রয়োগ। এছাড়াও আধিপত্যবাদী ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল দখলে রাখার জন্যে সংঘাত ও সামুদ্রিক পথের আবিষ্কার। অন্যদিকে 888sport apk ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ক্রমবিকাশ দ্রম্নততর হওয়া সত্ত্বেও মানব-অস্তিত্বসমূহ বিপর্যয়ের মধ্যে বিপুল হতাশা ও নৈরাশ্যের ভেতর জেগে উঠেছিল, নিশ্চিন্ত বিশ্বাস ও প্রশান্ত জীবনের মধ্যে সুস্থিত থাকার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। রবীন্দ্রবিরোধী কবিকুল উলিস্ন­খিত বাস্তবতার সন্তান ছিলেন এবং তারই শৈল্পিক রূপায়ণ আধুনিক কাব্যের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনা। আইয়ুব তিরিশের সেই সময় থেকে তিন দশক সরে এসেও সেই পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন।

এক (দুই)
রবীন্দ্র-ভাবনা আইয়ুবের মনে উদিত হয়েছে মূলত তিরিশের 888sport app download apkর ভাবচেতনার পরিপ্রেক্ষিতে। সেই ভাবচেতনার অন্যতম উপাদান – ‘দুঃখবোধ’ ও ‘পাপচিন্তা’। এই ‘দুঃখবোধ’ ও ‘পাপচিন্তা’র দ্বৈতরূপ এক কথায় ইংরেজিতে ‘evil’ যার বাংলা তরজমা আইয়ুবের ভাষায় ‘অমঙ্গলবোধ’। এই অমঙ্গলবোধপীড়িত আধুনিকতার পথিকৃৎ, মালার্মের মতে, শার্ল বোদলেয়ার। শার্ল বোদলেয়ারের 888sport app download apkর বুদ্ধদেব বসু-কর্তৃক সার্থক 888sport app download apk latest version ও তাঁর চমৎকার ভূমিকা কলকাতাকেন্দ্রিক তরুণ প্রজন্মকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং তাঁরা সহসাই বোদলেয়ারের অনুরক্ত হয়েছিলেন। আধুনিক বাংলা কাব্যের পাঁচজন স্থপতি – জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে রবীন্দ্র-বলয়ের বাইরে বাংলা কাব্যের যে-ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, মূলত বোদলেয়ার ছিলেন তাঁদের ‘মন্ত্রগুরু’। অতএব রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের জবাব প্রদানকালে প্রাসঙ্গিকভাবে বোদলেয়ার আলোচ্য হয়ে ওঠেন। আইয়ুব তাই তাঁকে নিশানা ধরে নেন আলোচনার প্রয়োজনে।
এটা বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক ব্যাধিগ্রস্ততা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বোদলেয়ারের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক বিতৃষ্ণা ও বিবমিষা, অবসাদ ও প্রবল নৈরাশ্যবোধ জাগিয়েছিল। জীবনকে ভালোবাসা ও পৃথিবীকে সুন্দর ভাবার জন্য কিছু আস্থার ভাব আকৈশোর থাকতে হয়। সম্ভবত তা বোদলেয়ারের মধ্যে ছিল না। বরং জীবনকে ভালোবাসতে না-পারা এবং জগৎকে ঘৃণার্হ মনে করার প্রবণতা, যা বোদলেয়ারের কাব্যে ছড়িয়ে রয়েছে, তাকেই ধরা হয়েছে আধুনিক কাব্যের একটা ‘বিশেষ গুণ’ হিসেবে। অনেক বিবেচনার পর, আইয়ুব মনে করেন, ওই গুণের অধিকারী বোদলেয়ার এক অনন্য প্রতিভা। তিনি আরো বলেন, ‘নৈরাশ্যের এই ছায়াকে কায়া দিয়েছেন বোদলেয়ার। তার অভূতপূর্ব প্রকাশ, প্রকাশের পরোৎকর্ষ ঘটেছে তাঁর 888sport app download apkয়। এসব স্বীকার্য। তবু বলব, একটি বিশেষ মুডের, বিশেষ একটি রসের অনন্য এবং অনবদ্য কবি বোদলেয়ার – তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।’৮
রোমান্টিসিজমের অতি-প্রাবল্যের প্রতিবাদে বোদলেয়ারের অ্যান্টি-রোমান্টিক মেজাজের উত্থান। বৈশ্বিক বিতৃষ্ণা ও পাপবোধ, যা বোদলেয়ার তাঁর কাব্যের মুখ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরেন, তৎকালে কলকাতাসহ বিশ্বের সব বড় রাজধানী শহরের বাসিন্দা – কবি-888sport live footballিকদের সেটা বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। সে-কারণে রবীন্দ্রবিরোধীদের বক্তব্য, ‘জগতের অশুভ, কদর্য, বীভৎস রূপটা তাঁর চোখে ঠিকমতো ধরা পড়ে নি, রোমান্টিক ভাবালুতায় রাঙানো গোলাপী কাঁচের বেশ পুরু চশমা পরে তিনি সব কিছু দেখেছেন। – স্বভাবত তাঁর মনে হয়েছে, ধন্য এই মানব জীবন, ধন্য এই বিশ্বজগৎ।’৯ এই ধারণার ঠিক বিপরীতে বোদলেয়ার ও তাঁর অনুগামীদের অবস্থান। রোমান্টিকরা যেখানে ‘মাধুর্য ও প্রেমের কবি’, সেখানে বোদলেয়ার এবং তাঁর অনুগামীরা তিক্ততা ও ঘৃণার কবি। রোমান্টিক কল্পনার আবরণ ছিঁড়ে বাস্তবতার নগ্ন রূপকে তিনি নিরীক্ষণ করেছেন। কী বীভৎস সেই নিরীক্ষণ! এক কথায় তাঁর বিশ্ব-বিতৃষ্ণা ছিল তাঁর ‘কাউন্টার রোমান্টিসিজমের’ অঙ্গবিশেষ। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বিশ্বজগতের অনুভবরাশি যেখানে ‘সাবজেক্টিভ’, সেখানে বোদলেয়ার ব্যাপকভাবে ‘অবজেক্টিভ’। আইয়ুবের ভাষায়, বোদলেয়ার ফোটালেন ‘পঙ্কজাত পুষ্প’। তাঁকে এও বলা যায়, ‘রোমান্টিকরা যদি হন যৌবনের কবি, বোদলেয়ার তাহলে জরার কবি।’ অন্যপক্ষে রবীন্দ্রনাথ কখনো জরার কবি ছিলেন না। যৌবনময় চেতনার বহুরূপ ও রূপান্তর নিরন্তর ঘটেছে তাঁর কাব্যিক উচ্চারণে, পূর্ণগতিতে।
রবীন্দ্রনাথ সর্বাধিক রোমান্টিক ছিলেন। তবে ‘তাঁর রোমান্টিকতা বস্ত্তলোক অতিক্রান্ত ছিলো না কখনো। আজীবন তাঁর সাধনা ছিল পূর্ণতার, সামঞ্জস্যবিধানের।’১০ সেই রোমান্টিকতার সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সংবেদনশীলতায়, কল্পনাবৃত্তির নিগূঢ়তায়, নবোন্মেষশালী উদ্ভাবনক্ষমতায় ও অনুভূতির অন্তর্মুখীতায় ছিলেন রোমান্টিক।’১১ রবীন্দ্র-রোমান্টিকতার নিগূঢ় প্রকৃতি উপলব্ধির ক্ষেত্রে সমকালীন যুগ ও জীবনার্থের স্বরূপ অধ্যয়ন করতে হয়েছে আইয়ুবকে। তিনি উপলব্ধি করেন, বর্তমান যুগের হৃদয়-মন-গ্রাস করা মিথ্যাটি হলো – অমঙ্গলের এবং কদর্যতার সর্বব্যাপ্তি। এদের দাপটে কিটসের সেই সমীকরণ উলটে দিয়ে বলতে হয়, ‘যা কদর্য তা সত্য, যা সত্য তা কদর্য।’১২ রবীন্দ্রবিরোধীদের দিকে তাকালে এই আক্ষেপোক্তিকে অবাস্তব মনে হয় না। সবাই যখন বিশ্বব্যাপী নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি দেখে আধুনিক কালকে সরাসরি অবক্ষয়ের চূড়ান্ত কাল বলে অভিহিত করেন, আইয়ুব তাতে কিছুটা আপত্তি তোলেন। ‘অবক্ষয়’ পুরোটা নেতিবাচক অর্থবাহী। এ-যুগকে সম্পূর্ণ অবক্ষয়ের না বলে রবীন্দ্র-ভাষায় তিনি ‘ক্ষয়ক্ষতির যুগ’ বলাকে শ্রেয় মনে করেন। কারণ অনেক কিছু ধ্বংস ও বিনাশের পরেও ভালো কিছু রয়ে গেছে, নয়তো সভ্যতা টিকল কী করে? মানবীয় অগ্রযাত্রার ভিত্তি ও বিশ্বাস ঠিক এখানটায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সভ্যতার চরম সংকট উপলব্ধি করেছেন, সতর্ক করেছেন মানুষকে। তবে সেইসঙ্গে মানবমঙ্গলের ধারায় একটা চিরকালীন শুভবোধের প্রতি তিনি শেষাবধি আস্থা রেখেছেন। আইয়ুবের নিজস্ব বিশ্বাসও এর সঙ্গে বিজড়িত। তিনি মনে করেন, মানুষের অস্তিত্বে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে চিরস্থায়ী হওয়া যায় না, নিরন্তর অগ্রগতি ঠিক থাকে না। আইয়ুবের নিখুঁত পর্যবেক্ষণে এ-সত্য বেরিয়ে আসে যে, অমঙ্গলবোধ মাত্রায় অল্প ও গুণে স্বতন্ত্র। আধুনিক 888sport live footballে অমঙ্গলবোধ স্বাভাবিক বা যথাযথ নয়, সযত্নচর্চিত, মাত্রাজ্ঞানরহিত। – এবং সেটা শাশ্বতকে বিগত ভাববার মতো সংকীর্ণ মন তৈরি করে দিচ্ছে।’১৩
রবীন্দ্রপ্রেমে আইয়ুবের বাংলা ভাষা শেখা, বিরোধীদের সমালোচনার জবাব প্রদানের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রকাব্য বিচারের উদ্যোগ। রবীন্দ্র-বিচারে তিনি যে-মানদ- ঠিক করে নিয়েছেন সে-সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্র-কাব্যে আমি অমঙ্গলবোধের ক্রমবিকাশ দেখাবার চেষ্টা করেছি, তাঁকে আধুনিক সাব্যস্ত করবার জন্যে নয়। কবি রূপে তিনি কেমন করে আমার চোখে মহৎ থেকে মহত্তর হয়ে উঠেছেন সে কথাটা, সেই আনন্দটা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার জন্যে।’১৪ এ-কথা এ-সত্য প্রতিপাদন করে যে, আইয়ুব মুগ্ধ তন্ময়তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত রবীন্দ্রপাঠকে কম্পারেটিভ স্টাডির মধ্যে টেনে নিয়েছেন। এই স্টাডির গভীরতা এসেছে বাংলা ভাষার সমকালীন কতিপয় আধুনিক কবি শুধু নন, আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত দর্শন, 888sport live football, 888sport live chatকলা ও ধর্মতত্ত্বের বিশাল ক্ষেত্রে তাঁর বিসত্মৃত পঠন-পাঠনের অভিজ্ঞতা থাকার জন্য। সে-কারণে আইয়ুবের রবীন্দ্রপাঠ অ্যাকাডেমিক না হয়ে ব্যক্তিগত, প্রচারমুখী না হয়ে আত্মসমৃদ্ধির, ক্ষণিকের উত্তেজনা নিবৃত্তির না হয়ে কালোত্তীর্ণ আকাঙক্ষা ও অনুধাবনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তিনি যখন বলেন, তাঁর পাঠলব্ধ আনন্দ পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে আগ্রহী, তখন এমনটা ভেবে নেওয়া যায় না যে, তিনি কেবল বোদলেয়ার-প্রবর্তিত অমঙ্গলবোধই রবীন্দ্রকাব্য ছেঁকে ছেঁকে বের করে দেখাবেন। মূলত তাঁর রবীন্দ্রপাঠ যেমন সুদীর্ঘকালের একাগ্র পরিশ্রমী প্রয়াস এবং মোহমুক্ত, তেমনি তাঁর রবীন্দ্র-অনুধাবন সর্বাধিক পরিশুদ্ধ। একজন মহৎ কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্ব যাচাই কেবল বোদলেয়ারের বিপরীতে নয়, আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের স্থান নির্ধারণ করাও আইয়ুবের ভেতরগত অভীপ্সা ছিল। তাঁর এই প্রচেষ্টা (কাব্য-বিচারের ক্ষেত্রে) যেমন আন্তরিক, তেমনি সামগ্রিক উপলব্ধির গভীরতায় অনন্য। যেহেতু রবীন্দ্রানুরাগের তীব্র দহন তাঁকে রবীন্দ্র-সৃষ্টিসম্ভারে চার দশকের বেশি সময় একনিষ্ঠ আন্তরিকতায় ধরে রেখেছিল। বাংলা 888sport live footballে হাজার বছরের ইতিহাসে রবীন্দ্র-প্রতিভার অলৌকিকতা সন্দেহাতীত। অনেক আলোচক রবীন্দ্রনাথকে তাই ‘গুরুদেব’ মেনে সেই অলৌকিক প্রতিভার কেবল গুণকীর্তন করেছেন। কিন্তু এটা সত্য যে, ‘প্রতিভা যে অলৌকিক শক্তি, তাকে তাই কেবলমাত্র স্বীকার করা চলে, কিন্তু বিচারের ক্ষেত্রে তার অলৌকিকত্ব বাদ দিয়েই তাকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে।’১৫ এ-বোধ আইয়ুবের উপলব্ধিতে ছিল। সেহেতু অলৌকিকতা একপাশে রেখে তাঁর আন্তরিক চেষ্টা ছিল রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করা, আবিষ্কার করা। রবীন্দ্রনাথকে
যথাযথ মূল্যমানে আবিষ্কার করতে তাই আইয়ুবের জন্য আদৌ কঠিন হয়নি। তিনি কেবল রবীন্দ্র-কাব্যের সরল সাধারণ বিশ্লেষণ করেননি, রবীন্দ্রনাথের মনোভঙ্গি বা ভাব-ভাবনার মূল দ্যোতনাটা ধরতে এবং পাঠককে বোঝাতে গিয়ে সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করেছেন। একই ভাবনা যদি প্রথম পর্যায়ের 888sport app download apk এবং শেষ পর্বের 888sport app download apkয় ব্যক্ত হয়ে থাকে, বা মধ্যপর্বে, অথবা তা কোনো বিখ্যাত গদ্যে দেখা যায় এবং তার মধ্যে যদি মাত্রাগত কোনো পার্থক্য অনুভূত হয়, তাও তিনি নিরঙ্কুশ নিষ্ঠায় বিশ্লেষণ করতে ছাড়েননি। বিশুদ্ধ কবি-মনের স্বরূপ সন্ধান – আইয়ুবের মূল লক্ষ্য হিসেবে কাজ করেছে। 888sport app download apkর একটি ভাব বিশ্লেষণের প্রয়োজনে অনুরূপ ভাবোদ্দীপক একটি গান বা গদ্য-রচনার উদ্ধৃতি সংযুক্ত করে তিনি নিজের আলোচনাকে পোক্ত করেছেন। এর মধ্যে উদ্ধৃতি বাহুল্য ধরা পড়েনি বা অন্য আলোচকদের মতামত খুব বেশি ধার-কর্জ করেননি, বরং নির্মোহ সমালোচকের সততা সর্বত্র অক্ষুণ্ণ থেকেছে। একজন মহৎ সমালোচক হিসেবে এখানেই আইয়ুবের বিশিষ্টতা। এক (তিন)
আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থের মাধ্যমে আইয়ুব রবীন্দ্রকাব্য আলোচনার গভীরে প্রবেশ করার সময় একটা অনুসিদ্ধান্ত পেশ করে নেন যা মূলত তাঁর রবীন্দ্র-বীক্ষণের সারকথা। ‘রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apk রোমান্টিকতার পরাকাষ্ঠা এবং তার প্রধান উপাদান বিস্ময়বোধ ও তার চিত্তনিবেদন ঈশ্বরপ্রেমে।’১৬ তবে এই রোমান্টিক ভাবাবেগ সারাজীবন একই তালে রবীন্দ্রকাব্যে সমান তরঙ্গে প্রবাহিত হয়নি। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে বহু ঘটনা-দুর্ঘটনায় কবি মর্মাহত ও আলোড়িত হয়েছেন এবং তারই প্রত্যক্ষ ছাপ-ছায়া তাঁর 888sport app download apkর অঙ্গসৌষ্ঠবে অসংশয়ে ছড়িয়ে আছে। সেটাও আইয়ুব চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেন।
আইয়ুবের রবীন্দ্র-ভাবনা যা আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮)গ্রন্থে পরিব্যক্ত হয়েছে, পান্থজনের সখা (১৯৭৩) ও পথের শেষ কোথায় (১৯৭৭) গ্রন্থে তা আরো প্রসারিত ও পরিপূর্ণতা পেয়েছে। আইয়ুব রবীন্দ্রনাথকে প্রথম থেকেই একটা পরিপূর্ণ বিশ্বাসের মধ্যে আবিষ্কার করেন। রবীন্দ্রনাথের সেই বিশ্বাসের জগৎ – বিশ্বব্রহ্মা- পরিব্যাপ্ত, যুগ-যুগান্তর ধরে বয়ে চলা মানুষের চিরন্তন সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনা, জড় ও প্রাণের উজ্জীবন ও ধ্বংস, শুভ ও অশুভের দ্বান্দ্বিক বিকাশ, সভ্যতার বিপুল আয়োজনে মানবের রক্তরঞ্জিত কষ্ট-প্রচেষ্টা, মৃত্যু ও জীবনের অন্তহীন লীলা, প্রতিদিনকার
হতাশা-দৈন্য দুর্ভোগ দ্বারা পরিপূর্ণ। রবীন্দ্রভাবজগৎ – মানবজীবনের বিপুল বিস্ময় বিজড়িত প্রশান্ত উপলব্ধির অপূর্ব প্রকাশ – কাব্য, নাটক, গান ও শেষ জীবনের চিত্রকর্ম তারই বিশেষ 888sport live chatরূপ এবং তার চিরন্তনতার আবেদন কখনো সর্বাংশে ক্ষুণ্ণ হবার নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের এমন একজন কবি যাঁর কাব্যসম্ভার বা 888sport live chatকর্ম জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি ও উপলব্ধি না জেনে পাঠ করা যায় না। কখনো কখনো মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন উপলব্ধির গভীরতা তাঁর কাব্যের চেয়ে বেশি। তাই মোহিত সেন, অজিতকুমার চক্রবর্তী কিংবা নীহাররঞ্জন রায়ের রবীন্দ্রকাব্যের বিষয়বস্ত্তগত ব্যাখ্যার চেয়ে কাব্যের ভাবগত ঐশ্বর্য ও তার পূর্বাপর যোগসূত্র মূল্যায়নে আইয়ুব যেন অনেকটা অগ্রগামী। কাব্যে বিধৃত ভাবের দ্যোতনা ধরা তাঁর লক্ষ্য, 888sport app download apkর বিষয় আলোচনা আকস্মিক, উপলক্ষ মাত্র। আধুনিককালের বিসত্মৃত পটভূমিতে
রবীন্দ্র-কবি-কর্ম মূল্যয়ন করতে গিয়ে আইয়ুবের আলোচনা তাই হয়ে উঠেছে দর্শনতত্ত্বাশ্রয়ী, জীবন-জগৎ সম্পর্কে রবীন্দ্র-ভাবনার তাত্ত্বিক সারাংশ।
আইয়ুবের রবীন্দ্রভাবনা অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। তাঁর এই স্বাতন্ত্র্য আবদুল মান্নান সৈয়দের কাছে এভাবে ধরা পড়ে, ‘মোহিত
সেন-অজিতকুমার চক্রবর্তী থেকে যে রবীন্দ্র-সমালোচনার ধারা প্রবাহিত, তার একটি শিখরে আরোহণ করেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। আইয়ুবের মতো কালের নিরিখে রবীন্দ্রনাথের শাশ্বত মূল্যাঙ্কন করেন নি আর কেউ।’১৭ রবীন্দ্র জীবন-দর্শন ও কাব্যপরিক্রমা নিয়ত পরিবর্তনশীল – নানাবিধ পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এগিয়েছে, প্রমথনাথ বিশী কিংবা নীহাররঞ্জন রায়ের এমন সিদ্ধান্তে আইয়ুবের অনাস্থা নেই; তবে রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তায় কবি ও ঋষির দ্বৈতরূপ গভীর আত্মতায় তিনি অনুভব করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ভেতর কবিসত্তার সন্ধানে গিয়ে একজন ঋষিকেও পেয়ে যান, যিনি গীতার চেয়ে উপনিষদীয় ভাবধারায় উদ্দীপ্ত। সেই উদ্দীপনার ব্যাখ্যা আইয়ুবের কাছে মুখ্য নয়, রবীন্দ্র-কবিসত্তার স্বরূপ উন্মোচনই মুখ্য। বস্ত্তত তাঁর কবিসত্তার নানামুখী প্রকাশ আইয়ুব নিরীক্ষণ করেছেন। তাঁর নিরীক্ষণ অন্তর্ভেদী, তুলনামূলক এবং অনেকান্তে সিদ্ধান্তসূচক।
রবীন্দ্রকাব্যের আইয়ুবীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সারাৎসার এভাবে পাঠ করে নেওয়া যায় – প্রাক-মানসী পর্বে অতিরোমান্টিকতার সঙ্গে মিশেছে বহির্মুখীনতা, তবে মানসী পর্বে দেখা যায় একজন কবির সঙ্গে একজন 888sport live chatীর যুক্ততা। এখানে ব্যক্ত হয়েছেন নৈরাশ্য-হতাশা ও বিরহ-বোধের তীব্র দহন। সত্যিকার 888sport live chatীর হৃদয় দিয়ে জীবনের ভাবাবেগকে তুলে ধরার নিখুঁত চেষ্টা 888sport live chatায়িত হয়েছে মানসী পর্বের 888sport app download apkয়। সোনারতরীতে ইহলোক ও অনন্তলোক প্রসারিত সৌন্দর্য পিপাসার মধ্যে বিজড়িত ‘মানসসুন্দরী’র জন্যে আকুলতা। সেটা ‘জীবন-দেবতা’ নামে উত্তীর্ণ হয়েছে চিত্রায়। রবীন্দ্র-কাব্যবীক্ষার মধ্যে রহস্যময় অনুষঙ্গ এই ‘জীবন-দেবতা’র স্বরূপ নির্ণয়ে অনেক প্রসিদ্ধ সমালোচক অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ‘জীবন-দেবতা’ নীহাররঞ্জন রায়ের কাছে নিসর্গ সৌন্দর্যপিপাসু কবিসত্তার ভেতরগত একটা ‘ভাব-প্রত্যয়’। অনেকটা ঈশ্বরানুভূতির কাছাকাছি। তবে আইয়ুবের ‘জীবন-দেবতা’র সমীক্ষণটা ভিন্ন। চিত্রাপর্বে যে
‘জীবন-দেবতা’র খোঁজ পেলেন রবীন্দ্রনাথ, তিনি ধর্ম-নির্দেশিত ঈশ্বর নন, তাঁর প্রতীকও নন। অনন্ত অনাদিকাল থেকে কবির মানসলোকে বিরাজমান – তিনিই মুখ্য ‘জীবন-দেবতা’ যে কবিকে 888sport app download apk লেখায় আড়াল থেকে প্রেরণা জোগাচ্ছে। এই পর্বে মানসসুন্দরী ও জীবন-দেবতার সন্ধান পেয়ে চিত্রার শেষে ‘আরো কত দূর যেতে হবে’ – এই প্রশ্ন রেখে কবি সহসা অগ্রসর হন। চিত্রায় পৃথিবীর একটা করুণ ছবি আছে। এখানে অসহায় মানবসন্তান, মানবভাগ্য নিয়ে কবি ব্যথিত। ‘যেতে নাহি দিব হায়’ ‘সন্ধ্যা’ ‘এবার ফিরাও মোরে’ – এসব 888sport app download apkয় বাস্তব জীবনের প্রতিদিনকার
বিরহ-বেদনার হাহাকার ব্যক্ত হয়েছে।
কল্পনা কাব্যে তিনি ঐতিহ্যমুখী হলেন, গেলেন কালীদাসের কালে। ক্ষণিকায় নিলেন কিছু স্বস্তি, আর অন্য পথে আবিষ্কার করতে চাইলেন ভারতবর্ষকে। গীতাঞ্জলির আগে ক্ষণিকা রবীন্দ্রনাথের সফল কাব্য। সেখানে কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা আইয়ুবীয় ভাষায় ‘আটপৌরে’। রক্তমাংসের মানুষের একান্ত প্রতিবেশী হয়ে গেলেন তিনি। এখানে পূর্ব কাব্যধারায় বিধৃত সেই অতিরোমান্টিকতার ‘চড়াসুর’ অব্যাহত রইল না। ঈশ্বরের মঙ্গলময় রূপ, স্বদেশপ্রেম ও সর্বমানবের মঙ্গলচেতনার বাণীরূপ ‘নৈবেদ্য’ আইডিয়া প্রধান কাব্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। গীতাঞ্জলিতে (১৯১৩) নোবেলপ্রাপ্তি রবীন্দ্রনাথকে স্বদেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। রবীন্দ্র-ভাবজগৎ প্রভাবক শক্তি হয়ে ওঠে অনেকের জন্য। আবার কেউ কেউ মনে করেন, গীতিমাল্য বা গীতালির চেয়ে গীতাঞ্জলির সার্থকতা কিছু কম। কিন্তু আইয়ুব গীতাঞ্জলির মধ্যে ঈশ্বরভক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ দেখতে পান। দুঃখ ও পার্থিব অমঙ্গলবোধও এর মধ্যে আভাসিত। ঈশ্বরবিরহী প্রাণ বিষাদাচ্ছন্ন, তার প্রকাশ গভীর ও মধুর। আইয়ুবের ঊন-আস্তিকতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের আস্তিকতা ও ভক্তিরস বিজড়িত গীতাঞ্জলির 888sport app download apkপাঠে যথেষ্ট মুগ্ধতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর নিজের উক্তি ‘অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ভক্তি কাব্যেও আমার অ-ভক্ত মন মুগ্ধ।’১৮ যে-দুঃখ ও অমঙ্গলবোধের সন্ধানে রবীন্দ্রকাব্যে আইয়ুবের অভিনিবেশ, গীতাঞ্জলির মধ্যে তার একটি বিশেষ রূপ পেয়েছেন বলে তিনি নিশ্চিত। ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বের রচনায় দুঃখ ও অমঙ্গলবোধকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে গ্রহণ করেছেন তা এই পর্বের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এদিক থেকে তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছেন বলা ভুল হবে; কিংবা দুঃখ-দুর্দশারূপ তমসার একেবারে পরপারে আদিত্যবর্ণ মহান পুরুষকে দেখতে পাচ্ছেন, তাও ঠিক নয়।’১৯
রবীন্দ্র-কবিচিত্তে দুঃখের যে-আবাহন, গীতাঞ্জলি পর্বে তার কথা দারুণ আকুলতায় কবি ভেবেছেন। সেটা যেন একান্তই নিজের দুঃখ। আইয়ুব সুস্পষ্ট করে বলেন, ‘সেটা প্রমথনাথ বিশী, নীহাররঞ্জন রায় থেকে বেশ স্পষ্ট ও গভীর। ‘গীতাঞ্জলি’র কবি নিজেকে এবং তাঁর জীবনবলস্নভকে নিয়ে সর্বামত্মঃকরণে ব্যাপৃত, প্রায় সমস্ত 888sport app download apk
এই নিভৃত দ্বিরালাপের 888sport app download apk।’২০ প্রেমের মধ্যে, বিশেষত রবীন্দ্র- চেতনা উৎসারিত ঈশ্বর-প্রেমে দুঃখের নিবিড়তা গীতময় হয়ে ওঠে গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি নামের তিনখানি ভক্তিরসের কাব্যে। এই কাব্য তিনখানা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে অন্য আলোচকগণ (নীহাররঞ্জন রায়, অজিতকুমার, প্রমথনাথ বিশী) নিজেদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে স্পষ্ট করেননি বা বুঝতে দেননি তাঁদের একান্ত বিশ্বাসের জগৎ কোথায়। নিজেদের অনেকটা আড়ালে রেখে রবীন্দ্রনাথকে পাঠকের গোচরীভূত করার প্রয়াস পেয়েছেন তাঁরা। সেক্ষেত্রে আইয়ুব ব্যতিক্রম। তিনি নিজের বিশ্বাস-অবিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতেই রবীন্দ্রনাথকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে আইয়ুবের আত্মগত জগৎ দ্বারাই রবীন্দ্র-জগতের নিরীক্ষণ করতে হয়।
রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন তাঁদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান অন্যতম। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ব্যাখ্যা করে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ : কাব্য বিচারের ভূমিকা গ্রন্থ (১৯৭৪)। তিনি রবীন্দ্রনাথকে যেন পেছন থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, সঙ্গী বা সারথি হননি রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রকাব্যে শব্দের নির্মাণ, ব্যবহারগত কলাকৌশল, উপমা, রূপকল্প প্রয়োগ ও রাবীন্দ্রিক অনুভবে সর্বদা সত্য-সুন্দর-শোভনতা কীভাবে আভাসিত ও উদ্ভাসিত হয়েছে তার সরলরৈখিক বর্ণনা দিয়েছেন নিজের মতো। সে-বর্ণনায় আমরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে দূর থেকে নিক্ষিপ্ত চমৎকার মাধুর্যপূর্ণ কাব্যিক ভাষণ শুনতে পাই, কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সম্পূর্ণ উপলব্ধিতে আসে না। কারণ সৈয়দ আলী আহসান রবীন্দ্র-কাব্যে 888sport live chatীর কুশলতা ও শোভনতা আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, দার্শনিক সত্য নির্ণয়ে তুলনামূলক ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেননি। ‘আমি পূর্বেই বলেছি যে রবীন্দ্রনাথ মানব জীবনের একটি অবাধ ও বিপুল বিস্ময়কে আবিষ্কার করবার চেষ্টা করেছিলেন’।২১ এই বক্তব্য রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছুটা আভাস দেয়, কিন্তু তাত্ত্বিক সমালোচনার মান রক্ষা করে না। এ-ধরনের কথা অতলস্পর্শী নয়, ভাসা ভাসা। বলাকাপর্ব থেকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বযুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে যে অমঙ্গলবোধ দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন তার খোঁজ আলী আহসান করেননি। তাঁর সমালোচনাও অনেকটা নিজস্ব বাচনভঙ্গির নির্দিষ্ট ঘরানার মধ্যে আবর্তিত হয়ে টিপিক্যাল রূপ নিয়েছে, সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠেনি। আবদুল মান্নান সৈয়দ সেক্ষেত্রে আইয়ুবের সমালোচনাকে ‘সৃষ্টিশীল’ বলে অভিহিত করেন। ‘আইয়ুব রবীন্দ্রকাব্যেও
বিশ্ব-পটভূমির একটি বস্ত্তভিত্তি নির্মাণ করে দিয়েছেন তাঁকে বোদলেয়ার ও অন্য কবিদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করে। তাঁর আবেগ যুক্তিভিত্তিক, আবার তাঁর যুক্তি দর্শনাশ্রয়ী। তাঁর
রবীন্দ্র-সমালোচনা গভীর উপলব্ধিজাত, আবার নির্মনন নয় কোনমতেই। এক অসাধারণ কেলাসন সম্পন্ন করেছেন আইয়ুব মনন ও হৃদয়ের বিবাহে। দর্শনে-888sport apkে-মেশা তাঁর 888sport live footballালোচনা এই ভাবে নিজেই হয়েছে সৃষ্টিশীল।’২২ আইয়ুবের সমালোচনা সৃষ্টিশীল হওয়ার অন্যতম কারণ তত্ত্ব ও তথ্য সমবায়ে গঠিত প্রতিটি বাক্য তাঁর ভেতরগত চিন্তা-সমর্থিত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বক্তব্যে তিনি অন্যদের পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যান। নিজের উপলব্ধির মধ্যে রবীন্দ্রচিন্তাকে টেনে নিয়ে প্রথমে আত্মস্থ করেন, অতঃপর উপস্থাপন করেন। তাঁর ভাষায়, ‘প্রেমের অভিজ্ঞতা আমার নেই এমন কথা বলবো না। কিন্তু ঈশ্বরবিষয়ক যে কোন প্রকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি বঞ্চিত। শব্দ (authority) প্রমাণ হিসেবে আমার কাছে একেবারে অগ্রাহ্য, শুধু অগ্রাহ্য নয়, অশ্রদ্ধেয়। এবং দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তার পথে-বিপথে যতো এগিয়েছি, ঈশ্বরে বিশ্বাস আমার ততই ক্ষীণ হয়েছে; অবশেষে আজ প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে পৌঁছে বাল্যকালের পরম আশ্রয়দাতা, পরম কল্যাণময়, অনন্ত শক্তিধর, সকল দুঃখতাপহর কোনো বিশ্ববিধান কর্তাকে তো আর খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ যে ব্যক্তি স্বরূপ ঈশ্বরকে গ্রহণ করতে আমার মনের প্রতিটি কক্ষে প্রবল প্রতিরোধ, সেই ঈশ্বরপ্রেমে আদ্যোপান্ত অনুরঞ্জিত কাব্যকে হৃদয়ে স্থান দিতে একটুও বাধে না।’২৩ ‘ঈশ্বরভাবে ভরপুর’ বলে নয়, কাব্যের ‘সংরক্ত’ আবেদন তাঁকে গীতাঞ্জলির একান্ত পাঠকে পরিণত করে। তিনি উপলব্ধি করেন, ঈশ্বরকে কেন্দ্রে রেখে একজন কবির একাধিক অনুভূতির সুন্দর-সার্থক প্রকাশ ঘটেছে গীতাঞ্জলিতে। প্রেম ও ভক্তি – দুটো ভিন্ন ভাবাবেগ। এর মধ্যে অন্য আলোচকগণ তেমন পার্থক্য টানেননি, আইয়ুব টেনেছেন। যেহেতু তাঁর বোধকে ভিন্ন মাত্রায় নাড়া দিয়েছে। অনেক নিখুঁত তাঁর পর্যবেক্ষণ। মধ্যযুগের কবীরের ভক্তিরসের সঙ্গে রবীন্দ্রভক্তি রসের তুলনা করে আইয়ুব বলেন, ‘এঁরা (অন্য আলোচকগণ) লক্ষ্য করলেন না যে কবীর শুধু খাঁটি ভক্ত নন, ভক্তই, 888sport app download apk তাঁর পক্ষে গৌণ কর্ম; কবি না হলেও তাঁর ভক্তিরস বিন্দুমাত্র খ–ত হতো না। অপরপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ খাঁটি কবি এবং মূলত কবিই, ভক্তি তাঁর কাব্য সৃষ্টির উপাদান এবং একমাত্র উপাদন নয়; ভক্ত না হলেও তিনি উঁচুদরের কবি হতেন, কিন্তু 888sport app download apkর প্রকাশের সার্থকতা না পেলে তাঁর ভক্তিরস অচিরে শুকিয়ে যেত।’২৪ আইয়ুব শশীভূষণ দাশগুপ্তের আলোচনা সমর্থন করে বলেন যে, প্রেমের ধারা যে বৈষ্ণব পদাবলী থেকে রবীন্দ্রনাথে এসেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তিনি এটাও স্পষ্ট করে দেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর গীতাঞ্জলি পর্বের কাব্যের সঙ্গে পদাবলী 888sport live footballের একাত্মতা বোধ করেন নি।
প্রকৃতপ্রস্তাবে কবীরও ‘খেয়া-গীতাঞ্জলি’ রচয়িতার পূর্বসূরী ছিলেন না। রবীন্দ্র-প্রতিভা বিকাশে ভারতীয় ভাবধারার ও সৃষ্টিকর্মের পূর্বাপরতা যতোখানি লক্ষণীয় অপূর্বতা তার চেয়ে ঢের বেশি। তবে অপূর্বতা তাঁর ভুঁইফোড় ছিলো না। দেশের মাটির মধ্যে বহুদূর বিসত্মৃত এবং শক্ত তার শিকড়।’২৫

এক (চার)
গীতালির গান শেষ না হতেই বৈশ্বিক পরিস্থিতির স্পষ্ট ইঙ্গিত নিয়ে এলো বলাকা (১৯১৬)। অনেক আলোচকের মতে, বার্গসের গতিবাদে উদ্বুদ্ধ বলাকায় নতুন ছন্দে যৌবনময় প্রাণস্পন্দনের নিত্যচাঞ্চল্য নিয়ে পার্থিব চিন্তার ব্যাপক উৎসারণ ঘটল। আইয়ুব একটু এগিয়ে বলেন, ‘বলাকা’ কাব্যে কিন্তু নতুন কালের করাঘাতে ছন্দের মুক্তি ও ভাবের উন্মোচন একই সঙ্গে ঘটে। – বলাকাতে পশ্চিমী গতিবেগের যৌবনোচিত চাঞ্চল্য দেখা যায় এবং সাম্প্রতিককালের বিক্ষোভ। – ‘গীতাঞ্জলি’র কবি ছিলেন সমাজ থেকে বেশ একটু দূরে,আপন পরান সখার সঙ্গে একান্তে আসীন, বা এক তরীতে কূলহারা কিন্তু প্রশান্ত কানে কানে গান শোনানো যায় এতোটা প্রশান্ত সমুদ্রের মাঝখানে ভেসে যাওয়ার জন্যে ব্যাকুল। ‘বলাকা’র কবি সারা পৃথিবীর দুঃখ ও পাপের ভারে নিপীড়িত। – এতখানি সমাজসচেতন, অমঙ্গলপীড়িত, দেশ-বিদেশের দুঃখ ও পাপ বিষয়ে কর্তব্যগ্রস্ত কর্মীপুরুষের অস্তিত্ব ইতিপূর্বে অনুদ্ঘাটিত ছিল।’২৬
বলাকায় যুগের শব্দমান বাস্তবতার মুক্ত উচ্চারণ শোনা যায়। বলাকায় আঘাত-সংঘাতময় যুদ্ধবিভীষিকার ভয়াবহতা দ্বিধাহীনভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ‘পাপের মার্জনা’ নামক 888sport liveেও রবীন্দ্রনাথ বিশ্বব্যাপী পাপাচারীর পরিণাম এবং মানবভাগ্যের কথা বলেছেন। যুদ্ধ বাধিয়ে যারা বিশ্ব ধ্বংস করেছে তাদের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অসহায় মানুষের অরুন্তুদ বেদনার কথা কে বলবে? রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলো। আইয়ুব বলেন, ‘বস্ত্তত এত বিরাট, এত ভয়াবহ, এত দুর্বিষহ ও দুর্বোধ্য আকারে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ ও পাপের চেহারা ইতিপূর্বে কখনো দেখেননি, কল্পনার চক্ষেও না। এর ফলে তাঁর ধর্মচিন্তা, জীবনবোধ, হৃদয়ানুভূতির বর্ণালী, কাব্যরচনার ধারা – সবই বদলে গেলো। একটু তলিয়ে দেখলে এই নতুন কবির পরিচয় ‘বলাকা’তেও আমরা পেতে পারি; তবে তার অব্যর্থ স্বাক্ষর শেষ পর্বের (অর্থাৎ ‘পরিশেষ’ ও তৎপরবর্তী) কাব্যেই পরিলক্ষ্য।’২৭ রবীন্দ্রকাব্যে, আইয়ুবের মতে, একটা বিশ্বদর্শন ক্রমান্বয়ে সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। বুদ্ধদেব বসু যেখানে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেন, ‘জীবন ও 888sport app download apk বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ আজীবন একই ধারণা পোষণ করতেন’২৮, সেখানে আইয়ুবের নিবিড় রবীন্দ্রপাঠ ভিন্ন কথা বলে। নৈবেদ্য থেকে গীতালি পর্যন্ত তাঁর ভক্তিরসধারা ক্ষীণ হয়ে সত্য ও সুন্দরের প্রতি গভীর আকর্ষণ তৈরি হয়। ‘তাঁর চরম মূল্যবোধের স্থানাঙ্কদ্বয়
(co-ordinate) গেল পাল্টে। এই নতুন কো-অর্ডিনেট ফ্রেম সম্বন্ধে অবহিত না হলে রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কাব্যের রস গ্রহণ ব্যাহত হবে।’২৯ আইয়ুব শেষ পর্বে কবি রবীন্দ্রনাথ ও দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক ধরনের অমীমাংসিত বোঝাপড়া লক্ষ করেছেন। গোটা রবীন্দ্রকাব্য সম্পর্কে তাই তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা, ‘রবীন্দ্রনাথের দর্শন শ্রদ্ধেয়, কিন্তু আরো অনেক ঊর্ধ্বে তাঁর দার্শনিক অপূর্ণতা ও
অতৃপ্তি-সম্ভূত গীতিকাব্যের স্থান।’৩০
শেষ পর্বের কাব্যে আইয়ুব রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তার যথার্থ রূপের পরিচয় উদ্ঘাটন করেন। রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথের এমন আত্মপ্রকাশ তাঁর কবিসত্তার বিপুল বৈচিত্র্যকে চিহ্নিত করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর এই নতুন ভাবসমুদ্র সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সেই মহাভাবসমুদ্রে ‘মহামানব’, ‘বিশ্বমানব’, ‘চিরন্তনমানব’ সন্ধান করেন তিনি। এ পর্যায়ে ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ নন, কবি রবীন্দ্রনাথই আইয়ুবের অন্বিষ্ট। বিখ্যাত ‘শিশুতীর্থ’ 888sport app download apkর ভাববস্ত্ত পাঠ করে আইয়ুব এটাকে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ 888sport app download apkরূপে নির্বাচন করেন। ‘এই দশ পৃষ্ঠার ঠাসবুনানো রচনায় আছে মহাকাব্যের সুবিসত্মৃত পটভূমি, মহোচ্চ ভাব ও অনুভব, আছে বলিষ্ঠ ভাষার গম্ভীর ঝংকার।’ মানবসভ্যতার অতীত থেকে বর্তমান, জড় থেকে জীবন, জন থেকে বিশ্বজনতা, একক থেকে বিরাট সমাজে চলমান সেই চিরপুরনো বিদ্বেষ, হিংসা, মূঢ় সংস্কার, স্বার্থান্বেষীর চক্রান্ত – উক্ত 888sport app download apkর ক্যানভাসে বিধৃত হয়েছে। উঠে এসেছে দেশে দেশে যুগে যুগে প্রেম ও প্রজ্ঞার বাণী নিয়ে আগত মহামানবের কথাও। মানুষ তাদের সত্য দেবতাকে খুন করে যুগে যুগে যে-মূঢ়তার পরিচয় দিয়েছে তাও রবীন্দ্রনাথ উলেস্নখ করেন। মানুষ অমানুষ হয়ে ওঠে। তবু মানুষই সত্যের সাধনা দ্বারা ভেতরের পশুশক্তিকে জয় করতে সচেষ্ট হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস হারান না,৩১ চেয়ে থাকেন সেই অনাগত কালের দিকে, যখন মানুষ জয় করবে তার পশুস্বভাবকে। অবতার বা মহাপুরুষ নন, ঘরে ঘরে ভূমিষ্ঠ হবে পূর্ণ পুরুষ, পূর্ণ মনুষ্যত্বের চিরজীবিত আদর্শ।৩২ প্রসঙ্গত মানুষের ধর্ম গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ যে-প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, সভ্যতার সংকট সত্ত্বেও মানব অগ্রগতিতে যে আস্থা রেখেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ বা ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ – এই ঘোষণার মধ্যে তার পূর্ণতা আছে। শেষ পর্বের কাব্যে কখনো স্রেফ গদ্যে, কখনো মুক্ত পদ্যে উপনিষদীয় ভাবসত্য ‘স্বে মহিম্ন’, আপন মহিমায়, এ-কথা ব্যক্ত হয় জ্বালাময়ী ভাষায়। ‘মনুষ্যজাতির দেবকল্পনার ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে তার আপন পূর্ণতার আদর্শকে গড়ে তুলবারই ইতিহাস; আপন পরিপূর্ণ বিকাশের চরম আদর্শকে মানুষ ভগবান বলে জেনেছে চিরকাল’।৩৩ ‘দেশ-বিদেশের ধর্ম শাস্ত্র ভাগবানকে যতো মানবোত্তীর্ণ বিশ্বতিগ রূপেই কল্পনা করুক না কেন, বস্ত্তত, মনুষ্যত্ব-বিকাশের চরম আদর্শ ছাড়া ভগবানের আর কোন মানে নেই।’৩৪
রবীন্দ্র-কাব্যের দার্শনিকতা বিচারের হেতু থাকতে পারে, তবে তাঁর কাব্যিক সৃষ্টির মধ্যে মানবিক আকুতির স্বরূপ বিশ্লেষণ একজন সমালোচক হিসেবে আইয়ুব কোনোভাবে উপেক্ষা করেননি। গীতাঞ্জলি পর্বে ‘বৈষ্ণব-ঘেঁষা’ ভাবধারা ও শেষপর্বের ‘পরিশেষ ও শেষ লেখা’ পর্যন্ত ‘শৈব-ভাব’ লক্ষ করা যেতে পারে। তবে আইয়ুব তারও একটা মীমাংসা টানেন এভাবে, ‘গীতাঞ্জলি-র ভাব
বৈষ্ণব-ঘেঁষা হলেও ঠিক বৈষ্ণবীয় নয়। পদাবলীর সঙ্গে গীতাঞ্জলি-র সাদৃশ্য যতোখানি, বৈসাদৃশ্য তার চেয়ে বেশি। তেমনি শেষ পর্বের সঙ্গে কোনো প্রচলিত শৈব মতের মিল খুঁজতে যাওয়া প-শ্রম। বৈষ্ণবই হ’ন আর শৈবই হ’ন, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই।’৩৫ দার্শনিকের মধ্যে তাত্ত্বিকের বাস, কবির মধ্যে বাস করেন রক্তমাংসের মানুষ। বড্ড বেশি সংবেদনশীল মানুষ। এই মানুষটির মধ্যে আত্মা-পরমাত্মা, অনুরাগ-বিরাগ, সংক্ষোভ ও যন্ত্রণা, বিরহ-আনন্দ, ত্যাগ ও নিবেদন ক্রিয়াশীল। এগুলোই কাব্যের বিষয়বস্ত্ত রূপে ধরা দেয়। দার্শনিকের চোখ দিয়ে জীবন ও জগৎকে নিরীক্ষণ করা এবং রসিকের দৃষ্টিতে জীবন ও জগৎকে অবলোকন করা এক নয়। আইয়ুব নিজে দর্শনের ছাত্র এবং শিক্ষক ছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের 888sport app download apkয় বিধৃত আটপৌরে ভাবনার ভেতর থেকে দার্শনিক লক্ষণগুলো ছেঁকে আলাদা করতে পেরেছেন। বিশ্বভূমার সঙ্গে ব্যক্তির যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব চলছে ‘তার জ্বালাটাই হয়ে উঠে 888sport app download apk; সমাধানে নৈর্ব্যক্তিক, নিরাসক্ত অনুসন্ধিৎসা থেকে জন্মলাভ করে দর্শন।’৩৬ 888sport app download apk ও দর্শন আলাদা। 888sport app download apk রূপকের রচনা, দর্শন উপমাহীন সত্যবোধ। কিন্তু জীবন উপলব্ধির ক্ষেত্রে দার্শনিকের তাত্ত্বিকতা না থাকলে তা 888sport app download apk হোক বা চিত্রকলা, তা কালোত্তীর্ণ হয় না। রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে অতিরোমান্টিক, গীতাঞ্জলিপর্বে আধা বৈষ্ণব, শেষ পর্বে কিছুটা শৈবভাবধারার হলেও কাব্যে যে জীবন নিরীক্ষণ ও মানব মূল্যায়ন পেশ করেন তার ভেতর থেকে আমাদের এক ধরনের দার্শনিক সত্যকে খুঁজে নিতে হয়, সেখানে বৈশ্বিক অমঙ্গলবোধ দ্বারা যত প্রভাবিত হন বা না হন। আইয়ুব কিন্তু সমগ্র আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমাদের এই কথাটি ব্যাপকভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে এভাবে আগে কেউ কখনো বিশ্লেষণ করেননি। রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবন একটা নির্দিষ্ট দশকের যুগার্থ দ্বারা নির্ণীত হয়নি, জীবন ও জগৎ বলতে রবীন্দ্রনাথের মনে জাগ্রত ছিল প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যিক মূল্যবোধ যা বেদ-উপনিষদ-বৈষ্ণব ভাবধারার সমর্থনে ঋদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথের শেষপর্বের কাব্যের দিকে দৃষ্টি ফেলা যাক। পরিশেষ কাব্যে যা বলা হয়নি তা তিনি পুনশ্চ কাব্যে বললেন। ‘ছেলেটা’ বা ‘ক্যামেলিয়া’ প্রভৃতি 888sport app download apkয় নিত্যদিনের মানুষের ছবি আঁকলেন তিনি। সেঁজুতি কাব্যে এসে জীবনের পথে-প্রান্তে পতিত পার্থিবের মধ্যে অনুভূত অপার্থিব রসসম্পদের অশেষ মূল্য আবিষ্কার করলেন কবি। রবীন্দ্রনাথ সাধারণ তুচ্ছের মধ্যে জীবনের মহার্ঘ্যের সন্ধান পেলেন। এটা টলস্টয়ের শেষ জীবনের প্রচেষ্টার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। রাশিয়ান ‘মুজিক’ বা ‘কৃষকে’র মধ্যে জীবনের অনন্যতা বিদ্যমান। টলস্টয়ের এই প্রত্যয়ের খুব কাছে শেষ পর্বে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান। জীবনকে মহৎ রূপে উপলব্ধির এটাও একটা উপায়। অনেকটা অনিবার্যও বটে। কারণ জীবনের অখ- সমগ্রতার
কথা যদি ধরা হয়, তাহলে রাবীন্দ্রিক মানস বিবর্তনের এই ক্রমবিকাশ একটা সামগ্রিকতারই প্রকাশ। যেহেতু ‘রবীন্দ্রনাথ বিশুদ্ধতত্ত্ব ও চিন্তাবাদী দ্রষ্টা নন, তিনি তত্ত্বাবেগ, চিন্তাবেগ ও জীবনাবেগের 888sport live chatী।’৩৭
‘প্রামিত্মকে’ এসেছে কাব্যিক উচ্ছ্বাসের বদলে মননশীলতার তীব্রতা। ‘জন্মদিনে’ জন্ম ও মৃত্যুর মিলন কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে কবির উপলদ্ধি পরিব্যাপ্ত হয় ব্যাপকভাবে। আত্মসমীক্ষণ করে কবি স্বীকার করে নেন, বিচিত্র পথে গেলেও তাঁর কাব্য সর্বত্রগামী হয়নি। আরোগ্যের পরে শেষলেখা তাঁর জীবনের শেষ উপলব্ধি, যা তাঁর বিরাট ঘটনাবহুল জীবন উপলব্ধির দলিল। মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তিনি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ভাষায় জীবনের শেষ সত্য আবিষ্কার ও উপলব্ধির কথা বলেছেন। তিনি নিবিড়ভাবে বুঝতে পেরেছেন – সৃষ্টির পথ বিচিত্র ছলনাজালে আকীর্ণ, মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পাতা নিপুণ হাতে এ সরল জীবনে। উপমাহীন ঋজু সরল বক্তব্যে জীবনের চরম দার্শনিক সত্য উচ্চারিত হয়েছে শেষলেখা কাব্যে। জীবনের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে কবি মানবজীবনের রহস্যঘেরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত সত্যোচ্চারণ করলেন, মানবজাতি ও মানবজীবনের মহত্ত্ব অনুভব করলেন। উপমাহীন ভাষায় বললেন,
সত্য যে কঠিন
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ আত্মবিশ্বাসী, আস্থাশীল একজন আত্মসমাহিত মানবপ্রেমী কবি। বৈরাগ্যের মধ্যে মুক্তির কোনো পথ খোঁজেননি তিনি। আইয়ুব তাই আমাদের 888sport app download for android করিয়ে দেন, ‘মনে রাখা ভাল যে রবীন্দ্রনাথ প্রথমত এবং শেষতও অনুরাগেরই কবি।’৩৮
আইয়ুব যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে অমঙ্গলবোধ রবীন্দ্রকাব্যে দেখানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মূলত সন্ধান করেছেন একটা ‘বিশুদ্ধ কবিমনে’র। এই বিশুদ্ধ কবিমন ক্ষণকাল ও মহাকালের টানাপড়েনে আলোড়িত। মহাকালের পটে ক্ষণকালের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে চেয়েছেন কবি। ‘কখনো অমৃতভরা ধাবমান মুহূর্তগুলো’ বাঙ্ময় হয়েছে নিবিড় অনুভূতিরসে রঞ্জিত হয়ে। শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ বার্ধক্যজনিত পীড়নের কবলে শক্তিহীন হয়েছেন শরীরে। তাঁর মধ্যে জাগতিক দুঃখ ও পাপবোধের মাত্রাও বেড়েছিল যথেষ্ট। তবে আইয়ুব লক্ষ করেছেন, ‘মানুষের অপরাজেয় শক্তি ও অনন্ত সম্ভাবনায় বিশ্বাস তাঁকে তিক্ত নৈরাশ্যের কবল থেকে রক্ষা করেছিল মৃত্যুদিন অবধি।’ দুই মহাযুদ্ধে নির্বাপিতপ্রায় মনুষ্যত্বের ভস্মসত্মূপে দেখতে পেয়েছেন চিরমানবকে। তাঁর ওপর ভরসা রেখে সমকালীন যুগের অমঙ্গলবোধ নয়, চিরকালের অশুভ ও অসুন্দরকে অতিক্রম করে যাওয়ার প্রেরণা দেন মানুষকে। আইয়ুব যথার্থই বলেন, ‘কোন কালে কোন দেশে একজন মানুষও যদি ‘নিজ মর্ত্যসীমা’ চূর্ণ করে থাকে, দুঃখের সীমান্ত খুঁজতে বেরিয়ে থাকে, তবে সেইখানে আমরা দেখতে পেয়েছি ‘নক্ষত্রের ইঙ্গিত’ ভুল হয়নি, সেই একটি মানুষ মনুষ্যত্বকে রক্ষা করেছে দ্বিপদবিশিষ্ট পশুত্বের গ্রাস থেকে, বলে গেছে – এ জগৎ স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন নয়, কাফকার 888sport alternative link নয়।’৩৯
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সরাসরি বলার চেয়ে আইয়ুবের এই প্রতীকী সিদ্ধান্ত তাঁর নিজস্ব নীতি অবস্থান থেকে এক বিরাট স্বীকৃতি। তবে ‘রবীন্দ্রানুরাগী আইয়ুব’ নিজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যত মুগ্ধতা পোষণ করুন, রবীন্দ্রনাথকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশেস্ন­ষণ করতে কোথাও
দ্বিধা করেননি। রবীন্দ্রকাব্যের বিষয়বস্ত্ত নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি 888sport app download apkর ভাব-বিভাব সমেত আলোচনা করেছেন। তবে রবীন্দ্রকাব্য-ভাবনার আইয়ুবীয় সারাৎসার – রবীন্দ্র সৌন্দর্যচেতনা, মানবপ্রেম, ঐতিহ্যপ্রীতি, 888sport apkবোধ, প্রকৃতি অনুধ্যান, ঈশ্বর ও ধর্ম বিশ্বাস এবং জীবনে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের অভিব্যক্তি।
‘888sport app download apkর ইতিহাস যে টেকনিকের ইতিহাস’ সে-কথা জানা সত্ত্বেও আইয়ুব রবীন্দ্র888sport app download apkর প্রকাশশৈলীর ওপর বিশেষ কোনো নজর দেননি। শুরুতেই তিনি সে-কথা বলে নিয়েছেন। 888sport app download apkর রূপাঙ্গিকের উৎকর্ষের ওপর যাঁরা অধিক জোর দিয়েছেন তাঁদের ব্যাপারে আইয়ুব বলেন, ‘শুধু রূপের পরোৎকর্ষ কোনো কবির রচনা মহত্ত্বের শিরোপা লাভ করতে পারে না। পরম রূপাতীত ও ব্যক্তিত্বের বহর ছোট হতে পারে।’

এক (পাঁচ)
রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apkর বাইরে 888sport alternative link বা ছোটগল্প যদি যাচাই করতেন তাহলে অমঙ্গলবোধের পরিচয় আরো স্পষ্টাকারে পেতেন আইয়ুব। আবদুল মান্নান সৈয়দ এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে আইয়ুব 888sport app download apkর বাইরে এসে রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর আলোকপাত করেন তাঁর পান্থজনের সখা গ্রন্থে। রবীন্দ্রযাত্রার সফলতা ও সার্থকতার রূপটি বারবার উঠে এসেছে গানে। আস্তিকতায় অনাস্থা সত্ত্বেও আইয়ুব কী নিবিড় আত্মতায় রবীন্দ্রগানের ভাষ্য রচনা করেছেন, যা অনেকটাই তাঁর আত্মোৎসারিত। বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথ গানে যদি অধরা কোনো সৌন্দর্যের, ঈশ্বর নামে কোনো সত্তার আরাধনাকে চিত্রিত করে থাকেন তাহলে আইয়ুব রবীন্দ্রনাথ নামক একজন 888sport live chatীকে ধ্যান করেছেন, তার বাণীরূপ দিয়েছেন ক্ষুদ্রকায় গ্রন্থগুলোতে। আইয়ুব রবীন্দ্রনাথকে এতটা আত্মস্থ করেছিলেন যে, তিনি রবীন্দ্রভাবকে নিজের বক্তব্য দ্বারা ভিন্নমাত্রায় পূর্ণতাদানের প্রয়াস পান কখনো কখনো। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঈশ্বরভাবনা প্রকাশ করতে যেখানে বলেন, ‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’ আইয়ুব সেখানে বলেন যে, ভক্ত কি ভগবানকে বলতে পারে না – ‘অর্ধেক সত্য তুমি, অর্ধেক আমারই রচনা?’
গানের ভাষ্য রচনাকালে আইয়ুব পরিষ্কার করে বলেন যে, রবীন্দ্রগান বা 888sport app download apkকে আলোচ্য বিষয় করার পেছনে সরল কোনো ব্যাখ্যা প্রদান উদ্দেশ্য ছিল না। ‘উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের গান-888sport app download apk ও নাটকের পিছনে যে জগৎ-নিরীক্ষা এবং ঈশ্বরভাবনার পটভূমিকা কখনো স্পষ্ট-গোচর কখনো আবছা রয়েছে, তারই স্বরূপ-সন্ধান।’৪০ গানের বিপুল কাব্যশক্তির কারণে বিশ্বের মহোত্তম কবিদের একজন হিসেবে রবীন্দ্রনাথ যখন নিজের গানের সুরকার তখন সেই গানগুলো কালোত্তীর্ণ হয়েছে তার কথার জন্যে; সুরের জন্যে নয়। গানের আলোচনায় আইয়ুব বলেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুরের 888sport live chatোৎকর্ষ ও ব্যঞ্জনাশক্তি সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই, তবু বলবো সুর সেখানে, রথ, সারথি নয়, কথার সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা ও
আদিগন্ত বিস্তার হৃদয়ের গভীরে পৌঁছিয়ে দেওয়া তার কাজ।’ গানের জাত বিচার, সুর বিচার, ভাব-বিভাব বিচার ও রাগ-রাগিণী বিচার করতে গিয়ে আইয়ুব রবীন্দ্র-প্রতিভার প্রতি সূক্ষ্মতম দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। আইয়ুব যখন দাবি করেন যে ‘রবীন্দ্রনাথকে আমি নিবিড়ভাবে চিনি’, তখন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অন্য যে-কোনো সমালোচকের চেয়ে তাঁর অনুধাবন ও বিবৃতিকে অনেকটা আস্থা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে গ্রহণ করতে দ্বিধা থাকে না। একজন মহৎ কবির কাছে মানুষের প্রত্যাশা সম্পর্কে আইয়ুব পূর্ণমাত্রায় সচেতন। ‘আমরা মহৎ কবির কাছ থেকে প্রত্যাশা করি অনুভূতির সূক্ষ্মতা, প্রশস্ততা, উদারতা।’ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এগুলোর প্রতিটি বিদ্যমান। তাই আইয়ুব যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে পেতে চেয়েছেন ঠিক যেন সেভাবেই পেয়েছেন এবং সেই প্রাপ্তির আনন্দটা পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। ‘আমি রবীন্দ্রনাথের যতোটুকু পেয়েছি আমার ভাবনা ও বেদনায় তাতেই আমি ধন্য হয়েছি। সে-ধন্যতা যদি আরো পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি তবে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।’৪১
ভাবকে বাদ দিয়ে কেবল রূপের পরোৎকর্ষ বিচারে কেউ যে তাঁর রচনার জন্য মহত্ত্বের শিরোপা পেতে পারে, ভাবের অনন্যতাও প্রয়োজনীয় এই অনুষঙ্গে এবং এরই প্রতিতুলনায় রবীন্দ্র-কাব্যালোচনার অবতারণা করেছিলেন আইয়ুব। ‘রবীন্দ্রনাথ কেবল শুভ ও সুন্দরকেই দেখেন নি, কেবল ‘আনন্দ, মঙ্গল ও ঔপনিষদিক মোহ’ বিস্তার করেন নি তাঁর ষাট বছরের কাব্যরচনায়, আরো অনেক কিছু দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন আমাদের।’৪২ এই যে ‘আরও অনেক কিছু’র অনুসন্ধান যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে আইয়ুব-প্রদর্শিত পথে, বিশেষত রবীন্দ্র-888sport live footballের অঙ্গনে,
নতুন কাব্য-সমালোচকের হাত ধরে, সে-কথা নিঃসন্দেহে
বলা চলে। সেইসঙ্গে আইয়ুবের রবীন্দ্র-ভাবনার বিচিত্র মাত্রা নতুনভাবে চিহ্নিত হবে পাঠকের কাছে। রবীন্দ্র-কাব্য
ব্যাখ্যায় আইয়ুবের নিজস্ব, একান্তই অন্তর্গত অনুরাগ ও অধীত দর্শন মিশে যে-মীমাংসা পাওয়া গেছে তা কেবল স্বতন্ত্র নয়, অনেকটা উঁচুতে রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অশ্রম্নকুমার সিকদার আইয়ুবের রবীন্দ্র-ভাবনার কিছু সমালোচনা করেও শেষতক
বলে দেন, ‘পা–ত্য ও স্বচ্ছ চিন্তাধারার যুগল-মিলন তাঁর রচনাকে দিয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য।’ এই সাফল্যের বহু দিক সবিস্তারে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। কারণ বাংলা 888sport live footballে
আইয়ুবের মাধ্যমে আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ নতুন আলোয়
স্পন্দিত হয়ে ওঠেন। আইয়ুব যেন বাংলা 888sport live footballে একজন
কারলাইল। তাই তিনি কেবল পাঠকের 888sport apk download apk latest version নয়, সুচিমিত্মত পঠন-পাঠনও দাবি করেন। তাঁর রবীন্দ্র-ভাবনার গভীরতা নির্মোহ দার্শনিকতায় ভরপুর। তার কারণও অস্বচ্ছ নয়, আইয়ুবের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছিল জগৎ ও জীবনের একটা সামগ্রিক অর্থবোধ। তার প্রেক্ষণবিন্দুতে দাঁড়িয়ে তিনি
রবীন্দ্র-888sport app download apkর বিষয় ও ভাববস্ত্ত বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। তাঁর মধ্যে একটি সামগ্রিকতা সন্ধানের অভিনিবেশ সক্রিয় ছিল পূর্বাপর। খ- নয়, প্রান্ত নয়, টোটাল রবীন্দ্রনাথই তাঁর আরাধ্য ও অনুসন্ধিৎসার বিষয় ছিল। আইয়ুবের রবীন্দ্রালোচনার ভিত্তিতে একটি সুচিমিত্মত ও পূর্ণাবয়ব 888sport live footballতত্ত্ব সহসাই তৈরি হয়ে গেছে। ফলত মননশীল পাঠক তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারেন না।
তথ্যনির্দেশ
১. রবীন্দ্রনাথ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, প্রথম প্রকাশ, 888sport app ফেব্রম্নয়ারি
২০০১, পৃ ১৯২।
২. পথের শেষ কোথায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পঞ্চম সংস্করণ,
কলকাতা জানুয়ারি ২০০১, পৃ ৯।
৩. আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, আবু সয়ীদ আইয়ুব, দ্বিতীয় সংস্করণ,
দে’জ পাবলিকেশনস, কলকাতা ১৯৭৪, পৃ ১২৫।
৪. 888sport app download apkর কথা, জীবনানন্দ দাশ, প্রথম সংস্করণ, ১৩৬২, পৃ ২২।
৫. ‘সূর্যাবর্ত’, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, স্বগত, পৃ ২২৮।
৬. ভূমিকা ‘আধুনিক বাংলা 888sport app download apk’, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও
হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
৭. আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয়, দীপ্তি ত্রিপাঠী, দে’জ
পাবলিকেশনস, কলকাতা ১৯৭৪, পৃ ৩।
৮. আধুনিকতা ও রবীনদ্রনাথ, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ২৩-২৪।
৯. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১০।
১০. 888sport app download apk ও সমাজ, রফিকুলস্নাহ খান, প্রথম সংস্করণ, বাংলা
একাডেমি, ১৯৮৫, পৃ ৮৬।
১১. রবীন্দ্রনাথের 888sport alternative link : চেতনালোক ও 888sport live chatরূপ, সৈয়দ
আকরম হোসেন, প্রথম প্রকাশ, 888sport app ১৯৮১, পৃ ৩৪।
১২. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৩৪।
১৩. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৪০।
১৪. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১৪।
১৫. বাঙলার কাব্য, হুমায়ুন কবির, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা
১৩৬৫, পৃ ৬১।
১৬. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১৭।
১৭. প্রাগুক্ত, আবদুল মান্নান সৈয়দ, পৃ ২০০।
১৮. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৬৫।
১৯. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৬৫।
২০. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৬৭।
২১. রবীন্দ্রনাথ : কাব্যবিচারের ভূমিকা, সৈয়দ আলী আহসান,
দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯১, পৃ ৬১।
২২. প্রাগুক্ত, আবদুল মান্নান সৈয়দ, পৃ ১৯২।
২৩. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৬৯।
২৪. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৮৩।
২৫. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৮৪।
২৬. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৮৬-৮৭।
২৭. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৯৩।
২৮. বুদ্ধদেব বসু 888sport live সংকলন, পৃ ৬।
২৯. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৯৬।
৩০. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ৯৭।
৩১. রবীন্দ্রনাথ, 888sport app download apk ‘জয়ধ্বনি’, নবজাতক।
৩২. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১২১।
৩৩. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১২৩।
৩৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানুষের ধর্ম, পৃ ১৬৫।
৩৫. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১২৫।
৩৬. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১২৭।
৩৭. প্রাগুক্ত, সৈয়দ আকরম হোসেন, পৃ ৩৪।
৩৮. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১৩১।
৩৯. প্রাগুক্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১৩৫।
৪০. পান্থজনের সখা, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১৫।
৪১. পান্থজনের সখা, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১৯।
৪২. পান্থজনের সখা, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পৃ ১৭।