আমার গুরুর আসনতলে

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা

রবীন্দ্রনাথকে আমি দেখিনি। গান, 888sport app download apk, গল্প, নাটক, আমার দেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে আলোছায়ায় স্বপ্ন প্রদোষে তাঁর উপস্থিতি ছিল। দূর থেকে হৃদয়ে তাঁর উপলব্ধি ক্রমশ নিবিড় হচ্ছিল, কিন্তু দূরত্ব ঘোচেনি। মোহরদির হাত ধরে আমি সেই দূরত্ব ঘোচালাম। দূরের মানুষ যেন এলো আজ কাছে। মোহরদি নিয়ে গেলেন সেই চিরচেনা মানুষটির চেনাগল্পের কাছাকাছি। কবি রবীন্দ্রনাথকে দেখলাম মোহরদির গুরুদেবের ছবিতে। কেমন ভাবে ছোট্টবেলায় ফ্রকপরা বালিকা মোহর ডাক পেলেই দৌড়ে দৌড়ে চলে যেতেন উত্তরায়ণে। এক দৌড়ে গুরুপল্লি থেকে খেলার মাঠ পেরিয়ে সেই উদয়নের সামনে। হাওয়ায় উড়ন্ত চুল। কপালে, নাকের মাথায় জমত শ্বেতকণিকা; কিন্তু ছোটা থামাত না। গুরুদেব বসে থাকতেন তাঁর ইজিচেয়ারে শুভ্র-সৌম্য মূর্তিতে, কখনো বা লেখায় রত। তাঁর ঘরে কাচের বয়ামে রাখা থাকত ছোটদের জন্য লেবেঞ্চুষ। পৌঁছে গেলেই একটা করে হাতে ধরিয়ে দিতেন। সেটাও বড় কম আকর্ষণ ছিল না। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল গান শেখা। গুরুদেবের ডেকে পাঠানো মানেই নিশ্চয় সদ্য-রচিত কোনো গান শিখতে হবে। কখনো তো এমনও হয়েছে, ভরদুপুরে স্নান-খাবারের সময় রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভৃত্য বনমালী এসে উপস্থিত – বাবামাশাই ডেকে পাঠিয়েছেন। মা তাতে একটু বিরক্তই। এই দুপুরে উত্তরায়ণে গেল, ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যাবে। স্নান-খাওয়া কিছুই হবে না। কিন্তু মোহরদির সে খেয়াল নেই। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ছুটে চলেছেন নাওয়া-খাওয়া ফেলে।

গুরুদেব যখন-তখন ডেকে পাঠান। ছোট্ট মোহরের তাতে মর্যাদা বাড়ে, গুরুত্ব বাড়ে। বড়দের সঙ্গে একসঙ্গে গুরুদেবের কাছেই গান শেখে। সেই বয়সেই সেই গৌরব মোহরদি দারুণ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন। শান্তিদা, রমাদি, অমিতাদি, সুরেন কর – সব বড়র মাঝখানে একলা ছোট্ট মোহর। গুরুদেবের যেন একটু আলাদা নজরই ছিল ছোট্ট মোহরের প্রতি। গলাটা যাতে ভালো করে তৈরি হয় তাই আলাদা করে শৈলজারঞ্জন মজুমদার বলেছিলেন, ক্ল্যাসিকাল শেখাবার ব্যবস্থা করতে। সংগীতভবনে তখন অধ্যাপক চিনচোরেজির কাছেই উচ্চাঙ্গসংগীত শেখা শুরু হলো। মাঝে মাঝে গুরুদেবকে একা পেলে যাদের ওপর রাগ হতো তাদের নামে নালিশও করে আসতেন। গুরুদেব শান্ত ভঙ্গিতে হেসে বলতেন, আচ্ছা আমি বলে দেবো। একবার উদয়নে তাসের দেশের রিহার্সাল চলছে। শান্তিদা সবাইকে গান শেখাচ্ছেন, মোহরদিও সেই দলে। ‘কেন নয়ন আপনি ভেসে যায়’ গানটি মোহরদি গাইছেন, শান্তিদার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। শেষে ভেংচি কেটে বললেন – এহ! গাইতে পারে না আবার গানের দলে থাকা চাই! অপমানিত মোহরদি মহড়া থেকে বেরিয়ে উত্তরায়ণের আঙিনা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। উদীচীর বারান্দায়  বসে গুরুদেব কিছু একটা লিখছিলেন। মোহরদিকে মহড়া ছেড়ে চলে যেতে দেখে ইশারায় ডাকলেন কাছে। জানতে চাইলেন কী হয়েছে। বালিকা মোহরের গুরুদেবের কাছে কোনো সংকোচের আড়াল ছিল না। অনায়াসে কাঁদতে কাঁদতে নালিশ করলেন শান্তিদা কী বলেছেন। গুরুদেব একটু বিরক্তই হলেন, – শান্তিটাকে নিয়ে আর পারলাম না। আয়, আমি তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি। বলে নিজেই তক্ষুনি শিখিয়ে দিলেন, বালিকার উপযোগী করে। সহজ করে দিলেন সুরটি। রয়ে গেল সে-সুর মোহরদির কণ্ঠে চিরদিনের জন্য।

আরো কত গল্প, কত ভালোলাগা, কত ভালোবাসা অভিবাদন। বোলপুরে পোস্ট অফিসের উদ্বোধন হবে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরে গানের অনুষ্ঠান। বালিকা মোহরের তাতে ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’ গানটি গাইবার কথা। সেই প্রথম মোহরদির মঞ্চ-পরিবেশনা। গুরুদেব নিজে শিখিয়েছেন গান, মোহরদি স্বভাবতই খুব উত্তেজিত। মঞ্চে গুরুদেব একা ইজিচেয়ারে বসে আছেন, পুরো অনুষ্ঠান পাঠে-আবৃত্তিতে-গানে সঞ্চালন করছেন। সে-সময় তো বোলপুরে মাইক্রোফোনের অত ব্যবস্থা ছিল না। মোহরদির যখন গানের পালা, তখন বসে থাকা গানের দলের থেকে উঠে মোহরদি মঞ্চের একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে গুরুদেবের ইজিচেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে গান শুরু করলেন। ওই ছোট বয়সে তখন ঘাবড়ে যাওয়ার মতো বোধও হয়নি। মনের আনন্দে গান গুরু করলেন। মঞ্চে যে পাশে গুরুদেব স্বয়ং বসে আছেন সে-সম্পর্কে একটুও সচেতন না হয়ে হঠাৎ শুনতে পেলেন, সঙ্গে সঙ্গে গুরুদেব গান গাইছেন বেশ জোর গলায়। মোহরদি তাতে বিরক্ত দারুণ। অনুষ্ঠান শেষে সোজা  গুরুদেবকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন –

‘আপনি কেন আমার সাথে গাইতে গেলেন। ও গানটা তো আমার গাইবার কথা।’

গুরুদেব প্রশ্ন শুনে হেসে উত্তর দিলেন – ‘ওরে তোর যে এত সাহস তা তো জানা ছিল না। ভাবলাম কী জানি তুই যদি ঘাবড়ে যাস। তাই তো তোর সাথে গাইছিলাম।’

গুরুদেবের সঙ্গে এমনি ছিল মোহরদির অনুযোগ আর আবদারের সম্পর্ক। মোহরদি খুব আফসোসের সঙ্গে বলতেন – ‘তখন তো বোঝবার মতো বয়স হয়নি। গুরুদেব কত বড়মাপের মানুষ, সারা পৃথিবীর সেরা বাঙালি। আমাদের মনে হতো গুরুদেব তো আমাদেরই, আমাদের আশ্রমের, আমাদের শান্তিনিকেতনের। যখন তখন তাঁর কাছে যাওয়া যায়। সব কিছু বলা যায়। অনুযোগ, অভিযোগ, আবদার সবকিছুর জন্যই গুরুদেব আছেন।’

এর মধ্যেই গুরুদেব ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বড়রা কবিকে সারাক্ষণ ঘিরে রাখেন। ছোটদের সেখানে যাওয়া বারণ। গুরুদেব আর ডেকে পাঠান না। উত্তরায়ণে আর গানের মহড়া হয় না। এর-ওর মুখে খবর পান, গুরুদেবের শরীর খারাপ। কলকাতা থেকে বড় বড় সব ডাক্তার-কবিরাজ আসছেন গুরুদেবকে দেখতে। আগের দিন পাঠ-ভবনে গিয়ে কারো মুখে শুনলেন, পরের দিন গুরুদেবকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হবে। পরদিন ভোর না হতেই ছুটলেন উত্তরায়ণে, গুরুদেব যদি বেরিয়ে যান তাঁর যাবার আগে আর দেখা হবে না। গিয়ে দেখেন পুরো আশ্রম যেন ভেঙে পড়েছে উত্তরায়ণের সামনে। ছোট-বড়, চেনা-অচেনা, ছাত্র-মাস্টারমশাই কেউ আর বাদ নেই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু পরেই গুরুদেবকে নামানো হবে। কী এক অজানা আশঙ্কা মনের মধ্যে কাজ করছিল, তবে গুরুদেব যে আর ফিরবেন না। এটাই যে শেষযাত্রা তা ঘুণাক্ষরেও মনে আসেনি। গুরুদেবকে যখন নামানো হলো, তখন যে-গাড়িতে তোলা হবে তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন মোহরদি। গাড়িতে ওঠার সময় বুঝি চোখ পড়ল বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর স্নেহের মোহরের দিকে। মোহরদি যেন অনুভব করলেন ক্লান্ত চোখে বললেন – ‘যাই রে’। আস্তে আস্তে গাড়িটা চলতে শুরু করল। আশ্রমের সবাই চোখের জলে ‘সব হতে আপন/ আমার শান্তিনিকেতন’ গাইতে গাইতে গুরুদেবকে বিদায় জানালো। সেই শেষ বিদায়।

মোহরদির নিচুস্বরের কোমল কণ্ঠের ধীরে ধীরে বর্ণনায় আমার কল্পনার চোখে পুরো সময়টা দৃশ্যমান হয়। আমি অনায়াসে মিশে যাই ওইদিনের ওই-সময়ে।

গুরুদেবের প্রয়াণের পরে শান্তিনিকেতনে যে-মন্দির হয় তাতে মোহরদি একা গান গেয়েছিলেন। শৈলজাদা গান ঠিক করে দিয়েছিলেন ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে’। যখন মন্দিরে উপাসনার পর গান শুরু করলেন ‘কে জানে কী হলো, চোখের জলে ভেসে গেলেম।’ এ-বর্ষাগানটি শৈলজাদা যখন মোহরদিকে শোনালেন তখন গুরুদেবের প্রয়াণের খবর শান্তিনিকেতনে পৌঁছে গেছে। মোহরদি ভাবছিলেন, শৈলজাদা আমাকে এই বর্ষার গানটি কেন মন্দিরে গাইতে বলেছেন, এটি তো মৃত্যুর গান নয়। কিন্তু যখন মন্দিরে গাইলেন তখন যেন গানের ভেতরের গভীর বেদনার ভাবটি আয়নায় উপলক্ষ করলেন। গাইতে গাইতে চোখের জলে ভেসে গেলেন। বালিকা মোহরের গুরুদেবের স্নেহছায়ায় আশ্রমে বড় হয়ে ওঠার কাহিনি শুনতে শুনতে কখন নিজেরই অজান্তে তা ছবি হয়ে উঠেছে। তাতে রং লেগেছে। প্রাণ জেগেছে। সময়ের পেছনে চলে পৌঁছে গেছি সেই ফেলে আসা সময়ে। আমার রবীন্দ্রনাথের দূরত্ব ঘুচে গেছে মোহরদির গুরুদেবে এসে। যেন তাঁকে পেয়েছি উপলব্ধির গভীরতার বাইরে স্পর্শের সীমায়। আমার গুরু মোহরদি আমাকে নিয়ে গেছেন তাঁর গুরুদেবের পদতলে।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি 888sport live chatী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন স্বমহিমায় রবীন্দ্রসংগীতের সম্রাজ্ঞীর আসনে অধিষ্ঠিত, তখন আমি সংগীতভবনের ছাত্রী হলাম। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংগীতভবনের অধ্যক্ষ রূপে যেদিন প্রথম দেখলাম যেন স্বপ্নলোকের চাবি পেলাম। কী বিস্ময়! এই সেই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে। কী অপূর্ব সুন্দরী! যেন স্বর্গ কাছে মর্ত যা চায় স্বরূপ পবিত্র শুভকল্যাণী প্রতিমা। সদ্য স্নান করা ভেজা চুল পিছে ছড়ানো, সাদা ধরনের শাড়ি পরা, প্রসাধনহীন নিরাভরণ। কেবল পান-খাওয়া লাল ঠোঁটে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওহ! তোমরা 888sport apps থেকে এসেছ?’ সেই সম্বোধনে মুহূর্তের মধ্যে ‘আমার কূল যেন হল অকূল সমুদ্র, এই যে নাচে তরঙ্গ তাহার’। তরঙ্গায়িত অক্ষরকে বেঁধে রাখি সাধ্য কি তার! আবার কাছে যাওয়ার দুঃসাহসই কি আছে তখন!

সংগীতভবনের ছাত্রী হিসেবে ক্রমে পার করি সত্তর দশকের শেষ পাঁচ বছর। একটু একটু করে বাড়ে দেখাশোনা, ঘনিষ্ঠতা। পরিচয়ের দূরত্ব ঘুচতে থাকে ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে। নিয়মিত ক্লাস, মাঝে মাঝে বাড়িতে গিয়ে গান শেখা, কলকাতায় মোহরদি-পরিচালিত শান্তিনিকেতন দলের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে খুলতে থাকে সম্পর্কের এক নতুন দিক। পেতে শুরু করি বিশ্বখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতের ব্যক্তিত্ব কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোহরদি সম্বোধনের নৈকট্য। কিন্তু এ-পর্যন্তই। সদ্য পদ্মভূষণ পাওয়া, এইচ.এম. ভি গোল্ডেন ডিস্ক পাওয়া, নানা পুরস্বারের 888sport app download bdের সম্মানে, অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যস্ত কণিকার ক্ষণিক অবসরের অবকাশ নেই। ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসেন খুবই, অধ্যক্ষ হিসেবে খোঁজখবরও রাখেন কিন্তু তাঁকে নিয়ে আলাদা করে বসার সময় নেই। শিক্ষকের আসন থেকে গুরুর আসনে মোহরদিকে পাওয়ার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয় আরো এক দশক।

নববইয়ের দশকের শুরুতে আবার ফিরে গেলাম শান্তিনিকেতনে। আমার প্রাণের, আমার আত্মার শান্তির আশ্রমে। সেও মোহরদিরই আহবানে। ততদিনে নিজেকে একেবারেই গুটিয়ে নিয়েছেন মোহরদি বাইরের সংগীতের জগৎ থেকে। কেবল পারিবারিক পরিমন্ডলে আর অন্তরের সংগীতময় সত্তার মধ্যে তাঁর চলাফেরা, ওঠাবসা। আমি আশ্রয় পেলাম আমার গুরুর আসনতলে। সে আরেক রূপে পাওয়া। কর্মের অবসর। বাইরের জগতের হাতছানি সমস্ত পরিহার করেন। কিন্তু অন্তরের গানের ডালিটি নিয়ে উৎসুক অপেক্ষমাণ দানের জন্য। আমি সেই সময় পৌঁছে গেলাম। পরম সৌভাগ্য আমার, মোহরদি হাত বাড়িয়ে ডেকে নিলেন ওঁর কাছে। উজাড় করে দিলেন ওঁর গানের ডালি।

আমার দুই ছোট্ট ছেলেমেয়ে নিয়ে মোহরদির বাড়ির পাশের ছোট্ট একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। দিনরাত শুধু গানের মধ্যে ওঠাবসা। সকাল হলেই চলে যাই মোহরদির কাছে। আমি পৌঁছাবার আগেই দেখি উনি তৈরি হয়ে বসে আছেন আমার অপেক্ষায়। চলে গান, গল্প, শুনি রবীন্দ্র-গল্পের রূপকথা। পরিচয় হয় মোহরদির কাছে আসা কত বিশিষ্টজনের সঙ্গে। সবার কাছেই আমার পরিচয়, এটি আমার 888sport appsের ছাত্রী।

সম্পর্কের এক নিবিড় বন্ধন তৈরি হতে থাকে। কখনো গুরু হিসেবে, কখনো অপত্যস্নেহে, কখনো সমালোচকের কাঠগড়ায়, কখনো আবার অসম এক গভীর বন্ধুত্বের আস্থার জায়গা তৈরি হয়। আমি অনায়াসে প্রবেশ করতে থাকি তাঁর না-বলা ঘন যামিনীর মাঝে। বলতে পারি তিনি আড়ালটি ঘুচিয়ে দেন। গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের আসন থেকে আমরা অনায়াসে চলে আসি আরেক আসনে, শব্দে যার ব্যাখ্যা নেই।

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে, স্নেহে, প্রেমে আমাকে তৈরি করেন আমার আগামীর পথচলার জন্য। রবীন্দ্রনাথকে চিনতে শেখান প্রতিটি গানের মধ্যে নিবিড় উপলব্ধি দিয়ে। আমিও এক অলিখিত দায়িত্ব আর অধিকার বোধ অনুভব করি আমার মধ্যে। যেন মোহরদি আমার।

শান্তিনিকেতন-বাসের মেয়াদ শেষ হলে আমাকে ফিরে আসতে হয় 888sport appয়। কিন্তু যে-বন্ধন তৈরি হয়েছিল তা অটুট থাকে অথবা বলতে পারি আরো নিবিড় হয়ে উঠতে থাকে। প্রতি মাসে না হলেও দু-মাসের মাথায় যেতেই হতো শান্তিনিকেতনে। অপেক্ষা করে থাকতেন। প্রণাম করা মাত্রই প্রথম প্রশ্ন ছিল – কবে ফিরছ? আমাকে চাতুরীর আশ্রয় নিতে হতো সেই প্রশ্নের উত্তর এড়ানোর জন্য। প্রতি সপ্তাহে যখন ফোন করতাম প্রথম প্রশ্ন ছিল, কবে আসছ?

আজ ভাবি, কী গভীর ভালোবাসায় চারপাশের অপরিসীম একাকিত্বের মধ্যে আমার অপেক্ষায় থাকতেন। গোরাদা, রুনুদি, তানাজি পরিবারের অন্যরা সবসময় ঘিরে থাকলেও মানসিক একটা একাকিত্বের মধ্যে বাস করতেন। কোনো এক মন্ত্রবলে তাঁর সেই একাকী মনোজগতে বিচরণের সঙ্গী হতে পেরেছিলাম। কবে আমি যাব ওঁর সঙ্গে বসে বসে গল্প করব। ওঁর ফেলে আসা দিনের 888sport sign up bonus রোমন্থনের সঙ্গী হবো।

ক্রমশ আমিও সেই আস্থার জায়গাটি খুঁজে পেয়েছিলাম ওঁর কাছে। আমার জীবনের ওঠাপড়ায়, দুঃসময়ে মোহরদির সামনে চোখের জলে একাকার হয়ে যখন জিজ্ঞেস করতাম কী করব, চুপ করে গভীর অভিনিবেশে সব শুনতেন। অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে ওঁর স্বভাবসিদ্ধ শান্ত মধুর কণ্ঠে এমন কিছু বলতেন যাতে খুঁজে পেতাম সাময়িক পথের দিশা। প্রতিবার গিয়ে দেখতাম শরীর একটু করে ভাঙছে। অসহায়, একাকী, যেন জীবনের কাছেই সমর্পিত। কিন্তু তখনো স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্নের মধ্যে বাস করেন। আরেকবার 888sport appsে আসবার স্বপ্ন ছিল আমৃত্যু। তারপর এলো সেই দুঃস্বপ্নের কাল, ২০০০ সালের এপ্রিল মাস। একমাসের রোগভোগের পরে তাঁর অন্তিম যাত্রা।

আনন্দধারায় সব আছে কেবল সেই মানুষটি চলে গেলেন। যাকে ঘিরে ঘুরত আমার শান্তিনিকেতনের জীবন। সেই ঘর, সেই খোলা জানালা। সেই দূরের আকাশ। গন্ধরাজ, বোগেনভিলিয়ার ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে দূরের রাস্তার অংশ দেখা। মাঝে মাঝে পাখির ডাক। এমনকি আমি বসতাম যে-ডিভানে তাও আছে। কেবল মোহরদি নেই। প্রতি পদে পদে জানছি, জীবন কত ক্ষণস্থায়ী। সব থাকে কেবল মানুষ চলে যায়। কোথায় যায়? কোন পরবাসে? এই জীবনের মায়া, মানুষ এত সহজেই কি কাটাতে পারে। এত বছরের এত গভীর ভালোবাসা, টান – সব কোথায় যায়। তবে যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘এ জীবনে কিছু না কি হারায় না, যায় কোথায়। কেবল কি রূপ থেকে অরূপে প্রবেশ? সীমা থেকে অসীমে।’

বছর পেরিয়ে পেছন ফিরে দেখা। আমি অনেকটা পথ একা পেরিয়ে এসেছি। মাথার ওপর থেকে মোহরদির ওপর নির্ভরতার আশ্রয় সরে গেছে; কিন্তু আমি পেয়ে গেছি আমার রবীন্দ্রনাথের অনেক বড় আকাশ। সেই আকাশে অনেক আলোর উজ্জ্বলতা, অনেক তারা পথ দেখানোর জন্য। অনেক নীল-গভীর প্রশান্তি এনে দেয়। আমি এই মাটির পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথকে অন্তরে ধারণের চেষ্টা করি।

সেই দিনগুলিকে ফিরে দেখি আমার ডায়েরির পাতায়। কিছুমাত্র সম্পাদনা না করে – সে-সময়কার অনুভূতিকে ভাগ করে নিতে পারি পাঠকের সঙ্গে –

 

888sport app

৭.৩.২০০০

দুপুরের পর শান্তিনিকেতনে ফোন করেছিলাম। কয়েকদিন ধরেই মোহরদির শরীরটা খারাপ। আজ শুনলাম মিয়ান হাসপাতালে নিয়ে গেছে, কাল হয়তো কলকাতা নিয়ে যাবে। ইউরিন ইনফেকশন জাতীয় কিছু হয়েছে। ওখানকার ডাক্তাররা বুঝতে পারছে না। বড় মনটা খারাপ লাগছে। মোহরদির জন্য বড় দুঃশ্চিন্তাও হচ্ছে। এত দুর্বল শরীর কতটা ধকল সইতে পারবেন। সবদিকে ঘনায়মান গভীর অন্ধকার। পৃথিবীতে আমার জন্য শান্তির ঠাঁই দু’একটিই তো আছে। আর থাকবে না ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে।

 

888sport app

৯.৩.২০০০

সকালে মোহরদির খবর নিয়েছি। কাল রাতে ভালো ঘুমিয়েছেন। কলকাতার ডাক্তাররা বলছেন, সম্ভবত বিকোলাই ইনফেকশন হয়েছে। রুনুদিকে বললাম যদি প্রয়োজন পরে তবে আগে চলে যাব, না হলে ১৫ তারিখের আগে থেকেই যাবার টিকিট কাটা আছে।

888sport app, এয়ারপোর্ট