আমিনা ফুপু ও বোন

আমার বাপ-দাদার পরিবারে ছেলের 888sport free bet খুব বেশি। তুলনায় মেয়েরা বড় 888sport free betলঘু। বড়দাদা ইরশাদ আলীর এক ছেলে ২৪-২৫ বছর বয়সে যক্ষ্মায় মারা যান। বাবার সমবয়সী ছিলেন। তার আগেই বড়দাদি মারা গেছেন, ফলে তাঁকে পুত্রশোক পোহাতে হয়নি। বড়দাদা একা সব দুঃখ বুকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে গেছেন। দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। সন্তানহারা হয়ে তিনি আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে যান।

বড়দাদা বড় অমায়িক মানুষ ছিলেন। একেবারে মাটির মানুষ। চাচা মারা যাওয়ার পর তাঁর দোতলাবাড়িটা তিনি ভাইপোকে অর্থাৎ বাবাকে দান করে দেন। আর আমাদের সংসারের এক সদস্য হয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে গেছেন। তিনি মারা যান ১৯৪৮ সালে। তখন তারিখ মনে রাখা বা লিখে রাখার মতো আমার বয়স হয়নি। তাই শুধু মনে পড়ে, ঝামটিয়া মামাবাড়িতে আমাদের গ্রামের এক মহিলা খবরটা নিয়ে এসেছিলেন। খবরটা অবশ্য ছিল বেশ বড়। কারণ দুই দাদা পনেরো দিনের মধ্যে ইহলোক ত্যাগ করেন। দুজনই মারা যান ম্যালেরিয়ায়। ছোটবেলায় সবলসিংহপুরে আমি বেশ কয়েকবার ম্যালেরিয়ায় ভুগেছি। কেন জানি ঝামটিয়া ছেড়ে যখনি আমি বাড়িতে আসতাম, শরীর ভালো থাকত না। হয়তো ওই মহল্লা বা গ্রামের আবহাওয়া আমাকে সুট করত না। অর্থাৎ ওখানকার বাঁশঝাড়ভরা অন্ধকার পরিবেশ আমাকে ভেতরে ভেতরে পীড়িত করত। আর নতুন পুকুর নামে নতুন হলে কী হবে, ক্ষুদে পানায় ভরে যেত। গোটা পুকুরজুড়ে। এই স্নান থেকে মুক্তি পেতাম যখন দাদারা আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন অদূরে পশ্চিম দিকে কাজিদের বিরাট দিঘিতে। বড়দাদা, আমি ও আমার ছোটভাইদের নাকে, কানে ও নাভিতে সর্ষের তেলের ফোঁটা দিতেন। তেলের ঝাঁজটা নাকে এসে লাগত। বেশ একটা ভালো লাগা অনুভূতি হতো। বড়দাদা খুব আদর করে এই পর্ব পালন করতেন। আমরা স্নেহটা উপভোগ করতাম। ভালো লাগত। চেহারায় বড়দাদা কালো হলেও মুখের সাদা দাড়ি আর মাথার সাদা চুল তাঁকে খুব আপন করে তুলত। তাঁকে খুব উজ্জ্বল দেখাত। নিজের কেউ নেই, তাই আমরাই ছিলাম তাঁর কাছে গর্বের বস্তু নাতি বলে কথা!

বড়দাদার বাড়িটা দোতলা হলে কী হবে, ছিল মাটির। অবশ্য মোটা দেয়াল। ঘর বেশ ঠান্ডা থাকত। আর শীতকালে তেমন শীত লাগত না। মাটির বাড়ির এই এক মাহাত্ম্য। বাড়ির নিচে একটি কামরা। তার ওপর আর এক কামরা। সামনে ফাঁকা নয় – দাওয়া অনেকটা বড়। পুবদিকে সিঁড়ি। দক্ষিণমুখী ঘর। সিঁড়ির পর বারান্দা। কাঠের রেলিং ঘেরা। তারপর শোবার ঘর। এই কামরায় আমরা থাকতাম। বাবা কলকাতা থেকে এলে মায়ের কাছে শোয়া নিয়ে টানাটানি চলত। কে মায়ের পাশে শোবে।

এই কামরার পুবদিকে আবার একটি পাইপ দিয়ে প্রস্রাব করার জায়গাও ছিল। তবে আমরা ব্যবহার করতাম না। বাইরে বারান্দায় গিয়ে যতদূর সম্ভব দূরে প্রস্রাব সরানোর কসরত করতাম। অল্প সময়ের মধ্যেই মাটি সব শুঁষে নিত। কোনো চিহ্ন থাকত না। আমাদের নিচের কামরায় থাকতেন দু-দাদা। এক বিছানায়। এই ঘরে আমরা খুব কমই ঢুকেছি। মনে করতে পারছি না, কেমন দেখতে ছিল। শুধু উত্তরে ও পুবে একটা করে জানালা ছিল। এটুকু মনে আছে। আমার এসব বর্ণনা কেউ শুধরে দেবে, তেমন কেউ এই ধরাধামে নেই। সবাই গত হয়েছেন। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হলো, ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে এক ভয়াবহ বন্যা হয়। দামোদর প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে জল হুড়মুড় করে সমতলে লাফিয়ে পড়ে, আর সামনের সব কিছু জলের তোড়ে তৃণবৎ ভেসে যায়। জলের তোড় শুধু নয়, এই বাঁধ ভাঙার ফলে জল নামতে অনেক সময় লাগে। প্রায় ৪৫ দিন জল স্থির থাকে। যে-ভিটায় আমাদের বাড়ি, সেখানে কখনো বানের জল ওঠেনি। কিন্তু সেবার ভিটের ওপর তিন ফুট জল জমে ছিল। এতে বাড়িটি ধীরে ধীরে বসে যায়। আমাদের বাপ-দাদার ভিটে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আর কোনোদিন এর ছবি দেখতে পাবো না। কালের গর্ভে সব তলিয়ে গেল। এখনো সেই বাড়িটার কথা ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। যেন খুব আপনজনের কথা মনে পড়ে যায়। বাবা-মায়ের কথা মনে পড়লে যেমন কষ্ট হয়, অনেকটা তেমন। মানবমন এক বিচিত্র কারখানা।

এই দোতলা বাড়ি সংলগ্ন ছিল একটি টানা এক কামরার ঘর। নাম ছিল নতুনঘর। এর পাশে ছিল রান্নাঘর। কঞ্চির ওপর কাদা লেপে দেয়াল। এখানে মা-দাদি রান্না করতেন। আমাদের পবিত্র ঘর। পাকঘর। রান্নাঘর। রন্ধনশালা … কত নাম। সব শেষে কিচেন। একটু সাহেব-সুবো হতে হবে তো! কতকাল আর গাঁইয়া থাকা যায়।

আমাদের দোতলা ঘরের বারান্দা বা ব্যালকনিতে আমরা ভাইয়েরা মিলে নাচতাম। বারান্দাটা কাঁপত। আর আমাদের নাচের বেগ আরো বাড়ে। আরো কাঁপন … শেষে মায়ের ধমকে থামতে হতো। তোরা ঘর ভেঙে ফেলবি নাকি! মায়ের ধমক। খুব কড়া। ফিল্ড মার্শাল। এক ধমকেই কাজ। গুটি গুটি পায়ে নিচে নেমে দে দৌড়।

একেবারে রায়মণির ডাঙ্গা, এটা একটা পুরনো ভিটে। আমাদের সম্পত্তি। রায়মণি গ্রামে কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে কেনা হয়েছিল। ভিটের ঢিবিটুকু ছিল নতুন পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। মাঝখানটা ফাঁকা। বাকি দিকে বাঁশঝাড়। দক্ষণে ফাঁকা। গড়ান। নেবে গেছে সমতলে। তারপর গ্রামের বড় রাস্তা। রাস্তার দু-পাশে তালগাছের সারি।

এই রাসত্মা গ্রামের মুসলিম পাড়াগুলোর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। বাঁয়ে পড়ে সবলসিংহপুর জুনিয়র মাদ্রাসা। চমৎকার একতলা পাকা ভবন। গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর এলাকা। সামনে ফাঁকা জায়গাটা খেলার মাঠ। যদিও কাজিদের দিঘির দু-পাড়ে দুটো ফুটবল গ্রাউন্ড ছিল। একটা দক্ষণ-পুব কোণে – অন্যটা পশ্চিম পাড়ে। ওটা অন্য পাড়া। এই দুটো মাঠ যুবকদের খেলার মাঠ। বড়রা যখন খেলে, ছোটরা লাইনের ধারে বসে খেলা দেখে আর শেখে। তারাও তো জুনিয়র প্লেয়ার। টেনিস বল দিয়ে খেলে। ঠেলাঠেলি তার মধ্যেও কম নয়। আর লেঙ্গি মারা তো আছেই। ফাউল … ফাউল … চিৎকার করলে কী হবে … কে শোনে কার কথা। যার পায়ে বল, সে নতুন উদ্যমে ছুটছে। ডিফেন্ডাররা এবার পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়। ভেতরে ঢুকতে দেবো না। গোলকিপার এদিক-ওদিক করে সামাল দেওয়ার কসরত করে চলেছে। তার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। একমাত্র হাতে ধরার অধিকার তার। অন্যদের হ্যান্ডবল। অপরাধ। ফ্রি কিক।

বলছিলাম আমাদের পরিবারে মেয়ে সদস্যের 888sport free bet খুব কম। এক ফুপু বাবার আগে জন্মেছিলেন – নাম ছিল আনোয়ারা। বিয়ের পর হঠাৎ করে মারা যান। তাই ছোটফুপু আমিনা একা হয়ে যান। এই ফুপুরও অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমার জন্মের পর বোধ-বুদ্ধি গজানোর আগে ফুপুকে বাড়িতে দেখিনি। তিনি তখন শ্বশুরবাড়ি। পুবপাড়ায়। খুবই কাছে। এক কিলোও দূরত্ব হবে না। পাড়ার দূরত্ব। এটি সবলসিংহপুর গ্রামের পুবদিকের শেষ বসতি। তারপর ধানক্ষেত। একেবারে গিয়ে শেষ হচ্ছে মুণ্ডেশ্বরী নদীতীরে। ওপারে হরিশচক। আর উত্তর-পুবদিকে লতিফপুর। বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিরোধের ফলে অনেক জায়গার নাম পরিবর্তন হয়। যেমন লতিফপুরকে এখন সবাই ডাকে নতিফপুর বলে। আমার খুব কানে বাজে। অসহ্য লাগে হিন্দু-মুসলিম এই বিরোধের ব্যাপারটা। বাঙালি শেষ পর্যন্ত জাতিতে রূপান্তরিত হতে পারল না। এই একবিংশ শতাব্দীতেও। বাঙালি দুটি জাতি : একটি হিন্দু বাঙালি, অন্যটি মুসলিম বাঙালি। কেন জানি এ-জাতি এগোতে চায় না। শ্রেণিদ্বন্দ্ব পাকাপাকি করে রাখার জন্য এরা। মৃতপ্রায় মুসলমান চাঙ্গা হয়ে ওঠে হিন্দু মারার জন্য। তেমনি মৃতপ্রায় হিন্দু চাঙ্গা হয়ে ওঠে মুসলমান মারার জন্য। এ এক আজগুবি কাণ্ড।

পৃথিবীর সবকিছু বদলাচ্ছে, শুধু ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিমে কোনো পরিবর্তন নেই। কুকুরের লেজের মতো। শ্রেণিদ্বন্দ্ব দূর না হওয়ার এ এক বড় উপাদান বা হাতিয়ার। গেল গেল সব হিন্দুরা নিয়ে গেল … গেল গেল সব নেড়েরা নিয়ে গেল। এ এক টম অ্যান্ড জেরি সিরিজ বাস্তবে ঘটছে। চিরন্তন কার্টুনচিত্র। দেখে বেশ আমোদ পাওয়া যায়।

আমিনা ফুপুরও অল্প বয়সে বিয়ে হয়। আমার বাবা-মায়ের বিয়ের সময় আমিনা ফুপু এক পুত্রসন্তানের মা। ভাইয়ের নাম শেখ আনসার আলী। পিসান বা ফুফার নাম শেখ নজর আলী।

ফুপা শেখ নজর আলীর বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। নাতিউচ্চতার মানুষ। রং কালো। আমার মনে পড়ে খাকি রঙের হাফ শার্ট পরা এবং খাকি হাফ প্যান্ট পরা ছবি। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল। মনে হয় তিনি কোনো শামিত্মরক্ষী বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এর বেশি আর কিছু মনে নেই। আজ এসব জানতে গেলে আমাকে পুবপাড়ায় গিয়ে রীতিমতো গবেষণাকর্ম চালাতে হবে।

ফুপাতো ভাই শেখ আনসার আলীর ডিম্বাকৃতির মুখ। রং উজ্জ্বল কালো। উচ্চতাও কম। আমার চেয়ে দু-বছরের বড়।

ফুপুর ছিল আর এক মেয়ে, বোনটিও কৃষ্ণকায়। পাতলা গড়ন, ফুপুর মতো। মধ্যম উচ্চতা। নাম শামসুন নাহার বেগম। তার এই বেগম নামটিই ডাকনাম হয়ে দাঁড়ায়। বিনা বাক্য ব্যয়ে। আমরাও বেগম বলে ডাকতাম। ছোটবেলায় বেশ চওড়া মতো নাদুস-নুদুস ছিল। বড় হওয়ার পর ফুপুর মতোই তালপাতা চেহারার মহিলা। ওর চার ছেলে, এক মেয়ে বর্তমানে আমাদের ভিটায় বসবাস করে। ভাগ্নিটি অবশ্য বরের বাড়িতে থাকে। ওদের বাড়িটা যে কোন জায়গায় তাও এখন মনে পড়ছে না।

এ তো গেল আমাদের বাড়ির মহিলা সদস্যদের কথা। এবার অন্যদের কথা বলি।

বড়দাদার ছিল এক ছেলে।

মেজোদাদা অকালপ্রয়াত : শেখ ওসমান আলী।

দাদা যিনি সেজো – এহিয়ার শেষ পর্যন্ত এক মেয়েতে এসে ঠেকে।

চতুর্থ দাদার তিন ছেলে, এক মেয়ে। ফুপুর নাম আনসুরা বেগম। লম্বা-ফর্সা চেহারা। ছোটবেলায় গুটিবসন্ত হয়ে মুখশ্রী নষ্ট করে দেয়। তবু তাঁর ফর্সা চেহারায় একটা মায়া মাখানো ছিল। নাক বেশ খাড়া। গলাটা ভারী। উচ্চস্বরে হাসতেন। ফুপু আনসুরা মা ও আমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর বিয়ে হয় আমাদের পাড়াতেই। তাই ফুপু বা পিসি বলতে তিনি ছিলেন আমাদের মূল সম্পদ। একচ্ছত্র রাজত্ব।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ছোটদাদা মাত্র এক সন্তানের জনক। দাদাকে আমি দেখিনি। দাদার একমাত্র পুত্র শেখ মর্তুজা আলী ছিলেন শ্যামলা। পাতলা গড়ন। অনেকটা আমার বাবার মতো।

ছোটদাদি ছিলেন বেশ ভারী, নাদুস-নুদুস চেহারা।

গোলাকৃতির মুখটা ছিল মায়া-মাখানো। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। বংশের একজন নামী ছেলের পুত্র হিসেবে। আমার ছেলেবেলার শ্যামলা রং সবাইকে আকর্ষণ করত। মা ছিলেন ফর্সা। বাবা শ্যামলা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, আমার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রং পরিবর্তন হতে থাকে এবং উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ – প্রায় ফর্সা ঘেঁষা রং বেরিয়ে আসে। মা-নানি, নানা-মামা এঁরা সবাই গৌরবর্ণ, হয়তো বংশধারা সেখানে সক্রিয় ছিল। আমাদের তিন মা-খালা খুব কাছাকাছি ছিল রঙে ও দেখতে। মায়ের সঙ্গে মেজোখালা সাহিদা খাতুনের খুব মিল ছিল। বড়খালা মোমেনা খাতুন ছিলেন একটু চওড়া মুখশ্রীর। অনেকটা নানা শেখ কওসর আলীর মতো। বড় মেয়ে তো, বাবার জিন পেয়েছে বেশি।

নানারা যে উত্তর ভারত থেকে ঝামটিয়ায় বসবাস শুরু করেন এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ পাই। আমার ছোটভাই জাঁনেসার তখন 888sport app বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বন্ধুদের সঙ্গে শ্রীনগর দিয়ে ভ্যাগ্যকূলের দিকে রওনা দিয়েছে। পথে গ্রামের লোক ছেলেদের দলকে ধরেছে যে, তারা বিহারি পাচার করছে। বিহারি আর কেউ নয় আমার ছোটভাই জাঁনেসার ওসমান। অনেক কষ্টে তাকে ছেলেরা উদ্ধার করে এই বলে যে, সে 888sport live footballিক শওকত ওসমানের কনিষ্ঠ পুত্র এবং তারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছে।

এতে প্রমাণ হয়, আমরা কীভাবে বাংলায় উত্তর ভারতের জনগোষ্ঠী ও ইরান-তুরস্ক-আফগান-আরব ও ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ের রক্ত ধমনিতে বহন করছি। এছাড়া মঙ্গোলীয় রক্তধারা ও নিগ্রো রক্তধারারও অভাব নেই। স্বীকার করা ভালো যে, বাঙালি বর্তমানে একটি পরিপূর্ণ সংকর জাতিতে পরিণত হয়েছে। আজকে চাকরিসূত্রে অনেকে জাপানি, জার্মানি, রুশ, মার্কিন-ব্রিটিশ মেয়েদের স্ত্রী হিসেবে দেশে নিয়ে আসছেন। তাই ভবিষ্যতে বাঙালির মধ্যে নীল চোখ তরুণীর দেখা মিলতেই পারে। আর কটা চোখ বা মার্জারাক্ষী তো হরহামেশা দেখা যায়।

আমাদের পাড়ায় একমাত্র পাকাবাড়ি ছিল আনসুরা ফুপুর শ্বশুরবাড়ি। ফুপা বা পিসান শেখ হাফিজুর রহমান ছিলেন ফর্সা, মধ্যম উচ্চতার, গোলগাল মানুষ। মুখে একটা আভিজাত্যের ছাপ। পান খেতেন নিয়মিত। ঠোঁট মেয়েদের মতো রাঙা, তাই আরো সুন্দর লাগত।

এই হাফিজ ফুপার মা ছিলেন মাঝবয়সী। দেহ বেশ পেটানো – তাঁদের বংশপরিচয় আমার কিছুই জানা ছিল না, এখনো নেই। জানতে গেলে রীতিমতো গবেষণা করতে হবে। এই দাদির সঙ্গে আমাদের একটা মধুর সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে বেয়াই বলতেন। সুতরাং তিনি আমার বেয়াইন হয়ে গেলেন। সংক্ষপে আমি ডাকতাম বেন বলে। মনে হবে যেন ইংরেজি নাম। আসলে তা তো নয়। দাদির মুখে সামান্য গোঁফের রেখা দেখা যেত। আদলে একটা পুরুষালি ভাব ছিল। চুল ছোট করে কাটা। তাই তাঁকে বেশ স্মার্ট লাগত। মনে হতো যেন কোনো আধুনিকা, গ্রামে বাস করছেন। বেনের ইতিহাস আমার কিছু জানা নেই। যদিও আমাদের বাড়ির পাশেই তাঁর পাকাবাড়ি। এমন নিকট পড়শিও দূরে রয়ে গেলেন দেশভাগের ফলে। পূর্ববঙ্গে আসার পর তাঁর সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। তাঁর কবরটা যে কোথায় সে-খবরও নেওয়া হয়নি। অথচ আজ লিখতে গিয়ে তাঁকে আমি উজ্জ্বল তারকার মতো দেখতে পাচ্ছি। কী মিষ্টি আন্তরিক একটা হাসি ছিল। এমনিতে গম্ভীর প্রকৃতির, কিন্তু আমার সঙ্গে ছিল অন্তরের টান। দেখা হলেই জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতেন। সেই স্নেহের সমুদ্র ফেলে আমাকে ভিন জায়গায় জীবন কাটাতে হলো। ভাবলে আজো মনটা ভার হয়ে যায়। দেশভাগ, হিন্দুস্থান-পাকিস্তান সবই আমার কাছে ফাঁকিস্তান মনে হয়। আমার মতো কত কোটি মানুষ মানসিকভাবে ভুগেছে তার হিসাব কেউ রাখেনি। বড় কঠিন ঠাঁই। মানুষের মনোলোকের বেদনা বাইরে দেখা যায় না। আজো কত মানুষ নীরবে চোখের জল ফেলে। করে হা-হুতাশ। চৌদ্দ পুরুষের ভিটার কথা মনে করে গুমরে গুমরে মরে। কাঁদে। জন্ম-জন্মান্তরের আদি ভিটার মায়াই আলাদা। যে হারায়নি তাকে বোঝানো যাবে না। সাপের কাটা বিষ যন্ত্রণার মতো।

এই বেনদাদির কথা কেন তুললাম তার একটা ইতিহাস আছে। আনসুরা ফুপু মায়ের একমাত্র কাছের ননদ। প্রতিবেশী। মায়ের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব। মা বড়লোকের বিটি এঁদের কাছে কোনো অহংকার দেখাতেন না। তবে আমি দেখেছি পাড়ার বাকি সবাই মাকে খুব সমীহ করে চলত। একে বড়লোকের বিটি তার ওপর শেখ আজিজুর রহমানের বউ … কলেজে প্রফেসারি করেন … ব্যাপারটা তাদের হিসাবে মেলে না। পাড়ার অন্য পুরুষরা ম্যাট্রিক পর্যন্ত পাশ নয় বা সুযোগ পায়নি। বেশিরভাগ হাতের কাজে লেগে যেত। হাতের কাজে কাঁচা পয়সা আছে। ক্লাস এইট পর্যন্ত পাশ না করেও মাসে ভালো রোজগার করা যায়।

আমাদের গ্রামের জোয়ান ছেলেরা লেদ-মেশিনের কাজ, রুটি-বিস্কিটের বেকারি বা শাড়িতে জরির কাজ – এসবে লেগে যেত। গাড়ি মেরামত আরেকটি মাধ্যম। আর কেরানিগিরি তো সব শেষে আছেই। তাও ম্যাট্রিক পাশ না হলে ভাগ্যে ওটাও জুটত না। তার 888sport free bet ছিল অতি নগণ্য।

একমাত্র আমাদের পাশে মুন্সীপাড়ার কাজিরা ছিলেন ব্যবসায়ী। গ্রামে পাকা তিনতলা বাড়ি। যেন রূপকথার গল্পের মতো। বাড়ির সামনে বিরাট দিঘি। এমনকি আমাদের পাড়ার পাশে একটা লম্বা টানা ডোবা ছিল। তার পাশে অনেকটা জায়গায় ওঁদের পারিবারিক কবরস্থান। পাকা দেয়ালঘেরা। ধনী বলতে শুধু এঁদের পরিবার। ওঁদের বংশ ভাগ হয়ে আমাদের বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল দ্বিতীয় ধারা। ওঁদের লোকে বলত ওঠা কাজি। অর্থাৎ মূল ভিটা থেকে উঠে গেছে। এঁদেরই এক বউয়ের সঙ্গে আমার মায়ের খুব সখীপনা ছিল। এই কাজিবউকে আমি কাজিমা বলে ডাকতাম, তা-ও একটা ঘটনা। ওদের বাড়িতে মা আমাকে নিয়ে গেছেন। আমার বয়স তখন তিন-চার। মায়ের কোলে উঠি। মায়ের সখীর বাড়িতে যাওয়ার পর আমাকে কাজিমা কোলে নিয়ে রাখে। কাজিমা ছিলেন খুব সুনদরী। কটা চোখ – মানে মার্জারাক্ষী। ফেরার সময় আমি কাজিমার কোল ছাড়ব না। কাজিমা বললেন, ভাবি, ছেলে আমার কাছে থাক। পরে দিয়ে আসব।

সেই থেকে কাজিদের এই বধূ আমার মা হয়ে গেলেন। দীর্ঘকাল পরে গ্রামে গিয়ে শুনি, আমি গ্রামে পৌঁছার এক বছর আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। মরার আগে নাকি তিনি আমার খোঁজ নিয়েছিলেন এবং একবার দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই আশা পূরণ হয়নি। আর আমার মন এখনো কাজিমার জন্য কাঁদে। ঠিক নিজের মায়ের কথা মনে পড়লে যেমন হয়, অনেকটা তেমন। কখনো কখনো মনে হয় তার চেয়ে বেশি। ট্র্যাজেডি যুগকে ছাড়িয়ে যায়। এখনো লোকে ‘কারবালা’ নিয়ে শোক করে। যেমন করে 888sport cricket BPL rateে ফেব্রুয়ারি নিয়ে। শোক করে ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭০ নিয়ে।  ১৯৭১-এর কথা আর না-ই বা বললাম।

বেনের আলোচনা থেকে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে এসেছি। আনসুরা ফুপু ছিলেন ঘরের মানুষ, প্রতিদিন আছেন। সবচেয়ে কাছের এক ফুপু।

ছোটদাদার মাত্র একজন সন্তান মুর্তজাচাচা। সুতরাং আমাদের বংশে মেয়েদের বড় অনুপস্থিতি। সব মিলিয়ে পেয়েছি মাত্র দুজন ফুপুকে। অথচ দাদারা পাঁচভাই। আমার আপন ফুপু আমিনা থাকতেন পুবপাড়ায়। তাই আমাদের কাছে ফুপু বলতে আনসুরা ফুপু। লম্বা, দীর্ঘদেহী … ফর্সা গলাটাও ভারী … দূর থেকে হাসির শব্দ শোনা যেত।

তো এবার বেনের কথা।

আমরা তখন পিঠাপিঠি তিন ভাই। সব দু-বছর পরপর। তিন বাঁটুলের দল। যেখানে যাই তিনজন গুট গুট করে চলেছি। আমি সর্দার। বাকিরা লেঠেল।

আগেকার দিনে মানুষ ব্যাটা ছেলে হলে খুব খুশি হতো। বিপরীত দলের লোকেরা হতো মনঃক্ষুণ্ণ। ব্যাটা মানে হাতে লাঠি ধরবে। এই জন্য কথায় বলে অন্ধের-যষ্টি। অর্থাৎ শেষ বয়সে পথ দেখাবে। তখনকার দিনে ছানি কাটানো খুব কষ্টের ব্যাপার ছিল। তাই মানুষ বৃদ্ধ বয়সে চোখে দেখত কম। আজকের মতো ফেকো অপারেশন ছিল না। আজ টাকা থাকলে সব আছে। দেশে নয় তো বিদেশে। ভারত নয়তো সিঙ্গাপুর।

আমাদের পাড়ার পেছন দিকে ছিল দহলিজ। এটা যৌথ। তারপর সামান্য ফাঁকা জায়গা – এটা পাড়ার কবরস্থান। তারপর পুরুষদের টাট্টিখানা। বাঁশের বেড়া দেওয়া। ঢাল আছে। পেছনে ছোট একটা খালের মতো। ওপাশে কাজিদের পুকুরপাড়। উঁচু করে বাঁধানো। কলাগাছ-নারকেল ও 888sport app গাছের জঙ্গল।

কবরস্থানের পর একসার জুড়ে বাঁশঝাড়। সব নুয়ে পড়েছে পশ্চিমের জলাভূমিতে। ও-পাশে কাজিদের জায়গা। বিশেষ করে নামডাক ছিল হাজি খিলাফত হোসেন কাজির। তিনি ওদের বাড়ির কর্তা। ছোটখাটো মানুষ। মুখে শুভ্র দাড়ি মেহেদি রাঙানো। সাদা পাঞ্জাবি ও সাদাকালো চেক লুঙ্গি। এই ছিল তাঁর রোজকার পোশাক। গ্রামের রাসত্মায় ঘুরে বেড়াতেন। কথা বলতেন খুব কম। সম্মানী মানুষ তো! একমাত্র বাবাকে পেলে তিনি আর ছাড়তেন না। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলত দু’জনের গুফ্তগু। সেটাও ঘটত কালেভদ্রে। বছরে দু-একদিন। তা-ও ঈদের ছুটিতে সবাই যখন গ্রামে আসত সেই সময়।

এই খিলাফত কাজি সাহেবের তিন সন্তান। মেজোজন ছিলেন বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বড় দাউদ চাচা, মেজো আবু

চাচা আর ছোট জালু মানে জালাল চাচা। তিনি বাবার চেয়ে অনেক ছোট।

আবু চাচা কাজিদের অন্যদের মতোই বেঁটেখাটো, তবে ছিলেন ফর্সা। গোলগাল। তিন ভাই প্রায় এক ছাঁচের। তবে জালু চাচার রং শ্যামলা।

আমাদের বাড়ির পেছনে কবরস্থানের পাশে একটা পুকুর। মাঝখানে একটা সরু বাঁধ। দু-পারে যাওয়ার জন্য। এদিকে দক্ষণে একটা পুকুর। কম গভীর। জল প্রায় ঘোলা। উত্তরেরটা বেশ গভীর। জল ছিল গাঢ় নীল। বাঁশগাছের ছায়া পড়ে তা আরো মায়াময় করে তুলত।

একদিন সকালে আমরা তিন ভাই দু-পুকুরের মধ্যের বাঁধে বসে খেলছি। খেলছি মানে কী বড় বড় ঘাস ধরে টান মেরে তোলা। দূর্বাঘাস বেশ নরম। আর একটা ঘাস চওড়া পাতা, যাতে চোরকাঁটা জন্মায়। এই ঘাস টেনে তোলা তেমন সহজ নয়। একে তো থাকে 888sport app ঘাসের সঙ্গে চেপ্টে। দ্বিতীয়ত, শেকড় খুব শক্ত। টেনে তোলা মুশকিল।

আমার ছোটভাই হাবলু এরকম একটা ঘাস টেনে তোলার কসরত করে চলেছে। সে সফল। কিন্তু শেকড়সহ গাছ উপড়ে যাওয়ায় তাল সামলাতে পারল না। একেবারে ঝপাং করে উত্তরের গভীর পুকুরটায় গিয়ে পড়ল। এই আকস্মিকতায় আমরা হতবাক। দু-ভাই থ। আমার মাথায় কাজ করছে, কিছু একটা করতে হবে। ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে নামতে পারি। কিন্তু ভালো সাঁতার জানি না। তাছাড়া অনেক গভীর। আমি এদিক-ওদিক চাইছি। বড় কাউকে দেখা যায় কি না।

হঠাৎ চোখে পড়ে বাঁশঝাড়ের নিচে বেন পাতা ঝাড়ু দিচ্ছেন, কালবিলম্ব না করে আমি দে ছুট। হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, আমার ছোটভাই পানিতে পড়ে গেছে।

বেন কালবিলম্ব না করে ঝাড়ু ফেলে দে ছুট। ঝাঁপিয়ে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া ভাইকে তুললেন। তারপর সোজা আমাদের ঘরে। বেশ একটা জটলা জমে গেল। উদ্ধারকর্মী হিসেবে বেন অনেক 888sport apk download apk latest version-ভালোবাসা পেলেন। বুদ্ধি করে আমি এই দাদির কাছে ছুটে গিয়েছিলাম বলে আমিও প্রশংসার কিছু ভাগিদার হলাম। মনটা ভরে গেল ভাইকে বাঁচাতে পেরেছি বলে।

মা-দাদি তো প্রায় কাঁদো-কাঁদো। সবার চোখ ছলছল করছে।

কী একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল – সবার মুখে এক কথা।

আজো ছবির মতো সব দেখতে পাই। বেনের মুখে বিজয়ের হাসি। তিনি তো নায়িকা। আমরা দু-ভাই প্রায় খলনায়কের পর্যায়ে পড়তাম। ভাগ্যিস, বুদ্ধি করে বেনদাদিকে ডাকটা দিয়েছিলাম। না হয় তিনজনই একসঙ্গে জড়াজড়ি করে ডুবে মরতে পারতাম। ভাই বলে কথা। পৃথিবীতে ভাই হলো অমূল্য। ভাইয়ের স্থান আর কেউ পূরণ করতে পারে না।

আমার সেই তৃতীয় ভাই হাবলু ওরফে ইয়াফেস ওসমান পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে 888sport appsের একজন নামকরা স্থপতি। আর 888sport apps সরকারের একটানা ষোলো বছর 888sport apk ও প্রযুক্তিমন্ত্রী।

ভাগ্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়। কেউ বলতে পারে না। এটাই নিয়তির খেলা। যা হওয়ার তা হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না।

আজো যখন সেই বাঁশঝাড় ভরা অন্ধকার জায়গাটার কথা ভাবি, মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মনে পড়ে বেনদাদির কথা। পাড়ার অন্য সবার কথা। আনসুরা ফুপুর কথা … পরে তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের এক ছেলেকে দত্তক নেন। নাম রেখেছিলেন ময়না। তিনি সন্তান ধারণক্ষমতার অধিকারিণী হতে পারেননি। ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে সুখী ছিলেন। পরে এঁরাও সব দেশ ছাড়েন। চলে আসেন পূর্ববঙ্গে। পুরনো 888sport appর নারিন্দায় বাড়ি করেন। বেনদাদির কবরটা যে কোথায় তা-ও জানি না। কালের গর্ভে কোথায় হারিয়ে গেছে। ওখানে মানে ও-পাড়ায় আগের মানুষ একজনও এখন নেই। কার কাছ থেকে তথ্য নেব। তার উপায়ও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।