এক কাপ চা গিলতে তিন ঘণ্টা সময় লাগার কথা নয়। তবে শুধু এক কাপ চা নয়। কাঁটা চামচ বিঁধিয়ে আস্ত ছ’ আনার একটা চপ্ সাবাড় কোরছিলাম। ঘটনাটা অবশ্য নিছকই আকস্মিক। পকেটে যার সাড়ে তের আনা পয়সা মূলধন, তার কাছে ত বটেই।
তাঁতীবাজার থেকে হেঁটে আসছিলাম। সেপটেম্বরের ক্লাসিক্যাল রোদ। বিত্তবানদের চকচকে গাড়ীর 888sport app চরকার মত ধাবমান হোচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে। কম পয়সাবান আয়েসী সায়েবরা রিকসার হুড তুলে মাথায় টোপ লাগিয়েও চোখ বুজে ফেলছেন। আর তারই মধ্যেই হন্তদন্ত হোয়ে সঙ্কীর্ণ রাস্তায় অতি উৎকণ্ঠ সাইকেলগুলো সলি সর্পিল কোরে নিচ্ছিল। আমি কেবলই হাঁটছি সেই এগারোটা থেকে। আবলুশ রাস্তার পৈশাচিক প্রতিফলন আর ধুলোয় চোখ দুটো বয়লারের মত জ্বলছে।
শো কেসে রাখা জিনিস দেখছি। জুতোর নাকি টাকাপ্রতি এক পয়সা কাটথ্রোট দাম কমেছে। কোথাও রকমারী তৈরী শার্ট পথচারীর গায়ে চড়াও হবার জন্যে আকুতি জানাচ্ছে। ছাতার নূতন প্লাষ্টিকের বাঁটটায় নির্মাতার কারসাজির সুস্পষ্ট ছাপ। শুভ্র স্বচ্ছ একটা অন্তরঙ্গতা কাল কাপড়ের ভাঁজে কেমন উন্মোচনের একটা অধীর আগ্রহ জন্মায়। এমন কি লে লে বাবু ছয় আনা-ওয়ালা উদ্যমী ফিরিওয়ালাদের চীৎকারটা অবধি কিছুমাত্র কমেনি।
রোদ চড়লেও ব্যবসায় চলে। একটা এ্যারিষ্ট্রোক্রেট দোকানের আলম্বিত করোগেট শেডের তলায় এসে জিরোলাম। এই অপূর্ব রোদের সর্বাত্মক আক্রমণ থেকে সযত্নে রক্ষিত তিনফুট জায়গা – আদিগন্ত উত্তাপের মরুভূমিতে ওই একটু শেতল পাটির প্রলেপ। হঠাৎ এক গুচ্ছ কথা ভেসে এল কানে। উৎকর্ণ আগ্রহে শুনলাম : ব্ল্যাকে ছাড়া পাবেন না। আমিত তেত্রিশ দিচ্ছি। আরে রাখুন কনটোল।
সীসের পাইপ নিয়ে উৎকট দরাদরি। এতক্ষণ দেখিনি তাকিয়ে, এটা ছিল হার্ডওয়ারের দোকান, হোমি আদিয়ালার হেড অফিস।
আমার দরকার স্রেফ পাঁচটা টাকা। এখান থেকে বংশাল যাব। আলিমকে যদি নাও পাই বোসব। শুনেছি ও বিয়ে করেছে। বাড়ীঘর যখন আছে, নিশ্চয়ই রাস্তায় দাঁড়াতে হবে না।
তবু এই অগাধ প্রয়োজনের দুপুরটায় কেন এসে বসলাম রেস্তোরায়। কি জানি একটু বিজলী পাখার স্পর্শকাতর ছোঁয়া না মূল্যবান পৃথিবীর সর্বনিম্ন পানীয়ের আস্বাদন লোভ। বোলতে পারব না তা ছাড়া ভেবে দেখলাম দুপুরে আলিমকে না পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। কলিয়ারীর কনট্যাক্টটা নাকি ওর হাতে এসেছে ইদানীং।
ভিনিগারে পেঁয়াজটা ভিজিয়ে নিলাম। অন্ততঃ পেঁয়াজ ভিনিগার আর লবণের জন্য বাড়তি পয়সা দিতে হবে না। অদ্ভুত লাগে – অদ্ভুত পরিশ্রান্ত হোয়ে একটা চপ কাটতে – পকেটে যখন মাত্র সাড়ে তের আনা – অথচ পেতে হবে পাঁচ টাকা।
ধুপ কোরে একটা পোর্টফোলিও ব্যাগ এসে পড়ল টেবিলের ওপর। লোকটা চেনা চেনা মনে হোল। তবু সংশয় ছিল, যদি আর কেউ হয়।
শওকতই কথা বোলল প্রথম, শিন্টু না?
বোললাম, এত তাড়াতাড়ি – কথাটা সঞ্চিত সাহস নিয়েই বোললাম। পেঁয়াজটা আরেকটু বেশী ভিনিগারে ভিজিয়েই বোললাম। বোধ হয় গলাটা ভেজাবার জন্যেই।
শওকত দেখলাম রীতিমত লজ্জিত বোধ কোরল, না না এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেছি বোলছ। না না। তবে তোমার ত চশমা জোড়া ছিল না। গোঁফ জোড়াও আগে দেখেছি বোলে মনে হোচ্ছে না।
দুজনে হেসে উঠলাম। সত্যি কথা বোলতে কি পাঁচ টাকা প্রাপ্তির আরব্ধ সংগ্রাম শেষ হোতে এখনও অনেক বাকী। কথাটা মনে হোলে অত জোরে কিন্তু হাসা যেত না।
উদ্বিগ্নতা দেখিয়ে বোললাম, চা?
শওকত হাত নেড়ে বোলল, দ্যাটস্ অল্ রাইট। আমি বোলে দিয়েছি।
বাঁচলাম, অন্ততঃ আরও ছ’টা পয়সা যেত।
বিলক্ষণ আলাপ হোল।
শওকত হারান গ্লাস ফ্যাক্টরীর কমিশন-এজেন্ট। ঐ ধরনেরই কিছু একটা আশা করেছিলাম। নিজে থেকেই
বোলে ফেলল, আমাদের ফ্যাক্টরীর তৈরী কোয়ালিটি গ্লাস – লাগলে বোল।
মনে মনে বোললাম, মাটির হাঁড়ি নিয়ে যার কারবার চীনেমাটির স্বপ্ন দেখে তার লাভ?
একটু থেমে বলি, তা’ পয়সা কেমন হচ্ছে ?
পয়সা – দেখ, আমার কাঁধে ওর সবল হাত রেখে বোলল, পয়সা কোরতে জানলে আসে। এই দেখো না। কাল আমাদের কোম্পানীর পঁচিশ হাজার টাকার টেণ্ডারটা তুলতে পারলে একদম কেল্লা ফতে।
মনে মনে একটু আশান্বিত হোলাম। পঁচিশ হাজারের কনট্রাক্ট হোক না হোক, হাত পাতলে পাঁচটা টাকা নিশ্চয়ই দেবে শওকত। বড় বাঁচা যাবে তা হলে এ-যাত্রা। অদ্দূর হেঁটে আলিমের ওখানে যেতেও হবে না।
শওকতের চা এসে গেছে।
কোথায় যেন একটু অস্বস্তি বোধ কোরছিলাম। পাঁচ টাকা যার দরকার সে কেন রেষ্টুরেন্টে বোসে সামন্ততান্ত্রিক চালের একটা চপ শেষ কোরছে, এ প্রশ্ন যদি একান্তই শওকতের মনে উদয় হয়। প্রয়োজনের গুরুত্বটা যদি ও সম্যক উপলব্ধি না করে।
কৈফিয়ৎ-এর সুরেই বোললাম, কিছু মনে কোর না। সকালে খেয়ে বেরুই নি। তা ছাড়া পকেটেও তেমনি –
দেখলাম আমার প্রসঙ্গ নিয়ে নয়, অন্য কথা ভাবছে শওকত, না তেমন লস্ হবে না। পাঁচ পারসেন্ট কোরে ধোরলে কি বল –
চায়ের কাপে মুখ বুজে এবং না বুঝেই বোললাম, না তেমন আর কি? আরও হৃদ্যতা দেখালাম, শুনলাম বিয়ে কোরেছো?
ও, হ্যাঁ সে আর বোল না ভাই। সবাই বোললে বিয়ে কর।
অঢেল টাকা পাচ্ছ। কোথা দিয়ে কি হোয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে বিয়ে কর।
তা’ বেশ ত, একদিন চল না যাই। একদিন, হ্যাঁ হ্যাঁ এসো। উৎসাহ পেয়ে বোললাম, যদি ধর আজ এখুনি।
আমতা আমতা কোরে জবাব দিয়ে বোলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এস মাত্র ছ’ মিনিটের পথ।
মন্দ নয়। পরিচ্ছন্ন দুটো কামরা। স্বামী স্ত্রীর পক্ষে মনোরম। একটা বেতের চেয়ার টেনে এনে বসাল শওকত। দেখলাম পরিপাটি গুছানো। এক ধারে তাকের ওপর দুটো বনস্পতির টিন, আর তারই কাছ ঘেঁষে মার্কিনী পঁচিশ সেন্টের বই গাদী কোরে সাজানো। ছোট্ট একটা লেবেলে ঠিক তারই পাশে সযত্নে লেখা – দয়া করিয়া বই লইবেন না।
কথাটা জমাবার জন্যই বোললাম, ভাল কালেকশন ত হে?
হ্যাঁ, ভাল আর কই। ভাল যা ছিল, গেছে বন্ধু বান্ধবদের পাল্লায়। নেসফিল্ডের একটা গ্রামার ছিল। বড় রেয়ার বই। গেল সেবার। শেকশপীয়ারের কি যেন একটা লষ্ট –
বোললাম, বোধ হয় মিল্টন বোলতে চাচ্ছো।
হ্যাঁ হ্যাঁ, শেকশপীয়ারের সেই মিল্টনটাই হবে। তাও গেল।
পরিহাসের অবস্থা তখন আমার নয়। এ মুহূর্তে সব ভুল ওর ক্ষমার্হ হোতে পারে আমার চোখে।
একটা বাচ্চা মেয়ে পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এল। দুর্বল শীর্ণ দেহ। অদ্ভুত নির্জীবতার একমাত্র জলজ্যান্ত যেন ওই দুটি চোখ। কাছে টেনে আদর কোরলাম। বোললাম, বড় নাদুসনুদুস, ফুটফুটে চেহারা ত। বড় মিষ্টি হাসে ত। এই যে খুকি, কি নাম তোমার?
ভেতর থেকে ডাক এল, পুঁটু। মেয়েটা চলে গেল।
শওকত একটু নড়ে চড়ে বোসে বোলল, হ্যাঁ ভাই, বেবীকে ভেবেছিলাম একটা ইস্কুলে দেব। কোথায় আর তেমন স্কুল। দিয়েছি কনভেন্টে – তা যে কি ছাইপাঁশ পড়াচ্ছে। তবে ইংরিজী মিডিয়ম, এই যা রক্ষে।
পুঁটু জাতীয় মেয়েরাও আজকাল তা’হলে শওকতের অভিধানে বেবীতে রূপান্তরিত হোয়েছে।
কিন্তু রসভঙ্গ ঘটালো সেই বেবী অর্থাৎ পুঁটু। হন্তদন্ত হোয়ে শওকতের কাছ ঘেঁষে এসে বোলল, বাবা অধ্যবসায় মানে কি?
বিলিতী কনভেন্টওয়ালারাও কি তা হোলে আজ কাল ‘অধ্যবসায়’ শেখাচ্ছে। চুপ করে গেলাম। দেখলাম মেয়েটার দিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে শওকত। পুঁটু দৌড়ে পালিয়ে গেল।
কি যেন আরেকটা প্রসঙ্গ শুরু কোরতে যাচ্ছিল শওকত। এবার এক ভদ্রমহিলা হাতে কি নিয়ে ঢুকলেন। ভাবছিলাম আমারই শুভাগমনে মিষ্টি মুখের একটা বিনীত আয়োজন বোধ হয়।
ভদ্রমহিলা আর যাই হোক, দৈহিক সৌষ্ঠবে অপূর্ব। একটা পোষ্টকার্ড হাতে কোরে নিয়ে এসে বোলল, ছোট বুবু মতলব থেকে চিঠি লিখেছে –
তারপর আমাকে দেখে একটু সরে দাঁড়াল।
শওকত বোলল, ও ভাল কথা। পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি। আমার বৌ। আর আমার বন্ধু শিন্টু কি যেন ক্লার্ক –
আদাব বিনিময় কোরে বোললাম, সওদাগরী অপিসে।
বৌ-টি সলজ্জ হোয়ে বোসল।
যত লাজুক ভেবেছিলাম তত নয়। চিঠিটা নিয়েই পড়ছিল। হঠাৎ বোলে উঠল, দেখো, কি মজার ব্যাপার। আমাদের দু’জনেরই দৃষ্টি আকর্ষিত হোল। দেখেছো, কত জায়গা খালি। ঐটারই ফাঁকে ফাঁকে জবাবটা লিখে দি। তোমাকে পোষ্টকার্ড আনতে বোললে ত উলটো বল, পয়সা কি গাছে তৈরী হয়?
সামান্য তিন পয়সার জন্যে অতখানি আহ্লাদিপনা তাও আবার বাইরের একজন আগন্তুকের সামনে বোধ হয় ভাল লাগলো না। বিনয়ের সুরে শওকত বোলল, ওটা যে এসেছে তোমার নামে।
তাতে কি। নাম ত আর কাটবো না। ঠিকানাটা বদলে
রি-ডাইরেক্ট কোরে দোব। কত কোরেছি এমন।
হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বৌকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বোলল, ওসব কিন্তু ভারি অন্যায় – ধোরতে পারলে –
ফিরে এসে চেয়ারটায় বোসে বোলল শওকত, ব্যাপারখানা দেখ। সেদিন এক টাকার খাম পোষ্টকার্ড এনে দিলাম – এরই মধ্যে গায়েব।
কোন প্রয়োজন ছিল না এ-ধরনের কৈফিয়ৎ-এর। বিশেষ কোরে শওকতের চোখে-মুখে এই কষ্ট কল্পিত অজুহাতের ছদ্মবেশটা যখন ভাল কোরেই ধরা পড়ছিল।
এবার আর্জিটা জানাব ভাবলাম। দ্বিগুণ উৎসাহে সিঁড়ি পর্যন্ত নেবে আরও খানিকদূর পথ চলা শুরু কোরল আমার সঙ্গে।
অনেক দূর এসে পড়েছি। কথাটা প্রায় বোলতে যাচ্ছিলাম। শওকতই বোলল, দেখো কিছু মনে কোর না। গোটা তিনেক টাকা হবে। কাল টেণ্ডারটা পেলেই –
বোললাম – আমার কাছে ত মাত্তর ছ’ আনা।
তাই দাও – তাই দাও! চল এসেই পড়েছি যখন এই বেলা বাজারটাও সেরে ফেলি।
আনিস চৌধুরী
তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালের ১ এপ্রিল কলকাতায়।
তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস 888sport appsের কুমিল্লায়। তিনি একাধারে নাট্যকার, কথা888sport live footballিক, কবি ও প্রাবন্ধিক। ১৯৫৩ সালে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থেকে বিএসসি পাশ করেন। কর্মজীবনে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রেডিও ও টেলিভিশনে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতায়ও যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। 888sport live footballচর্চায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি 888sport app download bdসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯০ সালের ৩রা মে তিনি পরলোকগমন করেন।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.