হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায়
ইলশেগুঁড়ির নাচ,
ইলশেগুঁড়ির নাচন দেখে
নাচছে ইলিশ মাছ।
– সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ভোজনবিলাসীরা এ-বাক্যবন্ধটি প্রায়শ ভোজোৎসবে ব্যবহার করে থাকেন – ‘তিক্তেন আরম্ভম, মধুরেণ সমাপয়েৎ’। অর্থাৎ তিতা জাতীয় খাবার দিয়ে শুরু করে মিষ্টি জাতীয় খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে ভোজনক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। বাক্যটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত বলে অনুমান করি, প্রাচীনকালের বৃহৎ বঙ্গের মানুষের খাদ্য-রুচির পরিচয় এতে নিহিত আছে। আদিকাল থেকে সম্পন্ন বাঙালি যে ভোজনপটু ও খাদ্যরসিক তাতে সন্দেহ নেই। চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় – সর্বপ্রকার খাবারেই বাঙালি সরস। বাঙালির ভোজনক্রিয়ায় ভোজ্যদ্রব্য পরিবেশনের আছে পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিকতা। তাই সেই সংস্কৃত শ্লোকের অনুকরণে একটি বাংলা প্রবচনে পাই – ‘আগে তিতা পরে মিঠা’। তিক্ত বস্তু ও শাকজাতীয় ব্যঞ্জনের মাধ্যমে বাঙালির ভোজনক্রিয়া আরম্ভ আর সমাপ্ত হয় মিষ্টিজাতীয় খাবারের মাধ্যমে। মাঝে ঝালে-ঝোলে মাখামাখি – নিরামিষ ও আমিষ জাতীয় খাদ্য – বহু জাতের মাছ-মাংস-ডিমের সমারোহ।
মিষ্টান্নের অব্যবহিত পূর্বে থাকে অম্বল। মিষ্টান্ন বা দুগ্ধজাত খাবার না-থাকলে ভোজনক্রিয়ার পরিসমাপ্তি টক বা চাটনির মাধ্যমে। এ-কারণেও প্রবাদ আছে : ‘খাওয়ার শেষে অম্বল/ পথের সম্বল কম্বল।’ বাঙালির আদি কাব্য-সংকলন চর্যাপদে অভাব, দারিদ্র্য, খাদ্য-সংকট ও দুর্ভিক্ষের কথা আছে : ‘টালত মোর ঘর নাই নিতি আবেসী।’ তারপরও লিখব : বাঙালিরা ভোজনবিলাসী, রসনারসিক এবং খাদক। পান্তা থেকে পানতোয়া, পলান্ন থেকে খুদের জাউ, সর্ষেবাটা ইলিশ থেকে শুঁটকি মাছের ভর্তা – কোনোকিছুতেই তার রুচির দুর্ভিক্ষ নেই। মধ্যযুগের কাব্য চণ্ডীমঙ্গলে কালকেতুর ভোজনের বর্ণনা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এভাবে দিয়েছেন : ‘চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ।/ ছয় হান্ডি মুসুরি সুপ মিশ্যা তাতে লাউ।।/ ঝুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া।/ কচুর সহিত খায় করঞ্জা আমড়া ॥/ অম্বল খাইয়া বীর বণিতারে পুছে।/ রন্ধন কইরাছ ভাল আর কিছু আছে।।/ এন্যাছি হরিণী দিয়া দধি এক হাঁড়ি।/ তাহা দিয়া খায় বীর অন্ন তিন হাঁড়ি।।/ শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিটকাল।/ গ্রাসগুলি তোলে যেন তে-আটিয়া তাল।।’ এই বর্ণনা বাস্তবতাবর্জিত হলেও বাঙালির খাদক-চরিত্রের স্বরূপ অনুমান করা যায়।
দুই
বৈষ্ণব 888sport live footballে শাকান্ন ভোজনের বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি ‘মাছেভাতে বাঙালি’ – এমন প্রবাদও আছে। তবে ইলিশই বাঙালির রসনায় মাছের রাজা।
স্বাদে-গন্ধে, রূপে-রসে অতুলনীয়। ঈশ্বর গুপ্তের ‘তপসে মাছ’ 888sport app download apkটি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা বাঙালির মৎস্যপ্রিয়তায় বিমোহিত না-হয়ে পারেননি! প্রাগৈতিহাসিক ও পৌরাণিক যুগ থেকেই বাঙালির জীবন ও কর্ম এই রুপোলি জলজ শস্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। হরিশংকর জলদাসের গবেষণাগ্রন্থ বাংলা নদীভিত্তিক 888sport alternative link ও কৈবর্ত জনজীবন ও মৎস্যগন্ধা 888sport alternative link এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়া 888sport app বাঙালি-অঞ্চলে সামুদ্রিক মাছ সুলভ নয়। তবে মিঠা পানির মাছ কমবেশি সর্বত্রই মিলে। নোনা জলের রুপোলি শস্য হিসেবে বাঙালির কাছে ইলিশই সর্বোৎকৃষ্ট। শুধু নোনা জল নয় – মিঠা পানির মাছের সঙ্গে টেক্কা মেরেও ইলিশই মহোত্তম হবে। যদিও লৌকিক প্রবাদ বলে : ‘মাছের মধ্যে রুই/ শাকের মধ্যে পুঁই’ তবু ইলিশ রূপে-গুণে, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। এদেশে বিগত আশির দশকে রেডিও-টিভিতে একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন আমার বয়সীরা নিশ্চয় শুনেছেন : ‘মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা ফিলিপস্!’ ইলিশ নিয়ে যুগ-যুগ ধরে আমাদের সমাজে কত-যে গান, 888sport app download apk ও লৌকিক ছড়া রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি লোকগানে পাই এরকম : ‘রাজার পালন মাছ ইলিশা রে,/ জামাই ভোজনের মাছ ইলিশা রে,/ রান্ধনী-পাগল মাছ ইলিশা রে।/ ছাওয়াল কান্দাইন্যা মাছ ইলিশা রে।’ ইলিশ নিয়ে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের একটি চমৎকার গল্পের নাম ‘কতয় হল’ বাঙালির ইলিশবন্দনার অন্যতম সাক্ষ্য।
888sport appsের মুক্তিযুদ্ধের পর একটি লৌকিক ছড়া সে-সময়ের বালক ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল : ‘ইলিশমাছের তিরিশ কাঁটা/ বোয়ালমাছের দাড়ি।/ টিক্কা খান ভিক্ষা করে/ শেখ মুজিবের বাড়ি।’ শিশুদের বৌচি ও গোল্লাছুট খেলা এবং কিশোরদের হা-ডু-ডু খেলায় এই ছড়াটি আমাদের ময়মনসিংহ অঞ্চলে দম দিতে দেখেছি। ইলিশে ও পুলিশে একমাত্র অন্ত্যমিল ছাড়া আর কোথায় মিল তা বোঝা দায়! হতে পারে ইলিশে আছে অসংখ্য কাঁটা, পুলিশেও আছে ক্যাকটাসের মতো অগণিত কাঁটা। তবে গ্রামবাংলায় প্রবাদ শুনেছি : ‘মাছের মধ্যে ইলিশ/ চাকরির মধ্যে পুলিশ।’ পুলিশের কাঁটা ইলিশের মতোই সংগুপ্ত থাকে। সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, ধরলে বোঝা যায় তার গুপ্ত কণ্টকের ভয়াবহতা ও ক্ষমতার দাপট!
তিন
বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল হাজার-হাজার পৃষ্ঠা, লাখ-লাখ বাক্য ও কোটি-কোটি শব্দ লিখলেন কিন্তু ইলিশ নিয়ে তাঁদের একটি কথাও এ-পর্যন্ত পেলাম না। হয়তো আছে তবে আমার অজানা! অথচ ইলিশের বঙ্গীয় রাজধানী পদ্মায় কত তাঁরা 888sport slot game করেছেন! জসীম উদ্দীনের জন্মজেলা ইলিশের চারণজলা পদ্মাপারের ফরিদপুর। যদ্দূর মনে পড়ে, খুদে ডানকানা মাছ তাঁর 888sport app download apkয় এলেও মাছের রাজা ইলিশ আসেনি! সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ইলশে গুঁড়ি’ 888sport app download apkটির প্রথম লাইন ‘ইলশে গুঁড়ি, ইলশে গুঁড়ি/ ইলিশ মাছের ডিম’ – আমাদের শিশুমনকে আন্দোলিত করেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝিতে আছে রাতভর পদ্মানদীতে ইলিশ ধরা এবং ভোরবেলা জাহাজঘাটে ইলিশ বিকিকিনির চমৎকার বর্ণনা। 888sport alternative linkটির শুরুই হয়েছে ইলিশ ধরার বর্ণনা দিয়ে। তা মানিকের মধুচক্রে ভ্রামণিকেরা জানেন। তবু লোভ জাগে একটু উদ্ধৃতি দিতে : ‘বর্ষার মাঝামাঝি। পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরশুম চলিয়াছে। … নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলোকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মত দেখায়।’ 888sport app download apkয় বোধ করি এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুই সেরা! তাঁর ‘ইলিশ’ 888sport app download apkটিই এ-বিষয়ে অনন্য : ‘রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে/ জলের উজ্জ্বল শস্য রাশি রাশি ইলিশের শব/ নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।/ তারপর কলকাতার বিবর্ণ শহরে ঘরেঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ;/ কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার সরস সর্ষের ঝাঁজে।/ এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।’ বুদ্ধদেব বসুর এই কাব্যিক বর্ণনার মতো ইলিশের গাদ্যিক বিবরণ আছে মানিকের পদ্মানদীর মাঝিতে : ‘পাশেই কাঠের প্যাকিং কেসে এক সারি মাছ ও এক পরল করিয়া বরফ বিছাইয়া চালানের ব্যবস্থা হইতেছে। খানিক দূরে মেন লাইন হইতে গায়ের জোরে টানিয়া আনা একজোড়া উঁচুনিচু ও প্রায় অকেজো লাইনের উপর চার-পাঁচটা ওয়াগন দাঁড়াইয়া আছে। মাছের বোঝাই লইয়া যথাসময়ে ওয়াগনগুলি কলিকাতায় পৌঁছিবে। সকালে বিকালে বাজারে বাজারে ইলিশ কিনিয়া কলিকাতার মানুষ ফিরিবে বাড়ি। কলিকাতার বাতাসে পাওয়া যাইবে পদ্মার ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ।’ বোঝা যায়, ইলিশের বিপণন-বাণিজ্য ছিল সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই।
খাবার হিসেবে ইলিশ বাঙালির কাছে মুখরোচক পোশাকি আমিষ এবং অভিজাতও। স্বাদে-পুষ্টিতেও ইলিশ তুলনাহীন। বাঙালির কৌমজীবন থেকে ইলিশ সম্ভবত খাদ্যতালিকায় যুক্ত। তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের খাদ্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে ইলিশের কথা খুব কম। তবে নিরামিষভোজী ব্রাহ্মণদের মাছ খাওয়ার সুবিধার জন্য তাঁরা তৈরি করেছেন একটি শ্লোক : ‘ইল্লিশ, খল্লিশ, ভেটকী, মদগুর এব চা/ রোহিত রাজেন্দ্র, পঞ্চমৎস্যা নিরামিষা।’ অর্থাৎ ইলিশ, খলসে, ভেটকি, মাগুর এবং রুই – এই পাঁচ প্রকার মাছ নিরামিষ। বিধানদাতা বামুনদের চালাকি-চতুরতার এটা এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁরা আরো বলেছেন, কাঁচকলা দিয়ে রান্না করলে সব মাছই নিরামিষ হয় এবং তা ব্রাহ্মণভোজ্য! গঙ্গায় নৌবিহারে ‘রামপাখি’ ভক্ষণেও নাকি দোষ নেই! এ-ও ব্রাহ্মণদের চাতুর্য ও ইতরতারই সাক্ষ্য।
চার
একালে বাঙালির খাদ্য-সংস্কৃতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন – বিশেষত ইলিশ ভক্ষণে। সিকি শতাব্দী আগেও নববর্ষের উৎসবের সঙ্গে ইলিশ যুক্ত ছিল না। বিগত পঁচিশ বছরে নাগরিক মধ্যবিত্ত-জীবনের পয়লা বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইলিশ। নাগরিক নববর্ষ উৎসবে পান্তা-ইলিশ এখন অন্যতম অনুষঙ্গ। বাঙালির লোকজীবনের সঙ্গে তা যুক্ত না-থাকলেও স্বীকার করব, ঐতিহ্যের নবরূপায়ণ হতেই পারে।
মাঝেমধ্যে খবরের কাগজে দেখা যায়, এদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ-উৎসব হয়। তাতেই মনে এলো এসব কথা! ইলিশ কেবল মহার্ঘ্য মাছ নয়, রাজনীতির অঙ্গনেও ইদানীং ব্যবহৃত হচ্ছে ইলিশ। নইলে বঙ্গভবন ও গণভবনে বিদেশি অতিথিদের জন্য ইলিশের এত কদর হবে কেন? কেনই বা অন্য দেশের রাজ্যপ্রধান, সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সৌজন্যে বাক্সবন্দি ইলিশের উপঢৌকন যায়?
সংস্কৃত ‘ইল্লিশ’ থেকে তদ্ভব শব্দরূপ ইলিশ। হিন্দি ও লৌকিক বাংলায় বলে হিলসা বা ইলসা। অভিধানমতে সুস্বাদু, তৈলাক্ত নোনা জলের শ্রেষ্ঠ মাছ। ইংরেজিতে ঈষঁঢ়বধ ওষরংযধ, সংস্কৃতে বলা হয়েছে – ‘ইল্লিশো মধুরো স্নিগ্ধো রোচনা বহ্নিবর্দ্ধনোঃ।’ মানে ইলিশ সুমধুর স্বাদের রুচিবর্ধক ও ক্ষুধা উদ্রেককারী মাছ। পাকিস্তানের সিন্ধু নদে প্রাপ্ত ইলিশকে ওরা বলে ‘পাল্লা’।
ইদানীং ইলিশ বেচাকেনা হয় ওজন দরে, কেজি হিসেবে। কিন্তু বছরবিশেক আগেও এদেশে জোড়া বা হালি হিসেবে বিক্রি হতো। ইলিশ এখন মহার্ঘ্য মাছ – মধ্যবিত্তেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তা রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত জাতীয় মাছ বলে নয়; রফতানিযোগ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অবলম্বন বলে। অথচ পঁচিশ বছর আগেও এক বর্ষায় আমি মাঝারি ইলিশ কিনেছি দশ টাকা গোটা। ট্রাকবোঝাই ইলিশ বিক্রি হয়েছে মাইক লাগিয়ে। এখন মনে হবে আষাঢ়ে বা গাঁজাখুরি গল্প। কেন না, হাজার টাকা কেজির নিচে এখন ইলিশ কল্পনাতীত। তাও আবার সামুদ্রিক, চানপুরী ও পদ্মার ইলিশের ভিন্ন-ভিন্ন দাম! যে-মাছটি যত বড় তার দাম ততই বেশি – প্রতি কেজি কমবেশি দু-হাজার। তাই ঝিলিক-মারা ইলিশ গরিবের পাতে নৈব নৈব চ। ইলিশ-নন্দন বা নন্দিনী, যার নাম ‘জাটকা’ – দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো দরিদ্রের তা-ই সম্বল। অবৈধ রোজগেরে, ক্যাসিনো ব্যবসায়ী বা কালোবাজারি ছাড়া একালে ইলিশ-কপালে কজন আছে! এখন আবার পুকুরে চাষ করা নকল ইলিশও আছে। নাম বড় বাহারি – চন্দনা। না-চিনে কিনতে গিয়ে ঠকার আশঙ্কা আছে।
ইলিশ খুব বেশি বড় কিংবা ওজনের হয় না। সোয়া থেকে দেড় কেজি হলেই তা বড় ইলিশ। প্রদর্শনীর যোগ্য দু-কেজি ওজনের ইলিশ কালেভদ্রে চোখে পড়ে! তবে বছরতিনেক আগে (২০১৯) খবরের কাগজে বেরিয়েছিল, বাগেরহাটে সাড়ে তিন কেজি ওজনের একটি ইলিশ ধরা পড়েছে। তার দাম হাঁকা হয়েছিল তিন হাজার টাকা কেজি! মানে সেটির দাম দশ হাজার টাকার ওপরে। শেষাবধি মাছটি বিক্রি হয়নি। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সেটি, ‘বিদুরের খুদ’ বা 888sport apk download apk latest versionর সামান্য ধন হিসেবে সরাসরি পাঠানো হয়েছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যার দফতরে। ইলিশটি ছিল চাঁদকপালে! প্রসঙ্গত মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা ও কাহিনী কাব্যের ‘মূল্যপ্রাপ্তি’ 888sport app download apkটির কথা। সেখানে কবি বলেছেন : ‘দোঁহে করে দেহ দেহ/ হার নাহি মানে কেহ/ মূল্য বেড়ে ওঠে ক্রমাগত।/ মালী ভাবে যার তরে/ এ দোঁহে বিবাদ করে/ তারে দিলে আরো পাব কত!’ রবীন্দ্রনাথের শ্রীদাম মালীর মতোই মনে হয় এই ইলিশ-শিকারি মাছ বিক্রেতাকে। আহা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি 888sport alternative linkের হতভাগ্য কুবের মাঝির ভাগ্যটা যদি এমন হতো!
আমরা সবাই জানি, ইলিশের আবাস নোনা জলে, সমুদ্রে। কিন্তু প্রকৃতির কী নিয়ম – লবণাক্ত সাগরের জলে ইলিশ মাছের ডিম ফোটে না! তাই প্রসবের সময় হলে গর্ভবতী ইলিশ বর্ষাকালে সমুদ্রে পতিত নদীর মোহনা পেরিয়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে, লাখে-লাখে চলে আসে মিঠা পানিতে। ওরা হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করে চলে আসে পদ্মা-মেঘনায়। চলে যায় উজানে যমুনা-গঙ্গা পর্যন্ত। এই নদীগুলি যেন ইলিশের বাপের বাড়ি। বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্যে আসন্ন প্রসবা বধূরা যেমন সন্তান প্রসবের লক্ষ্যে চলে আসেন বাপের বাড়ি, তেমনই ডিম ছাড়ার সময় হলে চলে আসে পোয়াতি ইলিশ। সব ইলিশের জন্মই যেন তার নানাবাড়িতে। ডিমে প্রাণসঞ্চার হলে আবার শরতে চলে যায় স্বামীগৃহে, সমুদ্রে। তা-ও যেন হিমালয়-কন্যা দশভুজার মতো – শরতে পিতৃগৃহে এসে শরতেই চলে-যাওয়া স্বামীগৃহে।
বর্ষায় ইলিশের এই মাতৃত্বকালীন সময়ে পদ্মায় ও এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জেলেদের জালে ঝাঁকে-ঝাঁকে ধরা পড়ে রুপালি ইলিশ। দেশের অধিকাংশ মানুষের কপালে না-জুটলেও তারা বাজারে-বন্দরে দেখতে পায় পারদশুভ্র চকচকে ইলিশের ঝিলিক! ইলিশ এখন খানদানি মাছ। কেবল সাগরে তার স্থায়ী বাস বলে নয়।
রূপে-গুণে, স্বাদে-গন্ধে বা খাদ্যগুণে অপূর্ব বলেও নয়; 888sport appsের জাতীয় মাছ বলে ইলিশের আছে সাংবিধানিক স্বীকৃতি। বাঙালির খাদ্য-সংস্কৃতিতে শিরোমণি এই মাছ। শত শত টন রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যমও এখন এই ইলিশ। তাই কেবল দুর্মূল্য নয় – মহার্ঘ্যও। যে-কয়েকটি বিষয় বা প্রতীক বাঙালির জাতিরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়েছে তার মধ্যে ইলিশও একটি। তাই রুপালি ইলিশ নিয়ে আমাদের গৌরব মিছে নয়।
ইলিশের স্বামীগৃহ সাগরের নোনা পানিতে আর পিতৃগৃহ আমাদের পদ্মায়। পৃথিবীর সব সাগরে ইলিশ আছে কি না জানা নেই। তবে ইলিশ আমাদের সম্পদ ও খাদ্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্য। বর্ষা ও শরতে বিক্রমপুর, চাঁদপুর ও পদ্মার সমুদ্র-উপকূলীয় মোহনায় জেলেদের জালে ধরা পড়ে শত শত ইলিশের ঝাঁক। তবে সাগর বা অন্য কোনো নদীর ইলিশের চেয়ে স্বাদে-গন্ধে পদ্মার ইলিশ অনন্য। বাঙালির ক্রীড়া-সংস্কৃতিতেও আছে ইলিশের ভূমিকা! পশ্চিমবঙ্গের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল দল ইস্ট বেঙ্গল ও মোহনবাগান। এই দু-দলের খেলায় মোহনবাগান জিতলে কলকাতার মাছবাজারে চিংড়ির দাম অগ্নিমূল্য হয় আর ইস্ট বেঙ্গল জিতলে ইলিশের দাম হয় আকাশছোঁয়া! ইস্ট বেঙ্গলিরা তো পিতৃ বা মাতৃ সূত্রে কিংবা উভয় সূত্রে এক সময়ের পূর্ববঙ্গীয়। তাই পদ্মার ইলিশের উত্তরাধিকার তাঁরা এখনো ধারণ করে আছেন। গঙ্গা বা যমুনায় ইলিশ মিললেও পদ্মার ইলিশের স্বাদ এখনো তাঁরা ভুলতে পারেননি। পাকিস্তানের সিন্ধু নদ, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের গোদাবরী নদী এবং গুজরাটের নর্মদা ও তাপ্তি নদীতেও ইলিশ মেলে। কিন্তু তার স্বাদ পদ্মার ইলিশের ধারেকাছেও নয় – এটি আত্মশ্লাঘার কথা বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
পাঁচ
রান্না একটি 888sport live chat। এই রন্ধন888sport live chat অন্য 888sport live chatকলার চেয়ে হীন নয় কোনোমতেই। রন্ধন888sport live chat প্রাচীনও – মানবসভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষের আগুন জ্বালাতে শেখার পর থেকেই রন্ধন888sport live chatের উদ্ভব। বাঙালি 888sport promo codeর রান্নাঘর ভোজনবিলাসী বাঙালির 888sport apkাগার। সপ্তব্যঞ্জন রসায়নের প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া হয় ওই রন্ধন-888sport live chatশালায়। বৈচিত্র্যে ভরা বাঙালির পাকপ্রণালি। ইলিশের রান্নায়ও আছে বহুবিধ বৈচিত্র্য – ভাজি থেকে পাতুরি, পাতলা ঝোল থেকে নানাবিধ মশলার বাহারি সংযোগ। একালে দেশি-বিদেশি রন্ধন888sport live chatের রেসিপি শেখার বইয়ের তো অভাব নেই! টিভিতেও নিত্য প্রদর্শিত হয় বিচিত্র রান্নার নিয়মকানুন। সেখানে কী দৃষ্টিনন্দন রান্নাঘর ও ঝকঝকে বাসনকোসন! ইলিশের বিচিত্র রান্না সম্পর্কে কলকাতার গবেষক মিলন দত্ত তাঁর বাঙালির খাদ্যকোষ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘ভাপা, ভাজা বা পাতলা ঝোল, যেকোনোভাবে রান্না করা হোক, ইলিশ সুস্বাদু। স্রেফ কালোজিরে ও বেগুন দিয়ে পাতলা ঝোলও ইলিশের একটি প্রিয় পদ। এছাড়া শর্ষেবাটা দিয়ে ঝোল বা গা-মাখা কিংবা কলাপাতায় মুড়ে ভাপা বা ভেজে পাতুরি। ইলিশ মাছ কিংবা ইলিশ মাছের ডিম কাঁচকলা দিয়ে ঝোল করার রীতিও চালু আছে। ইলিশ মাছের ডিমের অম্বলও খান অনেকে। হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে চল না থাকলেও মুসলমানদের মধ্যে ইলিশ রান্নায় পেঁয়াজ রসুনের ব্যবহার চালু রয়েছে।’
(পৃ ৫০)। তাছাড়া ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক-ডাঁটা সাধারণ বাঙালির পুরনো খাদ্যোপকরণ। সম্ভ্রান্তদের মধ্যে ঘি ও সুগন্ধি মশলাযোগে বিরিয়ানি বা ইলিশ-পোলাও জিভে জল-আসা খাবার। সূক্ষ্ম কাঁটাযুক্ত বলে ইলিশ বিদেশিরা খেতে অপারগ। সম্ভবত এ-কারণে ইলিশ ভিনেগারে চুবিয়ে রেখে কাঁটা নরম করে রান্না করা হয়। তাকে বলে ‘বোনলেস ইলিশ’। ইলিশ রান্নায় কত যে রকমফের তার ইয়ত্তা নেই! একালের রেসিপির বইয়ে ইলিশ রান্নার বিচিত্র বিবরণ পাওয়া যায়। পুরনো দিনেও এই বৈচিত্র্য কম ছিল না! কলকাতার অনিরুদ্ধ ফাল্গুনি সেনের লেখায় পাই : ‘এখো গুড় দিয়ে খই মেখে, সেই খইতে আগুন জ্বালিয়ে বেতের চুপড়িতে নিষ্কণ্টক ইলিশ ঝুলিয়ে তৈরি করত স্মোক হিলসা।’ (নুনেতে ভাতেতে, ২, পৃ ১০৮)। এখানেই ইতি নয়! ‘ইলিশ মাছের ডিমকে পরিষ্কার কাপড়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো আখার ওপর – দিন দশ-পনেরো। আখার উপর তাপ পেয়ে আরও জমাট বাঁধত সেই ইলিশের ডিম। তারপর আঁশবঁটি দিয়ে কেটে টুকরো করে, কুমড়ো বা লাউ দিয়ে তৈরি হতো সেই ঝোল ঝোল অমৃত।’ (রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল, নুনেতে ভাতেতে, পৃ ৩২) ইলিশ রান্নার যত রূপ-রূপান্তরই হোক শর্ষে-ইলিশের কোনো বিকল্প নেই – একেবারে আদি ও অকৃত্রিম। চন্দনস্নিগ্ধ সোনালি শর্ষেবাটা দিয়ে কলাপাতায় মোড়ানো পদ্মার ইলিশ-ভাপার স্বাদে বাঙালিমাত্রই মাতোয়ারা। এর স্বাদ যে-বাঙালির রসনায় পড়েনি তার জীবনই বৃথা। রস888sport live footballের রাজাধিরাজ ভোজনরসিক সৈয়দ মুজতবা আলী তো বেহেশতের খাদ্য-তালিকায় শর্ষে-ইলিশ নেই বলে স্বর্গে যেতে অমত প্রকাশ করেছেন। ষোলো আনা বাঙালিয়ানা আর কাকে বলা যায়!
তবে ইলিশ যতই অভিজাত এবং সুস্বাদু মাছ হোক দশকচারেক আগেও আমাদের যৌবনে বিয়ে-শাদি বা সামাজিক অনুষ্ঠানে ইলিশের স্থান ছিল না! রুই-কাতলাই ছিল সামাজিক আপ্যায়নের মাছ – ইলিশ অপাঙ্ক্তেয়! সিলেট অঞ্চলে যেমন রসমালাইয়ের চেয়ে জিলিপি ও রুইয়ের চেয়ে বোয়াল মাছের কদর বেশি তেমনই! মনে পড়ে, বছরচল্লিশেক আগে এক বউভাত অনুষ্ঠানের কথা। মাছ-ব্যবসায়ী চুক্তিভঙ্গ করায় আপ্যায়নকারী আমন্ত্রিতদের জন্য ইলিশের আয়োজন করেছিলেন। তাতে কী নাক-সিটকানো আমন্ত্রিতদের! আর এখন আপ্যায়নে ইলিশ রাখলে সবাই ধন্য ধন্য করেন। সামাজিক রুচির কী পরিবর্তন – একেবারে ইউটার্ন!
আমার ঠাকুরমা ছিলেন বিক্রমপুরী আর মা কিশোরগঞ্জের – মানে খাঁটি ময়মনসিঙ্গা। মাকে বালিকাবধূ অবস্থা থেকে তিনি বিক্রমপুরী রান্নাবান্না ও রীতিনীতি শিখিয়েছেন। তাই ময়মনসিংহে আবাস হলেও আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতিতে চলে বিক্রমপুরী ধারা। এ কারণে ইলিশ খাওয়ায় আমাদের আছে সুনির্দিষ্ট বাৎসরিক কালসূচি। দুর্গাপুজোর দশমীতে ঘরে আসে জোড়া ইলিশ। তেল-সিঁদুর দিয়ে তা বরণ করা হয়। তারপর তিন মাস ইলিশ খাওয়া বারণ – মাঘমাসের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজোর পূর্বদিন পর্যন্ত। ঐতিহ্যের এই ধারা বিক্রমপুরের মানুষের মধ্যে এখনো বহমান। তাই বাঙালির খাদ্যকোষ গ্রন্থে মিলন দত্ত লিখেছেন : ‘ইলিশ আবার বাঙালি হিন্দু পরিবারে মঙ্গলের দ্যোতক। অনেক পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু পরিবারে এখনো সরস্বতীপুজোর দিন জোড়া ইলিশ ঘরে এনে ধান, দূর্বা, সিঁদুর দিয়ে বরণ করে ঘরে তুলে আনুষ্ঠানিকভাবে ইলিশ মাছ খাওয়া শুরু হয়।’ (পৃ ৫১)। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন বিক্রমপুরীদের মধ্যে ইলিশ নিয়ে এমন সংস্কার? এই সংস্কারের অন্তরালে কি কোনো যুক্তিসংগত কারণ আছে?
পদ্মানদীর অববাহিকায় বিক্রমপুর আর সেই পদ্মাই ইলিশ মাছের ক্যান্টনমেন্ট। তাই সে-অঞ্চলে ইলিশ ধরা ও খাওয়া নিয়ে আছে নানান নিয়মকানুন। সুপ্রাচীন কাল থেকে তাঁরা অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, ওই সময়টা – বঙ্গাব্দের কার্তিক থেকে পৌষ মাস ইলিশের প্রজনন ঋতু এবং ডিম থেকে ফোটা খুদে ইলিশের শৈশবকাল। সেই শিশু-ইলিশের নামই জাটকা। তখন ইলিশ ধরলে ও খেলে মা এবং শিশু-ইলিশ দুয়েরই নির্বংশ হওয়ার আশংকা। তাই মৎস্য888sport apkমতে ও সরকারের আইন অনুসারে, এ-সময় ইলিশ ধরায় থাকে নিষেধাজ্ঞা। বড় হয়ে বুঝেছি, বাঙালির সব সংস্কারই কুসংস্কার নয় – অমূলকও নয়। এর মধ্যেও আছে 888sport apkবুদ্ধির ঝিলিক। অভিজ্ঞতা ও জীবন-বাস্তবতার জ্ঞান প্রয়োগে আমাদের লৌকিক সমাজ কখনো অনগ্রসর ছিল না।
‘ইলিশবন্দনা’ শেষ করি রসরচনার রাজাধিরাজ সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি রম্যগল্প দিয়ে :
গোয়ালন্দগামী ইস্টিমারের কেন্টিনে ইলিশ মাছের ঝোল আর গরম ভাত বিক্রি হচ্ছে। না-খেলে নাকি এর স্বাদ বোঝানো যায় না! পেটচুক্তি খাওয়ার দাম চার পয়সা। তাও মানুষের খাওয়ার ক্ষমতা নেই! তাই শুধু ঝোল আর ভাত বিক্রির ব্যবস্থা আছে। দাম এক পয়সা। তাছাড়া আরো একটা ব্যবস্থা আছে – ইলিশ মাছের দ্যাখনাই! এর দাম দেড় পয়সা। মাছ সমেত ঝোলভাত দেবে। মাছটা দেখে-দেখে ভাত খাওয়ার পর মাছ ফেরত নিয়ে যাবে। এক লোক দ্যাখনাই নিয়েছে। বিল দেওয়ার সময় দোকানদার দুই পয়সা কেটে নিয়েছে। খরিদ্দার জিজ্ঞেস করল – দুই পয়সা ক্যান? আমি তো দ্যাখনাই খাইছি।
দোকানদার বলে – ওই হালা, আমি দেহি নাই? তুই কয়েকবার চোষণ দিছস!


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.