সন্দকফু অর্থাৎ উঁচুতে বিষাক্ত গাছ। আর এক জায়গায় সন্দকফু শব্দের অর্থ দেখেছিলাম পাগলা হাওয়ার (সন্দক = পাগলা, ফু = হাওয়া) দেশ। অর্থ যা-ই হোক, পশ্চিমবঙ্গ তথা সিঙ্গলীলা পর্বতশ্রেণির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সন্দকফু থেকে মাউন্ট এভারেস্টের সৌন্দর্য এবং শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার ভুবনমোহিনী রূপ যুগ যুগ ধরে পর্যটকদের মুগ্ধ করছে। বিশেষ করে সূর্যোদয়ে। সোনালি সূর্যের আভায় কাঞ্চনবর্ণা কাঞ্চনজঙ্ঘা কাঁচা সোনার রঙে ঝকমকিয়ে ওঠে। পথের আকর্ষণও কম নয়। নেপাল এবং পশ্চিমবঙ্গের সীমানা বরাবর সিঙ্গলীলা অরণ্যের বুক চিড়ে অসাধারণ এই ট্র্যাকরুটের আকর্ষণ যুগ যুগ ধরে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষদের হাতছানি দিচ্ছে। পথের দুপাশে অজস্র রডোডেনড্রন ফুল, চেনা-অচেনা অসংখ্য পাখির কাকলি, ঘন সবুজ অরণ্য, বনচর পশু আর মাঝেমধ্যে ছোট ছোট গ্রাম অতিক্রম করে পৌঁছে যাওয়া ৩৬৫৮ মিটার বা ১১ হাজার ৯২৯ ফুট উচ্চতার পর্বতশীর্ষে – এমন একটা স্বপ্ন অনেকদিন ধরেই ছিল। হঠাৎ সুযোগ এলো। সহকর্মী সুজিত চৌধুরী জানাল, সন্দকফু যাচ্ছি, যাবেন নাকি? হঠাৎই ঠিক হয়েছে –
হাতে মাত্র এক সপ্তাহ সময়। এত অল্প সময়ে ট্রেনের টিকিট মিলল না। জুনের প্রথম সপ্তাহে কলকাতার হাঁসফাঁস করা উষ্ণতাকে টাটা জানিয়ে ধর্মতলা থেকে সন্ধ্যার বাসে চেপে বসলাম। পরদিন সকালে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে শেয়ার জিপে ঘুম হয়ে, লেপচা জগৎ, সুখিয়াপোখরি পার করে বিকালের রোদ মরে আসার আগেই মানেভঞ্জন পৌঁছে গেলাম। মানেভঞ্জন (২১৩৪ মি.) সন্দকফু ট্রেকিংয়ের গেটওয়ে। রাতটা এখানে কাটিয়ে পরদিন ভোরেই শুরু করব হাঁটতে। প্রয়োজনীয় রেশন এবং গাইডও সংগ্রহ করতে হবে এখান থেকে।
ভারত-নেপাল সীমান্তবর্তী ছোট জনপদ মানেভঞ্জন। নেপালি ভাষায় যার অর্থ দুই গিরিশিরার মিলনস্থল। টংলু আর জোড়পোখরি পাহাড়ের মিলনস্থলে বাটির মতো উপত্যকা। দক্ষিণ-পশ্চিম ঢালে নেপাল আর উত্তর-পূর্ব ঢালে ভারত। মাঝখানে সীমারেখা বলতে ছোট্ট একটা নালা। নালা পেরিয়ে সারাদিনে অসংখ্যবার নেপাল-ভারত করছে মানুষ। সীমান্তরক্ষীদের কোনোরকম চোখ রাঙানি নেই। মরশুমে দেশি-বিদেশি ট্রেকারদের ভিড়ে সরগরম থাকে মানেভঞ্জন। এমনিতেই এটি একটি ঘনবসতি অঞ্চল। মূলত বৌদ্ধ শেরপাদের বাস। তিববতীয় খাম ভাষায় শের = পূর্বদেশ আর পা = লোক, অর্থাৎ পূর্বদেশের লোক। যাই হোক, দোকানপাট, বাড়িঘর, হোটেল-লজ- রেস্তোরাঁ, চোর্তেন, মন্দির নিয়ে মানে একটা ঘিঞ্জি এলাকা। তবে মানের মূল বাজার অঞ্চল ছাড়িয়ে পায়ে পায়ে কিছুদূর (যে কোনো দিকে) এগোলেই দৃশ্যটা আবার অন্যরকম। তখন সেই শান্ত নির্জন হিমালয়ের চিরচেনা রূপ। বিকালটা তাই এলোমেলো এদিক-ওদিক ঘুরে, মন্দির ও গুম্ফা দর্শন করে আস্তানায় ফিরি সন্ধ্যা পার করে।
‘আস্তানা’ বললাম এই জন্যেই, যেখানে উঠেছি সেটা ঠিক হোটেল নয়, স্থানীয় একজন বাসিন্দার বাড়ির দোতলায়। ঘটনাটা কাকতালীয়ভাবেই ঘটে গেল। আমাদের গাড়ি মানেভঞ্জন বাজারে এসে থামতেই গাড়ির জানালায় বছর পঁয়ত্রিশ-চলিস্নশের এক নেপালি মুখ। জানতে চাইলো হোটেল লাগবে কি না। যেহেতু আমরা আগে থেকে হোটেল বুক করে আসিনি তাই জানতে চাইলাম, ভাড়া কেমন?
– কতজন আছেন আপনারা?
– সাতজন।
– একটা ঘরে হবে?
– বড় ঘর হলে হবে।
– দুশো টাকা দেবেন।
মাত্র? বন্ধুরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। কেমন ঘর সে? মনুষ্য বসবাসের উপযুক্ত তো? যেমনই হোক, দেখতে তো ক্ষতি নেই। গাড়িতে লটবহর রেখে দুজন পিছু নিই তার। যেতে যেতে লোকটি তার নাম জানাল, অর্জুন। আমাদের নিয়ে একটা বস্তির মধ্যে ঢুকল সে। দুপাশে পায়রার খোপের মতো ঠাসাঠাসি বাড়িঘর, মাঝখানে সরু রাস্তা। রাস্তার ওপরেই কলকাতার বস্তিগুলোর মতো সণান, বাসন মাজা, কাপড় কাচার মতো দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজকর্ম। বেশ নোংরা পরিবেশ। গলি ধরে কিছুদূর এগিয়ে বাঁদিকের একটি বাড়িতে ঢুকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সোজা ওপরে। নিচের ডাইনিংরুমে জনা পাঁচ-ছয় চা-পানের আসরে গল্পগুজব করছিল। আমাদের ঢুকতে দেখে তাদের মধ্যে একজন উঠে এলো আমাদের পিছুপিছু। অনুমানে বুঝলাম ইনিই গৃহস্বামী। কারণ এটা যে বসতবাড়ি এক ঝলক দেখেই বোঝা যায়। নিচে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা, ওপরটা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। একটাই মাত্র ঘর ওপরে, বেশ বড়। ঘরের চারদিকে চারখানা বেড। এক একটা বেডে অনায়াসে দুজন শুতে পারবে। মাঝখানে সুদৃশ্য সেন্টার টেবিল। ভেতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম ঘরের ডেকোরেশন দেখে। একেবারে ঝাঁ-চকচকে সবকিছু। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিছানা, কাঠের দেয়ালে চোখ ধাঁধানো কারুকার্য। শোকেসে সুদৃশ্য পেয়ালা, পিরিচ, চিনামাটির থালা-গ্লাস। যে-কোনো থ্রি-স্টার হোটেলের রুমকেও যেন লজ্জা দেবে। বাইরে থেকে এর চার আনা প্রত্যাশাও করিনি। প্রথম দর্শনেই মন ভরে গেল। বুঝলাম না এমন একটা ঘরের ভাড়া দুশো টাকা হয় কী করে! থাকতে রাজি হয়ে গেলাম আমরা।
সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে দেখি, অর্জুন নিচে বসে আছে। সামনে পানপাত্র। পাশে গৃহস্বামী। একটি অল্পবয়সী মেয়ে মেঝেতে বসে আটা মাখছে। নত মুখ। আগেও দেখেছি কয়েকবার। সুন্দরী না হলেও সুশ্রী। শান্ত স্বভাব, চুপচাপ থাকতেই যেন বেশি পছন্দ করে। পাহাড়ি মেয়েদের মতো উচ্ছল নয়। আর একটা বিষণ্ণতার ছাপ আছে মুখে। অর্জুনকে একা বসে থাকতে দেখে অবাক হলাম। কারণ সে কথা দিয়েছিল সন্ধ্যায় আমাদের গাইড কাম পোর্টার ঠিক করে দেবে। তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। তাকে সে-কথা বলতে আমাদের আশ্বস্ত করে বলল, ঠিক সময়ে এসে যাবে।
চাইলে রাতের খাবার এখানেই মিলবে, গৃহস্বামী আগেই জানিয়েছিল। আপাতত সাত কাপ চা আর রাতের জন্যে রুটি-সবজি অর্ডার দিয়ে ওপরে নিজেদের ঘরে উঠে আসি। কিছুক্ষণ পরে কিশোর কুমারের ‘মুসাফির হো …’ গাইতে গাইতে ওপরে উঠে আসে অর্জুন। গানের গলাটি বেশ মিষ্টি। হাতে চায়ের ট্রে। তবে সাত কাপ নয়, কাপের 888sport free bet নয়। পেছনে বাড়ির মালিক। চায়ের ট্রেটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে ভাঙা ভাঙা বাংলায় অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন বন্ধুরা?
– ফাইন। আপনার গানের গলা কিন্তু বেশ।
উত্তরে গৃহস্বামী ভদ্রলোক বললেন, একসময় ও ফাংশানে গাইতো।
অর্জুন লজ্জা পেল। বলল, না না, তেমন কিছু নয়। এমনিই শখে একটু-আধটু … কথা বলতে বলতে চায়ের কাপ তুলে দিলো আমাদের হাতে। সঙ্গী ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বলল, আমার দোস্ত। এক্কেবারে ছোটবেলার বন্ধু (নামটা বলেছিল, এখন মনে নেই)। এই যে আপনাদের এখানে এনে তুললাম, এর পেছনে অন্য কোনো স্বার্থ নেই। মানে কমিশন-টমিশনের ব্যাপার নেই। স্রেফ বন্ধুত্বের কারণেই …
বন্ধুটি কোনো মন্তব্য করল না! বরং প্রসঙ্গ বদলে কাজের কথায় এলো। আমাদের কী কী প্রোগ্রাম আছে, সকালে কখন বেরোবো, ব্রেকফাস্ট করে বেরোবো কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। গাইডের প্রসঙ্গে বলল, সকালে যথাসময়ে এসে হাজির হবে। আমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। গাইড হিসেবে যাকে বলা হয়েছে, ভীষণ ভালো মানুষ, মিশুকে, শক্তপোক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। দিনপ্রতি ২৫০ টাকা হিসাবে তাকে পারিশ্রমিক দিতে হবে। ট্রেকিংয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমরা এখানেই রেখে যাবো ঠিক হলো, সন্দকফু থেকে ফেরার পথে নিয়ে নেব। লাগেজ যত কম বইতে হয় ততই মঙ্গল। কেবল পথের রসদ হিসেবে কিছু শুকনো খাবার, চকোলেট, কিসমিস আর প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার সঙ্গে যাবে। না, মালপত্র রেখে যাওয়ার জন্যে অতিরিক্ত দক্ষিণা কিছু লাগবে না।
প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে ফাঁকা কাপগুলো নিয়ে ভদ্রলোক নেমে গেলেন। রয়ে গেল অর্জুন। বেশ হাসিখুশি আড্ডাবাজ মানুষ। আরো গান শোনানোর জন্যে অনুরোধ করলাম আমরা। প্রথমে সামান্য আপত্তি জানালেও গাইতে শুরু করল। পরপর গাইতে লাগল কিশোর কুমারের জনপ্রিয় সব হিন্দি গান। দু-একটি বাংলা গানও গাইল। তবে ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে। গানে-গল্পে-আড্ডায় জমে উঠল রাত্রিবাসর। গানের ফাঁকে ফাঁকে টুকরো আলাপচারিতায় অর্জুন সম্পর্কে অনেক তথ্য জানলাম। সংসারে সে একা মানুষ। সকাল শুরু হয় ঘুম থেকে উঠে দেশি মদ দিয়ে, চলে রাতে শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। সারাদিন নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। ঘুরে বেড়ায় বাউন্ডুলের মতো। কাজকর্ম কখনো করে কখনো করে না। যদিও সে ভালো কাঠমিস্ত্রি। কিন্তু কার জন্যে কামাই করবে? বাড়ি বলো আর আস্তানা – মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তার আছে বটে, তবে তার সঙ্গে সম্পর্ক শুধু রাতে শোয়ার সময়। বাকি জীবনটা সে এভাবেই কাটিয়ে দিতে চায়। বুঝতে পারি অর্জুনের কোনো গোপন কষ্ট আছে। নিজের ওপর অথবা অন্য কারো ওপর অভিমানে সে নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করছে। একটু চেপে ধরতে সে-সত্যও বেরিয়ে আসে।
বছরদশেক আগের ঘটনা। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল অর্জুন, সংসার পেতেছিল। জীবিকার তাগিদে বাইরে বাইরে ঘুরতে হতো তাকে। কখনো দিন পনেরো কখনো এক-দেড় মাস। গৃহস্থালি সামলাতো বউ। দিব্যি চলছিল। আনন্দেই ছিল অর্জুন। অথচ তার অলক্ষে কখন যে সংসারে, বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটেছে সে বুঝতেও পারেনি। সেবার কাঠের কাজে শিলিগুড়ি গিয়েছিল। বেশ বড় কাজ। সেই কন্ট্রাক্টটা ধরেছিল। মাসখানেকের ব্যবধানে বাড়ি ফিরে দেখল বউ ঘরে নেই। ভাবল হয়তো আশেপাশে আছে। অপেক্ষা করল। দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও যখন ঘরে ফিরল না, প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজখবর করল। তাদের কাছেই জানল, দিন পনেরো আগে তার এক বন্ধুর সঙ্গে পালিয়েছে। সংসার পেতেছে। তার অনুপস্থিতির সুযোগে প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু যে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে সে কল্পনা করতে পারেনি।
না, বউকে ফিরিয়ে আনার কোনো চেষ্টাই অর্জুন করেনি। অভিমানে। যে-সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস নেই সে-সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই
তার কাছে।
এমন ঘটনার কোনো সহানুভূতি হয় না। তবু সৌজন্যের খাতিরে কিছু বলতে হয়। কিছুক্ষণ পর অর্জুন একটু ধাতস্থ হলে বলে, এমন একটা বিশ্বাসঘাতকের জন্যে নিজের জীবনটা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। নতুন করে আবার সংসার পাতো।
উত্তর দিতে বেশ খানিকটা সময় নেয় অর্জুন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার মতো একটা মাতালকে কে মেয়ে দেবে! বিয়ে করার কোনো ইচ্ছাই আর নেই। তবে হ্যাঁ, একটি মেয়েকে সে ‘লভ’ করে। যদি কোনোদিন তার সঙ্গে সংসার পাতা সম্ভব হয় তবেই আবার বিয়ে করবে।
– সম্ভব হয় বলছো কেন! মেয়ে খুব সুন্দরী?
অর্জুন মাথা নাড়ে, খুব সাধারণ।
– বড়লোক?
– তাও নয়?
– তবে? মনের কথা এখনো তাকে বলে উঠতে পারোনি?
অর্জুন চুপ। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলি, সাহস করে বলে ফেলো। পেটে খিদে মুখে লজ্জা দেখিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া তোমার মতো ভালোমানুষকে সে ফেরাতে পারবে না।
– সে জানি, অর্জুন মুখ খোলে, সমস্যা তাকে নিয়ে নয়, তার দাদাকে নিয়ে। শক্ত ধাতের মানুষ, জানতে পারলে আর রক্ষক্ষ রাখবে না।
এবার আমাদের সন্দেহ বাড়ে, একটু একটু যেন ধরতে পারছি। সম্ভবত আমরা তাকে দেখেছি। অর্জুনকে চেপে ধরি, সেই মেয়ের বৃত্তান্ত আমাদের বলতেই হবে। আমরা পরদেশিরা, এই এসেছি আবার কবে আসবো, আদৌ আর আসা হবে কি না তার কোনো ঠিক নেই। আমাদের বলতে কী সমস্যা? আমরা তো আর তার দাদাকে জানাতে যাচ্ছি না। শেষটায় অনেক চাপাচাপির পর, কাউকে না জানানোর শর্তে সে বলল, পাত্রী গৃহস্বামীর বোন। কিছুক্ষণ আগেই যাকে আটা মাখতে দেখে এসেছি।
বন্ধুর প্রতি অর্জুনের কর্তব্যবোধের কারণ এতক্ষণে বুঝতে পারি। বুঝতে পারি বিনা কমিশনে আমাদের মতো ট্যুরিস্টদের কেন সে বন্ধুর বাড়িতে তোলে। যদি এভাবেই খুশি করে কঠিন বরফ কোনোদিন গলানো যায়!
পরদিন সকাল ঠিক সাতটায় অর্জুন এলো। সঙ্গে বিশ-বাইশের সুদর্শন স্বাস্থ্যবান এক যুবক। পরনে জিন্স টি-শার্টের ওপর চামড়ার জ্যাকেট। মাথায় ক্যাপ। পেছনে লম্বা চুল পনিটেল করে বাঁধা। নাম বলল, পসন। এ-যাত্রায় সে-ই আমাদের গাইড। প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায় লাজুক প্রকৃতির এই ছেলেটিকে।
ঠিক আটটা বেজে দশ মিনিটে মানেভঞ্জন থেকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। তার আগে ব্রেকফাস্ট এবং পরিবারের সঙ্গে একপ্রস্ত ছবি তোলা। ছবি তোলার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল অর্জুনের। এক হিসেবে তার আবদারেই আমরা ক্যামেরা বের করেছি। হঠাৎ একটি অপ্রত্যাশিত আবদার করে বসল সে। আচমকা তার প্রেমিকার পাশে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করল ছবি তোলার জন্যে। তুললাম। মুহূর্তে বদলে গেল পরিবেশ। অর্জুনের বন্ধুটি গম্ভীর। বলল, চলুন আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি, দেরি হয়ে যাচ্ছে –
অর্জুনকেও আমাদের সঙ্গী হতে বললাম। সে রাজি হলো না, কাজের অজুহাতে এড়িয়ে গেল।
মানেভঞ্জন থেকে যে-পথে যাত্রা শুরু করলাম তার চড়াই এতটাই যে ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয়। প্রাণান্তকর এই চড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে বুক দুরুদুরু করে। তবু এগিয়ে চলি ছোট ছোট পায়ে। কিছুদূর এগোতেই হাঁপ ধরে আসে। বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে বসি এক জায়গায়। একটু দূরে গৃহকর্তা বসে। চোখাচোখি হতে ইশারায় কাছে ডাকে আমাকে। উঠে গিয়ে তার কাছে বসি।
– আপনার ডিজিটাল ক্যামেরা?
– হ্যাঁ। কেন?
– ছবি দেখা যায়?
– যায়।
– ডিলিট করা যায়?
– কেন বলুন তো?
গৃহকর্তার গলায় করুণ আকুতি, একটা অনুরোধ রাখবেন? আমার বোনের সঙ্গে অর্জুনের যে-ছবিটি তুললেন, ওটা ডিলিট করে ফেলুন। অর্জুনের মতলব ভালো না, ও খুব খারাপ মানুষ।
এতক্ষণে আমাদের পিছু নেওয়ার কারণ বুঝতে পারি। এগিয়ে দেওয়াটা বাহানা মাত্র। যদিও এজন্যে তাকে ঠিক দোষ দেওয়া যায় না। কোনো দায়িত্ববান দাদাই চাইবে না এমন একটা ছন্নছাড়া পাঁড় মাতালের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠুক। সঙ্গে অর্জুনের অতীত ইতিহাস তো আছেই। বিনা বাক্যব্যয়ে ক্যামেরা বের করে তার সামনেই ছবিটি ডিলিট করি। উদ্দেশ্য সফল হতে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে চলে গেল।
ছবি না হয় মোছা গেল, কিন্তু প্রেম। জানি না অর্জুন কেমন মানুষ! যেমনই হোক – প্রেম অকৃত্রিম হলে তাকে না যায় মোছা, না যায় রোখা। সাত-সকালে মনটা ভারি হয়ে যায় অজানা-অচেনা এক নেপালি যুবকের জন্যে।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর আমরা আবার হাঁটতে শুরু করি। প্রথম দু-কিলোমিটার অসম্ভব চড়াই ভাঙার পর প্রথম জনপদ চিত্রে। খুব ছোট গ্রাম। হাতেগোনা ছবির মতো গোটাকয় বাড়িঘর। শান্ত পরিবেশ। চা-পানের সাময়িক বিরতি এখানে। সেই অবসরে গ্রামটা একটা চক্কর ঘুরে দেখা, ছবি তোলা। যদিও এটুকু আসতেই হাঁপিয়ে পড়েছি। ভয় হচ্ছে শেষ রক্ষা করতে পারব তো! এটা আমার তৃতীয় ট্র্যাকিং। আগের দুটি ছিল একদিনের। সে হিসাবে অনেক শক্ত পরীক্ষা। যাতায়াতে ৫২ কিলোমিটার। যার মধ্যে আজ প্রথম দিনেই আছে ১২ কিমি। আরো ১০ কিলোমিটার অতিক্রম করে ২৯৩৫ মিটার উচ্চতায় তুমলিং পৌঁছাতে হবে। সেখানেই আজ রাত্রিবাস। যদিও অধিকাংশ যাত্রী মেঘমা হয়ে টংলুর পথ ধরে, প্রথম রাত্রিবাস করে টংলুতে। কিন্তু গ্রাম তুমলিংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং তুমলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ 888sport app নামি-অনামি শৃঙ্গের যে অপার সৌন্দর্য – পূর্বাতন অভিযাত্রীদের মুখে সে-গল্প আগেই শুনেছি। তাছাড়া সন্দকফু পৌঁছে আবহাওয়া ভালো পাবো, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। দুধের স্বাদ তাই আগেই ঘোলে মিটিয়ে রাখার একটা চেষ্টা।
যা হোক, চিত্রাগ্রামে চা-বিরতি এবং ছবি তোলার পর্ব শেষ করে আবার হাঁটতে শুরু করি। পথ এবার অপেক্ষাকৃত কম চড়াই। আবহাওয়াও অনুকূল। মাথার ওপরে ঝলমলে সূর্য। মাঝে মাঝে মেঘ আসছে সত্যি, চারপাশ ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে – কিছুক্ষণ পরেই আবার কুয়াশা চিড়ে রোদ উঁকি মারছে। বেশ একটা লুকোচুরি খেলা চলছে মেঘ-কুয়াশার। আমরা হাঁটছি প্রতিটি বাঁকের শেষে নতুন নতুন সৌন্দর্য আবিষ্কারের আনন্দে। পাহাড়ে এখন ফুলের মরশুম। প্রায় ১৪০ প্রজাতির রডোডেনড্রন ফোটে এ-সময়। পথের দুপাশে তাদের রঙিন কার্পেট। ভাবলে অবাক লাগে এদের অসম্ভব জীবনীশক্তির কথা। রুক্ষ পাথরের বুকেও এমন কোমল প্রাণের সমারোহ। বেঁচে থাকার রস, রসদ পায় কোথা থেকে!
বর্ণবৈচিত্র্যে আমার চলার পথ বর্ণময়। স্বাগত জানায় অদৃশ্য সব পাখির কাকলি। মাঝে মাঝে হিমেল বাতাসের ঝলক এসে পথ চলার ক্লান্তি মুছিয়ে দেয়। ক্লান্তিহীন আমরা আরো সাড়ে তিন কিলোমিটার অতিক্রম করে পরবর্তী জনপদ লামেডুরায় পৌঁছাই। খুব ছোট জনপদ, চিত্রের থেকেও ছোট, গোটা দশেক বাড়ি আর গোটা দুই দোকান। চা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায় দোকান দুটিতে। ইচ্ছা করলে আরো একবার গরম চায়ে গলা ভিজিয়ে নেওয়া যেত এখানে; কিন্তু আমরা অহেতুক সময় নষ্ট না করে এগিয়ে চলি।
পরবর্তী গ্রাম মেঘমা। লামেডুরা থেকে দূরত্ব আড়াই কিমি। উচ্চতা ২৮৯৫ মিটার। গ্রামটি নেপালের মধ্যে। আমরা চলেছি ভারত-নেপাল সীমান্ত বরাবর। কখনো নেপালের মধ্য দিয়ে হাঁটছি তো কখনো ভারতের। নেই সীমান্তরক্ষীর নজরদারি, সীমান্ত নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি। যত এগোচ্ছি হিমালয়ের সৌন্দর্য তত বাড়ছে, বাড়ছে ফুলের সমারোহ।
মেঘমায় পথ দুভাগ হয়েছে। ডানদিকে টংলু – কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে জন্ম সিঙ্গলীলা গিরিশিরার উচ্চতম শৃঙ্গ। উচ্চতা ৩০৭০ মিটার। সমগ্র দার্জিলিং পাহাড় তথা উত্তর জুড়ে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা সুন্দর দেখা যায় টংলু থেকে। টংলুর চার কিমি আগে ধোত্রে থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। অন্যপথটি বাঁহাতি। আমাদের গন্তব্য। এ-পথে আর মাত্র দু-কিলোমিটার অতিক্রম করতে পারলেই তুমলিং পৌঁছে যাব।
মেঘমা অতিক্রম করতেই আবহাওয়া বদলে গেল। আচমকা মেঘে ঢেকে গেল, রোদ মুছে ছাইরঙা আঁধারে ঢেকে গেল চরাচর। সেই সঙ্গে হিমেল হাওয়া। শরীরে যেন সুচ ফোটাচ্ছে। এই জন্যেই কী গ্রামের নাম মেঘমা! সম্ভবত। মেঘ-কুয়াশার অবগুণ্ঠন ঠেলে এগিয়ে চলি আমরা।
তুমলিং (২৯৩৫ মি) পৌঁছাই দুপুর আড়াইটে নাগাদ। আজকের মতো এখানেই যাত্রাবিরতি। এখানেই রাত্রিবাস। যেহেতু আগে থেকে হোটেল বুক করে আসিনি, থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে আরো আধঘণ্টা কাটল। বেশকিছু লজ আছে এখানে। আমরা উঠলাম মাউন্টটেন লজে। ভাড়া মাত্র দুশো টাকা। প্রশস্ত ঘর। তিনটি ডবল বেড। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো ঘর। সাতজনের জন্যে এত কমে এত ভালো ব্যবস্থা সত্যিই অকল্পনীয়।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ি আবার। গ্রামটা এক চক্কর ঘুরে দেখব। ততক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে। মেঘমুক্ত হয়েছে আকাশ। ঘণ্টাখানেক আগেও যারা ছিল অদৃশ্য, এখন সেইসব গিরিশৃঙ্গ চোখের সামনে। বিশেষ করে কাঞ্চনজঙ্খা। কাছেই একটা পাহাড়চূড়ায় শুরু হয়েছে দুধসাদা মেঘের ঘনঘটা। মেঘ-পাহাড়ের লুকোচুরিতে বর্ণময় হয়ে উঠেছে গিরিশৃঙ্গ। লুকোচুরি চলছে মেঘের সঙ্গে সূর্যের। কখনো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে সূর্যের অবয়ব, মেঘ ফুঁড়ে ছিটকে বেরোচ্ছে তার আলোকরশ্মি। কখনো সূর্যদেব বাচ্চা ছেলের মতো নিজেই উঁকি মারছেন মেঘের ওপর থেকে। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। শুধু দুচোখ ভরে দেখারই নয়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করারও। ওদিকে আবার কাঞ্চনজঙ্খার রং বদলানো শুরু হয়েছে। সূর্যাস্তে কেউ যেন তার রজতশুভ্র শরীরে গাঢ় সিঁদুর বর্ণের প্রলেপ মাখিয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে সেই রক্তরাগ। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় একসময়। আর তখনই চোখে পড়ে আকাশজুড়ে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে।
মনে পড়ে কাল পূর্ণিমা। আমরা থাকবো পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। আহা, ওয়েদার ভালো থাকলে আমাদের মতো ভাগ্যবান আর কে!
এ-প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা দরকার, তুমলিংয়ে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। সোলার কিংবা মোমবাতির আলোয় আলোকিত হয় গৃহ। কে জানে বিদ্যুৎ পৌঁছালে প্রকৃতি এমন মোহময় হয়ে ধরা দেবে কিনা!
রাত নটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় যাই। সারাদিন পথ চলার ধকলে শরীর ক্লান্ত। সহজেই চোখের পাতা বুজে এলো। ঘুম ভাঙলো পরদিন ভোর চারটেয়, বন্ধু শ্যামলের ডাকে। তখনো বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই সেটা বুঝতে পারলাম। এখন আরো স্পষ্ট, আরো বিসত্মৃত এবং কাছে মনে হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্খা। যেন জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই তার নাগাল পাবো। তাড়াতাড়ি গরম পোশাক পরে ক্যামেরা হাতে বাইরে বেরিয়ে আসি। ঘুম ভাঙছে গ্রামের। ঘুম ভাঙছে অসংখ্য রডোডেনড্রন আর অর্কিডের। চরাচরজুড়ে অসংখ্য পাখির ডাক। কী বলছে ওরা? না কি গান গাইছে ঘুম-ভাঙানিয়া।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো স্পষ্ট হয় সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্খা। ঝকমকে আবহাওয়া। ঝলমলে রোদ। না, আনন্দ নয়, মন খারাপ হয় আমাদের। হাতে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে না আসার জন্যে। সময় থাকলে অনায়াসে একটি দিন এখানে কাটানো যেত।
তল্পিতল্পা গোছাতে হবে। সামনে উনিশ কিমি পথ। শেষ পাঁচ কিমি প্রাণান্তকর চড়াই। সন্ধ্যার আগে সন্দকফু পৌঁছাতে হবে। পসন তাড়া লাগায়, তাড়াতাড়ি করুন বাবু। অগত্যা বেরোতে হয় রুকস্যাক কাঁধে। মনে মনে বলি, বিদায় তুমলিং। আবার আসব। তখন আর সন্দকফু নয়, শুধু তোমার জন্যে, তোমার কাছে।
সকালের মিষ্টি রোদে মেষশাবকের দল চড়তে বেরিয়েছে। পেছনে রাখাল – হাত নেড়ে সেও আমাদের বিদায় জানায়। যত এগোচ্ছি, পথরূপ যেন তত খুলছে। একটু একটু করে। আমরা পিয়াসী পথিক, রূপের টানে এগিয়ে চলি চড়াই-উতরাই ভেঙে। তিন কিমি দূরে ২৮১১ মিটার উচ্চতায় আজকের যাত্রাপথের প্রথম গ্রাম জৌবাড়ি পেছনে ফেলে এগিয়ে চলি। আরো দু-কিমি উতরাই নেমে গৌরীবাসে (২৬৮২ মি) প্রথম যাত্রাবিরতি। গৌরীবাস সিঙ্গলীলা ন্যাশনাল পার্কের গেটওয়ে। পথ গিয়েছে ন্যাশনাল পার্কের ভেতর দিয়ে। মাথাপিছু ২৫ টাকা এবং ক্যামেরাপিছু আরো ২৫ টাকা টিকিটের বিনিময়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। যে-পথে গাড়ি চলে সে-পথ নয়, পথ শর্টকাটের জন্যে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলার শর্টকাট রাস্তা ধরি আমরা। যেমন চড়াই তেমন দুর্গম এ-রাস্তা। ধীর পায়ে বিশ্রাম নিতে নিতে পথ হাঁটি আমরা। সিঙ্গলীলা অভয়ারণ্যের প্রথম গ্রাম কয়ালকাটা পেরিয়ে আরো চার কিমি উত্তরে কালাপোখরি (৩১৭০ মি) যখন পৌঁছাই ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর বারোটা। কালাপোখরিতে আমাদের দ্বিতীয় পর্বের যাত্রাবিরতি। দুপুরের আহারপর্বটা আমরা এখানে সেরে নেব।
কালাপোখরি ঢোকার মুখে ছোট একটা পুকুর, চারপাশে ধর্মীয় পতাকা, নাম – কালাপোখরি। অর্থাৎ কালো জলের হ্রদ বা পুকুর। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী কালনাগের বাসস্থান। স্থানীয় মানুষের কাছে অতি পবিত্র হ্রদ। হ্রদের নামে স্থানের নাম। হিমালয়ের কোলে, সিঙ্গলীলা অরণ্যের গহিনে অল্পকিছু ঘরবাড়ি আর অসম্ভব নির্জনতা নিয়ে অপরূপ কালাপোখরি। পাহাড়ে এখন বসন্ত, অসংখ্য প্রজাতির রডোডেনড্রন তাদের বিচিত্র রং আর অবয়ব নিয়ে অর্ঘ্য সাজিয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে ফুলগাছ। চেনা-অচেনা পাখির গানে মুখরিত আকাশ-বাতাস। আরো মুগ্ধ হই স্থানীয় মানুষের আন্তরিকতায়। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপন করে নেয় তারা। পরম আগ্রহে স্থান-মাহাত্ম্য শোনায়। এরকম একটা জায়গায় একটা দিন থাকতে পারলে হতো না! যদিও অধিকাংশ সন্দকফুযাত্রী, যারা তিনদিনে সন্দকফু পৌঁছান, তাদের কেউ কেউ এখানে দ্বিতীয় রাত্রিটি কাটান। কেউ থাকেন আরো চার কিমি এগিয়ে বিকেভঞ্জনে। দু-জায়গাতেই থাকা-খাওয়ার জন্যে বেশ কিছু বেসরকারি লজ আছে।
আমরা তিনদিনের পথ দুদিনে অর্থাৎ আজই সন্দকফু পৌঁছতে চাই। সেভাবেই প্রোগ্রাম সেট করা আছে। ইচ্ছা থাকলেও তাই গ্রামটা ভালো করে ঘুরে দেখা হয় না। ঘণ্টাখানেকেরও কম সময়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে হয়। গাইড পসন আগে থাকতেই মোবাইলে অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। এ-প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, এ-পথে মাঝে মাঝেই মোবাইলের টাওয়ার মেলে। তখন পরিবার বা প্রিয়জনদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি বিনিময় করার আনন্দই আলাদা।
খাবার রেডি ছিল, আমরা পৌঁছতেই গরম-গরম পরিবেশন করল। ভাত-ডাল আর সবজি। সঙ্গে বিশেষ ধরনের সুস্বাদু আচার। চমরি গাইয়ের দুধ, দুগ্ধজাতদ্রব্য এবং মাংস এ-অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার। প্রায় প্রতিটি বাড়ির রান্নাঘরে চোখে পড়বে ঘুড়ির লেজের মতো লম্বা ফালিকাটা লাল চমরি গাইয়ের মাংস ঝুলছে। প্রকৃতিই যেখানে সারাবছর ফ্রিজের ভূমিকা নিয়েছে সেখানে মাসের পর মাস এভাবে থাকলেই বা ক্ষতি কী! পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এখানেও হোটেল পরিচালন এবং অতিথিদের দেখাশোনার দায়িত্বে মেয়েরা। তিন বোন মিলে সবদিক সামলাচ্ছে, আর আছে তাদের বৃদ্ধ বাবা। ঘরের এক কোনায় বসে তিনি সাং পান করছেন। সাং হচ্ছে দেশীয় প্রথায় ঘরে তৈরি এক ধরনের মাদক পানীয়। আমাদের দিকে তার কোনো আগ্রহ নেই। বাড়ির সমর্থ পুরুষরা এ-সময় জীবিকার তাগিদে শহরে থাকে। শহর বলতে দার্জিলিং, শিলিগুড়ি কিংবা সুদূর কলকাতা। কিংবা অন্য কোথাও।
ঘর-গেরস্থালি মেয়েরাই সামলায়।
আহারপর্ব মিটতেই পথে নামি আবার। পসনের তাড়ায় সামান্য বিশ্রামেরও অবকাশ মেলে না। আমাদের থেকে ওর টেনশন বেশি। বিকেভঞ্জন থেকে সন্দকফুর দূরত্ব আরো তিন কিমি, অর্থাৎ এখনো সাত কিমি হাঁটতে হবে আমাদের।
শেষ চার কিমি পথ অসম্ভব চড়াই। কিছুতেই শেষ হতে চায় না। একটুতে হাঁপ ধরে আসছে, পাঁচ মিনিট হাঁটলে পাঁচ মিনিট যাচ্ছে বিশ্রাম নিতে। খাওয়া-দাওয়ার পর হাঁটার কষ্টটাও যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে। ক্লান্তি আসছে একটুতেই। অথচ থামার উপায় নেই, বিকেভঞ্জনের পর আর কোনো জনবসতি নেই। যেভাবেই হোক সন্ধ্যার আগে সন্দকফু পৌঁছাতে হবে। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে বন্য জীবজন্তু বিশেষ করে রেড পান্ডা, ধূসর চিতা, হিমালয়ান বস্ন্যাক বিয়ার ছাড়াও নানাধর্মী বনচর পশুদের মুক্তাঞ্চল হয়ে ওঠে ম্যাগনোলিয়া-সিলভার-ফার-জায়েন্ট ব্যাম্বু ট্রি ফার্ন-ম্যাপল-ওক-বার্চ আর অর্কিডের ঘন অরণ্য এই সিঙ্গলীলা ন্যাশনাল পার্ক। পা চলছে না, শরীরে যেন আর একটুও শক্তি অবশিষ্ট নেই, নিজেদের ওপরেই ক্ষোভ বাড়ে তিনদিনের পথ দুদিনে হাঁটার এই হটকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে। আফসোস হয় ছবির মতো গ্রাম কালাপোখরি ঘুরে দেখার সময় না পাওয়ার জন্যে। আপনারা যাঁরা ভবিষ্যতে সন্দকফু যাবেন, তাঁরা অবশ্যই কালাপোখরির জন্যে একটা দিন বরাদ্দ রাখবেন। কালাপোখরি আপনাদের বঞ্চিত করবে না।
কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন সন্দকফু এসে পৌঁছলাম ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল চারটে বেজে পনেরো মিনিট। পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শিখরে পা রেখেই সবুজ ঘাসে 888sport app লনের ওপর শরীর এলিয়ে দিলাম। চারপাশে নাম-না-জানা অসংখ্য রংবেরঙের ফুল আর ছবির মতো ঘরবাড়ি। চারপাশ ঘন কুয়াশায় 888sport app। চরাচর জুড়ে তীব্র হাওয়ার শনশনানি। এতটাই তার তীব্রতা যে সোজা হয়ে দাঁড়ানো দায়, সামান্য অসতর্ক হলেই ফেলে দেবে ধাক্কা দিয়ে। সেই সঙ্গে ঠান্ডার তীব্রতা, শরীরে যেন সুচ ফুটছে। এমন অবস্থায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকা সম্ভব নয়। মনোজ আর সুজিত গিয়েছিল হোটেল দেখতে, কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলো তারা। তল্পিতল্পা নিয়ে হোটেলে ঢুকে সোজা কম্বলের তলায় সেঁধিয়ে গেলাম। রাতে ডিনারের জন্যে অবশ্য একবার বেরোতে হয়েছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে এসেছি। কম্বলের উষ্ণতা ছাড়া আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না।
পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙলো। জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই আনন্দে আত্মহারা হওয়ার জোগাড়। মেঘমুক্ত আকাশ। দিনের আলো ফুটছে একটু একটু করে। সোনালি সূর্যের আভায় রূপসী কাঞ্চনজঙ্খাসহ 888sport app তুষারাবৃত শৃঙ্গগুলো কাঁচা সোনার রং পাচ্ছে। তড়িঘড়ি পোশাক পরে নিই, ক্যামেরা হাতে বাইরে বেরিয়ে আসি। তখনো সেই শরীরে সুচ ফোটানো ঠান্ডা হাওয়ার শাসানি। অবশ হয়ে আসে হাতের আঙুল, নাকের ডগায় জ্বালা ধরে। তা হোক এতবড় প্রাপ্তির জন্যে এটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারবো না! সোজা গিয়ে উঠি সানরাইজ পয়েন্টে। ততক্ষণে দিনের আলো অনেক স্পষ্ট। স্পষ্ট বরফে 888sport app অমল-ধমল শিখরগুলো। পাশের এক ভদ্রলোককে দেখলাম তার সঙ্গীদের পাহাড় চেনাচ্ছেন। তাঁর নির্দেশিত তর্জনী অনুসরণ করে আমারও চিনে নিই একে একে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট, কুম্ভকর্ণ, কাব্রম্ন সাউথ, কাব্রম্ন নর্থ, কাঞ্চনজঙ্খা, পান্ডিম, নরসিংহ
প্রভৃতি অনেক শৃঙ্গ …। ছবি তুলি তাদের। মনে মনে ভাবি কত শত-সহস্র বছর ধরে এরা এভাবেই পর্যটকদের আনন্দ দিয়ে আসছে, ভবিষ্যতেও দেবে – যুগ যুগ ধরে মানুষও ছুটে আসছে শত কষ্ট সহ্য করে এই রূপের টানে, ভবিষ্যতেও আসবে। শুনেছি ঈশ্বর অমর, তাকে কখনো প্রত্যক্ষ করিনি; কিন্তু ঈশ্বরের এইসব অমর সৃষ্টি প্রত্যক্ষ করে এদেরই ঈশ্বর বলে মানতে ইচ্ছা হয়। দূর থেকে নত মস্তকে এদের উদ্দেশে শতকোটি প্রণাম জানিয়ে আমাদের 888sport apk download apk latest versionর্ঘ্য অর্পণ করি।
আমরা ভাগ্যবান, আবার হতভাগ্য। ভাগ্যবান আবহাওয়া অনুকূল পাওয়ায় আর হতভাগ্য পেয়েও হারানোর জন্যে। নইলে সন্দকফুর জন্যে একটা দিন রাখবো না কেন! তুমলিং বা কালাপোখরির কথা না হয় বাদ দিলাম। অর্বাচীন হলে যা হয় আর কী! মানে এই ট্যুরের উদ্যোক্তা সুজিতের কথা বলছি। সে এই টিমের মোড়লও বটে। যেমন মোড়ল তেমন তার মাতববরি – অলটাইম ব্যস্ত। কোথাও একটা মুহূর্ত অতিরিক্ত ব্যয় করতে রাজি নয়। স্বাভাবিকভাবেই যা পরিণতি হওয়ার তাই হলো, সকাল নটার মধ্যে তল্পিতল্পা কাঁধে তুলে সন্দকফুকে বিদায় জানাতে হচ্ছে। বিদায় জানাচ্ছি চির প্রণম্য সব শৃঙ্গরাজিকে। শ্যামলের চোখে জল। এটাই তার জীবনের প্রথম ট্রেক কেবল নয়, ট্যুরও বটে। চাকরি পাওয়ার পর ঘুরতে এসেছে। আমাদের সঙ্গে মানেভঞ্জন পৌঁছানোর পর প্রথম জানতে পারে আমরা ট্রেকিংয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা আমসি মতো হয়ে যায়। যাচ্ছেতাই গালাগাল করে আমাদের। চাকরি পাওয়ার আনন্দ সেলিব্রেট করতে এসে শেষে কিনা তাকে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হবে … সেই শ্যামল কাঁদছে। ছেড়ে যাওয়ার শোকে। সুখেনদা বিষণ্ণ, কিং নির্বাক। মনোজ শুধু ক্ষুব্ধ, সে এই পরিণতির জন্যে সুজিতকে দুষছে। সুজিতেরও মন খারাপ। তারও ধারণা ছিল সন্দকফু সম্পর্কে … আমরা কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি প্রকৃতি আমাদের জন্যে কী অপরূপ অর্ঘ্য সাজিয়ে রেখেছে। কিছু করার নেই। ফিরতেই হবে। বিষণ্ণ পায়ে নামতে শুরু করি আমরা …
এ-কাহিনির শেষ হতে পারত এখানে; কিন্তু ফেরার পথ ভিন্ন। সে-পথের সৌন্দর্যও কম কিছু নয়, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও আলাদা। এবং আমার ট্যুরিস্ট জীবনের 888sport app download for androidীয় পথগুলির মধ্যে অন্যতম একটি। তাই সংক্ষেপে দু-একটা কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি।
ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সংকীর্ণ পথ, খাড়া-উতরাই। দুপাশে বুনো ফুলের মেলা, অসংখ্য প্রজাপতি – ভালোভাবে দেখার উপায় নেই। চোখ কেবল পায়ের দিকে। একটু অসতর্ক হলেই হড়কানোর ভয়। গড়াতে গড়াতে কোথায় গিয়ে ঠেকব, জীবিত ফিরতে পারবো কি না তাতেও সন্দেহ। এতটাই ডাউনে নামতে হচ্ছে যে, শরীরের ভারসাম্য রাখার জন্যে প্রত্যেকে হাতে লাঠি তুলে নিয়েছি। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটছি। এরকম পথে বেশি কষ্ট মোটা মানুষের। সমস্ত শরীরের ভর এসে পড়ে হাঁটু আর গোড়ালির জয়েন্টে, অসম্ভব যন্ত্রণা হয়। আমাদের মধ্যে গুড্ডুদা একমাত্র মোটা, তাই কষ্টও তার বেশি। মাঝে মাঝে অবশ্য সমতল জায়গাও কিছুটা আছে, সেখানে সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো। ক্ষণিক বিশ্রাম নিই এরকম জায়গা পেলে। কেউ কেউ একটু গড়িয়ে নেয়। তারপর আবার পথচলা। এভাবেই ছবির মতো ছোট একটা গ্রাম গুরদুমে এসে পৌঁছাই। ফেরার পথে এটাই প্রথম জনপদ। দ্বিতীয় জনপদ শ্রীখোলা। সন্দকফু থেকে দূরত্ব ১২ কিমি। শ্রীখোলাতেই আজ আমরা রাত্রিবাস করব। তার আগে গুরদুমে প্রথম পর্বের বিরতি। দুপুরের খাওয়া-দাওয়াটাও সেরে নিই এখানে। ভাত ডাল সবজি আর সালাদ। সঙ্গীদের কেউ কেউ স্নানটাও সেরে নেয়। গুরদুম যেন ফুলের উপত্যকা। প্রতিটি বাড়ির সামনে ফুলের বাগান, অসংখ্য প্রজাতির ফুল। পসনের তাগাদা সত্ত্বেও এখানে ঘণ্টা-দুই কাটিয়ে শ্রীখোলার উদ্দেশে রওনা দিই।
পথ একই রকম অর্থাৎ মারাত্মক ঢালু। কিছুদূর এগোতেই আবার গভীর জঙ্গল। কোথাও কোথাও সূর্যের আলো পর্যন্ত পৌঁছায় না। ভয়ে গা শিরশির করে। রোমাঞ্চও হয়। আরো কিছুদূর এগোতে কাঠের একটা পুল, ঝরনার ওপরে। আরে ধুর ঝরনা কোথায়, এটা তো নদী! শ্রীখোলা। নেপালি ভাষায় খোলা শব্দের অর্থ নদী। নদীর নামেই জায়গার নাম। নদী শ্রীখোলা এবার আমাদের সঙ্গী হয়, পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। নদীর ধার বরাবর ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ হাঁটি আমরা। শেষ হয় শ্রীখোলায় গিয়ে। তখন বিকেল। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হতে যতটুকু সময়, তারপরেই ঝুলন্ত কাঠের সেতু পেরিয়ে অপর পাড়ে নদীর ধারে এসে বসি। সঙ্গীদের দুজন আবার শ্রীখোলার বরফগলা জলে স্নান করে। ধীরে ধীরে আঁধার নামে। পেছনের ঘন জঙ্গলে পাখির ঝাঁক কিচিরমিচির করতে করতে একসময় থেমে যায়। চাঁদ ওঠে আকাশে। জ্যোৎস্নায় নদীর বুকে বড় বড় বোল্ডারের ওপরে বসে আমরা গান ধরি ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে …।’
পরদিন একটু বেলা করেই বেরোই শ্রীখোলা থেকে। আর মাত্র সাত কিমি পথ। প্রায় সমতল। এ-পথে হাঁটতে একটুও কষ্ট হয় না। যাব রিম্বিক। মাঝে ছোট ছোট গ্রাম পড়ে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে স্কুলে যাচ্ছে। তাদের হাতে লজেন্স তুলে দিতেই একগাল মিষ্টি হেসে থ্যাংক ইউ জানায়। ফুলের মতো সেইসব শিশুর মিষ্টি হাসি পাথেয় করে রিম্বিক পৌঁছে যাই একসময়। রিম্বিক থেকে শেয়ার জিপে মানেভঞ্জন – ঘুম হয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছাই সন্ধ্যার মুখে। সেখান থেকে রাতের বাসে কলকাতা। সঙ্গী থাকে সন্দকফুর 888sport sign up bonus।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.