উজানে মৃত্যু : অ্যাবসার্ডের আড়ালে গভীরতর জীবনবাস্তবতা

আবু সাঈদ তুলু

অ্যাবসার্ড ধাঁচের নাটকে ঘটনার উদ্ভটতা, স্থানকালের অযৌক্তিকতা ও সংলাপের অর্থহীনতাসহ নানা অসংগতি- শৃঙ্খলাহীনতায় ক্লান্তিকর দর্শনের অভিজ্ঞতাই সাধারণত বেশি হয়। অ্যাবসার্ডও যে গল্পগাঁথার মতো বিনোদনমুখী গল্পনির্ভর হয়ে উঠতে পারে তা পালাকার নাট্যদলের নতুন প্রযোজনা উজানে মৃত্যু নতুন করে প্রমাণ করে দিলো। পালাকার-প্রযোজিত এ-নাটক অরূপজাত জীবনদর্শনকে যেন রূপের কল্পনায় দৃশ্যরূপে ধরেছে। তিনটি প্রতীকী চরিত্রের অস্তিত্বহীন অনিশ্চিত গন্তব্যের পরিক্রমায় মানবজীবনের প্রকৃত সত্যকে অনুসন্ধান করা হয়েছে। কালজয়ী 888sport live footballিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-রচিত উজানে মৃত্যু নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন তরুণ প্রতিভাবান নির্দেশক শামীম সাগর। অনবদ্য 888sport live chatমাত্রায় সহজ-সরল অথচ নানা ব্যঞ্জনাধর্মী টানটান দৃশ্য গাঁথুনির উপস্থাপনায় নাটকটি দর্শকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জন করে। নাট্য-প্রদর্শনীর ওপর ভিত্তি করে মূলনাটক, নির্মাণরূপ, উপস্থাপনরীতি, অভিনয়-আলো-মঞ্চবিন্যাসের স্বরূপ আলোচনাই লেখাটির লক্ষ্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় সৃষ্টি হয় অ্যাবসার্ড ধারার নাট্যচর্চা। উদ্ভট বাস্তবতা, পরম্পরাহীন গল্প, কার্যকরহীন সংলাপ কিংবা পরিণামহীনতা যার মূল। কিন্তু সামগ্রিক বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে কখনো কখনো অতিপ্রাকৃতিক বাস্তবতা ফুটে ওঠে। পাশ্চাত্যে ইউজিন আয়োনেস্কো, স্যামুয়েল বেকেট, জাঁ জেন এ-ধারায় অন্যতম নাট্যকার। স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো সারা

পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে। 888sport appsে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, সাঈদ আহমেদ, পশ্চিমবঙ্গে মোহিত চট্টোপাধ্যায়, বাদল সরকার প্রমুখের কাজে এ-ধারার চর্চা রয়েছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উজানে মৃত্যু আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও 888sport live chatমানে উৎকর্ষমণ্ডিত। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নাটকটি সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অস্তিত্বহীন মানবজীবন ও তার সংগ্রাম এ-নাটকের মূল প্রতিপাদ্য। বৃত্তহীন ঘটনাবিন্যাসে বিমূর্তরূপী 888sport live chatনিরিখে কাব্যময়তায় অনবদ্যভাবে উপস্থাপিত হয়ে ওঠে মানুষের জীবনব্যাখ্যা। স্টুডিও থিয়েটারের প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়ে সাম্পান জাতীয় বৃহৎ নৌকার সাজেশনে নাটকটি উপস্থাপিত। পেছনে সাদা সায়াক্লোমা। একজন একজন নৌকার দাঁড় টানছে। অস্তিত্বহীনতার বিপরীত দিকে যেন তার চলার গতি। জীবনের মুক্তি কোথায়? সাদা পোশাক কিংবা অপর কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি Ñ সবাই জীবনসায়াহ্নে একই। কিন্তু জীবনের অস্তিত্বহীনতায় বেঁঁচে থাকার অনিশ্চয়তায় গতি আজ তাদের উজানেই। সাদা পোশাকধারী তা পছন্দ করলেও কালোর মানসিকতা ভিন্ন। পৃথিবীর নশ্বরতাই কালো পোশাকধারী মান্য বলে মনে করে। নাটকের শেষে তিনজনই বাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দর্শকের কাছে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে জীবনসমুদ্রে মানুষ প্রকৃতই দিগি¦দিকহীন। জীবন নদীর কোন ঘাটে সে আশ্রয় নেবে Ñ এমন একটি নৈর্ব্যক্তিক নিরিখে নাটকটি অন্তে পৌঁছে।

পালাকার সময়ের আলোচিত নাট্যদল। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এ-যাবৎ 888sport appsের নাট্যধারায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ, জনপ্রিয় ও কুশলী নাট্য উপহার দিয়ে চলেছে। 888sport appsে স্টুডিও থিয়েটার চর্চায় তাদের অবদান অনস্বীকার্য। পালাকার মনে করে, তাদের গবেষণা ও নিরীক্ষার এই পথ আমাদের হাজার বছরের নাট্য-ঐতিহ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হবে। পালাকারের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হলো Ñ রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর, সেলিম আল দীনের বাসন, উডি অ্যালেনের ডেথ নকস, ব্রের্টল্ড ব্রেখটের রাইফেল, সৈয়দ শামসুল হকের 888sport promo codeগণ, ইবসেনের নোরার তিনকন্যা, ফ্রানজ জ. ক্রোয়েটজের রিকোয়েস্ট কনসার্ট প্রভৃতি। এমন নানান বিষয়বৈচিত্রের নাট্যনিরীক্ষা পালাকারকে স্বতন্ত্র এক পরিচয় এনে দিয়েছে।

উজানে মৃত্যুতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্রান্তিক চরিত্রের কোনো নাম উল্লেখ না করে নৌকাবাহক, সাদা/ কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শামীম সাগর-নির্দেশিত এ-নাটকে নাট্যকারের ভাবনা যেন নতুন রূপে, নতুন ভাবনায়, 888sport live chatকুশলে আরো বাক্সময় হয়ে ওঠে। মানবজীবন রূপের নতুন আরেক দার্শনিক বক্তব্যের দৃশ্যরূপ হয়ে দাঁড়ায়। পালাকারের এ-নাটকে বিমূর্ত, গল্পহীন কিংবা অধিক ভাবগাম্ভীর্যের গ্রন্থনা নেই। আছে অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে দার্শনিক সত্য খোঁজা।

পালাকার নাট্যনির্মাণে মঞ্চের একপাশ নৌকা চলনের প্রতীক তৈরি করেছে। নাট্যগৃহের একপাশের পুরোটা মঞ্চ। জীবনসমুদ্রের প্রতীক। সেখানে তিনটি স্পটে প্রতীকায়িত নৌকার গঠন। পেছনে মধ্যমঞ্চে নৌকার ওপরের মাস্তুল। তিন পাশে দাঁড় টানার তিনটি দড়ি। তিনজন মানুষের অনিশ্চয়তার পথে হাঁটার মধ্য দিয়ে নাটকটি শুরু হয়। একজন সাদা, একজন কালো ও বাকিজন নৌকাবাহক। তারা যেন জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরছে। সাদা ও কালো মূলত প্রতীকী। চরিত্রগুলো নানা ভাবব্যঞ্জনার দ্যোতনা তৈরি করে।

প্রান্তিক মানুষ এরা। নৌকাবাহক সারারাত নৌকার গুণ টানতে টানতে ক্লান্ত। সে একটু জিরিয়ে নেয়। ‘মাঝি রে আজ ঝড় তুফানে চালাও তরী হুঁশিয়ার’ গান বাজতে থাকে। নাটকে গানগুলো রেকর্ডেড ব্যবহার হয়েছে। নৌকাবাহক পুনরায় গুণ কাঁধে নৌকা টানতে থাকে। নিজেকে সহ্যের শেষ সীমায় নিয়ে যায় সে। এক আত্মঘাতী প্রবণতা নৌকাবাহকের মধ্যে। জীবনের উজান ঠেলে সে মৃত্যুই কামনা করে। সে ভূমিতে পতিত হয় পরিশ্রমে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বালিহাঁস দেখতে পায়। প্রতীকী অর্থে বালিহাঁস ব্যবহৃত।

নৌকা বাহক : বালিহাঁস! ঠিক দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু বালিহাঁসই হবে। সূর্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে, একমুঠো বালু যেন!

সাদা : ভাবলাম এবার কিছু খাওয়া যাক।

নৌকাবাহক : গেল কোথায়?

সাদা : কী?

নৌকাবাহক : বালিহাঁস। দেখতে পাচ্ছি না আর। একটু আগে সূর্যের দিকে উড়ে গেল। …

নাটকে ওরা খেতে বসে। খাবারটা যদিও সত্যিকার খাবার নয়। কিন্তু আমিনুর রহমান মুকুলের বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়ে তা যেন বাস্তব হয়ে ওঠে। কোরিওগ্রাফির অসাধারণ বিন্যাসে মঞ্চে যেন অনবদ্য কম্পোজিশন তৈরি হয়। হঠাৎ কোনো একটা সুর নৌকাবাহককে টেনে নিয়ে চলে নদীর পাড়ে। যেখান থেকে নদীর ওপারের একটি সুনির্দিষ্ট গ্রামে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় নৌকাবাহকের। নৌকাবাহক জীবননৌকা বয়ে বয়ে ক্লান্ত। বাউল চরিত্রের প্রতীকে জীবনের ব্যাখ্যা আরো অনবদ্য হয়ে ওঠে।

নৌকাবাহক : নদীর ওপারের গ্রামটি আমি চিনি। কী নাম? গ্রামটি সত্যিই আমি চিনি। কিন্তু তার নাম মনে পড়ছে না। গ্রামটা চিনি, কারণ দু-বছর আগে সেখানে একটি লোক ভীষণভাবে মরেছিল। বাঁশে বিদ্ধ হয়ে মরেছিল লোকটা, ব্যথা লাগবে বলে কাউকে বাঁশটা বের করতে দেয় নাই। মরতে তিন-দিন তিন-রাত লেগেছিল।

সাদা : সব কল্পনা! তুমি ভাবছো গ্রামটি তুমি চেন কারণ Ñ তুমি একথা বিশ্বাস করতে চাও যে, তুমি জানো তুমি কোথায় যাচ্ছো আর গ্রামটি তোমার পথে একটি সুপরিচিত চিহ্ন।

নাটকের নাম যেমন প্রতীকী তেমনি নানা ঘটনা-উপঘটনাও সাংকেতিক। একদিকে জীবন, অন্যদিকে জীবনের মায়া। প্রেম-ভালোবাসা জাগতিকতাকে যেন বারবার টেনে ধরে। সন্তানের কণ্ঠ শুনতে পায় নৌকাবাহক। কিন্তু জীবনকে থামিয়ে রাখতে পারে না কেউ। 888sport sign up bonus থেকে যেন সন্তান ভেসে ওঠে। কালো চরিত্র একটি লম্বা কাঠিতে তিনটি পুতুল তুলে ধরে। অনবদ্য এক মঞ্চমায়া তৈরি হয়। নৈর্ব্যক্তিক এক অনুপম 888sport live chat তৈরি হয়। এ যেন জীবনের মায়া Ñ ঘিরে ধরে রাখতে চায় তাকে। সন্তানদের ছেড়ে থাকার কষ্ট তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকে সে। সন্তানের কণ্ঠ বাজতে থাকে Ñ

বাজান। ও বাজান। বাজান আসছে, বাজান আসছে। মা বাজান আসছে। বাজান তুমি এতো দেরি করলা কেন। বাজান আমারে নিয়া মেলায় যাইবা, আমি একটা ঘুড্ডি কিনমু, নিয়া যাইবা তো বাজান, ও বাজান। বাজান, আমার কতা হোনো, আমারে গুড়ের সন্দেশ কিইনা দিবা। তুমি আমারে বুকের মইদ্দে কইরা হুইয়া থাকবা, আর সারারাত ধইরা গপ্পো হুনাইবা, বুজছো, মনে থাকবো তো তোমার, ও বাজান। বাজান, তুমি যাইও না, তোমারে ছাড়া আমার ভালো লাগে না। বাজান, বাজান, ও বাজান।

নৌকাবাহক তখন বলতে থাকে তার ছেলে বসন্তে মরেছে। সে তিন বছর হলো। তখন সবে নতুন বছর এসেছে। মাঠে মাঠে ঘূর্ণি হাওয়া। নৌকাবাহক তার ফেলে আসা জীবনে তার স্ত্রীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অনাচার প্রত্যক্ষ করে। তার স্ত্রী মধ্যমঞ্চ থেকে উঠে আসে। গান বাজতে থাকে Ñ ‘ও ঘাটে কেউ ছিল না, সে ছিল আমি। আমি একা বন্দে, বাঁশি বাজাই সখী গো। মনের মানুষ পাইবার আশে।’ অত্যন্ত চমৎকার আবেগ তৈরি হয় মঞ্চ ঘিরে। এক জীবনের মহাকাব্য হয়ে ধরা দেয়। নৌকাবাহক ভূমিতে পড়ে থাকে।

সাদা : কিন্তু তুমি ছাড়া আর কেউ কি বউ হারায় নাই?

নৌকাবাহক : আমার বউ-ছেলেদের কথা বলছো কেন?

সাদা : না, ইয়ে, মানে সারারাত অর্থহীনভাবে খালি নৌকা টেনেছো, তুমি জানো না কেন? শোন! তোমার বুকে অনেক দুঃখ, কিন্তু তাই বলে এমন পাগলামি করবে নাকি?

নৌকাবাহক : না, তুমি আমাকে বুঝতে পারছো না। এর সঙ্গে ওসবের কোনো সম্বন্ধ নেই। আমার বুকে অনেক দুঃখ আছে কি নাই, তাও ঠিক জানি না। আমি আমার বউ-সন্তানসন্ততি হারিয়েছি বটে, কিন্তু সেসব অন্যকথা। এমনকি অন্য ক্ষতিটাও।

উদ্দেশ্যহীন এলোমেলো সব উক্তি-প্রত্যুক্তি। কালোর ইশারায় নৌকাবাহকের সমুখে এক ডুবতে থাকা মানুষ আবির্ভূত হয়। বাইচের নৌকা পাশ দিয়ে চলে যায়। গান বাজতে থাকে Ñ ‘আমার ডুবুডুবু তরী’। সাদার বেসুরো গান শুনে নৌকাবাহক হাসে। সাদাও সে-হাসিতে যোগ দেয়।

সাদা : বুঝলে, কণ্ঠে সুর না থাকলেও কিন্তু গান গাওয়া যায়।

কালো : কী বোকামি! মাথায় এমন রোদের তাপ কিন্তু ছাতাটা বন্ধ করে রেখেছিলাম। একটু মনভোলা হয়ে পড়েছি যেন। অবশ্য ছাতার কথা মনে পড়লো অন্য একটি কারণে Ñ গায়ে যেন হঠাৎ কেমন শীতল হাওয়া লাগলো। চারধারে কেমন মেঘ করে আসছে, শীঘ্র ঝড় উঠবে।

জীবন কী! আকাশ কালো মেঘে ঘন হয়ে আসে। এক মহিলাকে নির্যাতনের দৃশ্য দেখা যায়। নৌকাবাহকের 888sport sign up bonusতে তার বিয়ের সময়ের ঘটনা ভেসে আসতে থাকে। ‘ভাদ্র মাসে কাটিলাম সুতা আশ্বিন মাসের পয়লাতে বাড়ির কাছে তাঁতিয়া ভাইরে শাড়িখান বুইনে দে’ Ñ গান, অভিনয় ও দৃশ্যকল্পের মধ্য দিয়ে জীবনের গভীরতর বাস্তবতা উদ্ভাসিত হতে থাকে।

কালো : দুস্থ শোকাচ্ছন্ন ক্রন্দনরতা সে-মেয়েমানুষটির বাহুতে একটি জ্বলন্ত শিক ধরলাম। তারপর তার দিকে তাকিয়ে দেখি আশ্চর্য ব্যাপার! তার কান্না হঠাৎ থেমে গেছে, তার চোখে বিস্ময়ের অন্ত নাই। শুধু তাই নয়, মুখে একটু শব্দও নাই। হঠাৎ সে যেন এমন একটা সত্যের সামনে দাঁড়িয়েছে Ñ যার সামনে কান্নাকাটি বা চিৎকার-আর্তনাদের কোনো অর্থ নাই। …

সাদা : শেষবারের মতো তোমাকে বলছি Ñ এই মুহূর্তে তুমি যদি না  থামো তবে নৌকা থেকে লাফিয়ে নেবে যাবো। তোমার পাগলামি আর সহ্য করা যায় না, শুনছো?

কালো : শূন্যে ভয় প্রদর্শন! লাফিয়ে পড়বে না ছাই করবে! আসলে সে একটি বিরাট সমস্যায় পড়েছে। মাথামুণ্ডু কোনো অর্থ হয় না এমন কিছুতে তাকে টেনে নিয়ে যায় সে তা চায় না।

অ্যাবসার্ড নাটকের এ-উপস্থাপনায় নানা বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে মঞ্চে। প্রথম থেকেই অভিঘাত তৈরি হয়। পরিমিতি বোধসম্পন্ন সংলাপ। নাটকের ভাষা প্রমিত। যদিও অসংলগ্ন কথায় ভরা, তবু জীবনবাস্তবতার গভীর হাহাকার ফুটে ওঠে। চরিত্রনির্মাণে নির্দেশক বাস্তববাদী ধারাকেই বেছে নিয়েছেন। প্রচলিত নৌকাবাহকদের মতোই খালি গা ও কাছা দেওয়া লুঙ্গি পরিহিত ছিল। প্রান্তিক মানুষের জীবনোপকরণও মঞ্চদৃশ্যে বিদ্যমান। কোরিওগ্রাফি ও নানা নাট্যক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনের নানা বিষয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন। নানা প্রতীকে ঘটনার নানা ব্যঞ্জনা তৈরি হয়। নৌকাবাহক বিমর্ষ হয়ে ওঠে জীবনের প্রতি। সংলাপে ফুটে ওঠে Ñ

নৌকাবাহক : ঐ যে! ঐ!। আমি ভেবেছিলাম, আমি কোথাও যাচ্ছিলাম না, উদ্দেশ্যহীনভাবেই চলছিলাম! কিন্তু ঐ যে! অসীম আকাশ আর উন্মুক্ত প্রসারিত ধরণীর প্রান্তে, একান্ত নিরাপদ, একান্ত নিশ্চিন্ত! না, চোখের ভুল নয়।

আর কি শুদ্ধ-পবিত্র, কী শান্তিময়! ঐ যে সে গ্রাম! অতি উজ্জ্বল, তবু তারার মতো তাপশূন্য। দেখলেই বুক জুড়িয়ে যায়!

মৃত্যু যেন জীবনের সন্নিকটে। নৌকাবাহক যেন জীবনের সমাপ্তি দেখতে পায়। ওরা গিয়ে নৌকার গুণের দড়ি ধরে। কালোর বুকজুড়ে হাহাকার ফুটে ওঠে। ঝরা ফসলের ভাষা কে বুঝতে পারে। সাঁঝের সোনার বরণ গোপন মেঘের কাছে সুরটুকু রেখে যায়। হঠাৎ করে কালো বালিহাঁস দেখতে পায়। সূর্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে। মৃত্যু নয়, জীবন যেন তাদের ডাকে। আর তিনজন জীবননৌকা টানতে থাকে অনিশ্চিত জীবনের পথে। এ যেন রূপক Ñ এ জীবন-মৃত্যুর গল্প। এভাবেই নাটকের সমাপ্তি ঘটে।

হাজার বছরের বাংলা নাটকে রূপকাশ্রিত বিমূর্ত নানা নাট্যোপকরণ ছিল। তবে তা অ্যাবসার্ড টার্ম হিসেবে প্রচলিত ছিল না। নির্দেশক ছোট ছোট দৃশ্যকল্পের মধ্য দিয়ে রূপকাশ্রিত জীবনের ব্যাখ্যাগুলো তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন। মেটাফোরিক্যালি অনবদ্য 888sport live chatনৈপুণ্যতার প্রকাশ ঘটেছে। নির্দেশক দেখিয়েছেন, অ্যাবসার্ড মানেই অসংলগ্ন বিষয় নয়, জীবনের আরো সত্য উন্মোচনের প্রচেষ্টা। নাটকটি প্রযোজনায় একটি 888sport live chatসৌন্দর্য তৈরির প্রচেষ্টা ছিল। বিমূর্তের মধ্য দিয়ে জীবনের গভীর তাৎপর্যকে তুল ধরতে সচেষ্ট ছিলেন নির্দেশক। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ঘটনা হলেও অতীন্দ্রিয় 888sport live chatচেতনার রূপ প্রকাশিত হয়েছে। জীবনসমুদ্রে সাধারণ দাঁড় টানার মধ্য দিয়ে জীবনের বহমানতায় অনুপমভাবে জীবনদর্শন প্রকাশিত হয়েছে।

উজানে মৃত্যু নাটকের অভিনেতাদের দুটো দল রয়েছে। একেক শোতে একেক দল অভিনয় করে। নৌকাবাহক চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমিনুর রহমান মুকুল। যদিও প্রথম কয়েকটি শোতে আসাদুজ্জামান শুভ অভিনয় করেছিলেন। আমিনুর রহমান মুকুলের অভিনয়ে সাত্ত্বিক দিকটা অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। প্রথম থেকে শুরু করে নাটকের গতি ঠিক রেখেছেন মুকুল। তাঁর মেকাপ-গেটআপ মিলে নৌকাবাহক মাঝিই মনে হয়েছে। চরিত্রের বিভিন্ন আবেগ প্রকাশে বিশ্বাসযোগ্য আবহ তৈরিতে  অনবদ্য ছিলেন। খাবারের দৃশ্যটি 888sport live chatসত্যে উদ্ভাসিত। ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক স্নায়ুগত যে-পরিবর্তন তাতে অভিনয়ের অনুপম বিশ্বাসযোগ্যতা ফুটে উঠেছে। সন্তানদের জন্য বারবার জীবনের মোহে আটকেপড়া এবং আত্মঘাতী অনিশ্চিত জীবনের টান প্রভৃতি ব্যঞ্জনা প্রকাশে অনবদ্য অভিনয় করেছেন তিনি। অ্যাবসার্ডের সংলাপগুলোয় তাল-খেয় না থাকলেও এ-নাটকের সংলাপগুলোকে বাস্তব ঘটনার নিরিখে যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে। সংলাপ প্রক্ষেপণ ছিল স্পষ্ট। গভীর বেদনার বিষাদ তাকে সারাক্ষণ ঘিরে রাখে। মানবজীবন তো তাই। সাদা পোশাকধারী চরিত্রে সাজ্জাদ হোসেন নিষাদ প্রথমদিকে অভিনয় করলেও সেদিন অভিনয় করেছেন কাজী ফয়সল। অত্যন্ত বাস্তবমুখী প্রাণবন্ত ছিল অভিনয়। উক্তি-প্রত্যুক্তিগুলোও ছিল প্রাণবন্ত। কালো পোশাকধারী চরিত্রে প্রথমে চারু পিন্টু অভিনয় করলেও সেদিনের শো’তে বাবর খাদেমী অভিনয় করেন। তার অভিনয় প্রাণবন্ত ও সুস্পষ্ট ভাবপ্রকাশক ছিল। তিনটি প্রধান চরিত্র অভিনয় করলেও বউ, বাইচাল, কোরাসে শতাব্দী সানজানা; ডুবন্ত মানুষ, বাইচাল ও কোরাসে সোনিয়া আক্তার/ মুনিরা অবনী এবং মহাজন, বাঁশবিদ্ধ ব্যক্তি, কোরাস চরিত্রে ফাহমিদা মল্লিক শিশির, অধরা হাসান, নির্ভানা ইভার অভিনয়ও ছিল প্রশংসনীয়। নাটকটির 888sport live chatনির্দেশনায় ছিলেন আমিনুর রহমান মুকুল, কোরিওগ্রাফি অনিকেত পাল বাবু, আলোক পরিকল্পনা বাবর খাদেমী, সংগীত অজয় দাশ, পোশাক পরিকল্পনা ফাহমিদা মল্লিক শিশির ও প্রপস চারু পিন্টু।

নির্দেশক শামীম সাগর বলেন, ‘সম্ভবত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ই 888sport appsের প্রেক্ষাপটে সর্বপ্রথম নিরীক্ষাধর্মী নাটক লেখেন। মানুষের অবচেতন মনের যে-বিচিত্র ধারা, যা সহজে চোখে পড়ে না, অথচ বাস্তবেরও অধিক বাস্তব, তা সুচারু এবং শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি, সমাজে বহমান গভীর ক্ষতকে সকলের দৃষ্টিগোচর করেছেন। সম্ভবত তিনিই 888sport appsে প্রথম জাদুবাস্তবতা নিয়ে 888sport live football রচনা করেছেন। এমন একজন মহাজনের সৃষ্টি নিয়ে মঞ্চে কাজ করতে পারাটা আনন্দের এবং চ্যালেঞ্জেরও বটে। কেননা বহিঃকাঠামোতে উজানে মৃত্যুতে আমরা সোজাসাপ্টা একটা গল্প পাই; কিন্তু অন্তঃসলীলা নির্ঝরিণীর মতো এই গল্পের ভাঁজে ভাঁজে আশ্চর্য সব দর্শন আর অন্তর্বাস্তবতার কথা ছড়িয়ে রয়েছে।’

আলোর মায়ায় দৃশ্যরূপ অসাধারণ আবেগঘন হয়ে উঠেছে। পোশাকগুলোও চরিত্রের পরিচয় ও ভাবাবেগ প্রকাশে অত্যন্ত কার্যকর। নাটকে নৌকাবাহকের চরিত্রে প্রান্তিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বিক্ষুব্ধতা যেন পরতে পরতে। তবুুও স্বপ্ন, প্রেম, ভালোবাসা তাকে আঁকড়ে ধরে। নৌকাবাহক সমাজ-সংসার-সন্তান বন্ধন আঁকড়ে ধরতে চাইলেও সে আত্মঘাতী। দৃশ্যে বস্তুবাদী কালো পোশাকধারী পুতুল প্রপসের মাধ্যমে এগিয়ে আসাটা যেন ব্যঞ্জনাময় উঁচুতর 888sport live chatমূল্যে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এ-নাটকে তিনটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মানুষজীবনরূপ। বাউল-বৈষ্ণবী Ñ এমন নানা প্রতীকে নানা রূপে নাটকের বক্তব্য ফুটে ওঠে। প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ব্যাপ্তির অবচেতন ভাববাদী গল্পপরম্পরাহীন এ-নাটকে দর্শক কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেছে বলে মনে হয়নি। অত্যন্ত সুগভীর দার্শনিক ভাষ্য সহজ-সরলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। অভিনেতাদের ভাব-ভাষায় অনেক স্পষ্টতা লক্ষ করা গেলেও চলনে আরো স্বতঃস্ফূর্ততা জরুরি। মঞ্চ, আলো, আবহ নিয়ে আরো ভাবনার সুযোগ থাকলেও অত্যন্ত উপভোগ্য। মানুষের চেতনার গভীরে লুকিয়ে থাকা ভাবনাগুলো যেন অনবদ্যভাবে বিবৃত হয়েছে উজানে মৃত্যুতে। জীবনের সৌন্দর্য ও অনিশ্চয়তা এক অনবদ্য ঐকতানিক সুরে অনবদ্য এ-নাটক। জীবনস্রোতের উল্টো দিকের অনিশ্চয়তা যেন নান্দনিক উৎকর্ষে রূপায়িত।

নাট্যালোচনায় ব্যবহৃত সব ছবি লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত