উত্তরাধিকার

হাসনাত আবদুল হাই

আজিমপুর থেকে আনোয়ার সাহেব যে-রিকশা নিলেন তার চালক বয়স্ক, বেশ কসরত করে চালাচ্ছেন। দেখে কষ্ট পেলেন তিনি, কিছুটা অপরাধবোধও জেগে উঠল ভেতরে। তার সঙ্গে নাতনি নাজনীন। দুজনের ওজন একজন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমন দৃশ্য অবশ্য বেশ সাধারণ। তবু বয়স্ক রিকশাওয়ালার জন্য তার মন বেশ অস্বস্তিতে ভরে উঠল। নেমে অন্য একটা রিকশা নেবেন কি না ভাবলেন কয়েকবার।

তার অস্বস্তি দেখে নাজনীন বলল, অসুবিধা হচ্ছে বসতে নানা?

তিনি অপ্রস্ত্ততের মতো বললেন, না। অনেকদিন রিকশায় উঠিনি তো তাই কেমন লাগছে।

নাজনীন বলল, আপনাকে নিয়ে রিকশায় বেরিয়েছি শুনলে মা রাগ করবে।

বলিস, আমার কথামতো কাজ করেছিস। তোর নিজের ইচ্ছে ছিল না।

বুড়ো রিকশাওয়ালা পেছনে না তাকিয়ে বলল, কই যাইবেন কইলেন?

শহীদ মিনার। আনোয়ার সাহেব বেশ উৎসাহ নিয়ে জানালেন।

ও। শহীদ মিনার। রিকশাওয়ালা তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, সেখানে কিছু হইব না কি?

না। আজ কিছু হবে না। পরশুদিন হবে।

তয় আজ যাইতাছেন যে? রিকশাওয়ালা প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলে।

দেখার জন্য। জায়গাটা দেখবো। ঘুরে বেড়াবো।

হ্যাঁ। শহীদ মিনার দেখার জন্য যাচ্ছেন আনোয়ার সাহেব। অনেক বছর হলো দেখা হয় না। 888sport cricket BPL rateে এলে শুধু টেলিভিশনেই দেখেন। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন দেখার জন্য। ছাত্রজীবনের দিনগুলোতে ফিরে যান।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তিনি অবাক হয়ে বললেন, এখানে অনেক বড় বড় বিল্ডিং হয়ে গিয়েছে দেখছি। চেনাই যায় না। আগে কত নির্জন ছিল। বেশ ফাঁকা দেখাতো।

নাজনীন হেসে বলল, এখন 888sport appয় ফাঁকা জায়গা কোথায় আর দেখতে পাওয়া যায়। সব ভরে যাচ্ছে সিমেন্ট-কংক্রিটে।

আনোয়ার সাহেব ডান দিকের তিনকোনা ছোট মাঠটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওইসব মূর্তি? কারা সাজিয়ে রেখেছে?

নাজনীন বলল, শামীম সিকদারের ভাস্কর্য। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাকে এই জায়গায় সাজিয়ে রাখতে দিয়েছে। স্কাল্পচার পার্ক।

তিনি বললেন, মূর্তিগুলো ময়লা হয়ে গিয়েছে। কোনোটা ভেঙে পড়ছে। কেউ যত্ন নেয় বলে মনে হয় না।

নাজনীন হেসে বলল, 888sport appর অনেক কিছুরই এমন অবস্থা।

জগন্নাথ হলের পর তারা রিকশা থেকে নামলেন। নাজনীন রিকশার ভাড়া চুকিয়ে দিলো। ফুটপাত দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে থাকলেন আনোয়ার সাহেব। জায়গায় জায়গায় ভাঙা, অসাবধান হলেই পড়ে যেতে হবে। নাজনীন তার একটা হাত ধরে রেখেছে, যেন পড়ে না যান। পাশের দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে উদ্ধৃতি লেখা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের, নজরুলের, দ্বিজেন্দ্রলালের, আবুল ফজলের, ভরতচন্দ্রের, আলাওলের। এক জায়গায় বর্ডারের ভেতর লেখা : ‘বিনে স্বদেশী ভাষা, মেটে কি আশা?’ তার পাশেই লেখা : ‘888sport cricket BPL rate মানে মাথা নত না করা।’

আনোয়ার সাহেব দেখতে দেখতে বললেন, আমাদের সময়, মানে আমরা যখন কলেজে পড়ি, সে-সময় দেয়ালে কিছু লেখা হতো না।

কেন? নাজনীন তার দিকে তাকায়।

লেখার কথা মনে হয়নি কারো। তাছাড়া হয়তো ইতস্তত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কথা ভেবে।

ভয় পেতেন আপনারা? নাজনীনের স্বরে কৌতুক।

না, না। ভয় পাবো কেন? ভয় পেলে আমাদের বয়েসি ছেলেরা বুক পেতে গুলি নেয়? কারফিউ লঙ্ঘন করে? পুলিশের বাধার মুখে মিছিল বের করে? বায়ান্নর 888sport cricket BPL rateেতে সবাই বেপরোয়া, অকুতোভয় ছিল। তারপরও প্রতি বছর 888sport cricket BPL rateে এলে ছেলেমেয়েরা দুরন্ত সাহস নিয়ে পথে নেমেছে। পুলিশের চোখরাঙানিতে ভয় পায়নি কেউ।

বায়ান্নর 888sport cricket BPL rateেতে কি আপনি কলেজে পড়তেন নানা?

না। স্কুলে। কিন্তু আমরাও বড়দের ডাক শুনে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। তাদের সঙ্গে মিছিল করেছি, স্লোগান দিয়েছি উত্তেজিত হয়ে।

আপনাদের সময় 888sport cricket BPL rateের উদ্যাপন কেমন ছিল? নিশ্চয়ই এখনকার মতো না?

না। খুব সিম্পল ছিল। ভোরবেলা খালি পায়ে হেঁটে ফুলহাতে আমরা শহীদ মিনারে যেতাম। সেখান থেকে আজিমপুর গোরস্তানে।

মেয়েরাও থাকতো মিছিলে?

হ্যাঁ। তবে তাদের 888sport free bet বেশ কম ছিল। তখন কজন মেয়েই-বা স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো?

গান গাইতেন আপনারা?

হ্যাঁ। ওই একই গান যা এখনো গাওয়া হয়। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো 888sport cricket BPL rateে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? গানের উচ্চারণ ছিল ভাবগম্ভীর। উপাসনার মতো শোনাতো। রক্তে শিহরণ আনতো সেই গান। জাদু-মাখানো ছিল কথাগুলোতে। সেই জাদু চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছে। সকল প্রজন্মের ছেলেমেয়ের কাছে গানটি প্রিয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী গানটি লিখে অমর হয়ে গিয়েছেন।

কথা বলতে বলতে তারা দুজন শহীদ মিনারের সামনে চলে এসেছেন। বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে উবু হয়ে বসে মিনারের সিঁড়িতে, মেঝেতে আলপনা অাঁকছে। আনোয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে  মুগ্ধ হয়ে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, প্রথম দিকে বেদিতে কিছু অাঁকা হতো না। বেশ সাদামাটা ছিল। শহীদ মিনারটাও এখনকার মতো এতো বড় আর সম্পূর্ণ ছিল না। আকারে ছোট ছিল।

নাজনীন বলল, আর কী করতেন আপনারা শহীদ দিবসে?

আর? হুঁ। আর ছোট ছোট ম্যাগাজিন বের করতাম। চাঁদা তোলা হতো ছাপানোর জন্য। নিজেদের লেখা গল্প 888sport app download apk থাকতো ম্যাগাজিনে। বাংলা সংবাদপত্রগুলো বিশেষ 888sport free bet বার করতো। সেখানে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা ছাপা হতো।

বইমেলা?

না। কোনো বইমেলা ছিল না। ওটা 888sport appsের পর থেকে হচ্ছে।

নাজনীন বলে, তখন আর এখনকার মধ্যে 888sport cricket BPL rateের উদ্যাপনে আর কী কী তফাৎ দেখতে পান?

এই যে ভোরবেলার পরিবর্তে মাঝরাতে শহীদ মিনারে এসে ফুল দেওয়া। দলবেঁধে নেতাদের আসা। এতো মানুষের ভিড়। এইসব ছিল না। এখন তো বলতে গেলে সারারাতই শহীদ মিনার লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। বেশ একটা উৎসবের আমেজ চারিদিকে। শোক আর আনন্দ প্রকাশ এখন এক হয়ে গিয়েছে।

কোনটা ভালো মনে হয় আপনার? আগের উদ্যাপন, না এখনকার?

দুটোই ভালো। দুটোর দুরকম সৌন্দর্য। আকর্ষণ। তুলনা করা চলে না।

নাজনীন বলে, আগের চেয়ে মেয়েরা বেশি আসে, তাই না?

হ্যাঁ। তা তো হবেই। আগের তুলনায় কতো বেশি মেয়ে পড়াশোনা করছে। তাদের বাইরে ঘোরার স্বাধীনতা বেড়ে গিয়েছে।

নাজনীন বলল, আমি কখনো 888sport cricket BPL rateের রাতে শহীদ মিনারে আসিনি। এবারে আমরা শহীদ মিনারে ফুল নিয়ে যাবো।

আমরা? আনোয়ার সাহেব নাজনীনের দিকে চোখ তুলে তাকান।

আমরা মানে আমি আর আমার বান্ধবীরা। কলেজে পড়ার সময় আসিনি। এবার আসবো জোটবেঁধে।

বাসায় ফিরে আনোয়ার সাহেব দেখলেন নাজনীনের মা চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছে। তাদের দেখে আশ্বস্ত হলো। বলল, হঠাৎ দুজনে কোথায় গেলে? তোমার না শরীর খারাপ? ঠান্ডা লেগেছে?

এই একটু বেরিয়ে এলাম। সারাদিন ঘরে বসে থাকি। হাসিমুখে বললেন আনোয়ার সাহেব।

কোথায় বেড়াতে গেলে?

শহীদ মিনারে।

শহীদ মিনারে? সেখানে আজ কী?

কিছুই না।

তবে?

দেখতে গেলাম। অনেক বছর যাওয়া হয় না। শুধু ঘরে বসে টেলিভিশনে দেখি।

নাজনীনের মা বলল, সারাজীবন অনেকবার গিয়েছো। এখন বয়স হয়েছে। শরীর প্রায়ই ভালো থাকে না। ঘরে বসে দেখাই ভালো। এই যে রিকশা দিয়ে গেলে, কোমরে ব্যথা পেলে না? রিকশা চড়া নিষেধ তোমার।

একদিনে কী আর হতে পারে। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন আনোয়ার সাহেব। তারপর বললেন, এক কাপ চা দাও। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। মনটা অবশ্য ফুরফুরে। হেসে বললেন, শরীরটাকে দেখিয়ে দিলাম। পারি। এখনো পারি।

888sport cricket BPL rateের রাতে খাওয়ার পরই নাজনীনের সঙ্গে তুমুল তর্ক শুরু হলো তার মায়ের। তার মা চেঁচিয়ে বলছে, যেতে পারবে না। ওই ভিড়ের মধ্যে গেলে বিপদে পড়বে। যে-কোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটে যেতে পারে।

বা রে। এতো মেয়ে যাচ্ছে তাদের কিছু হচ্ছে না। আমার বেলাতেই অঘটন ঘটতে যাবে কেন? নাজনীন উত্তেজিত হয়ে বলে।

এতো লোকের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি হবে। খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েও কেউ কেউ যেতে পারে।

এ তোমার কল্পনা। শহীদ মিনারে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ যায় না। সবাই সুশৃঙ্খল হয়ে থাকে। কোথাও জটলা হয় না। ধাক্কাধাক্কি করে না। টেলিভিশনেই তো দেখায় প্রতিবছর।

নাজনীনের মা নাছোড়বান্দা। সে জোর গলায় বলে, দুর্ঘটনা ঘটলে হঠাৎ করেই ঘটে। কাজ নেই তোমার ওখানে যাওয়ার। টেলিভিশনে দেখো।

আমি তো একা যাচ্ছি না। আমার বান্ধবীরাও যাচ্ছে সঙ্গে। আমরা দলবেঁধে থাকবো। গান গাইবো। নাজনীনের স্বরে জেদ।

নাজনীনের মা এবার প্রায় চেঁচিয়ে বলল, আমি বলছি তুমি যাবে না। আর কথা বাড়িও না।

আনোয়ার সাহেব ঘরে বসে দুজনের কথা শুনছিলেন। চেয়ার থেকে উঠে ঘরের ভেতর একটু পায়চারি করলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের দুজনের সামনে এসে বললেন, কী নিয়ে তর্ক হচ্ছে তোমাদের?

নাজনীনের মা বলল, তোমার নাতনি বলছে, রাতদুপুরে শহীদ মিনারে যাবে। ফুল দেবে। গান গাইবে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন আনোয়ার সাহেব। তারপর বললেন, ও কি একা যাবে? অন্য মেয়েরা যাবে না?

নাজনীন তার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা সব বান্ধবী মিলে যাবো। মা শুনছে না। বলছে, দুর্ঘটনা হতে পারে।

দুর্ঘটনা? তিনি বুঝতে না পেরে তাকালেন দুজনের দিকে।

নাজনীন বলল, দুর্ঘটনা মানে জটলা, বিশৃঙ্খলা, মেয়েদের ওপর হামলা। এসবের কথাই ভাবছে মা।

শুনে তিনি মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, না। তা হতে যাবে কেন? প্রতিবছরই শান্তিপূর্ণভাবে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে শহীদ মিনারে যাচ্ছে। ফুল দিচ্ছে। গান গাইছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

ঘটেনি। কিন্তু ঘটতে পারে। নাজনীনের মা মুখ গম্ভীর করে বলে।

তেমন ভাবছো কেন? সবসময় ইতিবাচক দিকটা চিন্তা করবে। ওকে যেতে দাও। ও খুব মন খারাপ করবে যেতে না পারলে। ছোট হয়ে যাবে অন্যদের কাছে যদি না যায়। তারা হাসবে। বলবে, ভীরু।

নাজনীনের মা অসহায়ের মতো চোখ তুলে বলল, আমার খুব ভয় করছে বাবা। যদি কিছু হয়।

কিছু হবে না। আমি বলছি। তুমি নিশ্চিন্তমনে যেতে দাও। সকালবেলায় ও ঠিকই বাড়ি ফিরে আসবে। ওর প্রথমবার শহীদ মিনারে যাওয়া বন্ধ কোরো না।

নাজনীনের মা চুপ করে থাকল। তাকে তখনো অস্থির দেখাচ্ছে।

 

ঘরটা অন্ধকার। তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। ১২টার সময় তিনি উঠে টেলিভিশনে শহীদ মিনারের দৃশ্য, অনুষ্ঠান দেখবেন। হয়তো নাজনীনকেও দেখা যাবে। ভেবে তাঁর মুখে এক টুকরো স্নিগ্ধ হাসি এলো। ঘরে কেউ ঢোকার শব্দ পেলেন। কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। চুপ করে শুয়ে থাকলেন।

তাঁর বিছানার পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে। ফুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একটু পর কপালে উষ্ণ একজোড়া ঠোঁটের স্পর্শ পেলেন। ফুলের গন্ধ গাঢ় হলো। একটু পর ঘর থেকে পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল। অন্ধকারটা একটু ফিকে হয়ে এসেছে। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল।