উদ্যান লণ্ঠন

888sport app download apk latest version : শাহীন কবির

আমি যত বেশি বলি তত লোকজন আমাকে কম বিশ্বাস করে। যত লোকের সাথে আমার দেখা হয় তারা প্রত্যেকেই আমাকে দেখে কেমন সতর্ক হয়ে যায়। আমি যখন কারো বাসায় বেড়াতে যাই, শুধুমাত্র আরেকটি কোনো মানুষের মুখ দেখার জন্য, আমাকে দেখে ওদের চোখেমুখে ফুটে ওঠে, ‘কী, কেন এসেছ’ এমন একটা ভাব। এসব কথা ভাবতেও আমার কাছে অসহনীয় মনে হয়।

শেষে এমন হলো যে, আমার আর কোথাও যেতেই ইচ্ছা করে না। এমনকি আমাদের পাড়ায় যে-øানাগারে সবাই স্নান করতে যায়, সেখানে যেতেও আমি সবসময় সন্ধ্যাটাকেই বেছে নিতাম। আমি চাইতাম না কেউ আমাকে দেখতে পাক। কিন্তু যখন গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি হলো, আর আমার হালকা সুতির কিমোনো সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠল, আমার মনে হলো, সবাই বুঝি আমাকে দেখে ফেলল। আমি এতই বিব্রত বোধ করলাম যে, মনে হলো যদি মরতে পারতাম। গতকাল আর আজ আবহাওয়া আগের চাইতে অনেক স্নিগ্ধ, ঠান্ডা হয়ে এসেছে। দেখতে দেখতেই পশমের কাপড় পরার আবহাওয়া শুরু হয়ে যাবে। আর আমিও যত তাড়াতাড়ি পারি আমার হালকা সুতির কিমোনো ছেড়ে গাঢ় রঙের পোশাকি কিমোনো পরতে চাই। আর যদি সবকিছু এভাবে চলতে থাকে, শরৎ পেরিয়ে শীত আর বসন্ত পার করে আবার গ্রীষ্ম ঘুরে আসে, আর আমাকে আবার আমার হালকা পোশাক ‘ইউকাতা’ পরে চলতে ফিরতে হয়, তা হবে আমার জন্য অসহনীয়। অন্ততঃপক্ষে আগামী গ্রীষ্মের মধ্যে আমি চাই কোনোরকম ভীত না হয়ে উজ্জ্বল ফুলের নক্শা আঁকা ইউকাতা পরে ঘুরে বেড়াতে। আমি চাই উৎসবমুখর দিনে হালকা প্রসাধন নিয়ে রাস্তায় লোকের ভিড়ে হেঁটে বেড়াতে। আর আমার তখনকার আনন্দের কথা ভাবতে গিয়ে আমার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপে ওঠে।

আমি একটা চুরি করেছিলাম। এটাই ছিল আসল কথা। আমি মনে করি না যে, আমি যা করেছিলাম তা ভালো করেছিলাম। কিন্তু – না, আমি তবে প্রথম থেকেই বলি। আমি এটা বলব আমার ঈশ্বরের উদ্দেশে। আমি মানুষজনকে বিশ্বাস করি না। যদি কোনো লোক থেকে থাকে, যারা আমাকে বিশ্বাস করবে, তাহলে ভালো, তারা বিশ্বাস করুক।

এক দরিদ্র কাঠের জুতো তৈরি করা মুচির কন্যা এবং একমাত্র সন্তান আমি। গতকাল সন্ধ্যায় যখন আমি রান্নাঘরে বসেছিলাম, পেঁয়াজ কাটছিলাম, তখন আমাদের বাড়ির পেছনের মাঠ থেকে একটা ছোট ছেলেকে করুণভাবে তার বড় বোনকে ডাকতে শুনতে পেলাম। ততক্ষণে ও কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। আমি হাতের ছুরিটা নামিয়ে রাখলাম, আর ভাবলাম, আমার যদি একটা ছোট ভাই বা বোন থাকত, যে আমাকে এরকমভাবে ভালোবাসতো আর এভাবে কেঁদে কেঁদে আমাকে ডাকত, আমার জীবন তাহলে হয়ত-বা এরকম নিঃসঙ্গ হতো না… আমার দুচোখ পেঁয়াজের ঝাঁজে জ্বালা করে অশ্রুতে ভরে উঠল, তারপর ভেসে গেল। যত আমি আমার হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে লাগলাম, ততই আমার চোখ আরো বেশি জ্বালা করে তা থেকে একের পর এক অশ্রুর ফোঁটা উপচে পড়তে থাকল। শেষকালে এমন হলো যে, আমাকে নিয়েই আমি একটা বিপদে পড়লাম।

সেই সময়টা, যখন একজন কেশপরিচর্যাকারী এমন গুজব ছড়াতে শুরু করল যে, স্বার্থপর সেই মেয়েটি শেষ পর্যন্ত এক লোকের প্রেমে পড়েছে, তা ছিল এ-বছরের চেরি ফুলে ফুলে চারদিক ছেয়ে যাবার ঠিক পরপরই, তখন সবেমাত্র গোলাপি বুনো ফুল আর আইরিস উৎসবমুখরিত রাতের দোকানগুলোতে আসতে শুরু করেছে। তবে সময়টা সত্যি আনন্দময় ছিল। সূর্য ডুবে গেলে মিযুনোসান এসে আমাকে ডাকত। তার আগেই আমি পোশাক পরে, সামান্য প্রসাধন নিয়ে তৈরি হয়ে থাকতাম। কতবার যে আমি আমাদের বাইরের দরজা দিয়ে ভেতর-বার করতাম। প্রতিবেশীরা আমার এই অবস্থা দেখে আমার দিকে বাঁকাভাবে আঙুল দেখিয়ে হাসত আর ফিসফিস করে বলত, ‘তাহলে কাঠের জুতো তৈরির মুচির মেয়ে শেষ পর্যন্ত পুরুষ-প্রেমে পাগল হলো!’ পরে আমি জেনেছি যে তারা এসব বলত। আমার বাবা-মাও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলেন যে চারপাশে কী বলাবলি হচ্ছে, কিন্তু তাদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব ছিল না। এটা খানিকটা আমাদের দারিদ্র্যের কারণেই যে আমার চব্বিশ বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও আমি তখনো বধূবেশে অন্য কোনো ঘরে উঠে যাইনি, কিংবা ঘর-জামাই হিসেবে অন্য কেউ আমাদের পরিবারে প্রবেশ করেনি। কিন্তু এছাড়াও ছিল আমার মায়ের অতীত। তিনি ছিলেন এই এলাকারই এক বড়োসড়ো ভূস্বামীর রক্ষিতা। যদিও ওই ব্যক্তিটি আমার মায়ের প্রতি সদয় ব্যবহারই করতেন, আমার মা সেসব ভুলে গিয়ে আমার বাবার সঙ্গে কথা ঠিক করে নিয়ে একদিন পালিয়ে এসে আমার বাবার বাসায় উঠলেন। এবং প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই আমার জন্ম হয়। আমি দেখতে – ওই ভূস্বামী বা আমার বাবা কারো মতোই হলাম না – আর এই সত্যটি পৃথিবীটাকে আমার মায়ের জন্য আরো যন্ত্রণাদায়ক করে তুলল। বেশ কিছুুদিন তাকে সমাজের বাইরে পতিতের মতো কাটাতে হয়। হয়ত-বা এরকম একটি পরিবারের মেয়ের জন্য দেরি করে বিয়ে হওয়াটাই ভাগ্যে লেখা থাকার কথা। অবশ্য, আমার যা চেহারা তাতে ধনী-সম্ভ্রান্ত কোনো পরিবারে জন্মালেও আমার ভাগ্য হয়ত-বা ঠিক এরকমটাই হতো। কিন্তু তবুও আমার বাবার বিরুদ্ধে আমার কোনো নালিশ নেই, আমার মায়ের বিরুদ্ধে বলারও আমার কিছু নেই। আমি আমার বাবার সন্তান। যে যা-ই বলুক না কেন, এটা আমি বিশ্বাস করি। আমার বাবা-মা দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসেন এবং আমিও তাদের ভালোবাসি, আর করুণা করি। আমার বাবা আর আমার মা দুজনই দুর্বল ব্যক্তি। এমনকি তাদের নিজের সন্তান, আমার প্রতিও তারা খানিকটা ভীরু-সন্ত্রস্ত। আমি মনে করি, দুর্বলচিত্ত দ্বিধান্বিত ব্যক্তিদের প্রতি প্রত্যেকেরই নম্র ও দয়াশীল হওয়া উচিত। আমি ভেবেছিলাম, আমার বাবা-মায়ের জন্য আমি যে-কোনো যন্ত্রণাদায়ক নিঃসঙ্গতা সইতে পারব। কিন্তু মিযুনোসানের সঙ্গে আমার পরিচয় হবার পর, সন্তান হিসেবে তাদের প্রতি আমার কর্তব্যে বেশ খানিকটা অবহেলা আমি করেছিলাম।

আমার এটা বলতেও লজ্জা করে। মিযুনোসান, যে কি-না ব্যাবসা-স্কুলের ছাত্র ছিল, আমার চাইতে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট ছিল। কিন্তু আমাকে তোমরা দয়া করে মাফ কোরো। আমার পক্ষে এছাড়া আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। আমার সঙ্গে মিযুনোসানের দেখা এই বসন্তে, আমার বাম চোখে যে-একটা অসুবিধা হচ্ছিল সেটা ডাক্তারকে দেখাবার জন্য আমি যে-হাসপাতালে গিয়েছিলাম সেখানকার অপেক্ষা করার কক্ষে। আমি সে-রকম এক মানুষ ছিলাম, যে কি-না একজন কাউকে দেখামাত্র পছন্দ করে ফেলতে পারত। ঠিক আমার মতো বাম চোখের ওপর সাদা পট্টি বাঁধা, বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে একটা ছোট পকেট-অভিধানের পৃষ্ঠা ওলটানোরত মিযুনোসানকে দেখামাত্র আমার মনে ধরে গেল। আমার নিজেরও চোখের ওপর পট্টির কারণে খুব বিষণ্ন ও মন-খারাপ লাগছিল। এমনকি জানালা দিয়ে যখন বাইরে ওক গাছগুলোর নতুন কচিপাতার দিকে তাকালাম, আমার মনে হলো পাতাগুলো যেন প্রচণ্ড গরমের তাপে সবুজ আগুনের শিখায় চিকচিক করে উঠছে! বাইরের পৃথিবীর সবকিছুই মনে হলো         যেন কোনো এক সুদূর রূপকথার রাজ্য। আর     অবশ্যই আমার চোখের ওপরকার পট্টির জাদুমন্ত্রের জন্যই আমার মিযুনোসানের মুখটাকে মনে হলো সুন্দর,মোহনীয় আর স্বপ্নরাজ্যের।

মিযুনোসান ছিলেন এতিম। আপনজনের মতো ভালোবাসা দেবার মতো তার কেউ ছিল না। ওর পূর্বপুরুষেরা বেশ সচ্ছল ওষুধ-বিক্রেতা ছিলেন। কিন্তু মিযুনোসানকে শিশু অবস্থায় রেখে তার মা মারা যান, আর ওর যখন বারো বছর বয়স তখন মারা যান তার বাবা। এরপর সংসারটা ভেঙে যায়। ওর বড় দুভাই আর বড় বোনকে নিয়ে যান ছড়ানো-ছিটানো দূরের আত্মীয়স্বজনরা। মিযুনোসান, সর্বকনিষ্ঠ সন্তানটি, তাদের দোকানের এক কেরানির কাছে বড় হতে থাকেন। ফলে এখনো, যদিও তিনি ব্যাবসা-স্কুলে যাচ্ছেন – তাকে দেখে খুব নিঃসঙ্গ একাকী মনে হয়। জীবনের সঙ্গে নিজেকে যেন ঠিক খাপ খাওয়াতে পারছেন না। উনি নিজেই আমাকে বলেছেন, এবং ওকে আমার যথার্থই আন্তরিক মনে হয়েছে যে, আমার সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যাবার সময়গুলোই তার জন্য একমাত্র আনন্দের সময় ছিল। তার জীবনে যেন সবরকমের জিনিসের অভাব ছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, এই গ্রীষ্মে তিনি তার এক বন্ধুর সঙ্গে সমুদ্রতীরে সাঁতার কাটতে যাবেন বলে কথা দিয়েছেন। কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো না যে তিনি এ-ব্যাপারে কোনো উৎসাহবোধ করছেন। বরং তাকে এজন্য বেশ মনমরাই দেখাচ্ছিল। ওইদিন সন্ধ্যায় আমি একটা চুরি করলাম। আমি পুরুষদের সাঁতার-কাটার একজোড়া পোশাক চুরি করলাম।

আমি আমাদের এলাকায় সবচাইতে বড় যে বিভিন্ন ধরনের তৈরি-পোশাকের দোকান আছে সেখানে চুপি চুপি ঢুকে পড়লাম। আমি যেন মহিলাদের গ্রীষ্মে পড়ার মতো হালকা পোশাক দেখছি – এরকম ভান করে এগুতে এগুতে পেছন দিকে গিয়ে ছেলেদের একজোড়া কালো সাঁতারের পোশাক পেয়ে গেলাম। ওটাকে সুন্দর করে ছোট ভাঁজ করে আমার বগলের নিচে লুকিয়ে ফেলে আমি আস্তে করে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি বিশ ফুট দূরত্বের বেশি যাইনি, এমন সময় পেছন থেকে একটি কণ্ঠস্বর চিৎকার করে উঠল, ‘এই! – তুমি!’ ভয়ে আমি চিৎকার করে উঠতে চাইলাম, তারপরই পাগলের মতো দৌড়ুতে লাগলাম। আমার পেছনে সেই গম্ভীর ভারি কণ্ঠস্বরের চিৎকার, ‘চোর’! তারপরই আমার ঘাড়ের ওপর এত জোরে এক থাবা এসে পড়ল যে আমি জোরে হোঁচট খেলাম। আর ঘুরে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার গালে সজোরে এক চপেটাঘাত পড়ল।

আমাকে পুলিশ-স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হলো। ওটার সামনে অসংখ্য কালো-মাথা জড়ো হয়েছে ব্যাপারটা দেখার জন্য। এদের সবাই আমাদের এলাকারই প্রতিবেশী, যাদের আমি শুধু মুখ চিনতাম। আমার সমস্ত চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, আমার পোশাক টানের চোটে উপরে উঠে গিয়ে হাঁটু দেখা যাচ্ছিল। ভালোই দেখাচ্ছে তোমাকে, আমি মনে মনে ভাবলাম।

স্টেশনের পেছনে মাটিতে মাদুর-বিছানো একটি ছোটঘরে আমাকে বসিয়ে একজন পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন। লোকটির বয়স সাতাশ-আটাশ, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, শুকনো ফ্যাকাশে মুখে প্রসন্নতার ছিটেফোঁটাও নেই। খুব যত্নসহকারে আমার নাম, ঠিকানা, বয়স – সব একটা নোটখাতায় টুকে নিয়ে, হঠাৎ তিনি দাঁত বের করে হেসে উঠলেন, আর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই নিয়ে তোমার কতবার হলো?’

ভয় পেয়ে আমি চমকে উঠলাম। আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। দ্বিধার সঙ্গে চিন্তা করতে করতে আমার মনে হলো, আমার বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর অভিযোগ আনা হবে, আর ওরা আমাকে জেলখানায় পুরবে। আমাকে যে-কোনো ভাবে হোক কথা বলে এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মরিয়া হয়ে আমি বুঝিয়ে বলার জন্য সঠিক শব্দ খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু আমি কী-ই বলতে পারতাম? আমি যেন এক বিশাল কুয়াশার ভেতর পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার জীবনে আমি আর কখনো এরকম ভয় পাইনি। শেষ পর্যন্ত আমার কণ্ঠ দিয়ে যে-কথাগুলো বেরিয়ে এল সেগুলো ছিল যেমন খাপছাড়া তেমনি অগোছালো, কিন্তু একবার বলতে শুরু করার পর আমি আর থামতে পারছিলাম না। আমি অনর্গল বকে যেতে লাগলাম, যেন ভূতে পেয়েছে। আমার কেমন যেন মনে হলো আমি পাগল হয়ে গেছি।

‘তোমরা আমাকে জেলে পুরতেই পারো না। আমি খারাপ মানুষ নই। আমার চব্বিশ বছর বয়স। চব্বিশ বছর ধরে আমি আমার মা-বাবার ভালো সন্তান ছিলাম। আমি কন্যা হিসেবে তাদের জন্য সবকিছু করেছি। আমি কীভাবে খারাপ হলাম? আমাকে নিয়ে আমার পেছনে কেউ কখনো কিছু বলেনি। মিযুনোসান একজন চমৎকার মানুষ। তিনি অবশ্যই খুব শীঘ্র নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। আমি জানি, তিনি তা করবেন। আমি চাইনি যে তিনি অপ্রস্তুত বা লজ্জিত হোন। তিনি সমুদ্রতীরে যাবেন বলে তার এক বন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম সমুদ্রসৈকতে যাবার জন্য তার যা প্রয়োজন হতে পারে আমি তাকে তা-ই দেবো। এর মধ্যে এত খারাপ কী ছিল? আমি একটা বোকা। সত্যিই আমি একটা বোকা, কিন্তু আমি ঠিকই আপনাদেরকে দেখাব – আমি মিযুনোসানকে সুন্দরভাবে বিদায় জানাব। তিনি খুব ভালো পরিবার থেকে এসেছেন। তিনি অন্য সবার থেকে আলাদা। আমার কী হলো তাতে কিছু এসে যায় না। শুধু যদি এই মানুষটি ভালোভাবে তার জীবন শুরু করতে পারেন, আমি আর কিচ্ছু চাই না। আমার জন্য আমার নিজের কাজ রয়েছে। আপনারা আমাকে কিছুতেই জেলে ভরতে পারেন না। আমি কখনো কোনো অন্যায় করিনি। আমি কি সবসময় আমার গরিব বাবা-মার ভালো যত্ন নিইনি? এটা অন্যায়। এটা অন্যায়। আপনারা আমাকে জেলে দিতেই পারেন না। আপনাদের কোনো অধিকার নেই আমাকে জেলে দেবার। সারাজীবন আমি সাধ্যমতো পরিশ্রম করেছি, চব্বিশটি বছর ধরে, আর এখন, মাত্র এক মুহূর্তের জন্য আমি আমার হাতকে একটা ভুলপথে চালিয়েছি বলে, শুধুমাত্র এটুকুর জন্য আপনারা আমার চব্বিশটি বছর ধ্বংস করে দিতে চাইছেন, না, আমার সমস্ত জীবনটাই। আপনারা তা কখনোই পারেন না। এটা অন্যায়। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আমার সমস্ত জীবনে কেবলমাত্র একবার আমার ডানহাত আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে এক ফুট এদিক থেকে ওদিক নড়ল, তার মানে এ-ই হতে পারে না যে, আমি ‘ক্লেপটোম্যানিয়াক’। এ হতেই পারে না। হতেই পারে না। এটাতো শুধু একবারই হয়েছে, মাত্র দুই-তিন মিনিটের জন্য, শুধ্ইু একবার, তাই নয় কি? আমার এখনো বয়স তরুণ। আমার জীবন সামনে পড়ে আছে। আমি এভাবেই চলতে থাকব, এতদিন পর্যন্ত যেভাবে দারিদ্র্যের কঠিন জীবন কাটিয়ে এসেছি, সেভাবেই। এছাড়া আর কিছুতোঘটেনি। আমি তো বদলাইনি। গতকাল আমি যে-জন ছিলাম আজো আমি তা-ই। একটা সাঁতারের পোশাকের জন্য অতবড় একটা নামী দোকানের কী-বা এসে যায়? এমন লোক কি নেই যারা অন্যদের ঠকায়, অন্যের অর্থ আত্মসাৎ করে, আর তারপর সেই সব অর্থের সবটা খরচই শুধু করে না, উপরন্তু তার জন্য প্রশংসিতও হয়। শুধুমাত্র বিত্তহীন মানুষরাই জেলে যায়। আমার চোরদের জন্য মমতা হয়। ওরা নিশ্চয়ই খুব দুর্বল ভালো মানুষ, যারা জানে না অন্যকে কীভাবে ঠকাতে হয়। যেহেতু তারা এত চতুর নয় যে জানবে কী করে মানুষকে ঠকিয়ে জীবিকা অর্জন করতে হয়, তারা আস্তে আস্তে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আর তখন তারা বোকার মতো একটা কিছু করে, যেমন-সামান্য কিছু টাকা চুরি করে, এবং তাদের পাঁচ বা দশ বছরের জন্য জেলে যেতে হয়। হা-হা-হা! এটা সত্যিই খুব অদ্ভুত, খুব হাস্যকর!’

আমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই তাতে। ফ্যাকাশে হয়ে গিয়ে পুলিশটি আমার দিকে চেয়ে থাকল। হঠাৎ করে ওই পুলিশটিকে আমার বেশ ভালো লাগল। যদিও আমি তখন কাঁদছিলাম, তবুও তার মধ্য দিয়েই ওর দিকে চেয়ে আমি একটু হাসলাম। এরপর থেকে ওরা আমাকে মানসিক রোগী হিসেবে গণ্য করতে শুরু করল। খুব সন্তর্পণে, যেন একটা ফোড়া ছুঁচ্ছে এমনিভাবে, পুলিশটি আমাকে হেডকোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। সেই রাত্রে ওরা আমাকে একটি সেলে আটকে রাখল। পরদিন সকালে আমার বাবা আমাকে নিতে এলে তার সঙ্গে আমাকে বাড়ি যেতে দেওয়া হলো। পথে আমার বাবা শান্তভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে মারধোর করা হয়েছে কি-না। শুধু এটুকুই, এর বেশি তিনি আর কিছু বললেন না।

সেদিনের সন্ধ্যার পত্রিকার দিকে যখন আমি তাকালাম আমার দুকান লাল হয়ে উঠল। পত্রিকাটিতে আমাকে নিয়ে একটি গল্প বেরিয়েছে। ‘একজন চোরেরও দোকান থেকে জিনিস তুলে নেবার পেছনে কারণ থাকে’ – শিরোনামটি ছিল এরকম। আরো লেখা ছিল, ‘অদ্ভুত খ্যাপাটে এক তরুণী-কমিউনিস্টের কাছ থেকে সুন্দর সুন্দর কথার ফুলঝুরি।’ লজ্জা আর অপমানের এখানেই শেষ ছিল না। ওই পাড়ার লোকজন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকল। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি এর কারণ কী ছিল, কিন্তু যখন আমি বুঝলাম যে, ওরা আমাকে দেখার জন্যই এসেছে, আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। আস্তে আস্তে আমার বোধগম্য হলো যে, আমার ওই ছোট্ট একটি কর্মই কী বিরাট ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঘরে যদি কোনো বিষ থাকত তখন, আমি তাহলে তা-ই পান করতাম। বাড়ির কাছে যদি বাঁশঝাড় থাকত আমি তাহলে সেখানে ধীরে হেঁটে গিয়ে গলায় ফাঁস দিতাম। দু-তিন দিন আমরা আমাদের বাড়ির সামনের দিকের দোকান বন্ধ রাখলাম।

এর বেশিদিন পরে নয়, আমি এমনকি মিযুনোসানের কাছ থেকে একটা চিঠিও পেলাম। ‘এ-পৃথিবীতে এমন আরেকজন নেই, যে তোমাকে আমার চাইতে বেশি বিশ্বাস করে। কিন্তু তোমার বেড়ে-ওঠার মধ্যে ত্রুটি ছিল। যদিও তুমি একজন সৎ ও অল্পবয়সী তরুণী, তোমার চারপাশের পরিবেশে কিছু খারাপ জিনিস রয়েছে। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তোমার ত্রুটিগুলো সংশোধন করতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই পরিবর্তন করতে পারিনি। আসলে প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা খুব প্রয়োজনীয়। কদিন আগে আমি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে সমুদ্রে øান করতে গিয়েছিলাম। সৈকতে বসে মানুষের জীবনে আদর্শ-উচ্চাভিলাস এসবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলো। আমাদের মনে হয়েছে আমরা এই পৃথিবীতে কিছু করে যেতে পারব, এবং তা শীঘ্রই। তুমি, সাকিকো, তোমাকেও এখন থেকে তোমার আচরণে অনেক নম্র-বিনীত হতে হবে। তুমি যে-অপরাধ করেছ তার হাজার ভাগের এক ভাগের জন্যও যদি তুমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাও, তোমাকে অবশ্যই সমাজের কাছে গভীরভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। সমাজ অপরাধকে ঘৃণা করে, অপরাধীকে নয়।

মিযুনো সাবুরো।

পুনশ্চ: পড়া হয়ে যাবার পর অবশ্যই এই চিঠি ভুল না করে ধ্বংস করে ফেলো। এমনকি খামটাও পুড়িয়ে ফেলো। ভুল হয় না যেন।

এ-ই ছিল তার পুরো চিঠি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আসলে মিযুনোসান ছিলেন এক ধনী ব্যক্তির পুত্র।

একটি একটি করে দিনগুলো, যা কি-না কাঁটার মতো বিঁধত, পার হয়ে গেল, এবং এর মধ্যেই ঠান্ডা আবহাওয়া এসে গেছে। আজ রাতে, আমার বাবা, কম আলোর বাতিতে মন বিষণ্ন হয়ে যায় বলে আমাদের ছয়-মাদুরের ঘরটার বাতি পালটে আরো উজ্জ্বল আলোর একটি বাতি লাগিয়ে দিলেন। আর তারপর আমরা তিনজন মিলে, বাবা-মা আর মেয়েতে, ওই উজ্জ্বল আলোর বাতির নিচে রাতের খাবার খেলাম। আমার মা তার চপস্টিক ধরা হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে বলতে লাগলেন, ‘উহ্’। চোখ ধাঁধানো আলো, চোখ ধাঁধানো!’ তিনি বেশ ফুর্তির মেজাজে ছিলেন। আমি আমার বাবাকে সাকে ঢেলে দিলাম। আমি মনে মনে নিজেকে বললাম, আমাদের মতো গরিব মানুষের স্বল্পআলোর বাতি বদলাবার মধ্যেই কী সুখ নিহিত, কিন্তু তাতে করে কোনো নিঃস্ব মনে হলো না আর আমার নিজেকে। বরঞ্চ আমাদের এই বাড়িটাকে এর অল্প আলোর ঝলমলানিসহ দেখতে যেন খুব সুন্দর একটা উদ্যান-লণ্ঠনের মতো মনে হলো আমার। যদি আপনি চান, তাকিয়ে দেখুন! আমার মনে হলো আমরা তিনজন কী অপরূপ! এক øিগ্ধ সুখানুভূতিতে আমার হৃদয় ভরে উঠল, আর আমার সে-সুখের কথা এমনকি বাগানের গুনগুন করতে থাকা পোকামাকড়গুলোকেও ডেকে বলতে ইচ্ছে হলো আমার।

দাযাই ওসামু: বিংশ শতাব্দীর আধুনিক জাপানি কথা888sport live footballিকদের অন্যতম দাযাই ওসামুর জন্ম ১৯০৯ সালে, জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আওমোরিতে। তাঁর গভীর আবেদনময় ছোটগল্প গবসড়ৎরবং ‘স¥ৃতিমালা’ রচিত হয় লেখকের চব্বিশ বছর বয়সের সময়। দাযাই ওসামুর নিজের কথায়, ‘আমি আমার নিজের আত্নহত্যার চিরকুট লিখেছি। তা হলো আমার ‘স¥ৃতিমালা’। আমার মনে হয়েছিল যে আমার শিশুকালে যে-মন্দ অভিজ্ঞতা আমি সয়েছিলাম তার অলঙ্কারহীন সাদামাটা এক বর্ণনা আমি দিতে চাই।… আমি এটা লিখি আমার একঘরের বিচ্ছিন্ন বাসস্থানে বসে, বাইরে তাকিয়ে আগাছায় আকীর্ণ একটি পরিত্যক্ত বাগান দেখতে দেখতে। আমি হাসার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল যে, আমি বোধ হয় দ্বিতীয়বার মৃত্যুবরণ করলাম।’ ১৯৪৮ সালে মাত্র উনচল্লিশ বছর বয়সে সত্যিই তিনি একদিন তাঁর প্রেয়সীকে সঙ্গে নিয়ে তামাগাওয়া জলসংরক্ষণাগারে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। দাযাইয়ের কথা888sport live football তরুণদের বিশেষ প্রিয়। প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে টোকিওর স্কুলছাত্রীরা দাযাই ওসামুর সমাধি ফুলে ফুলে ছেয়ে দেয়।