উনিশ শতকীয় নবজাগৃতি ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর

শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীর বঙ্গসমাজ গ্রন্থে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘১৮২৫ হইতে ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিংশতি বর্ষকে বঙ্গের নবযুগের জন্মকাল বলিয়া গণ্য করা যেতে পারে। এই কালের মধ্যে কি রাজনীতি, কি সমাজনীতি, কি শিক্ষাবিভাগ, সকল দিকেই নবযুগের প্রবর্তন হইয়াছিল।’ উনিশ শতকীয় নবযুগ বা নবজাগৃতির উতল হাওয়ার পরশে নতুনভাবে জেগে ওঠে মহানগর কলকাতা, জেগে ওঠে বঙ্গদেশের মফস্বল শহরগুলিও। শাস্ত্রী মহাশয় যাকে নবযুগ বলে অভিহিত করেছেন, পরে তারই নাম হয় বেঙ্গল রেনেসাঁস। উনিশ শতকে বঙ্গদেশে যা ঘটেছিল তাকে রেনেসাঁস বা নবজাগৃতি বলা যায় কি না তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতদ্বৈধতা থাকলেও এর তরঙ্গ-ক্ষুব্ধ স্রোতধারা বাঙালি তরুণচিত্তে যে-বিপুল স্বপ্ন ও সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে সেটা বোধহয় কেউ অস্বীকার করতে পারেননি। ইতিহাসের এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে বাংলার কৃতী পুত্র-পুত্রীরা নতুন নতুন 888sport live chatোদ্যোগের তৎপরতায়, মুক্তবুদ্ধি সুস্থযুক্তি ও স্বাধীনচিন্তার প্রদীপ্তিতে চারদিক আলোকিত করে তোলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে প্রমোট করার জন্য কলকাতার অভিজাতপল্লিতে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে এজেন্সি হাউজ। 888sport live chat-888sport live football-শিক্ষা-ব্যবসা থেকে রাজনীতি-888sport apkচর্চা – প্রতিটি ক্ষেত্রেই একাধিক নক্ষত্রের উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে আবির্ভাব ঘটে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী বা ‘ইন্টেলিজেনসিয়া’ শ্রেণির। 888sport live chat-উদ্যোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে-কর্মযোগী মানুষটির প্রবল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, তিনি হলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)। তিনিই প্রথম হুগলির তীরে ইংল্যান্ডের  মতো 888sport live chatায়নের স্বপ্ন দেখেন। তাঁর মাধ্যমেই বাঙালি আত্মবিশ্বাসী, 888sport live chatোদ্যোগী ও বাণিজ্যমুখী হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের প্রারম্ভে মতিলাল শীল, বিশ্বম্ভর সেন, রামদুলাল দে, রাধাকৃষ্ণ বসাক, রামকৃষ্ণ মল্লিক প্রমুখের মধ্যে 888sport live chatোদ্যোগের যে-প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় তা স্বীকার করে নিয়েও বলা যায়, দ্বারকানাথ ঠাকুরই ছিলেন বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষে স্বাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য ও 888sport live chatোদ্যোগের অগ্রগণ্য পুরুষ। তাঁর মধ্যে প্রথম পরিস্ফুট হয় নতুন যুগের সাহস ও উদ্যম। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের পত্রিকা ফিশার’স কলোনিয়াল ম্যাগাজিন (১৯৪২) থেকে দ্বারকানাথের যে-কর্মবহুল জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় তা সত্যিই বিস্ময়কর। ‘স্বাধীন 888sport live chatোদ্যমের আদর্শ দ্বারকানাথ দেশবাসীর কাছে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। এদেশে তিনি চিনি উৎপাদনের নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। জমিদার, প্লান্টার এবং উদ্যোগী ব্যবসায়ী হিসেবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ প্রতিপত্তি ছিল, – তিনি ইউনিয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, পরে তার মালিক হন।’ তাঁর সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গদেশে আবির্ভূত হয় এক ঝাঁক সফল পেশাজীবী, চিকিৎসক, উদ্যোগপতি, সমাজকর্মী, সৃজনশীল লেখক, মহৎ 888sport apkী, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাবিদ। তাঁর আবির্ভাবকালে 888sport appsের বুক জুড়ে সহস্র বছরের গাঢ় অন্ধকার। তখনো এদেশের মানুষ দু-বেলা পেট ভরে খেতে পায় না, মাথা গোঁজার আশ্রয় নেই, রোগে পথ্য নেই, রাস্তাঘাট-হাসপাতাল কিছুই নেই। গ্রাম-গঞ্জ-লোকালয় আছে, কিন্তু দেশ নেই; স্বাধীন জাতিসত্তা নেই। তারপরও কেউ কেউ দেশজাতির কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে চেয়েছেন। কিছু কিছু মানুষ চিন্তা করেছেন ধর্মসংস্কারের, শিক্ষাবিস্তারের, 888sport promo codeমুক্তির, নিজস্ব সংস্কৃতির উজ্জীবনের, দারিদ্র্য দূরীকরণের, রাজা-রায়তের সম্পর্কের উন্নতির। এ যেন অন্ধকার দ্বীপে প্রদীপ প্রজ্বালন! উনিশ শতকের 888sport apps ছিল বড়ই অদ্ভুত, বড়ই বিচিত্র। শোষণ-পীড়ন যেমন ছিল, তেমনি ছিল নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এই দ্বন্দ্বমুখর পরিস্থিতিতে আত্মপ্রত্যয়ী স্বপ্নবাজ দ্বারকানাথ ঠাকুর সফল ব্যবসায়ী ও উদ্যোগপতি হিসেবে আবির্ভূত হন।

 নানা কারণে বাঙালি সমাজ তথা ভারতবর্ষের মানুষ প্রিন্স দ্বারকানাথের কাছে ঋণী। ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রবর্তন, সংবাদপত্রের উন্নতি সাধন, শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রেলপথের রূপকল্প প্রণয়ন – এই সবকিছুর সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। জমিদার হিসেবেও ছিলেন দক্ষ ও প্রবল প্রতাপশালী। সাহাজাদপুর ও বিরাহিমপুর পরগনায় নিয়োগ করেন ইউরোপীয় ম্যানেজার। রায়ত-প্রজা, নায়েব-গোমস্তাদের কাছে দোর্দণ্ড দাপুটে জমিদার হলেও দান-দক্ষিণায়, ভদ্রতা-শিষ্টাচারে ছিলেন অতুলনীয়। ছিলেন উদার মনোভাবাপন্ন যুক্তিবাদী মানুষ। 888sport live chatরসিক ও বঙ্গীয় থিয়েটারের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে রঙ্গালয় স্থাপনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। নানা ধরনের ব্যবসায়-বাণিজ্যের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। আফিম, কয়লা, নীল, রেশম থেকে লবণ, চিনি, জাহাজের ব্যবসায় ছিল তাঁর একক আধিপত্য। ‘কার অ্যান্ড ট্যাগোর’ কোম্পানির ছিলেন অর্ধেক অংশীদার। অথচ এমন একজন বড়মাপের মানুষকে বাঙালি সমাজ ও সে সমাজের বুদ্ধিজীবীরা কেবল রবীন্দ্রনাথের পিতামহ হিসেবেই চেনেন। তিনি কী শুধুই রবীন্দ্রনাথের পিতামহ? কেবলই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পিতা? পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ও পৌত্র রবীন্দ্রনাথও কি তাঁর প্রতি সুবিচার করেছেন? সত্যি বলতে কী, পুত্র-পৌত্ররাও তাঁর প্রতি সুবিচার করেননি। দ্বারকানাথের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে বাইরের লোকের চেয়ে পুত্র দেবেন্দ্রনাথের ভূমিকাই ছিল বেশি। তিনি তাঁর পিতাকে বেহিসেবি, অপব্যয়ী, উড়নচণ্ডীর বেশি অন্যকিছু ভাবতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি ও 888sport apk download apk latest versionসঞ্জাত মূল্যায়নে রাজা রামমোহন ছিলেন ‘ভারতপথিক’ কিংবা নবজাগরণের ঋত্বিক। রামমোহনকে আধুনিক ভারতবর্ষের জনক বলা হলেও দ্বারকানাথের নাম সেইভাবে উচ্চারিত হয় না। রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১৫ বছর আগে দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রয়াত হন, সম্ভবত এ-কারণে পিতামহ দ্বারকানাথ সম্পর্কে আগ্রহ দেখাননি কিংবা উল্লেখ করার মতো তেমন কিছুই লেখেননি তিনি। তাঁর গান, 888sport app download apk তথা সুবিশাল রচনাবলির কোথাও পিতামহ দ্বারকানাথকে সেইভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ আধুনিক বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষ নির্মাণে দ্বারকানাথের অবদান পুত্র দেবেন্দ্রনাথ তো বটেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রামমোহনের তুলনায়ও বেশি।

দ্বারকানাথের জন্ম ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে, যখন বাংলার সমাজ, রাজনীতি ও ভূমি ব্যবস্থায় লেগেছিল ভাঙনের পালাবদল। তাঁর বাবা রামলোচন ঠাকুরের ছিল বিশাল জমিদারি। নদীয়া, রাজশাহী, পাবনা, মেদিনীপুর, রংপুর প্রভৃতি জেলায় দ্বারকানাথ ঠাকুর উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জন করেন বিশাল জমিদারি। তিনি অবশ্য রামলোচনের ঔরসজাত সন্তান নন, ছিলেন পালকপুত্র। রামলোচনের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। স্ত্রী অলকাসুন্দরীর সম্মতি নিয়ে মেজ ভাই রামমনি ঠাকুরের এক ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন তিনি। রামলোচনের আকস্মিক মৃত্যুর পর পালিকা-মাতা অলকাসুন্দরীর স্নেহচ্ছায়ায় দ্বারকানাথ বড় হন। পড়াশোনা করেন ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে স্থাপিত শেরবোর্ন সাহেবের স্কুলে। রবার্ট গুটলার ফারগুসন নামক এক ইংরেজ আইনজীবীর নিকট শিক্ষানবিশ হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কিত আইনের পাঠ গ্রহণ করেন। এরপর কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট, সদর ও জেলা আদালতের যাবতীয় আইন ও কার্যপ্রণালি নিয়ে অধ্যয়ন করেন। আঠারো বছর বয়স থেকেই তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। পালক-পিতার কাছ থেকে তিনি প্রচুর সম্পত্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ সেই সম্পত্তি থেকে যে আয় হতো, তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী, স্বাপ্নিক ও ব্যতিক্রমী স্বভাবের। তাই যৌবন পেরুতে না পেরুতেই বিপুল ধন সঞ্চয় করে সমকালীন আর সব ধনীদের ছাড়িয়ে যান। দেওয়ানগিরি ও জমিদারদের মামলা-মোকদ্দমায় ল’ এজেন্ট হিসেবে কাজ করে বাড়াতে থাকেন পরগনার পর পরগনায় নিজস্ব জমিদারি। বিত্ত-বৈভবে ছাড়িয়ে যান ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ দর্পনারায়ণ ঠাকুর, লক্ষ্মীকান্ত ওরফে নকুড় ধর, ‘ব্যাংক অব বেঙ্গল’-এর মালিক রাজা সুখময় রায়, হ্যারিস সাহেবের দেওয়ান রামহরি বিশ্বাস, কলকাতার জমিদার কাছারির দেওয়ান গোবিন্দ মিত্র, লবণ ব্যবসায়ী কৃষ্ণচন্দ্র পালচৌধুরী, ‘পামার কোম্পানি’র খাজাঞ্চি গঙ্গানারায়ণ সরকারের মতো বিশিষ্ট ধনীদের। জমির মালিকানার প্রতি বঙ্গীয় জমিদারদের অত্যধিক আকর্ষণ ছিল, কিন্তু দ্বারকানাথ বুঝেছিলেন, যক্ষের ধনের মতো জমি আগলে কোনো লাভ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া নিজের এবং স্ব-সমাজের মুক্তি সম্ভব নয়, ইংরেজ সাহেবদের সমকক্ষ  হতে হলেও বাণিজ্যের বিকল্প নেই। তাই বহু রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য ও 888sport live chatোদ্যোগের সঙ্গে দ্বারকানাথ সম্পৃক্ত হন। সাহেবদের কাছ থেকে কমার্শিয়াল ব্যাংক কিনে নেন। কিনে নেন ইউনিয়ন ব্যাংকও। চালু করেন লবণ কোম্পানি।  বিদেশ থেকে মালপত্র আমদানি  করে নিজ দেশের বাজারে বিক্রি করতে লাগলেন। হাতে আসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সেই টাকা দিয়ে গড়ে তোলেন ‘কার, টেগোর এন্ড কোম্পানি’। এই কোম্পানির ছত্রচ্ছায়ায় নিজ উদ্যোগে চালাতে থাকেন নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ও 888sport live chat-কারখানা। এমনকি ইংরেজদের সঙ্গে পার্টনারশিপেও কয়েকটি কোম্পানি স্থাপন করেন। তাঁর নিজের জমিদারি এবং মধ্যবাংলায় তৈরি হতে থাকে নীল, চিনি ও রেশম। কুষ্টিয়া এলাকায় বিরাহিমপুর পরগনাসহ মধ্যবাংলার বিভিন্ন পরগনায় নীলচাষ ও কারবার চালু করেন পূর্ণ উদ্যমে। কলকাতায় নিয়ে এসে ওইসব পণ্য তিনি বিক্রি করতেন। নীল, রেশম, চিনি কলকাতায় আনার জন্য জাহাজ প্রয়োজন। তাই নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তোলেন জাহাজ কোম্পানি। আগে নদীতে চলাচল ও মালপত্র আনা-নেওয়ার জন্য কেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কয়েকটি জাহাজ ছিল। দ্বারকানাথই প্রথম ভারতীয় যিনি জাহাজের কোম্পানি খুলেছিলেন। লর্ড বেন্টিঙ্কের অনুমোদন নিয়ে আসামের বাগানে চা চাষ শুরু করেন এবং গড়ে তোলেন বিশাল টি কোম্পানি। আসামের চা কলকাতায় এনে ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকেন।

শেরবোর্ন সাহেবের স্কুলে পড়াকালে দ্বারকানাথ ভালো করে ইংরেজি শিখে নিয়েছিলেন। ইংরেজি ভাষাটা এতটাই রপ্ত করেছিলেন যে, লন্ডনের নামকরা ব্যক্তিরা তাঁর ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর ইংরেজি শুনে মহারানী ভিক্টোরিয়া এতটাই  চমৎকৃত হন যে, নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখেন, ‘ব্রাহ্মণ ভালো ইংরেজি জানে।’ তিনি মিউজিক জানতেন, পিয়ানো বাজানোও শিখেছিলেন। বেলগাছিয়ায় ‘বেলগাছিয়া ভিলা’ নামে যে মনোরম বিলাসপুরী নির্মাণ করেন, সেখানে শে^তাঙ্গ রাজপুরুষদের আমন্ত্রণ জানাতেন। এ-বাড়িতে বিশিষ্ট রাজপুরুষ, কাউন্সিলের সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, সামরিক কর্মকর্তারা যেমন আসতেন, তেমনি আমন্ত্রিত হতেন দেশীয় জমিদার, বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ও ব্যবসায়ীরা। যেসব ইংরেজ রাজপুরুষ এ-বাড়িতে আসতেন, তাঁরা দেশীয় জমিদার ও এলিটদের  আনাড়ি, অশিক্ষিত, অসমঝদার কৃষ্ণাঙ্গ বলে গণ্য করতেন। এক্ষেত্রে দ্বারকানাথ ছিলেন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যাঁকে কলকাতার ইংরেজ সমাজ উপেক্ষা করতে পারেনি। ইউরোপেও তাঁর বিশাল গ্রহণযোগ্যতা ছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন, চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে তাঁর হার্দিক সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন সর্বতোভাবে উন্নতরুচির মানুষ, বিলাসিতার ক্ষেত্রেও কার্পণ্য করতেন না। তাঁর বেলগাছিয়ার বাড়ি সাজানো হয়েছিল ৯২৯টি 888sport live chatকর্ম – ছবি, ভাস্কর্র্য ইত্যাদি দিয়ে। এই উন্নত রুচিজ্ঞান তিনি অর্জন করেন বন্ধু রাজা রামমোহন, জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার ও ইউরোপের রসিকজনদের কাছ থেকে।

দ্বারকানাথ পাশ্চাত্য সভ্যতা, 888sport live chatকলা, জীবনাদর্শের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, পিছিয়ে পড়া ভারতের জন্য ইংরেজ শাসন আশীর্বাদস্বরূপ। ইংরেজদের বিরোধিতা করা স্রেফ মূর্খতা বই অন্য কিছু নয়। কারণ ভারতীয়রা  ইংরেজদের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। তাই ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য তিনি ইংরেজদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি আশা করেছিলেন, ইংরেজরা যেন বণিকবৃত্তি না করে এদেশে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। এতে করে বঙ্গদেশের মানুষ সার্বিকভাবে লাভবান হবে। বাঙালি ও ইংরেজ বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। ইংরেজদের বন্ধুত্ব অর্জনের কোনো সুযোগ দ্বারকানাথ ঠাকুর হাতছাড়া করতে চাননি। সাহেবদের সঙ্গে সখ্য স্থাপনের জন্য একদল প্রগতিশীল জমিদার ও বণিককে নিয়ে ‘জমিদার সমিতি’ (১৮৩৭) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার সকল জমিদারের স্বার্থ সংরক্ষণ ছিল এই সংগঠনের মূল কাজ।

উনিশ শতকে সাহেবদের প্রবল প্রতাপের মধ্যেও দ্বারকানাথ ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। ইংরেজ সাহেবদের তিনি সহযোগিতা দিতে ও নিতে চেয়েছিলেন। কৌশলগত ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নীলচাষ ও নীলকর সাহেবদের প্রতি তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, নীল কারবারে লোকসানের সম্ভাবনা কম। তাছাড়া বিলাসব্যসন, পারিবারিক সংস্কৃতিচর্চা, ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্টে সহায়তা দান, মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন ও ব্রাহ্মধর্মের প্রসারের জন্য প্রচুর টাকা দরকার, সে-টাকা প্রাপ্তির সহজ-পথ হিসেবে নীলচাষ ও নীলব্যবসাকে বেছে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নীলচাষের বদৌলতে নীলকরদের ছত্রছায়ায় নিম্ন শ্রেণির চাষিরাও আরামে দিন কাটাতে পারবে, জমিদাররাও ভালো থাকবে। তাই নিজেই কয়েকটি নীল কনসার্নের মালিকানা কিনে নেন।

রামমোহনের ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনকে অনেক সময় দ্বারকানাথের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই দুই যুগপুরুষের মধ্যে  কিছু বিষয়ে অমিল থাকলেও মিলও ছিল প্রচুর। দুজনেই সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, 888sport promo codeমুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, নিজ ও স্ব-সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অক্লান্ত কর্মী হিসেবে শ্রম দিয়েছেন। ধর্মকর্ম মেনে নিয়েও জাগতিক বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেননি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদেশে হিউম্যানিস্ট পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত। দ্বারকানাথ পণ্ডিত ছিলেন না, ছিলেন বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। অসামান্য বিদ্বান ও বিদগ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো পুস্তক রচনা করেননি, শাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতেও উদ্যোগী হননি। ধ্রুপদী সংগীত ও চিত্রকলার সমঝদার ছিলেন, কিন্তু ধ্রুপদী বিদ্যাচর্চায় উৎসাহ প্রদর্শন করেননি। উদ্যোগপতি হলেও তিনি ছিলেন বঙ্গীয় নবজাগৃতির সক্রিয় কর্মী। তিনি তাঁর সে-ভূমিকা পালন করেছিলেন ভিন্ন পথে, ভিন্ন কায়দায়। নবজাগৃতির পুরোধা ও পথিকৃৎ রামমোহন ও দ্বারকানাথ – এই দুই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি গোটা ভারতবর্ষকে মধ্যযুগীয়তা থেকে আধুনিকতার পথে নিয়ে আসতে সংগ্রাম করেছিলেন।  সে-কারণে রামমোহনকে আধুনিক ভারতবর্ষের জনক বলা হয়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, রামমোহনকে এই স্বীকৃতি প্রদান করা হলেও দ্বারকানাথকে কোনো স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। অথচ একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে বোঝা যায়, আধুনিক ভারতবর্ষ বিনির্মাণে রামমোহনের চেয়ে দ্বারকানাথের ভূমিকাই বেশি। ধর্ম সংস্কার ছাড়া আধুনিক ধ্যান-ধারণাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে রামমোহনের ভূমিকা নগণ্য। অন্যদিকে বঙ্গীয় রেনেসাঁস তথা আধুনিক চিন্তার বিকাশে দ্বারকানাথ পালন করেছিলেন অসামান্য ভূমিকা। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপনে সহায়তার হাত প্রসারিত করে দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ।  কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা ও এর উন্নয়নে দ্বারকানাথ অকাতরে অর্থায়ন করেছেন। বেঙ্গল হেরাল্ড, বেঙ্গল হরকরা, ইন্ডিয়া গেজেট, ইংলিশম্যান প্রভৃতি সংবাদপত্রের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত সংবাদ কৌমুদিকেও পৃষ্ঠপোষণা প্রদান করেছেন।

অভিমানী মানুষ ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। সবার উপর অভিমান করেই হয়তো ১৮৪৬ সালের ১লা আগস্ট মাত্র একান্ন বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর প্রিন্স দ্বারকানাথের যে ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে তা একজন উড়নচণ্ডী, অপব্যয়ী, ভোগবিলাসী পুরুষ হিসেবে। অথচ তিনি ছিলেন রেনেসাঁস-স্নাত এক যুগন্ধর পুরুষ। স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি 888sport live chatোন্নত আধুনিক ভারতবর্ষের। দেশি-বিদেশি সহযোগিতায় গড়তে চেয়েছিলেন স্বনির্ভর ভারতবর্ষ। বাঙালি ব্যবসায়ী ও উদ্যোগপতিরা জ্ঞান-888sport apkচর্চায়, শিক্ষাবিস্তার, 888sport live chatকলার উন্নয়নে তেমন সহায়তা করেননি। এক্ষেত্রে দ্বারকানাথ ছিলেন পুরোপুরি ব্যতিক্রমী। বহুবিধ কর্মতৎপরতার মাধ্যমে তিনি আধুনিক ভারতবর্ষের ভিত্তি স্থাপন করেন। অথচ কূপমণ্ডূক, কর্মবিমুখ, অলস বাঙালি তাঁকে মনে রাখেনি, এমনকি রবীন্দ্রনাথও তাঁকে সেইভাবে 888sport app download for android করেননি। উত্তর লন্ডনের কেনসাল গ্রিন সিমেট্রিতে দ্বারকানাথ সমাহিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অন্তত চারবার লন্ডনে গিয়েছেন, কিন্তু একটিবারও পিতামহের সমাধি পরিদর্শন করেননি। পিতা দেবেন্দ্রনাথের মহানুভবতার প্রসঙ্গ টেনেছেন নানা লেখায়, কিন্তু পিতামহ সম্পর্কে উল্লেখ করার মতো সদর্থক কিছুই লেখেননি। পিতামহ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা অনেককেই বিস্মিত করেছে। দ্বারকানাথের জীবনীকার (রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী নন্দিতার স্বামী) কৃষ্ণ কৃপালনীকেও অবাক করেছে। তিনি  তাঁর দ্বারকানাথ টেগোর : আ ফরগোটেন পাইওনিয়ার : আ লাইফ গ্রন্থে বলেছেন, ‘তিনি কেন অবজ্ঞাত উপেক্ষিত হয়ে রইলেন? এই বিস্মৃতপ্রায় লোকটি কী তবে কুলে কালি দিয়েছিলেন যার জন্য পরিবারের কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করে না? যে-লোকটি তাঁর জীবিতকালে এতো লোকের 888sport apk download apk latest version অর্জন করেছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁকে এতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলো কেন?’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘ঠাকুর-পরিবারের লোকদের মুখে কিংবা বহুকাল শান্তিনিকেতন থেকেও আমি তো তাঁর নাম বড় একটা শুনিনি। তবে রবীন্দ্রনাথের মেজদা আইসিএস অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মেধাবী পিতামহ সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের মনোভাব পোষণ করতেন। দ্বারকানাথের 888sport sign up bonusবিজড়িত স্থানগুলোও পরিদর্শন করেছিলেন, যা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘888sport sign up bonusকথা’ থেকে জানা যায়। সত্যেন্দ্রনাথের মনে পিতামহের কিছু 888sport sign up bonus কী ছিল, যার জন্য পিতামহের স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন?’