ঋত্বিক ঘটকের দলিল নাটকে উদ্বাস্ত্ত বিপন্নতার চিত্র

অমিতাভ বিশ্বাস

‘রিফিউজি’ শব্দটির দুটি বাংলা প্রতিশব্দ আছে। একটা হলো ‘শরণার্থী’, যার আক্ষরিক অর্থ হলো এমন কোনো ব্যক্তি যিনি কোনো ঊর্ধ্বতন শক্তির শরণ নিয়েছেন অর্থাৎ আশ্রয় এবং নিরাপত্তা প্রার্থনা করেছেন। এই শরণার্থী সম্পর্কে ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ-কর্তৃক শরণার্থী মর্যাদাবিষয়ক সম্মেলনে অনুচ্ছেদ ১-এ সংক্ষিপ্ত আকারে ‘শরণার্থী’র সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়। একজন ব্যক্তি যদি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন ও দেখতে পান যে, তিনি জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শ, সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় তাকে ওই দেশের নাগরিকের অধিকার থেকে দূরে সরানো হচ্ছে, সেখানে ব্যাপক ভয়ভীতিকর পরিবেশ বিদ্যমান এবং রাষ্ট্র তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখনি তিনি শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হন। অন্য প্রতিশব্দটি হলো ‘উদ্বাস্ত্ত’ যার মানে গৃহহীন। একটা বিশেষ অর্থে গৃহহীন কারণ বৈদিক ঐতিহ্যে সংস্কৃত ‘বাস্ত্ত’ (বাড়ি) শব্দটির একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। বাংলায় প্রায়ই ‘ভিটা’ বা (ভিটে) শব্দের সঙ্গে জুড়ে উলেস্নখ করা হয়। এই ভিটার সঙ্গে আবার সংস্কৃত ‘ভিত্তি’ শব্দটির (যার মানে হলো ভিত) যোগ আছে। এই ভিত বা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আবার পূর্বপুরুষ অর্থাৎ পুরুষানুক্রমিক বংশধারার একটা যোগ আছে। সুতরাং ‘বাস্ত্তভিটা’ শব্দটি দেখিয়ে দেয় বাড়ির ভিত্তি বলতে যা বোঝায়, তার সঙ্গে কতটা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে পিতৃশাসিত বংশানুক্রমিক। কারণ স্থায়ী বাড়ি হলো তার ভিত্তি। উদ্বাস্ত্ত মানেই সেই ভিত বা ভিত্তি থেকে চ্যুত হওয়া। মানবজীবনে বাস্ত্তভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ সব হারালেও গৃহ হারাতে চায় না। বাসভূমির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক মানুষের শুরু হয়েছে সেই আদিমকাল থেকে। সেই বাসভূমি হারাতে হলো মানুষকে দেশবিভাগের নামে। হারাতে হলো নিরুপায় হয়ে। আশ্রয় হারিয়ে মানুষ ছিন্নমূল অবস্থায় পাড়ি দিলো একে অপরের দেশে। আশ্রয় পেল অপরিচিত দেশের অসংখ্য বসিত্মতে। আশ্রয়হীন এসব মানুষজনের কাছে স্বাধীনতার অর্থ বোধ হলো বাস্ত্তচ্যুত হওয়া। অথচ তারা যে-কোনো কিছুর বিনিময়ে নিজগৃহে
থাকতে চেয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় পাশের বাড়ির অপর সম্প্রদায়ের মানুষটি যে স্বাধীনতার আগে বন্ধু ছিল, ঠিক স্বাধীনতার নামে দেশবিভাগের সঙ্গে সঙ্গে শত্রম্নরূপে হাজির হলো। এতদিনের পরিচিত মানুষটির অত্যাচারে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হলো। ছিন্নমূল এসব উদ্বাস্ত্ত মানুষ মাথাগোঁজার কোনো স্থান পেল না। তারা উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায় ঘুরতে লাগল। আশ্রয় পেল স্টেশনে, নোংরা বসিত্মতে, রাস্তার ধারে।

দেশবিভাগের পর ভিটেমাটি ছেড়ে ছিন্নমূল মানুষগুলো দলে দলে সীমান্ত পেরিয়ে ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ স্টেশনে নামতে লাগল; কিন্তু তারপর আর কিছু নেই। আপাত যাত্রা শেষ। সমুদ্রের মতো কলকাতা শহর। ভীতসন্ত্রস্ত, সর্বহারা মানুষগুলো এই শহর দেখে ভয় পেল। তারা থেমে গেল শিয়ালদহ স্টেশনে। যতদিন তাদের অন্যত্র পাঠানো না হচ্ছে, ততদিন তারা এখানেই থাকবে। এখানেই প্রতিষেধক টীকা দেওয়ার জন্য প্রথমেই এদের লাইন দিতে হবে। সেখানে একটি সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে যে তারা উদ্বাস্ত্তশিবিরে আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য। পস্ন্যাটফর্মে থাকাকালীন উদ্বাস্ত্তরা সরকারের কাছ থেকে রেশন হিসেবে বিনে পয়সায় চিড়ে-গুড় পেত। এই রেশন বিতরণ করত বেসরকারি ত্রাণসংস্থার কর্মীরা। সরকারি কর্মীদের দায়িত্ব থাকলেও তারা সেভাবে তা পালন করত না। কারো অসুখ করলে তাকে দেখাশোনা করার কেউ ছিল না। প্রসব যন্ত্রণায় কাতর কোনো মহিলারও কোনো রকম সাহায্যের কেউ ছিল না।

পূর্ব বাংলার উদ্বাস্ত্তরা আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে চলে এসেছিল পশ্চিমবঙ্গে। তারা জানত না কী ভয়ানক মৃত্যুর মতো জীবন পশ্চিমবঙ্গে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। সেই জীবনের বিষাক্ত আস্বাদ পেল তারা শিয়ালদহ স্টেশনের নরকু–। তারা বুক বেঁধেছিল পশ্চিমবঙ্গের মুক্তজীবনে স্বাধীন মানুষের মতো বাঁচবে বলে। কিন্তু নিষ্ঠুর কলকাতা তাদের কী দিলো? পাষাণ শহর তাদের দিকে তাকিয়ে দেখল না, কঠিন অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নিল। হাজার হাজার নিত্যযাত্রী যারা প্রতিদিন কলকাতায় আসত, তারা একবারো এই ধুলোকালি মাখা মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখত কিনা সন্দেহ আছে। কালিঝুলি মাখা পুরুষ, 888sport promo code ও শিশুদের দেহের সংস্পর্শ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলত। চাল, চিড়ে, গুড়ের সামান্য বরাদ্দ, কলের জলের জন্য মারামারি-হাতাহাতি নিত্যসঙ্গী। ব্যস্ত নিত্যযাত্রীরা অনায়াসে তাদের মাড়িয়ে চলে যেত। স্থানীয় মানুষ উদ্বাস্ত্ত মানুষদের অনুকম্পার দৃষ্টিতে দেখত। অন্য দেশে এসে গৃহহীন সব মানুষ উপলব্ধি করল তারা অবাঞ্ছিত অতিরিক্ত। ব্যঙ্গ করা হলো তাদের ভাষা নিয়ে, সংস্কৃতি নিয়ে। স্থানীয়রা কোনো দিন উদ্বাস্ত্তদের ঠিক মানুষ পদবাচ্য মনে করেনি। একদিকে সরকারি উদাসীনতা আর অন্যদিকে স্থানীয় মানুষদের অবহেলায় এসব উদ্বাস্ত্ত মানুষের জীবন নাজেহাল হয়ে উঠেছিল। দেশভাগের এই করুণ পরিণতি নিয়ে কবি, 888sport live footballিক, নাট্যকাররা তাঁদের সৃষ্টিকর্ম সাজিয়ে দিয়েছেন আমাদের সামনে।

দলিল (১৯৫২) নাটকের রচয়িতা ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫-৭৬)। ঋত্বিক ঘটক ও live chat 888sport একই ফ্রেমে বাঁধানো এই একটি ছবিকে অধিকাংশ পরিচিতিতে টানিয়ে রাখা হয় আমাদের দৃষ্টির সমান্তরালে। যেখান থেকে চোখ সরানোর কোনো সুযোগ প্রায়শই থাকে না। আধুনিক সমাজ ঋত্বিক ঘটককে চেনে যত না নাট্যকার হিসেবে তার থেকে বেশি চেনে live chat 888sportকার রূপে। কিন্তু নাট্যকার, অভিনেতা, পরিচালক ঋত্বিক ঘটককে আমরা অনেক বেশি অনুভূতিপ্রবণ, সংবেদনশীল সমাজ চিত্রকরূপে নাটকের মধ্যে দেখতে পাই। তাঁর সম্পর্কে এই দীর্ঘ বাক্যটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি প্রথমে নাটক, এরপর গল্প, তারপর নাটক, সবশেষে সিনেমা এবং সর্বপরিশেষে আবার নাটকের জগতে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর নাট্যপ্রীতির স্ফুরণ বিদ্যালয়ের কৈশোরে চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চানক্যের বেশে। অভিনয়ের মধ্যে তবুও এক রহস্যময় সাধারণ ও স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে, কিন্তু অচলনায়তনের মঞ্চ নির্মাণ কিছু ব্যতিক্রম তো বটেই। এই মঞ্চাভিনয় প্রসারিত হয় বিদ্যালয়ের অঙ্গনে এবং সেটা একাধিক অবতরণে। এরপর তিনি আরম্ভ করলেন গল্প। নাট্যের মধ্যে যে ছবি আঁকা হয় মুহুর্মুহু, তা এলো গল্পের চিত্রপটে। একের পর এক গল্প প্রকাশিত হতে লাগল নানা পত্রিকায়। মহাবিদ্যালয়ে থাকাকালীন মঞ্চস্থ করেন ফাল্গুনীরাজা নাটক কুমাররায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে। পাশাপাশি রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরিতে অভিনয়ে অংশ নেন ডাকঘরবিসর্জন নাটকে। এরপর তিনি একে একে যুক্ত হন ক্রান্তি 888sport live chatীসংঘে, এরপর বহুরূপী, শেষে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। এই তিন সংগঠনই তাঁর নাট্যের অনুভবে, 888sport live chatীর ভাবনায় জীবন-নীলিমাকে আরো গভীর ও গভীর রঙে সিক্ত করে তোলে।

ঋত্বিক ঘটক এই মহান ব্যক্তির জন্ম ৪ নভেম্বর ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে এবং মৃত্যুবরণ করেন ৬ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর জন্ম পূর্ববঙ্গ (বর্তমান 888sport appsের) 888sport app শহরের ঋষিকেশ লেনে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় এবং ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ববঙ্গের প্রচুর লোক কলকাতায় আশ্রয় নেয়। তাঁর পরিবারও একই অবস্থায় চলে আসে। শরণার্থীদের অসিত্মত্বের সংকট তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করে এবং পরবর্তী জীবনে তাঁর live chat 888sportে এর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে।

ঋত্বিক ঘটকের জীবনসরণি ধরে হাঁটলে গভীরভাবে অনুভব করা যায় তিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত নাটকের লোক, এমন এক সংস্কৃতিকর্মী যার রক্তের ভেতর প্রবাহিত থিয়েটারের কলেস্নাল, সেখান থেকেই ঋত্বিককে চেনা শুরু করা উচিত। সব মিলিয়ে পাঁচটি মৌলিক নাটক লিখেছেন। জ্বালা (১৯৫০), দলিল (১৯৫২), সাঁকো (১৯৫৫), সেই মেয়ে (১৯৬৯) ও জ্বলন্ত (১৯৭৪)। দুটি নাটক 888sport app download apk latest version করেন ব্রেশটের গ্যালিলিও চরিত (১৯৬৪) এবং খড়ির গ-ী (১৯৬৬)। ঋত্বিক ঘটক live chat 888sportের জগতে পা রাখেন নিমাই ঘোষের সহকারী পরিচালক হিসেবে ছিন্নমূল (১৯৫১) সিনেমার মধ্য দিয়ে। একসঙ্গে অভিনয়ও করেন। ১৯৫২ সালে পরিচালক হিসেবে live chat 888sportে স্বয়ং পদার্পণ নাগরিক (১৯৫২) ছবির মধ্য দিয়ে। যদিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রথম ছবিটি মুক্তি পায়নি। তবে পরপর সাফল্যে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর পরিচালিত ছবিগুলো হলো – অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে 888sport app তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭১), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭)।

ঋত্বিক-সমালোচক রথীন চক্রবর্তীর মতে – ‘ঋত্বিকের এই বাঙালিয়ানার উৎসার এক অনির্বাচনীয় দেশপ্রেম থেকে। যে দেশপ্রেমের গভীরে নিহিত থাকে এক কল্পিত প্রতিমা, দেশমাতৃকা। স্নেহ ও অভিমানে, ভালোবাসা ও বিরাগে, অন্তরঙ্গতা ও বিক্ষোভে, গাঢ়তম সখ্য ও বিবাদে রঞ্জিত হতে হতে এই দেশমাতৃকা কখন যে 888sport promo codeমূর্তি করে তা একজন কবি বা চিত্রীও টের পান না। এই 888sport promo code, 888sport live chatীর অনুভবের পরতে পরতে, সৃষ্টির রেখায় রেখায় উঠে আসে এবং জীবনবোধের শেষ কথাটি তাঁর মুখেই উচ্চারিত হয়। একজন 888sport promo code, একজন প্রেমিকা, একজন বধূ, একজন জননী এবং কন্যা। জ্বালা নাটকে বধূ, দলিল নাটকে ফিরোজা, সাঁকো নাটকে মা, সেই মেয়ে নাটকে কন্যা, জ্বলন্ত নাটকে বিষ্ণুপ্রিয়া – এরা একই সারণিতে উপস্থিত হয় একই কথা নিয়ে, একই প্রতিমার কাঠামোয়, মানুষকে পাপমুক্ত, কঙ্ককমুক্ত করার জন্য।’

দেশভাগের প্রত্যক্ষ ছবি নিয়ে দলিল নাটকটি রচিত। দেশবিভাগের পর উদ্বাস্ত্ত মানুষের দুঃখ-বেদনা, মনোভাব ও সংগ্রামী চেতনার যে বাস্তব ছবি দলিল নাটকে দেখা যায় তা ঋত্বিকের নিজের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। কারণ তিনি
নিজে পূর্ববঙ্গের অধিবাসী ছিলেন এবং নিজেও উদ্বাস্ত্ত ছিলেন। তাই দলিল নাটকের উৎসর্গ পত্রে লিখেছেন –
‘উদ্বাস্ত্ত মনোভাবের প্রতিটি অনুরণন আমি পেয়েছিলাম আমার বাবার মধ্যে। যে-বাবার জীবনকালে কোনোদিন আমি তাঁকে কিছু দিতে পারিনি – সেই আমার পরমপূজনীয় স্বর্গত বাবার উদ্দেশ্যে আমার প্রথম প্রচেষ্টা উৎসর্গীকৃত হল।’

দলিল নাটকের আরম্ভ যেদিন দেশভাগ ঘোষণা, সেদিন থেকে। হরেন প–ত গঞ্জে যাচ্ছে, রেডিওতে খবর শুনতে, দেশভাগ হবে আজ। ফিরে এসে রাতে খবর দিয়ে গেল রূপাইকান্দি গ্রাম পাকিস্তানের মধ্যে পড়েছে। আর বলে যাচ্ছে হুই আঁধারের মধ্যে লুকিয়ে আছে হিন্দুস্থান। বোঝা যায় নাট্যকার হরেন প–তের মধ্য দিয়ে তিনটি প্রশ্ন আমাদের সামনে উপস্থিত করতে চেয়েছেন। এক. স্বরাজ বা স্বাধীনতার ঘোষণা, দুই. দেশভাগ ও তিন. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বিভাজনের ইঙ্গিত বা দাঙ্গা। একজন সচেতন নাগরিকের মতো ঋত্বিকও নাটকের অভিমুখ নির্দিষ্ট করেছিলেন স্বাধীনতা, দেশভাগ ও দাঙ্গার বিষময় ক্ষত নিয়ে। স্বাধীনতা, দেশভাগ ও দাঙ্গার প্রেক্ষাপট হিসেবে নির্বাচন নাট্যকারের স্বদেশচেতনা দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আধার রূপে পরিগণিত হয়। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কথা। ঋত্বিকের 888sport app নাটক এমনকি live chat 888sportেও নাট্যকীয় উপাদানের পাশাপাশি দেশভাগজনিত যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ের জলছবি প্রতীয়মান।

দলিল (১৯৫২) নাটকে রূপাইকান্দি গ্রামের কৃষক ক্ষেতু ঘোষ ও তার পরিবার এবং ফিরোজা নানি ও তার পরিবারকে সামনে রেখে নাটকটি এগিয়ে যায়। একই সঙ্গে দুটি পরিবারের মধ্যে অন্তরঙ্গতা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই। বলা ভালো, উভয় পরিবারের অন্তরঙ্গতার মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যকার ঐক্য ও সম্প্রীতির সনাতন চিত্রকে নাট্যকার সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে কোনো দ্বিচারিতার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। দলিলের চোদ্দটি চরিত্রের প্রধান অংশই কৃষিজীবী পরিবারের অন্তর্গত। দুটি পরিবারকে সামনে রেখে প্রতিটি চরিত্র আত্মপ্রকাশ করেছে।

নাটকের ভূমিকায় ঋত্বিক ঘটক লেখেন – ‘মানুষগুলো শিকড় উপড়ে এসে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে, একবার এদিক যায়, একবার ওদিকে, আর তারই মধ্যে নিষ্ঠুর সমাজ আর বিশ্বাসঘাতক নেতৃত্ব তাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলে চলেছে – ওরা যেন একেবারে দিশেহারা। ক্রমে আশা নিভে যায়, যার থেকে বড় মৃত্যু আর নেই। মানুষগুলো ভেতর থেকে পচে আসছে, পিছনের কথাই বারবার মনে পড়ে, সামনে বুঝি কিছু দেখা যায় না। তারই মধ্যে থেকে এক-একটা চমক আসে, যার থেকে বেরিয়ে আসে ভবিষ্যৎ দৃঢ়তার দিকে বলিষ্ঠ-পদক্ষেপ। জনতার ওপর যে আস্থা শিথিল হয়ে আসছিল, আবার জোরদার হয়।’

নাটকের প্রথম প্রবাহের শুরু দেশভাগ নিয়ে, দ্বিতীয় প্রবাহের শুরুতে শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্বাস্ত্ত মানুষগুলোর করুণ মুখগুলো ভেসে ওঠে আমাদের চোখের সামনে। তাদের চোখে-মুখে হতাশা, আশাভঙ্গের আর বিপন্নতার চিহ্ন স্পষ্ট হচ্ছে। হিন্দুস্থান সম্পর্কে আশাভঙ্গ শুরু হয়েছে শিয়ালদহ স্টেশনে স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যবহার আর সরকারের উদাসীনতা দেখে। ক্ষেতু ঘোষ ও তার প্রতিবেশী দেবিন্দরের কথোপকথনের মধ্য থেকে জানা যায়।

‘দেবিন্দর : আর বেশিদিন বুল্যা তো মনে হত্যাছে না। ভল্টিয়ারবাবুরা আর দুধ দিবে না আজ থিকা। কী হবে?

ক্ষেতু : মিছা দুনিয়ার মাঝে আর ঘরখান বাঁধ্যা যাবে না। দেখ্যা শুন্যা কেমুন আমার বেভ্রম ধর‌্যা গিছে। বোবা হয়্যা যাত্যাছি।

দেবিন্দর : যাও কুণ্ঠি?

ক্ষেতু : কলপারে। জল খরিদ করতে এখনো পয়সা লাগে ই দ্যাশে বোধ করি তাও সম্ভব।’

সুফলা-সুজলা বাংলা ছেড়ে আসা মানুষগুলো আজ অন্নের অভাবে, বাসস্থানের অভাবে স্টেশনে দিন কাটাচ্ছে। চারদিকে শুধু হাহাকার ধ্বনি শুনতে পারছে নিরন্ন মানুষগুলো। আর দেশভাগের নামে তাদের সঙ্গে যে-ধোঁকা হয়েছে তার প্রমাদ গুনছে। ক্ষেতু ঘোষ তাই জানায়, শ্বাস নিতে গেলেও এখানকার হাওয়া যেন আপত্তি করে। দেশটা তাঁর মনের মতো হয়নি। তাই তিনি জানান, ‘শখ মিট্টা গেছে হামার। হিন্দুস্থান আর হিন্দু ভাই।’ উদ্বাস্ত্ত এই মানুষগুলোকে দূর-দূর থেকে আসা নিত্যযাত্রীরা পর্যন্ত কখনো ফিরে তাকিয়ে দেখনি, সাহায্য-সহযোগিতা তো দূরের কথা। স্টেশনে শুয়ে থাকা মহিন্দরের গায়ে পা দিয়ে চলে যায় নিত্যযাত্রী। মানুষের পরিচয় হারিয়ে ফেলা মানুষগুলোর শুধু প্রতিবাদটুকুই অবশিষ্ট বেঁচে ছিল। পূর্ববঙ্গে এসব মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব ছিল না। আজ দেশভাগের জাঁতাকলে পড়ে শিয়ালদহ স্টেশনে শুয়ে আছে, আর নিত্যযাত্রীদের তাদের মাড়িয়ে যাওয়া সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করে মহিন্দর শুবার জায়গার আবেদন করেছে।

শিয়ালদহ স্টেশনে শুধু কি অন্ন কিংবা শোবার অভাব তা নয়, সঙ্গে আছে মেয়েদের আব্রম্ন রক্ষারও সংকট। হাজার মানুষের সামনে স্নান করা, গা-মোছার মতো নিত্যদিনের কর্ম করতে হচ্ছে উদ্বাস্ত্ত মেয়েদের। সেখানে আছে লম্পট মুখোশধারী কিছু মানুষ, যারা কিনা উদ্বাস্ত্ত মেয়েদের অবৈধ কাজে লাগাতে চায় তাদের আর্থিক অনটনের সুযোগ বুঝে। তার প্রমাণ মেলে স্বর্ণের কথাতে – ‘স্বর্ণ : কলপারে হাজার লোক চ্যায়া আছে। গা ধুবার পথ নাই, মুখ ধুবার পথ নাই, জল ভরার পথ নাই, – আবাগির বেটারা ড্যাবা ড্যাবা চোখে খালি তাকায়্যা আছে। মুখানে নুড়া ধরাইয়া দিবার পারলে হামার জ্বালা জুড়ায়।’

এভাবেই এক অজানা আশঙ্কায় দিন কাটে ভূমিচ্যুত মানুষের। স্টেশনের বাইরে চলে উদ্বাস্ত্তদের ঢল। একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে প্রস্ত্ততি চলতে থাকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের। লাটভবনে আছে প্রধানমন্ত্রী প–ত নেহরু, তাঁর সকাশে মিছিল যাচ্ছে, পুনর্বাসনের দাবিতে। মিছিলকে ঘিরে বাস্ত্তচ্যুত মানুষের স্বপ্ন আর প্রত্যাশার ছবি। এত যন্ত্রণা, এত হাহাকারের মধ্যে রূপাইকান্দি গ্রামের গোপালের প্রতিবেশী অর্জুন মালাকার দেশভাগজনিত ক্ষত বুকে নিয়ে একটা ভরসার খোঁজে নিরবচ্ছিন্ন অনুসন্ধান চালিয়ে যায় রাজার দরবারের সামনে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দলিল দেখিয়ে সুবিচার চাইবে। দেশভাগের যন্ত্রণা শুধু নয়, এদেশে মাথাগোঁজার মতো ঠাঁই পেতে হলে একটা নথি যে লাগে ছিন্নমূল মানুষের সব হিসাবের বাইরে অন্তত একটা অবলম্বন এই দলিল। যার মধ্যে হারানো সব লুকিয়ে আছে। আবার হকের ধন ফেরত পাওয়ার আশায় ছিন্নমূল মানুষগুলো জোট বাঁধেন। উদ্বাস্ত্ত মানুষগুলো মিছিল করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায় লাটভবনে পৌঁছালে মিছিলে গুলি হয়। মিছিলে গুলি হলে অর্জুন মালাকার নিহত হয়। ক্ষেতু ঘোষ দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে টলতে টলতে আসে।

পশ্চিমবঙ্গে আসার আগে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে এদেশ সম্পর্কে অনেক আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল। পশ্চিমবঙ্গ এসব দেশত্যাগী ছিন্নমূল মানুষকে সাদরে গ্রহণ করবে। সেরকম প্রফুলস্ন রায়ের (১৯৩৪) কেয়াপাতার নৌকা (২০০৩), 888sport alternative linkে হরিন্দরের আশা – ‘ইন্ডিয়ায় একবার যাইতে পারলে থাকনের এট্টা না এট্টা বন্দবস্ত ঠিক হইয়া যাব।’ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত, হতাশায় ভেঙে পড়ে উদ্বাস্ত্ত মানুষের দল। ভুবন দাসের ভাবনায় – ‘তার অটুট বিশ্বাস ছিল, ইন্ডিয়ায় সবাই তাদের জন্য হাত বাড়িয়ে বসে রয়েছে। সেখানে জমিজমা, গোলাভরা ধান, বাড়িঘর, ফলবাগিচা, সমস্ত সাজানো রয়েছে। তারা এলে তাদের হাতে সেসব তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার আগেই স্বপ্নভঙ্গ ঘটে গেল। চরম হতাশাগ্রস্ত ভুবন দাস জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকে।’

দলিল নাটকে ক্ষেতু ঘোষ একই আর্তনাদ করে ওঠে। ‘তারপর আর স্বপন নাই – প্রত্যক্ষ। এদেশের হাওয়া ভালো না মা, ইয়ারা বুলে রিফিউজি, শরণার্থী। আচ্ছা কও তো মানুষের ডাক্যা যায় উহা বুইল্যা। এট্টা মান হ্যামি কইর‌্যা রাইখ্যাছিলাম নিজের তরে। সেটা খোয়া গেছে। এখন চোরা চোরা লাগে।… ক্যানে? কি কর‌্যাছি হামরা।’ যাদের ঘর ছিল, বাড়ি ছিল, সামাজিক পরিচয় ছিল তা হারিয়ে আজ তারা রিফিউজি, শরণার্থী। সামাজিক পরিচয় হারিয়ে আজ তারা একবুক হতাশা আর বেদনা নিয়ে প্রমাদ গোনে। ছিন্নমূল উদ্বাস্ত্ত মানুষ যখন সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশের নিরাপত্তার সন্ধানে চলে যায় তখন তারা remain suspended hanging between the two worlds. একদিকে 888sport sign up bonusর মধ্যে থেকে যায় ছেড়ে আসা অতীত, অন্যদিকে বর্তমান তাকে নতুন করে গড়ে তোলে নতুন জীবন, বিশুদ্ধ বাঁচার মৌলিক তাগিদে ব্যাপৃত থাকতে হয়। ক্ষেতু ঘোষ আজ অভাব-অনটনে পড়ে সেই অতীত দিনের কথা মনে করছে। সেখানকার হাওয়া ভালো ছিল, বাগানখানার কথা মনে পড়ছে, পদ্মার পাড়, জমিজায়গা সব আজ 888sport sign up bonusতে উঁকি দিচ্ছে।

ক্ষেতু ঘোষ ও তার পরিবারে অভাব দেখা দেয় চরম আকারে। খাবারের সংস্থান করতে বাসনপত্র সব বিক্রি হয়ে গেল। মহিন্দরের স্ত্রীর স্বর্ণের সোনাদানা যা ছিল সব বিক্রি হয়ে যায়।

চরম হতদরিদ্রের মধ্য দিয়ে দিন কাটায় তার পরিবার। ঘটনাক্রমে রূপাইকান্দি গ্রামের হরেন মাস্টারের সঙ্গে দেখা হয় ক্ষেতু ঘোষের প্রতিবেশী দেবিন্দরের, তিনি নিয়ে আসেন শিয়ালদহ স্টেশনে মহিন্দরের পরিবারের সঙ্গে দেখা করাতে। মাস্টারই তাদের জান্তব জীবনযাপন দেখে যাদবপুরের পাশে গড়ে ওঠা নতুন কলোনিতে আসতে বলে। হরেন প–ত বলেন – ‘আমাহেরা কলোনিতে আর জায়গা নাই বটে, তবে পাশে কতকগুল্যান কী কয়, ব্যারাক আছে। সেখানে চলেক। তারপর কাম ধান্দা কর‌্যা যা হবেনে। জায়গা খারাপ, তবে ইয়ার থিকা তো ভালো! আব্রম্ন জাগা।’১০ বসিত্মতে আসার পরে কষ্টের সীমা আরো বেড়ে যায়। মহিন্দর অনেক কাজের চেষ্টা করেও কোনো কাজ পায় না। স্বর্ণবাবুদের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতে গিয়ে বাবুদের লালসার শিকারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় বাড়ি ফিরে আসে। কারণ সেখানে মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে খেলা করে বাবুরা। আসলে ইতিহাস বলে পৃথিবীর যে-কোনো বিপর্যয়ে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয় 888sport promo codeরা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের দাঙ্গা, সবকিছুতে মেয়েদেরকে ভোগ্যপণ্য করা হয়েছে। সে-সময়ের উদ্বাস্ত্ত 888sport promo codeদের মতো আর বোধহয় কোনোদিন বর্তমানে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়নি সমাজের নোংরা মানুষদের কাছে। এ-প্রসঙ্গে স্বর্ণের উক্তি তুলে ধরা যেতে পারে – ‘স্বর্ণ – … ইজ্জত তোমাক, খোয়াবার হবেই, কিন্তুক গড়িমসি কল্যা এমন সময় খোয়াবা য্যাখন দেশসুদ্ধা ঘটি-বাঙ্গাল সব খোয়াইছে, ইজ্জত যখন সস্তা হয়্যা গিছে।’১১

সংসার চালানোর মতো আর্থিক সংগতির অভাবে আজ 888sport promo code তাঁর সম্মান খোয়াতে প্রস্ত্তত। সমাজজীবনের এমন এক সংকটের সামনে আজ মহিন্দরের পরিবার দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে 888sport promo codeর ইজ্জত তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। গোপাল তার গানের বই বিক্রি করে দেয়। ক্ষেতু ঘোষ অভাবে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করে। এদের মতো পূর্ববঙ্গ থেকে আসা আর এক উদ্বাস্ত্ত অর্জুন মালাকার, তার অবস্থা পাগলের মতো। সে পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতা আসার সময় শুনেছিল যে, সেখানে তার নিজের জমির দেখলে সরকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেবে। তাই সে তার পূর্ববঙ্গের জমির দলিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর খোঁজ করে বেড়ায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে দলিল দেখিয়ে সে ক্ষতিপূরণ চাইবে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ হয়ে গেলে নেতারা পূর্ববঙ্গের 888sport free betলঘুদের নিরাপত্তার আশ্বাস ও সুষ্ঠু পুনর্বাসনের ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। যেমন – ‘নূতন দিলস্নীতে ১৬ই জুলাই ১৯৪৭ তারিখে মহাত্মা গান্ধী প্রার্থনা পরবর্তী সভায় বলেছিলেন যে কল্পিতভাবে বা বাস্তবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যেসব হিন্দু পাকিস্তানে তাদের নিজের গৃহে থাকতে পারবে না… সেক্ষেত্রে ভারতীয় রাষ্ট্রের সম্পর্কিত প্রদেশের নিশ্চিত কর্তব্য এসব উদ্বাস্ত্তদের দুহাত তুলে গ্রহণ করা এবং সকল প্রকার যুক্তিসঙ্গত সুযোগ সুবিধা দেওয়া। তাদের অনুভব করাতে হবে যে তারা অপরিচিত দেশে আসেনি।’১২

জওহরলাল নেহরু উদ্বাস্ত্তদের উপযুক্ত সম্মান ও ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট লোকসভায় বিতর্কে উদ্ধৃত করেন – ‘পূর্ববঙ্গে যারা বিপন্ন হবে, তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য হবে তাদের নিজেদের দেশেই তাদের রক্ষার ব্যবস্থা করা। আর যদি অন্য উপায় না থাকে এবং বিশেষ অবস্থায় প্রয়োজন হয়ে পড়ে আমাদের নিজেদের দেশেই তাদের আশ্রয় দেওয়া। পূর্ব পাকিস্তানে যারা 888sport free betলঘু তারা নিশ্চিত আমাদের দায়।’১৩ আর দলিল নাটকে সেসব নেতার আশ্বাসবাণীর কথা উলেস্নখ করেছে অর্জুন মালাকার। দেশের নেতাদের আশ্বাস মতো সে-দেশ ছাড়ার আগে বাড়ির দলিল সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে হিন্দুস্থানের রাজার কাছে তা দেখাবে বলে এবং অধিকার ফিরে পেতে চাইবে, বাসস্থান, অন্নের সংস্থান চাইবে। রাজা কি প্রধানমন্ত্রী তা অর্জুন মালাকার মাথা ঘামায় না, সে চায় অধিকার। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কোনদিকে সেদিকে ছুটে যায় এবং পুলিশের গুলিতে মারা যায়, তার আর দলিল দেখানো হয়ে ওঠে না, যা সেইসঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। দেশভাগের নামে যে ওপার বাংলার মানুষের সঙ্গে ধোঁকা হয়েছে অর্জুন মালাকারের মতো লাখ লাখ উদ্বাস্ত্ত মানুষের শিয়ালদহ স্টেশনে নামার পর ভুল ভাঙে।

দলিল নাটকের তৃতীয় প্রবাহে কলোনিতে শুরু হয় নতুন এক সমস্যা। নোংরা-অপরিষ্কার অবস্থায় জীবন কাটানো মানুষগুলোর ছেলেমেয়েরা আক্রান্ত হয় মহামারিতে। কলেরা ছড়িয়ে পড়ে সারা কলোনিতে। মহিন্দরের সমত্মান হারু কলেরায় আক্রান্ত হয়। একের পর এক মৃত্যু গ্রাস করতে থাকে কলোনিতে। সৎকারের সামর্থ্য নেই। জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয় লাশ, জন্তু-জানোয়ারদের উদ্দেশ্যে। বিবর্ণ হয়ে ওঠে একটি জনপদ। ডাক্তার এসে হারুকে মৃত ঘোষণা করে এবং বিছানা পুড়িয়ে ফেলতে বলে। একমাত্র সম্বল বিছানা পুড়িয়ে ফেলার কথায় পরিবারটির দুশ্চিমত্মা আরো বেড়ে যায়। নবীন সাংবাদিক দেবু তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশে উদ্বাস্ত্ত কলোনিতে এসে জড়িয়ে পড়ে। সহায়-সম্বলহীন ছিন্নমূল মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে দেবুও স্বপ্ন দেখে একদিন এই ভিটেছাড়া মানুষগুলোর আশা পূর্ণ হবে। দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে চটকল ধর্মঘটের প্রসঙ্গ এনে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, কীভাবে মালিকপক্ষ চটকলে ধর্মঘট করিয়ে উদ্বাস্ত্ত কলোনি থেকে সস্তায় মজুর নিয়ে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের ওপর পেছন থেকে ছুরি চালাতে চায়। নতুন কলোনিতে দুঃখের শেষ নেই। রাতে শিয়ালে জনার্দন মালির ছাওয়ালটির মু- নিয়ে যায়। মরা ছাওয়ালের রোজনাতে সেখানে দশ-বারোটা বাচ্চা মারা যায়। কলোনির মানুষগুলো ওপার থেকে এপারে এসে যেন ভীষণ রকমের অন্যায় করে ফেলেছে। তাদের অসহায়তা শুধু প্রকট হয়ে ওঠে তা নয়, আত্মবিশ্বাসও যেন শেষ তলানিতে এসে পৌঁছায়, যেখান থেকে আর কোনোদিকে আশা দেখতে পায় না। সেই মানুষগুলোই আবার স্বপ্ন দেখে। ফেলে আশা দিনগুলোর কথা ভেবে আত্মসুখে নিমগ্ন হয়। পরক্ষণেই ঋত্বিক সেই সুখ888sport sign up bonusকে বাস্তবের মুখোমুখি এনে দাঁড় করান, সেই স্বপ্নগুলো আবার যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়। মানুষগুলো আবার স্বপ্নহীন আশাহত হয়ে পড়ে।

ঋত্বিক ঘটকের দলিল নাটক বাংলাভাগের বিরুদ্ধে, বাংলার মানুষজনকে বিভক্ত করার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। তিনি নিজে উদ্বাস্ত্ত ছিলেন তাই এই জ্বালা খুব ভালো বুঝতে পারতেন। তাই শেষ দৃশ্যে ভাঙা বাংলার মানুষজন আবার মিলিত হবে, এই আকাঙক্ষা নাট্যকার জ্ঞাপন করেছেন। নাটকের শেষে রূপাইকান্দি গ্রাম থেকে চিঠি আসে, সেই চিঠির অংশবিশেষ পাঠ করতে করতে ক্ষেতু ঘোষের সজল চোখে ভবিষ্যতে আলোর দিশা। আজ সেখানে অবাঙালি শাসকদের হাত থেকে পূর্ববঙ্গকে বাঁচানোর, বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর লড়াই শুরু হয়েছে। বাঙালি আজ হাতে হাত রেখে অবাঙালি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ঋত্বিক তাই বলেছেন – ‘ভাঙা বাংলার প্রতিরোধই আমার শেষ কর্তব্য। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে বাংলা আজ চিৎকার করে উঠছে, – বাঙালি এক, তার ঐতিহ্য এক, তার ভাষা এক, তার সংস্কৃতি এক। বহু যুগ অতীত থেকে বহুদূর ভবিষ্য পর্যন্ত সে এক। মাঝের এই বিশ্বাসঘাতক কালনেমির লঙ্কাভাগ, ধুয়েমুছে কোথায় চলে যাবে, মির্জাফরকে ইতিহাস সহ্য করবে না। এ ঘোষণা বারবার করার দরকার আছে বলে মনে করেছিলাম, সেইটেই আমার শেষ কথা।’১৪ ঋত্বিক ঘটক যুক্ত বাংলাকে ভালোবাসেন। তাই বাংলার মানুষের এই চরম দুর্দশায় রাগে নিজে জ্বলে-পুড়ে মরেছেন। প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে এই নাটক আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন। পূর্ববঙ্গের মানুষের এই দুর্দশার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

বাস্ত্তহারা ছিন্নমূল মানুষগুলো এদেশে আশার পর পুরনো মূল্যবোধকে আর ধরে রাখতে পারেনি। বেঁচে থাকার জন্য কোনো না কোনো মূল্যবোধ অপরিহার্য। কিন্তু মানুষের জীবন যখন বিপন্ন হয়ে পড়ে, আর্থিক কারণে জীবনে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা ও গস্নানি। তখন চিরাচরিত মূল্যবোধও বিপর্যস্ত হয়। দেশভাগের পর উদ্বাস্ত্ত মানুষগুলোর জীবনেও নেমে এলো সেই বিপন্নতা। মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে কেউ কেউ বিপথগামী হলো। জীবন থেকে অনেক সময় হারিয়ে গেল
888sport apk download apk latest version-প্রেম-ভালোবাসা।

বর্তমানে সারাবিশ্বে সবচেয়ে বড় সংকট উদ্বাস্ত্ত সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি এ-সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। জাতিগত সংঘর্ষ কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেখানকার মানুষগুলো দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, মিসর থেকে লাখো মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। কিছু মানুষ আবার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পথে পথে দিন কাটাচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালেই প্রায় চার কোটি উদ্বাস্ত্ত পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন – জার্মানি, গ্রিস, ফ্রান্সে তিন লাখ উদ্বাস্ত্ত আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর পূর্ববঙ্গ থেকে 888sport free betলঘু সম্প্রদায়ের আগমন পশ্চিমবঙ্গে থামেনি। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আন্দোলিত হওয়া ঘটনার মধ্যে একটা রোহিঙ্গা উদ্বাস্ত্ত সমস্যা। পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আরিয়ান জনগোষ্ঠী। প্রাচীন আরকানিরা তাদের বাসভূমিকে বলত ‘রখইঙ্গ’। এই শব্দটি কালক্রমে মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখায় ‘আরখং’ বা ‘রাখাংগ’-এ পরিণত হয়। এভাবেই এই ‘রাখাংগ’ বা ‘রাখাইন’ শব্দ থেকে রোয়াং হয়ে রোহিঙ্গা শব্দের উৎপত্তি। এই রোহিঙ্গাদের ওপর ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে বার্মিজ (মিয়ানমার) সেনাবাহিনী সামরিক অভিযান চালায়। ১৯৮২ সালে বার্মিজ নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে এদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। ১৯৯২ সালের সামরিক অভিযানে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা 888sport appsে আশ্রয় নেয়। এরপর সবচেয়ে বড় ধরনের জাতিগত সংঘর্ষের কারণে সামরিক অভিযানের শিকার হয়ে ২০১৬ সাল থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা 888sport apps, ভারত বা পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের মতে, বর্তমানে রোহিঙ্গা সবচেয়ে নিগৃহীত 888sport free betলঘু সম্প্রদায়। অমানবিক উদ্বাস্ত্ত জীবন কাটাচ্ছে তারা।

উদ্বাস্ত্ত জীবনের প্রতিফলিত জীবনচিত্র ঋত্বিক ঘটকের মতো আরো অনেক নাট্যকারের কলমে উঠে এসেছে। সবচেয়ে আলোড়িত করেছিল সলিল সেনের (১৯২৪-৯৮) নতুন ইহুদি (১৯৫৩) নাটকটি। দেশভাগের কারণে প–ত মনমোহন ভট্টাচার্য দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে নিজের পরিবারকে সংগঠিত করতে পারেনি। মেয়ে-পুত্রের কারো জীবন বাঁচাতে পারেনি। নিজেও ধুঁকে ধুঁকে জীবন বিসর্জন দিয়েছে। জ্যোতু বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯২৮-২০০৫) মুছেও যা মোছে না (১৯৬৫) নাটকে দেশত্যাগের সময় ধর্ষিত উদ্বাস্ত্ত 888sport promo code সমাজের উপেক্ষা বিরুদ্ধে স্বাধিকার অর্জনের লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে। ঋত্বিক ঘটকের (১৯২৫-৭৬) জ্বালা (১৯৫০) নাটকে উদ্বাস্ত্ত মানুষগুলো জ্বালা সহ্য না করতে পেরে একে একে পাড়ি দিয়েছে পরলোকে। যুগ যুগ উদ্বাস্ত্ত সংকট ঘটে চলেছে সারাবিশ্বের নানা প্রান্তে।

 

তথ্যসূত্র

১।  রথীন চক্রবর্তী-সম্পাদিত, ঋত্বিক ঘটকের নাটকসমগ্র, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি,  প্রথম প্রকাশ, ২০০৮, পৃ ৩২।

২।   ঋত্বিক ঘটক, দলিল, উৎসর্গপত্র, গণনাট্য নিউ মাসেস পাবলিকেশন, পৃ ১।

৩।  রথীন চক্রবর্তী-সম্পাদিত, ঋত্বিক ঘটকের নাটকসমগ্র, পশ্চিমবঙ্গ   নাট্য   আকাদেমি, দলিল    নাটকের   ‘প্রসঙ্গত’  শীর্ষক    ভূমিকা।

৪।   তদেব, পৃ ৯১।

৫। তদেব, পৃ ৯৩।

৬। তদেব, পৃ ৯৪।

৭।   প্রফুলস্ন রায়, কেয়াপাতার নৌকা, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, অখ- সংস্করণ ২০০৪, পৃ ৪৫৭।

৮। তদেব, পৃ ৪৯৫।

৯।  রথীন চক্রবর্তী-সম্পাদিত, ঋত্বিক ঘটক নাটকসমগ্র,  পশ্চিমবঙ্গ নাট্য
আকাদেমি, প্রথম প্রকাশ ২০০৮, পৃ ১০৪।

১০। তদেব, পৃ ৯৬।

১১। তদেব, পৃ ১০৬।

১২। তাপস ভট্টাচার্য, বাংলা 888sport alternative linkে উদ্বাস্ত্ত জীবন, পুস্তক বিপণি, প্রথম প্রকাশ ১৪১১।

১৩। তদেব, পৃ ৩৮।

১৪। ঋত্বিক ঘটক, দলিল, গণনাট্য নিউ মাসেস পাবলিকেশন, ভূমিকা
অংশ। r