মীনাক্ষী সেন
আমার বাবাকে আমার মনেই নেই।
অথবা যতটুকু মনে পড়ে তা মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে।
একটা মানুষ, বিরল প্রতিভা, অতল স্নেহ, অসীম সাহস আর স্বপ্নময়। কিন্তু বাবা যে নেই আমার জীবনে, সেই বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে সত্য একটাই যে, মা-ই আমার জীবনে সবকিছু। আমাকে কোলে করেছে, বড় করেছে, গুনগুন করে ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়েছে, গরাস মেখে ভাত খাইয়েছে, আঙুল ধরে চলতে শিখিয়েছে। হাত ধরে অ-আ-ক-খ বা, এ-বি-সি-ডি। আমার জন্য পয়সা রোজগার করেছে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে, শাসন করেছে, আদর করেছে আর কী যে করেছে তা যে জানে সে জানে।
– এসবই তোর বাবার জন্য। সে তোকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। তাই তোর জন্য সবকিছু করার শক্তি পাই আমি।
মা বলতো। তবে, এর বেশি কিছু নয়। মোট কথা, আমাদের মা-ছেলের সংসারে বাবা না থেকেও সর্বদা উপস্থিত থাকতো। মায়ের হঠাৎ বলা কোনো কথায়, কিংবা মায়ের না-বলা কথাতেও বাবা থাকতো।
আমার কাছে অবশ্য মা-ই ছিলো সবকিছু। কিন্তু যেহেতু মায়ের কাছে বাবা ছিলো বিশাল কিছু। তাই আমিও সেই বিশালত্বের ছায়ায় বড়ো হয়েছিলাম।
– কিন্তু বাবা ঠিক কী চাইতো আমার কাছে? আমি কেমন হলে বাবা খুশি হতো?
আমি জিজ্ঞাসা করলে মা বলতো – নিজের চাওয়ার বোঝা ছেলের ওপর চাপিয়ে দেবে, তোর বাবা এমন মানুষ ছিলো না। তোর বাবা কেবল চাইতো তুই মানুষের মতো মানুষ হ। যারা সত্যিকারের মানুষ তারা নিজেরাই চিনে নেয় কোন পথে চলতে হবে…।
এসব কথাবার্তার মধ্য দিয়েই আমি বড়ো হলাম। টের পেতাম, মায়ের চোখের আলো ক্রমশ নিভে আসছে। হয়তো যাকে ‘মানুষের মতো মানুষ হওয়া’ – মা ভাবতো, আমি তেমনটি হচ্ছিলাম না। তবে এ নিয়ে কোনো অনুযোগ-অভিযোগ মায়ের মুখে শুনিনি।
এভাবেই আমি একদিন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হলাম। পড়াশোনায় সেরা হয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ভালো কলেজে সুযোগ পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারিনি আমি। মা টাকা-পয়সা খরচ করে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়িয়ে আমাকে ইঞ্জিনিয়ার করেছিল।
আমি মায়ের অল্প বয়সের সন্তান। কিন্তু আমি যখন পাশ করলাম, আমার মায়ের স্বাস্থ্যে তখনই ভাঙনের লক্ষণ। আমি তাই মাকে ছেড়ে দূরে কোথাও চাকরি নিয়ে গেলাম না। মা অবশ্য বারবারই বলতো – তোর জন্য তো রাজার খাজনা নেই। রোজগার করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠ। তার জন্য যেখানে যেতে হয়, যাবি বইকি। আমি মায়ের কথায় কর্ণপাত করিনি। মা তার চারপাশের সঙ্গে নানা কাজের মাধ্যমে এমনভাবে জড়িয়ে ছিলেন যে, মাকে অন্য কোথাও নিয়ে গেলে মা ভেতরে ভেতের শুকিয়ে যেতো। আর আমার মতো প্রাইভেট কলেজের ইঞ্জিনিয়ারের জন্য ভালো কোনো চাকরি আমি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি পাচ্ছিলামও না। ফলে আমি মায়ের সঙ্গে ঘরে বসে বেকার জীবনই কাটাচ্ছিলাম। মায়ের রোজগারের টাকায় মা-ছেলের দিন চলে যাচ্ছিলো। তারপর একদিন যে বিপর্যয়ের জন্য আমি আমার মনকে কখনোই রাজি করাতে পারিনি, সেই ঘটনাই ঘটে গেল, মা মারা গেলেন।
পাগল-করা শোকের সঙ্গে এক বন্ধন মুক্তির গোপন আনন্দও কি ছিলো না? কে জানে, মানুষ কবেই বা নিজেকে ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছে?
আসলে মা বাদে আমার আর কোনো আপনজনই ছিলো না। এ নিয়ে প্রায়ই আমি মাকে প্রশ্ন করতাম – মা, সবারই তো মামা, কাকা, নিজের না হোক খুড়তুতো, মামাতো, পিসতুতো ভাইবোন থাকে, আমার কেউ নেই?
– আছে কেন থাকবে না। আমার আত্মীয়স্বজন কি কম আছে। মা তার গর্বিত গ্রীবা উঁচু করে বলতো – কিন্তু তারা কেউ তোমার বাবার বা আমার আত্মীয় হওয়ার যোগ্য নয় বলেই তোমাকে কাছে টানতে পারেনি।
– তাহলে আমার কি কোনো আপনজনই নেই?
– কেন থাকবে না? এই যে তুমি বড় হলে, শর্মী মাসি, উমি দিদি, শুক্লা পিসি, রাতুল ভাইয়া, এরা না থাকলে হতে পারতে এতটা বড়?
– না, মানে ওরা তো ঠিক আত্মীয় নয়। আমি তর্ক জুড়তাম।
– আপনজন নিশ্চয়ই।
– এ-যুগে আত্মীয়তা আর রক্তের সম্পর্কে হবে না, উত্তরাধিকারসূত্রেও নয়। এ-যুগের আত্মীয়তা একই ধরনের মন-মানসিকতা যাদের, তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। সেই সূত্রেই তোমার জ্বর হলে শর্মি মাসি নিজের সব কাজ ফেলে, বাড়ি ছেড়ে আমার সঙ্গে রাত জেগে তোমার মাথায় জল ঢেলেছে। শুক্লা পিসি পথ্য বানিয়ে এনে দিয়েছে, উমি দিদি তোমায় বেচাল দেখলে শাসন করেছে আর অপর্যাপ্ত আদর, প্রশ্রয়ও দিয়েছে, রাতুল ভাইয়া তোমার খেলার সঙ্গী হয়েছে –
– তবু…
আমি খুঁতখুঁত করলে মা আমার দিকে অদ্ভুত, কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলতো – আছে। তোমার একেবারে নিজের লোকেরা, সবাই আছে, হয়তো তোমার কাছে নেই, কিন্তু আছে, জীবনে কখনো না কখনো, তোমার সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
তা, মা চলে যাওয়ার পর, আপনজনের অভাব হলো না ঠিকই। এত মানুষ আমার পাশে জড়ো হলো, এত কান্না, শোক, আমার মায়ের জন্য, আমার জন্য এত শুশ্রূষা, সান্ত্বনা, সাহায্য যে, এক সময় আমি বিহবলতা কাটিয়ে উঠে সংযত হলাম, সবাই বললো আমি নাকি তিনদিন – মা, মা, মা বলে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম, দিনরাতের জ্ঞান ছিলো না। পরে শান্ত হলাম। ওই যে বললাম, আর কোনো বন্ধন নেই জীবনে, নোঙর উঠে ভেসে গেলাম অকূলে, মুক্ত, এমন অনুভবও ছিলো। তারপর সম্মুখীন হলাম বাস্তবের। মা নেই মানে মায়ের রোজগার নেই। আমার বয়স পঁচিশ ছাড়িয়েছে, কাজেই ফ্যামিলি পেনশনও পাবো না। তবে খাবো কী? তখন একটু ঘোরাঘুরি, দরখাস্তটাস্ত করে বেশ সহজেই একটা চাকরি পাওয়া গেল। তেমন আহামরি কোনো চাকরি নয়। পোস্টিংও দূর মফস্বলে, তা, কী আর করা। আজকাল আমার মতো সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা মাথায় ইট পেতে ফুটপাতে শুয়ে থাকে, প্রাইভেট ও গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউশন থেকে শয়ে শয়ে এতো এতো ইঞ্জিনিয়ার প্রোডাকশন হচ্ছে। আই-আইটি বা তুল্যমূল্য ড্যাম-গুড ইনস্টিটিউশনের পাশ-আউট না হলে ফ্যাট স্যালারি মেলে কই?
তা যা পেলাম, তা-ই সই। পেট চলে যাবে। মেদিনীপুরের কোনো এক মফস্বল গ্রাম্য গঞ্জ-শহর বলা যায়। সেখানে একটা কোল্ডস্টোরেজ হবে, সেটার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকতে হবে, তদারকি করতে হবে অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ার টু লেবার সুপারভাইজার সবকিছুর কাজই।
চাকরিটা পেয়ে সবচেয়ে বড় স্বস্তি হলো এই ভেবে যে, সর্বক্ষণ মায়ের 888sport sign up bonus ও কথার সঙ্গে জড়িত যে-বাড়ি যে-জায়গা, সেখান থেকে দূরে যেতে পারবো। মনে হলো, অসহ্য এক মনভার মনকে যে সবসময় পীড়িত করছে, তার থেকে রেহাই মিলবে।
বাবা যেমন না থেকেও সব সময় আমাদের সঙ্গে থাকতো, সেভাবেই মা-ও আমার সঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলো, ফলে মায়ের শাসন, অনুশাসন, স্নেহ, যত্ন ও 888sport sign up bonus কোনো কিছুর বাইরে যেন যেতে পারছিলাম না। মনে হলো অনেক দূরে, এক অজানা-অচেনা পরিবেশে আমি বাবা, মা, সবার 888sport sign up bonusভারমুক্ত এক স্বতন্ত্র মানুষ হয়ে উঠতে পারবো আর মাতৃহারা হওয়ার ওই অসহ্য মনোবেদনা থেকেও মুক্তি মিলবে।
আবাল্যের বাসস্থান ছেড়ে, ঘরদোরে তালাচাবি মেরে বেরিয়ে পড়লাম কর্মস্থলের উদ্দেশে। অনেকদিন পর, মনে খানিকটা তাজা বাতাস ঢুকলো যেন, তারপর মায়ের কাছ থেকে দূরে যেতে গিয়ে মনে হলো মায়ের সেই স্নেহকাতর চোখের কোমল মায়ায় যেন জেগে উঠেছে পরিতৃপ্তি। আমি স্বাবলম্বী হবো, মায়ের রোজগারের ওপর নির্ভর করবো না, আয়েশ তো নয়ই – মায়ের বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল।
– আঃ মা। চলেই যখন গেছ আমায় রেখে, একেবারে যাও। এভাবে বারবার মনে আসো কেন? সারাজীবন তো আমায় টানলে, এবার বিশ্রাম নাও। আমি ক্লান্ত স্বরে মাকে বললাম। তারপর আমার গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম।
দুই
যে গঞ্জ-শহরটায় এসে আমি পৌঁছলাম তার চারদিকে ক্ষেত। শহরের মধ্যখানের বসতি অঞ্চলটা, শুনলাম সবচেয়ে পুরনো। শেষের দিকের বাড়িগুলো তৈরি হয়েছে অনেক পরে। অবশ্য বসতিটির প্রান্তঘেঁষা কিছু বাড়িও পুরনো দিনে তৈরি।
এই শহরটি তেমন শহর নয়, যার প্রান্তে রয়েছে গ্রামের কুটির বা ঝুপড়ি। এ-শহরটির চারদিকে প্রায় আট-দশ মাইল জুড়ে ছড়ানো ক্ষেত। তারপরই শুরু হয়েছে গ্রাম।
অবশ্য এই গঞ্জ-শহরটিকেও আমার গ্রামের মতোই লাগছিল, আর এই কারণেই আমি সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়লাম আমার বাসস্থান নিয়ে। এমনিতেই আমি একটু একলা একলা থাকতে পছন্দ করি, আর এরকম গঞ্জ-শহরে সকলেরই শহর থেকে আসা ‘ইঞ্জিনি’ সাহেবের প্রতি গভীর কৌতূহল। হ্যাঁ, সংক্ষেপে এই নামেই ওরা আমায় ডাকতো। এই অহেতুক কৌতূহলের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ছিল নিরিবিলি একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা। কিন্তু তেমনটি মেলা দায় হয়ে উঠলো। এখানে ঘরভাড়া পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়, তবে সেসব ঘরই বাড়িওয়ালার ঘরের লাগোয়া। কিছু বাড়ি, বাড়িওয়ালার ভাষায়, ‘মাড ওয়াল, ফ্লোর পাক্কা; ল্যাট্রিন, বাথরুম আছে’ – তবে সেগুলো ঘরের বাইরে, ল্যাট্রিনে যেতে হলে রিকশা চড়তে হবেও বলা যায়।
কোনো কোনো বাড়িতে ল্যাট্রিন থাকলেও বাথরুম বলে কিছু নেই। স্নান করতে হবে খোলা কলতলায়। বাকি যেসব বাড়ি পাকা, ল্যাট্রিন বাথরুম অ্যাটাচড, না হলেও ঘরের সঙ্গেই – সেগুলো সব বাড়িওয়ালার পরিবারের সকলের সঙ্গে ভাগ করে ব্যবহার করতে হবে। সাময়িকভাবে এমনই একটি বাড়িতে ঘরভাড়া নিয়ে উঠলাম বটে কিন্তু সেখানে বসবাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠলো। বাড়িটা পাকা বাড়ি হলেও রান্নাঘরটা ছিল বেড়ার আর ঘরের বাইরে। উঠোনের পাশে। রান্নাঘরটার মধ্যখানে একটা বেড়ার পার্টিশন, ওধারে বাড়িওয়ালির রান্নাঘর।
মায়ের সঙ্গে একা একা বড় হওয়ায় আমি রান্নাবান্না জানতাম ও নিজেরটা নিজেই করতাম। তা, একদিন রান্না করছি তো বাড়িওয়ালি ওধার থেকে তার বাপের বাড়ি বেড়াতে আসা ছোটো মেয়েকে বলতে শুরু করলেন – এভাবে ছেলেটা হাত পুড়িয়ে খায়। আমাদের রমাটা তো… খুব মানাবে দুটিতে ইত্যাদি।
রমা ওনার ছোটো বোনের ‘সর্বসুলক্ষণযুক্ত’ কন্যা, এও জানলাম।
এভাবে কোনোদিন বিয়ের সম্বন্ধ, কোনোদিন হয়তো আনাজ কাটতে ছুরি ব্যবহার করছি দেখে করুণা-পরবশ বাড়িওয়ালির নাতনি এলো আনাজ কুটে দিতে। ওদের কাছে ছুরি দিয়ে আনাজ কাটা তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছার মতোই। শেষে রান্নাবান্না করা ছেড়ে দিয়ে আমি হোটেলে খাওয়া শুরু করলাম। তবু ব্যক্তিগত বলে আর কিছু থাকল না এমন একটা অবস্থা। আমি প্রাণপণে নিরালা, একটেরে, নিভৃত একটা বাড়ি খুঁজছিলাম, এমন বাড়ি, যে-বাড়িটা পুরোপুরি থাকবে আমার দখলে, অন্য কেউ থাকবে না সেখানে।
এইরকম একদিন কাজের জায়গা থেকে ফিরতে ফিরতে দেখছিলাম একটা যাত্রীবোঝাই টেম্পো কীভাবে পদ্মফুলের মতো ফুটে উঠেছে ঝুলন্ত যাত্রীদের এবড়ো-খেবড়ো ভিড়ে। গ্রামের দিক থেকে যাত্রী নিয়ে ওটা শহরে পৌঁছালো। দেখছিলাম সাইকেল নিয়ে লোকেরা যাচ্ছে, কেউ একা একা লম্বা লম্বা পায়ে রাস্তায় হাঁটছে আর ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে পুরো পশ্চিম আকাশজুড়ে। এমন সময় পথের একধারের একটা বাড়িতে চোখ আটকে গেল।
একদম একা একা বাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিলো। মস্তবড় একতলা একটা বাড়ি। নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, মস্ত বড় লোহার গেট কিন্তু উদোম করে গেটের দুটো পাল্লাই খোলা। চারদিকে, বাড়িটার গায়ে পর্যন্ত আগাছার জঙ্গল।
– আরে, এ-বাড়িতে কোনো মানুষজন থাকে না মনে হচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে আমি নিজের অজান্তে বাড়িটার খোলা গেট পেরিয়ে ভেতরে। মস্তবড় বাড়ি। দরজা-জানালা, কপাট সবকিছুতে সাতপুরু ধুলা কিন্তু ধুলার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে আভিজাত্য। লাইন করে পাথরের ওপর কাঠের থাম বসানো, কড়িকাঠ, দরজা-জানালা সব কাঠের এবং কালো কুচকুচে। এখন যদিও ধুলা, মাকড়সার জালে 888sport app।
বাড়িটার সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কেউ যেন গাঢ় গভীর স্বরে ডাকলো – এসো।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চৌকাঠে পা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। চমৎকার বাড়ি, বাড়ির ভেতরে সবকিছু আছে, যা আমার চাই, অনেক বেশি কিছুও আছে, যা অবশ্য আমার চাই না।
মানি যে, কাজটা বোকার মতো হয়েছিলো, কেননা, গোটা বাড়িটা আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম।
– করেছেন কী? পুরনো বাড়িতে ‘ইঞ্জিনি’ সাব, কত সাপখোপে ঘোরে জানেন না?
আমার বাড়িওয়ালা রেগে বললেন, শাসনের সুরে। আসলে আমি অন্য বাড়ি ভাড়ার জন্য খুঁজছি জেনে তিনি অসন্তুষ্ট।
আমি দুঃখ ও আতঙ্ক (সাপের জন্য) প্রকাশ করেও বললাম – ওই বাড়িটা আমার লাগবে। আমি ওটা ভাড়া চাই।
– আপনার মাথাটা বিগড়ে গেছে। বলে বাড়িওয়ালা রণে ভঙ্গ দিলেন। আমি দিলাম না। ইতোমধ্যে শহরের একটা ছোট্ট হোটেলে আমি ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম। বাড়িওয়ালা পেয়িং গেস্ট থাকার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, আমি রাজি হইনি। কে জানে, শেষে ভাগ্নি কিংবা ভাসুরঝি কাকে ‘গলায় ঝুলিয়ে’ দেওয়ার চেষ্টা নেন। ভাগ্যিস ওনার একটিই মেয়ে এবং সে বিবাহিত।
যাই হোক, সেদিন দুপুরে হোটেলে ভাত খেতে খেতে আমি হোটেল মালিককে জিজ্ঞেস করলাম – দক্ষিণ দিকে, অশ্বত্থগাছটার ধারের ওই পরিত্যক্ত বাড়িটা কাদের?
– কোন বাড়িটা?
হোটেলমালিক প্রশ্ন করায় আবার বুঝিয়ে বললাম।
– ও হো। আর বলতে লাগে না, বুয়েচি।
হোটেল মালিক ঠোঁট মচকালেন।
– আরে ও-বাড়িটার মালিক তো গত হয়েছেন। ছেলেমেয়েরা কেউ কলকাতা, কেউ বোম্বে, কেউ আমেরিকা।
– তাই নাকি? শুনে আমি আরো খুশি।
– তা-বাড়িটা এমনই পড়ে থাকবে? মালিকেরা কি বিক্রিও করবেন না, ভাড়াও দেবেন না?
– আরে পাঁচ ভূতে মালিক। বিক্কিরি কে করবে? তবে ভাড়া দিতে চেয়েছিলেন। মালিকের কলকাতার ছেলে তন্ময়বাবু। তা ও-বাড়ি কে ভাড়া নেবে মশাই? চাবি তো আমার কাছেই পড়ে আছে। এদিকে ভাত-খাবার ভালো হোটেল তো মশাই আমারই। শওর থেকে চাগরি করতে লোক এলে একানেই খায়, তাই চাবি আমার কাছেই। তারপর মালিক গলা নিচু করলেন।
– কিন্তু ও-বাড়িতে কে থাকবে মশাই।
– কেন বলুন তো? আমি প্রশ্ন ছুড়লাম।
– কেন মানে? জানেন ও-বাড়িতে ভূত আছে?
– ভূত?
– হ্যাঁ, ভূত। অপমৃত্যুর ভূত। লোকে সে-ভূতের ভয়ে ও-বাড়িতে ঢোকে না পর্যন্ত, ঢোকে কেবল গরু-ছাগল আর আপনি ও-বাড়ি ভাড়া নেবেন?
মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেশ একটা একলা থাকার উপযুক্ত নিরিবিলি পাকা বাড়ি, লাগোয়া ঘর বারান্দা বাথরুমসহ পাওয়া যেত, বাড়িওয়ালা থাকে না, বাড়িওয়ালি নেই, কেউ উলটোপালটা কিছু প্রশ্ন করে আমার একলা জগতে ঢুকে পড়তো না। এর মধ্যে ভূত এসে ঢুকে পড়লো কেন!
দু-চারদিন মন খারাপ করে এধার-ওধার খোঁজখবর করতে শুরু করলাম।
প্রথম ধরলাম আমার কোম্পানির লোকাল এক স্টাফকে।
– সমাচারটি আপনাকে কে দিলো?
মধ্যবয়সী এই স্টাফটি ‘ইঞ্জিনি’ সাহেব বলে আমাকে কোনোদিনই পাত্তা দিতেন না, এক বেকুব ছেলেছোকরা যেন আমি, এমন হাবভাব, তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
আমি হোটেল মালিকের কথা বললাম।
– ওহ! তা ও তো বাড়ি-মালিকের সম্পর্কে ভাতিজা। ও তো ভুল বলবে না। তা ও-বাড়ি ভূতের হোক বা প্রেতের। আপনার তাতে খোঁজখবর কেন?
– আমি ও-বাড়িটা ভাড়া নিতে চাই?
– অাঁ। ওই ভূতের বাড়ি। কভি নেহি। আপনার মা-বাপ সঙ্গে নেই বলে কি আমরা নেই? ওই ভূতের বাড়িতে আপনাকে থাকতে পাঠাবো? যে-বাড়িতে আছেন অসুবিধা হলে বলবেন। আমার দাদার বন্ধুর বাড়িতে আপনি থাকেন। সেই সূত্রেই তো আপনাকে বাড়িটা খুঁজে দিলাম, দাদাকে বলবো বলতে –
– আরে না, না।
আমি শশব্যস্ত হলাম। বাড়িওয়ালা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার তো করে না, এই মাতববর আবার কী বলতে কী বলে বসবে বাড়িওয়ালাকে, কে জানে। অতঃপর রাত্রিবেলা সেদিন নিজে থেকে বাড়িওয়ালার ঘরে গেলাম। চা-বিস্কুট-জল খেলাম। বাড়িওয়ালি আম কেটে দিয়েছিল, খেলাম না। প্রশ্ন করলাম, বাড়িটার বর্ণনা দিয়ে – ও-বাড়িতে বুঝি ভূত আছে?
– ভূত মানে ভূত। প্রতি রাতে দরজা-জানালা সব খট্খট্ করে খোলে, বন্ধ হয় আপনা-আপনি। তারপর ঘরের চেয়ার-টেবিল তুলে কে যেন আছড়ায়। শেষে গুলির শব্দ … চিৎকার … রোজ রাতে। শুনে আমার মনটা দমে গেল। আমি তো রক্তমাংসের মানুষ, ভূতে আমার যথেষ্ট ভয় আছে। মা ছিলো সাহসী। আমার ভূতের ভয় দেখে হেসে খুন হতো কিন্তু আঠারো-কুড়ি বছর পর্যন্ত রাতে, ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে গেলে মাকে দাঁড়াতে হতো, ঘুম থেকে উঠে। সেই আমি জেনেশুনে ভূতের বাড়ি কী করে থাকবো। বাড়িওয়ালা ওদিকে ভূতের কান্ডকারখানার বর্ণনা শেষ করে জিজ্ঞেস করলেন – তা হঠাৎ ও-বাড়ির খোঁজ?
– এমনিই।
আমি হালকাভাবে বললেও বাড়িওয়ালা হালকাভাবে নিলেন না।
– বুঝেছি। এ-বাড়িতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে। বাড়িভাড়া খুঁজছেন?
তারপর আমাকে নিবৃত্ত করার জন্যই বোধহয়, ওনার মোটা অঙ্কের বাড়িভাড়াটা বেহাত হওয়ার ভয়ে মরিয়া হয়ে বললেন – তা পছন্দ হলে যান না ও-বাড়িতে। যে সে ভূত নয়, নকশাল ভূত আছে ও-বাড়িতে, বুঝলেন? আমি চমকে উঠে বাড়িওয়ালার দিকে চাইলাম। বাড়িওয়ালা গলাটা নামিয়ে নিলেন, যেন নকশাল নাম উচ্চারণ করলেই ওনাকে পুলিশে ধরবে।
– একটা জলজ্যান্ত ছেলে মশাই, সিআরপি গুলি করেছিলো ও- বাড়িতে। মায়ের কাছে শুনেছি। আমি তো তখন ছোট। এ-অঞ্চলে নকশাল আন্দোলন তো খুব ছড়িয়েছিল সত্তরের শুরুতে। শহর থেকে সব শিক্ষিত অল্পবয়সী ছেলে আসতো, চাষিদের ঘরে থাকতো। তাদের সঙ্গে একবেলা খেতো কি না খেতো – চাষিদের মাথাটা চিবিয়ে খেত। কি সব, দাঁড়ান, আমিও শুনেছি – ‘খতম অভিযান জিন্দাবাদ, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা, মাও সে -’
আমি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমার ভয় কেটে গেছে। আমার মা তার কৈশোরে ছিলেন নকশাল, জেলে ছিলেন ছয় বছর, আমার বাবাকে নকশাল বলে পুলিশ গুলি করে মেরেছিলো, আমি নকশালদের ভয় করবো কেন? সে ভূত হলেও? তাও আবার পুলিশের গুলি খাওয়া বিপ্লবী ভূত? বিপ্লবীদের ভয় পাওয়া আমার সাজে না। তাছাড়া আমার একটা গোপন অ্যাজেন্ডা আছে একা থাকতে চাওয়ার পেছনে। আমি মায়েদের কৈশোর, যৌবন, জেলবাস, বিপ্লবের স্বপ্ন ও সেই সময় নিয়ে একটা 888sport alternative link লিখতে চেয়েছিলাম।
মা বলতো আমার লেখার হাত নাকি চমৎকার, আর ইংরেজিটা আমি লিখতেও পারতাম, তাই চুপিচুপি, একা বসে একটা 888sport alternative link লিখবো, এ-ইচ্ছেও ছিলো। সে-888sport alternative link লেখার জন্য ওই বাড়ির চেয়ে উপযুক্ত জায়গা আর কি-ই বা হতে পারে। কাজেই আমি উঠে পড়লাম। ঘরে গিয়ে শান্তিতে ঘুমোলাম। আর সকাল হতেই বেরিয়ে পড়লাম ভাতের হোটেল মালিকের সন্ধানে।
ভদ্রলোক সবে তখন দোকান খুলেছেন। দুজন কর্মচারী হোটেল সাজাচ্ছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন :
– এই সাত-সক্কালে?
– ওই বাড়িটা ভাড়া নেব। আপনি আমার মোবাইল থেকে মালিকের কলকাতার ছেলের সঙ্গে কথা বলে নিন।
তিন
বাড়িটা পরিষ্কার করতে সময় লাগলো। কলকাতার মালিকের ছেলের সম্মতি পেয়ে চারজন লেবার লাগিয়ে সে-কাজটাও করে নিলাম। জঙ্গল সাফাই হলো। গোটা বাড়ি ঝাড়পোছ হলো। কার্বলিক, ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হলো, ফিনাইল, লাইজলে মোছা হলো। তারপর দুটি ঘর, রান্নাঘর ও একটি লাগোয়া বাথরুমের দখল নিয়ে বাকিঘর আবার তালাবদ্ধ হলো।
ইতোমধ্যে গ্রামের যে দু-তিন জায়গায় আমার যাতায়াত, সেসব জায়গা থেকে, কোল্ডস্টোরেজের জন্য যারা কাজ করছেন, তাদের কাছ থেকে আমি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জেনে নিয়েছি।
এ-অঞ্চলে নকশাল আন্দোলন খুব ছড়িয়েছিল। শহর থেকে অনেক ছেলেই এসব এলাকায় এসে গরিব চাষি বা ক্ষেতমজুরদের ঘরে থাকতেন। মেদিনীপুরের এ-অঞ্চলটা বাকি পশ্চিমবঙ্গ থেকে কিছু আলাদাও। পশ্চিমবঙ্গে সে-সময় খুব ধনী ও প্রচুর জমির মালিক, যাদের ‘জোতদার’ বলা যায়, হাত গুনলে কয়েকজন হয়তোবা পাওয়া যেত। মেদিনীপুরের এ-অঞ্চলে কিন্তু কয়েকজন সত্যিকারের বড় জোতদার ছিল।
তা নকশাল ছেলেরা এসে চাষিদের ঘরে আশ্রয় নিতে এরা ভয় পেল। তারপর, এ-শহরে না হলেও কাছাকাছি গ্রামে একজন জোতদার খুন হলো। যাকে ওরা বললো – ‘খতম’। সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে সিআরপি, পুলিশে ছয়লাব গোটা এলাকা।
এ-শহরটা তখন তাকতও হয়নি, একটু সমৃদ্ধ কিন্তু প্রায় গ্রামই ছিল। এখানে এক গরিব দিনমজুরের বাড়িতে ছেলেটা থাকতো। পুলিশ কী করে যেন খবর পেয়ে সিআরপি নিয়ে ঘিরে ফেলে বাড়ি। বাড়ির মেয়েরা খিড়কি দিয়ে ছেলেটাকে বের করে দিলেও সিআরপি দেখতে পেয়ে তাড়া করে। ছেলেটা অনেকদিন এলাকায় ছিল। এ-এলাকার মানচিত্র তার নখদর্পণে। সে বোধহয় কাউকে বিপদাপন্ন করতে চায়নি বলেই দৌড়ে এই পরিত্যক্ত বাড়িটায় ঢুকবে ভেবেছিল। এ-বাড়িটা তখন পোড়োবাড়ি নয়। কলকাতার মালিকটি প্রায়ই এ-বাড়ি এসে থাকতো। সেদিন কেউ ছিল না, সদরে তালা থাকলেও গেট খোলা ছিল, ছেলেটি যখন গেট দিয়ে দৌড়ে ঢুকছে সিআরপি পেছন থেকে গুলি করে ছেলেটাকে ফেলে দেয়, একটা নয়, কয়েকটা গুলি…
এসব কাহিনি টুকরো টুকরো এদিক-ওদিক থেকে শুনেছি। বিস্তারিত বলেছিল চরণ। আমার চুল কাটতো যে-বৃদ্ধ, সে। এসব তার সচক্ষে দেখা।
– আহা, কিসব ছেলে ছিলো গো। তখন আমি জোয়ান ব্যাটা, ছেলেটা তো একেবারে কচি। কীভাবে তাকে গুলি করে ফেললে –
চরণ এখনো বলতে বিহবল হলো।
– তুমি কি ওদের, মানে নকশালদের সাপোর্টার ছিলে নাকি?
আমি নাক মুছে জিজ্ঞেস করলাম।
– না গো ইঞ্জিনি সাব। আমি তো তখন এই দোকান খুলবো, বাপ মরেচে, পেটের ধান্দা নিয়ে ব্যস্ত, এসব গোলমালকে ডরাতাম খুব; কিন্তু ছেলেগুলান যে খুব ভালো, তা আমরা সকলে জানতাম গো।
চরণ বললো।
আমি যেদিন এ-বাড়িতে এলাম, আমার পুরনো বাড়িওয়ালা টিপ্পনি দিয়ে বললো – আপনের ঘর আপনেরই থাকলো। ও-বাড়িতে ডরালে ফিরে এসেন।
আমি সহজভাবে বললাম – আচ্ছা।
তারপর বাড়ির সদর গেটের ডানদিক দিয়ে সন্তর্পণে আমার ব্যাগট্যাগ নিয়ে ঢুকলাম। ব্যাগগুলো উঠোনে নামিয়ে রেখে বাঁ-পাশের মাটিতে হাত ঠেকিয়ে মাথা ছুঁলাম আর ধীরে ধীরে বললাম, নকশালকাকু তুমি রাগ করো না। আমি তো আগে জানতাম না, কোথায় তোমাকে ওরা গুলি করে ফেলেছিল, তাই দুপদাপ করে মাড়িয়ে ঢুকেছি। এখন থেকে আমি কেবল ডানদিক দিয়েই ঢুকবো।
কাজটা করে আমার একটু হাসিও পেল। আমি কাউকে প্রণাম করি না। মা করতে বললে বলতাম – ‘ওসব পা ছোঁয়ার ব্যাকডেটেড রীতির প্রতি তোমার টান দেখে অবাক হই।’ মা যেখানেই থাক, আমার এই কর্ম দেখে ফিক করে হেসেছে হয়তোবা।
তারপর ঘরে ঢুকলাম। একটা শোবার ঘর বানিয়েছিলাম, একটা পড়ালেখার। ঘরটর গোছাতে আমি পটু। সব গোছগাছ করে নিলাম।
বাড়িতে রান্নাঘর থাকলেও খাওয়াটা হোটেলেই করবো ঠিক করলাম। ওতে একটা জনসংযোগ হয়। তাছাড়া রান্না মানে বাজারহাট, এসব ঝামেলার সময়ই বা কই। সকাল থেকে সন্ধ্যা তো সাইটেই কাটে। কখনো-সখনো ম্যাগি বা ওমলেট ভাজার ব্যবস্থা রাখলাম কেবল, রান্নাঘরে।
রাত্রিবেলা, শূন্যে তাকিয়ে আবার বললাম – নকশালকাকু। তুমি কিন্তু জানালা-দরোজা দুপদাপ, জিনিসপত্র ওলটানো এমন কান্ড করো না। তুমি তো জানো, আমি কত ভীতু। এই সেদিনও মাকে রাতে দাঁড়াতে হতো। মায়ের সঙ্গে যদি দেখা হয়ে থাকে, শুনেছো নিশ্চয়ই। আমাকে ভয় দিয়ো না।
রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটলো। কেবল সেই রাতটা নয়। পরপর অনেক রাত, নির্বিঘ্নে, নিরাপদে কেটে গেল ওই বাড়িতে। না কোনো ভয়-ধরানো ঘটনা, না কোনো শব্দ বা কিছু। ওদিকে কোল্ডস্টোরেজের কাজটাও দ্রুত এগোচ্ছিল। আর লেখার কাজটা চলছিল ধীরে কিন্তু মসৃণভাবে। ফলে আশা হলো চমৎকার এই বাড়িটায় চমৎকারভাবে দিন কাটিয়ে, 888sport alternative linkটাও অনেকখানি লিখে ফেলে কলকাতা শহরের কর্মস্থলে ফিরতে পারবো, যতক্ষণ না আবার পোস্টিং দিচ্ছে অন্য কোথাও, মায়ের বাড়ি থেকে কলকাতা অফিসে যাতায়াত করবো। যখন বাড়িতে ছিলাম, দূরে আসতে চাইছিলাম, এখন দূরে এসে মনে হচ্ছিলো কখন যে বাড়ি ফিরবো। বাড়িতে মা নেই জেনেও নিজের বাড়িটা আমায় আবার টানছিল। মনে হচ্ছিল, 888sport alternative linkটা ওই বাড়িতে গিয়ে আমি আরো ভালোভাবে লিখতে পারবো। সেইসঙ্গে আমার যে আর এই পৃথিবীতে কেউ নেই, এ-কথাটাও বুকে শেলের মতো বিঁধে ছিল। মা যা বলতো তা ঠিকই, বাড়ি ফিরলে মা যাদের আমার আপনজন বলতো তারা সবাই আসবে, সঙ্গ দেবে, সাহায্য করবে, তবু তারা তো কেউ আমার মা নয়, অভিভাবক নয় যে, ছাবিবশ বছরের ছেলে ভুল করলে তাকে চোখ লাল করে শাসন করার অধিকার ফলাবে। কিংবা যার জীবনের ভরকেন্দ্রে থাকবো কেবল আমিই। অন্য কেউ নয়।
এভাবেই ওই ভাড়া পোড়োবাড়িটাতে আমার দিন কেটে যাচ্ছিল দিব্যি। সমস্ত সুবিধার মধ্যে একটাই সমস্যা, মাঝে মাঝেই লোডশেডিং হতো। তখন অত বড় বাড়িটা এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার যে, আমি সব সাহস হারিয়ে ফেলতাম, কেরোসিন-লণ্ঠন একটা ছিল বটে কিন্তু সেটা কখন জ্বলবে, কখন নিভবে ঠিক ছিল না। আসলে কেরোসিন কখন ফুরিয়ে যেত আমার খেয়াল থাকতো না।
অন্ধকার এমন ব্যাপার, তখন ভূত-প্রেত সাপখোপ সবকিছুর ভয় সত্যি হয়ে ওঠে। মুখ হাঁ করে ভয় দেখায়।
আমি সেসব সময় কাতরভাবে বলতাম – নকশালকাকু তুমি আর আমি ছাড়া এ-খন্ডহরে কেউ নেই। আমাকে কিন্তু ভয় দেখাবে না ভুল করেও আর সাপখোপের হাত থেকে বাঁচাবে, নয়তো মাকে বলে দেব কিন্তু। আমার মা কিন্তু কাউকে ভয় পায় না, ভগবানকেও না। আর বকুনি দিতে এক নম্বরের ওস্তাদ বলে দিলাম। তোমার কানের পোকা যখন নড়িয়ে দেবে, বুঝবে তখন মজাটা।
অন্ধকার থেকে কোনো উত্তর আসতো না অথচ আমার মনে হতো ফিক করে কেউ হাসল।
হোটেলমালিক ততদিনে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে। সে বলে, তুমি একটা এক নম্বরের বোকা। ভূত যখন তোমার কাকু, ভয় দেখাচ্ছে না, তখন তাকে বললেই পারো – কাকু কেরোসিন এনে দিয়ে লণ্ঠনটা জ্বালাও না।
আমি রেগে বলতাম – চোপ। নো বাকোয়াজ বন্ধু। আমার কাকুকে আমি কী বলবো, সেটা আমার ব্যাপার।
এভাবে কোল্ডস্টোরেজের কাজ যখন প্রায় শেষ, একটা কান্ড ঘটল। লোডশেডিং হয়েছে, আমি চৌকিতেই পা-টা মেলে বসে আছি চুপচাপ। খেয়ে এসেছি, আলো এলে মশারি ফেলে চারদিকে দেখে শুতে যাবো।
এতবড় বাড়ি, আরামে থাকি বটে কিন্তু লোডশেডিং হলেই সাপখোপের ভয় আমাকে পেড়ে ফেলে। তাই চৌকির ওপরই বসে আছি। আলো এলে মেঝেতে নেমে ঝেড়েঝুড়ে মশারিটা টানাবো এই ভেবে।
এমন সময় মনে হলো পায়ে তীব্র জ্বালা আর ব্যথা করে উঠলো। সরসর করে কী যেন একটা নেমে গেল চৌকি থেকে, তাও মনে হলো।
– সাপ। সাপ, সাপে কাটলো আমায়। আমায় সাপে কামড়েছে।
আমি চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু এই খন্ডহরে, কে শুনবে আমার কথা? আমার কান্না? আমার চিৎকার?
ভয়ে আর যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে আমি বালকের মতো কাতড়ে কেঁদে উঠলাম – ও নকশালকাকু, আমার মাকে ডাকো না, না-হয় বাবাকেই ডাক দাও, কী নিজে এসো। দেখছো না আমায় সাপে কামড়েছে। সাহায্য করো আমায়। বাঁচাও… ও নকশালকাকু। জীবনের আকাঙ্ক্ষা যে আমার কত তীব্র ওই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম। একসময়, ছোটবেলা, ভাবতাম মাকে ছাড়া তো আমি থাকতে পারবো না। মা মরে গেলে মাকে পোড়াবো না, ঘরে রেখে দেবো। বড় হয়ে যখন সেটা অসম্ভব বুঝলাম, তখন ভাবতাম, মা মরলে আমিও মরে যাবো। কিন্তু ওই মুহূর্তে টের পেলাম জীবন মৃত্যুর চেয়ে ঢের বড়ো। না হলে ওই সময়, ওই খন্ডহরে, আমার বাঁচার আকাঙ্ক্ষা অত তীব্র হয়ে উঠতো না।
– ও নকশালকাকু, কোথায় তুমি? বাঁচাও আমায়, আমি বোধহয় কাঁদতে কাঁদতেই অর্ধঅচেতন হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো ঘরে কেউ ঢুকেছে। দাঁড়ালো আমার পাশে। ছোট্ট একটা টর্চ ফেলে পরীক্ষা করছে আমার ক্ষতস্থান।
– ডাক্তার।
মনে হলো আমার, যেন আমার বুকে কেউ স্টেথো বসালো। পাশে কি কেউ দাঁড়িয়ে? ঠিক বুঝছি না, সবই অস্পষ্ট, অাঁধার-অাঁধার।
– কালাচ। কালাচ কামড়েছে – কেউ বলল।
– ঠিক আছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, অ্যান্টিভেনম আছে আমার কাছে।
কেউ ইঞ্জেকশন পুশ করছে হাতে টের পেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
পরদিন দেখি আমার ঘরের ভেতর লোকে লোকারণ্য। সাইট ম্যানেজার, কয়েকজন কর্মচারী, হোটেল মালিক, ক্ষৌরকার দাদা, প্রাক্তন বাড়িওয়ালা, সবাই।
– আরে সাইটে যান না দেখে দেখতে এসেছিলাম। ম্যানেজারবাবু বললেন।
– দেখি মড়ার মতো পড়ে আছেন, সাড়া নেই কোনো। যে-ভয় পেয়েছি, সববাইকে ডাক দিয়েছি।
বাড়িওয়ালা বললো – আপনাকে ভাড়া দিতে হবে না মশাই, আমরা কথাটিও জিজ্ঞেস করবো না আপনাকে, আমার বাড়িতে চলুন দেখি। এই খন্ডহরে থাকতে হবে না।
– আহা খন্ডহর হবে কেন!
বলতে গিয়েও আমি থেমে গেলাম। আমারও সাপের ভয়ে এ-বাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছে হচিছল না। আবার নকশালকাকুর জন্য বাড়িটা ছাড়তেও মন চায় না। কালকে নিশ্চয়ই নকশালকাকুই ডাক্তার এনেছিল। ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললাম সবাইকে।
– জানেন, কালকে আমাকে সাপে কামড় দিয়েছিল রাতে।
– আরে বলে কী!
সবাই লাফিয়ে উঠলো।
– কই? দেখি! কোথায়?
সবাই আমার শরীরে ঝুঁকে পড়েছে। হোটেলমালিক অবিশ্বাসের স্বরে বললো – হুঁ। সাপে কাটলে আর এমনি এমনি বেঁচে উঠেছ আর কী।
– হতিও পারে। ঢোঁড়া হলি বা হেলে।
একজন কেউ বললো। বাকিরা আমার সাপে কাটা পা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলল – ধুত। কোনো দাঁতের দাগ নেই তো, কেবল নাপিতদাদু তার পাকা মাথা নেড়ে নেড়ে বললে –
– আচ্ছা। হালকা দুটো দাগ আছে বইকি। কালাচ হলেও হতি পারে। তার কামড়ের দাগ বোঝা মুশকিল।
– তা কালাচে কামড়ালে এতক্ষনি অক্কাপটাং হোতনি, বিনে চিকিচ্ছায়।
একজন সুচিন্তিত মতামত রাখলেন।
– আহ, কী আজেবাজে অলক্ষণ কথা।
ম্যানেজার চটলেন। আমার প্রতি ওনার স্নেহ ছিল।
– চিকিৎসা হয়েছে তো।
আমি বলতেই সবাই অবাক।
– এখানে তো রাতে একজনই ডাক্তার মেলে। তিনি তো গতকাল ছিলেন না, আজ ফিরেছেন। চিকিৎসা কে করবে? হোটেল মালিক আর বাড়িওয়ালা, দুজনেই বললো।
– তাছাড়া ডাক্তার ডাকলো কে, না আপুনি নিজে গেলেন?
– না, না, নকশালকাকু ডাকলো নিশ্চয়ই। সেই স্টেথো গলায় এক বুড়োমতো ডাক্তার, বুড়ো ব্যাটার কী দৃষ্টি, যেন চোখের ভেতরে ভরে নেবে আমায়।
আমি ভাবতে ভাবতে, সেই চোখ, বললাম।
– ধুত। কাল মাংস খেয়েছিলো রাতে। তাতে পেট গরম হয়ে সব বাজে স্বপ্ন দেখেছো। হোটেল মালিক বললো।
– চলো দেখি ইঞ্জিনি সাহেব, আজ আমার বাড়ি চলো। পরে ভেবেচিন্তে দেখো…
বাড়িওয়ালা ডাক দিলো। আমি বারণ করলাম না। পায়ে ব্যথা ছিল, শরীরে কেমন আচ্ছন্নতা। আমার মনে হচ্ছিলো আমার আরো চিকিৎসার প্রয়োজন। আমি জিনিসপত্র ব্যাগে ভরার জন্য উঠতে উঠতে জিজ্ঞাসা করলাম – ডাক্তারের বাড়িটা কই? আগে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি যাবো।
বলতে বলতে দেখি খাটের পাশের টেবিলের ওপর একটা কাগজ, ঢিল দিয়ে চাপা। তুলে নিয়ে দেখি –
– ড. এ কে দত্ত… কিন্তু আর যেসব লেখা, তা পড়া যায় না। অথবা কিছু লেখাই ছিলো না, কেবল কাগজটাই আছে।
– ড. দত্ত কে গো? জানো চরণদাদু? আমি প্রশ্ন করি।
– ওমা, ঝে ডাক্তারের কথা বলছি সেই তো গো। ক্ষৌরকার চরণ দাদু বলে।
– তাহলে সে এয়েছিলো কিন্তু তারে ডাকলো কে? আর সে যে পাশের শহরে গেছে শুনলাম তারই বা কী?
ম্যানেজারবাবুর কথার কেউ উত্তর দিলো না। আমরা বাইরে বের হলাম। সাইটের দুটো কর্মী ছেলে বললো – কোথায় যাবেন? আমরা সঙ্গে যাই।
আমি বললাম, না, ডাক্তারবাড়িটা কেবল দেখিয়ে দাও আর মামা কাপড়ের ব্যাগটা রেখে আসো আমার আগের বাড়িওয়ালার বাড়িতে।
– খুব সাবধানে। দরকার হলে ডাক দেবে।
বলে সবাই বিদায় নিলো। বাড়িওয়ালা বললো – বাড়িতে খাবেন গিয়ে, কেমন, দেরি করবেন না।
ডাক্তার দত্তর বাড়িটা একতলা। শ্রীছাঁদ এককালে বোধহয় ছিল, এখন দেখাচ্ছে জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়ের মতো। অভিজাত কিন্তু জীর্ণ। আমি এখানে নবাগত কিন্তু মনে হলো বাড়িটা আমার কতই চেনা। বাড়িতে বেল নেই। আমি কড়া নাড়লাম।
– কে?
ভেতর থেকে একটা আওয়াজ।
– আমি। ডাক্তারবাবু কি বাড়ি আছেন? আমি বললাম।
– আছি। কিন্তু এখন তো রোগী দেখি না। বিকেলে। ভরাট গলায় উত্তর এলো।
– আমার খুব দরকার। সাপে কেটেছে কাল রাতে।
– সাপ!
দরজা খুলে গেল। প্রায় বৃদ্ধ বেশ সৌম্যকান্তি এক প্রৌঢ়। আমার মনে এক ঝলকা তাজা হাওয়া ঢুকলো। প্রৌঢ় দরজা খুলে প্রায় চমকে গিয়ে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ, তারপর অতিকষ্টে বললেন – কে?
– আমি।
পরিচয় না দিয়েই আমি ভেতরে ঢুকলাম।
– কাল রাতে আপনি কি আমার চিকিৎসা করেছিলেন? মাধব সাহার বাড়ি গিয়ে? আমি প্রশ্ন করলাম।
– আমি? না। কিসের চিকিৎসা? আমি করিনি। প্রৌঢ় ভারি গলায় উত্তর দিলেন। প্রশ্ন করলেন।
– সাপে কাটার, কালাচ।
– কই না।
– কিন্তু ডাক্তার দত্তর প্রেসক্রিপশন, আপনিই তো ডাক্তার দত্ত।
– হ্যাঁ, কই দেখান, আগে বসুন।
আমি একটা চেয়ারে বসে প্রেসক্রিপশনটা এগিয়ে দিলাম।
– এটা কোথায় পেলেন?
ডাক্তারবাবু চমকে উঠলেন।
– এটা তো আমার বাবার প্রেসক্রিপশন। বাবা সতীশ কুমার দত্ত আর আমি সৌম্যকুমার দত্ত। তারপর সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন।
– শুয়ে পড়ুন ওই বেডটায়, দেখি। কী হয়েছে।
আমি শুয়ে পড়লে তিনি জিজ্ঞেস করলেন – ডান পায়ে কেটেছে সাপ?
আমি মাথা নাড়লাম।
– হ্যাঁ। কেটেছে তো। কালাচ। ওদের দাগ এমনই, ভালো বোঝা যায় না। আর যে-পরিমাণ দাঁত বসেছে, ভালো বিষ ঢুকেছে। চিকিৎসাও তার মানে ঠিকই পেয়েছেন। কিন্তু আজ থেকে পনেরো বছর আগে মারা গেছেন আমার বাবা, তিনি তো আর আপনার চিকিৎসা করতে আসেননি, অথচ প্রেসক্রিপশনটা ওনারই। যদিও ওটায় কিচ্ছু লেখা নেই।
– তাহলে নকশালকাকু বোধহয় বিপদ দেখে ওনাকেই ধরে এনেছিল। উনি একটা চিহ্ন রেখে গেছেন।
আমি অম্লানবদনে বললাম।
এবার ডাক্তার চমকালেন – নকশালকাকুটা কে?
আমি সব খুলে বললাম।
ডাক্তার দত্ত শুনতে শুনতে নীরবে একটা ইনজেকশন পুশ করলেন আমার হাতে। তারপর চেয়ারে বসে বললেন – আমার বাবা তখন এ-তল্লাটে একনম্বর ডাক্তার। কী, এই গ্রামদেশে ষাট টাকা। ওরা একদিন হামলা করলো বাবার চেম্বারে। নকশালরা। বললো – আট টাকার বেশি ফি নেওয়া চলবে না। এ-গ্রামে সবাই গরিব।
বাবা কেবল ওদের কথা শুনলেন, ফি আট টাকা করে দিলেন। তাই নয়, ওদের ভক্ত হয়ে গেলেন বলা যায়। আমি তখন কিশোর, দাদার উঠতি বয়স, দাদাও নকশাল হয়ে ওদের সঙ্গে চলে গেল। তারপর একদিন দাদার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। মায়ের বিশ্বাস ছিল, দাদা একদিন বাড়ি ফিরে আসবে। বাবার ধারণা ছিল, দাদাকে পুলিশ মেরে ফেলেছে, দাদা আর আসবে না। মবিব সাহার বাড়িতে তাকে গুলি করে মেরেছিল সিআরপি। বাবা তাকেও দেখতে ছুটে গেছিলেন, যদি চিকিৎসা করা যায়। কিন্তু সে আগেই মারা গেছিল। ছটা গুলি লেগেছিল তার পেটে। কোমরে দুটো, হাতে একটা। ডাক্তারকাকু এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন কোনো ধারাভাষ্য দিচ্ছেন নিরপেক্ষভাবে।
সেখান থেকে হঠাৎ ফিরে এসে বললেন – তুমি, তোমাকে তুমিই বলছি, আমার পুত্রও তুমি, এখানেই এখন শুয়ে থাকো। বিশ্রাম নাও, তোমার দুপুরের পথ্যের ব্যবস্থা করে দেবো এখানেই। তোমার এখনো কিছু চিকিৎসা লাগবে। স্যালাইনও দিতে হবে, আমি আনিয়ে নিচ্ছি। তোমার নাম বলো।
বলে প্রেসক্রিপশনে হাত ও কলম রেখে আমার দিকে চেয়ে আছেন তিনি – আমি বললাম সূর্য সম্ভব সেন দত্ত।
– কী?
ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে চাইলেন।
– এ আবার কেমন নাম?
– কেন, আমার মা সেন, বাবা দত্ত, বাবার নাম সূর্য। তাই এমন নাম রেখেছে মা। সূর্যের ছেলেই তো সূর্য সম্ভব। তার সঙ্গে মাও রইলো।
ডাক্তারবাবু একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইলেন অপলক। তারপর বললেন – তোমার বাবার নাম সূর্য দত্ত?
– হ্যাঁ।
– সে কোথায়?
– পুলিশ তাকে মেরে ফেলেছে অনেকদিন আগে। আমি উত্তর দিলাম। ডাক্তারবাবু বললেন – তার কোনো ছবি আছে তোমার কাছে।
– আছে।
আমি মায়ের দেওয়া লকেটটা খুলে ডাক্তারবাবুকে দেখালাম। একদিকে বাবা, একদিকে মায়ের ছবি। বন্ধ হলে একটি হৃদয়ের আকৃতি। লকেটটা আমি কাছে রাখি সব সময়। আমি পিতৃমুখী, মা বলেছে। ছবিটা দেখতে দেখতে ডাক্তারবাবু আমাকে বিছানা থেকে তুলে বুকে সপাটে জড়িয়ে ধরে ডাক দিলেন – ওগো দেখবে এসো, সূর্যদাদার ছেলে ফিরে এসেছে গো বাড়িতে। বাবা কাল নাতির চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তাকে এ-বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে গেছেন।
দরজার কাছে এক শ্যামবর্ণা কোমল মুখ দেখা গেল। তার স্নেহকাতর দৃষ্টি আমার মুখের ওপর স্থির হলে, মা চলে যাওয়ার পর, এই প্রথম আমার মনে হলো মা চলে যায়নি। ওই তো আছে।
এভাবেই আমি আমার আপনজনদের ফিরে পেলাম। মায়ের কথা কি কখনো মিথ্যা হয়? মায়েরা সব জানে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.