বায়েজিদ বোস্তামীর পাশের পাহাড়গুলো ঢেউ দিতে দিতে মিশে গেছে আকাশে। এদিকে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট। চারদিকে তারের বেড়া। গেটে সেন্ট্রি। তাঁবুর পর তাঁবু সাজান – যেন অসংখ্য ব্যাঙের ছাতা ফুটে আছে পাহাড়ের

থলিতে। জিপ, লরি, ওয়াগন আসছে যাচ্ছে। সোলজাররা মার্চ করে একদল ঢুকছে, একদল বেরিয়ে যাচ্ছে।

গেটের কিছুদূরে ঝাপ মেরে দলা হয়ে বসে আছে লিকলিকে আধা লেংটা কতকগুলো লোক। কারো হাতে হাঁড়ি, কারো হাতে ভাঙ্গা টিন, কারো হাতে কলাপাতা। এরা বসে তাকিয়ে আছে তাঁবুগুলোর দিকে – ক্ষুধার্ত কুকুরের মত।

সূর্য আকাশ থেকে মুছে গেলে সামনের ডাষ্টবিনটায় এসে জড় হবে ছেঁড়াফাঁড়া সেকা রুটি, হাড় – তাতে কিছুটা মাংস ঝুলঝুল করবে, ঝোলমাখা ভাত, ভাঙ্গা মাছের টিন, ভেজা চায়ের পাতা। এগুলো ডাষ্টবিনে পড়বার সাথে সাথেই ওরা ঝাপ্‌টা ঝাপটি করে চেঁচাবে, একজন আরেকজনকে খাম্চাবে, বকবে, কাঁদবে। ওরা সব আশেপাশের গাঁয়ের লোক।

একদিন নাকি ওদের সব ছিল – ভিটেঘর, গরু, লাঙ্গল, পুকুর, নৌকো, নোলক পরা বউ, ধান। এখন কিছু নেই। আছে শুধু ধুকধুকে প্রাণ। আর সেই প্রাণটাও নাকি ওরা এই ডাষ্টবিনের পাশে দিয়ে যাবে। ওরা বলে – এই ডাষ্টবিনটাই এখন এদের সব।

পশ্চিম আকাশ লাল।

এখান থেকে দুটো বিল পেরোলেই কাহার পাড়া।

বিরাট তেঁতুলগাছের গুঁড়িতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা চালাঘরের দাওয়ায় হাঁটু গেড়ে বসে মাটির পুতুল বানাচ্ছে শ্রীনাথ। আর গুনগুন করে গাইছে তার কবিয়াল দোস্ত কালু ফকিরের গীতখানা।

অবে, আখেরে হিসাব লৈবো

পরভূ নিরাঞ্জন।

চাঁন্দ মরিবো, সূরুয মরিবো

আর মরিবো তাবাগণ,

আদ্মী সকল মরিয়া যাইবো –

না থাকিবো তিবভূবন।

গাইছে আর ভাবছে শ্রীনাথ।

না হোক মেলা। না কিনুক তার পুতুল। সে তার কাজ চালিয়ে যাবে। আকাল তো আর চিরকাল থাকবে না।

যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ। যুদ্ধ কি আর ভগবানের তৈরী! মানুষই যুদ্ধ করে, মানুষই মরে, আবার মানুষই যুদ্ধ থামায়।

আহা! যুদ্ধের আগে এই পাড়ায় কত হৈ চৈই না ছিল! ওই মাঠটায় ডাঙ্গুলি খেলতো বাচ্চা ছেলেরা। পুকুর ঘাটে বসে চাল ধুতে ধুতে ঘরের কথা বাইরে ছড়াতো বউ মেয়েরা। দাওয়ায় বসে তাস পিটতো জোয়ান মরদগুলো। গরমের জোছনা রাতে কত হাডুডু খেলা, বর্ষায় মাথায় জুইর চেপে মাছ ধরার দুপাদুপি, শরতে ডুমডুমাডুমডুম্ ঢোলের কাঠি, মাঘ মাসে খেজুর বসের পিঠা আব বসন্তে ‘রাত কাটাইয়ম বন্ধু কারে চাই’ – গান।

আহা কি দিনই না ছিল!

ভাবতে ভাবতে শ্রীনাথের চোখ দুপুরের পুকুরের মত চক্‌চক্‌ করে ওঠে। আর এখন। সেই মাঠ আছে – সেই বাচ্চাগুলো নেই। কেউ না খেতে পেয়ে মরে গেছে, কেউ ভুখমিছিলের সাথে চলে গেছে শহরের সড়ক ধরে। পুকুরঘাটের বউ মেয়েরা কেউ দিয়েছে গলায় দড়ি, কেউ গিয়েছে মিলিটারী ক্যাম্পে। তাগড়া জোয়ানগুলো এখন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে হাঁটছে।

গরম আসে, বর্ষা আসে, শরত আসে, আসে শীতবসন্ত – কিন্তু হাডুডু আর কেউ খেলে না, দেখা যায় না মাথায় জুইর চাপা কোন মানুষ, আব শোনা যায় না ঢোলের শব্দ বা গান।

আহা কি দিনই না ছিল!

ভাত! কত খাবি খা। মলা মুড়ি খই দৈ – কত খাবি খা। এর দাওয়ায় বসে চিল পিঠা, এর দাওয়ায় বসে কলাপিঠা – কত খাবি খা। দিঘিতে বড় জাল দিয়ে ইয়া বিরাট বিরাট মাছ ধরা হয়েছে – ঘরে ঘরে মাছের গন্ধ। কত খাবি খা। খেতে খেতে গলা পর্যন্ত আটকে যেত। আর এখন।

স্বপ্ন! ভাত মাছ মলা মুড়ি দই খই – সব স্বপ্ন।

সেই ঢেঁকির শব্দ। আহা সেই ঢেঁকির শব্দ আর শোনা যায় না। ভোর রাতে মাঝ রাতে – কখনো সারারাত শব্দ দিয়ে চলেছে, কত মেয়ের পা দুলেছে ঢেঁকিতে।

ধান। কত ধানের ছড়াছড়ি। উঠানে, পথেঘাটে, দাওয়ায় কত ধানের ছড়াছড়ি। কত পায়রা শালিকের ভিড়। ধান, ধান, ধান – ধান থেকে প্রাণ, প্রাণ থেকে গান, জীবন হাসিকান্না।

ভাবতে ভাবতে শ্রীনাথ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলে – আমার কাজ আমি করে যাব। দিন যাক বা দিন আসুক।

সন্ধ্যা তখন ঘরে ঘরে কালো হাওয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে।

ভেজা ময়নার মত কাঁপতে কাঁপতে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে শ্রীনাথের একরতি মেয়েটা। কাঁদছে সে, একটানা। সারাদিন পুকুরে ডুব দিতে দিতে শাপলার ভেট আর ডিগ খেয়ে পেট ভরিয়েছে। এখন মনে পড়েছে ভাতের কথা। কাঁদতে কাঁদতে চেঁচাচ্ছে – অমা ভাত খাইয়ুম, ভাত।

ঘরের ভেতর থেকে জবাব আসছে 888sport promo codeকণ্ঠের – চুপ।

মেয়েটা গড়াগড়ি দেয় উঠোনে।

শ্রীনাথ গিয়ে তাকে কোলে নিয়ে এসে বসে দাওয়ায়। বলে – এই চা, কি সোন্দর পুতুল। মেয়েটা তাকায় না পুতুলের দিকে। একটানা কাঁদে আর চেঁচায় – ভাত, ভাত, ভাত। ঝলমলে শাড়িপরা একটি আধবয়সী বউ ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল দাওয়ায়। এক ঝাপটা মেরে মেয়েটাকে শ্রীনাথের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হেঁচড়িয়ে চলতে চলতে বলল – চল্, ভাত খাইবি। আঁয়ার রক্ত খাইবি। চল্, চল্ হারামজাদী।

বলতে বলতে বউটা মেয়ের হাত ধরে উঠোন থেকে মুছে গেল পথে, পথ থেকে শুকনো বিলে।

অন্ধকারে চোখ জ্বেলে সেদিকে চেয়ে রইল শ্রীনাথ।

তার সাধের বউটা। কত সাধ করে ওকে ঘরে তুলে এনেছিল তার বাপ মা। বিয়ের আগে বলেছিল শ্রীনাথ – না, না, ও বোঝা আমি বইতে পারব না। ধমকে উঠেছিল তার বাপ – বোঝা তোকে বইতে হবে না। ভগবানের বোঝা ভগবানই বইয়ে নেবেন। তুই আমি কে!

পাল্কি থেকে নেমে পাখির মত পা ফেলে ঘরে এসে বউটা সেদিন ঢুকেছিল।

অবাক হয়ে তাকিয়েছিল শ্রীনাথ। মনে মনে বলে উঠেছিল, সত্যিই তো! এমন পুতুল কি আর মানুষের বানান কাজ!

সংসার নিয়ে কোনদিন ভাবেনি শ্রীনাথ। তার বাপ-মা চিতার কাঠে জ¦লে যাবার পরও তার বউটা তাকে আজ পর্যন্ত কিছু ভাবতে দেয়নি।

শ্রীনাথের ভাবনা শুধু মাটির কাজ।

তবু, মাঝে মাঝে শ্রীনাথ ভাবে। ভাবে – বউটা কি করে এই নৌকোটা চালায়! টিন ভরা দুধ মাংস রুটি ভাত শাড়ি এসব আসে কোত্থেকে। আর ভাবে – সেজেগুজে বউটা রোজ সন্ধ্যায় যায় কোথায়। ভাবতে ভাবতে মন যখন রোদে পোড়া মাটির মত গরম হয়ে ওঠে তখন গুনগুন করে গেয়ে ওঠে – অবে, আখেরে হিসাব লৈবো পরভূ নিরাঞ্জন।

মন, মন তো মাটির মত।

উপড়ে ফেল, গুঁড়ো গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দাও কাদায় কাদায় নরম কর, যেদিকে চালাও সেদিকে চলবে। মন যদি বলে – আমি ফসল ফলাব, মন বলবে – ফলাব। মন যদি বলে – আমি ভেঙ্গে দেব, মন বলবে – হ্যাঁ। যেদিকে ঘুরাবে সেই দিকে ঘুরবে মন – মাটির মত।

শ্রীনাথ বলে – আমি মনের কারিগর।

বউটা যাক, যেখানে খুশি সেখানেই যাক্। আমি আমার কাজ করতে পারলেই হল। আমার ফসল ফললেই হল। মাটি, আমার মন, পুতুলগুলো আমার ফসল।

যুদ্ধ লাগার সাথে সাথেই পাড়ার লোকজন বলেছিল – শ্রীনাথ, এই কাজ ছেড়ে দে। না ছাড়লে ক’দিন পর শুকিয়ে মরে যাবি। চল – দা কোদাল নিয়ে মাঝিগিরি করিগে। চল, শহরে চল।

এতকাল মাটি নিয়ে কপচাতে কপচাতে ঠোঁটে ভোরের রোদের মত হাসি ফুটিয়ে শ্রীনাথ শুধু তাদের দিকে তাকিয়েছিল – বলেনি কিছুই।

যখন সমস্ত পাড়া উপোসে খা খা তখন মতি দালাল এসে বলেছিল – শ্রীনাথ চল কাজ করবি।

ড্যাবড্যাবে দৃষ্টি মেলে সাজান পুতুলগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল শ্রীনাথ – এগুলো কি কাজ নয়?

হো হো করে হেসে উঠেছিল মতি। বলেছিল – মাটি দিয়ে পুতুল না বানিয়ে মাটি কেটে কুলী-মজুর হয়ে যা শ্রীনাথ। না হলে মরে যাবি হারামজাদা।

কিন্তু মরেনি শ্রীনাথ।

মরতে মরতে বেঁচে আছে। শ্রীনাথ বলে – আমি মরবো না। মরতে পারি না। আমি কারিগর। কারিগর মরে না। ঝড় আসে, তুফান আসে – আবার চলেও যায়। আজ আকাশ যুদ্ধের মেঘে 888sport app। কিন্তু কাল তা কেটে যাবে। যুদ্ধ চিরকাল থাকবে না। একজনকে হার মানতেই হবে।

শ্রীনাথ বলে – মেলা আবার বসবেই। আবার তার পুতুল কিনবে লোকে।

সেই দিন আবার আসবে। সেই পৌষের দিন। ধানকাটা হয়ে গেলে শালী আর বীজ বালাম ধান জমি থেকে উঠে যাবে ঘরে ঘরে। সব গ্রামের একহাতে নতুন ধানের মঞ্জরী, অন্য হাতে সূক্ষ্ম বাঁশের তৈরী করা কুলো – ঠোঁটে লাজুকরাঙা হাসি, ধানের চোখের মতই চোখ ধাঁধান। রূপে রূপে রূপবতী, ধানে ধানে ধানবতী। সারা বছর সাজবে, পৌষ এলে অভিসারে বেরোবে। রূপ যেন তার ছলকে পড়বে।

রোদে ঝলসে উঠবে জমি প্রান্তর।

মাটি ফুঁড়ে উঁকি দেবে মুগ কলাইয়ের চিকন চিকন পাতা। লাউ কুমড়োর সর্পিল ডগাগুলো খড়ের চালের ওপর লক্‌লক্ করে বাতাসে দুলবে। সাদা, খয়েরী, কালো পালকের ওপর সরু নীল রঙ আঁকা পায়রাগুলো অকারণে ডাকবে, ডাকবে ঘুঘু। ভাটুই পাখিরা ধানঝরা জমিতে সতর্কে ঘুরে বেড়াবে।

আলের ধারে ধারে খেজুর গাছের সারি – তাতে হাঁড়ি বসান থাকবে। কয়েকটা শালিখ হাঁড়ির মুখে ঠোঁট লাগিয়ে কিচির মিচির শব্দ তুলবে – মায়ের স্তনে ঠোঁট বসিয়ে হঠাৎ খুশিতে কেঁদে ওঠা শিশুর মত।

খালের জলে ভাসবে মরা গরু, দু-তিনটে শকুন তার ওপর বসে মাংস খোটাবে।

দাঁতালো কুকুরটা ঘেউ ঘেউ শব্দ করে ডাক দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে শকুনগুলোকে তাড়াবে। খালের ধারে বসা অনেকগুলো শকুন দীর্ঘ গলা বের করে তাকিয়ে থাকবে ভাসমান গরুটার দিকে। কুকুরটা আবার সাঁতার কেটে ফিরে আসবে। কয়েকটা শকুন সাঁই সাঁই করে উড়ে চলে যাবে।

চক্‌চক্‌ করবে দিঘির ফল। কিনার ঘেঁষা সূক্ষ্ম সূঁচের মত সবুজ ঘাসের বনে উড়ে বেড়াবে রঙবেরঙের প্রজাপতি। মৌমাছিরা জটলা পাকাবে ঘন লালফুলে মেতে ওঠা মাদার গাছের ডালে ঝোলা মৌচাকে। শাপলা ফুলেরা শাদা শাদা পাপড়ি মেলে বিস্তীর্ণ পাতার ভিড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকবে। ছোট ছোট রূপোলী মাছ সাঁতার কাটবে দিঘির সোনালী জলে। আর সেদিকে দৃষ্টি হেনে তাকিয়ে থাকবে মাছরাঙ্গার লুব্ধ শিকারী চোখ।

শুকিয়ে যাওয়া অল্পজলে কচুরিপানার তলে তলে শিঙ আর মাগুর মাছের ঝাপট। বেতলতার ফাঁকে ফাঁকে জারুল গাছের ডাল থেকে ঝুলে পড়া চড়ুই পাখির বাসাগুলোকে দূর থেকে দেখাবে মৃদঙ্গের মত।

ঘর থেকে ঘরে, উঠোনে, গোলাঘর থেকে গোয়ালঘর পর্যন্ত গেরুয়া রঙের শুকনো খড় বানের পালক হয়ে ছিটিয়ে ছড়িয়ে থাকবে। ঢেঁকির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ঢেঁকির লেজ উঠবে নামবে – বউগুলো ঘামে নেয়ে উঠবে, ঘোমটা খসে পড়বে। কালো চুলের অরণ্যে ছেয়ে যাবে গুঁড়ো গুঁড়ো ধানের তুষ। খিলখিলে হাসি আর কলকলে ধানী গানের কথা। শাদা শাদা চালগুলো হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসবে ধানের কঠিন নির্মোক থেকে, দোল খাবে দু’পা ছড়িয়ে দেওয়া হাতের মুঠোয় চেপে ধরা কিষাণ বউয়ের কুলোর মধ্যে। লাল বা হলুদ আঁশের আবরণে কোনগুলো হয়ত নিজের শুভ্র সত্তাকে একটা লজ্জার মত আড়াল করে রাখবে – যৌবন ঢেকে রাখা কোন লাজুক মেয়ের মত।

ধান, ধান, ধান, ভেতরে যতই দুঃখ থাকুক না বাইরে গ্রামগুলো তার পোষালি ধানের মতই আনন্দে মেতে উঠবে। যাদের জমি নেই – তারাও হলুদ হলুদ ধান দেখে মুগ্ধ হবে – এটা ওটার বদলে ধান কিনবে। খই ফোটাবে, চিঁড়ে বানাবে, মুড়ি ভাজবে। চাল গুঁড়ো করে হরেক রকমের পিঠা তৈরী করবে। ধুঁই, পাক্কন, নারকেল পিঠা – কত কি। খেজুরের রসে চিবিয়ে চুবিয়ে খাবে, অন্যকে খাওয়াবে। দূর দেশে – মেয়ের বাড়িতে, বাপের বাড়িতে বা বেহাইয়ের বাড়িতে পাঠাবে।

কোন মেয়ে হয়ত বাপের বাড়ির পিঠার জন্য প্রতীক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকবে পুকুর পাড়ের ছায়া888sport app সারি সারি কলাপাতার নিচে।

ধূ ধূ ধান উঠে যাওয়া শুকনো বিলের ওপার হতে মাথায় একটা বিরাট হাঁড়ি চেপে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসবে একটা লোক। লোকটা হয়ত তার বাপ কিম্বা সোদর ভাই।

মুহূর্তে মেয়েটার গলার হাঁসুলী উঠবে দুলে, কাঁখের কলসী থেকে ছলাৎ করে কয়েক আঁজলা জল ছিটকে পড়বে – পালাবে, খুশির আবেগে। তারপর বাপের বাড়ির সাধ-করা পিঠা খেতে খেতে মনে মনে ডানা মেলে উড়ে যাবে মা বাপের সেই ফেলে আসা ভিটে-ঘরখানাতে।

আর, কোন মেয়ে হয়ত চোখের জলে সাজাতে বসবে পিঠার পরে পিঠা দিয়ে একটা কালো রঙের বিরাট হাঁড়ি।

গুনে গুনে সাজাবে – মা খাবে, বাপ খাবে, ভাই খাবে, বোন, পাড়া-পড়শি সবাই খাবে। সঙ্গে দেবে একটা পানের বিড়া, সুপোরি, একহাঁড়ি মোষের দই, ছোট ছোট ভাইবোনের জন্য কয়েকমুঠো কাঁচাপাকা কুল দিতেও ভুলবে না। দাদীর দাঁত নেই – ছাঁচা সুপোরি দেবে একটা কলাপাতায় মুড়ে। সব দেবে মুঠো ভরে – বিনি ধান, কামিনী ধান।

আর সেই সব পেয়ে তার মা মেয়েকে নাইয়র আনতে পাঠিয়ে দেবে কোন আত্মীয়কে।

থলোথলো খুশীতে মেয়েটা আবার চোখের জলে সাজাতে বসবে একখিলি পান। স্বামীর মুখে তা পুরে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলবে – আঁয়ারে নাইয়ব নিতো আইস্যে।

ঘরে ঘরে হানা দেবে ফিরিওয়ালা।

কাঁধের ভারটায় পুরো একটা মনোহারি দোকান তুলে আনবে। টিপ, সেপটিপিন, কালো নীল হলুদ রঙের চুলের ফিতে, নকল সোনার কানপাশা, লালরঙে আঁকা ‘ভুল না মোরে’ লেখা ডালা বন্ধ করা আয়না, চুলের কাঁটা – কাপড়ও থাকবে হরেক রকমের, গোলাপি বেগুনি আসমানি রঙের মন কেড়ে নেওয়া শাড়ি, জ্বলজ্বলে ছিট্‌ কাপড়, পাতলা পাতলা ওড়নাও থাকবে।

পুকুর পাড়ে এসে ডাক দেবে ফিরিওয়ালা।

সেই ডাকে ছুটে আসবে ন্যাংটা ন্যাংটা ছেলেমেয়েরা, সোমত্ত বউরা খড়ের গাদার পেছনে গা আড়াল কবে দাঁড়াবে।

দর-কষাকষি চলবে, ধান দিয়ে এটা ওটা কিনবে।

ফিরিওয়ালার কাছ থেকে আসমানি রঙের শাড়িখানা দু’হাতে সাপটে ধরে একটা ছেলে তার মাকে এনে দেখাবে।

বউটা ফিসফিস্ করে শুধাবে, কত?

ফিরিওয়ালা চেঁচাবে – পাঁচ আড়ি ধান।

হেই ব্যাডা কয় কি! বউটা ছুড়ে দেবে শাড়িখানা। খাবলা মেরে জড়িয়ে ধরবে ছেলেটা। মেপে মেপে ধান দেবে, দেখে দেখে শাড়ি নেবে – নেবে চিরুনি, খুশবু তেল, আতরের শিশি। সোহাগ করে স্বামীকে দেখাবে, সাজবে – ধানে ধানে ধানবতী, রূপে রসে বর্ণে গন্ধে সপ্তকলায় হবে রূপবতী।

আসবে ছবিওয়ালা।

ছবি তোলার বাক্সটিকে দাঁড় করিয়ে তার ওপর কাপড়ের ঘোমটা দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াবে ছবিওয়ালা।

সামনে কাঠ হয়ে টুলের ওপর বসে থাকা আধবয়সী লোকটার চুল থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়বে সর্ষের তেল। গায়ের লালশালুর কামিজটা আগুনের মত জ্বলতে থাকবে। পরনের লুঙ্গিটাও নানা রঙের কাজ করা, পায়ে একজোড়া ভারী বুটজুতো – কোন মিলিটারির কাছ থেকে সেটা বকশিস্ পাওয়া হয়ত, তাতে কাদাও লেগে থাকবে খানিকটা।

হাসো, মিয়া সাব হাসো।

লোকটা মুখ বিস্ফারিত করে হাসবে। পেছনে মাদার গাছে টাঙানো একটা সিন – তাতে আঁকা থাকবে সরু একটা নদী, নদীর ওপর একটা বিরাট জাহাজ, জাহাজের ওপর মাছির মত উড়ন্ত কতকগুলো ছোট ছোট এরোপ্লেন। দূরে নীল রঙের পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা দালান, দালানের গায়ে বড় বড় ফুল, ফুলগুলো দালানের চেয়েও বড়। আঁকা উড়ন্ত পাখিও থাকবে আকাশের কোণে – তবে সেগুলো চিত্রকরের খেয়ালী তুলির টানে এরোপ্লেনের মতই দেখাবে। কিছু সময়ের মধ্যে জলে ভরা গামলা থেকে লোকটার ছবি বেরিয়ে এসে রোদে শুকোতে থাকবে। ছোট বড় মাঝারি সব রকমের লোকের ভিড় করা চোখগুলোতে তাক লেগে যাবে।

ধানের টুকরীটা রেখে লোকটা ছবি নিয়ে চলে যাবে।

একজনের পর আরেকজন। বুড়ো থেকে জোয়ান, ছোট ছোট ছেলেরাও লুঙ্গির কোঁচায় ধান লুকিয়ে এনে ছবি তুলতে বসে যাবে।

একজন তার কামিজের বুকে একটা মেয়েলোকের ছবি ঝুলিয়ে হুকুম দেবে – চাই, তোল। কিন্তু মাইয়া লোকও থাকা চাই, আতরের খশবুও উঠন চাই।

ছবি ঠিকই উঠবে – মেয়েলোকটাকে যেন বুকে ধরে রেখেছে। কিন্তু তবু তার পছন্দ হবে না। বলবে সে – ছবি ঠিক আছে, কিন্তু খশবু কোথায়!

ছবিওয়ালা শহরের ঝানু লোক। জোয়ানটাকে কিছুক্ষণ পর ঘুরে আসতে হবে। এই অবসরে ছবিটার গায়ে আতর রাখবে মেখে। কিছুক্ষণ পর জোয়ানটা ফিরে এলে তার হাতে ছবিটা তুলে দিয়ে বলবে – ধরো, শুঁকি চাও।

ছবিটা শুঁকে দেখে জোয়ানটা তারিফ করে উঠবে – হ, একদম ঠিক।

বলী খেলা হবে, কবির লড়াই হবে, যাত্রা হবে। শ্রীনাথ বলে – মেলা আবার বসবেই।

অন্ধকারে ডুব দেওয়া চালাঘরগুলোর দিকে সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে – আহা! ওই বোকা গগন দেখতে পেল না সব। নদীতে ঝাঁপ দেবার আগে এসেছিল তার কাছে। বলেছিল – ছিরিনাথ, আঁয়ারা আর ন বাঁচ্যম্।

ধমকে উঠেছিল শ্রীনাথ – মিথ্যে কথা।

একগাল হেসে পাথরের মত স্থির চোখ দুটি তুলে নদীর পথ ধরে চলে গিয়েছিল গগন। শ্রীনাথ বলে – গগন বোকা। আর বোকা এই বউগুলো। বৃন্দাবনের বউ, সনাতনের বউ, পাঁচকড়ির বউ। কথা নেই বার্তা নেই অমনি গলায় দড়ি। ব্যাপার কি। ব্যাপার আর কিছু নয় – জীবনে আর খেতে পাওয়া যাবে না। মানুষ আর বাঁচবে না। জগৎটা ধ্বংস হয়ে যাবে।

বোকা বোকা – সবাই বোকা! এই বোকামীর জন্য ওরা সূর্যজাগা ফুলফোটা ধানদোলা নদী পথ ঘাট মাঠ প্রান্তর আর মানুষের হাসি কান্না থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেল।

একটা মেয়েলি ছায়া কেঁপে উঠল উঠোনে।

– হিবা কন্?

– ফুলরানী।

বলেই ছায়াটা ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল মোহনবাঁশির ঘরের দিকে।

ফুলরানী মতি দালালের বড় মেয়ে। লম্বা। কালো। দীর্ঘ চুল। মূর্তিমতী কামনার শিখা যেন।

মতি ঘাঘু লোক।

কর্ণফুলির ওপারের এক বুড়ো জোতদারের কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে মেয়েকে পালকিতে তুলে দিয়েছিল। দু’মাস ঘুরতে না ঘুরতেই ফুলরানী শাঁখা ভেঙ্গে শাদা থানে বাপের ঘরে এসে হাজির।

ফুলরানীর আক্রোশ বাপের ওপর নয়, মোহনবাঁশির ওপর।

বিয়ের আগের দিন কত সেধেছিল সে মোহনবাঁশিকে। বলেছিল – বাঁশি, চল আমরা পালিয়ে যাই। জবাবে মোহনবাঁশি বলেছিল – না। আমার এখন অনেক কাজ।

সাপের ফণার মত চিবুক উঁচিয়ে বলেছিল ফুলরানী – তুই তাহলে আমায় মন দিস্নি?

বলেই ঠাস্ করে এক চড় মেরে সেদিন চলে গিয়েছিল সে। তার পরদিনই সে দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে গিয়ে উঠেছিল বুড়ো জোতদারের পাল্কিতে।

আজ, এই অন্ধকারে চলেছে সে মোহনবাঁশির ঘরে। একটা বোঝাপড়া হবে।

বলবে – বাঁশি, কেন তুই ছেলেবেলায় আমায় ফুল ভালবাসতে শিখিয়েছিলি? আমি যখন বার বছরের একটি শাপলাফুল, তখন তুই ঘাটে বসে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বলেছিলি – আইজ যে দেখি ফোটা ফুল, কাইল দেইখাছি কলি – তুই কেমনে এমন হৈলি কেন বলেছিলি! বল, কেন বলেছিলি।

শাওন মাসে বিল যখন বানের জলে ডুবুডুবু – তখন তুই নৌকো চেপে এসে দাঁড়িয়েছিলি আমাদের ঢেঁকিঘরের পিছনে।

দুপুর তখন কান্নার পর হেসে ওঠা বাচ্চা মেয়ের মুখের মত ঝকঝকে। চুপি চুপি বলেছিলি – চল, বেড়িয়ে আসি। এক কথায় হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে কাদা ছড়াতে ছড়াতে তোর নৌকোয় গিয়ে উঠেছিলাম। লগি ঠেলে ঠেলে তুই আমায় নিয়ে গিয়েছিলি ধূ ধূ বিলের মাঝখানে, যেখানে বানের জল সাগরের মত আকাশ ছোঁয়া।

ভয়ে ভয়ে বলেছিলাম – বাঁশি, চল্ ঘরে চলে যাই।

হো হো করে হেসে উঠে বলেছিলি – তোর ভয় করছে বুঝি?

মনকে শক্ত করে জবাব দিয়েছিলাম – না।

তুই নৌকোটাকে ইচ্ছা করে হেলিয়ে দুলিয়ে বলেছিলি – তুই হলি মতি দালালের মেয়ে। তোর ভয় করতে নেই।

আকাশে গর্জে উঠেছিল কালো মেঘ।

চোখের পলকেই বৃষ্টি আর হাওয়ায় দুলে উঠেছিল নৌকো। তুই জোরে লগি মারতে মারতে হাঁফিয়ে উঠেছিলি। আর আমি গুটি গুটি হয়ে বসে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। তোর মুখেও কথা নেই আমার মুখেও কথা নেই।

হঠাৎ চারদিক কালো হয়ে গিয়েছিল। কি হয়েছিল কিছুই বুঝিনি সেদিন।

চোখ মেলে দেখেছিলাম তার দু’দিন পর। এর ভেতর একদিন একরাত চলে গিয়েছিল। চোখ মেলে তোকে দেখতে না পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম। বাপ মা ভাই বোন সবাই ধমকে উঠেছিল।

বাঁশি, বল্, কেন তুই সেদিন নৌকোয় করে আমায় নিয়ে গিয়েছিলি জলে ডোবা থইথই বিলে!

সেই তেঁতুল গাছ এখনো সাক্ষী আছে। আর সাক্ষী আছে তোর কপালের কাটা দাগ। ডালে বসে তেঁতুল খেতে খেতে বলেছিলি – ফুলি, তুই আঁয়ার বউ হবি?

এক ধাক্কা মেরে তোকে নীচে ফেলে দিয়েছিলাম। অনেকদিন তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস্নি।

আমার মনে হয়েছিল – যেন অনেক অনেক বছর।

একবার ঝাঁক বেঁধে সবাই গিয়েছিলাম সীতাকুণ্ডের মেলায়।

রেলগাড়ী থেকে নেমে আমার হাতে এক টিপ মেরে বলেছিলি – আয়, আমার পেছন পেছন চলে আয়। বাপ-মার হাত থেকে স্রোতে ভাসা কচুরিপানার মত তোর পেছনে গিয়েছিলাম।

তখন বয়স আমার তেরোয় পড়েছে।

কোকিলের ডাক শুনলে আমার কেমন কেমন লাগতো। চাঁদ, তারা, ফুল দেখলে হাততালি দিয়ে উঠতাম। বেশী ভাল লাগতো তোকে দেখলে, আবার ভয়ও লাগতো।

একটা চুড়ির দোকানের সামনে এসে তুই থমকে দাঁড়িয়েছিলি। আমার দিকে মিটিমিটি হেসে একগাছা চুড়ি কিনে নিয়ে আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলি – চল্‌!

আমি যেন তোর বানানো কলের পুতুল। তুই টিপছিলি, আমি চলছিলাম।

তারপর কপালের টিপ কিন্‌লি, রেশমি রুমাল কিন্‌লি, কিন্‌লি সুগন্ধি তেল – কত কি! এক বোঁদা বিড়িও কিনলি আমার জন্যে।

প্রেমতলায় গিয়ে একছিলিম গাঁজা টেনে এসে আমার হাত ধরে বলেছিলি – চল্। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পায়ের গোড়ালিতে হাত দিয়ে বলে উঠেছিলাম – না। আমি আর হাঁটতে পারব না।

পথের ধারে, একটা চাপালিশ গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে আমি বসে বসে হাঁফাচ্ছিলাম। তুই বিড়ি ফুঁকছিলি।

ভয়ে, ক্লান্তিতে, অজ্ঞানা কৌতূহলে জিজ্ঞেস করেছিলাম – বাঁশি, আমরা কি তবে হারিয়ে গিয়েছি।

আরে দূর! হারাব কেন! তোর মা-বাপের সাথে এক্ষুনি দেখা হয়ে যাবে।

কিন্তু দেখা হল না।

দিন চলে গেল। এল রাত। আমার বুক ভয়ে দুরু দুরু। তুই এপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লি। আমি গুটি গুটি হয়ে বসে রইলাম।

সারারাত পায়ের শব্দ এল আর গেল।

বল্ বাঁশি, কেন তুই ইচ্ছে করে আমায় নিয়ে সেদিন মেলায় হারিয়ে গিয়েছিলি! আজ আমি বিধবা। তোর জন্যই বিধবা। তুই-ই তো তুলে দিয়েছিস সেই বুড়োটাব ঘাড়ে। তোকে আজ সব কথার জবাব দিতে হবে।

ভাবতে ভাবতে ফুলরানীর পা-জোড়া এসে থামলো মোহনবাঁশির ঘরের দাওয়ায়। শ্বাস পড়ার শব্দ হল। নড়ে উঠল দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিটা। গতকাল পুকুরঘাটে দেখা হতেই মোহনবাঁশি তার কাছে লঙ্গরখানার জন্য চাঁদা চেয়েছিল।

ফুলি, তোর বর কত্তো বড় জোতদার। তোর চাঁদা পাঁচ টাকা।

মুচকি হেসে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ফুলরানী।

আর মনে মনে বলেছিল – পাঁচ টাকা কেন! তোর জন্যে পাঁচশ’ টাকা চাঁদা দিতে রাজি আছি আমি।

দু’হাতে আঁচলের কোণটুকু চেপে ধরে ফুলরানী ভাবে, টাকাটা বাঁশির হাতে দিয়ে বলবে – বাঁশি আর কি চাস্ তুই?

যদি বলে – তোকে।

তখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে সে মোহনবাঁশির বুকে।

ভাবতে ভাবতে দাওয়া থেকে ঘরের দিকে পা বাড়ায় ফুলরানী। কোমরের প্যাঁজে বিরি আর দেশলাই ছিল। বিড়ি জ্বালিয়ে ঝাপ খুলে ঢুকলো ভেতরে। কুপির সলতে জ্বলে উঠতেই দেখা গেল – তার চোখে ভুরুতে নাকের ডগায় চিবুকে ঠোঁটের নীচে নয়া ঘাসের ওপর জমে থাকা ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের মত ঘাম।

ঘরের চারদিকে তাকালো সে।

পাটি, ছেঁড়া কাঁথা, তুলো বেরিয়ে যাওয়া তেল চিট্‌চিটে বালিশ, ভাঙ্গা টিনের বাক্স, সুরই, হাঁড়ি – টুকরো টুকরো আধপোড়া বিড়ি, ভাঙ্গা কল্কে, রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি।

কুপি নিভে যাওয়ার আগে দেখা গেল সুরই, হাঁড়ি, কলসি সব ঘরের কোণে সাজানো। বাক্সটা একপাশে তার ওপর যুগল মূর্তিটা দাঁড়ানো। মাঝখানে পাতা। তাতে শুয়ে আছে ফুলরানী।

ঝাপ খোলা।

শুয়ে আছে ফুলরানী।

যত রাত করেই ফিরুক মোহনবাঁশি – সে একটুও নড়বে না, জাগবে না।

দেশলাই জ্বালিয়ে যা দেখবে মোহনবাঁশি, তাতে তার শরীরের আগুন ধপ্ কবে জ¦লে উঠবে। যদি দেশলাই না থাকে – ঘরে ঢুকেই তার পায়ের পাতা এসে ঠেকবে ফুলরানীর বিরাট ঊরুতে।

চমকে উঠে জিজ্ঞেস করবে মোহনবাঁশি – হিবা কন্?

কোন জবাব দেবে না ফুলরানী। মরার মত পড়ে থাকবে। মোহনবাঁশি তখন তার শরীর হাতড়াতে হাতড়াতে মানুষ চিনবার চেষ্টা করবে। বুকে চুলে কোমরে হাত দিয়েই মোহনবাঁশি চমকে উঠবে।

তখন?

তখন কি আগুন জ্বলে উঠবে না?

ফিস্ফিস্ করে বলবে ফুলরানী – আমি।

মোহনবাঁশি যদি লাগাম ছেঁড়া ঘোড়ার মত খট্ করে উঠে দাঁড়ায় তবে অন্য কথা – কিন্তু যদি ঢেউয়ের মত তার বুকে আছড়ে পড়ে, তবে সে তক্ষুনি শক্ত বাহুর আড়ে মোহনবাঁশির গলা চেপে ধরে বলবে – বাঁশি, এই তোর ভালবাসা! জানোয়ার, তুই জানোয়ার।

বলেই কিল চড় মেরে চেঁচাতে চেঁচাতে সমস্ত পাড়া জাগিয়ে তুলবে।

সবার সামনে তাকে বেইজ্জতি করে ছাড়বে।

ফাঁদ পেতে শুয়ে আছে ফুলরানী মোহনবাঁশির ঘরে।

মোহনবাঁশির মুখ তখন আঁতুরা ডিপোর এক চায়ের দোকানে লটকানো হারিকেনের আলোয় ঝলসে উঠছে।

আরো কয়েকটি মুখ আলো আঁধারে কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট। লক্ষ্মণ, যামিনী দা, ইয়াকুব, শীতল পাল, মধু কামার, নিতাই শীল। সবাই ভাবছে – কি করে পাড়াগুলোকে দুর্ভিক্ষের কবল থেকে বাঁচাবে।

যামিনীদা বলছে – চল, আমরা মিছিল করে শহরে গিয়ে হাজির হই।

লক্ষ্মণ বলছে – ও কিচ্ছু হবে না। ডাকাতি করতে হবে।

ইয়াকুব বলছে – আগে রিলিফের ব্যবস্থা কর।

মোহনবাঁশি কিছুই বলে না। সে শুধু ভাবে।

কথায় বলে – খালকুলের গাছকে যত্ন করতে হয় না। সে আপনি বেড়ে ওঠে, আপনিই গন্ধ ছড়ায়।

মোহনবাঁশিও ঠিক তেমনি।

ওকে ওর ঠাকুরদার কোলে রেখে ওর বাপ-মা মারা গিয়েছিল। কি করে দিন দিন বেড়ে উঠেছিল – এ এক আশ্চর্যের কথা। সবাই বলে, ছেলেটার গায়ে ফকিরের ফুঁক আছে।

মোহনবাঁশি – হ্যাঁ, বাঁশির মতই তার গলার সুর। চোখে মোহন টান। কাঁচা, ঢলঢলে। ছিপ নৌকোর মত চলাফেরা, দিলখোলা হাসি। হাতের কাজ অদ্ভুত। চাকি ঘুরিয়ে হাত লাগাতেই এত সুন্দর সব সুরই কলসি বেরিয়ে আসতো – তা দেখে সবাই অবাক হয়ে বলতো – ইবা দেঁওতা, না মানুষ?

মোহনবাঁশির মা ছিল শঙ্খনদীর কূলের কোন এক কায়েত ঘরের বউ।

তার স্বামী ছিলেন বাঁকাবাবু। সকালে চিঁড়ে দই খেয়ে হাটে গিয়ে আড্ডা, দুপুরে ফিরে স্নান সেরে ভাত খেয়ে ঘুম, বিকেলে আবার আড্ডা, তারপর গভীর ঝিঁ ঝিঁ ডাকা রাত্রে বাড়ি ফিরতেন তিনি।

পান থেকে চুন খসলে বউকে ধরে বেদম মার।

এই মারের জ্বালায় বউটা মাঝে মাঝে পুকুরে গিয়ে ঝাঁপ দিত। কিন্তু মরতে পারত না। ডাঙ্গায় তুলে এনে আবার মার।

বউটা সব সহ্য করত। সবাই মনে করত সে ছিল বাঁজা।

এইসব যন্ত্রণা থেকে ছাড়া পারার জন্য বউটা একদিন এক কাণ্ড করে বসল।

তখন মেলা বসেছে পদুয়ার বিলে। ঘোমটা পরা বউটা ইচ্ছে করেই হারিয়ে গেল মানুষের ভিড়ে।

সন্ধ্যায় ঝিমিয়ে পড়া মেলায় জোনাকিব মত আলো জ্বলে উঠতেই যে যার ঘরে ফিরে গেল। বউটার সঙ্গিনীরা কেউ উঁচু গলায় শেষবারের মত ডাক দিয়ে চোখ মুছলো – কেউ দূর থেকে পেছন ফিরে বারবার মেলার দিকে তাকালো।

আর এদিকে বউটা হাতি ঘোড়া ময়ূর পাখি – পুতুলের বিরাট স্তূপের পাশে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে কাত হয়ে শোয়া।

– হিবা কন্?

বাতাস-কাঁপা তেলের কুপিটা তুলে ধরে এগিয়ে এল মোহনবাঁশির বাবা।

বউটা একটুও নড়লো না। সে তখন ঘুমের ঘোরে

খাঁচা থেকে বেরিয়ে আকাশে উড়ছে। সকালে সব দোকানপাট উঠে গেছে।

এদিকে ওদিকে গুড়ের ভাঙ্গা কলসি – আখের ছোবড়া, তরমুজের খোসা, পচা ডিম, ভাঙ্গা উনোন, চিল আর কুকুরের ঝগড়া। চারদিকে শান্ত ঝিল্মিলে রোদ।

কাঁধে ঝাঁকা আর মাথায় পোটলা তুলে মোহনবাঁশির বাবা জিজ্ঞেস করলে – তুঁই কণ্ডে যাইবা?

বউটার পেছনের ছায়া নড়ে উঠল। ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে রইল কলাগাছের মত। একথা ওকথা জিজ্ঞেস করার পর মোহনবাঁশির বাবা আঁচ করে নিল – বউটার একুলে ওকুলে কেউ নেই। নারায়ণ ভরসা! চল, আমার সঙ্গেই চল।

তার পেছন পেছন চলল মেলা থেকে মেলায়। যেতে যেতে ভুলে বসলো সে ছিল এক কায়েত ঘরের বউ – তার স্বামী ছিল গ্রামের এক গণ্যমান্য ব্যক্তি – যিনি দিনরাত বউকে ধরে পিটতেন, আর শালিশে আড্ডায় মুরুব্বিয়ানা করতেন।

একদিন বর্ষার রাতে ধলঘাট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বউটা ধরা দিল মোহনবাঁশির বাবার বুকে।

দু’বছর পরেই মোহনবাঁশির জন্ম!

মোহনবাঁশি কাউকে দেখেনি। না তার বাবাকে, না তার মাকে। তার বুড়ো দাদাকে জিজ্ঞেস করলে বলতো – ওরা মরে গেছে। পাড়ার লোকে জানে – তার বাবা আর মা তাকে তার ঠাকুরদার হাতে তুলে দিয়ে চলে গেছে বার্মায়। তার মায়ের বিশ^াস, ওখানে গেলে শঙ্খকুলের সেই বাঁকাবাবুটা তাদের আর খুঁজে পাবে না। সে আজ অনেকদিন আগের কথা।

একটা লালপেড়ে সাদা শাড়ি যখন মোহনবাঁশির মনের দাওয়ায় দুলে উঠে আবার মুছে যায় – তখনি সে কাজ ফেলে দুমদাম্ ঘাস মাড়িয়ে ধুলো উড়িয়ে কাদা ছাড়িয়ে গিয়ে বসে বোয়ালমারির চরে। যেখানে রোদ নরম হলে ঘাস থেকে মুখ তুলে গাইগুলো চলে যায়, ঝিঁঝিঁরা ঘুম থেকে জেগে ওঠে, – আর, আকাশের লাজুক মেঘ ধীরে ধীরে নীল হয়ে যায়। তখনি ভাবনার হাওয়া বইতে শুরু করে তার মনে। ভাবে তার মায়ের কথা।

মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখে ফুটে ওঠে ফুলরানীর ফুলের মত মুখখানা। বিয়ের আগের দিন ফুলরানী যখন পালাতে চেয়েছিল তখন মোহনবাঁশির বুকে ছিল দুর্ভিক্ষের হাহাকার।

পাঁচ বছর আগের মোহনবাঁশিটি তার মন থেকে মুছে গিয়েছিল। সেই নৌকো, সেই বিল, সেই মেলা আর সেই তেঁতুল গাছটাকে যুদ্ধের ধাক্কায় একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। না ভুলে উপায় কি! চোখের সামনে বৃন্দাবনের বউটা না খেতে পেয়ে মরে গেল। ফুলরানী যেদিন তাকে পালাতে বলেছিল সেদিন সে ফিরছে সনাতনের বউটাকে চিতায় তুলে দিয়ে।

তার বুকে তখন হাহাকার।

বৃন্দাবনের চালাঘরে অন্ধকার, পাঁচকড়ির বাচ্চা মেয়েটা ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে, সনাতন ছটফট করছে ভাতের জন্য – আর ফুলরানী তখন জিজ্ঞেস করছে, বাঁশি, তুই আমায় মন দিস্নি।

কি জবাব দেবে মোহনবাঁশি? চড় খেয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে ফুলরানীর গর্জে উঠে চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল।

কি হবে ওই ভুলকো তারায়! ওতো আকাশেরও নয়, মাটিরও নয়।

পরদিন ফুলরানী যখন পালকিতে চড়ে চলে যাচ্ছিল তখন মোহনবাঁশি একদল লিকলিকে বাচ্চাকাচ্চাদের হাঁড়িতে ঢেলে দিচ্ছিল রিলিফের চাল।

আর, পালকির দুয়ার খুলে ফুলরানী তার দিকে চেয়ে দৃষ্টির তীর হানছিল তীব্র আক্রোশে। মনে মনে বলে উঠেছিল মোহনবাঁশি – মন, তুই সব ভুলে যা।

ফুলি, তুই আর তাকাসনে আমার দিকে। যা, চলে যা। কি হবে ওই ভুলকো তারায়! তুই আকাশেরও নস্, নাটিরও নস্। তোর চোখে মরণ নদী, চুলে সর্বনাশা ঝড়, রগে রগে সাপের টগবগানি।

ফুলি, আমি আর সেই মোহনবাঁশি নেই।

বদলে গেছি। অনেক বদলে গেছি। ওই চালাঘরটার মত, ওই কালো ছায়ার মত, সনাতন খুড়োর শরীরের মত বদলে গেছি। তোকে এখন আর স্বপ্নে দেখি না। স্বপ্নে দেখি বিরাট বিরাট চালের পাহাড়, মাছ তরকারি। কখনো দেখি – রাত জেগে বসে আছি হাজার হাজার লাশ নিয়ে পাশে। কখনো দেখি – ঘরবাড়ি গাছ পাতা সব যেন ভাত ভাত ভাত করে কাঁদছে। কখনো দেখি – ভাতের সমুদ্রে সাঁতার কাটছে বৃন্দাবনের বউ সনাতনের বউ আর গগন জ্যাঠা।

আমার মা নেই।

ছেলেবেলায় বুকটা যখন খাঁ খাঁ করে উঠত তখন ছুটে যেতাম তোর কাছে। বৃষ্টির মত দৃষ্টি হেনে তুই আমার সব যন্ত্রণা ভিজিয়ে দিতিস্। কত আবদার করেছি তোর কাছে। যখন বলেছি, চল – সঙ্গে সঙ্গে তুই বেরিয়ে এসেছিস্। এখন আর সেই সব জোর খাটাবার মনের জোর নেই। এখন অনেক বদলে গেছি। যখন মনে হয় কেউ আমার নেই এই জগৎ সংসারে – তখন চুপচাপ বসে থাকি, কাঁদি, শুয়ে থাকি।

ফুলি, তুই আমায় ভুলে যা।

ফুলরানীর মুখখানা মোহনবাঁশির চোখে ফুটে উঠলে আরেকটি মেয়ের ঝাপসা মুখ কেঁপে ওঠে তার চোখের তারায় – যার মুখ দেখেনি – যার গায়ের রঙ কাঁঠালের কোয়ার রঙের মত কি বিকেলের রোদের মত তা কোনদিন দেখেনি। এমন একটি মেয়ের মুখ উঁকি দেয় মাঝে মাঝে ।

না দেখলেও তার নামটা জানে মোহনবাঁশি।

পুত্লি।

পুত্লি হরি যুগীর মেয়ে। যুদ্ধের আগুন লাগতেই প্রথমে জ্বলে গেল জানালিহাটের যুগীপাড়াটা। ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়ে-মরদ বেরিয়ে গেল ভিটে ছেড়ে।

একদিন জানালিহাট ইষ্টিশনের চায়ের দোকানে বসে মোহনবাঁশি বিড়ি ফুঁকছিল – এমন সময় হরিযুগী এসে ভ্যা করে কেঁদে জড়িয়ে ধরল তার দু’টি পা। ঘটনা কি? ঘটনা ভয়ানক। আজ সকালে মতি দালাল তাকে লোভ দেখিয়ে গেছে – পুত্লিকে বেচলে পাঁচশ’ টাকা পাওয়া যাবে।

কাঁদতে কাঁদতে হরি বলল – আয়ারে বাঁচা অ পুত। আঁয়ার পুত্লি সাহেব পাড়ার খান্কি হইত্ ন পারিবো।

মুহূর্তে মোহনবাঁশির মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল এক সরুগলি। তার এধারে ওধারে দাঁড়িয়ে আছে কতকগুলো মেয়েলি ছায়া। কারো ঠোঁটে বিড়ি, কারো কারো খোঁপায় চাপা বেলী জুঁই। কেউ গুনগুন করে গাইছে – আমার এ সাধের বাগানে একজোড়া ডালম্ ধইরাছে।

শিউরে উঠল মোহনবাঁশি।

হরিকে জড়িয়ে ধরে বলল – কোন চিন্তা নাই। আঁই তোঁয়ার পুত্লিরে বিয়া কর্ইগ্যম।

খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উপোসী রোগা হরিযুগীর মুখাবরণে ফুটে উঠল খুশির কান্না – রুক্ষ রোদেপোড়া জমির ওপর নেমে আসা এক পশলা বৃষ্টির মত।

তারপর কাঁপতে কাঁপতে বলল – তুই আঁয়ার বাপ, তুই আঁয়ার বাপ। মোহনবাঁশি কথা দিয়েছে – পুত্লিকে সে বিয়ে করবে।

পুত্লি – অর্থাং পুতুল – সেই পুতুলের দেহে মনে বইয়ে দেবে প্রাণের নদী। দেহপসারিণীব সরু গলিটা মুছে গিয়ে মোহনবাঁশির চোখে ফুটে উঠল একটি সরু পথ – যার দু’ধারে কলাই মরিচ রাই সরিষার খেত।

সেই সরু পথ দিয়ে কাঁখে কলসি নিয়ে এগিয়ে আসছে একটা কলাপাতা রঙের শাড়িপরা বউ। নাকে নাকবোলক্, আধভাঙ্গা চাঁদের মত কপালে জ্বলজ্বলে টিপ – তার নিচে যেন দুটো কোকিল আছে বসে।

একটু স্বপ্ন, একটু মায়া, একটু ভালবাসা আর মাথায় টোপর ও গলায় রঙীন কাগজের মালা পরে – সাথে একজন পাতার সানাই একজন দগরওয়ালা নিয়ে মোহনবাঁশি যেদিন হরিযুগীর চালাঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল – তখন কেউ তাকে বরণ করতে আসেনি। অন্ধকারে গুম মেরে বসেছিল চালাঘরখানা।

পাশের আমগাছটা একবার জ্বলছিল, একবার নিভছিল। সানাই শুনে কেউ এগিয়ে এল না। গতকাল দুপুরে বণিকদের বাড়িতে দরিদ্র নারায়ণ সেবার খিচুড়ী খেয়ে সারারাত যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সকালে মারা গেছে হরিযুগী, হরিযুগীর বউ আর কচুর লতির মত বাচ্চাটা।

পুত্লি বিকেল অবধি ছিল গোঙাতে গোঙাতে।

দূর থেকে পাতার সানাইর সুর শুনতে শুনতে কিছুক্ষণ আগে নীরব হয়ে গেছে। পাড়াটা নিঝুম।

ভিটে সব ফাঁকা। একটা উজাল জ্বালিয়ে নিয়ে মোহনবাঁশি ঢুকেছিল হরিযুগীর ঘরে।

ঢুকেই সুপোরী গাছের মত স্থির হয়ে রয়েছিল। তার কল্পিত বউ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। মাথায় জটা জটা চুল, মজা মুখ, চুপসে যাওয়া মাই, হাড় বের করা কাঁধ। সে ছবি মনে পড়লে মোহনবাঁশির মুখ আকাশের মেওলার মত হয়ে যায়।

সে আর বিয়ের কথা ভাবে না।

কি হবে আর বিয়ের কথা ভেবে! যেদিকে তাকাও সেদিকেই চিতার ধোঁয়া। সে বলে – বিয়ে তার হয়ে গেছে। সেই রঙীন কাগজের মালাটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে টিনের বাক্সে – যেখানে ভাঁজ করা আছে তার মায়ের লালপেড়ে শাড়িখানা।

মোহনবাঁশির ভাবনা এখন কাহারপাড়াকে নিয়ে। কাহারপাড়া যেন তার বুকের ভেতবে ঢুকে গিয়ে ভাত ভাত করে চেঁচাচ্ছে। চেঁচিয়ে বলছে – বাঁচাও, বাঁচাও।

কি করে বাঁচাবে!

যেদিকে যাও সেদিকেই একই কান্না। তেলিপাড়ার একদল লোক ভাত ভাত করে এখানে সেখানে ঘুরে জানোয়ারের মত হয়ে গিয়েছে। চেনাই যায় না। ময়লা লম্বা লম্বা নখ, জটবাঁধা চুল, লেংটা।

মোহনবাঁশি ওদের বলেছিল – মিলিটারী ক্যাম্পের বাইরে দাঁড়িয়ে – খুড়া, তোঁয়ারা ঘরৎ যা।

ওরা হা করে তাকিয়েছিল মোহনবাঁশির দিকে।

মোহরার ঢুলীপাড়ায় সন্ধ্যা হলে আগে টুমটুমাটুম্ বোল শোনা যেত।

এখন শেয়াল ডাকে সেখানে। ভিটের ঘরগুলো কাত হয়ে পড়া। সূর্য ওঠে কি ডোবে মাটি আছে কি নেই – তা আর জানে না ঢুলীপাড়ার লোকেরা।

পাঁচলাইশের হাঁড়িপাড়ার চালাঘরগুলো একদিন সাঁৎ করে জ্বলে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড হাসি – খেঁদু পাগলার। তার হাতে জ্বলন্ত উজাল। সেই-ই ধরিয়ে দিয়েছে আগুন। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে – খা, খা। সব খেয়ে যা। মরা মানুষ সব খেয়ে যা।

মোহনবাঁশি তাকে ধরতে গিয়েছিল। ইয়াকুব আর নিতাই পাল তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল – তুইও পাগল হলি নাকি।

আগুন না লাগালে মরা মানুষের গন্ধে টেকা যেত না।

হু হু করে উঠেছিল মোহনবাঁশির বুক।

মোহনবাঁশির ভাবনা এখন – কি করে বাঁচানো যাবে সবাইকে! যামিনীদা, লক্ষ্মণ, নিতাই শীল, ইয়াকুব, শীতল পাল – সবার দিকে তাকিয়ে সে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল – মিছিল টিছিল আর নয়। যারা ধান চাল জমা করে রেখেছে তাদের কাছে যেতে হবে আমাদের। বলতে হবে – বাঁচাও সবাইকে।

বলেই মোহনবাঁশি কারো কাছে কোন জবাবই পেল না। সবাই তাকিয়ে রইল তার দিকে হা করে। হারিকেনটা দুলছে সবার মুখের সামনে।

গভীর রাত তার হাত বাড়াচ্ছে কাহারপাড়ার দিকে। গাছে জোনাকী, আকাশে তারা। ঝিম ধরে বসে আছে ঘরগুলো।

বড় সড়ক থেকে নেমে বিলের আল্ ধরে এগিয়ে আসতে লাগল মতি দালাল। পেছন পেছন দুটো মূর্তি, দুটো গোরা সোলজার। টর্চের আলো কখনো জ্বলছে, কখনো নিভছে।

মতির কাছে এ কাজ নতুন নয়। কত সোলজারকে সে এমনি পেছন পেছন লেলিয়ে নিয়ে এসে কত মেয়েকে ধরিয়ে দিয়েছে তাদের জিবের সামনে।

মতি বলে – এ কাজে পয়সা আছে। কুম্‌ছাডা কাজ – একটু হুসিয়ার থাকলেই হল।

মতি দালাল।

বাপ পর্যন্ত পালকির বেয়ারা ছিল। বুদ্ধি বাড়াব সাথে সাথেই মতি জানিয়ে দিল – ও কাজ আমার দ্বারা হবে না। আমি অন্য কাজ করব। এর জিনিস ওকে দেব, এর জিনিস একে – ব্যস, মাঝখান থেকে আমি পাব টাকা। দুনিয়াটাই তো এই দালালির ওপব চাক্‌ দিচ্ছে।

মতির প্রথমে হাতেখড়ি হয়েছিল বিন্দু খুড়ীর পায়রা জোড়া দিয়ে।

কচি পায়রাগুলো উঠোনে বসে ধান খাচ্ছিল।

মতি এসে বলল – খুড়ী কইতর বেচিবা।

না।

বহুৎ দাম পাইবা। এক টাকা।

এক টাকা শুনে বিন্দু খুড়ীর আমের আঁটির মত চিবুকখানা নড়ে উঠেছিল। রাজী হয়ে গিয়েছিল তখুনি।

বিকেলে আমগাছের ছায়ায় একটি লোককে দাঁড় করিয়ে রেখে একটি টাকা খুড়ীর হাতে তুলে দিয়ে পায়রাগুলোকে নিয়ে চলে গিয়েছিল মতি।

মতির বয়স তখন দশ কি এগারো বছর।

পায়রা থেকে ছাগল, ছাগল থেকে গরু, গরু থেকে ধান, ধান থেকে জমি – তারপর জমি থেকে মেয়েমানুষ। এই সবের দালালী করতে করতে মতির বয়স এখন পঞ্চাশটা খাল বিল পেরিয়ে গেছে।

মতির বউটা বলে – ওই কাজ ছেড়ে দাও। তোমার মেয়ে আছে, ছেলে আছে, ছেড়ে দাও।

দাঁত দিয়ে জিবের ডগা চেপে ধরে বলে মতি – ছাড়ি দিয়ম্।

মতি অনেকবার চেষ্টাও করেছে। পারেনি।

সোলজারদের টাটকা নোটগুলো দেখলে সে তার সব কিছু ভুলে যায় – ভুলে যায় সে একটি মানুষ, তার সাজানো গোছানো সংসার আছে, ছেলে-মেয়ে আছে, আছে টিনের ছানি দেওয়া দোতালা মাটির ঘর, লাঙ্গল জোয়াল গোলাঘর গোয়ালঘর।

টর্চের আলো ছড়িয়ে এগোচ্ছে মতি। পেছন পেছন গোরা সোলজার দুটো। রাত বাড়ছে। হঠাৎ একটা মেয়েলি চিৎকার শুনে অন্ধকার দাওয়ার ওপর চমকে উঠল শ্রীনাথ।

নকুলের বউয়ের গলা বলেই মনে হল।

নকুল আজ তিনদিন হল উধাও। বউটা সকালে শ্রীনাথের বউয়ের কাছে এসেছিল দু’সরা চালের জন্য। শ্রীনাথের বউ বলেছিল – এখন তো কিছু নেই, রাত্রে আসিস্। চাল কেন – তোকে আমি রুটি মাংসও দেব।

আহা! বউটা খুব লাজুক।

লক্ষ্মীছাড়া নকুলটা এমন সতীলক্ষ্মীকে একলা ফেলে চলে গেল। গাল দিতে দিতে শ্রীনাথ দাওয়া থেকে উঠে ঘরে গেল। সেখান থেকে বাতি জ্বালিয়ে এনে দাওয়ায় এসে বাঁশের ফালি দিয়ে একটা উজাল ধরিয়ে নিল।

উজাল হাতে শ্রীনাথ চলল নকুলের ঘরের দিকে।

নকুলের বউটা সকালে শ্রীনাথের ঘর থেকে এসে সেই যে দাওয়ায় খুঁটি ধরে বসেছিল আর নড়েনি। নড়বেই বা কেমন করে! আজ তিনদিন উপোস। সমস্ত শরীর বেশদ্।

দুপুরে মতি এসে হাজির।

এই নকুল!

বউটা ঘোমটা টেনে ঘরের ভেতর গিয়ে বলল – নেই। নকুলের কাছ থেকে দুটো টাকা পেত মতি। সেই প্রসঙ্গ না তুলে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল – চাইল ডাইল আছে তো?

না?

একটা পাঁচ টাকার নোট দাওয়ায় রেখে বলল মতি – ধরো, লও। রাতিয়া সাজিগুজি থাইক্য। এই কাম কর – নইলে মরি যাইবা।

বলেই মতি দালাল ছায়ায় ছায়ায় সরে গিয়েছিল।

বউটা ফ্যালফ্যাল্ ক’রে চেয়ে রইল নোটটার দিকে। ওটা দিয়ে অনেক কিছু পাওয়া যাবে – চাল ডাল কুমড়োর ডগা, শুঁটকি মাছ, – সব।

বউটা নোটটার দিকে চেয়ে রইল দুপুর থেকে বিকেল অবধি। সন্ধ্যা হতেই সেটা উড়ে গিয়ে উঠোনে পড়ে তার দৃষ্টি থেকে মুছে গিয়েছিল।

তারপর কি মনে করে বউটা চারদিকে হাতড়ে বের করল একটা তালপাতার ঝাঁপি।

তার থেকে একটা শাড়ি নিল তুলে। শাড়িটা তার বিয়ের। ওটা পরলো। বাঁশের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে খিল্‌ খিল্‌ ক’রে হাসলো, কাঁদলো, গুনগুন করে গাইলো – ওরে ও বন কইতরা। এ জনমে তার লগে আর ন হৈব দেখা। তুমি তারে কইও আমার কথা।

গাইতে গাইতে হঠাৎ তার চোখে ভেসে উঠল কতকগুলো গোরা সোলজারের বীভৎস মুখ।

তখুনি সে পরণের শাড়িটা নিজের গা থেকে খুলে নিয়ে দড়ির মত পাকিয়ে ঘরের ভেতরের চালের সঙ্গে বেঁধে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একটা করুণ চিৎকার দিয়ে চিরকালের জন্য চুপ হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পর উঠোনে টর্চের আলো।

সোলজার দুটোকে নিয়ে মতি এসে দাঁড়িয়েছে। একজনকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে মতি বলছে – গো আন্ সাব।

সোলজারটা ভেতরে ঢুকেই টর্চ মেরে ফাঁসে ঝোলা বউটাকে দেখে শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি পা ফেলে উঠোন পেরিয়ে চলে গেল।

মতি অবাক।

সে ঢুকল ঘরে। টর্চের আলো জ্বেলেই আবার নিভিয়ে দিল। তারপর তার সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। পালিয়ে গেল সে।

আরেকজন গোরা সোলজার, যে দাঁড়িয়ে ছিল উঠোনে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে, সে ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে ঢুকল ঘরে।

টর্চ জ্বেলে তাকিয়ে রইল সে নকুলের বউয়ের ঝোলান নগ্ন দেহটার দিকে।

একটুকুও নড়ল না, একটুও শিউরে উঠল না ভয়ে বা আপশোষে।

বরং অর্ধদগ্ধ সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জড়িয়ে ধরল মৃত বউটাকে। আর, তখুনি উজাল হাতে দাওয়ায় এসে দাঁড়াল শ্রীনাথ।

গলা খাঁকারি দিল, ডাক দিল নকুলের নাম ধরে – তারপর ঘরে ঢুকেই তার দুই চোখ পাথরের মত স্থির।

শ্রীনাথের দেহে কে একজন আক্রোশে জ্বলে উঠল। মুহূর্তে উজালের জ্বলন্ত আগুন সে এই গোরা সোলজারের চোখে-মুখে লাগিয়ে দিল।

বিকট চিৎকার দিয়ে জানোয়ারের মত লাফাতে লাফাতে ছুটে চলে গেল সোলজারটা। শ্রীনাথ থ। কি জানোয়ার। আহা বউটা মরে গেল! বুকে তার শোকের নদী – কাঁদতে কাঁদতে যেন একূল ওকূল ভেঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিড় বিড় করে কি বলতে বলতে শ্রীনাথ পা বাড়িয়ে দিল পথে – যে পথে তার বউ আর মেয়েটা চলে গেছে সন্ধ্যায়।

দু’ধারে ঝাউগাছ রেখে বৃহৎ সড়কটা চলে গেছে রাঙামাটির দিকে।

সেখানে এসে হাঁফাতে লাগল শ্রীনাথ।

সড়কের ওপর সাঁ সাঁ করে একটার পর একটা জিপ লরি চলে যাচ্ছে – তার আলোয় ঝলসে উঠছে শ্রীনাথের ঘর্মাক্ত মুখ। কিছুদূরে একটা বাচ্চা মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে সে চমকে ওঠে।

অমা, মারে, আইও।

তার মেয়ে।

লুকিয়ে ছায়া হয়ে সে ঝোপের ধারে গিয়ে বসল। আর, ঝোপের ওপাশেই সোলজারটা কাকে যেন বলছে – এই চিকো, হাম্ টুমকো বহুৎ রটি দেগা।

সঙ্গে সঙ্গে খিল্খিলে মেয়েলি হাসি।

হাসির শব্দ শুনে তার শরীর অবশ।

এতদিনে সে বুঝতে পেরেছে – রোজ সন্ধ্যায় বউটা সেজেগুজে যায় কোথায়। রুটি মাংস টিনভরা দুধ রোজ আসে কোত্থেকে। সব ভেবে তার নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেল। বউয়ের গা বিক্রির রোজগার সে এতদিন খেয়েছে। আর না। ঝোপের ধারে ওঁৎ পেতে বসে রইল সে।

সোলজারটা টর্চের আলো ফেলে চলে গেল। এদিকে মেয়েটা চেঁচাচ্ছে – অমা, আইও। বউয়ের ছায়া ঝোপের ওধার থেকে এধারে আসতেই তাকে লাফিয়ে জড়িয়ে ধরে নিচে ফেলে দিল শ্রীনাথ। ছটফট করতে করতে চেঁচাতে চেষ্টা করল বউটা। পারল না। শ্রীনাথের শক্ত থাবা তখন তার গলা টিপে ধরেছে।

তবু অতি কষ্টে বলেছিল – আমি কি করব বল! তুমি তো বাতদিন পুতুল নিয়েই মশগুল। ভাত আসবে কোত্থেকে। কবে তোমার মেলা বসবে – তা ভেবে তো পেট ভরবে না। তাই আমি এই পথ ধরলাম। আমি –

আর কিছুই বলতে পারল না বউটা।

ওদিকে মেয়েটা চেঁচাচ্ছে – অমা, মারে, আইও।

শ্রীনাথ এসে দাঁড়াল মেয়ের সামনে।

খুশিতে ডগমগ হয়ে বাপকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল মেয়েটা – অমা, বাবা আইসো। একটানে মেয়েকে কাঁধে তুলে নিয়ে শ্রীনাথ চলতে শুরু করে দীর্ঘ সড়ক ধরে।

মেয়ে জিজ্ঞেস করে – মা ন যাইব?

ঝোপের দিকে চোখ ফেলে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চলতে চলতে জবাব দেয় শ্রীনাথ – না।

একদল গোরা সোলজার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বুটের শব্দ তুলে এসে দাঁড়ায় কাহারপাড়ার ঘরগুলোর সামনে।

এসেই তিন ভাগ হয়ে গেল। সবার হাতে রাইফেল।

ফাঁদ পেতে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে ফুলরানী।

ঘুমোতে ঘুমোতে স্বপ্ন দেখছে – ভোরের নদী, সূর্য উঠছে পাহাড়ের চুড়ো বেয়ে মায়ের স্তনে ঠোঁট লাগান শিশুর মত। ঝাঁক বেঁধে পাখিরা উড়ে চলে যাচ্ছে পশ্চিম দিকে। ঠাণ্ডা হাওয়া।

ছইয়ের নিচে বসে আছে সে। সাম্পান বাইছে মোহনবাঁশি। জিজ্ঞেস করছে ফুলরানী – বাঁশি, তুই আমায় কোথায় নিয়ে চলছিস্?

মোহনবাঁশির দাঁড়টানার শব্দই যেন জবাব দিচ্ছে – তোর দেশে।

বাঁকের পর বাঁক পেরোচ্ছে – খেজুর আম জাম কাঁঠাল সুপোরী নারিকেল গাছগুলো পেছনে সরে যাচ্ছে – সব সরে যেতে যেতে একটা ঘাটে এসে নৌকো লাগতেই ফুলরানী চেঁচিয়ে উঠল – না, না, আমি যাব না।

মোহনবাঁশি শব্দহীন হেসে ছইয়ের ভেতর ঝুঁকে তাকিয়ে বলল – ফুলি, তোর দেশ এসে গেছে।

ফুলরানী মাথা দুলিয়ে বলল – না।

ঘাটে দাঁড়িয়ে তার বুড়ো জোতদার স্বামী চেঁচাচ্ছে – ওগো এস।

ডুকরে কেঁদে উঠে মোহনবাঁশিকে জড়িয়ে ধরে বলল ফুলরানী – বাঁশি আমি এই বুড়োর ঘর করব না। আমি তোকে ভালবাসি। তুই ছাড়া আমার কেউ নেই, বাঁশি, আমি তোকে ভালবাসি।

মোহনবাঁশি ফিস্ফিস্ করে জবাব দেয় – ফুলি, আমার অনেক কাজ। তোকে নিয়ে ঘর করা আমার সাজে না।

ফুলরানীর মুখ জলে ডোবা।

তাকে ঘাটে তুলে দিয়ে মোহনবাঁশি নৌকোর ছপছপ শব্দ তুলে চলে গেল।

তার বুড়ো স্বামী খক্‌খক্ করে কাশতে কাশতে বলছে – বউ, চল্ ঘরে যাই। আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছে ফুলরানী – বাঁশি, তুই আমায় নিয়ে যা। বাঁশি, বাঁশি, বাঁশি। … স্বপ্নের ঘোরে চেঁচাচ্ছিল ফুলরানী।

এমন সময় একদল সোলজার এসে ঢুকল সেই ঘরে। কয়েকটি টর্চের আলোয় ফুটে উঠল ফুলরানীর দেহের ভরা গাঙ।

একজন গিয়ে চেপে ধরল তার মুখ। আরেকজন গিয়ে শাড়িখানা ছিনিয়ে নিল গা থেকে।

তারপর একজনের পর একজন।

বিধ্বস্ত জমির মত চিৎ হয়ে পড়ে রইল ফুলরানী।

বাইরে রাইফেলের গর্জন।

মতি ভাত খেতে বসেছিল। তড়াক করে এক লাফ দিয়ে সে গুদামঘরে চলে গেল। ডাকাত এসেছে। তার ঘর লুট করবে। গুদামঘরে একটা রাইফেল আছে – এটা সে এক মিলিটারির কাছ থেকে কিনেছিল।

রাইফেলটা নিয়ে সে চুপি চুপি সবাইকে ডেকে একঘরে বেঁধে রেখে দোতলার ওপর উঠে গেল।

সেখান থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে লাগল।

এদিকে একসাথে গর্জে উঠল দশ-বারোটা রাইফেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভারী জিনিস দোতলা থেকে মাটিতে পড়ল। শব্দ হল ঝুপ ।

মতির ঘরে গিয়ে ঢুকল সোলজাররা। ব্যাঙকোহাল্ করে উঠল সবাই।

লক্ষ্মণের মা আশি বছরের থুড়থুড়ে বুড়ি। খাওয়া নেই দাওয়া নেই – তবু কোনমতে বেঁচে আছে। রাইফেলের শব্দ শুনে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল – কি মুস্কিল। এত রাইতে বাজী কেয়া পুড়ের।

বলেই আরেকটা গুড়ুম করে শব্দ হতেই উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

সনাতন আর তার মেয়ে সকালে গিয়েছিল ষোলসহর ইস্টিশানে।

প্ল্যাটফর্মে ভিক্ষে করে চার পাঁচ সের চাল পেয়েছিল। মেয়েটা উনোনে হাঁড়ি চাপিয়ে বসে আছে। সনাতন ক্লান্তিতে চাটাইয়ে শোয়া।

আর, বাইরে গর্জন – রাইফেলের।

মেয়েটা চিৎকার করে লাফ মেরে জড়িয়ে ধরল বাপকে।

চারজন সোলজার এসে ঢুকল ঘরে।

মেয়েটা মুখ লুকাল সনাতনের বুকে – ভয়ার্ত কুকুরছানার মত ।

গুড়ুম গুড়ুম গুড়ুম।

দাওয়ার ওপর সাজানো পুতুলগুলো ভেঙ্গে গেল শ্রীনাথের। ঘরে কাউকে না পেয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল সোল্জাররা। সেই ঘরপোড়া আগুনে দেখা গেল উঠানে দাঁড়িয়ে মতির ছাগলের বাচ্চাটা একটানা চেঁচাচ্ছে।

কসাইপাড়ায় হৈ চৈ।

ভাঙ্গা সাঁকোটা পেরোলেই কসাই পাড়া। সেখানে গিয়ে ঢুকেছে সোলজাররা। গুড়ুম্ গুড়ুম্ গুড়ুম্ শব্দ।

দূর থেকে গুলির শব্দ শুনে মোহনবাঁশি একলাফে বেরিয়ে পড়ল আঁতুরার ডিপোর চায়ের দোকান থেকে।

লক্ষ্মণ, যামিনীদা, ইয়াকুব, নিতাই, মধু কামারও ছুটতে লাগল কাহারপাড়ার দিকে। ওরা চুপিচুপি এসে থামল লক্ষ্মণের ঘরের পেছনে।

সবাইকে ফিস্ফিস্ করে মোহনবাঁশি কি বলল। তা শুনে যামিনীদা, শীতল, নিতাই, মধু কানার অন্ধকারে গা 888sport app দিয়ে চলে গেল।

মোহনবাঁশি আর ইয়াকুব বুকে ভর দিয়ে কখনো হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায় তার ঘরের দিকে।

গোরা সোলজাররা তখন কসাইপাড়ার ঘরে ঘরে।

নিজের ঘরে এসে ঢুকতেই মোহনবাঁশির পায়ে ঠেকল ফুলরানীর অচেতন দেহ। রক্তাক্ত, ভেজা।

কে?

দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালাল ইয়াকুব। পরমুহূর্তেই তা কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল। ফুলি?

থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মোহনবাঁশি গিয়ে বসল ফুলরানীর শিয়রে। ডাকল – ফুলি, ফুলরানী।

জবাব নেই।

মোহনবাঁশি তাড়াতাড়ি দেশলাই জ্বেলে তালপাতার ঝাঁপি থেকে মায়ের লালপেড়ে শাড়িটা বের করে এনে ফুলরানীর শরীরে পরিয়ে দিল। সুরই থেকে আঁজলা ভরে জল নিয়ে তা ছিটিয়ে দিল ফুলরানীর চোখে মুখে চুলে। পাখার হাওয়া দিল। ফিস্ফিস্ করে ডাকল কয়েকবার।

রাগে ফুলতে ফুলতে ইয়াকুব তখন ছুটে গেছে বাইরে। যে করে হোক চুপেচাপে একজন সোলজারকে সে আজ রাত্রে ধরবেই।

চারিদিকে হৈ চৈ শব্দ।

এ গ্রাম ও গ্রাম ভেঙ্গে লোকজন আসছে লাঠি নিয়ে, শেল্ বল্লম্ নিয়ে। হাতে হাতে জ্বলন্ত উজাল। হাজার হাজার জ্বলন্ত চোখ যেন জোনাকির মত ধেয়ে আসছে।

সোলজাররা গুলি ছোঁড়া বন্ধ রেখে কসাইপাড়ার পুকুরের অন্ধকার পাড়ে এসে দাঁড়াল। উন্মত্ত তরঙ্গের মত চারদিক থেকে লোকজন ছুটে আসছে। সোল্জাররা লাইন করে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ছুড়তে লাগল রাইফেলের গুলি।

ধড়াৎ ধড়াৎ করে পড়ে গেল একঝাঁক লোক।

চিৎকার, কান্না, কোলাহলে কেঁপে উঠল কসাইপাড়ার অন্ধকার। পেছন থেকে সোলজারদের ওপর বর্ষণ শুরু হল লাঠি, ছোরা আর জ্বলন্ত আগুন।

ওরা আর দাঁড়াতে পারল না। হাজার হাজার লোকের গর্জন শুনে ওরা পালাতে শুরু করল। কেউ পালিয়ে গেল, কেউ ধরা পড়ল।

তারপর জনতরঙ্গের বিরাম নেই।

ষোলসহর, পাঁচলাইশ, ফতেয়াবাদ, নাসিরাবাদের লোকজন পায়ের শব্দ তুলে গমকে গমকে এগিয়ে আসছে।

মোহনবাঁশি মৃত ফুলরানীর শিয়রে বসে তখন ডাকছে এক একজনের নাম ধরে। ও মতি খুড়া!

মতি দালাল ব্যাঙের মত উঠানে চিৎ হয়ে শোয়া! জিব বের করা।

– ও নকুল ভইজ।

নকুলের বউ ফাঁসের দড়িতে শুকোতে দেওয়া ধোবার কামিজের মত লটকাচ্ছে।

ছিরিনাথ জ্যাডা, ও ছিরিনাথ জ্যাডা।

শ্রীনাথ তখন মেয়েকে কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছে দীর্ঘ সড়ক ধরে। দুধারে ঝাউ, পলাশ, জারুল গাছ। পাখি ডাকছে। পূর্ব আকাশ লাল।

সূর্য আসছে রাতের অন্ধকার ঢেকে দিতে।

সুচরিত চৌধুরী

জন্ম ১৯২৯ সালের ২১শে জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কধুরখীল গ্রামে। কথা888sport live footballিক, কবি ও গীতিকার। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করার পর আর শিক্ষায়তনিক শিক্ষা অব্যাহত রাখেননি অ্যাকাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। চমৎকার বাঁশি বাজাতেন। 888sport live footballকর্ম ও সংগীতসাধনার সূত্রে সংবাদপত্র-সাময়িকী এবং চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছোটগল্পে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেন বাংলা একাডেমি 888sport app download bd। সুচরিত চৌধুরী ১৯৯৪ সালের ৫ই জানুয়ারি পরলোকগমন করেন।