এক পরিক্রমা কথা

১৯৫০-এর জুন মাসে দার্জিলিংয়ে ‘বনলতা সেনে’র সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ এটুকু পড়ে পাঠক অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই। তাহলে খুলে বলি।
১৯৫০-এ গরমের সময় মা ও দাদার সঙ্গে আমরা জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ে গিয়েছিলাম। তখন দারুণ ধস হয়। ধসে সব পথঘাট বন্ধ হয়ে যায়। কিছু করার নেই। আমি কাছের একটা বইয়ের দোকান থেকে একটা বই কিনি। নাম আঠারো বসন্ত, তাতে ছিল কয়েকজন বাঙালি লেখকের প্রেমের গল্প ও 888sport app download apk। প্রথম গল্প মনীন্দ্রলাল বসুর ‘দার্জিলিঙে’। তাই দেখেই হয়তো আঠারো বসন্ত কিনেছিলাম। বাড়িতে এসে গল্পটি পড়ে দেখি বইটিতে একটি 888sport app download apk ‘বনলতা সেন’। কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। 888sport app download apkটিও নতুন ধরনের, কবির নামও অজানা। কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, এমনকি প্রেমেন্দ্র মিত্রেরও নাম জানতাম। বরং প্রেমেন্দ্রর সঙ্গে আমার স্কুলবেলা থেকে চেনাজানাও ছিল। জলপাইগুড়িতে এসে তাঁকে লিখলাম ‘জীবনানন্দ দাশ কে?’ তিনি লিখলেন, ‘জীবনানন্দ অন্য ধরনের কবি।’ ছোট্ট উত্তর।
১৯৫১-তে আমি জলপাইগুড়ি কলেজের ছাত্র। গ্রীষ্মের ছুটিতে সহপাঠী নিতাইয়ের সঙ্গে যাই শান্তিনিকেতনে। অন্নদাশঙ্করের পথেপ্রবাসে পড়ে জেনেছিলাম ইউরোপের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজের ছুটি পেলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে বেড়াতে। নিতাই ও আমি গেলাম শান্তিনিকেতনে। অন্নদাশঙ্কর রায় তখন অকাল অবসর নিয়ে শান্তিনিকেতনে বাসা ভাড়া করে আছেন। শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাঁর বাসা খুঁজে খুঁজে বের করলাম। তখন তিনি সাদা ট্রাউজার্স ও হাফহাতা সাদা শার্ট পরে র‍্যাকেট হাতে কোথাও টেনিস খেলতে যাচ্ছিলেন। আমরা জলপাইগুড়ি থেকে এসেছি শুনে ঘরে গিয়ে পোশাক পালটে এলেন – এবার খদ্দরের ধুতি, গেরি পাঞ্জাবি, টেনিস র‍্যাকেটের বদলে হাতে টর্চ। আমাদের নিয়ে হাঁটতে চললেন। এই রাস্তাটা কোথায় গেছে জানতে চাইলে বললেন, ‘শ্রীনিকেতনে। তবে অতদূর যাব না।’ ফিরতি পথে আধো অন্ধকার দেখে মনে পড়ল ‘বনলতা সেন’ ও জীবনানন্দ দাশের কথা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘জীবনানন্দ দাশের 888sport app download apk কেমন লাগে আপনার?’ তিনি বললেন, ‘জীবনানন্দ আমাদের শুদ্ধতম কবি।’
শান্তিনিকেতন থেকে দু-বন্ধু আসি কলকাতায়, উঠি প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে, থাকি তাঁর বড় ছেলে মৃন্ময়ের (মনা) ঘরে। প্রেমেন্দ্রকে বলি, ‘জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে আলাপ করতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘ওঁর একটি 888sport app download apk পড়ে আলাপ করতে যেও না, ওঁর 888sport app download apkর বইগুলো পড়ে নাও। তারপর যেও।’ আমি কলেজ স্ট্রিটে যাই। খুঁজে খুঁজে পাই সাতটি তারার তিমির। কিনে আনি। নতুন বই। আমার হাত থেকে নিলেন প্রেমেনদা, তাঁর হাত থেকে নিলেন ধীরাজদা (ধীরাজ ভট্টাচার্য)। ধীরাজদা আগে ছিলেন পুলিশে, তারপর এলেন সিনেমাতে। প্রেমিক হিসেবে আদর্শ অভিনেতা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সমাধান সিনেমায় ভিলেনের চরিত্র করেন। তারপরে কালো ছায়া, হানাবাড়ি, ডাকিনীর চরে ভিলেন। এই ছবিগুলোয় ধীরাজদাকে দেখে নরেশ মিত্র কঙ্কাল ছবিতে ধীরাজদাকে ভিলেনের চরিত্র দেন।
ফিরে আসি জীবনানন্দ প্রসঙ্গে। ধীরাজদা সাতটি তারার তিমিরের প্রথম 888sport app download apkটি বের করে পড়া শুরু করলেন, ‘সুরঞ্জনা, অইখানে যেও নাক’ তুমি, বোলো নাক’ কথা, ওই যুবকের সাথে।’ 888sport app download apkটি বারবার পড়লেন। অনবদ্য আবৃত্তি। শেষে আমাকে বললেন, ‘জীবনানন্দের কাছে গেলে বলো, বড় ভালো লেগেছে আমার।’ তখন প্রেমেনদা বললেন, ‘ওকে জীবনানন্দের বাসা বুঝিয়ে দাও তো।’ প্রেমেনদার কথা বলা জটিল ছিল, কিছু মুখে বর্ণনা করতে হলে গুলিয়ে ফেলতেন, অথচ লেখাতে অতি স্পষ্ট, সরল। অন্তত 888sport liveে। গল্পে অস্পষ্টতা এক অদ্ভুত ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। কিছু ব্যক্ত, কিছু গুপ্ত।
ধীরাজদা বুঝিয়ে দিলেন – দেশপ্রিয় পার্কের পশ্চিমে একটা পেট্রোল পাম্পের দু-একটা বাড়ি পরে একটা দোতলা কি তিনতলা বাড়ির একতলায় থাকেন। একাকিত্বই তাঁর পছন্দ। প্রেমেনদা যোগ করলেন, ‘বরিশাল থেকে এসে এখানে বোধহয় মানিয়ে নিতে পারছেন না।’
যা হোক, খুঁজে খুঁজে বের করলাম। বের করতে বেশ কষ্টই হলো। বাইরে শুধু একটা নম্বর ১৮৩। কলিংবেল বাজাতে একজন বৃদ্ধা এলেন। জীবনানন্দের নাম বলাতে বললেন, ‘পাশের দরজাতে দেখুন।’ পাশের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লাম। হঠাৎ খেয়াল করি দরজার ওপরের দিকে এক কোণে কলিংবেল। কলিংবেল বাজানোর বেশ কিছু পরে দরজা খুলে উঁকি মারলেন এক ভদ্রলোক – গায়ে ধুতির খুঁট জড়ানো, বেশ বলিষ্ঠ, কিন্তু মুখে ভয় বা সন্দেহ। অচেনা আগন্তুক দেখে দরজা একটু দ্বিধা করেই যেন আদ্ধেক খুললেন। আমি বললাম, ‘আমি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছ থেকে আসছি।’ শুনে দরজা পুরো খুলে ভেতরে ডাকলেন। উঠোন, সামনে নিমগাছ, উঠোনে টাঙানো তারে শাড়ি, পেটিকোট ইত্যাদি। উঠোন থেকে দু-ধাপ বা এক ধাপ উঠে বারান্দায় উঠলাম। দরজা দিয়ে ভেতরঘরে। আমি জানলার ধারে মোড়ায়, তিনি ঘরের মাঝখানে একটা টুলে। প্রথমে দুজনেই নির্বাক। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রেমেন কেমন আছে? ও কি 888sport live football ছেড়ে দিলো?’ বললাম, ‘আপাতত সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত আছেন, কিন্তু 888sport live football ছাড়েননি। বছরে অন্তত একটা মজাদার গল্প লেখেন।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার – আপনার নাম কী?’ আমার নাম বলে বললাম, ‘আমাকে তুমি করেই বলুন।’ এভাবে থেমে থেমে কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরে আমি বললাম, ‘আমরা একটা পত্রিকা বের করার কথা ভাবছি। আপনার 888sport app download apk চাই।’ তিনি হেসে বললেন, ‘তোমরা মানে কারা?’
‘আমরা জলপাইগুড়ির কয়েকজন বন্ধু।’
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি বুঝি জলপাইগুড়ি থেকে আসছ?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার মা অশ্রম্নবালা দাশগুপ্ত জলপাইগুড়ি লেডি ডাক্তার। আমরা ব্রাহ্ম।’ আমার মা সম্বন্ধে আমার খুব গর্ব ছিল ও আছে। তবে কেন বললাম ব্রাহ্ম তা জানি না। কিন্তু তাতে তাঁর প্রতিক্রিয়া হলো। তিনি বললেন, ‘আমিও ব্রাহ্ম।’ একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রেমেন তোমাদের পত্রিকাতে লিখবেন?’
বললাম, ‘নিশ্চয়ই লিখবেন। উনিই তো জলপাইগুড়ির সঙ্গে ধ্বনি মিলিয়ে ‘জলার্ক’ নাম দিয়েছেন।’ এমন সময় পাশের কোনো ঘর থেকে একজন মহিলার চ্যাঁচামিচি, তারের শাড়ি-সায়াগুলো কে গুটিয়ে রাখল – তাই নিয়ে বিশ্রী চ্যাঁচামেচি। জীবনানন্দ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন, ‘উহ্, অসহ্য।’ তারপর আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা, আজ এসো।’ আমিও চলে এলাম। যখন চলে আসছি তখন বললেন, ‘আর একদিন এসো।’ আবার বললেন, ‘কালই।’
ভেবেছিলাম পাশের কোনো ঘর থেকে তাঁর স্ত্রীই চ্যাঁচামেচি করছেন। তাঁর স্ত্রীকেও দেখলাম না। পরিবারের আর কাউকেই দেখলাম না। প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়ি তো ধর্মশালার মতো – কে আসছে, কে চা-টোস্ট খাচ্ছে, কিছুরই ঠিক নেই। অন্নদাশঙ্কর প্রথম দিন বেরিয়ে ফিরলে তাঁর মেমসাহেব স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘মাসিমা’ বলে আর মেমসাহেব মাসিমা আমাদের প্রচুর দুধ-দেওয়া চা খাইয়ে আমাদের নিয়ে কোথায় চললেন গেস্টহাউসের দিকে, অন্ধকারে এক জায়গায় থেমে বললেন, ‘এই হচ্ছে ছাটিমটলা, এই এক টির্ঠ, শান্টিনিকেটনে এলে প্রঠমে এখানে আসবে।’
জীবনানন্দের বাড়ির ও ব্যবহারের সঙ্গে সব যেন আলাদা। তবু দ্বিধাভরে আসব স্থির করলাম। আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনে প্রেমেনদা বললেন, ‘শুনেছি, উনি কোনো মহিলাকে বাড়ির একাংশ সাবলেট করে এখন পস্তাচ্ছেন। অতবড় বাসা ভাড়া করা ঠিক হয়নি ওঁর।’ নিতাই বলল, ‘আমি জলপাইগুড়ি ফিরে যাচ্ছি, তুই থাকো আর কলকাতায় থেকে কবি-888sport live footballিক করো।’ চলে গেল।
আমি পরদিন একটু বিকেলে গেলাম। জীবনানন্দ ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বের হচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘অসময়ে এসেছ। আমি লেকে বেড়াতে যাচ্ছিলাম। চলো একটু বসা যাক।’ সেদিন স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে আলাপ করালেন। আলাপ মানে স্ত্রীকে প্রণাম আর মেয়েকে নমস্কার। এবার কবির সঙ্গে আমি বেড়াতে বের হলাম লেকের দিকে। যেতে যেতে বললেন, তাঁর ভাই তাঁর জন্য একটা মস্ত ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন, অত বড় ফ্ল্যাট দরকার ছিল না, তাই কিছুটা অংশ ভাড়া দিয়েছিলেন
এক মহিলাকে, সেই মহিলার একটি ছোট মেয়ে আছে। কিন্তু ভাড়া নেওয়ার পরে সেই মহিলার অন্য রূপ বের হলো। যেমন ঝগড়ুটে, বাড়িতে যাত্রা-সিনেমা।
বললাম, ‘তার মানে কি মহিলাকে সাবলেট করেছিলেন?’
বললেন, ‘তা-ই। সবই মুখের কথায়, কাগজে-কলমে কিছু নয়। আমি তো আর সুধীন দত্ত নই। অত আইন-কানুনও জানি না। উনি সব সময় ঠিক, correct, শুদ্ধ।’
তারপরেই তিনি হঠাৎ নির্বাক হয়ে গেলেন। আমরা অনেকক্ষণ চুপচাপ লেকে বেড়ালাম। লেকের গাছপালার নীড়ে ফেরা পাখিদের কাকলি থেমে গেল। আমরা কাকলি থেমে গেলে আবার ফিরে এলাম দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে। তিনি বাড়ির পথ ধরার আগে ছোট্ট মন্তব্য করলেন, ‘ভালো লাগল।’ আমিও ফিরে এলাম ৫৭ হরিশ চাটুজ্যে স্ট্রিটে। প্রেমেনদার বাড়িতে।
কিন্তু পরদিন আবার গেলাম ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডে। দরজা খুললেন জীবনানন্দের মেয়ে মঞ্জুশ্রী। গিয়ে জীবনানন্দকে বললাম, ‘একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।’ তাঁর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য আপনাকে বলতে বলেছিলেন আপনার সাতটি তারার তিমির তাঁর ভালো লেগেছে।’
তিনি বললেন, ‘তাই নাকি? অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য আগে ছিলেন কলেস্নাল গোষ্ঠীর কবি, তারপর হলেন পুলিশ, এখন অভিনেতা। ওঁকে বোলো খুশি হয়েছি।’
আমি একদিন গেলাম বুদ্ধদেব বসুর ‘888sport app download apk ভবনে’। দার্জিলিং থেকে ফিরেছিলাম আমরা জুন মাসে। কয়েক মাস পরে দাদা পুজোর ছুটিতে কলেজ লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এলেন আধুনিক বাংলা 888sport app download apk বলে একটি বই। তার প্রকাশক বুদ্ধদেব বসু, ঠিকানা ‘888sport app download apk ভবন, ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ’। একতলায় চামড়ার জুতো ও ব্যাগের দোকান। নিচের দোকানে জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘ওপরে।’ শুনে ওপরে উঠে গেলাম। সাদা ধুতি আর হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরা এক ভদ্রলোক বললেন, ‘নিচের তলায় – দোতলায় বুদ্ধদেব বসুর 888sport app download apk ভবন।’ আমি এলাম দোতলায়। দরজার এক কোণে ছোট একটা বোর্ড বা ফলক। তাতে একটা পালতোলা নৌকার নকশা। তার নিচে লেখা ‘888sport app download apk ভবন’। বুঝলাম ঠিক জায়গায় এসেছি। কলিংবেল বাজালাম। ছোটখাটো এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। গায়ে পাঞ্জাবি, পরনে ধুতি। ভেতরে নিয়ে বিনা প্রশ্নে বসালেন। বললাম, ‘আমি জলপাইগুড়ি থেকে এসেছি। আমার নাম সুরজিৎ।’ বলে তাঁকে প্রণাম করলাম। তিনি ‘থাক’, ‘থাক’ বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কোথায় উঠেছ? কোন হোটেলে?’ বললাম, ‘না, প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে – ওটা তো আধাধর্মশালা।’ তিনি বললেন, ‘ও।’ বলে চুপ করে থাকলেন।
আমি একটু থেমে বললাম, ‘আমরা জলপাইগুড়ি থেকে একটা পত্রিকা বের করব ভাবছি।’
তিনি বললেন, ‘ও।’
বুঝতে পারলাম না, এবার কী বলব?
কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘আচ্ছা, এসো।’
আমি হতভম্ব। উঠে চলে এলাম।
দু-একজন অন্তরঙ্গ ছাড়া কাউকে বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে এমন অভিজ্ঞতার কথা বলিনি। অন্নদাশঙ্কর, জীবনানন্দের বাড়িতে যে-অভিজ্ঞতা তা অনেককে বলেছি ও লিখেছি। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে যে-অদ্ভুত ব্যবহার পেয়েছি তা এই প্রথম অদৃশ্য পাঠকদের উদ্দেশে লিখছি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে আরো কয়েকদিন ছিলাম।
একদিন প্রেমেনদার কাছ থেকে নির্দেশ নিয়ে গেলাম সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি। সাহেবপাড়ায় সাহেবি কায়দায় থাকেন, বেশিরভাগ সময়ে ইংরেজিতে কথা বলেন, যদিও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত এভাবে প্রেমেনদা আমাকে আগাম সাবধান করে দিলেন। প্রেমেনদার বড় ছেলে মৃন্ময় ও আমি হাজরার মোড় থেকে বাসে উঠলাম। সে উত্তর কলকাতায় চলে গেল, বোধহয় হেদুয়ার দিকে আর পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে আমাকে নেমে যেতে বলল। নেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে করে রাসেল স্ট্রিট বের করলাম। প্রেমেনদা বলেছিলেন যে, ৬ নম্বর রাসেল স্ট্রিটের একটা চারতলা বাড়ির আটটা ফ্ল্যাটের ৬ নম্বর ফ্ল্যাট। লিফট নেই – সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। চওড়া কাঠের সিঁড়ি।
গিয়ে দেখি বিরাট উঠোনজুড়ে কয়েকটা মোটরগাড়ি, উঠোনের ধারে মস্ত বিল্ডিংবাড়ি, তার দেয়ালঘেঁষে কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ ও টুল, তাতে এলোমেলোভাবে বসে কয়েকজন পুরুষ, অধিকাংশের পরনে সাদা প্যান্ট, প্যান্টের ওপরে হাতাকাটা কোর্ট, গল্প করছে হিন্দি-বাংলায়। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা ছ-নম্বর রাসেল স্ট্রিট?’ একজন বলল, ‘হ্যাঁ, কিসকো মাংতা?’ বললাম ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।’ লোকটি বলল, ‘আপ সিধা উপর চলা যাইয়ে। মালুম নহি দত্ত সব হ্যায় কি নাহি। যাকে দেখিয়ে।’ কে একজন সিঁড়িটা দেখিয়ে দিলো। আমি উঠে গেলাম চওড়া কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। মস্ত বড় পালিশ করা দরজা। এক পাশে ঝকঝকে পেতলে ছোট করে লেখা – S. Dutta। তার নিচে কলিংবেলের বোতাম। মনে তুলনা এলো প্রেমেন্দ্র মিত্রের দরজার কড়া খটখট করার ব্যবস্থা, রাত্তিরে ভেতর থেকে খিল লাগানো হয়, জীবনানন্দের ও প্রেমেনদার দরজার বাইরে নাম লেখা ফলক নেই, তাঁদের দরজাও সাত-আট ফুট উঁচু। এখানে S. Dutta ফলক, তবে বেশ ছোট, দরজাটা বিশাল, অন্তত দশ ফুট উঁচু, বার্নিশ পালিশ। সব কিছুতে স্বাতন্ত্র্য।
বেল বাজালাম। একটু পরে সাদা ফুল প্যান্ট ও গায়ে হাফ-হাতা শার্ট পরা একজন এলো। জিজ্ঞেস করাতে বলল, ‘সাব ডিভিসির মাইথন গিয়া, মেমসব রেডিয়ো গেয়া।’ বলে আমাকে একটা পাতলা খাতা ও পেনসিল এনে দিয়ে বলল, ‘নেম আউর পারপাজ লিখ দিজিয়ে।’ লিখে দিয়ে চলে এলাম। প্রেমেনদা সব শুনে বললেন, ‘ভুলে গেছলাম যে উনি স্টেটসম্যান ছেড়ে ডিভিসির পিআরও হয়েছেন। দু-একদিন পরে আবার যেও। মাকে লিখে দাও, একটু কাজ বাকি আছে। কদিন পরে যাবে, এখানে ঝালছাড়া রান্না, তবে খেতে বসে প্রথমেই জল খাওয়া বারণ।’ বলে হাসলেন।
আমি মাকে লিখলাম, ‘জীবনানন্দের সঙ্গে ভালো পরিচয় হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কলকাতার বাইরে কোথাও গেছেন, কদিন পরে ফিরবেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ করেই ফিরে আসব। প্রেমেনদা বউদির কাছে আমি খুব আরামেই আছি, দাদার হোস্টেলের চাইতে ভালো। অবরেসবরে দোকানে খাই, এটা বউদি পছন্দ করেন না। দোকানের এমন ডেভিল ব্রেস্ট কাটলেট তো জলপাইগুড়ির দোকানে পাই না।’ মোটমাট এই চিঠি পাঠিয়ে প্রেমেনদার বাড়িতে থেকে গেলাম।
নিতাই চলে গেলে মনা আবার নিজের ঘরে ফিরে এলো – আমরা দুজনে একই ঘরে। একটাই ব্যাপার – বিকেলে কোনো জলখাবার নেই। দুপুরেই পেট ঠেসে মাছ ভাত ডাল, ভাতের পরে দই বা রাবড়ি। জলপাইগুড়িতে রাবড়ি দুর্লভ মিষ্টি।
যা হোক, কিছুদিন পরে আবার সুবীন্দ্রনাথের খোঁজে যাই। সেদিনকার লোকটাই বলল, ‘সাব অফিস গয়া, আপ কোই বিকাল সামমে আইয়ে।’ পরদিনই বিকেল পেরিয়ে সন্ধে-সন্ধে গেলাম। সেই লোকটাই দরজা খুলে ভেতরে ডাকল, বলল বসতে। সামনে একটা টেবল ঘিরে অনেক চেয়ার। অতবড় ডাইনিং টেবল আগে দেখিনি। আর দেয়ালঘেঁষে ছাদ সমান উঁচু বইয়ে ঠাসা র‌্যাক। কিছুক্ষণ পরে লোকটি আমাকে ডাকল বাঁদিকের বারান্দায় – মস্ত চওড়া বারান্দা। যেদিকে রেলিং ও খোলা সেদিকটা যদ্দুর চোখ যায়, দূরের কলকাতা শহর; কিন্তু নিচের দিকে লোহালক্কড়ের কিছু কাঠামোয় মনে হলো কোনো বিল্ডিং তৈরির তোড়জোড় চলছে। ওখান থেকে কলকাতার অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে দূরের কলকাতা দেখছি। এমন সময় পেছন থেকে কে যেন বলল, ‘হ্যালো ইয়ংম্যান।’ ফিরে দেখি, সাদা ট্রাউজার্স, একটা সাদা শার্ট। আমি বললাম, ‘নমস্কার।’ তিনি বললেন, ‘গুড আফটারনুন। তুমিই তো সুরজিৎ দাশগুপ্ত। দুদিন এসে ঘুরে গেছ বলল প্রসাদ। অ্যানিওয়ে, পিস্নজ টেক ইয়োর সিট।’ আমি আমার কাছের সেটিতে বসলাম। আমি বসার পরে আমার উলটো দিকের সেটিতে তিনি বসলেন। আমার সেটির ডানদিকে একটা সাইড টুল। ওঁর সেটির বাঁদিকে অমনই সাইড টুল। মাঝখানে একটা সেন্টার টেবল। খুবই পুরু কাচের।
সুধীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়ংম্যান, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?’ তারপরে সাইড টুলের ওপর রাখা একটা কৌটো আমার দিকে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডু ইউ স্মোক?’
বললাম, ‘খুব কম। কখনো কখনো।’ আবার যোগ করলাম, ‘এখন খাব না।’ আসলে তাঁর সামনে স্মোক করতে চাইনি।
তিনি হেসে বললেন, ‘আমরা ডালভাত খাই, smoke হচ্ছে ধূমপান।’ তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘উড ইউ লাইক টু ড্রিঙ্ক?’
আমি ভাবলাম চা-কফি খাওয়ার কথা বলছেন।
বললাম, ‘চলতে পারে।’
তিনি একটু গলা তুলে বললেন, ‘প্রসাদ, আমাদের দুজনকে ড্রিঙ্কস দাও।’
প্রসাদ ট্রেতে করে দুটো কাচের গস্নাস, একটা পেটমোটা ধাতুপাত্র, বোধহয় চকোলেট রঙের এনামেল করা, দুটো বোতল ও একটা জগে টলটলে জল এনে সুধীনবাবুর হাতের নাগালে সেন্টার টেবলের ওপর রাখল। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখছিলাম। এ কেমন চা-কফি! তিনি বোতল থেকে একটা গস্নাসে রঙিন কিছু ঢাললেন, অল্প। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘সোডা অর ওয়াটার?’ বললাম, ‘ওয়াটার।’ আমি শুধু ভাবছি, জিনিসটা কী। এখন এটা ড্রিঙ্ক করব না বলা ঠিক হবে না আর ভাবছিলাম যে, আসল কথা কোন সুযোগে বলব! আমাকে পানীয়টা দিয়ে এগিয়ে দিলেন। তারপর নিজের পানীয় তৈরি করে বললেন, ‘পিস্নজ স্টার্ট।’ তারপর বললেন, ‘চিয়ার্স।’ একটু ঝাঁঝাল পানীয়টা মুখে তুলে দেখি একটা কেমন অদ্ভুত গন্ধ, স্বাদটাও অদ্ভুত। একঢোকে খেয়ে নিলাম। তিনি বললেন, ‘নো, নো, দ্যাটস নট দ্য ওয়ে টু ড্রিঙ্ক।’
আমি বলে ফেললাম, ‘আমরা জলপাইগুড়ি থেকে একটা পত্রিকা বের করছি। আপনার 888sport app download apk চাই।’
তিনি একটু আমাকে তীক্ষনচোখে দেখে বললেন, ‘দ্যাটস নট পসিব্ল। আমি তো আজকাল লিখছিই না।’ এমনভাবে বললেন যে আমার মুখে কোনো উত্তরই জোগাল না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন একটা নতুন ম্যাগাজিন বের করতে চাও?’
এমন প্রশ্নের জন্যে একেবারে প্রস্ত্তত ছিলাম না। তাছাড়া কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম। কোনো উত্তর জোগাল না। ভাবতেই পারছিলাম না। সত্যিই তো কেন পত্রিকা বের করছি? এমন কথাটা তো ভেবেই দেখিনি। ভাবলাম, উত্তরটা ভেবে আর একদিন আসব। উঠে পড়লাম। বললাম, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে কাল আসব।’ তিনিও উঠে পড়লেন, আমাকে এগিয়ে দিলেন দরজা পর্যন্ত। দরজা খুলে দিয়ে বললেন, ‘কাম অ্যাগেইন।’ তারপর বললেন, ‘সাবধানে যেও।’
নিচে নেমে খোলা হাওয়ায় শরীরটা ফুরফুরে লাগল। বুঝলাম ঠিকমতো পা ফেলতে পারছি না। চৌরঙ্গী পেরিয়ে ময়দানে এসে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। যখন চৌরঙ্গী রোডে গাড়ি চলাচল কমে এলো, তখন ট্রাম ধরে পূর্ণ থিয়েটারের স্টপে নামলাম। পূর্ণ সিনেমা বাঁদিকে রেখে সরু রাস্তা ধরে বলরাম বসু ঘাটে হরিশ চ্যাটার্জি এসে দেখি মৃন্ময় দরজা খুলে ঘর-বার করছে। প্রেমেনদা দোতলায় পায়চারী করছিলেন। মৃন্ময় আমার নিশ্বাসে গন্ধ পেল। তখন বললাম সব কথা। প্রেমেনদা বললেন, ‘ওরে বোকা ড্রিঙ্ক পানে কখনো ভার্ব, কখনো নাউন। কখনো পান করা, কখনো হুইস্কি-ব্রান্ডি।’ বউদি বললেন, ‘যা খেয়েছ, খেয়েছ, এটাকে দস্ত্তর করো না।’
পরদিন সন্ধেবেলায় আবার গেলাম সুধীন্দ্রনাথের কাছে। সেদিনও জিজ্ঞেস করলেন, ‘ড্রিঙ্কস?’ আমি অকপটে বললাম গতকালকের কথা। তিনি হা-হা করে হেসে বললেন, ‘প্রেমেনবাবুকে বোলো খারাপ কিছু ছিল না, স্কচ হুইস্কি। অ্যানিওয়ে – তোমার কথায় আসি। কাম টু দ্য পয়েন্ট। তোমরা একটা কাগজ বের করবে – কিন্তু কেন? ফেমাস রাইটার্সদের লেখা পাবলিশ করবে বলে? প্রেমেন, বুদ্ধদেব, অচিন্ত্য – এঁদের সব লেখা বের করবে বলে? ফেমাসদের লেখার অনেক জায়গা আছে।’
বললাম, ‘নিজেরাও লিখব বলে।’
নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘রাইট। সেটাই কোরো। নিজেরা লেখো। অ্যাট টাইমস ফেমাসদের লেখা ছাপতে পারো। বাট ইয়োর টার্গেট হবে নিজের কথা বলা, নিজের ভাষা তৈরি করা। তার সঙ্গে মধ্যে মধ্যে ফেমাসদের লেখা ছাপতে পারো – হেরিটেজকে প্রিজার্ভ কোরো।’ একটু থেমে বললেন, ‘নিউ এজ-এর সঙ্গে হেরিটেজের ফিউশন চাই। আবার বাইরের পৃথিবীতে যে লিটারেচর, যে-আর্ট, যে-ফিলোজফি জন্মাছে, যে-ফুল ফুটছে তার কথাও লিখবে। এই যেমন এলিয়ট, পাউন্ড, ফকনার, জয়েসের সঙ্গে, কামু, সার্ত্রে, হাইডেগগার পড়বে। কাকে বলে ওয়র্ল্ড লিটারেচর, কাকে বলে মডর্ন লিটারেচর, কাকে বলে মডর্ন আর্ট – রিড, রিড, সার্চ, সার্চ – eternal search is man’s destiny’ – এর মধ্যে দুজন ভদ্রলোক এলেন। সুধীন্দ্রনাথ আলাপ করিয়ে দিলেন – শিবনারায়ণ রায় ও দেবব্রত রেজ। আমি উঠে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ অভ্যাগতদের উদ্দেশে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কাম অ্যাগেইন।’ দুদিন পরেই ফিরে এলাম জলপাইগুড়িতে। মা বললেন, ‘বিশ্বজয় করে এবার ঘরে মন দাও।’