নলিনী বেরা
স্নানাহারের পূর্বেই আমার শাকান্ন ভোজন হয়ে গিয়েছিল, তাই মধ্যাহ্ন-ভোজনে অভিরুচি ছিল না। কিন্তু একে ‘মহিমারঞ্জন’, তার ওপর ‘দাদা-বউদির হোটেল’ – অগত্যা যেতেই হলো।
হরিদ্বার-888sport slot gameার্থীদের মুখে এতো শুনেছি ‘দাদা-বউদির হোটেল’ ‘মাসির হোটেল’ না ‘মাসি-পিসির হোটেল’-এর নাম যে, ‘বন্যানি চ তথান্যানি স্বাহারাণি’, আহার করি আর নাই করি – যেতেই হচ্ছে আমাকে!
এছাড়াও তো আছে ‘গৌরীশঙ্কর হোটেল’ ‘হোটেল শিবালিক’, আছে ‘চটিওয়ালা হোটেল’, হোটেল ‘আহার’। আরো কত পাঞ্জাবি-চীনা ধাপাটাপা!
দেবভূমি হরিদ্বারে নিরামিষ আহার, আমিষ বর্জনীয়। সব হোটেলেই প্রায় শাকান্নের আয়োজন। তবে ঘিয়ের আধিক্য, রুটি-চাপাটি-পরোটা আর দেরাদুন রাইসের ‘ভাত’।
ভাত, ভাত।
ভুরভুর করে উঠছে সুগন্ধী চালের ভাত-গন্ধ। দেশে-ঘরে যাকে বলে ‘মহকাচ্ছে’। বাঙালি-ওড়িয়া-ঝাড়খন্ডি-বিহারি-ভোজপুরি তো আছেনই, তার সঙ্গে যেন এসে জুটেছেন রাজস্থানি-পাঞ্জাবিও।
‘বাঙালিয়ানা’র এমন দৃষ্টান্ত বুঝি খোদ এপার-ওপার দুই বাংলাতেও নেই! হরিদ্বার যেমন ‘বেদভূমি’, তেমনি এক অর্থে ‘বঙ্গভূমি’ও বটে। কলকাতা শহরে যেখানে আইন-আন্দোলন করেও দোকানের নাম ‘ইংরেজি’ ‘হিন্দি’র পাশাপাশি ‘বাংলা’য় লেখানো যায় না, সেখানে হরিদ্বার সিটিতে শুধু ‘দাদা-বউদি’, ‘মাসি-পিসি’ ‘ভাই-বোন’-এর হোটেলের নামই নয়, বাঙালি খরিদ্দার টানবার নিমিত্ত ব্যাগ-শীতবস্ত্র শাড়িজামার দোকানের নামও যে বাংলায় লেখা!
আহা রে! ‘আ-মরি বাঙলা ভাষা – মোদের গরব মোদের আশা’! ওই তো রাস্তার ওধারে – ‘গ্রামোদ্যোগ কম্বল ভান্ডার’। প্রো: গগন তলোয়ার \ deals in : Kashmiri Shawls, Blankets, Bed Cover, Saree, Suit \ Our specialist in : Pasmina Shawls, Toosh, Kasmiri Lohi, Malida Chaders etc. \
কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে – অনর্গল বাংলা কথা! ‘আসুন! আসুন! দেখে যান! নিয়ে যান! সস্তায় কাশ্মিরি শাল, কম্বল, তুষের চাদর…!’
কে জানে গগন তলোয়ার পাতিয়ালা না গাড়োয়ালের লোক! মাতৃভাষা ছেড়ে ব্যবসার খাতিরে কেমন অনর্গল বাংলা বলে চলেছেন। – ‘আসুন দিদিভাই! আসুন দাদাভাই -’
পাশাপাশি ‘দাদা-বউদি’র দু-দুটি হোটেল। দুটোতেই ‘হাউসফুল’, ঠাসা-ভিড়! হাত-মুখ ধোয়ার জলের ড্রামের কাছে দাঁড়িয়ে আছি তিনবন্ধুতে। ‘লাইনেই আছি বাবা’ -। কিন্তু কে জানে কখন আসবে আমাদের পালা!
আচমকা কানে এলো –
‘নিলাম বালা ছ্যায় আনা
লে লও বাবু ছ্যায় আনা
যা লিবে তাই ছ্যায় আনা
চুনো বাছো ছ্যায় আনা -’
প্রথমে মনে হলো – কলের গান শুনছি কি! এদিক-ওদিক উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখলাম – না, জনৈক হকার ভোলাগিরি রোডের ধারে রাস্তার উপর গাদাগুচ্ছের উলের টুপি, পায়ের মোজা, হাতের দস্তানা, আরো নানাবিধ টুকিটাকি জিনিস ফেলে হেঁকে চলেছে।
ধুস্! ‘যা লিবে তাই ছ্যায় আনা’ – তাও আবার হয় নাকি! ছয়আনা পয়সাও আজকাল আর আছে নাকি, আনি-দুআনি!
তা নাই থাক। কিন্তু হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় এসে কলকাতার ফুটপাথের হকারদের মতো ‘নিলামবালা ছ আনা’র গান শুনব – এ যে কল্পনারও অতীত!
ভানু পেল লটারি না পৃথিবী আমারে চায় – কে জানে কোন ছায়াছবির গান, এই মুহূর্তে ঠিক মনেও তো পড়ছে না!
সে নাই পড়ুক, বুঝলাম ওই বাংলা গান গেয়েই বাঙালি কুম্ভযাত্রীদের দৃষ্টি-আকর্ষণ, মনোহরণ ও বশীকরণ।
কোথায় যেন পড়েছিলাম – ‘ঝাং ঝাং ঝাং হাঁ হাঁ হাঁ হেঁ হেঁ হেঁ’-এর নাম আকর্ষণ-মন্ত্র। মনুষ্য, দেবতা, যক্ষ, নাগ, রাক্ষস এবং স্থাবর-জঙ্গম-সকলেই এই মন্ত্র দ্বারা আকর্ষিত হয়। পাঁচশতবার এই মন্ত্র জপ করলে নাকি সিদ্ধিলাভ হয়।
শাস্ত্রকার হয়ত জানেন না নস্টালজিক বাঙালিদের কাছে এর চাইতেও বড় মন্ত্র হলো ওই গান – ‘নিলামবালা ছয় আনা যা লিবে তাই ছয় আনা…।’
আমার কাছে দাঁড়িয়ে মন্ত্রযুগ্ধ ও ভূতগ্রস্তের মতো শঙ্করদেব গুনগুন করে এর মধ্যেই পরের দুকলি গাইতে লাগল –
‘লে লও বাবু ছ আনা –
এই তো আছে রঙিন ফিতে খোঁপার কাঁটা কানের দুল
প্রিয়ার চোখে দুঃখ কেন রুক্ষ কেন মাথার চুল -’
যাঁদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, হাত-মুখ ধুয়ে মিছরি-মৌরি আর দাঁতের কাঠি নিচ্ছিলেন, ‘নিলামবালা ছ্যায় আনা’ তাঁদের কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্রই তাঁরা দৌড়ুলেন, বিশেষত মেয়েরা।
চৈত্র সেলের ক্রয়-বিক্রয়-বার্গেনিং-পটিয়সী বাঙালি 888sport promo codeদের চেয়ে ছয়-আনা দামের উলের টুপি, হাতের দস্তানা, পায়ের মোজার মর্ম আর কে বুঝবে!
এই সুযোগে আমাদের ‘লাইন’ আরো কিছুটা এগিয়ে গেল।
আমরা যখন খেতে বসলাম তখনো ‘হাউসফুল’, তখনো বাইরে লম্বা লাইন। পাশাপাশি দু-দুটি হোটেল লাগাতার জুগিয়ে চলেছে ‘আহার’।
ভোলাগিরি রোডের উপর চলমান ‘ভারত বর্ষ’, যতই আওয়াজ তোলে ‘জয় গঙ্গামাঙ্গ কী জয়’ ‘হর হর গঙ্গে মাতা’ ‘হর হর মহাদেব’ ‘নাচেঙ্গে ভোলেনাচেঙ্গে ত্রিপুরারি’, ততোই ‘দাদা-বউদির হোটেল’-এর ভেতর বুভুক্ষু ‘ভারত বর্ষ’ কড়া-বালতি হাতা-খুন্তির ঠুং-ঠাং আওয়াজও বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুণ-তিনগুণ চতুর্গুণ! বেলা যে পড়ে এলো!
থালার উপর সাইজ করা কাঁচা পদ্মের পাতা, জলে ধোয়া। তার উপর এই পড়ল নুন-লঙ্কা। চাই কি এক কোয়া লেবু। পেঁয়াজ নৈব নৈব চ।
পিতলের ঝকঝকে বালতি থেকে পদ্মপাতায় উপচে পড়ল দু-তিন হাতা ভাত! দিনাজপুরের ‘তুলাইপঞ্জি’ চাল, তো নয়, উত্তরাখন্ডের ‘দেরাদুন রাইস’-এর ভাত।
ভাত তো নয়, সদ্য ফোটা শ্বেত শিউলি। তার ওপর ঝকঝকে স্টিলের ঘটি থেকে ‘পলা’য় ভরে চরণামৃতের মতো ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘি।
ঘিয়ে-ভাতে, তার কী সুবাস! পলায় ভরে একসঙ্গে তিন-চার ‘পাতে’ ঘি-ছিটানো – আহা, কী তার অনবদ্য ভঙ্গিমা!
ভাতে ঘি পড়তে না পড়তেই কেউ কেউ শুরু করেছে খাওয়া, চ্যাঙাড়ি থেকে জ্যান্ত শোলমাছের মতোই প্রায় লাফ দিয়ে এসে থালায় থপ করে পড়ল একেকটা হাতে-গরম চপ, আর নয় তো বেগুনি!
আমার একবার শাকান্ন ভোজন হয়ে গেছে, তাই এখন ভূরিভোজের দরকার নেই। কেবলমাত্র বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে যা হোক তা হোক খেতে বসেছি। বেশিরভাগ সময়টাই এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি ‘দাদা-বউদির হোটেল’-এর কর্মকান্ড।
তদুপরি দেখছি – চোখের সামনে অনন্ত জনপ্রবাহমধ্যে না শীত-না বসন্তবায়ু বিক্ষিপ্ত। বীচিমালায় আন্দোলিত হতে হতে চলেছে বঙ্গ-বিহার-ওড়িশা ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র-ছত্তিশগড়-কর্নাটক-গুজরাট, রাজস্থান-পাঞ্জাব-হরিয়ানা-হিমাচল, অসম-অরুণাচল- রাজস্থান-উত্তরপ্রদেশ-উত্তরাখন্ড –
আচমকা চিৎকার উঠল – ‘নন্দীগ্রাম! নন্দীগ্রাম! নন্দীগ্রামের মেয়ে এসেছে! নন্দীগ্রামের মেয়ে এসেছে!’
কানে যেন শুনছি – ‘রোদ উঠেছে! রোদ উঠেছে! ডাঙ্গা! ডাঙ্গা! ডাঙ্গা!’
যাঁরা আমাদের আসার সামান্য পরে এসে খাবারের বেঞ্চিতে বসেছেন, যাঁদের পাতে বড়জোর এই নুন-লঙ্কা আর পেঁয়াজ পড়েছে, তাঁরা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালেন –
‘না, না, ‘নন্দীগ্রাম’ আগে! ফার্স্ট প্রায়োরিটি! আসুন ‘নন্দীগ্রামের মেয়ে’! আসুন! আসুন! আপনারাই আগে বসুন!’
বস্ত্ততপক্ষে আমরা তিনবন্ধুতে প্রথমে বিমূঢ়, হকচকিত। পরক্ষণেই বুঝলাম – একদল কুম্ভযাত্রী নন্দীগ্রাম থেকে কদিন আগেই এসেছেন। সেই দলের মধ্যে এই ‘মহিলা’ও আছেন।
আর যাঁরা উঠে দাঁড়ালেন, তাঁরা আর যেখানেরই লোক হোন অন্তত নন্দীগ্রামের লোক নন। কদিন আগে তাঁরাও এসেছেন হয়তো কলকাতা বা তার আশপাশ থেকে। এই হোটেলেই অথবা হর-কি পৌড়ীর ঘাটে দেখাও হয়েছে দুদলের মধ্যে বারকতক।
বেশ তো চলছিল – ঝাড়খন্ড-ছত্তিশগড়-অরুনাচল-হিমাচল-উত্তর প্রদেশ-উত্তরাখন্ড – অনন্ত জনপ্রবাহের চলমান ‘ভারতবর্ষ’! তার মধ্যে আস্ত একটা রাজ্য হয়েই যেন ঢুকে পড়ল ‘নন্দীগ্রাম’।
নন্দীগ্রাম, নন্দীগ্রাম।
‘কেমিক্যাল হাব’ নির্মাণের উদ্দেশ্যে জমি-অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে যে-নন্দীগ্রাম কাগজের শিরোনাম, সোনাচূড়া-সাউধখালি-জলপাই তেখালি-অধিকারীপাড়া-গাংড়া-কেশবপুর-বাড়কেশবপুর গ্রাম টিভি রেডিওর ‘ব্রেকিং নিউজ, সুপ্রিয়া জানা – বাসন্তী কর – লক্ষ্মীরানি-মিনতি-মঞ্জুরা-জানকী-রাণু-রেণুকারা খবর কাগজের ‘ছবি’, চিৎপুরের যাত্রাজগতের অধিকারী মশাইরা পালা নামিয়ে দেন, ‘সিঙ্গুরের বর নন্দীগ্রামের কনে’, আধুনিক কবিরা 888sport app download apk লেখেন –
‘সবাই বলেন : রোদজ্বলা দিন
তখন নিশুত মধ্যরাত
চৌদ্দই মার্চ নন্দীগ্রামে
শ্যাল-শকুনের মধ্য রাত।
সামনে লরি মাইক চোঙা
উর্দিধারী উল্লাসে
পিছন পিছন চপ্পল-পা
চরম খুলমখুল্লা সে!
সেই নন্দীগ্রাম, নন্দীগ্রামের মেয়েকে তো জায়গা ছেড়ে দিতেই হয়! আমরাও আমাদের খাবার উচ্ছিষ্ট না করলে হয়তো উঠে দাঁড়াতাম।
কত আর বয়স হবে, বড়জোর তিরিশ-বত্রিশ! পরনে তাঁত, মাথার চুলগুলি পিছনে টান দিয়ে বাঁধা, লালফিতার টুকরো দেখা যাচ্ছে।
গায়ের রঙে ‘মাতঙ্গিনী হাজরা। চোখের দৃষ্টিতে আর ‘পিছাবোনি’। লোকগুলোর অনুরোধে অনেকক্ষণ ‘না’ ‘না’ করলেও অবশেষে জোর করে বসিয়ে দিলেন তাঁরাই। তাঁর সঙ্গে বসে পড়লেন সঙ্গে-আসা-মানুষেজনও।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি অধুনাপূর্ব মেদিনীপুরের ‘নন্দীগ্রামের মেয়ে’কে। যদিও পশ্চিম মেদিনীপুরের আমি। তবু তো এক সময় পূর্ব-পশ্চিম ছিল না আর আমরা অবধারিতভাবেই এক ও অখন্ড ‘মেদিনীপুর’-এরই ছিলাম।
‘দাদা-বউদির হোটেল’-এ বোধকরি দুয়েকজন পত্রকারও ছিলেন। তাঁরা পটাপট ছবি তুলছেন। হয়তো কাল কলকাতার ভোরের কাগজগুলোয় ছেপে বেরিয়ে যাবে।
এহ বাহ্য, আমি কিন্তু বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছি আর আমার মনের মধ্যে অবিরাম রবীন্দ্রনাথের সেই ‘নিশীথে’ গল্পের ‘ইলিউশ্যান’ আর ‘রিয়েলিটি’র খেলা –
– ‘ও কে, ও কে, ও কে গো! ও কে, ও কে, ও কে গো!’
পাশে বসা শঙ্করদেব আমার গায়ে তার ডানহাতের কনুইয়ের খোঁচা মেরে বলল, ‘হচ্ছেটা কী! খাও না! থামলে কেন!’
শুরু হয়েছিল টাটাদের মোটরগাড়ি কারখানার জন্য সিঙ্গুরে চাষিদের দো-ফসলি তিন-ফসলি জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে, তারপর তো নন্দীগ্রামে ‘কেমিক্যাল হাব’ – আর এখন তো ‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম!’
অধুনা হলদিয়া মহকুমার অন্তর্গত নন্দীগ্রাম থানা। যদিও তার অধীনে তিন-তিনটি ব্লক – নন্দীগ্রাম-১, নন্দীগ্রাম-২, আর নন্দীগ্রাম-৩ – তবু সেখানে যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই অনুন্নত!
থানার একদিকে হুগলী নদী, আরেকদিকে হলদি। পশ্চিমে ভগবানপুর, দক্ষিণে খেজুরী। তদুপরি প্রবাহিত তালপাটি খাল, গড় চক্রবেড়িয়া-টেঙ্গুয়া-মঙ্গলচক-তেখালির খাল। কেলেঘাই-কাঁসাইয়ের গেরুয়া জলে পুষ্ট হলদি নদী।
হলদি নদী, হলদি নদী।
হলদি নদীর হলুদ জলও মানুষের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এই সেদিন! এমনিতেই নন্দীগ্রামের নব্য পলি বা পুরাতন পলি ভূমিতে চর, চড়া আর জালপাইয়ের ছড়াছড়ি। হাঁসচড়া, সোনাচুড়া (চড়া), গাঙড়াচর, নাকচিরা চর, কেঁদ্যামারি জালপাই, সাউদখালি জালপাই –
জালপাই তার মানে খাঁড়ি।
চর, চড়া আর খাঁড়ির দেশ হলেও নন্দীগ্রাম বহু পুরাতন গ্রাম। লোচন দাসের ‘চৈতন্য মঙ্গল’-এ এর উল্লেখ আছে। পুরী যাবার পথে হলদি নদী পেরিয়ে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য নাকি রাত্রিবাসও করেছিলেন এই গ্রামে!
একটা গল্প আছে। ইংরেজ আমলে নন্দীগ্রাম থানায় ‘গোপাল ভাট’ নামে এক জুয়াচোরের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। সে ‘দুনো চম্পট’ নামে এক খেলা আবিষ্কার করেছিল। এই খেলায় সপ্তাহের গোড়ায় যে যত টাকা গচ্ছিত রাখবে, সপ্তাহান্তে সে তার দ্বিগুণ টাকা ফেরত পাবে।
খেলা বেশ জমে উঠেছিল। থানা-মহকুমা ছাড়িয়েও ছড়িয়ে পড়েছিল বাইরে। গরিব মানুষ ঘটি-বাটি গয়না-গাঁটি বিক্রি বা বন্ধক রেখেও টাকা খাটাচ্ছিল ভয়ংকর লোভে পড়ে। গোপাল ভাট যেমন ফুলেফেঁপে উঠছিল, তেমনি উপরি-রোজগারও কম হচ্ছিল না থানার দারোগা রাইমোহন ঘোষের।
কিন্তু এসব ব্যাপারে যা হয়! বখরা নিয়ে অচিরেই মতান্তর ঘটল দারোগার সঙ্গে গোপাল ভাটের। ইতিমধ্যে নন্দীগ্রমের নামও হয়ে গিয়েছিল ‘ফন্দিগ্রাম’।
দারোগা আমানতকারীদের খাতাপত্র আটকে দিতেই জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। আর জনরোষ দমন করতে পুলিশ যা করে – তাই করল, শুরু হলো ‘লাঠিচার্জ’ গুলিগালাজ!
মার খেয়ে ক্ষিপ্ত জনতা ‘দুনো চম্পট’ অফিসের সামনেই এক খড়ের গাদায় ফেলে পুড়িয়ে মারল দারোগা রাইমোহন ঘোষকে। কে বলে ‘ফন্দিগ্রাম’, নন্দীগ্রাম ‘নন্দীগ্রাম’ই!
আজো এলাকার কাগমারারা, সাপধরা শবররা এই ঘটনার ওপর সেই থেকে বাঁধা গান গেয়ে ভিক্ষা করে –
‘কি খেলা খেলিলি গোপাল নন্দীগ্রামের বাজারে!
খেলার দাপে গুমগড় কাঁপে, রাইমন ঘোষ পুড়ে মরে
– কুটাগাদার ভিতরে।
খেলার নাম চম্পটদোনা বাঁধা দিয়ে কাপড়-গহনা
একগুণ দিলে দ্বিগুণ মেলে তাই জমা দিল ঘরে-ঘরে।…’
এসব ঘটনা আর গানের কথা কী আর ‘নন্দীগ্রামের মেয়ে’কে বলেছি! আমিও মেদিনীপুরের – এই পরিচয় দিয়েই জিজ্ঞাসা করলাম –
‘তমানে নন্দীগ্রামের কাইনু আসঠ?’
তোমরা নন্দীগ্রামের কোত্থেকে আসছ?
একগাল হেসে মেয়েটিই বলল, ‘মনে সোনাচূড়ানু আসিঠি।’
আমরা সোনাচূড়া থেকে আসছি।
মাঝে তালপাটি খাল। খালের উপর ভাঙাবেড়া ব্রিজ। ব্রিজের ডানদিকে খেজুরি, বাঁদিকে সোনাচূড়া গ্রাম।
সোনাচূড়া, সোনাচূড়া।
খেজুরির দিক থেকে ভাঙাবেড়ার ব্রিজ পেরিয়ে এসে আক্রমণকারীরা এই সোনাচূড়া গ্রামেই প্রথমে আছড়ে পড়ত।
কবে কোন ভাটার সময় সোনাচূড়ার বালিপোতায় জেগে উঠেছিল সোনার চূড়া! তাই নাকি গ্রামের নাম সোনাচূড়া!
আজ সে সোনার চূড়া তো দূর-অস্ত, বালিপোতায় সোনার এককণা টিকলিও নেই। আছে কেবল তালপাটির ‘জেলিং হাম’ প্রজেক্ট, তেলজেটি – যেখান থেকে পাইপের ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে তেল যায় হলদিয়ায়!
২০০৭-এর ৩ জানুয়ারি নন্দীগ্রামে ‘কেমিক্যাল হাবে’র জন্য জারি হয়েছিল নোটিশ। তারপর থেকেই ভূমিরক্ষার আন্দোলনে লাঠিসোঁটা হাতা-খুন্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নন্দীগ্রামের 888sport promo code-পুরুষ, মায় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, মা-বোনেরাও।
তাঁদের তো একটাই দাবি – ‘রক্ত দেব, তবু জমি দেব না!’ সত্যি সত্যি রক্ত দিতে হলো ভরত-বিশ্বজিৎ-শেখ সেলিমকে। ওইদিনই গুলিবিদ্ধ হলেন আরো চার। জাহির-জাকির-সাত্তার-নুর।
ভবী তবু ভুলবার নয়। ১৪ই মার্চ, ২০০৭ শাসকবৃন্দ শুরু করল্এক ভয়ঙ্কর পুলিশি অভিযান, যার নাম, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস! তার সঙ্গে চপ্পল পায়ে বন্দুক হাতে মিশে থাকল পার্টির ক্যাডাররা।
নন্দীগ্রামের বুকে ঘটে গেল এক ভয়াবহ গণহত্যা! হলদি নদীর জল রক্তে হয়ে গেল লাল! শুধু কী গণহত্যা! কত যে ‘নন্দীগ্রামের মেয়ে’ হয়ে গেলেন ধর্ষিত! কলকাতার রাজপথে মিছিলে খবরের কাগজে টিভির পর্দায় আওয়াজ উঠল – ‘ তোমার নাম আমার নাম নন্দীগ্রাম নন্দীগ্রাম!’
সেই ‘নন্দীগ্রামের মেয়ে’ এখন হরিদ্বারের ‘দাদা-বউদির হোটেলে’। আওয়াজ তো উঠবেই – ‘নন্দীগামের মেয়ে এসেছে! নন্দীগ্রামের মেয়ে এসেছে!’
‘এখুন সেখানকার অবস্থা একটুচার ভালা আছে নি?’
‘হউ, কী যে কহঠ আফুয়া কথা! ঘরনু বেরাইলি পেরায় তিন বস্সর! আশ্রয় শিবিরে লপ্সি খাই করি কাটি গেলা দেড়-দু বস্সর! এখুন বাগনানে এক বন্ধুর বাড়ি। মনত্ একটুচার সুখ নাহি।’
‘তবে যে কুম্ভে এলে?’
‘নাই আসি থাকি পারলি নি। বারো বস্সরকার বেপার, কতলোক যায়ঠে – যাই, যদি মনত্ শান্তি আসে! সোউ বলে না – তিনকাল যাই করি এককালে ঠৈকিছে। এখুন না আইনে আর কি আসি পারিমি? বারো বস্সর ত না, একযুগ! বাঁচি থাকম্যু না তার মরি যাম্যু – তার নাই ঠিক!’
হো হো করে হেসে উঠলেন সবাই। কত আর বয়স – তবু বুড়িদের মতো কথা!
জিজ্ঞাসা করলাম, কপালকুন্ডলা 888sport alternative link পড়া আছে?’
‘না গ। তেবে ছিনেমাটা দেখ্থিনু। সেবার মহিষাদলে রথের মেলায় গেলি। রথ দেখি মনকার কী আনন্দ! রথ দেখা বি হেলা কলা বেচা বি, থুড়ি, ছিনেমা দেখা বি হেলা।’
বললাম, ‘জানো কি, তুমি যা বললে কপালকুন্ডলা 888sport alternative linkেও তা আছে – ‘তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। এখন পরকালের কর্ম্ম করিব না ত কী করিব?’
‘কাই, মুই কী করি জানমু! মুই ত আর বইটা পড়ি নি!’
এসময় কে যেন বলে উঠলেন, ‘ওহে! ‘নন্দীগ্রামের মেয়ে’কে আর একটা বেগুনি দাও!’
সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বললেন, ‘শুধু বেগুনি কেন, আরেক হাতা ভাত, আরেকটু ফুলকপির ঘণ্ট দাও!’
কথায় আছে – ‘মুখ মিষ্টি ভিতর খইল্সা, দীঘল ঘোম্টা 888sport promo code। পানা-পুকুরের ঠান্ডা জল বড় অহিতকারী \’ খইল্সা – তার মানে খল চরিত্রের।
‘নন্দীগ্রামের মেয়ে’ সেরকম কখনো নয়। তার ভিতর-বাহির একই রকম। একই রকম, একই রকম। মুখেও হাসি তো, অন্তরেও হাসি। দীঘল ঘোমটা-টোমটার বালাই নেই।
বোধ করি এতদিন আশ্রয়-শিবিরের একঘেয়ে লপ্সি খেয়ে খেয়ে মুখটা বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল, এক হাতার জায়গায় ভাত চেয়ে নিল দুহাতা। পাতে একটা বেগুনির জায়গায় বেগুনি পড়ল দু-দুটো। ফুলকপির ঘণ্টও পরিমাণে একটু বেশিই পড়ল।
সঙ্গী-সাথিরাও চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিলেন, এতক্ষণে জনৈক ভদ্রলোক মুখ তুলে বললেন, ‘নন্দীগ্রামের এখনকার পরিস্থিতি জানতে চাইছিলেন না?’
ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি -?’
‘আমিও নন্দীগ্রামের ভাঙাবেড়ার, আমিও সেই গণহত্যার পর থেকেই ঘরছাড়া। নন্দীগ্রামের ঘরে-উঠানে-পথে-ঘাটে এখনো চাপ চাপ রক্ত। রক্তের দাগ কে ধুয়ে দেবে বলুন!’
আরেকজন বলে উঠলেন, ‘রাজাকে বলি রাজা, গ্রামকে বলি মহারাজা। কে আর রক্তের দাগ মুছে দেবে! সেই বলে না – গ্রামের মানুষ জোটবদ্ধ হলে মহারাজার থেকেও তার বিক্রম বেশি। যা করার আমরা গ্রামবাসীরাই করব! কখনো তো রাত হলেই বাঁশঝাড় বেগুনাঝাড়ের আড়াল থেকে ছুটে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি -’
কথার মাঝখানেই প্রথমজন বলে বসলেন, ‘দ্যাখা না ঝুমা, তোর পিঠে গুলি মারার দাগটা!’
‘নন্দীগ্রামের মেয়ে’ খেতে খেতে একটাও কথা না বলে বাঁ হাত দিয়ে মুহূর্ত শাড়ি-ব্লাউজ সরিয়ে উনমুক্ত করে দিলো তার পিঠ!
ডান হাতের ওঠা-পড়া আর নেই, থেমে গিয়েছে হাপুস-হুপুসও। ‘দাদা-বউদির হোটেল’ এখন যেন এক মিনিটের নীরবতা পালন করছে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.