কতটুকু আছেন, কতটুকু নেই : বিদ্যাসাগর

পবিত্র সরকার 

‘১. কী বাকি থাকে আমাদের জন্য?

যাঁরা ইতিহাস নির্মাণ করেন এবং এক সময় ইতিহাস হয়ে আমাদের থেকে দূরত্বে চলে যান, তাঁদের মধ্যে প্রধানত দু-ধরনের লোক থাকেন। এক, যাঁদের কথা আমরা ইতিহাস বইয়ে পড়ি, কিন্তু যাঁরা ওই বইয়ের পাতাতেই সমাধিস্থ থাকেন। তাঁদের অনেকের নাম ও বিবরণ আমাদের পাঠ্য মাত্র, মুখস্থ করার এবং (পরীক্ষার পরে, বহুলাংশে) ভুলে যাওয়ার বিষয়। এরকম হাজারো নামে ইতিহাস এবং 888sport app আখ্যান ছেয়ে আছে।

আবার কিছু নাম নাছোড়বান্দার মতো আমাদের সঙ্গ ছাড়ে না। মানুষের শিশুর জীবন, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন যেহেতু একটা ‘হয়ে-ওঠা’র সরণিতে ফেলে দেওয়া হয়, এবং সবাইকে একটা শিক্ষাগত, আর্থনীতিক এবং সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়, সেহেতু সেই সিঁড়ির শেষে অনেকগুলি প্রতিকৃতি ঝোলানো থাকে মানবশিশুর দেখার জন্য। ইংরেজি ভাষায় আজকাল যাকে ‘রোল মডেল’ বলা হয় তাঁদের প্রতিকৃতি।  বাঙালি শিশুর জন্য বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতি তার একেবারে কেন্দ্রে থাকে।

তার একটা কারণ, শুধু তাঁর প্রণীত বা নির্দেশিত শিক্ষা থেকে নয়, তাঁর জীবন থেকেও আমরা শিখি। অর্থাৎ তাঁর জীবন একটি গ্রন্থ, সেই গ্রন্থ পাঠ করলে আমরা উপকৃত হই। তিনি যদি এক ছত্রও পাঠ্যবস্তু না লিখতেন, তবু আমরা তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে প্রচুর শিক্ষা নিতে পারতাম। বিদ্যাসাগরের লেখা জীবনচরিত বা চরিতাবলীর অনেকের মতো, যাঁরা তাঁদের জীবন-সাধনা বা জীবন-সংগ্রাম দিয়ে একটা বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন। আমাদের শিশুদের সেই উচ্চতায় পৌঁছানোর জন্য পেছন থেকে আমরা ঠ্যালা দিই, এবং ধরে নিই, সামনে থেকে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষেরা তাঁদের আশা আর আশ্বাস জোগাবেন।

মনে রাখতে হবে, এই সব মানুষের পুরো জীবন আর কর্মের সমস্ত অনুপুঙ্খ আমাদের অনুকরণ করতে বলা হয় না, কারণ ঐতিহাসিক-সামাজিকভাবেই তা অসম্ভব। বিদ্যাসাগর যেভাবে 888sport promo codeমুক্তির দুটি পথ খুলে দিয়েছিলেন – একটি শিক্ষার (আক্ষরিকভাবে 888sport promo codeশিক্ষার প্রথম উদ্যোগী তিনি না হলেও), আর একটি উচ্চবর্ণের তরুণী হিন্দুবিধবাদের পুনর্বিবাহ – দুটিই দুই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অংশ, এবং পরে, নানা ব্যক্তি ও সংগঠন (ব্রাহ্ম সমাজ, বেগম রোকেয়া, নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরী, রামকৃষ্ণ মিশন প্রভৃতি), এবং রাষ্ট্র সে-দায়িত্ব হাতে তুলে নেয়। স্ত্রীশিক্ষাও, আশানুরূপভাবে না হলেও, ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিধবাবিবাহের প্রয়াসও সেভাবেই একটি ইতিহাসলগ্ন বিষয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা খুব সফল হয়নি, কিন্তু এখন তার জন্য নতুন আন্দোলন সৃষ্টি করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তাঁর ভাষা আর 888sport live footballে বিপুল কাজও এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অঙ্গ। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ভাষা সম্বন্ধে ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে যা-ই বলুন (আমাদের মতে তাতে বঙ্কিমচন্দ্রের সমালোচনার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়েছে), বিদ্যাসাগর আখ্যানের ভাষা সৃষ্টি না করলে বঙ্কিমচন্দ্রের 888sport alternative link রচিত হতো কি না সন্দেহ, তর্ক ও ব্যঙ্গবিদ্রূপের ভাষা সৃষ্টি না করলে হয়তো কমলাকান্তের দপ্তরও লেখা সম্ভব হতো না। আজকের যুগে সেই অসামান্য ভাষা আমরা উপভোগ করতে পারি, তবে তাতে আমাদের ফিরে যাওয়ার আর উপায় নেই, তাঁরই প্রেরণায় আমরা সে-ভাষাকে ফেলে অনেক দূর চলে এসেছি। তাই এ-নিবন্ধে আমরা তাঁর ভাষা আর 888sport live footballে অবদানেরও আলোচনা করব না। আমরা বিদ্যাসাগর নামক ঐতিহাসিক অস্তিত্বের যে-নির্যাসটুকু বেঁচে আছে তারই দিকে নজর রাখতে চাই। 

তাহলে বিদ্যাসাগর (বা হাজী মুহম্মদ মহসীন (১৭৩৩-১৮১২), বা স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২), বা আরো অনেকে) প্রমুখের জীবন থেকে আমরা কী নেব, তাঁদের কোন‌ দিকটা অনুসরণ করার কথা আমাদের সন্তানদের বলব ? এর উত্তর, প্রথমত বলব, তাঁদের চারিত্রিক গুণাবলি আর সাধনার কথা, যা তাঁদের একটা মহত্ত্বে পৌঁছে দিয়েছে, আর দ্বিতীয়ত, তাঁদের সামাজিক কাজকর্মের কথা, যা আমাদের সমাজকে অগ্রসর করে দিয়েছে। অর্থাৎ তাঁর সমস্ত প্রয়াস আর কীর্তি, সাফল্য আর ব্যর্থতার যে-সূত্র নির্যাসরূপে তাঁর চরিত্র নির্মাণে উপস্থিত ছিল, তাকেই আমরা বোঝার চেষ্টা করব, এবং পরিণামে গ্রহণ করব আমাদের আত্মোন্নয়নের পথরেখা হিসেবে। 

বস্তুত কে কী অনুকরণ করবেন তাও নানা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভর করে। গান্ধিজি (১৮৬৮-১৯৪৮), আমার মতে, অনুসরণ করেছিলেন, হয়তো আরো অনেক কিছুর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পোশাকটিকেও। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে পুরোপুরি ফিরে আসার (১৯১৫) অনেক আগেই, ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি Indian Nation পত্রিকায় বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে একটি 888sport live লিখেছিলেন – বিশ্বের 888sport app কয়েকজন খ্যাতনামা মানুষের জীবন আলোচনা সেরে তিনি ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম অবলম্বন করেছিলেন বিদ্যাসাগরকে। তাতে বিদ্যাসাগরের পোশাক – ওই ধুতি আর চাদর সম্বন্ধে তিনি আলাদা একটি অনুচ্ছেদ রচনা করে ওই ‘সন্ন্যাসী’, ‘ফকির’ বা ‘যোগী’র বেশ সম্বন্ধে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

এ-কথাগুলি সাধারণ বর্ণনামাত্র হয়ে থাকত, যদি না গান্ধিজি ভারতে ফেরার পরে নিজের পোশাকে সমজাতীয় পরিবর্তন আনতেন। গান্ধিজি ধরতে পেরেছিলেন যে, ওই পোশাকের একটা বিশেষ অর্থ আছে, যাকে হয়তো ইদানীংকার সেমিওটিক্‌স বা চিহ্ন888sport apk দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অর্থাৎ তা একটা প্রতিবাদে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগেই আমাদের রাজা বদল হয়েছে। কিন্তু উচ্চবিত্তেরা – রামমোহন রায়, ঠাকুর-পরিবার, রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ অনেকেই প্রাক্তন রাজাদের পোশাক পরেছেন, আবার নতুন রাজাদের পোশাকও পরেছেন মধুসূদন প্রমুখ, এবং অনেক উচ্চশিক্ষিত বাঙালি। এক বিদ্যাসাগর গোঁ ধরে গরিব বাঙালি (হিন্দুর) পোশাক আঁকড়ে রইলেন, হয়তো এই ভেবে যে তাঁর দেশের সাধারণ মানুষের থেকে তাঁকে খুব বেশি আলাদা মনে হবে না। আমাদের অনুমান, গান্ধিজি পরে নিজের পোশাক সম্বন্ধে যে-সিদ্ধান্ত নেন, বিদ্যাসাগরের পোশাক তাকে প্রভাবিত করেছিল। ফলে একটা মানুষের চরিত্রের অন্তর্গত বিশেষত্ব নিশ্চয় আমরা অনুকরণ করি, কিন্তু কখনো কখনো তাঁর বহিরঙ্গের আনুষঙ্গিক নানা জিনিসও, তার চিহ্নায়নের কারণে আমাদের কাছে অনুকরণযোগ্য মনেই হতে পারে। কারণ তিনি সজ্ঞানে, সচেতনভাবে ওই পোশাক নির্বাচন করেছেন। অন্য পোশাক নির্বাচনের সুযোগ ছিল, প্রচলনের সামাজিক চাপ ছিল, তবু তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি ওই পোশাক গ্রহণ করেছিলেন। এই পোশাক দিয়ে তিনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন তাঁর সময়কার পৃথিবীকে।

এমন নয় যে, বিদ্যাসাগর বা গান্ধিজি তাঁদের ওই পোশাকের জন্যই মহৎ। কিন্তু তাঁদের পোশাক, আমাদের মতে তাঁদের একটা statement, তাকে অন্যসব কাজ আর প্রকাশের সঙ্গে জড়িয়ে দেখতে হবে।

আমরা যদি আমাদের পোশাকের বিচার করি তা হলে দেখি যে, এই statement ব্যক্তির দিকে নজর টানে। বলি, ‘আমাকে দ্যাখো।’ বলি না, ‘আমার মধ্যে আমার আসল দেশকে দ্যাখো।’ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যুগে হয়তো সেটাই স্বাভাবিক, তাছাড়া সবাই বিদ্যাসাগর বা গান্ধিজির এই দিকটা অনুসরণ করলে বিশ্বের পোশাক-বাণিজ্যও সমস্যায় পড়বে। তাই এ নিয়ে আবেগপ্রবণ হওয়ার কোনো অর্থ হয় না। 

২. তাঁর অগ্রগতির পিছনে কী ছিল?

অগ্রগতি, অর্থাৎ তাঁর তো পেছন থেকে সামনে বা তলার থেকে ওপরে ওঠার একটা বৃত্তান্ত আছে। এই বৃত্তান্তটা আমরা একটু লক্ষ করি।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যত অগ্রনেতা ছিলেন, তাঁদের সকলের আর্থসামাজিক ভিত্তি যদি  লক্ষ করি, তাহলে বিদ্যাসাগরের মতো এত দরিদ্র পরিবার থেকে, গ্রাম্য প্রতিবেশ থেকে উঠে-আসা মানুষ খুব বেশি ছিলেন না। রাজা রামমোহন (১৭৭৪-১৮৩৩), রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪-১৮৬৭), ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮), দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬), রাধানাথ শিকদার (১৮১৩-৭০), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩-৯৮), কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-৮৫), প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-৮৩), রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-৬৮), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-৮৬), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-৮৪) প্রমুখ যাঁরই নাম করব তাঁদেরই একটা শিক্ষা, বিত্ত ও সামাজিক মর্যাদার উচ্চ ভিত ছিল। মুসলমান সমাজপতিদের সম্বন্ধেও নিশ্চয়ই বহুলাংশে এমন কথা বলা চলে। বিদ্যাসাগরের পরিবার এইসব পরিবারের সঙ্গে কোনো দিক থেকেই তুলনীয় ছিল না। যে-শিক্ষা তাঁদের ছিল তা আধুনিক সময়ের শিক্ষা নয়, এমনকি বিদ্যাসাগরের পিতা-পিতামহ তাঁকে আধুনিক বা আগামী যুগের শিক্ষা দেওয়ার কথা ভাবেনওনি। সংস্কৃত তখনই নাগরিক শিক্ষায় তার মর্যাদা হারাতে চলেছে। ১৮৩৫ সালে টমাস ব্যারিংটন মেকলের নতুন শিক্ষানীতিতে ইংরেজি উচ্চশিক্ষা আর সরকারি প্রশাসনের ভাষা হবে, সংস্কৃত শিক্ষাকে পার্শ্বিকতায় ঠেলে দেওয়া হবে। ১৮১৩-তে কোম্পানির স্কুল শিক্ষায় অর্থের বরাদ্দ শুরু হলো, ১৮১৭-তে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হলো – তা থেকে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় মূল ভাষা যে ইংরেজি হতে চলেছে, এবং পরিণামে তা হবে আধিপত্য, সাফল্য আর মর্যাদার ভাষা তার ইঙ্গিত মেকলের প্রস্তাবের আগেই পাওয়া গিয়েছিল। এর ইতিবাচক একটি দিক যা ছিল তা এই যে, বাংলা ভাষারও চর্চা শুরু হয়েছিল, এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, শ্রীরামপুরের মিশনারির দল এবং শিক্ষানুরাগী কিছু ইংরেজ বাংলাভাষায় পাঠ্যগ্রন্থ, পত্রপত্রিকা প্রকাশ এবং স্কুলপাঠ্য পুস্তক লিখে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাভাষার চর্চায় উৎসাহ সৃষ্টি করছিলেন, যাতে পরে বাঙালি এলিট বা অভিজন-সম্প্রদায় সাগ্রহে অংশ নেয়। সংস্কৃত থেকে বাংলায় 888sport app download apk latest versionের প্রয়াস রামমোহনেই পাই, ১৮১৫-র বেদান্ত গ্রন্থে।

বাংলা 888sport live footballচর্চার ইতিহাস রচনা এখানে আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা লক্ষ করি যে, বিদ্যাসাগরের অধীত বিদ্যা সংস্কৃত তখন ওই বিষয়ে অধ্যাপনা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না (পৌরোহিত্য ছাড়া – যে-দিকটা পণ্ডিত বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ পরিহার করেছিলেন, হিন্দু আচারগত ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর উৎসাহহীনতার জন্য)। কিন্তু বিদ্যাসাগর, তাঁর কোনো গ্রন্থ প্রকাশের আগেই তাঁর বাংলা রচনায় দক্ষতার জন্য খ্যাতিলাভ করেছিলেন। খুব বেশি রচনা তাঁর সাময়িকপত্রেও প্রকাশিত হয়নি। তবু তা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, এবং তিনিই উনিশ শতকের চল্লিশের বছরগুলির শেষদিকে বিদ্যাসাগরকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নিয়ে যান। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে তত্ত্ববোধিনী সভার সদস্য করেন এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার (১৮৪৩ -) রচনা-সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত করেন, পত্রিকার ‘গ্রন্থাধ্যক্ষ সভা’র সদস্য হিসেবে। তার আগেই সম্ভবত ঈশ্বরচন্দ্র অক্ষয়কুমারের বাংলার ইংরেজি প্রভাব ও 888sport app দুর্বলতার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। (ইহ)জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির একাত্মকতার ফলে দুজনের বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়, এবং অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগরের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেন।

আমরা বীরসিংহের ওই দরিদ্র বালকের কলকাতার অভিজন সমাজের শীর্ষস্থানীয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে পৌঁছানোর বিন্দুটিকে একটি সামাজিক ঊর্ধ্বায়ন হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। এটা সম্ভব হলো তাঁর চরিত্রের যে-স্বভাবের জন্য তা হলো একটি অদম্য জেদ, সংকল্পের দুর্জয়তা, যা নিজেকে ক্ষমাহীনভাবে তাড়না করেছে, কোনো পরিশ্রমকেই পরিশ্রম বলে মনে করেনি। অন্ধকার বাসস্থানে বাবা ও ভাইদের সঙ্গে থাকা, রান্না করা (উনুনের কাঠ কাটা থেকে তরকারি কোটা, বাটনা বাটা, রান্না, পরিবেশন করা, বাসন ধোয়া), গহ্বর পরিষ্কার করা, ঘুমকে শাসন করে পড়াশোনা, ঘুমোলে বাবার হাতে প্রহার সহ্য করা, হেঁটে হেঁটে সংস্কৃত কলেজে গিয়ে প্রতিবছর পরীক্ষায় 888sport app download for androidীয় সাফল্য লাভ, রচনায় 888sport app download bd লাভ ইত্যাদি।

যেন এই বালক, তার কৈশোরে পৌঁছানোর আগেই এমন ভেবেছিল কি না কে জানে – যে, আমি রাজধানীতে পৌঁছেছি, আমি এবার পৃথিবীর নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমাকে তাই হতে হবে। তাই তিনি সংস্কৃত ভাষা, কাব্য, 888sport live football, দর্শন সবই পাঠ করছেন গভীর এবং বিচারশীল মনোযোগসহকারে (পরে সাংখ্য আর বেদান্ত দর্শন – শেষেরটি স্বামী বিবেকানন্দের প্রচারে বিশেষ মাহাত্ম্য পেয়েছে মনে রাখতে হবে – তিনি false philosophies বলবেন), কিন্তু বাংলাভাষা লিখনের প্রয়াসে নিমগ্ন থেকেছেন, অন্যদিকে রাধাকান্ত দেবের দৌহিত্র আনন্দকৃষ্ণ বসুর কাছে ইংরেজি শিখছেন, শেক্সপিয়র পড়ছেন। আর তাঁর স্কুল-কলেজের পাঠ্যতালিকার সম্পূর্ণ বহির্ভূত 888sport apk বিষয়ে তাঁর জিজ্ঞাসা ক্রমশ বিস্তারিত হচ্ছে।

এই পরিক্রমার পেছনে যে নিষ্ঠা আর একাগ্রতা ছিল, যে প্রাণপণ আত্মবিস্তারের ইচ্ছা ছিল – তার শিক্ষা দেড়শো বছর পার হয়ে এখনো আমাদের কাছে জেগে আছে। এই না-হারবার ইচ্ছা, এই প্রাণপণে কোথাও একটা পৌঁছানোর ইচ্ছা, এবং জয়লাভ করা, পৌঁছে যাওয়া। এই গেল একটা দিক।

দুর্জয় সাহস, স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার ওপরে আমরা তাঁর একার অগ্রগমন লক্ষ করলাম। তিনি নিজে অনেকটা ওপরে উঠেছেন। তাতে তাঁর বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে একরকম সংযোগ ঘটেছে, সফল হয়েছেন বলে সমাজ তাঁকে নানাভাবে ব্যবহার করছে। এই ভাবে তাঁর আরো ব্যক্তিগত সাফল্য আসবে। তিনি সংস্কৃত কলেজে সহ-সম্পাদক হবেন, অধ্যাপক হবেন, অধ্যক্ষ হবেন (১৮৫১), তখনকার সরকারকে শিক্ষাবিষয়ে নানা পরামর্শ দেওয়ার ডাক পাবেন। এগুলি তাঁর সাফল্য ও প্রাপ্তির ক্রমোন্নত পর্যায়কে চিহ্নিত করে। সব কাজই তিনি যথাসাধ্য নিষ্ঠা এবং অর্জিত যোগ্যতার সঙ্গে করবেন, সে-সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। তবু এই অগ্রগতি বা উন্নতিকে এখনো আমরা ব্যক্তিগত সফলতা হিসেবেই মূলত চিহ্নিত করব।

কিন্তু এর পরে তিনি নিজে, তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের সঙ্গে আপাত-সম্পর্কহীন – কিছু ‘দায়’ তুলে নেবেন, যা না তুলে নিলেও তাঁকে কেউ কিছু বলত না। তার একটি হলো বিধবাবিবাহ বৈধ করার আন্দোলনের আরম্ভ। এই ইতিহাস বহুচর্চিত, আমরা তার অনুপুঙ্খে যাওয়ার প্রয়োজন দেখি না। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তাঁর চরিত্রের যে-দিকটি প্রকাশিত হলো তা বোধহয় সমাজ আর প্রতিবেশের মুখোমুখি না হলে হয় না, তা হলো, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ‘অজেয় পৌরুষ’, ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’। এই তেজস্বিতা তাঁর আলোচনায় একটি বংশানুক্রমিক ব্যাখ্যা পেয়েছে, ঠাকুরদা, পিতা হয়ে যেন-বা তা বিদ্যাসাগরে বর্তেছে। কিন্তু তাঁর বংশগত পূর্বসূরিরা সমাজের সঙ্গে সংঘাতে তাঁদের পৌরুষের পরীক্ষা করেননি, যেটা বিদ্যাসাগর করেছেন। তবে উৎস যাই হোক, প্রতিকূলতার প্রতিরোধের বিরুদ্ধে তাঁর যে অনমনীয় মনোভাব, তার প্রাসঙ্গিকতা কি আমাদের কাছে স্পষ্ট এবং অনুকরণযোগ্য? এ-প্রশ্ন আমাদের নিজেদেরই করতে হয় জীবনের নানা সময়ে। সকলে সমাজের সঙ্গে প্রতিবেশের সঙ্গে এই সরাসরি সংঘাতে যাবেন, এমন নাও ঘটতে পারে। কারণ আমরা সকলে নিজের স্বার্থের বাইরে কোনো ‘দায়’ কাঁধে তুলে নিই না, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া আমাদের অনেকের জীবনেই জরুরি মনে হয় না। সেই যে বঙ্কিমচন্দ্রের এক গুরু তাঁর ধর্মতত্ত্ব বা অনুশীলন বইয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘এই জীবন লইয়া কী করিব’ – আমরা অনেকেই তার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক গণ্ডিতে বদ্ধ একটা উত্তর খুঁজি, তাই আমাদের ভিতরে ওই ‘অজেয় পৌরুষ’ আছে কি না তার পরীক্ষা হয় না। সেটা এক দিক থেকে স্বস্তির। কিন্তু বিদ্যাসাগর স্বস্তির পথ বেছে নেননি – এটাই মূলত মনে রাখার। সেটা স্ত্রীশিক্ষার প্রয়াসেই হোক, বিধবাবিবাহের বৈধীকরণে হোক, বহুবিবাহ আর বাল্যবিবাহ রোধের (অসফল) চেষ্টাতেই হোক। আজকে আমরা যদি কোনো সামাজিক প্রয়াসে (যার সম্প্রসারিত রূপ হলো রাজনৈতিক প্রয়াস) দৃষ্টি দিই, তাহলে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টান্ত আমাদের উৎসাহ এবং দ্বিধা দুয়েরই কারণ হতে পারে।

৩. বোধ ও বিশ্বাস

তাঁর আরেকটি দিক আমাদের কাছে উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হয়। সেটি তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের দিক। তাতে সমাজের সঙ্গে তাঁর সংঘাত হয়েছে, কিন্তু বিধবাবিবাহের মতো অত তীব্র নয়। অন্তত তাঁর বিশ্বাসকে তিনি লেখায় নথিবদ্ধ করতে পেরেছেন, বিশেষ কোনো বাধা পাননি। হ্যাঁ, জন মারডক নামে একজন পাদরি তাঁর বর্ণপরিচয়ে ‘র‌্যাঙ্ক মেটিরিয়ালিজ্‌ম’ আর ‘সেকিউলারিজ্‌ম’ লক্ষ করেছেন, কিন্তু অন্য কিছু বই সম্বন্ধে খুব সামান্য আপত্তি উঠেছে। এটা লক্ষ করি যে, বিদ্যাসাগর পাঠশালা থেকে সংস্কৃত কলেজ পর্যন্ত যে-পাঠ নিয়েছেন তাতে কোথাও তাঁর 888sport apkকে জানার বা 888sport apkের বই পড়ার সুযোগ হয়নি – সংস্কৃত পাঠক্রমে 888sport apk বিষয় থাকার কথাও নয়। তাঁর মায়ের প্রথাগত আচারপ্রধান হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে একটা হিসাব ছিল, তিনি দয়াধর্মকে আনুষ্ঠানিক ধর্মের চেয়ে বড় বলে মনে করতেন। বিদ্যাসাগর নতুন চাকরি পেয়ে মা-বাবার ইচ্ছাপূরণ করতে চাইলে তাঁর বাবা চেয়েছিলেন ধুমধাম করে গ্রামে জগদ্ধাত্রী পুজোর ব্যবস্থা, মা চেয়েছিলেন গ্রামের গরিবদের মধ্যে শীতের কম্বল বিতরণ। মায়ের এই আচারধর্ম সম্বন্ধে অনীহা বিদ্যাসাগর পেয়েছিলেন, এবং এই সংস্কৃতজীবী কুলীন ব্রাহ্মণসন্তান কখনো পরে সন্ধ্যা-আহ্নিক জপতপ করেননি, তাঁর কলকাতার বাড়িতে পূজার জন্য কোনো বিগ্রহ ছিল না, কোনো দিন মন্দিরে যাননি – এমনকি কাশীতে গিয়ে কাশীর মন্দিরেও যাননি – পুরোহিতদের অভিযোগের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তাঁর ঘরেই বাবা বিশ্বেশ্বর এবং মা অন্নপূর্ণা – অর্থাৎ তাঁর বাবা আর মা – আছেন, তাঁর মন্দিরে যাবার দরকার নেই। ধর্মপ্রচার করা দূরে থাক, ধর্মপ্রচারক রামকৃষ্ণের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তা দ্বারাও প্রভাবিত হননি। রামকৃষ্ণ-শিষ্য মহেন্দ্র গুপ্তের শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত পড়লে দেখা যায় যে, রামকৃষ্ণের উদ্যোগে সংঘটিত (তিনি নিজে বিদ্যাসাগরের বাড়ি গিয়েছিলেন ভক্তদের নিয়ে) এই দুই মহাপুরুষের সাক্ষাৎকারে রামকৃষ্ণ যেখানে সত্তরের বেশি বাক্য ব্যবহার করছেন সেখানে বিদ্যাসাগর বলছেন মাত্র আট-দশটি বাক্য, তাও খুব সংক্ষিপ্ত। রামকৃষ্ণের কাছে তাঁর নিজের বিশেষ প্রশ্ন ছিল না, তিনি নিজে কিছু জানতে চাননি। রামকৃষ্ণ যাওয়ার সময় তাঁকে বারবার আমন্ত্রণ করলেন দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার জন্য, বিদ্যাসাগর একবারও সেই ডাকে সাড়া দিলেন না। রামকৃষ্ণ ব্যথিত হয়ে মহেন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের বিদ্যাসাগর এত মিথ্যেবাদী কেন, আসবে বলে এলো না।’

যে রামকৃষ্ণ আন্দোলন তখনই কলকাতার বহু প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগদানে শক্তি লাভ করেছে, এবং পরে ১৮৮০-র পরে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে এক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করবে, তার সঙ্গে বিদ্যাসাগর যে যুক্ত হলেন না, এ তাঁর এক সচেতন নির্বাচন। তা সংস্কৃতপাঠের সঙ্গে প্রাচীন হিন্দুধর্মের প্রতি ভক্তির সরল সমীকরণের ছকটি যেমন ভেঙে দেয়, তেমনি বিদ্যাসাগরের মনোভাবটিকেও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে।

কিন্তু বংশের প্রচলিত ধর্মে উদাসীন হওয়া এক কথা, আর পাশ্চাত্য 888sport apkে আগ্রহী হওয়া আরেক কথা – দুয়ের সম্পর্ক অনিবার্য নয়। সেটাই হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, এবং এমনভাবে হয়েছিলেন যে, তাঁর বোধোদয় (১৮৫১) বইয়ের প্রথম সংস্করণে ‘ঈশ্বর’ সম্বন্ধে কোনো সংবাদই ছিল না। পরে নাকি ব্রাহ্ম (পরে সন্ন্যাসী) বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর অনুরোধে তিনি ‘পদার্থ’-এর পরে ‘ঈশ্বর’ সম্বন্ধে এখনকার অনুচ্ছেদটি রচনা করেন। এটি একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে যে, তা বিদ্যাসাগরের অন্যমনস্ক রচনা। সব সংস্করণে এই পাঠ এক নয়। কোথাও ‘ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’ – ব্রাহ্মধর্মসুলভ এই বাক্যটি আছে। আবার বলছেন, ‘আমরা যাহা করি, তিনি তাহা দেখিতে পান। আমরা যাহা মনে করি, তাহা তিনি জানিতে পারেন।’ এর মধ্যে স্ববিরোধ আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বস্তুবাদী কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য তাঁকে নাস্তিক বলেছেন, অন্য অনেকে তাঁর ঈশ্বরে একটা গুরুত্বহীন সাধারণ বিশ্বাসের কথা বলেছেন। অনুগতদের তিনি নাকি বলতেন, ‘এ দুনিয়ার একজন মালিক আছেন তা বেশ বুঝি’, কিন্তু তার বেশি তিনি বুঝতে বা বোঝাতে চান না। 

যাই হোক, চিঠিতে শ্রীহরিশরণং বা শ্রীশ্রী দুর্গা সহায় লিখলেও, বা একজন সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা থাকলেও ঈশ্বর ও ধর্ম তাঁর কাছে অগ্রাধিকার পায়নি। তাহলে তাঁর কাছে অগ্রাধিকার কী দাঁড়িয়েছিল? একদিকে শিক্ষায় 888sport apk আর চরিত্রনীতি, আর অন্যদিকে আচরণে মানুষ সম্বন্ধে, বিশেষত বিপন্ন মানুষ সম্বন্ধে মমতা ও দয়া, যার মধ্যে 888sport promo codeরাও ছিল। যে মমতার জন্য তিনি তেজোদৃপ্ত সংগ্রামেও প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

888sport apkের কথাটা আগে বলি। তাঁর কিছু রচনা – জীবনচরিত (১৮৪৯), বোধোদয় (১৮৫১), ঋজুপাঠ (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় – ১৮৫১-৫২), চরিতাবলী (১৮৫৬), আখ্যান মঞ্জরী (তিন ভাগে ১৮৬৩, ১৮৬৮) – মূলত জীবনীর সংকলন – এবং এই জীবনীগুলির মধ্যে একটিও ধর্মগুরুর বৃত্তান্ত নেই। তার বদলে আছে 888sport apkীদের এবং কষ্ট করে, বা গ্রন্থপাঠের ব্যাকুল তৃষ্ণা বা 888sport app ধরনের অধ্যবসায়ে যাঁরা জীবনে সাফল্য লাভ করেছেন তাঁদের কথা। এর মূলেও একটা নৈতিক উদ্দেশ্য ছিল, বিদ্যাসাগর বাঙালির কাছে কিছু ‘রোল‌ মডেল’ হাজির করতে চান, কারণ, জীবনচরিতের ভূমিকায় তাঁর কথা – ‘কোনো কোনো মহাত্মারা অভিপ্রেত কার্য সম্পাদনে কৃতকার্য্য হইবার নিমিত্ত যেরূপ অক্লিষ্ট পরিশ্রম, অবিচলিত উৎসাহ, মহীয়সী সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তর অধ্যবসায় প্রদর্শন করিয়াছেন এবং কেহ বহুতর দুর্ব্বিষহ নিগ্রহ এবং দারিদ্রনিবন্ধন অশেষ ক্লেশ ভোগ করিয়াও যে ব্যবসায় হইতে বিচলিত হন নাই’ তা চর্চায় হাজার উপদেশের কাজ হয়। আর ওইসব দেশ, সমাজ আর কালের কথাও জানা যায়। প্রথম মূল্য নীতিমূলক, তা জীবনসাধনার সঙ্গে যুক্ত; দ্বিতীয় উপকার জ্ঞানাত্মক। তাই জীবনচরিতে এসেছে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন থেকে টমাস জেঙ্কিন্স প্রমুখের কথা, চরিতাবলীতে এসেছে ডুবাল প্রিডো রেমাস প্রমুখের কথা। আখ্যান মঞ্জরীতে ব্যক্তির নাম ধরে জীবনী উপস্থাপিত হয়নি, কিন্তু নানা গুণাবলি (‘লোভসংবরণ’, ‘অপত্যস্নেহ’ ‘অমায়িকতা ও উদারচিত্ততা’) ধরে গল্পগুলি পরিবেশিত। এখানেও নৈতিক উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট। ইসপের গল্পের কথামালা (১৮৫৬) নামে 888sport app download apk latest versionও এই বইগুলির লক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়।

নৈতিকতার কথাটা একটু বলা উচিত। যদিও বিদ্যাসাগরের প্রায় সমস্ত রচনাই একটি নৈতিক উদ্দেশ্যের আভাস দেয়, তা কোনো ধর্মীয় নৈতিকতা নয়, তা মানবিক নৈতিকতা। অর্থাৎ মানবচরিত্রকে সমাজের সহায়ক আর উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য যে-নৈতিকতা প্রয়োজন বিদ্যাসাগর দীর্ঘকাল ধরে তারই সন্ধান করে চলেছেন দেখতে পাই। ১৮৫৫-তে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ থেকেই তার শুরু। সেখানেই গোপাল ও রাখাল নামে দুটি বালক-চরিত্রের বিরোধ বিদ্যাসাগর নির্মাণ করেন, পরে দ্বিতীয় ভাগে ভুবন নামে একটি নষ্ট ছেলের গল্পও আসবে। প্রথম গোপাল আর রাখাল কেন গোপাল আর রাখাল হলো তার পটভূমিকা দেওয়া হয়নি, কিন্তু ভুবনের গল্পে ভুবন যে অন্যদের কারণে ফাঁসির আসামি হয়েছে তা বলা হয়েছে।

কিন্তু গোপাল আর রাখাল নিয়ে গত শতাব্দীতে একটি গবেষণায় কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, গোপাল বিদ্যাসাগরের ঔপনিবেশিক আনুগত্যের ফলে তৈরি, গোপাল হয়তো পরে সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ এক নাগরিক হবে। আমরা দুদিক থেকে এই মত ভ্রান্ত বলে মনে করি। প্রথমত, প্রায় সব প্রথম ভাষাশিক্ষার বইয়েই (প্রাইমারে), হয়তো সব দেশেই, এরকম একটি চরিত্র খাড়া করার চেষ্টা থাকে, উপনিবেশ-অনুপনিবেশ নির্বিশেষে। আর দ্বিতীয়ত, তখনকার কলকাতার নাগরিক সমাজে বিত্তবান ‘বাবু’ সমাজের পুরুষ সন্তানদের মধ্যে যে পচন ধরেছিল – যার খবর মধুসূদনের একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৫৯), দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশীসহ (১৮৬৬) 888sport app প্রচুর নাটকে আছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এরকম একটি চরিত্র নির্মাণের ইচ্ছা অস্বাভাবিক নয়, তাকে শুধু ঔপনিবেশিক প্রেরণা বলে ব্যাখ্যা করা যায় না।

৪. অজেয় মনুষ্যত্ব : নানা অর্থে

আমরা এর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর 888sport app মানুষের সঙ্গে উৎসের দিক থেকে বিদ্যাসাগরের তুলনা করে দেখিয়েছি যে, অত্যন্ত গ্রামীণ, দরিদ্র, ঐতিহ্যভিত্তিক ও ‘অনাধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবার থেকে বিদ্যাসাগর উঠে এসেছিলেন বলে তাঁর উত্থান এবং পথ-পরিক্রমা ছিল অনেকের চেয়ে অনেক কঠিন। এবারে আমরা লক্ষ করব যে, হয়তো সেই কারণেই বিদ্যাসাগরকে ছুঁতে বা তাঁর কাছে পৌঁছোতে পারতেন একেবারে নিঃস্বতম থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরের, সব সম্প্রদায়ের মানুষ, ভিক্ষুক থেকে অস্পৃশ্য, ভদ্রলোক থেকে গ্রামীণ অভাবগ্রস্ত 888sport promo code-পুরুষ। তাঁর কাছে ধর্ম, সম্প্রদায়, হিন্দু-সমাজের জাতিগোত্র, শিক্ষা, বিত্ত – কিছুই কোনো বাধা ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আর কোনো অগ্রনেতা সম্বন্ধে এমন কথা বলা যায় কি না সন্দেহ। এ-বিষয়ে অজস্র গল্প পাঠকদের জানা আছে, তার উদ্ধার 888sport liveের আয়তন বৃদ্ধি করবে মাত্র।

যেজন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লোকের মুখে ‘বিদ্যেসাগর’ হয়ে বাংলার ‘ফোকলোর’ বা লোককথার মধ্যে প্রবেশ করেছেন, যা আর অন্য কারো সম্বন্ধে বলা যায় না। তাঁর সম্বন্ধে এত লোকগল্প প্রচলিত হয়েছে যে, আমরা শৈশবে তাঁর জীবনী পড়বার আগেই এই গল্পগুলি দিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই। তাঁর জীবনীকারেরাই তাঁর সম্বন্ধে কিছু গল্প যে কল্পিত, বাস্তব ঘটনা নয়, তা উল্লেখ করে আমাদের ‘ভ্রমনিরাস’ করেছেন। যেমন তার মধ্যে একটি বর্ষায় প্লাবিত ভয়ংকর দামোদর সাঁতরে পার হয়ে তাঁর মায়ের কাছে পৌঁছানোর গল্প; কিংবা নীলদর্পণ অভিনয় দেখতে দেখতে তাঁর রোগ সাহেবের অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফীকে চটিজুতো ছুড়ে মারার গল্প। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের নামে প্রচারতি একাধিক লোকগল্প বাস্তবভিত্তিহীন।

তবু আমাদের কথা হলো, এইসব গল্প তৈরি হলো কেন? হলো, এমন এক লোকবিশ্বাস থেকে যা বলতে চায়, এমন যদি কেউ পারে তো একা বিদ্যাসাগরই এটা পারেন, ওই দামোদর সাঁতরে পার হওয়া বা অভিনেতাকে চটিজুতো ছুড়ে মারা। তার কারণ বিদ্যাসাগরের মধ্যে প্রকাশিত ছিল ওই অজেয় মনুষ্যত্বের আরেক দিক, দুর্জয় সাহস আর বীরত্বের পাশাপাশি এক অন্তহীন মানবিক করুণা, যা মানুষকে ভালোবাসার অন্য নাম। এই চরিত্রলক্ষণ, যা ঊনবিংশ শতাব্দীর লোক888sport sign up bonusতে বিপুলভাবে সংরক্ষিত, শত শত আখ্যানে – তা উচ্চনীচ বিচার করত না, ধর্ম-সম্প্রদায় বিচার করত না, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য বিচার করত না – তা সমকালের খুব কম এলিটের সম্বন্ধেই নির্ধারণ করা যায়। অন্যরা নানা কারণে মহৎ, তাঁদের মহত্ত্বকে আমরা কুর্নিশ করি, কিন্তু বিদ্যাসাগর যেভাবে ‘করুণাসাগর’ হয়ে উঠেছিলেন, তার তুলনা আর কারো মধ্যে পাই না। কী পথের কলেরা রোগী, কী মুসলমান ভিক্ষুক ও বাউল গায়ক, কী বর্ধমানের বস্তির ছেলেমেয়ে, কী কর্মাটাঁড়ের নিঃস্ব সরল সাঁওতাল মানুষেরা – সকলে বিদ্যাসাগরের অপার মমতা পেয়েছেন। এখানে তাঁর সঙ্গে তুলনা করার মতো আর কেউ নেই।

নিজের আদি দুর্বল অবস্থান থেকে উঠে আসার জন্য দুর্বিষহ সংগ্রাম, জ্ঞানের অর্জন ও বিস্তার, সামাজিক যুদ্ধে বীরত্ব, 888sport live footballের ভাষা নির্মাণ, যুক্তিঋদ্ধ ইহজাগতিকতার প্রচার, হয়তো শেষ জীবনে তাঁর বিপুল নিঃসঙ্গতা ইত্যাদির সঙ্গে তাঁর এই সীমানাহীন মানবপ্রেম বিদ্যাসাগরকে তাঁর এবং সকল সময়ে এক ভিন্ন পরিচয়ে চিহ্নিত করে দিয়েছে। এই পরিচয়গুলি আমাদের নিজেদের সম্পত্তি করে তোলার আমন্ত্রণ, হয়তো বা চ্যালেঞ্জ, নিয়ে হাজির হয় এমন একজন মানুষের শত, দ্বিশত বা সহস্র বর্ষ।  [কৃতজ্ঞতা : এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমি অজস্র লেখকের সাহায্য নিয়েছি। বিদ্যাসাগরের নানা জীবনীকার, এবং রবীন্দ্রনাথসহ ঊনবিংশ শতাব্দীর অগণিত লেখক তো বটেই, কিন্তু এখন বিশেষভাবে উল্লেখ করি বিনয় ঘোষ, ইন্দ্র মিত্র, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আশিস লাহিড়ী, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় প্রমুখের লেখা। মতামত অবশ্য আমার নিজের বলেই দাবি করি। তবে উদ্ধৃতি আর সূত্রপঞ্জি দিয়ে এটিকে গবেষণা-888sport liveের চেহারা দেওয়া থেকে বিরত থাকলাম।]