কবি

আনিসুল হক

কীরকম বৃষ্টি পড়ছে! চিলেকোঠার ঘরের জানালাটার ওপরে কোনো শেড নাই আর পাল্লার একটা কাচ ভাঙা। সেখানে সে লাগিয়ে রেখেছে একটা শক্ত কাগজের বোর্ড। কাগজটা ভিজে বাদামি হয়ে গেল।

জানালা খোলাই ছিল। যা গরম পড়েছিল রাতে। এখন বৃষ্টির ছাঁট এসে তার বিছানায় পড়ছে। তার পায়ের কাছটায় লাগছে জলের ছিটে। পা জোড়া টেনে নিল। হাঁটু জিনিসটা তো দেওয়াই হয়েছে ভাঙার জন্য। তা না হলে হাঁটুভাঙা দ অক্ষরটাই তো থাকত না। সে নিজের পা দুটো ভাঁজ করে হাঁটু ভাঙা দ-য়ের আকার দিলো।

বিছানা ভিজে যাচ্ছে। তোশকটা ভিজে গেলে মুশকিলই হবে। এমনিতেই ঘরের বোঁটকা গন্ধটা তার নাকে সয়ে গেছে। কিন্তু তোশক ভিজে থাকলে যে-গন্ধ হবে সেটা হয়তো তার মতো গন্ডারের নাকেও একটুখানি আঘাত দিয়ে খানিকটা ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। জানালার কবাটদুটো বন্ধ করে দিতে পারলে ভালো হতো! কিন্তু দেবেটা কে?

তার আলসেমি করতে ভালো লাগছে। সারারাত গরমে কষ্ট পেয়েছে। সকালের বৃষ্টি তার চোখে আরামের স্পর্শ বুলিয়ে দিয়ে বলছে, ঘুমো।

বুয়া এলেই ঝামেলা! আসার কোনো দরকার নাই। কারণ রাতের বেলা রান্না হয়নি, কাজেই খাওয়া হয়নি, কাজেই কোনো বাসন-কোসন নাই যে ধুতে হবে।

টাকা নাই পকেটে একটাও। গতকাল দুপুরেও বুয়া ক্যাটর ক্যাটর করেছে, টাকা দেন, বাজার করি। মামুন বলেছে, বুয়া, আমার রাতে দাওয়াত আছে। খেতে হবে না। রাতে খাওয়া হেভি হলে সকালে নাশতাও লাগে না। কাজেই একদম চিন্তা করবেন না। কালকে দেখা যাবে।

সকালে নাশতা করবেন না, এইটা কোনো কথা হইল। খালি প্যাডে কেউ থাকে সকালবেলা!

তুমি জানো না বুয়া। এইটাই বড়লোকদের নিয়ম। বড়লোকেরা রাতের বেলা হেভি খায়, ডিনার করে, সকালে কিছু খায় না। তুমি ডায়নার নাম শুনেছ?

ডায়না, কেডা?

আরে বিলাতের রাজার বেটার বউ। রাজবধূ। উনি সকালে কিছু খেতেন না।

আপনে একটা বিয়া করেন। একটা বউ আনেন। আপনের বউ তখন সব সামলাইব। আপনে দিনের পর দিন না খায়া থাকেন, এইটা আমার ভালো লাগে না। আমি সইতে পারি না।

আমি না খেয়ে থাকি আপনাকে কে বলেছে। একদমই ঠিক বললে না বুয়া। আমি ডায়েট করি। নিজেকে স্লিম রাখতে হবে। মোটা হওয়া মানে সর্বনাশ। আপনাকে কেউ পছন্দ করবে না। ডায়াবেটিস হবে। ব্লাডপ্রেসার হবে।

এখন খিদেয় পেটটা মোচড় দিচ্ছে। হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড শূন্য পাকস্থলীতে গড়াচ্ছে। খাবার না পেয়ে অ্যাসিডের বলকানি পাকস্থলীর মাংসই হজম করতে শুরু করে দিয়েছে। একটা অ্যান্টাসিড খেয়ে নিলেই চলবে। আর এক গেলাস পানি। এক টাকার ওষুধে চল্লিশ টাকার ভাতের কাজ হয়ে যায়। তারপর গরম পানি ফুটিয়ে দুধ-চিনি ছাড়াই এক কাপ চা। তাহলে আজ দুটো পর্যন্ত আর খাবারের চিন্তা থাকে না।

বুয়া এসে গেছে। চিলেকোঠার এককোণে একটা মেকশিফট রান্নাঘর। বাথরুমও আছে একটা। আর আছে একটা ছাদ। এই ছাদে মামুনের নিজেকে রাজা বলে মনে হয়। ছাদটা তার রাজ্য। এইখানে অবশ্য কোনো পাত্রমিত্র অমাত্য নাই। স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা-পড়া সিঁড়ি। কাপড়-চোপড় শুকুতে দিতেও কেউ ওঠে না এই ছাদে। চারদিকে বড় বড় বাড়ি উঠে গেছে। এই দোতলা বাড়িটা পড়ে গেছে মধ্যখানে। ইঁদুর মরে পড়ে থাকা গলি পেরিয়ে নর্দমা মাড়িয়ে এই বাড়িতে ঢুকতে হয়। ভাড়া কম, তবু তিন মাস বাকি পড়ে আছে, মাঝেমধ্যে বাড়িওয়ালি খালাম্মা আসেন, ভাড়া চাইতে মামুন তাকে 888sport app download apk শোনায়।

খালাম্মা, আপনার নাম কী?

কেউ তো কোনোদিন আমার নাম জিগাই নাই বাবা। তুমি জিগাও ক্যান?

বলেন না।

সবাই বলে নূরির মা।

না, না, নূরির মা না। আপনি আপনার নাম বলেন।

আমার নাম জরিনা।

শোনেন। আপনাকে নিয়ে 888sport app download apk বানাই। শোনেন।

 

নামটি তাহার জরিনা

তিনি কিন্তু পরী না

কিন্তু পরীর মতোন রূপ

তাকে দেখে সবাই চুপ।

কাছের তিনি, দূরের না।

সবাই ডাকে, নূরির মা।

 

কেমন হলো খালাম্মা 888sport app download apkটা?

খালাম্মা তখন বলেন, দুপুরে কী খাইবা? রান্নাবান্না হইছে কিছু।

আরে খালাম্মা, দুপুরের খাওয়ার কথা আপনে এখন               জিগান কেন। কেবল বাজে আড়াইটা। চারটার আগে                    দুপুর হয়?

খালাম্মা নিচ থেকে একটা বড় প্লেটে ভাত আর তরকারি সাজিয়ে নিয়ে আসেন। শোনো, আইজকা তরকারি ভালো না। খাও। আর তিন মাসের ভাড়া বাকি। দিবা কবে?

কিছু টাকা ধার দিয়া যান খালাম্মা। তিনটা নতুন গান লিখছি। সুর হয়ে গেছে। টাকা পেয়ে যাব। পেলেই আপনাকে দিয়ে দিব। একদম চিন্তা করবেন না।

বুয়া এসে দরজায় কড়া নাড়েন, রাইতে কিছু খান নাই। অহন উঠেন। রুটি খান। আটা নিয়া আইছি দোকান থাইকা। আমার নামে বাকি আনছি। আপনের নামে তো আর দিত না।

মামুন বলে, বুয়া, আমি তো এখন রুটি খাব না। ঘুমাব। দেখছেন না কী রকম বৃষ্টি হচ্ছে। আজ আমার ঘুমানোর দিন।

দরজা খোলেন। নাশতাটা খায়া তারপর ঘুম দেন। আরে আমি বৃষ্টিতে ভিইজা যাইতাছি। দরজা খোলেন তো!

মামুন ওঠে। কবাট খোলে। এক পশলা বৃষ্টি আর বাতাস এসে তাকে ভিজিয়ে দেয়।

চিলেকোঠার ছাদ থেকে দরদরিয়ে পানি ঝরছে। সেই পানিতেই চোখ-মুখ ধুয়ে ফেলে সে।

বুয়ার রুটি থেকে একটা পোড়া গন্ধ বেরুচ্ছে। খিদেটা উথলে উঠল। সে বিছানায় বসলে বুয়া তার সামনে রুটি আর আলুভাজির থালা বাড়িয়ে দেয়।

মামুন খায়।

বুয়া, আপনার নাম কী?

ক্যান? নাম দিয়া কী করবেন?

888sport app download apk বানাব।

আমার কোনো নাম নাই।

আরে সবাই আপনাকে কী বলে ডাকে? অনামিকা?

কী যে কন বুঝি না।

আপনার নাম কী?

বুলির মা।

বুলির মা টা চলবে না। নাম বলেন।

আমার নাম জাহানারা।

 

তাইলে আপনারে নিয়া 888sport app download apkটা হবে এরকম :

নামটি যাহার জাহানারা

দেশ চলে না তাহা ছাড়া

সব কাজ হয় তাহার দ্বারা

রূপটি তাহার নজর কাড়া।

 

বুয়া পান খাওয়া মুখে হাসেন। কী যে কন…

মামুন তার মোবাইল ফোন হাতে নেয়। ও আল্লাহ। ১৩টি মিসড কল।

আবদুল্লাহ মেলামাইনের ম্যানেজার ফোন করেছে… পরে কথা বলা যাবে।

ফোন রেখে সে রুটি খায়। বুয়া, চা হবে নাকি? দুধ-চিনি ছাড়া হলেও চলবে।

বুয়া চা বানিয়ে আনেন।

মামুন আয়েশ করে ফোন দেয়। জি ম্যানেজার সাহেব, বলেন… স্যারের পছন্দ হয়েছে? ভেরি গুড… কিন্তু আপনারা আমার রেট জানেন তো। এক লাখ টাকার কমে কিন্তু আমি কারো আত্মজীবনী লিখি না। জীবনী লিখলে পঞ্চাশ, কিন্তু আত্মজীবনী এক লাখ… দেখেন। সস্তায় চাইলে অন্য কোনো লেখকের কাছে যান। ভাত ছিটালে এই শহরে অনেক কাক পাবেন। কবি পাবেন। কিন্তু মামুন আর রাশীদকে পাবেন না।

বুয়া হা হয়ে শোনেন।

মামুন ফোন রেখে দেয়।

বুয়া বলে, আপনে আমারে শুনায় শুনায় বানায়া কথা কন। তাই না?

কোন কথা?

ওই যে ফুনে কইলেন এক লাখ টাকা পাইবেন।

না বুয়া। আমি তো মিথ্যা বলি না।

বলেন। রাতে না খাইয়া কন ইচ্ছা কইরা না খায়া থাকি। এখন আমারে নিয়া 888sport app download apk বানাইছেন। আমি হইলাম বুড়ি একটা কাউয়া। আমারে যে সুন্দরী কয়, হে হইল এক নম্বরের             মিথ্যুক।

না বুয়া। আপনে খুব রূপবতী। কবিরা কখনো সত্য কথা বলে না, সেটা ঠিক। আবার কখনো মিথ্যা বলে না, এটাও ঠিক।

বুয়া বলেন, ভাইজান, এক লাখ টাকা পাইলে আপনে একটু ভালা চাউল কিনেন। আপনেরে আমি একটু তিন-চার পদ রাইন্ধা ভালো কইরা খাওয়াইতে চাই। কী খান না খান! আপনের মা যদি শুনে তার পোলা কি খায় না খায় আমারে কী কইব?

আমার মা তো আপনিই বুয়া। আপনি আমারে যা  খাওয়াবেন আমি তাই খাব। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই, দীন দুখিনী মা যে তোদের এর বেশি আর সাধ্য নাই।

বুয়া বলে, ভাইজান, এক লাখ টাকা পাইলে আপনে কি এই বাসায় থাকবেন, না চইলা যাইবেন।

ওই টাকা আমি পাব না বুয়া। ওই টাকা পেতে হলে আমাকে অন্যের আত্মজীবনী লিখতে হবে। জীবনী লিখে দেওয়া যায়। আত্মজীবনী তো অন্যের হয় না। বুঝলেন?

জে না। আমি মুরুক্ষ মানুষ। বুঝি না।

আমি যদি আমার আত্মজীবনী লিখি, সেটা তো কেউ কিনবে না। আজকে কিনবে না। কিন্তু একদিন কিনবে। আমি আগে বড় কবি হয়ে নিই। তারপরে কিনবে বুয়া। বুঝলেন?

না। ভাইজান বুঝি না। তয় আমি চাই আপনে টাকাটা পান।

দোকানে কি অনেক বাকি?

হ। তা তো বাকিই।

তাহলে তো আমাকে কাজটা করতেই হবে বুয়া। কিন্তু তারা আমাকে কিনতে পারবে না। যদি ভাবো কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ…

আমি যাই ভাইজান। বিকাল বেলা আসুম নে।

আচ্ছা যান। আমাকে এখন 888sport app download apkয় পেয়েছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি এখন 888sport app download apk লিখব… আমার লাইন আসছে… 888sport app download apkর লাইন…

মামুন 888sport app download apk লেখার জন্য নিউজপ্রিন্টের খাতাটা টেনে নেয়। বৃষ্টিতে ভিজে পুরো খাতাটা নরম হয়ে আছে। বলপেন বসানো মাত্র পাতা ছিঁড়ে যাবে…

আবার রিং বাজে। আবদুল্লাহ মেলামাইনের ম্যানেজার…

মামুন তার ফোন ধরবে না। বরং সে এখন 888sport app download apk লিখবে। কাগজ নাই। তাতে কী। সে মোবাইলে এসএমএস করে করে 888sport app download apk লিখবে।

সে বুঁদ হয়ে যায় 888sport app download apkয়। সময় পেরিয়ে যায়।

আবদুল্লাহ মেলামাইনের ম্যানেজার তাকে এসএমএস পাঠায়, আজকের মধ্যে বলেন, ৭৫ হাজারে পারবেন কিনা। তা না হলে আমরা অন্য রাইটার দেখব।

মামুন সেই এসএমএসের জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করে না।

 

সে ছাদে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ায়। বৃষ্টি হচ্ছে। সে বৃষ্টিতে ভিজবে। এসো করো স্নান নবধারাজলে। সে বৃষ্টিজলে স্নান করবে।

একটু পরে তার হুঁশ হয়। মোবাইল ফোনটা পরনের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের পকেটে রয়ে গেছে। ভিজে জবজবে।

সে ঘরে আসে। ফোনটা বের করে। পুরাটাই নষ্ট। সস্তা সেট। আরেকটা কিনে নিতে হবে। কিন্তু তার 888sport app download apkটা বোধহয় হারিয়ে গেল। মেসেজের ড্রাফটে আছে তার 888sport app download apkর লাইনগুলো। সেসব যদি আর ওপেন না হয় আর কোনোদিন কি সে এই লাইনগুলো লিখতে পারবে? লাইনগুলো সে বানিয়ে লেখেনি, কেমন ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় লিখে ফেলেছিল।

 

ফোনের দোকানে যেতে হয়। তারা তাকে ফোনটা চালু করে দেয়। তবে সব নম্বর হারিয়ে গেছে। সব এসএমএস বার্তাও।

বুয়া আসেন সন্ধ্যায়। মামুনের সঙ্গে তার দেখা হয় না। দেখা হয় পরদিন সকালবেলা। বুয়া বলেন, ভাইজান, আপনের লাখ টাকার কী হইল?

ও হো বুয়া, ভালো কথা মনে করেছেন। আবদুল্লাহ মেলামাইনের নম্বরও তো মুছে গেছে। বাদ দেন। নম্বর জোগাড় করা যাবে। কিন্তু আমার 888sport app download apkর লাইনগুলো যে হারিয়ে গেল, তা আর কোনোদিনও ফিরে পাব না বুয়া। মনটা তাই খুব খারাপ। খুব…

লাখ টাকা আর পাইবেন না?

888sport app download apkগুলো আর পাব না বুয়া… ভীষণ লস… খুব বড় ক্ষতি… অনেক বড়…

বুয়া মামুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। উসকো-খুসকো চুল। গনগনে চোখ। গালভরা দাড়ি… তার দৃষ্টি অন্য কোনো পৃথিবীতে…