আবুল আহসান চৌধুরী
উনিশ শতকে বাঙালি সমাজ যে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও বিকাশের সুযোগ লাভ করে তার তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। যদিও এই নতুন চেতনার পরিধি ছিল মূলত নাগরিক-জীবনে সীমাবদ্ধ, তবু কিছু বিলম্বে হলেও ইংরেজি শিক্ষা ও প্রতীচ্য জ্ঞান-888sport apkচর্চা, স্বাজাত্যবোধ ও স্বদেশচিন্তা, সমাজ-সংস্কার ও সমাজ-উন্নয়ন প্রচেষ্টা, 888sport live football-সংস্কৃতির চর্চা এবং সংবাদ-সাময়িকপত্রের প্রকাশনা – নবচেতনার এসব চিন্তা ও কর্মের হাওয়া এসে লেগেছিল নিস্তরঙ্গ মফস্সলে – এমনকি গ্রামদেশেও। এই পটভূমিতেই ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ শুনতে পেয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-৯৬)। বলা চলে, হরিনাথ ছিলেন উনিশ শতকের গ্রামীণ বুদ্ধিজীবীদের প্রধান প্রতিনিধি।
দুই
কাঙাল হরিনাথের জীবন নাটকীয় বিন্যাসে রচিত। তিনি বিত্ত, বিদ্যা কিংবা কৌলীন্য কোনোটারই অধিকারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন গ্রামীণ মফস্সলের অধিবাসী, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নিরিখে প্রায়-অশিক্ষিত, ধন-বিত্তের বিচারে নিতান্ত হতদরিদ্র এবং বংশ-কৌলীন্যের গৌরব-বঞ্চিত। কিন্তু তিনি এসব সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজেকে সমকালীন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন লোককল্যাণবোধে প্রবল প্রতিজ্ঞা এবং তা রূপায়ণে সাহসী নির্ভীক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে।
হরিনাথ সেসব বিরল মানুষের অন্যতম, যাঁরা নিজের ভাগ্যকে গড়ে তুলেছেন আপন চেষ্টায় এবং নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জনকল্যাণের মহান ব্রতে। মেধা ও মনোবল, নিষ্ঠা ও সততা, মানবপ্রীতি ও স্বদেশানুরাগ, সৎ অভিপ্রায় ও স্থির লক্ষ্য থাকলে একজন মানুষ প্রতিকূল পরিবেশেও যে তাঁর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন, কাঙাল হরিনাথ তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
তিন
কাঙাল হরিনাথ কুমারখালীর মতো এক নিভৃত পলিস্নতে বসে সংস্কৃতিচর্চা ও লোককল্যাণের যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন, তা ব্যতিক্রমধর্মী ও বিস্ময়কর ঘটনা। এর সমতুল্য দৃষ্টান্ত নির্দেশ অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। এই বহুমাত্রিক লোকোত্তর ব্যক্তি একাধারে ছিলেন 888sport live football888sport live chatী,
সংবাদ-সাময়িকপত্র পরিচালক, শিক্ষাব্রতী, সমাজ-সংস্কারক, 888sport promo codeকল্যাণকামী, দেশহিতৈষী, রায়ত-কৃষকপ্রেমী, সাধক ও ধর্মবেত্তা এবং নব্য-888sport live footballসেবীদের উদার পৃষ্ঠপোষক। মূলত তাঁর জীবনের আদর্শ ও কর্ম বিভক্ত হয়ে গেছে 888sport live football-সংস্কৃতিচর্চা, জনহিতৈষণা ও ধর্মসাধনা – এই তিন ধারায়।
চার
হরিনাথের অন্যতম পরিচয় 888sport live footballসেবী হিসেবে। তবে বিশুদ্ধ 888sport live footballচর্চার উদ্দেশ্যে নয়, হরিনাথ ‘সুনীতি’, ‘ধর্মভাব’ ও ‘লোকশিক্ষা’র প্রয়োজনেই লেখনী ধারণ করেন। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে তাঁর রচনা এক অর্থে লোকশিক্ষারই বাহন। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে হরিনাথ প্রায় চলিস্নশখানা গ্রন্থ রচনা করেন। অবশ্য এর মধ্যে সবই যে বই-আকারে প্রকাশিত হয়েছিল তা নয়। হরিনাথের রচনাবলিকে নীতিশিক্ষামূলক শিশুপাঠ্য, ধর্মকথার বিনোদন 888sport live chatরূপ, ধর্মশাস্ত্র ও সাধনতত্ত্বের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সামাজিক চিন্তামূলক এবং 888sport live football-রসাশ্রিত – এই কয় শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা চলে। আখ্যান বিজয়-বসন্তের লেখক ও পত্রিকা গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার সম্পাদক পরিচয়ের বাইরে কাঙাল হরিনাথ বাঙালিসমাজে মূলত মরমিভাবের বাউলগানের রচয়িতা হিসেবেই পরিচিত।
পাঁচ
মরমিগানের সঙ্গে কাঙাল হরিনাথের সম্পর্ক অতি নিবিড়। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘শখের বাউল’ হিসেবে তাঁর আবির্ভাব হলেও শেষ পর্যন্ত এই বাউলগানের সূত্রেই হরিনাথ তাঁর সাধন-অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন এবং তাঁর 888sport live chat-শক্তির যথার্থ পরিচয়ও এর মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর লোকপ্রিয়তা ও পরিচিতির মূলেও রয়েছে এই বাউলসংগীত। তাঁর জীবনদর্শন, অধ্যাত্মভাবনা ও মরমি-মানসের পরিচয় বিধৃত রয়েছে এসব গানে। এ-প্রসঙ্গে জলধর সেন লিখেছেন :
কাঙাল হরিনাথ, পূবর্ববঙ্গের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার নিকটে তাঁহার বাউলসঙ্গীতের দ্বারাই অসামান্য লোক বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। এই বাউলসঙ্গীতের সহজ সরল প্রাণস্পর্শী কথায় শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবর্বশ্রেণীর লোকই মুগ্ধ হইতেন। অল্পদিনের মধ্যে বাউলসঙ্গীতের মধুর উদাস সুর হাটে, ঘাটে, মাঠে, নৌকাপথে সবর্বত্রই শ্রম্নত হইত।১
হরিনাথ বাউলগানের একটি ভিন্ন ‘ঘরানা’ সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি ‘কাঙাল’ ও ‘ফিকিরচাঁদ’ ভণিতায় পরমার্থসূচক যেসব বাউলাঙ্গের মরমিগান রচনা করেন তার 888sport free bet প্রায় হাজারের কোঠায়। তাঁর এই বাউলসংগীতের স্বরূপ ও জনমনে তার প্রভাব সম্পর্কে জানা যায় :
অনেক সঙ্গীতে সংসারের অনেক সুখদুঃখের কথা ধ্বনিত হইয়াছে বটে, কিন্তু কাঙ্গাল হরিনাথের বাউলসঙ্গীতে হৃদয়ের মধ্যে যেমন সংসারের অনিত্যতা, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রেমভাব জাগাইয়া তুলে, এমন আর কিছুতেই নহে। রূপের গর্ব, ঐশ্বর্যের অভিমান, বাসনার আসক্তি হইতে মানুষ আপনাকে যদি নির্মুক্ত করিতে চাহে, তাহা হইলে তার পক্ষে হরিনাথের সঙ্গীত এক অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্র-স্বরূপ। 888sport app, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, রাজশাহী, রঙ্গপুর প্রভৃতি জেলার অনেক লোকই কাঙ্গাল হরিনাথের এই সকল সাধন সঙ্গীত শ্রবণে মনে করিতেন হরিনাথ দেবতা। উপলক্ষে উপলক্ষে কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ যখন যে স্থানে গমন করিয়াছেন, তখনই সেই স্থান হরিনাথের বাউলসঙ্গীতের পবিত্র স্রোতে পস্নাবিত হইয়া গিয়াছে।২ বাংলা ১২৮৭ সালে ফিকিরচাঁদ ফকিরের বাউলগানের দল গঠিত হয়। এই দলকে লোকে রসিকতা করে ‘ভূতের দল’ও বলত। কাঙাল হরিনাথের এই দল-গঠন ও বাউলগান রচনার প্রেরণা এসেছিল বাউলসাধক লালন ফকিরের (১৭৭৪-১৮৯০) কাছ থেকে। উনিশ শতকের এই দুই গ্রামীণ এলিট – লালন ও কাঙালের মধ্যে যে সখ্য-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা ছিল কীর্তিময় এবং সহমর্মিতা ও মৈত্রীর স্মারক। লালন-আবিষ্কারে হরিনাথের ভূমিকা যেমন পথিকৃতের, তেমনই হরিনাথের অন্তর্জগতের পরিবর্তন, মরমি-ভাবনায় সমর্পণ ও সেই সূত্রে বাউলগান রচনার মূলে রয়েছে লালন সাঁইয়ের একান্ত প্রভাব। একদিকে লালন যেমন হরিনাথের মনে মরমিভাব ও অধ্যাত্মচেতনার বীজ বপন করেছিলেন, অপরদিকে কাঙালের বিপন্ন সময়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে লালন আন্তরিক বন্ধুকৃত্য ও সামাজিক কর্তব্যও পালন করেছিলেন। পথ ও পন্থা ভিন্ন হলেও উভয়েই ছিলেন পার্থিব-আকাঙক্ষামুক্ত মানব-মিলনপ্রয়াসী লোকায়ত সাধনপথের মরমি-পথিক। এক্ষেত্রে দুজনেরই ‘অমোঘ অস্ত্র’ ছিল তাঁদের গান – সে-গান কেবল দেহতত্ত্বের নয়, মানবতন্ত্রের ও জীবনসত্যের অনুষঙ্গে ভাবসাধনারও গান। লালনের সঙ্গে কাঙালের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সেই অন্তরঙ্গতার সূত্রেই লালন মাঝেমধ্যে কুমারখালীতে কাঙাল-কুটিরে আসতেন। অপরদিকে কাঙালও গিয়ে আসর জমাতেন ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়ায়। কাঙাল তাঁর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জমিদারের প্রজা-পীড়নের সংবাদ প্রকাশ করে বিপন্ন হন। তাঁর সেই দুঃসময়ে লালন ফকির শিষ্য-শাবকদের সঙ্গে নিয়ে আক্রান্ত কাঙালের পাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করেন। সেই লালন একদিন কাঙাল-কুটিরে এসে তাঁর মরমি বাউলসংগীত পরিবেশন করলে হরিনাথের শিষ্যদের মনে তা গভীর দাগ কাটে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র প্রস্তাব-মতো একটি বাউলের দল গঠনের চিন্তা সকলকে প্রাণিত করে। ফলে সঙ্গে-সঙ্গেই ‘ফিকিরচাঁদ’ ভণিতা দিয়ে গান রচিত হয় – ‘ভাব মন দিবানিশি, অবিনাশী সত্য-পথের সেই ভাবনা’। গ্রামবার্ত্তার সহযোগী ও ছাপাখানার কর্মীদের এই অভিনব ‘ফিকির’ হরিনাথের সাগ্রহ অনুমোদনই শুধু লাভ করল না, কাঙাল স্বয়ং তক্ষনি গান রচনায় উদ্যোগী হলেন। ‘আমি কোরব এ রাখালী কতকাল।/ পালের ছটা গরু, ছুটে কোরছে আমায় হাল-বেহাল’ – এই হলো কাঙাল-রচিত প্রথম গান। এরপর হরিনাথের মনে গানের জোয়ার এলো, একের পর এক রচিত হতে লাগল মনোহর সব বাউলগান।
‘ফিকিরচাঁদের দল’ ও বাউলগান রচনার ফলাফল সম্পর্কে হরিনাথ তাঁর দিনলিপিতে উল্লেখ করেছেন :
শ্রীমান অক্ষয় ও শ্রীমান প্রফুল্লের গানগুলির মধ্যে আমি যে মাধুর্য পাইলাম, তাহাতে স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, এইভাবে সত্য, জ্ঞান ও প্রেম-সাধনতত্ত্ব প্রচার করিলে, পৃথিবীর কিঞ্চিৎ সেবা হইতে পারে। অতএব কতিপয় গান রচনার দ্বারা তাহার স্রোত সত্য, জ্ঞান ও প্রেম-সাধনের উপায়স্বরূপ পরমার্থপথে ফিরাইয়া
আনিলাম এবং ফিকিরচাঁদের আগে ‘কাঙ্গাল’ নাম দিয়া দলের নাম ‘কাঙ্গাল-ফিকিরচাঁদ’ রাখিয়া তদনুসারেই গীতাবলীর নাম করিলাম।… অল্পদিনের মধ্যেই কাঙ্গাল-ফিকিরচাঁদের গান নিমণশ্রেণী হইতে উচ্চশ্রেণীর লোকের আনন্দকর হইয়া উঠিল। মাঠের চাষা, ঘাটের নেয়ে, পথের মুটে, বাজারের দোকানদার এবং তাহার উপর শ্রেণীর সকলেই প্রার্থনা সহকারে ডাকিয়া কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদের গান শুনিতে লাগিলেন।৩
ফিকিরচাঁদের গানে মানুষের মনে ভাবের বান ডাকল। এ-গানের সুর ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে শহরে, প্রান্তর থেকে জনপদে। নৌকার মাঝি, মাঠের কৃষক, প্রান্তরের রাখাল, মসিজীবী মধ্যশ্রেণি সকলকেই অধিকার করল এই গান। ক্রমে এর সঙ্গে যুক্ত হলেন বিষাদ-সিন্ধুর লেখক মীর মশাররফ হোসেন। ‘মশা’ ভণিতায় রচনা করলেন বাউলাঙ্গের অনেক গান। ব্রহ্মজ্ঞানী সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে গভীরভাবে স্পর্শ করল কাঙালের গান। এই গান তাঁর অন্তর্জীবনে আনল এক বিরাট পরিবর্তন। ব্রাহ্মসমাজের প্রচারের কাজে এই গান হয়ে উঠল এক শক্তিশালী বাহন। এই বিস্ময়কর ভাববিপস্নবের কথা 888sport app download for android করে জলধর সেন বলেছেন :
কে জানিত যে, আমাদের অবসর সময়ের খেয়াল হইতে যে সামান্য গানটি বাহির হইয়াছিল, তাহার তেজ এক অধিক! কে জানিত যে, এই কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদের সঙ্গীতে সমস্ত পূবর্ববঙ্গ, মধ্যবঙ্গ, উত্তরবঙ্গ এবং আসাম প্রদেশ ভাসিয়া যাইবে। কে জানিত যে, সামান্য বীজ হইতে এমন প্রকা- বৃক্ষ জন্মিবে! প্রিয়তম অক্ষয়কুমার সত্যসত্যই বলিয়াছেন যে, ‘এমন যে হইবে তাহা ভাবি নাই। এমন করিয়া যে দেশের জনসাধারণের হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত করা যায়, তাহা জানিতাম না।’৪
হরিনাথের বাউলগান সমাজ-মানসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর গানের প্রেরণা ও প্রভাব সমকাল ও উত্তরকালের সংগীত-রচয়িতারা অস্বীকার করতে পারেননি। ‘ফিকিরচাঁদে’র দলভুক্তদের ওপর কাঙালের গানের প্রভাব অনেকটা অনিবার্যভাবেই পড়েছে। মীর মশাররফ হোসেন মূলত কাঙালের প্রেরণাতেই সংগীত রচনায় হাত দেন এবং ফিকিরচাঁদের দলের একজন সৃষ্টিশীল সদস্য হিসেবে গণ্য হন। তাঁর রচিত বাউলগানের কিছু-কিছু লহরী (১৮৮৭) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবি দাদ আলী কাঙাল হরিনাথের প্রভাবে কিছু বাউলাঙ্গের গান রচনা করেন। তাঁর আশেকে রাসুল (প্রথম খ-, ১৯৭০) গ্রন্থে ‘ফিকিরচাঁদের স্বরে রচিত গজল’ নামে কয়েকটি গান সংকলিত হয়েছে, যা হরিনাথের প্রেরণা ও প্রভাবের কথা 888sport app download for android করিয়ে দেয়।৫ তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব রচিত গানেও কাঙালের প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের
ভক্তি-আশ্রিত সংগীত-রচনার অন্যতম প্রেরণাও যে কাঙাল হরিনাথ, সে-সম্পর্কে ড. সুকুমার সেনের মন্তব্য :
ইনি [রজনীকান্ত] ভক্তিরসের গানের প্রেরণা পাইয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান এবং কাঙাল হরিনাথের বাউলগান হইতে।… রজনীকান্তের কোন কোন গানে ‘কান্ত’ ভণিতা দেখা যায়। এই ভণিতা দেওয়ার রীতি হরিনাথের রচনাসূত্রে পাওয়া।৬
শুধু তাই নয়, কাঙালের বাউলগান রবীন্দ্রনাথকেও স্পর্শ করেছিল বলে জানা যায়।৭
হরিনাথের ফিকিরচাঁদের দলের অনুসরণে কুমারখালী ও আশপাশ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি সংগীতদলের আবির্ভাব হয়। মীর মশাররফ হোসেন জানিয়েছেন :
নদীয়া জিলার অমত্মঃপাতী কুমারখালীতে ফিকিরচাঁদ ফকীরের আবির্ভাব হয়। দেখাদেখি, আজবচাঁদ, রসিকচাঁদ দেখা দেন।৮
অন্যত্রও এই সংগীতদল সম্পর্কে উল্লেখ মেলে :
… এবার ঝুলনে ফিকিরচাঁদ একদিন গরিবচাঁদ একদিন এবং ঘাসখাল হইতে লালনচন্দ্র চক্রবর্তীর আজবচাঁদের দল একদিন ৩ দিন গান হইল।৯
হরিনাথের ফিকিরচাঁদের দলের সাফল্যের প্রেরণায় বিভিন্ন ‘চাঁদে’র দলের গানে-গানে গ্রামাঞ্চল মেতে ওঠে। এর
সমকালীন-সাক্ষ্য মেলে কুমারখালীর প্রাণকৃষ্ণ অধিকারীর বর্ণনায় :
ক্রমে ১২৯০ সাল আসিল এই সময় কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ফিকিরচাঁদ ফকিরের গানের বড়ই ধূম, গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই গান শুনিবার জন্য পাগল। প্রথমে যখন গান বাহির হইল তখন সকলের বাড়ী বাড়ী গান গাহিয়া যাইতে লাগিল, খেলকা, চুল দাড়ি, টুপী ব্যবহার [করিত] এবং কাহার কাহার পায়ে নেপুরও থাকিত, বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ডুগি, খোমক, খুঞ্জুরি, একতারা প্রভৃতি ফকিরের সাজে তাহারা বাহির হইত পরে নিয়ম করিল যাহার বাড়ী গান হইবে তিনি একখানা নিমন্ত্রণপত্র দিলেই তাহারা আসিয়া গান গাহিয়া যাইবে। ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল দেখিয়া শেষে গ্রামে গ্রামে অনেক দল সৃষ্টি হইল। কোনও স্থানে দুই দলে পালস্নাও হইত। আমিও ঐ দেখাদেখি কতকগুলি বালক লইয়া বালকচাঁদের দল করিলাম। সেই সময় আকাশে পূবর্ব-দক্ষিণ কোণে ভয়ানক একটি ধুমকেতু উঠে তাহার প্রকা- লেজ দেখিতে আশ্চর্য্যজনক। রাত্রি এগারটার সময় উঠিত। এলঙ্গী গ্রামের প্রসন্নচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে ফিকিরচাঁদের দলে ছিলেন গানও প্রস্ত্তত করিতেন। কোন এক বিষয় লইয়া প্রফুলস্নচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সহিত মনমালিন্য হওয়ায় ঐ দল ত্যাগ করিয়া লোহারাম প্রামাণীকের সঙ্গে যোগ দিয়া তিনি গরিবচাঁদের ভণিতা দিয়া দল সৃষ্টি করিলেন। ফিকিরচাঁদে ও গরিবচাঁদে দুই দলে খুব পালস্না বাধিত তাহা শুনিতে অত্যন্ত আমোদজনক হইত। ইহাদের বিছানা লাগিত না পানতামাক লাগিত না কেবল একখানা নিমন্ত্রণপত্র পাইলেই সন্তুষ্ট যিনি পত্র দিতেন তাহার বাড়ীই গান হইত, জাতিবিচার ছিল না।১০
ছয়
কাঙাল হরিনাথের বাউলগান তাঁর সমকালে সমগ্র 888sport appsকে আলোড়িত করতে সমর্থ হয়েছিল। কাঙালের গান জনচিত্তে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। জলধর সেনের সাক্ষক্ষ্য জানা যায়, বাংলার অবি888sport app download for androidীয় লোকসংগীত-প্রতিভা পাগলা কানাইয়ের গানের পাশাপাশি কাঙালের গানও স্থান করে নিতে পেরেছিল। এই সাফল্য যে অসামান্য তা বলা বাহুল্য। কাঙাল হরিনাথ ‘পূবর্ববঙ্গের প্রধান সঙ্গীত কার বলিয়া প্রসিদ্ধ’ – দুর্গাদাস লাহিড়ীর এই মন্তব্য যথার্থই সত্যমূল্যে সম্মানিত।১১ ফিকিরচাঁদের সংগীতে কেবল যে বাউলগানই ছিল তা নয়, এতে ‘সামাজিক, আধ্যাত্মিক, সাময়িক’ গানও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কাঙালের মৃত্যুর পর ফিকিরচাঁদের দল নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ায় ক্রমে বিলুপ্ত হয় এবং তাঁর গানের প্রচারও কমে আসে। কাঙাল-রচিত গানের সঠিক 888sport free bet জানা যায় না। অনুমান করা চলে, তা প্রায় হাজারের কাছাকাছি হবে। তাঁর
কাঙাল-ফিকিচাঁদ ফকীরের গীতাবলী ও কাঙাল-ফিকিরচাঁদ ফকীরের বাউল সঙ্গীত গ্রন্থে কয়েকশো গান পাওয়া যায়। কাঙালের 888sport app গ্রন্থেও (ব্রহ্মা-বেদ, মাতৃমহিমা ইত্যাদি) তাঁর অনেক গান মুদ্রিত হয়েছে। এসব গ্রন্থে, বিশেষ করে ব্রহ্মা-বেদে ধর্মীয় ও সাধনতত্ত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্যে গানগুলি ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু
সংগীত-সংগ্রহ পুস্তকেও, যেমন নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়-সংকলিত সঙ্গীত মুক্তাবলী (১৮৮৭?), দুর্গাদাস লাহিড়ী-সংকলিত বাঙ্গালীর গান (১৩১২) ইত্যাদিতে কাঙালের গান সংকলিত হয়েছে। কাঙালের নিজের হাতে-লেখা কয়েকশো গানের পান্ডুলিপি কুমারখালী
কাঙাল-কুটিরে সংরক্ষিত আছে।
জীবিতকালেই হরিনাথের পদাবলি-সংগ্রহ তাঁর নিজের ছাপাখানা ‘কুমারখালী মথুরানাথ যন্ত্রে শ্রীপ্রফুলস্নচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত’ হয়। সম্ভবত বারো খ– এই কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ ফকীরের গীতাবলী প্রকাশ পেয়েছিল। প্রতি খ–র মূল্য ছিল এক আনা। এর তৃতীয় খ- চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১২৯১ (১৮৮৪) সালে। তারপর গানগুলি ফিকিরচাঁদের বাউল সঙ্গীত নামে কলকাতা থেকে ১০ খ– প্রকাশ পায় মে ১৮৮৫ সালে, প্রকাশক ও মুদ্রাকর ছিলেন ২ তারক চ্যাটার্জি লেনের উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য – গ্রন্থস্বত্বও ছিল তাঁর। প্রতি খ–র পৃষ্ঠা-888sport free bet ১২ ও মূল্য ছিল এক আনা। হরিনাথের মৃত্যুর পর তাঁর গানের সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন প্রথমত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সতীশচন্দ্র মজুমদার ও পরে তাঁর 888sport live footballশিষ্য সাংবাদিক-888sport live footballিক জলধর সেন (কাঙ্গাল-ফিকিরচাঁদের বাউল সঙ্গীত- : গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়
অ্যান্ড সন্স, কলিকাতা, ভাদ্র ১৩২৩)। সতীশচন্দ্র মজুমদার কাঙ্গাল-ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী নামে গীত-সংকলন প্রকাশ করেন আষাঢ় ১৩০৮ সালে। মোট ১৬ খ– বিভক্ত আট আনা মূল্যের এই ‘গীতাবলী’ কুমারখালী ‘মথুরানাথ যন্ত্রে শ্রীকুঞ্জলাল দাস দ্বারা মুদ্রিত’ হয়। এসব বই আজ বড় দুষ্প্রাপ্য।
সাত
কাঙালের গানে জীবনের অনিত্যতা, সংসারের মায়া-মোহ, পরমপুরুষের সন্ধান-তৃষ্ণা, দেহ-বিচার ও সাধন-প্রক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে অনিবার্যভাবেই নানা রূপক-প্রতীকের আড়াল মানতে হয়েছে, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের অলংকারে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হয়েছে তত্ত্বকথাকে। তত্ত্বসংগীতের বিষয়-প্রসঙ্গের ক্লান্তিকর অনুবর্তন, তাত্ত্বিক জটিলতা ও সাধন-পদ্ধতির সাংকেতিক দুরূহতা থেকে যদিও কাঙালের গানও মুক্ত নয়, তবু কখনো-কখনো এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাতে 888sport live chat-সৌন্দর্য আবিষ্কার করা চলে।
যেমন :
অরূপের রূপের ফাঁদে, পড়ে কাঁদে, প্রাণ আমার দিবানিশি।
কাঁদলে নির্জনে বসে, আপনি এসে, দেখা দেয় সে রূপরাশি;
সে যে কি অতুল্য রূপ, নয় অনুরূপ, শত সূর্য্য শশী \
যদি রে চাই আকাশে, মেঘের পাশে, সে রূপ আবার বেড়ায় ভাসি, আবার রে তারায় তারায়, ঘুরে বেড়ায়, ঝলক লাগে হৃদে আসি\আবার পরমপ্রিয়ের সন্ধান-ব্যাকুলতার প্রকাশও 888sport live chat-সন্ধানীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে :
আমারে পাগল করে যে জন পালায়, কোথা গেলে পাব তাঁয়।
তাঁরে না হেরে প্রাণ কেমন করে, হিয়া আমার ফেটে যে যায় \তত্ত্ব-কথা আর 888sport live chatের সহাবস্থান প্রকাশিত নিচের এই গানে :
শূন্যভরে একটি কমল আছে কি সুন্দর।
নাই তার জলে গোড়া, আকাশ-জোড়া সমান ভাবে নিরন্তর \প্রসঙ্গ ও প্রকরণে তাঁর কোনো-কোনো গান গীতি888sport app download apkর স্তরে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। যেমন এই ‘নদীর গান’টি :
নদী বল্ রে বল্ আমায় বল্ রে।
কে তোরে ঢালিয়া দিল এমন শীতল জল রে \
পাষাণে জন্ম নিলে, ধরলে নাম হিমশিলে,
কার প্রেমে গ’লে আবার হইলে তরল রে।
(ওরে) যে নামেতে তুমি গ’ল, সেই নাম একবার আমায় বল,
দেখি গ’লে কিনা আমার কঠিন হৃদিস্থল রে \
কার ভাবে ধীরে ধীরে, গান কর গভীর স্বরে,
প্রাণমন হরে কিবা শব্দ কল কল রে;
নদীরে তোর ভাবাবেশে, যখন রে বক্ষঃস্থল ভেসে
তখনই বর্ষা এসে ভাসায় ধরাতল রে \
নিরন্তর অনুশীলনের মাধ্যমে কাঙাল বাউলগানের একটি স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর অনুপ্রেরণাও এসেছিল লালন ফকিরের কাছ থেকে। জনশ্রম্নতি আছে, কাঙাল একবার লালন ফকিরকে তাঁর রচিত গান শুনিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে লালন জবাব দিয়েছিলেন, ‘তোমার এ ব্যঞ্জন বেশ হইয়াছে, তবে নুনে কিছু কম আছে’ (অর্থাৎ ভাষা কিঞ্চিৎ নীরস হইয়াছে)…।’১২ চর্চা ও অনুশীলনের ফলে কাঙালের গানের ভাষা পরবর্তীকালে সরস ও মার্জিত হয়ে উঠেছিল। হরিনাথ বাউলগানের প্রচলিত ধারায় একটি মাত্রা যুক্ত করে তাকে শিক্ষিত নাগরিক সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। বাউলগান যে সংগীত-888sport live footballের মর্যাদালাভ করেছে তার জন্যে হরিনাথের অবদানও কম নয়। তাঁর ‘দিন তো গেল, সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে’ – এই গানটি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী live chat 888sportে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘রবীন্দ্রনাথের আগে বাউলগানের – যাহাকে ইংরেজিতে বলে ঠড়মঁব তাহা হরিনাথই সৃষ্টি করিয়াছিলেন’১৩ – ড. সুকুমার সেনের এই মন্তব্য যথার্থ।
আট
বাউলগান রচনায় লালন যে শুধু হরিনাথের প্রেরণাই ছিলেন তা নয়, তার ভাব-ভাষা-ভাবনার একটা প্রভাবও হরিনাথের গানে পড়েছিল। বাউল বা সমানধর্মা মরমিগানের সীমাবদ্ধতা হলো এর বহুল উচ্চারিত তত্ত্বকথা ও গতানুগতিক বিষয়ের অনুবর্তন। তাই পদ-রচনা করতে গিয়ে কাঙাল অনিবার্যভাবেই এই সীমাবদ্ধ
তত্ত্ব-বিষয়ের মধ্যেই আবর্তিত হয়েছেন এবং এ-প্রসঙ্গে পূর্বসূরি ও বাউলসাধনার শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার লালনের প্রভাব তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে। হরিনাথের পারমার্থিক ও জাত-সম্পর্কিত গানে সে-প্রভাব স্পষ্ট। যেমন কাঙালের এই গানটি :
যারা সব জাতের ছেলে, জাত নিয়ে যাক যমের হাতে।
বুঝেছি জাতের ধর্ম, কর্মভোগ কেবল জেতে \
অজাতে জন্ম হোল
মা বাপের নাই জাতকুল
কুলধ্বজ কুলাচার মতে \
এর সঙ্গে সহজেই তুলনীয় লালনের জাত-ধর্ম সম্পর্কিত গানগুলো। যেমন :
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।
লালন বলে জেতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে \
কিংবা এ পদটি :
একবার জগন্নাথে দেখ রে যেয়ে, জাত কেমন রাখ বাঁচিয়ে।
চ-ালে আনিলে অন্ন ব্রাহ্মণে তা-ই লয় খেয়ে \
জাত-বিচার ও স্পর্শ-দোষ সম্পর্কে লালন তাঁর গানে চূড়ান্ত অভিমত পেশ করে বলেছেন :
জাত না গেলে পাইনে হরি
কি ছার জেতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে।
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পুড়াতাম আগুন দিয়ে \
এর সার্থক তুলনা হরিনাথের ‘যারা সব জাতের ছেলে, জাত নিয়ে যাক যমের হাতে’ – এই উক্তি। অন্যত্র কাঙালের গানে পাওয়া যায় :
দিনে দিন যাচ্ছে চলে, রে বিফলে,
মন তুমি চেতন হোলে না
জন্মিয়ে মানবকুলে, কী করিলে,
ভেবে একবার তো দেখলি না;
পাশাপাশি লালনের এই গানটির বিষয়-ভাবের ঐক্য চোখ এড়িয়ে যায় না :
এমন মানবজনম আর কি হবে।
মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে \
কাঙাল হরিনাথের একটি গানে ‘মনের মানুষ’ অন্বেষণের গভীর আকুতি ফুটে উঠেছে :
এখন, আমার মনের মানুষ কোথা পাই।
যার তরে মনোখেদে প্রাণ কাঁদে সর্বদাই \
অনুমান করতে বাধা নেই যে, পরম প্রিয়ের সান্নিধ্যলাভের এই ব্যাকুলতার উৎস হতেই পারে লালনের সমধর্মী কোনো গানের ভাব ও বাণী :
মিলন হবে কতদিনে
আমার মনের মানুষেরই সনে \
লালনের জীবনীকার বসন্তকুমার পাল কাঙাল ও লালনের গানের তুলনামূলক উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর মহাত্মা লালন ফকির গ্রন্থে। এই তুলনায় বাণী ও ভাব উভয় সাদৃশ্যই উঠে এসেছে। লালন আফসোসের সুর চড়িয়ে তাঁর এক গানে বলেছেন :
হীরা লালমতির দোকানে গেলে না।
সবই কিনলি রে তুই পিতল দানা \
চটকে ভুলে রে মন
হারালি তুই অমূল্য রতন
হারলে বাজি কাঁদলে তখন
আর সারবে না \
হরিনাথের গানেও এই একই সুর ধ্বনিত :
ভোলা মন, কী করিতে কী করিলি, সুধা বলে গরল খেলি।
সংসারে সোনার খনি পরশমণি, রতনমণি না চিনিলি,
কী বলে অবহেলে, সোনা ফেলে, আঁচলে কাচ বেঁধে নিলি \
নদী-পালিত 888sport appsে পারাপারের প্রধান বাহন নৌকা। এই নৌকার রূপকে সাধনতত্ত্বের অনেক মনোহর পদ আছে বাংলার মরমি সংগীতের ঝাঁপিতে। এমনই একটি পদে লালনের কাতর উচ্চারণ :
আজ বাতাস বুঝে ভাসা রে তরী।
তেহাটা ত্রিপিণে বড় তোড় তুফান ভারী \
একে আমার অসার কাষ্ঠের না’
তাতে বিষম বদহাওয়া
কুপাকে কুপ্যাঁচে পড়ে জীবনে মরি \
কাঙালেরও এই একই আহাজারি। ভজন-সাধনে হীন বলে পারাপারের শঙ্কা তাঁর মনেও :
ধরে তোল হে আমায় ও দরদি, ভবে ডুবেছি আমি।
গড়ন ভাল পাঁচটা তক্তার
এ যে চৌদ্দ পোয়া নৌকা আমার
এক মাঝি তার দশ বাহনদার
চড়নদার ছিলাম আমি \
সংসারে মোহপাকে
মাঝি ঘুরাইছে পাকে পাকে
আমি না পারি তাকে
ডুবলাম আমি ধরো তুমি \
জীবনসায়াহ্নে সাধকের কাছে পৃথিবীর রং যখন ক্রমশ ধূসর হয়ে আসে, পারাপারের আকাঙক্ষায় যখন তাঁর অন্তর হয় ব্যাকুল, ঠিক তেমনই এক মুহূর্তে দয়ালগুরুর অভয়-শরণ কামনায় একান্ত আত্মনিবেদনের সুর শোনা যায় লালনের কণ্ঠে :
পার করে হে দয়ালচাঁদ আমারে।
ক্ষম হে অপরাধ আমার ভবকারাগারে \
না হলে তোমার কৃপা
সাধনসিদ্ধি কে করিতে পারে।
আমি পাপী তাইতে ডাকি
ভক্তি দাও মোর অন্তরে \
‘ভবপারের কা-ারির অনুগ্রহ প্রাপ্তির আশায়’ ব্যাকুল হরিনাথের কণ্ঠেও অভিন্ন সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে :
ওহে, দিন তো গেল, সন্ধ্যা হ’ল, পার কর আমারে।
তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা, ডাকছি হে তোমারে \
(ওহে দীন দয়াময়)
আমি আগে এসে ঘাটে রইলাম বসে
(ওহে আমায় কি পার করবে না হে, অধম বলে)
যারা পরে এল, আগে গেল, আমি রইলাম পড়ে \
এই রকম লালনের গানের বিষয়-ভাব-উপমা-রূপক-চিত্রকল্প-ভাষাগত সাদৃশ্য কাঙালের আরো অনেক গানে আবিষ্কার সম্ভব। আসলে বাউলগানের শীর্ষ পদকর্তা – বাউলসাধনার শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার লালন ফকিরের প্রভাব অস্বীকার করা সমকাল ও উত্তরকালের বাউল-পদকর্তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। সংগত কারণেই এক্ষেত্রে কাঙাল হরিনাথও তার ব্যতিক্রম নন।
নয়
কাঙাল হরিনাথের বাউলাঙ্গের মরমিগান কি গ্রামীণ কি নাগরিক – উভয় সমাজেই সমাদৃত হয়েছিল। শিক্ষিত-সমাজে তাঁর গানের আসন করে নেওয়ার পেছনে ব্রাহ্মসমাজের একটি বড় ভূমিকা ছিল, তা বেশ অনুমান করা চলে। এই সূত্রেই গ্রামোফোন কোম্পানি সম্ভবত তাঁর রচিত গান রেকর্ড করতে আগ্রহী হয়। গ্রামোফোন রেকর্ডে তাঁর গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯১৪-তে অমলা দাস প্রথম হরিনাথের গান রেকর্ড করেন কলকাতার গ্রামোফোন কনসার্ট কোম্পানির উদ্যোগে – এর এক দিকে ছিল তাঁর ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হলো, পার কর আমারে’ এবং অপর পিঠে ছিল গগন হরকরার বিখ্যাত সেই গান ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’। ১৩৩৯ সালে এইচএমভি থেকে ভবতোষ ভট্টাচার্য কাঙালের ‘হরি দিন তো গেল’ গানটি রেকর্ড করেন। একই 888sport live chatীর কণ্ঠে এইচএমভি থেকে ১৯৪০-এ প্রকাশ পায় হরিনাথের ‘দোকানী ভাই দোকান সার না’। ‘হরি দিন তো গেল’ – এই জনপ্রিয় গানটি বিভিন্ন সময়ে কানন দেবী, উত্তরা দেবী, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায় এবং আরও কেউ-কেউ রেকর্ড করেন। এ-থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, হরিনাথের গান কেবল গ্রামীণ প্রান্তরে নয়, নাগরিক জনপদেও রসিক ও ভাবুকচিত্তকে আপস্নুত ও তৃপ্ত করেছিল।
হরিনাথের অনেক প্রাতিস্বিক গদ্য-পদ্য রচনা থাকলেও তাঁর খ্যাতির ভিত্তিভূমি তাঁর বাউলগান। বাউলগান তাঁকে জনচিত্তের সন্নিকটে পৌঁছে দিয়েছিল। তাই কাঙাল-মানস বিচারে ও তাঁর 888sport live chatকর্মের মূল্যায়নে বাউলগান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। কাঙালের বাউলগানের মূল্যায়ন-প্রসঙ্গে জলধর সেন যা বলেছেন, তা বিশেষ উল্লেখ্য :
বঙ্গ888sport live footballকে সমুজ্জ্বল করিবার জন্য তাঁহার পবিত্র লেখনীপ্রসূত বহু পুস্তকাদি বিদ্যমান থাকিলেও, একমাত্র সঙ্গীতেই কাঙ্গাল ফিকির অমরত্ব লাভ করিয়াছিলেন। অসংখ্য নর888sport promo code এখনও কৃতজ্ঞ হৃদয়ে যে তাঁর নাম করে, তাঁহার সঙ্গীতই তাহার কারণ।১৪
প্রকৃতপক্ষে বিষয়বৈচিত্র্য ও 888sport live chat-চেতনায় কাঙালের মরমি বাউলগান সংগীত-888sport live footballের মর্যাদা লাভ করেছে। এবং সেইসঙ্গে বলা যায়, কালান্তরেও এই গানের আবেদন নিঃশেষিত হয়নি।
হরিনাথের জীবন শুরু হয়েছিল 888sport live footballচর্চা, সাময়িকপত্র-সম্পাদনা, শিক্ষাপ্রসার ও সমাজহিতব্রতের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে। লালন ফকিরের সখ্য-সাহচর্যে এসে তাঁর জীবনে যুক্ত হয় মরমি ভাবসাধনার ধারা এবং সেই সূত্রে বাউলগান রচনার পর্ব। এক সময়ে লালন ও তাঁর পথ এসে একটি মিলনবিন্দুতে মেশে মূলত বাউলগানের অনুষঙ্গে। ‘শখের বাউল’ কাঙালের জীবনে এই বাউলগানই অবশেষে হয়ে ওঠে তাঁর জীবনবেদ, – যার মূলে ছিল লালন সাঁইয়ের প্রেরণা, প্রভাব ও পরিচর্যা, যা কাঙাল-মানসের এক ভিন্ন ইতিহাস রচনার সহায়ক হয়।
তথ্যসূত্র
১. জলধর সেন, কাঙ্গাল হরিনাথ (প্রথম খ-), ১৩২০, কলিকাতা, পৃ ১৭।
২. ওই, পৃ ১৮।
৩. ওই, পৃ ৩৪-৩৫।
৪. ওই, পৃ ৩১।
৫. আবুল আহসান চৌধুরী, কুষ্টিয়ার বাউলসাধক, জানুয়ারি ১৯৭৪ কুষ্টিয়া পৃ ৩৫৪।
৬. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা 888sport live footballের ইতিহাস (চতুর্থ খ-), ১৩৬৫, পৃ ৬২।
৭. সুরেশচন্দ্র মৈত্র, বাংলা 888sport app download apkর নবজন্ম, পৃ ৩২০-২১।
৮. মীর মশাররফ হোসেন, লহরী, আবুল আহসান চৌধুরী-সম্পাদিত, পৃ ৫৬।
৮. প্রাণকৃষ্ণ অধিকারী, আমার জীবনী বা প্রাণকৃষ্ণাবলী
(প্রথম খ-), পৃ ১৪৫।
১০. ওই, পৃ ৪২।
১১. দুর্গাদাস লাহিড়ী (সম্পাদিত), বাঙ্গালীর গান, ১৩১২, কলিকাতা, পৃ ৫০৮।
১২. বসন্তকুমার পাল, মহাত্মা লালন ফকির, ১৩৬১, শান্তিপুর, পৃ ১০৪।
১৩. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা 888sport live footballের ইতিহাস (দ্বিতীয় খ-)। ষ-স, ১৩৭৭, কলিকাতা, পৃ ১৬৫।
১৪. জলধর সেন, কাঙ্গাল হরিনাথ (প্রথম খ-), পূর্বোক্ত, পৃ ১৯।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.