হাসান ফেরদৌস
আজ অনেকদিন পর আবু হোসেন সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠেছেন।
অনেকদিন পর নয়, হিসাব করলে দেখা যাবে গত দশ বছরে এই প্রথম। রেস্তোরাঁর চাকরি, ক্যাশ গুছিয়ে, সবাইকে বিদায় দিয়ে, দোকানের শাটার নামিয়ে তবে ঘরে ফেরা। ঘর মানে এই রেস্তোরাঁর তিনতলা। শুতে-শুতে রাত দেড়টা-দুটো তো বটেই, কখনো-সখনো বড়সড় পার্টি থাকলে, তারও পরে। সকালে সূর্য ওঠা কতদিন দেখেননি আবু হোসেন। অথচ বিয়ের পর পরীর সঙ্গে নিত্যদিনের খেলাই ছিল নতুন সূর্যকে সাক্ষী রেখে রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apk পড়া। প্রথম-প্রথম বই দেখে, পরে অবশ্য অনেক 888sport app download apkই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। পরী কিন্তু আগাগোড়াই 888sport sign up bonus থেকে অবিকল পড়ে শোনাতে পারত। প্রথম-প্রথম আবু হোসেনের সন্দেহ হতো, পরী হয়তো দু-চার লাইনে এদিক-সেদিক করে দিচ্ছে। সে-কথা বলায় পরী তার সঙ্গে একদিন সারা সকাল কথা বলেনি। পরে, রাগ ভাঙলে বলেছিল, বেশ তো, পরীক্ষা নাও। তার দরকার পড়েনি, আবু হোসেন পরীর চোখে টলটলে জল দেখে বুঝতে পেরেছিলেন ও মিথ্যে বলছে না।
কি আশ্চর্য, সেই পরী এগারো বছর নেই। ওই অতটুকু মেয়ে, বড়জোর বাইশ কি তেইশ, মাথায় কী একটা টিউমার হওয়ায় তিন সপ্তাহের মাথায় চলে গেল। মাত্র তিন বছর বিয়ে, এরই মধ্যে তাঁর নিজের জীবনটা পরীর হাতে সঁপে দিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিলেন তিনি। পুরুষ মানুষ মুখে যত হম্বিতম্বি করুক, তার ভেতরে বরাবর একটা শিশু বাস করে, সে অন্যের ঘাড়ে মাথা গুঁজে থাকতে ভালোবাসে। পরী যতদিন ছিল, একটা ডিম ভেজে দেখারও চেষ্টা করেননি। করবেন কী, পরী তাকে ভাঁড়ারমুখো হতে দিতই না। সকালের 888sport app download apk পাঠশেষে দরজার গোড়ায় হকারের রেখে-যাওয়া সংবাদ হাতে নিয়ে বসতে-না-বসতেই নাশতা এসে হাজির। সাড়ে আটটার মধ্যে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি, গলার নিত্যদিনের টাইটি পর্যন্ত পরী টেনে না দিলে লাগানোর সাধ্য ছিল না আবু হোসেনের। বিদেশি সাহায্য সংস্থায় চাকরি, কেউ বলতে পারবে না কোনোদিন তার দু-দশ মিনিট দেরি হয়েছে। পরী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় সব ওলটপালট হয়ে গেল।
স্ত্রী মারা যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় আবু হোসেন 888sport app ছেড়ে এই নিউইয়র্কবাসী। যে-মার্কিন সাহায্য সংস্থায় তিনি কাজ করতেন, তার প্রধান নিজ উদ্যোগে ভিসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আবু হোসেন মানুষটা ভেতরে-ভেতরে একদম ভেঙে পড়েছে, এ-কথা তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন। যাক, কিছুদিন বাইরে থেকে ঘুরে আসুক, এই ভেবে আবু হোসেনের আপত্তি সত্ত্বেও তাঁকে সংস্থার হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই যে আসা, আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ফিরে যাওয়ার কথা কখনো যে ভাবেননি তা নয়, কিন্তু পরী নেই, তিনি কোথায় কার কাছে যাবেন, ভেবে উঠতে পারেননি। দেশ ব্যাপারটা তার ভেতরে কখনো ঠিক কোনো শেকড় পাকাতে পারেনি। সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি 888sport app এসে উঠেছিলেন, বাবা তখন ওয়াপদার বড়বাবু। তাঁর বয়স বড়জোর সাত কি আট। কলেজে উঠতেই বাবার মৃত্যু, তার এক বছর না যেতেই মা। তাকে ছায়া দেবে, এমন আর কেউ রইল না। প্রথমে মামাবাড়ি, তারপর লজিং খুঁজে অন্নসংস্থান করতে হয়েছিল তাঁকে। গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি, সেখানে কাছের বা দূরের কোনো আত্মীয় ছিল না যাদের কাছে গিয়ে উঠবেন। ভাগ্যিস ইন্টারমিডিয়েটে স্কলারশিপ পেয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়নি। ছাত্র থাকতেই পার্টটাইম চাকরির ব্যবস্থা হয়েছিল, এক সাপ্তাহিক পত্রিকায়। এমএ পাশ করতে-না-করতেই বিদেশি সাহায্য সংস্থায় চাকরি জুটে গেল। সেই সূত্রে নেত্রকোনা এসেছিলেন, সেখানে ডেরা বাঁধায় 888sport appর কথা ভুলে গেলেন।
এই শহরেই পরীর সঙ্গে পরিচয়, পরিণয়, এই শহরেই পরীর মৃত্যু।
আয়নায় নিজেকে একবার দেখলেন। সুদর্শন তিনি কখনো ছিলেন না, সে নিয়ে আজীবন মুখ লুকিয়ে থেকেছেন, এমনকি ক্লাসের সেরা ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কোনোদিন ফার্স্ট বেঞ্চে বসার সাহস করে ওঠেননি। এখন বয়সের একটা স্পষ্ট ছাপ, চোখের কোণে ক্লান্তির চিহ্ন। নিজের শরীরের বয়স যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে মনের। অনেক ছবিই এখন ধূসর হয়ে এসেছে, এমনকি সবসময় পরীর চেহারাটাও স্পষ্ট মনে পড়ে না। নেত্রকোনার ভাড়াবাড়ির দোতলায় একফালি বারান্দা ছিল, পুবমুখী, সকালের সূর্য এসে সোনারং মাখিয়ে দিত। সেই দৃশ্যটা কিন্তু অবিকল মনে আছে। পরীর গায়ের রং কিছুটা শ্যামলা ছিল, কিন্তু সকালের সেই রোদে তাকে কী অপূর্ব লাগত! আবু হোসেনের ছোটবেলায় পড়া রূপকথার গল্প মনে পড়ে যেত। সেই যে রাজপুত্র গোঁ ধরেছিল, সোনারঙা মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবে না। তখন চতুর মন্ত্রী নিজের কালো মেয়েকে বিকেলের রোদে বসিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করল। শর্ত ছিল স্বয়ম্বরা সভার আগে সে-মেয়েকে দেখা যাবে না, দেখলেই তার রং মরে যাবে। রাজপুত্র উৎকণ্ঠা রোধ করতে পারেনি, লুকিয়ে দেখে ফেলেছিল। আবু হোসেন নিজেকে সেই রাজপুত্র ভাবতেন, শুধু তফাৎ এই যে, তাঁর বউ কালো, কিন্তু সোনারঙা তার রূপ, সে-কথা জেনেই বিয়ে করেছিলেন।
পরীর সঙ্গে সম্বন্ধটা এনেছিল অফিসের কলিগ হাবিবুল। খুব মাই ডিয়ার মানুষ, পরের ব্যাপারে নিজের নাক গলাতে অতিউৎসাহী। যেহেতু কারো কোনো ক্ষতি করেন না, হাবিবুলের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো তাই তেমন দোষের কিছু মনে করতেন না আবু হোসেন। একই পাড়ার মেয়ে, দুঃসম্পর্কের কেমন যেন আত্মীয় হতো, নিজে একদিন ছবি এনে দেখালেন। আবু হোসেন তো লজ্জায় মাথা লুকোনোর পথ খুঁজতে ব্যস্ত। ‘আরে মশাই, লজ্জার কী আছে, পুরুষ মানুষ, ভালো করে দেখুন। আমি বলছি, এমন মেয়ে এই সারা নেত্রকোনায় দুটি খুঁজে পাবেন না,’ হাবিবুলের সে-কথা অফিসের বাকি সবাই শুনতে পেয়েছিল। দু-চারজন উঠে এসে সে-ছবি টেনে নিয়ে দেখার চেষ্টাও করেছিল। ছোকরামতো অ্যাকাউন্ট্যান্ট পরেশ হেসে বলেছিল, ‘হাবিবুল ভাই, নেত্রকোনার সব মেয়ের ডিরেক্টরি বুঝি এখন আপনার দখলে?’
এক নজর দেখে সে-ছবি ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলেন। পরে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। হোন্ডায় বাসায় ফেরার সময় দেখা হয়নি, কিন্তু ঘরে ফিরে হাত-পা না ধুয়েই ছবি খুলে বসেছিলেন। তার মনে কোনো রাজকন্যার ছবি আঁকা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে কোনো মেয়েকে হয়তো ভালো লেগেছিল, কিন্তু তাদের কাউকে ভালো করে কখনো তাকিয়ে দেখেননি, এগিয়ে এসে কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। অনবরত একটা ভীতি তাঁকে গ্রাস করে থাকত।
নেত্রকোনায় তাঁর দোতলার ঘরে ভয় পাওয়ার কেউ নেই, এখানে কেউ তাঁকে ঠাট্টাও করবে না। তবু যেন বিড়ম্বিত, এভাবে দ্বিধা ও লজ্জা কাটিয়ে ছবিটি খুলে দেখেন আবু হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী নায়না নামে একটি মেয়ের কথা মনে পড়ল। কালো করে মেয়েটি, কোমরতক লম্বা চুল, সে-চুল দেখাতে মাঝেমধ্যে মাথাটা কেমন চক্কর দিত, পাখার মতো চুলগুলো বাতাসে উড়ে বেড়াত। এক-আধবার সে-চুলের আঁচড় তার গাল-মুখেও লেগেছে। চার বছরে যে দু-চারটে মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন, অধিকাংশ সময়েই ক্লাস নোট বা সেমিনার নিয়ে, তার মধ্যে এই নায়নাই বলা যায় তাঁর বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছিল। পরে অবশ্য তাঁর বন্ধু কায়েসের সঙ্গে মেয়েটির সখ্য গড়ে ওঠে, তখন তার নামে নালিশ করতে সে যখন-তখন আবু হোসেনের হোস্টেলের রুমে এসে হাজির হতো। তাই নিয়ে কোনো-কোনো বন্ধু তাঁর সামনেই ঠাট্টা করেছে, আবু হোসেনের অবশ্য কস্মিনকালেও ওই মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ভাবনা মাথায় আসেনি। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, তাঁদের দুজনকে পাশাপাশি দেখে ক্লাসের অন্য মেয়েরা মুখ টিপে হাসে। সে-কারণে আরো বেশি ভয়ে সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকতেন তিনি অথচ মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে তাঁর যে খারাপ লাগত না, এ-কথাও মিথ্যে নয়।
তারপর এই পরী।
নিউইয়র্কের এই বাড়িতে কোনো বারান্দা নেই। এখানেও নিশ্চয় সকালে সূর্য ওঠে, কিন্তু তার খবর তিনি জানেন না। এতদিন তা জানার কোনো প্রয়োজনও বোধ করেননি। জীবন মানে তো কেবল দিনযাপনের রোজনামচা, নিত্যদিন একই রুটিন। কোনো ভিন্ন রস নেই, ভিন্ন আলো নেই। এই ভালো, আবু হোসেন ভাবতেন, জীবনের ভিন্ন কোনো নির্যাস আছে, গত দশ-এগারো বছরে তা বোঝার কোনো চেষ্টাও তাঁর মধ্যে ছিল না। জীবনধারণের ইচ্ছা ছাড়া জীবনধারণ অসম্ভব, বোদলেয়ার প্রসঙ্গে এমন একটা লাইন লিখে তিনি সরোয়ার স্যারের ইংরেজি সেমিনারে বাহবা পেয়েছিলেন। সে-কথার কোনো অর্থ তাঁর কাছে এখন আর নেই। তেমন ইচ্ছার জন্য চাই ভেতর থেকে কোনো একটা প্রেরণা। বোদলেয়ার সে-প্রেরণা হারিয়েছিলেন, সম্ভবত ভ্রষ্টা মায়ের কারণেই। গণিকা প্রেমিকার কাছ থেকে দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার তিনি, সে-কথা জানতেন, কিন্তু পরোয়া করেননি। মৃত্যু যখন অনিবার্য ও নিকটবর্তী, তাকে উদ্যাপন করা যাক, হয়তো ভেবেছেন। নগ্ন, নির্জন তাঁর 888sport app download apk, কিন্তু জীবনযাপনে বেপরোয়া। এই কবি যে মৃত্যুকে নাচের সঙ্গে তুলনা করবেন, তাতে আর বিস্ময় কি!
আবু হোসেনের মাথায় যে মৃত্যুচিন্তা খেলা করেনি, তা নয়। কিন্তু আত্মহননের জন্য যে-সাহস চাই, আবু হোসেনের তা ছিল না। ফলে, এই ভার বহন, আমৃত্যু।
পরীর মৃত্যুর এগারো বছর পর, এই এখন, তার অজ্ঞাতে সেই ভার বহনের একাকিত্ব একটু-একটু করে কমছে। এই বোধটি তাঁর কাছে এখনো খুব স্পষ্ট নয়, কিন্তু আগামীকাল যে কেবল দিনপঞ্জির একটি তারিখ নয়, তার জন্য অপেক্ষায় এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা, এমন একটি বোধ তাঁর ভেতর ক্রমশ জেগে উঠছে। ব্যাপারটা ভেবে নিজের কাছে অপরাধী লাগে তাঁর কাছে। পরী তাঁকে ক্ষমা করবে তো?
নিউইয়র্কে আসার পর প্রথম সাতদিন আবু হোসেন কোনোকিছু করেননি, কার্যত হোটেলেই বসেছিলেন। যে-মার্কিন সাহায্য সংস্থায় তাঁর চাকরি নির্ধারিত ছিল, তাদের শুধু একবার ফোন করে জানিয়েছিলেন তিনি এখন এই শহরে, কিন্তু কাজে যোগ দিতে এখনো প্রস্ত্তত নন। ওরা নিজে থেকে আর কোনো যোগাযোগ করেনি, আবু হোসেনও দ্বিতীয়বার ফোন করেননি। এখান থেকে কোথায় যাবেন, কী করবেন, কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা করা হয়ে ওঠেনি। সাততলা হোটেলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে লাফিয়ে পড়ার মতো পাগলামি তাঁর মাথায় এক-আধবার খেলেছে, কিন্তু সাহস করে ওঠেননি। মঞ্জুর সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো আজন্ম এই হোটেলের ক্ষুদ্র কক্ষে আটকে থাকতেন। হোটেল, অতএব দিনশেষে পয়সা গুনতে হয়। কদ্দিনই বা এখানে থাকা সম্ভব, আবু হোসেন তারও হিসাব করেননি। সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে তাঁর দেখা মঞ্জুর সঙ্গে, নিজের হোটেলের লবিতে। সিগারেট কিনতে বেরিয়েছিলেন, একটি বিদেশি মেয়ের সঙ্গে, মঞ্জুর সঙ্গে সেখানেই দেখা। সে নয়, মঞ্জুই তাঁকে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে। ‘দোস্ত, তুমি?’ প্রায় লাফিয়ে এসে আবু হোসেনকে জড়িয়ে ধরে সে।
হাইস্কুলে তাঁরা দুজন ছিলেন হরিহর আত্মা। বড়লোকের ছেলে মঞ্জু, বাবা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বড়কর্তা। আবু হোসেনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হওয়ার কথা নয়, ক্লাসের ভালো ছাত্র হলেও তিনি বরাবর মুখচোরা। ক্লাস নাইনে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার পর লতিফ স্যার ইংরেজিতে লেটার মার্কস দিয়েছিলেন, তাঁদের স্কুলে তিনিই নাকি প্রথম। চারদিকে একদম হইচই পড়ে গিয়েছিল। ওপরের ক্লাসের ছেলেরা নোট চাইতে বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছে। মঞ্জুও ইংরেজির নোট চাইতে এসেছিল, সে-থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব শুরু।
আবু হোসেন ছাত্র বয়সে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েননি, কিন্তু তিনি মঞ্জুর প্রেমে পড়েছিলেন, এ-কথা হলফ করে বলা যায়। নির্দোষ কিশোর-প্রেম। এমন অনেকদিন গেছে যে, মঞ্জু স্কুল শেষে তার বাসায় চলে এসেছে, গল্প তাঁদের ফুরায় না, স্কুল থেকে যে-গল্প শুরু বাড়ি পর্যন্ত তাকে বয়ে আনতে হয়। আবু হোসেনের মা মঞ্জুকে স্নেহ করতেন, বাসায় এলে না খেয়ে গেছেন, এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। মাঝেমধ্যে তার বাবার ডজ গাড়িতে মঞ্জু এক-আধবার আবু হোসেনকে নিয়ে গুলশান লেকে বেড়াতে গেছে। সিনেমাতেও গেছে বারদুয়েক। মনে আছে, 888sport appর মধুমিতায় ক্লিওপেট্রা ছবিটি দেখতে গিয়েছিল, ওই মঞ্জুই আগাম টিকিট কিনে এনেছিল। বড়দের ছবি, সম্ভবত ‘অ্যাডালটস অনলি’ও লেখা ছিল, তাঁরা দুজনেই টিকিট চেকারের শ্যেনদৃষ্টি এড়াতে কোট-প্যান্ট পরে ছিলেন। মঞ্জুর কাছ থেকে ধার নিয়ে টাই পর্যন্ত ঝুলিয়ে ছিলেন। পরদিন ক্লাসে এসে সে-গল্প করাতে স্কুলসুদ্ধ ছাত্ররা ঈর্ষায় লাল। আবু হোসেনের মনে পড়ে, মঞ্জুর বিদেশি সাইকেলে চেপে কতদিন বিকেলে তাঁরা দুজন পল্টনের আগাখানিপাড়ায় গেছেন ফর্সা সুদেহী মেয়েদের দেখতে। একবার পেছন থেকে ভারি সুন্দর এক মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করে শেষমেশ দেখেন সে এক বুড়ি।
সেই মঞ্জু, রোগা-পাতলা একটা বিদেশি মেয়েকে বগলদাবা অবস্থায় এই হোটেলের লবিতে। কয়েক সেকেন্ড লেগেছিল চিনতে। বোলচালে বদলেছে, চেহারাতে ভিন্ন চেকনাই। কিন্তু যেই বুঝল লোকটা মঞ্জু, মনের মধ্যে আশ্চর্য একটা স্বস্তি ফুটে উঠল। বিদেশের মাটিতে আবু হোসেনের গত সাতদিন যে একা-একা ভাবটা ছিল, এক লহমায় তা উধাও। বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো, জ্যানেট, ফিলিপিনো, বলল তার ফিয়াসেঁ। কথাটা বলার সময় মেয়েটা কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা কৌতুক নিয়ে তাঁর দিকে তাকাল, মঞ্জু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আবু হোসেনকে রীতিমতো টানতে-টানতে নিয়ে গেল রাস্তার উলটোদিকের ক্যাফেতে।
স্কুলে মঞ্জু খুব যে কথা বলত এমন নয়, কিন্তু এখন তার মুখে কথার খই ফোটে। বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে হড়হড় করে তার জীবনবৃত্তান্ত জানিয়ে দিলো। আট-দশ বছর নিউইয়র্কে আছে, নিজে ডাংকিন ডোনাটসে কাজ করে, তিন রুমের একটি ঘরের মালিক, জ্যানেট ও সে একমাত্র তার বাসিন্দা। ‘দোস্ত, চল আমার সাথে। কাঁহাতক হোটেলের ভাড়া গুনবি।’ কোনো ওজর-আপত্তিতে কাজ হলো না। সপ্তাহখানেক ছিল মঞ্জুর জ্যাকসন হাইটসের ফ্ল্যাটে। সকালে তারা দুজন কাজে বেরিয়ে যেত, আবু হোসেন একা। প্রথম দুদিন ঘরেই বসে ছিলেন, দোতলায় ছোট একটি বারান্দা ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিউইয়র্কের এই পাড়াটা বেশ লোকজনে ভরা, অনেকেই পাকিস্তান-888sport appsের। কান পাতলে বাংলা শব্দ শোনা যায়। দলবেঁধে কিশোর-কিশোরীরা স্কুলে যায়, তাদের উচ্চকণ্ঠ, খিলখিল হাসি, আবু হোসেনের বারান্দা পর্যন্ত ধাওয়া করে। তার মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।
নিউইয়র্কের যে-জায়গাটার কথা আবু হোসেন আগে থেকে জানতেন এবং যার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ছিল তা হলো সেন্ট্রাল পার্ক। এক কোটি মানুষের মহানগর নিউইয়র্ক অথচ তার ঠিক বুকের মাঝখানে প্রায় সাড়ে আটশো একর জায়গা নিয়ে বিশাল পার্ক। সে-পার্কের উলটোদিকে সারি-সারি ভবন, এর একটিতে থাকতেন জন লেনন। নিজের ফ্ল্যাটের সামনেই খুন হয়েছিলেন ১৯৮০ সালে। আবু হোসেন তখন সদ্য ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন, পার্টটাইম একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন এক সাপ্তাহিক পত্রিকায়। লেনন মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পর সম্পাদকের নির্দেশে লেননকে নিয়ে লিখতে হয়েছিল প্রচ্ছদকাহিনি। এর আগে বিটলসের গান এক-আধবার যে শোনেননি তা নয়, কিন্তু মনে গেঁথে রাখার মতো কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। লেননকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বিটলসের, বিশেষ করে লেননের, প্রেমে পড়ে গেলেন। সেই প্রচ্ছদকাহিনির জন্য লেননের ‘ইমাজিন’ গানটি 888sport app download apk latest versionও করেছিলেন। বেলাল ভাই, সে পত্রিকার সম্পাদক, তাঁর কলমের খোঁচায় অবশ্য সে-গানের খোলনলচে একদম বদলে গিয়েছিল। আবু হোসেনের জানা ছিল, প্রিয় গায়কের 888sport sign up bonus ধরে রাখতে এই সেন্ট্রাল পার্কে বানানো হয়েছে স্ট্রবেরি ফিল্ডস। নিউইয়র্কে মঞ্জুর বাসায় ওঠার তিনদিনের মাথায় খোঁজ করলেন স্ট্রবেরি ফিল্ডস কোথায়। মঞ্জুর জানা ছিল না, পরে কাউকে যেন ফোন করে সেখানে যাওয়ার পথটা বাতলে দিয়েছিল। মঞ্জু হয়তো বিস্মিত হয়েছিল, কিন্তু জানতে চায়নি কেন হঠাৎ স্ট্রবেরি ফিল্ডস। কাজে যাওয়ার পথে সেন্ট্রাল পার্কের সবচেয়ে কাছের স্টেশনে নামিয়ে দিয়েছিল, ফেরার পথও কাগজে-কলমে লিখে দিয়েছিল।
পুরো একটা বিকেল ও সন্ধ্যা সেখানে কাটিয়েছিলেন আবু হোসেন। তেমন কিছু করেননি, শুধু সবুজ ঘাসের ওপর বসে ছিলেন। যেন একফোঁটা চোখের জল, এমন করে কেটে সাজানো মাঠটি, এক কোনায় সাদা-কালো মোজাইকে আঁকা ‘ইমাজিন’ কথাটি। প্রথমে পা মুড়ে বসেছিলেন, তারপর সবুজ ঘাসের ওপর আকাশের দিকে তাকিয়ে সটান শুয়ে পড়েছিলেন। চারদিকে সহাস্য মানুষের ভিড়, চারদিকে জীবনের হাতছানি, সাজানো বাগান, এসবে আবু হোসেনের মন আরো বিষাদগ্রস্ত হয়ে ওঠে। এই পার্ক তাদের জন্য, যারা জীবন থেকে আরো অনেক পাওয়ার আশা করে। আবু হোসেনের তো আর চাওয়ার কিছু নেই। যেখানে বসে ছিলেন তার বেশকিছুটা দূরে, খোলা আকাশের নিচে, স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে এক যুবক-যুবতী শুয়ে, সে-দৃশ্য তার নজরে এলো। প্রথমে তেমন বিশেষ কিছু ভাবেননি, কিন্তু খানিক পরে কিছুটা আগ্রহভরে তাকাতে তিনি বুঝলেন স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে যুবক-যুবতী সঙ্গমে লিপ্ত। এমন দৃশ্য তিনি আগে কখনো দেখেননি, সঙ্গমের ভাবনাও তার মাথায় ছিল না। ছেলেমেয়েটির মুখ-শরীর কিছুই তিনি দেখেন না, শুধু নজরে আসে তাদের দেহের দুলুনি। একবার উঠছে, একবার নামছে। অসভ্যতা ভেবে তিনি চোখ ফিরিয়ে নেন, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারেন না। সম্ভবত তাদের সঙ্গম ততক্ষণে শেষ অথবা আদৌ হয়তো সঙ্গম তারা করেনি, শুধু ভঙ্গিমা করছিল। আবু হোসেন দেখেন মেয়েটি ছেলেটির বুকের ওপর তার গালে গাল রেখে শুয়ে। পরীর মৃত্যুর পর একদিনের জন্যও তিনি কখনো 888sport promo codeদেহের প্রয়োজন অনুভব করেননি। এমনকি স্বমেহনের চিন্তাও তাঁর মনে হানা দেয়নি। কিন্তু সেদিন, খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর সারাশরীর একটু কাঁপুনি দিয়ে ওঠে।
বাসায় সেদিন রাত করে ফিরে দেখেন মঞ্জু ও জ্যানেট খেতে বসেছে। সে-রাতেই খেতে-খেতে মঞ্জু বলল, ‘চল, কাল তোকে আরশাদ ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাই।’ তার এক বন্ধু ডাউন টাউনে সদ্য রেস্তোরাঁর ব্যবসা শুরু করেছে, তার একজন বিশ্বস্ত লোক চাই। কথাটা মঞ্জু বারকয়েক বলেছিল, কিন্তু আবু হোসেন আমলে আনেননি। ডাউন টাউন কী, তার জানা নেই। রেস্তোরাঁর কাজেরই বা সে কী বোঝে! চারদিনের মাথায় মঞ্জুই তাকে জোর করে নিয়ে এলো। আরশাদ ভাই তাকে দেখে এককথায় রাজি, ‘আরে, এমন লোকই তো আমি খুঁজছি। দেখেই মনে হয় কাজের লোক হবে।’
যাওয়ার আগে মঞ্জু আবু হোসেনের হাতে একশ ডলারের খুচরো নোট গুঁজে দিয়ে বলল, ভালো থাকিস। আবু হোসেনকে জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল। আবু হোসেন বুঝতে পেরেছিলেন চোখের জল দেখাতে চায়নি সে প্রিয় বন্ধুর সামনে।
সেই আসা, আর ফিরে যাওয়া হয়নি। আরশাদ ভাইয়ের এই তাজমহল হোটেলই আমেরিকায় তার একমাত্র ঠিকানা হয়ে উঠল। প্রথম-প্রথম রেস্তোরাঁর কাজ বিন্দুবিসর্গ বুঝতেন না, আরশাদ ভাই-ই তাকে বুঝিয়ে-পড়িয়ে নেন। আলম নামে এক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন, এই রেস্তোরাঁর ম্যানেজার, তিনিও আবু হোসেনকে হাতে-কলমে বিস্তর কাজ শিখিয়েছিলেন। প্রথমদিন আবু হোসেনের ওপর ভার পড়েছিল দুপুরে দোকান খোলার আগে প্রতিটি টেবিলে গ্লাস, কাঁটাচামচ ও ন্যাপকিন সাজিয়ে রাখা। এসব সাজানোর যে বিশেষ নিয়ম আছে, আবু হোসেনের তা জানার কথা নয়। আবু হোসেন একবার কাঁটাচামচে হাত রাখেন, একবার ন্যাপকিনে, কীভাবে সাজাবেন সে-বুদ্ধি মাথায় আসে না। আলম সাহেব খানিকক্ষণ তাঁকে দূর থেকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখলেন, তারপর কিঞ্চিৎ পরিহাসের সঙ্গেই বললেন, ‘কী, এই কাজে বোধহয় প্রথম?’
ভদ্রলোক সত্যি ইঞ্জিনিয়ার কিনা তা অবশ্য কখনো যাচাইয়ের সুযোগ হয়নি। প্রয়োজনও পড়েনি। আবু হোসেন 888sport live footballের ছাত্র, অন্যদিকে আলম ভাই 888sport apkের ছাত্র হলেও 888sport app download apkপাগল ছিলেন। গোপনে 888sport app download apk লিখতেন, কিন্তু এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে এমন কেউ নেই যাকে পড়ে শোনাবেন। আবু হোসেনকে পেয়ে তিনি বর্তে গেলেন। রেস্তোরাঁয় কাজের একটা সুবিধা যে এখানে শুক্র থেকে রোববার, এই তিনদিন ছাড়া বাকি দিনগুলো তেমন কাজের চাপ থাকে না। দিনের বেলায় লাঞ্চ আওয়ারে দু-পাঁচজন আসে, সেও নিয়মিত নয়। আলম ভাই কাজে আসতেন 888sport app download apkর একটি খাতা বগলদাবা করে। দুপুরে লোকজন খাঁ খাঁ, অতএব আসো 888sport app download apk শুনি। বড় সাইজের এক গ্লাসে তেতো বিয়ার ঢেলে, আবু হোসেনের জন্য ঠান্ডা কোক সামনে রেখে, শুরু করতেন।
‘বুঝলা মিয়া, এই 888sport app download apkটা যখন লিখি, তখন বাতাসীর বয়স ১৪।’
বাতাসীর আসল নাম জিনিয়া, কিন্তু সে-নাম সহজে নিতেন না আলম ভাই। কেন, সে ইতিহাস কখনো জানা হয়নি, আবু হোসেনও তা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করেননি। বাতাসী বা জিনিয়া, যা-ই হোক, সে-মেয়ের গল্প আবু হোসেন অনেকবার শুনেছেন। প্রতিবারই নতুন-নতুন তথ্য যুক্ত হয়েছে, তাতে আবু হোসেনের এমন বোধ হয়েছে যে, জিনিয়া নামের মেয়েটি আলম ভাইয়ের 888sport sign up bonus নয়, সে জীবন্ত। কাছে নেই অথচ কাছে আছে। প্রতিদিন একটু-একটু করে সে বাড়ে। চৌধুরীপাড়ায় তার প্রতিবেশী এক আর্মি অফিসারের মেয়ে। আলম ভাই তখন কলেজের ছাত্র। পাশাপাশি বাড়ি, ফলে চোখাচোখি হতো। এতটুকুন মেয়ে, তার সঙ্গে প্রেমের কথা কখনো মাথায় আসেনি। একদিন আবিষ্কার করলেন মেয়েটি রবীন্দ্রসংগীত গায়। ব্যস, হয়ে গেল! ‘বুঝলা মিয়া, গলাটা ঠিক রাজেশ্বরী দত্তের মতো। চিনছ তো, তোমাগো কবি সুধীন দত্তের বউ। মাদ্রাজি মেয়ে, কিন্তু গান গাইত দুর্দান্ত। রবিঠাকুর নিজে এক সময় সার্টিফিকেট দিছিল। বাতাসী, বুঝলা, আমার নিজের বিবেচনায়, তুমি আবার কথাটা শুইনা হাইসো না, রাজেশ্বরী দেবীর পর রবীন্দ্রনাথের গান এত দরদ দিয়া আর কেউ গায় নাই।’
আলম ভাই খুব দরদ দিয়ে বাতাসীর জন্য চিঠি লিখতেন, সেসব চিঠির কপি ফুলস্কেপ কাগজের এক খাতায় সযত্নে তোলা থাকত। আবু হোসেনের মাথায় ঢুকত না নিজের চিঠি এত যত্ন করে কপি করার কী দরকার। চিঠি লেখা তো অন্যের জন্য, খামে করে তা ডাকবাক্সে ফেলে দেওয়ার পর তার আর গুরুত্ব কী! সে-কথা একবার তাঁকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন। আলম ভাইয়ের সোজা উত্তর, ‘ক্যা, তোমাগো রবিঠাকুর, তারে দেহো না?’ বাতাসী তাঁকে জবাবে কোনো চিঠি লিখেছে কিনা, এ-প্রশ্নও আবু হোসেন জিজ্ঞাসা করেছেন। আর লিখে থাকলে সেসব তাঁর কাছে জমানো আছে কিনা, তাও জানতে চেয়েছিলেন। আলম ভাই, তাঁর উদাস চেহারা আরো উদাস করে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আছে, সব এইখানে।’ এই বলে বুকের মাঝখানে বাঁ-হাতের মধ্যমা দিয়ে মৃদু টোকা দিয়েছিলেন।
সে-জবাব শুনে আবু হোসেন হেসে ফেলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর এক বন্ধু মুর্শেদ ঠিক এরকম একটা কান্ড করেছিল। সেমিনার রুমে রাজা-উজির মারা চলছে, হঠাৎ এক ভদ্রলোক, সম্ভবত অন্য ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ছাত্র, এসে জিজ্ঞেস করল, ভাই আগুন আছে। ভদ্রলোক আগুন বলতে দেশলাই বুঝিয়েছিলেন। মুর্শেদ মহাগাম্ভীর্যের সঙ্গে জবাব দিলো, ‘আছে, এইখানে, নেবেন?’ এই বলে সে বুকে দুটো টোকা দিলো।
‘বুঝলা, তার চিঠির একেকটা লাইন, সে যে কী ভীষণ ইরোটিক, তোমারে কেমনে বুঝাই। প্রথম চিঠিটা আমিই লেখি, কিন্তু এরপর চিঠির বন্যা বইয়া গেল। বাতাসী চাইলে কবি হইতে পারত, ও স্যাফো পড়ে নাই, কিন্তু কখনো-কখনো তারেও হার মানায়। মনে আছে, তার এক চিঠিতে লিখছিল, আমার গোপন অঙ্গের চুম্বন জানিও।’ কথাটা বলে সারা গায়ে অদ্ভুত ঝাঁকুনি দিলেন আলম ভাই।
ঠিক কদ্দুর প্রেম, কেমন প্রেম সেসব বিস্তারিত কিছুই বলেননি আলম ভাই, কিন্তু সেই দূরদেশে থাকা মেয়েটির জন্য তিনি 888sport app download apk লিখে গেছেন। সবই প্রেমের 888sport app download apk, কিছুটা অতুলপ্রসাদের মতো বুকভাঙা দুঃখের গানের মতো। একটা লাইন আবু হোসেনের এখনো মনে আছে, ‘ঘাস, কুমারী ঘাস, তুমিও শিশির হলে।’
‘বুঝলা মিয়া, মানুষের দুঃখে ঘাস পর্যন্ত কাইন্দা ওঠে। কেমন, দুর্দান্ত না মেটাফরটা?’
পরে জেনেছেন বুয়েটের ছাত্র থাকতেই সেই বাতাসীর বিয়ে হয়ে যায় অন্য এক আর্মি অফিসারের সঙ্গে। আবু হোসেনের কখনো-কখনো এমন মনে হয়েছে, বাতাসীর ব্যাপারটা হয়তো পুরোটাই আলম ভাইয়ের কল্পনা। হয়তো পাশের বাড়িতে কোনো কিশোরী থাকত, তার সঙ্গে কালেভদ্রে চোখাচোখি হতো, তার চেয়ে অধিক কিছু নয়। সে-মেয়ে সত্যি থাক বা না থাক, 888sport app download apkয় তাকে বাঁচিয়ে রাখতে আলম ভাইয়ের কসরতের কমতি ছিল না।
‘888sport app download apk জিনিসটা, বুঝলা মিয়া, একটা জীবন্ত জিনিস। রক্ত-মাংসের চেয়েও জীবন্ত। ঠিক মাইয়া মানুষের মতো। মনের মধ্যে মাইয়ার যে-ছবিটা ধরা থাকে, সে সত্য-সত্য যেমন হোক, এই মনের ছবিটাই আসল।’ উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর জন্য কালিদাসের মেঘদূতের উল্লেখ করতেন। ‘যক্ষের কোনো প্রিয়া সত্য সত্যই ছিল কি না, এইটা জানা তো আমাদের জন্য জরুরি না। 888sport app download apkয় সেই প্রিয়ার হাহাকার আমাদের বুকের মধ্যেও বাইজা উঠে কি না, সেইটা হইল আসল কথা।’ তিনি কেন যেন বুদ্ধদেব বসুকে বলতেন বুদ্ধুদেব বসু। ‘বুদ্ধুদেবের 888sport app download apk latest versionে তো পড়ছ, নাকি? যে মাইয়াটার কথা কালিদাস লেখছে, সে কি রক্তমাংসের চেয়েও অধিক সত্য না?’ 888sport sign up bonus থেকে অবিকল পড়ে শোনাতেন :
তন্বী শ্যামা আর সূক্ষ্মদন্তিনী, নিম্ননাভি, ক্ষীণমধ্যা,
জঘন গুরু ব’লে মন্দ লয়ে চলে, চকিত হরিণীর দৃষ্টি,
অধরে রক্তিম পক্ব বিম্বের, যুগল স্তনভারে ঈষৎ-নতা,
সেথায় আছে সেই, বিশ্বস্রষ্টার প্রথম যুবতীর প্রতিমা।
তারপর কিঞ্চিৎ পরিহাসের সুরে বলতেন, ‘জঘন মানে বুঝলা তো? না, তুমি যা ভাবছ তা না। জঘন হইল মেয়েদের নিতম্ব, তার কোমর।’
‘ভাইবা দেখো, মনের মধ্যে ছবিটা আঁইকা দেখো কেমন ছিল মাইয়াটা, একদম শরীল গরম হইয়া উঠে না, কও?’ তারপর চোখজোড়া বুজে, কোনো এক অদৃশ্য যুবতী প্রতিমা অথবা তার যৌবনের বাতাসীর কথা ভেবে এক হ্রস্বশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘বুঝলা, এইটাই হইল 888sport app download apkর কাজ, সে আমাদের মনের মধ্যে সত্যের চেয়েও অধিক সত্য এক বিস্ময়ের জন্ম দেয়। তোমাগো রবিঠাকুর ঠিকই কইছে, সব সত্য সবসময় সত্য নয়, ভিন্ন এক সত্যও আছে, যা কেবল কবিই পারে উদ্ধার করতে।’
আলম ভাইয়ের কাছে আবু হোসেন এখনো নানা কারণে কৃতজ্ঞ। শুধু যে রেস্তোরাঁর কাজ তাঁকে শিখিয়েছিলেন, তা নয়, প্রবাসে প্রায় মরুভূমির মতো এই নির্বাসনে, আলম ভাই তাঁর কাছে ছিলেন একখন্ড ওয়েসিস। নানা বিষয়ে আড্ডা হয়েছে, উত্তপ্ত তর্ক হয়েছে, তবে তপ্ত যা হওয়ার আলম ভাই-ই হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি তর্ক হয়েছে 888sport app download apk, বিশেষত শামসুর রাহমানের 888sport app download apk নিয়ে। আবু হোসেনের প্রিয় কবি, অনেক লিখেছে, কেউ-কেউ বলেন 888sport free betর বিচারে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি, তবে তিনি নিজে সত্যি-সত্যি ভালোবাসেন এই কবির প্রথম তিন-চারখানা বই। নিজ বাসভূমের পর অন্য আর কোনো বই সে-অর্থে তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। শেষের দিকে শামসুর রাহমান প্রবল রকম রাজনীতিমুখীন হয়ে ওঠেন। সত্তরের গোড়ার দিকেও এই কবি রাজনৈতিক ছিলেন; কিন্তু সে-সময়ের 888sport app download apkয় বক্তব্য আসত প্রতীকের ছদ্মবেশে। ফলে পাঠককে সে-ছদ্মাবরণ সাবধানে খুলে তার সারাৎসার উদ্ধার করতে হতো। ‘টেলেমেকাস’ নামে শামসুর রাহমানের একটি 888sport app download apk তাঁর খুবই প্রিয়। বিশ্বজয় করে দেশে ফিরছেন ইউলিসিস, তাঁর অপেক্ষায় পুত্র টেলেমেকাস। দন্ডগ্রাম, বিপন্ন জনপদ, ভগ্ন-হূদয় শহরবাসী, সবাই অপেক্ষায় সেই মহানায়কের প্রত্যাবর্তনের। সে-888sport app download apk প্রথম পড়ার অনেকদিন পর আবু হোসেনের মনে হয়েছে, এমনকি হতে পারে এই মহানায়ক আসলে এই বাংলারই কেউ? এমনকি হতে পারেন তিনি শেখ মুজিব?
অথচ সেই শামসুর রাহমান একাত্তরের পর কেমন বদলে গেলেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতি হয়ে উঠল তাঁর কাব্যপ্রকাশের প্রধান অনুষঙ্গ। আবু হোসেনের মনে হয়েছে, এই ক্ষমতাবান লোকটি নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। 888sport appsের 888sport app download apkয় রাজনীতির ধুপধাপ আওয়াজ, গরুর হাম্বা হাম্বা ধ্বনি, তাও তাঁর মনে হতো শামসুর রাহমানের জন্যই। 888sport app download apk লেখার একটা টেমপ্লেট তিনি বানিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে ক্যাটালগিং থাকবে, দু-চারটে সাজানো বুলি থাকবে, দেশ নিয়ে দু-দশ কথা, তাও থাকবে। সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি, এক 888sport app download apk পড়লে মনে হবে বাকি সবই পড়া হয়েছে। নিজে তো বটেই, দেশের বুড়া-গুঁড়া সবাই সেই ফর্মুলা ধরে 888sport app download apk লিখছে!
আবু হোসেনের কথা শুনে আলম ভাই হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন। শামসুর রাহমানের ওপর তাঁর নাতিদীর্ঘ ভাষণ শুনে তিনি প্রবল পরিহাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘তুমি একটা গর্দভ। মনে রাখবা, কবি কেবল নিজের জন্য লেখে না। যে-পৃথিবীতে সে বাস করে, তার কথাও তাকে ভাবতে হয়। তুমি যারে রাজনীতি কও, তা আসলে মানুষের নিত্যদিনের সংগ্রামের গল্প। পুনরাবৃত্তি আছে, তা তো থাকবেই। দৈনন্দিন জীবনে বাঙালির এই তো অভিজ্ঞতা। এই গল্প কবি যদি না করে, তবে কে করবে? প্রত্যেক দেশের, প্রতিটি সময়ের এক একজন বংশীবাদক থাকে, থাকে এক একজন ত্রুবাদুর। শামসুর রাহমান হইল আমাদের সেই ত্রুবাদুর।’
তারপর ত্রুবাদুর জিনিসটা কী, তা বোঝাতে আধঘণ্টা ব্যয় করেছিলেন।
সেই আলম ভাই, রেস্তোরাঁয় আধ-মাতাল খদ্দেরের জন্য ককটেল বানাতে-বানাতে যিনি বিনা আয়াসে 888sport app download apkর স্তবক পড়ে শোনাতেন, প্রায় বিশ বছর বিদেশে কাটানোর পর দেশে ফিরে গেছেন। বড় এক ভাই মারা যাওয়ার পর দেশের জায়গা-জমি নিয়ে কী সব ঝামেলা হয়েছিল, সেসব মেটাতে যেতে হয়েছিল, যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন, ‘জায়গাটা ধইরা রাইখো। আমি গেলাম আর আসলাম।’ ছয় বছর আগে সেই যে গেলেন, আর ফেরা হয়নি। কী আশ্চর্য, লোকটার সঙ্গে কোনো যোগাযোগও আর নেই। ফিরে যাওয়ার পর তিনি একবার চিঠি দিয়েছিলেন, একবার ফোনও করেছিলেন তাঁর ঘরের জিনিসগুলো দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা যাতে করা হয়, সেই অনুরোধ করতে।
জানতে ইচ্ছা করে আলম ভাই এখনো 888sport app download apk লেখেন কিনা।
আবু হোসেন নিজে কখনো 888sport app download apk লেখেননি। লেখার চেষ্টাও করেননি। পরী তাঁকে লুকিয়ে কিছু একটা লিখত, কিন্তু কখনো তাঁকে পড়ে শোনায়নি। তাঁরা দুজন অবশ্য 888sport app download apk নিয়ে বিস্তর বাহাস করেছেন। তিনি ইংরেজি 888sport live footballের ছাত্র, এই নিয়ে কিছুটা গোপন অহংকার ছিল, কখনো-কখনো নিজের পান্ডিত্য প্রকাশের জন্য দু-চারটে বিদেশি নাম, তাদের 888sport app download apkর দু-চার লাইন পড়ে শোনাতেন। কিন্তু 888sport app download apk ব্যাপারটা যে পান্ডিত্যের নয়, প্রেমের, পরীর কাছ থেকেই তিনি শিখেছিলেন।
সকালে উঠে স্নান সেরে নেওয়া আবু হোসেনের পুরনো অভ্যাস। দেশে থাকতে এই নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম হয়নি, এখানে রেস্তোরাঁর কাজ শুরুর পর থেকে সে-অভ্যাসটি ধরে রেখেছেন। স্নান শেষ হতে না হতেই ধোঁয়া তোলা চা এসে হাজির, দৈনিক সংবাদের পাতায় চোখ বোলাতে-বোলাতে চায়ের কাপে চুমুক দিতেন, পরী সামনে বসে থাকত, খুব একটা কথা না বলেই। পরী নিজেই বলেছে, সকালের এই সময়টা তার প্রিয়। এখন পরী নেই, কিন্তু অভ্যাসটা বদলায়নি। শুধু ধূমায়িত চায়ের বদলে ঘন কালো কফি।
আজ কফির কাপ হাতে নিতেই খানিকটা কফি চল্কে পড়ল। মনের মধ্যে একটি অপরাধবোধ তাঁর অলক্ষেই কুরে কুরে খাচ্ছিল, এবার তা যেন একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। পরী মারা যাওয়ার পর এক ধরনের বৈরাগ্য তিনি লালন করেছেন, তার 888sport sign up bonusকে দেরাজে তুলে রাখেননি, বরং তাকে নিত্যদিনের অভ্যাসের ভেতরেই জাগিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর অলক্ষেই কিছু-কিছু পরিবর্তন শুরু হয়েছে। মনের ভেতর যে-জায়গাটায় পরী এতদিন একলা আসন নিয়ে বসে ছিল, এখন সেখানে আরেকজন এসে দরজায় কড়া নাড়ছে।
গ্লানিতে মনটা ভারী হয়ে আসে।
হাসি চক্রবর্তী নামে মেয়েটি – মেয়ে নয়, তাকে মহিলা বলা ভালো – আজ নিজ থেকে তাঁর বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কোনো আমন্ত্রণ নেই, হাসি বাসায় থাকবে কিনা, তা জানা নেই। তবু তাকে যেতে হবে। হাসির আজ তাকে প্রয়োজন।
গেল এক বছর ধরে মেয়েটির সঙ্গে আলাপ। আলাপ বলা কি ঠিক হবে, কথা তাদের হয় খুব সামান্যই। গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাস আবু হোসেনের নেই। এক পরী ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে মুখ ফুটে কথা বলার কোনো অভিজ্ঞতাও তাঁর নেই। প্রায় এক যুগ হলো এই নিউইয়র্কে অথচ এই দীর্ঘ সময়েও দেশি বা বিদেশি কোনো মেয়ের সঙ্গেই হাই-হ্যালোর বাইরে কোনো পরিচয় গড়ে ওঠেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম হাসি চক্রবর্তী।
তাঁর রেস্তোরাঁয় আলাপ, মেয়েটি প্রতি সপ্তাহের একদিন, শুক্রবার, ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টেক অ্যাওয়ের অর্ডার দেয়। প্রতিবার একই অর্ডার : তিনটি নান, একটি তন্দুরি চিকেন ও একবাটি তড়কা ডাল। সন্ধ্যার এই সময়টা রেস্তোরাঁ প্রায় ফাঁকা, রাত আটটা-নটার আগে খদ্দেরের ভিড় জমে না। পুরো রেস্তোরাঁ আবু হোসেনকে একা সামাল দিতে হয়। আরো দুটি বাস বয় আছে, কিন্তু রাত নটার আগে তাদের ডিউটি শুরু হয় না।
প্রথম দিন ভালো করে তাকিয়েও দেখেননি তিনি। হালকা একটা স্প্রিং জ্যাকেট পরে এসেছিল, তার নিচে যে শাড়ি সেটিও ভালো করে নজরে আসেনি। যে দু-চার কথা, তাও ইংরেজিতে। অর্ডার তৈরি হতে মিনিটদশেক লেগেছিল, সে পুরো সময় কাউন্টারের সবচেয়ে কাছের টেবিলটায় বসে থাকল, একবারো তার দিকে তাকাল না, অন্য কারোর দিকেও নয়। অর্ডার আসতেই উঠে দাঁড়াল। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ, পরে দেখেছিলেন সেটি চটের, আড়ং বা সেরকম কোনো দোকানের। ব্যাগটা কাউন্টারে রেখে, তার ভেতর থেকে ছোট আরেকটি কাপড়ের পার্স বের করে, সেখান থেকে গুনে-গুনে বারো ডলার তুলে দিলো। আবু হোসেনের কাছ থেকে ৬৫ সেন্ট ফেরত নিতে গিয়ে প্রায় অস্ফুট স্বরে মেয়েটি বলল, থ্যাংকস। খাবারের প্যাকেটখানা একবার নাকের কাছে নিয়ে শুঁকল, একটা তৃপ্তির হাসি, তারপর খুব সাবধানে সে প্যাকেট চটের ব্যাগটায় রেখে তাঁর দিকে না তাকিয়ে বলল, ওকে, সি ইউ।
দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় আবু হোসেন লক্ষ করলেন মেয়েটির পরনে শাড়ি।
হাই-হ্যালোর বাইরে কথা বলতে তাঁর মাসখানেক তো লেগেছিলই। বলার কী কথাইবা থাকতে পারে? মেয়েটি বাঙালি, সে-কথা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন আর বাঙালি যদি হয়ও, সম্ভবত এ-দেশে দীর্ঘদিন থেকে বাস করছে। এমন চোস্ত উচ্চারণে ইংরেজি বলা অন্য কোনো বাঙালি মেয়ে তিনি দেখেননি। একদিন অদভুতভাবে জানা গেল, মেয়েটি শুধু বাঙালিই নয়, 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ে সে একসময় ইংরেজি 888sport live football নিয়ে পড়েছে, তবে তার নিজের পাঠ চুকানোর বেশকিছু পরে।
আলম ভাই চলে যাওয়ার পর অবসর সময়ে 888sport app download apkর বই ওলটানোর একটা অভ্যাস তাঁর ছিল। সেদিন শহীদ কাদরীর 888sport app download apkসমগ্র কাউন্টারে মুড়ে রাখা ছিল, প্রচ্ছদটা ওপরে। হাসি যথারীতি তার নান-তন্দুরি চিকেন অর্ডার দিয়ে পয়সা বের করতে তার চটের ব্যাগ কাউন্টারে রেখে তা খুলতে গেছে, চোখ পড়ল সে-বইয়ের ওপর। যেন কিছুটা বিস্মিত, খুব দারুণ কিছু একটা দেখেছে, কিঞ্চিৎ উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ওমা, আপনি 888sport app download apk পড়েন?’
বাংলায় সেই প্রথম বাক্যালাপ।
যেন কিছুটা বিব্রত, নাকি অপরাধী, এভাবে তার স্বভাবের চেয়েও নিচু গলায় বললেন, ‘পড়ি, যখন সুযোগ পাই।’
‘শহীদ কাদরী আমারও প্রিয় কবি। সমর সেনের কথা মনে করিয়ে দেন, কিন্তু ছবিগুলো তাঁর চেয়েও পাওয়ারফুল।’
জবাব দেওয়ার কথা খুঁজে পেলেন না। বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, সমর সেনের সঙ্গে মিলটা বড় সুপারফিশিয়াল। 888sport appsের – পূর্ব বাংলার – নিজস্ব কনটেক্সট ছাড়া এই কবিকে অন্য কোথাও বসানো যাবে না। তাঁর প্রতিটি মেটাফর, প্রতিটি স্বরাভ্যাস পূর্ব বাংলার রাজনীতি ও প্রকৃতিনির্ভর। শহুরে কবি, সে-কথা ঠিক, কিন্তু 888sport app download apkর ইথোস বিচার করলে সমর সেনের সঙ্গে তাঁর কোনো মিলই নেই। 888sport app download apk তিনি লিখেছেন মুক্ত ছন্দে, কিন্তু শহীদ কাদরীর 888sport app download apk প্রায় ক্ষেত্রেই মাত্রা মেপে-মেপে, হয় অক্ষরবৃত্ত, নয়তো মাত্রাবৃত্ত।
কথাগুলো মনে-মনে বললেন। হাসি ততক্ষণে পয়সা গুনে কাউন্টারের ওপর রেখেছে, আলগোছে ঠেলা দিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে দিলো। ‘আমার নাম হাসি। আমরা 888sport appর, শ্যামলীতে আমাদের বাসা।’ তারপর, যেন জরুরি কিছু একটা বলা বাদ ছিল, শশব্যস্ত হয়ে যোগ করল, ‘তবে গ্রামের বাড়ি বরিশালে।’
শ্যামলীটা কোথায় যেন, ভাবতে চেষ্টা করলেন। একটা 888sport app download apkর লাইন মনে পড়ল, ‘টিকিটগুলো শ্যামলী শ্যামলী।’ কাউন্টারের পেছনে ছোট একটা ঘুলঘুলি, তার ফাঁক দিয়ে অর্ডার পৌঁছে দিতে হয়। নান-তন্দুরি হয়ে আসতে আরো দশ মিনিট, এই ফাঁকে কিছু কথা বলা যায়। কিন্তু কী কথা বলবেন? কাউন্টারে চোখ রেখে অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘আমি নেত্রকোনার।’ কথাটা ঠিক হলো না, নেত্রকোনা তাঁর কর্মস্থল, দেশের বাড়ি তো সুনামগঞ্জ। উচ্চারণে এখন আর সিলেটি টান নেই, অবশ্য দেশোয়াল ভাই হলে তার অবশ্য বোঝার কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
কিচেন থেকে অর্ডার এসে গিয়েছিল। একটা পলিথিন ব্যাগে তা সাবধানে ঢুকিয়ে তাতে ন্যাপকিন, গোটা চার-পাঁচ প্যাকেট নানা জাতের সস মুড়িয়ে রাখতে-রাখতে বললেন, ‘আমার নাম আবু হোসেন। বাংলায় কথা বলতে পারায় খুব ভালো লাগছে।’
মেয়েটি মৃদু হাসল, কোনো কথা বলল না। কাউন্টার থেকে টেক অ্যাওয়ের প্লাস্টিক ব্যাগ তুলে হাতব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, ‘আসি’।
এই সময়টা টেক অ্যাওয়ের অর্ডারের টেলিফোন আসে, দু-চারজন খদ্দের অর্ডার সংগ্রহ করতে নিজেরাই রেস্তোরাঁ পর্যন্ত দৌড়ায়। তাদের একজন, সেও সিলেটের, ততক্ষণে কাউন্টারের সামনে। হাসি চলে যাচ্ছে, তার দিকে পেছন ফিরে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে অযাচিতভাবেই প্রশ্ন করলেন, ‘এই ফুরিরে চিনেননি?’
উত্তর দিলেন না, কথাও বাড়ালেন না। লোকটির টেলিফোন অর্ডার এসে গিয়েছিল, নিঃশব্দে তা তুলে দিলেন।
‘এই ফুরি হিন্দু, আমার বাইচ্চার স্কুলো ফড়ায়,’ লোকটি হড়বড় করে কথাগুলো বলল।
সে-সন্ধ্যায় হাসির কথা আর মনে পড়েনি, মনে পড়ারইবা কী আছে? মেয়েটি শহীদ কাদরীর নাম দেখে চট করে সমর সেনের কথা বলল, ব্যাপারটা তাঁর কাছে বেশ আগ্রহোদ্দীপক মনে হয়েছিল, কিন্তু এই নিয়ে ভাবার সুযোগ পাননি। রাতে পুরো রেস্তোরাঁ একসময় ফাঁকা হয়ে এলে সে-বইটা তুলে নিলেন। তখন হাসির কথাটা মনে পড়ল।
একজনের 888sport app download apk পড়ে অন্য কারো কথার অনুরণন তাতে আমরা খুঁজি সম্ভবত এই কারণে যে, পাঠক হিসেবে নিজের ক্রেডেনশিয়াল তাতে পোক্ত হয়, নিজের কাছেই। গল্প-888sport alternative link বা 888sport live পড়ে তেমন কোনো ভাবনা মাথায় জাগে না, যদি সরাসরি অনুকরণের ছাপ তাতে না থাকে। কিন্তু 888sport app download apkর কথা এলেই তুলনা খুঁজি, অন্যের প্রভাব নিরীক্ষণ করি। আবু হোসেন এই ব্যাপারটায় নিশ্চিত যে, অন্যসব পাঠকের তুলনায় 888sport app download apkর পাঠক অনেক বেশি আত্মমুগ্ধ। কেউ-কেউ আছেন কোনো প্রম্পট ছাড়াই 888sport sign up bonus থেকে পাতার পর পাতা 888sport app download apk শোনাবে, সেও তো আত্মমুগ্ধতা থেকে। তিনি ভাবলেন, মেয়েটি কি তাঁর কাছে নিজের জ্ঞান ফলিয়ে গেল?
আলম ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। সুযোগ পেলেই 888sport sign up bonus থেকে 888sport app download apk শোনাতেন, সবটা যে জ্ঞান ফলানোর জন্য, তা নয়। অধিকাংশ কথাই হয়তো নিজেকে নিজে বলা, অন্যকে শুনিয়ে বললে যা কানে এসে লাগে, বুকের ভেতরেও তার ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে পাড় ছুঁয়ে যায়। তাতে নিজের কথার এফারমেশন মেলে। আলম ভাই বলতেন, ‘বুঝলা মিয়া, 888sport app download apkর আসল শক্তি হইল শব্দে। শব্দ মানে শুধু পার্ট অব স্পিচ না, শব্দ মানে ধ্বনি। কান দিয়া শুনো, একটা খলখল পানি পড়ার আওয়াজ পাইবা।’ এ-কথা বলে তিনি সত্যি-সত্যি কানটা কিছুটা উৎকর্ণ করে যেন কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছেন, এমনভাবে অনির্দিষ্টভাবে তাকাতেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস বুঝি আপনা হতেই নিঃসরিত হলো। আলম ভাইয়ের কথা মনে পড়ল, আজ এখানে থাকলে তিনি তুলকালাম কান্ড করতেন। শহীদ কাদরীর 888sport app download apkর সঙ্গে সমর সেনের তুলনাটা কেন সুপারফিশিয়াল, সে-কথা বলে তর্ক জুড়ে দিতেন। ‘888sport app download apk হইল মেয়েমানুষের শরীরের মতো। সবই তো এক অথচ কোনো কিছুই এক না। এইটা যে বোঝে না, তার 888sport app download apk পড়নের কাম নাই,’ সোজাসুজি বলে দিতেন।
লোয়ার ম্যানহাটনের এই পাড়ায় খুব বেশি বাঙালি থাকে না, তবে দু-চার ব্লক পরে কো-অপারেটিভ কমপ্লেক্সে দু-চারজন আছে। আশপাশে আরো দু-চারটে বাঙালি-ভারতীয় রেস্তোরাঁ আছে, সেসব রেস্তোরাঁর মালিক-ম্যানেজারের কেউ-কেউ সেখানে ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। পরে জেনেছেন, হাসি তার একটাতে সাবলেট নিয়ে থাকে, আরো তিনজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। নিজের একখানা রুম আছে, কিন্তু বাকি সবই অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। মাস শেষে পানি-গ্যাসের বিলটাও। কোনো এক সপ্তাহে, ঠিক সেই শুক্রবারে, রেস্তোরাঁয় এসে আবু হোসেনকে হাসি নিজেই এসব কথা বলেছিল। বিল দেওয়া নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কী একটা কথাকাটাকাটি হয়েছিল, তা নিয়ে মেজাজটা খিঁচড়ে ছিল, আবু হোসেনকে সে-কথাটাই গায়ে পড়ে শোনাল।
কিছুটা অবাক হয়েছিলেন। এমন তো কোনো পরিচয় নয় যে, নিজের গার্হস্থ্য সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করবে। পরে বুঝেছিলেন, কথাগুলো আসলে সে নিজেকে নিজেই শোনাচ্ছিল, মনের ভেতর একটা ঝাঁজ ছিল, কাউকে না শোনানো পর্যন্ত সে শান্তি পাচ্ছিল না। কোনো কবি যেমন কিছু একটা লেখার পর অন্য কাউকে না শুনিয়ে স্বস্তি নেই। আলম ভাই সম্ভবত একেই বলতেন পোয়েটিক এফারমেশন।
সেদিনই প্রথম জানা গেল হাসি ইংরেজি 888sport live football নিয়ে তাঁরই মতো 888sport app বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পড়েছে, পরে আমেরিকায় এসে এমএ ডিগ্রিটাও নিয়েছে, তবে 888sport live footballে নয়, এডুকেশনে। তাতে স্কুলে চাকরি জোটানো সহজ, হাসি অবশ্য নিজ মুখে সে-কথা বলেনি। পরের তিন-চার মাস প্রায় প্রতি সপ্তাহে একবার দেখা হয়েছে, তাও কয়েক মিনিটের জন্য। কিন্তু প্রতিবারই আলাপটা ঘন হয়েছে, তাও ওই 888sport app download apkকে ঘিরে। একে অপরের অন্য কোনো ব্যক্তিগত কথা কেউ কখনো বলেননি, বলার প্রয়োজনও পড়েনি।
আবু হোসেন বরাবর সকালে উঠে কফি বানাতে-বানাতে অনুপস্থিত পরীর সঙ্গে কথা বলতেন। সারাদিন ফাঁকে-ফাঁকে অনেকবারই তাঁর পরীর সঙ্গে কথা হতো। কিন্তু ক্রমশ পরীর জায়গায় হাসি এসে আসন গাড়ছে, এ-জিনিসটা তাঁর আদৌ নজরে পড়েনি। পরীর সঙ্গে সাংসারিক নানা বিষয়, রেস্তোরাঁর গল্প থেকে দেশের রাজনীতি, কোনোটাই বাদ যেত না। কিন্তু হাসির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কথা হয় 888sport live football নিয়ে। তিনি নিজের মনে হাসিকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে তর্ক জুড়তেন। কখনো পরী ও হাসিকে একে অপরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন, ‘বুঝলে পরী’, বলার পরও মাথার মধ্যে কিন্তু হাসির ছবিটি।
হাসি প্রায় দিনই নিত্যনতুন বই সঙ্গে নিয়ে আসত। কাউন্টারের সবচেয়ে কাছের টেবিলটিতে বসে তার সেই পুরনো চটের ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে তাতে ডুবে যেত। আড়চোখে তাকে তাকিয়ে দেখেছেন, কী বই পড়ছে, তা জানার চেষ্টা করতেন। অধিকাংশ বই-ই শিক্ষকতা বিষয়ক, পরে জেনেছেন হাসি কী একটা উচ্চতর ডিগ্রির জন্য তৈরি হচ্ছে, তারই প্রস্ত্ততিপাঠ।
বই পড়া আবু হোসেনের নিজেরও পুরনো অভ্যাস, বিদেশে এসে সে-অভ্যাস আরো পোক্ত হয়েছে। এ-দেশে সস্তায় সেকেন্ডহ্যান্ড বই পাওয়া যায়, তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সেসব কিনে সেলফ ভরে তুলেছেন। এই বই কেনা শুরু হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। চাকরি পাওয়ার দিনকয়েকের মধ্যে তিনি একাই হেঁটে গ্রিন উইচ ভিলেজ দেখতে এসেছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর কল্যাণে সে-ভিলেজের অল্পবিস্তর গল্প তাঁর জানা। এক বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর কাচের জানালায় সাজানো বই দেখছিলেন। হঠাৎ এক লোক, পরনে লম্বা স্প্রিং কোট, সে-দোকান থেকে হনহন করে বেরিয়ে এসে কাচের সেই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল, ‘নিউ বুক, জাস্ট ওয়ান ডলার।’ বুঝতে বাকি রইল না বইখানা সদ্য সে হস্তগত করেছে এই বইয়ের দোকান থেকে, তার সামনে দাঁড়িয়েই এখন সেই বই বিক্রির চেষ্টা করছে। গলা বাড়িয়ে দেখলেন জোয়ান বায়েজের আত্মজীবনী, অ্যান্ড এ ভয়েস টু সিং উইথ। 888sport appয় থাকতে এই মহিলার দু-একটি গান তিনি শুনেছেন, বিশেষত একাত্তর নিয়ে তাঁর সেই বিখ্যাত ব্যালাড – 888sport apps, হোয়েন দ্য সান সিংকস ইন দ্য ওয়েস্ট, ডাই আ মিলিয়ন পিপল ইন দ্য 888sport apps। এ-গান জর্জ হ্যারিসনের কনসার্ট ফর 888sport appsের জন্য বাঁধা হয়েছিল, কিন্তু সে-আসরে তাঁর গাওয়া হয়নি। কেন, কে জানে। এই মেয়ে 888sport appsের বন্ধু, সে-কথা মনে হতেই পকেট থেকে এক ডলার বের করে প্রায় চিলের মতো ছোঁ মেরে বইখানা বাগিয়ে নিলেন।
নতুন-পুরনো বই নিয়ে এই শহরে আবু হোসেনের আরো নানারকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। মাসখানেক আগে দেখা গেল তাঁর দোকানের সামনেই গুটিকয় পুরনো বই, জামা-কাপড় সাজিয়ে দোকান দিয়েছে এক কালো লোক। কালো লোক মানে আফগানিস্তান আমেরিকান, পলিটিক্যালি কারেক্ট এই নামকরণটি তিনি এখনো রপ্ত করে ওঠেননি, যদিও 888sport app বাঙালির মতো অভদ্রভাবে ‘কাউলা’ বলাও তাঁর ধাতে নেই। লোকটি সম্ভবত হোমলেস। তাকাতেই নজরে এলো ভজনেসেনস্কির 888sport app download apk সংগ্রহ, অ্যান্টি-ওয়ার্ল্ডস। প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, বইখানা হাতে নিয়ে দেখেন কেউ একজন গোল গোল অক্ষরে লিখেছে, দিস ইজ ফর ইউ, লেস্ট ইউ ফরগেট লাস্ট নাইটস কনভারসেশন। গতকালের কথা যাতে না ভুলে যাও, সেজন্য তোমাকে এই বই দিলাম। কী এমন কথা হয়েছিল যে, 888sport app download apkর বই দিয়ে তা 888sport app download for androidে রাখতে হবে? মাত্র এক ডলারে কিনে নিয়েছিলেন। সে-বই হাতে নিয়ে এত খুশি হয়েছিলেন, যেন দিগ্বিজয় করে ফেলেছেন, খুব ইচ্ছা হচ্ছিল এ-নিয়ে কথা বলেন। পরী নেই, আলম ভাই নেই। আছে এক হাসি, তাঁর কাল্পনিক বন্ধু। তাঁর সঙ্গেই ভজনেসেনস্কি নিয়ে সাতকাহন হয়ে গেল।
নিজে কোনোদিন রাজনীতি করেননি, ছাত্ররাজনীতিও নয়। তবে বন্ধুবান্ধবদের কেউ-কেউ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের দেখে-দেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারে আগ্রহ জন্মেছিল।সে-দেশের রাজনীতি নয়, রুশ ফিল্ম ও 888sport live football। চেখভ তাঁর নিজের ভাষায় পড়বেন, সেই উৎসাহ থেকে কয়েক মাস রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিলেন, কিন্তু ‘দা’ ও ‘নিয়েতে’র বাইরে খুব বেশিদূর এগোনো হয়নি। কিন্তু সে সুযোগে দেদার সোভিয়েত ফিল্ম ও বই পড়ার সুযোগ হয়েছিল। একটা ফিল্মের কথা খুব মনে পড়ে। মেয়েটি বারবার প্রেমে পড়ে, প্রেমে পড়তে-না-পড়তেই বিয়ে। অথচ একটা বিয়েও টেকে না। শেষমেশ কিছুটা বুড়োমতো একজনের প্রেমে পড়ে, যে তাকে জিজ্ঞেস করে, চারবার বিয়ে করেছিস, জীবনে পেলি কী? মেয়েটির মুখ যেন আঁধারে ঢেকে যায়, বলে, ‘মূর্খ, আমি কি শখে বিয়ে করি? আমি তো ভালোবাসা খুঁজছি, পাই না তো।’ একই রকম একটা গল্প ছিল চেখভের, সম্ভবত ‘আদরিণী’ বা ‘দুলালী’ এই নামে তার 888sport app download apk latest versionও হয়েছিল।
‘বুঝলে হাসি, মানুষের, তা সে ছেলে হোক বা মেয়ে, আসল অন্বেষণ হলো প্রেম।’ এমন একটা পন্ডিতি কথা কাল্পনিক হাসিকে তিনি শোনান, অথচ পরীর সঙ্গে বিয়ের আগে প্রেম নামক কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর নিজেরই ছিল না। ছিল না, তার মানে তো এই নয় তিনি প্রেমে আগ্রহী ছিলেন না। সাহসে কুলোয়নি, কাউকে দু-লাইন চিঠি লিখেও দেখেননি। অথচ মনের মধ্যে কত চিঠি পুষে রেখেছেন। পরী ঘরে আসতে তাকেই সবটা উজাড় করে দিয়েছিলেন। একটা মানুষ, তার সঙ্গে জানা নেই, শোনা নেই, কী করে এত সহজেই আপন হয়ে ওঠে? আবু হোসেনের মনে হয়েছে, মানুষ আসলে কখনো পুরোপুরি একা নয়। একদম জন্মের গোড়া থেকেই তার একটা জুড়ি থাকে। সারাজীবন মানুষ সেই জুড়িকেই খোঁজে, কেউ পায়, কেউ পায় না। আচ্ছা, হাসি কি হতে পারে সেই জুড়ি?
সোমবার তাঁর সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ছুটি হলেইবা কি, তাঁর তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ফলে হয় ঘরে শুয়ে-বসে, নয়তো বিকেলের দিকে বড়জোর পাড়ার ছোট পার্কটিতে বই বা খবরের কাগজ নিয়ে বসা। গ্রীষ্মকালটা এ-দেশে বড় সুন্দর, ভারি সবুজ আর রকমারি ফুলের বাহার, একেবারে চোখ জুড়িয়ে যায়। পরী খুব ফুল ভালোবাসত। নেত্রকোনার একফালি বারান্দা, সেখানে হরেকরকম ফুল টবে চাষ করত। পাড়ার ব্যাংকের ম্যানেজারের স্ত্রী অর্কিড বানানো জানতেন, তাঁর কাছ থেকে সে-888sport live chatটা পরী শিখে এসে নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট করত। মাঝেমধ্যে আবু হোসেন বিরক্ত হতেন। কী হবে এত ফুল নিয়ে সময় ব্যয় করে! পরী সকৌতুকে তাকে সৈয়দ হকের বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালার একটি পাতা খুলে দেখিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-বইটি ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়, কখনো-সখনো বগলদাবা করে ঘুরতেন। তাতে এমন একটা লাইন, ফুল কে না ভালোবাসে! পেনসিলে মোটা করে দাগিয়ে রেখেছিলেন, কে জানে কেন। পরী তাঁকে সেই বই খুলে লাইনখানা দেখাত আর মুখ টিপে হাসত।
হাসির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। রেস্তোরাঁর বাইরে তাঁদের দুজনের কখনো দেখা হয়নি, কোনো কথাও হয়নি। সেদিন ম্যানহাটনে পাড়ার সেই ছোট পার্কে বসে ছিলেন, হাতে যথারীতি একখানা বই। কয়েক সপ্তাহ ধরে শহীদ কাদরীর 888sport app download apkসমগ্র নিয়ে আছেন, কখনো পড়েন মনে-মনে, কখনোবা সামান্য উচ্চৈঃস্বরে। একজন বয়স্ক লোক নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলছে, তা দেখে সম্মুখ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কোনো-কোনো মহিলা বা পুরুষ সকৌতুকে তাকিয়ে দেখেছে। ভ্রুক্ষেপ করার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি আবু হোসেন।
একদম হঠাৎ হাসির সঙ্গে দেখা। হনহন করে যাচ্ছিল মেয়েটি, হয়তো দেখেছে বা দেখেনি, কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো। ‘আরে, আবু ভাই, আপনি?’
হাসির তাঁকে আবু ভাই নামে ডাকা সেই প্রথম।
আবু হোসেন হাতের বইখানা গুটিয়ে রেখে হাসির পায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, ‘এই তো, ছুটির দিন।’ হাসি রংচটা নীল জিনস পরেছিল, পায়ে হালকা বাদামি রঙের ওয়াকিং শু। কিছুটা ইতস্তত করে বেঞ্চে তাঁর পাশে এসে বসল। কাঁধে আজ আর সেই ঝোলা নেই, তার বদলে পলিথিনের দুটি ব্যাগ, গ্রোসারি সেরে বাড়ি ফিরছে। পায়ের কাছে ব্যাগ দুটি নামিয়ে হাসি মুখে সে বলল, ‘ছুটি বুঝি?’ তারপর কিছুটা অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘কী, আজকেও শহীদ কাদরী?’
যেন মহাঅপরাধ হয়েছে, সলাজে বইখানা মুড়ে রেখে বললেন, ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ পড়ছিলাম।
‘সেই নুহের প্লাবন তো?’ কপালের ওপর একগোছা বেয়াড়া চুল বাঁ-হাতে সরিয়ে, যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, এরকম একটা ভাব নিয়ে হাসি জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আপনার কাছে কখনো মনে হয়েছে এই 888sport app download apkয় কোথাও যেন ওয়েস্টল্যান্ডের সঙ্গে মিল আছে?’ কথা বলা শেষ হলে গ্রোসারির ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা পানির বোতল বের করল হাসি।
ওয়েস্টল্যান্ড এক অতিআস্তিক, খ্রিষ্টমুখী অসুখী মানুষের আর্তচিৎকার, যে মানুষে ভালোবাসা না খুঁজে তা খোঁজ করে ঈশ্বরে। 888sport app download apkর শেষে ‘শান্তি, শান্তি, শান্তি’ বলে আহাজারি হঠাৎ অভিজ্ঞানপ্রাপ্ত এক লোকের বিস্ময় উচ্চারণ নয়, সভ্যতার ভ্রষ্টতায় উদ্ভ্রান্ত ও অনিশ্চিত আশাহত এক যুবকের হাল ছেড়ে দেওয়ার বেদনার্ত স্বীকৃতি। এর সঙ্গে শহীদ কাদরীর মিল কোথায়?
মুখে বললেন, ‘কই, না তো। দুটো দুই ভিন্ন ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার ডাইসেকশন। মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। এলিয়ট অনেক বেশি বিষণ্ণ, তার তুলনায় শহীদ কাদরী রীতিমতো আশাবাদী, অপটিমিস্টিক।’
বড়-বড় চোখ করে তাকাল হাসি, তাতে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা কৌতুক। এই লোক, যার মুখ দিয়ে হ্যাঁ-না তার বাইরে কখনো পুরো একটা বাক্য সে শোনেনি, আজ হঠাৎ পুরো একটা প্যারাগ্রাফ!
হাসি হাতের পানির বোতল সরিয়ে রেখে, গ্রোসারির ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে এককাঁদি কলা বের করল। ‘খাবেন?’ এই বলে নিজে একটা কলা নিয়ে অন্যটা আবু হোসেনের দিকে বাড়াল। নিতে খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, কলার একটা প্রতীকী অর্থ আছে, তিনি জানেন, কিন্তু সসংকোচে হাত নেড়ে না জানালেন। হাসি সে-কলা ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নিজের হাতে-ধরা কলায় এক কামড় দিয়ে বলল, ‘আজ দুপুরে লাঞ্চ হয়নি। বেজায় খিদে পেয়েছে।’
তারপর, যেন ইতোমধ্যে অনেক তর্কাতর্কি হয়েছে এই বিষয়ে, এমনভাবে খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, ‘আপনি একটা জিনিস এড়িয়ে যাচ্ছেন। কবি যেমন কল্পনা করে, তাঁর সে-কথা বুঝতে হলে পাঠককেও কিছুটা স্বাপ্নিক হতে হয়। কবির প্রকৃত কল্পনার কথা পাঠকের জানার কথা নয়, তা জানাটা প্রয়োজনও নয়। পাঠক নিজেই নিজের মতো করে কবির স্বপ্নের অর্থ সাজিয়ে নেবে। অন্যথায় প্রেমের 888sport app download apk পড়ে আমরা এত আবেগতাড়িত কেন হই? যে-প্রেমের কথা কবি বলেন, সে তো আমাদেরও, নাকি? আল মাহমুদ যখন 888sport app download apkকে মক্তবের আয়েশা আখতার, না কী যেন নাম, বলেন তখন পাঠকের মনেও তো নিজের কোনো আয়েশা আখতারের একটা ছবি ভেসে ওঠে, নাকি?’
একটানা, প্রায় কোনো যতি ছাড়া কথাগুলো বলে হাসি থামল। ঠিক বোঝা গেল না হাসি আসলে কী বলতে চাইছে, তর্ক তো শহীদ কাদরীর 888sport app download apk নিয়ে, পাঠক ও কবির অভিপ্রায়ের ভিন্নতা নিয়ে নয়। বেঞ্চের পাশে রাখা পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে এক ঘড়া পানি খেয়ে, প্রায় অনির্দিষ্ট একটি স্মিত হাসি দিয়ে সে বলল, ‘বৃষ্টি বৃষ্টি পড়তে পড়তে আমার কিন্তু ওয়েস্টল্যান্ডের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে কোনো কষ্টই হয়নি। সেজন্য একটু কল্পনার চৌহদ্দিটা বাড়ানো চাই।’
‘বইটা দিন’, এই বলে সম্মতির অপেক্ষা না করে আবু হোসেনের হাঁটুর ওপর মোড়ানো 888sport app download apkর বইখানা তুলে নিল হাসি। হাঁটুতে তার হাতের মৃদু স্পর্শও বুঝি লাগল অথবা লাগল না। ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ 888sport app download apkখানা বের করে বলল, ‘আপনার কি কখনো এ-কথা মনে হয়নি, এলিয়ট যে ধূসর মরুভূমির কথা বলেন, যে নষ্টভূমির কথা বলেন, শহীদ কাদরীর প্লাবন বস্ত্তত সেই মরুভূমি, শুধু তার কনটেক্সটটুকু আলাদা। ইট-পাথরের লন্ডন, তাতে প্রেম নেই, বিশ্বাস নেই, আশা-জাগানিয়া নেই। প্লাবনে ভেসে যাওয়া 888sport app, লোভী, মাতাল-সুদখোরের এই শহর, সেও তো এক রকমের নষ্টভূমি। তবে তফাত একটা আছে। এলিয়ট এই হতশ্রী নগর থেকে নতুন জীবনের কোনো প্রত্যাশা করেন না, এখান থেকে তিনি পালাতে চান, প্রার্থনা করেন সুদূর ভারতের গঙ্গার ধারে জেগে উঠতে। জ্বলন্ত শহুরে অঙ্গার থেকে নিস্তারের জন্য ঈশ্বরের কাছে আবেদন করেন, প্রভু, আমাকে উন্মীলিত করো। কিন্তু শহীদ কাদরী এই নগরের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করেন না। এই নগর তাঁর এবং তাকে শুচিস্নিগ্ধ করার দায়িত্বও তাঁর। যে-প্লাবনে তাঁর শহর ডুবছে, কবি চান তা ভাসিয়ে নিয়ে যাক সব ক্লেদ, সব বর্জ্য। সে শুচিস্নিগ্ধ হোক।
আপনার কি কখনো মনে হয় না, ‘প্লাবনের প্রতীকে কবি আসলে এক অনাগত বিপ্লবের কথা বলছেন, যে-বিপ্লবের অপেক্ষায় কবি, অপেক্ষায় আমরাও।’
আবু হোসেনের মুখে কথা সরে না। হাসির বলা সব কথা যে তাঁর কানে ঢোকে এমনও নয়, তার দিকে সরাসরি না তাকিয়ে গোগ্রাসে কেবল কথাগুলো তিনি গিলছিলেন। মেয়েটি এমন গুছিয়ে কথাগুলো বলল, তাতে যুক্তির চেয়ে আবেগ যদিওবা বেশি, তবু তাতে নির্দ্বিধায় তিনি আস্থা রাখতে পারেন। মনে-মনে একটা পালটা যুক্তি তিনি খুঁজছিলেন, হাসির তোলা যুক্তি ব্যবহার করেই তিনি বলতে পারতেন, হতে পারে ঊষর মরু ও প্লাবনে কোনো তফাৎ নেই, কিন্তু পৃথিবীর দুই প্রান্তের এই দুই কবি তো সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আপনিই তো বলছেন, একজন পালাতে চায়, অন্যজন, জীবনকে আঁকড়ে ধরে। একজন মানবতায় আস্থাহীন, অন্যজন মানুষকে ভালোবাসেন, তার জন্য বাসযোগ্য নগর নির্মাণ করতে চান। তাহলে মিল কোথায়?
একটা কথাও বলা হয় না।
যেন লেকচার শেষ, এভাবে বইখানা ফের তার হাঁটুর ওপর মুড়ে রেখে হাসি উঠে দাঁড়ায়। প্রথমে পানির বোতলটা তুলে নিয়ে একটা প্লাস্টিক ব্যাগে ঢোকায়, তারপর কিছুটা নুয়ে দুহাতে গ্রোসারির ব্যাগ দুটো তুলে নিয়ে বলে, ‘চলি’।
চলে গেল মেয়েটা, পেছন ফিরে একবার তাকালও না। স্থাণুর মতো বসে রইলেন আবু হোসেন। সন্ধ্যার পরও অনেকক্ষণ পার্কের বেঞ্চে একলা বসে থাকলেন। মাথার মধ্যে কেবলি হাসির কথাগুলো পুরনো রেকর্ডের মতো বারবার বাজিয়ে তিনি শুনলেন। সেদিনই প্রথম লক্ষ করেছিলেন হাসির ওপরের পাটির বাঁদিকে একটি দাঁত গ্যাজা। হাসলে কখনো-কখনো সে দাঁত নজরে আসে। পরীরও একটি দাঁত ছিল গ্যাজা, নিচের পাটির, তা নিয়ে সে কিছুটা বিব্রতবোধ করত। আবু হোসেনের মনে হতো ওই গ্যাজা দাঁতের জন্য পরীকে হাসলে এমন সুন্দর দেখায়। বাসায় ফিরে এসেও সে-ঘোর কাটল না। যেন হাতের কাছে কোনো টেপরেকর্ডারে হাসির প্রতিটি কথা তুলে এনেছেন, এমনভাবে তা বারবার বাজিয়ে শুনলেন। প্রতিটি শব্দ, এমনকি একটা লম্বা বাক্য শেষে খুক করে ছোট একটা গলা খাঁকারি দেওয়ার যে অভ্যাস হাসির, তাও অবিকল তিনি শুনতে পাচ্ছেন।
অন্ধকার ঘরে, আলো না জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন। পরীর মৃত্যুর পর থেকে একাকিত্বকে বিনাতর্কে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন, এমনকি এক ধরনের বিলাসী দুঃখকে তাঁর নিয়তি ভেবে তাতে আত্মসমর্পণ করে বসেছিলেন। বিছানায় ঠান্ডা বালিশখানা আঁকড়ে ধরে এই প্রথম তার খুব কাঁদতে ইচ্ছা হলো। একবার অস্ফুট স্বরে বললেন, পরী।
এরপর কিছুদিন কেটে গেছে, হাসি যথারীতি শুক্রবার সন্ধ্যায় তার টেক অ্যাওয়ের অর্ডার দিতে এসেছে, হাই-হ্যালো হয়েছে, তার বেশি নয়।
সেদিন বিকেলে কাউন্টারে একলা বসে ছিলেন। খাঁ-খাঁ রেস্তোরাঁ, একজনও খদ্দের নেই। ভজনেসেনস্কির অ্যান্টি-ওয়ার্ল্ডস বইখানা উলটেপালটে দেখছিলেন। ডব্লিউএইচ অডেনের একটি ভূমিকা আছে, তাঁর 888sport app download apk latest versionে 888sport app download apkও রয়েছে। সোভিয়েত আমলের কবি, অথচ সরাসরি কোনো রাজনীতি নেই। অডেন ভূমিকায় সতর্ক করে দিয়েছেন, এই কবির 888sport app download apkয় আইডিওলজি খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করো না। স্বদেশের জন্য তাঁর প্রবল ভালোবাসা এই কবির প্রতিটি 888sport app download apkয়, সে-ভালোবাসার অন্য কোনো অর্থ নেই। অডেনের এই পূর্বঘোষণা মাথায় রেখে দু-চারটে 888sport app download apk পড়ার চেষ্টা করলেন, মাথায় ঢুকল না। বস্ত্তত, 888sport app download apk latest versionে 888sport app download apk তার প্রাণশক্তি হারায়, যা জোটে তা বড়জোর সে-প্রাণের খোলস, তার চলটা ওঠা গাছের বাকল।
সন্ধ্যার দিকে এক ভদ্রলোক রেস্তোরাঁয় ঢুকলেন। দেখে মনে হলো বাঙালি, ছোটখাটো, তামাটে রঙের, সুটকোট পরা, হাতে অফিসের ব্যাগ। হনহন করে কাউনটারের কাছে এসে কিছুটা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, এক কাপ কফি আর দুটো শিঙাড়া হবে।
বাংলায়ই বললেন, বোঝা গেল পশ্চিমবাংলার মানুষ। উচ্চারণে একটা ভিন্ন টান, মঞ্জুর এক মামা খুব কায়দা করে বাংলা বলত, অনেকটা সেই ধাঁচের, শুনেই বোঝা যায়, কী যেন কৃত্রিম একটা ব্যাপার। মঞ্জু বলত, কনস্টিপেশনের রোগী, কথা বলছে চিবিয়ে-চিবিয়ে।
কিচেনে অর্ডার পৌঁছে দিয়ে কাউন্টারে ফিরে এসে আবু হোসেন দেখেন ভদ্রলোক তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে। আপনি বসুন, ‘মিনিট পাঁচেক লাগবে,’ হাত দিয়ে সামনের টেবিলখানা দেখিয়ে দিলেন আবু হোসেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় এই টেবিলেই এসে বসে হাসি।
‘আপনি কি এই এলাকায় অনেকদিন?’ হাতের ব্যাগখানা কাউন্টারের ওপর নামিয়ে রেখে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক। কথা বলার সময় ভ্রূ কোঁচকানোর একটা অভ্যাস আছে লোকটার, চোখজোড়া কিছুটা গোল-গোল হয়ে আসে, মনে হয় এক ধরনের বিরক্তি রয়েছে।
‘আমি হাসি চক্রবর্তী নামে এক বাঙালি মহিলাকে খুঁজছি। আমার স্ত্রী। না, ঠিক স্ত্রী নয়, প্রাক্তন স্ত্রী। কিছু ইন্স্যুরেন্সের কাগজপত্র আছে ওর কাছে, সেগুলো দরকার।’ হড়বড় করে কথাগুলো বলে কোঁচকানো ভ্রূ ও গোল গোল-চোখ নিয়ে তাকালেন তিনি।
তারপর ডান হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘মানস দাশগুপ্ত। ডাক্তার, আমি মিশিগানে থাকি, আজকেই নিউইয়র্কে এসে পৌঁছেছি এই মহিলার খোঁজে। এ-পাড়াতেই থাকে, কিন্তু ঠিক কোন বাড়িটা, তা আমার জানা নেই। আমার কাছে ছবি আছে, দেখবেন?’
জবাবের অপেক্ষা না করে ব্যাগ খুলে পাসপোর্ট সাইজের একখানা ছবি বের করলেন। বেশ আগের ছবি, ভীষণ রোগা এক কিশোরী, চোখের কোণে কালি, মনে হয় কত রাজ্যের ক্লান্তি। না বলে দিলে বোঝা অসম্ভব যে এটি হাসির ছবি।
শিঙাড়া ও কফি এসে গিয়েছিল। আবু হোসেন টেবিলে দিয়ে আসতে উদ্যত হয়েছিলেন, ভদ্রলোক দু-হাত তুলে বারণ করলেন, ‘না, মশাই, এখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই খাই। আপনার সঙ্গে কথা বলা যাবে।’
কিঞ্চিৎ স্থূলকায়, গলায় টাই থাকায় হাঁসফাঁস করছিলেন। ছবিটা ফেরত নিয়ে বললেন, ‘বউ বলছি বটে, কিন্তু কোনোদিন সংসার করা হয়নি। হবে কী করে মশাই, ও মেয়ে কি সংসার করার যোগ্য!’ বড় হাঁ করে শিঙাড়ায় কামড় বসালেন, তার কিছুটা ভেঙে কাউন্টারের ওপর পড়ায় নিজেই হাত দিয়ে তা সরিয়ে দিলেন। কপালে ঘাম জমেছিল, ন্যাপকিন দিয়ে তা মুছে কফির কাপে চুমুক দিলেন। টকাশ-টকাশ শব্দ হলো, আবু হোসেনের মনে হলো কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। পরে বুঝলেন হাতুড়ি পেটানোর শব্দ তার কানে নয়, নিজের বুকের ভেতর বাজছিল।
‘আপনি তো 888sport appsের, নাকি? আমি ভাই কলকাতার, তবে আদি বাড়ি বরিশালে। আমরা দাশগুপ্ত, কমল দাশগুপ্ত আমার এক রকমের মামা হন। কি, চিনলেন তো, আপনাদের ফিরোজা বেগমের স্বামী। শুনেছি 888sport appতেই মারা গেছেন। নামটা পর্যন্ত বদলে ফেলেছিলেন, কামাল উদ্দিন না কি যেন নাম দিয়েছিলেন। বড় মাসি কত করে বলেছিলেন, যাসনে, যাসনে। কে শোনে কার কথা?’
এই লোক হাসির স্বামী, অথবা প্রাক্তন স্বামী, ভাবতেই আবু হোসেনের গা রি রি করে ওঠে। আস্ত গাড়ল, ছ-ছ করে কথা বলে, কফি খান, মনে হয় যেন ডাবের পানি খাচ্ছেন। হাসির সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা সরলো না। ভদ্রলোক আবারো এক কামড় দিলেন শিঙাড়ায়। যথারীতি তা চুর, চুর করে ভেঙে পড়ল কাউন্টারের ওপর।
‘ওই মামার পরিবারের কেউ একজনের কথাতেই তো মশায় হাসিকে বিয়ে করতে হলো। তখন কি জানি ওই মেয়েকে একাত্তরে পাকিস্তানিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল।’
সে-কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন আবু হোসেন।
‘বলব কী মশাই, হাসির বাবা হলেন আমার বড় মামার বন্ধু, 888sport appর কোনো একটা কলেজের অধ্যাপক। কুলীন ব্রাহ্মণ, পড়াশোনা জানা পরিবার, লতায়-পাতায় জড়িয়ে কী রকম আত্মীয় বোধহয় হন আমাদের। দেখতে-শুনতে তো মন্দ না। আমরা লম্বা মেয়ে খুঁজছিলাম, জুটে গেল। ব্যস, আমরা এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। আমি তখন বিদেশে আসার জন্য তিন পায়ে খাড়া। এদিকে মা-বাবা হত্তা দিয়ে বসে আছেন বিয়ে না করে বিদেশ যাওয়া চলবে না। সেই বরিশালের গ্রামের বাড়ি গিয়ে বিয়ে হয়েছিল। অথচ সে-সময় কেউ ঘুণাক্ষরেও বলেনি একাত্তরে ওকে পাকিস্তানি আর্মি ধরে নিয়ে গিয়েছিল।’
আবু হোসেনের চোখ আঁধার করে আসে। মানস দাশগুপ্তের একটা কথাও তাঁর কানে আসে না। তিনি হাসির মুখখানা মনে করার চেষ্টা করেন, ইচ্ছা হয় ওর হাতখানা একবার নিজের হাতে তুলে নেন।
‘বিয়ের পরে হলো কি মশাই, হাসি দেখি আমার বিছানা ছেড়ে মাটিতে শোয়। আমি প্রথম-প্রথম এ নিয়ে রা করিনি। বাচ্চা মেয়ে, এখনো রেডি না। এক সপ্তাহ পরে আমরা আমেরিকায়, এই নিউইয়র্কেই। ভাবলাম সব ফিরসে শুরু করা যাক। কোথায় কী, সেই আগের মতো। এখানেও তার গায়ে হাত দিতে গেলে কেঁদেকেটে একশেষ। জোর করে এক-আধবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু বলব কি মশাই, মেয়েমানুষের শরীর তো নয়, যেন ঠান্ডা বরফ।’
আবু হোসেনের বুকটা ভীষণ একা-একা লাগে। কানের মধ্যে একটা গোঙানির আওয়াজ শুনতে পান। মনে পড়ে যায় একাত্তরে, তখন তিনি 888sport appর মগবাজারে, লজিং থাকতেন। ছাদের ওপর চিলেকোঠায় রাতযাপন হতো। সেটা সম্ভবত জুন বা জুলাই মাস হবে। বাসার ঠিক উলটোদিকে একতলা পাকা বাসায় থাকতেন এক সওদাগর, লোকে তাকে এই নামেই ডাকত, কেন কে জানে। তার চার-চারটে মেয়ে, সবগুলো প্রায় এক বয়সী, সতেরো থেকে বিশ বছরের হবে। ছাদে দাঁড়িয়ে কখনো-সখনো তাদের ব্যাডমিন্টন খেলা দেখেছেন। খেলার সময় মেয়েগুলো ওড়না ছাড়াই দৌড়ঝাঁপ করত। আবু হোসেন জানতেন কাজটা শোভন নয়, তবু গুরুবক্ষা মেয়েগুলোর খেলা অনেকবারই তিনি লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখেছেন।
হঠাৎ এক রাতে মিলিটারি এসে হাজির। এমনিতে সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাটে লোকজনের যাতায়াত কম, আর্মি প্যাট্রল কার যখন-তখন টহল দিয়ে বেড়ায়। রাত বাড়লে রাস্তা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। আবু হোসেন কিছুই বোঝেননি প্রথম, অকস্মাৎ তাঁর কানে এলো মেয়েদের আর্তচিৎকার, মা, আমারে ধরো, ধরো।
কানের মধ্যে সেই চিৎকার যেন আবার ধক করে এসে লাগে। চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলেন আবু হোসেন। স্পষ্ট দেখতে পান মিলিটারির গাড়িতে মেয়ে চারটিকে টেনে তোলা হচ্ছে। তাদের ভয়ার্ত চিৎকার, ‘মা, আমারে ধরো,’ শব্দহীন আকাশকে খানখান করে দেয়। ইচ্ছা হয় এখনই ছুটে যান, তাদের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু অন্ধকার ঘরে জানালার পর্দা উঁচিয়ে দেখা ছাড়া বাইরে এক-পা নড়ারও সাহস হয় না। সৈনিকদের কোলাহল, খুকখুক হাসি, এক বৃদ্ধ – সম্ভবত মেয়েদের বাবা, পা ধরে আকুতি-মিনতি করছেন, আবু হোসেন আর দেখতে পারেন না। সব শেষের মেয়েটিকে এক রকম চ্যাংদোলা করে ছুড়ে ফেলে দিলো সৈনিকদের কেউ একজন। গাড়ির হেডলাইটে মেয়েটির মুখ চোখে পড়ে। মনের আয়নায় তাকে এখনো দেখতে পান আবু হোসেন, মনে হয় অবিকল হাসির মুখ।
মুখটা কান্নায় ভেঙে আসে, ইচ্ছা হয় এ-মুহূর্তে অসভ্য এই লোকটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন।
কফিতে আরেক সুখ টান দিয়ে মানস দাশগুপ্ত কথা বলতেই থাকেন। ‘এমনিতে কোনো দোষ নেই, ঘরের কাজকম্ম ভালোই সামলাত। কিন্তু রাত হলেই একদম কুঁকড়ে যেত, কোনো-কোনো দিন বাথরুমে বসে থাকত, হয়তো একা-একা কাঁদত। ডেফিনিটলি ওর মনের মধ্যে পুরনো একটা ভয় কাজ করত। মজা কি জানেন, ও যে পাকিস্তানিদের হাতে রেইপড হয়েছে, এ কথা আমি তখনো জানি না। থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম, তখন জানা গেল ব্যাপারটা। ভেবে দেখুন, কী জঘন্য একটা ব্যাপার! একটা ইউজড মেয়েলোক, কে জানে কতজন তাকে রেইপ করেছে, সে কি না আমার ঘরে! বিয়ের আগে কথাটা বলে নিবি না? একদম দু-নম্বরি কাজ।’
আবু হোসেনের ইচ্ছা হয় লোকটাকে কষে এক চড় কশান। তাঁর নিজের পা দু-খানা তখন অল্প-অল্প কাঁপছে, বুকের মধ্যে পাহাড় ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পান তিনি। ইচ্ছা হয় এখনই ছুটে যান হাসির কাছে, একবার তার হাতটা ধরেন, বলেন, লক্ষ্মী সোনা, এই তো আমি আছি।
সে-রাতে তাঁর একফোঁটা ঘুম হলো না। সারারাত এপাশ-ওপাশ করেছেন। তন্দ্রার মতো একটা ভাব হয়তো এসেছিল, কিন্তু সেই আর্তচিৎকার, মা আমারে ধরো, বারবার কানে এসে বাজে। অস্ফুট স্বরে, প্রায় গোঙানির মতো বারবার বলতে থাকেন, না, সোনা, ভয় পেয়ো না, আমি তো আছি।
রেস্তোরাঁর মালিককে বলে এসেছিলেন পরদিন তাঁর কাজে আসা হবে না। আরশাদ সাহেব এই হঠাৎ ছুটির বায়নায় বিস্মিত হয়েছিলেন। যে-লোক নিজের পাওনা ছুটির দিনেও রেস্তোরাঁয় বসে থাকে, নানা কাজে হাত লাগায়, সে নিয়মিত কাজের দিনে ছুটি চাইছে! খুব কম কথার মানুষ তিনি, অতি সজ্জন, আবু হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন লোকটার মনের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোসেন ভাই, শরীর ভালো তো?’ কথা না বলে মাথা নেড়েছিলেন আবু হোসেন, সে মাথা নাড়ার অর্থ দুটোই হতে পারে। কথা বাড়াননি আরশাদ সাহেব। ‘ঠিক আছে, আমি ম্যানেজ করে নেবানে,’ বলে তাঁর পিঠে আলগোছে চাপড় দিয়েছিলেন।
দুই
সকাল-সকাল উঠে পড়লেন আবু হোসেন। গত দশ বছরে সম্ভবত এই প্রথম সকালে ওঠা। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালেন, ভোরের নরম আলো মাটি ভেজাচ্ছে, সামনের পপলারগাছের পাতায় সে-আলোর মাখামাখি, কেমন মিষ্টি একটা আভা তাতে ছড়ানো। বেলাল ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। একদিন পত্রিকা অফিসে, সম্ভবত কিঞ্চিৎ মদ্যপানের পর, এক বন্ধুর সঙ্গে বেজায় তর্কের পর বলেছিলেন, জানবেন, সকাল হলে এই ক্লেদ, এই বর্জ্য, সব মুছে যাবে। সব আবার নতুন করে শুরু হবে, সবকিছু শুচি, সবকিছু সুন্দর। কেন বলেছিলেন, তা এখন ঠিক মনে নেই, কিন্তু তাঁর বলা কথাটা মনে ধরে গিয়েছিল। আবু হোসেন অনেকবারই সে-কথা নিজেকে শুনিয়েছেন, কিন্তু নতুন ভোরের প্রতি তাঁর আস্থা জাগেনি। ভোর হয়, কিন্তু গতকালের বেদনার তো উপশম হয় না! বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো সে ঠায় বসে থাকে, সকালের রোদ এত সুন্দর, তা দেখতেও মন চায় না।
কিন্তু আজ তার ইচ্ছা হলো হাসির পাশে গিয়ে দাঁড়ান, তাকে বলেন, দেখো, কেমন সুন্দর সকাল। গতকালের সব ক্লেদ, সব বর্জ্য মুছে গিয়ে চারদিকে সব কেমন নরম আলোয় ভরে গেছে।
দাশগুপ্ত লোকটার সঙ্গে কথা বলার সময়েই তিনি মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন, পরদিন বিকেলে হাসির বাসায় যাবেন। দুই ব্লক দূরেই হাসির কো-অপারেটিভ অ্যাপার্টমেন্ট, সেখানে একবার তার সঙ্গে যেয়ে কথা বলবেন। কিন্তু কী কথা বলবেন, কেন এসেছেন, তাইবা কী করে বুঝিয়ে বলবেন? মানস দাশগুপ্তের নাম উচ্চারণেও তাঁর বিবমিষা জাগে, লোকটি তার খোঁজে এসেছিল সে-কথা হাসিকে বলা যাবে না। শেষ পর্যন্তু তার অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পেয়ে ইন্স্যুরেন্স না কিসের কাগজপত্র নিয়ে গেছে, সে-কথা জিজ্ঞেস করাও তো শোভন হবে না। অকারণে নাক গলানো হবে, যা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। একাত্তর নিয়ে কথা বলবেন, তাইবা কী করে হয়? যে ক্ষত বুকে নিয়ে মেয়েটি গত পনেরো-বিশ বছর কাটিয়েছে, তাকে নতুন করে উস্কে দেবেন কী করে?
সারাটা দিন সামনের পপলারগাছের দিকে তাকিয়ে হাসির সঙ্গে কথা বললেন। এই গাছ এক অদ্ভুত জিনিস, সারা বছরের অর্ধেক সে ছায়া বিছিয়ে রাখে। কিন্তু তারপর যেই শীত আসে, সে একদম ন্যাড়া। পপলার সবচেয়ে সুন্দর হয় হেমন্তে, তখন গাছের সব পাতা আগুনরঙা হয়ে ওঠে, 888sport appর কৃষ্ণচূড়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। সবচেয়ে সুন্দর এ-গাছের পাতাগুলো। কাছ থেকে দেখলে মনে হয় ঠিক যেন হূৎপিন্ডের মতো। হার্টের এই ছবিটা দিয়েই এ-দেশের টি-শার্টে লেখা হয়, আই লাভ নিউইয়র্ক।
সকালে উঠে সারাদিন কাটালেন হাসির সঙ্গে কথা বলে, কিন্তু পপলারগাছকে সাক্ষী রেখে কী কথা হলো তাঁর? কোনো কিছুই গুছিয়ে বলা হয়নি, সেসব কথার কোনো মানেও হয় না। পপলারগাছ নিয়ে বলতে গিয়ে জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ 888sport app download apkর কথা তুলে আনলেন। দেখ হাসি, এই পপলার, এখন কেমন সবুজ, কেমন যৌবনের শৌর্য তাতে ঠিকরে পড়ছে। তিন মাস পর যেই শীত জেঁকে বসবে, এর সব পাতা ঝরে যাবে, কিন্তু তারপরও কেমন এক স্নিগ্ধ আভা জড়ানো থাকবে। ন্যাড়া গাছের দিকে তাকালে গতকালের সৌন্দর্য মনে পড়ে, আবার এই ন্যাড়া গাছ সবুজ হবে, তেমন ইঙ্গিতও সে রেখে যায়। অন্য কথায়, যেখানে জীবন, সেখানেই মৃত্যু, আবার সেখানেই জীবন। জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’, সেখানে ইঁদুর ও প্যাঁচা যেমন, তার একটা মৃত্যু – অন্যটি জীবন, কিন্তু একে ওপরের সঙ্গে কড়া আংটার মতো জড়ানো। প্যাঁচা, সে মৃত্যুর প্রতীক, তার খাদ্যগ্রহণ অর্থাৎ বেঁচে থাকা, নির্ভর করে অন্যের – মানে ইঁদুরের – জীবন হরণের ওপর। আবার দেখো, অন্ধকারের কোনো রং নেই অথচ এই অন্ধকারেই জোনাকি আলো ছড়ায়। তার মানে যা জীবন তা-ই মৃত্যু, তা-ই আলো। ভেঙে বললে দাঁড়ায়, সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত আসলে একই সঙ্গে জীবন ও মৃত্যু, অস্তিত্বের এই দুই প্রকাশের ভেতর সে মূর্ত।
কোনোরকম প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই মঞ্জুর কথা টেনে আনলেন। ছেলেটাকে তিনি সত্যি ভালোবাসতেন, সেই যে আরশাদ ভাইয়ের দোকানে তাঁকে গছিয়ে গেল, তারপর বড়জোর পাঁচ-সাতবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে অবশ্য তার চেয়ে বেশি। পাঁচ-সাত বছর আগে আটলান্টায় গ্যাস স্টেশন কিনে মঞ্জু সেখানেই থিতু হয়েছে। জ্যানেট মেয়েটা আর নেই, শুনেছে চিটাগাংয়ে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সেখানেই বিয়ে করেছে মঞ্জু। সম্ভবত চাচাত বা মামাত বোন হয়। মঞ্জুর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই, দোষটা অবশ্য তাঁর, নিজেই আর খোঁজখবর রাখেননি। ‘জানো হাসি, মঞ্জুর সঙ্গে দেখা হলে দেখবে কি মাই ডিয়ার মানুষ।’
কায়েসের কথাও বললেন, কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই। জানো, কি দুর্দান্ত ছেলে। একবার, সে ঘোষণা দিয়ে বসল, আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে, ইরানি না কী যেন নাম, দারুণ ফর্সা আর ভীষণ লম্বা, বব করে কাটা চুল, তাকে সে সবার সামনে টিএসসিতে চুমু খাবে। আমরা তো ভয়ে অস্থির। এমন কাজ কায়েসের দ্বারা অসম্ভব নয়, কিন্তু সত্যি তেমন কিছু করলে ইরানি পা থেকে স্যান্ডেল খুলে সপাং দুঘা বসিয়ে দেবে, তাও অসম্ভব নয়। সেদিন টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায় গোল হয়ে ইংরেজির ছাত্ররা আড্ডা দিচ্ছি। আমি যথারীতি সবার শেষে, সবার নজর এড়িয়ে। হঠাৎ কায়েস ধূমকেতুর মতো উদিত হলো। কোনো ভণিতা ছাড়া, কোনো পূর্বভাষণ ছাড়া, সেই এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের সামনে ইরানিকে জড়িয়ে ধরে একদম ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসল। আমরা তো ভয়ে অস্থির। কোন এক সিএসপি অফিসারের মেয়ে, এখন কমপ্লেইন করলে কায়েসের বারোটা বেজে যাবে। কিন্তু ইরানি কী করল জানো। ও হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ল, কায়েসের পিঠে বাহবা দেওয়ার মতো চাপট মেরে বলল, ‘বাহ্, তুমি আবার কিসিং শিখলে কবে?’
এসব নানা কথা হলো, কিন্তু কী আশ্চর্য, পরীর কথা একবারো উল্লেখ করলেন না।
আবু হোসেন জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন সূর্য ডুবে যাচ্ছে। রাস্তার পপলারগাছের পাতায় পড়ন্ত সূর্য প্রথম তার আগুনের মতো জ্বলজ্বলে রং দিয়ে মাখাল, ঠিক সেই প্রবল উদ্ধত রং, যা দেখে রাজপুত্র তার কালো রাজকন্যাকে দুধে-আলতায় মাখা ভেবেছিল। তারপর পপলারের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকল, এক গাছের ছায়া অন্য গাছের ছায়ায় এক হলো, মনে হয় দুটো শরীর। এক সময় তাও ফিকে হয়ে এলো, আর কোনো ছায়া নেই, আর কোনো গাছ নেই, গাছের কোনো পাতার দিকে তাকিয়ে হার্টের অবিকল ছবিও নজরে পড়ে না। হ্যাঁ, এখন সময় হয়েছে রাস্তায় নামার। আবু হোসেন তাঁর একমাত্র সুট নামিয়ে রেখেছিলেন, সাবধানে তা গায়ে চড়ান। একটি মাত্র টাই, এই টাই পরেই আমেরিকায় এসেছিলেন, আর কোনো দিন পরার প্রয়োজন পড়েনি। নট আগে থেকে বাঁধা ছিল, সযত্নে মাথা গলিয়ে তা পরে নেন। একটু কোঁচকানো, কোটের আস্তিনে সামান্য দাগ, বারদুয়েক হাত দিয়ে ঘষে নিলেন, সে-দাগ মোছার বদলে আরো ছড়িয়ে পড়ল। ন্যাপকিনে সামান্য পানি জড়িয়ে বারকয়েক সে-দাগের ওপর ডলে নিলেন, কোনো কাজ হলো না, নিজের ওপরেই বিরক্ত হলেন। বারদুয়েক আয়নায় নিজেকে দেখলেন, এক সময় কোঁকড়ানো চুল ছিল, এখন মাথাজুড়ে মস্ত টাক। চিরুনি দিয়ে অবশিষ্ট কয়েক গোছা চুল দিয়ে সে-টাক 888sport appর চেষ্টা করলেন। নজরে এলো খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, আজ সকালে সেভ করতে ভুলে গিয়েছিলেন, কোট খুলে টাই পরা অবস্থাতেই খচখচ করে দাড়ি কামিয়ে নিলেন। তাড়াহুড়োয় কণ্ঠার কাছে সামান্য ছড়ে গেল, হাত দিয়ে সেখানে তিন মিনিট চেপে রাখলেন রক্ত থামাতে।
রাস্তায় যখন নামলেন তখন রাত নয়টা। এখান থেকে তিন ব্লক দূরে হাসির কো-অপারেটিভ অ্যাপার্টমেন্ট। পা টিপে-টিপে তিনতলা থেকে নেমে, রেস্তোরাঁর মালিক-কর্মচারীর চোখ এড়িয়ে, সন্তর্পণে রাস্তা পেরোলেন। বারদুয়েক চোখ কচলালেন। আশ্চর্য, এখনো এত আলো! স্ট্রিট লাইটগুলো সব জ্বলে উঠেছে, একরাশ বিরক্তিতে তাঁর ভুরু কুঁচকে এলো। এখনো তো দিনের আলো আছে, তারপরে স্ট্রিটের আলো, একদম অপচয়!
দ্রুত পা বাড়ালেন আবু হোসেন।
এই পাড়ায় সারি-সারি রেস্তোরাঁ, অগুনতি পাব। জুনের নিউইয়র্কে প্রতিদিনই উৎসব লেগে থাকে, মনে হয় ঘরে একটা লোকও নেই, সবাই হয় রাস্তায়, নয়তো রেস্তোরাঁ বা পাবে। মাথা নিচু করে হাঁটছিলেন আবু হোসেন, একবারও ডান-বাঁ তাকালেন না। মনে হলো সবাই তাঁকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছে, হঠাৎ সুটে তাঁকে নিশ্চয় ঠিক ক্লাউনের মতো দেখাচ্ছিল। কারো কথায় ভ্রুক্ষেপ করার সময় তাঁর নেই, কে কী ভাবল তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই।
সিক্সথ স্ট্রিটের কোনায় আইরিশ পাবের সামনে এসে থামলেন আবু হোসেন। এখান থেকে হাসির বাড়িখানা নজরে আসে। একবার তাকিয়ে দেখলেন, না, হাসি নেই। এই চারতলা ভবনের কোন অ্যাপার্টমেন্টে সে থাকে, তাও তিনি জানেন না। অনুমানে ভেবে নিলেন তিনতলার দক্ষিণমুখো কোনার ঘরটাই হবে হাসির। তাতে একটি আলো জ্বলছে, হালকা নীল একটি পাতাবাহারি পর্দা, হাওয়ায় অল্প-অল্প দুলছে। লবির বাইরে সিকিউরিটি অফিসার চেঁচিয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে, তার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে পাবের ভেতরে পা বাড়ালেন আবু হোসেন।
কতদিন তিনি মদ খান না, যদিবা অনুরোধে খেতে হয়েছে, তাও সামান্য বিয়ার ভিন্ন অন্য কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কায়েসের পাল্লায় পড়ে একবার সস্তা হুইস্কি খেতে হয়েছিল। সেদিন কায়েস নায়নার সঙ্গে প্রথম সঙ্গম করেছে, তারই সেলিব্রেশন। দু-চুমুক দেওয়ার পর এমন একটা বমি-বমি ভাব এলো যে তিনি হাতের গ্লাস লুকিয়ে ফেলেছিলেন। কায়েস যতবার তাতে হুইস্কি ঢালে, আবু হোসেন সবার নজর এড়িয়ে ততবার তা জানালার ধারে রাখা ফুলের টবে ঢেলে দেন। খুব খারাপ লেগেছিল গাছটার জন্য, নির্ঘাত মরে যাবে, তিনি ভেবেছিলেন। সেই প্রথম হুইস্কি, সেই শেষ। পাবে ঢুকে একদম শেষের চেয়ারটা দখল করে আবু হোসেন প্রথমেই অর্ডার দিলেন স্কচ।
তিন ঘণ্টা পর শুঁড়িখানা থেকে যখন বেরোলেন, তখন মধ্যরাত। বাইরে পা রাখতেই দেখেন চারদিক ঘন বরফে ঢেকে আছে। সব ফকফকে সাদা। কী আশ্চর্য, পাবে যখন ঢুকেছিলেন, তখন কি এই বরফ ছিল? জুন মাসে কি নিউইয়র্কে তুষার পড়ে? বৃষ্টির মতো তুষার পড়ছে, ঝুরঝুর করে, নিঃশব্দে। আচ্ছা, বৃষ্টির তো নিজস্ব গান আছে, তুষারেরও কি কোনো গান আছে? হুমড়ি খেয়ে বরফের ওপর পড়ে গেলেন, তাতে কান পাতলেন কোনো গান শোনা যায় কিনা দেখতে। বোদলেয়ারের একটা লাইন মনে পড়ে গেল, আই জয়েন আ হার্ট অব স্নো টু দ্য হোয়াইটনেস অব সোয়ান্স। আচ্ছা, বুদ্ধদেব বসু কি এই 888sport app download apkটা 888sport app download apk latest version করেছিলেন? এই কথাটা বাংলায় কী দাঁড়াবে, ভাবতে চেষ্টা করলেন, হলো না। বরফের ওপর দুই হাঁটু মুড়ে, হাত দুখানা বরফে ঘষতে-ঘষতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। পারলেন না। এবার সটান সে-বরফের ওপর শুয়ে পড়লেন, ইচ্ছা হলো একটু ঘুমোন। কান ঘেঁষে, চুলের ফোকর দিয়ে, ঘাড়ের নিচে কোটের কলার গলে তুষারকণা চুর-চুর করে ঢুকে পড়ছে। কি মোলায়েম, যেন কেউ শিশু হাত দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আহ্, থাম, কপট বিরক্তিতে বলে ওঠেন আবু হোসেন।
প্রবল প্রস্রাবের বেগ অনুভব করলেন। এবার তাহলে উঠে দাঁড়াতে হয়। হামাগুড়ি দিয়ে বরফ ডিঙিয়ে রাস্তার ধারে হাইড্রেন্ট ধরে উঠে দাঁড়ালেন। রাস্তা দিয়ে ধুপধাপ আওয়াজ তুলে গাড়ি শোঁশোঁ ছুটে যাচ্ছে। চোখে পড়ে ফর্সা গোলগাল মেয়েরা, তাদের সোনালি চুল বাতাসে উড়ছে। হাসির লম্বা কোঁকড়ানো চুলের ছবি মাথায় এলো, এমন চমৎকার চুল অথচ কখনো তাকে এলোচুলে দেখেছেন বলে মনে হয় না। ইচ্ছা হলো এমন একটা গাড়িতে চড়ে হাসিকে নিয়ে শোঁশোঁ উড়ে যাবেন, বাতাসে দোল খাবে তার চুল। খুব ইচ্ছা হলো সে-চুলে মুখ ডুবিয়ে বুকভরা শ্বাস নেন। একটা 888sport app download apkর লাইন মনে পড়ল, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। কবিকে চুলের তুলনা খুঁজতে কবেকার ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যাওয়া বিদিশা নগরের আশ্রয় নিতে হলো কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির সেমিনারে সরোয়ার স্যার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন পুরো বনলতা সেন 888sport app download apk এনোটেশনসহ ইংরেজিতে ভাষান্তর করতে। সে-সময় খুঁটে-খুঁটে উদ্ধার করেছিলেন, কোথায় বিদিশা, কোথায় বিম্বিশা ও শ্রাবস্তী। বিদিশা নামে সত্যি-সত্যি একটা নগর ছিল, পুরাণে তার উল্লেখ আছে, আধুনিক ভূপালের ধারে-কাছে কোথাও তার ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়েছে, সে-কথা জেনে বিস্মিত হয়েছিলেন। বাক্যটির 888sport app download apk latest versionে তিনি লিখেছিলেন, ‘হার হেয়ার স্পোক অব বিদিশাস ডার্ক নাইট।’ স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন স্পোক শব্দটি কেন তিনি ব্যবহার করলেন। আবু হোসেনের জবাব ছিল, জীবনানন্দের 888sport app download apkর প্রতিটি শব্দ আসলে সুনির্দিষ্ট ছবি, একেকটা কেটে-কেটে বসানো, আলাদা-আলাদা, কিন্তু সব একসঙ্গে করলে তা পূর্ণ একটা প্যানোরমা হয়ে ওঠে। এই ছবি চোখে যতটা দেখতে হয়, ঠিক ততটাই শুনতে হয় কান পেতে। বাংলা ভাষায় এই এক কবি যাঁর 888sport app download apk শুধু মনে-মনে পড়ার নয়, তা উচ্চৈঃস্বরে, ধ্বনির ঝংকার নিয়ে শুনতে হয়। সেজন্য স্পোক। খুব স্মার্ট কোনো উত্তর নয়, কিন্তু সরোয়ার স্যার খুশি হয়েছিলেন।
আর পারা যাচ্ছে না, ডান-বাঁ তাকিয়ে প্যান্টের চেইন খুলে তুষারের ওপর প্রস্রাব করলেন আবু হোসেন। নরম, সদ্য পড়া তুষারের ওপর খুব যত্ন করে লিখলেন, HASHI. ঈষদুষ্ণ প্রস্রাব, তুষারের ওপর পড়ে এক মুহূর্তে গলে পড়ল, আবু হোসেনের মনে হলো তার কান্নাভেজা অশ্রু মিলিয়ে যাচ্ছে।
আবু হোসেন এখন হাসির ফ্ল্যাটবাড়ির ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে। তিনি মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন তিনতলার দক্ষিণের ফ্ল্যাটটি হাসির, দেখে আশ্বস্ত হলেন যে সেখানে তখনো আলো জ্বলছে। মোমবাতির মতো নরম সে-আলো জানালা গলে বাইরে ঠিকরে বেরোচ্ছে। জানালার ধারে ঘরসমান আয়নার সামনে ছোট একটা টুলের ওপর বসে হাসি, সে তার চুল আঁচড়াচ্ছে। আবু হোসেন অস্ফুট স্বরে বললেন, হার হেয়ার স্পোক অব বিদিশাস ডার্ক নাইট। এই মেয়েকে তিনি আগে কোথায় দেখেছেন, মনে করার চেষ্টা করলেন। বিদিশায়, বিম্বিশায়, নাকি মগবাজারে, সেই একাত্তরের জুনে, জলপাইরঙা জিপের হেডলাইটে। কানে বাজল ভয়ার্ত আর্তনাদ, মা, আমারে ধরো। দুহাতে কান চেপে ধরলেন, চিৎকার করে বললেন, না, না।
এখন চারতলা সে-ভবনের পেছনে দাঁড়িয়ে আবু হোসেন। অনবরত তুষার ঝরে পড়ছে, পেঁজাতুলোর মতো সে-তুষার ক্রমশ জমতে থাকে। আবু হোসেন তুষারের সে-পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে, চুল গলে তুষার তার সারাশরীর ঢেকে দেয়, উহ্, কী গরম, জ্যাকেট টেনে খুলে ফেলেন, হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেলেন টাই। মাথাটা এমন ঝিমঝিম কেন করছে, মনে হয় একটা মৌমাছি কানের ফুটো দিয়ে মাথার ভেতর ঢুকে পড়েছে, ঠিক নমরুদের গল্পে যেমন আছে। একি, তার চোখ যে জলে ভিজে যায়, সে-জল গাল বেয়ে জামা ভিজিয়ে দেয়, তিনি বুঝতে পারেন তাঁর হাত-পা একটু-একটু করে কাঁপছে। তিনি জানালার দিকে তাকান, সেখানে হাসি চুল বাঁধছে।
তুষার ক্রমশ জমতে থাকে, আবু হোসেনের পায়ের নিচে সে-তুষার পাহাড় হয়ে ওঠে, একসময় তা হাসির তিনতলার ফ্ল্যাট ছুঁয়ে ফেলে। আবু হোসেন এখন তার জানালার ঠিক বাইরে, হালকা নীল রঙের পর্দা, বাতাসে একটু দুলছে, তার ফাঁক গলিয়ে তিনি দেখেন হাসিকে। পিঠের আধখানাজুড়ে তার ঘনকালো চুল হাওয়ায় মৃদু দোল খাচ্ছে। সরাসরি মুখখানি দেখা যায় না, দেখা যায় আয়নায়। বিনে হাতার বেগুনি রঙের ব্লাউজ, আবু হোসেন লক্ষ করেন বাঁ-হাতে ছোটকালে দেওয়া টিকার অক্ষয় দাগ। নিজের বাম হাতেও সেই টিকা, তার ওপর হাত বোলান আবু হোসেন। দু-পা এগিয়ে এবার তিনি আরো কাছে আসেন, হাসির খোলা জানালার শিক শক্ত হাতে ধরে নিজের মুখ দুই শিকের মাঝখানে রাখেন। তাকিয়ে দেখেন হাসির কান্ড, বিষণ্ণ মুখ। তার শুষ্ক ঠোঁটের দিকে তাকালেন তিনি, মনে হলো কতকাল ওই বিষণ্ণ মুখে ভালোবাসার স্পর্শ পড়েনি, ওই শুষ্ক ঠোঁটে কেউ দেয়নি চুম্বন।
জানালার শিক গলিয়ে হাত বাড়ালেন আবু হোসেন। আলগোছে হাত রাখলেন হাসির ঘনকালো বেখেয়ালি চুলের ওপর। সে-চুলের গোছা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বাঁ-হাতের তালুতে ঘষতে-ঘষতে খুব নরম গলায় আবু হোসেন বললেন, ‘ভয় কি সোনা, এই তো আমি আছি।’

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.