রবিশংকর বল
সোফি অ্যান্ডারসনের আঁকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে এখন মন খারাপ হয়ে যায় শেহ্রজাদের। উনিশ শতকের মাঝামাঝি কোনো সময়ে সোফি তাঁর ছবিটা এঁকেছিলেন। ছবিটা দেখতে ইচ্ছে না-করলেও বারবার শেহ্রজাদেকে টানে। ওই যৌবন আর সৌন্দর্য, নিজেকে ভুলে যাওয়ার মুহূর্তে দুই চোখ যেমন দিশাহীন নৌকার মতো ভেসে থাকে মাঝনদীতে, অমন দৃষ্টি আর কখনো ফিরে পাবেন না তিনি। চামড়া ঝুলে গেছে, মুখে সময়ের নানা কাটাকুটি খেলা, চুল সব সাদা, একটু হাঁটলেই হাঁপাতে হয় – শেহ্রজাদে এই ভবিতব্যকে মেনে নিতে পারেন না। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, সুলতানকে বলা হাজার এক রজনীর গল্পগুলোর মতই চিরনবীনা থাকবেন। কিন্তু সেইসব কিস্সাই এখন আর ঠিকঠাক মনে পড়ে না তার, কত দস্তান যে ভুলে গেছেন। গল্পরা যেমন ভেসে যায়, মানুষও কালস্রোতে ভাসতে-ভাসতে পুরনো হয়ে যায়, একদিন নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। এখন আমি বিবাহের রাত্রির দিকে এগিয়ে চলেছি আশিকের সঙ্গে মিলনের আশায়, কথাটা ভেবে মনে-মনে হাসলেন শেহ্রজাদে।
খোঁজা প্রহরী এসে সুলতানের আসার খবর দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সুলতান শাহ্রিয়ার এসে পৌঁছলেন। হেসে বললেন, ‘আয়নার সামনে বসে কী করছ, বেগম সাহেবা?’
– মুখোশ দেখছি। শেহ্রজাদে নিজের প্রতিবিম্বের দিকেই তাকিয়ে রইলেন।
– মুখোশ? কোথায়? মুখোশ কোথা থেকে পেলে?
– ওই তো – । শেহ্রজাদে আয়নার দিকে আঙুল দেখালেন।
– ওখানে তো তুমি। সুলতান বিবির পাশে বসে আয়নার দিকে তাকালেন।
– ওটা মুখোশ। এখন আর মুখ নয়।
– তোমার মুখ আমার কাছে আগের মতই সুন্দর। সুলতান শাহ্রিয়ার বিবিজানকে আলিঙ্গন করলেন।
– আপনি আমাকে অতীতের ভেতরে দেখেন। না হলে দেখতে পেতেন, বাগিচা থেকে বাহার অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। শেহ্রজাদে হাসলেন। – তা, আমার মহলে এতদিন পরে কী মনে করে?
– আজ রাতে কিস্সা শুনতে চাই। সেই আগের মত – সারা রাত –
– আমি তো সব গল্প ভুলে গেছি। দুনিয়াজাদ এখন শোনাতে পারে।
– তা পারে বটে। কিন্তু তুমি যেভাবে কিস্সার ভেতরে মিশে যাও – যেন মনে হয়, তোমার জীবনেরই কথা – দুনিয়াজাদ তা পারে না।
হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকে কিস্সা-গল্পের ভেতরেই বেঁচে থেকেছেন শেহ্রজাদে। আর ছিল বই পড়া। পুরনো সব রাজা-সুলতানের সম্পর্কে, তাঁদের রাজত্বের ধারাবিবরণী। প্রাচীন সব জাতি আর মৃত শাসকদের সম্পর্কে কয়েক হাজার বই সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। দর্শন, 888sport apk, 888sport app download apkর কিতাবও বাদ যায়নি। কিন্তু লাভ কী হল? সবই তো ধীরে-ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে মীর তকী মীরের একটা শের মনে পড়ছিল ভাঙা-ভাঙা, কিছুতেই পুরো শেরটাকে ছুঁতে পারছিলেন না। সে যে কী কষ্ট! চেনা মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর নাম মনে না-করতে পারার যন্ত্রণা। দুদিন পরে আস্তাবল থেকে ভেসে-আসা একটা ঘোড়ার চিৎকারে মনে পড়ে গেল :
দাগ-ই-ফিরাক-ও-ইসরত-ই-ওয়াসল, আরজু-ই-শওক
ম্যাঁয় সাত জির-ই-খাক থি হাঙ্গামা লে গয়া।
বিচ্ছেদ-বেদনা, আশিকের জন্য আকাঙক্ষা, ভালবাসার পিপাসা। একটা ঝড় নিয়ে আমি কবরে চলে গেলাম।
আমিও একটা ঝড় বুকে করে নিয়ে চলে যাব, শেহ্রজাদে মনে-মনে বললেন।
সুলতান শাহ্রিয়ার দেখলেন, প্রতিবিম্ব আপন মনে কথা বলছে। এসবই বুড়ো হওয়ার লক্ষণ। সব কথা তো এখন আর মুখ ফুটে বলা যায় না, তাই নিজের মনেই বলতে হয়। সুলতানও তো বলেন।
– চলুন জি। শেহ্রজাদে বলেন। – কিতাবখানায় গিয়ে বসি।
– কেন?
– আপনি যে কিস্সা শুনতে চাইলেন।
– তুমি তো ভুলে গেছ।
সুলতানের কণ্ঠস্বর বেদনাহত শোনাল।
শেহ্রজাদে তাঁর হাতে হাত রেখে হেসে বললেন, ‘নতুন কিস্সা যদি বলি?’
সুলতানও হাসলেন। – নতুন কিস্সা বানিয়েছ বুঝি?
কিস্সা কি কেউ বানায়, সুলতান? চারপাশে সবসময় তাদের জন্ম হচ্ছে, মরে যাচ্ছে। মানুষ তার পছন্দমত বেছে নেয়। কিন্তু এসব কথা শেহ্রজাদে বলতে গেলেন না। কথাপুরুষ তাঁকে বলেছেন, যে-রহস্য থেকে কিস্সারা জন্মায়, তা নিয়ে কখনো কথা বলো না। হাজার-হাজার বছর ধরে কিস্সারা বেঁচে থাকে রহস্যের ঝরনার জলপান করে।
কিতাবখানার মেঝেতে পাতা ফরাসে এসে বসলেন দুজনে। চামড়ায় বাঁধানো হাজার-হাজার বই, সোনার জলে নাম লেখা। বইগুলোর দিকে তাকিয়ে শেহ্রজাদের মনে পড়ল, জেগে থাকা আর স্বপ্ন দেখা আসলে একই বইয়ের পৃষ্ঠা। ধারাবাহিকভাবে পড়ার নাম বেঁচে থাকা আর পৃষ্ঠা উলটে-উলটে এলোমেলো পড়াই স্বপ্ন। কথাটা কে বলেছিলেন? শেহ্রজাদে কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। সত্য অনুভবের কোনো লেখক থাকে না, শুধু কলম-চালনার শব্দ শোনা যায়। আর এই ঘরে এলেই কত অদৃশ্য মানুষের কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে তাঁর কানের কাছে কত যে কথা বলে যেতে থাকে। যেমন এখন, কে যেন বলে উঠল, ‘নদীটা তৃষ্ণায় মরে যাবে।’
– কেন? শেহ্রজাদে জিজ্ঞেস করলেন।
কণ্ঠস্বর কোনো উত্তর দিল না। শেহ্রজাদে শুনতে পেলেন, কোথাও বালি ঝরছে, ঝরেই চলেছে।
আকাশ থেকে ফেলা বোমায় মিনিটখানেকের মধ্যে একটা বাড়ি ভেঙে পড়েছে, বালি ঝরছে তো ঝরছেই। বাড়ির লোকদের মত বাড়িটাও এইমাত্র মরে গেল। প্রত্যেকটা বস্ত্ত যন্ত্রণায় কাঁপছে – কত আঙুলের স্পর্শ, গন্ধ, ছবির 888sport sign up bonus তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তাদের 888sport sign up bonusও হারিয়ে যাবে। পাথর, কাঠ, কাচ, লোহা, সিমেন্টের ভাঙা টুকরোগুলো মানুষের ছেঁড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতই ছড়িয়ে আছে। শেহ্রজাদে ভাবলেন, আমাদের জিনিসপত্রগুলো আমাদেরই মত মরে যায়, কিন্তু আমাদের সঙ্গে তাদের কবর দেওয়া হয় না।
– চুপ কেন, বিবিজান? কিস্সা শুরু করবে না?
শেহ্রজাদে উত্তর দিলেন না। নিচু, ছোট টেবিলের ওপর রাখা কয়েকটি বই। তিনি একটি বই নিয়ে পৃষ্ঠা উলটাতে লাগলেন। একটা ছবির পৃষ্ঠা বার করে সুলতানের দিকে এগিয়ে দিলেন।
সমুদ্রের তীরে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে তিন বছরের ছেলেটি। লাল জামা, নীল প্যান্ট, পায়ে জুতো। মনে হয় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে সে। সমুদ্রের ঢেউ এসে মাঝে-মাঝে আদর করে যাচ্ছে তাকে।
– ছেলেটি কে? সুলতান প্রশ্ন করলেন।
– আয়লান কুর্দি। দেশ থেকে উদ্বাস্ত্ত হয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘরের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিল সে। তুরস্কের সমুদ্রতীরে ওর মৃতদেহ পাওয়া যায়, এভাবেই।
– কোন দেশ থেকে এসেছিল?
– সিরিয়া। দেশটা এখন আর পৃথিবীর মানচিত্রে নেই। একের পর এক যুদ্ধে লুপ্ত হয়ে গেছে।
শেহ্রজাদে সুলতানের কাছে এগিয়ে এলেন। আরেকটি ছবি-ছাপা পৃষ্ঠা বার করে বললেন, ‘দেখুন সুলতান।’
কমলা চেয়ারে বসে আছে বছরপাঁচেকের একটি শিশু। সারা মুখ ছাইয়ে ধূলিমলিন, শরীর ধূসর। মুখের বাঁদিক রক্তাক্ত। ছবিটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন সুলতান, তারপর প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন, ‘এত সুন্দর ছেলেটা কে?’
– ওমরান দাক্নিশ্। নিস্পৃহ স্বরে বলেন শেহ্রজাদে – সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে ওরা থাকত।
– আলেপ্পো – দামাস্কাস – এবার দেশটার কথা মনে পড়ছে। কত বড়-বড় সব শহর। মওলানা জালালুদ্দিন রুমি জ্ঞানার্জন করতে আলেপ্পো, দামাস্কাসে গিয়েছিলেন। দামাস্কাসে তখন ইবন্-আল-আরাবি, উত্মান-আল-রুমি, আওহা-উদ্দিন কিরমানি, সদরউদ্দিন কুনাইয়ের সুফি-সাধক ও বিদ্বৎজনেরা সারা পৃথিবী থেকে আসা শিক্ষার্থীদের পড়ান। দামাস্কাস থেকেই তো জালালুদ্দিন বল্খি ফিরে এসেছিলেন মওলানা রুমি হয়ে।
– সেদিন সন্ধ্যায় কাতারজি এলাকার মসজিদে সবে
আজানের ডাক দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ সাইরেনের শব্দ। ওই শব্দ শুনতে-শুনতেই তো ওমরানের জন্ম, বড় হয়ে ওঠা। দেশ জুড়ে চলছে যুদ্ধ। সাইরেনের সঙ্গে বোমারু বিমান ওড়ার আওয়াজ। এমন সময় একটা বোমা এসে পড়ে ওমরানদের বাড়ির ওপর। নিমেষে চারপাশ অন্ধকার, সব ধ্বংসসত্মূপ। সেখানেই খুঁজে পাওয়া যায় ওমরানকে।
– তারপর?
– ওমরান তখন মরেনি। হয়তো তার দেশটা একদিন মানচিত্র থেকে মুছে যাবে, তা দেখার অপেক্ষাতেই বেঁচে ছিল।
সুলতানের জন্য সুরা, কাবাব, নানারকম বাদাম ও ফল এল। শেহ্রজাদে পানপাত্রে সুরা ঢালতে-ঢালতে বললেন, ‘আপনার বোধহয় শুনতে ভাল লাগছে না, তাই না?’
– তুমি কি হাজার এক রাত্রির সব গল্পই ভুলে গেছ বেগম সাহেবা? সিন্দবাদ, হারুন-অর-রশিদ, আলিবাবা, আলাদীন, আল মামুন, জুবেদা বেগমদের কিস্সা কি কিছুই মনে নেই তোমার?
– না, জনাব। শেহ্রজাদে মাথা নিচু করলেন। – ওইসব ঝলমলে কিস্সার কিছুই মনে নেই আমার। একে-একে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
– কী করে?
– বুড়ো হয়ে গেলে যেমন জীবন থেকে রং মুছে যায়।
– আমি তো তোমার চেয়ে বয়সে বড়। সুরাপাত্রে চুমুক দিতে-দিতে বললেন সুলতান শাহ্রিয়ার।
– কিন্তু মেয়েরা তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যায়, জনাব। শেহ্রজাদে হাসলেন।
– কেন?
– সে আপনি বুঝবেন না।
– যখনই কোনো কথা তুমি বলতে চাওনি, তখনই বলেছ, আমি বুঝব না। আমি কি এতই বোকা।
শেহ্রজাদে শাহ্রিয়ারের হাত ধরে বললেন, ‘এভাবে বলবেন না জনাব। আমি আপনাকে কখনো কষ্ট দিতে চাইনি।’
– আমি জানি বিবিজান। আজ অনেকদিন পর তোমার মুখে কিস্সা শোনার ইচ্ছে হয়েছিল। পুরনো কোনো কিস্সা – সারা রাত ধরে তুমি বলবে।
শেহ্রজাদে হাসলেন। বেদনা ও ঠাট্টা মিলেমিশে গেছে তাঁর হাসিতে। তিনি বুঝলেন, ভেতরে একটা নদীতে জোয়ার এসেছে। নিজেকে সংযত করা প্রয়োজন। বয়স বাড়তে-বাড়তে তিনি বুঝেছেন, এ-দুনিয়ায় চোখের জল কোনো কাজে লাগে না। সমাজের কাছে অশ্রম্ন দুর্বলতার চিহ্ন।
– কী হয়েছে, বিবিজান?
– একটা সত্যি কথা বলব?
– বলো –
– আপনার কাছে কিস্সা শোনা ছিল আমাকে পরীক্ষা করা। আর আমার কাছে কিস্সা ছিল জীবন-মরণের প্রশ্ন। আর কখনো গল্প শুনতে চাননি আপনি। আমারও বলার সুযোগ আসেনি। তাই কিস্সারা আমাকে ছেড়ে একদিন চলে গেছে। ওরাও তো বেঁচে থাকতে চায় – মানুষের মুখে-মুখে। জাঁহাপনা, আমি ওই গল্পদের ভেতরেই বেঁচে ছিলাম। ওরা চলে যাওয়ার পর আমারও মৃত্যু হয়েছে।
– তুমি তাহলে আর কখনো গল্প বলবে না?
– নতুন গল্প যদি শোনেন, মালিক।
– কিন্তু ওই কিস্সা কতদিন তুমি বলতে পারবে বেগম? কোনো রং নেই, জাদু নেই –
শেহ্রজাদে হাসলেন। – আপনি যতদিন শুনতে চাইবেন। আমার নতুন গল্প হাজার এক রজনীর চেয়েও দীর্ঘ। এই কিস্সার মানুষদের আপনি রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। এদের ঘর নেই, সম্বল একটা কাপড়ের পুঁটুলি বা পুরনো, জং-ধরা টিনের তোরঙ্গ – রাতে ফুটপাতে শুয়ে থাকে পরিবার-ছেলেমেয়ে নিয়ে – সকাল হলে আবার হাঁটা শুরু – এভাবেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছে যায় ওরা – কোনো দেশেই ওদের ঘর নেই। ওরা কেউ আলিবাবা, আলাদীন হওয়ার ভাগ্য নিয়ে আসেনি।
– তুমি শুরু করো শেহ্রজাদে।
– তার আগে এক প্রাচীন গল্প বলব আপনাকে, সুলতান। এই গল্পের নায়ক যুধিষ্ঠির। বনবাসে এসে মা, চার ভাই, স্ত্রীকে নিয়ে যুধিষ্ঠির তখন দ্বৈত বনে রয়েছেন। একদিন তিনি স্বপ্নে অনেক হরিণ দেখতে পেলেন। তারা বলল, মহারাজ, আপনার অস্ত্রপটু বীর ভাইয়েরা আমাদের অল্পই অবশিষ্ট রেখেছেন। এভাবে মৃত্যু হলে আমরা লুপ্ত হয়ে যাব, আমাদের 888sport free bet যাতে বাড়ে, আপনি দয়া করে সেই ব্যবস্থা করুন। সকালে যুধিষ্ঠির স্বপ্নবৃত্তান্ত জানিয়ে ভাইদের বললেন, এখনো এক বছর আট মাস আমাদের হরিণের মাংস খেয়ে বনবাসে থাকতে হবে। চলো, আমরা এই বন ত্যাগ করে কাম্যকবনে যাই, সেখানে অনেক মৃগ আছে।
কাম্যকবনে বনবাসের এগারো বছর শেষ হল। একদিন সহযোগী ব্যাসদেব এসে উপদেশ প্রসঙ্গে একটি গল্প বললেন।
– এই তো – এই তো বেগমজান, তোমার ক্ষমতা তো এখনো মরেনি। গল্পরা তোমার কাছে এসেই প্রাণ ফিরে পায়। সুলতান শাহ্রিয়ার উৎফুল্ল হয়ে বলেন।
শেহ্রজাদে মৃদু হেসে শুরু করেন, ‘কুরুক্ষেত্রে মুদ্গল নামে এক ধর্মাত্মা মুনি ছিলেন। স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে পনেরো দিনে একদিন খেতেন, যাগযজ্ঞ করতেন, অতিথি এলে ফেরাতেন না। একদিন ঋষি দুর্বাসা উন্মত্তের মতো উপস্থিত হয়ে বললেন, আমাকে অন্ন দাও। মুদ্গলের দেওয়া অন্ন দুর্বাসা সবটাই খেয়ে ফেললেন, গায়ে উচ্ছিষ্ট মেখে চলে গেলেন। এভাবে পরপর দুবার পর্বের দিনে এসে ঋষি দুর্বাসা সব অন্ন খেয়ে নিলেন। মুদ্গল অনাহারে রইলেন। দুর্বাসা সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বললেন, তোমার মহৎ দানের সংবাদ স্বর্গেও পৌঁছেছে, তুমি সশরীরে সেখানেই যাবে।
‘এই সময় এক দেবদূত বিমান নিয়ে এসে মুদ্গলকে স্বর্গে যাওয়ার কথা বললেন, স্বর্গবাসের গুণ আর দোষের কথা
জানতে চাইলেন মুদ্গল। দেবদূত বললেন, ধর্মাত্মা, জিতেন্দ্রিয় দানশীল, সম্মুখ সমরে নিহতরাই স্বর্গে যেতে পারেন। সেখানে
ঈর্ষা, শোক, ক্লামিত্ম, মোহ, মাৎসর্য নেই। দেবগণ, সাধ্যগণ, মহর্ষিগণ সেখানে নিজ-নিজ ধামে বাস করেন। স্বর্গে কৃতকর্মের ফলভোগ হয়, কিন্তু নতুন কাজ করা যায় না। সেখানে অন্যের বেশি সম্পদ দেখে অসমেত্মাষ হয়, কর্মক্ষয় হলে আবার ধরাতলে পতন হয়।
মুদ্গল নমস্কার জানিয়ে বললেন, দেবদূত, আপনি ফিরে যান। আমি স্বর্গসুখ চাই না। যে-অবস্থায় মানুষ শোক-দুঃখ পায় না, পতিতও হয় না, আমি সেই কৈবল্যের খোঁজ করব।
‘এরপর মুনি মুদ্গল জ্ঞানযোগ অবলম্বন করে ধ্যানস্থ হলেন এবং নির্বাণমুক্তির সিদ্ধিলাভ করলেন।’
– এই গল্প কেন বললে বিবিজান? সুলতান শেহ্রজাদের হাত ধরলেন।
– আমার নতুন কিস্সা সব শোক-দুঃখের অতীত। যে-দেশের কথা বলছি, তার নাম ভারতবর্ষ।
দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল শেহ্রজাদের। r
(চলবে)


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.