ল্যাম্পপোস্টের ফটকা আলোর নিচে দাঁড়ানো এক মহিলা।
মাথার ওপর জন্ডিস রোগীর চোখের মতো রাজধানীর সোডিয়াম বাতি। এসব বাতি সাধারণত সন্ধ্যাবেলায় যেরকম ঝাপসা হলদেটে রং ছড়ায় চারপাশে, মহিলার মুখাবয়বও সেরকম ম্লান অস্পষ্ট আলোর প্রলেপে 888sport app। কাছে এগিয়ে না এলে চটজলদি বোঝা মুশকিল মানুষ নাকি অন্যকিছু।
রাস্তায় মানুষজন একেবারে হাতেগোনা। করোনা-মুখোশে সবার মুখ 888sport app। বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। 888sport app নগরীর
লাল-নীল আলো-ঝলমল উচ্ছল যৌবন এখন ফ্যাকাশে; ভয়ার্ত নির্জনতার চাদরের তলায় যেন ধুঁকছে!
শুধু এ-মহিলাটি, মৃত্যুর মতো কঠিন এক নগর-বাস্তবতার মাঝখানেও, ক্ষয়াটে চাঁদের মতো প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে। কার জন্য এ অপেক্ষা – স্বপন তা জানে না।
সস্তা প্রসাধনীর প্রলেপ মহিলার মুখ জুড়ে। গায়ে লাল টকটকে ডুরে শাড়ি। দৃষ্টি স্থির ও নিষ্প্রভ, কোনো ভাষার ধাঁধা নেই তাতে। নির্বিকার-নির্বিকল্প চাহনির ভেতর কোনো আকাক্সক্ষার স্ফূরণও নেই। তাকিয়ে আছে তো আছেই। এ যেন মহামারিকালে অন্তহীন অপেক্ষা কারো জন্যে!
হালকা-পাতলা শারীরিক গঠন আর দৃষ্টির এই উদাসীনতা প্রতিনিয়ত মহিলার বয়সকে আড়াল করছে। সুনির্র্দিষ্ট কিছু বলা মুশকিল। হয়তো বিশ-পঁচিশ হতে পারে, নয়তো পঞ্চাশেও নদী ঢেউ তুলতে পারে। কে জানে!
জবুথবু স্বপন ভয়-শঙ্কায় কাতর হয়ে প্রতিদিন যখন ন’টা সাড়ে ন’টার দিকে মহল্লার মেসে ফেরে, তখন দূর থেকে
এ-মহিলাকে দেখতে পায়। একই রকম ভঙ্গি, ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ল্যাম্পপোস্টের তলায়। একই শাড়ি, একইরকম ম্লান ও পাণ্ডুর প্রসাধনী মুখের পরতে। দৃশ্যটি দেখামাত্র ভৌতিক এক শিহরণ খেলে যায় ওর লোমকূপগুলিতে।
এমনিতে নিজেকে চরিত্রবান পুরুষ ভেবে খুব আনন্দ পায় স্বপন। গর্বের ওর শেষ নেই এজন্য। বান্ধবী যূঁথিও তা জানে। সে পাত্তা দেয় না এসব কথা। শ্লেষভরা গলায় বলে, ‘এক্কেরে ছেলেমানুষ!’
সাধারণত এমন পুরুষদের যেরকম ব্যক্তি-স্বভাব হয়, সামান্য নড়াচড়াতেই ভেতরে চিলিক দিয়ে ওঠে ঘন দুধের সরের মতো এক নৈতিকতা বোধ, সে এর ব্যতিক্রম নয়।
অতএব স্বাভাবিকভাবে স্বপন চোখ সরিয়ে নেয়। ওর ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, ‘তুমি না ভদ্রলোক? ওদিকে চোখ চলে যাচ্ছে কেন? যদি অন্য কেউ দেখে ফেলে? যদি কাল তোমার পত্রিকা অফিসে গিয়ে বলে দ্যায়, স্বপনকে দেখলাম, একটা রাস্তার বেশ্যার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে, তাহলে? জীবনটা তো তখন থেঁতলে যাবে, ছিঃ নামের বিশ্রী সব পোকা কিলবিল করবে শরীর-মনের সবখানে, ওরা ছেড়ে দেবে ভাবো? দংশনে-দংশনে জীবন্মৃত করে ফেলবে না তোমাকে?’
ওর রিকশা যত এগোচ্ছে তত প্রতিটি ছিঃ উচ্চারণে যেটুকু ঘৃণা বা বিতৃষ্ণা-মেশানো থুতু মিশে থাকে তা যেন ল্যাম্পপোস্টের চারপাশ থেকে ছিটকে এসে নিজের ওপর আছড়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে। চোখ আপনা-আপনি অন্যদিকে সরে যায়, কোনো জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হয় না।
তবু সে একটা টান বোধ করে মহিলার প্রতি। এই টানের কোনো ব্যাখ্যা নেই ওর কাছে; তা সত্ত্বেও উপলব্ধির লক্ষ্মণরেখার ভেতর এ-আবেগ ঢুঁ মারার আগেই সে নিজেকে সরিয়ে নেয়। এরকম কেন হয় তা সে নিজেও জানে না। অথচ নিত্যদিন তা-ই ঘটছে। তখন সে ওর একমাত্র রক্ষাকবচ তিন-চার স্তরের মুখোশটি আরো আঁটোসাঁটো করে বেঁধে রাখে মুখের সঙ্গে। এরকম দুঃসময়েও মহিলা মুখোশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কীভাবে? ভয়-ডর বলে কিছু নেই নাকি? স্বপন নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে।
স্বপন পেশায় একজন আলোকচিত্র888sport live chatী। খুব বড় কাতারের আলোকচিত্রী না হলেও সবাই আজকাল ওকে চেনে। নতুন কিছু করার সার্বক্ষণিক এক তাগিদ ওর ভেতর কাজ করে। হাতেগোনা দুই-তিনটা প্রদর্শনীও হয়েছে। বাহবাও মিলেছে সেসব দ্বিজ সম্প্রদায়ভুক্ত দিগ্গজদের, যাঁদের প্রশংসা পেলে সহজেই এ-পেশায় জাতে ওঠা যায়। এখন সম্ভাবনাময় তরুণ অলোকচিত্রীদের অন্যতম সে। ওর ব্যক্তিত্ব ঈর্ষা না কুড়ালেও সম্ভ্রমবোধ তৈরি করে অন্য সহযোদ্ধা আলোকচিত্র888sport live chatীদের মাঝে। তাও-বা কম কিসে! সে মনে মনে তৃপ্তি বোধ করে সেজন্য।
চাকরি-জীবনটাও ওর বর্ণিল। অ্যাড-ফার্ম দিয়ে যাত্রা শুরু; তারপর এঁকেবেঁকে নানা সংস্থায় নৌকা ভিড়িয়ে এখন দোল খাচ্ছে এক দৈনিক পত্রিকার কোলে। এটিও কবে ছেড়ে দেবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এ পর্যন্ত যত জায়গায় সে চাকরি করেছে, সেগুলি বছর দুয়েকের মাথায় ছেড়ে দিয়েছে। বর্তমান পেশায় এখন অবধি আয়ু পেরোল দেড় বছর। ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’ ভাব এখনো জাগেনি। এবার ইচ্ছেটা ভেতরে ঢুঁস মারলে অবশ্যই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দিকে ঝুঁকবে সে। সেভাবেই নিজে তৈরি হচ্ছে দিন-দিন।
স্বপন খন্দকার যে আর দশজনের মতো নয়, তা সে ভালোই বুঝতে পারে। ওর ভেতরকার 888sport live chatীমন ওকে সারাক্ষণ খোঁচায়। ভাবায়, সে অন্যরকম। কেননা, ওর ভেতরকার বিচারবুদ্ধি ও সংস্কৃতিবোধ আর সবার মতো নয়। একটুখানি ব্যতিক্রমের রং এর সঙ্গে মিশে রয়েছে। নইলে চৈত্রের কাঠফাটা দুপুরে তৃষ্ণার্ত একটা দাঁড়কাক পানির ট্যাংক থেকে চুইয়ে-পড়া পানি পান করার জন্য মাথাটা যখন অস্থিরভাবে ডান-বাঁ করতে থাকে তখন ওর হাত অত নিশপিশ করবে কেন? একটা স্টিল-ছবির জন্যে মন এত আঁকুপাঁকু করার কারণ কী?
যে-মহিলাটি এমন দুঃসহ করোনাকালের সন্ধ্যাবেলায় সোডিয়াম বাতির নিচে দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপর ভাবলেশহীন দৃষ্টি ফেলে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তাকে ক্যামেরাবন্দি করার তীব্র তাগিদ বোধ করবে কেন নিজের ভেতর?
গ্রামের রাস্তায় অকিঞ্চিৎকর এক ঝুমকো ফুলের ছবি তোলার জন্যে মন কেন অত উদাস হয়? কেন বৃষ্টির অঝোরধারায় এক ন্যাংটো শিশুর ভেজার দৃশ্য দেখে সে এত মোহিত হয়? অতুলপ্রসাদের ‘পাগলা মানটারে তুই বাঁধ’ গানটা শুনলেও মনটা কেমন যেন আনচান করে, এসব কিসের নমুনা?
এসব নানাকিছু মাথায় নিয়ে সে রিকশায় বসে থাকে। ওর রিকশা মেসের প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। তখন চোখে পড়ে কতগুলি লোক ওর বাসার সামনে জটলা পাকাচ্ছে।
নিচতলায় একটা আড়াই রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ছয়জন মিলে ভাগাভাগি করে থাকে ওরা।
সেই বাড়িটার সামনে কতগুলি লোক জড়ো হয়েছে। রাতের বেলার নাগরিক আলো-আঁধারি আর মুখোশের কারণে দূর থেকে চেনার উপায় নেই মুখগুলি। অনেক পরিচিত মুখও তখন অপরিচিত দেখায়। ভয়ও হয়। যদি অদৃশ্য করোনা ভাইরাস ঢুকে পড়ে নিজের শরীরে?
সে কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগটা ঝুলিয়ে দৃপ্তভঙ্গিতে রিকশা থেকে নামে। একঝলক তাকায় জটলার দিকে।
ওকে চমকে দিয়ে কর্কশ এক কণ্ঠ জটলার ভেতর থেকে বলে উঠল, ‘চিনবার পারছেন ভাই?’
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে ফেলার ফাঁকে একটুক্ষণ জিরিয়ে অচেনা কণ্ঠটি ফের চেঁচিয়ে উঠল, ‘চিনবার পারলেন না? আমি হামদু। আপনে যে বাসায় থাকেন এর তিন বাসার পরের গলিটার ছয় নম্বর বাড়িটা আমরার। একবার আপনাগো মেসে বুয়া চুরি করল। আমি বিচার কইর্যা দিলাম। এইবার পারছেন চিনতে?’ মুখোশটা সরিয়ে তেঁতুল-দাঁত-কটি কেলিয়ে হাসে লোকটা। হাসির গমকে মরা গাছের গুঁড়ির মতো বেঢপ মুখখানি কাঁপতে থাকে। যেন অনেক খোঁজাখুঁজির পর পরিচত এক আপনজন ওর বাসার ঠিকানার সন্ধান পেয়েছে!
স্বপন নিমেষে চিনতে পারে। গায়েপড়া স্থানীয় এক লোক। কোনোকালে মহল্লায় মাস্তানি করে বেড়াত। গাট্টাগোট্টা
শরীর-স্বাস্থ্য। এখন বাপ-দাদার শরিকী বাড়ির ভাড়া তোলা নিয়ে ভাগীদারদের সঙ্গে অহেতুক ঝগড়া বাধায়, বসে বসে খায় আর গায়েপড়া মাতব্বরি করে মহল্লায়।
এ এমন এক মানুষ যাকে এড়িয়ে চলতে পারলে নিজেকে হালকা লাগে, আর না এড়ানো গেলে বিরক্তিতে মাথা গরম হয়।
‘হ্যাঁ, চিনব না কেন? আপনি তো মহল্লার বিখ্যাত লোক।’ হাসিমুখে এটুকু বললেও মনে মনে বলতে ছাড়ল না, ‘তোমারে ভালোই চিনি মিঞা। বুয়ার কাছ থেকে পর্যন্ত ‘তোর কিছু হবে না বলে’ বলে পাঁচশো টাকা হাতিয়ে নেওয়া পাবলিক তুমি। তুমি তো সেই লোক। চিনব না কেন?’
হামদু হে হে করে একধরনের বিনয়-বিগলিত হাসি হাসতে লাগল। ওর কথাবার্তা আর হাবেভাবে মনে হচ্ছে বিধ্বংসী করোনা ভাইরাসটির সঙ্গে ওর দারুণ বন্ধুত্ব জমে গেছে। সারা পৃথিবীকে ধ্বংস করতে পারলেও ওর আর সাঙ্গপাঙ্গোদের বেলায় দুর্ধর্ষ এ-ভাইরাস ঠিকই হাঁটু ভেঙে বসে করজোড়ে বলবে, ‘অ্যানি প্রবলেম, ওস্তাদ?’
স্বপন জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপারটা কী?’
‘আওনের সময় একটা মাগিরে দেহেন নাই ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়ায়া নাগর খুঁজবার লাগছে? মাগিরে একটু টাইট দেওন দরকার। পাড়া-মহল্লার পোলপান খারাপ অইয়া যাইতাছে। মহল্লাবাসী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আছে না? পোলাপান তো খারাপ অয়ে যাবে, সাংবাদিক সাব। তাই না?’
স্বপন একেবারে থ। করোনকালেও এসব চলে? তাও প্রকাশ্যে? মাথার ভেতর জট পাকায় নানা ভাবনা।
এ-সময় পাড়ার দুটো ক্ষুধার্ত নেড়ি কুকুর ঘুরঘুর করতে থাকে ওদের আশপাশে। খাবারের অভাব এখন সবখানে। ডাস্টবিনগুলি শূন্য। তাই ওদের গলা থেকে যে শব্দ বেরুচ্ছে তা বড়ই ম্রিয়মাণ শোনাচ্ছে।
স্বপন মাথা নেড়ে হামদুর কথায় সায় জানায়। এরকম উত্তেজক সময়ে কী বলা উচিত সে বুঝতে পারে না। এসব লোক প্রকৃতিগতভাবে খুব হিংস্র হয়। কোন কথায় কখন কাকে বেকায়দায় ফেলে দেবে, তার চাইতে কথা কম বলা ঢের ভালো।
সে চুপচাপ থাকে।
হামদু বলতে থাকে, ‘মাগির বয়স কত জানেন? পঞ্চাশ। আগ বয়সে এইসব করছস, মাইনা লইলাম। অহন কুনতালে এগুলান করছ? মাইনষের বাড়িত কাম করলেও তো পেটটা চলে। না, তাইর কামকাজ ভালা লাগে না। নডি কি ভালা অইতে পারে? নইলে করোনার সময়ে কেউ রাস্তায় গিয়া দাঁড়ায়, কন? যহন জামাই-বউ পর্যন্ত পারলে দুই বাড়িত হুতে, তহন তুই কেমনে দাঁড়াছ ধান্ধায়?’ প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় সামনে দাঁড়ানো মহল্লার কতগুলি গোঁয়ার টাইপের মূর্খ ছেলেপিলের উদ্দেশে। ওরা উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকে স্বপনের মুখের দিকে।
স্বপন পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘আমার কী করতে হবে, ভাইজান?’
‘আপনে সাংবাদিক মানুষ। মাগির একটা ছবি তুইলা পত্রিকায় ছাপাইয়া দিতে অইব। নাম দিবেন করোনাকালের নষ্টামি।’ বলে খ্যাক-খ্যাক করে হাসতে শুরু করে হামদু। চোখে ভেসে বেড়ায় একধরনের নিষ্ঠুরতা।
‘আপনারা মহিলাকে মানা করেন নাই? নিজেদের বাসাবাড়িতে কাজের ব্যবস্থা করে দেন। অবশ্য এ-সময় কে-ই বা কাজ দেবে? সবাই তো সন্দেহ রোগে জর্জরিত।’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে স্বপনের বুক চিরে। ওর নিজের চাকরিটাও যে কদ্দিন এ করোনা-বাজারে টিকে থাকবে, কে জানে! এ সময় জানুয়ারির ঠান্ডা হাওয়া হুল বসায় শরীরে।
‘করি নাই আবার? মাগির মুখ ম্যালা খারাপ। যা খুশি তা কয়। আমারে পর্যন্ত ছাড়ে না। কয়, বেজন্মার ঘরের বেজন্মা, ঘরের কাজকাম দেওনের কতা কইয়া যা করবি, আমি হেইডাই করি। সাংঘাতিক বজ্জাত টাইপ।’ হামদু রাগ ঝরায় সবার সামনে।
কথা শুনে স্বপনের হাসি পায় বড়। এরকম শক্তপোক্ত দেহের অধিকারী একদা মাস্তানও যে রাস্তার বেশ্যার গালাগাল শুনে ভীত-সন্ত্রস্ত হতে পারে তা না দেখলে ঠিক বোঝা দায়।
স্বপন রসিকতা করে বলেই ফেলল, ‘আপনি তাতেই ভয় পেয়ে গেলেন?’
প্রশ্ন শুনে হামদু সবার সামনে কিঞ্চিৎ হতচকিত হয়ে পড়ে। পরক্ষণে নিজেকে সামলে ওর স্টাইলে বলে উঠল, ‘আমগো তো একটা প্রেস্টিজ আছে ভাই। সমাজে একটা মানসম্মান নিয়া চলি। মহল্লার পোলাপান আমগোরে মানে। ওর মতো রাস্তার মাগি তো না আমরা।’ বলে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে থাকে সবার সামনে। ফাটা বাঁশের মতো গলা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। আশেপাশের বিল্ডিং থেকে সতর্ক উঁকিঝুঁকি মারে কিছু কৌতূহলী মুখ।
স্বপন ফের মনে মনে হাসে। দুজনার মাঝে সত্যিকার অর্থে কতটুকু পার্থক্য তা সে ভাবার চেষ্টা করে।
এবার সে স্পষ্ট করে বলে, ‘আপনারা কি এখন আমাকে দিয়ে ওই মহিলার ছবি তোলাতে চান?’
হামদু তার সাঙ্গপাঙ্গদের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয় একঝলক। তারপর বলে, ‘আপনের লাইগ্যাই তো দাঁড়ায়া আছি। চলেন।’
‘এখন? আমি ক্লান্ত। সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরছি।’ স্বপন ওর চেহারা-সুরতে একটা শ্রান্তির ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে।
‘কিন্তু মাগিটা তো রাইতেই এইখানে আইসা দাঁড়ায়। চলেন। আমরা হইলাম মহল্লার লোক। ভয় নাই আপনের। সমাজটারে প্যাক-কাদামুক্ত রাখাটাই আমরার কাজ, বুঝলেন না? চলেন!’ কথা বলায় একধরনের আদেশের সুর। আরেকটু বাড়লে হয়তো তা ধমকে পরিণত হবে।
স্বপন তা আন্দাজ করে নানারকম অজুহাত হামদুর সামনে বিনীতভাবে উপস্থাপন করতে থাকে। কিন্তু হামদু নাছোড়বান্দা। সে যে করে হোক আজ রাতেই কাজটা সেরে ফেলতে চায়। ওর ধারণা, মহিলাকে যত দ্রুত ল্যাম্পপোস্টের তলা থেকে সরানো যায়, তত কলুষমুক্ত হবে এ-সমাজ, তত কম বয়সের ছেলেরা সৎচরিত্রের অধিকারী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখবে সমাজে।
স্বপন অনুনয়ের সুরে বলে, ‘আমি কথা দিচ্ছি কাজটা করে দেব। আমার পুলিশ বন্ধুরা আছেন। তাদের কাউকে বলে অবশ্যই কাজটা করে দেবো। কথা দিলাম।’
হামদু ঘাড় কাত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে ক-সেকেন্ড। তারপর ফোঁস করে ওঠে, ‘কামডা করবেন না তাইলে? ঠিক আছে। যা করার আমরা মহল্লাবাসীই করুম। কিছু মনে কইরেন না। বিরক্ত করলাম। এ্যাই চল্ তোরা। সময় নষ্ট কইর্যা লাভ নাই। চল।’ কথা বলার মাঝে এতটাই গোঁয়ার্তুমি মিশে ছিল যে, স্বপন ভয় পেয়ে যায়।
সে মিনমিন করে বলে, ‘মাইন্ড করলেন ভাই?’
‘আপনের ওপরে মাইন্ড কইর্যা কী অইব? এ-মহল্লায় থাকেন, ভাই হিসাবে একখান মহৎ আবদার করছি, রাখেন নাইকা। অসুবিধা কী। যাইগা। দড়ি প্যাঁচাইয়া লাভ নাই। আগে জানলে সময় নষ্ট করতাম না। শ্লা-মালিকুম।’
হামদু চলে যাওয়ার বেশ কদিন পর ওরই এক সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করেছিল এসবের কারণ। উত্তরটা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেল, ‘মাগি তো হেরে অনেকদিন ধইরা ভাড়া দেয় না। গালিগালাজ করে খালি।’
‘মানে?’
‘আরে, হামদু রেলওয়ের বস্তিটা থেইখ্যা ভাড়া তুইলা খায় না? ওই মাগি তো হেরে গনাত ধরে না। এইজন্যই তো হের রাগ।’ বলে ফিকফিক করে হাসতে থাকে।
স্বপন কোনো কথা না বলে একবার ভাবার চেষ্টা করে মহিলার চেহারা।
চেহারাটি স্পষ্ট নয়। শুধু একটা অস্তিত্বের কথা মনে পড়ে ওর, আর কিছু নয়।
দুই
করোনাকাল।
মানুষের সবরকম সাধ-আহ্লাদ আর ঘোরাঘুরির পায়ে শিকল এঁটে দিয়েছে ভাইরাস। যেভাবে কলাগাছের মতো চোখের সামনে, টেলিভিশনের পর্দায় সকাল-বিকেল মানুষগুলি নেই হয়ে পড়ছে তাতে যে-কারো অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠার কথা। কোথাও এতটুকু সান্ত্বনা নেই। শঙ্কা, সন্দেহ আর আত্মমগ্নতা মানুষগুলিকে ছোট থেকে আরো ছোট করে তুলছে। মানুষ যেন ইঁদুর হয়ে পড়ছে দিনদিন; আলো কিংবা মানুষের পদচারণা চোখে পড়লেই লুকোতে চাইছে গর্তে। এমনকি, শ্মশান বা কবরেও কেউ যেতে চায় না শেষ বিদায় জানাতে। কী নিষ্ঠুর, কী স্বার্থপর সমাজ – ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে স্বপনের। বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলেমেয়েদের মমতাভেজা সাবলীল সব চিরদিনের সম্পর্কেও ফাটল ধরিয়েছে এ-ভাইরাস, দাঁত বসাচ্ছে অমোঘ মৃত্যুচিন্তা!
তবু এরই ভেতর কোথাও এতটুকু সুযোগ পেলে ছুটে যায় স্বপন। ভেতর থেকে একধরনের তাড়না ওকে কুরে কুরে খায়। একটা অদেখা ছবি চুম্বকের মতো ওকে টানতে থাকে। কে যেন ফিসফিস করে বলতে শুরু করে, ‘যা। যা না। ঠিক পাইয়া যাবি। অত ভয় পাস ক্যান?’
এ শুধু পত্রিকার ধরাবাঁধা চাকরি নয়; এর চেয়ে ঢের বেশি কিছু!
ভালুকার যে-জায়গাটায় করোনার ভেতর স্বপন চলে গিয়েছিল সেটি ঠিক অজপাড়াগাঁ নয়। বড় রাস্তার বাঁ-পাশ দিয়ে কংক্রিটের সরু রাস্তা সিঁথির মতো অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এর আশপাশে গড়ে উঠেছে কতগুলি গ্রাম। সবচাইতে কাছে যে-গ্রামটি, সেখানটায় গিয়ে উঠল স্বপন।
উদ্দেশ্য একটাই – লোকমুখে যে-মানুষটির নাম শুনেছে তার স্থিরচিত্র গ্রহণ করা।
বাড়িটি খুঁজে পেতে দেরি হলো না। শনছাওয়া মাটির ঘর। চারপাশে বড়বড় গাছ আর লতাগুল্ম ঘিরে রাখায় জায়গাটা বেশ শীতল।
হাতে ক্যামেরা থাকায় শিং মাছের পোনার মতো বেশকিছু ছেলেপিলে ওর পিছু নেয়। স্বপন উপভোগ করে ওদের সঙ্গ এবং শেষ পর্যন্ত বহুশ্রুত অদ্ভুতদর্শন লোকটির দেখা পেয়ে যায়।
‘অ্যাই লোকটাই মাকড়সা মানুষ?’ নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করার আগেই হাতের ক্যামেরা চলতে শুরু করে ওর।
একটা-দুটো করে মোট আটটা শট।
ক্লিক-ক্লিক করে মোট আটবার।
আশ্চর্য! এ-ছবিটাই 888sport app download bd পেল জাতীয় পর্যায়ে। তাও করোনাকালের দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনাময় অসহনীয় আবহাওয়ার ভেতর। একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ। জট পাকানো চুল ঝুরিবটের মতো মাথার চারপাশ থেকে নেমে কোমর পর্যন্ত ছুঁয়েছে। বয়স হওয়ার কারণে লোকটি ধনুকের মতো বেঁকে গেছে। এখন আর দু-পায়ে হাঁটতে পারে না। সঙ্গে দু-হাতেরও দরকার হয়। সব মিলিয়ে লোকটিকে দূর থেকে দেখতে লাগে অবিকল মাকড়সার মতো।
স্বপন ছবিটা তুলে নেয় ক্যামেরায়; কিছুদিন পর দেশের বেশ কজন তারকা আলোকচিত্রীকে হারিয়ে এ-ছবি অনলাইনে এক নামজাদা সংস্থার 888sport app download bd জিতে নেয়। নিরানন্দের ভেতরও সময়টা বড় আনন্দময় তখন। ওর আত্মবিশ^াস সে-সময় আকাশ ছুঁতে চাইছে।
কদিন বাদে সে ফের ভেতর থেকে একধরনের তাগিদ অনুভব করে কিছু একটা করার। ফুল-পাখি-প্রকৃতি এবং সভ্যতার ছবি তো অনেক নেওয়া হলো। কিন্তু স্বপন চাইছে নতুন কিছু, যা আগে কখনো মানুষ দেখেনি; এমনকি, ভাবেনি পর্যন্ত!
প্রায়ই মন খারাপ থাকে। শুধু রুটি-রুজির জন্য এখানে-ওখানে ছবি নিতে ইচ্ছে করে না। মন বিক্ষিপ্ত হয়, উদ্ভ্রান্ত হয়ে এলোপাতাড়ি এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে চায়। কিন্তু উদ্দীপিত হওয়ার মতো কোনো রসদ সে খুঁজে পায় না কোথাও।
এ সময় ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়ানো এই মহিলাটিকে সে দূর থেকে লক্ষ করে।
রোজই দৃশ্যটি চোখে পড়ে। সোডিয়াম বাতির তলায় দাঁড়ানো এক নির্বিকার 888sport promo code। হামদুর বারণ সত্ত্বেও মহিলা রোজ সন্ধ্যায় এসে দাঁড়ায় নির্দিষ্ট স্থানে।
এরকম দৃশ্য, যা কি না রোজই চোখে পড়ে যেতে-আসতে, তা কিন্তু আগ্রহ তৈরি করার কথা নয় ওর ভেতর। বরং সুপ্ত কৌতূহলকে গলা টিপে মেরে ফেলারই কথা। এভাবে রোজকার অনেক দৃশ্য লোকচক্ষুর সমাদর থেকে বঞ্চিত হয়।
কেবল এ-দৃশ্যটির বেলায় স্বপনের আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু কীভাবে দৃশ্যটি ক্যামেরায় তুলে নেবে তা-ই ঠিক করতে পারছে না বেচারা। কতটুকু আলো ছড়ালে স্টিল ছবিটার ভেতর মহিলার অন্তর্গত কষ্টগুলি মিছরির দানার মতো দৃশ্যমান হবে তা নিয়ে ভাবনা আর ফুরায় না ওর।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে এখান দিয়ে যায় আর কাজের ছক আঁকার চেষ্টা করে মনে মনে। আলো আর আঁধারের পরিমাণ নিয়ে ছক আঁকে, ছবিটা সম্পূর্ণ হতে কোন উপাদান কতটুকু জরুরি তা সে হিসাব-নিকাশ করে। পরক্ষণে সবকিছু ভুলে যায়। যূঁথির কথা ভাবে। রিকশায় বসে মোবাইল থেকে রিং দেয়, ‘হ্যালো?’
‘বলো।’
‘দিল্লি থেকে ফিরবা কবে?’
‘ট্রেনিং শেষ করে যে-সময়ে ফেরার কথা, ঠিক সে-সময়।’
‘ও।’
‘তোমার কাজকর্ম ঠিকঠাক চলছে তো?’
‘তা চলছে। কিন্তু সোডিয়াম বাতির নিচে যে রংমাখা মহিলার ছবি নিতে চাইছিলাম তা আর পারছি না। পারছি না বলা ঠিক নয়। হচ্ছে না। ’
‘তাই?’
‘একদম।’
যূঁথির সঙ্গে এরকম খুচরো কথাবার্তা প্রায়ই হয়। ইচ্ছেটা ওদের কথাবার্তার ভেতরই আটকে থাকে। বের হয়ে কখনো এটি বাস্তবরূপ নিতে পারছে না। যখন ওর রিকশা ল্যাম্পপোস্টটির কাছে আসে তখন অকারণে বুক ধড়ফড় করে। অহেতুক কুণ্ঠাবোধ ওকে ঘিরে ফেলে। ভেতরকার এ কুঁচকে যাওয়া পরাজিত অনুভবটুকু টের পেলেও তা ঝেড়ে ফেলে কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে পারে না স্বপন।
এজন্য একধরনের অনুতাপ সারাক্ষণ মনে বাসা বেঁধে বসে থাকে।
হামদুর সঙ্গে দেখা হয় রাস্তায়। সে কথা বলে না। গম্ভীরভাবে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কথা বলার ইচ্ছা না হলেও অস্বস্তিবোধ ওর ভেতর কাজ করে। গায়ে পড়ে একদিন জিজ্ঞাসা করে বসে, ‘হামদু সাহেব, কেমন আছেন? রাগ করলেন?’
হামদু যেন এ-কথাটার অপেক্ষাতেই ছিল। সে চট করে উত্তর দিলো, ‘শোনেন সাহেব, আমরা খালি নিজের কতা ভাইব্যা চলি না। আশপাশে হ¹লের কতাই ভাবন লাগে। আগামী পরশু দিন জুম্মার পরপরই মজিদে মিটিং হবে মাগিটার ব্যাপারে। যদি পারেন তো আইসেন।’
‘এই সামান্য ব্যাপারে মিটিং?’ বলতে চেয়েও বলতে পারে না স্বপন। সে নিজেকে সংযত রাখে। হয়তো ভাবে, এক অচেনা-অজানা দেহপসারিণীকে ঘিরে শুধু শুধু কেন হামদুর মতো মাতব্বর গোছের ক্ষতিকর লোকের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করা, এ তো নিজের ঘরে নিজের আগুন দেওয়ার মতো কাজ।
এরকম এক বোধ থেকে যূঁথিকে রিং দেয় দিল্লিতে। সব শুনে যূঁথি বলে উঠল, ‘তুমি হামদুর কথায় খারাপ কাজটা করো না। তুমি তোমার মতো ছবি তোলো। তোমার মন যা চায় তাই শোনো।’
এ-কথায় যূঁথির প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতায় মন একেবারে নরম কাদা হয়ে যায়। দুজন দুই ভুবনের বাসিন্দা হয়েও কেন যে দুজন দুজনকে এত বোঝে – তা ভেবে আনন্দ পায় সে।
করপোরেট সেক্টরের মেয়ে যূঁথি, ভালো বেতন, বাড়ি-গাড়ি সব হাতের মুঠোয়। স্বপনের আলোকচিত্রের পাগলামির সঙ্গে কোনোরূপ যোগসূত্রই থাকার কথা নয়। একটা প্রদর্শনীতে স্পন্সর হিসেবে ওর সঙ্গে পরিচয়। দেখতে অসম্ভব সুন্দরী অথচ বিয়ে করেনি। কথা বলে চড় মারার মতো ঠাস-ঠাস শব্দ করে। হাসতে জানে বলে তো মনেই হয় না। একশ দশ পার্সেন্ট পেশাজীবী নির্মোহ মহিলা যূঁথি। অথচ স্বপনের প্রতি ওর কেন এত আগ্রহ তা-ই মাঝে মাঝে অবাক করে দেয় ওকে।
যখন-তখন বাঁধভাঙা হাসিতেও ভেঙে পড়ে, যা ওর করপোরেট নিরাবেগ স্বভাবের সঙ্গে মোটেই যায় না। টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে ওর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যূঁথি দাঁড়িয়ে রয়েছে অগাধ-অকুণ্ঠ সমর্থনের ডালি হাতে নিয়ে। ঠোঁটের কোনায় মজাদার সুস্বাদু অথচ রহস্যময় এক হাসির ছোঁয়া।
মাঝে মাঝে স্বপনের মনে হয়, সে যদি খুন করে এসে যূঁথিকে বলে যে, সে খুন করে ফেলেছে, তো যূঁথি সঙ্গে সঙ্গে বলবে, ‘আগে বোস, একটু জিরিয়ে নাও। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও। আমি দেখছি কী করা যায়। ডোন্ট ওরি।’
সেই যূঁথির কাছ থেকে সমর্থন পেয়ে সে আর দেরি করে না। মনস্থির করে ফেলে সে, হলুদ বাতির নিচে দাঁড়ানো মহিলার ছবি তুলবে। সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর সামাজিক লজ্জার চোরকাঁটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে তৈরি হয়ে যায় সে।
সে এখন মহিলাকে একজন মডেল ছাড়া আর কিছু ভাবতে চাইছে না। 888sport live chatী যেভাবে তার মডেলের মনোদৈহিক সৌন্দর্যকে উন্মোচিত করে সবার সামনে মেলে ধরে, সে-ও একইভাবে এ রহস্যময়ীর ভেতর থেকে সেই কুহককে খুঁজে বের করবে। যেভাবে সে মাকড়সা-মানবকে সবার সামনে তুলে ধরেছিল, একইভাবে এর বেলাতেও এগিয়ে যাবে সে। দেখা যাক, কী হয়।
যূঁথিকে বলে, ‘মহিলার বয়স বেশি। কেউ কাছে ঘেঁষে না।’
‘তবু ল্যাম্পপোস্টের নিচে নিয়ম করে দাঁড়ায়, খদ্দেরের খোঁজ করে। হয়তো সোডিয়াম আলোর ধাঁধায় পড়ে কোনো রিকশাওয়ালা কাছে ঘেঁষলেও বিদায় নিতে এক সেকেন্ডও দেরি করে না। সামনাসামনি মহিলা এতোটাই বয়স্ক আর অনাকর্ষণীয় দেখতে, তাই না?’
‘দূর থেকে তুমি এতটা বুঝলে কীভাবে যূঁথি?’ বিস্ময় প্রকাশ করে স্বপন।
‘বা রে, তুমি প্রতিদিন গল্প করছ এই ছবি তোলা নিয়ে আর আমি সামান্য কল্পনা করে বাকিটুকু বলতে পারব না? এটুকু ইনটুইশন না থাকলে একজন 888sport live chatীকে বুঝব ক্যামনে বলো?’
‘তুমি তো ব্যবসা-উদ্যোগের মানুষ।’
‘কেন, এই এলাকার লোকের কি 888sport live chatবোধ থাকতে নেই? এটি না থাকলে তোমার সঙ্গে কোনোরূপ চাওয়া-পাওয়া ছাড়া আমার চলছে ক্যামন করে বলো?’ বলে হাসিতে ভেঙে পড়ল সে।
স্বপন নিশ্চিত হলো, এ হচ্ছে সত্যিকার যূঁথি রহমান, কোনো ছদ্মবেশী নয়।
সে নিশ্চিন্তে সেই হাসিতে যোগ দেয়।
তিন
রিকশাটি দ্রুত এগিয়ে চলেছে ল্যাম্পপোস্টের দিকে।
যে-কোনো সৃজনশীল কাজ করার আগে যেমন রোমাঞ্চ জাগে, বারবার করে শিউরে ওঠে শরীরের লোমকূপগুলি, স্বপনেরও তাই হচ্ছে।
বুকের ভেতর জমে থাকা 888sport live chatীর অতৃপ্ত বাসনা সামান্য বৃষ্টির আশায় যেন আকাশের দিকে মুখ তাক করে থাকে।
কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের তলায় আসার আগেই সে দেখতে পায় সেখানে বেশকিছু মানুষের ভিড়।
রিকশা ভাড়া চুকিয়ে কাঁধে ক্যামেরাব্যাগ নিয়ে স্বপন এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
ল্যাম্পপোস্টের আলো হলুদের গুঁড়ো হয়ে সবার মুখেচোখে রং ছিটাচ্ছে। কাউকেই ঠিক চেনা যায় না। যেন ওরা পৃথিবীর মানুষ নয়, অন্য কোনোখানের। যেখানে পাপ, ধ্বংস, বিচ্যুতি, অবক্ষয়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অবসাদ ও ক্লান্তি কোনোকিছুই নেই।
স্বপন কারো দিকে না তাকিয়ে কাছ থেকে সোজাসুজি মহিলার ওপর চোখ রাখে। একেবারেই অপুষ্ট ভাঙাচোরা একখানা মুখ। মুখে মেকআপের সস্তা প্রলেপ সত্ত্বেও বলিরেখাগুলি স্পষ্ট তাকিয়ে রয়েছে সবার দিকে। শুকনো চিমসানো দেহকাণ্ড, পুঁতি-বসানো ঝিলিমিলি শাড়ি দিয়ে জড়ানো। কোনোভাবেই তার দিকে তাকিয়ে যৌনতা বোধ করার কথা নয় কারো। মহিলা কি তা জানে?
তবু সে নিয়ম করে এখানে এসে দাঁড়ায়, অপেক্ষা করে কোনো এক শাঁসালো খদ্দেরের, যার কাছে শরীর বেচে বিনিময়-মূল্য নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে!
কিন্তু তার সেই আশা কি পূর্ণ হয় এই করোনাকালে?
স্বপন যখন মহিলার দিকে তাকিয়ে এরকম ভাবছে, তখনি সে শুনতে পায় হামদুর গলা।
ভিড়ের একেবারে সামনে নেতা হয়ে দাঁড়ানো হামদু।
মুখ-চোখ শক্ত। দৃষ্টিতে সমাজ উদ্ধারের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
‘তোরে না মানা করছি এইখানে দাঁড়াইতে? জীবনভর পোলাপানের চরিত্র নষ্ট করছস। এখন এই বুড়া বয়সে করোনার সময়েও সং সাইজা রাস্তাত দাঁড়ান লাগে? যা ভাগ?’ স্বপন যা আশা করেছিল, সেরকম উত্তেজিত নয় হামদু। বরং ওকে খানিকটা নমনীয় বলেই মনে হচ্ছে ওর।
‘তুই আমারে মানা করণের কেডা?’ খনখন করে ওঠে মহিলা, ‘এইডা তর বাপের জায়গা?’
‘তুই জায়গাডা ছাড়বি কি না ক?’ হামদুর কণ্ঠ এবার চড়া। ওর সাঙ্গপাঙ্গ উত্তেজিত।
‘আমারে খাওয়াবি? ক, আমারে খাওয়াবি?’ ভাবলেশহীন চেহারা এবার কথা কয়। প্রসাধনী ছাপিয়ে রাগ উছলে পড়ে।
‘কাম কইর্যা খা।’ হামদুর গা-ছাড়া জুতসই উত্তর। সবার মুখে হাসির ছটা।
‘তর বাসাত কাম দিবি বুড়া খানকিরে? দিবি, ক?’ কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। সবাই বিব্রত। প্রশ্নটা যেন শুধু হামদুকে নয়, সবার উদ্দেশেই ছোড়া।
‘চুপ খানকি। জায়গাডা ছাড়বি কি না ক?’ হামদুর গলা এবার সপ্তমে।
‘আমার জোয়ান মাইয়াডা আমার ধারে থাকলেও হে গতর খাডাইয়া আমার খাওন জোগাড় করত। তাইও চইল্যা গেল।’ স্বগোতক্তির মতো বের হয়ে এলো কথাগুলি।
‘তুই জায়গাডা ছাড়বি কি না ক?’ চেঁচিয়ে ওঠে হামদু।
‘তুই আমার মাইয়াডারে ফিরাইয়া দে, বেজন্মার বাইচ্চা! জোয়ান মাইয়াডারে ফুঁসলাইয়া ঘরের বাইর করলি, খানকি করলি, পকেটে ট্যাকা ভরলি আর আমারে এই বুড়া বয়সে রাস্তায় খানকি কইর্যা নামাইয়া অহন আমারে রাস্তা থেইক্যাও তুইল্যা দিতে চাছ? আল্লাহতালা তোরে দোজখেও জায়গা দিব না। থুঃ।’ বলে সরাসরি একদলা থুূতু ছিটিয়ে দেয় হামদুর মুখ বরাবর।
সঙ্গে সঙ্গে রাগে উন্মত্ত হামদু শরীরের সমস্ত শক্তি কব্জিতে জড়ো করে মহিলার ভুখাশুকা অপুষ্ট মুখ বরাবর প্রচণ্ড জোরে এক ঘুষি লাগিয়ে দেয়। সহ্য করতে পারল না মহিলা!
‘কক’ করে একটা আওয়াজ হলো প্রথমে। মনে হলো ধারেকাছে কোনোকিছু ফেটে গেল আচমকা।
কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময়। স্বপনের চোখের পলক পড়ার আগেই মহিলার মাথাটা ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা খেলো। মহিলা সঙ্গে সঙ্গে নিচে রাস্তার ওপর চিত হয়ে পড়ে রইল। নাক দিয়ে রক্তের চিকন রেখা বেরিয়ে এসে কংক্রিটের হলদেটে রাস্তাটা ভিজিয়ে দিলো।
মহিলা মাথাটা কিঞ্চিৎ তুলে কিছু একটা বলতে চাইল, হয়তো শেষ প্রতিবাদ, পারল না, মাথাটা নেতিয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। স্বপনের মনে হলো, গলা থেকে ঘড়ঘড় করে অস্পষ্ট হলেও কটি শব্দ বের হয়ে এলো, ‘বেজন্মার বাইচ্চা।’ অস্পষ্ট, তবু সবাই বুঝতে পারল মহিলার শেষ প্রতিবাদটুকু।
ভয়ে-শঙ্কায় ক্ষণিকের ভেতর জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। সেখানে ক্যামেরা হাতে স্বপন ছাড়া আর কেউ নেই। সে-ও ফেরার জন্য দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়।
কিছুদূর গিয়ে যূঁথিকে উত্তেজিত গলায় রিং দেয়, ‘যূঁথি, হলো না। ছবি তোলা আমার হলো না। ’ কাঁদো কাঁদো গলা ওর।
‘মানে?’
‘অপুষ্ট ক্ষুধার্ত মহিলাটি এইমাত্র হামদুর হাতের এক নিষ্ঠুর ঘুষির আঘাতে ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে রাস্তার ওপর কাতরাচ্ছে। হয়তো মারা গেছে। কুণ্ডলী পাকানো দেহটি ল্যাম্পপোস্টের তলায় হলুদ আলো মেখে পড়ে রয়েছে। রাতও বাড়ছে। আমি ফিরছি বাসায়। পুলিশ আর করোনা ভয়ে এখানে এখন কেউ নেই। আমার হাত-পা কাঁপছে!’
ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা। যূঁথি হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে ঘটনার আকস্মিকতা এবং নিষ্ঠুরতা।
একটু পর যূঁথি নরম গলায় বলল, ‘তোমার মন খারাপ স্বপন? প্লিজ, ডোন্ট গেট আপসেট। আমি তো আগামী হপ্তায় ফিরছি। দেখো, তুমি চমৎকার ছবি তুলতে পারবে। আমরা আউটিংয়ে যাবো। দেখো, তুমি পারবে।’ সান্ত্বনার সুর যূঁথির মোলায়েম কণ্ঠে।
মোবাইলের সুইচটা অফ করে দেয় স্বপন। ওর ইচ্ছে হচ্ছে না যূঁথির সঙ্গে আর কথা বাড়াতে।
যেতে যেতে স্বপন একবার ফিরে তাকায় পেছনে। সহসা মহল্লার পরিচিত ক্ষুধার্ত দুটি কুকুরকে সে সেখানে দেখতে পায়। মহিলার দেহ ঘিরে ঘুরঘুর করছে!
একসময় কুকুর দুটো মহিলার নাক-মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া উষ্ণ তাজা রক্ত চেটে খেতে শুরু করে। কিছুক্ষণ বাদে আকাশের দিকে মুখ করে কুকুর দুটি প্রচণ্ড শব্দে বলে ওঠে – ঘেউ, ঘেউ।
এবার নিস্পন্দ মহিলার শরীরে চড়ে বসে চেনা কুকুরদুটি। মেকআপ করা ফ্যাকাশে মুখে লেগে থাকা শেষ রক্তবিন্দুগুলিও ওদের লালচে জিহ্বা চেটে খায়।
সুনসান রাস্তা; রাস্তার পাশে নির্জন-নিস্তব্ধ আকাশছোঁয়া অট্টালিকা আর গাছগাছালির অন্ধকার ছায়া। মাথার ওপর ল্যাম্পপোস্টের পাণ্ডুর আলো আর হিমেল কুয়াশার ধোঁয়া মিশে একাকার। কুকুর দুটো মনের আনন্দে মানুষের রক্ত চেটে খাচ্ছে; খাচ্ছে তো খাচ্ছেই।
স্বপন এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে কী যেন ভাবে। পরক্ষণে জায়গাটাতে ছুটে যায়। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে একের পর এক ছবি নিতে থাকে। নানা কোণ থেকে বিরল এ-দৃশ্যটি ধারণ করে চলে সে। এক অন্যরকম উন্মাদনা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে সারাক্ষণ।
একসময় সে ফিরে আসে বাসায়। বারবার রক্তাক্ত মহিলা আর দুটো লোলুপ কুকুরের ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ঠেলে সরাতে পারছে না ভেতর থেকে।
যূঁথিকে রিং দেয় দুদিন পর, ‘দেখো, এই দৃশ্যটি কেমন? চলবে?’ স্বপন ছবিগুলি পাঠিয়ে দেয় হোয়াটসঅ্যাপে।
‘নিষ্ঠুর।’ গম্ভীর শোনায় যূঁথি রহমানের গলা। ছবিটা দেখার পরপরই ওর শরীর কাঁপতে থাকে। শরীরের পরতে পরতে খেলে যাচ্ছে ভয়ার্ত এক শিহরণ।
থামছেই না।
‘শিরোনাম কী দেবো? বললে না তো?’ স্বপনের জিজ্ঞাসা। ওর মনে অন্যরকম শিহরণ। আরেকটা 888sport app download bdের দ্যুতিময় তারা সে যেন দেখতে পাচ্ছে নিজের আকাশে।
‘কী নাম দেবো?’ একটুখানি ভেবে নেয় স্বপন। তারপর বলে, ‘ক্ষুধা? চলবে?’ উল্লাস ঝরে ওর গলা থেকে।
ওপাশে যূঁথি আর সহ্য করতে পারে না। অপ্রকাশিত তীব্র এক যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
তারপর বেশ কদিন যূঁথির মোবাইলটি খোলা পায়নি স্বপন।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.