কে বুদ্ধিজীবী?

ইংরেজি intellectual শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি চালু হয়ে গেছে। তাই আমি ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটিই ব্যবহার করব। যদিও প্রতিশব্দটি আমার খুব একটা পছন্দ নয়। বিনয় ঘোষ ‘intellectual’-এর বাংলা করেছেন ‘বিদ্বৎজন’। আমার পছন্দ হলেও কথাটি তেমন চালু হয়নি। থাক সে-কথা। ‘কে বুদ্ধিজীবী?’ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেকেই ভাবনাচিন্তা করেছেন। বিষয়টি আমারও খুব প্রিয়। ভীষণ আকর্ষণ করে ‘বুদ্ধিজীবী কে’ – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে। ২০০০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক মাতৃভূমি পত্রিকায় ‘কাঠামোগত সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। লেখাটি আমার প্রসঙ্গ : শিক্ষা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেই লেখায় প্রসঙ্গক্রমে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে আমার কিছু ভাবনা প্রতিফলিত হয়। সেদিন আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম, ‘শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী কি সমার্থক?’ ১৯৭৩ সালে এই একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন বিনয় ঘোষ। উত্তর খুঁজতে তিনি সেদিন ম্যাক্স ওয়েবার, আর্নল্ড টয়েনবি, কার্ল ম্যানহেইম, রবার্ট মিচেল্স প্রমুখ সমাজ888sport apkী ও পণ্ডিতের ওপর দারুণভাবে নির্ভর করেছিলেন। তাঁদের লেখা থেকে বিপুল পরিমাণে উদ্ধৃতির উল্লেখ করে সেদিন তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, ‘বিদ্বান হলেই বিদ্বৎসমাজভুক্ত হয় না।’ ‘শিক্ষিত’ আর ‘বিদ্বৎজন’ এক নয়। তিনি সেদিন রবার্ট মিচেল্সের কথার উল্লেখ করেছিলেন, ‘It would be wrong to define intellectual in terms of academic examination’। আমিও সেদিন বিনয় ঘোষের লেখা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছিলাম। তাই আজকের লেখায় আমি  তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আমার এই লেখাটি সেদিনের ওই লেখাটিরই সম্প্রসারণ মনে করা যেতে পারে।

১৯৯৩ সালে এডওয়ার্ড সাঈদও who are intellectuals?- এই প্রশ্ন তুলে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। বইটি যে-কোনো কারণেই হোক আমার দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি বইটি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়। কয়েকবার পড়ি। এডওয়ার্ড সাঈদও তাঁর সিদ্ধান্তের গোড়া শক্ত করার জন্য নোয়াম চমস্কি, এন্টেনিও গ্রামসি, মাইকেল ফুকো, পিটার নোভিক, রাসেল জ্যাকোবাই, জাঁ পল সার্ত্র, জাঁ জেঁনে প্রমুখ পণ্ডিতের সাহায্য গ্রহণ করেন। আসলে বইটি তাঁর ‘রিথ বক্তৃতা’। ১৯৪৮ সালে ‘রিথ বক্তৃতা শুরু করেন বার্ট্রান্ড রাসেল। তারপর অনেকেই ওই বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করেন। যেমন রবার্ট ওপেনহাইমার, জন কেনেথ গলব্রেথ, জন সিয়ার্ল। ১৯৯৩ সালে এডওয়ার্ড সাঈদ ওই বক্তৃতাটি দেন। সেই বক্তৃতাটিই Representation of the Intellectual নামে বইয়ের আকারে প্রকাশ করে Vintage Books Addition ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে। সম্ভবত ১৯৯৪ সালে অন্য কোনো প্রকাশক বইটি প্রকাশ করেছিল।

প্রথমেই আমি অশিক্ষিত মানুষকে আমার এই লেখার গণ্ডির বাইরে রাখব। কারণ এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে বুদ্ধিবৃত্তির সাথে শিক্ষার একটা সংযোগ আছে। সেই সঙ্গে এ-কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলো শিক্ষিত মানুষ তৈরির কারখানা। তবুও প্রশ্ন ওঠে, যাঁরা ওইসব উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র থেকে উচ্চতম ডিগ্রির ছাপ নিয়ে বের হন, তারা সবাই কি ‘বুদ্ধিজীবী’? তারা সবাই শিক্ষিত, হয়ত এ-কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু বিনয় ঘোষ, এডওয়ার্ড সাঈদের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে আমিও বিশ্বাস করি যে তারা সবাই বুদ্ধিজীবী নন। তাহলে? বুদ্ধিজীবী কারা? কী বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা? যে-সংজ্ঞাভুক্ত না হলে শিক্ষিত হয়েও অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তিই বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না? যাঁরা শিক্ষিত কিন্তু বুদ্ধিজীবী নন, বিনয় ঘোষ সেদিন কৌতুকপূর্ণ ভাষায় তাঁদের নির্মমভাবে কশাঘাত করেছিলেন। তাঁর সে-লেখায় কলকাতার শিক্ষিত মহলে ঝড় উঠেছিল। এডওয়ার্ড সাঈদও একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সামান্য একটু মার্জিত ভাষায়। তাই এডওয়ার্ড সাঈদের পাশাপাশি বিনয় ঘোষের উদ্ধৃতি উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করা বেশ কষ্টকর।

 যেমন ‘কে বুদ্ধিজীবী?’- এই প্রশ্নের উত্তরে সাঈদ প্রথমেই বলেন, ‘একজন বুদ্ধিজীবী সেই মানুষ সমাজে যার বিশেষ ভূমিকা আছে। তিনি কোনো নামগোত্রহীন পেশাজীবী নন, যিনি সমাজের একজন সদস্য হিসেবে প্রতিদিন তাঁর বাঁধাধরা কাজে যান আর আসেন।’ এরপরই তিনি বলেন, ‘There is no such thing as a private intellectual, since moment you set down words and then publish them you have entered the public world.’ বর্তমানের এই রমরমা privati“ation -এর যুগে বুদ্ধিজীবীদের privati“ation সম্ভব নয়। কারণ, সাঈদের মতে, ‘বুদ্ধিজীবীদের কর্মতৎপরতার প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের স্বাধীনতা ও তার জ্ঞানের সম্প্রসারণ। যেসব বুদ্ধিজীবী দাবি করেন যে তাঁরা কেবল তাঁর নিজের জন্য লেখেন কিংবা কেবল ‘খাঁটি’ জ্ঞানচর্চা বা বিমূর্ত 888sport apkের জন্য কাজ করেন, তাঁদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করা যায় না।’ বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত লেখক জাঁ জেঁনে একবার বলেছিলেন বলে সাঈদ জানান যে, “সমাজে যখনই তুমি একটা 888sport live বা লেখা প্রকাশ করো, তখনই তুমি ‘রাজনৈতিক’ জীবনে প্রবেশ করো। সুতরাং তুমি যদি নিজেকে ‘রাজনৈতিক’ বলে প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হও, তাহলে কোনো 888sport live লিখো না কিংবা কথা বলো না।” বিনয় ঘোষও বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বের কথা বলতে গিয়ে ম্যানহেইমের উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছিলেন। ‘প্রত্যেক সমাজে নানা গোষ্ঠীভুক্ত এমন কিছু লোক থাকেন, যাঁদের কাজ হলো সেই সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি রচনা করা এবং ব্যাখ্যা করা। যাঁরা সমাজের এই জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করেন তাঁরাই বিদ্বৎসমাজের অন্তর্ভুক্ত হবার যোগ্য। তাঁরাই প্রকৃত ‘বিদ্বৎজন’ – intellectual।

সভ্যতার উষালগ্ন থেকে বুদ্ধিজীবীরা তা-ই করছেন। এমনকি লিখিত ইতিহাস শুরুর আগে যাঁরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে পূজো করার জন্য সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তাঁরাও সে-সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যেই পড়েন। কিন্তু সমাজ ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা পরিবর্তিত না হলেও তাঁদের কাজের ধারার পরিবর্তন হয়। ম্যানহেইম, মিচেল্স ও সাঈদের সংজ্ঞায় একজন ধর্মবেত্তাও বুদ্ধিজীবী। কারণ তাঁরাও একসময় সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি রচনা করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরাও সেদিন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও মানুষের জন্মের নানা তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। আজ তার অধিকাংশই আমাদের কাছে পরিত্যাজ্য মনে হলেও তাঁদের সময়ে মানুষ সেগুলো সরল মনে বিশ্বাস করত। জ্ঞানের সম্প্রসারণের সাথে সাথে তাঁদের অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং অনেক তত্ত্বই আজ ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সামন্তযুগের বুদ্ধিজীবীরাও একই কাজে লিপ্ত ছিলেন। তাঁদের কাজের ধারা ছিল সেদিনের সমাজ-সংগঠনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেদিন তাঁরা ছিলেন রাজা-বাদশাহদের আশ্রিত বুদ্ধিজীবী। দরবারাশ্রিত। তাঁরা ছিলেন রাজ-দরবারের অলঙ্কার বিশেষ। জনগণের সঙ্গে তাঁদের সামান্যতম যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তাঁদের কাজও মানুষের স্বাধীনতা ও জ্ঞানের সীমানা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। সুতরাং সামন্তযুগে তাঁরাই ছিলেন বুদ্ধিজীবী।

কিন্তু আধুনিক যুগ ও আধুনিক 888sport apkের শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীদের কর্মতৎপরতার ধারা একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে। অর্থনীতি যেমন আর সামন্তবাদের জালে আটকে থাকতে চায় না, তেমনি সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীরাও রাজা-বাদশাহর দরবারের শোভাবর্ধনে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। সামন্তবাদী সম্পদের মতো তাঁরা আর ঘড়াভর্তি হয়ে মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকতে রাজি নন। পুঁজির মতো সচল হয়ে উঠতে চান। ইউরোপীয় রেনেসাঁ, রিফর্মেশন ও 888sport live chat-বিপ্লবের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আধুনিক যুগের বুদ্ধিজীবীরা হয়ে ওঠেন বিদ্যাবুদ্ধিধারী শ্রমিক হিসেবে। সমাজ ও জনমানুষের থেকে দূরে সরে থাকা তাঁদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। সভ্যতার নতুন মোড়-পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীদের কাজের ধারাও পালটে যায়। মানুষের স্বাধীনতা ও জ্ঞানের বৃদ্ধির সাথে সাথে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। কারণ মানুষের স্বাধীনতার যেমন সীমা নেই, তেমনি সীমা নেই তার জ্ঞানের। তাই রাজ-দরবারের আয়েশী ও নিশ্চিত জীবন তাদের ধরে রাখতে পারে না। এডওয়ার্ড সাঈদ আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘There is no question in my mind that the intellectuals belongs on the same side with the weak and unrepresented.’ দুর্বল ও নামগোত্রহীন মানুষের সঙ্গে থাকাই আজকের পৃথিবীতে বুদ্ধিজীবীর প্রধান দায়িত্ব। এ-সম্পর্কে সাঈদের মনে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বের স্থান নেই। তাই আজকের সভ্যতায় কেউ যদি বিদ্যার জাহাজ হয়েও সেই বিদ্যার ভারে নুইয়ে থাকেন এবং সমাজ ও মানুষের কোনো কাজে না আসেন, তাঁকে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলা যাবে না। বিনয় ঘোষ ১৯৭৩ সালে এ-ধরনের পণ্ডিত সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেছিলেন, “মহাবিদ্বান কেউ যদি অগাধ জ্ঞানসমুদ্রে ডুব দিয়ে তলিয়ে থাকেন এবং কেবল ভুড়ভুড়ি কাটেন, যদি তাঁকে দেখা না যায়, তাঁর চিন্তাভাবনার কথা জানা না যায়, তাহলে জ্ঞানতপস্বী ‘স্কলার’ হলেও সামাজিক অর্থে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ নন।” অর্থাৎ একজন বুদ্ধিজীবীকে আজ অবশ্যই সামাজিক হতে হবে। সমাজ-পরিবর্তনে তাঁর ভূমিকা থাকতে হবে। Private বুদ্ধিজীবী বলে যে কিছু নেই সে-কথা আমরা আগেই সাঈদের মুখে শুনেছি। এবারে বিনয় ঘোষের কলম দিয়ে মিচেল্সের কথা শুনি, ‘Those who have merely accumulated knowledge are not true intellectuals. The scholar must possess priestly qualities and fulfil priestly functions, including political activity. Fichte -এর কথা উদ্ধৃত করে মিচেল্স বলেন, ‘His knowledge should be truely applied for societys use. এখানে ‘priestly qualitiesÕ Ges Ôpriestly function’ বাক্যবন্ধ দুটি নিয়ে একটু বিভ্রান্তির অবকাশ আছে। তাই বিষয়টির একটু ব্যাখ্যা দরকার। আমি একটু আগেই বলেছি প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মবেত্তারাই ছিলেন ‘বুদ্ধিজীবী’। কারণ সে-সময়ে তাঁরাই সাধারণ মানুষের চিন্তাধারাকে পরিচালিত করতেন, সেই সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি সেই সময়ের রাজ্য বা সাম্রাজ্য এবং রাজা-বাদশাহরাও অনেক সময়ে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকতেন। সেই সময়ের আচার-অনুষ্ঠান, নৈতিক মূল্যবোধ, শিক্ষা সবই নিয়ন্ত্রিত হতো ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চিন্তার বাঁধা সড়কে। আধুনিক পুঁজিবাদ সেই প্রাচীন সামন্তবাদী অচলায়তনকে ধ্বংস করে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতাকে অনেকটা বৃদ্ধি করে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে বুদ্ধিজীবীদের কাজ যুগে যুগে এক হলেও, তাঁদের কাজ করার পথ ও পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে।

তাই এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর আলোচ্য গ্রন্থে মূল প্রশ্নটি উত্থাপন করেন এই বলে যে, ‘Hwo does one speak the truth? What truth? For whom and where?’ সাঈদ মনে করেন যে আজকের ঐতিহাসিক ও সামাজিক পৃথিবীর স্রষ্টা মানুষ। আমাদের এই পৃথিবী ইহজাগতিক, সুতরাং এই ইহজাগতিক কাঠামোর মধ্যেই একজন বুদ্ধিজীবীর কাজ সীমাবদ্ধ থাকা উচিত বলে মনে করেন সাঈদ। ব্যক্তি (চৎরাধঃব) জীবনে কোনো প্রত্যাদেশ বা বাইরের কোনো প্রেরণার অপরিহার্যতার কথা অস্বীকার করেন না এডওয়ার্ড সাঈদ। কিন্তু সেগুলো যখন তত্ত্বগতভাবে ইহজাগতিক জগতে প্রয়োগ করা হয়, সেগুলো তখন সর্বনাশা পরিণতি ডেকে আনে। এমনকি তা কখনো কখনো বর্বরতার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। সাঈদ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, একজন বুদ্ধিজীবীকে সারাজীবন প্রত্যাদেশ বা গ্রন্থসমূহের অভিভাবকবৃন্দের সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত থাকতেই হবে কারণ অসংখ্যবার তাঁরা মানুষের স্বাধীনতা ও জ্ঞানান্বেষণের স্পৃহাকে লুণ্ঠন করেছে। তাঁদের শক্তহাত কোনো দ্বিমত সহ্য করে না। কোনো রকম বৈচিত্র্যকে তো সহ্য করেই না। মতপ্রকাশের আপসহীন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত রাখা একজন ইহজাগতিক বুদ্ধিজীবীর প্রধান কাজ। কোনো অজুহাতে সে-স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিলে কিংবা যে-কোনো যুক্তিতে সে-স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করার প্রচেষ্টাকে মেনে নিলে তা হবে ‘বুদ্ধিজীবী’ নামের সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল। সেজন্য সাঈদ সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেসের পক্ষাবলম্বন করা মূল কর্তব্য বলে মনে করেন। কেবল সালমান রুশদির স্বার্থে নয়, যে-কোনো সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি ও ইতিহাসবিদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর যেন কখনো বিঘ্নিত না হয়, তার স্বার্থেই সালমান রুশদির পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য বলে মনে করেন এডওয়ার্ড সাঈদ।

সাঈদের মতে, এ-যুগের বুদ্ধিজীবীকে অবশ্য প্রথাবিরোধী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী হতে হবে। নিরবচ্ছিন্নভাবে সে কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাকে কখনো দুর্বল ভাববে না। এ-সম্পর্কে তিনি এ-যুগের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী দার্শনিক ও সমাজ888sport apkী মাইকেল ফুকোর উদ্ধৃতির উল্লেখ করেন। ফুকো বলেন, ‘একজন মতাদর্শহীন ব্যক্তিকে লেখক বলা উদ্দেশ্যপূর্ণ এবং অতিরঞ্জিত করা। প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীই কোনো-না-কোনো মত ও পথের সমর্থক। তাঁর একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকে।’ উদাহরণ হিসেবে সাঈদ তাঁর Culture and Imperialism গ্রন্থ থেকে একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি বুদ্ধিজীবী অষবীরং ফব ঞড়পয়ঁবারষষব আমেরিকার গণতন্ত্রের চুলচেরা বিচার করেন এবং ইন্ডিয়ান ও কালো ক্রীতদাসদের সঙ্গে তারা যে-ব্যবহার করত তার তীব্র সমালোচনা করেন। কিন্তু সেই তিনিই ১৮৩০-৪০-এর শেষে ফ্রান্সের উপনিবেশবাদনীতি এবং আলজেরিয়া দখলের কোনো সমালোচনা করেন না। সেদিন ফ্রান্স আলজেরিয়ায় যে-গণহত্যা চালিয়েছিল, তা তাঁকে বিচলিত করে না কারণ তিনি মনে করতেন যে মুসলমানরা একটি নিম্নস্তরের ধর্মে বিশ্বাস করে। কাজেই তাদের সংশোধন করতেই হবে।

রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সংমিশ্রণে রাজনীতি আজ সকল প্রকার নিষ্ঠুরতাকে অতিক্রম করেছে বলে মনে করেন সাঈদ। তিনি যুগোশ্লাভিয়ার উদাহরণ টেনে ধর্ম ও রাজনীতির সংমিশ্রণের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। 888sport appsের ধর্মভীরু অথচ রাজনৈতিক সচেতন মানুষ এ-বিপদ সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন। তাই সাঈদ একজন বুদ্ধিজীবীর পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া বাধ্যতামূলক বলে মনে করেন। এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর এই বইতে এন্টেনিও গ্রামসির ‘Prison Notebook’-কে ভালোভাবে ব্যবহার করেছেন। গ্রামসি বুদ্ধিজীবীদের দুটি গ্রুপে ভাগ করেন। এক, ঐতিহ্যবাহী এবং দুই, জৈব বুদ্ধিজীবী। প্রথম দলে আছেন শিক্ষক, যাজক, পুরোহিত, মোল্লা এবং প্রশাসক। তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই কাজ করে চলেন। কিন্তু জৈব বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁরা তাঁদের উদ্দেশ্যকে সংগঠিত করতে জানেন; শক্তি সঞ্চয় করতে পারেন এবং আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। গ্রামসি বিশ্বাস করেন যে, জৈব বুদ্ধিজীবীরা সমাজে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁরা চিন্তার পরিবর্তনের জন্য নিরলস সংগ্রাম করে চলেন। নিজেদের সামাজিক ভূমিকা বাড়িয়ে চলেন। অন্যদিকে ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবীরা একই স্থানে স্থবির থাকতে পছন্দ করেন। চেনা রাস্তায় চলাফেরা করেন। অন্যপক্ষে জৈব বুদ্ধিজীবীরা সবসময়ে কর্মতৎপর ও চঞ্চল থাকেন। সবসময়ে নতুন কিছু সৃষ্টিতে তৎপর থাকেন।

এখানে গ্রামসি যাঁদের ‘ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবী’ বলেন, তার সঙ্গে এডওয়ার্ড সাঈদের বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞাটির কিছুটা বিরোধ দেখা যায়। সাঈদের সংজ্ঞানুযায়ী, ‘The intellectual is an individual with a specific public role in society that cannot be reduced simply to being a faceless professional, a competent member of a class just going about her/his business.’ এ-সংজ্ঞা অনুযায়ী গ্রামসির ‘ঐতিহ্যবাহী’ বুদ্ধিজীবীরা ‘বুদ্ধিজীবী’ নামের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না। এডওয়ার্ড সাঈদ একজন শিক্ষক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও আমেরিকান 888sport live football পড়াতেন। কিন্তু সাঈদ যদি তাঁর শ্রেণিকক্ষের মধ্যে কেবল তাঁর পেশায় নিয়োজিত থাকতেন, তাহলে কি তিনি আজ সারা বিশ্বে অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন? পারতেন যে না এ-সত্যটি সন্দেহাতীতভাবে সত্য। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মতো হাজার হাজার শিক্ষক ইংরেজি ও আমেরিকান 888sport live football পড়ান। তাঁরা কেউ এডওয়ার্ড সাঈদ হতে পারেননি। সাঈদ বলছেন, ‘I speak and teach about broader matters as a rank amateur I am spurred on my commitments that go well beyond my narrwo professional career’. শিক্ষকতার ক্ষুদ্র পেশাগত গণ্ডির মধ্যে সাঈদ নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। আরো বিস্তৃত ও বৃহত্তর জগতে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেসব লেখার জন্য সাঈদ আজ বিশ্বময় পরিচিত, তার সঙ্গে তাঁর পেশাগত শিক্ষকতার কোনো সম্পর্ক নেই। সেসব লেখা বা কথা তিনি কোনোদিন শ্রেণিকক্ষে উচ্চারণ করেননি। জানিয়েছেন সাঈদ নিজে। সকল ধর্মের ধর্মবেত্তাগণ মন্দির-মসজিদ-গির্জায় সারাজীবন একই শিক্ষা দিয়ে আসছেন যুগের পর যুগ। তাঁদের মধ্যে নতুন কিছু করার বা বলার প্রবণতা অনুপস্থিত। সে-ইচ্ছাও তাঁদের নেই। মানুষের ইহজাগতিক স্বাধীনতা ও জ্ঞানবৃদ্ধি তাঁদের শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়। পারলৌকিক মুক্তিই তাঁদের শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তাই ‘The purpose of the intellectual activity is to advance human  freedom and knowledge’ সাঈদের এ-কথা তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আর প্রকাশক/আমলা? তাঁরা তো অন্য জগতের মানুষ! তাঁরা তো জনগণের ছোঁয়া বাঁচিয়ে সংরক্ষিত এলাকায় বসবাস করেন। নিপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্রের তাঁরা এক শক্ত খুঁটি। কাজেই সাঈদের সংজ্ঞানুযায়ী তাঁরাও ‘বুদ্ধিজীবীভুক্ত’ হতে পারেন না। বিনয় ঘোষের সঙ্গেও গ্রামসির পার্থক্য লক্ষ করা যায়। বিনয় ঘোষ মনে করেন, মহাবিদ্বান হয়েও কেউ যদি অগাধ জ্ঞানসমুদ্রে তলিয়ে থাকেন, তাঁরা বুদ্ধিজীবী নন। গ্রামসির ‘ঐতিহ্যবাহী’ বুদ্ধিজীবীরা তো এ-দলেই।

অন্যদিকে সাঈদ মাইকেল ফুকোর কথা উল্লেখ করে বলেন যে, ‘বুদ্ধিজীবীরা একটা শৃঙ্খলার মধ্যে কাজ করলেও তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা যে-কোনো দিকে পরিচালিত করতে পারেন।’ ফুকো বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী ছাড়া আধুনিক ইতিহাসে কোনো বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, তেমনি বুদ্ধিজীবী ছাড়া পৃথিবীতে প্রধান কোনো প্রতিবিপ্লবও সংঘটিত হয়নি।’ তাই ফুকো বুদ্ধিজীবীদের যে-কোন আন্দোলনের ‘মা-বাবা, অবশ্যই পুত্র-কন্যা, এমনকি ভাইপো-বোনপো’ বলে উল্লেখ করেন।

সাঈদ রাসেল জ্যাকোবাইয়ের The last intellectuals : American Culture in the Age of Academe বইটি থেকে বড় উদ্ধৃতির উল্লেখ করেন। জ্যাকোবাই তাঁর বইতে বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে nonacademic বুদ্ধিজীবীরা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেছে। সেই স্থান দখল করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভীরু এবং দুর্বোধ্য অধ্যাপকবৃন্দ, যাদের প্রতি সমাজের একজন মানুষও কোনো গুরুত্ব দেন না।

জ্যাকোবাই মনে করেন বুদ্ধিজীবীরা শহুরে মানুষ। টৎনধহ। এর ফল হয়েছে এই যে আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চিত আয়ের ক্ষুদ্র নিভৃত শ্রেণিকক্ষে নিজেদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করেন। শ্রেণিকক্ষের বাইরে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীর সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক স্থাপন করতে চান না তাঁরা। জ্যাকোবাই অভিযোগ করেন যে, এই ধরনের বুদ্ধিজীবীরা রহস্যজনক ও রুচিহীন গদ্য লিখে থাকেন যা কেবল অ্যাকাডেমিক উন্নয়ন ঘটায় – সমাজে বিন্দুমাত্র ঢেউ তোলে না। সুতরাং তাঁর মতে, বর্তমানের এই নয়ারক্ষণশীল আন্দোলনের সময় একসময়ের স্বাধীন, প্রগতিশীল বামপন্থি বুদ্ধিজীবীরা খোলাখুলিভাবে প্রতিক্রিয়াশীল না হলেও, তাঁরা রক্ষণশীল সামাজিক এজেন্ডার প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। আমেরিকার সবচেয়ে নামকরা প্রগতিশীল পত্রিকা Nwe York Reviwe of Books এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানকার প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকাগুলো উঠতি লেখক ও সাংবাদিকদের টানছে, যাঁদের মধ্যে এককালের অনেক বামপন্থি বুদ্ধিজীবীও আছেন। সবশেষে জ্যাকোবাই বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে তাঁর ধারণাটি প্রকাশ করেন এই বলে যে, ‘all incorrigibly independent soul answering to no one.’ এভাবে একটি প্রজন্ম হারিয়ে গেছে এবং জ্যাকোবাইয়ের মতে, ‘একদল মুখচাপা ও ক্লাসরুম টেকনিশিয়ান, যারা সহজেই প্রভাবশালী কমিটির ভাড়াটে বাহিনীতে পরিণত হতে পারেন কিংবা যারা সবসময়ে উৎসাহদাতা পৃষ্ঠপোষক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহকে তুষ্ট করতে সর্বদা ব্যস্ত থাকেন কিংবা সেইসব শিক্ষাগত প্রশংসাপত্র এবং সামাজিক কর্তৃপক্ষ যা বিতর্ক-সৃষ্টিতে উৎসাহ প্রদান করে না বরং যশ বা খ্যাতি এনে দিতে পারে এবং সেইসঙ্গে nonexpert -দের ভয় দেখায়, তাদের ভয়ে কণ্টকিত হয়ে থাকেন, এমন ব্যক্তিরা সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে।’

সাঈদের কাছে এ-চিত্র অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ও অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, জ্যাকোবাই যা বলেন তা কি সত্যি? যদি সত্যি হয়, তবে তার জন্য তিনি যেসব কারণের উল্লেখ করেছেন সেগুলো কি সত্যি? আমরা কি তার জন্য আরো গ্রহণযোগ্য সুস্পষ্ট কোনো কারণের উল্লেখ করতে পারব? তাই সাঈদ এক্ষেত্রে জ্যাকোবাইয়ের সাথে সামান্য দ্বিমত পোষণ করেন এবং মনে করেন তাঁর কথা পুরোপুরি সত্যি নয়। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর পরিপ্রেক্ষিতে কথাগুলো বলেছেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সে কয়েকজন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন স্বাধীন বুদ্ধিজীবীর দেখা পাওয়া যায়। যেমন, সার্ত্র, কাম্যু, অ্যারোন, সিমন ডি বুভ্যোয়া প্রমুখ। বিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীর কাজ কেবল বিতর্ক-সৃষ্টির মাঝে সীমাবদ্ধ নয় বলে মনে করেন সাঈদ। যেমনটা বেনডা করেছেন। কিছুটা রাসেলও করেছেন। বিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবীর কাজ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘সমালোচনা ও মোহমুক্তির সাথে সাথে মিথ্যা পয়গম্বর ও প্রাচীন ঐতিহ্য এবং মহাপুরুষদের চেহারা উন্মোচন করা’ আজকের বুদ্ধিজীবীর অন্যতম প্রধান কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। পিটার নোভিকের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে সাঈদ বলেন যে, “আজ কেবল ‘বস্তুগত সত্য’ সম্পর্কে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঐকমত্য হারিয়ে যায়নি, হারিয়ে গেছে অনেক ঐতিহ্যবাহী কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে ঐকমত্য। এমনকি ঈশ্বর সম্পর্কেও।” সাঈদ বলেন যে, ইতিহাসবিদদের মতো অ্যাকাডেমিক বুদ্ধিজীবীরা আজ সমাজে ভাষার ভূমিকা, ঐতিহ্যিক চিন্তার স্থায়িত্ব এবং ইতিহাস লেখার ধারাকে পুনর্বিন্যাস করে ফেলেছে। বুদ্ধিজীবীরা কোনো ঈশ্বর নন, তাঁরা হার না-মানা শক্তি, যে-শক্তি মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য কাজ করে – মানবসমাজকে আলোকিত করার কাজে নিরলস লড়াইয়ের ময়দানে থাকেন। সাঈদের মতে, আজকের বুদ্ধিজীবীদের জন্য সবচেয়ে ভয়ের কারণ পেশাদারিত্ব। বুদ্ধিবৃত্তিক কাজকে যাঁরা জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁরা ৯টা-৫টা অফিস করেন; নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখেন এবং নিজেকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করেন এবং মনে করেন যে কেবল তাঁরাই বস্তুগত সত্যের পুরোধা।

সার্ত্রের মতে, বুদ্ধিজীবীরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে দার্শনিকরাজা নন যে মানুষ তাঁদের পুজো করবে। বুদ্ধিজীবীরা সবসময়ে সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। ফুকোর সংজ্ঞা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীরা ভালো ও মন্দে বিভক্ত। তাঁরাই ভালো যাঁরা সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। মানুষের মঙ্গল ও স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন। এঁদের বলা যায় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। আর মন্দ বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবিপ্লবী। তাঁরা নতুন জ্ঞান888sport apk চর্চার বিরোধিতা করেন। মানুষের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে চান। তাঁরা বর্তমান শোষণমূলক সমাজ-কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধিকে পরিচালিত করেন। এঁরা অস্থিমজ্জায় প্রতিক্রিয়ার দুর্গ।

এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, আজকের বুদ্ধিজীবীকে প্রধানত চারটি চাপ সহ্য করতে হয়। এক. speciali“ation, যা একজন বুদ্ধিজীবীর উত্তেজনা ও আবিষ্কারের স্পৃহাকে হত্যা করে। অথচ উত্তেজনা ও নতুনের সন্ধান একজন বুদ্ধিজীবীর চিন্তাচেতনাকে জড়িয়ে থাকে। দুই. বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান, বীঢ়বৎঃরংব – অ্যাকাডেমিক এবং নন-অ্যাকাডেমিক। একজন expertise না-হয়েও চমস্কি ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর যা লিখেছেন, অফিসিয়াল মার্কামারা expertise -রা তা পারেননি। তিন, কেন্দ্রীভূত শক্তি। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা বুদ্ধিজীবীদের ভাগ করে নিয়েছে। তাছাড়া সেদেশের রকফেলার, ফোর্ডস ও মেলনেরা গবেষণার জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। তার একটি প্রজেক্ট পেলেই একজন বুদ্ধিজীবী লাখ ডলারের মালিক বনে যান। তাই Professionalism বা পেশাদারিত্ব বলতে যা বোঝায় তাকেই সাঈদ একজন বুদ্ধিজীবীর জন্য সবচেয়ে মারাত্মক ভয়ের কারণ বলে শনাক্ত করেন। সে-কথা আগেই বলেছি।

তাই সাঈদ বলেন, ‘গত দুবছরে প্রচার-মাধ্যম আমাকে বেশ কয়েকবার পেশাদার (অর্থের বিনিময়ে) উপদেষ্টা নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ খুবই সোজা। তা আমাকে কেবল একটি টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের মধ্যে বন্দি রাখত। তাছাড়া তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ভাষার মধ্যে আমাকে সীমাবদ্ধ থাকতে হতো। একইভাবে সরকারি কোনো কনসাল্ট্যান্সিতে আমার কখনোই কোনো আগ্রহ ছিল না। কেননা, আমি জানি না সেখানে আমার মতানুসারে আমি কতটা কাজ করতে পারতাম। দ্বিতীয়ত, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বক্তৃতা করার ব্যাপারেও আমি ভীষণ দ্বিধান্বিত ছিলাম। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাবলিক বক্তৃতা দেবার আহ্বান জানালে আমি সবসময়ে স্বাগত জানাই, কিন্তু অফিসিয়ালদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সামনে আমাকে বক্তৃতা দিতে ডাকলে আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। তৃতীয়ত, যখনই কোনো প্যালেস্টাইন গ্রুপ কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সাহায্য ও বক্তৃতা দিতে ডাকে, আমি সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করি এবং সেখানে আমি বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে এবং অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলি। সেখানে আমি আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস ব্যক্ত করতে পারি। যে-সমস্ত মূল্যবোধ ও আদর্শে আমি বিশ্বাসী, সেইসব মূল্যবোধ ও আদর্শের সঙ্গে মিলে যায় যেসব কাজ ও আদর্শ, আমি সেগুলোকেই সমর্থন করার জন্য বাছাই করি। আমার পেশার ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে আমি বাধ্য মনে করি না।’

সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার মনোভাবকে সাঈদ সবচেয়ে নিন্দনীয় ব্যাপার বলে মনে করেন। এর ফলে একজন বুদ্ধিজীবী যে-কোনো সংকটাপন্ন অবস্থা এবং নিজের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে দূরে সরে থাকেন। যদিও তিনি সে-অবস্থানকে সত্যি বলে মনে করেন। এঁরা সমাজ ও দেশের কাছে নিজেকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বলে তুলে ধরতে পছন্দ করেন, যদিও তাঁরা তা নন। এঁরা বিতর্কিত হওয়া থেকে সভয়ে দূরে সরে থাকতে চান। এঁরা মুনিব বা কর্তৃপক্ষের সুনজরে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁরা পক্ষপাতহীন একটি অবস্থানে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে চান। তাঁরা নিজেকে বাস্তববাদী ও মধ্যপন্থি বলে দাবি করেন। তাঁরা সবসময়ে মনে মনে আশা পোষণ করেন যে একদিন শক্তিমান কর্তৃপক্ষ তাদের ডাকবেন এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এভাবে তাঁরা ক্ষমতাবান প্রধান ধারার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পছন্দ করেন। ফলে এঁরা আশা করেন একদিন তাঁদের কপালে শিকে ছিঁড়তেও পারে। জুটে যেতে পারে কোনো সম্মান, ডিগ্রি, বিরাট কোনো 888sport app download bd, এমনকি কূটনৈতিক পদ। এ-ধরনের মনোভাব একজন বুদ্ধিজীবীর পক্ষে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।

সাঈদ মনে করেন যে, এ-ধরনের মনোভাব একজন বুদ্ধিজীবীর চরিত্রহননে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন ‘For an      intellectual these habits of mind are corrupting per      execllence…. If aûthing can denature, neutrali“e and finally kill a passionate intellectual life it is the internali“ation of such habits.সহায়ক গ্রন্থ :

১. শহিদুল ইসলাম প্রসঙ্গ : শিক্ষা; শিক্ষাবার্তা প্রকাশনা, 888sport app, ফেব্রুয়ারি ২০০২।

২. বিনয় ঘোষ : বাংলার বিদ্বৎসমাজ, ৪র্থ সংস্করণ, প্রকাশভবন, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০০।

৩. Edward W. Said, Representation of Intellectuals, First Vintage Books Addition, April, 1996.