কোজাগরি জ্যোৎস্না

দুপাশে ঘন জঙ্গল, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পথ। পাকা সড়ক সমতল ছাড়িয়ে লাটিমের লেত্তির মতো পাক খেতে খেতে একেবারে উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়। সমন্বয় নিজেই ড্রাইভ করছে। যদিও সে খুব একটা পটু নয়, তবে মাঝেমধ্যে ড্রাইভার ছুটি নিলে এদিক-সেদিক যাওয়ার অভ্যাস আছে। শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় চালানো শক্ত, তার চাইতে হাইওয়েতে চালানো তুলনামূলকভাবে সোজা। আর ওয়ানওয়ে হলে তো কথাই নেই।

শহর ছাড়িয়েছে বহুক্ষণ। এখন ও ঘন বনপথের ভেতর দিয়ে চলেছে। সারাটা দিন এই পথে বহু গাড়ি চলাচল করলেও রাত আটটার পরে রাস্তাটা সুনসান হয়ে পড়ে। সাধারণত রাত্রি নামার আগেই লোকজন পাহাড় থেকে নেমে আসার চেষ্টা করে। খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে রাতের বেলা এদিকে কেউ আসে না।

তবে হ্যাঁ বেশ কিছু শহুরে শৌখিন মানুষ আছেন যারা উইকএন্ডে মস্তি করতে রাতের দিকে এদিকে চলে আসেন। সারাটা সপ্তাহ চরকিবাজির মতো পাঁক খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে তারা একটু নির্জন জায়গায় এসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যান। তাদের জন্যে তথাগত তামাং ‘লুম্বিনী’ নামে একটা হোটেল খুলেছেন। একেবারে পাহাড়ের পাদদেশে তিনতলা হোটেলটা অত্যাধুনিকভাবে সাজানো। এখানে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা না থাকলেও রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা আছে। দেশি-বিদেশি হরেক রকমের হরেক দামের পানীয় মজুদ আছে। আর তার সঙ্গে থাকবে নানান ধরনের স্ন্যাক্স।

পর্যটকদের কাছে ‘লুম্বিনী’ তাই পরিচিত একটি নাম। পাহাড়ে ওঠার আগে কিংবা পাহাড় থেকে নেমে পর্যটকরা এখানে ঢোকেন।

লুম্বিনীর সুস্বাদু খাবারের কথা সকলের মুখে মুখে। শহরের বিত্তবানেরা প্রায় সকলেই এখানে আসেন। জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতি মনোরম। তিনদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা, নিচে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী। উপল খণ্ডের ওপর দিয়ে গান গাইতে গাইতে সে কিশোরী-বালিকার মতো ছুটে চলেছে। 888sport promo codeর বিনুণির মতো তার স্রোতরেখা। পাহাড়ের ওপরে ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাইন, ওক আর দেবদারু। পাহাড়, জঙ্গল এবং নদীর এক আশ্চর্য ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি রচনা করেছে এ-জায়গাটা।

সমন্বয় খুব বেশিদিন আসেনি এখানে। এখানকার একটা হাসপাতালে সে জয়েন করেছে বছরখানেক হতে চলল। সমন্বয় এখনো ব্যাচেলর। সবে এমএস করে ‘সুপি’তে এখানে এসেছে। তিন বছরের বন্ডে সই করা আছে। আর মাত্র দুই বছর বাকি।

সমন্বয় এখানে এসে এক অদ্ভুত মানুষের দেখা পেয়েছে। যদিও তার কলিগ, বেশ সিনিয়র, কিন্তু তিনি যত বড় না ডাক্তার তার চাইতে বড় একজন সাধক। কাজের ফাঁকে যতবার সমন্বয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে তখন দেখেছে লোকটাকে ইয়া বড় বড় সব পুরাণ মহাকাব্য বিভিন্ন শাস্ত্রের বই পড়ছেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কথাও বলেন না তিনি। তবে চিকিৎসায় কোনোরকম ত্রুটি রাখেন না। সমন্বয় প্রথম প্রথম নিতান্ত কৌতূহলী হয়ে উঁকি মেরে দেখেছে কী বই পড়ছেন। সে-ব্যাপারে অবশ্য চিরন্তন নন্দীর বিন্দুমাত্র ভ্রƒক্ষেপ নেই।

ডা.  নন্দী এক মুহূর্তের জন্যও বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাননি। যেভাবে পড়ছিলেন সেভাবেই পড়তে লাগলেন। সমন্বয় লক্ষ করল, বেশ মনোযোগসহকারেই তিনি পড়ছেন। এই হাসপাতালের প্রায় সকল স্টাফ তাঁকে অত্যন্ত 888sport apk download apk latest version-ভক্তি করে। অথচ এই মানুষটার সঙ্গে সেদিন যে কীভাবে একজন সিস্টারের গোলমাল বেঁধে গেল সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। গোলমালটা অনেকটা দূর পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। এখন আর শুধু ডা. নন্দী বনাম বাসবী সিস্টার নন, এখন গোলমালটা ডাক্তার বনাম নার্সিং স্টাফ – দুই সংগঠনের দুজন নেতাও জড়িয়ে পড়েছেন। ডাক্তার সংগঠনের নেতা যেমন সুপারকে প্রেশারাইজড করছেন, ঠিক তেমনি সিস্টারদের সংগঠনের নেত্রীও চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন সুপারিনটেন্ডেন্টকে। তার এখন শাঁখের করাতের মতো অবস্থা। এদিকে হাসপাতালের সুষ্ঠু পরিষেবা রীতিমতো বিঘ্নিত হচ্ছে। রোগী কল্যাণ সমিতির প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান, লোকাল কাউন্সিলরও এই ঘটনার কথা জেনে গেছেন।

হাসপাতাল সুপারিনটেন্ডেন্ট সেদিন রাতেই একটা মিটিং কল করেছেন। সিস্টার এবং ডাক্তারবাবুরা যদি ঠিকমতো ডিউটি না করেন তাহলে তো ঘোর বিপদ!

সেদিন ছিল শনিবার। সন্ধের পরেই মিটিং ডাকা হলো, যাতে ডাক্তারবাবুরা সকলে উপস্থিত থাকতে পারেন।

সমন্বয়ও ছিল। প্রায় সকলেই আজ উপস্থিত অথচ ডা. নন্দী, যাকে কেন্দ্র করে আজকে এই মিটিং, তিনিই অনুপস্থিত। বেশ কয়েকবার ফোন করা হলো। ফোন বেজেই গেল, উনি ধরছেন না।

এরপর ডা. মুন্সী ফোন করলেন।

ডা. মুন্সীর সঙ্গে আবার ডা. নন্দীর বেশ দহরম-মহরম।

কিন্তু এবারো তিনি ফোন ধরলেন না।

অগত্যা ডা. নন্দীকে ছাড়াই মিটিং আরম্ভ হলো এবং চলতে লাগল। ডা. মুন্সী একসময়ে কথাটা বলেই ফেললেন, ‘দেখো, আজ আবার লুম্বিনীতে গেছে কি না। একে পূর্ণিমা তায় আবার শনিবার।’

কথাটাতে কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেল সমন্বয়।

সমন্বয়ের পাশেই ডা. মুন্সী বসে ছিলেন।

সমন্বয় সোমবার দিন ক্যান্টিনে চায়ের কাপটা নিয়ে একেবারে ডা. মুন্সীর পাশে এসে বসল। বসে এটা-সেটা বলতে বলতে ডা. নন্দী এবং হোটেল লুম্বিনীর প্রসঙ্গ তুলল।

ডা. মুন্সী অবাক চোখে বললেন, ‘তুমি এক বছর হতে চলল এখনো কোনোদিন লুম্বিনীতে যাওনি? একদিন যাও দেখে এসো কী সুন্দর জায়গা। তবে ওখানে গেলে তুমি জ্যোৎস্না রাতে যেও। পূর্ণিমা রাতে গেলে খুব ভালো লাগবে। একেবারে তিনতলায় চলে যাবে। খোলা ছাদ, উন্মুক্ত আকাশ – পাহাড়-জঙ্গল-নদীর ল্যান্ডস্কেপ।’

সমন্বয় বেশ উৎসাহ প্রকাশ করছে দেখে ডা. মুন্সী এতসব কথা জানালেন। যখন ধান পাকার সময় হয় তখন ওখানে হাতির পাল বের হয়। দলে চল্লিশ-পঞ্চাশটা করে হাতি থাকে। জ্যোৎস্নারাতে এই বুনো হাতির তাণ্ডব দেখার জন্য দলে দলে মানুষ শহর থেকে ছুটে যায়। শনি-রবিবার এবং পূর্ণিমাতে হোটেল লুম্বিনী তাই মুখর থাকে।

ডা. মুন্সীর মুখ থেকে সমন্বয় আরো একটা কথা জানল, খুবই গোপন কথা, ডা. নন্দীকে নাকি পূর্ণিমারাত টানে। যত কাজই থাকুক তিনি পূর্ণিমারাতে একবার না একবার পাহাড়ে যাবেনই। যত কাজই থাকুক না কেন, যত অসুবিধাই থাক। যেতে তাকে হবেই।

কথাটা বলতে বলতে ডা. মুন্সীর চোখ দুটো এক জায়গায় স্থির হয়ে গেল।

দুই

আজ আবার সেই পূর্ণিমাতিথি। রাত যত বাড়ছে চাঁদের আলোর প্রাবল্য তত বাড়ছে। নীলাভ জ্যোৎস্নায় চরাচর প্লাবিত হয়ে আছে।

শহর ছাড়িয়ে আরো প্রায় দশ কিলোমিটার পথ চলে এসেছে সমন্বয়। শুরু হয়েছে ঘন বন। অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে 888sport promo codeর সিঁথির মতো চলে গেছে পাকা সড়ক। গতি ধার্য করা আছে ঘণ্টায় চল্লিশ কিলোমিটার। যে-কোনো সময় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে অরণ্যের সন্তানেরা। জঙ্গলে গাছের মাথায় ওঁৎ পেতে থাকে হিংস্র চিতা, রাস্তায় পথ অবরোধ করে বুনো হাতির দল। গাড়ির জানালা খোলা থাকলে হুট করে ঢুকে পরে দুষ্টু বাঁদরছানারা। অন্ধকারের সঙ্গে গা মিলিয়ে ঘুরে বেড়ায় খতরনাক বাইসন। এসব নিয়েই যত রোমাঞ্চ। আর এ-পথে তাই রাতে গাড়ি চালানোর মজাই আলাদা। সমন্বয় রহস্যপ্রিয় মানুষ। বেশ বড়সড় একটা চাঁদ উঠেছে জঙ্গলের মাথার ওপরে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সেই নীলাভ জ্যোৎস্না রাস্তায় অপূর্ব অলংকরণ করেছে। রাস্তা সুনসান, এ-পথে এখন লোক-চলাচল সীমিত। ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে ঝিঁঝিদের ঐকতান শোনা যাচ্ছে।

সমন্বয় এখন পৌঁছে গেছে পাহাড়ের কোলে। সামনেই একটা ছোট্ট সেতু পার হলো। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছোট খরস্রোতা নদী। কিশোরী পায়ে ঘুঙুর পরা ছন্দে সে বয়ে চলেছে। সেতু থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে সে মিলিত হয়েছে অন্য একটি বড়ো পার্বত্য নদীর সঙ্গে। এই দুই নদীর সঙ্গমস্থলের থেকে কিছুটা ওপরে ‘হোটেল লুম্বিনী’। শীতকালে এই নদীর চরে জমিয়ে পিকনিক হয়। এখন বানভাসি জ্যোৎস্নায় মুখরিত চরাচর। তিনদিকে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। যেন অতিকায়  প্রাগৈতিহাসিক ম্যামথেরা দলবেঁধে একটার পেছনে একটা দাঁড়িয়ে আছে। সমন্বয় গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে লক করে এগিয়ে যায়। কিছুটা চড়াইয়ে উঠলে বাঁদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে নেপালি বস্তির দিকে। জনাপঞ্চাশেক লোকের বাস সেখানে। কাঠের তৈরি বাড়িগুলো সমতল থেকে বেশ খানিকটা ওপরে। হিংস্র জন্তুর ভয়ে মোটা মোটা শাল-সেগুনের খুঁটির ওপরে বানানো হয়েছে ছোট ঘরগুলো। দেখতে খেলনাবাড়ির মতো। রাস্তার ডানদিকে তাকালে দেখা যাবে হোটেল লুম্বিনীর সাইনবোর্ড। কয়েক পা এগোলেই হোটেলের গেট। গেট পেরোলে দুপাশে কার পার্কিংয়ের জায়গা। সমন্বয় দেখল সার সার গাড়ি রয়েছে দাঁড়িয়ে। ভাবল, এখানে গাড়িটাকে রাখলেই বুঝি নিশ্চিন্ত হতো। তারপর কী মনে করে হোটেলের দিকেই এগিয়ে গেল।

তিনতলায় উন্মুক্ত ছাদে দেখা যাচ্ছে টেবিল ঘিরে বিভিন্ন বয়সের পুরুষদের। রাতের দিকে সাধারণত মহিলারা এখানে আসেন না। সমন্বয় মৃদু আলোতে সকলকে একনজর দেখে নিল। একেবারে নদীর দিকের একটা টেবিলের কোণে সমন্বয়ের চোখ আটকে গেল। দেখল সেখানে জঙ্গলের দিকে মুখ করে বসে আছেন ডা. নন্দী। সামনে রাখা আছে একটা দামি হুইস্কির বোতল। একটা গ্লাসে অর্ধেকের কিছু কম পানীয় ঢেলে সেখান থেকে একটু একটু করে পান করছেন আর ডান হাতে ধরা সিগারেটে হালকা টান দিচ্ছেন।

সামনে পাহাড়, জঙ্গল আর নদীর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। বেশ আনমনা লাগছে তাকে। গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন মনে হচ্ছে।

সমন্বয় ধীর পায়ে ড. নন্দীর থেকে বেশ কিছুটা তফাতে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ওয়েটার এলে মৃদু গলায় সামান্য কিছু স্ন্যাক্স আর এক পেগ হুইস্কি অর্ডার দিলো। লক্ষ্য একটাই, এখানকার নৈশশোভা উপভোগ করা আর সেইসঙ্গে সামান্য দূর থেকে ডা. নন্দীকে ওয়াচ করা।

রাত বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা এখন এগারোটা ছাড়িয়েছে। দোতলা ফাঁকা হয়ে গেছে বেশ খানিকটা আগেই। এখন শুধু তিনতলায় ব্যস্ত ওয়েটাররা। বিভিন্ন টেবিলে একের পর এক পানীয় ঢালছে তারা। সঙ্গে চিজ পকোড়া, পনির টিক্কা, রোস্টেড চিকেন, রোস্টেড কাজু, মশালা বেবি কর্ন ইত্যাদি হরেকরকমের খাদ্য পরিবেশন করছে।

সমন্বয় সামনের জ্যোৎস্নাপ্লাবিত নদীর চরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, এমন এক পূর্ণিমারাতে তার বাবার মৃত্যু হয়েছিল। সে আজ থেকে প্রায় সাতাশ-আঠাশ বছর আগের কথা। বাবা এসেছিলেন এখানে একটা সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে। এক রাত্রি এখানে থেকে পরের দিন নর্থ সিকিমে যাবেন ঠিক ছিল। গ্যাংটকেও একটা প্রোগ্রাম ছিল। হোটেল বুক করাই ছিল। একাই এসেছিলেন বাবা, সমন্বয় তখন খুব ছোট। তাই মা আসতে রাজি হননি।

চিন্তার ফাঁকে ডা. নন্দী একসময় উঠে গেলেন এবং বিল মিটিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। সমন্বয় অর্ধেক খাওয়ার ফেলে তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে বিল মেটাতে মেটাতে খেয়াল করল ডা. নন্দী নিচে নেমে পার্কিংয়ে গাড়ির দিকে যাচ্ছেন। সমন্বয় দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল এবং ডা. নন্দীকে অনুসরণ করল।

ডা. নন্দী বাঁদিকে টার্ন নিয়ে পাহাড়ের রাস্তা ধরলেন। কিছুটা ওপরে ওঠার পরে গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করালেন। সমন্বয় কিছুটা দূরত্ব রেখে গাড়িটার আড়ালে এমনভাবে দাঁড়াল যাতে চট করে দেখা না যায়। তারপর ডা. নন্দীকে অনুসরণ করতে লাগল।

কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই দেখল একটা সরু গলিপথ ঢুকে গেছে নেপালি বস্তির দিকে।

গলিপথের দুদিকে আকন্দ, আকছটি, ভাঁটি ফুল, কিছু বুনো কুল এবং বৈচি ফুলের জঙ্গল আর আগাছায় ভরা।

রাংচিতার ডাল এসে মাঝে মাঝে পথ আটকে দিচ্ছে। মাথায় লাগছে পাহাড়ি বাঁশের ছোঁয়া। দূরে কয়েকটা কুকুর অনর্গল ডেকে চলেছে। একেবারে নির্জন পথঘাট।

চড়াই-উতরাই ভেঙে বেশ খানিকটা পথ চলে এসেছে। সমন্বয় বুঝতে পারছে না ডা. নন্দীর এত রাতে এখানে কিসের প্রয়োজন? প্রতি পূর্ণিমাতে কেনই-বা তিনি কিসের টানে এখানে ছুটে আসেন?

বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর ডা. নন্দী একটা ভাঙাচোরা কাঠের খুপরিঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর বেশ নিচু গলায় কাউকে ডাক দিলেন। একজন মাঝবয়েসি নেপালি মহিলা বেরিয়ে এলো। ডা. নন্দী নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি ধরে ছোটখাটো খুপরিঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। ঘরের ভেতরে একজন বয়স্ক মানুষের কাশির শব্দ শোনা গেল। মনে হলো লোকটি ভীষণ অসুস্থ। সমন্বয় কিছুটা সময় বাড়িটার পেছনে পাশাপাশি ঘন সন্নিবিষ্ট হরীতকী এবং ওদলা গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখল। আশপাশে পার্থে নিয়ামের জঙ্গল, বন তুলসীর ঝোপের ভেতরে গুচ্ছগুচ্ছ জোনাকির সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা তাকে গ্রাস করল। চোখে-মুখে নাকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। সমন্বয় এই বিরাট মশকবাহিনীর হাতে এই মুহূর্তে পরাজয় স্বীকার করে নিল। চড়-চাপাটি দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয় মনে করে একেবারে নিঃশব্দে সময় গুনতে লাগল। কিছুটা সময় পরে ডা. নন্দী বাইরে বেরিয়ে এলেন। গলার সুর নরম করে মহিলাটিকে বললেন, ‘ওর শরীরের দিকে নজর দিও, আর শোনো টাকা-পয়সা লাগলে আমায় ফোন করো রাতের দিকে। আমি তো শনিবার করে আসছিই।’

এরপর ভাঙা সিঁড়ি ধরে টলোমলো পায়ে নিচে নেমে এলেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে এলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারকয়েক দ্রুত টান দিয়ে দূরে ছুড়ে ফেললেন এবং গাড়িতে চড়ে বসলেন।

রাত দুটো বাজতে যাচ্ছে। ডা. নন্দী বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমন্বয়ও বেরিয়ে পড়ল। কিছুটা দূরত্ব রেখে তারা শহরের অভিমুখে ছুটল।

তিন

এরপরে বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। সমন্বয় ইচ্ছা করেই ডা. নন্দীর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করলেন। ডা. নন্দী কম কথা বললেও মানুষ হিসেবে খুবই উদার প্রকৃতির। কিছুদিনের ভেতরেই সমন্বয়ের সঙ্গে তার আন্তরিকতা গড়ে উঠল। সমন্বয় এখানে আসার পর থেকে ডা. নন্দী ছেলেটাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতেন। ওর  কথাবার্তা, চালচলন লক্ষ করতেন। ডক্টরস রুমে বসে সমন্বয় সিগারেট ধরায়। আগে খেত না। ডা. মুন্সীর পাল্লায় পড়ে সিনিয়রদের সামনে সিগারেট ধরায়। ডা. নন্দী বই পড়ার ফাঁকে লক্ষ করেছেন ওর সিগারেট খাওয়ার স্টাইলটা। অবিকল ওরই মতো। ঠোঁটের বাঁদিকে সিগারেটটাকে ঝুলিয়ে রেখে সমন্বয় হয়তো মন দিয়ে কারো কথা শুনছে। সিগারেটটা পুড়ে ছাইটা বেশ খানিকটা লম্বা হয়ে গেছে। যে-কোনো মুহূর্তে ঝরে পড়বে মাটিতে। সেই মুহূর্তে ডা. নন্দীর হঠাৎ পিয়াসীর কথা মনে পড়ে গেল। পিয়াসী! নামটা এখনো তার বুকের ভেতর একটা অদৃশ্য কাঁটার মতোই বিঁধে আছে। পিয়াসী তার প্রথম প্রেম, তার প্রেয়সী। কত না স্বপ্ন দেখেছিল পিয়াসীকে নিয়ে। কিন্তু তাকে ধরে রাখতে পারল কই? যে-নদী আপন খেয়ালে পাগল পারা হয়েছে তাকে কে কবে বেঁধে রাখতে পেরেছে? স্টুডেন্ট লাইফে ও যখন পিয়াসী সামনে সিগারেট খেতো তখন এমন কত দিন হয়েছে, এমনিভাবে সিগারেট পুড়ে পুড়ে নিঃশেষিত হয়ে ছাই হয়ে ঝুলে পড়েছে। তাই দেখে পিয়াসী হেসে ফেলত। বলত, ‘চিরন্তন দেখো, দেখো, কেমন দেখাচ্ছে? একেবারে ছাইয়ের দড়ি মনে হচ্ছে। আচ্ছা, ওটা খসে পড়ছে না কেন? ওটা তো কখন পুড়ে শেষ হয়ে গেছে?’

চিরন্তন মৃদু হেসে বলত, ‘ওরই নাম বন্ধন। এতো সহজেই যে মুক্ত হওয়া যায় না। সম্পর্কের টান বলে কথা। যাকে তুমি নিজের করে এতোটা সময় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিলে, যখন তার সঙ্গে তোমার দেওয়া-নেওয়ার পাট চুকে গেল তখন তাকে ঝেড়ে ফেললে। কিন্তু ঝেড়ে না ফেললে সে এমনিভাবেই ঝুলে থাকতে চায়। দেখলে তো?’

ডা. নন্দীর মনে হচ্ছে তার জীবনটা এমনি পোড়া ছাইয়ের মতো পুড়ে নিঃশেষিত হয়ে গেছে কবেই। ভাঙা হাল, ছিন্ন পাল, ভঙ্গুর জাহাজখানা নিয়ে এতোটা দিন তো কাটিয়ে দিলেন। একসময় হতাশা, বিষাদ অনেক কিছুই ঘটে গেছে জীবনের ওপর দিয়ে। ধুধু মরু বালুরাশির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে চলে এসেছেন। যৌবন চুকেবুকে গেছে কবেই, এখন বার্ধক্যের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু অতীত তাঁকে এখনো তাড়া করে ফেরে। যৌবনের সেই দিনগুলির কথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না।

অতীত 888sport sign up bonus মানেই পিয়াসী, পিয়াসীর সঙ্গে সঙ্গে মালব্যর নামটাও উঠে আসে। মালব্য বল, তাদের ব্যাচমেট ছিল। মালব্য খুব ভালো টেবিল টেনিস খেলত। সকলেই জানত চিরন্তন আর মালব্যর গভীর বন্ধুত্বের কথা। ওরা দুজনে একসঙ্গে ঘুরত, ফিরত; কিন্তু সেই বন্ধুত্বে কীভাবে যে হঠাৎ ফাটল ধরল সেটাই আশ্চর্যের। আস্তে আস্তে প্রকাশ পেল, ওদের দুজনের মাঝে এসে পড়েছে পিয়াসী পাল। পিয়াসী ওদের এক বছরের জুনিয়র ছিল। ফর্সা, রোগা ছিপছিপে পানসি নৌকার মতো। ওর দু-চোখে সবসময় রোদ্দুর ঝলমল করত। সবার সঙ্গে মিশত, সকলের সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলত। ওই বয়সে ছেলেদের মনের ভেতরে পিয়াসী-নৌকার একটা ঢেউ জাগত। অনেকেই ওর সম্বন্ধে নানান কথা বলত। চিরন্তন ছিল ওদের ক্লাসে সবচাইতে কম কথা বলা ছেলে। যে বলার চাইতে শুনতেই বেশি পছন্দ করত। সে ছেলেটার সঙ্গে পিয়াসীর যে কীভাবে এতো আন্তরিকতা, এমন মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠল, সেটা ভেবেই সকলে আশ্চর্য হলো। ওদের ক্লাসের প্রায় সকলেই জানত, চিরন্তনের সঙ্গে পিয়াসীর বিয়ে হবে। সম্পর্কের রেশ এতোটাই গড়িয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এমনই যে, মালব্য বল ওদের মাঝখানে ঢুকে পড়ায় ওদের ছন্দবদ্ধ জীবনে একটা ঝড় উঠল। পিয়াসী অগোচরে কবে থেকে যে আস্তে আস্তে মালব্যের দিকে ঝুঁকে পড়ল সে নিজেই জানত না। কিন্তু চিরন্তন বুঝতে পারতেন তাদের জীবনবীণার তার কেটে গেছে। সেই সুর সেই সপ্তকে আর বাঁধা পড়ছে না। পিয়াসী তার চাইতে মালব্যের সঙ্গে ঘুরতে, কথা বলতে বেশি পছন্দ করে। একদিন জানা গেল, মালব্য আর পিয়াসী রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে ফেলেছে। ততোদিনে ওরা ইন্টার্নশিপ শেষ করতে হাউজ স্টাফশিপ করছে। সঙ্গে পিজি এনট্রান্সের চেষ্টায় আছে। জোরদার প্রিপারেশন চলছে। এই অবসরে চিরন্তন কলকাতা ছেড়ে অনেক দূরে চলে এলেন। এখানে থাকতেই চান্স পেলেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন না করে দিল্লি চলে গেলেন। সেখান থেকে পিজি কমপ্লিট করে এই হাসপাতালে জয়েন করলেন।

সেই থেকে এখানেই চাকরি করছেন ডা. নন্দী। বর্তমানে এখানকার সিনিয়রমোস্ট তিনি। দেখতে দেখতে এই হাসপাতালেই প্রায় পঁচিশ বছর কেটে গেল। সকলেই তাঁকে ভীষণ 888sport apk download apk latest version করে। খুবই শান্ত মাথার মানুষ ডা. নন্দী; কিন্তু হঠাৎ কখনো যদি রেগে যান তখন প্রলয়কাণ্ড বেঁধে যায়।

একদিন সমন্বয় কথা প্রসঙ্গে ডা. নন্দীর কাছে হোটেল লুম্বিনীর প্রসঙ্গ তুলল এবং উইকএন্ডে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করল। ডা. নন্দী জানালেন, ‘সে ভালোই হয়, আমি একা যাই, একজন সঙ্গী হলে তো বেশ জমে।’

 সেদিনটা ছিল এমনি এক পূর্ণিমারাত। চারদিকে একেবারে জ্যোৎস্না ফুটফুট করছে। ডা. নন্দী আজ ড্রাইভ করছেন। সমন্বয় পাশে বসে হালকা চালে কথাবার্তা বলছে। পরিচিত জায়গা পার হয়ে সম্পূর্ণ একটা নতুন পথ ধরলেন ডা. নন্দী। এদিকটা সমন্বয়ের একেবারেই অচেনা। তবে জ্যোৎস্নারাতে মন্দ লাগছিল না। পাহাড়ি পথে অসংখ্য বাঁক। বাঁদিকে পাহাড়, ডানদিকে গভীর খাদ। পথটাও বেশ সংকীর্ণ। ডা. নন্দী খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছেন। তবে একটাই সুবিধা, এই রাতে উলটোদিক থেকে কিংবা পেছনদিক থেকে কোনো গাড়ি যাতায়াত করছে না। পাহাড়ের দিকটা ঘন জঙ্গলে পূর্ণ। ক্রমশ ওপরের দিকে উঠছে ওরা। বেশ খানিকটা ওপরে উঠে এসেছে। বেশ শীত অনুভূত হচ্ছে, তাতেই সমন্বয় টের পাচ্ছে কতটা ওপরে চলে এসেছে ওরা।

একটা জায়গায় এসে গাড়িটাকে দাঁড় করালেন ডা. নন্দী। ডানদিকে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। গার্ডওয়াল দিয়ে ঘেরা পাহাড়ি পথে এমন জায়গা মাঝে মাঝেই দেখা যায়। সুযোগ পেলেই রাস্তা নির্মাণকর্তারা এই জায়গাগুলো গাড়ি ঘোরানোর জন্য তৈরি করে থাকেন। পাহাড়ি পথে জায়গার ভীষণ অভাব। সেখানে এতোটুকু জায়গা পেলেই ড্রাইভাররা ধন্য হয়ে যান।

সমন্বয় গাড়ি থেকে নিচে নেমে দেখল একটা ছোট সিমেন্টের বেঞ্চমতো করা আছে। তাতে দু-তিনজন বসতে পারে। সমন্বয় একটু একটু করে ধারের কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে পারল ওর দৃষ্টিসীমা তল পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। ও এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার তিন দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মাঝখান দিয়ে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী। তীব্র জলস্রোত উপল খণ্ডের বাধা ডিঙিয়ে তীব্রবেগে ছুটে চলেছে। জলের শব্দ এতোটা ওপর থেকেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো বন্যজন্তুর রোষ সশব্দে ফেটে পড়ছে। সেই হিংস্র গর্জন এই তিন পাহাড়ে প্রতিহত হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। সে এক ভয়ংকর শব্দ, যা সমন্বয়কে কেবল বিস্মিত নয়, রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুলল।

বন-জঙ্গলে পূর্ণ এই নির্জন পাহাড়ি অঞ্চল, মায়াবী জ্যোৎস্না, খরস্রোতা নদীর জন্তুর ধ্বনি ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে করতে ক্ষণিকের জন্যে আনমনা হয়ে পড়েছিল সমন্বয়। কখন যে ওর পেছনে ডা. নন্দী নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছেন ও খেয়াল করেনি। ডা. নন্দী বললেন, ‘কী দেখছ ওইভাবে?’

সমন্বয় হঠাৎ দুই পা পিছিয়ে এসে বলল, ‘এই চারদিকটা একটু দেখছিলাম। জায়গাটা কেমন ভয়ানক বলুন?’

ডা. নন্দী বলেন, ‘সত্যি ভয়ংকর। দেখেছো জায়গাটা কেমন একেবারে খাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। উলটোদিকের পাহাড় থেকে দেখলে মনে হবে তুমি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছো তার নিচের দিকে তেমন কোনো সাপোর্ট নেই।’

‘সত্যি কি তাই?’

‘হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে বর্ষায় এসব অঞ্চলে ধস নামে। রাস্তা অদৃশ্য হয়ে যায়। তবে এই জায়গায় বহুদিন ধস নামেনি। তাহলে কি আর এখানে গার্ডওয়াল দিয়ে ঘেরা থাকত, গাড়ি ঘোরাত লোকে? তবে সাবধান!’

ওরা দুজন সেই বেঞ্চের ওপরে এসে বসল। ডা. নন্দীর এক হাতে হুইস্কির বোতল। কথা বলতে বলতে ঢক ঢক করে গলাধঃকরণ করে সমন্বয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও, খাও। এমন জ্যোৎস্নারাতে ড্রিংক না করলে কি আর চলে।’

কিছুক্ষণের ভেতরেই নেশাটা বেশ জমে উঠেছে ডা. নন্দীর। সেটা সমন্বয় তাঁর কথা শুনেই টের পেল।

আজ ডা. নন্দীকে অন্য রূপে দেখছে সমন্বয়। স্বল্পবাক মানুষটি আজ হঠাৎ করেই মুখর হয়ে পড়েছেন। ডা. নন্দী একের পর এক শুনিয়ে চলেছেন তাঁর অতীত জীবনের কাহিনি, যার পরতে পরতে জমে আছে বিস্ময় এবং বেদনার অশ্রুবিন্দু দিয়ে আঁকা জীবনের প্রতিটি পাতা। কথা বলতে বলতে কতবার যে তিনি পিয়াসীর নামটা উচ্চারণ করলেন।

ডা. নন্দীর মুখ থেকে তাঁর হারানো অতীতের কথা শুনে সমন্বয় কেবল বিস্মিতই হলো না, সেইসঙ্গে একটা গোপন রহস্যের সূত্র খুঁজে পাচ্ছে মনে হলো। সমন্বয় কোনোরকম প্রশ্ন না করে মন দিয়ে শুনতে লাগল নিরলসভাবে বলে যাওয়া ডা. নন্দীর কথাগুলো। যতো শুনছে ততোই চমকিত হচ্ছে।

সমন্বয়ের জীবনেও একটা ছিন্নবীণা আছে। আজ নতুন করে আরো একবার তাকে হাতে তুলে নেওয়ার সময় এসেছে মনে হলো।

বোতলের প্রায় অর্ধেক হুইস্কি ডা. নন্দী একাই শেষ করে ফেললেন। এখন আর তাঁর পা মাটিতে পড়ছে না। সমস্ত শরীর দুলছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবী বুঝি তাঁর এই ওজন বইতে সমর্থ নয়। তাই তিনি মাঝে মাঝে বিশ্রী ভাষায় গালি দিচ্ছেন পৃথিবীকে। গালি দিচ্ছেন মালব্য বলকে। এখানে একবার নিয়ে এসেছিলেন ডা. নন্দী তার বন্ধু মালব্য বলকে। সে বহুদিন আগের কথা। মালব্য একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে এখানে আসেন। বহুদিন বাদে পুরনো বন্ধু ডা. চিরন্তন নন্দীর সঙ্গে দেখা।

ভেবেছিলেন চিরন্তনের সঙ্গে পুরনো ঝামেলা মিটিয়ে নতুন করে সম্পর্কটাকে ঝালিয়ে নেবেন। ভুলচুক যা হয়েছে তার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নেবেন।

কিন্তু কিছু ভুলের যে ক্ষমা হয় না সেটা মালব্য কী বুঝতে পেরেছিলেন?

সেদিন এখানেই নিয়ে এসেছিলেন ডা. নন্দী মালব্যকে। বহুদিন বাদে দুই বন্ধু মিলে গল্প করতে করতে পান করছিলেন দামি বিলাতি মদ। মালব্যই বন্ধুর জন্যে কিনে এনেছিলেন। ডা. নন্দী তখন এখনকার মতো এতো ড্রিংক করতেন না। ওই মাঝেমধ্যে পার্টিতে গেলে এক-আধটু বন্ধুদের কম্প্যানি দিতেন। সেদিন অবশ্য মালব্য কথা বলতে বলতে অনেকটাই খেয়ে ফেলেছিলেন। তারপর ইনহিবিশান ভুলে গলগল করে সব দুঃখের কথা বেরিয়ে এলো। পিয়াসীকে বিয়ে করেও তিনি তার মন পেলেন না। মনহীন শরীরটাকে নিয়ে বেশিদিন চলা যায় না। কথা বলতে বলতে মালব্য একেবারে খাদের কিনারায় চলে যান। তখন এখানে কোনো গার্ডওয়াল ছিল না। ওঁর হাতে ধরা ছিল চুরুট। সেদিনটাও ছিল জ্যোৎস্নারাত। কোজাগরি চাঁদ উঠেছিল আকাশে। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ হওয়ায় চমকে ওঠেন ডা. নন্দী। দেখেন মালব্য যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেই জায়গাটায় নেই। প্রায় অর্ধবৃত্তাকার হয়ে জায়গাটা ধসে গেছে।

‘তারপর?’

সমন্বয়ের বুকের ভেতর দামামা বাজছে, দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম।

ডা. নন্দী একটু দম নিয়ে বলতে লাগলেন, চোখের সামনে এতোবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে দেখে তিনি শিহরিত হলেন। কী করবেন ভাবতে পারছেন না। এই রাতে জনহীন অঞ্চলে কারই-বা সাহায্য পাবেন! তিনি কিছুটা সময় কাটিয়ে আস্তে আস্তে গাড়িতে চেপে বসলেন। হাত-পা কাঁপছে। সমস্ত শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। মাথাটা বনবন করে ঘুরছে। এই কঠিন পরিস্থিতির  ভেতর দিয়ে তিনি অতি সন্তর্পণে গাড়ি চালাতে লাগলেন। কীভাবে এতোটা পথ নামলেন নিজেই জানেন না। শুধু ভাবছিলেন পিয়াসীকে কী জবাব দেবেন। ও কি সত্যিটা বিশ্বাস করবে? সমতলে নামার ঠিক আগেই একটা বাঁক আছে। আর সেই বাঁকের মুখে একটা মস্ত বড়ো পাইনগাছের গুঁড়িতে প্রচণ্ড বেগে গাড়িটা ধাক্কা খেল। ‘প্রচণ্ড আঘাতে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই, এরপরে আর কিছুই আমার মনে নেই।’

‘তারপর?’

‘পরে শুনেছি, বেশ কিছু সময় পরে একজন ট্রাফিক গার্ডের চোখে পড়ায় তারা দ্রুত থানায় ফোন করেন। অ্যাম্বুলেন্সে করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে দেন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সেদিনের অ্যাক্সিডেন্টে মাথায় আঘাত লাগে। পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে-ছড়ে যায়।

অনেকদিন লেগে গেল সুস্থ হতে। এই ঘটনায় আমি ট্রমাটাইজড  হয়ে পড়েছিলাম। কোনো কথাই ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারতাম না। কিছুই মনে পড়ছিল না। কখনো বা ছেঁড়াখোঁড়া ভাসা কিছু কথা, কিছু 888sport sign up bonus জলরঙের ছবির মতো ক্ষণিক উদ্ভাসিত হয়ে পরক্ষণেই মিলিয়ে যেত। 888sport sign up bonus ফিরে আসে বহু বছর বাদে। হাসপাতালের কলিগেরা সে-সময় আমার পাশে না থাকলে আমি কিছুতেই এই সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারতাম না। এই যে ডা. মুন্সী আছেন না, ও যা করেছে তার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না। আমাকে সুস্থ করতে দিল্লি ব্যাঙ্গালোর চেন্নাই হায়দরাবাদ কোথায় না গেছে।’

চার

রাত বাড়ছে। সমন্বয় মোবাইল অন করে দেখল বারোটা বেজে দশ। নিস্তব্ধ চারপাশ। যেন এই পাহাড় এই বনভূমিকে কোনো এক জাদুকর তার জাদুদণ্ডের পরশে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। একা চাঁদ সমস্ত আকাশ ঘুরে পাহারা দিচ্ছে।

গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসলেন ডা. নন্দী।

সমন্বয় বলল, ‘সরি স্যার, আজ আমি চালাচ্ছি, আপনি পাশে বসুন।’

‘কেন রে ইডিয়ট আমাকে কি তোর আনফিট মনে হচ্ছে? আই অ্যাম ফার ফার বেটার দ্যান ইউ। ওয়ান লাখস কিমি আই হ্যাভ অলরেডি রানড।’

‘সেটা আমি জানি স্যার, কিন্তু।’

‘কোনো কিন্তু নয়, আমার গাড়িতে আমি কাউকে হাত দিতে দেব না, বুঝলি?’

একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো কথা বলছেন ডা. নন্দী।

সমন্বয়ও ছাড়বার পাত্র নয়। ও কিছুতেই গাড়িতে উঠছে না। ডা. নন্দী স্টিয়ারিং হাতে বসে আছেন।

রাত বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে চাঁদের নীলাভ দ্যুতি। মায়াবী চাঁদ যেন আরো বেশি করে তার মায়ার চাদরে ঢেকে দিচ্ছে এই নির্জন পাহাড়ি বনপথ। সমন্বয়কে অগত্যা গাড়িতে উঠে বসতে হলো। এছাড়া ওর কাছে দ্বিতীয় কোনো অপশন ছিল না। এ অঞ্চলে এখন আর কোনো যানবাহন মরে গেলেও পাওয়া যাবে না। সুতরাং প্রাণ হাতে সে ডা. নন্দীর পাশে বসে পড়ল। কিন্তু তার চোখ সদা সতর্ক। অতটা ড্রিংক করেও ডা. নন্দী সেটা টের পেলেন। বললেন, ‘কী রে ব্যাটা, তোর কি মনে হচ্ছে আমি তোকে মেরে ফেলব? পাহাড়ি পথে গাড়ি হড়কানোর মানে জানিস? তুই শুধু একা মরবি? আমার প্রাণের কোনো দাম নেই?’

সমন্বয় কিছু বলতে গিয়েও চেপে গেল। এখন ভালোয় ভালোয় ক্রুশিয়াল বাঁকগুলো পেরিয়ে সমতলে না নামা পর্যন্ত ও কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। এতোটা ওপরে কখন উঠে এসেছে টের পায়নি। পথ কিছুতেই যেন ফুরাচ্ছে না। তবে একটাই স্বস্তির যে উলটোদিক থেকে কোনো গাড়ি আসছে না। ডা. নন্দী যতটা সম্ভব পাহাড়ের দিক ঘেঁষে ড্রাইভ করছেন। উলটোদিকে গভীর খাদ। রাতে সেই খাদের দিকে তাকালে আরো ভয়ংকর মনে হয়।

সমতলে নামতেই ডা. নন্দী গাড়ির গতি বাড়ালেন। এমনিতে এ-পথে চল্লিশের বেশি কেউ চালায় না; কিন্তু তার গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা এখন আশি থেকে নব্বইয়ের ভেতরে ঘোরাঘুরি করছে। সমন্বয় হঠাৎ একটু আস্তে চালানোর কথা বলতে গিয়ে জোর একটা ধমক খেল এবং মিনিটখানেকের ভেতর প্রচণ্ড জোরে একটা ঝাঁকুনি এবং সেইসঙ্গে বিকট একটা শব্দ হলো। মনে হলো কাছেপিঠে কোথাও বিস্ফোরণ টাইপের কিছু ঘটে থাকবে। একই সঙ্গে চোখের নিমেষে ও সিট থেকে কিছুটা এগিয়ে আসে এবং কিছুটা ওপরের দিকে উঠে গেল। সিটবেল্টটাই আজ ওকে বাঁচিয়ে দিলো। ঘাড়ে-মাথায় চোট লাগলেও আঘাত তেমন গুরুতর নয়।

সমন্বয় সিটবেল্ট খুলে আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলো। দেখল গাড়িটা একটা প্রকাণ্ড গামার গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে একেবারে দুমড়ে গেছে। ওর আঘাত গুরুতর হতো যদি ও সিটবেল্টটা না বাঁধত।

রাস্তার ধারের এই গাছগুলোর গায়ে ফ্লুরোসেন্ট রং লাগানো থাকে, যাতে রাতের বেলায় গাড়ির আলো পড়লে পরিষ্কার করে বোঝা যায় এবং চালকেরা সতর্ক হন।

সমন্বয় গাড়িতে ফিরে এসে দেখল ডা. নন্দী সেইভাবে স্টিয়ারি ধরে থম মেরে বসে আছেন। তাঁর চোখ দুটো বিস্ফারিত। সমন্বয় জিজ্ঞাসা করে, ‘স্যার, আপনার লাগেনি তো?

‘আ-আ-মি ঠ-ঠিক আছি।’

তারপর তিনি ঘোরলাগা গলায় বলতে লাগলেন, ‘আমি জানি মালব্য তুই আজো আমাকে ঘৃণা করিস। কিন্তু বিশ্বাস কর সেদিনের অ্যাক্সিডেন্টে আমার কোনো হাত ছিল না। ওটা স্রেফ একটা অ্যাক্সিডেন্টই ছিল। পিয়াসী ভেবেছিল আমি ইচ্ছা করে তোকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমি হয়তো এইভাবে আমার দুঃখের বদলা নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর, যে আমার কখনো হওয়ার নয়, হওয়ার ছিল না, তাকে জোর করে ধরে রাখার কোনো মানে হয়? আমি যখন বুঝতে পারলাম পিয়াসীর আমার প্রতি কোনো মন নেই, তখন আমি ওর দ্বার খুলে দিলাম, বললাম, যাও পাখি, যতদূর যেখানে খুশি উড়ে যেতে চাও, যাও।’

কথাগুলো শুনতে শুনতে ডা. নন্দী বারকয়েক ওয়াক ওয়াক করে বমি করলেন। সেই বমির সঙ্গে রক্ত বের হলো। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। সমন্বয় বুঝতে পারল ডা. নন্দীর আঘাতটা গুরুতর। বাকি কথাগুলো আর বলা হলো না। এখন একটাই কাজ ডা. নন্দীকে দ্রুত হসপিটালাইজড করা।

ডা. নন্দীর বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতি ভালো নয়। যে-কোনো সময়ে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। একটু আগেই সমন্বয় ডা. নন্দীকে দেখে ঘরে ফিরল। মেডিক্যাল কলেজের আইসিইউতে ভর্তি আছেন। ডিপ কোমায়। আটজন চিকিৎসক মিলে একটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। তাঁরাই দেখছেন ডা. নন্দীকে।

সমন্বয় ঘরে ফিরে ভগ্নমনে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। ভাবছে ডা. নন্দীর কথা। ভাগ্য কীভাবে তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করছে। সেই রাতে অ্যাক্সিডেন্টের পর সমন্বয় ছুটি নিয়েছিল। এই কয়েকদিনের  ভেতরে সমন্বয় ওর চিন্তার সূত্রগুলোকে জোড়া দিয়ে চলেছে।

জানতে পেরেছে সেদিন মালব্য পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে গড়াতে গড়াতে একটা গাছের গুঁড়িতে আটকে যান। মাথায় আঘাত পান। অজ্ঞান অবস্থায় সারাটা রাত ওখানেই পড়েছিলেন। পরদিন একজন আদিবাসী মানুষ সুদর্শন যুবকটিকে দেখতে পেয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। তিনি এবং কয়েকজন সেই সময়ে ওই জায়গায় রাস্তা মেরামতের কাজ করছিলেন। নিঃসন্তান সেই মানুষটি এবং তার বউ মালব্যর গায়ে-হাত-পায়ে যেসব জায়গা ছড়ে গিয়েছিল সেখানে গাছের পাতার রস আর জড়িবুটি দিয়ে তাঁকে আস্তে আস্তে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু মালব্যের মাথায় গুরুতর আঘাত লাগায় তাঁর পূর্বের 888sport sign up bonus লোপ পায়। তাই তাঁরা জানতেও পারেননি মালব্য কে এবং কোথা থেকে এসেছে। একেবারে পুত্রস্নেহে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন তারা দুজনে।

এরপর কেটে গেছে বেশ অনেকটা সময়। বহুদিন বাদে একদিন ঘটনাচক্রে মালব্যর কথাটা জানতে পারেন ডা. নন্দী। আদিবাসী লোকটি ছিলেন ডা. নন্দীর পেশেন্ট। ডা. নন্দী এখানে এই পাহাড়ি গ্রামে আসেন এসব আদিবাসী অসহায় মানুষকে চিকিৎসা করতে। এখানে তাঁর একটি চ্যারিটেবল ডিস্পেন্সারি আছে। একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি ডা. নন্দীকে মালব্যের ঘটনাটা খুলে বলেন এবং কীভাবে তাঁর চিকিৎসা করা যায় সে-ব্যাপারে সাহায্য চান। তারা নিঃসন্তান ছিলেন, তাই মালব্যকে পেয়ে তারা তাদের সন্তানহীনতার দুঃখ ভুলতে চেয়েছিলেন, সে-কথাও জানালেন। সুদর্শন যুবক মালব্যকে দেখতে পেয়ে মনে হয়েছিল ভগবান তাদের হাতে একে তুলে দিয়েছেন। কতই বা বয়স তখন মালব্যের, সবেমাত্র আটাশ পেরিয়েছেন। রোগা পাতলা চেহারায় আরো কম বলে মনে হতো।

একদিন ডা. নন্দী সেই আদিবাসী লোকটির বাড়িতে যান এবং দেখেন, সত্যি মালব্যকে সেখানে বেঁধে রাখা হয়েছে। এমনিতে তিনি বেশ শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ বেশ অশান্ত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে গ্রীষ্মের সময়ে। মালব্যকে দেখে তিনি চমকে ওঠেন। দেখেন, কেমন জুলুজুলু দৃষ্টিতে তাঁকে দেখছেন।

কিন্তু প্রবীণ চিকিৎসক ডা. নন্দীর চোখে সেই দৃষ্টির অসারতা খুব শিগগির প্রকাশ পেল। মালব্য চিনতে পারলেন না ডা. নন্দীকে। বরঞ্চ অবান্তর কিছু ছেলেমানুষি সংলাপ বলে গেলেন। সকলেই জানে সেদিনের ধসে ডা. মালব্য বলকে খরস্রোতা নদী কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। শুধু ডা. নন্দী জানলেন মালব্য এখনো বেঁচে আছেন। তবে এই বাঁচা অর্থহীন। সেদিন থেকে মালব্যর চিকিৎসার ভার ডা. নন্দী নিজেই তুলে নেন। মালব্য এখন অনেকটাই সুস্থ। ভেবেছিলেন আরেকটু সুস্থ করে তিনি পিয়াসীর হাতে মালব্যকে তুলে দেবেন।

পাঁচ

আজ কোজাগরি পূর্ণিমা। ঘরে ঘরে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা চলছে। শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে মুখরিত চারপাশ। পিয়াসী খবর পাওয়া মাত্র একটা গাড়ি নিয়ে কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে সোজা এখানে চলে আসেন।

সমন্বয়ের কাছ থেকে খবরটা পান পিয়াসী। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এসেছিলেন ডা. নন্দীর সঙ্গে দেখা করতে।

তবে হাসপাতালে নয়, পিয়াসী যখন এলেন তখন ডা. নন্দীর মরদেহ নদীর পাড়ে শ্মশানে একটি উঁচুমতো বেদিতে শায়িত ছিল। একটু বাদেই ইলেকট্রিক চুল্লিতে তাঁকে ঢোকানো হবে। রিচুয়াল শেষ হলো খানিকটা আগেই। এই মুহূর্তে তেমন কেউ নেই তাঁর পাশে। তাঁর নিজের বলতে তো কেউই ছিল না। কলিগরাই তাঁর আপনজন। অদূরে একজন শ্মশানরক্ষী দাঁড়িয়েছিল। বাকিরা নদীতীর থেকে খানিকটা ওপরে শ্মশানযাত্রীদের জন্যে বানানো একটা ঘরে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছেন।

পিয়াসী সিঁড়ি দিয়ে নদীতীরে নেমে এলেন। ধীরপায়ে এসে দাঁড়ালেন ডা. নন্দীর মাথার কাছে। দেখলেন উন্মুক্ত বালুচরে উঁচু বেদিকায় চুপচাপ শুয়ে আছেন ডা. নন্দী। সাদা কাপড়ে 888sport app আছে শরীরটা। উন্মুক্ত মুখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল।  মাথার ওপরে উদার বিপুল সীমাহীন একলা আকাশ। কোজাগরি জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। পাশ দিয়ে ছলছল শব্দে বয়ে চলেছে পূত প্রবাহিনী। নিস্তব্ধ রাত। ততোধিক নিস্তব্ধ চারপাশ। পিয়াসী ঝুঁকে পড়ে দেখছেন তাঁর প্রথম প্রেমিক চিরন্তনকে। দেখছেন তাঁর সন্তানের পিতাকে। ভাবছেন, সমন্বয়ের মুখ থেকে কোনোদিন ‘বাবা’ ডাক শুনতে পেল না চিরন্তন। পিয়াসী যেদিন সমন্বয়ের মুখ থেকে চিরন্তনের কথা জানতে পারলেন তখন ভেবেছিলেন সত্যিটা জানিয়ে দেবেন ছেলেকে। সমন্বয় জানুক চিরন্তনই ওর আসল পিতা। মালব্যর সঙ্গে যখন তাঁর রেজিস্ট্রি হলো তখন পিয়াসী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।

পিয়াসী ঝুঁকে পড়ে দেখছেন চিরন্তনকে। দুই হাতের তালুর ভেতরে মুখটাকে জড়িয়ে ধরেছেন। কতদিন কতকাল দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন মানুষটার কথা ভেবে। আজ সব কষ্টের সমাপ্তি, সমস্ত জল্পনার অবসান হলো।

হঠাৎ সমন্বয়কে দেখে পিয়াসী চমকে উঠলেন। তাঁর চমক ভাঙল সমন্বয়ের কথায়, ‘বাবার মুখাগ্নি করলাম, এখন শুধু’, আর কিছু বলতে পারল না, কথা আটকে গেল। সমন্বয়ের দুই চোখে এখন বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাস।

কারো মুখে কোনো কথা নেই। চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে দুজনে। ফিরোজা নীল জ্যোৎস্নায় ভিজে যাচ্ছে বিষণ্ন বালুচর।

হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ছুটে এলো ভারী ইঞ্জিনের শব্দ, – ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ … অদূরে নদীর ওপরে রেলব্রিজ দিয়ে তখন একটি আপ এবং একটি ডাউন ট্রেন পরস্পরকে অতিক্রম করল।