রবীন্দ্রনাথের কালে ভারতবর্ষকে, ভারতবর্ষীয় ভাবদর্শন ও সংস্কৃতিকে যিনি সবচেয়ে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন, তিনি ভারতপথিক আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালের ২রা ডিসেম্বর, 888sport appsের বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে। তাঁর পিতামহ পণ্ডিত রামমণি শিরোমণি ছিলেন বহুশাস্ত্রবিদ, অধ্যাপক ও কবিরাজ। বাহাত্তর বছর বয়সে তিনি কাশীতে গিয়ে বসবাস করবেন বলে মনস্থির করেন। একদিন নিজগ্রাম ছেড়ে নদীপথে যাত্রা করেন কাশীর উদ্দেশে। পুত্র ভুবনমোহন ছিলেন আয়ুর্বেদশাস্ত্রজ্ঞ কবিরাজ। ভালো পসারও ছিল তাঁর। একসঙ্গে বসবাসের ইচ্ছায় তিনিও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পিতার সঙ্গী হন। ফলে ক্ষিতিমোহন বেড়ে ওঠেন কাশীতেই। নিজেকে তিনি কাশীর মানুষ বলে মনে করতেন। তখন কাশী বা বেনারস যেমন ভারতসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল, এখনো তাই আছে। কাশীর গঙ্গা নদী, তার ঘাট, নানা অলিগলি, মন্দির, মসজিদ, নানা সাধকের আখড়া, নানা সম্প্রদায়ের মঠ কিশোর ক্ষিতিমোহনের মন গড়ে তুলছিল একটু অন্যভাবে। সংকীর্ণতার বদলে মুক্তমনে তিনি সবকিছু দেখার দৃষ্টি অর্জন করেছিলেন। আকর্ষণবোধ করতেন কাশীর সাধুসন্ন্যাসী, ভক্ত ও সন্তদের প্রতি। কাশীতে পেয়েছিলেন বড় বড় পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধকদের দেখা। তাঁদের কথা শুনতে তিনি ঘুরে বেড়াতেন কাশীর নানা অলিগলিতে। কাশীর বাইরে যেসব সাধক ছিলেন, তিনি চলে যেতেন তাঁদের কাছেও। যে দুজন অধ্যাপক তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিলেন তাঁরা হলেন মহামহোপাধ্যায় সুধাকর দ্বিবেদী ও ঈশানচন্দ্র বিদ্যারত্ন। ভারতের মধ্যযুগের সন্তদের বাণীতে যে গভীর আধ্যাত্মিক সাধনা ও উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে, তার খবর ক্ষিতিমোহনকে দিয়েছিলেন সুধাকর দ্বিবেদী। কাশীর সন্তদের বাণী ক্ষিতিমোহনকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের কাছ থেকে পাঠ নিলেও তাঁর মন পড়ে থাকত কবীর, দাদূ, রজ্জব, মীরাবাঈ, নানক কিংবা রবিদাসের বাণী সংগ্রহ ও শোনার জন্য। এক অমোঘ আকর্ষণ তাঁকে এক উদার ও গভীর ধর্মের জগতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ১৮৯৫ সালে, মাত্র পনেরো বছর বয়সে, তিনি সন্তমতী সাধকের কাছে দীক্ষাও নিয়েছিলেন। এই দেখা ও চেনার চেষ্টাতেই তিনি খোঁজখবর নিতে শুরু করেন মধ্যযুগের সন্তসাধনা ও ভক্তিগীতির পাশাপাশি বাংলার বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে।
ক্ষিতিমোহন সেনের পৌত্র নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর আত্মজীবনী জগৎ কুটির বইয়ে মাতামহ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বস্তুত, ভুবনমোহনের আশঙ্কা ছিল ক্ষিতিমোহনের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস হয়তো বা পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুবর্তী হয়ে উঠবে, এবং তা যাতে না হয় সেজন্য তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু ক্ষিতিমোহনের চিন্তাবিশ্ব্ প্রসারিত হচ্ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পথে; তিনি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হচ্ছিলেন হিন্দু ভক্তি 888sport live football এবং মুসলমান সুফি সাধকদের 888sport app download apk ও সঙ্গীতে। এজন্য তিনি ফারসিও শেখেন তাঁর দাদা, ফারসিতে সুপণ্ডিত অবনীমোহনের কাছে। চোদ্দ বছর বয়সে ক্ষিতিমোহন কবীর পন্থায় দীক্ষা নেবেন বলে স্থির করেন। কবীরের বহুত্ববাদী সাধনার ধারায় উদারভাবে মিশেছিল হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের নানা ভাব।’
অমর্ত্য সেন আরো লিখেছেন, ‘ক্ষিতিমোহনের বদলাতে থাকা ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনের অগ্রাধিকারগুলিও পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল। ১৮৯৭ সালে, চাম্বা যাওয়ার দশ বছর আগে, মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি কবীর, দাদূ এবং এঁদেরই মতো হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মেরই স্বাধীন ধারার 888sport app সাধকদের 888sport app download apk ও গান সংগ্রহের উদ্দেশ্যে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের নানা প্রান্তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যে এলাকাটি তিনি ঘুরেছিলেন সেটি আয়তনে বিশাল, কারণ কবীর ও 888sport app সন্তদের অনুগামীরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতের নানা প্রান্তে।’
ক্ষিতিমোহন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত কাশ্মীরের হিমালয়ের কোলে পাহাড় ঘেরা ছোট করদরাজ্য চাম্বায় গিয়েছিলেন ১৯০৭ সালে, রাজা ভুরি সিংহের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের চাকরি নিয়ে। চাকরি নিয়ে এত দূরে যাওয়ার কারণ ছিল। তিনি ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু বড় ভাই অবনীমোহন হঠাৎ মারা যাওয়ায় পরিবারের দায়িত্বভার এসে পড়ে তার কাঁধে। ফলে ডাক্তার হওয়ার বাসনা গঙ্গায় ভাসিয়ে তাকে শুরু করতে হয় চাকরির সন্ধান। চাম্বা দূরে হলেও চাকরি পেয়েছেন, এটা বড় ব্যাপার। না গিয়ে উপায় ছিল না।
তখনো তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সরাসরি না দেখলেও পরিচিত হয়েছেন রবীন্দ্র888sport live footballের সঙ্গে। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে কাশীর গঙ্গার ঘাটে কলকাতা থেকে আসা কালীকৃষ্ণ মজুমদারের কাছে প্রথমে এবং পরে বিপিন দাশগুপ্তের মাধ্যমে তিনি রবীন্দ্রকাব্যের পরিচয় পান। তাঁর মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apk যেন মধ্যযুগীয় সন্তদের কোনো বাণী। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমি সেই কাব্যের মধ্যে উপনিষদ ও সন্তকবিদের ভাব দেখতে পেলাম। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমার পরমাত্মীয় … রবীন্দ্রকাব্য যে কত ভাল লাগত কী বলব? সন্তবাণী তো শত শত বছরের পুরনো আর রবীন্দ্রনাথ জীবন্ত। এতদিন খেতাম আমসী এখন খেলাম টাটকা ল্যাংড়া-আম। ধন্য হয়ে গেলাম।’
ক্ষিতিমোহনের ইচ্ছা জাগল রবীন্দ্রনাথকে দেখার। ১৯০৪ সালে মিনার্ভা থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথ ‘স্বদেশী সমাজ’ 888sport liveটি পাঠ করবেন শুনে কাশী থেকে কলকাতায় এসে হাজির হন ক্ষিতিমোহন। ভিড়ের চাপে তাঁর জামা ছিঁড়ে গিয়েছিল। সে-যাত্রায় আর রবীন্দ্রনাথকে দেখা সম্ভব হয়নি। পরে রবীন্দ্রনাথ আবার সেই 888sport live পড়েন কার্জন থিয়েটারে। সেখানে বন্ধুদের সাহায্যে ক্ষিতিমোহন স্টেজের পেছনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে এক নজর দেখার সুযোগ পেলেও তাঁর মুখটি ভালোভাবে দেখার সুযোগ হলো না। রবীন্দ্রনাথ যখন 888sport live পড়ছিলেন তখন তাঁর মনে হচ্ছিল, যেন পাঠ নয়, রবীন্দ্রনাথ গাইছেন।
১৯০১ সালের ২২শে ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, যাকে বলা হয় পাঠভবন, যার উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি ও চেতনাবোধের উন্মেষ ঘটানো। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই পাঠভবনে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের জন্য একজন অধ্যক্ষ খুঁজছিলেন তিনি। পণ্ডিত হিসেবে ক্ষিতিমোহন সেনের নাম তখন চারিদিকে শোনা যাচ্ছিল। তাঁর খোঁজ রবীন্দ্রনাথ প্রথম পেয়েছিলেন কালীমোহন ঘোষের মাধ্যমে। কালীমোহন ছিলেন কর্মব্রতী, 888sport live footballানুরাগী, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক এবং রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি যখন স্বদেশব্রতে দীক্ষিত হয়ে 888sport appsের বিভিন্ন গ্রামে বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছিলেন, তখন ঘটনাচক্রে সোনারাং গ্রামে মায়ের সঙ্গে এসেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। সেবারই দুজনের পরিচয় হয়। পরিচয় গড়ায় ঘনিষ্ঠতায়। কালীমোহন শান্তিনিকেতনে ফিরে রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষিতিমোহনের কথা সবিস্তারে বললেন। পরবর্তীকালে ক্ষিতিমোহন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ 888sport live footballিক ও শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অধ্যাপক অজিত কুমার চক্রবর্তীকে লিখেছেন, ‘তাঁর 888sport live footballানুরাগ ও বিদ্যাবুদ্ধির কথাতেই যে আমি উৎসাহিত হয়েছি তা নয়, এর মধ্যেও ওই লোকপ্রেমের সংবাদ পেয়েছি, ইনিও ওই বালকটির সঙ্গে গ্রামে কাজ করে ফিরেছেন, লোকসেবার উৎসাহ তাঁর পক্ষে যেরকম স্বাভাবিক সেইটে জেনেই আমি তাঁকে বোলপুরে আবদ্ধ করতে এত উৎসুক হয়েছি। সুশিক্ষিত সুযোগ্য এম এ ডিগ্রিধারী বেতন দিলেই পাওয়া যায়, কিন্তু যে জিনিসটা পুঁথিগত নয়, সেটা আমাদের দেশে কত দুর্লভ তা’ তো জানো।’
১৯০৭ সালের ডিসেম্বরের একদিন ক্ষিতিমোহন পেলেন রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি। সেই চিঠিতে রয়েছে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের কাজে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ। ক্ষিতিমোহনকে লেখা সেই প্রথম চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সবিনয় নমস্কারপূর্ব্বক নিবেদন, বোলপুরে আমি কিছুদিন হইতে একটি ব্রাহ্মচর্য্যশ্রম স্থাপন করিয়া বালকদিগকে শিক্ষা দিতেছি। আপনার সম্বন্ধে আমি যেরূপ সংবাদ পাইয়াছি তাহাতে এখানকার কর্ম্মে আপনাকে আবদ্ধ করিবার জন্য বিশেষ উৎসুক হইয়াছি। যদি অনুগ্রহ করিয়া আমার এই কার্য্যে যোগদান করেন তবে আমি সহায়বান হইব। এবং যাহাতে আপনার আর্থিক ক্ষতি না হয় সেইরূপ ব্যবস্থা করিয়া দিব। আমার বিশ্বাস সেখানকার কর্ম্মে আপনি আনন্দলাভ করিতে পারিবেন।’
কদিন পর বন্ধু বিধুশেখরের (পরবর্তীকালে যিনি হয়ে উঠবেন পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী) কাছ থেকেও একটি চিঠি এলো। সেই চিঠিতেও একই আমন্ত্রণ। এই আমন্ত্রণ পেয়ে ক্ষিতিমোহন আনন্দিত বটে, একইসঙ্গে মনে দ্বিধাও। দ্বিধার কারণ অর্থনৈতিক। চাম্বার বিদ্যালয়ে প্রতি মাসে ১১০ টাকা পাচ্ছেন এবং প্রতি বছর ১০ টাকা করে বাড়ার কথা। সেই হিসাবে রবীন্দ্রনাথ যদি ১০০-১৫০ টাকা বেতন না ধরেন, তাহলে তার পক্ষে আসা অসম্ভব। তিনি বিবাহিত, বাবা-মা বয়স্ক, মৃত দাদার পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে। ফলে অর্থের বিষয়টি তিনি প্রথমেই পরিষ্কার করে নিতে চাইলেন। এক চিঠিতে জানালেন সে-কথা। রবীন্দ্রনাথও তাঁকে পুনর্বার চিঠি লিখলেন। অবশেষে ১৯০৮ সালে অর্থের বিষয়টি সুনিশ্চিত করে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘সবিনয় সম্ভাষণপূর্ব্বক নিবেদন, সময় সম্বন্ধে কোনো সীমা না বাঁধিয়াই আপনার জন্য অপেক্ষা করিব। যাহাতে আপনার ক্ষতি না হয় তাহাই করিবেন এবং যত শীঘ্র পারেন আমাদের জালে আসিয়া ধরা দিবেন।’
ক্ষিতিমোহন রওনা হয়ে গেলেন বোলপুরের উদ্দেশে। তখন আষাঢ় মাস। মধ্যরাতে নামলেন বোলপুর স্টেশনে। তুমুল বৃষ্টির কারণে বেরুতে না পেরে স্টেশনেই অপেক্ষা করতে লাগলেন। এই প্রসঙ্গে ক্ষিতিমোহন তাঁর রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন বইয়ে লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতনে আশ্রমের কাজে যোগ দিতে আসিয়া রাত্রে বোলপুর স্টেশনে নামিলাম। ভয়ংকর বৃষ্টি; তখনকার দিনে গো-গাড়ি ছাড়া আর যান ছিল না। পরদিন সকালে পদব্রজেই আশ্রমে রওয়ানা হইলাম। বোলপুরে তখন এত বাড়িঘর ছিল না। স্টেশন হইতে পথে নামিয়াই শুনিলাম কবি গাহিতেছেন, ‘তুমি আপনি জাগাও মোরে।’ কী শক্তি তখন তাঁহার কণ্ঠে ছিল। শান্তিনিকেতনে তাঁহার দেহলী নামক গৃহের দোতলায় তিনি দাঁড়াইয়া গাহিতেছেন আর বোলপুরে তাহা শুনা যাইতেছে। অবশ্য তখন বোলপুরের পথ বড়ো নির্জন ও শান্ত ছিল।’
শান্তিনিকেতনে এসে শুরু হলো ক্ষিতিমোহনের জীবনের আরেক অধ্যায়। তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের ‘নতুন বাড়িতে’
থাকতে শুরু করেন তখন রবীন্দ্রনাথ পাশের ‘দেহলী’ বাড়িটিতে থাকছিলেন। শুরু হলো পরস্পরকে জানার পর্ব। রাতের অন্ধকারে দেহলীতে রবীন্দ্রনাথ সুর সৃষ্টি করতেন, আর নতুন বাড়ির বারান্দায় বসে ক্ষিতিমোহন সেই গানের কথা লিখে নিতেন। সেকাল তো বোলপুরে বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যার পর আলোর অভাবে রবীন্দ্রনাথ পড়াশোনা করতেন না। তখন শুরু হতো আশ্রমের ‘অনধ্যায়’ পর্ব। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বসতেন শিক্ষকেরা। আলোচনা চলত নানা বিষয়ে। সেই আড্ডায় যোগ দিতেন রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও। যোগ দিতে শুরু করলেন ক্ষিতিমোহন সেনও। সেই আড্ডায় তিনি পেতেন রবীন্দ্রনাথের অতল পাণ্ডিত্যের খবর। কখনো কখনো উত্তেজনার বশে আচমকাই প্রকাশ করে ফেলতেন নিজের পাণ্ডিত্য, যা অবাক করত রবীন্দ্রনাথকে। বিভিন্ন সন্ত ও বাউল ফকিরের গান রবীন্দ্রনাথ প্রথম শুনেছিলেন ক্ষিতিমোহনের কণ্ঠে।
কয়েক মাস পর ক্ষিতিমোহনেরই অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ বলতে শুরু করেন বিস্ময়কর সব কথা, যেগুলো পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে বক্তৃতামালা নামে সংকলিত হবে। ভোরবেলায় আশ্রমের মন্দিরের পুবদিকের সিঁড়িতে বসে সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রবীন্দ্রনাথ সেসব কথা বলে যেতেন আপন খেয়ালে। উজাড় করে দিতেন অন্তরাত্মাকে। সামনে থাকতেন ক্ষিতিমোহন সেন এবং আরো কয়েকজন শিক্ষক।
শান্তিনিকেতনে আসার মাত্র চার বছরের মধ্যে আশ্রমের একজন অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন ক্ষিতিমোহন, রবীন্দ্রনাথের পরেই যাঁর অবস্থান। সবার কাছে তিনি আশ্রমের ‘ঠাকুর্দা’ এবং তাঁর স্ত্রী কিরণবালা হয়ে ওঠেন ‘ঠানদি’। বিশিষ্ট রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক নেপাল মজুমদার লিখেছেন, ‘বহির্জগৎ হইতে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করিয়া কবি শান্তিনিকেতন আশ্রম-বিদ্যালয়টিকে মনোমতো রূপদান করিতে চাহিলেন। এই সময়েই ক্ষিতিমোহন সেন শান্তিনিকেতনে আসেন। ক্ষিতিমোহন আসিয়াই আশ্রমের সকল কাজে কবির সহায়ক হইলেন। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের যুগে কবি যে-সব পরিকল্পনা করিয়াছিলেন তাহাই এখন তিনি ক্ষিতিমোহন-বিধুশেখর প্রভৃতির সহায়তায় বাস্তবে পরিণত করিতে উদ্যোগী হইলেন।’
ক্ষিতিমোহনকে রবীন্দ্রনাথ কেবল শিক্ষক হিসেবে চাননি, চেয়েছেন সঙ্গী হিসেবেও। ক্ষিতিমোহনকে দেওয়া এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আপনি মনে করিতেছেন, আপনি কেবল আপনার ছাত্রদের লইয়াই কাজ করিবেন, সেটা আপনার ভুল। আমরাও আছি। ছাত্রদের পাইয়া আমাদিগকে অবহেলা করিবেন না।’
অবহেলা করেননি বটে ক্ষিতিমোহন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী, আলাপ-আলোচনায় নিত্যসহচর, বিশ্বভারতীর গুণিজনসভার প্রধান সভাসদ। রবীন্দ্রনাথের নানা উৎসব-অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন তিনি। যথার্থ সহচর হয়ে রূপ দিয়েছেন আশ্রমের নানা উৎসব-অনুষ্ঠান। তার মধ্যে ছিল বর্ষামঙ্গল ও শারদোৎসব। তাঁর মাধ্যমেই শান্তিনিকেতন আশ্রমজীবনে রূপ পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ভাবনাপ্রসূত এক জীবনচর্যা, যেখানে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন বিভিন্ন অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতি-বন্দনার উৎসব। আর ক্ষিতিমোহন সেই উৎসবের আঙ্গিকের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বেদ-উপনিষদ থেকে চয়ন করা বিভিন্ন শ্লোক বা সূক্ত। রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছিলেন উৎসব-উপযোগী গান এবং ক্ষিতিমোহনের সঙ্গে পরামর্শ করে নন্দলাল তাঁর ছবি ও আলপনা দিয়ে তৈরি করেছেন উৎসবগুলোর অঙ্গসৌষ্ঠব ও লালিত্য। লোকধর্ম ও 888sport live footballচর্চায় রবীন্দ্রনাথ ও ক্ষিতিমোহন হয়ে উঠেছিলেন দুজনের পরিপূরক। ক্ষিতিমোহন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তিনি যদিচ প্রাচীন শাস্ত্রজ্ঞ তথাপি তিনি অত্যন্ত উদার। তিনি বলেন এই ঔদার্য তিনি শাস্ত্র হতেই লাভ করেছেন। হিন্দুধর্মকে যাঁরা নিতান্ত সংকীর্ণ করে অপমানিত করেন তাঁদের মধ্যে এই দৃষ্টান্ত হয়ত কাজ করবে। অন্তত ছাত্রদের মনকে সংকীর্ণতা মুক্ত করতে পারার পক্ষে ইনি অনেকটা সাহায্য করবেন।’
রবীন্দ্রনাথ যখন ইংল্যান্ড 888sport slot gameে যাচ্ছিলেন তখন সঙ্গী করতে চেয়েছিলেন ক্ষিতিমোহনকেও, যাতে স্বামী বিবেকানন্দের পর একজন যোগ্য ব্যক্তি পাশ্চাত্যের সামনে প্রাচ্যের সাধনার খবর সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারেন। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করেও তা সম্ভব করতে পারেননি। অবশ্য ১৯২৪ সালে চীন ও জাপান 888sport slot gameে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ক্ষিতিমোহন একবার তরুণ সহকর্মী অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্তকে বলেছিলেন, ‘দেখ, আমরা ছিলাম মাটির তাল, গুরুদেব আমাদের হাতে ধ’রে গড়ে পিটে তৈরি করে নিয়েছেন।’ একথা মানতে পারেননি হীরেন্দ্রনাথ। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন, ‘ক্ষিতিমোহন মাটির তাল নন, সোনার তাল। রবীন্দ্র-প্রতিভার বহ্নিস্পর্শে সে স্বর্ণাভা উজ্জ্বলতর হয়েছে …। ক্ষিতিমোহনের প্রতিভা তিনিই আবিষ্কার করেছেন এবং প্রতিভাকে উদ্দীপিত করবার জন্য যে উৎসাহ ও প্রেরণা আবশ্যক তাও তিনি জুগিয়েছেন। তাহলেও বলব ক্ষিতিমোহনবাবু শুধু পাণ্ডিত্য নয়, 888sport app যে-সব অনন্যসাধারণ গুণের অধিকারী ছিলেন তাতে তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ যে-কোনো অবস্থাতেই হতে পারত।’
ক্ষিতিমোহন সেনের বহুমাত্রিক প্রতিভার পরিচয়টি লেখক ও গবেষক পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ধার করে দেওয়া যাক। তিনি লিখছেন, ‘শুধু শাস্ত্রজ্ঞ-পণ্ডিত ছিলেন না ক্ষিতিমোহন, তিনি ছিলেন মধ্যযুগের সন্তধর্মের প্রচারক, রবীন্দ্র888sport live footballের রসজ্ঞ সমালোচক, বৌদ্ধধর্মের গবেষক, বাউল-ফকির গানের তত্ত্বসন্ধানী সংগ্রাহক, শব্দতাত্ত্বিক, বৈদিক প্রথা অনুসারী পুরোহিত, উৎসব-অনুষ্ঠানে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষায় নিষ্ঠাবান ব্রতী, সতত জিজ্ঞাসু পর্যটক, ছাত্রদরদী অধ্যাপক, অসাধারণ বাগ্মী ও অলৌকিক কথক। তাছাড়া সঙ্গীত, নাটক-অভিনয় ও অলঙ্কারশাস্ত্রে ছিল তাঁর অপরিসীম অনুরাগ। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে রন্ধনশাস্ত্র সবই ছিল তাঁর অধীনে।’
আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী ছিলেন বাংলার মুক্তবুদ্ধি চর্চার অগ্রপথিক। তিনি বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, গুজরাটি, রাজস্থানি এবং ফার্সি-আরবি ভাষায় ছিলেন পরদর্শী। স্বচ্ছন্দে ভাববিনিময় করতে সমর্থ ছিলেন প্রতিটি ভাষায়। মধ্যযুগের বাঙালি জীবনের সাংস্কৃতিক বিকাশের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাঁর গবেষণাকর্মে প্রকাশ করেছেন।
দুই
গবেষক ক্ষিতিমোহন সেনের যে-দুনিয়া, সে-দুনিয়ার মানুষেরা অলীক নয়। গল্পকার-ঔপন্যাসিকদের মতো তিনি কোনো কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করেননি, তাঁর চরিত্ররা বাস্তবের মানুষ। তিনি চাইলে রবীন্দ্রগল্পের চরিত্রদের নিয়ে গবেষণা করতে পারতেন, চাইলে রবীন্দ্র-888sport alternative linkে সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করতে পারতেন, চাইলে ভারতবর্ষের রাজ-রাজড়াদের ইতিহাস নিয়েও গবেষণা করতে পারতেন। কিন্তু সেসবের প্রতি তাঁর মন ছিল না, তাঁর মন ছিল শৈশব-কৈশোরে যে ভাব-দর্শনে প্রভাবিত হয়েছিলেন সেদিকে। ভারতবর্ষের লোকসাধক, যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বতন্ত্রভাবে সাধনা করে গেছেন, সেই ব্রাত্যজনদের নিয়েই তাঁর কাজ। সেসব সাধকের মধ্যে রয়েছেন রামানুজ, রামানন্দ, কবীর, নানক, দাদূ, রজ্জন, মীরাবাই, চৈতন্য প্রমুখ। তিনি গবেষণা করেছেন বাংলা-ভারতের সংস্কৃতি নিয়ে, উৎসব-অনুষ্ঠান নিয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গৌণ ধর্মসমূহ নিয়ে। আর গবেষণা করেছেন বাংলার বাউল-ফকিরদের নিয়ে।
ক্ষিতিমোহন বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের কাছে যে সন্তকে প্রথমে হাজির করেন, তাঁর নাম কবীর। মধ্যযুগে ভারতবর্ষে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতের বিরুদ্ধে যেসব গৌণ ধর্মসম্প্রদায়ের বা মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল, তার প্রতিটিতে কিছু না কিছু হলেও রয়েছে সন্ত কবীরের প্রভাব। কবীর ছিলেন সাধক রামানন্দের শিষ্য। জাতিভেদ, পৌত্তলিকতা, তীর্থ888sport slot game, ব্রত, মালা, তিলক প্রভৃতির ধার ধারেননি। তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলমান ধর্মের সকল কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরোধী। উভয় সম্প্রদায়ের সাধক ও জ্ঞানীদের সঙ্গে তিনি আড্ডা দিয়ে বেড়াতেন। সুফিদের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। হিন্দু-মুসলমান সাধকদের সঙ্গে সাক্ষাতের তৃষ্ণায় ভারতের নানা স্থানে 888sport slot game করেছেন। পুরীতে ছিলেন দীর্ঘকাল। মক্কা, বাগদাদ, সমরখন্দ, বোখারা প্রভৃতি স্থানের সাধকদের সঙ্গে করেছেন সাক্ষাৎ। তখন বাগদাদ ছিল উদার চিন্তার সাধকদের চিন্তাচর্চার প্রসিদ্ধ ক্ষেত্র। হিন্দু-মুসলমান সমাজের অর্থহীন বাহ্য আচার ছিল কবীরের কাছে গুরুত্বহীন। তাঁর গুরু রামানন্দের মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ করার জন্য শিষ্যরা কবীরের কাছে এলো দুধ চাইতে। কবীর একটি মরা গরুর পিঞ্জরের কাছে গিয়ে দুধ চাইলেন। শিষ্যরা তিরস্কার করতে লাগল। এ কেমন কথা! মরা গরু কি দুধ দিতে পারে? কবীর বললেন, মরা মানুষের খাদ্য হিসেবে মরা গরুর দুধই ভালো।
একদিন জাহানগন্ত নামে এক মুসলমান সাধক দেখা করতে এলেন কবীরের সঙ্গে। বাড়ির আঙিনায় একটি শূকরকে চরতে দেখে ঘৃণায় তিনি চলে যাচ্ছিলেন। কবীর ডাক দিয়ে বললেন, বাবা, এখনো তোমার এসব সংস্কার আছে! শূকর তো মলিনতা, কিন্তু অন্তরে কি মলিনতা নেই?
কবীর বলেন, ধর্মের আলাদা আলাদা নাম হলেও সব ধর্মের অনুসারীরা একই ভগবানের সন্ধান করছে। কাজেই ঝগড়া বৃথা। হিন্দু-মুসলমান বৃথাই ঝগড়া করে মরল। অহংকার দূর করে, অভিমান ত্যাগ করে, কৃত্রিমতা ও মিথ্যা পরিহার করে সকলকে আত্মার আত্মীয় মনে করে ভগবতপ্রেমে, ভক্তিতে চিত্ত পরিপূর্ণ করো, তবেই সাধনা সফল হবে। বাইরে যাওয়ার দরকার নেই, তোমার অন্তরেই ভগবান আছেন। সেখানেই সহজে তাঁকে পাবে। শাস্ত্র, তীর্থ, আচার ও তর্কের পথে বৃথা ঘুরে মরবে। তোমার নিজের মধ্যেই ব্রহ্মাণ্ড। কাজেই বাইরে না ঘুরে অন্তরে বিশ্বতত্ত্বকে প্রত্যক্ষ করো। বিশ্বনাথ সেখানে বিরাজমান।
হিন্দু-মুসলমান বিভেদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনার চেষ্টা করেছেন কবীর। তার দোঁহায় বলেছেন : ‘অসরে ইন্ দুহু রাহ ন পাঈ/ হিন্দুকী হিন্দুওয়াই দেখী, তুর্কন কী তুর্কাঈ।’ অর্থাৎ, ‘ওরে, এরা দুজনেই পথ পায়নি। হিন্দুর হিন্দুত্ব দেখেছি, আর মুসলমানের মুসলমানত্ব।’ কবীর আরো বলেন : ‘হিন্দু কহত হৈ রাম হমারা, মুসলমান রহিমানা/ আপসমে দৌউ লড়ে মরতে হৈ, মরম কোই নেহি জানা।’ অর্থাৎ, ‘হিন্দু বলে রাম আমার, মুসলমান বলে রহিম আমার। একে অপরের সঙ্গে লড়ে মরে, অথচ মর্ম কেউ জানল না।’
কবীর বলেন : ‘কবীরা, কুয়াঁ এক হ্যায়/ আওর পানি ভরে অনেক/ ভাণ্ড মে নেহি ভেদ হ্যায়/ আওর পানি সব মে এক।’ অর্থাৎ, ‘কবির বলেন, কুয়া তো একটাই। পানি যতই ভরুক সবাই, ভাগাভাগি সব কলসিতে, পানিতে ভেদাভেদ নেই।’
সন্ত কবীর হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা বলেন। কিন্তু ধর্ম বিষয়ে তিনি যেসব কথা বলেন তা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের গায়ে লাগে। একদিন উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন মিলে কবীরের বিরুদ্ধে নালিশ করল তৎকালীন দিল্লির সুলতান সিকান্দার শাহ লোদীর কাছে। কবীরকে ডেকে পাঠালেন সুলতান। কবীর আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। বাদীপক্ষের কাঠগড়ায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজনকে দেখে তিনি অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘ভালোই হয়েছে। তবে ঠিকানায় একটু ভুল হয়েছে।’ সুলতান বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ভালো হয়েছে? কোন ঠিকানা ভুল হয়েছে?’ কবীর বললেন, ‘হিন্দু-মুসলমানকে মিলানোই আমার লক্ষ্য ছিল। সবাই বলত এটা অসম্ভব। আজ তা সম্ভব হলো। ঠিকানা ভুল হয়েছে মানে হচ্ছে, এরা একই ঈশ্বরের দরবারে মিললে ভালো হতো, মিলেছে সুলতানের দরবারে।’ সুলতানের উদ্দেশে কবীর বললেন, ‘তোমার মতো জগতের রাজার সিংহাসনতলে যদি এই মিলন সম্ভব হয়, তবে বিশ্বের অধিপতির সিংহাসনতলে কি আরো প্রশস্ত স্থান মিলবে না?’ সুলতান লজ্জিত হয়ে কবীরকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।
সংসারধর্মকে উপেক্ষা করেননি কবীর। বিয়ে করেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল লোই। তাঁর ছিল এক পুত্র, যাঁর নাম কমাল এবং এক কন্যা, যাঁর নাম কমালী। সাধক বলে কর্মকে তিনি গৌণ মনে করেননি। সাধন অর্থে তিনি শ্রমবিমুখতা বুঝতেন না। নিজে জোলার কাজ করতেন, কাপড় বুনে বাজারে বিক্রি করতেন। তাঁর দোঁহায় উল্লেখ : ‘কহৈঁ কবীর অস উদ্যম কীজৈ/ আপ জীয়ে ঔরন কো দীজৈ।’ অর্থাৎ, এমন শ্রম করবে যা ভিক্ষার ওপর নির্ভর না করে নিজের চলে এবং সম্ভব হলে অপরকেও সহায়তা করা যায়।
তাঁর পুত্র কমালও ছিলেন সাধক। পিতার মৃত্যুর পর কমালকে সবাই বলল, ‘তুমি তোমার বাবার শিষ্যদের নিয়ে সম্প্রদায় গড়ো তোলো।’ উত্তরে কমাল বললেন, ‘আমার বাবা তো চিরজীবন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন আমি যদি সম্প্রদায় গড়ে তুলি, তবে তা হবে পিতার সত্যকে হত্যা করা। এটা একপ্রকার পিতৃহত্যা। এটা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
মধ্যযুগের সব সাধক ছিলেন গানপ্রিয়। 888sport app download apk ও গানের মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজেদের বাণী প্রচার করতেন। কবীরও ছিলেন গীতিকার। নিজে গান রচনা করতেন এবং গাইতেন। বাণী প্রচার করতেন গানের মাধ্যমে। তাঁর বাণীর সারমর্ম হচ্ছে, ‘সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য সব কৃত্রিম বাধা পরিত্যাগ করে সত্য হও, সহজ হও। সত্যই সহজ। সেই সত্যকে বাইরে খুঁজে বেড়ানোর দরকার নেই। তীর্থে, ব্রতে, আচারে, তিলকে, মালায়, ভেখে, সাম্প্রদায়িকতায় সত্য নেই। সত্য আছে অন্তরে। তার পরিচয় মেলে প্রেমে, ভক্তিতে, দয়ায়। কারো প্রতি বৈরীভাব রেখো না, হিংসা করো না। কারণ প্রত্যেক জীবের মধ্যে ভগবান বিরাজিত।’ এই চমৎকার দোঁহায় কবীর বলেন :
দূর গবনতরো হংসা হো
ঘর অগম অপার ॥
নহিঁ ব্ই কায়া নহি বই মায়া
নহি ব্ই ত্রিগুণ পসার ॥
চার বরণ উহ বাঁ হৈ নাহী
না হৈ কুল ব্যোহার ॥
নৌ ছঃ চৌদহ বিদ্যা নাহিঁ
নহিঁ ব্ঁহ ভেদ বিচার।
তপ জপ সংজম তীরথ নাহীঁ
নাহীঁ নেম অচার ॥
পাঁচ তত্ত নহি উৎপত্তি ভইলে
সো পরলয়কে পার।
তীন দেব না তেঁতীস কোটি
নাহিঁ দসো অব্তার ॥
পুরুষ রূপ কহাঁ বরনো মহিমা
তিন গতি অপরম্পার।
কোটি ভানুকী সোভা জিন্হ্কে
ইক ইক রোম উজার ॥
ছর অচ্ছর দূনোঁসে ন্যারা
সোঈ নাম হমার।
অমৃতবাণী লেইকে আয়ো
মিরতু লোক মংঝার ॥
সকল জগকে তুম সব হংসা
গহিলো শব্দ হমার।
দাস কবীরা কস ছিপাবৈঁ
সবকো কহত পুকার ॥
অর্থাৎ, হে হংস (জীব বা সাধক), বহুদূর হইবে তোমাকে যাইতে, অগম্য অপার তোমার ধাম। সেখানে না আছে কায়া, না আছে মায়া, না আছে ত্রিগুণের পসার। চারিবর্ণ সেখানে নাই, কুল ব্যবহার সেখানে কোথায়? নববিধ বিদ্যা, ষড়্বিদ্যা, চৌদ্দ বিদ্যা সেখানে নাই; বেদ বিচার সেখানে নাই। তপ জপ সংযম তীর্থ সেখানে নাই, নিয়ম আচার সেখানে নাই। সেই প্রলয়ের পারে পঞ্চতত্ত্বের উদয়ই হয় নাই। তিন দেব, ত্রিশ কোটি দেব, এবং দশ অবতার কিছুই সেখানে নাই। যিনি স্বামী তাঁহার রূপ কেমন করিয়া করিব বর্ণনা? অপরম্পার তাঁহার মহিমার গতি, যাঁহার এক এক রোমের উজ্জ্বলতায় কোটি ভানুর দীপ্ত প্রভা। সান্ত ও অনন্ত এই উভয়েরই অতীত আমার নাম (স্বরূপ)। এই মৃত্যুলোকের মধ্যে আমি অমৃত বাণীকে লইয়া আসিয়াছি। এই জগতে যত হংস আছ, তোমরা সকলে আমার কথা গ্রহণ করিয়া লও। দাস কবীর কেমন করিয়া সেই অমৃত বাণীকে রাখিবে গোপন করিয়া? সকলকে ডাকিয়া সে উচ্চকণ্ঠে কহিতেছে সেই বাণী।
সেই কালে ছিল সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্য। কিন্তু সংস্কৃত তো পণ্ডিত-ব্রাহ্মণরা ছাড়া সাধারণ মানুষ বোঝে না। কবীর চান তাঁর কথা সবাই বুঝুক। তিনি সরল হৃদয়ের কথা সহজ ভাষায় ব্যক্ত করতে চান। তাই তিনি সংস্কৃত ছেড়ে চলিত হিন্দি ভাষাতেই গান রচনা করতেন। তাঁর দোঁহায় উল্লেখ, ‘সংস্কৃত কূপজল কবীরা ভাষা বহতা নীর।’ অর্থাৎ, ‘হে কবীর সংস্কৃত হলো কূপজল, আর ভাষা হলো প্রবহমান জলধারা।’
হিন্দুধর্মের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিশূলের ডগায় অবস্থিত কাশী বা বারাণসী। বিশ্বনাথের এই প্রাচীন মন্দির গঙ্গা নদীর পশ্চিম পারে অবস্থিত। কাশী বিশ্বনাথের মন্দির বিশ্বেশ্বর মন্দির নামেও পরিচিত। কাশীতে মৃত্যু হলে জন্ম-মৃত্যুর বৃত্তাকার চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে মনে করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। এখানে যার মৃত্যু হয়, স্বয়ং মহাদেব তার কানে তারকমন্ত্র দেন বলে প্রচলিত বিশ্বাস। প্রচলিত এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন কবীর। চিরদিন তিনি কাশীতে ছিলেন। মৃত্যুর আগে বললেন, ‘আমাকে কাশী থেকে দূরে নিয়ে চলো।’ শিষ্যরা তাঁকে বস্তী জেলার মগহরে নিয়ে গেল। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর হিন্দু রাজা বীরসিংহ ও মুসলমান রাজা বিজলী খাঁর মধ্যে লাগল বিবাদ। বীরসিংহ চান কবীরকে হিন্দুমতে দাহ করতে, আর বিজলী খাঁ চান কবর দিতে। ঐতিহাসিক সত্যতা না থাকলেও কথিত আছে যে, কবীরের কাফনের কাপড় খুলে দেখা গেল সেখানে কবীর নেই, কতগুলো ফুল পড়ে আছে। সেসব ফুলের অর্ধেক নিয়ে মুসলমান ভক্তরা মগহরে কবর দিলো, বাকি অর্ধেক হিন্দুরা কাশীতে এনে দাহ করল।
এই যে সন্ত কবীর সম্পর্কে এত কথা লিখলাম, তার কয়েকটি দোঁহা উল্লেখ করলাম, তা কখনোই সম্ভব হতো না, যদি না আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মধ্যযুগের এই সন্তকে নিয়ে গবেষণা করতেন। কবীরের প্রতি ক্ষিতিমোহনের প্রেম ছিল গভীর। চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই তিনি কবীরপন্থি। কাশীতে এবং নানা তীর্থে যেসব সাধকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন, তাঁদের কাছে তিনি কবীরের নানা গভীর বাণী শুনতে পেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে যোগদানের পর তিনি শুরু করলেন কবীরের দোঁহা সংগ্রহের কাজ। ভারতের যত স্থান থেকে কবীরের দোঁহা মুদ্রিত হয়েছে সব সংগ্রহ করলেন। নানা পাঠের মধ্যে যে পাঠটি সংগত মনে করেছেন এবং যা সাধকেরা সংগত মনে করেছেন, তিনি তা-ই 888sport app download apk latest version করে সংকলনভুক্ত করলেন। তাঁর চেষ্টা ছিল কবীরপন্থিদের মধ্যে প্রচলিত পরম্পরাগত বাণীগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে উদ্ধার করা। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি। একই বছর তাঁরই আগ্রহ ও উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ক্ষিতিমোহনের চার খণ্ডের আকরগ্রন্থ কবীর। কবীরের দোঁহা সংকলনের মাধ্যমে ক্ষিতিমোহন সবার জন্য খুলে দিলেন এক রত্নভাণ্ডার। তাঁর সংগৃহীত কবীরের দোঁহা পড়ে উৎসাহিত হয়ে সেসব দোঁহার ইংরেজি 888sport app download apk latest versionে হাত দিলেন রবীন্দ্রনাথ। একশটি দোঁহা 888sport app download apk latest version করলেন তিনি। ১৯১৫ সালে ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত হয় সেই অনূদিত বই।
ক্ষিতিমোহন সেন সাধক কবীরকে বাঙালি পাঠকদের কাছে হাজির করে থেমে যাননি, কবীর-পরবর্তী আরেক প্রভাবশালী সাধক দাদূকে নিয়ে শুরু করলেন কাজ। কবীরের মতো দাদূও ছিলেন মধ্যযুগের সমন্বয়বাদী সাধক। তিনিও কোনো জাতপাত মানতেন না। বলতেন, ‘নির্ভয় হও, উদ্যমী বীর হও, সম্প্রদায়বুদ্ধি ত্যাগ করো। তীর্থ, ব্রত, মূর্তিপূজা, বাহ্য আচার ও চিহ্ন ধারণ সব ব্যর্থ। ক্ষমাশীল হও, ভগবৎ-বিশ্বাসে দৃঢ় হও।’
একবার এক হিন্দু সন্ন্যাসী ও এক মুসলিম মৌলবি এসে দাদূকে বললেন, ‘দাদূ, আপনি সাধনার কথা বলেন, ঈশ্বরের আরাধনা করেন, মানুষের সেবা করেন, সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কোন সম্প্রদায়ভুক্ত?’ দাদূ মুচকি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা ভাই, সূর্য পৃথিবী আকাশ ও নদী হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের সেবা করে চলেছে, আপনারা কখনো জানার চেষ্টা করেছেন তারা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত?’
উদার ও সমন্বয়বাদী সাধক দাদূ ছিলেন সন্ত কবীরের ভাবদর্শনে প্রভাবিত। ভারতবর্ষে তো তখন জাতপাতের ভেদাভেদ চরমে। দাদূ তার উদার ‘পদ’ বা ‘বাণী’র মাধ্যমে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন জাতপাতের দেয়াল। কবীরের মতো সকল ধর্মের ঐক্যের লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রহ্মসম্প্রদায়’ বা ‘পরব্রহ্মসম্প্রদায়’। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু যেমন ছিল, তেমনি ছিল মুসলমানরাও। আজো তাই আছে। হিন্দু-মুসলমান ও সকল ধর্মকে এক উদার ও মৈত্রীভাবের দ্বারা যুক্ত করার এক বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল দাদূর। তাঁর পদ বা বাণীগুলো গভীর ও উদার। পদগুলোতে তিনি বারবার সন্ত কবীরের গুণগান করেছেন। কবীরের মতো দাদূরও কোনো শাস্ত্রপ্রীতি ছিল না, আত্মানুভবকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সত্য অজেয়, সত্য জীবনে লুকানো যায় না। অহংকার ত্যাগ করো। সকল মানুষ পরস্পরের ভাই। এক ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়ে সকলকে ভাইবোনের মতো দেখো। তোমার অন্তরেই ভগবানের ধাম, সেখানেই তাঁর নিবাস। প্রেমের মাধ্যমে সেখানে তাঁকে পাওয়া যায়। ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হও। তাঁর কাছে কিছু প্রার্থনা না করে বরং তাঁর বিশ্বসেবার সঙ্গে নিজের সেবাকে মিলাও, তাহলেই গভীরতর হবে যোগ। দুর্নীতি, মলিনতা ত্যাগ করে সরলভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছার অধীন হওয়ার নাম যোগ।’ দাদূর পদে উল্লেখ : ‘মহারো লাগি রাম বৈরাগী তজা নঁহী জাঈ/ প্রেম বিথা করত উর অন্তর বিসুরি সুখ নঁহী পাঈ।’ অর্থাৎ, ‘আমার জন্য রাম বৈরাগী, তাই তাঁকে ত্যাগ করার কোনো উপায় নেই। অন্তর আমার প্রেমের বেদনায় আর্ত, তাঁকে বিস্মৃত হওয়ার উপায় নেই।’ দাদূ এই দীর্ঘ পদে বলেন :
ঘট ঘট রাম রতন হৈ দাদূ লখৈ ন কোই।
জবহী কর দীপক দিয়া তবহী সূঝন হোই ॥
মন মালা তহঁ ফেরিয়ে দিরস ন পরসৈ রাত।
তই গুরু বানা দিয়া সহজৈ জপিয়ে তাত ॥
মন মালা তহঁ ফেরিয়ে প্রীতম বৈঠে পাস।
অগম গুরুতৈ গম ভয়া পায়া নূর নিবাস ॥
মন মালা তহঁ ফেরিয়ে আপৈ এক অনংত।
সহজে সো সতগুর মিলা জুগ জুগ কাল বসংত ॥
সতগুর মালা মন দিয়া পরন সুরতি সো পোই।
বিনা হাথ নিস দিন জপৈ মরম জাপ ফুঁ হোই ॥
মন ফকীর মাহৈ হুয়া ভীতরি লিয়া ভেখ।
সবদ গহৈ গুরুদেরকা মাঁগৈ ভীখ অলেখ ॥
মন ফকীর সতগুরু কিয়া কহি সমঝায়া গ্যান।
নিহচল আসনি বৈঠি করি অকল পুরূস কা ধ্যান ॥
মন ফকীর এসৈ ভয়া সতগুরু কে পরসাদ।
জহঁকা থা লাগা তহাঁ ছুটে বাদ বিবাদ ॥
না ঘরি রহ্যা না বন গয়া না কুছ কিয়া কলেস।
দাদু জে্যাঁ হি ত্যো মিলা সহজ সুরত উপদেস ॥
য়হু মসীতি য়হু দেরংরা সতগুরু দিয়া দিখাই।
ভীতরি সেবা বংদগী বাহরি কাহে জাই ॥
মংঝেহি চেলা মংঝে গুর মংঝেহি উপদেস।
বাহরি চুঁ ঢ়ৈ বাররে জটা বঁধায়ে কেস।
আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন এই পদের 888sport app download apk latest version করেছেন এভাবে : ‘হে দাদূ প্রতি ঘটেই (জীবে জীবেই) রাম রতন বিরাজমান। অথচ কেহই দেখিতে পায় না; যখনই গুরু হাতে সাধনার প্রদীপ দেন তখনই দর্শন মেলে। মন-মালা সেখানে ফিরাও যেখানে দিবসের ও রাত্রির নাই কোনো পরশ; সেখানে গুরু দিয়াছেন সাধনার রীতি, সহজেই করো সেখানে জপ। মন-মালা সেখানে ফিরাও যেখানে প্রিয়তম বসেন পাশে, গুরুর প্রসাদে অগম্যও হইয়াছে গম্য, জ্যোতির্ময় ধাম গিয়াছে পাওয়া। মন-মালা ফিরাও সেখানে, যেখানে তিনি আপনিই একা অনন্ত। সহজেই সেই সদগুরু মিলিয়াছে; এখন যুগের পর যুগ আমার ফাগ, যুগের পর যুগ আমার বসন্তোৎসব। প্রেমের নিশ্বাসে মালা গাঁথিয়া সদ্গুরু দিলেন মন-মালা। বিনা হাতে নিশি-দিন চলিয়াছে জপ, এমন করিয়াই হয় মরম জাপ। ভিতরেই মন হইল ফকির, ভিতরেই লইল ভেখ, ভিতরেই গুরুদেবের শব্দ (সংগীত) করিল গ্রহণ আর অলেখ (অপার অনন্ত) চাহিল ভিক্ষা। সদ্গুরুই মনকে ফকির করিয়া দিলেন, কহিয়া বুঝাইয়া দিলেন জ্ঞান। এখন নিশ্চল আসনে বসিয়া অনন্ত অকল পুরুষের ধ্যান করিতে হইবে সাধন। সদ্গুরুর প্রসাদে মন এমনি হইয়া গেল ফকির। যেখানকার সে ছিল সেখানেই সে গেল যুক্ত হইয়া, সব বাদ-বিবাদ গেল ঘুচিয়া। ঘরেও সে রহিল না, বনেও সে গেল না, কিছু ক্লেশও সে করিল না, হে দাদূ, সহজ প্রেমধ্যানের উপদেশে, ঠিক যেমন ধারা তেমনি গেল মিলিয়া। সদ্গুরু দেখাইয়া দিলেন যে এই অন্তরেই মসজিদ অন্তরেই দেব-মন্দির, ভিতরেই সেবা ভিতরেই প্রণতি, তবে বৃথা আর বাহিরে কেন যাওয়া? হে দাদূ, অন্তরের মধ্যেই চেলা, অন্তরের মধ্যেই গুরু, অন্তরেই উপদেশ। কেশে জটা বাঁধিয়া পাগলেরা বাহিরে বৃথা মরে খুঁজিয়া।’
ক্ষিতিমোহন সেনের দাদূ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। তার দশ বছর আগে প্রবাসী ভাদ্র ১৩৩২ 888sport free betয় রবীন্দ্রনাথ একটি 888sport live লিখেছিলেন। সেই 888sport liveটিই মুদ্রিত হয় দাদূর ভূমিকা হিসেবে। সেই ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের সাধক কবিদের অন্তর থেকে গানের উৎস এমনি করেই খুলেছে। তাঁরা রামকে, আনন্দস্বরূপ পরম এককে আত্মার মধ্যে পেয়েছিলেন। তাঁরা সকলেই প্রায় অন্ত্যজ, সমাজের নীচের তলাকার; পণ্ডিতদের বাঁধা মতের শাস্ত্র, ধার্মিকদের বাঁধা নিয়মের আচার তাঁদের কাছে সুগম ছিল না। বাইরের পূজার মন্দির তাঁদের কাছে বন্ধ ছিল বলেই অন্তরের মিলনমন্দিরের চাবি তাঁরা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁরা কত শাস্ত্রীয় শব্দ আন্দাজে ব্যবহার করেছেন, শাস্ত্রের সঙ্গে তার অর্থ মেলে না। তাঁদের এই প্রত্যক্ষ উপলব্ধির রাম কোনো পুরাণের মধ্যে নেই। তুলসীদাসের মতো ভক্ত কবিও এদের এই বাঁধনছাড়া সাধনভজনে ভারি বিরক্ত। তিনি সমাজের বাহ্য বেড়ার ভিতর থেকে এদের দেখেছিলেন, একেবারেই চিনতে পারেন নি। এঁরা হলেন এক বিশেষজাতের মানুষ। ক্ষিতিবাবুর কাছে শুনেছি, আমাদের দেশে এঁদের দলের লোককে বলে থাকে ‘মরমিয়া’। এঁদের দৃষ্টি, এঁদের স্পর্শ মর্মের মধ্যে; এঁদের কাছে আসে সত্যের বাহিরের মূর্তি নয়, তার মর্মের স্বরূপ। বাঁধা পথে যাঁরা সাবধানে চলেন তাঁরা সহজেই সন্দেহ করতে পারেন যে, এঁদের দেখা এঁদের বলা সব বুঝি পাগলের খামখেয়ালি। অথচ সকল দেশে সকল কালেই এই দলের লোকের বোধের ও বাণীর সাদৃশ্য দেখতে পাই।’
ক্ষিতিমোহন সেনের এই অনন্য গবেষণাকর্ম দাদূ 888sport appsে দুর্লভ ছিল, কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না বলে পাঠকেরা বঞ্চিত হচ্ছিল। ভারতীয় পুরাণ বিষয়ে আমার আগ্রহ রয়েছে। ভারতীয় পুরাণ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আগ্রহী হই বাংলা-ভারতের ফকির, সন্ন্যাসী, বাউল, সাধু, সন্ত, মরমি সাধকদের সম্পর্কে। এসব মরমি সাধক ও তাঁদের সাধনা নিয়ে মাঝেমধ্যে লিখতামও। একদিন হাতে পাই ক্ষিতিমোহনের দাদূ বইটি। সানন্দে পড়লাম। এর আগে ক্ষিতিমোহন সেনের বিভিন্ন লেখায়, বিশেষত ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা বইয়ে দাদূ সম্পর্কে জেনেছি। দাদূ বইয়ে পেলাম সম্পূর্ণ দাদূকে, তাঁর জীবন, কর্ম ও দর্শনকে। একদিন যোগাযোগ করলাম বাংলাবাজারের রোদেলা প্রকাশনীর প্রকাশক রিয়াজ খানের সঙ্গে। তাঁকে বইটির গুরুত্ব বোঝালাম। বললাম যে, চাইলে তিনি রোদেলা থেকে বইটি প্রকাশ করতে পারেন। কপিরাইট সংক্রান্ত কোনো ঝামেলা নেই। কারণ বইটি প্রথম প্রকাশের ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বইটি প্রকাশে সানন্দে রাজি হলেন রিয়াজ। অবশেষে 888sport appsের পাঠকদের জন্য ২০২৪ সালের 888sport cricket BPL rateে বইমেলায় প্রকাশিত হয় ক্ষিতিমোহন সেনের অসাধারণ গবেষণাকর্ম দাদূ।
মরমি সাধক কবীর ও দাদূর আজীবনের সাধনা ছিল সম্প্রীতির সাধনা। সবার ঊর্ধ্বে তাঁরা স্থান দিয়েছিলেন মানবতাকে। ক্ষিতিমোহন সেনও করে গেছেন সেই সাধনা। অধিকাংশ 888sport apps ও ভারতবাসীর মন আজ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে দূষিত, কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মানুষের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সহিষ্ণু মনোভাব। এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির অবসানে প্রয়োজন মানুষের বুদ্ধির মুক্তি। ক্ষিতিমোহন সেনের কবীর ও দাদূ বই দুটি সেই মুক্তির পথ দেখাবে, মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলবে মানবিক বোধ।
তিন
কবীর ও দাদূ ছাড়াও ক্ষিতিমোহন সেনের আরো যেসব উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম রয়েছে সেগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, তাঁর দুনিয়া থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি। গোটা জীবন তিনি তাঁর দুনিয়াতেই স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন। কবীর ও দাদূ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্মসমূহের মধ্যে রয়েছে : ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা, ভারতের সংস্কৃতি, বাংলার সাধনা, যুগগুরু রামমোহন, জাতিভেদ, বাংলার বাউল, হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ, ভারতের হিন্দু-মুসলমান যুক্ত সাধনা, প্রাচীন ভারতে 888sport promo code, চিন্ময় বঙ্গ, রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ, ভারতীয় ধর্মে উদারতা, Medieval Mysticism of India, শান্তিনিকেতনের দিনলিপি, সন্তমত এবং মানবযোগ এবং হিন্দুধর্ম।
তাঁর সবকটি বই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই গদ্যের পরিধি এতই বিস্তৃত হয়ে পড়বে যে, দুশো পৃষ্ঠার একটি আলাদা বই হয়ে যাবে। তাছাড়া যেসব বিষয়ে লিখব, সেসব বিষয়ে যা লেখার তা ক্ষিতিমোহনই লিখে দিয়ে গেছেন। তাঁর বইগুলোতে সবই আছে। আমি লিখতে গেলে তা হয়ে উঠতে পারে পুনর্লিখন। সুতরাং তাঁর হিন্দুধর্ম বইটি নিয়ে সংক্ষেপে আমার পাঠউপলব্ধি জানিয়ে এই গদ্যের ইতি টানব।
ভারতবর্ষে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে হিন্দু ও মুসলমান দুটি সম্প্রদায় বসবাস। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, তারা পরস্পরকে ঠিকমতো জানে না। মুসলমানরা জানে না হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে, হিন্দুরা জানে না মুসলমান ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে। সাধারণ কোনো মুসলমানকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, হিন্দু ধর্ম কী? সে উত্তর দেবে, ওটা তো কোনো ধর্মই না। হিন্দুরা দেব-দেবীর পূজা করে, মাটির মূর্তির পূজা করে, সূর্যের পূজা করে, বৃক্ষের পূজা করে। তারা পৌত্তলিক, তারা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে, তারা নিশ্চিত জাহান্নামি। মুসলমানরা কখনো বেদ পড়ে দেখেনি; কখনো রামায়ণ, মহাভারত কিংবা উপনিষদ পড়ে দেখেনি। তাদের যদি প্রশ্ন করা হয়, শ্রীবিষ্ণু কে? কেউ কেউ হয়তো বলতে পারবে, তিনি একজন হিন্দুদেবতা। এর বেশি কিছুই না। তাদের যদি শিব ও পার্বতীর কথা জিজ্ঞেস করা হয়, তারা কিছুই বলতে পারবে না। তাদের যদি ব্রহ্মা সম্পর্কে বলতে বলা হয়, তারা হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তাদের যদি শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তারা সর্বোচ্চ বলবে, সে তো রাধার প্রেমিক। এর বেশি কিছু না। এই ভারতবর্ষের ভাব-দর্শনে, সংগীতে এবং 888sport live footballে কৃষ্ণের কী প্রভাব, কিছুই তারা বলতে পারবে না। ভারতবর্ষের এই সনাতন ধর্মের কত মত, কত পথ, কত বৈচিত্র্য, কত পূর্জা-অর্চনা, কত দেবদেবী, কত সংস্কার-কুসংস্কার, তার কিছুই তারা জানে না। আমি সব মুসলমানের কথা বলছি না। মুসলমানদের মধ্যে চিন্তায় যাঁরা অগ্রসর, যাঁরা জ্ঞানান্বেষী, যাঁরা বৈচিত্র্যবাদী, তাঁরা সনাতন ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান রাখেন। তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু তাঁদের 888sport free bet এতই কম যে, হিসাবের মধ্যেই ধরা যায় না।
একইভাবে হাজার বছর পাশাপাশি বসত করা সত্ত্বেও হিন্দুরাও জানে না ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে। হিন্দুদের মধ্যে ভাই গিরিশচন্দ্র 888sport free betয় কম, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, স্বামী বিবেকানন্দ কিংবা রাজা রামমোহন রায়ের 888sport free bet কম। সবার পক্ষে তা হয়ে ওঠা সম্ভবও নয়। আমি বিরাটসংখ্যক সাধারণ হিন্দুদের কথা বলছি, যারা ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবহিত। তাদের কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনি কখনো কোরান পড়েছেন? তিনি এক শব্দে উত্তর দেবেন, না। আপনি কখনো হাদিস পড়েছেন? না। কখনো ইসলামের দর্শন জানার চেষ্টা করেছেন? না। আপনি কখনো শুনেছেন ইসলামের ভেতরে কত মতভেদ, কত ধারা-উপধারা? না।
সাধারণ হিন্দু কেন, পশ্চিমবঙ্গে বিদ্বজ্জনদেরও মাঝেমধ্যে এই অজ্ঞতায় ভুগতে দেখা যায়। কলকাতার বড় বড় সংবাদপত্রও মুসলমানদের নামের বানান ভুল করে থাকে। প্রখ্যাত লেখক সাদাত হাসান মান্টোকে সদত হসন মন্টো লিখতে দেখেছি। 888sport appsের খ্যাতিমান কবি শামসুর রাহমানকে শামছুর রহমান, কথা888sport live chatী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আখতারুজ্জমন ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হককে সৈয়দ শমসুল হক লিখতে দেখেছি। এই ভুল যে সবসময় ইচ্ছাকৃতভাবে করে তা নয়, অজ্ঞতাবশতও করে। মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তারা অজ্ঞ বলে ঠিকমতো মুসলমানদের নামগুলোও লিখতে পারে না।
পরস্পরকে এই না জানা, না বোঝার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, সৃষ্টি হয়েছে অনৈক্য, বারবার ঘটেছে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত। কোনো মুসলমান যদি হিন্দুধর্মকে জানতে আগ্রহী হয়, তবে তাকে আমি একটি বই সাজেস্ট করব, ক্ষিতিমোহন সেনের হিন্দুধর্ম। হিন্দুধর্ম কী, তার দর্শন কী, তার বৈচিত্র্য কী এবং তার উদারতা, সহিষ্ণুতা, বহুত্ববাদিতাকে জানার জন্য এই বইটিকে আমি শীর্ষে রাখব। ক্ষিতিমোহন সেন বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, ‘এ গ্রন্থে আমার লক্ষ্য সেই সব পাঠক, হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে যাঁদের কোনও বদ্ধধারণা নেই। সেই কারণেই পাঠকের কাছে নূতন ঠেকতে পারে এমন সব তত্ত্বকেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। হিন্দুধর্মের বিশেষজ্ঞ বানাতে চাইনি পাঠককে। বেশ দক্ষতার সঙ্গে লেখা অনেকগুলি বিপুলায়তন বই আছে ধর্ম বিষয়ে। উৎসাহী পাঠক সেগুলি দেখে নিতে পারবেন সহজেই। এই গ্রন্থ নিছক ভূমিকা ছাড়া কিছু নয়। হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কিছুই জানেন না এমন পাঠকদের এ ধর্মের স্বভাব আর ক্রিয়াকলাপের একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার, আর সেই সঙ্গে তাঁদের মনে একটু আগ্রহ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যই এ বই লেখা।’
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কোনো মুসলমান পাঠক হিন্দুধর্ম বইটি পড়লে তার মধ্যে তৈরি হবে সহিষ্ণুতা, তৈরি হবে উদারতা, তৈরি হবে সম্প্রীতির মনোভাব। এতদিন সে যাকে শত্রু মনে করে এসেছে, তার সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা লাভ করতে পারবে। অজানা শত্রুকে বেশি ভয় পায় মানুষ। যে শত্রু চেনা, যার সব কিছু জানা, তাকে শত্রু বলেই মনে হয় না। 888sport appsের পার্বত্যাঞ্চলে বাস করে ত্রিপুরা, চাকমা, ম্রো, খাসিয়া, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাঙ্খো, খিয়াং, বম, খুমি প্রভৃতি জাতি। ভারতের আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যে বাস করে বাঙালি, গারো, খাসি, জয়ন্তিয়া, মণিপুরী, চাকমা, কুকি, মিজো, আরকানিজ প্রভৃতি জাতি। তারা ধর্মে, জাতিতে এবং সংস্কৃতিতে আলাদা হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরকে শত্রু মনে করে না, ধর্মীয় সংঘাতে জড়ায় না। কারণ তারা পরস্পরকে জানে। পরস্পরের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজকে জানে। জানে বলেই পরস্পরের প্রতি তাদের কোনো ভয় কাজ করে না। কোনো মুসলমান হিন্দুধর্ম বইটি পড়লে, আমার ধারণা, কোনো হিন্দুধর্মাবলম্বীকে তার আর শত্রু বলে মনে হবে না। কেননা সে বইটি পড়ে এই ‘শত্রুর’ অন্দরমহল জেনে যাবে। তখন সে নিজেকেই প্রশ্ন করবে, এতদিন আমি হিন্দুধর্ম সম্পর্কে যা জেনে এসেছি তার সবই ভুল?
এ-বইয়ে ক্ষিতিমোহন দেখিয়েছেন কীভাবে পাঁচ হাজার বছর ধরে বহু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যপূর্ণ হিন্দুধর্ম ভারতবর্ষের ধর্মান্দোলনের ধারাগুলির জন্ম দিয়েছে এবং আত্তীকরণ করেছে। দেখিয়েছেন ধর্মটি কীভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ সব দর্শনকে আত্তীকরণ করে নিতে পারে। হিন্দু ধর্ম ও দর্শন নিয়ে এরচেয়ে ভালো বই আমার আর পড়ার সুযোগ হয়নি। আদৌ হবে কি না সন্দেহ।
চার
ক্ষিতিমোহন সেই ভারতপথিক, ভারতবর্ষের পথে পথে হেঁটে হেঁটে যিনি এদেশের ভাব-দর্শনের অন্তঃপ্রবাহী স্রোতধারাকে গ্রন্থবদ্ধ করে আমাদের অবহিত করেছেন। তিনি সেই গবেষক, যিনি গৃহকোণের টেবিলে বসে গবেষণা করেননি, তিনি গবেষণার উপাদানের কাছে গেছেন, সেসব সাধু সন্ত ফকির সন্ন্যাসী বাউলদের কাছে গেছেন, যারা বহু পথ বহু মতের এই ভারতবর্ষে সৃষ্টি করেছিলেন সম্প্রীতি, সহিষ্ণুতা, উদারতা ও ঐক্যের এক মহত্তম ধারা। ক্ষিতিমোহন সেই 888sport appsের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, একদা যে 888sport appsে এসে গলাগলি করেছিলেন হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের সাধকেরা।
ক্ষিতিমোহন সম্পর্কে তাঁরই ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলীর মূল্যায়নটি যথার্থ। ‘আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন’ 888sport liveে তিনি লিখছেন, ‘ক্ষিতিমোহনের প্রধান কর্ম ছিল, সমাজের তথাকথিত নিম্নতম সম্প্রদায়েও যে সত্য যুগপৎ লুক্কায়িত ও উদ্ভাসিত আছে, তারই দিকে তথাকথিত শিক্ষিতজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মধ্যযুগের সন্তদের নিয়ে তিনি তাঁর সাধনা আরম্ভ করে নিচের দিকে নেমে এলেন আউল-বাউল এবং সেখানে সেসব মণিমুক্তা পেলেন, তাদের প্রাচীনত্বের সন্ধানে ওপরের দিকে গেলেন বেদ-উপনিষদে। এই অবিচ্ছিন্ন তিন লোকে তাঁর গমনাগমন গতিধারা ছিল অতিশয় স্বতঃস্ফূর্ত আয়াসহীন। এটা পণ্ডিতজন-দুর্লভ-ধর্মলোকে বিধিদত্ত স্পর্শকাতরতা না থাকলে এ জিনিস সম্ভব না। ক্ষিতিমোহন পথ প্রদর্শন করার পর আরও অনেকেই আউল-বাউল নিয়ে চর্চা করেছেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ক্ষিতিমোহন একক। তার কারণ ক্ষিতিমোহনের এমন একটি গুণ ছিল যা এ যুগে আর কারও ছিল না – আমার অভিজ্ঞতায় পৃথিবীর কুত্রাপি আমি এ গুণটি দ্বিতীয় জনে দেখিনি।’
888sport apps-ভারত তো বটেই, আজ পৃথিবীর নানা দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং যুদ্ধের হুংকারে সংবেদনশীল, উদার, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক মানুষেরা বিপর্যস্ত। ধর্মাশ্রয়ী ফ্যাসিবাদ ঘিরে ধরেছে শান্তিপ্রিয় মানুষদের। এই দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায় হচ্ছে প্রাচীন বাংলা ও ভারতে হিন্দু-মুসলমান যুক্তসাধনার যে ধারা ছিল, গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে যে ধারাকে আমাদের সামনে প্রকাশ করেছেন ক্ষিতিমোহন, সেই ধারাকে পুনর্বার ক্রিয়াশীল করে তোলা। তবেই বিনাশ হবে সাম্প্রদায়িক এবং বিভেদকামী অপশক্তির। তবেই জাগতে পারে আমাদের শুভবোধ, উদারতা, সহিষ্ণুতা এবং সম্প্রীতি। সেই ধারাকে ক্রিয়াশীল করে তোলার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেই ধারা সম্পর্কে জানা। ক্ষিতিমোহন সেন আবিষ্কৃত সেই দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়া। আপনাদের আমি আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর সেই দুনিয়ায় প্রবেশের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
সহায়ক গ্রন্থ : ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা, ভারতের সংস্কৃতি, বাংলার সাধনা, যুগগুরু রামমোহন, জাতিভেদ, বাংলার বাউল, হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ, ভারতের হিন্দু-মুসলমান যুক্ত সাধনা, প্রাচীন ভারতে 888sport promo code, চিন্ময় বঙ্গ, রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ, ভারতীয় ধর্মে উদারতা, Medieval Mysticism of India, শান্তিনিকেতনের দিনলিপি, সন্তমত এবং মানবযোগ, এবং হিন্দুধর্ম। একটি গ্রন্থ ক্ষিতিমোহন সেনের। এছাড়া আরো যেসব গ্রন্থ ও 888sport live থেকে তথ্যসহায়তা নেওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে : প্রণতি মুখোপাধ্যায়ের ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধশতাব্দীর শান্তিনিকেতন, সুদেষ্ণা বসুর 888sport live ‘রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য আবিষ্কার’, রবিন পালের 888sport live ‘রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন ও প্রসঙ্গকথা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্র এবং স্বকৃত নোমানের ‘বাংলায় ইসলাম – সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারা’, অমর্ত্য সেনের জগৎ কুটির।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.