ইমতিয়ার শামীম
ইলেকট্রিসিটি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত এসে যায়। অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে মোমবাতির মরে যাওয়া দেখি আমি। বহুদূর থেকে অন্ধকারের গা বেয়ে সুধা আর অমলের কণ্ঠ ভেসে আসে, আমি সুধাকে বলতে শুনি, আমি সুধা… ফুল তুলে ফেরার পথে তোমার সঙ্গে গল্প করে যাব।
অমল এ-কথায় কিছু বলে না। স্তব্ধতাকে ধাক্কা দিয়ে হঠাৎ করে আলো জ্বলে ওঠে। তখন দেখি, কোথায় সুধা ও অমল! পুরো ঘরে মা ছাড়া আর কেউ নেই। মা বসে আছে মোড়ার ওপর। ঘাড়টা খানিক কাত হয়ে আছে তার, যতই চেষ্টা করুক, এখন আর সেটা সোজা হয় না। কৈশোরে কিংবা তারুণ্য এভাবে কোনো মেয়েকে অথবা তাকে বসে থাকতে দেখেই হয়তো আল মাহমুদ অথবা ইউসুফ মনিরের মনে হয়েছিল, ‘ঘুরিয়ে গলার বাঁক, ওঠো বুনোহংসী আমার…’
কিন্তু আমি পিকু নই, আমার মধ্যে দুপুরের ঝিমধরা নিঃসঙ্গতা নেই, মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ দেখে আমাকে কোনোদিন বাগানে গিয়ে একা-একা ড্রয়িংখাতার সামনে বসতে হয়নি রং-তুলি নিয়ে। আর অকস্মাৎ একপশলা বৃষ্টি হয়ে ছুটে আসেনি ঝরঝরে কান্না। সত্যজিতের মতো কেউ তাই সুযোগ পায়নি আমাকে নিয়ে পিকু তৈরির, কালীকৃষ্ণ গুহর মতো কেউ কোনো 888sport app download apkও লেখেননি আমার নিঃসঙ্গ দুপুর নিয়ে। এমন দুপুর আমার জীবনে কোনোদিন আসেনি। কেননা, আমি তো জানতামই না, রিফাত সুলতানার জীবনে ইউসুফ মুনিরের ভূমিকা। আমি তো জানতামই না, অপচয়ের 888sport live chat দিয়ে মানুষ নিজের অশ্রুবিন্দুকে কত দুর্লভ করে তোলে।
এখন আমি একা-একা ডাকঘর শুনি, সুধা আর অমলের হাহাকার শুনি অথবা স্বগত সংলাপ শুনি রিফাত সুলতানা ও ইউসুফ মুনিরের। পলেস্তারা খসে পড়তে পড়তে ঘরের দেয়ালে বিবর্ণতা উঠে আসে, কচুরিপানায় অদৃশ্য পুকুর অাঁকুপাঁকু করে বর্ষা কিংবা হেমন্ত ও শীতের দিনগুলোতে – ভাড়া বাড়িয়ে দিতে অথবা অগ্রিম চাইতে পারে, এসব ভয় ও আশঙ্কায় আমি আর বলি না নতুন করে রং করতে। কিন্তু কোনো বিবর্ণতাই মাকে স্পর্শ করে না। কবে সেই চার না পাঁচ বছরে সে স্টিমারে চড়েছিল ফুলছড়ি ঘাট থেকে 888sport app আসার পথে, তারপর শুনেছিল ইঞ্জিনের থরথরানো আওয়াজ, দেখেছিল স্টেকহোল্ডে কয়লাওয়ালাদের মুখ রক্তাক্ত হয়ে-ওঠা, চিমনি থেকে উঠে আকাশের দিকে ধোঁয়া মিলিয়ে যাওয়া আর বিরক্ত একঝাঁক পাখির পথ বদলানো – সবকিছু স্পষ্ট বলে যেতে থাকে। বলে স্টিমারের মালিশঘরের কথা, চোখ মুদে লোকজন শুয়ে আছে উপুড় হয়ে, আর বাচ্চাবাচ্চা ছেলেমেয়েরা তাদের পিঠ-মাথা বানিয়ে দিচ্ছে নিপুণ ভঙ্গিতে। যখন-তখন এসব শুনতে শুনতেও মায়ের ওপর আমার আর রাগ হয় না, বরং কপাল আর নাকের ওপর স্বেদবিন্দু জমতে থাকে। মায়ের জন্য কষ্টের স্বেদবিন্দু।
অথচ ইউসুফ মুনিরকে আমি কখনো চোখে দেখিনি। কোনোদিন দেখবও না। ইউসুফ মুনির মারা গেছেন অনেক আগেই। তবে এত বেশি আগে নয় যে, রিফাত সুলতানার বিয়েরও আগে; এত বেশি আগে নয় যে, রিফাত সুলতানা সন্তানবতী হওয়ারও আগে। আমি জানি না, ইউসুফ মুনির আমাকে কোনোদিন নিজের চোখে দেখেছে কি-না, কোনোদিন কোলে তুলে আদর করেছে কি-না। যদি কোলে নিয়ে থাকে, তার কি তখন মনে হয়েছিল, এই সন্তানের পিতা আমিও হতে পারতাম?
মায়ের কাছে সুযোগমতো শুনতে হবে।
এমনকি আমি তো এটুকুও জানতাম না, রিফাত সুলতানা আর ইউসুফ মুনির ভিসিআরে রোমান হলিডে দেখেছিল একসঙ্গে একদিন সন্ধ্যারাতে। আধো ক্লান্তি নিয়ে রিফাত সুলতানা সোফাসেটের ওপর শুয়ে পড়েও কী এক অদৃশ্য টানে চোখদুটো খুলে রেখেছিল বারবার গ্রেগরি পেককে দেখার লোভে। খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে হেপবার্ন পথবেঞ্চের ওপর, পড়ে যাচ্ছে ঘুমের ঘোরে, আর রিফাত সুলতানা উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠছে – ‘আরে, পড়ে যাচ্ছে তো…’ কিন্তু গ্রেগরি পেক তাকে আবারো পথবেঞ্চের ওপর শুইয়ে দিচ্ছে দেখে স্বস্তিতে তার মুখ দুলে উঠছে, অতএব আবারও হেপবার্ন পড়ে যাচ্ছে দেখে সে হেসে উঠছে – কেননা সে জানে, নিশ্চয়ই পেক আবারও সামলাবে হেপবার্নকে; কিন্তু হাসতে হাসতেই কী ভেবে ইউসুফ মুনিরের দিকে ফিরে তাকিয়ে সে চমকে ওঠে এবং হাসিটুকু ফিরিয়ে নেয় নিজের মনের ভেতর। ইউসুফ মুনির মাথা নিচু করে রাখে মেঝের ওপর। আজ সে সারা বিকেল সূর্যমুখী খুঁজে ফিরেছে শহরের ফুটপাত, অলিগলি আর বাগানে; আজ তার ইচ্ছা ছিল রিফাতকে দেবে সূর্যমুখী আর রজনীগন্ধা মেলানো একগোছা ফুল। দিনের ফুল সূর্যমুখী আর রাতের ফুল রজনীগন্ধা – দিনরাত সে থাকতে চায় রিফাতের পাশে, দিনরাত সে চায় রিফাতকে। কিন্তু এই শহরের কোথাও সে সূর্যমুখী খুঁজে পায় না, ফুলের দোকানগুলোতেও শুধু রজনীগন্ধা আছে, ফুলের মালীরা তাকে রজনীগন্ধাই নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু সে তো চায় না, শুধু রাতটুকুই রিফাতের পাশে থাকতে তার তাই কোনো ফুলই আনা হয় না। সে শুধু রোমান হলিডের ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে রিফাতদের বাসায় ঢোকে।
আমি এখন আমার মাকে ঘেন্না করতে পারি। রাগ নয়, অভিমান নয় – এতকিছু জানার পর পুরোপুরি ঘেন্নাই করা যায় হয়তো; যেমন করত আমার বাবা। অথবা যেমন ঘৃণা করত হেনাকাকি আশরাফকাকাকে। কেননা, খুব মায়াবী ভালোবাসা দিয়ে হেনাকাকি বিয়ের পরপরই জেনে নিয়েছিল বিয়ের আগে কাকা একবার প্রেমে পড়েছিল। কাকা তখন জানত না, পুরনো প্রেমকে দুর্গার চুরি করা হারের মতো রেখে দিতে হয় পুকুরের তলায় – যাতে কোনোদিন কোনো ঝাউয়া এসে খুঁজে পেলেও গ্রামের কেউ বলতে না পারে, চুরিই হয়েছিল হারটা। কিন্তু সুন্দরী বউয়ের প্রশ্রয়মাখা চোখের দিকে তাকিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে মুগ্ধ ও নিবেদিত কাকা কোনো দ্বিধা করেনি। তার কি তখন মনে হয়েছিল, কোনো একদিন অবসন্ন বিকেলে পুরনো প্রেমিকার কথা মনে হলে নিবিড় এক শুশ্রূষা হয়ে হেনাকাকি তাকে বুকে তুলে নেবে? বোধহয় তাই, নইলে গড়গড় করে সবকিছু বলেছিল কেন! যদিও মোটেও ওরকম হয়নি, বরং হেনাকাকি তার হিংস্র ভালোবাসা দিয়ে নরক করে তুলেছিল কাকার জীবন।
প্রতিদিন, কোনোদিন হয়তো গভীর রাতে, কোনোদিন হয়তো সন্ধ্যাবেলায়, কোনোদিন আবার গভীর রাতে হেনাকাকির তীক্ষ্ণ কণ্ঠ তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠত। শুরু হতো নিতান্তই সাদামাটাভাবে, যেন হঠাৎ হাত থেকে কাচের গ্লাস পড়ে গেছে শুকনো বিছানায়, ভিজে উঠছে বিছানা-চাদর, তারস্বরে কেউ চেষ্টা করছে চাদরটা সরিয়ে ফেলার। ওদিকে গ্লাসটা গড়াতে গড়াতে সশব্দে পড়ে গেল মেঝের ওপর। কিন্তু ঘটনা এর চেয়েও ভয়াবহ – কেননা, হেনাকাকির হঠাৎ মনে পড়ে গেছে, আশরাফকাকা একদা কাউকে ভালোবেসেছিল এবং তাই এও মনে হচ্ছে, এখনো আশরাফকাকা তাকে ভালোবাসে, এখনো মেয়েটির সঙ্গে তার নিয়মিত দেখা হয়, তারা দুজন কথা বলে, হাসাহাসি করে, তারা দুজন খুব গোপনে একজন আরেকজনকে নেয়। হয়তো মেয়েটি তারও পরিচিত, ভীষণ পরিচিত, তাই তার চোখের সামনে দিয়েই আশরাফকাকা নির্বিবাদে এসব করে চলেছে। অথচ সে শকুনের মতো চোখগুলোকে মেলে রেখেও পারছে না ধরতে, – এই ক্ষোভ আর অসমর্থতা হেনাকাকিকে ক্ষিপ্ত থেকে ক্ষিপ্ততর করে তুলত। তার তীক্ষ্ণ স্বরে আকাশটা খানখান হয়ে ভেঙে পড়ত – শুয়ারের বাচ্চা, ভাবছিস আমি কিছু বুঝি না? বল, বল, শুয়ারের বাচ্চা, সাহস থাকে তো আমাকে খানকি মাগিটার নাম একবার বল…
ভাগ্য ভালো, আশরাফকাকা সেই ‘খানকি মাগি’র নাম বলার দুঃসাহস দেখায়নি কোনোদিন। হয়তো সে ‘আমি একজনকে ভালোবেসেছিলাম’ বলার পরই টের পেয়েছিল, এটুকু বলাতেই ভবিষ্যতের জন্যে মারাত্মক বিপদ তৈরি হয়ে গেছে। তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। হয়তো ঠিক তখনই সে বুঝতে পেরেছিল, বিয়ে করে আসলে সে একা হয়ে গেল, সত্যি-সত্যিই একা হয়ে গেল – এখন আর তার কোনো অধিকার নেই অতীতকে একটু ফিরে তাকিয়ে দেখার। হেনাকাকি সন্দিগ্ধ চোখে সবার দিকে তাকায়, মায়ের দিকেও তাকায়, গল্প করতে করতে জেনে নিতে চায়, মায়ের সঙ্গে আসলে আশরাফকাকার পরিচয় কত আগে থেকে, একসঙ্গে কোনোদিন সিনেমা দেখতে গিয়েছিল কি-না, রাগের চোটে মায়ের কোনোদিন আশরাফকাকার চুল টেনে ধরার ইচ্ছা হয়েছে কি-না।
মায়েরও বোধহয় ইচ্ছা হতো গনগনে এক চুলো জ্বালিয়ে রাখার – মিষ্টি হেসে শুনাত হেনাকাকিকে – ও মা, সেসব মনে আছে নাকি? তবে হ্যাঁ, সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা মনে আছে। ওর বাবার তো সময়ই হতো না, তাই আশরাফের সঙ্গেই মাঝেমধ্যে যেতাম। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে – হলের চেয়ার তো জানোই ছারপোকায় ভরা, ছারপোকা আমার পেছনে কামড় দিয়েছে আর আমি তো ক্ষেপেটেপে ভূত – মনে করেছি, অন্ধকারে আশরাফই চিমটি কেটেছে…
মা সমানে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে অাঁচলে মুখ চাপা দেয়। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হেনাকাকিও হাসে। কিন্তু আমি বুঝি – ক্লাস এইটে পড়ি, তার পরও বুঝি, কত কষ্টের তার সে-হাসি। খানিক পরে হেনাকাকি চলে যায়, আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, সত্যিই তুমি আশরাফকাকার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতে?
হুহ্ – তোর যে কথা না! তোর বাবার সঙ্গেই যেতাম না, আর কোথাকার কোন আশরাফকাকা…
ততক্ষণে পাশের বাসায় হেনাকাকির স্বরগ্রাম ক্রমাগত উঁচু হতে শুরু করেছে। ‘তুমি শোনো, তুমি বোঝার চেষ্টা করো – ভাবি সবসময়ই আমাদের সঙ্গে মশকরা করে, তুমি একটু শান্ত হয়ে শোনো –
চুপ কর। আমি তোকে চিনি না? মিচকা শয়তান – মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকিস, তারপর বাথরুমে যেয়ে হাত মারিস –
এবার আশরাফকাকারও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, মারবই তো, একশবার মারব, ঠান্ডা কোলা ব্যাঙ!, ঠ্যাং কেপ্টি মেরে কাঠ হয়ে শুয়ে থাকিস, আবার বেশি বেশি কথা বলিস –
শোনা যায়, সবকিছুই স্পষ্ট শোনা যায়। শুনতে না চাইলেও আমরা শুনি। শুনতে শুনতে মা মিষ্টি হেসে ফিসফিসিয়ে আমাকে বলে, শোন, ভালো করে শুনে রাখ। মনে রাখিস, মানুষ যেদিন বিয়ে করে, সেদিন থেকেই আসলে তার বিশ্বাস মরে যায়, অবিশ্বাসের জন্ম হয় – বিয়ে আসলে মানুষকে ভালোবাসতে নয়, ঘেন্না করতে শেখায়।
বলার পর মা আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে – যেন বুঝতে চায়, আমিও বিয়ের পর ঘৃণা করতে শিখব কি-না। সেই ১৩ নাকি ১৪ বছর থেকেই শরীর হিম-করা ওই অদ্ভুত দৃষ্টি আমাকে তাড়িয়ে ফিরছে। হয়তো ওই একদিনই, মাত্র একদিনই মা ওইভাবে তাকিয়েছিল আমার দিকে – কিন্তু ওই চাউনির কথা মনে হলে এখনো আমার চোখ নিচু হয়ে যায়। সেদিনও আমি চোখ নিচু করে তাকিয়েছিলাম। আর মা যে তার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তা বুঝতে পেরেছিলাম দীর্ঘশ্বাসের শব্দ থেকে। যেন দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে দিয়ে অনুতাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসের মধ্যে; অনুতাপ – ঘৃণিত হওয়ার অনুতাপ, অথবা ঘৃণা করার অনুতাপ। কোনটা সঠিক, জানি না আমি। অথবা এমনও তো হতে পারে, দুটোই ভুল ধারণা কিংবা দুটোই সঠিক। কোনটা যে ঠিক, কী যে ঠিক, আমি তো কখনো জানতে পারব না। না কি জানা যায় – একটু চেষ্টা করলেই জানা যায়? তবে তার জন্যে আগ বাড়িয়ে যেতে হবে বাবার কাছে। বাবা নিশ্চয় বুড়ো এখন, হয়তো এত বুড়ো যে, সকালে আর হাঁটতেও বের হয় না ঠান্ডা লাগার ভয়ে – দ্বিতীয় বিয়ের ধকল নাকি শেষ পর্যন্ত আর সামলাতে পারেনি। তা না পারুক, ঘৃণাটুকু নিশ্চয়ই এখনো আগের মতোই আছে। কী যে সূক্ষ্ম ঘৃণা করতে পারে বাবা! একদিনও টের পাইনি আমি। একদিনও বুঝতে পারিনি আমি। যেদিন টের পেলাম, বুঝতেও পারলাম, সেদিন এ-খবরও পেলাম, বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। আরেকটা বাসা নিয়েছে। এ-বাসায় আসবে মাঝেমধ্যে, আর প্রতিমাসের ভাড়াও দেবে। শেয়ারবাজারে ব্যবসা করে বাবা তখন অনেকটাই সুখী বুড়ো হয়ে উঠেছে। সকালে উঠে নিয়মিত দাড়ি কাটে, শেভিং ক্রিম মাখতে মাখতে গানও গেয়ে ওঠে দু-একদিন, কাহা চলে… কাহা চলে…। আমি বুঝে যাই, আর কোনোদিন ওই গান শোনা হবে না। মা ওইদিনই তার টুকিটাকি দরকারি জিনিসপত্র একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়েছিল। আর আমাকে বলেছিল, তুই কি আমার সঙ্গে যাবি? না এখানেই থাকবি?
আমার কান্না পাচ্ছিল। এ কোন ধরনের প্রশ্ন? ইচ্ছা হচ্ছিল ঝগড়া করি। কিন্তু নিজেকে সামলে আমিও জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছিলাম। বাসার চাবি বাড়িওয়ালার কাছে রেখে আমরা গিয়ে উঠেছিলাম মায়ের এক বন্ধুর বাসায়। বাবার সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হয়নি।
তারপর আরো কত বছর কাটে। একদিন অনেক রাতে মা আমাকে ডেকে তুলে বলে, আমার স্বামীর কিন্তু কোনো দোষ ছিল না। দ্বিতীয় বিয়ে করাটা ওর খুবই স্বাভাবিক ছিল। এখন টের পাচ্ছি, নিজেকে তখন কত অসহ্য করে তুলেছিলাম।
একটু দম নিয়ে মা আবারো বলে, অবশ্য ইউসুফ মুনিরকে আমি ভালোবাসিনি, পছন্দও করিনি। সহ্য করেছি। ভদ্র ব্যবহার করেছি। কিন্তু যেদিন আমার স্বামী ভালোবাসাবাসির কথা বলল, পছন্দ-অপছন্দের কথা তুলল, সেদিন মনে হলো ভালোবাসাই উচিত ছিল – পছন্দ করাই উচিত ছিল। হয়তো ভালোও বেসেছিলাম! কিন্তু বুঝতে পারিনি, একটুও বুঝতে পারিনি। হয়তো বোকা ছিলাম, হয়তো ভিতু ছিলাম। চিন্তাও করতে পারতাম না কাউকে ভালোবাসবার কথা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাঁকা কথা বলতে বলতে স্বামীই আমাকে বুঝিয়ে দিলো, ভালোবাসা কাকে বলে, আমি আসলে কাকে ভালোবেসেছিলাম কিংবা কাকে আমার ভালোবাসা উচিত।
অত রাতে ওইভাবে আমাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে টেনে তুলে এরকম সব কথা বলার কোনো মানে হয় না। আবার বলতে না বলতেই মা ভীষণ নিষ্পৃহতা নিয়ে আমার বিছানাতেই গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। এরকম ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক – মা কখনোই অন্য কোনো বিছানায় শোয় না। আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, মা আমার ঘুমিয়ে গেছে। আর এমনভাবে ঘুমাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে ওইভাবে আমাকে ডেকে তুলে কথা বলার ঘটনাটি তার দীর্ঘ কোনো স্বপ্নের অংশ। আমি চিন্তিত হই। কয়েকদিন আগেও এরকম ঘটেছে। চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্যে আগাম কেটে রাখা ট্রেনের টিকিট দিয়েছিলাম মায়ের কাছে। মা আর মনে করতে পারছে না, সেই টিকিট কোনখানে রেখেছে। অথচ গড়গড় করে বলছে, আমি যখন প্রথম ট্রেনে চড়ি, কী যে ভিড় ছিল সেদিন! বাবা আমাকে নিয়ে ট্রেনের টয়লেটের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। আর অত ভিড়ের মধ্যেও সিগারেট-পানওয়ালারা কী নির্বিঘ্নে কেনাবেচা চালাচ্ছিল! ফেরিওয়ালারা বই বেচছিল! ভাবলেই কেমন লাগে।
পরের দিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই মাকে। একগাদা টেস্ট ধরিয়ে দেয় আমার হাতে, তবে আরো কয়েকদিন পর ডাক্তার ‘স্যরি’ বলতে বলতে জানায়, 888sport sign up bonusভ্রম ঘটছে মায়ের। বর্তমানের 888sport sign up bonus মনে থাকছে না, তবে অতীতের 888sport sign up bonus ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। দিন দিন অবস্থা আরো খারাপ হবে। খুব ভালো নার্সিং দরকার ওর এখন।
দিন দিন মা অতীতচারী হয়ে উঠতে থাকে। আমি খুব ভালো নার্সিংয়ের চেষ্টা করি। আগে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলেও মা কী সুন্দর করে ধন্যবাদ দিত, এখন মায়ের জন্যে কত কী করি, মা সেসব ফিরেও দেখে না। মনে মনে আমি আমার সঙ্গে মায়ের জন্ম বদল করার চেষ্টা করি। কিন্তু মা ভয়ংকর নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজের অতীত দিনের কথা আমাকে শুনিয়ে চলে। মনে হয়, আমরা দুজন সমবয়সী, একই মেসে এসে উঠেছি ঘোরতর কোনো মফস্বল পাড়াগাঁ থেকে, রাত ফুরিয়ে গেলেও আমাদের অতীত শেষ হয় না, আমাদের কলাপাতা সারারাত দোলে, বাতাস পেলেও দোলে, না পেলেও দোলে, আমাদের রাত শেষ হয়ে যায়; কিন্তু শৈশব-কৈশোর আর শেষ হয় না – আমরা একজন আরেকজনের কাছে নিজেদের শৈশব, কৈশোর, মা-বাবা আর পাড়াগাঁর গল্প করে চলি, গোপন 888sport sign up bonus ভাগাভাগি করি। মায়ের অতীত আমার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বের হয়ে যায় না ঠিকই, কিন্তু শুনতে শুনতে প্রতি মুহূর্তে আমি কামনা করি, মা যেন এমন কোনো অতীতের 888sport sign up bonus বলে না ফেলে, যা শুনে আমি তছনছ হয়ে যাই; শুনি আর আশা করি, এরপর যেন ডাক্তারের কাছে গিয়ে শুনতে পাই, মা আমার ভালো হয়ে গেছে পুরোপুরি।
কিন্তু মা ভালো হয় না। খুব বেশি অসুস্থ হয় না বটে; ভালোও হয় না তেমন। একরুমের সাবলেট বাসায় আমি জানলার পর্দা সরিয়ে বোটকা গন্ধ উপেক্ষা করে গভীর রাতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি। মায়ের এ-অসুখটা না হলে হয়তো আলাদা একটা বাসা নেওয়া যেত, বাসে না চড়ে রিকশাতেই অফিসে যাওয়া যেত। নতুন ক্যাসেট আর কেনা হয় না, পুরনো ক্যাসেটগুলোই বারবার শুনি, মায়ের ভ্রূতে ফুটে ওঠা বিরক্তি মাপার চেষ্টা করি। বিনা পয়সায় মাকে খুশি করতে প্রতিদিন সংবাদপত্র খুঁটিয়ে দেখি অফিসবেলায়, খুঁজে বের করি বাসার ধারেকাছে কোথায় কোথায় বিনা পয়সার গানের আসর আর প্রদর্শনী আছে। মা আমার এই খোঁজাখুঁজি আর আবেগের কোনো ধার ধারে না। প্রদর্শনীতে তো একদমই যেতে চায় না। গান শুনতে গেলেও খানিক পরে উশখুশ করতে থাকে। আর প্রদর্শনীতে যেতে তো রাজিই হলো না, শেষমেষ গেল একদিন – হয়তো আমি মন খারাপ করছি ভেবেই গেল, কিন্তু যাওয়ার পর এমন সব কথা বলল যে, তাতে আমার মন আরো খারাপ হয়ে গেল।
এক্সিবিশন থেকে বেরিয়ে আমরা ক্যান্টিনে বসলাম। চায়ে চুমুক দিতে না দিতেই মা তার মুখ খুলল। যেন মা ইউরোপের 888sport live chatীদের পেইন্টিং কত বোঝে, এভাবে বলতে লাগল, এসব কোনো পেইন্টিং হলো? সবগুলো কাপড়চোপড় আর ঘোমটা পরে আছে – কোনো কোনোটায় বড়জোর খানিকটা স্তনের আভাস, না-হয় নিতম্বটা বিকট! আর ওই কোণের ছবিটা দেখেছিস? ওইগুলো পিউবিক হেয়ার নাকি সুন্দরবনের ক্যাওড়াগাছের গোড়া? এর কোনো মানে হয়? মনে হয় চোখ বুজেও কোনো মেয়েকে ন্যুড কল্পনা করতে পারে না! পারবে কেমন করে? নেহাৎ কামার্ত না হলে এরা তো কাপড়চোপড় ছাড়া কাউকে ভাবতেই পারে না। ন্যুড আর ন্যাংটো হওয়ার পার্থক্য এরা বুঝবে কেমন করে?
শুনে আমি আতঙ্কিত – এসব কী বলছে মা?! এমন করে ভাবলই বা কোন সময়ে? মায়ের কি এতকিছু ভাবার সময় কখনো ছিল? এত লোকে ভরা ক্যান্টিন – এরাই বা কী ভাবছে এসব শুনে! আমি তাড়াতাড়ি মাকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসি।
মায়ের ছেলেমানুষি দিনে দিনে বেড়েই চলে। আমি দেখি, আমারও অস্থিরতা বাড়ছে, জীবনটা পালটে গেছে। কখনো কখনো মায়ের মৃত্যু চাইতে ইচ্ছে করে, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যাই। দেয়ালের পাশে রাখা পুরনো সেলাইকল, সুতা রাখার আইসক্রিমের বক্স আর চিমনিবিহীন হারিকেন আমার বিবর্ণতাকে উজ্জ্বল করে তোলে। সে-দিনের কথা মনে হয় ফের মা খুব শান্তভাবে গোছাচ্ছে সবকিছু, তারপর গোছানো হয়ে গেলে আমার সামনে এসে বলছে, তুই কি আমার সঙ্গে যাবি? না এখানেই থাকবি? এভাবে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছি – এখন সেই মা চলে গেলে কী করে বাঁচব, কুল পাই না সেসব ভেবে। আমি আমার রুটিন পালটে ফেলি, চলাফেরার নতুন ছক তৈরি করি, এমনকি আয়-রোজগার কী করে বাড়বে এসবও চিন্তা করি রাতের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। কোথাও কোনো নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানি কানে বাজে না, কোথাও কোনো অশুভ পাখি ডাকাডাকি করে না, শুধু অন্ধকারের মধ্যে দূরে কোথাও ট্রাকের ঘড়র-ঘড়র শব্দ আমার চিন্তা মাড়িয়ে চলে যায় নিরুদ্দেশে। অন্ধকার বিছানায় শুয়ে নির্ঘুম মা আমাকে দূর অতীতের গল্প শোনায়।
মা বলে, ছোটবেলায় নানু তাকে খুব করে মেরেছিল। রক্তজবা, হলুদ কল্কে আর দুপুরচন্ডী ফুলে ফুলে মা দেবী সেজেছিল, রমার মায়ের লালপেড়ে হলুদ শাড়ি পরেছিল দুভাঁজ করে – দুর্গার মতো তার দশ হাত ছিল না; কিন্তু গাঁদা ফুল দিয়ে দীপালি আর রমা তার মুকুট বানিয়েছিল। ছোট জলচৌকির ওপর সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হাতে ত্রিফলা নিয়ে। স্কুলের পাশে দীপালিদের বাড়ি – সাজগোছ সেখানেই হয়েছিল। তারপর সঞ্জীব, আলতাফ, রমেন আর ত্রিদিব জলচৌকিটা কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছিল স্কুলের মাঠে। কতটুকুই বা পথ – তবু সে হিমশিম খেয়েছিল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে। তারপর হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল স্কুলের মাঠে ওরা জলচৌকিটা নামিয়ে রাখলে। কিন্তু মুখ আর মাথা বরাবর ফুলের পাঁপড়ি ছিটাতে শুরু করতেই সব ভুলে বলে বসেছিল, আস্তে ছিটা… হো-হো করে হেসে উঠেছিল জলচৌকি-ঘেঁষা সবাই, এভাবে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’র 888sport app download bd। কী যে মন খারাপ হয়েছিল! অথচ বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই বাবা রান্না করার চেলা কাঠ দিয়ে তাকে পেটাতে শুরু করেছিল দুর্গা সেজেছে বলে।
আবার একদিন মা তার প্রথম মিন্সট্রেশন হওয়ার কথা বলতে থাকে। আমি শুনতে চাই না – কিন্তু শুনতেই হয়। মা বলে, মিন্সট্রেশন শুরু হলেই মনে হতো আশপাশে বোধহয় গন্ধ ছড়াচ্ছে। আমি তাই ফুলের মালা পরতাম, ফুল দিয়ে কোমরের বিছা বানাতাম, হাতের বালা বানাতাম, বাজুবন্ধ বানাতাম, খোঁপায় ফুলের মালা জড়াতাম। রমারা কী যে হাসাহাসি করত! কিন্তু আমি কানেই নিতাম না…
আমি শুনি, শুনতে শুনতে ভাবি – মানুষের মনে এত 888sport sign up bonus জমে, এত 888sport sign up bonus কখনো কখনো ফের উগরে উঠতে পারে? আমার তো শৈশব-কৈশোরের কোনো কিছুই মনে পড়ে না – তাহলে আমারও কি এভাবে কোনো একদিন সব 888sport sign up bonus হুড়মুড় করে উঠে আসতে পারে মনের ভেতর থেকে?
কিন্তু কোনো-কোনোদিন সারাবেলা এত 888sport sign up bonusময় থাকে না, বরং ভয়ংকর ভীতিময় হয়ে ওঠে। একদিন সকালে বাথরুম থেকে বেরিয়ে মাকে আর সারা বাসায় খুঁজে পাই না। অফিসে যাওয়া আমার লাটে ওঠে আর কী যে পাগল-পাগল লাগে! এখন কাকে বলি, কোথায় যাই – আমাদের আত্মীয়স্বজন কোনো কিছু নেই; একে একে সবাই পর হয়ে গেছে, একে একে সবাই পর হয়ে যায় – কেউ মাকে আবার বাবার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কেউ বাবার সংসারে আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কেউ আবার সম্পর্ক রাখলে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ দেওয়ার ভয়ে। এমন নয় যে, চেনাজানা লোকের অভাব – কিন্তু খবরটা জানার পর কে কীভাবে নেবে, সেসবও বুঝে উঠতে পারি না। মায়ের অসুস্থতার খবর কাউকেই বলিনি আমি। এখন এভাবে বলতে হবে চিন্তা করে মাথা ঘোরে। তেমন কোনো বন্ধুও নেই আমার, কেবল আকাশ – কিন্তু আকাশ তো মেসে থাকে, মেসে কোনো ফোন নেই, আর সেই মেসটাও তো চিনি না আমি। তা ছাড়া আকাশকেও বোধহয় আমি এড়িয়ে চলতে চাই… জানি না কেন, কিন্তু নিশ্চয়ই এড়িয়ে চলতে চাই। আমরাও রোমান হলিডে দেখেছি, দেখতে দেখতে চানাচুর খেয়েছি, কিন্তু আমি মায়ের মতো চমকে উঠিনি, রোমান হলিডের পর বিহোল্ড দ্য পেলড হর্স দেখেছি, আর একেবারে শেষে মনে হয়েছে, আকাশ হয়তো একদিন এভাবেই মারা যাবে – এভাবে আততায়ীর গুলিতে। আমি তখন কালো শাড়ি পরে তার কফিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াব, ঠিক যেমন আবুল হাসানের লাশের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সুরাইয়া চৌধুরী। আমার সমস্ত ভালোবাসা ভবিষ্যতের মৃত আকাশের জন্যে, জীবিত আকাশকে আমি ভালোবাসি না। তবু আমি আকাশেরই খোঁজ করি। ফোনবুথ থেকে ওর অফিসে টেলিফোন করি আর অফিসেই পেয়ে যাই।
আকাশ আমার চিন্তার চেয়েও তাড়াতাড়ি চলে আসে। সব শুনে আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে থাকি – তুই আমাকে কখনোই বলিসনি এসব…
না, আমি কখনোই বলিনি। আর কেনই বা বলব!? কিন্তু এখন তো বলতেই হচ্ছে!
আমরা একে একে আমাদের সব পুরনো বাসায় যাই – আমার মনে হয় না, এভাবে মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু অন্য কোনো পথ মাথাতেও ঢোকে না। একটা একটা করে পুরনো বাসা দেখতে দেখতে আমরা সবশেষে আসি সেই বাসাটায়, যেটা থেকে একদিন মায়ের সঙ্গে চিরদিনের জন্যে বেরিয়ে এসেছিলাম। দেখি, গেট থেকে খানিকটা দূরে পথঘেঁষা চায়ের দোকানের একধারে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে মা। তাকে ঘিরে জমে উঠেছে ছোটখাটো ভিড়। আমি রিকশা থেকে প্রায় লাফিয়ে নামি। মাও ভিড় ঠেলে অনেকটা দৌড়ে আসে, বলে, দেখো তো, বাসার নম্বর মিলছে, কিন্তু বাসাটা মিলছে না কিছুতেই – ভারি অদ্ভুত ঘটনা!
মা এখন সেই মা, যার সঙ্গে বাবার ছাড়াছাড়ি হয়নি, যার 888sport sign up bonusতে বাবার বাসাই নিজের বাসা, যার কাছে আমি অতীত আর বর্তমানের মধ্যেকার রহস্যময় সেতু। আমাকে সে চেনে না, কিন্তু আপন মনে করে; আমাকে সে জানে না, কিন্তু চিরবর্তমানের মতো আগলে রাখে। মা এই বাসা চিনবে কেমন করে? আমি নিজেও তো চিনতে পারছি না। চেনার কথাও নয়। পুরনো দালান ভেঙে ডেভেলপাররা নতুন অ্যাপার্টমেন্ট করেছে। কাছেই নতুন চেইনশপ উঠেছে, তার পাশে ঝকঝকে বেসরকারি ব্যাংকের শাখা আর জুতার দোকান। আকাশ লোকজন সামলায়, একটা স্কুটার ডেকে তুলে নেয় আমাদের। আমি টের পাই, মা আমার দুহাতের মধ্যে থরথর করে কাঁপছে।
মা অনবরত এরকম অদ্ভুত সব ঘটনার জন্ম দিতে থাকে। শেষরাতে উঠে হঠাৎ করে সেলাইকল নিয়ে বসে পড়ে পুরনো দিনের মতো – সেলাই করার কাপড় খুঁজে না পেয়ে কান্নাকাটি করতে থাকে। আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসি। মা কাঁদতে কাঁদতে বলে, কী বোকা আমি, কাপড় যে শেষ – একটুও মনে নেই! অথচ সকালেই ডেলিভারি নিতে আসবে। মাকে আমি এখন কেমন করে বোঝাই – মা, এখন আর তোমার সেই দিন নেই। অনেক আগে থেকেই নেই। মা এসবের কিছুই বোঝে না, কাঁদতে কাঁদতে সেলাইকলের শব্দ খোঁজে। মাঝখান থেকে আকাশের আসা-যাওয়া বেড়ে যায়, খোঁজখবর নেওয়া বেড়ে যায়। কখনো তা ভালো লাগলেও বেশিরভাগ সময়েই আমার মেজাজ খিঁচড়ে যায়। কোথাকার কোন নবাব এসেছে আমাদের উদ্ধার করতে! একদিন সত্যিই ফেটে পড়ি আমি – এবং মায়ের সামনেই। কী সব বলতে থাকি নিজেও জানি না। কিন্তু একবারও তাকাই না ওর চোখের দিকে, মনে হয় চোখে চোখ পড়লে আমিই কেঁদে ফেলব। গালাগালি করতে করতে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আমি অযথাই ধুয়ে রাখা থালাবাসন আবার ধুতে শুরু করি। বাইরের দরোজা খুলে যাওয়ার শব্দ শুনি, কারো চলে যাওয়ার শব্দ শুনি, ট্যাপ থেকে বেসিনে পানি ঝরার শব্দ শুনি।
ছুটির দিনের সকালঘেঁষা দুপুরের দিকে এ-ঘটনা ঘটে। বাসার দরজাটা হা-হা করে, কিন্তু চাপিয়ে দিতে ইচ্ছা করে না। মনে হয়, এই বাসায় অমল আছে, এখনই ডাকহরকরা আসবে রাজার বাড়ির চিঠি নিয়ে – দরোজা বরং খোলাই থাকুক। মা তার এতক্ষণের নীরবতা ভেঙে হঠাৎ বলে, আমিও এভাবে একদিন ইউসুফ মুনিরকে একদিন বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম।
মায়ের কণ্ঠ উদাস হয়ে ওঠে, আমার একটা মেয়ে ছিল, বছর আড়াইয়ের, চোখমুখ ঠিক তোমার মতো। মেয়েটার কী যে হলো! ঠিক মনে পড়ে না।
মা আর আমাকে চিনতে পারে না, ঝগড়ার অবসন্নতা নিয়ে আমারও সবকিছু ভুলে যেতে ইচ্ছা করে। কেমন হয় আমিও যদি সব ভুলে যাই একদিন? একদিন সকালে উঠে যদি আমার আর মনে না পড়ে, আমার একটা মা আছে, অসুস্থ, 888sport sign up bonusভ্রষ্ট? যদি আর মনে না থাকে, বাসায় এসে আকাশ জেদ করে না খেয়ে থাকে – যাতে আমি অনেক-অনেক সাধাসাধি করি আর সেও অনেকক্ষণ থাকতে পারে আমার পাশে? তখন আমার মনের মধ্যে থেকেও কি ঠিক এভাবে অন্য কোনো 888sport sign up bonus হুড়মুড়িয়ে উঠে আসবে? নাকি এর চেয়েও ভয়ানক 888sport sign up bonusভ্রষ্টতা ঘিরে ধরবে? কিছুই মনে করতে পারব না আমি? না অতীতের 888sport sign up bonus, না বর্তমানের 888sport sign up bonus? লোকজন আমাকে ধর্ষণ করে যাবে, আমার তা মনেও থাকবে না – তারপর একদিন হয়তো সন্তানও হবে আমার – কিন্তু তাকেও নিজের বলে আর মনে হবে না। অথবা কিছুই মনে থাকে না বলে বাসা থেকে একদিন বাড়িওয়ালা বের করে দেবে; আর যা অবস্থা এ-শহরের, আমরা মা-মেয়ে ক্রমাগত ধর্ষিত হতে থাকব, আমাদের মনেও থাকবে না, মনেও পড়বে না ধর্ষিত হচ্ছি।
আমার গা গুলাতে থাকে। কিন্তু মাকে এখন ইউসুফ মুনির পেয়ে বসেছে। ইউসুফ মুনির একদিন রোমান হলিডে নিয়ে এসেছিল, মা সেই গল্প শুনাচ্ছে। শুনাতে শুনাতে তার চোখে জল জমছে, তবু বলছে, আমার ঠিক মনে নেই সব – প্রেস ব্রিফিং শেষ, বিশাল হলঘরের মাঝখানে একা সেই সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছে – রাজকন্যা চলে গেছে। দ্যাখ তুই, মাত্র একটা দিন – মাত্র একটা দিন, মানুষগুলোকে কী বদলে দিলো, জীবনের তলদেশে এক মুহূর্তের সামান্য চাওয়া-চাওয়ির এক গোপন 888sport sign up bonus সারা জীবন এই তুচ্ছ পৃথিবীর ভারি সব জোয়াল বইবার শক্তি দিলো, একেকজন তুচ্ছ মানুষ কত মহৎ হয়ে উঠল…
মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে, কণ্ঠ আরো ভারি হয়ে আসে, আর সেই এতটুকুও যদি কেউ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে টেনে তোলে, রক্তাক্ত করে, এতটুকুও যদি কারো সহ্য না হয়, তা হলে –
মা আর কিছু বলতে পারে না, তার কণ্ঠস্বর বুজে আসে।
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর কী ভেবে সোজা উঠে দাঁড়াই। বলি, মা, আমি একটু বাইরে যাব। তুমি কিন্তু সেদিনের মতো কোথাও যাবে না।
মা চোখ মুছে আমার শৈশবের মতো মিষ্টি করে হাসে। বলে, না, আমি কোথাও যাব না। আমি তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করব।
বাইরে এখন প্রচন্ড রোদ, ঝাঁ-ঝাঁ রোদ এই শহরকে ফাঁকা করে ফেলেছে। বাস ও গাড়ির কাচ থেকে তীব্র আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে, তীব্রগতিতে ছুটে আসছে অন্ধ করে দিতে। সূর্যের গা থেকে ঘাম গলে গলে পড়ছে দালির অনন্ত সময় হয়ে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, সারা পৃথিবী এখন আমি চষে ফেলব। ইউসুফ মুনির একদিন খুঁজে পায়নি, কিন্তু একগোছা সূর্যমুখী আর রজনীগন্ধা আমাকে আজ পেতেই হবে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.