মাধ্যমই বার্তা, আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিডিয়া : দ্য এক্সটেনশন অব ম্যান বইয়ে ১৯৬৪ সালে যখন কানাডীয় তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহান ঘোষণা করেছিলেন, কথাটাকে শুনিয়েছিল কুজ্ঝটিকার মতো। গণমাধ্যমের জগতে পত্রিকাই তখনো সর্বেসর্বা। পত্রিকার বাইরে আর দু-চারটি উদ্যোগ গণমাধ্যমের পরিসরে স্পষ্ট আকার নিয়ে মাথা তুলতে শুরু করেছে। রেডিও শুরু করেছে কিছুটা আগে। মোটামুটি ১৯৩০-এর দশকে। এর কিছুটা পরে টেলিভিশন আর live chat 888sport হাত ধরাধরি করে এগিয়ে এসেছে প্রায় কাছাকাছি সময়ে। টেলিভিশন গণমানসে জায়গা নিতে শুরু করে ১৯৫০-এর দশকে। হলিউডের কল্যাণে গণবিনোদনের তুমুল জনপ্রিয় অনুষঙ্গ হয়ে live chat 888sport যাত্রা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা ছাপিয়ে। বিভিন্ন দেশেও তখন চলছে রুপালি পর্দায় নিজের নিজের মতো করে উঠে দাঁড়ানোর প্রয়াস। বিজ্ঞাপনী প্রচারণার রংচঙে ইতিহাসটা অবশ্য এগুলোর মতো অভিনব নয়। সে-ইতিহাস আরেকটু পুরনো, জটিল ও বিভঙ্গময়। তার গল্প আলাদা।
পত্রিকাই যেন কুলীন। গাম্ভীর্যে, মর্যাদায় আর মানুষের মন শাসন করার একচ্ছত্র ক্ষমতায়। শুরুর দিকটায় অন্য মাধ্যমগুলোর প্রভাব যখন পড়ছে, ভাবুক ও বিশ্লেষকেরা এসবের দিকে আলাদা করে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেননি। মার্শাল ম্যাকলুহানের ঘোষণা সে-সময়ে তাই তীব্র চমক তৈরি করেছিল। তারপরও আজকের দিনে মনে হয়, সেটি ছিল মার্শাল ম্যাকলুহানের পূর্বঘোষণা-আরো অর্ধশতক পরে অন্তর্জাল বা ইন্টারনেটের উত্থানের পর এর ঝোড়ো ঝাপটায় বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের চেহারা যেভাবে আমূল ওলটপালট হয়ে যাবে, যেনবা তারই। সোশ্যাল মিডিয়ার ঊর্ণাজালে আটকেপড়া সাম্প্রতিক এই পৃথিবীতে মাধ্যম আর এখন শুধু বার্তা নয়; মাধ্যমই ভাষা, মাধ্যমই বিষয়, মাধ্যমই চেতনাবিশ্ব-মাধ্যম একমেবাদ্বিতীয়ম, এই সত্য-পরবর্তী যুগে।
তবু পত্রিকা তো কুলীন বটেই, অন্তত বয়সে। অন্তর্জালের নতুন সর্বগ্রাসী উত্থানের মুখে সে আজ দারুণ পর্যুদস্ত বটে। তারপরও গণমাধ্যম নামে যে-বর্গটিকে আমরা এখন চিহ্নিত করি, পত্রিকার হাত ধরেই তার উদ্ভব। তথ্য ছাড়া মানুষের এখন চলে না। অতীতেও কখনো চলেনি। আমরা বলি, মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হওয়ার মধ্যেই মানুষের চেতনার স্ফুর্তি, সভ্যতার দিকে তার অভিযাত্রা। সে-কারণে সমাজের একপ্রান্তে মানুষের জীবনে কী ঘটছে, অন্যপ্রান্তের মানুষের তা না জানলে বাঁচার উপায় নেই। তাই ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে দুনিয়ার নানা অঞ্চলে বার্তা আদান-প্রদানের নানা উপায় মানুষ উদ্ভাবন করে এসেছে। প্রাচীন রোমের রাজকীয় বুলেটিন হিসেবে যদি এর নাম হয় আক্তাদিউর্না, হান রাজতন্ত্রের চীনে প্রথমবারের মতো কাগজে প্রকাশিত এই বার্তা মাধ্যমের নাম তাহলে দিবাও।
পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি জার্মান দেশেই য়োহান গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কার করে পুরো জগৎটারই চেহারা পাল্টে দিলেন। ছাপাখানা এনে দিলো যে-কোনো বার্তা, ভাবনা, প্রচারণা, পরোয়ানা বহুগুণ করে গণপ্রচারের অবাধ সুযোগ। ইতিহাসের এতো দিনের চেনা ছক পাল্টে দেওয়ার পথে ছাপাখানার যুগান্তকারী প্রভাব পড়ল। তার এক প্রভাবশালী উপাদান হয়ে পড়ল মুদ্রিত খবরের কাগজ। মানুষের পৃথিবীতে জায়গা করে নিল নতুন একটি বর্গ, যার নাম গণমাধ্যম।
১৫৫৬ সালে ভেনিসে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম মুদ্রিত আধুনিক মাসিক পত্র নোতিৎসিয়েস্ক্রিত্তে। সে হিসেবে আমাদের চেনা গণমাধ্যমের ইতিহাসের বয়স প্রায় পাঁচ শতাব্দী। এই সময়ের মধ্যে এর পরিবর্তন বিস্ময়কর। তারপরও গত দেড় দশকে এর ভোল যেভাবে পাল্টেছে, তাকে যুগান্তকারী বললেও কম বলা হয়। প্রযুক্তির উপর্যুপরি বিস্ফোরণে গণমাধ্যম ব্যবহারের ধরন, তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাপনা, বার্তা নির্মাণের কৌশল এর চিরচেনা ভাষা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। আর নতুন ভাষা পাল্টে দিয়েছে আমাদের চেনা আপাদমস্তক জীবনপ্রণালি।
একটু একটু করে আসা যাক। বিশ শতকের শুরুতেও পত্রিকায় ভাষা বলতে বর্ণে-শব্দে-বাক্যে যাকে আমরা নিছক ভাষা বলে জানি, তারই একচেটিয়া রাজত্ব। শুধু 888sport live footballের আর ভাবনার ভাষার চেয়ে পত্রিকার ভাষার প্রকার আলাদা। 888sport live footballের বা ভাবনার মতো পত্রিকার ভাষা সর্পিল ও রহস্যময় নয়; এই ভাষা সমতলীয়। সরলতা আর বোধগম্যতাই এর লক্ষ্য। কারণ শব্দের সঙ্গে শব্দ যুক্ত করে সহজেই ভাষার বাহ্যার্থ বুঝে নিতে পারেন, এর কম যতটা বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারাটাই পত্রিকার উদ্দেশ্য। এই বাহ্য ভাষার সঙ্গে আস্তে আস্তে যুক্ত হতে লাগল হাতে আঁকা ছবি-কোনো খবরের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির, কখনো বা কোনো ঘটনারও। এর ধারাবাহিক বিস্তারে এলো কার্টুন। ঘটনার মধ্যে কার্টুন যোগ করল সম্পাদকদের মন আর বিশ্লেষণী শ্লেষ।
এরই মধ্যে চলে এলো আলোকচিত্র। ঘটনার নির্বাচিত কোনো একটি মুহূর্তকে চিরন্তনভাবে স্থির করে রাখার ক্ষমতায় দ্রুতই এটি হয়ে উঠল পত্রিকার ভাষার প্রধানতম এক উপাদান। ভাষায় যা বলা হচ্ছে ছবি যেন তাতে দিলো অতিরিক্ত এক বিশ্বাসযোগ্যতা। শুধু যে বলছি, তা-ই নয়; এবার তাকিয়েও দ্যাখো।
আর অতিসম্প্রতি এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইনফোগ্রাফিকস। ছবি আর ভাষার চিত্রময় উপস্থাপনায় জটিল তথ্য সমবায়কে এক লহমায় পাঠককে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। পাঠকের অত সময় কোথায়? অত কষ্ট না করে তার দরকার চারপাশের জগৎটাকে দ্রুত বুঝে নিয়ে চৌকস পায়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া, প্রতিযোগিতার অস্থির ইঁদুরদৌড়ে অন্যকে পেছনে ফেলে যাওয়া।
একইভাবে রেডিওর মতো শ্রুতিনির্ভর মাধ্যমের ছিল কণ্ঠস্বর; আর কোনো ঘটনার বা ব্যক্তির শ্রুতি যন্ত্রে ধারণ করা অংশ। টেলিভিশন তো ছাপিয়ে গেল প্রায় সবাইকে। ঘটনার চলচ্ছবির কারণে তার বিশ্বাসযোগ্যতা হয়ে উঠল একেবারে অকাট্য। উপস্থাপনের কৌশলে উত্তেজনাকর ঘটনাগুলো হাজির হলো সোপ অপেরার মতো চিত্তাকর্ষক হয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নৃশংসভাবে ইরাক আক্রমণের পরে অরুন্ধতী রায় বলেছিলেন, হলিউডের থ্রিলার ছবিগুলো ভান করে যেন তারা নিখুঁত বাস্তবোচিত, আর টেলিভিশনে প্রচারিত যুদ্ধে মানুষ মারার নিষ্ঠুর ফুটেজ হয়ে ওঠে live chat 888sportের মতো রোমাঞ্চকর আর উপাদেয়। টেলিভিশনের মতো সম্প্রচারমাধ্যমে বাস্তব এবার সত্যি সত্যি হয়ে উঠল কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। উঠতে শুরু করেছিল আগে থেকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্নায়ুযুদ্ধের পটভূমিতে পশ্চিমা বিশ্বের পুঁজিবাজারের লালসা যখন সারা পৃথিবীকে গ্রাস করার লড়াই চালাতে শুরু করছে, তার হাত ধরেই উত্থান ঘটেছিল করপোরেট গণমাধ্যমের। বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন হলো বিশ্বমানস করায়ত্ত করা। পশ্চিমা গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করা হলো বিপুল অর্থ। নানা চিত্তাকর্ষক উপস্থাপন-কৌশল উদ্ভাবন করল তারা। সেগুলোকে ক্রমাগত করে তুলল চৌকস। পশ্চিমাবিশ্বের আরব দখলের লড়াইয়ের হাত ধরে এলো এমবেডেড জার্নালিজম, এলো উত্তেজনাকর ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার (যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা সম্প্রচার সাংবাদিক মার্ক টালি এই লেখককে বলেছিলেন, সম্পাদনার নানা বিধিবদ্ধ নিয়ম পার হয়েই কেবল কিছু তথ্য 888sport world cup rate হয়ে উঠতে পারে-সে কারণে সম্পাদনাহীন ‘সরাসরি সম্প্রচার’ সাংবাদিকতার নিকৃষ্টপন্থা), আরো কত কী!
প্রশ্ন উঠতে শুরু করল নানা দিক থেকে এবং খুবই যথার্থভাবে। পৃথিবীর নানাকোণে প্রতিনিয়ত অজস্র ঘটনাই তো ঘটছে। কোন ঘটনা 888sport world cup rateযোগ্য আর কোনটি নয়, সেটি নির্ধারণ করছে কে বা কারা? কোনটি গুরুত্বপূর্ণ খবর, কোন 888sport world cup rate প্রথম পাতায় আসবে, প্রধান শিরোনাম হবে, বড় জায়গাজুড়ে থাকবে-তা নির্ধারণের নিরিখ কী? নানা বর্গের মানুষদের নিয়ে বলছে বটে গণমাধ্যমগুলো, কিন্তু গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের অবস্থানটি সমাজের কোন বর্গে? কোনো প্রশ্নই অমূলক নয়। কারণ কোনো গণমাধ্যম যত বিপুল, তার অবস্থান ও খবর নির্বাচন প্রভাবশালী মানুষের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট ছাঁচে মতৈক্য গড়ে তোলার তত বেশি ক্ষমতা রাখে। মার্কিন ভাবুক নোয়াম চমস্কি একে বললেন, মিডিয়া কনসেন্ট। ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত সংস্কৃতি পর্যালোচক এডোয়ার্ড সাঈদ তাঁর কাভারিং ইসলাম বইটিতে উদাহরণের পর উদাহরণ দিয়ে দেখালেন, মার্কিন গণমাধ্যমগুলো কী চাতুর্যপূর্ণভাবে মানুষের মধ্যে ইসলামভীতি বা ইসলামোফোবিয়া উসকে দিয়ে একের পর এক আরবসহ মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে আগ্রাসন চালানোর পূর্বসম্মতি আদায় করেছিল। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, করপোরেট গণমাধ্যম ও বার্তা পরিবেশনা সংস্থাগুলো এ-সম্মতি আদায় করেছিল বিশ্বব্যাপী।
এলেনরে ১৯৯০ সালে লাইজ অব আওয়ার টাইম নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকাটির কাজ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস কীভাবে এ-ধরনের সম্মতি আদায় করে, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখানো। চমস্কি আর সাঈদ দুজনই ছিলেন এ-পত্রিকার প্রভাবশালী লেখক-তালিকায়।
১৯৯৫ সাল থেকে অন্তর্জালের গণব্যবহার সূচিত হওয়ার পর পরিস্থিতির আরো এক ব্যাপক রূপান্তর ঘটল। বস্তুত অন্তর্জাল এক নতুন বিশ্ব-পরিস্থিতির সূচনা ঘটাল। পাল্টে গেল এতদিন কার জীবনধারা, তার খোলনলচে সমেত। সে এক আলাদা সন্দর্ভের বিষয়। এসবের ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল পরিসরে বার্তা পরিবেশন এবং গণযোগাযোগের ক্ষেত্রেও ঘটে গেল বিরাট পালাবদল।
অন্তর্জালের জগতে সুব্যবস্থিত প্ল্যাটফর্মে বার্তা পরিবেশনের ধারণা দানা বাঁধতে থাকে ২০০৫ সালের পর থেকে। এরপর প্রযুক্তির নানা উদ্ভাবনার ধাপে পা ফেলে ফেলে এটি ক্রমশ সুস্পষ্ট আকার পেতে শুরু করে। ডিজিটাল গণমাধ্যমের নবতর বিভিন্ন মঞ্চরাষ্ট্রের সীমানাই দিলো মুছে। এর ভোক্তা এবার প্রকৃত অর্থেই ছড়িয়ে পড়ল জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরে। গণমাধ্যমের প্রভাবের ক্ষেত্র এত দিনে হয়ে উঠল আক্ষরিক অর্থেই বৈশ্বিক।
গণমাধ্যমের আগের পর্বকে যদি বলি আনুভূমিক বিস্তারের, এই পর্বটি তাহলে আলম্ব উত্থানের। ডিজিটাল পরিসরের ব্যবহার, বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতা এতটাই আলাদা এবং প্রযুক্তির অবিরাম অগ্রগতির কারণে দ্রুত পরিবর্তনশীল যে মুদ্রিত গণমাধ্যমের সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না। পত্রিকার পৃষ্ঠা888sport free bet সীমিত; অনলাইনে কোনো সীমানারেখা নেই। পত্রিকার মূল ভরলেখায়, সঙ্গে ছবি-কার্টুন-ইনফোগ্রাফিকস; অনলাইনে লেখার পাশাপাশি কত কী-ভিডিও, অডিও, ইন্টার-অ্যাকটিভ গ্রাফিকস ইত্যাদি ইত্যাদি। আসতে শুরু করেছে ত্রিমাত্রিক চলচ্ছবি, ভি আর বা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেডরিয়েলিটি। আরো কত কী যে এখনো আসার পথে! পত্রিকা পড়ার একটাই পথ, নগদ টাকায় আপনাকে একটি কপি কিনে নিতে হবে; অথচ অনলাইনে আসার পথ অজস্র, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করে দিয়েছে আরো হাজারো গলিপথ-যারযার রুচি অনুযায়ী।
‘যার যার রুচি অনুযায়ী’ কথাটার মধ্যে আছে আরেক বিপদের ফাঁদ। সে-কথায় ঢোকার আগে চকিতে তাহলে একবার দেখে নেওয়া যাক মোটের ওপর কত ধাঁচের গণমাধ্যম আমরা পেলাম : ১. মুদ্রিত মাধ্যম-এর মধ্যে আছে পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই ইত্যাদি। ২. সম্প্রচারমাধ্যম-রেডিও, টেলিভিশন, live chat 888sport, রেকর্ডবদ্ধ গান ইত্যাদি পড়ছে এর আওতায়। ৩. ডিজিটাল মাধ্যম-এর প্রধান বাহন অনলাইন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ৪. বহিরাঙ্গন মাধ্যম-ইংরেজিতে যাকে বলে আউটডোর মিডিয়া। এই জগৎ সম্পূর্ণতই বিজ্ঞাপনী প্রচারণার।
এর মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যম শেষতম। বয়স মাত্র দেড় দশক। এর জন্ম সোনার চামচ মুখে দিয়ে-অপার সম্ভাবনাময় এই পরিসরটি পেয়েছে বিপুল বিনিয়োগ, প্রযুক্তির অনিঃশেষ উদ্ভাবনী চমকের আশীর্বাদ, আর সর্বশেষ করোনার অতিমারিতে বছরের পর বছর রুদ্ধ ঘরে বসে থেকেও পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য মানুষের মরিয়া আকুতি। এই যে পরিস্থিতি, তার প্রশ্রয়ে প্রায় অর্ধসহস্রাব্দের মুদ্রিত গণমাধ্যমকে ডিজিটাল গণমাধ্যম দেড় দশকের মধ্যেই কাবু করে আনল প্রায়।
ডিজিটাল গণমাধ্যমে পাঠককে-ঠিক পাঠকও নয়, বলা যাক ভিজিটর বা পর্যটক-ধারণা দেওয়া হয়, তিনিই ঈশ্বর। নতুন প্রযুক্তি তাঁকে দিয়েছে নিজের মতো আরামে থেকে পছন্দ করার অবাধ সুযোগ। চাইলে তিনি যে ওয়েব পোর্টাল যে রঙে-বিন্যাসে-নির্বাচনে দেখতে চান, সেভাবেই তাসাজিয়েনিতে পারেন। কেউ শুধু বিনোদনজগৎ কিংবা বাজারে আসা নতুন পণ্যের খবর দেখতে চাইলে শুধু সে খবরটুকুই তার ওয়েবসাইটে আসবে। খবর এখন পাঠককে আগের মতো খুঁজে পড়তে হয় না, খবর চলে আসে ভিজিটরের কাছে তাঁর ইচ্ছামতো।
অনেক সময় ভিজিটরকে ওয়েবসাইট কষ্ট করে সাজাতেও হয় না। অ্যালগরিদমের জাদুকরি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভেলকি অলক্ষ্যে প্রতিটি ভিজিটরের ওপরে নজর রাখে। তাঁদের আচার-আচরণ, পছন্দ-অপছন্দ, অভ্যাস ও মুদ্রাদোষ বিশ্লেষণ করে। ভিজিটর নিজেকে যতটা না জানেন, এই গণিত ব্যবস্থা তাঁকে জানে তার চেয়ে সহস্রগুণে বেশি। এরপর তাঁকে তাঁর রুচিমাফিক দ্রব্যই পাঠাতে থাকে। ভিজিটরই ঈশ্বর, এ-মিথ্যা সম্মোহনে বশ করে সর্বগ্রাসী এই গণিত ব্যবস্থাই আসলে হয়ে ওঠে তাঁর চূড়ান্ত নিয়ন্তা। ভিজিটরের চারপাশে একটি নিñিদ্র দেয়াল তৈরি করে তাঁকে এর মধ্যে বন্দি করে ফেলে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিটি ভিজিটর সম্পর্কে বিপুল সঞ্চিত তথ্য থাকায় তাঁদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ এখন পুরনো। করপোরেট বাজার ব্যবস্থা থেকে বৃহত্তর রাজনীতির ভাঙাগড়ায় এই দেয়াল বন্দি ভিজিটরদের নাচানো হচ্ছে নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প আলাদা আলাদা মেজাজের গোষ্ঠীর কাছে আলাদা আলাদা বার্তা পাঠিয়ে নির্বাচনী কৌশলের যে সাফল্য পেয়েছিলেন, সেটি এখন নাগরিক কিংবদন্তি।
পত্রিকার পাঠকের সঙ্গে অনলাইনে ভিজিটরের একটি তুলনা হয়তো টানা যেতে পারে। পত্রিকার পাঠক অনেকটা ইবনে বতুতার মতো অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া ভূ-পর্যটক। ইবনে বতুতা যাবেন হয়তো চীনে, কিন্তু তাঁকে মাঝখানে পেরিয়ে যেতে হচ্ছে বিপুল এক মহাদেশ-ভারতবর্ষ ও বাংলা। কত বিচিত্র ভূগোলের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা নিতে নিতে তিনি পৌঁছাচ্ছেন চীনে। পাঠকও পত্রিকার পাতা উল্টে যাচ্ছেন, আর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় নতুন নতুন বিষয় হাজির হচ্ছে তাঁর সামনে। মনমতো খবরটি খুঁজে বের করতে করতে আরো কত না অজানা খবরের শিরোনাম পার হয়ে যাচ্ছেন তিনি। বিপরীতে অন্তর্জালের ভিজিটর যেন বসে আছেন স্টারট্রেক-এর টেলিপোর্টেশন যন্ত্রটির মুখোমুখি। তিনি যা খুঁজছেন, সেই চাবি শব্দটি কম্পিউটারে দিয়ে ক্লিক করলেই লহমায় বেরিয়ে আসছে সে-সংক্রান্ত হাজারো তথ্য; তার বাইরে আর কিচ্ছুটি নয়। এককুয়া থেকে তিনি চলে যাচ্ছেন আরেকটি কুয়ার গভীরে। নতুন প্রযুক্তি, বার্তা মঞ্চ আর এসবের পেছনে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে এখন চলছে প্রচণ্ড এক অস্থিরতা। প্রতিনিয়তই দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে এর আদল, পাল্টে যাচ্ছে এর ভাষা আর ব্যবহার। গণমাধ্যমের দুনিয়া এতই দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে, বুলেট ট্রেন থেকে দেখা বাইরের দৃশ্যপটের মতো অস্পষ্ট মনে হচ্ছে সব। আগামী এক-দেড় দশকের মধ্যে বোধকরি গণমাধ্যমের স্থিত একটি অবয়ব আমরা ফিরে তাকিয়ে বুঝতে পাব। ততদিনে গণমাধ্যমের চেহারা নিশ্চিতই হয়ে যাবে অনেক আলাদা। আমরাও হয়তো তখন আরো অন্য রকমের মানুষ।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.