আমি বেঁচে আছি এ নিয়ে অনেকে আপত্তি করে; কারা কারা করে তা নিয়ে কোনো তালিকা দেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। এবং তাদের কথায় আমার খুব রাগও হয় না। এদের মধ্যে কারো কারো আপত্তি বেশ যুক্তিপূর্ণ তবে মৃত্যু নিয়ে আলাদা করে আমি কম ভেবেছি। ভেবেছি, যেদিন খেলা সাঙ্গ হবে সেদিন তো আমার কিস্সু করার থাকবে না; কাজেই ও নিয়ে না ভাবলেও চলে। আবার  অসুখ তো ছিল সারাজীবন, বড় বড় অসুখ, ছোট ছোট অসুখ, তারপরও টিকে গেলাম, এখন এইট্টি এইট নট আউট। আগামী মাসে মানে আগস্টে আমার ৮৯ শুরু হবে। এই দেশে এত আয়ু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কীভাবে বেঁচে আছি – এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করে, বিশেষত সাংবাদিক ভাইয়েরা। নানাভাবে আমার একটু খ্যাতি ছিল, যদিও আমি সেটাকে খ্যাতি মনে করি না, তবু কিছু মানুষ মনে করে, তাদের হয়তো নতুন কিছু করার নেই বলে আমাকে নিয়ে গল্প বানাতে চায়। আমি ওদেরকে কখনো বলিনি যে, আমি মূলত গল্প নিয়েই বেঁচে আছি। ওরা হয়তো বিশ্বাস করবে না।

এখন বড় মেয়ে ইশরাতের বাসায় থাকি; তার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। দুজনই দেশের বাইরে থাকে। বড় বড় চাকরি করে শুনেছি। কালেভদ্রে কথা হয়। ও যা বলে সেটাই শুনি, নিজে কিছু জিজ্ঞেস করি না। বছর দশেক হলো ওর স্বামী আফতাব হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল। আমি তখন এখানে ছিলাম না। ছিলাম এক স্যানাটোরিয়ামে, দু-একবার আমাকে যেতে হয়েছে। তারপর বেশ ভালো হয়ে যাই। মন ভালো থাকে, শরীর তো ভালো রাখতে হয় নানা কায়দা করে। এখন মেয়ে আর আমি থাকি। সে অবশ্য বেশির ভাগ সময় থাকে না। কী সব সামাজিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। দেশ উদ্ধার করে।  সত্যিকারের দেশ উদ্ধারে আমিও একবার গিয়েছিলাম, সেখান থেকে তো ডান পা-টা ঠিকমতো চলে না। সে আবার বছরের ছয় মাস থাকে আমেরিকায়, ছেলের কাছে। ছোট  মেয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়, সেখানেও নাকি যাবে শুনেছি, ওদের নাকি খুব নাক উঁচু। ইশরাত ভিসার জন্য দরখাস্ত করেছিল, ভিসা দেয়নি। দিলে আমার কী হতো জানি না। কোথায় থাকতাম? পুরো বছর তো আর একা একা থাকা যায় না। বড় ছেলে অমিত কানাডায় থাকে। সে আমাকে সেখানে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, আমি যাইনি। ছোট ছেলে তো চাকরি-বাকরি করার আগেই চলে গেল। এরশাদের বাহিনী ওকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল ৮৮-তে। মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, তখন এম.এ-তে। ওর মায়ের ধারণা ছিল, ও-ই তার সবচেয়ে মেধাবী সন্তান। আমি জানি বিষয়টা গোলমেলে, তবে নিঃসন্দেহে সে ভালো ছিল। আমি ওকে ডাক্তারি পড়ানোর মৃদু ইচ্ছে পোষণ করেছিলাম। সে রাজি হয়নি। অমিতের মেয়ে অদিতির সঙ্গে আমার খুব খাতির, ওরা যদি দেশে থাকতো তাহলে খাতির আরো বাড়তো মনে হয়। কীভাবে আমার সঙ্গে ওর এত গভীরতা তৈরি হলো তার কোনো জুতসই কারণ আমার জানা নেই। সে দেখতে হয়েছে আমার মতো। কেন আমার মতো হয়েছে তা ওর মা নাকি ভেবে পায় না। দাদুকে পছন্দ করে প্রায় জন্ম থেকে, সে প্রথম ভালো করে চোখ মেলে আমার কোলে এসেছিল, সেই কোল ওর খুব পছন্দ হয়ে গেল, তারপর তো আমার সঙ্গে সারাদিন খুঁটিনাটি খুনসুটি; তবে ওর মা আবার আমাকে সহ্য করতে পারে না; আমি কথা বললে তার নাকি বুকের  মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। তবে খুব ছ্যাঁৎ করার সুযোগ হয়নি, কারণ বেশিদিন কথা বলার সুযোগ তো হয়নি। কাজেই সে ভালো আছে। আমি অবশ্য কোথাও যেতে চাই না।

সকালবেলা দুটো পত্রিকা পড়া আমার অভ্যাস। অভ্যাসটা দীর্ঘদিনের। একটা বাংলা, একটা ইংরেজি। ইংরেজি পত্রিকার কিছু ব্যাপার থাকে যা বাংলা দৈনিকে থাকে না। কিছু বিদেশি খবর থাকে, ব্যাখ্যা থাকে যা আমার বরাবরই পছন্দ। আরো কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা আমার বাসায় নিয়মিত রাখতাম। 888sport live football রাজনীতি সংস্কৃতি বিষয়ক কিছু পত্রিকা পড়তাম। এখন মেয়ের বাড়িতে যেহেতু তার টাকায় চলি, তাই খুব বিলাসিতা করতে চাই না। অর্থের সমস্যা ওর নেই। আমার যা লাগে সব না চাইতে  দেয়। তবু সংকোচ একটু থাকে। নিজের বাড়িটা বিক্রি করে সব টাকা অমিতকে দিয়েছিলাম ও যখন কানাডায় গেল। স্কলারশিপ পেল না, কী করে পড়বে? আমি ওর মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও বাড়ি বিক্রি করে ওকে প্রায় সব টাকা দিয়ে দিলাম। একটা ভাড়া বাড়িতে উঠলাম। মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল আগেই। মেয়ের জন্য কিছু রাখিনি, আমাদের বুড়ো-বুড়ির ভরসা আমার মাসিক পেনশন। তার কয়েক বছর পর তো শায়লা মারা গেল। সে আসলে এসব সহ্য করতে পারেনি বোধহয়। আমাকে বলতো না, তবে অন্যদের বলতো, তাদের কাছে আমি শুনেছি। এটা আমার জন্য দুঃখজনক, অন্যের কাছে আমাকে ওর মনের কথা শুনতে হবে কেন? আমি তো সহজভাবে ওর সঙ্গে সব কথা বলি, ভয়ভীতির ব্যাপারও ছিল না কখনো। এখন বুঝি সে অভিমান করেছিল। নিজে যে সংসার বিশেষত বাড়ি তিলে তিলে সে তৈরি করেছে, সেখান থেকে চলে আসা মানে ওর সব 888sport sign up bonusসহ ফিরে আসা। সহ্য করা সম্ভব নয় এখন বুঝি, আমি কীভাবে সহ্য করেছিলাম সে-গল্পও ওকে কখনো বলিনি, আমি যেমন এখন বুঝি ওর কষ্ট। সেই ছেলে মা মারা যাওয়ার সময় আসতে পারলো না। আমরা একবার যাবো ছেলের কাছে ভেবেছিলাম, বিয়ে দেওয়ার আগে, বিয়ে দেওয়ার পর আর কখনো ভাবতে পারিনি। লাকি বিয়ের পর পাল্টে গেল, তখন ওর কাছে স্বামী-সন্তানই আসল, শ্বশুর-শাশুড়ি অনেক দূরের বিষয়। আমাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়লো, শায়লা মারা যাওয়ার পর অবশ্য আমাকে অনেকবার নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। আমি হ্যাঁ-হুঁ বলেছি, যাইনি, যাবো না, সেটা আমি জানি, ওরা জানে না। শায়লা যদি থাকতো, যদি সে যেত তাহলে যেতাম। সে নেই তবু ওর অস্তিত্ব আছে, ওকে সব সময় দেখতে পাই, আমি ওর নিশ্বাস পর্যন্ত শুনতে পাই। কে বিশ্বাস করলো না করলো তাতে আমার কিছু আসে-যায় না।

পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া আমার রোগ বলা যায়। কেন পড়ি তার পক্ষে কোনো ভালো যুক্তি আমি দিতে পারবো না। গভীর এক আসক্তি তৈরি হয়, খবরের নেশা, অন্তত আমার হয়; খুন-খারাবি ধর্ষণ লুটপাট ঘুষ দুর্নীতি চুরি ডাকাতি রাহাজানি – সব নোংরা খবর ভর্তি পত্রিকায়; তা-ই মুখস্থ করি বলা যায়। তবে ভালো খবরের আশায় থাকি, কোনো ভালো খবর পড়লে, কোনো সৎ মানুষের খবর ছাপা হলে, দেশের গৌরবের কিছু ছাপা হলে চোখে জল আসে। তখন মনে হয়, না, এখনো
দু-একজন ভালো মানুষ আছে দেশে। আপনারা বলতে পারেন, বুড়া মানুষের কাজ কী? অন্যদের মতো সারাদিন
নামাজ-রোজা, দোয়া-দরুদ-তসবিহ পাঠ না করে আপনি সারাদিন পত্রিকা পড়ে সময় নষ্ট করেন, পরকালের চিন্তাও নেই? চিন্তা আছে বটে। তবে তা আমাকে খুব যে তাড়িত করে তা নয়। ওই যে বলেছিলাম, যেটা হবে সেটা তো আমি রোধ করতে পারবো না।

ইশরাত হুট করে চলে এলো আর কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিলো। ইশরাতের অনুপস্থিতিতে বাড়ির দারোয়ান ছেলেটা সব কিছু করে, বাজারঘাট থেকে সব বিল পর্যন্ত দেয়। ঢুকেই সে আমাকে বলে, প্রতিদিনের মতো, বাবা সব ঠিক আছে না? একটা উৎকণ্ঠা ওর মুখে ছোট্ট কিন্তু নিখুঁত ছবি তোলে। আমি সেটা বুঝি। তবে মাখি না। বলি, হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। সে বলে, তুমি রেডি হও, খাবো। সে ঝটপট ওর ঘরে গিয়ে জামাকাপড় পাল্টে হাতে-মুখে জল দিয়ে টেবিলে এসে বসে পড়ে। আমি ডাইনিংয়ের পাশে বেসিনে হাত ধুয়ে ওর পাশে বসি। টেবিলে খাবার সাজানোই আছে। দুলি সব ঠিক করে রাখে। ছোট্ট মাছের একটা পদ দেখে খুব খুশি হলাম। সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি, মসুর ডাল আর ছোট লাল আস্ত আলু দিয়ে মুরগির ঝোল। লাল শাকও আছে কুচো চিংড়ি দিয়ে। আমি সবকিছু খেতে পারি না। খাওয়ার ইচ্ছেও হয় না। তবে পঁয়ত্রিশ বছর ধরে শায়লার রান্না খেতে খেতে অন্যদের রান্না ভালো হলেও খেতে পারি না, স্বাদ পাই না। এই যে আজ সজনের ডাঁটা রান্না হয়েছে, এটাও খেতে পারবো না। আমরা যখন রাজশাহীতে ছিলাম। একতলা একটা বাড়ি, তখন ইশরাতও হয়েছে। বাড়ির সামনে দু-তিনটে সজনে গাছ ছিল, তিনটার সজনে তিন সময় ধরতো। ধরো, একটা ধরবে ঠিক মার্চ মাসে। তারপর ধারাবাহিকভাবে ধরতে থাকবে। কেউ একজন অনেক কষ্ট করে লাগিয়েছে। আমরা আনন্দ করে খাচ্ছি। সজনে খাওয়ার নেশা হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। সরু চিকন জালি সজনে সরিষাবাটা দিয়ে অনেক পেঁয়াজ দিয়ে একটা গাঢ় ঝোলসহ রান্না করতো শায়লা। সে বিয়ের আগে রান্না করতে না পারলেও বিয়ের পর খুব দ্রুত সব রান্নাই শিখে ফেলে। বি.এ পাশ করেও সে কোনো চাকরি করতে চাইতো না। আমি জোর করিনি। তো সজনের সেই ঝোল যাকে আমি সুরুয়া বলতাম, এখনো আমার মুখে লেগে আছে, আর বললেই সে রাগ করে বলতো, সুরুয়া আবার কী? শুনতে খুব খারাপ লাগে, একদম বলবে না, তবু আমি প্রতিবার মুখ ফসকে বলে ফেলি, সে বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকায়, আমি চোখ নামিয়ে নিই। আমি বোধহয় মায়ের কাছ থেকেই শিখেছিলাম শব্দটা। কোত্থেকে যে শব্দটা এসেছে জানি না, কারো কাছ থেকে এর ব্যুৎপত্তিটা জেনে নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, ভুলে যাওয়ার কারণে আর হয় না। ইশরাত আমাকে বলে, বাবা সজনে রান্না খুব ভালো হয়েছে। আমি তাকাই বাটির দিকে, তবে নিই না। শায়লার সজনে রান্নার কথা মনে হলে, সেই স্বাদের কথা মনে হলে এ-রান্না অমৃত হলেও খেতে পারবো না। কাজেই ইশরাতকেও কিছু বলি না। সে শুনলে রাগ করবে কি না  জানি না। লাল শাক আর এক টুকরো মাংস দিয়ে সামান্য খেয়ে নিই। সে জোর করে, বাবা এইটুকু খেলে হবে কী করে? আর একটু ভাত নাও। আমি চুপ থাকি। ও আমার প্লেটে আর একটু ভাত, ডাল আর মাংস দেয়। আমি নাড়তে থাকি। আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর বয়স কমে  গেছে চল্লিশ বছর। সে আমার ঘাড়ে উঠে আমাকে বলছে, বাবা চলো, ঘুরে আসি, আইসক্রিম খাবো। তখন এইসব বড় বড় কোম্পানি ছিল না, লাল সাদা কমলা রঙের আইসক্রিম পাওয়া যেত, পাঁচ-দশ পয়সা করে দাম। সে মুখে দিয়ে চুষতো আর সারা মাথা-গা মাখামাখি হয়ে যেত লাল কমলা ছোপ ছোপ রঙে। বাড়ি ফিরেই মায়ের কাছে গল্প করতো, জানো, আজ কী হয়েছে? তাকে আমরা জোর করে খাওয়াতাম। আমি আর শায়লা ওকে খাওয়ানোর জন্য সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াতাম, সে খাবে না। পরে গাছে উঠে, ছাদে ওঠে খাওয়ানো হতো। ওর কি সেসব মনে আছে? আমি জিজ্ঞেস করবো ভাবি, আবার মনে অন্য চিন্তা আসে। ইশরাত বলে, বাবা, সারাদিন তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? একা একা লাগে? অবান্তর প্রশ্ন, তবু সে করে সৌজন্য করে, সেটাই তো অনেক। বুড়ো বাপ ওর ঘাড়ে আছে, বোঝা হয়ে আছে। আমি বলি, না, কষ্ট হবে কেন? পত্রিকা পড়ি, বই পড়ি, দু-একটা গান শুনি, চোখটা তো ঠিক আছে, কাজেই সমস্যা নেই। সে বোধহয় আমার সূক্ষ্ম খেদোক্তি বুঝতে পারে। বলে, বাড়িতে একটা ছেলে রেখে দেব ভাবছি, শামসু তো আছে, বাজারঘাট করে, দুলু ঘরবাড়ি রান্নাবান্না সামলায়। তবে বাড়ির ভেতরে একজনকে রাখবো যদি পাই, তোমাকে সময় দেবে। ধরো, আমাকে তো আগামী মাসে ইউএসএ যেতে হবে, তখন তো তোমার অনেক কষ্ট হবে। আমি বলি, শুধু শুধু বাইরের মানুষকে ঘরে ঢোকানোর কী দরকার? আমার তো কোনো অভাব নেই। চলে তো যাচ্ছে। আগেও গেছ না তুমি? একা থাকা তো আমার কাছে কোনো ব্যাপার না। ইশরাতকে ‘তুমি’ বলার পর মনে পড়ে বিয়ের আগে ওকে কখনো ‘তুমি’ বলিনি আমি। বিয়ের পর আফতাবের হাতে ওকে তুলে দেওয়ার পর, যে-কথাগুলো বললাম, তখন কেন জানি তুমি করে বললাম। ও শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল, কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু গাড়িতে ওঠার সময় আমার বুকে এসে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো, ওর মা ওকে থামালো। থামিয়ে নিজেই কাঁদতে লাগলো।

ইশরাতের দিকে ঘন করে তাকাতেই আবার শায়লা এসে মুখের সামনে দাঁড়ালো। ইশরাতকে আসলে ওর মায়ের ক্লোন বলা ভালো। গায়ের রং, শারীরিক গঠন, উচ্চতা, চোখ হাত পা নাক ঠোঁট কান সব একই রকম। সে শাড়ি পরে দাঁড়ালে, পেছন দিক থেকে দেখলে মনে হবে শায়লা দাঁড়িয়ে আছে। সে হাসলে মনে হবে শায়লা হাসছে, ভ্রু কুঁচকালেও মনে হবে শায়লা, আর কণ্ঠ তো চেনা মুশকিল, অন্তত টেলিফোনে তো আমি কখনোই বুঝতে পারি না, কে কথা বলছে। হতে পারে এটা আমার মেধাহীনতার ব্যাপার। সে বলে, বাবা, তুমি এবার আমার সঙ্গে চলো, আমি ভিসা করতে পারবো তাড়াতাড়ি। আমি বলি, তোর ভাই তো কত অনুরোধ করলো, ভিসা তো ছিলই, টিকেট পর্যন্ত পাঠিয়েছিল, যাইনি। এখন তোর সঙ্গে গেলে ও কী ভাববে? ইশরাত বলে, যা ভাবে ভাবুক, তোমাকে ওখানে থেকে কানাডা পাঠিয়ে দেব না হয়। আর ওর বউ তো তোমাকে দেখতে পারে না। আমি বললাম, কে বলেছে? আমি বলেছি তোকে? সে একটু থতমত খায়। আমি ওকে বলেছি কি না আমার মনে নেই। সে অবশ্য শুনে থাকতে পারে কোথাও থেকে। সে উঠে গিয়ে দু-কাপ কফি নিয়ে এলো, আগেই হয়তো পানি গরম ছিল। আমি খুশি হলাম। কারণ চিনি ছাড়া এক কাপ ব্ল্যাক কফি দুপুরবেলা আমার খুব প্রিয় একটা বিষয়। ইশরাত জানে অবশ্য। সে বলে, বাবা, তোমার প্রেশার ঠিক আছে? আমি জানি সে প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছে। আমি বললাম, কবে আমার প্রেশার ছিল? যদিও বাড়িতে ডিজিটাল প্রেশার মাপার যন্ত্র আছে, আর আমি মাঝে মাঝে মাপি। একটু লো হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। তখন খাওয়া একটু বাড়াই। সে বলে, তোমার সঙ্গে একদিন বেড়াতে যাবো। তুমি জায়গা ঠিক করো, কোথায় যাবে? আমি বলি, আচ্ছা। সে উঠে যায় একটা ঢেউ তুলে।

আমি ওর ফিরে যাওয়ার দিকে তাকাতে তাকাতে শায়লার কথা মনে হতে হতে হঠাৎ কেন যেন বাবার কথা মনে হয়। বাবার সঙ্গে শায়লার বেশিদিন মেশার সুযোগ হয়নি। বিয়ের পরই তো আমি নতুন চাকরিস্থলে ওকে নিয়ে গেলাম। আর মাকে তো ও দেখেনি, মা তো আরো আগে গেছে আমাদের ছেড়ে। সত্যিকার অর্থে মায়ের ছবি আছে শুধু বুকের মধ্যে অথবা চোখের মধ্যে, সে-ছবি কখনো ভুলি না, যুদ্ধ থেকে ফিরে মাকে আমি আর পাইনি। আমি প্রায় ১১ মাস পরে বাড়ি ফিরি। মানে ফিরতে বাধ্য হই। সে আরেক গল্প। সে-গল্পও আমাকে তাড়ায় মাঝে মাঝে। মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট মুখটা, নীরব শ্যামলা মুখটা মনে পড়ে, যতদিন বাড়ি ফিরে এসেছি মা খুব মৃদু একটা হাসি ঠোঁটে তুলে নিয়ে বলতো, আয়, কতদিন পর বাড়ি এলি। আমার মুখে ঘাম না থাকলেও মা আঁচল দিয়ে মুখের অদৃশ্য ঘাম মুছে দিত। চোখ-মুখে এক শান্ত দীপ্তি লেগে থাকতো মায়ের। ছবিটা বুকে বাঁধাই করে রেখেছি। কিছুটা সাদা রঙের শাড়ি, হালকা নীলের ছোপ, কুয়াশার মতো একটা আস্তরণ, সাদা একটা ব্লাউজ, আর রং উঠে যাওয়া রুপোর মোটা চুড়ি দুই হাতে, কানে একটা মাকড়ি, নাকে সোনার পাতলা একটা নথ। পুকুরধারে কলের কাছে মা হয়তো থালাবাটি ধুতে গেছে, আমি চিৎকার করে বলি, মা, মা, তুমি কোথায়? মা দ্রুত হাঁটতে পারে না, রহিমা বুবু হয়তো মায়ের সঙ্গে আছে, তবু মা খুব দ্রুত চলে আসে। আমি দৃশ্যটা গেঁথে ফেলি। মা বেশ জোরে বলে, খোকা, কি রে, কী খবর তোর? ভালো আছিস? কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সেবার আর কী কী মনে পড়েছিল, জানি না, কোন কোন ছবি গেঁথেছিল বুকে সব মনে নেই, তবে জিউল গাছের ঘন পাতার ছায়ায় মায়ের কবরে নতুন কয়েকটা বনফুল ফুটেছিল কয়েক মাসে। বাবাকেও ওখানে মায়ের পাশে কবর দেওয়া হয় কয়েক বছর পর। রহিমা বুবু ও আয়শা বুবুর ধারণা, মায়ের শোকে বাবা মারা গেছে। আমি বাড়ি ছিলাম না অনেকদিন। একটা কলেজে যোগ দিয়েছি। নতুন চাকরি, ছুটি দিতে চায় না, বাবার অসুখের কথা বলে বাড়ি এলাম, শায়লাও এলো, সে তখন নতুন বউ। কয়েক মাস আগে আমাদের বিয়ে  হয়েছে। বাড়ি ফিরে বাবার সিথানে বসলাম। বাবা আমার দিকে তাকালো সমুদ্রের ওপার থেকে, যেন আমাকে চিনতে পারছে না। সাদা দাড়ি-গোঁফ যত্ন না নেওয়ায় এলোমেলো হয়ে আছে। মাড়ির সব দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে মুখের আকার চিকন হয়ে গেছে। চোখের ভেতরে অশ্রু, বাবা পাঞ্জাবির কোনার কাপড় দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে আমাকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলো, আমি বুঝতে পারি। চিকন লম্বা চৌকি দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দেওয়া; সেখানে একটা বালিশ দিয়ে আমি বাবার কথামতো বসিয়ে দিলাম। বসতে যে কষ্ট হচ্ছে সেটা আমাকে বুঝতে দিতে চায় না। শুধু পিঠে একবার বাঁ হাতটা ঠেকানোর চেষ্টা করলো। শায়লা এসে বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। বাবা শায়লার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, দুই কপোলে হাত বুলিয়ে দিলো, মুখে বলল, বেঁচে থাকো মা, সুখে-শান্তিতে থাকো। আমি  কথা বলার মতো  কিছু পাই না, বাবার পুরনো সেই কথার মতো, বুদ্ধি সব হারিয়ে যায়। বাবাই বললো, তোর মায়ের কবরে গিয়েছিলি? আমি বললাম, এখনই যাবো। বাবা আবার বললো, জানিস, আমি এখন সারাদিন, একটু একলা হলেই তোর মাকে দেখতে পাই। স্বপ্নে দেখি, জেগেও দেখি, আমার মনে হয় এখন ওর কাছে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি বললাম, বাবা কিসব কথা বলো, এসব বলতে হয় না। তোমার তো তেমন কোনো অসুখ নেই। আমার কৃষক বাবা, আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে, মৃত্যুর জন্য অসুখ লাগে, তোকে কে বলেছে? মৃত্যুর সময় যখন হয়, তখন এমনিতেই সব শেষ হয়। আমি জানি বাবার তেমন কোনো কষ্ট নেই। যা জমিজমা আছে তা বর্গা দিয়েই ভালোভাবে চলে যায়। আগে নিজেই চাষ বাস করতো লোকজন দিয়ে, এখন আর পারে না। মাইনর পাশ করে কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতাও করেছিল গ্রামের স্কুলে – শিক্ষক ছিল না বলে। পারে শিক্ষক এলে আর যেত না।

আমি মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে মাঠে যেতাম। বুবুরা আমাদের জন্যে বড় গামলায় করে পান্তা ভাত নিয়ে যেত। বাবা নিজেও লাঙল চালাতো মাঝেমধ্যে। আমাকে একদিন বললো, শিখবি, কৃষকের ছেলে শিখে রাখা ভালো। তখন আমার দশের মতো বয়স। কেবল দেশভাগ হয়েছে। বর্ষার নদীর স্রোতের মতো হু-হু করে লোকজন ওপারে যাচ্ছে আর এপারে আসছে। দাঙ্গা শুরু হয়েছে কলকাতায়, এপারেও হচ্ছে। বাবা বলে, দেশের অবস্থা ভালো না। খুব অভাব হবে দেখিস। ভাতের ব্যবস্থা অন্তত করতে হবে। আমি অতশত বুঝতে পারি না। বাবার সঙ্গে গরুর লেজে একটা মৃদু মোচড় দিয়ে লাঙল চালাতে শুরু করি। রহিমা বুবু দেখে খিলখিল করে হাসে। এরপর আমরা পেঁয়াজ কাঁচা মরিচ লাল খেজুরের গুড় দিয়ে পান্তা খাই। আমি খেতে পারবো না ভেবে মা কাল রাতের নয়না মাছের ঘন ঝোলের তরকারি পাঠিয়েছে; শিম লাল আলু আর বড় বড় নয়না মাছ। আমি তো খুব মজা করে খেলাম বাবার সঙ্গে আলের ওপর বসে। সুরুত সুরুত করে শব্দ হয় পান্তা আর তরকারি মিলে, আমি ইচ্ছে না করলেও শব্দ হয়। আবার রহিমা বুবু খিলখিল করে হাসে। সে অবশ্য বিনা কারণেই বেশি হাসে। একদিন দেখি ওপার থেকে উস্কোখুস্কো একটা মেয়ে ওর বাবার সঙ্গে দেশ ছেড়ে আমাদের গ্রামে এসে আমিনুদ্দিনের পরিত্যক্ত ভিটেয় থাকতে শুরু করেছে। আমরা একদিন দেখতে গেলাম। রিফিউজি কিরকম তাই দেখবো। নানা গল্প করে লোকে। লোকটা  নাকি দু-তিনজন মানুষ খুন করে এসেছে। তার বউ আর দুই ছেলেকে হত্যা করেছে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা। লোকটাকে দেখলে অবশ্য খুনি খুনি মনে হয় না। অবশ্য আমার তো জ্ঞান নেই যে বুঝবো। আমি দেখলাম, মেয়েটা প্রায় আমার বয়সী, হ্যাংলা-পাতলা, শ্যামলা, আর মুখটা ঠান্ডা বরফের মতো। চোখ দুটো গভীর। সে একটা নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজছে। আমাকে দেখে বাঁ হাতের কনিষ্ঠা দিয়ে বাঁ কান অনবরত চুলকাতে থাকে। আর আমার দিকে বারবার তাকায়। রহিমা বুবু
হি-হি করে হেসে ওঠে। সবাই ওর হাসি দেখে ওর দিকে তাকিয়ে কারণ খোঁজার চেষ্টা করে। মেয়েটার বাবা ওকে বলে, খুকি তোমার কী হলো? আমি বুবুকে বলি, কী ব্যাপার? সে বলে, মেয়েটা তোকে পছন্দ করেছে। আমি ওর মুখের দিকে হা করে তাকাই। আর কী মনে করে মেয়েটার দিকে আর একবার তাকাই। সে তখন আমাদের সামনেই  ছিল। আমি দেখি তার মায়া আর দুঃখভরা অথচ সুন্দর একটা মুখ; সে শিমুলগাছে বসে থাকা কতকগুলো শালিকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। এই ছবি আমি সারাজীবন ভুলতে পারি না। মাও ওকে বলে, মেয়েদের এত হাসি ভালো না। সে পাত্তাই দেয় না। বাবা অবশ্য বলে, কেন? হাসি কি শুধু ব্যাটালোকের সম্পদ?

আমরা বাড়ি থাকতে বাবা ভালোই ছিল। আমাকে শুধু বললো, আগামী শুক্রবার সকালে আমি চলে যাবো। আমি বাবার কথা বিশ্বাস করিনি। রহিমা বুবু ছিল, সেও বিশ্বাস করেনি। আমি বাবাকে বলে আমার কলেজের কাছে ভাড়াবাড়িতে শায়লাকে নিয়ে ফিরে গেলাম। বাবা করুণভাবে তাকালো, মানা করলো না। আমরা শনিবার পৌঁছলাম কুষ্টিয়া। বাবা পরের শুক্রবার সকালে মারা গেলেন। রহিমা বুবুর বর্ণনা অনুসারে : খুব ভোরে ঝড় হলো, বজ্রপাত হলো কয়েকবার, ঘন বৃষ্টিপাতে মুখরিত হলো আশেপাশের প্রকৃতি। আমি ধড়ফড় করে উঠলাম, দৌড়ে বাবার কাছে গেলাম। বাবা নামাজ পড়েছে বোঝা যাচ্ছে। অজুর পানি, বদনা ব্যবহার করেছে, নামাজের পাটি পড়ে আছে মেঝেতে। বাবা ডান কাতে শুয়ে আছে। আমি বাবা! বাবা! বলে ডাকলাম। বাবা কোনো উত্তর দিলো না। কপালে বুকে পিঠে হাত বুলালাম, টেনে তোলার চেষ্টা করলাম, পাথরের মতো ভারী মনে হলো বাবার শরীর। আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম।

কলেজ থেকে মাইলখানেক দূরে একটা প্রাচীর দেওয়া টিনের ঘরে আমরা থাকি, পূর্ব পাশে গড়াই নদী, নদীর ওপর রেলের ব্রিজ। ওপারে পাংশা না কুমারখালী থানা। শায়লাকে বাবা পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছিল; ওর বাবা একটা ভালো সরকারি চাকরি করতো। তার আরো দুজন ছোট ভাই ছিল। একটা ভাই আমাদের বাসায় কিছুদিন ছিল পড়ালেখার জন্য। খুব ভালো ফুটবল খেলতো। সে এখন কোথায় থাকে আমার মনে নেই। ভাবি একবার খবর নেব। সে আমাকে সাদিক ভাই বলে ডাকতো। শায়লা বলতো, এটা আবার কী রকম ডাক? দুলাভাই বলতে পারিস না? সে বলে, শুধু ভাই বলতে খুব আপন আপন লাগে। বিয়ের আগে আমি ওকে সবার সামনে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে ওর পছন্দ কি না? আমার মতো হ্যাংলা-পাতলা সামান্য দাঁত উচু মোটামুটি লম্বা শ্যামলা ছেলেকে কারো পছন্দ হওয়ার কথা নয়। সে কী বলবে, অনেকক্ষণ পর মুখ নাড়ালো। বিয়ের আগে বুঝিনি এত টান হতে পারে একটা মেয়েকে নিয়ে। সে আমাকে সত্যি দু-তিনদিনের মধ্যে গভীরভাবে বেঁধে ফেললো তার আঁচলে। এই প্রথম আমি কোনো 888sport promo codeর কাছে এলাম; সম্পর্ক হলো – শারীরিক ও  মানসিক। এই সম্পর্কের কোনো ব্যাখ্যা আমি দিতে চাই না বা দিতে পারবো না, তবে আমার অবগাহনের কথা বলতে পারি, যে-888sport sign up bonus আমাকে আপ্লুত করে গভীরভাবে। তার সব সৌন্দর্য আনন্দ অনুভূতি অভিমান অনুরাগ রাগ দ্রোহ আমি স্পর্শ করেছি। তাকে পেয়েছি গভীর আশ্লেষে। সে যখন প্রথম কাছে আসে, একটা মৃদু আলোর রাতে আমরা একাকী, আমরা অনেকক্ষণ নানা কথা বলার পর অবগাহনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। একটা নতুন গন্ধ পেলাম ওর শরীর থেকে, যা সারা জীবন মনে রেখেছি, মনে রেখেছি প্রথম আলিঙ্গন, আমি তাকে দু-হাত বাড়িয়ে আমন্ত্রণ জানালে সে ইতস্তত করলো কিছুক্ষণ, তারপর সে আমার বুকে এলো, আমি তাকে জাপটে ধরে, দাঁড়িয়ে কাঁপতে শুরু করলাম যেন, একটা ঝড় উঠছে কোথাও কি না জানি না, তবে একটা প্রপাত হচ্ছে আমার ভেতরে। অল্প আলোয় তাকে দেখলাম গভীরভাবে। একেই বোধহয় স্বর্গীয় অনুভূতি বলে। সেও আমাকে তার কোমল অথচ শক্ত বুক দিয়ে বেঁধে ফেললো। মৃদু চাঁদনি রাতে দুজন নর-888sport promo codeর প্রথম মিলিত হওয়ার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আমি কখনো ভুলিনি। শায়লাকে আমি দু-একবার জিজ্ঞেস করেছি পরে, সে বলে, তুমি তো পাগলের মতো কথা বলো, এত কথা বলার কী আছে, এসব অনুভবের বিষয়। সত্যি তাই, তবু তা কখনো কখনো মনে করতে ইচ্ছে হতো মাঝে মাঝে। এখনো হয়, মাঝে মাঝে, তবে মাঝখানে প্রায় পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান। তবু সব স্পষ্ট, তার চোখ, তাকানোর ভঙ্গি, মুখের অস্পষ্ট কথামালা। সব দেখতে পাই।

ইশরাত ডাকে, বাবা, আসো, চা খাই। সন্ধেবেলা, সে বাড়ি থাকলে একসঙ্গে চা খাই। আমি বলি, একটু মুড়ি দাও। যদিও টেবিলে অনেক ফলমূল, খাবার আছে। দুলু বেশ ভালো পরিপাটি করে খাবার দেয়। সেও আমার পছন্দ খানিকটা জানে। কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ কুচি, কালিজিরা আর সরিষার তেল দিয়ে সে একবাটি মুড়ি আমার সামনে দেয়। আমি ইশরাতকে বলি, খা, তোর মা খুব পছন্দ করতো। সে বলে, জানি, আমার মনে আছে। তোমরা সন্ধেবেলা বসে খেতে আদা-চা দিয়ে। আমি বলি, আর কী মনে আছে তোর? সে বলে, মা গান করতো, অনেক অনেক গান, আমার দু-একটা মনে আছে। আমি বলি,
দু-একটা কেন? তোর তো সব মনে থাকার কথা। সে বলে, না বাবা, আমরা তো ওসব গান তেমন শুনতাম না। ধরো, মায়ের পছন্দ ছিল গীতা দত্ত। ‘ওই সুর ভরা দূর নিলীমায়,  ওই তারা ঘেরা স্বপ্ন সীমায়, সেথা চন্দ্রকলার বাঁকা নায় মোর মন আজ উধাও হতে যায়, আহা হা হা  ও ওহো হো হো আহা হা হা হা’ – এই গানটা মায়ের খুব প্রিয় ছিল। তাই না বাবা? আমি অবাক হয়ে যাই, এই গানটার কথা আমি ভুলে গেলাম কী করে? দুজনেরই খুব প্রিয় গান ছিল এটা। ও বলে, বাবা তুমি এখন গান গাও না কেন? আমি বলি, শোন, গান হলো আনন্দের বিষয়। হৃদয় যখন আনন্দে উদ্বেলিত হয়, তখন সবাই গান গায়, যে জানে না সেও হু-হু করে গুনগুন করে, ভুল সুরেও গায়। আমি তো সেই সময়ে নেই রে। তবে আমি একেবারে নিরানন্দেও থাকি না। নানা কিছু নিয়ে আছি, তাকে ঠিক আনন্দ বলে না। ইশরাত যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে বলল, বাবা সত্যি, আমি তোমার জন্য তেমন কিছু করতে পারি না। আমি বললাম, কেন? তুই মাঝে মাঝে গল্প করিস, তাতেই হবে।

কে যেন বেল বাজালো। আমার মনে পড়লো একটা পত্রিকার সম্পাদক ও তার কয়েকজন সহযোগী আসতে চেয়েছিল, আমার প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থ নিয়ে কথা বলতে। আমি রাজি ছিলাম না। তারা অনেকদিন ধরে নানাভাবে আমাকে রাজি করিয়েছে। ইশরাত ওদের নিয়ে এলো। আমরা ড্রয়িংরুমে বসলাম। নিয়ামুল বাশার নামে তরুণ ছেলেটা সে ছাপচিহ্ন নামে একটা পত্রিকা করে। আমাকে বললো, আপনার সারাজীবনের ঘোর বইটা পড়েই আমরা আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছিলাম। আমি বললাম, আমি তো ঠিক লেখক না, মাঝেমধ্যে লিখেছি। বলতে পারো নিতান্ত বাধ্য হয়ে, তাড়না থেকে। সে কথা বলতে থাকে : আপনি ব্রিটিশ পাকিস্তান 888sport apps – তিনটা সময় দেখেছেন, কোনো বড় ধরনের সাংস্কৃতিক বা সামাজিক পরিবর্তনের কথা আমাদের বলতে পারেন? দুলু আমাদের নাস্তা দিয়ে গেল। ইশরাত এক ফাঁকে বলে গেল, বাবা তোমরা গল্প করো, আমি ঘণ্টাখানেক পরেই ফিরবো। আমি বললাম, তোমরা কি আমার সাক্ষাৎকার নিতে চাও? আমি তো বলেছি, আমি সেটা দিতে চাই না। আমি সামান্য মানুষ, সামান্য কিছু হয়তো করেছি। তবে নিজের জীবনের বাইরে আমি কিছু ভাবতে চাই না। আর সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি নিয়ে আমি তেমন কিছু জানি না। বরং তোমরা কিছু গল্প করো, আমি শুনি। তোমাদের প্রজন্মের গল্প। দেখো, পঞ্চাশ বছর বা একশ বছরে একটা দেশের বড় ধরনের পরিবর্তন হয় না। যা হয় তা ঠিক চিহ্নিত করাও যায় না। আমি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখবো যদি সময় পাই। আমি ওদের চা এবং 888sport app খাবার খেতে বললাম। অনেকদিন পর নিজেকে আবার শিক্ষক মনে হলো। কথা বলতে ইচ্ছে আর হচ্ছে না। ওরা আরো প্রশ্ন করার চেষ্টা করতে চাইলে আমি বললাম, দেখো, আমি কথা বলতে এখন ঠিক আনন্দ পাই না। আগেও যে খুব কথা বলতাম, তা নয়। পত্রিকায় লিখতাম। তাও কেউ পড়তো বলে মনে হয় না। তাই আর লিখি না। একজন বললো, তবু, আপনার লেখা বা বলা উচিত। কেউ কেউ তো পড়ে। আপনার অভিজ্ঞতা জাতির কাজে লাগবে। আমি বলি, বহু মানুষ আছে এসব বলার। বাশার বললো, এতদিনে জীবনের কোনো বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? আমি বলি, নিভৃতি। খুব প্রয়োজন; অন্তত আমার মনে হয়। জীবনে স্থিতধী হওয়া খুব প্রয়োজন, নিজের মতো করে কিছু সময়, কিছু চিন্তা করার সময়, কিছু সময় নিজের মতো কোনো বাধা ছাড়াই পার করে দেওয়া খুব দরকার। আর দরকার মানুষকে ভালোবাসার সুযোগ ও আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা, আর তাতে যে আনন্দ হয়, তার তুলনা হয় না। দেশটাকে ভালোবাসার যে আনন্দ, দেশ যদি দেশের জায়গায় থাকে তাহলে সেটাও খুব আনন্দের। এসব আনন্দ নিয়েই বেঁচে থাকাটাকে সার্থক মনে হয়। আমি থামলে বাশার আবার বললো, আপনি তো সরকারের কাছে কোনো সাহায্য কখনো নেননি, সেটা কি অভিমান, নাকি রাগ? আমি এসব বিষয়ে কথা বলতে চাই না, বলিও না কখনো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলতে ইচ্ছে হলো : দেখো, আমার কখনো প্রয়োজন হয়নি, প্রতিদানের জন্য তো এসব করিনি, তখন এটা আবশ্যিক কাজ ছিল। দেশের নাগরিক হিসেবে যে বোধ থেকে কাজ করেছি, সেটা দেশের জন্য তোলা আছে। সেটা আমার আর দেশের মধ্যে থাক। একজন বলে, কোনো আফসোস হয় আপনার? আমি বললাম, দেশটাকে সভ্য দেখতে চেয়েছিলাম, দেখতে পেলাম না। কলিংবেলের আওয়াজ পেলাম। মনে হয় ইশরাত এসেছে। দুলু দরজা খুলতেই দেখলাম সত্যি ইশরাত এসেছে। বাশার উঠে দাঁড়ালো, বললো, আমরা আজ যাই, আপনি চাইলে আরেকদিন আসবো। আমি বললাম, আচ্ছা। ইশরাত বললো, বাবা তোমাদের আলাপ শেষ, নাকি আমাকে দেখে বন্ধ করে দিলে? আমি বলি, না রে। এত কী বলার আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে গভীরভাবে। মুখে কিছু বলে না। তারপর সোফায় বসে। বলে, জানো বাবা, টিকিট কেটে ফেললাম। একটু আগে কাটলে কম টাকায় পাওয়া যায়। যাবো তো সেই সেপ্টেম্বরে তবু এখন কাটলাম। আমি কিছু বললাম না। বলতে ইচ্ছে হলো না। সে বললো, বাবা মন খারাপ হলো? আমি উত্তর দিলাম না। সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় অনেকক্ষণ ধরে। আমি কিছু বলি না। সে বলে, তুমি বসো, আমি কাপড় পাল্টে তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।

আমি ওর প্রস্থানের দিকে একবার তাকাই। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজি। জীবনটাকে খুব লম্বা মনে হয় হঠাৎ। একসময় ছোট মনে হতো। তখন কত কী করার পরিকল্পনা করতাম। এখন মনে হচ্ছে কোনো পরিকল্পনা নেই। কোনো কাজ নেই। সত্যি কি নেই? এদেশের সাধারণ মানুষদের নিয়ে, তাদের চিন্তা ও আনন্দ নিয়ে একটা বই লিখতে চেয়েছিলাম, সংগ্রহ করেছিলাম অনেক লোকগান, সেখানে ওদের মনের কথা লুকিয়ে থাকে। কত সহজ কত সুন্দর সেই কথা। কত নির্মোহ লোভহীন সেই জীবন। পারবো বলে মনে হচ্ছে না। অমিত ফোন দিয়েছিল। আমার খুব রাগ হলো ওর কথায়। এই দেশে কেন পড়ে আছি সে জানতে চায়। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছি। খোকার সঙ্গে এরকম ব্যবহার আমি করি না কখনো। কেন করলাম? আমার কি রাগ-ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে? ইশরাতের ওপর রাগ, অমিতের ওপর রাগ, কেন রাগ? কিসের রাগ? ইশরাত গেলে একা থাকতে পারবো তো? অমিতের  মেয়ে অদিতিকে দেখতে পাই, সে আমার কোলে আসার জন্য দু-হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, শায়লা দাঁড়িয়ে আছে, মা যেন বাবাকে কী বলছে, সেই যে রিফিউজি মেয়েটা যে কানে কনিষ্ঠা দিয়ে অল্প হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে – বদলে যাচ্ছে দৃশ্য। একটা বুলেট এসে আমার ডান পায়ে আঘাত করে, যুদ্ধ শেষ, দেশ স্বাধীন, আমি হাসপাতালে কাতরাচ্ছি, বাড়ি যাবো।

মা-বাবার সঙ্গে, রহিমা বুবুর সঙ্গে দেখা করবো, এরা আমাকে ছাড়ে না কেন? আমার তো অনেক তাড়া। অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে এখনো, অনেক কাজ, অনেক কিছু বাকি, শক্তি থাকতে সব 888sport sign up bonusকে, সব গল্পকে জড়ো করতে চাই, আমার আনন্দটুকু সবার কাছে জানাতে চাই। কে যেন আমাকে ডাকছে, ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছি না, শায়লার গলা মনে হলো, আবার মনে হলো ইশরাতের গলা। সত্যি কেউ কি আমাকে ডাকছে? কেউ কি আর ডাকে আমাকে প্রাণ থেকে? অবিরাম বেল বেজে যাচ্ছে বোধহয়, কেউ কি খুলে দেওয়ার নেই? ইশরাত কি ফিরছে? ফিরবে? আমি কি বাড়িতে একা? কেউ নেই কোথায়?

একটু পরে সত্যি ইশরাত ফিরে এলো যেন হুড়মুড় করে। তাকে খুব ভীতু মনে হচ্ছে। এসেই সে কম্পিত গলায় বললো, সব আলো নেভানো কেন? সবাই কোথায় গেছে? তুমি ভালো আছো তো বাবা? আমি বুঝতে পারি না, সে কেন আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে? আমি তো ওকে কিছু বলিনি। ওকে একটু সাহস দেওয়ার জন্য একটু জোর গলায় বললাম, হ্যাঁ, তোমার বাবা ভালো আছে, ভালো থাকার চেষ্টায় আছি।