ফেরদৌস আরা আলীম
তাঁর হাতে হাত রেখে দাঁড়ানোর পর তাঁরই হাত ধরে বিশ্ব888sport slot gameের যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলা ছোটগল্প। আমাদের 888sport live chat-888sport live football ও সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে প্রথম সূর্য তো তিনিই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সমকালের কিছুটা সময় এবং পরবর্তীকালের দু-চার দশকে বাংলা 888sport live footballে বিশ্বমানের ঋদ্ধ ছোটগল্পের একটি ঐতিহ্যিক ভুবন যাঁরা নির্মাণ করে গেছেন, অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁদেরই একজন। তাঁর জন্ম-পরিবেশ, বংশকৌলীন্য (বা অকৌলীন্য) প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা গল্পের 888sport free betবিচারে এ-গৌরবের কোনো হেরফের হয় না।
দে’জ পাবলিশিং কলকাতা থেকে অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ২০০২-এ। সাড়ে সাত শতাধিক পৃষ্ঠার রচনাসমগ্রে মাত্র চল্লিশ পৃষ্ঠার আয়োজন তাঁর ছোটগল্প। গ্রন্থিত চারটি মাত্র ছোটগল্প নিয়ে আমাদের অদ্বৈত-তর্পণ, তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে। অবিভক্ত ভারতবর্ষে অল্পধিক তেত্রিশ বছরের এপার-ওপারে ভাগ করা জীবন দেশভাগের পর সময় পেয়েছিল আর মাত্র চারটি বছর। এই অল্প সময়ে অসাধ্য সাধন করে গেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। রচনাসমগ্রে আমরা তাঁর চারটে ছোটগল্প, ছটি 888sport app download apk, 888sport live-নিবন্ধ ও আলোচনা মিলিয়ে চবিবশটি রচনা, তিনখানা চিঠি এবং পাঁচখানা 888sport alternative link পেয়েছি। তাঁর শ্রমসাধ্য মননশীলতার কাছে গোনাগুনতির হিসাব তুচ্ছই বটে। গড় আয়ুর গড়পড়তা মানুষ যেমন ছিলেন না, তেমনি শুধু লেখার আনন্দে লিখে যাওয়া মানুষটিও ছিলেন না তিনি। তাঁর জীবন, তাঁর লেখা ‘বেঁচে থেকে জীবন খরচ করে ফেলার গল্প। পুরোপুরি জীবনের ভাঁড়ার শূন্য হয়ে গেলে, বেলুনের বাতাস সবটা বেরিয়ে গেলে, সাপের শুকনো খোলসের মতো জীবনবৃক্ষের তলায় পড়ে থাকতে থাকতে মৃত্যুকে এক হাত দূর দেখতে পাওয়া গল্প।’ (‘না-লেখা’, হাসান আজিজুল হক, গল্পপত্র, 888sport free bet ৫, সেপ্টেম্বর ২০১৪) যক্ষ্মাক্রান্ত মানুষটি জীবনের মায়া ছেড়েছিলেন যে-888sport alternative linkটির জন্য জীবদ্দশায়, সেটিও আড়ালে থেকে গেছে তাঁরই মতো। মৃত্যুর প্রায় এক যুগ পরে (১৯৬৩) উৎপল দত্তের নাট্যরূপে না এলে এবং আরো দশ বছর পরে ঋত্বিক ঘটকের হাতে live chat 888sportায়িত না হলে এবং পরবর্তী প্রায় এক যুগ ধরে আলোচনায় না থাকলে ভারতীয় পেঙ্গুইন A River Called Titash প্রকাশ করতেন কিনা কে জানে! (চট্টগ্রামের সন্তান প্যারিসপ্রবাসী ফরাসি ভাষা ও 888sport live footballের অধ্যাপক মলয় দত্তগুপ্ত যে তিতাস একটি নদীর নাম 888sport alternative linkের ফরাসি 888sport app download apk latest version করেছেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভোরের কাগজের কলামের বরাত দিয়ে শান্তনু কায়সার অদ্বৈতের জীবনীগ্রন্থে সে-কথাই বা কেন লিখবেন?) আর কল্পনা বর্ধনই বা কেন ওই ‘নদী ও মানুষের 888sport app download apkটি 888sport app download apk latest version করতে যাবেন এবং সেইসূত্রে ১৯৯০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও গোকর্ণঘাট গ্রাম ঘুরে গিয়ে কেনই-বা তাঁর মনে হবে যে, তিতাসে বর্ণিত জনগোষ্ঠীর আনন্দ ও ভালোবাসা, সংগীত ও 888sport app download apk, নৈতিকতা ও নান্দনিকতাকে লালন ও বর্ধন করার এমন অসাধারণ ক্ষমতা থাকলে মৃত্তিকালগ্ন মানুষের এমন কালজয়ী 888sport alternative link হওয়া সম্ভব।’ অবশ্য এ-888sport app download apk latest versionকর্মটির আগেই বাংলা একাডেমি জীবনী গ্রন্থমালা সিরিজে শান্তনু কায়সার অদ্বৈতকে নিয়ে প্রথম বড় কাজটি করেছিলেন। সেই থেকে অদ্বৈত-অন্বেষণের সূচনা।
রচনাসমগ্রে তাঁর মুদ্রিত গল্প888sport free bet মাত্র চারটি (শিরোনামসহ আরো দুটি গল্পের কথা জানা যায়) হলেও সমান টানা জমিতে কর্ষণ-সৌকর্যে (গল্পভাবনায়, গল্প-গ্রন্থনায় এবং গল্প-কথনে) পরিবেশ রচনার সহজ মাধুর্যে এবং চরিত্র সৃজনের অসামান্য কুশলতায় তাঁর গল্প শেষ পর্যন্ত আসমগ্র জীবনেরই গল্প। প্রথম গল্প ‘সন্তানিকা’।
ছুটির ঘণ্টা বাজলে মফস্বলের কোনো স্কুলের বাড়ি-অন্তপ্রাণ বালক যখন এক হাতে ধুতির কোঁচা, অন্যহাতে বইখাতা সামলে বাড়িমুখো ছোটে, তখন তার পিছু নিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণ বীরেশ্বর ভট্টাচার্যের বাড়ির আঙিনায় উঠে আসেন গল্পের মূল চরিত্র ধনঞ্জয় ঘোষাল। এককালে প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, ছিল সবই; আজ তিনকুলে কেউ নেই। সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে কর্তাবাবু একটু আশ্রয় দিলে তিনি প্রাণে বাঁচেন। বেঁচেও গেলেন। তবে পরীক্ষায় নরেশের শোচনীয় ব্যর্থতায় দায় বহন করে আবার পথে নামতে হলো তাঁকে। কিন্তু অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে গিয়েও সন্তানিকা- ভাবনায় সমর্পিত হয়ে গিন্নিমার শরণ নিয়ে শেষবারের মতো তাঁর বেঁচে যাওয়া – গল্প তো এটুকু। কিন্তু নিশ্চিত নির্ভরতার একটা ঠাঁই পেলে জীবনের গল্প কীভাবে পরতে পরতে খুলে যায় এবং কীভাবে অনিশ্চিত মৃত্যুভাবনাও নিশ্চিত জীবনের অংশ হয়ে যায় সে-গল্প বলেছেন অদ্বৈত। স্কুলের ছুটির ঘণ্টা ধনঞ্জয়ের জীবনের শেষ প্রহরের দ্যোতক হয়ে আসে গল্পে। বালক নরেশ এবং বয়স্ক ধনঞ্জয় দুজনই ছোটে। বালকের একহাতে ধুতির কোঁচা, অন্যহাতে বই-খাতা। ধনঞ্জয়ের একহাতে মলিন কাপড়ের পুঁটুলি, অন্যহাতে শততালি দেওয়া জোড়া চটি। বালকের ঘর্মাক্ত মুখে (পাঞ্জাবির হাতায় মুখ মুছতে গিয়ে) কাঁচা সবুজ কালির ছোপ আর ধনঞ্জয়ের পায়ে ‘ধুলার মোজা’। বালক যদি ঘোর ঘরমুখো তো ধনঞ্জয় ‘ঘোর পর্যটক’। গৃহবাসের নিশ্চয়তা যাঁর কাছে পাওয়া গেল, তিনি এই ঘোর পর্যটকের চোখে ঈশ্বর তো বটেই। আর দুবেলা আহারের সময় কাছেপিঠে গিন্নিমার দাঁড়িয়ে থাকাটা তাঁর কাছে পরম পাওয়া। গিন্নিমা তাঁর খাওয়া দেখেন, পরম ধৈর্যশীল শ্রোতা হয়ে কথা শোনেন। এই গিন্নিমার চরণে মনে-মনে শত প্রণাম জানাতে কুণ্ঠাবোধ করেন না ধনঞ্জয়। তেমনি আহারের পর ঘাটে ‘সকড়ি ধুতে’ যেতেও তাঁর আপত্তি হয় না। বরং সন্ধ্যায় বা রাতে চাঁদের আলোয় পুকুরের জলের রহস্যময়তায় ফেলে আসা জীবনের মধুর কিছু 888sport sign up bonusর লুকোচুরি বেশ লাগে।
জীবনযাপন নিয়মের আওতায় এলে কিছু পুরনো অভ্যেস ফিরে আসে ধনঞ্জয়ের। বাবুর কাছে পয়সা চেয়ে টিকে-তামুক কিনে বাঁশের চোঙে ‘জলভরা হুঁকোয় মধুর মধুর রবে’ জীবনে সুন্দরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। পাড়ার পাঁচজনে মিলে একদা তামাক সেবনের আনন্দ মনে আসে। সেইসঙ্গে লেখকও যোগ দেন : কোনো ভালো জিনিস কি একা একা উপভোগ করা যায়? দুপুরবেলা গিন্নিমাকে মহাভারত শোনান ধনঞ্জয়। এভাবে দিনগুলি বয়ে গেলে মৃত্যুকেও আর ভয় নেই ধনঞ্জয়ের। সন্ধ্যার পাঠপর্বে নরেশ আর তার ছোটভাইটির সঙ্গে ছোট খুকিও এসে জোটে। নরেশকে ধমক-ধামক দিতে বৃদ্ধ ধনঞ্জয়ের বিকট মুখভঙ্গিতে (অনিচ্ছাকৃত, অনায়াসজাত) ভীত ছোট খুকির কান্না থামাতে গিন্নিমাকে ছুটে এসে ‘জীবনের এই দুই প্রান্তের দুটি প্রাণীর মধ্যে রফা’ করে দিতে হয়। ও-ঘর থেকে বীরেশবাবুর কণ্ঠে পাঠ শেষ করার তাগিদ এলে প্রাণ ফিরে পান ধনঞ্জয়। অত্যুৎসাহে ছাত্রের উদ্দেশে বলেন, ‘আজ এটুকুতে ছেড়ে দিচ্ছি, কাল কিন্তু ওটা হবে না। এত শীঘ্র ছুটি পাবে না।’
সকালে ইদানীং ক্ষিদেটা প্রচন্ড হয় এবং নরেশের ওপর মাস্টারের হম্বিতম্বি খুব বাড়ে। নরেশও ‘বিকৃত মুখের তর্জন-গর্জন, প্রহারোদ্যত হস্তের তাড়ন, যুদ্ধংদেহী অঙ্গভঙ্গি’ অনায়াসে উপেক্ষা করে অপসৃত হয় এবং অচিরে গুড়সহ একডালা মুড়ি নিয়ে এলে ‘আনন্দে বুড়োর সর্বাঙ্গে পুলক শিহরণ বহিয়া যায়।’ কখনো সের-কষার আর্যা গড়গড় করে বলতে ভুল হলে নরেশ জানে ক্রোধান্ধ মাস্টারকে কী কথায় ভোলাতে হয়। আকর্ণবিস্তৃত হাসিতে উদ্ভাসিত হন ধনঞ্জয় যখন ছাত্র বলে, ‘মাস্টার মশাই, তামাক সাজিয়া আনি?’
‘সন্তানিকা’র গল্পকার বলেন, গল্প শোনাতে মাস্টারের ভালো লাগে। আর পড়া বাদ দিয়ে সে-গল্প শুনতে ছাত্রের ততোধিক ভালো লাগে, যদি গল্পটা হয় কোনো বিয়েবাড়ির, যেখানে কানা বর দেখে কন্যার পিতা বেঁকে বসেন কারণ বর বদল হয়েছে। তখন যুবাবয়সী ধনঞ্জয়কে বিয়ের আসনে বসতে হলে সে-গল্পের আর তুলনা হয় না। কিন্তু গল্পে-গল্পে বেলা কাটলে যা হয় তাতে বীরেশ ভট্টাচার্যকে ক্ষমাহীন হতেই হয়। বিতাড়িত হওয়ার আতঙ্কে-দুশ্চিন্তায় প্রবল জ্বরে পড়লেন ধনঞ্জয়। মৃতপ্রায় ধনঞ্জয়ের কানে পৌঁছল বীরেশবাবুর কণ্ঠ : তুমি কি সত্যি আমাদের ছেড়ে চললে মাস্টার? সেইসঙ্গে শয্যাপার্শ্বে গিন্নিমার চিন্তাক্লিষ্ট মুখ দেখে প্রাণ ফিরে পান ধনঞ্জয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। পথে তাকে নামতেই হয়। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি? তারও চেয়ে বড় কথা, কোথায় গিয়ে মরবেন? গিন্নিমার চরণ ছাড়া ঠাঁই কোথায়? মরিয়া হয়ে ফিরে আসা ধনঞ্জয়ের এমন আর্জিতে গিন্নিমার মাতৃত্ব শতধারা কল্লোলিত হয়ে ওঠে। ‘সন্তানিকা’র অভিজ্ঞ চোখ বিশ্বের চিরন্তন মাতৃমূর্তি চিনতে ভুল করে না। তাঁকে আশ্বস্ত করে গিন্নিমা খাবার আনতে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, স্নেহবুভুক্ষু এক অসহায় বৃদ্ধকে নিয়ে, তার মৃত্যুভাবনা নিয়ে জীবনতৃষ্ণার পূর্ণবৃত্ত রূপ গল্পের জমিনে সাজানো যুবক অদ্বৈত মল্লবর্মণের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।
অদ্বৈতের ছোটগল্প চরিত্রনির্ভর এবং চরিত্রভাবনার মৌলিকত্বে তাঁর প্রতিভার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে বলেছেন সুম্মিতা চক্রবর্তী ও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। (অচিন্ত্য বিশ্বাস, ‘প্রসঙ্গ অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও তিতাস একটি নদীর নাম’) ‘কান্না’ গল্পের গুরুদয়াল নানাদিক থেকে আলো ফেলা একটি বিরল চরিত্র, বাংলা 888sport live footballে যার জুড়ি মেলা ভার।
স্ত্রী-বিয়োগের পর গুরুদয়ালের ঘরে আর মন টেকে না এমন একটি বাক্য দিয়ে ‘কান্না’ গল্পের শুরু। নিরুদ্দিষ্ট গুরুদয়ালের ঘরে হঠাৎ কোনো রাতে আলো জ্বলতে দেখা যায়। কোনো প্রাতে শোনা যায় রাধে-কৃষ্ণ গান। গুরুদয়ালকে নিয়ে পাড়ার পাঁচজনের পাঁচকথার ধার যখন ক্ষয়ে এলো, দূর-সম্পর্কীয় পিসিমার শোকও মন্দীভূত হয়ে এলে একদিন ঘরে ফিরে এলো এক নতুন গুরুদয়াল। লম্বা চুলে, পরিপাটি সাজসজ্জায়, জ্ঞানের কথায়-ভাবের কথায় সে আর আগের মানুষটি নয়। শোনা গেল তার দ্বিতীয় বিবাহ আসন্ন। গল্পটা এখান থেকেও শুরু হতে পারতো।
পরমা সুন্দরী এক তরুণী বিধবার সঙ্গে ঠিকঠাক হওয়া বিয়ের দিন-তারিখের তোয়াক্কা না করে ভাবী-শ্বশুরগৃহে তার আসা-যাওয়াটা পাড়ার লোকে ভালো চোখে দেখেনি, বিয়েটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো না। অধিক নগদপ্রাপ্তির লোভে কন্যার পিতা আধবুড়ো এক কানাপাত্রে কন্যাদান করবেন বলে মনস্থ করেছেন। পিসিকে অশ্রুজলে ভাসিয়ে আবার নিরুদ্দিষ্ট হলো গুরুদয়াল। তবে মাস দুয়েকের মাথায় আবার যখন ফিরে এলো তখন সে আর একা নয়। গল্প এখন গুরুদয়াল এবং তার স্ত্রীর। গ্রামবাসী বউ দেখে হতাশ; এমন হতকুচ্ছিত বউ এ-তল্লাটে আর নেই। গুরুদয়াল নিজেও তা জানে এবং সেই রাগে মনের ঝাল মিটিয়ে বউ পেটায় সে। বউ টুঁ-শব্দটিও করে না।
এ-সময় গোকর্ণ থেকে নবীনগর পর্যন্ত তিতাসে মোটর লঞ্চ চলে। অর্থাৎ গল্প এখন নদীতে। কী একটা কাজে লঞ্চের যাত্রী গুরুদয়াল পিঠে কার একটা কোমল হাত পড়ায় চমকে পেছন ফিরে আহ্লাদীকে দেখে চমকে ওঠে। তার সিঁথিতে তখনো রং ধরেনি। ধরবে দুদিন বাদে। তবে গুরুদয়াল যদি নির্ধারিত জায়গায় ঠিক সময়ে হাজির থাকে আহ্লাদী তার সঙ্গে পালাবে। গল্প কি তবে নতুন বাঁকে পা রাখতে যাচ্ছে?
বিকেল থেকে সেদিন গুরুদয়ালের সাজগোজ আর ঘরে-বাইরের অন্ত নেই। বেরুবার মুখে বউটা সামনে এসে দাঁড়ালো। ‘শ্রীহীন বেদনাময় মলিন মুখ।’ ‘সে দুঃখদগ্ধ রূপহীন মুখখানা হঠাৎ কি বিপাকে ফেললো গুরুদয়ালকে।’ অন্তহীন ভাবনায় ডুবে গেল গুরুদয়াল। ঘরে-ঘরে সাঁঝবাতি জ্বলে উঠলো। গুরুদয়ালের ভাবনায় আহ্লাদী প্রহর গুনছে এবং তাকে ডাকাডাকি চলছে। কতক্ষণ আর তার টালবাহানা টিকবে? এতক্ষণে সে নিশ্চয়ই ফুলশয্যায়। অকস্মাৎ গুরুদয়াল নিরপরাধ বউটার দুই গালে দুই চড় বসিয়ে দেয়। অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সে চায় বউটা মরে যাক। পাড়া-প্রতিবেশীরা তাই চায়। মরে বেঁচে যাক মেয়েটা। মা চন্ডীর দয়ায় এ-সময় গ্রামের এদিকে-ওদিকে দু-চারজন মারা গেল। গুরুদয়ালের বউটাও হঠাৎ একদিন চোখ দুটো বুজে ফেললো চিরদিনের মতো।
কিন্তু এ কোন গুরুদয়াল? গুরুদয়াল কাঁদে। কেবল কাঁদে। গল্প এখন অন্য ঘাটে। কেঁদে আর কী হবে? পাড়া-পড়শিরা ভাবে, গুরুদয়ালের মনটা বাইরেই এমন; ভেতরটা কোমলই বটে। গল্পকার এখানে কথা বলবেন কারণ গল্পটা তিনি শেষ করবেন। তিনি কি পাঠকের মুখ চেয়ে চরিত্রের ধারাবাহিকতা বিপর্যস্ত করবেন? তিনি গুরুদয়ালের মনের সামনে একটা আয়না বসিয়ে দিলেন। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ সে-মন যারা দেখতে পাচ্ছে তারা দেখছে, চোখের জলে ভিজে গুরুদয়াল যেন বলছে, বলেই চলেছে – ‘মরিলে তো কিন্তু কটা দিন আগে কেন মরিলে না?’ অতঃপর লেখকের আরেকটি প্রশ্নবোধক বাক্য পাঠককে আরেকবার বিচলিত করে। ‘সত্যিই কি তাই?’
শেষের এই প্রশ্নবোধক বাক্যটিতে জীবনের অপার রহস্যময়তার চিহ্ন দেখেছেন অচিন্ত্য বিশ্বাস। তাঁর মতে, সম্ভাবনার কথা আমরা বলতে পারি তবে সম্ভাবনা তো অশেষ। গুরুদয়ালকে নিয়ে গ্রামবাসীর ভাবনা ও সিদ্ধান্তের বারবার পরিবর্তনের কারণ কি শুধু এই যে, মানুষটি অদ্ভুত? তাও তো নয়। এভাবে লেখকের একটি প্রশ্নের উত্তরে অজস্র প্রশ্ন তৈরি করা যায়। অচিন্ত্য বিশ্বাসের বিশ্লেষণটি অসাধারণ। তিনি বলেন, ‘একবার সংযত থাকার – মৃতা পত্নীকে বারবার 888sport app download for android অথবা ঈশ্বর সাধনার পথে গতি খুঁজে নেওয়ার – একবার নিজেকে প্রসারিত করে আহ্লাদীর জন্য প্রস্ত্তত থাকতে চাওয়া, এই দুই বৃত্তির মধ্যে যে দোলাচল তাও কি একমাত্র সত্য? অন্য সত্য কি নেই? যে অনাম্নী 888sport promo codeটিকে দেখে গুরুদয়াল আহ্লাদীকে পাবার দুর্দম রোমান্টিক আকাঙ্ক্ষাটিকে দমন করেছে, মনে করেছে ‘এটা বড় অসহায়’, তাও কি প্রেমজাতীয় মনস্তত্ত্বব নয়? সুতরাং গুরুদয়ালের কান্না সম্পর্কে শেষ কথা না লিখে অদ্বৈত সম্ভাবনার যে নতুন দ্বার খুলে দিলেন, পাঠক-সমালোচকের মনের সেই নিভৃতেই গুরুদয়াল আহ্লাদীর পরস্পরের দিকে অপার বিরহ বেদনায় চেয়ে থাকায় কান্নাটি আভাসিত হয়। আর এইভাবে দেখলে বলতে হবে, অদ্বৈত বাংলা ছোটগল্পের কালান্তরের 888sport live chatী – আধুনিকতার মনস্তত্ত্ব বিচারের প্রাচীরটি তিনি অনায়াসে অতিক্রম করে গেছেন।’ (অচিন্ত্য বিশ্বাস, ‘প্রসঙ্গ অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও তিতাস একটি নদীর নাম’)
‘বন্দী বিহঙ্গ’ গল্পের মূল চরিত্র কলকাতা প্রবাসী আবু মিঞা একটি সাপ্তাহিক কাগজের সহকারী সম্পাদক। সারা সপ্তাহের খবরগুলো ছোট করে লেখা থেকে শুরু করে প্রুফ পড়া ও সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত অনেক কাজ তাকে করতে হয় তবে কাগজে তার নাম থাকে না। জমিলা তার চমৎকার চিঠিতে আহ্লাদের খোঁচা দিয়ে লেখে, ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার! সম্পাদক কে? না কাগজটার মালিক। সবকিছু তুমিই করছো আর তোমার নামটাই ওরা ছাপতে পারছে না’ – এরপর জমিলা জানিয়েছে যে, পাড়ার মেয়েদের কাছে এ-খবরটা সে চাউর করে দিয়েছে। তার স্বামীই আসল এডিটর। এই সঙ্গে জমিলা জানিয়েছে যে, কথাটা সবাই বিশ্বাস করেনি। না করুক, জমিলা তো খুশি। স্বামীর কৃতিত্ব সে জাহির করবে না? তাছাড়া লোকের কত অভাব, দুবেলা হাঁড়ি চড়ে না। কিন্তু তাদের তো অভাব নেই। আর শুধু খাওয়াটাই তো সব নয়। এবারে নিজের দুঃখের কথা বোনে জমিলা। এত জ্ঞান রাখে তার স্বামী শুধু তার মনের কথাটাই বোঝে না। আবু মিঞা বোঝে সবই কিন্তু সে যে বন্দি বিহঙ্গ।
এ বন্দি বিহঙ্গের মন জুড়ে থাকে তার গ্রামের খোলা আকাশ আর মেঘেদের আনাগোনা। গল্পের শুরু হয়েছে ঋতুচক্রের এক অসাধারণ বর্ণনা দিয়ে, যে-বর্ণনা আবু মিঞার মনের বেদনাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়। নিজের চেয়ারে বসে জানালার ওপরে দু-তিনতলা বাড়িগুলোর ওপর দিয়ে যেটুকু আকাশ দেখা যায় তাতে যখন মেঘ করে আসে, তখন আবুর মনে পড়ে নিজেদের বিশাল আকাশটার কথা যেখানে ঈশাণ কোণে অাঁধার করে মেঘ জমে আর পুকুরের জলে নেমে আসে তার কালো ছায়া। অতটুকু ছোট পুকুরের বুকে এত বড় কালো ছায়া ধরে না বুঝি হায়! আর একজন যদি তখন ওই খড়ো ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় তার মনেও কি ওরকম একটি বড় ছায়া ধরি-ধরি করে উপচে ওঠে না – সে কি অনেক দিনের অনেক কথা… ভাবে না।
বর্ষার এমন একটি বর্ণনার আগে আমরা জ্যৈষ্ঠের বাউল বাতাসে শুকনো পাতা ওড়ার ছবি পেয়েছি, শূন্যতায় বিহঙ্গের খাঁ-খাঁ করে ওঠা বুকের ভেতরটা দেখেছি। তারও আগে রংঝরা ফাল্গুনে তার মনে দোলা লাগতে দেখেছি। কিন্তু বর্ষার পরে শরৎ না এসে এলো রমজান মাস। এবং এ-মাসের পবিত্রতা ও পূর্ণতার বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, সময়টা বর্ষাই বটে। যেমন ‘দিনগুলি দীর্ঘ মনে হয় না, কাজ ফুরোয়, ফুরোয় না কেবল আনন্দের একটা আবেশময় মাধুরিমা।’ আমরা জেনে যাই যে, বছরে এই একটি মাসে ঈদ উপলক্ষে আবু মিঞা পনেরো দিনের ছুটি পায়। এখানটায় এসে গল্পের ঘাটে নতুন করে পা রাখেন লেখক। এ-বছর ছুটিতে আবু মিঞার দেশে যাওয়া হলো না। অসুস্থ ছিল, ওষুধপথ্যে হাতের টাকা ফুরিয়েছে। এখন গাড়ি ভাড়া কে দেবে আর খালি হাতে যাবেই বা কী করে? অতএব বন্দি বিহঙ্গকে স্বপ্ন দেখতে হয় এবং সেটিই গল্প।
আসে হেমন্ত। আমরা শরতের অনুপস্থিতি লক্ষ করব। ঝকঝকে-তকতকে শরৎ আবু মিঞার বেদনার ভার নেবে কি করে? আবু মিঞার রুগ্ণ, বিরহী মন বরং হেমন্তের স্বল্পজীবী সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেয়। কড়া বিদ্যুতের আলোয় অনেক রাত অবধি কাজ করে রেসের ঘোড়ার মতো ক্লান্ত আবু মিঞা মেসে ফিরেই পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে কারণ জমিলার চিঠি এসেছে। জমিলার চিঠি যত দীর্ঘ ততো ভালো কারণ ‘জমিলার লেখার শক্তি অসাধারণ।’ জমিলা তো চিঠি লেখে না, জমিলা ছবি অাঁকে। পুকুরপাড়ে আলো-ছায়ার খেলা, উঠানে (অদ্বৈত উঠোন লিখছেন না) পড়ন্ত রোদের যাই-যাই ভাব, বন-বাদাড়ে পাখ-পাখালির কলরব – এসব তো আবু মিঞা জমিলার চোখ দিয়ে দেখে। বিশেষ করে ছেলে দুটির নষ্টামি-দুষ্টুমির কথা কী লোভনীয় করেই না লেখে! চিঠি পড়ছি না নিজের চোখে দেখছি, ভুল হয়ে যায় অনেক সময়।
আমরা এই সূত্রে লেখার শক্তি-সৌন্দর্য সম্পর্কে এক লেখকের অভিমত জেনে যাই। জমিলা লিখেছে, ‘খোকা দুটি মূর্খ হয়ে রইল, মেয়েটা আহাম্মকের একশেষ।… এতটুকু বাচ্চা মেয়ে – তোমার কথা উঠলে এমন করে কোনো একদিকে চেয়ে থাকে যে মনে হয় কোনো সুদূর বুঝি তাকে ডাকছে…।’ ছেলেদের কীর্তি-কাহিনির বর্ণনা জমিলা এমনভাবে দেয় যে লেখক বলেন, ‘এত বেড়ে হয়েছে যে একবার পড়ে মন থেকে সেটাকে বের করতে ভালো লাগে না – এমন করে লিখেছে যে অাঁখড়ে অাঁখড়ে (অক্ষরে অক্ষরে নয়) না পড়লে পুরাপুরি (পুরোপুরি নয়) তৃপ্তি আসে না।’ আমরা এও লক্ষ করবো যে, কলকাতার কাগজের সহকারী সম্পাদক আবু মিঞার নয়, এ বানানরীতি জমিলার, যে-জমিলা পূর্বদেশের মেয়ে। এবং এ-চিঠির প্রাপক আবু মিঞাও এ-অঞ্চলের বানানরীতিটিই অনুসরণ করে লিখছেন।
স্ট্যালিনগ্রাডে নাৎসি অভিযানের খবর-সংক্ষেপ লিখছেন আবু মিঞা। জমিলার চিঠি তাঁর বুকপকেটে। গল্পকার লিখছেন, ‘অচেতন মনকে ছেড়ে দিয়ে কেবল হাতে পাওয়া মনটাকে নিয়েই’ এসব খবর লেখা যায় কিন্তু যখন কোনো পিতা-পুত্রের নিখোঁজ হওয়ার খবর লেখাতে আসে তখন মনটা ‘পশুপতি গ্রামের ছায়াঘেরা পুকুরের পাড়ে, পেয়ারাতলায় কামরাঙা গাছের ছায়ায় রোগা-পটকা দুটি শিশুর অন্তহীন দুষ্টামি (দুষ্টুমি নয়) এবং সংসারের জন্য খেটে খেটে নাস্তানাবুদ মহিলার কাছে ছুটে যায়। মহিলা যদি কখনো কোনোদিন ছেলে দুটোকে খুঁজে না পায়, যদি দেখে ‘ওরা নেই, পেয়ারাতলায় নেই, কোথাও নেই আর সে খবরটা চিঠিতে এলে কেমন লাগবে আবু মিঞার?’ হাতের কলম বন্ধ হয়ে যায় তার। বুকটা খচখচ করে। চারদেয়ালের ঘেরে বন্দি আবু মিঞার চোখ জানালা দিয়ে জুবেনাইল জেলের উঁচু পাঁচিল দেখে। দেখে তার ওপরে কাঁটাতারের সারি। এখানে বন্দি ছেলেরা পালাতে পারে না। তার ছেলেরাও পালাবে না। ওরা থাকবে ‘আমার আর জমিলার বুকে।’
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হয়নি। আরেকটা চিঠি আসে জমিলার। আবু মিঞার উদ্বেগ, পাঠকের রুদ্ধশ্বাস কৌতূহল হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে জমিলা এক বন্দি বিহঙ্গের মুক্তির গল্প শোনায়। ছেলেটা খাঁচায় আটকে রেখেছিল একটা পাখিকে। পাখিটা কেবল ছটফট করে। ওদের মেয়েটা খাঁচার দরোজা খুলে পাখিটাকে মুক্তি দিয়েছে। জমিলা সে-মুক্তির গান শোনায় আবু মিঞাকে।
এ-জমিলাকে অদ্বৈত কোথায় পেলেন? তিতাসের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া তাঁর অসাম্প্রদায়িকতা আমরা দেখেছি। কিন্তু 888sport promo codeরা সেখানে ছিলেন অনাম্নী। কারো মা, কারো মাসি-পিসি, কারো বিধবা। গল্পে জমিলার আগে এক আহ্লাদীকে আমরা পেয়েছি। প্রথমত পরমা সুন্দরী সে। দ্বিতীয়ত গুরুদয়ালের (‘কান্না’ গল্প) মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া – তাকে নামধারী করেছেন লেখক। জমিলা একে মুসলমান মেয়ে, উপরন্তু ভালো লেখে। আমাদের মনে পড়বে দৈনিক আজাদের বার্তা-সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাবেবর ও তাঁর স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের সঙ্গে অদ্বৈত মল্লবর্মণের প্রীতিমধুর সম্পর্কের কথা। হোসনে আরা শিশু888sport live footballিক ছিলেন।
রচনাসমগ্রে গ্রন্থিত শেষ গল্প ‘স্পর্শদোষ’ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক দুঃসাহসী গল্প। বাংলা 888sport live footballে এটি এক অভিনব সংযোজন, এখনো। ‘স্পর্শদোষ’ দুটি জীবের গল্প। এদের একজন কুলি-মজুর বা ভিখিরি শ্রেণির; তার বেশভূষাও তাই বলে। এদের মানুষ না ভাবলেও চলে। অন্যটি একটি কুকুর – নিতান্তই পথের খেঁকি, বড়লোকের বাড়ির আদুরে নাদুসনুদুসটি নয়।
নিউ পার্ক স্ট্রিটের উত্তর দিকের ফুটপাত আর বাঁদিক থেকে আসা একটি অতি সরু গলির সংযোগস্থলে এদের একজনের হাঁটুর সঙ্গে অন্যজনের লম্বা থুঁতনির সজোর এক ধাক্কাপাতে যে স্পর্শদোষ ঘটে গেল এ তারই গল্প। খেঁকি বারবার ঘাড় বাঁকিয়ে সংঘর্ষের সঙ্গীকে দেখতে-দেখতে পথ চলল। ভজাও হাঁটুর আঘাতের জায়গায় হাত বুলিয়ে খেঁকির দিকে চাইতে-চাইতে গন্তব্যে চলে গেল।
হিটলার প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ করেছে; 888sport appsে বেড়েছে কাগজের দাম। বেড়েছে কুড়নো কাগজের চাহিদা। ভজার ইদানীংকার পেশা তাই। জ্যৈষ্ঠের দুপুর; রাস্তার কলের জলে আগুন। সেই খেয়ে ভজারা আবার যখন মোট মাথায় তুলে স্থানান্তরে যাওয়ার জন্য তৈরি, তখন এক তেলেভাজাঅলার খাবারের ডালায় ভজার দৃষ্টি বিঁধে গেল। পঁয়ত্রিশের ভজা খাবার দেখলে পাঁচ বছরের বালক হয়ে যায়। কী হলো ভজার, মাথার মোট ফেলে দিয়ে খেঁকির সামনে চারপেয়ে সারমেয়র ভঙ্গিতে বসে পড়তেই খেঁকি গলিপথ ধরে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটি ছিল তাদের দ্বিতীয় দফার সাক্ষাৎপর্ব। প্রথম দফায় ভজাকে নিজের খাবারের ঠোঙাটি খেঁকির মুখ থেকে একরকম কেড়ে নিতে হয়েছিল বলে ভজা বিকট ধমকে খেঁকিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। অল্প দূরে বসে খেঁকি সেদিন করুণ চোখে ভজার খাওয়া দেখেছিল। আহারের পর খালি ঠোঙাটা খেঁকির দিকে ছুড়ে মারতেই খেঁকি তেড়ে এসেছিল। মোট ছুড়ে ভজা আত্মরক্ষা করলে দ্বিগুণ বেগে তেড়ে এসেছিল খেঁকি। ভজা লড়াইয়ের গতি পরিবর্তন করে কোমর গোড়ালি পর্যন্ত নামিয়ে হাত দুটো কনুই অবধি মাটিতে পেতে খেঁকিকে অনুকরণ করে বিকট শব্দে ডেকে উঠল। ভজাকে স্বগোত্ররূপে আবির্ভূত হতে দেখে খেঁকি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল কিছুক্ষণ। এমনটি দুবার অভিনীত হওয়ার পর খেঁকি রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। অতঃপর এবারের দ্বিতীয় দফা মিলনে গল্পকার জানালেন, তাদের দ্বিতীয় মিলনও বিয়োগান্ত।
হল্যান্ড ও বেলজিয়াম আয়ত্তে এনে প্যারিস আক্রমণ করেছে হিটলার। মৈত্রীর সন্ধানে লোকের আর মন যায় না। কাগজের চাহিদা অতএব কমেছে। ভজাদের এখন কঠিন সময়। আগুনঝরা রোদের দুপুরে ভিক্ষুক ভজা সার্ধদিবসের গলাবাজির পর একটা পয়সা রোজগার হতেই ঢুকল তেলেভাজার দোকানে। দোকানের নোংরা সিঁড়ির ধাপে পা রেখে ব্যাকুল চোখে ভজার দিকে তাকিয়ে খেঁকি চোখ নত করে। দোকানের মাইনে করা ছেলেটি তখন চুরি করা জিলিপিটা মুখে পুরে কাঠের বাক্সের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে। ভজার ইচ্ছাকৃত কনুইয়ের ধাক্কাটা তখনই লাগলো তক্তার ওপর রাখা রুটির স্তূপে। রুটির তাল ড্রেনে গড়িয়ে পড়ার আগেই খেঁকি তা মুখে পুরে দে ছুট। বুভুক্ষু স্বগোত্রীয়দের এবং মানুষ ভিখিরিদের দৃষ্টি বাঁচিয়ে কবরখানার দেয়াল ঘেঁষে গাছের গুঁড়ির আড়ালে বসে কোলের কাছে রুটিগুলো রেখে খেঁকি যখন একের পর এক রুটি সাবাড় করে যাচ্ছে, তখনই ভজার আগমন সেখানে। কিন্তু রুটির ভাগ ভজা পেল না। রক্তারক্তি হবে বুঝে ভজা রণে ভঙ্গ দিলো বটে তবে একটা পৈশাচিক প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছে পূরণ করার ইচ্ছায় সে উঠেপড়ে লাগে। এরপর যতবার দেখা হয়েছে ভজা সেই সারমেয় ভঙ্গিতে তাকে ভয় দেখিয়ে উত্ত্যক্ত করেছে। প্রথম প্রথম এটাকে কৌতুক ভেবে উপভোগ করলেও একসময় খেঁকি বুঝে যায় যে, এ খেলা নয়। এ ঠাট্টাও নয়। মানবিকতার সীমা ডিঙানো চোখা দাঁতের হিংস্রতায়, বিকট শব্দে ভীত খেঁকি এরপর ভজার ছায়া দেখামাত্র ছুটে পালায়। ভজারও এমন হলো যে, দিনে কয়েকবার খেঁকিতে ভয় দেখাতে না পারলে তার দিন কাটে না।
খেঁকি যখন দিনে দিনে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, লোকে তার অনাহারটা দেখল ঠিকই। গল্পকার বলেন, এ-সমাজে কারো মাথা ভাঙলে লোকে দেখে কিন্তু বুক ভাঙলে কেউ তা দেখে না, তার খোঁজও রাখে না। তারা কী করে বুঝবে যে, না খেয়ে মরার চেয়ে সে আরো সাংঘাতিক। এ-গল্পের শুরুটা যখন আরেকবার মনে পড়বে পাঠকের। দারিদ্র্য নিয়ে কিছু দার্শনিক গোছের কথা দিয়ে গল্প শুরু হয়েছিল। অদ্বৈত বলেছেন, দরিদ্র হওয়া কষ্টকর নয়। দারিদ্রে্যর কুয়াশার ফাঁক দিয়ে প্রাচুর্যের প্রতি ব্যর্থ চাহনিটাই জ্বালাময়। এর সপক্ষে তিনটে দৃষ্টান্ত দিয়েছেন তিনি। এক. তাচ্ছিল্যের দু-একটি ভিক্ষের পয়সা কুড়িয়ে নিয়ে যে চলে যায়, তাকে নিয়ে বিশেষ কেউ ভাবে না। কিন্তু বুকজোড়া বুভুক্ষা নিয়ে খাবারের দোকানের কাচের দরোজার ওপারে সুখাদ্যের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে বুকটা খচ করে ওঠে। দুই. যে-পল্লিবধূ গঞ্জনাসম্বল নিরন্ন দিন কাটায় তাকে দেখে ব্যথা পাই বা না পাই যে-বউ শাশুড়ি-রক্ষিত সুখাদ্য চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, সে আমাদের সহানুভূতি পায় বেশি। তিন. অভাব নিয়ে যারা বাঁচে, অভাব তাদের গা-সওয়া। বৈদান্তিকের তারা নির্মল প্রশংসার অধিকারী। অভাব নিয়ে যারা কাঁদে, মানুষের বুকে তারা আঘাতের পর আঘাত হানে। তিনি বলেন যে, কে জানত দুটি জীবের জীবনে এ-সত্য প্রতিফলিত হওয়া সম্ভব। আর একটু এগিয়ে গিয়ে বললেন যে, বুভুক্ষা শুধু উদরের নয়, মনেরও আছে। মনের বুভুক্ষা চায় প্রেম; আর প্রেম চায় স্পর্শ। অতঃপর আমাদের দেখার ও ভাবার বিস্ময় এখানেই যে, ‘স্পর্শদোষে’র মতো একটি গল্প তিনি লিখেছেন।
এ-গল্পের সমাপ্তি টানার জন্য আর বেশি সময় তিনি নেননি। ভজার তাড়া খেয়ে প্রাণপণে ছুটতে-ছুটতে এক বিশাল বাড়ির একপ্রান্তে একান্তে ঝোপঝাড়ের আড়ালে সারাদিন লুকিয়ে রইল। সন্ধ্যার মুখে শেষবারের মতো আবার ভজাকে দেখে সে আর প্রকৃতিস্থ রইল না। লাফ দিয়ে পথে নেমে এক পথচারীকে কামড়ে দিয়ে সে রাস্তা ধরে ছুটতে থাকে। পরদিন সন্ধ্যায় একটি মৃত কুকুরের দেহ ঘিরে কিছু তরুণের রণজয়ের আনন্দ অনুসরণ করে রক্তাক্ত মাথা ও শলাকাবিদ্ধ চোখের খেঁকিকে দেখে ভজা। উৎসুক জনতার উদ্দেশে ওই তরুণদেরই একজন তখন বিবরণ দিয়ে চলেছে, কীভাবে ওই পাগলা কুকুরটি একের পর এক পথচারীকে কামড়ে দিয়ে নিজেও মরল। ভ্রূক্ষেপহীন ভজা বীরদর্পে এগিয়ে গিয়ে খেঁকির মৃতদেহটি বুকে তুলে নীরবে চলে গেল। অপস্রিয়মাণ ভজার প্রতি এক হিন্দুস্তানির ভাঙা বাংলায় গল্পের শেষ বাক্যটি বর্ষিত হলো : ‘এ ভি পাগল হোয়ে গেছে।’
এ-গল্পটির সামনে বড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের উত্তাল জাগরণের আশঙ্কা লেখকের ছিল হয়তোবা। সেজন্যে শুরুতে তিনি সুর বাঁধার মতো করে কৈফিয়ত বেঁধে নিয়েছেন। এবং শেষে হিন্দুস্তানির ভাষ্যে হালকা করে দিয়েছেন পরিবেশ। গল্পের গড়িয়ে পড়ার কোনো পথ তিনি রাখেননি। বাংলা ছোটগল্পে এ-কোনো অভিনব গাঁথুনিমাত্র নয়; এ এমন এক নতুন পথ, যে-পথে লেখকের এ-এক অসামান্য পদযাত্রা, শতবছরে যে-পথের ছায়া মাড়াতে আমরা আর কাউকে দেখিনি, এ-এক দুর্দান্ত সাহসের গল্প। তাঁর সততার, অভিজ্ঞতার ও উপলব্ধির সাহস। সেইসঙ্গে প্রকাশের সাহসও বটে। জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলি কতটা মুখব্যাদান করে থাকলে এমন গল্প হয়? শতবছরে মানুষের দুরবস্থা বা মর্মবেদনা তো শতগুণ বেড়েছে; কিন্তু এমন গল্প আর হয়েছে?
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘আশালতার মৃত্যু’ গল্পটি এখানে গ্রন্থিত হয়নি। শান্তনু কায়সার সম্প্রতি তাঁর আরেকটি গল্প সম্পর্কে জানিয়েছেন আমাদের। (‘অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিয়ে 888sport live football পরিক্রমা’, দৈনিক ইত্তেফাক, 888sport live football সাময়িকী, ২.১.২০১৫) গল্পটির পটভূমি কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি ফকিরহাট রেলস্টেশন, যেখানে গল্পের বর্ণনামতে দিনে পাঁচবার ও রাতে তিনবার ট্রেন যাতায়াত করে। টিকিট চেকার নায়কের তবু স্টেশনে যাওয়ার সময় হয় না। আত্মজৈবনিক এ-গল্পের নায়কের মতো কলকাতাবাস ছেড়ে গল্পকারেরও আর গোকর্ণঘাটে আসা হয় না। শান্তনু কায়সারকে উদ্ধৃত করে শেষ করছি : যে-জায়গাকে তিনি নির্বাসনে পাঠিয়েছেন অথবা নির্বাসনে থেকে সততই যাকে তাঁর মনে পড়েছে গল্পে, তাকে তিনি তুলে এনেছেন। স্বপ্ন-বাস্তবতার এই মধুর আনন্দ-বেদনায় তিনি বসবাস করেন। তাকে ভুলে যাওয়ার ভ্রান্তি অথবা স্পর্ধা যেমন তাঁর, তেমনি আমাদেরও নেই।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.