চলার পথে, চলতে চলতে

মোহাম্মদ আযাদ

রেলওয়ে স্টেশনে আজ অনেক ভিড় লেগে আছে। টিকিটগুলো তিনদিন আগেই শেষ। এখন কেবল স্ট্যান্ডিং টিকিট। সেটিও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। ছুটির দিন ভোরবেলা এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। স্টেশনে দাঁড়িয়ে অনিকের মনে হলো, প্রতিদিনের জীবন যেন জীবনকেই তুড়ি বাজিয়ে মেতে উঠছে সময়ের ধাঁধায়, যেখানে নির্দিষ্ট কোনো বাঁধন নেই। গাড়ি ছাড়তে এখনো দশ মিনিট বাকি। সোজা ভেতরে চলে গেল অনিক। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সামনে সমান্তরাল রেলপথ। ওদিকে চোখ পড়তেই শরীরটা কেমন মুচড়ে ওঠে। নিজের কাছে কেবলই মনে হতে থাকে, ও বুঝি প্রথম যাত্রী। সকল যাত্রীর থেকে বিচ্ছিন্ন কিংবা সকলকে ডিঙিয়ে ও একা-একা দেখতে পাচ্ছে প্রাত্যহিক চলমানতা; যেখানে মানুষ হয়েও মানুষকে মেলানো যায় না। কেবলই 888sport sign up bonusভরা অতীত, নয়তো অতীতের পিছুটানে বুকের ভেতর থেকে রক্তগুলো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অনিকের সামনে পথ থাকলেও পথকে ঘিরে এখনো সমান্তরাল গতিময়তায় ছুটে চলছে অনুভবের খেলা, কোনো এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে স্পর্শ করতে গিয়ে ফের সমান্তরাল।

প্রায় এক ঘণ্টা পর ইঞ্জিন এসে লাগে। মানুষগুলো সামনে-পেছনে ছুটছে। বগির ভেতর বসে থাকা অনেকের মুখেই স্বস্তি। বিলম্বের জন্য বিরক্তির ক্ষীণ একটা রেশও কাজ করছে। ঘটনাক্রমে পরিচিত অনেকে দৃষ্টিবদল করলেও আন্তরিকতার প্রশ্নে কোনো সরস উপলব্ধি নেই। মানুষের প্রাণগুলো যেন প্রাণস্পর্শী, হুইসেল বাজিয়ে ছুটে-চলা ট্রেনের মতোই সতত গতিময়। মুখোমুখি সিটে বসেছে একজন মহিলা, কোলে শিশু, তার পাশে বসা শীর্ণকায় লোকটি চরম বিরক্তি নিয়ে উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে আছে। শিশুটি কেঁদে ফেলতেই লোকটি সামান্য বিচলিত হয়ে বলে, ওরে থামাও।

থামাইতাছি, ওয়া ওয়া, এই যে বাবা!

যেন খাদ থেকে উঠে এলো কণ্ঠস্বর। শিশুটির কান্নার কাছে কেমন একটা ভীতিকর সরল অস্বস্তি, তবু বুকে চেপে ওয়া ওয়া করতে থাকে। বগির ভেতরে বেশ গুমোট একটা অবস্থা। অনেকেই দরদর করে ঘামছে। যাত্রাপথের ভোগান্তি নতুন কিছু নয়, কিন্তু প্রতিবারই অনিকের মনে হয়, এ যেন নতুন দেখা! চলাচলের ভেতর আনন্দগুলো বদলে যেতে থাকে বিদ্বেষে।

শিশুটিকে কোলের ভেতর নড়াচড়া করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কিছু সময়ের জন্য মহিলাকে নির্ভার দেখায়। মাথার কাপড়টা টেনে অনিকের চোখে একপলক দৃষ্টি পেছনে বাইরে তাকায়। অনিকের মনে হলো না মহিলা কিছু দেখছে। বরং তার চোখ দুটিতে সংক্রমিত হচ্ছে ভারাক্রান্ত সময়ের গভীরতা, ধীরে ধীরে সন্তানের দিকেই সস্নেহে ঝুঁকে পড়ে। অনিক নিজেও দৃষ্টি উদোম করে প্রগাঢ় শূন্যতার দিকে তাকিয়ে বহুদিন খলখল করে হেসেছিল, সেটিও অল্প সময় মাত্র। কখনো সবকিছু এলোমেলো মনে হলে, আত্মবিশ্বাসের প্রাবল্যে হাসিটাকে এখনো ঠোঁটের কোণে মেলে দেয়। হোক তা মেকি হাসির অপ্রীতিকর রূপক কিংবা অন্যকিছু।

শিশুটি হাত-পা গুটিয়ে ঘুমোচ্ছে। একটুও নড়ছে না। এরকম সরল বাচ্চা মুখের দিকে অপলক তাকাতেই অনিকের অন্তঃকরণ টনটন করে। ভীষণ মায়া জাগছে। অতীতের কিছু কিছু 888sport sign up bonusকাতর দোলা মনে ভীষণ রেখাপাত করে। বর্তমান ঘটনাপ্রবাহে চলে অদ্ভুত সব হিসাব-নিকাশ। সময়ের আপেক্ষিক বিচারে কখনো কখনো জীবনের ছন্দ এলোমেলো হয়ে যায়। তখন সম্ভবত এই মায়াকেন্দ্রিক শিশুটির মুখে তাকিয়ে,  অন্তঃকরণে চলে কষ্টের নীরব শৈত্যপ্রবাহ, অনিক মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকায়।

মহিলার পেছনের সিটগুলোতে কয়েকজন যুবক হই-হল্লা করছে। নানারকম কথার সঙ্গে অট্টহাসি, তুড়ি অভ্যন্তরীণ গুমোট পরিবেশে যা উপদ্রবের মতো। ডানে-বাঁয়ে অনেকেই ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে। ছয়টি সিটে ওরা দশজন। চাপাচাপি করে বসলেও প্রত্যেকের চোখে-মুখে টলমলে আনন্দ। বিভিন্ন স্টাইলের কথা শেষ হতে না হতেই সম্মিলিত স্বরে হো-হো হাসির শব্দটা শান্ত জলপৃষ্ঠে আচম্বিতে ঢিল পড়ার মতো। মানুষেরা ফের ঘাড় বাঁকায়। অসহায় মুখ, ঠোঁটের কোণে বিতৃষ্ণা, আত্মকেন্দ্রিক জীবনের দায়বদ্ধতায় প্রতিবাদের বিষয়টি যেন-বা অবান্তর। অদম্য দুঃসাহস নিয়ে ছুটে চলা মানুষগুলোও একসময় ঘাড় মটকে পেছনের পদচিহ্নটাকেই খুঁজে নেয়।

ইঞ্জিন স্টার্ট নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যাটফর্মের কোলাহল ক্রমশ পেছনে সরে যেতে থাকে। বেশ ঝরঝরে লাগে অনিকের। স্টেশনের শেষ মাথায় উদোম করা পেটে একহাত চেপে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নিরুত্তাপ বালক। সামনে উজ্জ্বল দৃশ্যপটের সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে ঢোকে একঝলক বাতাস। ঘামগন্ধের শরীরে হিমায়িত রেশ, এ যেন বহুদিনের প্রত্যাশা – এরপর কত কি! খিলগাঁও রেলগেট থেকে এলোপাতাড়ি দৃশ্য থেকে দৃশ্যের অন্তর্গত রূপটা কেমন যেন 888sport app পড়ে যায়। গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলছে চোখ, নয়তো চোখের খেলা। বহুদিন পর রেলপথে অনিকের যাত্রা। আগে যদিও-বা মায়ের পীড়াপীড়িতে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এক লাফে বগির হ্যান্ডেল চেপে ধরতেই দেহে গতিসঞ্চার হতো, ছেলেমানুষি-আবেগের দুঃসাহস নিয়ে প্রতিটি পথের সমতল কিংবা উঁচু-নিচু বাঁকে দেখতে পেতো রোমান্টিকতা। এখন পুরোটাই বিপরীত। রোমান্টিক বলতে যা কিছু ছিল আলোকিত, এখন তাতে ভাঙনের খেলা চলছে। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বিষাদ-অনুভূতি। চলমান ট্রেন একটার পর একটা স্টেশন পেছনে ফেলে শেষ গন্তব্যের নেশায় ফোঁস্স্স্ শব্দ তুলে সিটি বাজায়, পুরো ব্যাপারটাই যেন আধুনিক। যদিও এরকম চলমানতায় আজ অস্তিত্বের পরিণত গন্ধটাই নাকে লাগে বেশি। অনিক ম্যাগাজিনের পাতা উলটাতেই মহিলার পাশে বসা ভদ্রলোকটি বলল, জানালাটা বন্ধ কইরা দেন।

রীতিমতো আদেশ। অপ্রস্ত্তত হয়ে তাকাল অনিক, কিছু বললেন?

জানালা বন্ধ কইরা দেন, বাচ্চার বাতাস লাগে।

ওহ!

আপনের অসুবিধা অইব?

না, ঠিক আছে।

অনিক জানালা বন্ধ করে দেয়। কাচের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে পড়ল মেটে আলো। মহিলা কিছুটা বিব্রত, ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন হাসি বুঝিয়ে, বাচ্চাটাকে বুকে জাপটে রেখেই কয়েকটা দুলুনি দিলো। বাচ্চাটি এখন পিটপিট করে তাকাচ্ছে। অকস্মাৎ একসঙ্গে হো-হো করে হেসে ফেলে যুবকগুলো। বাচ্চাটি কেঁদে ফেলে। অপ্রস্ত্তত হয়ে মানুষগুলো ফের ঘাড় বাঁকায়। মহিলার স্বামীও একপলক তাকিয়ে কঠিন মুখে বিড়বিড় করতে থাকে। কারো দিকে ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই। হাসি ভেঙে কথার পৃষ্ঠে ফের কথা ছুড়ে দিচ্ছে। ফুর্তির আবেগাপ্লুত কণ্ঠস্বর হয়তো কোনো স্টপেজ মেনে চলে না। সিগন্যালবার নেমে পড়লেও বয়স কিংবা যুক্তির আপেক্ষিক বিচারে উল্লাসটাই প্রশ্রয় পাচ্ছে বেশি।

ট্রেনে ইদানীং ইচ্ছে করেই খুব কম চলাচল করে অনিক। আন্তঃনগর এক্সপ্রেসগুলোতে এখন ভিখারির চাপ, সেইসঙ্গে ঘন ঘন ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক, সবটাই উপদ্রবের মতো লাগে। তবে স্টেশনের অদূরেই জুবিলি রোডে ওদের বাসা। ছোট সময় কখনো গভীর রাতে ঘুম কেটে গেলে, ট্রেনের সিটির শব্দ কানে এলে, বিছানায় গুটিসুটি মেরে ভীষণ আনমনা হয়ে যেতো। কেমন একটা প্লেটোনিক ভালোবাসার মতো, যা দুর্বোধ্য হলেও কল্পনার জগৎকে টেনে নিয়ে যেতো অনেকদূর। আরেকটু ব্যাখ্যা করলে বলতে হয়, উদ্দেশ্যহীন ভালোলাগার অন্তর্গত চমক নিয়ে কেউ বুঝি অপেক্ষা করছে। চলাচলের পথ সংক্রমিত হতে হতে সামনের দৃশ্যপটে জেগে উঠতো কত রকম অনুভূতির খেলা!

স্কুল ডিঙিয়ে তখন কলেজে উঠেছে অনিক। স্টেশনের একটু সামনে রেললাইনের পাশে ছিল নিউ কলোনি। ওখান থেকে সামসাদ নামে একটি মেয়ে কলেজে আসতো। কয়েকদিন কথা বলার পর অনিকের নিয়ন্ত্রিত আবেগে জেগেছিল সূক্ষ্মদর্শী মনন। নিজেকে নিজের ভেতর বেমালুম চেপে মূলত মধ্যরাতের নীরবতায় উপভোগ করতো ট্রেনের ঝকর-ঝকর শব্দ। কেমন একটা মোলায়েম সিটি বাজিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে নেতিয়ে পড়ে ট্রেনটি। রাতের বিছানায় শুয়ে শুয়ে পুরো দৃশ্যটা যেন দেখতে পেতো অনিক। একদিন মাঝদুপুরে রেললাইনের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে নিউ কলোনি চলে আসে। ব্যাপারটি এমন, যার কোনো মানে নেই, কেবলই একটা প্রবণতা, দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহে কাঁচা আবেগ যেন আস্বাদে মোচড় দিয়ে ওঠে প্রকৃতির রূপগন্ধময়তায়। সুন্দর বাতাস ছিল তখন। সামনে যতদূর চোখ যায়, ফাঁকা রেলপথে ঝলমল করছিল মধ্যাহ্নের রোদ। হাঁটার গতিটা শ্লথ আর উদাসীনতায় বেঁকে যায়, যখন দরজা খুলে একচিলতে ফাঁকা বারান্দায় এসে সামসাদ মুচকি হাসি দেয়। অনিক নিজেও হাসে। বলে, কেমন আছো?

ভালো।

কী করছ?

কিছু না।

তুমি সামসাদ বেগমের গান জানো?

ঠোঁটের মুচকি হাসিটা গলে পড়ে সামসাদের। বলে, না।

আমি জানি।

বোকার মতো উচ্ছ্বসিত গলায় বেসুরো টান দেয় অনিক, না বোল পি পি মোরে আঙ্গনা, পানছি যারে যা –

সামসাদ থেমে থেমে হাসছে। ঠিক তখনই ডান দিক থেকে ভৈরবগামী এক্সপ্রেসের বিকট হর্ন দৃশ্যপটকে বদলে দেয়। সামসাদ পেছনে ঝুঁকে বলল, যাই।

এক মুহূর্ত দেরি না করে দরজা বন্ধ করে দেয়। বিপরীতে পুরো বাকরুদ্ধ অনিকের খেয়াল হলো, এবার ফেরা দরকার। হেঁটে হেঁটে শ্মশানঘাটের ওপর বাঁকানো রেলপথের একপাশে কিছু সময় বসে থাকে। জায়গাটা বেশ উঁচু। নিচ দিয়ে কৃষি ভার্সিটির রাস্তা। এখনকার মতো তেমন একটা গ্যাঞ্জাম ছিল না। থেমে থেমে রিকশা চলছিল, বড় গাড়ি খুব একটা চোখে পড়তো না। সামসাদের ‘যাই’ শব্দটি ইথারে কেমন প্রসারিত হচ্ছিল। যাই থেকে যা-ই-ই – অতঃপর চোখের সামনে জীবনের স্তব্ধতায় জেঁকে বসে অঢেল কুয়াশা।

নিচের রেলপথ দিয়ে তখন ধেই ধেই করে 888sport app থেকে ছুটে আসছিল ঝটিকা এক্সপ্রেস। ট্রেনগুলোর নামও ছিল সুন্দর। ঝটিকা, দ্রুতযান, ধূমকেতু, আরো কত কী। মহিলার কোলে বাচ্চাটি হাত-পা নাড়ছে। কপালের একপাশে কালো টিপ। পেছনে মাথা ঠেলে এমন উসখুস করছে, যেন ট্রেনের শাঁশাঁ গতির বিপরীতে ওর শিশুশরীর মোচড় দিয়ে নতুন কোনো পথ পেতে চায়। মহিলা বারবার দুহাতে বুকের সঙ্গে চেপে রাখে।

জানালাটা খুইলা দেন।

একই রকম আদেশের সুর ভদ্রলোকের গলায়।

কেন?

দেখতাছেন না কিমুন সিগারেট টানতাছে।

ওহ্!

ওপর দিকে টেনে টেনে জানালা খুলে দেয় অনিক। গুমোট অস্বস্তির ভেতর যেটুকু তামাকপোড়া গন্ধ ছিল, বাতাসের তোড়ে মুহূর্তেই তা মিশে যায়। অনিক ততক্ষণে ভাবছে ওর গন্তব্যের কথা। নিউ কলোনির পরই স্টেশন, এরপর পনেরো কি বিশ টাকা রিকশা ভাড়ায় জুবিলি রোড। রাজধানীর এলোমেলো কিংবা পোড়ো বাস্তবতায় জীবনের একটা ছন্দ থাকলেও কখনো কখনো মফস্বলকেন্দ্রিক জীবনের মায়াটুকু প্রচন্ড রকম 888sport sign up bonusকাতর করে তোলে। ছোট ছোট গলিপথে মিশে আছে আজন্মকালের ইতিহাস। দুঃখ, ক্লেশ কিংবা আনন্দ কতটুকু মিশে আছে ঠিকমতো বোঝা যায় না। তবে খুব ইচ্ছে করে, বলতে কি খুবই ইচ্ছে করে, সেসব গলিপথ ধরে হাত-পা ছেড়ে বহুদূর একা একা হেঁটে যেতে।

ইঞ্জিনের গতি ধীরে ধীরে কমে আসে। সম্ভবত ক্রসিং, জানালা দিয়ে মাথা বের করে তাকায় অনিক। পুরো প্ল্যাটফর্ম ঢেকে এক নাম্বার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি ট্রেন। ট্রেনজুড়ে এমনকি ছাদেও হাত-পা মেলে কিংবা গুটিয়ে বসে আছে অনেক লোক। আউটার সিগন্যালে কিছু সময় থামতেই ভেতরের কোলাহলটা আরো বেশি করে কানে বাজে।

বহুদিন গ্রাম দেখেছে অনিক, কিন্তু এভাবে কোনোদিন দেখেনি। সহসা এমন থেমে পড়ার যুক্তিটা এক অর্থে ‘পার্ট অব লাইফ’ হলেও আরেক অর্থে জীবনের অসাড়তা ভেঙে ভেঙে জীবনকেই যেন জাগিয়ে তোলা। যেমন ওই যে মাটির রাস্তা ধরে ঘাড়কুঁজো বৃদ্ধাটি হেঁটে হেঁটে বামদিকের সরু রাস্তায় ট্রেনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, তাঁকে কখনো এমন সজাগ চোখে দেখা হয়নি। সে কি বলতে পারবে 888sport appsের রাজধানীর নাম? সম্ভবত পারবে না। জীবনের অসাড়তা ভেঙে ভেঙে চকিত জীবনের দোলায় অনেক কিছুই চাপা পড়ে যায়।

ট্রেনটি শব্দহীনভাবে এগিয়ে যেতে যেতে মুহূর্তেই সিটি বাজিয়ে গলগল ধোঁয়া ছেড়ে প্রবল গতি ফিরে পায়। স্টেশনের পাশ দিয়ে দুই নম্বর লাইন ক্রস করার সময় অনিকের ফের মনে পড়ে সামসাদকে। এতদিন মেয়েটিও হয়তো একের পর এক দৃশ্যবদল করছে চলমান ট্রেনের মতো। আড়মোড়া ভেঙে কখন যে বয়সটা অবিরাম ক্লান্তির ভেতর টুপ করে আড়াল হয়ে যায়। নিজের পরিণত বয়সটাকে তখন মনে হয় বিরাট এক রহস্য। ঝুঝি-বা ধসে যাবে এখনই। আবার অন্যরকমও মনে হয়। যেখানে ভাঙনের খেলা হয় না। মানুষেরা স্বস্তি না পেলেও অন্তত বিশ্রাম খোঁজে। অনিক নিজেও বিশ্রাম চেয়েছিল, তবে সবার মতো করে নয়। ফুলদানি ফুলগুলোর মতো যা ছিল আলগা, সবার দৃষ্টিতে সাজানো ফুলদানির মতো আশ্চর্য এক ভালো লাগা!

চমকে ওঠে অনিক। শিশুটিও চমকে লম্বা স্বরে কেঁদে ফেলে। যাত্রীগুলো তেতো মুখে ঘাড় বাঁকায়। ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে কী একটা বিষয় নিয়ে এক সঙ্গে হো-হো করতে থাকে। মহিলা বিব্রত হয়ে বাচ্চাটাকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। বাচ্চাটি শরীর মুচড়ে কান্নার শব্দ আরো বাড়িয়ে দেয়। পাশের ভদ্রলোক এবার দাঁড়িয়ে খিস্তি করার মতো বাঁকা স্বরে বলে, এই যে, পাইছেন কী আপনেরা, কী পাইছেন, চুপ কইরা বসেন।

ছেলেগুলো মুহূর্তেই স্থির হয়ে একদৃষ্টিতে তাকায়।

কী হইছে?

কী অইছে বুঝতাছেন না?

না, বুঝি না।

বুঝবেন, জায়গামতো পড়লে ঠিকই বুঝায়া দিব।

তেড়ে আসে একজন। লোকটির কলার চেপে ধরে।

ওই ব্যাটা, কী অইছে তর –

কথা শেষ হতেই মুখ বরাবর সজোরে ঘুষি মারে। লোকটি টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে মাঝের সরু স্পেসে পড়ে যায়। পেছনে আরো কয়েকজন এসে দাঁড়ায়। আজেবাজে খিস্তি করতে থাকে। ডানে-বাঁয়ে সবাই নিশ্চুপ। মহিলা দাঁড়িয়ে কাঁপছে। এক হাতে কান্নারত বাচ্চাটিকে জাপটে, অন্য হাতটি ভিক্ষুকের করুণা পাওয়ার মতো সামনে মেলে বলছে, হেরে মাইরেন না ভাই, মাইরেন না –

ট্রেনের শোঁশোঁ শব্দের ভেতর মহিলার আর্তিটুকু যেন মিশে যায়। গন্তব্যকেন্দ্রিক ভালোমন্দ, কষ্ট কিংবা আনন্দে যতই বিষাদের ছায়া থাক না কেন, ধাতব বস্ত্তর চলমানতায় কোনো পিছুটান নেই। গন্তব্যটাই বুঝি চূড়ান্ত। লোকটির নাকের নিচে হালকা রক্ত জমে আছে। চোখে-মুখে সর্বনাশা প্রতিবাদের আক্রোশ, তবু নিরুত্তাপ। পাশেই মহিলাটি মুখে অাঁচলচাপা দিয়ে কাঁদছে। ছেলেগুলো ফের মেতে উঠল। একটু লঘু স্বর, কিন্তু ভ্রূক্ষেপহীন। বাচ্চাটি দীর্ঘক্ষণ কেঁদে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে।

নিউ কলোনির কাছে আসতেই ট্রেনের গতি বেশ কমে আসে। স্টেশনে ঢোকার মতো পর্যাপ্ত সিগন্যাল হয়তো পায়নি। অনেকেই নেমে পড়ছে। অনিক নিজেও কাঁধে ব্যাগ চেপে নেমে পড়ল। কেমন একটা 888sport sign up bonusকাতর বোধ মনের ভেতর এমনই মায়া বিস্তার করতে থাকে যে, যাত্রাপথের অপ্রীতিকর যন্ত্রণার বিপরীতে নেমে পড়ার যুক্তিটাই প্রকট হয়ে ওঠে। এতোদিনে নিউ কলোনির রূপ অনেকটাই বদলে গেছে। এখানে-ওখানে স্টাফদের জন্য নির্মিত হচ্ছে নতুনসব দালান। চারপাশে বেশ গাছ-গাছালি। পুরনো বিল্ডিংগুলো চেনার উপায় নেই। অনেকটা অনুমান-নির্ভর হয়ে খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত সামসাদদের বাসাটা পেয়ে যায়। একতলা বিল্ডিংয়ের একপাশটা ধসে গেছে। ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেড়ে উঠেছে নানারকম আগাছা, দেয়ালগুলোতে কেমন স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। সেই এক চিলতে বারান্দার এদিক-ওদিক অনেক দূর্বাঘাস। অনিক বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলপথের দিকে তাকালো। ট্রেনটি ততোক্ষণে স্টেশনে চলে গেছে। সামসাদের মতো মুচকি হাসি দিয়ে বলল, যাই।

চমকে উঠে অনিক। কী সুন্দর উজ্জ্বল-আলোয় মায়াঘন প্রকৃতির কোলে প্রসারিত হচ্ছে ‘যাই’ শব্দটি। যেন সরল বালকের মতো সত্যদর্শী, কখনো-বা অতীত-জাগা বিস্ময়, কাঁধে ফের ব্যাগ ঝুলিয়ে সামনে চলার নতুন তাগিদ টের পায় অনিক।

মধ্যাহ্নের চড়া রোদে ততক্ষণে হাওয়ায় খেলা জমে উঠেছে বেশ