চা-বন্দনা

ঘুম ভাঙলে সকালবেলা 

গরম চা চাই এক পেয়ালা 

না-পেলে চা মেজাজখানা তিরিক্ষি হয়

উথলে ওঠে মনের জ্বালা।

সাব-এর মেজাজ বিবির মেজাজ 

বাড়ে দ্বিগুণ গলার আওয়াজ 

ঠিকা-ঝি আর চাকরকে কয় চা কর দ্রুত –

কণ্ঠে নাগা লঙ্কার ঝাঁঝ।

আন জলদি ধোঁয়াটে চা

গরম চায়ে মেজাজ বাঁচা

কী করিস রে রান্নাঘরে সকাল থেকে 

হারামজাদি, গাধার বাচ্চা। 

সাব’রা কি আর ভেবে দেখে 

সস্তা শ্রমিক কী শ্রম রাখে

চায়ের দেশে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির 

উৎপাদনের বাঁকে বাঁকে! 

এক পেয়ালা লালচে চায়ে

অর্ধাহারী কত মায়ে

শুকনো রুটি, নুন-চা গিলে

কপালের ঘাম ঝরায় নিত্য রুক্ষ পায়ে।

                             – স্বরচিত

চা নিয়ে সপ্তকাণ্ড রচনার আগে শুরুতেই দেখে নেওয়া যাক, চা শব্দটি তার একাক্ষরিক দেহে অর্থে ও ভাবে ধারণ করেছে কত বৈচিত্র্য! জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান থেকে জানা যায়, চা শব্দটির ছয়টি নিম্নরূপ ভিন্নার্থক ভুক্তি আছে :

চা – সংস্কৃতজাত বিশেষ্য পদ। স্পৃহা > ছিহা > ছা > চা। অর্থ : ইচ্ছা, অভিলাষ, বাসনা, বাঞ্ছা।

চা – চীনা শব্দ, বিশেষ্য পদ। চা-এর পাতা দিয়ে তৈরি পানীয়বিশেষ।

চা – হিন্দি ভাষার শব্দ, বিশেষণ পদ। অর্থ : অল্প, ঈষৎ, তুল্য, সদৃশ।

চা – ফারসি শব্দ, বিশেষণ পদ। অর্থ : ছোটো, ক্ষুদ্র। ক্ষুদ্রার্থে প্রত্যয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় – বাগিচা, গালিচা, কালচা, লালচা ইত্যাদি।

চা – সংস্কৃতজাত শব্দ। √চক্ষ্ > চকখ > চাখ্ > চাহ্ > চা। অর্থ : চক্ষুজ্ঞান, দেখ, লক্ষ কর।

চা – সংস্কৃতজাত শব্দ। √বাঞ্ছ থেকে। অর্থ : বাঞ্ছনীয়, যাচ্ঞা করা, বাসনা করা।

মাথায় গোল-বাঁধানো ব্যাকরণ ও শব্দের এত্তা জঞ্জাল-এ

না-ঢুকে আমরা কেবল চীনা শব্দটির দিকে চোখ রাখি, যা এখন বাঙালির জনপ্রিয় ও মহার্ঘ পানীয়।

মহাভারত-এর আখ্যান-বিস্তৃতি, ভাবের গভীরতা ও মহাকাব্যিক ওজস্বিতার কথা বোঝাতে এমন একটি কথা প্রচলিত আছে যে, যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভারতে। একথাটি ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে, অত্যুক্তি হবে কি না জানি না – যা নেই রবীন্দ্রনাথে, তা নেই বাঙালির চিত্তে। এ-কথা মনে এলো চায়ের প্রসঙ্গে। মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথের কথা888sport live footballে চায়ের প্রসঙ্গ অল্পস্বল্প এসেছে কিন্তু চা নিয়ে যে তিনি হাস্যরসাত্মক  একটি গান লিখেছেন এবং তা গীতবিতানে সংকলিত, তা আমাদের অনেকেরই নজরে আসেনি!

এ-বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে কলকাতার রবীন্দ্রসংগীত888sport live chatী কৌশিক মজুমদারের একটি ফেসবুক-স্ট্যাটাস পড়ে। সেদিন ছিল ২১শে মে ২০২৩ – জাতিসংঘ-ঘোষিত আন্তর্জাতিক চা দিবস! খুব বেশি আগে নয় – ২০১৯ সালে এই দিবসটি ঘোষিত হয়েছে। সেখানে কৌশিক রবীন্দ্রনাথের চা-সংগীতটির পটভূমি সম্পর্কে যৎসামান্য বর্ণনাও দিয়েছেন। কবিগুরু-যে চা-পান করতেন, চা-পিপাসু ছিলেন এবং চায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন – সেই খবরও আমরা অনুসন্ধানে জানতে পারি। তারও আছে বেশ চমকপ্রদ ইতিহাস! প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এবং প্রশান্তকুমার পালের মহাকাব্যিক রবীন্দ্রজীবনীতে অনুসন্ধান করলে তার খোঁজখবর পাওয়া যায়। সম্প্রতি চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও রবীন্দ্র-গবেষক ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার শীর্ষক গ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনা করে গবেষক হিসেবে ভারতে আনন্দ 888sport app download bd পেয়েছেন। তাতেও মিলে রবীন্দ্রনাথের চা-সংগীত রচনার তথ্য-উপাত্ত। তার আগে বিচিত্র পর্যায়ে গীতবিতানে ১২৩ সংখ্যকে সংকলিত কবীন্দ্র রবীন্দ্রের চা-বিষয়ক গানটির অংশবিশেষ পড়ে নেওয়া যাক :

হায় হায় হায়   দিন চলে যায়।

চাস্পৃহ চঞ্চল   চাতকদল চল’   চল’ চল’ হে।।

টগ’বগ’-উচ্ছল   কাথলিতল-জল  কল’কল’হে।

এল    চীনগগন হতে পূর্বপবনস্রোতে

শ্যামলরসধরপুঞ্জ।।

নিন্দার্থে রবীন্দ্রনাথকে ‘চা-খোর’ বলা না-গেলেও চায়ের প্রতি আসক্তি তাঁর ছিল। তিনি চা-পিপাসু ছিলেন, চা-প্রেমিক ছিলেন, চায়ে অনুরক্ত ছিলেন – এমনকি চা-বিলাসীও। শয্যা ত্যাগের পূর্বে বেড-টি না-খেলেও, প্রাতঃকর্ম সেরে সাত-সকালে বনমালীর হাতে চা-পান করে শুরু করতেন তিনি দিনের কর্মযজ্ঞ – বসতেন লেখার টেবিলে। চায়ের এই অভ্যাসটি ঠাকুরবাড়ির বড়দের প্রায় সকলের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথই ঠাকুরবাড়িতে চা-সংস্কৃতি প্রচলন করেছিলেন। সেখানে স্বজন ও সবান্ধবে, বিলাসী চায়ের আসর বা সম্মিলক আড্ডা, যা-ই বলি, শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বোঝা যায়, একাল তো বটেই, সেকালেও আলাপনে-আড্ডায়, কাব্যপাঠ বা 888sport live footballালোচনায় ধূমায়িত চায়ের সুঘ্রাণ ও চায়ের পেয়ালায় চুম্বন শিক্ষিত উচ্চবিত্ত সমাজে ছিল অপরিহার্য। আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণে, আলাপে-আপ্যায়নে চাকে অঙ্গীভূত করে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি-সংস্কৃতিতে আরেকটি নতুন পালক সংযোজন করেছেন, সন্দেহ নেই – যা এখন সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। আপ্যায়ন-সংস্কৃতির সূচনার সেই ইতিহাস এরকম :

১৯১৬ সালে জাপান 888sport slot gameকালে কবি এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে চায়ের আমন্ত্রণ পান। তিনি সানন্দে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কেননা, তিনি জেনেছিলেন, জাপানিরা চায়ের আপ্যায়ন ও পরিবেশনকে একটি নান্দনিক 888sport live chatের পর্যায়ে উন্নীত করেছে।  রবীন্দ্রনাথ তা পর্যবেক্ষণের জন্যই মূলত সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। সেই আপ্যায়নের ধরন ও পরিবেশনার নান্দনিকতায় কবি এতই বিমুগ্ধ  হয়েছিলেন যে, এর বিবরণ লিখেছেন সে-বছর ২২শে জ্যৈষ্ঠের একটি লেখায়। তাতে তিনি লিখেছেন : তারপরে গৃহস্বামী এসে বললেন, চা তৈরি এবং পরিবেশনের ভার বিশেষ কারণে তিনি তাঁর মেয়ের উপরে দিয়েছেন। মেয়ে এসে নমস্কার করে চা তৈরিতে প্রবৃত্ত হলেন। তার প্রবেশ থেকে আরম্ভ করে চা তৈরির প্রত্যেক অঙ্গ যেন 888sport app download apkর ছন্দের মতো। ধোয়ামোছা, আগুনজ্বালা, চা-দানির ঢাকনা খোলা, গরম জলের পাত্র নামানো, পেয়ালায় চা ঢালা, অতিথির সম্মুখে এগিয়ে দেওয়া, সমস্ত এমন সংযম এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত যে, সে-না-দেখলে বোঝা যায় না।

জাপানিদের চায়ের এমন 888sport live chatিত পরিবেশনায় রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। ফলে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের ভাবনাও নিশ্চয়ই তাঁর মাথায় এসেছিল। তাই শান্তিনিকেতনে তেমন একটি আসর জমিয়েছিলেন। এমনিতেই ঠাকুরবাড়িতে সকাল-বিকাল দুবেলা পারিবারিক চায়ের আসর বসত। সেই চায়ের প্রস্তুতকারক ছিলেন বনমালী – রবীন্দ্রনাথ যাকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘পুরাতন ভৃত্য’ 888sport app download apkটি। কবির পারিবারিক বহু ঘটনার সঙ্গে, বিশেষত চায়ের আসর জমানোর নেপথ্যে, বনমালী ভৃত্যের জীবন জড়িয়ে আছে। শব্দ-কারিগর ও ভাষা-বিনির্মাতা রবীন্দ্রনাথ চাকর শব্দটিকে অর্থান্তরিত করে চা-কর  ও সু-কর করেছিলেন। চা-কর শব্দের আভিধানিক অর্থ, চা-বাগানের মালিক। রাবীন্দ্রিক অর্থ, চা করে যে। শব্দ সংক্ষেপ করে চা-চক্রকে তিনি করেছিলেন চাক্র (চা + চক্র) – যেমন চা-আড্ডাকে (চা + আড্ডা) করা যায় চাড্ডা এবং যা-ইচ্ছা-তা-ইকে যাচ্ছেতাই। শিশু888sport live footballের সম্রাট সুকুমার রায়ও ব্যাকরণ মানি না বলে এরকমভাবে কিছু অদ্ভুত নামবাচক শব্দ তৈরি করেছিলেন। যেমন : হাতি + তিমি = হাতিমি, হাঁস + সজারু = হাঁসজারু, বক + কচ্ছপ = বকচ্ছপ ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথের জাপান এবং চীন 888sport slot gameের সময় চা-পানের অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছিল। ১৯২৪ সালে দেশে ফেরার পথে তিনি চীন থেকে চায়ের নানা সরঞ্জাম, বিবিধ উপকরণ ও বিভিন্ন রকম চা নিয়ে এসেছিলেন। এসব দিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে একটি চায়ের মজলিস সৃষ্টি করে নাম রেখেছিলেন সুসীম চা-চক্র। এই নামের সঙ্গেও মিশে আছে রবীন্দ্র-জীবনের  ইতিহাস। আর সুসীম নামের সঙ্গে আছে চীনা শব্দের আত্মীয়তা। চীন 888sport slot gameের সময় সু সীমো নামে এক তরুণ রবীন্দ্রনাথের দোভাষী ছিলেন। তাঁর নামের সঙ্গে মিল রেখে এই চা-মজলিসের নাম রাখা হয়। চীনা ভাষার একটি শব্দের সঙ্গে বাংলা ভাষার ধ্বনিগত মৈত্রীবন্ধনে বিশ্বকবির কৃতীও এখানে লক্ষযোগ্য।

কবির এই চায়ের আড্ডাখানার উদ্বোধন হয় ২২শে শ্রাবণ ১৩৩১ সালে (কাকতালীয়ভাবে কবির প্রয়াণের দিনটি এখানে 888sport app download for androidীয়), শান্তিনিকেতনের বর্তমান পাঠভবন অফিসের নিচতলায় বিদ্যাভবনের লম্বা ঘরে। এই সুসীম চা-চক্র-এর উদ্বোধন উপলক্ষেই কবি উপরোল্লিখিত চা-বন্দনা সংগীতটি লিখেছিলেন।  সেই গানটি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সুসীম চা-চক্র-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয়। প্রসঙ্গত ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার লিখেছেন : বাঙালির জীবনে এমন কোনও বিষয় নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া পড়েনি। তাই চা নিয়ে যে এমন একটি মজার গান লিখবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গানের মধ্য দিয়ে পুব দেশ থেকে আহূত চায়ের বন্দনার সাথে চা-চাতকদের আহ্বান করেছেন এই শ্যামলরসধরপুঞ্জে অবগাহন করবার। (‘চা-বিলাসী রবীন্দ্রনাথ’, কলকাতা নিউজ টুডে)।

রবীন্দ্রনাথের এই গানটি যদি মনোযোগ দিয়ে পড়া বা শোনা যায় তবে লক্ষ করা যাবে, চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল বলতে তিনি বুদ্ধিজীবী ও সর্ব888sport live chatের কারিগর ও কর্ণধারসহ দিগ্ভ্রান্ত বাউণ্ডুলে পর্যন্ত সকলকে উপস্থিতির আহ্বান জানিয়েছেন সেই চা-চক্রে অংশগ্রহণের জন্য। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, পুঁথিপ্রচারক, গণিততত্ত্ববিশারদ, কাব্যবিদ, তালমগ্ন সংগীতজ্ঞ, রুটিনবদ্ধ জীবনের হিসাববিদ, ভাবমগ্ন চিত্রী, সংবিধান-বিশেষজ্ঞ, কমিটি পলাতক, বিধানঘাতক, পথহারা উদাসীন  প্রমুখকে। চা-প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ জানতেন, অমৃততুল্য চা কর্মক্লান্ত মানুষকে দেহেমনে সজীব ও সতেজ করে তোলে। অবসর সময়ে  শান্তিনিকেতনের কর্মী, কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মিলন ও ভাব-বিনিময়ের জন্য একটি সুসজ্জিত চায়ের আসর হতে পারে উপযুক্ত স্থান। এর জন্যই রবীন্দ্রনাথ চীন ও জাপানের মতো চায়ের সুসজ্জিত স্থান গড়ে তুলেছিলেন। ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার জানিয়েছেন : শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে কবির কোণার্ক বাড়ির লাল বারান্দাটি ছিল চায়ের আসরের জন্য বিখ্যাত। গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য প্রায়ই এখানে চায়ের টেবিলের বন্দোবস্ত করতে হতো। যেবার জহরলাল সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এলেন, উঠেছিলেন এই কোণার্ক বাড়িতে। লাল বারান্দাতেই বসল চায়ের আসর। (পূর্বোক্ত)। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, চা যেমন রবীন্দ্রনাথের নিত্যসঙ্গী ও প্রিয় পানীয় ছিল তেমনি তিনি চায়ের কদর বুঝতেন।

চায়ের চেয়ে সুপ্রিয় পানীয় বাঙালির জীবনে আর দ্বিতীয়টি নেই। তা তিনি চায়ে অভ্যস্ত হওয়ার শুরুতেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথই প্রথম আমাদের চায়ের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়েছেন এবং সারস্বত-সমাজে পরিচিত করিয়েছেন। চা পরিবেশনের শৈল্পিক মানটিও তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন। অতিথিকে গরম চা পরিবেশনের সময়-যে হৃদয়েও উষ্ণতা থাকতে হয় – যেমনটি তিনি পেয়েছিলেন জাপানে – তা-ও রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই আমাদের শেখা। ভারতবর্ষে চা-888sport live chatের সূচনার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও লক্ষ করা যায়, রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন চা-888sport live chat স্থাপনের আদি উদ্যোক্তাদের অন্যতম। তিনিই তখন উদ্যোগ নিয়ে স্থাপন করেন দ্য বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। এই সূত্রে বলা যায়, চায়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা তাৎক্ষণিক নয়, পুরুষানুক্রমেই। তবে কবির দাদার চা-প্রীতি বাণিজ্যিক, কিন্তু নাতির প্রীতি পিপাসার্তের।

দুই

নজরুল গবেষকবৃন্দ অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন, চা নিয়ে তাঁর কোনো 888sport app download apk আছে কি না। তবে চা নিয়ে  তাঁর একটি হাস্যরসাত্মক গান আছে। সংগীতের 888sport app ক্ষেত্রে নজরুলের কৃতির কথা মনে রেখেও বলা যায়, তিনি ছিলেন হাসির গানের রাজাধিরাজ। তাঁর হাস্যরসের গান পেটে খিল ধরায়, মাটিতে লুটোপুটি খাওয়ায় এবং হাসির তোড়ে চোখে জলও আসে। বিদ্রোহী কবি বিশ্বকবির চেয়ে কম চা-প্রেমিক ছিলেন না, বরং এককাঠি সরেস। রবীন্দ্রনাথের চা-পান ছিল পরিমিত এবং সময়ানুগ; কিন্তু নজরুল এ-ব্যাপারে ছিলেন বেপরোয়া এবং বেহিসেবি। আমি তা-ই করি ভাই, যখন চাহে এ-মন যা – বোধ করি এ-ই ছিল নজরুলের বাউণ্ডুলে জীবনের মর্মবাণী। তাই তাঁর চা পানের কোনো সুনির্দিষ্ট সময় ছিল না – যে-কোনো সময় তিনি চা-পান করতেন। চায়ের বিষয়ে নজরুল কেবল বিলাসী ছিলেন না, বিমুগ্ধ প্রেমিকও নন – একেবারে চায়ে মগ্নমাতাল ছিলেন তিনি। উড়নচণ্ডী এই কবিবর বোধ করি মনেপ্রাণে বিশ্বাসই করতেন, দিবারাত্রির যে-কোনো সময়ই চা-পানের সময় এবং যখন-তখন চা-তৃষ্ণা চঞ্চল হলে ক্ষতি নেই! আমরা কবির বন্ধুদের 888sport sign up bonusচারণমূলক রচনা থেকে জানি, চা এবং পান দিয়ে তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন নিমগ্ন করে রাখা যেত। এই নিমগ্নতার ফাঁকে গান রচনা, সুরারোপ এবং 888sport live chatীর কণ্ঠে গান তুলে দেওয়ার মতো আয়াসসাধ্য শৈল্পিক কাজ অনায়াসে করিয়ে নেওয়া যেত। গ্রামাফোন কোম্পানির কর্তারাও সেই সুযোগ হাতছাড়া করেননি। ফ্লাক্সভর্তি চা, বাটাভরা পান, কৌটাভরা সুপারি-চুন-জর্দা দিয়ে কবিকে তাঁরা বসিয়ে দিতেন নিরিবিলি কক্ষে। হারমোনিয়াম তো থাকতই। সেখানে রচিত ও সুরারোপিত হয়ে যেত একাধিক অভাবিত সুন্দর গীতসুধা! গানের কথায়, ভাবে ও সুরে বিচিত্র এবং বিপুল গানের ভাণ্ডারী যিনি, তিনি যে চা নিয়েও গান লিখবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! চা নিয়ে নজরুলের হাসির গানটি নিম্নরূপ। এর পরিপূর্ণ রসাস্বাদনের জন্য সম্পূর্ণ গানটিই উদ্ধৃত করলাম :

চায়ের পিয়াসী পিপাসিত চিত্ত আমরা চাতকদল। দেবতারা কন সোমরস যারে সে এই গরম জল। চায়ের প্রসাদে চার্বাক ঋষি বাক-রণে হল পাশ,

চা নাহি পেয়ে চারপেয়ে জীব চর্বণ করে ঘাস।  লাখ কাপ চা খাইয়া চালাক

হয়, সে-প্রমাণ চাও কত লাখ?

মাতালের দাদা আমরা চাতাল, বাচাল বলিস বল ॥

চায়ের নামে যে সাড়া নাহি দেয় চাষাড়ে তাহারে কও,

চায়ে যে ‘কু’ বলে চাকু দিয়ে তার নাসিকা কাটিয়া লও।

যত পায় তত চায় বলে তাই

চা নাম হল এ সুধার ভাই।

চায়ের আদর করিতে হইল দেশে চাদরের চল ॥

চা চেয়ে চেয়ে কাকা নাম ভুলে পশ্চিমে চাচা কয়,

এমন চায়ে যে মারিতে চাহে সে চামার সুনিশ্চয়।

চা করে করে ভৃত্য নফর নাম হারাইয়া হইল চাকর,

চা নাহি খেয়ে বেচারা নাচার হয়েছে চাষা সকল ॥

চায়ে এলে যায় চাল-কুমড়ো সে, চাঁদা করে মার চাট্!ি

চা না খাইয়া চানা খায় আজ দেখহ অশ্বজাতি।

একদা মায়ের মুণ্ডেতে শিব

চা ঢেলে দেন, বের করে জিভ,

চা-মুণ্ডারূপ ধরিলেন দেবী সেই দিন রে পাগল ॥

চায়ে পা ঠেকিয়ে সেদিন গদাই পড়িল মোটর চাপা,

চাঁদ ও চাটনি চায়েরই নাতনি, লুকাতে পার কি বাপা?

চায়ে ‘সর’ বলে গালি দিয়ে মাসি

চামর দোলায় হয়ে আজ দাসী,

চাটিম চাটিম বুলি এই দাদা চায়ের নেশারই ফল।।

(‘চা-স্তোত্র’, গীতি-শতদল)

লক্ষ করুন, নজরুল এই হাস্যরসের গানটিতে  কত বিচিত্র রূপে চ-এর অনুপ্রাসমূলক শব্দকে বহুমুখী ব্যঞ্জনায় সমন্বয় করেছেন। চাতক, চার্বাক, চারপেয়ে, চালাক, চাতাল, চাষাড়ে, চায়, চাদর, চাচা, চামার, চাকর, চাষা, চাল-কুমড়া, চাঁদা, চাটি, চানা, চামুণ্ডা, চাপা, চাঁদ, চাটনি, চামর, চাটিম ইত্যাদি। নজরুল আদ্যক্ষরে এই চ-বর্ণযুক্ত শব্দগুলিকে চায়ের সঙ্গে মিলিয়ে অনুপ্রাসের মাধ্যমে নতুন ভাবানুষঙ্গে মহিমান্বিত করেছেন। এতে মনে পড়ে যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অনুপ্রাসের বাহাদুরির কথা : আনা দিয়ে আনা যায় কত আনারস! রবীন্দ্রনাথও অনুপ্রাস কাব্যালংকারের এই ক্যারিশমা তাঁর বিপুল কাব্যভাণ্ডারে কালেভদ্রে কম দেখাননি : কুলায় কাঁপিছে কাতর কপোত, দাদুরি ডাকিছে সঘনে/ গুরুগুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে। সংস্কৃত কাব্যালংকারের এই অনুপ্রাস বিষয়টি সুদীর্ঘ কাল ধরে বাংলা 888sport app download apkর সুপ্রিয় গয়নাগাটি। সম্প্রতি গায়ক সুরকার ও গীতিকার নকুলকুমার বিশ^াসের গানে তা ব্যাপকভাবে লক্ষিতব্য : চাচায় চা চায়, চাচি চ্যাঁচায়,/ চাচি চুলায় চচ্চড়ি চড়ায়।

চা নিয়ে নজরুলের জীবনে আরো চমকপ্রদ ঘটনা আছে। কবি জসীম উদ্দীন যাদের দেখেছি  শীর্ষক 888sport sign up bonusকথার নজরুল-অধ্যায়ে সেই চা-বৃত্তান্ত সরস শব্দবন্ধের চমৎকারিত্বে বর্ণনা করেছেন। নজরুল তখন বঙ্গীয় সমিতির আমন্ত্রণে ফরিদপুর গিয়ে জসীম উদ্দীনের বাড়িতে উঠেছেন। কবিকে ঘিরে রাতের বেলা বসেছে গানের আসর। এমন সময় গায়ক-কবির হলো এক মহাসমস্যা! জসীম উদ্দীনের ভাষায় : রাত্রিবেলা এক মুস্কিলে পড়া গেল। চা না পাইয়া কবি অস্থির হইয়া উঠিলেন। এই পাড়াগাঁয়ে চা কোথায় পাইব? নদীর ওপারে গিয়া যে চা লইয়া আসিব, তাহারও উপায় নাই। রাত্রিবেলা কে সাহস করিয়া এত বড় পদ্মানদী পাড়ি দেবে? তখন তিন-চার গ্রামে লোক পাঠানো হইল চায়ের অনুসন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আলিম মাতব্বরের বাড়ি হইতে কয়েকটা চায়ের পাতা বাহির হইল। তিনি একবার কলিকাতা গিয়া চা খাওয়া শিখিয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকেদের চা খাওয়াইয়া তাজ্জব বানাইয়া দিবার জন্য কলিকাতা হইতে তিনি কিছু চা-পাতা লইয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া চা-পাতা যখন কম হইয়া আসিত, তখন তাহার সহিত কিছু শুকনা ঘাসপাতা মিশাইয়া চায়ের ভাঁড়ার তিনি অফুরন্ত রাখিতেন। তিনি অতি গর্বের সহিত তাঁহার কলিকাতা-888sport slot gameের আশ্চর্য কাহিনি বলিতে বলিতে সেই
চা-পাতা আনিয়া কবিকে উপঢৌকন দিলেন। চা-পাতা দেখিয়া কবির তখন কী আনন্দ! এই মহামূল্যবান চা এখন কে জ্বাল দিবে? এ-বাড়ির বড়বউ ওবাড়ির ছোটবউ, সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া যাহার যত রন্ধনবিদ্যা জানা ছিল সমস্ত উজাড় করিয়া সেই অপূর্ব চায়ের রন্ধন-পর্ব সমাধা করিল। অবশেষে চা বদনায় ভর্তি হইয়া বৈঠকখানায় আগমন করিল। কবির সঙ্গে আমরাও তাহার কিঞ্চিত প্রসাদ পাইলাম। কবি তো মহাপুরুষ। চা পান করিতে করিতে চায়ের রাঁধুনিদের অজস্র প্রশংসা করিতেছিলেন। আমরাও কবির সঙ্গে ধুয়া ধরিলাম। গ্রাম্য-চাষির বাড়িতে যত রকমের তরকারি রান্না হইয়া থাকে, সেই চায়ের মধ্যে তাহার সবগুলিরই প্রসাদ মিশ্রিত ছিল। কমিউনিস্ট কর্মী আবদুল হালিম বড় সমালোচনা-প্রবণ। তাঁহার সমালোচনা মতে সেই চায়ের রামায়ণের রচয়িত্রীরা নাকি লঙ্কাকাণ্ডের ওপর বেশি জোর দিয়াছিলেন। আমাদের মতে, চা-পর্বে সকল ভোজনরসের সবগুলিকেই সমমর্যাদা দেওয়া হইয়াছিল। পরবর্তীকালে বহুগুণীজনের কাছে এই চা খাওয়ার বর্ণনা পরিবেশন করিয়া  কবি আনন্দ করিতেন।

উদ্ধৃতিটি সুদীর্ঘ হলেও কবি জসীম উদ্দীনের সরস ও শৈল্পিক বর্ণনার গুণে সুখপাঠ্য, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চা রান্নার এমন গল্পের তো এখানেই শেষ নয়! প্রথম দিকে বাঙালি গৃহবধূরা চা রান্না করেছেন। ভাতের মতো পানিতে চা-পাতা ফুটিয়ে ফ্যান ঝরিয়ে ফেলে সেদ্ধ পাতাটুকু পরিবেশন করেছেন! সেই চা এখন অমৃততুল্য জনগণমননন্দিত পানীয়।

তিন

চা বর্তমান বিশ্বে একটি বড় 888sport live chat। এই 888sport live chatের কাঁচামাল দুটি পাতা একটি কুঁড়ি। নাতিশীতোষ্ণ, বৃষ্টিপ্রধান ও পাহাড়ের ছায়াচ্ছন্ন ঢালু অঞ্চল চায়ের গাছ জন্মানোর উপযুক্ত স্থান। এই 888sport live chatের আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। এদেশে চায়ের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন নিয়ে হতে পারে গবেষণা এবং লেখা হতে পারে মূল্যবান অভিসন্দর্ভ। আমাদের তো বটেই সারাবিশে^ এখন জলের পরেই জনপ্রিয় পানীয় চা। বিত্তবান থেকে ভিক্ষুক, সওদাগর থেকে শ্রমিক, আমলা থেকে আমজনতা, আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের প্রিয় পানীয় অমৃততুল্য চা। তাই নগর-বন্দর থেকে গ্রাম্য বাজার, পাঁচতারা হোটেল থেকে পথের মোড়, অলিগলি, লেন-বাইলেন – সর্বত্র জমজমাট চায়ের দোকান। চায়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য যেমন সমৃদ্ধ তেমনই চা নিয়ে জনশ্রুতি, লোকশ্রুতি, গালগল্প এবং কিংবদন্তি কম নেই। কবি-888sport live chatী-888sport live footballিকদের লেখা ও রেখায় তাই উঠে এসেছে নান্দীপাঠ। একালে তাঁদের জীবনে চা যেন অনিবার্য অনুষঙ্গ। একটি চমকপ্রদ তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমান বিশে^ মানুষ এখন গড়ে প্রতি সেকেন্ড পঁচিশ হাজার কাপের বেশি চা পান করে।

দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সুগন্ধি অঞ্চল –

সবাই জানে 888sport appsের সিলেট-শ্রীমঙ্গল।

কারো অজানা নয় যে, ইংরেজরা এদেশে চা-888sport live chatের উদ্গাতা এবং  প্রচার-প্রসারের পাঞ্জেরি। খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চায়ের জন্মস্থান চীন হলেও এদেশে ব্রিটিশ-ঔপনিবেশিককালে চায়ের চাষ শুরু হয়। ইংরেজরা এদেশের মানুষকে শোষণ ও বাণিজ্যিক স্বার্থে চায়ের কাঁচামাল উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছিল – এ-কথা সত্যি। তবে এ-কথাও মিথ্যা নয় যে, তাদের এই ও বাণিজ্যিক প্রচারের ফলে এদেশবাসী ক্লান্তিনাশক বিশ্বসেরা পানীয়টিতে অভ্যস্ত হতে পেরেছে। এই ফাঁকে চায়ের গুণ সম্পর্কে পুষ্টি888sport apkীদের মত জেনে নেওয়া যাক : দুধ-চিনিবিহীন ফুটানো গরম জলে স্রেফ সামান্য চা-পাতা দিয়ে কেবল লিকার নিয়মিত পান করলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি মেলে। কিডনির সমস্যা, হৃদরোগের ঝুঁকি, রক্তের কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চা বেশ কার্যকর। তাছাড়া চা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং দাঁত ও মাড়ি সবল রাখে। গ্রিন টি বা সবুজ চা বার্ধক্য নিরোধক হিসেবেও কাজ করে। সুতরাং আমাদের দেহঘড়ি নীরোগ রাখতে পানীয় হিসেবে চাকে সঞ্জীবনী সুধার মতো বললে অত্যুক্তি হবে না নিশ্চয়ই!

এমন গুণসম্পন্ন মানবদেহের জন্য উপকারি যে চা, এর উৎপত্তি সম্পর্কে দু-ধরনের কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কথিত আছে, খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালে চীনের সম্রাট শেনংগ বা শেন নাং গরম জল পান করার সময় তাঁর পানপাত্রে একটি শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ে। তাতে জলের রং ও স্বাদ একটু পাল্টে যায়। সেই জল খেয়ে তাঁর খুব ভালো লাগে। তারপর সেই পাতা খুঁজে বের করে তিনি নিয়মিত খেতে থাকেন। ক্রমে সেই পানীয় সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ মনে করে, গৌতম বুদ্ধ হলেন চায়ের আবিষ্কারক। সেই জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ঘুম-কাতরতার জন্য কিছুতেই সাধনায় মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না। সাধনায় বসলেই দু-চোখের পাতাজুড়ে ঘুম নেমে আসে। শেষে নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে নিজেই দু-চোখের পাতা কেটে ফেলেন।

সেই পাতা থেকে গজায় এক রহস্যময় গাছ। এ-গাছের পাতা পানিতে সেদ্ধ করে পান করলে ঘুম দূরীভূত হয়। সেই অলৌকিক গাছের পাতাই চায়ের আদি মাতা। গৌতম বুদ্ধই এই ঘুমতাড়ানি পাতার সন্ধান বৌদ্ধভিক্ষুকে দিয়েছিলেন। তবে কিংবদন্তি যা-ই হোক, চায়ের মাতৃভূমি চীন। চা শব্দটিও চৈনিক। কিন্তু অনেক গবেষক মনে করেন, চা নামটি এসেছে গ্রিক পুরাণের দেবতার নাম থেকে – THEIA থেকে TEA (টি)।

চায়ের উৎপত্তি সম্পর্কে এসবই গালগল্প – জনশ্রুতি কিংবা কিংবদন্তি। এসবের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। প্রসঙ্গত ভারতীয় উপমহাদেশে চায়ের আগমন সম্পর্কে ইতিহাসের আলোকে অল্পবিস্তর তথ্যকণিকা এ-পর্যায়ে জেনে নেওয়া যেতে পারে। চায়ের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস।  ১৮৩৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের আসামে পরীক্ষামূলক চায়ের আবাদ এবং পরের বছর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। 888sport appsের চা-বোর্ডের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৮২৮ সালের দিকে কর্ণফুলী নদীর তীরে প্রথম চা চাষের জন্য জমি বরাদ্দ নেওয়া হয়। ১৮৪৯ সালে, মতান্তরে ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনীছড়ায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা-বাগান তৈরি হয়। ১৯৫৭-৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান। স্বাধীনতার পর মূলত তাঁর উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে 888sport apps চা গবেষণা ইনস্টিটিউট শ্রীমঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বর্তমানে দেশে দু-শতাধিক চা-বাগান আছে। এর মধ্যে দেড় শতাধিক বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। এক তথ্যে জানা যায়, স্বাদ, গন্ধ, বর্ণভেদ ও তৈরির পদ্ধতিতে পৃথিবীতে প্রায় ত্রিশ লক্ষ ধরনের চা আছে। কিন্তু চায়ের মূল বিভাগ তিন প্রকার। কালো চা বা ব্ল্যাক টি, সবুজ চা বা গ্রিন টি এবং সাদা চা বা হোয়াইট টি। এই তিন প্রকারের চা-ই একই গাছের পাতা থেকে পাওয়া যায়।

চার

কলকাতার পুরনো দিনের একটি গল্প দিয়ে বাঙালির চা-পানের কথা শুরু করা যাক। ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতার লক্ষ্যে বাঙালিকে জাগ্রত করার জন্য কোনো এক রাজনৈতিক দল দেয়াল লিখনে লিখেছে – বাঙালি জাগুন। পরদিন দেখা দেখা গেল এর নিচে কে বা কারা লিখে রেখেছে – জেগেছি, চা দিন! – এই দেয়াল লিখনে বাঙালির চায়ে অভ্যস্ততা ও চা-প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। চায়ের প্রতি বাঙালির এই আকর্ষণ জাদুকরি প্রভাবে ঘটেনি। এর জন্য উৎপাদক চায়ের কোম্পানিগুলিকে প্রচুর শ্রম এবং অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। লিফলেট, পোস্টার, সাইনবোর্ড ইত্যাদি তো আছেই – শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, অলিগলিতে, পাড়া-মহল্লায় একাধিক প্রচারক দল কাজ করেছে।

তারা চা বানানোর পদ্ধতি সাধারণ মানুষকে হাতে-কলমে শিখিয়েছে, বিনামূল্যে খাইয়েছে এবং বাড়িতে বানিয়ে খাওয়ার জন্য সঙ্গে দিয়েও দিয়েছে – সবই মুফত, সবই ফ্রি! এভাবেই ব্রিটিশের চা কোম্পানিগুলি রফতানির পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে বাঙালির মনে চা-প্রীতি জাগিয়ে অবশেষে আসক্ত করে তোলে। এসবই উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকের কথা। তখন থেকে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নাগরিক সমাজের চা-প্রীতি প্রকাশ পেতে থাকে।

ব্রিটিশ চা কোম্পানিগুলি চায়ের প্রচার ও বিপণনের জন্য প্রশিক্ষিত অনেক কর্মী নিয়োগ করেছিল। তাদের বলা হতো

চা-ওয়ালা। তাঁরা বিকেল হলেই নগরীর তেমাথা, চৌমাথার পাবলিক প্লেসগুলিতে চা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হতেন। এ-প্রসঙ্গে অধ্যাপক হাফিজ জি এ সিদ্দিকির লেখা 888sport sign up bonusচারণ থেকে জানা যায় : আমি তখন লালবাগ থানার হাজারিবাগ এলাকার বাসিন্দা এবং আমার জন্মও সেখানে। বাসার পাশেই রাস্তার এককোনায় সেই চা-ওয়ালা বসে থাকতেন। চা-ওয়ালা বিকালে ২-৩ ঘণ্টা নিয়মিত চা তৈরি করে বিতরণের ব্যবস্থা করতেন। অনেকেই বিকেলে তাদের সন্তানদের নিয়ে চা-ওয়ালাদের কাছে পাত্র নিয়ে যেত পরিবারের সবার জন্য চা সংগ্রহ করতে। … মাঝে মাঝে বিকেলে আমি ও আমার বড় ভাই চা-ওয়ালার কাছে যেতাম পরিবারের সবার জন্য চা সংগ্রহ করতে।

ফ্রি চা খাওয়ানো, ফ্রি চা-পাতা বিলানো – এসব তো আছেই। তাছাড়া চায়ের মনকাড়া ও বাহারি বিজ্ঞাপনের মায়াজালে বাঙালিকে বিমুগ্ধ করতে চা কোম্পানিগুলি ছিল সদাতৎপর। রেলস্টেশন ও বাজারসহ জনজমায়েতের সর্বত্র ছেয়ে গিয়েছিল চায়ের বিজ্ঞাপনে। 888sport appsের স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-৭৪ সালে, রংচটা হয়ে গেলেও আমি ময়মনসিংহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে সচক্ষে দেখেছি হলুদ জমিনে কালো রঙে লেখা তেমন সাইনবোর্ড। চা ক্লান্তি দূর করে। চা দেহ ও মন সতেজ করে। গরম চা গ্রীষ্মের একমাত্র শীতল পানীয়। চায়ে কোনো মাদকতা দোষ নেই, অশান্তি উদ্বেগের গ্লানি চা-ই দূর করে – ইত্যাদি। কোনো-কোনো বিজ্ঞাপন লেখা হতো 888sport app download apkর ছন্দে :

থাকলে মায়ের, বাপের আশীর্ব্বাদ

ভাল চা আর কাপড় যায় না বাদ।

কিংবা,

চায়েতে নাহিক মাদকতা দোষ

কিন্তু পানে করে চিত্ত পরিতোষ।

সেকালে এমন কোনো কবি-লেখক, 888sport live chatী-888sport live footballিক ও সাংবাদিক কমই ছিলেন, যাঁরা চায়ের প্রতি অনুরাগহীন। জানা যায়, সব্যসাচী লেখক বুদ্ধদেব বসুও ছিলেন চা-প্রেমিক। ১৯৭৪-এর ১৮ই মার্চ সন্ধ্যায় তিনি শেষবার চা-পান করেছিলেন। তারপরই স্ট্রোকে তাঁর মৃত্যু হয়। বুদ্ধদেবের বন্ধু কবি অজিত দত্ত একদা সেন্ট্রাল টি বোর্ডের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি চিত্র888sport live chatী অন্নদা মুন্সীকে এনে চায়ের বিজ্ঞাপনকে সচিত্র করিয়েছিলেন। সর্বধর্মের মানুষের প্রিয় পানীয় চাকে বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে সচিত্র করে অন্নদা মুন্সী বিজ্ঞাপনে নতুনত্ব এনেছিলেন। মায়ের কোলে ঘুমন্ত শিশু অঙ্কিত এমন একটি বিজ্ঞাপনে লক্ষ করা যায়, বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকছড়ার রূপান্তরিত ব্যবহার :

ঘুমপাড়ানী মাসি পিসি ঘুম দিয়ে যেও

বাটি ভরে চা দেব হাসি মুখে খেও

ঘুমপাড়ানী মাসি পিসি ঘুম দিয়ে যা

খোকার বাপ ঘরে আসবে করতে হবে চা।

সচিত্র বিজ্ঞাপনী ভাষার এমন চমক তখন চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়াতে কার্যকর হয়েছিল।

পাঁচ

বাঙালির চা-পানের ইতিহাস খুব প্রাচীন না-হলেও একেবারে নতুন নয়। কোন বাঙালি প্রথম চায়ের অমৃততুল্য স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া যাবে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ-করা বাঙালি আচার্য শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের নাম। কথিত আছে, ১০২০ সালে তিব্বত 888sport slot gameের সময় তিনি চা-পান করেছিলেন এবং এর আনন্দদায়ক অনুভূতি ব্যক্ত করে নাকি 888sport app download apkও লিখেছিলেন।

১৮৩৯ সালে দ্য বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশনে যুক্ত হয়ে চায়ের 888sport live chat ও বাণিজ্যে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের অবদানের কথা তো আমরা আগেই জেনেছি। ১৮৮১ সালে ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হয় কলকাতায়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দুই কৃতী বাঙালি – রাধাকান্ত দেব ও রামকমল সেন। ১৯০০ সালে বাংলা ভাষায় চা প্রস্তুত প্রণালী শিক্ষা নামে একটি বই প্রকাশ করেন গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১১২ পৃষ্ঠার এই বইয়ে লেখকের ভূমিকা থেকে জানা যায়, তিনি কাছাড়ের একটি চা-বাগানে টি-মেকার-এর কাজ করতেন। চা-বিষয়ক বিস্তারিত তথ্য, চা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ ও পদ্ধতি বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম ছাড়াও বিশিষ্ট বাঙালি কবি-লেখকদের প্রায় সবাই ছিলেন চায়ের প্রতি অনুরক্ত। একালে তো বটেই সেকালেও বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে এমন নাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যারা চা-পানে অনভ্যস্ত। সেকালে চায়ের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (ডি এল রায়), ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ, অভিধানকার ও লেখক রাজশেখর বসু (পরশুরাম)। তাঁদের চা-প্রীতির কথা অনেকেরই জানা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একবার নাকি এক জমিদারকে চা খায় কি না জিজ্ঞেস করেছিলেন। জমিদার না বলায় তিনি মন্তব্য করেছিলেন, কিন্তু তোমাকে তো ভদ্রলোকের মতোই দেখায়! ডি এল রায়ের চা-প্রীতির নিদর্শন মেলে তাঁর লেখায় : বিভব সম্পদ কিছু নাহি চাই, শুধু বিধি যেন প্রাতে উঠে পাই ভাল এক পেয়ালা চা। রাজশেখর বসুও ডি এল রায়ের চেয়ে চায়ের প্রেমিক কম ছিলেন না! তিনি নাকি বলতেন : একজনের বাড়িতে গেলাম, আর এক কাপ চায়ের দেখা পেলাম না, এই রকম কারও কাছে কোনো ভদ্রলোকের যাওয়া উচিত নয়। এই দুজন লেখকের চায়ের প্রতি পক্ষপাত যে চা-প্রেমে নিমজ্জিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 888sport appর নবাব আবদুল গণিও ছিলেন চা-পিয়াসী। প্রায় প্রতিদিন সকালে তিনি নবাববাড়িতে চায়ের আসর বসাতেন। তিনি 888sport appর বর্তমান বেগুনবাড়ি এলাকায় ত্রিশ বিঘা জমি কিনে চা চাষের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি।

স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী হলেও তিনি ছিলেন চায়ের একান্ত অনুরক্ত। তাঁর চা-প্রীতি ছিল প্রায় প্রবাদতুল্য। শৈশবে বিবেকানন্দ ও তাঁর ভাই মহেন্দ্রনাথ পৈতৃক বাড়িতে চা-পানের সমারোহ দেখেছিলেন। মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা বইয়ে ছেলেবেলার চায়ের 888sport sign up bonus লিখেছেন – জানিয়েছেন ওষুধ হিসেবে চা খাওয়ার কথা। স্বামীজির চায়ের প্রতি অনুরক্তির খবর জানাতে দীপারুণ ভট্টাচার্য লিখেছেন : যৌবনকালে বরাহনগর মঠ ও বেলুড় মঠে তিনিই চা প্রবেশ করিয়েছিলেন। আমেরিকায় থাকার সময় ভক্তরা স্বামীজিকে লেবু চা এবং আইস টি খাইয়েছিলেন। একবার বাল গঙ্গাধর তিলক বেলুড় মঠে এসে, জায়ফল জয়িত্রী ইত্যাদি দিয়ে, মোগলাই চা বানিয়েও স্বামীজিকে খাইয়েছিলেন। …

… তিনি নিজেও চা খেতেন এবং বেলুড় মঠে তার সঙ্গে দেখা করতে আসা বিশিষ্ট মানুষদেরও চা খাওয়াতেন।

স্বামী বিবেকানন্দ এমন দৃঢ়চেতা সন্ন্যাসী ছিলেন যে, তিনি বেলুড় মঠকে তাঁর বাগানবাড়ি ও চায়ের আড্ডাখানা বিবেচনা করে ব্রিটিশ পৌর কর্তৃপক্ষ কর বাড়িয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন এবং জিতেওছিলেন।

ছয়

সম্ভবত বছরচল্লিশেক বা তারও আগে ‘সংবাদ সাময়িকী’তে ডা. শুভাগত চৌধুরীর একটি 888sport live পড়েছিলাম – ‘চা তৃষ্ণা চঞ্চল হোক ক্ষতি কী’ শিরোনামে। 888sport live football ও 888sport apk মিশেলে সেটিই আমার চা-সম্পর্কিত প্রথম পাঠ। যতীন সরকার লেখক ও বক্তা হিসেবে যেমন শিরোমণি তেমনই খোশগল্পের আসরেও সরস। তাঁর কাছে শুনেছি, ইংরেজরা আমাদের ভালো কিছু শেখায়নি। ভুল করে একমাত্র ভালো জিনিস শিখিয়েছে – চা খাওয়া। সেটি যখন তারা বুঝতে পারল তখন আর বাঙালিকে চায়ের অভ্যাস ত্যাগ করানো সম্ভব নয়। তাই বুদ্ধি এঁটে ওরা চায়ের সঙ্গে দুধচিনি মেশানোর পরামর্শ দিয়ে বানিয়ে দিলো বিষ!

ফুটন্ত গরম জলে শুধু লিকারই যে সেরা চা, একথাই গল্পচ্ছলে বোঝাতে চেয়েছেন অধ্যাপক যতীন সরকার। সেই থেকে আমরা লিকার বা লাল চায়ের নাম দিয়েছি বুদ্ধিজীবী চা! এখন এই লাল চায়েরও রকমফেরের অভাব নেই – লেবু চা, আদা চা, তুলসী চা, লবঙ্গ চা, মসলা চা, মালটা চা, পুদিনা চা, মরিচ চা, নীল অপরাজিতা চা – আরো কত কী!

মনে পড়ে, আমার ‘মুখে-চা’ শৈশবকালে – বর্ণমালা শেখার বয়সে। আমার বাবার মাসি, কালোশশী, যাকে আমরা ‘বড়মা’ ডাকতাম, তার কাছেই গরম চায়ে ঠোঁট পুড়ে আমার শুভারম্ভ। সেই বড়মাকে কাপে চা খেতে দেখিনি কখনো। একটি স্পেশাল পিরিচ ও চা-ভরা কেটলি নিয়ে বসতেন তিনি – সকাল-সন্ধ্যায়, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়! সেই কেটলিতে কমপক্ষে পাঁচ কাপ চা তো থাকতই। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে দেখেছি, সকাল-বিকাল দু-বেলা বাবা বাড়িতে চা খেতেন। পাকিস্তান আমলে প্রাইমারি স্কুলে যেতে-আসতে দেখেছি, ইউনুস মিয়ার চায়ের স্টলে পিতৃব্যদের চায়ের আড্ডা ও দাবা খেলার ধুম! স্বাধীনতার পর আমাদের চায়ের আড্ডা ছিল সৈয়দ আলীর চায়ের দোকানে। সেখানে দুইটাকে চারটা, তিনটাকে পাঁচটায় ভাগ করে চলত চা খাওয়া। বন্ধুরা মিলে কখনো খালি পকেটেই চা খেয়ে বসে আড্ডা দিতাম। বন্ধু অপু সরকার তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকত রাস্তার দিকে। দিলদরিয়া কোনো ব্যবসায়ী বন্ধুকে যেতে দেখলেই তাকে ধরে আদায় করত চায়ের দাম। প্রয়াত বন্ধু বিরাজ ঘোষ বা অমলেশ সরকার আড্ডায় থাকলে তো কারো পকেটে হাত দিতে হতো না! লেবু ও আদা চায়ের জন্য বিখ্যাত ছিল ননী চৌধুরীর দোকান। সেটা বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ছিল স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও শিক্ষকদের দখলে। আমাদের মতো ইঁচড়েপাকাদের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। আতাহার আলীর চায়ের দোকানও ছিল আমাদের চাড্ডার আরেক স্থল। এই আতাহার আলী নামটি যে কীভাবে দ্রুত উচ্চারণে আতরালি হয়ে গেল – ভাষার এই মহিমা বোঝা দায়!

চায়ের প্রাণ আড্ডা নাকি আড্ডার প্রাণ চা, তা তর্কসাপেক্ষ এবং সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল! তবে চা এবং আড্ডা হরিহর আত্মা। চায়ের আড্ডা – তা স্টলে, টংঘরে বা ড্রইংরুমে, যেখানেই হোক – বিশ্বকৌষিক এবং অসীম গগনবিহারী। এর বিস্তার সর্ববিষয়ে – ধর্ম-দর্শন-রাজনীতি, সমাজ-888sport live football-সংস্কৃতি, প্রেম-পিরিতি-যৌনতা – কোনোকিছুই চায়ের আড্ডায় বাদ থাকে না। 888sport live chatী থেকে শ্রমিক, কবি থেকে কুলি, বুদ্ধিজীবী থেকে ব্যবসায়ী, দার্শনিক থেকে বেশ্যার দালাল – সকলেই একালে চায়ের প্রেমিক। চায়ের আড্ডা, চা-শ্রমিকদের জীবনযাপনের কথা উঠে এসেছে বাংলা 888sport live footballের গল্প-888sport alternative linkে। সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, হুমায়ূন আহমেদসহ বহু লেখকের রচনায় আছে চা-বাগান ও চা-পানের গল্প। শ্রীমঙ্গল বিটিআরআই চা-বাগানে রমেশ রাম গৌড়ের নীলকণ্ঠ টি কেবিন-এর সাতরঙা চা 888sport appsের চা-সংস্কৃতিতে গৌরবোজ্জ্বল সংযোজন। দেশি-বিদেশি খ্যাতিমানরা তো বটেই বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সেই সাতরঙা চায়ের স্বাদ গ্রহণ করেছেন।

চায়ের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক সুনিবিড়। চায়ের আসরে বসে চায়ের কাপে ঝড় তোলা, চায়ের আড্ডায় উজির-নাজির মারায় বাঙালির চেয়ে ওস্তাদ বোধ করি পৃথিবীতে আর কেউ নেই! যদিও আমরা লক্ষ করেছি, আইয়ুবের স্বৈরশাসন ও 888sport appsের স্বৈরশাসকদের আমলে প্রতিটি চায়ের দোকানেই লেখা থাকত, রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ। চাযের আসরের রাজনীতিতেও আছে এদেশের প্রাণস্পন্দন। 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের চায়ের আড্ডার সঙ্গে তো জড়িয়ে আছে এদেশের বাষট্টির ছাত্র-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের ছাত্র-গণআন্দোলনের ইতিহাস। চায়ের আড্ডা থেকেই বেরিয়ে এসেছে নতুন-নতুন স্লোগান এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সূত্র। তাই চায়ের কাপে ঝড় এবং চায়ের টেবিলে উজির-নাজির মারা – এই প্রবাদগুলি অর্থহীন নয়। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌন ইতিহাস। আর কলকাতার কফি হাউজের চায়ের আড্ডা এখন আগের মতো প্রাণময় না-হলেও তারুণ্যের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে অন্তত বাঁচিয়ে রেখেছে।

ভালোবাসার মুগ্ধতা প্রকাশ এবং প্রথম প্রেমের চোখ-ইশারায়ও এক কাপ চায়ের ভূমিকা গৌণ নয়। তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে – রবীন্দ্রনাথ এরকম না-লিখে যদি লিখতেন, তুমি আমায় ডেকেছিলে চায়ের নিমন্ত্রণে, তবু মন্দ হতো না! গানওয়ালা কবীর সুমনের গানে পাই : এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই। … শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই। কিংবা একটু ভালো চা পাওয়া যায় কোন দোকানে? এমন প্রশ্ন এখন চা-বিলাসী সব মানুষের। চায়ের প্রসঙ্গ এলে একালের কাব্যপ্রেমিকদের মনে পড়বে কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ 888sport app download apkটির কথা। হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনরত জনৈক তরুণ রাজনীতিকের মুখে শুনি : বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,/ অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও/ রফিজ আমাকে চিনলো না! – এই যে চা, যা আমরা বিভিন্ন রঙে ও স্বাদে পান করছি দিবারাত্র সবসময় তা জাতীয় পানীয় হিসেবে কি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে পারে না? সেই স্বীকৃতি না-পেলেও একথা সত্যি যে, পানির পরেই চা বাঙালির দ্বিতীয় পানীয়। পানি প্রয়োজনের আর চা প্রিয়জনের। পানি প্রাণসঞ্চার করে আর চা স্বস্তি ও সতেজতা দেয়।  সুখে-অসুখে, আনন্দ-আময়ে, উৎসবে-আড্ডায়, এমনকি মৃতের সৎকারে শ্মশানেও চা অনিবার্য। তাই স্বামী বিবেকানন্দকেও রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ায় শ্মশান-বন্ধুদের নিয়ে চা-পান করতে দেখা যায়।

সাত

চা-সংস্কৃতির গুণকীর্তন ও মহিমা-মাধুরী বর্ণন তো অনেক হলো। ব্রিটিশ আমলে চায়ের প্রচারণার যুগে এর বিরোধিতাও কম ছিল না! এই বিরোধিতায় ছিলেন মূলত সেকালের স্বদেশিরা এবং বিশেষভাবে একজন স্বদেশপ্রেমিক 888sport apkী। সেই ইতিহাসও যৎকিঞ্চিত বলা দরকার। সন্দেহ নেই, এদেশে চায়ের আগমন, চাষ, উৎপাদন, বিপণন ও বিস্তার, সবই ব্রিটিশদের হাত ধরে। সে-অর্থে চা বিদেশি পণ্য। তাই স্বদেশি আন্দোলনে নিবেদিত রাজনীতিবিদ ও বিপ্লবীরা চাকে বিদেশি পণ্য ও নেশাদ্রব্য বলে বর্জন করেছে। শুধু তা-ই নয়; চায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন, প্রচার এবং পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীও ছিলেন চা-পানের বিরুদ্ধে। তিনি চা খাওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন এই বলে যে, চীনে পানীয় জল পরিশুদ্ধ করার জন্য হয়তো এসব পাতা ব্যবহার করা হয়। ভারতে এর প্রয়োজন নেই। উষ্ণ পানীয় দরকার হলে গরম জলে দুধ আর চিনি গুলে খেলেই হয়!

স্বদেশি আন্দোলনকালে প্রবল স্বাধীনতাকামীরা চায়ের বিরোধিতার মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। চা-পান মানে বিষ পান – এই বিষয়টি তাঁরা লেখায়, রেখায় ও প্রচারণায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ব্রিটিশরাও তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে প্রচারণার নতুন-নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছিল –
চোঙা-ফুঁকানো থেকে ফ্রি চা খাওয়ানো এবং বাড়িতে খাওয়ার জন্য পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বদেশি
চা-বিরোধীদের ভূমিকার পরিচয় পাওয়া যায় শরৎচন্দ্রের পরিণীতা 888sport alternative linkে। সেখানে নায়িকা ললিতাকে দেখা যায়, সে তার প্রেমিকের ইচ্ছায় চা খায় না! কারণ শেখর একনিষ্ঠ স্বদেশি।

বাঙালি 888sport apkী প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন প্রবলভাবে

চা-বিরোধী। তিনি ১৯৩৫ সালে ৭ই ডিসেম্বর দেশ পত্রিকায়

‘চা-এর প্রচার ও দেশের সর্বনাশ’ শিরোনামে একটি 888sport live লেখেন। প্রায় একই বিষয় নিয়ে তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে আরো দুটি 888sport live রচনা করেন। এদেশের মানুষকে কূটকৌশলে ও প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ দীর্ঘায়িত করার সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রই চায়ের মধ্যে নিহিত, তা 888sport apkী প্রফুল্লচন্দ্র বুঝিয়েছেন। তাছাড়া চা-পানের ফলে আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন ক্ষতির কথাও তিনি 888sport liveগুলিতে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমেও কোনো-কোনো 888sport live chatী চা-পায়ীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছেন। তখন বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত 888sport live chatী হরিপদ রায়ের আঁকা একটি ব্যঙ্গচিত্রের শিরোনাম ‘পাক্কা চা-খোর’। সেই ছবিটির বর্ণনা লেখক মুহিত হাসান দিয়েছেন এভাবে : ছবিতে দৃশ্যমান সেই চা-খোরের স্বাস্থ্য ভঙ্গুর, গাল তোবড়ানো, খালি পা, চোখজোড়া কোটরাবদ্ধ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথার চুল উস্কো-খুস্কো ও হাতে অমোঘ নিয়মেই একটি চায়ের কাপ। একটি টেবিলে বিশাল বড় এক চায়ের কেটলি ও একখানা পিরিচ সামনে রেখে চেয়ারে উপবিষ্ট।

চা-বিরোধীদের এমনসব প্রচারের বিপক্ষে হয়তো ইংরেজ শাসক ও চা কোম্পানিগুলি 888sport apkী মেঘনাদ সাহাকে সহায়ক হিসেবে পেয়েছিল। তাই পূর্বাশা পত্রিকায় প্রকাশিত ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল টি বোর্ডের একটি বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছিলেন : আমি রোজ চা খাই, দিনে অন্তত দুবার করে। চা পানে স্বাস্থ্যহানি হয় বলে আমি জানিনে। বরং বরাবর দেখেছি সকালবেলা এক কাপ চা খাওয়ার পর দেহ-মনের জড়তা দূর হয়ে যায় এবং কাজে বেশ উৎসাহ আসে। এভাবে বিখ্যাত দুই বাঙালি 888sport apkী চায়ের পক্ষে-বিপক্ষে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। তাতে প্রথম দিকে সাধারণ মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত এবং বিভ্রান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত চায়ের প্রচার-প্রসার থেমে থাকেনি।

চায়ের গল্প সপ্তকাণ্ড রামায়ণের মতো না-হলেও তা নিয়ে অবশ্যই চা-মঙ্গল রচনা করা যায়। চা নিয়ে বাঙালি-সমাজে জনশ্রুতি, কিংবদন্তি, খোশগল্প এবং  রম্যগল্পও আছে অসংখ্য! 888sport appর বাঙাল, রম্যগল্পের রাজাধিরাজ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চায়ের গল্পটি নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। যাঁরা ভুলে গেছেন বা শোনেননি তাঁদের জন্য বলি : এক পাইকারি ক্রেতা মহাজনের দোকানে এসেছে মাল কিনতে। মহাজন তাকে দেখে কর্মচারীকে বলছে : তাড়াতাড়ি বাবুকে গজ দে, গজ দে। বাবুকে ভয়ে জড়োসড়ো হতে দেখে বললেন : ভয় পাবেন না! এই গজ সেই গজ না – চা! এই চা তিনবার ফুটাইছে তো, তাই! তিন ফুটে একগজ না!

শেষ করি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি রম্যগল্প দিয়ে। কলকাতার সল্টলেকের এক বড় রাস্তার পাশের এক টং দোকানে চা খেতে এসেছে এক ট্রাফিক পুলিশ। চা-বিক্রেতা জানে, সে দাম দেবে না, ফ্রি খাবে। তাই সে কর্মচারীকে বলছে : ট্রাফিকবাবুরে ভালো কইরা একটা জয় বাংলা চা দে। পুলিশ চা খেয়ে চলে গেলে একজন খরিদ্দার জয় বাংলা চা কী তা জানতে চাইলে চা-বিক্রেতা বলল : আগে সেদ্ধ করা ফেলে-দেওয়া পাতা দিয়ে তৈরি চা!

তথ্যসূত্র

১.        নুনেতে ভাতেতে-১, খাদ্যসংস্কৃতি বিষয়ক সংকলন। সম্পাদনা : রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল ও অনার্য তাপস। 888sport live : ‘বাঙালির চা পান’, মুহিত হাসান। পঞ্চম প্রকাশ, ২০১৯, হুগলি, কলকাতা।

২.       নুনেতে ভাতেতে-৩, পানীয় সংস্কৃতি। সম্পাদনা : রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল ও অনার্য তাপস। 888sport live :

‘চা-পান উদর’ – দীপারুণ ভট্টাচার্য এবং ‘ভারতে

চা-কফির গল্প’ – অনুষ্টুপ শেঠ। প্রথম প্রকাশ, ২০১৮, হুগলি, কলকাতা।

৩.  হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ। প্রথম সংস্করণ, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, 888sport app, ২০০৬।

৪.       ভেজাল বাঙালি, আবদুস শাকুর। প্রথম সংস্করণ, ঐতিহ্য, 888sport app, ২০০৯।

৫.       বাঙালির বিবিধ বিলাস, ফরহাদ খান। প্রথম সংস্করণ, অনুপম প্রকাশন, 888sport app, ২০০৯।

৬.       বাংলা ভাষা ও 888sport live footballে ব্যবহৃত বিদেশি শব্দের অভিধান, সংকলন ও সম্পাদনা : মোহাম্মদ হারুন রশিদ, বাংলা একাডেমি, 888sport app, ২০২০।

৭.       বাংলার শব্দকথা, ডা. নৃপেন ভৌমিক। অবসর প্রকাশনা সংস্থা, 888sport app, ২০২২।

৮.       বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান-১, বাংলা একাডেমি, 888sport app, ২০১৩।

৯.       বাঙ্গালা ভাষার অভিধান-প্রথম খণ্ড, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস। দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০০, কলকাতা।

১০.      বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

তৃতীয় মুদ্রণ ১৯৮৮, কলকাতা।

১১.      উইকিপিডিয়া।