সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
শাহিনার বাবা হাশিম মিয়া ছিলেন দিনমজুর। সারাদিন তিনি গতর খাটাতেন – অন্যের বাড়িতে, গঞ্জে, বাজারে। এবং সারারাত একটা কাঠের গুঁড়ির মতো ঘুমাতেন। কিন্তু ঘুম থেকে একসময় জেগেও উঠতেন, কোনো কোনো মাঝরাতে, অথবা ভোর যখন রাতের ঘোমটা সরিয়ে অল্প-অল্প মেলছে নিজেকে – এবং স্ত্রীকে জাগিয়ে, তাকে ব্যতিব্যস্ত করে, নিমেষের রতিক্রিয়া সেরে নিতেন – এবং আবার ঘুমিয়ে পড়তেন। ফলে বিয়ের দশ বছরে ছয় সন্তানে তার ঘর ভরে গেল। ঘর মানে ছাপড়া মতো একটা ঘর, শন আর টুকরা-টুকরা পলিথিন দিয়ে ছাওয়া। দুই বোনের পর জন্মেছিল শাহিনা, তারপর একটা ভাই, ইদ্রিস। তারপর আরো দুটো বোন। শাহিনার মা হঠাৎ তিন দিন জ্বরে ভুগে না মরে গেলে হাশিম মিয়ার ছাপড়াঘর ছাড়িয়ে আরো সন্তান-সন্ততি যে একটুকরা উঠানও ভরিয়ে দিত, তা তো পাঁচ বছরের শাহিনাও জানত, যেহেতু হাশিম মিয়া ছোট দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই বিলাপ করে বলতেন, তুমরা পুলা হইলা না ক্যান? আরো ছেলের শখ ছিল লোকটার, কিন্তু ছেলেমেয়ের মুখে যে তিনবেলা খাবার তুলে দেবেন, সেই সামর্থ্য তো তার ছিল না।
এজন্য সেই এগারো বছর বয়সে, ক্ষুধায় কাতর ছোট দুই বোনের কান্না শুনতে-শুনতে এবং একসময় হাশিম মিয়ার আকাশ-ফাটানো ধমকে চমকে গিয়ে, এবং একটি বোনকে হঠাৎ যেন কিছুটা ওপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়তে শুনে, এবং এক ভয়ানক আতঙ্কে তার কান্না গিলে ফেলার এবং অমানুষিক এক চিৎকারে আকাশের দিকে একটা ফরিয়াদ ছুড়ে দেওয়ার শব্দ শুনতে-শুনতে – যে-ফরিয়াদ একটা কুকুরকে ওপর থেকে আছড়ে ফেললেও সচরাচর সে জানায় – শাহিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে জীবনে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না, অথবা, বসলেও কোনো সন্তান নেবে না। ততদিনে বড় দুই বোনকে জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছেন হাশিম, একটিকে তুলে দিয়েছেন চল্লিশ বছরের এক দোজবরের হাতে, অন্যটিকে তিন গ্রাম পরের জোয়ার্দারবাড়ির কামলা নশু শেখের কাছে, যার সম্পর্কে লোকের নানা ধারণা, তবে যে-ধারণাটি সবচেয়ে ভয়ের, তা হচ্ছে, নশু শেখ অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ে করে, কোনো টাকা-পয়সা যৌতুক নেয় না, এবং এক বছরের মাথায় তাদের তুলে দেয় অন্য মানুষের হাতে, যারা বর্ডারে নিয়ে তাদের পাচার করে দেয় ওইপারের কিছু অন্য মানুষের হাতে। এগারো বছরের শাহিনা অবশ্য বিয়ে না করার তার সিদ্ধান্তে একদিনও অটল থাকতে পারত না, যদি হাশিম মিয়া তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে চাইতেন। তিনি চাননি, কারণ শাহিনার চোখের আলো কেন জানি ধীরে-ধীরে মরে যাচ্ছিল। জন্ম থেকে কিছুদিন ভালোই দেখেছে শাহিনা। মায়ের মরামুখটাও স্পষ্ট দেখেছে। তারপর একদিন-একদিন করে অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে তার জগৎটা। সেজন্য, এগারো বছর বয়সে, ছাপড়াঘরের একফালি সিঁড়িতে বসে সে শুধু দুই বোনের কান্না শুনেছে, মাটিতে আছড়ে পড়ে একজন যে ভয়ের চিৎকার দিয়েছে, সেটিও সে শুনেছে এবং শুনেছে হাশিম মিয়ার ক্রুদ্ধ গর্জন। একসময় হাশিম মিয়ার হঠাৎ নীরবতা এবং পড়ি তো মরি দৌড় দেওয়ার শব্দ শুনেছে, এবং এর মাঝখানে একটা সর্বনাশের গরম ঘূর্ণির শব্দ শুনেছে – শুনেছে, কিন্তু দেখতে পায়নি। অথবা পেলেও খুবই অস্পষ্ট, অনিশ্চিত কিছু ছায়ারেখার মতো, যাদের ঘিরে কোনো আলো নেই, শুধুই অন্ধকার। একসময় বসে-বসেই সে শুনল, ইদ্রিস বলছে, কণার নাক-মুখ ফেটে রক্ত বেরোচ্ছিল। ওই ভয়ানক চিৎকার দেওয়ার পর কণার শরীরে খিঁচুনি এসেছিল। মুখটা সাদা হয়ে চোখ দুটি উলটে গিয়েছিল। ইদ্রিস বলছিল আর কান্নার সঙ্গে যুদ্ধ করছিল।
শাহিনার এগারো বছর বয়সকালটা গুরুত্বপূর্ণ। হাশিম মিয়া কণাকে নিয়ে সেই যে দৌড় দিয়েছিলেন, আর ফিরে আসেননি। কিছুদিন না খেয়ে, কিছুদিন প্রতিবেশীদের দয়ায় এক-দেড় বেলা করে খেয়ে শাহিনা যখন কান পেতে আছে আজরাইল ফেরেশতার ডানার শব্দ শোনার জন্য, সে শুনল, তার বড় খালা তাকে ডাকছেন, ও পুড়ারমুখী, ভাইটারে ডাক, আর গোছগাছ কর।
শাহিনার মা মারা যাওয়ার পর বড় খালা, যার কোনো নাম আছে কি না, সে জানে না, তাদের অন্তত দুটি বোনকে নিতে এসেছিলেন। তার পছন্দ ছিল বড় দুটি, কিন্তু হাশিম মিয়া রাজি হননি। তার আঁতে ঘা লেগেছিল, যেহেতু তাঁর স্ত্রীর এই বোনটির কপালে জুটেছিল সচ্ছল পরিবার, যে পরিবারে দুটি কেন, চারটি মেয়ের খাবারের কোনো অভাব হওয়ার কথা নয়। বোনটি রাগ-বিরক্তিতে কোনো কথা না বলে চলে গিয়েছিল। এখন যখন খবর পেয়েছেন, হাশিম পালিয়েছে, তিনটি সন্তানকে ধ্বংসের খাদে ফেলে, তিনি এসেছেন তাদের উদ্ধার করতে।
শাহিনা আশা করেছিল, বাবা ফিরবেন। কিন্তু বড় খালা জানালেন, ওই ইস্টুপিডটাকে পুলিশ ধরেছে। মেয়েকে খুন করার মামলায়। এবং ইস্টুপিডটাই খবর পাঠিয়েছে, কার কার যেন হাতে-পায়ে ধরে, তিনি যেন একটু সহায় হন, তিন মাসুম বাচ্চার একটু দেখভাল করেন।
খালার বাসায় শাহিনার ঠাঁই হলো। তাকে নিয়ে একটা শহরেও গেলেন খালুজান, ইদ্রিসকে সঙ্গে নিয়ে। ডাক্তার দেখে ওষুধ-টষুধ দিলো, বলল 888sport appয় নিয়ে যান। খালু বাড়ি ফিরে 888sport appয় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা চেপে গেলেন। ধরা গলায় বললেন স্ত্রীকে, সম্ভাবনা নাই। ওষুধ খাইতে কইছে, আর পীর-ফকিরের দোয়া মাংতে কইছে।
ইদ্রিস বলেছিল শাহিনাকে, ডাক্তার যে কইল 888sport appয় গেলে তোমার চৌখ ভাল অইয়া যাইতারে, খালুয়ে এই কথা গোপন করল ক্যান?
শাহিনা ইদ্রিসের হাতে আন্দাজে একটা বাড়ি মারল। 888sport appয় গেলেই চৌখ ভালা অইব, তরে কে কইছে? সে বলল, 888sport app নিতে খরচ জানস? টেকাটা তুই দিবি, না খালুয়ে দিব?
এই ঘটনা থেকে দুটি সুতো বেরোলো। একটি শাহিনাকে তার ঘরের দাওয়ার এক কোনায় অথবা উঠানের লেবুগাছটার নিচে বেঁধে রাখল। অন্যটি যেন একটা লাটাই থেকে ছাড়া পেয়ে ইদ্রিসকে নিয়ে আকাশে উড়ল। ইদ্রিস কথা কম বলত, সেই ছোটবেলা থেকেই। সে সিদ্ধান্ত নিল, আপুর চোখ সারাবার জন্য সে তাকে 888sport app নেবে, এবং সেজন্য যত টাকা লাগে, সে উপার্জন করবে। ইদ্রিসের শরীর তার বাবার মতোই লম্বা এবং চওড়া, হাত দুটি যেন কেউ বানিয়েছে তার পেঁচিয়ে, এমনি শক্ত। খালু তাকে স্কুলে ভর্তি করেছিলেন, কিন্তু স্কুলের পর সে কাজ করতে যেত গঞ্জের বাজারে। বাবার মতোই। একসময় গঞ্জের হেলু মিয়ার দৃষ্টিতে সে পড়ল। হেলু মিয়ার ভেতর সমকামিতার একটা স্পৃহা ছিল। সেটা অবশ্য গঞ্জের ভিড়ে লুঙি তুলে ইদ্রিসের প্যান্ট নামিয়ে মেটানো মুশকিল, বাড়িতে তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে ইদ্রিস যে প্রতিদিন তার শরীরে এক ঘণ্টা ডলাই-মলাই করত, তাতে সেই দুধের স্বাদটা শরবতসুখেই মিটত। এই একটা ঘণ্টা তার শরীরে একটা শিরশির স্রোত…
থাক গে, হেলু মিয়ার মতো বজ্জাত লোককে নিয়ে এর বেশি কিছু লেখাটাও বিরক্তিকর। সে জাহান্নামে যেতে পারে। তবে, হেলু মিয়াকে এ-গল্প থেকে ছেঁটে ফেলা সম্ভব নয়, যদিও তা সম্ভব আরেকটি মানুষের বেলায়। সে আমাদের মনা, আছাড় খেয়ে মারা পড়া কণার বড় বোন। সেও বড় হতে থাকল খালার বাড়িতে, একসময় স্কুলে যেতেও শুরু করল। কিন্তু এই গল্পে মনার কোনো ভূমিকা নেই। হাশিম মিয়া হয়তো তাকেও আছাড় দিয়ে মেরে ফেলতেন, সে-ও যেহেতু কাঁদছিল, কণার থেকে একটু জোরেই বরং, যেহেতু ক্ষুধাটাও তার বেশি ছিল, কিন্তু কেন জানি কণাতেই তিনি আটকে গিয়েছিলেন। কিন্তু হাশিম মিয়া তাকে না ছুঁলেও আমাদের ছুঁতে হচ্ছে, এবং বলতে হচ্ছে, বিদায়, মনা।
খালু মাঝে মাঝে তর্ক করতেন বড় খালার সঙ্গে, শাহিনাকে নিয়ে। গঞ্জে তার আড়ত আছে, সেই আড়তে অবশ্য তিনি যান কালেভদ্রে; তার উৎসাহ তার তেলের কলটাতে। সেটা তিনিই চালান। আড়তটা দেখে মিজু জোয়ার্দ্দার। মিজুর স্ত্রী মরেছে চার বছর হলো, চার ছেলেমেয়ের চারটারই গতি হয়েছে। সে এখন বিয়ের জন্য উন্মুখ। খালুর কথা হলো, শাহিনার যেহেতু কোনো ভবিষ্যৎ নেই, মিজুর সঙ্গে বিয়ে দিলে কেমন হয়? মিজুও মেয়েটিকে দেখেছে। তারও আপত্তি নেই। কিন্তু শাহিনার খালা বেঁকে বসেছেন। তার বড় ছেলে আসগর, যে এবার ম্যাট্রিক দেবে, সেও হঠাৎ বেঁকে বসেছে। সে বাবাকে বলেছে, টিভিতে সে দেখেছে বাল্যবিবাহ দিলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। শাহিনাকে জোয়ার্দ্দারের সঙ্গে বিয়ে দিলে সে নিজে পুলিশে খবর দেবে।
শাহিনা ততদিনে তার এগারো বছর থেকে বেরিয়ে এসেছে কয়েক বছর হয়। এ-বাড়িতে যতগুলো শব্দ সে শোনে, তার মধ্যে সব থেকে বেশি তাকে আনন্দ দেয় আর আশ্বস্ত করে যে শব্দ তা আসগরের পায়ের। সে যখন পাশে এসে দাঁড়ায়, এবং বলে, হাতটা একটু বাড়াও তো আপু, শাহিনা ভাবে, আসগর যা-ই তুলে দিক তাতে – একটা মোয়া, একটা পেয়ারা অথবা একটা চিরুনি – তা তো সঙ্গে সঙ্গে একটা চাঁদের আকৃতি পেয়ে যাবে। সেই চাঁদটা হাতে নিয়ে সে বসে থাকবে, তার অর্থহীন দুটি চোখ দিয়ে পানি পড়বে। আসগর যখন বলবে, কান্দ ক্যান আপু? একটা চকোলেট মাত্র, মুখে দিলেই মিলাইয়া যাইব, তখন তার কান্না আরো বাড়ে।
একদিন আসগর তাকে বলেছিল, আমি পড়াশোনা শ্যাষ কইরা চাকরি নিমু। তোমারে 888sport appয় নিয়া যামু। তোমার চৌখ দুইটা ভালা করমু।
রাতে শুয়ে শুয়ে, ঘুমের ভেতরে, শাহিনার কানে কথাগুলি গানের মতো বেজে যায়। সে ভাবে, মানুষ কেন এতো ভালো হয়? এই ভালোত্বের ভার সে সইতে পারে না।
আসগরকে পড়াতে আসত ময়েজ। কষ্টে-সৃষ্টে এইচএসসি পাশ করে কলেজে ঢুকেছে বিএতে। তার বাবারও একটা দোকান আছে গঞ্জে, কিন্তু একটা মানুষ আর একটা সেলাই কল ছাড়া আর কিছুই ঢোকানো যায় না সেই দোকানে, এমনি সংকীর্ণ। সেলাই কলের পেছনে যিনি বসে থাকেন, তিনি ময়েজের বাবা। বসে থাকেন, কারণ হাতে কাজ তেমন না থাকলে বসে বসে রাস্তার ওপর দিয়ে আকাশের শূন্যতার দিকে চোখ মেলে দেওয়া ছাড়া আর কী করার থাকে, বলুন?
ময়েজের ওপর দায়িত্ব পড়েছে, আসগরকে শুধু ম্যাট্রিক নয়, পরের পরীক্ষাগুলি পাশ করাতে হবে। ময়েজ তাতে খুশি। তাছাড়া, পড়াতে এসে এক বেলা যে সে খেতে পারে, তাই বা মন্দ কি।
ময়েজকে ভালো ছাত্রই বলা যায়, যেহেতু অঙ্কটা ভালোই জানে। চালচলনেও গোবেচারা, টুঙ্গিঘরের ভেতর একবার ঢুকলে তার চার দেয়ালের বাইরে চোখ দুটাও যায় না। শুধু খেতে বসলে শরীরটা হঠাৎ যেন চঞ্চল হয়ে পড়ে। মুখটা ক্রমাগত নড়ে, শব্দ করে, চোখ দুটো ঘোরে। পেটে একটা যন্ত্র চালু হয়ে যায়, যাতে ভাত পড়লে ভাত, ডাল পড়লে ডাল, আলুপটোল পড়লে আলুপটোল নিমেষে হাওয়া হয়ে যায়। ফলে তার পেটের আকৃতিটা একটা মাঝারি আকারের বেলুনের মতো। এজন্য শরীরটা আলস্য খোঁজে। আর আলস্যে গেলে কল্পনাটা মনের কপাট খুলে বেরিয়ে পড়ে। ময়েজ 888sport app download apk লেখে। নিতান্ত ছাইপাশ 888sport app download apk, কিন্তু লেখে।
ময়েজের ছাইপাশ 888sport app download apkর একটা নতুন বিষয় জুটল কিছুদিনের মধ্যেই। সে আমাদের শাহিনা। একদিন, হয়তো আসগরকে জটিল কোনো অঙ্ক শেখানোর হঠাৎ ফুরসতে তার চোখ টুঙ্গিঘরের পেছনের দরজার একটা কপাট খোলা পেয়ে বাইরের জগৎটাতে ঢুকে পড়েছিল, এবং বাড়ির উঠানে লেবুগাছের নিচে বসা শাহিনার ওপর পড়েছিল। আসগর বুঝতে পেরেছিল কি না, কে জানে – হয়তো ময়েজের চোখে জমা বিস্ময় এবং শাহিনাকে ছেড়ে সে দুটোর টুঙ্গিঘরে ফিরে আসার অনীহা তাকে কৌতূহলী করেছিল। ফলে সে উঠে দরজার কপাটটা ভেজিয়ে বসে বলেছিল, দরজা খু্ইলা রাখলে আপুর ছাগলটা বাইরে পালাইব।
আসগরের আপুর কথা ময়েজ দু-একবার শুনেছে, কিন্তু মনে রাখেনি; ছাগলটাকেও একবার দেখেছে, ইদ্রিসের সঙ্গে সামনের পুকুরে নেমে সেটিকে গোসল করাচ্ছিল আসগর। আজ সেই আপুকে ময়েজ দেখেছে তার সামনে সময়ের হঠাৎ মেলে ধরা এক অবাক চিত্রপটে। সেই চিত্রপটে মেয়েটি বসে ছিল স্থির, চোখ দুটি সামনে তুলে ধরে, তার পেছনে সবুজ পাতারা দুলছিল, আলোছায়ার কিছু কাঁপন ছুঁয়ে যাচ্ছিল তার মুখ। মেয়েটিকে দেখে ময়েজের মনে হচ্ছিল, যেন সে কারো জন্য অপেক্ষায় আছে।
কে সে?
যতক্ষণ শাহিনাকে দেখেছে ময়েজ, তার নিষ্পলক চোখ দুটি তাকে অবাক করেছে। আরো অবাক করেছে তার চোখে বিছিয়ে থাকা ক্লান্তি।
ময়েজের রাতের ঘুমে ঘুরে ফিরে এসেছে শাহিনা। লেবুগাছের ঘ্রাণ নিয়ে, বিকেলের আলোছায়া নিয়ে, অপলক চাহনি নিয়ে। এবং সে ছাইপাশ 888sport app download apk লেখার অজস্র বিষয় পেয়ে গেছে। এগুলো থেকে বেছে বেছে কয়েকটি তার 888sport app download apkয় যাওয়া-আসা করতে থাকল এরপর। ‘আমি সেই অপেক্ষার পুরুষ’ নামে একটা 888sport app download apk লিখে সে আরেকটি লিখতে বসল, ‘বিকেলবেলার মরা আলোয় তোমার চোখ’। কিন্তু ‘মরা’ কথাটা পছন্দ না হওয়ায় লিখল, ‘বিকেলের লেবুতলায় তুমি ও আমি’ ইত্যাদি।
আসগরকে ভয় পায় ময়েজ। সে জানে, শাহিনার জন্য একটা 888sport app download apk তার হাতে তুলে দেওয়া আর এ-বাড়ির সীমানায় চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হওয়া একই জিনিস। এজন্য সে ভাব জমালো ইদ্রিসের সঙ্গে। সন্ধ্যায় যখন ময়েজ ফিরে যায়, ইদ্রিসের সঙ্গে পথে দেখা হয় – ইদ্রিসও যেহেতু সে-সময় গঞ্জ থেকে বাড়ির পথ ধরে। একদিন সে ইদ্রিসকে জিজ্ঞেস করল, শাহিনা 888sport app download apk পড়তে ভালোবাসে কিনা। প্রশ্নটা শুনে ইদ্রিস প্রচুর অবাক হলেও সহজ উত্তরটা দিলো, আপু পড়তারে না। দুবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে ময়েজ খুব কষ্ট পেয়েছিল। না, মেয়েদের পড়াশোনা শেখা নিয়ে কোনো আদর্শ চিন্তা ছিল না ময়েজের – সে কষ্ট পেয়েছিল তার 888sport app download apk তার স্বপ্নের মেয়েটি পড়তে পারবে না, সেই দুঃখে। ইদ্রিস কম কথার মানুষ, সে ব্যাখ্যা করেনি কেন শাহিনা পড়তে পারে না। আসগর থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে, সেরকম আশা করাটাও বৃথা। সেজন্য ময়েজ তার মনের দুঃখ চেপে ছাইপাশ 888sport app download apk লিখে যেতে থাকল, আর স্বপ্ন দেখল, একদিন সে শাহিনাকে নিয়ে নদীর পারের ঢালে একটা আকন্দ ঝোপের পাশে বসে তাকে 888sport app download apkগুলি শোনাচ্ছে।
শাহিনার নামটা সে ইদ্রিস থেকে শুনেছে। তারপর তার ব্যাগ্র চোখ টুঙ্গিঘরের কপাট পেরিয়ে শাহিনাকে খুঁজেছে। দু-একবার তার কপালের কপাট খুলে দিয়েছে সময়। লেবুগাছের নিচে নিশ্চল মহিমায় বসে থাকা শাহিনাকে দেখে ময়েজের ভেতরটা হাহাকার করেছে। লেবুতলার আলোছায়াকে তখন সে ঈর্ষা করেছে। কত সহজে তারা স্পর্শ করে গেছে শাহিনার চুল। হাত রেখেছে শাহিনার গালে, চুমু দিয়েছে তার ঠোঁটে। আর তার পাশে বসে এক হাতে তাকে জড়িয়ে শুনিয়েছে তাদের 888sport app download apk।
একদিন – এবং এই একদিনটা এসেছে দীর্ঘ দীর্ঘ সব প্রতীক্ষা, কষ্ট, কাতরতা আর হতাশার দিনক্ষণ পার হয়ে, যে কালক্রমে এক ছাত্রনেতার সঙ্গে তর্ক করার অপরাধে ময়েজের বাবাকে তার সেলাই মেশিনটাসুদ্ধ রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে; দোকানটাতেও, বলতে গেলে, এবং সেই কষ্টে কিছুদিনের মধ্যে বাবা চোখ বুজেছেন, এবং সংসারের দায়িত্বটা এসে পড়েছে ময়েজের কাঁধে, এবং শহরে চাকরি করা এক মামাতো ভাই তাকে একটা ছোটখাটো চাকরি জোগাড় করে দিয়েছে এক পলিক্লিনিকে – ময়েজ ভেবেছে শাহিনাকে তার কথাগুলো জানাতেই হবে। জানানো ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না তার সামনে। আসগরের বাবাকে সে বলেছে, সাতদিনের মধ্যে তাকে কাজে যোগ দিতে হবে, যদিও যখনই সে বাড়ি আসবে, আসগরকে পড়াবে, এবং এজন্য কোনো পয়সা সে নেবে না। আসগরকে সে বলেছে, মন দিয়ে অঙ্ক করতে, এবং ইদ্রিসকে বলেছে শাহিনার সঙ্গে সে একটুখানি কথা বলবে। ইদ্রিস জিজ্ঞেস করেছে, ক্যান? ময়েজ বলেছে, উত্তরটা সে শাহিনাকে দেবে। ইদ্রিস কথাটা গিয়ে বলেছে শাহিনাকে। শাহিনা হ্যাঁ না কিছু বলার আগে বড় খালা সেটি লুফে নিয়েছেন। ক্যান? ক্যান? বলে তিনি একটা শোরগোল তুললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আসগরের বাবাও তা শুনলেন। এবং টুঙ্গিঘরে ময়েজের শেষ দিনটা শেষ হওয়ার আগেই আসগরের বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ক্যান?
কিছুক্ষণ চুপ করে অকম্পিত গলায় ময়েজ বলল, শাহিনাকে আমার মনে ধরেছে। এই কথাটা তাকে কইতে চাই।
ময়েজের উত্তর শুনে বিমূঢ় হলেন আসগরের বাবা। তুমি তারে দেখছ? তিনি বিমূঢ় প্রশ্ন করলেন।
এক-দুই দিন। টুঙ্গিঘর থাইক্ক্যা। সে বলল।
আসগরের বাবা বিমূঢ়তা কাটাতে মাথা চুলকালেন। আমাগো পরিবারে কোনো মাইয়ারে এই রকম কথা কওয়ার নিয়ম নাই। তিনি বললেন, তুমার মনে ধরেছে, ভালা কথা, এহন এই মনে ধরা মনেতে রাইখ্যা চইল্যা যাও।
খুব যে কড়া করে কথাগুলি বলেছিলেন আসগরের বাবা, তা নয়, কিন্তু ময়েজের কানে সেগুলো যেন গলানো লোহা হয়ে ঢুকল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, আর যদি আমি তারে বিবাহ করতে চাই?
আসগরের বাবা এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কও কি মিয়া, বিবাহ করবা? তিনি হতবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।
জি, যদি আপনারা অনুমতি দেন। আমি তো একটা চাকরি পাইছি, শহরে। এইচএসসি পাশ করছি সেকেন্ড ডিভিশনে। বিএতেও পড়তাছি।
ময়েজের প্রায় মুখের সামনে মুখ নামিয়ে আনলেন আসগরের বাবা। তার চোখে একটা ঝিলিক দেখা গেল। ঝিলিকটা সহানুভূতির, না বেদনার, না শুধুই তীর্যক একটা মজার, ময়েজ বুঝল না। তিনি বললেন, কিন্তু মাইয়াটা যে চৌখে দেখে না? আন্ধা?
চৌখে দেখে না? ময়েজের প্রশ্নটা একটা আর্তনাদের মতো শোনালো।
না।
আন্ধা?
কইলাম তো।
মাথাটা মাটির দিকে নামিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল ময়েজ। তার ভাবনায় লেবুতলার বিকেলের চিত্রপট ভেসে উঠল। সময়ের পর্দাটা একটুখানি সরে গিয়ে অপার্থিব দু-এক মুহূর্তের মহিমা ধরা পড়ল। শাহিনার গালে-ঠোঁটে খেলা করা আলোছায়ায় সেই মহিমা এক তীব্র কাঁপন ধরিয়ে দিলো। সেই কাঁপনে একটা হাত রাখার একটা প্রবল ইচ্ছা ময়েজের ভেতরে জেগে উঠল। সে চোখ তুলে বলল, আমি যদি শাহিনাকে বিবাহ করতে চাই, আপনাদের আপত্তি আছে?
আসগরের বাবার মনে হলো, ছেলেটা অঙ্ক ভালো জানলেও ভেতরে-ভেতরে একটা আস্ত ছাগল, শাহিনার ছাগলটার মতোই। একটা আন্ধা মেয়েকে জেনেশুনে বিয়ে করতে চায়, এর থেকে অবাক হওয়ার মতো কোনো কথা হয়তো শাহিনার ছাগলটাই একমাত্র বলতে পারে, যদি ছাগলটা কোনোদিন কথা বলতে পারে।
শাহিনার বড় খালা শুধু বললেন, মাইয়াটা কী কয়, শোনেন। পুলাটারে কন, শাহিনার লগে কতা কইতে।
অতএব ময়েজকে কথা বলতে হলো। শাহিনাকে টুঙ্গিঘরে নিতে চেয়েছিল আসগর, কিন্তু ময়েজ লেবুতলাকে বেছে নিল। বলল, ভাই আসগর, তুমি আর ইদ্রিস একটু তফাৎ যাও।
তারা তফাতে গেল। লেবুতলায় থাকল শুধু ময়েজ আর শাহিনা।
দুই
শাহিনার এখনো মনে পড়ে খুব গাঢ় অন্ধকারে একটা অস্পষ্ট কিন্তু ভরাট ছায়া যেন ভেসে এলো কোথা থেকে, কিন্তু তার চোখের ভেতরে তার আভাস পৌঁছাতে না পৌঁছাতে আবার অদৃশ্যমানতার অন্ধকারে তা ডুবে গেল। কিছু এলোমেলো শব্দ হলো, এবং একটা অনিশ্চিত গলা ভেসে এলো। যে কথা বলছে সে যেন লজ্জিত অথবা কুণ্ঠিত, কিন্তু বলার একটা তাগিদও আছে সে-গলায়। অনেকক্ষণ সেই গলা শুনল শাহিনা। একসময় মনে হলো মেঘের ওপার থেকে বর্ষার ধারার মতো যেন তার কথাগুলি ঝরছে। এবং তার ভেতরটাকে ভেজাচ্ছে। যার জন্য তুমি অপেক্ষা করো, আমি সেই মানুষ, লোকটা বলল।
শাহিনা বিব্রত হলো। কার জন্য আমি অপেক্ষা করুম? সে বলল, অপেক্ষা অন্যেরা করতে পারে, আমার মতো মাইনষের অপেক্ষা আবার কী?
মানুষটার গলা এরপর ভারি হয়ে গিয়েছিল। তুমি যদি রাজি হও, এই দুইন্যাতে তাইলে আমিই হমু সব থাইক্যা সুখী। বুঝলা? সে গাঢ়স্বরে বলেছিল।
অনেক দিন সেই অবাক করা বিকালটা নিয়ে শাহিনা ভেবেছে। একটি বিকেল তার জীবনটাকে এরকম পালটে দেবে, অন্ধকার থেকে একটা আলোর দিকে নিয়ে যাবে, একজীবনের অপ্রাপ্তির কষ্ট ঘুচাবে, সে কি কখনো ভাবতে পেরেছিল?
সন্ধ্যায় যখন বড় খালা তার মাথায় হাত রেখে বললেন, কি রে মাইয়া? লোকটারে মনে ধরছে? শাহিনার মনে হচ্ছিল যেন লোকটাই সামনে দাঁড়িয়ে, আর তার গলা থেকে ঝরছে জাদু, এবং সেই জাদু তার মুখের সব কথা কেড়ে নিয়ে তাকে একটা ঘোর বিপদে ফেলে দিয়েছে।
মাথাটা নিচু করে শাহিনা শুধু কাঁদতে পেরেছিল, বড় খালার কথার উত্তরে।
তিন
শহরে একটা এক কামরার বাসা ভাড়া নিয়েছিল ময়েজ। একটা গলির শেষ মাথায় একটা ছোট ভদ্রগোছের বস্তিতে। সেই কামরার বাইরে একটা উঠান অবশ্য ছিল, কিন্তু তার মালিকানা ছিল আর দশটা এক-দুই কামরার মানুষজনের সকলের। উঠানে লেবুগাছও ছিল না, সেখানে বসে থাকার কথাও কেউ ভাবতে পারত না। সারাদিন সেখানে চলত কোলাহল, বাচ্চাদের খেলাধুলা, ঝগড়া, চিৎকার। কামরাটার পেছনে একটা দরজা অবশ্য ছিল, এবং দরজার পাশে একটা বাথরুম, স্নানের জায়গা। দরজার সঙ্গে একটা সিঁড়ি, চার ফুট দূরে উঁচু দেয়াল, এই সিঁড়িতে বসতে অসুবিধা ছিল না শাহিনার, যেহেতু এদিকে কারো আসার সম্ভাবনা ছিল না। বলা যায় এই চার ফুটের সামান্য একটি ভূগোলে তার একটি একক অধিকার ছিল।
কিন্তু শাহিনার কাছে চার ফুট যা, চল্লিশ ফুটও তা। তার চোখে এ দূরত্ব কোনো তারতম্য সৃষ্টি করত না।
ময়েজ বেরিয়ে যেত সকালে, ফিরত সন্ধ্যায়। নিয়ম করে। সন্ধ্যায় ফিরে সে চুলা জ্বালাতো। শাহিনা হাতের আন্দাজে মশলা পিষত, তরকারি কাটত, রান্না করত। ময়েজ পাশে বসে তদারকি করত। তার হাতের স্পর্শে শাহিনার সারাদিনের কষ্ট উবে যেত। তার মনে হতো, স্বর্গ নিয়ে এতোদিন সে যেসব কথা শুনেছে নানান জনের মুখে, তার তুলনায় এই এক কামরার ঘরটা কম কিছু তো নয়। ময়েজ তার দিনের গল্প বলত, শাহিনার সারাদিনের খতিয়ান নিত। শাহিনা অল্প দু-এক কথা বলেই শ্রোতার আসনে চলে যেত। আপনি কন, আমি হুনি, সে বলত।
একদিন ময়েজ তাকে বলল, হেলু মিয়া ইদ্রিসকে একটা দোকান করে দিয়েছে। আরেকদিন বলল, ইদ্রিস একটা তেলের কল দিয়েছে। এবং এর ছ-মাস পর জানাল ইদ্রিস একটা মোটরসাইকেল কিনেছে।
কথাগুলি শাহিনা যে জানে না, তা নয়। ইদ্রিস মাঝে মধ্যে শাহিনাকে দেখে যায়, তার জন্য এটা-সেটা নিয়ে আসে। শেষবার এসেছে সেই মোটরসাইকেলে চড়ে। শাহিনাকে বলেছে, তার কপালটা হেলু মিয়া খুলে দিয়েছেন। তাকে একটুকরা জমিও দিয়েছেন, যেখানে সে একটা ঘর তুলেছে। এখন সে ওই ঘরেই থাকে, যদিও মনা আছে বড় খালার সঙ্গে।
ইদ্রিসের কথাগুলোও নতুন নয়। এসব সে শুনেছে বড় খালার থেকে। ময়েজ তাকে একটা মোবাইল ফোন দিয়েছে, যে ফোনটা এক চালান ফোনের সঙ্গে ক্লিনিকের এক ডাক্তার পেয়েছিলেন এক এনজিও থেকে, অন্ধদের ব্যবহারের জন্য। সেই ডাক্তার দেখেছেন শাহিনাকে, এবং তার মনে হয়েছে সমস্যাটা জটিল। এটি তার পক্ষে সারানো সম্ভব নয়। 888sport appয় হলে হতে পারে, অথবা বিদেশে।
ইদ্রিসকে নিয়ে এর আগে যখন কথা বলেছে ময়েজ, তার গলায় শাহিনা স্নেহ শুনেছে, সমর্থন শুনেছে, উচ্চাশা শুনেছে। তার গলা আর্দ্র হয়েছে, উচ্ছ্বসিত হয়েছে। ময়েজের হাত শক্ত করে ধরে শাহিনা বলেছে, এই একটা ভাই আমার একশটা।
ভাইয়ের মতো ভাই তোমার, বউ, ময়েজ বলেছে, এবং শাহিনা সে কথায় শুনেছে পরিতৃপ্তি এবং প্রশংসা।
কিন্তু যেদিন থেকে ইদ্রিসের তেল কল দেওয়ার আর মোটরসাইকেল কেনার গল্প শুনছে শাহিনা, তার মনে হয়েছে, আগের সেই উচ্চাশা অথবা পরিতৃপ্তি অথবা প্রশংসা যেন সে শোনেনি। স্নেহটা যে আছে, সে টের পেয়েছে, কিন্তু তা আড়াল করে দিয়েছে নতুন একটা সুর, যার সঙ্গে এই প্রথম পরিচয় শাহিনার। কয়েক দিন তার ভেতর একটা অস্বস্তি খেলা করেছে। একটা কাঁটা যেন খচখচ করেছে, একটা না বুঝতে পারার অসমর্থতা তাকে বিপন্ন করেছে। ঠিক কী সেই সুর, কেন সেই সুর, সে ভেবেছে। ব্যাপারটা আরো জটিল হয়েছে ময়েজের আর সব কথায় পুরনো, মন ভরানো সুর বেজে যাওয়ায়। রাতে বিছানায় শুয়ে তার কানের কাছে সেই চেনা কথার মীড়, ঘুমের ভেতর তলিয়ে যেতে যেতে মেঘের ওপার থেকে বর্ষার ধারার মতো মন ভিজিয়ে দেওয়া সুর। কিন্তু ইদ্রিসের কথা উঠলে তালটা কেন কাটা যায়? সেই কাটা তালের নামটা কি?
উত্তরটা পেতে দেরি হলো না শাহিনার। একদিন সে বুঝল, এই নতুন সুরটা, অথবা সুরের অভাবটা আসছে একটা নিশ্চিতিবোধ থেকে। ইদ্রিস এখন পারবে, ইদ্রিস এখন তৈরি। যদি প্রয়োজন হয় – যদি – ইদ্রিস আছে। এই নিশ্চিতিবোধটা তো এতদিন ছিল ময়েজের একচেটিয়া মালিকানায়। সে যখন বলত, এই আমার হাত, এই হাতে তোমার হাত। ব্যস, দুইন্যাটা উইল্টা গেলেও এইটা কেউ ছাড়াইতে পারব না, তখন এই নিশ্চিতবোধটা ভোরবেলায় পাখপাখালির জেগে ওঠার শব্দের মতো তাকে আশা জাগাতো।
আজ কেন ইদ্রিসকে এই নিশ্চিতিবোধের ভেতর টেনে আনা?
ইদ্রিস তার নতুন কেনা মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে গেলে ময়েজ বেশ পুলকিত স্বরে বলল, অহন আর দেখতে অইব না। ইদ্রিস অহন খালি উপরে উঠব। দুবার সে কথাটা বলল, এবং দুবারই ময়েজের খুশি গলায় শাহিনা শুনল নিশ্চিতি। সে হঠাৎ প্রশ্ন করল, ইদ্রিস এখন আমারেও দেইখ্যা রাখতে পারবে, আপনি এই কথাই কি কইতে চান?
ময়েজের গলা নেমে এলো। এমন কথা কেন কইলা বউ?
মাটির দিকে তাকিয়ে বলল শাহিনা, আমরা না একটা বাবু চাইছিলাম? আপনি বাবুর কথা আর একদিনও কন না ক্যান?
ইদ্রিসের লগে বাবুর কী সম্পর্ক বউ? কী উল্টাপাল্টা কও?
শাহিনা চুপ করে থাকে। বাবু নিয়ে তাদের একটা পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনা যদি ঠিকঠাক এগোতো, তাহলে এতদিনে বাবুটা তার পেটের ভেতরে ছয় মাসে পা দিত। কিন্তু ছয় মাস হলো ইদ্রিসের গল্পটা শুরু হয়েছে, অথবা ময়েজ শুরু করেছে, এবং তারপর থেকে বাবুটাও চলে গেছে তাদের পরিকল্পনা সমেত।
আপনিই কন, সে আস্তে করে বলল।
রাতে ঘুমের ভেতর তলিয়ে যাওয়ার আগে শাহিনা শুনল, একটা না বউ, দুইটা বাবু দিমু তোমারে।
তারপর একটু সময় নিয়ে বলল, আর কয়টা দিন।
কিন্তু কেন জানি ময়েজের কথাগুলো বর্ষাদিন থেকে ছুটি নিয়ে চৈত্রে চলে গেল, এবং চৈত্রের ঘূর্ণির মতো কিছু হল্কা ছড়িয়ে গেল।
শাহিনার ঘুমে হানা দিলো হল্কাদিনের দুঃস্বপ্ন।
চার
একদিন ময়েজ তাকে জানাল, শোনো বউ, মধ্যপ্রাচ্যত একটা চাকরি হইছে।
মধ্যপ্রাচ্যত?
হুঁ। কাতারো। কাতারোর হাসপাতালে। অনেক অনেক টেকা বেতন। নাম হুনছ কাতারোর?
না।
অনেক টেকা। তিন বছরের কাম। তারপর দেশে ফিইরা একটা ব্যবসা দিমু, বাড়ি বানামু। তখন তোমার কোল জুইড়া আইব দুই বাবু।
শাহিনা মধ্যপ্রাচ্যের ভূগোল বিষয়ে আসগর থেকে শুনেছে। আসগর বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ধুধু মরুভূমি। শুধু বালিয়াড়ি। কাতারে ময়েজের চাকরি পাওয়ার কথা শুনে শাহিনার মনে হলো, তার ঘুমের মধ্যে চৈত্রের যে ঘূর্ণি তুলেছিল ময়েজ, এখন তা যেন মরুভূমির ফোস্কাছড়ানো হাওয়া হয়ে তার ভেতরটা পোড়াচ্ছে।
কেন, সে জিজ্ঞেস করে, কেন যেতে হবে ময়েজকে কাতারে? যেতে হবে কারণ সে সারাজীবন আইডিয়াল পলিক্লিনিকে অ্যাকাউন্টস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাটাতে চায় না। তার অনেক স্বপ্ন আছে, নিজেকে নিয়ে শাহিনাকে নিয়ে, আগামীতে যে দুই বাবু আসবে তাদের সংসারে, তাদের নিয়ে।
কাতারে যেতে এরপর মাস তিনেক সময় লাগল ময়েজের। কিন্তু প্রতিরাতে যখন তার স্বপ্নের কথাগুলো আরেকবার করে বলত ময়েজ, কেন জানি তার গলায় আগের সেই ভরাট ভাবটা থাকত না। কোথাও যেন একটা সুর কেটে যাচ্ছে, একটা জায়গায় একটা ফাঁক থেকেই যাচ্ছে। যেন নিজের স্বপ্নের কথা বলার সময় যে উচ্ছ্বাসটা কলকলিয়ে উঠত, শাহিনাকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথায় তাতে কোথাও ছিপি লাগার শব্দ শুনত সে। যেন কেউ চাপ কলটাতে চাপ কমিয়ে দিচ্ছে। গলগলিয়ে পানির ধারা নামছে না কলের মুখ থেকে।
শাহিনার যে-কথাটা বারে বারে মনে হতো শেষ তিন মাস – ইদ্রিস যদি হেলু মিয়ার সুনজরে না পড়ত, বিশেষ করে হেলু মিয়ার বড় ছেলেটা জোর করে তার থেকে পাঁচটা দোকান লিখিয়ে না দিত, এবং ইদ্রিস তার পাশে দাঁড়িয়ে না বলত, পুলা পর হইছে চাচা, তাইতে কি, আমি তো আছি, এবং সে তেলের কল না দিত, মোটরসাইকেল না কিনত, এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যা, একটা ঘর না তুলত, তাহলে কি ময়েজ মধ্যপ্রাচ্যে যেত? যাওয়ার কথা ভাবতে পারত? প্রথমে এজন্য ইদ্রিসের ওপর খুব অভিমান হয়েছিল শাহিনার। কিন্তু রাতে শুয়ে-শুয়ে যখন সে ভাবত, তার মনে হতো, না। ইদ্রিসের কিছু না হলেও ময়েজ যেত। তার স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। শহরে চাকরি নিয়ে এসে সে বুঝেছে, টিকে থাকতে হলে শুধু সামনে এবং ওপরে তাকাতে হয়। কথাগুলো সে অনেকবার বলেছে শাহিনাকে। এগুলোকে সে আমল দিত না। যেহেতু মেঘে ভেজা অনেক শব্দের সঙ্গে এসব সে বলত। মেঘে-ভেজা শব্দগুলো এগুলোকে আড়াল করে দিত, অথবা এদের ডানা মেলতে দিত না।
একরাতে চমকে উঠে বিছানায় বসেছে শাহিনা। পাশে নাকে শব্দ তুলে ঘুমাচ্ছে ময়েজ। তার গায়ে একটা হাত রেখে সে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল, আমারে তোমার যে মনে ধরছিল, সেই ধরাকি এহন মিলাইয়া যাইতাছে? এই রাইতের নরম বাতাসর লাহান?
ময়েজের নাকের শব্দে কথাগুলি মশারির ভেতরই হারিয়ে গেল।
পাঁচ
কাতার গেল ময়েজ এবং কাতারে গিয়ে হারিয়ে গেল, যেমন আর দশ বাঙালি যায়। প্রথম প্রথম প্রায় দিনই ফোন করত, কিন্তু কাজের চাপে ফোন করা কমে গেল। ফোনে ময়েজের কণ্ঠ খুব অচেনা মনে হয় শাহিনার কাছে, যেন মানুষটার গলার ভেতরে যে মেঘ ছিল, যেগুলো কোনো কোনো ঘনরাতে জমে মেঘ হতো, বৃষ্টি হতো, শাহিনাকে তুমুল ভেজাতো, সেইসব মেঘ হারিয়ে গেছে। যেন ময়েজের গলায় এখন মরুভূমির দুপুর। না, ময়েজকে দোষ দেয় না শাহিনা। সে এখনো বলে, বউ, একটু সবর করো। আর দিন গুইনো। একদিনের পরে একদিন। তিনটা বছর তো মানুষ জেলেও থাকে, কী কও। অথবা, তোমার মুখটা মনে পড়ে, আর আমি কান্দি, অথবা, রাইতে তোমারে পাশে পাই না বউ, আমার ঘুম হয় না। ইত্যাদি। কিন্তু ময়েজের গলায় সে নিশ্চিন্তি শোনে না। আষাঢ়ের মান্দ্রিত কোলাহল শোনে না। গোপন কোনো স্পর্শ শোনে না। সে শোনে এক মানুষের স্বপ্নের আর স্বপ্নপূরণে তার বিশাল এক অভিযানের বয়ান। সেই বয়ানটা জুড়ে শাহিনা যদি থাকে, তা ময়েজের হাত ধরে, ময়েজের কাঁধে চড়ে।
অথচ, শাহিনা জানে, ক্লিনিকে চাকরি নিয়ে এসে যখন প্রথম প্রথম তার স্বপ্নের কথাগুলি বলত, শাহিনা থাকত তার ঠিক মাঝখানে।
ছয়
গল্পটা ছোট করতে হয়, না, শাহিনার জন্য নয়। শাহিনার যে জীবন তাতে একদিনের থেকে আরেকদিনের, একটা ছায়ার সঙ্গে আরেকটা ছায়ার কোনো পার্থক্য নেই। ছোট করতে হয় আপনাদের জন্য, যেহেতু আপনারা হয়তো অপেক্ষা করছেন, তিনটা বছর কবে কাটবে, আর কবে ময়েজ ফিরবে তার প্রিয়তমার কাছে।
তিনটা বছর আমরা এখানেই শেষ করে দিচ্ছি – না, ঠিক তিনটা নয়, সাড়ে তিনটা, যেহেতু কাতারের হাসপাতাল তাকে ছাড়তে চাইছিল না। তারপর ময়েজ ফিরেছে বটে, তবে শাহিনা সেকথা জানল না। না জানলেও অবাক হয়নি শাহিনা, যেহেতু শেষ ছয় মাস কোনো ফোন পায়নি ময়েজ থেকে। ময়েজের পরিচিত এক লোক ফোন করে বলেছে, ময়েজ ভাইরে কাতারোর পুলিশ ধইরা নিয়া গেছে। হাসপাতালে চুরি অইছিল, এই অভিযোগে।
লোকটার কথা শুনতে শুনতে ফোনটা ইদ্রিসের দিকে এগিয়ে দিয়েছে শাহিনা। তার ইচ্ছা হয়েছিল লোকটাকে বলতে, উনি তো আপনার লগেই দাঁড়াইয়া আছেন, উনার নিঃশ্বাস তো আমি শুনতাছি, এই মিছা কথাটা কওনের কী দরকার আছিল? কিন্তু সে তা না বলে ইদ্রিসকে দায়িত্ব দিয়েছে কথা শেষ করার। ইদ্রিস শুনেছে অন্তত পাঁচ বছরের জেল হবে। টাকা-পয়সা সব বাজেয়াপ্ত হবে। লোকটা ডুকরে কেঁদেছে।
ইদ্রিস জিজ্ঞেস করেছে, আপু, অহন কী অইব?
শাহিনার চোখে জল। সে সামনের দিকে শান্ত চোখ মেলে বলেছে, কপালে যা আছে, তাই।
ময়েজ চলে যাওয়ার পর নিজের বাড়িতে শাহিনাকে এনে তুলেছে ইদ্রিস। ঘরের সঙ্গে একটা উঠান, সেই উঠানে একটা লেবুগাছ লাগিয়েছে। না, লেবুগাছের চারা লাগায়নি, বরং বন্ধু বাক্কারের বাড়ি থেকে নিচের মাটিসুদ্ধ একটা লেবুগাছ তুলে এনে উঠানে লাগিয়েছে। লেবুগাছের গন্ধে শাহিনা স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু এই লেবুগাছের নিচে বসে-বসে সে নিজের জীবনের পালাবদল দেখেছে, ময়েজের বদলে যাওয়া দেখেছে। সবশেষে তাকে জীবন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টাটা দেখেছে। অনেকদিন থেকে ময়েজের গলায় সে মিথ্যা শুনে আসছে। সে বুঝেছে, ময়েজ জীবন চিনেছে, টাকা চিনেছে, আরাম চিনেছে। এক বছর থেকে মিথ্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে ধোঁকা। কত রাত আমার কাটে না-ঘুমাইয়া, বউ, তোমারে কইলে বিশ্বাস করবা না, সে বলেছে, এবং পেছনে সে অন্য মানুষের হাসি শুনেছে, যে হাসি ইদ্রিস শুনত না। তার বড় খালা অথবা মনা শুনত না। তার জায়গায় ময়েজ হলে সেও শুনত না। সে বুঝেছে এই অন্য মানুষেরা তার বন্ধু। রাতে তারা হয়তো তাস খেলবে, অথবা পাশা। সিগারেট খাবে। একদিন ময়েজ বলেছে, তোমার একটা হাত আমি ধইরাই রাখছি বউ, এবং শাহিনা তার হাই চেপে যাওয়ার আওয়াজ শুনেছে, অভ্যাসের কথাগুলো বলার ক্লান্তি শুনেছে।
তারপরও সে ঠিক বুঝতে না পারল, পাঁচ বছরের জন্য জেলে যাওয়ার অভিনয়টা ময়েজের কেন করতে হলো। তার বুক ভেঙে কান্না এলো, তার মনে হলো, এর চাইতে তাকে যদি ময়েজ বলত, বিদায়, তাহলেও এত কষ্ট সে পেত না।
সাত
ইদ্রিস 888sport appয় নিয়ে গেছে শাহিনাকে, তার টাকা হয়েছে; হাতে টাকা থাকলে যে-সাহসটা হয় মানুষের তা হয়েছে; দু-এক মানুষকে বেতন দিয়ে পুষতে পারলে যে কর্তৃত্ব জাগে মানুষের, তাও তার জেগেছে। ফলে বড় হাসপাতালের বড় ডাক্তারকেই সে দেখিয়েছে। একটা অপারেশন করেছেন ডাক্তার, তারপর ওষুধ দিয়েছেন। বলেছেন, তিন মাস এই ওষুধ চোখে লাগাতে। তারপর আরেকটা অপারেশন। ইদ্রিসকে বলেছেন ডাক্তার, যদি ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করেন, চোখ দুটা দিয়ে দুনিয়াটা দেখতে পারবেন আপনার বোন। আমার আপনার মতো না, তারপরও দেখতে পারবেন। নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারবেন। ইত্যাদি।
888sport appয় যাওয়া-আসায় থাকতে হলো কিছুদিন। ইদ্রিস হেলু মিয়াকে গিয়ে বলল, চাচা, কাম দেন। পঞ্চাশ হাজার টেহার দরকার।
হেলু মিয়া হেসে বললেন, কামের কুনু অভাব নাই।
লেবুতলায় বসে একদিন শাহিনা দেখল, তার চোখের সামনের জমাটবাঁধা অন্ধকারটা কেমন জানি তরল হচ্ছে, সেই তারল্যে তরঙ্গ তুলে একটা কিছু ছোটাছুটি করছে। সেটিকে ছুঁতে গিয়ে তার হাতে কিছু রেণু লেগে গেল। প্রজাপতি? সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। প্রজাপতিটা পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে। কখনো লেবুগাছে বসছে। চোখ বন্ধ করে প্রজাপতির ওড়াউড়ি দেখতে পেল শাহিনা। তার খুব খুশি লাগল। ছোটবেলায় প্রজাপতির পেছনে কত না ছুটেছে সে! এখন অনেক দিন পর, একটা প্রজাপতি এসে তাকে বলল, চোখটা খোলো। আমাকে দেখ।
ইদ্রিসকে অবশ্য সে কিছুই জানাল না।
দুদিন পর ইদ্রিস এসে সামনে দাঁড়াল শাহিনার। শাহিনা টের পেল, ইদ্রিসের মেজাজ ভালো না। কী রে ভাইয়া, সে জিজ্ঞেস করল।
লোকটা অহন 888sport appয়, সে বলল।
কোন লোকটা? শাহিনা বলল, এবং বলেই বুঝল, বলাটা ভুল হয়েছে। সে চুপ করে থাকল।
বাক্কার কইল, লোকটা একটা বিয়া করছে।
শাহিনা চমকে উঠল। বিয়া? সে জিজ্ঞেস করল।
888sport appর এক মাইয়ারে। মাইয়াটা তার সব টেহা হাতড়াইয়া নিছে। আমি হারামজাদারে ধইরা আইনা তার কল্লাটা কাটুম।
আরেকবার চমকে উঠল শাহিনা। না। মুখ খারাপ করবা না।
ঠিক আছে আমার ময়েজ দুলাভাইরে দাওয়াত দিয়া আইনা আমি পুলাও-গোস্ত খাওয়াইমু। ইদ্রিস রাগ চেপে রেখে বলল।
তোমার কিছু করন লাগব না। তোমার কাম আছে না? যাও। শাহিনা বলল, এবং চোখ বন্ধ করে দুই হাতে মাথাটা ধরে নিচু হয়ে বসে রইল।
ইদ্রিস চলে গেলে নিজেকে প্রশ্ন করল শাহিনা। যতটা অবাক হওয়ার কথা, ততটা কেন হয়নি সে-খবরটা শুনে? তার তো একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার কথা ছিল, বিলাপ করার কথা ছিল, তাহলে? তার মনে পড়ল, কাতার থেকে একবার ফোনে সে বলেছিল, 888sport appর এক লোকের সঙ্গে সে ব্যবসা করবে। লোকটা ভালো। ইত্যাদি। শাহিনা সেদিন তার গলায় লোভ শুনেছিল। আর কি কিছু শুনেছিল? মনে মনে সে 888sport sign up bonus হাতড়ালো। এবং দেখতে পেল, ময়েজের লোভ নানা ডালপালা ছড়াচ্ছিল। একটা ডাল কি এই মেয়েটির দিকে লতলতিয়ে বেড়েছিল? মেয়েটি কি ওই 888sport appর লোকটার বোন?
এত কষ্টের মাঝখানেও শাহিনার হাসি পেল। ইদ্রিস বলার আগেই সে শুনেছে, না, ময়েজের বিয়ের খবর নয়, তার 888sport appয় ফেরার খবর। বড় খালা তাকে জানিয়েছেন, এবং খালু এও জানিয়েছেন, 888sport appর এক লোকের সঙ্গে সে ব্যবসা করছে। গঞ্জের অনেকেই তা জানে। একজন 888sport appয় তাকে দেখেওছে। তবে বাক্কার যে ময়েজের বিয়ের খবরটা দিয়েছে, সেটি শাহিনার কাছে নতুন, আবার নতুনও না।
আট
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মশারা উড়ছে। কিন্তু লেবুগাছের নিচ থেকে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। চান্দার মা বুড়ি, যাকে ইদ্রিস রেখেছে শাহিনার দেখাশোনার জন্য, গজর গজর করতে করতে একটা কুপি রেখে গেছে। কিছু না হোক কুপির ধোঁয়ায় দু-একটা মশা তো মরবে। শাহিনা চোখ বুজে ছিল বলে টের পায়নি। কিন্তু চোখ বুজে ভাবতে ভাবতে যখন তার মনে হয়েছে দুনিয়াতে যে কেউ যা কিছু করুক, যার যে কাজ অথবা অকাজ করার ইচ্ছা তা করুক অথবা না করুক, সে তা নিয়ে আর ভাববে না। সে ভুলে যাবে, তা চারদিকে জগৎ বলে কিছু আছে। এই লেবুতলা ছেড়ে সে কোথাও যায়নি, কোথায় যাওয়া যায় না, এমনটিই সে ভাববে। এবং যদি কোনোদিন একটা মানুষ তার ধূসর জগতে একটা গাঢ় ছায়ার মতো আবার ঢুকে পড়তে চায়, মেঘের ওপার থেকে ভেসে আসা কথা শোনাতে চায়, অথবা চৈত্রের ঘূর্ণি তোলা হাওয়ায় তাকে ভাসাতে চায়, সে সোজা জানিয়ে দেবে, শাহিনা নামের কেউ কোনোদিন ছিল না। শাহিনা লেবুতলায় পড়ে থাকা একটা ছায়ামাত্রের নাম। এই ছায়ার কোনো কায়া নেই, কোনো অস্তিত্ব নেই।
কিন্তু চোখ খুলে সে বুঝল একটা আলোর নাচন চলছে কোথাও। আলোটা আবছা, যেন একটা কাচের ভেতর দিয়ে পড়ছে, যে কাচে এক বর্ষার জল পড়ে পড়ে অস্বচ্ছ হয়ে গেছে। তারপরও আলোটা দেখল শাহিনা। কিসের একটা তাগিদে আলোটা নাচছে, বুঝতে পারল না সে, কিন্তু সেই নাচটা দেখতে দেখতে তার ঘোর মতো লাগল। তার ভেতরের জমে থাকা অন্ধকারে একটু একটু আলো পড়তে থাকল। কোথাও যেন একটা ছন্দ জেগে উঠল। চান্দার মার কুপি, কিন্তু এ যেন কোনো কুপি নয়, যেন একঝাঁক জোনাকি। দপ-দপ করছে, দুলছে নাচছে তার সলতের শিখাটা, আর শাহিনার ভেতরটা দোলাচ্ছে। শিখাটা একটা মোটামুটি আদল নিয়েছে; শিখাটা যে একটা শিখা, সেটি বুঝতে সমস্যা হলো না তার; কোথায় তার অবস্থান, তাও সে অনায়াসেই বুঝতে পারল। হঠাৎ তার মনে হলো, চেঁচিয়ে সে ইদ্রিসকে ডাকে, এবং বলে, সে কুপিটা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু ইদ্রিস বাড়ি নেই। তাছাড়া ইদ্রিসকে বলা আর না বলা এখন একই জিনিস। কুপির আলোটা তার ভেতরে যে পড়েছে, তার সলতের শিখায় একটা নাচন যে শুরু হয়েছে তার অস্তিত্বে অথবা অনস্তিত্বে, এই বিষয়টি এমনি একান্ত নিজের যে অন্যকে, এমনকি আপন ভাইকেও, তা বলাটা এখন অর্থহীন। তার চাইতে ভালো হয়, শাহিনা ভাবল, তার একাকিত্বকে, তার সন্ধ্যার লেবুতলাকে উদযাপন করলে। চোখ বন্ধ করলেও যখন চান্দার মায়ের কুপির শিখাটা নাচ থামালো না, সে হেসে হাত বাড়িয়ে কুপিটা তুলে নিল।
তারপর দুই আঙুলে সলতেটা চেপে নিভিয়ে দিলো।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.