888sport app download apk latest version : মেহবুব আহমেদ
মেয়েটি দেখছিল একটি ছেলে গানের সুরে শিস দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। একসময় সামনে এসে ছেলেটি দাঁড়িয়ে গেল, বিনীত ভঙ্গিতে জানতে চাইল, পপি স্ট্রিট কোন দিকে। প্রশ্নটির উত্তর দিতে মেয়েটি একটু দেরি করছিল, কিন্তু এটুকু সময়ে মধ্যেই যে ছেলেটি ওর গলার হার ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেবে সে তা ভাবতে পারেনি।
চিন্তামগ্ন মেয়েটি রাস্তার যেদিক দিয়ে হাঁটছিল সেদিক দিয়েই এগিয়ে এসেছিল ছেলেটি। ওকে দেখে তাই সন্দেহ জাগেনি, সাবধান হওয়ার কথাও মনে হয়নি। ওর মার্জিত ভঙ্গিতে অবস্থাপন্ন ঘরের ইঙ্গিত ছিল।
একটা তীব্র আঘাতে মেয়েটির বুকের পাঁজর যেন নড়ে গেল। মুহূর্তের জন্য অবশ বোধ হলেও উন্মত্ত ক্রোধ তাকে দ্রুত সামলে নিতে সাহায্য করল। সে ‘আমার হার, আমার হার, দাঁড়া চোর দাঁড়া’, বলে হাহাকার করতে করতে ছেলেটির পিছু ধাওয়া করল। লোকজন বেরিয়ে এলো দোকানপাট, ঘরবাড়ি আর ছোট ছোট কারখানা থেকে, সবাই যেন বেশ ভয় পেয়েছে, নিশ্চল দাঁড়িয়ে তারা যা ঘটছে দেখতে লাগল।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চোরটাকে পেছনে ফেলে মেয়েটি ওর পথ আটকে দাঁড়াল। নাছোড়বান্দার মতো তাড়া করে মেয়েটি যে অতটা দ্রুত দৌড়ে আসতে পারবে – এ ধারণা ছেলেটির ছিল না।
চোরটা তখন এঁকেবেঁকে দৌড়াতে লাগল। মাথার ওপর সূর্য আগুন ঢালছে। আলো পড়ছিল ছেলেটির ঘর্মাক্ত মুখের ওপর। অপকর্মে অভ্যস্ত ওর আঙুলে জড়ানো সোনার হারটা চকচক করে উঠল। ঝুলন্ত লকেটটার একদিকে উৎকীর্ণ ছিল ব্যাবল টাওয়ার১, অন্যদিকে রক-ডোম২। গয়নাগাটি জায়গামতো রাখার অভ্যাস মেয়েটির কোনোদিনই ছিল না; কিন্তু কখনো এসব খোয়া গেলে কত টাকার জিনিস হারাল তা ভেবে মন খারাপ করার আগেই সেসব সে পেয়ে গেছে। কিন্তু আজ যেন মনে হলো ওর আত্মাটা শরীর থেকে হঠাৎই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দাঁতে দাঁত চেপে চোরটাকে ধরার জন্য হাত বাড়াল মেয়েটি, থাবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো ওর আঙুলগুলি। চোরটা তখন ওর সামনে সোজা দাঁড়াতে গিয়ে ডান পা পিছলে টলে পড়ে গেল। তখনই মেয়েটি থাবা দিয়ে ধরল ওর শার্টের কোনাটা এবং ধরেই রইল। ছেলেটি নড়তে পারছিল না। মেয়েটির হাতের টানে শার্ট উঠে গিয়ে তার পিঠ বেরিয়ে গেল। চেষ্টা করেও মেয়েটির কঠিন থাবা থেকে সরতে পারছিল না ছেলেটি।
লোকজন মৌমাছির মতো ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল; কিন্তু কেউ এগোল না মেয়েটির সাহায্যে। মনে হচ্ছিল, লোকগুলো নির্বোধ, যেন ওদের মাথা কাজ করছে না। সাহায্যের আশায় মেয়েটি আর্তস্বরে বলে উঠল, ‘চোর দে, আমার হারটা দে।’
হঠাৎ চোরটা তার ট্রাউজারের লুকানো পকেট থেকে একটি ছুরি বের করে মেয়েটির মুখের ওপর ঘোরাতে লাগল। লোকজন পিছিয়ে যাচ্ছিল, ধাক্কাধাক্কি হচ্ছিল পায়ে পায়ে। সম্মিলিত কণ্ঠে তারা ওকে সাবধান করছিল।
‘সরে আসুন, ওর হাতে ছোরা।’
‘আরে বোকা, ও তো ফেঁড়ে ফেলবে মুখটা।’
‘ওর সঙ্গে পারবেন নাকি? কেন এতো সাহস করছেন?’
‘জেদী মেয়ে।’
মেয়েটির মুখ আরো কঠিন হয়ে উঠল যেন এক শক্তিধর অপদেবতা আশ্রয় নিয়েছে ওই ধীর-শান্ততার গভীরে। আসলেই বিশাল এক সাহস সঞ্চারিত হলো ওর মধ্যে। ভয় নামক কোনোকিছু এক মুহূর্তের জন্যও ওর চেতনায় এলো না। পিছু হটবে না ও।
এক কারখানায় কাজ করা তরুণ ওর সাহায্যে এগিয়ে আসছে দেখে লোকজন ওকে চেপে ধরল, বুদ্ধি নয়, রাগ দেখিয়ে বলল, ‘মরতে চাও নাকি? ও যা ইচ্ছে করুক, নিজের জেদের দায় নিজেই নিক, সে দায় আর কারো নিতে হবে কেন।’
ভয় মেশানো বিকারগ্রস্ত এসব কথা মেয়েটার হৃদয়ে আঘাত করল। মনে হলো চারপাশে ছোট ছোট পাখির ঝাঁক লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। ‘বাধা দেওয়ার কথা ওঠেই না, লোকটার হাতে মারাত্মক অস্ত্র।’ বিনা যুদ্ধে হার স্বীকারের ভঙ্গিতে কয়েকজন বলল।
ওদের আত্মসমর্পণ মেয়েটির জেদ আরো বাড়িয়ে দিলো, অন্ধ হিংস্রতা ফেটে পড়ল ওর ভেতর। ছেলেটি ওর মুখের ওপর যে ছুরিটা ঘোরাচ্ছিল সে চেষ্টা করল নখগুলোকে একটা অস্ত্রে পরিণত করে চোরের মুখটাকে নাগালের মধ্যে পাওয়ার। একটা বিশ^াস থেকে সে দৃঢ়ভাবে বলতে লাগল, ‘থাক না ওর কাছে সারা পৃথিবীর অস্ত্র, আমার হার আমি হতে দেব না।’
ওই মুহূর্তেই ঠোঁটদুটো পেছনে টেনে কটমট করে ওর দিকে তাকাল ছেলেটি; সাদা দাঁত খিঁচিয়ে রুক্ষস্বরে বলে উঠল, ‘জেদী অসভ্য ছুকরি।’ মেয়েটি দেখল ছেলেটির হলুদ চোখের মণিতে নিজের ছায়া পড়েছে আর আচমকাই ছেলেটি ওর কপালের পাশে, মুখে পাশবিক শক্তিতে ঘুসি মারছে। ভারসাম্য হারিয়ে চোরের আওতার মধ্যেই পড়ে গেল মেয়েটি। ঘুসি চলতেই লাগল। ততোক্ষণে আলগা হয়ে গেল মেয়েটির হাতে ধরা তার শার্ট আর তখনই জানোয়ারটা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে সবার চোখের সামনে মেয়েটিকে লাথি মারল। লোকজন কেবল ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখে দাঁড়িয়েই রইল। আরো একবার মেয়েটিকে প্রচণ্ড এক লাথি মেরে ছেলেটি পালিয়ে গেল।
তখনই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি। এলোমেলো চুল, নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, বেশবাস ধুলো-ময়লায় মাখামাখি। সমস্ত শক্তি জড়ো করে আবার সেই আর্তচিৎকার, ‘আমার হার, আমার হার’, বলে ধাওয়া করল মেয়েটি; কিন্তু ততোক্ষণে চোরটা পৌঁছে গেছে ওর সঙ্গীর কাছে, রাস্তার কোনায় যে মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। লাফ দিয়ে ওর পেছনে উঠতেই সে মোটরসাইকেল চালিয়ে দিলো। এবং ভিড়ের মধ্যে পথ কেটে বেরিয়ে গেল। মেয়েটি বুঝল, সবই ওদের পরিকল্পিত ছিল।
হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল মেয়েটি। সেই শক্তি, দৃঢ়তা – সব হারিয়ে গেছে। চোখ বেয়ে নামল উষ্ণ, জ্বালাধরানো অশ্রু, শরীরের ভেতর বইল অপমানের লজ্জাপ্রবাহ, এরকম এক রাস্তার পাশে বাস করার লজ্জা। অচেনা লোকের আক্রমণের চাইতে প্রতিবেশীদের নিষ্ক্রিয়তাকে তার কঠিনতর আঘাত মনে হলো। দুঃখে মন ছেয়ে গেলে তার মনে পড়ল কায়রোর রাস্তায় একাধিক তরুণের দ্বারা ধর্ষিত সেই মেয়েটির কথা, কোনো পথচারী যার সাহায্যে এগিয়ে যায়নি, হৃদয় নামক পদার্থটি কাজ করেনি তাদের, বরং এক আনন্দদায়ক, উত্তেজক ছবির মতো সবাই দৃশ্যটা উপভোগ করেছে।
দূর-অতীতের এক ঘটনার কথাও তার মনে পড়ল। এক মাদী উটের ওপর আক্রমণের জের ধরে আরবের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলেছিল। মানুষের অপমানের কথা অনুভব করে মেয়েটি গভীর অন্তস্তল ঠান্ডা পাথরের মতো হয়ে গেল। ভারি ও কাতর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আর ঠিক তখনই বাতাসে দুপুরের আজান ভেসে এলো আর সেই পবিত্র ধ্বনিবিন্যাস ওর অন্তস্তলের দুঃখবোধের সঙ্গে একাকার হয়ে তার যন্ত্রণা উপশম করতে লাগল।
লোকজন ভিড় করে দাঁড়াল চারপাশে। ওর চোখের দিকে না তাকিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল –
‘এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল, কী যে খারাপ লাগছে আমাদের।’
‘ওভাবে বিপদের ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হয়নি।’
‘নাছোড়বান্দার মতো নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনতে চাইলেন।’
‘অন্তত বিপদটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন, এখন ভালো থাকবেন – সেই আশাই করুন।’
‘দামি জিনিস গোপন করে রাখতে হয়, মানুষের নজরে পড়ার অবস্থায় রাখা ঠিক হয়নি।’
আহত অহংকার নিয়ে লোকজনের মুখের দিকে তাকাল মেয়েটি, নিঃশব্দে যেন এক দেয়াল উঠে গেল তার আর ওদের মাঝখানে। তারপর যখন ধুলো-ময়লায় মাখা কাপড়চোপড় নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারল তখন ওর কানে এলো একজন ঘৃণা মেশানো ধীরস্বরে বলছে, ‘লজ্জা করে না? নিজেকে হাসির পাত্র করে তুলেছেন, কী যে বিশ্রী কাণ্ড।’
ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটি, খুঁজতে লাগল কার গলা দিয়ে এলো কথাটা। তারপর স্থির দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে তীব্রস্বরে বলল, ‘ভীরু মেরুদণ্ডহীন, কাপুরুষ সব। নিজেকে, নিজের অধিকারকে রক্ষার সংগ্রাম করে কে হাসির বিষয় হয়েছে?’
কঠিন কথাগুলি তীব্রস্বরে বললেও তাতে বেদনার আভাস ছিল। সবাইকে তা নাড়া দিয়ে গেল।
রাস্তার শেষে ওর বাবা-মায়ের বাড়ি। আবার ও একাই হাঁটতে শুরু করল। ভারি ভারি অলীক কল্পনায় আবদ্ধ মন এবার মুক্ত হয়েছে বলেই তার মনে হলো, মেঘের আড়াল ছিন্ন করে সূর্যটা বেরিয়ে এলো এবং তার উত্তপ্ত নিশ্বাস যেন বিদ্বেষ ছড়াতে লাগল। কিন্তু এরই মধ্যে সে অবিচলিত পদবিক্ষেপে এগিয়ে যেতে থাকল।
লেখক-পরিচিত
রাশিদা আল শারনি ১৯৬৭ সালে তিউনিসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। আরবি ভাষায় লেখা তাঁর দুটি গল্পসংগ্রহ আছে – ঞযব খরভব (১৯৯৭) এবং The Life (1997) Ges The Neighing of Questions (২০০০)। রাশিদা 888sport alternative linkও লিখেছেন। তিনি তিউনিসেই থাকেন।
এ-গল্পটি হেলন হাবিলা সম্পাদিত আফ্রিকান শর্ট স্টোরি (২০১১ সালে গ্রান্টা বুকস থেকে প্রকাশিত) থেকে গৃহীত।
১। ব্যাবল টাওয়ার : শিনার অঞ্চলের এক প্রাচীন শহরে মহাপ্লাবনের পর ওই এলাকার লোকজন একটি মিনার তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যার চূড়া স্বর্গ স্পর্শ করবে। কিন্তু তাঁদের আকাক্সক্ষার ধৃষ্টতায় ঈশ্বর বাধা দেন। বাইবেলের এ-গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় এক সৌধ নির্মিত হয় এবং আধুনিক বিশেষজ্ঞরা একেই ব্যাবল চূড়া বলে আখ্যায়িত করেছেন।
২। রক-ডোম : প্রাচীন জেরুজালেমের এই কীর্তিটি নির্মাণের পর এর আসল গম্বুজটি ১০১৫ সালে ভেঙে পড়ে। ১০২২-২৩ সালে গম্বুজটি আবার তৈরি করা হয়। বিশ শতকে সম্পূর্ণ গম্বুজটিতে সোনার পাত বসানো হয়েছে। এটি মুসলমান ও ইহুদি উভয় ধর্মাবলম্বীর কাছে এক পবিত্র তীর্থ। এখান থেকেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর দর্শনে যাত্রা করেছিলেন।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.