ফেরদৌস সাজেদীন
সকালের খোলা রোদের রাস্তা সামান্য উঁচুতে উঠে গেছে। আপহিল, একটু ঝুঁকে হাঁটতে হচ্ছে। চোখেমুখে বাতাসের ধাক্কা। এক বস্নলক এগুলেই বাঁয়ে মোড় নিয়ে আরেকটা বস্নক, তারপর বড় রাস্তা পার হলেই ‘মেট্রো’। বেরুবার আগে হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে জিজ্ঞেস করে পরিষ্কার বুঝে নিয়েছি, কী করে যেতে হবে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। পৃথিবীর সব শহুরে ব্যস্ততার মেজাজ ও আয়োজন অনেকটাই একরকম। যে যার কাজে যেতে প্রায় নিঃশব্দে হাঁটছে বা ছুটছে। নটা-পাঁচটার নাগরিক জীবনের বেড়া, সর্বত্র। এই শহর অচেনা, কিন্তু আজ সকালের নগরচিত্র চিরচেনা। আমরাও আজ এদের একজন হয়ে মেট্রো চড়তে পাতালে নামি। টোকেন কিনে প্লল্যাটফর্মের দিকে এগোই। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আশপাশে তাকাই। আমাদের নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে যেমন, এখানেও দেখি ছোট-ছোট দলবদ্ধ মানুষ ট্রেন-দরোজা-খোলার স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও একটি দলে দাঁড়াই। দু-এক মিনিটের মধ্যেই ট্রেন এলো, মানুষে গাদাগাদি কামড়ায় উঠে পড়ি।
আমাদের চার নম্বর স্টেশনে নেমে ট্রেন বদলাতে হবে। যথারীতি ট্রেন থেকে নামি আরেক ট্রেন উঠতে। কিন্তু প্লল্যাটফর্ম কোনদিকে? কোনো সাইন নেই। হয়তো আছে, বুঝে উঠতে পারছি না। অনেকটা লন্ডনের টিউবের আদলে এদের মেট্রো, যাত্রীরা রাশ আওয়ারের ঠাসাঠাসি সামলে আসেত্মধীরে এগোচ্ছে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করি আমার প্লল্যাটফর্ম কোনদিকে হবে। মাঝবয়সী ভদ্রলোক, সঙ্গে আট-দশ বছরের মেয়ে, আমাকে আন্তরিকভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোন দিকে যেতে হবে। কিন্তু আমার মুখের ভাবসাব দেখে তিনি বুঝে উঠলেন, আমার কাছে এই দিকনির্দেশনাটা অত সহজ মনে হচ্ছে না। লোকটি বললেন, ‘আমিও ওইদিকে যাচ্ছি, আমাকে ফলো করো।’ আমরা ওর পেছন-পেছন এগোই। প্লল্যাটফর্মে এসে আমরা ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছি, ভদ্রলোক বললেন, তার অল্প-ভাঙা ইংরেজিতে, ‘আমি যে স্টেশনে নামব সে-স্টেশনে তোমরাও নামবে। তারপর তোমরা স্টেশন থেকে বের হয়ে ট্রাম নেবে, ওপরেই। আমার মেয়ের স্কুল অন্যদিকে, ওকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমি কাজে যাব।’ আমাদের স্টেশন এলে আমরা সবাই ট্রেন ছাড়ি। ভদ্রলোক ‘গুডলাক-গুড ডে’ বলে মেয়ে-হাতে অদৃশ্য হলেন। আমরা এস্কেলেটরে ওপরে উঠছি। ভিনদেশি একজন অপরিচিত সহযাত্রীর বিরল উষ্ণ ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম।
মেট্রো স্টেশন থেকে বের হয়ে ওপরে এসে চট করে ট্রামের স্টপটি খুঁজে পাচ্ছি না। সামনে ট্যাক্সি দেখে এগিয়ে যাই। চালককে গন্তব্যস্থলটি বলে ট্যাক্সিতে উঠি। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ আমার মনে হলো ট্যাক্সিচালক ঠিকানা জানে না – এত দূরে হওয়ার কথা নয়, জিজ্ঞেস করি, তুমি জানো কোথায় যাচ্ছ? উত্তরে কিছু বলল, আমরা বুঝতে পারলাম না। এটুকু বুঝলাম, ট্যাক্সি ড্রাইভার একবর্ণ ইংরেজি জানে না। এরকমটা আগেও হয়েছে অন্য শহরে। একটি ট্রামস্টপে ট্যাক্সি থামলে আমরা নেমে পড়ি। কী করি, ভাবছি, দেখি, অনতিদূরেই স্টেশনের প্রবেশস্থানে ট্রাম-ব্যবস্থাপনার লোক যাত্রীদের সাহায্য করছে। কাছে যাই। ম্যাপ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘এই স্টেশন থেকে যাওয়া যাবে’? মাথা নেড়ে বলল, ‘যাবে’। আমরা টোকেন কিনে প্লল্যাটফর্মে ট্রামের জন্যে অপেক্ষা করি। আকাশ নির্মেঘ, ফুরফুরে আবহাওয়া, আশপাশে অনেক মানুষ, কেউ কারো দিকে তাকিয়ে নেই। আমাদের সব ভালো লাগছে। এমনকি এই ট্রামের জন্যে অপেক্ষাও।
কিন্তু ঝলমল রোদ-মাথায় দু-এক মিনিটের দাঁড়ানোকে অপেক্ষা বলা যায় না। রেলের চাকা শব্দহীন প্রায়, দুই বগির ট্রাম এলো, আমরা চটপট উঠে পড়ি। বগিঠাসা মানুষ। সবাই হাতল ধরে মার্জিত ও শালীন চোখ-মুখ নিয়ে কে কী দেখছে বা ভাবছে, কে জানে। এরই মধ্যে কেউ একজন বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রীকে তার ছেড়ে দেওয়া জায়গায় বসতে বলল। আমরা দুজনই অবাক হলাম। এই যে 888sport promo codeজাতির প্রতি সম্মানবোধ, এই প্রক্রিয়ায়, অনেকদিন পরে দেখি। আমার স্ত্রী আপত্তি করেও ছাড় পেল না। নিরুপায় হয়ে বসল। ট্রামের জানালা দিয়ে দেখি, সরু ফুটপাতের পাশে সারি-সারি দোকান, বেশিরভাগই ক্যাফে বা রেসেত্মারাঁ, মনে হলো হাত বাড়ালেই চায়ের কাপটি ছুঁ-মেরে তুলে নেওয়া যাবে, ফুটপাতের লোকজনের প্রায় গা-ছুঁয়ে ঝকঝকে-তকতকে প্রশস্ত ট্রাম যাচ্ছে, ধীরে-ধীরে, কারো মনোযোগ নেই সেদিকে। আমার খুব আনন্দ হলো, খুব ইচ্ছে করছে একটু নেমে যাই, একটু বসি রেসেত্মারাঁয়, একটু চুমুক দিই চায়ের কাপে, চুমুক দিতে-দিতে দেখি, এদের সময়-বিহার, এই নগরের এই সময়ের নাগরিক চাঞ্চল্য, আর দেখি, হাত-বাড়ালেই-ছুঁতে-পারি-চলন্ত ট্রাম। মোটকথা, সরু রাস্তার ট্রামে চড়ে মানুষ আর পুরনো শহরের সংস্কৃতি-সুবাস চুকচুক পান করছি, এর শেষ হোক চাই না, ট্রামে-ট্রামে এরকম সময় যদি অনবরত বর্তমান হয়ে ওঠে, ক্ষতি নেই।
কিন্তু মিনিট দশেক পরই আমাদের ট্রাম থেকে নামতে হলো – ‘সুলতানাহমেতে’, আমাদের কাঙিক্ষত স্টেশনে। হুড়মুড় করে প্রায় সব যাত্রীই নেমে পড়লেন। পোশাক-আশাক আর বিস্ময়মাখা চোখমুখ বলে দিলো আমরা সবাই টুরিস্ট। দেখার খিদে নিয়ে দুনিয়ার প্রায় সব দেশের মানুষ এক-এক করে ছড়িয়ে পড়ল ডানে-বাঁয়ে-সামনে-পেছনে। আমরা এগিয়ে গেলাম সামনে।
‘বস্নু মস্কে’র আসল নাম হচ্ছে ‘সুলতান আহমেদ মস্ক’। মসজিদের ভেতরের দেয়াল ও ডোমের টাইলসগুলোতে নীল রং প্রাধান্য পেয়েছে বেশি, তাই আদর-নাম ‘বস্নু মস্ক’। অটোম্যানদের দুশো বছরের মসজিদ স্থাপনাশৈলীর সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে এই মসজিদ পৃথিবীর লোক ডাকছে সুলতানাহমেতে আসতে। একটি বিশাল, বড়, উঁচু, অতি সুন্দর কারুকার্যে শোভিত ‘ডোম’ অটোম্যান যুগের অভ্যর্থনা হয়ে দৃশ্যমান, ছটি সুউচ্চ মিনার, সঙ্গে আরো আটটি ছোট-ছোট ডোম, বড়-বড় কাঠের দরোজা ভেতরে ঢোকার, আমরা বিস্ময়ে চারিদিকে তাকাই। অটোম্যানদের শেষদিকের স্থপতি-বিলাসের এ-নিদর্শন সুলতান আহমেদ করেছিলেন অটোম্যানদের আধিপত্য-ঘোষণাকল্পে, ‘আমরা ফুরিয়ে যাইনি’ এইটি বিশ্ববাসীকে জানান দিতে। আমরা মুগ্ধ হয়ে, অবাক হয়ে সব দেখি।
দুপুরের খিদে আমাদের বেড়েছে। মসজিদ থেকে বের হয়ে রেসেত্মারাঁ খুঁজছি। ট্রাম-রাস্তায় নেমে আশপাশ দেখি, অনতিদূরেই মাথার ওপর ছাতার মতো টানা ছাদ দেওয়া বেশ সুন্দর একটি খোলা ক্যাফে চোখে পড়ল। ট্রাম-রাস্তায় পথচারী এলোমেলো এদিক- ওদিক। এরই মধ্যে ট্রাম সাবধানী হয়ে এগিয়ে যায় তার রেল ধরে। যে-রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে রেসেত্মারাঁটা দেখছি, তার বাঁপাশে একটু সরে গিয়ে ট্রামের রাস্তা আর ডানপাশে একটু উঁচুমতো জায়গায় উঠে গেছে আরেকটি রাস্তা, আর এই ত্রিভুজের মাঝখানে ‘গ্রিন কর্নার’ – আমাদের লাঞ্চ হবে সেখানে। মনে-মনে এরকম একটি ক্যাফেতে বসতে চাইছিলাম। আমার স্ত্রী বলল, ক্যাফেতে ঢুকতে-ঢুকতে, ‘বাহ’।
আজ সকাল থেকে সবকিছুই সুন্দর যাচ্ছে। তাপমাত্রা না শীত না গরম, ঝকমকে নরম কোমল রোদ, খোলা আমন্ত্রণ প্রকৃতির, আমরা দুজনই এসব উপভোগ করছি। পাশের লাগোয়া টেবিলে দুজন বৃদ্ধা মুখোমুখি বসেছে। ওদের একজন আমাদের দিকে দু-একবার তাকিয়েছে, আমি খেয়াল করেছি। মেনু দেখছি, আমার স্ত্রী হাতপাঁচেক দূরে একজন মধ্যবয়সী মহিলা উনুনে মাটির ‘তা’য়ে ‘ব্রেড’ ছেঁকছেন, তা দেখছে। অভিনব এক রুটি-বেলুন, উপুর করা তা’য়ে হাতে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে ছেঁকা, এটা-আমাকে-খেতে-হবে, এরকম রসনাসিক্ত রুটি। ওয়েটারকে 888sport app খাবারের সঙ্গে এই রুটিও যোগ করে দিতে বলি। পাশের টেবিলের বৃদ্ধা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ফ্রেশ, ভেরি গুড, পৃথিবীর আর কোথাও এরকম রুটি বানানো দেখিনি।
– আমিও না। আমি ও আমার স্ত্রী প্রায় একসঙ্গে বলি।
এর মধ্যেই সালাদ এলো, পানি এলো, আমরা খাবারের দিকে মনোযোগী হই। সালাদে ড্রেসিং ঢালছি পাশের বৃদ্ধা দুজন উঠতে- উঠতে বলল, আজ রাতেই ফিরে যাব, কথা বলে ভালো লাগল, এনজয়। সামনের বছর তোমাদের দেশে যাব, অনেকদিন ধরেই প্লল্যান করছি, খুব সুন্দর ভারতবর্ষ, তাই না?
– হ্যাঁ, খুব সুন্দর আর ওদেরও অনেক স্থাপত্য888sport live chat রয়েছে, ‘তাজমহল’? থেমে বললাম, আমরা কিন্তু 888sport appsের।
– ও, সরি। আমাদের ম্যানচেস্টারেও অনেক 888sport appsি আছে, ওদের অনেক রেস্টুরেন্ট, আমরা তোমাদের খাবার খুব পছন্দ করি। আমাদের ঘরেও তোমাদের মশলাপাতি রয়েছে। সপ্তাহে অন্তত একদিন তোমাদের খাবার হতেই হবে। বৃদ্ধা এক নিশ্বাসে বলল। আমার স্ত্রী মুগ্ধ হয়ে বলল, বাহ।
– তোমাদের সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল, এনজয়। বৃদ্ধা দুজন বলল।
– হেভ অ্যা সেইফ ট্রিপ, বলি। মহিলা দুজন অন্তর্হিত হলো। আমরা খাবার সামনে নিয়ে এতক্ষণ ওদের সঙ্গে কথা বললাম, সালাদ ছিল শুধু, গরম উবে যায়নি, ভাগ্যিস। আমার স্ত্রী বলল, কে বলবে এই বৃদ্ধা দুজন পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে! এঁরা আমাদের মশলা ভালোবাসে, বলো!
– তা বাসে। কাবাব এসে গেছে, ভীষণ ক্ষেদে, কথা থামিয়ে ‘বিফ কাবাবে’ মনোযোগী হই।
‘গ্রিন কর্নার’ ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আলস্য বোধ করি দুজনেই। আজ আর কোনো মিউজিয়ামে না গিয়ে একটু ঘুরেফিরে হোটেলে ফিরে যাব সিদ্ধান্ত নিই। সুলতানাহমেত চত্বরে মানুষের ঢল দেখছি, কারো কোনো উদ্বেগ নেই চোখেমুখে বা হাঁটায়, আপন-আপন সুন্দর সময়ের অনুগত দাস সবাই। এসব দেখে মন আনন্দে ভরে গেল। অল্পক্ষণ পরেই রাস্তার কোনায় সাইন দেখি ‘গ্র্যান্ড বাজারে’র, একটুখানি হাঁটাপথ। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, যাই, দেখি। গ্র্যান্ড বাজারে যাওয়ার কথা আগে থেকেই ভেবে রাখা আছে। আলস্য পালাল।
গিয়ে দেখি এলাহি কা-। ১৪৫৫ সালের শীতে অটোম্যান সাম্রাজ্য কনস্টান্টিনোপল জয় করার পরপরই, এই অভাবনীয়, একই-ছাদের-নিচে-দেয়াল-ঘেরা বাজারটি তৈরি করতে শুরু করে।
এই ছাদের নিচে ষাটের বেশি সরু সড়কে-সড়কে তিন হাজারের বেশি দোকান, পসরা, তেজারতিতে ঠাসা, ভাবা যায়? এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও পুরনো, একই ছাদ ও দেয়ালঘেরা বাজার। গ্র্যান্ড বাজারে, যতই ভেতরে ঢুকছি, অনুভব করে নিতে পারছি, কেন এটা বিশ্বের এক নম্বর দর্শনীয় স্থান। গেল বছর এই বাজারে এসেছেন আনুমানিক নববই মিলিয়ন টুরিস্ট! পুরনো এবং পুরনো বলেই উৎসাহ বাড়ছে আমাদের। বিরল-বিশালতার ব্যাপারটি তো আছেই। কী নেই এই বিপণিগুলোতে – সব আছে। আমরা এখানে অন্যজগতের সন্ধান পাই ও সময়জ্ঞানহীনতার কাছে সমর্পিত হই।
আগেই জ্ঞাত হয়েছি, গ্র্যান্ড বাজারে শুধু দেখতে যেতে হয়, কিছু কিনতে নয়। এখানে যারা দোকানদার তারা টুরিস্টদের কাছে একটি কর্মযোগেই দিনমানধরি পরিশ্রান্ত হয়, আর তা হলো, দামাদামির ছলনায় তাদের ঠকানো ও গছানো। দেখি সবাই বিদেশি, আর যত না ক্রেতা, তারচেয়ে বেশি বিক্রেতা। সড়কের দুপাশে দোকান, সড়কের ওপরেই বিক্রেতাদের ডাকাডাকি – আমার দোকানে এসো, এখানেই তোমার জিনিস পাবে, সঠিক দাম, এসব। এই বিক্রেতাদের প্রায় সবাই যুবক বয়সী। এক হাতে চায়ের গস্নলাস, অন্য হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট, অস্থির, ডাকাডাকি-হাঁকাহাঁকির মধ্যে মনে হলো একটা আপদ-বিপদের মধ্যে এসে পড়েছি। দেখি এই চায়ের গস্নলাস তাদের কাছে ঝুলানো-হাতল-ট্রেতে করে অনবরত অন্য আর কেউ চা-দোকান থেকে নিয়ে আসছে আর খালি গস্নলাস তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বেশ উৎসুক হয়ে উঠেছি। যেন পুরনো কোনো live chat 888sportের দৃশ্যে আমিও মাথায় ‘ফেজ’ পরে আছি। আমার এও মনে হলো, এরা সবাই চা পান করে করেই নেশাগ্রস্ত, এদের বিচরণভূমি একটাই, এই গ্র্যান্ড বাজার। এরা নিজেদের মধ্যেই মশগুল হয়ে আছে। ফাঁকে-ফাঁকে আমাদের মতো ক্রেতাদের সহানুভূতি কামনা করছে।
আমার স্ত্রী একটি দোকানের সামনে থামল। ছোট্ট সিরামিকের ঘর-সাজানো জিনিস দিয়ে ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত ঠাসা। দোকানের সামনে হ্যাংলা-পাতলা একজন ত্রিশ-ট্রিশ হবে লোক, মুখের হাসি বিস্তার করে ভেতরে যেতে আমন্ত্রণ করল। আমি জানি সিরামিকের এসব জিনিসের প্রতি আমার স্ত্রী বরাবরই ঝুঁকে থাকে। তবে পছন্দের সঙ্গে কোনো আপস সে করে না। এটা-ওটা দেখছে, লোকটি জিজ্ঞেস করল, তোমরা ইন্ডিয়ান?
– না, 888sport appsি। লোকটি টেবিলের ওপর ক্যাশ বাক্সের পাশে রাখা বিজনেস কার্ডের ‘বান্ডল’ থেকে মুহূর্তের মধ্যে একটি কার্ড বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, একে চেন? খুব ফেমাস 888sport appsে, আমার এখানে আসে, জিনিস কেনে –
– আমরা অনেকদিন ধরে নিউইয়র্কে থাকি। চট করে আরেকটি কার্ড আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আমাদের একটা দোকান আছে নিউজার্সিতে, একটু থেমে বলল, আমার নাম সুলেমান, ওদের ওখানে আমার নাম বললেই চিনতে পারবে। কিছু পছন্দ হচ্ছে আমাদের দোকানের হাতের কাজ করা জিনিস? আমার স্ত্রী হাতের ইশারায় একটি কারুকার্যখচিত পেস্নলট দেখাল। চট করে সুলেমান পেস্নলটটি এনে বলল, হাতের কাজ, প্রতিটা জিনিস, খুব সুন্দর। সুলেমানের মুখের হাসিটা হৃদয়গ্রাহী, হাসিটা সে ধরে রাখল। জিজ্ঞেস করি, দাম কত?
– আর কী নেবে? সুলেমান পাল্টা প্রশ্ন করল।
– অই শুরাদানিটা? স্ত্রীর আরেকটা পছন্দ সুলেমানকে বলল।
– এটাও হাতে করা।
– তোমাদের সব জিনিসই হাতে করা?
– না, সিলেক্টিভ কতগুলো মাত্র। সুলেমান মুখের হাসি ধরে রেখে বলল। পছন্দের জিনিস। এবার স্ত্রী বলল, দুটোর দাম কত, ঠিক দাম বলবে।
– আর কিছু পছন্দ হচ্ছে? সুলেমানের হাসি আগের মতোই বিস্তৃত।
– না, এই দুটোই, এদ্দূর নেব কী করে ভাবছি। আমার স্ত্রী উত্তরে বলল।
– চিমত্মা করো না, ভালো করে প্যাক করে দিচ্ছি। সুলেমান বলল। আমার স্ত্রী রাজি হলো না, বলল, সুটকেসে জায়গা হবে না। দোকান থেকে যখন বেরিয়ে আসব সুলেমানকে দেখি, না বলে-কয়েই চা-ওয়ালাকে দুকাপ চা আমাদের দিতে বলছে। আমাদের হাতে সময় অপ্রতুল, সুলেমানের আতিথেয়তাকে রক্ষা করতে পারিনি। আমরা বেরিয়ে আসি দুটো জিনিস নিয়ে, সুলেমানের চাওয়া দামের এক-তৃতীয়াংশ দাম দিয়ে। সুলেমান বলল, আবার এখানে এলে, আমার দোকানে এসো।
হোটেলে ফিরে টেলিফোনে মেসেজ পাই। আমাদের ভাগ্নের ফোন। সাজ্জাদ এ দেশে থাকছে বেশ কয়েক বছর ধরে। ও ইতালি গিয়েছিল কাজে দুদিন আগে, আজ দুপুরে ফিরেছে। রাত্রে সে আমাদের ওর গাড়িতে এশিয়ান সাইডে নিয়ে গেল। সে থাকেও ও-পাশেই। ‘কাদিকয়’, এদিককার বড় শহর, দোকানপাট, রেসেত্মারাঁ আর লোকজনের সমাবেশে উচ্ছ্বসিত, মুখরিত, জীবন-বন্দনায়-উজ্জীবিত। এমন ছোট-ছোট সড়কের সুখ-সুখ সখ্য আমি এর আগে দেখিনি ও অনুভব করিনি। আমরা সব উপভোগ করছি। এরই মধ্যে এলো ভাগ্নের স্ত্রী আর বাচ্চারা, তিন মেয়ে। বড়টা এ- বছর স্কুল শেষ করে কলেজে যাবে আর ছোটদুটি টুইন, স্কুলে। আমার স্ত্রী সিফুডের সারি-সারি রেসেত্মারাঁ দেখছে, ওকে কী খাবে জিজ্ঞেস করতেই, বলল, সিফুড। সব রেসেত্মারাঁ লোকজনে গমগম করছে। টেবিল মিলছে না, প্রায় মিনিট পনেরো পরে একটিতে মিলল, দোতলায়। আমাদের ইচ্ছা ছিল রাস্তার প্রায় মধ্যভাগে এসে যাওয়া কোনো একটি রেসেত্মারাঁ, যা বাইরে, যেমন ইউরোপীয় শহরগুলোতে যত্রতত্র দেখা যায়, তেমন যে-কোনো একটির; কিন্তু কোনো টেবিল খালি পাওয়া গেল না।
সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে ডাইনিং রুমে ঢুকি, হাতের ডানপাশে লাইভ মিউজিক হচ্ছে, আর বাঁপাশে বেশ কয়েকটি টেবিল, একটি ছাড়া বাকিগুলোতে খানাপিনাসহ মানুষের আনন্দ জমেছে।
আমরা খালি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঘরভর্তি সিগারেটের ধোঁয়া। আমার স্ত্রীর সিগারেটের ধোঁয়া আর গন্ধে অ্যালার্জি। অবাক হলাম, আজ এ নিয়ে সে কোনো অনুযোগ করল না। ভাগ্নে-বউ এদেশের, সে ওয়েটারের কাছে, আজ ফ্রেশ কী কী মাছ রয়েছে তা জানতে চাইল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি বড় ট্রেতে বেশ কয়েকটি কাঁচা মাছ নিয়ে এলো ওয়েটার। মাছ দেখিয়ে দাও, রান্না করে তোমাদের পাতে তুলে দেব, ওয়েটার বলল। আমরা এই প্রথার মেনুতে পরিচিত। ভাগ্নে-বউই এটা ভালো ওটা ভালো বলে আমাদের অর্ডার ঠিক করে দিলো।
ঘরে সিগারেটের ধোঁয়া, টেবিলে-টেবিলে খানাপিনার সঙ্গে, খুশি-খুশি উপচেপড়া চঞ্চল আনন্দ, সংক্রমণের অধীশ্বর হয়ে, রাতভরের পথে টর্চ ধরে রেখেছে। লাইভ মিউজিক, যত সুখ জীবনের, রেসেত্মারাঁর এই ঘরে এ-মুহূর্তে ঠাসা, সেই সুখের কাছে আমরা সমর্পিত।
অল্পক্ষণ পরই আমাদের খাবার পরিবেশিত হলো। সালাদ এলো, মাছ এলো; এলো রুটি, সবজি, মাঠা, দই। আবার মাছ এবং আবার আরো মাছ। যে-মাছগুলো দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সব, এইমাত্র উনুন থেকে তুলে আনা। সব মাছই অতিদ্রম্নত নিঃশেষিত হলো সকলের ভোজন-আগ্রহে। আমাদের ভাগ্নে বলল, এদের মাঠার তুলনা নেই। আমি চুমুক দিয়ে বলি, একফোঁটা মিথ্যে বলোনি। আমরা আহার শেষেও অনেকক্ষণ ঘরের সকলের সঙ্গে গানে-গানে প্রাণ সঁপে বসে রই। ভাষা ভিন্ন; কিন্তু আনন্দকে গুণ টেনে নিতে হলো না; আনন্দের পালে অবিশ্লেষিত জোর হাওয়া, আমরা ভেসে যাই। একসময় দেখি প্রায় সব টেবিলের মানুষ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে-দিয়ে নিজেরাও গায়কের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইছে। আমরা ভিনদেশি এই ভাষার গানের আনন্দযাত্রায় সওয়ার হই, হাততালি দিয়ে-দিয়ে। ঘড়িতে মধ্যরাত এলানো, আমরা গান ছেড়ে রেসেত্মারাঁ থেকে বের হই। বসফরাসের অন্যপাশে আমাদের হোটেল। হোটেলকক্ষে যখন ঢুকি, তখন রাত দুটো।
জানালা দিয়ে দেখি বসফরাসের দু-তীরের কনস্টান্টিনোপল, আজকের তুরস্কের ইস্তাম্বুল। ইতিহাস-আদ্রিত এমন আধুনিক শহর আমি এর আগে দেখিনি। না নদী, না সাগর, না হ্রদ, প্রণালি হয়েও না প্রণালি; বসফরাসকে মনে হলো এক রোমান্টিক বিভাস, স্রোতের, প্রাণের, চাঞ্চল্যের, জীবনের সমগ্রতায় এক অখ- সরসতায়। কী এক বৈচিত্র্যে আর মহিমায় এই জলের যুগপৎ অস্থির আর সংহত শরীর এত রাতেও জীবন-যৌবনযোগী, আমার এই মুহূর্তের সকল মনোযোগকে এক ঐশী বশে গ্রাস করে ফেলল। আমি অনেকক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি।
সকালে ঘুম ভাঙার পরে আমার স্ত্রীর এক কাপ চা না হলে তার মাথা ধরে। চা ‘আমার কাপ অব টি’ নয়। হলে হলো, না হলে না। বত্রিশ তলায়, আমাদের ফ্লোরেই বিশাল খোলা কাচের কয়েকটি জানালায় বসফরাসকে চোখের সামনে রেখে সুসজ্জিত টেবিল নিয়ে ব্রেকফাস্টের আয়োজন, একপাশে সোফাসহ বিশাল টিভি, মধ্যখানে বেশ কয়েকটি বইয়ের সেলফ। সারাদিন এখানে বসে চোখে ইস্তাম্বুল ধরে রাখতে কোনো বাধা নেই। আমরা এটা-ওটা এবং চা নিয়ে, নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ি। পথ আজ চেনা। মেট্রো আর ট্রাম নিয়ে সুলতানামায় পৌঁছতে-পৌঁছতে বেলা দশটা। আমাদের তাড়া নেই। আজ বেশ চেনা-চেনা মনে হলো আশপাশ। বেসিলিকায় দেখি এরই মধ্যে লম্বা লাইন টিকিট বুথে। বিকেলে সাজ্জাদ আমাদের আবার তার প্রিয় কিছু জায়গায় নিয়ে যাবে বলে কথা রয়েছে, আমরা এরই মধ্যে বেসিলিকা দেখতে লাইনে দাঁড়াই।
টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে ঘণ্টাখানেকের ওপর লেগে গেল। সুন্দর দিন, নির্মেঘ আকাশ, হাওয়ায় বসন্ত-দোলা। লাইনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে একেবারেই খারাপ লাগেনি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছি, মাটির নিচে, সব অন্ধকার লাগল। স্বল্প আলো, মোমবাতির মতো, পিঁপড়ের মতো এগিয়ে যায়-কি-যায়-না লাইনে দাঁড়িয়ে দেখি সারি-সারি মার্বেলের পিলার (কলাম), মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত, আরেকটু নামতেই দেখি, বড়-বড় স্কয়ার-স্কয়ার ফ্লোর পানিতে ডুবে আছে, যেন অগুনতি পানির টবে, বর্ণিল মাছেরা সাঁতার কাটছে। কোনো-কোনো পিলারের সামনে গিয়ে সবার পা থেমে যায়, আমাদের পালা এলো। দেখি, ‘মেডুসা’র মাথা পিলারের গোড়ায় ভাস্কর্য-শোভিত। মার্বেলে অমন নিপুণ কাজ সহজে চোখে পড়ে না।
ভেজা-ভেজা-শীতল বিশাল সিসটার্ন (জলাধার), তিন থেকে চার শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত রোমান সাম্রাজ্যের গোড়ার দিকে, পরে, অটোম্যানরা এই জলাধারের আরো সম্প্রসারণ করে এবং পানির বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। ভাবতে অবাক লাগে, নিজেদের এবং নগরবাসীর জন্য, অনেক শতাব্দী আগে এরকম একটি জলাধার তখন তৈরি করা হয়েছিল! কত লোক, কত আয়োজন, কত সম্পদ! চোখে না দেখলে এই বিশাল কর্মযোগটি অনুভব করাও অসম্ভব। বিশাল বলে বিশাল! ক্যাথেড্রাল ছাদকে মহিমান্বিত করে ধরে রেখেছে ৩৩৬টি মার্বেল কলাম, সবগুলো ৩০ ফুট উচ্চতায় ১২টি সারিতে নান্দনিক আবহে দাঁড়িয়ে আছে। অবাকবিস্ময়ে, সবাই, ভাষা হারিয়ে ফেললে যেমন, তেমনি তাকিয়ে-তাকিয়ে সব দেখছে আর ছবি তুলছে। একসময় আমরা বাইরে এসে আবার ফুটে থাকা বসমেত্ম শরীর-মন অর্পণ করি। চোখে তখনো বিস্ময়ের ঘোর, অমন জলাধারের নির্মাণ-কল্পনা ছিল কোনো মানুষেরই, সত্যি বিশ্ব জুড়ে কতই না বিস্ময় দেখব বলে অপেক্ষারত।
সাজ্জাদের ফোন এলো। বলল, রাস্তায় ট্রাফিক নড়ছে না। আমাদের ট্রাম নিয়ে বসফরাস পার হতে ফেরিঘাটে যেতে হবে, ওপারে সে অপেক্ষা করবে গাড়ি নিয়ে। ইস্তাম্বুলের ট্রাফিক সমস্যা একটি বড় নাগরিক সমস্যা। আমরা প্রথম দিনই এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে টের পেয়েছি।
সাজ্জাদ লাঞ্চ করতে বারণ করেছে। ওর একটা পছন্দের রেসেত্মারাঁয় নিয়ে যাবে আজ লাঞ্চে। ইস্তাম্বুলের ট্রামের সঙ্গে এই অল্প সময়ের মধ্যেই একটা বন্ধুতার টান অনুভব করি, যেন অনেকদিন ধরেই আমি এই ট্রামে-ট্রামেই ঘুরে বেড়াচ্ছি, ট্রামের ভেতর ঢুকলেই একটা সুখ-সখ্য-বিরল-আরাম পাই, আমার অবসরের ‘সময়’ যদি না-ই নড়ে, আমার কোনো আপত্তি নেই। চড়ার একটু পরেই ট্রাম থেকে ‘ইমিনুনু’ নামের স্টপে নেমে পড়ি আমরা। সাজ্জাদ ডিরেকশন দিয়েছিল ভালো, খুব সহজেই ঠিক-ঠিক ফেরিটি সময়মতো পেয়ে যাই। মিনিট পাঁচেক পরই ছাড়বে। ফেরিতে আমরা বসফরাস দেখব বলে জানালার পাশে বসি।
জীবন-যৌবন নিয়ে বসফরাসের শরীর-বিভাস বেসামাল। সিগাল উড়ছে, ঢেউয়ে-ঢেউয়ে জলের ফেনা ভাঙছে, রোদ হাওয়া আর আর ‘আর কিছু’, জানি না কী সেই ‘আর কিছু’, কেবল বুঝি, একটা আহবান যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের শামিয়ানার নিচে, একটি অখ- সমবয়স্ক ‘সময়’ হয়ে, আমার ইন্দ্রিয়ে ও মোহাচ্ছন্নতার সড়কে-সড়কে খলখল উজ্জীবন রচনা করছে। আমি মুগ্ধ-প্রশামিত্মতে বিলীন হয়ে রই।
ফেরি থেকে নেমে একটু এগোতেই দেখি, রাস্তার পাশে গাড়িতে, সাজ্জাদ তার দুই মেয়েকে স্কুল থেকে পিকআপ করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যমজ হলেও দুজনের স্বভাব পুরোপুরি ভিন্ন। আমিরা শান্তশিষ্ট, কম কথা বলে, বড়-বড় চোখে অনেক বিস্ময়, কোঁকড়ানো চুল পিঠ অবধি। সুরাইয়া চঞ্চল ও অস্থির, অনর্গল কথা বলে, চুল ছোট করে কাটা ঘাড় অবধি, বাবা ওকে ডাকে ‘টমবয়’। দুজনই ফুটফুটে ও মিষ্টি। সাজ্জাদ গাড়ি চালাতে-চালাতে বলছে আমরা যেখানে খেতে যাচ্ছি, সেটা এদেরও প্রিয়। সুরাইয়া চিৎকার দিয়ে বলল, ‘ইয়ে-য়ে’। অল্পক্ষণ পরই গাড়ি থামে, সরু রাস্তার ওপরেই পার্কিং, সাজ্জাদ আমাদের নিয়ে ভেতরে ঢুকছে, দেখি, রেসেত্মারাঁর নাম ‘নামলা’।
‘নামলা’ ছিল আমাদের জন্য আরেক অভিজ্ঞতা। কী নেই ‘নামলা’য়! অনেক টেবিল, সব টেবিলে মানুষ, সর্বত্র খাবার, সব টেবিলের পাশ দিয়ে দিয়ে এটা-ওটা তাক করে সাজানো, পরিষ্কার-তকতকে-পরিচ্ছন্ন, টেবিলে বসে হাত বাড়ালেই নানারকম চিজ, রুটি, পেস্তা বাদাম, চকোলেট, জুস, রকমারি ফলমূল, যার-যার টেবিলে বসেই, যা চাও তা-ই। হয় এমন? না, হয় না। কিন্তু ‘নামলা’তে হয়। আর একপাশে লম্বা কিচেন কাউন্টারসহ এ-মাথা থেকে ও-মাথা। থরে-থরে সাজানো গরম খাবার, ঠান্ডা খাবার, ‘যা চাও যতটুকু চাও কেবল বলে দাও’, পেস্নলটে সুন্দর করে সাজিয়ে তোমার টেবিলে পৌঁছে যাবে কাবাব, সবজি, হামাস, সালাদ, রুটি, দই, মাঠা, সব। সুস্বাদু খাবার খেতে-খেতে ভাবছিলাম এরকম আয়োজন আর কোথাও দেখিনি, কেন? টেবিলের ওপর খাবারের আইটেমসহ চকোলেটের মোড়কটা, কোকের বোতলটা, ফলের খোলসটা, দইয়ের, মাঠার প্যাকেটটা দেখে-দেখে ওয়েটার তৈরি করে দেয় বিল, কী কী খেলে, কতটুকু খেলে, তা নিয়ে হিসাব করে কোনো ট্রেস নিও না, পেট পুরে খাও আর বিল নিয়ে কাউন্টারে পয়সা দাও। ব্যস। অপেক্ষা নেই, তাড়াহুড়া নেই, ভিড়ের মধ্যেও একান্ত আহার, নো ঝামেলা। নো ঝামেলা জোন থেকে বেরিয়ে দেখি আপিস ফেরতা লোকজন ইতোমধ্যে রাশ আওয়ারের প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করে ফেলেছে। সাজ্জাদ বলল, এখানকার সব এত ফ্রেন্ডলি জীবনযাপনের জন্যে, শুধু এই ট্রাফিক যন্ত্রণাটা ছাড়া।
আমাদেরও এখানে সব ভালো লাগছে। ইমত্মাম্বুলের প্রকৃতি, মানুষ ও তাদের আচার-ব্যবহার বেশ উষ্ণ ও হৃদ-টানে সিদ্ধ। ট্রামে, রাস্তায়, হোটেলে, রেসেত্মারাঁয়, দোকানে, মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি কথাবার্তায় কখনো অনুভব করিনি যে, আমরা এদের নই, বরং, মনে হচ্ছে এই শহরটাও আমাদের, আমরা এই শহরবাসীর কারো না কারো পড়শি। পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছি, সব শহরেই অল্পবিস্তর ‘ফিল’ করেছি যে, আমরা ওদের একজন নই, ওদের এক সেকেন্ডের আড়চোখে আমাদের দিকে তাকানোতে একটা কিছু থাকে, যা মুহূর্তেই দূরত্ব রচনা করে দেয়, আপন-আপন সংস্কৃতির বিকাশ-উন্মুখতা আহত হয়ে বিমুখ হয়। আর এই ‘ফিল’ করাটা এতই বারবার এখানে-ওখানে এসেছে যে, এই ‘অন্য চোখে’ বা ‘নতুন কিছু’ দেখাটাকেই স্বাভাবিক ও গ্রহণীয় মনে হয়েছে। এই নিয়ে তাই ভাবাভাবির কিছু নেই। এটা হয়তো সব দেশেই সকল ভিনদেশিরই নিজ-নিজ ‘ফিল’ হতে পারে।
এই যে এদেশের মানুষের এত আন্তরিকতা, তা আরো স্পষ্ট হলো পরেরদিন। সাজ্জাদ বেশ সকাল-সকাল আমাদের তুলে নিতে হোটেলে তার গাড়ি নিয়ে হাজির। আমরা আজ যাচ্ছি ‘ইযমির’। ইযমির তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী ও আন্তর্জাতিক নৌবন্দর। ইস্তাম্বুল থেকে ৫০০ কিলোমিটারের মতো, গাড়িতে যেতে, হাইওয়ে ফাঁকা থাকলে ছয়-সাত ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছানো যাবে। আমরা ইযমিরে একরাত থাকব। সাজ্জাদ ভীষণ উৎসাহী আমাদের এই ইযমির যাত্রায়, প্রথম দিকেই বলেছিল, ‘আপনাদের ইযমির যেতেই হবে’। ভালো লাগছে যে, আমরা যাচ্ছি।
কিছুক্ষণ পরই ফেরিতে গাড়িসহ আমরা সবাই উঠি। সবাই মানে সাজ্জাদ, আমার স্ত্রী ও আমি। সাজ্জাদের স্ত্রী আয়েশার কাজ আর বাচ্চাদের স্কুল। ওদের অভাব অনুভব করছি। ফেরির ওপরতলায় উঠে দেখি অনেক মানুষ, খাবারদাবার, স্বেচ্ছাচারী জলজ হাওয়া, হাওয়ার পাতলা শরীর ভেঙে আসা চনমনে রোদ। সাজ্জাদকে জিজ্ঞেস করি, ফেরিতে থাকতে হবে কতক্ষণ। উত্তরে সাজ্জাদ বলল, এই তো ঘণ্টাখানেক। উত্তরটা পছন্দ হলো না, আমার সবকিছু এত ভালো লাগছে, ঘণ্টাখানেক অপ্রতুল মনে হলো।
আমরা কখনো উপত্যকা, কখনো পাহাড়, কখনো সমতলভূমির ওপর দিয়ে চোখের-সামনে ডানে-বাঁয়ে নিসর্গ যে অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে আমাদের অবর্ণনীয় আনন্দ দিচ্ছে এজন্যে জীবনের কাছে কৃতজ্ঞ হই। সাজ্জাদ গাড়ি চালাতে ভালোবাসে, আগেই জানা ছিল; কিন্তু এত বছর পরও এই গাড়ি চালিয়ে দূরে-দূরে ছুটে যাওয়াটা আজো তাকে আনন্দ দেয়, আমার ভালো লাগল। বলি, এত চালিয়েও ক্লান্ত হলে না? সে দর্শন দিলো গভীর, ‘যা আনন্দ দেয় যতদিন তা ধরে রাখা যায়, এই আর কী’!
গাড়ি প্রায় ফাঁকা রাস্তায় ঊর্ধ্বগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সাজ্জাদ বলল, একটু পরেই আমরা লাঞ্চ করব, সামনেই। ক্ষুধা আমাদেরও পেয়েছে। মিনিট পনেরো পরে সাজ্জাদ হাইওয়ের পাশের একটি ক্যাফের সামনে গাড়ি পার্ক করল। গাড়ি থেকে নেমে ক্যাফের দিকে এগোচ্ছি, সাজ্জাদ বলল, এদেশের মানুষদের প্রশংসা করছিলেন, এবার দেখবেন ওদের আতিথেয়তা। আমি ও আমার স্ত্রী একসঙ্গে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাই। সে আমাদের নিয়ে ক্যাফের ভিতরে না গিয়ে বাইরের টেবিলের একটিতে বসার সিদ্ধান্ত নিল। মাথার ওপরে ভেতর থেকে টানা আচ্ছাদন, যেমন থাকে ইউরোপের রেসেত্মারাঁগুলোতে, তেমন। বাইরেও সব টেবিলে লাঞ্চ হচ্ছে। একটা গমগম ভাব। যেন একটা আনন্দ-ভোজের আয়োজনে অংশীদারিত্ব নিত আমরাও এদের হয়ে টেবিলে বসেছি। টেবিলে-টেবিলে পানির বেশ কয়েকটি বোতল, একটি বড় পেস্নটে সত্মূপীকৃত টোস্টেট পাউরুটির বড়-বড় সস্নাইস, এই সস-অই সস আর ন্যাপকিন রাখা আছে। সাজ্জাদ বলল, এটা একটা চেইন ক্যাফে। এদের কোফতা বিখ্যাত। এজন্যেই এখানে থামলাম। সে ওয়েটারকে বেশি কিছু বলল না, মেনু দেখল না, আমাদের জিজ্ঞেস করল না, মিনিট দু-এক পরেই আমাদের টেবিলে এলো তিন পেস্নলটে একই খাবার – কোফতা, সবজি আর রুটি, সঙ্গে সালাদ আর সস। আমার আর সাজ্জাদের জন্য মাঠার বোতল ও দই। আমার স্ত্রী দই-মাঠায় উদাসীন, সাজ্জাদ এটা জানে। আর দিলো, হাত মুছতে ভেজা ন্যাপকিন, প্যাকেটের ওপর লেখা, ক্যাফের নাম, ‘কফতেজি-ইউসুফ’।
কোফতা মাত্র উনুন-তোলা, রুটি গরম, সব ফ্রেশ, মাঠার সাদা বোতলের গায়ে সহস্র জলকণা, মাত্র ফ্রিজ থাকে বের করা, বোঝা গেল। সবকিছু খেতে উৎসাহ বোধ করি। কোফতা মুখে দিই, অন্যরকম, কিন্তু অপূর্ব স্বাদ। আমার স্ত্রীর চোখেমুখেও খাবারের তারিফ দেখি। সাজ্জাদ এই দেখে বলল, কী খেলেন জানেন? সাজ্জাদ সারপ্রাইজ দিতে শুধু ভালোই বাসে না, এসবের জন্য সে অপেক্ষা করে, সুযোগমতো ব্যবহার করে আনন্দ লাভ করে। আমি উৎসুক হয়ে ওর দিকে তাকাই। সে বলল, ল্যাম্ব, পাহাড়ে চড়ে বেড়ায় মেষ। গন্ধ পেলেন? সাজ্জাদ জানে, আমি কখনো ল্যাম্ব খাই না। একটা না-রপ্ত-করা-বিটকেল-গন্ধ, মাংসের, আমি আমার খাবার-অভ্যাসে কিছুতেই এই মাংস যোগ করতে পারিনি। আমার স্ত্রীরও তাই। সেও আজকে ভাগ্নেকে বলল, একফোঁটা গন্ধ নেই, কী দেয় মাংসে? ভাগ্নে জবাব দিলো, কিছুই না, গ্রিলড। স্ত্রী জিগ্যেস করল, এতেই গন্ধ দূর হয়ে গেল? সাজ্জাদ হেসে উত্তর দিলো, এদের ল্যাম্বের তুলনা নেই। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মাঠাটা ঠান্ডা-ঠান্ডা শেষ করে ফেলুন। চুমুক দিয়ে দেখি, সেই মাঠার স্বাদ, 888sport appsের, ছোটবেলার।
আমার স্ত্রী সুলতানামাত স্কয়ারের ‘গ্রিন কর্নার’ ক্যাফের তুর্কি চা খেয়ে আর অন্য কোনো চায়ে সন্তুষ্ট হতে পারছে না আপাতত। সাজ্জাদ বলল, এখানকার চায়ে আপনি হতাশ হবেন না। তুর্কি চা হয় দুধ ছাড়া, টলটলে আর পরিবেশিত হয় স্বচ্ছ কাচের ছোট-ছোট হাতলহীন গস্নলাস আকারের কাপে। গস্নলাসের রিমে দুপাশে আঙুলের ফাঁকে ধরে রেখে ঠোঁটে তুলে চুমুক দিয়ে খেতে হয়। চা এলো। আমার স্ত্রী এক চুমুক দিয়ে সাজ্জাদকে বলল, চা-টা ভালো। পাশের টেবিলে দুজন উত্তরপঞ্চাশ 888sport promo code-পুরুষ। তারাও আহার সেরে চা খাচ্ছে। সাজ্জাদের ঠিক পিঠ ঘেঁষেই উল্টোদিকে, মুখ ঘুরিয়ে সাজ্জাদকে বলল, তোমরা কোন দেশের? সাজ্জাদ বলল, 888sport appsের। টুকটাক আরো একটু কথা হলো ওদের। আমার স্ত্রী সাজ্জাদকে বলল, চা-টা সত্যিই একদম ‘গ্রিন কর্নারে’র চায়ের মতো। আর এক কাপ খাব। সাজ্জাদ খুশি হয়ে অর্ডার দিলো। আমরা কথা বলছি, আমার স্ত্রী তৃপ্তি নিয়ে চা-পানে মনোযোগী, হঠাৎ ওয়েটার এলো আরো তিন কাপ চা নিয়ে। আমাদের তিনজনের সামনে চা রেখে বলল, পাশের টেবিল থেকে তোমাদের জন্যে। আমরা ফিরে তাকাই। ওদের মুখে বিনম্র হাসি, পুরুষটি বলল, ওয়েলকাম তোমাদের, পিস্নলজ চা-টা গ্রহণ করো। আমার স্ত্রী আর আমি বিস্মিত। সে বলল, আমি এমনিতেই দুই কাপ – না না, তা ছাড়া তোমরা, তারপর আর কী বলবে ভেবে না পেয়ে তড়িঘড়ি বলল, থ্যাংক ইউ।
জিজ্ঞাসার বোতাম খুলে গেল গাড়িতে উঠেই। সাজ্জাদ হেসে বলল, পেলেন এদের আতিথেয়তা? থেমে বলল, আমারও
প্রথম- প্রথম খটকা লাগত। চিনি না জানি না – চা দিয়ে আপ্যায়ন? পরে আমার এক বন্ধু বলল, 888sport appsিদের এরা বন্ধু হিসেবে দেখে এবং গ্রহণ করে।
– কেন? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।
– জালাল উদ্দিন রুমির দেশের এই তুর্কি জাতি মনে করে আমরা একই বংশের মানুষ। সুফিবাদ-আউলিয়া, ধর্ম, আমাদের মধ্যে সেতু তৈরি করেছে। এরা-আমরা এক বলেই একটি সহমর্মিতার চোখে দেখে আমাদের। তারপর বলল, আপনি বলছিলেন না, এই শহরে এসে আপনার মনে হয়েছে যে, আপনি এদেরই একজন, আপনি এদের সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারছেন, তাই না? আমি মাথা ঝুঁকিয়ে সহমত জানাই।
আমরা বুসরা ছেড়েছি বেশ আগে। নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি, হাইওয়ের দুপাশে সারিবদ্ধ দোকানপাট, দূরে-অদূরে উঁচুনিচু পাহাড়, সবুজ সব ক্ষেতখামার, দিগন্ত থেকে দিগমেত্ম সরে সরে যায় সেই সবুজ-ডাক, তুর্কি দেশটি এমন দীপ্তময় আর শ্যামল হবে, ভাবনার অতীত ছিল। গাড়ির ভেতর জীবন জাগিয়ে আবেশিত হচ্ছে আমাদের তিনজনের সময়, একটু-একটু করে বিলীন হচ্ছে জীবনেরই সঙ্গে যুক্ত সকাল-সন্ধ্যার সকল ভার।
সন্ধ্যা হবে-হবে সময়ে আমরা একেবারে একটি সমুদ্র-ঘেঁষা হোটেলে চেক ইন করি। আমরা রুমে ঢুকে দেখি কিছু
খাবার-দাবার, মানে বরফি, ড্রাই ফ্রুট ইত্যাদি টেবিলে সাজানো, একটু পরেই দরোজা নক করে বলল, রুমসার্ভিস। দরোজা খুলতেই হোটেলের লোক বলল, তোমাদের জন্যে এই বিশেষ কফি। ছোট্ট মিনি কাপে ফেনা-ওঠা কফি। চুমুক দিয়ে মনে হলো কফি হবে তো এরকম কফি, কফি কেন তেতো হবে! সাজ্জাদ ঘড়ি দেখছে। বললাম, অনেকক্ষণ গাড়ি চালিয়েছ, হাত-মুখ ধুয়ে বা গোসল করে একটু রেস্ট নাও। সাজ্জাদ বলল, আমি টায়ার্ড নই, মাত্র তো ঘণ্টা সাতেকের ড্রাইভ। কয়েক মিনিট পরেই দরোজায় আবার নক করল কেউ। সাজ্জাদই ত্বরিত উঠে গেল। সাজ্জাদেরই বয়সী, আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই আগন্তুক বলল, আমার নাম কামাল (কেমাল, তুর্কি উচ্চারণ), সাজ্জাদের বন্ধু। বলল, আপনি নিশ্চয়ই মামা, আর আপনি মামি, কষ্ট হয়নি তো আসতে? একনাগাড়ে সব বলে যোগ করল, আমি ইযমিরের ছেলে। ইযমির আমার জন্মস্থান। সাজ্জাদ কামালের কথা আগে বলেনি। কাউকে সারপ্রাইজ দিতে ও ওত পেতে থাকে।
কামাল রাতের খাবার খেতে আমাদের বাইরে নিয়ে গেল ঘণ্টাখানেক পরে। এর মধ্যে আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েছি। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দেখি হর্স-সু আকারের সমুদ্রতীর আমাদের সামনে, মাত্র ২০-৩০ ফুট দূরে। সরু রাস্তা, বৃক্ষাবলি, নানা রঙের ফুল। একটু আগেই সন্ধ্যা রাত্রির কাছে অর্পিত হয়েছে। তীরে, সারি-সারি বোট, ছোট-ছোট জাহাজ, নোঙর ফেলা। গাড়িতে যেতে যেতে কেবলই মুগ্ধ হচ্ছি। কামাল বলছে, আমার আশৈশবের শহর, একটু পরেই আমি যেখানে বড়ো হয়েছি, মানে আমাদের পাড়া, তোমাদের দেখাব। আগের মতোই আছে, ইযমির বেশ পুরনো শহর, পুরনো যা ধরে রাখা সম্ভব, আমরা তা ধরে রাখতে চাই। একটানে কথা বলছে কামাল, বলার স্টাইলে একটা উৎসাহ কেবলই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে। কামালের বেড়ে-ওঠা জীবনের পাড়া এলো, লাগোয়া ঘরবাড়ি, ঠিক নির্জন না আবার একধরনের প্রশামিত্ম চারপাশে। কামাল সরু চৌরাস্তার মোড়ে একটি বাড়ি দেখিয়ে বলল, এটা ছিল আমাদের বাড়ি। বাবা মারা যাওয়ার পর বিক্রি করে দিই। আমার মা আমার সঙ্গে থাকে, আমার সামার হোমটি মাত্র ৩০ মিনিটের পথ, আগামীকাল তোমাদের নিয়ে যাব, পাশের সিটে বসা সাজ্জাদের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, কী বলো? উত্তরের অপেক্ষা না করেই কামাল তার কথায় ফিরে গেছে, বলল, আর এই যে কোনার ক্যাফেটি দেখছ, এটা ছিল আমার বাবার ইলেকট্রনিকসের দোকান। কম্পিউটার, ঘড়ি, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদিসহ প্রায় সব গেরস্থালি জিনিস বাবা নিজ হাতে ঠিক করত। বেশ খ্যাতি ছিল তাঁর। আমিও বাবার সঙ্গে কাজ করেছি। আমার হাতেখড়ি ওখানেই। একনাগাড়ে সব বলে থামল। আমার ওর তুর্কি-ঘেঁষা ইংরেজি শুনতে বেশ লাগছে, একই সঙ্গে দেখে নিচ্ছি চারপাশ। আমার জন্যে এর সবকিছুই হয়ে উঠছে সব-সময়-দেখতে-চেয়েছি এমন সব চিত্র, যেন ইতিহাসের খুলে-খুলে যাওয়া পাতা, সিনেমায় দেখা দৃশ্যাবলি, বইয়ে পড়া বর্ণনা, হুট করে সব আমার চোখের সামনে, আমি একরকম ঘোরের মধ্যে, ‘আরো কিছু আসছে’র জন্যে নিজেকে সঙ্গে-সঙ্গে প্রস্ত্তত করছি।
আরো মিনিট-পনেরো-ড্রাইভে মেরিনা এলাকার একটি রেস্টুরেন্টের দিকে কামাল আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট সামনের সমুদ্রের দিকে মুখ করে একটু ফাঁক-ফাঁক হয়ে, ‘স্ট্যান্ডএলোন’ হয়ে মানুষ ডাকছে। কোনো-কোনো রেস্টুরেন্ট পানির ওপর, আমরা যেখানে হাঁটছি, ঠিক তারপরেই হাতবিশেক-একফালি-বালির-বিচের পরেই। কামাল জিজ্ঞেস করল পানির ওপরটায় যাব কিনা। একটু ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগছে, আমরা রাস্তার অন্যপাশের রেস্টুরেন্টের দিকে ইশারা করি। জানালার পাশের টেবিলে আমরা বসি। এখান থেকেই দেখি পানি, আলো, অন্ধকার, জাহাজ, রাতের সমুদ্র। এখানেও জীবন্ত মাছ, অ্যাকোয়ারিয়ামে, আমাদের ওয়েটার জিজ্ঞেস করল, দেখিয়ে দাও কোনটা খাবে। কাদিকয়ের আগের রাতের ডিনারের মতো।
ডিনার শেষে আবারো আজকের লাঞ্চের অভিজ্ঞতা। পাশের টেবিল থেকে চা এলো। খেতেই হবে। এত ভালোবাসা আর উষ্ণ আমন্ত্রণ, আমরা না করতে পারিনি। সাজ্জাদ বলল, এদেশে আমি থেকে যেতে পেরেছি, তার কারণ এখন বুঝতে পারছেন, এরা অন্তর থেকেই এটা করে। আমাদের সামার হোমের প্রতিবেশীদের ব্যবহার দেখলে বুঝতেন আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি।
পরের দিন সকাল-সকাল ইযমির দেখাতে কামাল হোটেলে এসে হাজির। আমি বললাম, হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোই। সাজ্জাদ ও কামাল প্রায় একসঙ্গেই বলল, না না এখানে না, বাইরে, একেবারে অথেনটিক তুর্কি নাস্তা। আমি ও আমার স্ত্রী ওদের প্রস্তাবে উৎসাহ বোধ করি। আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ি। গাড়ির রাস্তা নয়নাভিরাম। একদিকে সমুদ্র-পানি আরেকদিকে বৃক্ষাবলির ফাঁকে-ফাঁকে প্রশামিত্ম-মোড়া পুরনো বাড়িঘর ও দোকানপাট। মিনিট পনেরো পরে বাড়িঘর ফাঁকা-ফাঁকা, একটু পরে আরো কমে এলো। প্রায় তিরিশ মিনিটের মাথায়, সামনে পানি রেখে একটি রেসেত্মারাঁ, পাশেই বেশ বড়সড় একটি পার্কিং লট। সাজ্জাদ কামালকে বলল, আমি জানতাম তুমি এটাতেই থামবে।
সাজ্জাদ খাবার অর্ডার দিলো না, কামাল অর্ডার দিলো না; কিন্তু টেবিলের চেয়ারে বসামাত্র একে-একে খাবার আসতে লাগল। কামাল বলল, কমন আইটেমগুলোর জন্য ওয়েটারকে কিছু বলতে হয় না, টোস্টটা, হামাসটা, সালাদটা, এমনকি দই, নানা রকম সস, ডিম এগুলো টেবিলে নাস্তার জন্য বসলেই পরিবেশিত হয়। একটু পরেই, যা না বললে পরিবেশিত হয় না, তা এলো। দুধের সর। ক্ষেরের মতো ঘন। ছোটবেলার সর-সম্ভোগ-প্রীতি বুকের ভেতর থেকে খরগোশের মতো এক লাফে বেরিয়ে পড়ল। সাজ্জাদ বলল, কবে শেষ খেয়েছেন মনে পড়ে? বললাম, না।
কতদিন আগের 888sport appsের সুসময়ের দুধের সর এই ইযমিরের সকালে আমার জীবনের সকল সকালের মোহর হয়ে উঠল, একটু আগেও এর টের পাইনি। যত না খেয়ে, তারও বেশি সর বস্ত্তটির রসাগমনে। তুর্কি পাউরুটি, ‘অবলং’ এবং বড়-বড় সস্নাইসে প্লেট ভর্তি, যত খুশি খাও। আমেরিকায় নিজ ঘরে সকালের নাস্তা হয় দুধ সিরিয়ালে চটজলদি, এখানে আরাম করে সময় নিয়ে খেয়েও সব খাওয়া গেল না। কামাল বলল, খাবার ফেলব না, যা যা না খেতে পারো তোমরা আমাকে দাও। সাজ্জাদ জানে, আমি সব সাবাড় করার ওস্তাদ। মিনিট কয়েক পরে দেখি, কামাল তার কথা রেখেছে।
ইযমিরের পাহাড়, উপত্যকা, সমুদ্রতট, সমতলভূমি দেখে-দেখে উত্তরোত্তর মুগ্ধ হচ্ছি। ঘণ্টা দেড়েক পরে আমাদের গাড়ি পাহাড় থেকে নিচে নামতে শুরু করল। মিনিট দশেক পাহাড়ের গায়ে-গায়ে নেমে-নেমে গাড়ি থামল সমুদ্রতীরে। তীর বলতে একেবারে বালুতটে। গাড়ির দুপাশে দুটি বাড়ি। দেয়ালঘেরা, গাছপালার প্রশামিত্ম নিয়ে, লাল-টাইল-ছাদের-বাহারে, বেলকনিসহ সুন্দর বড়সড় একতলা বাড়ি। কামাল বলল, আমরা এখানে নামব মামা। আমার স্ত্রীর দরোজা খুলে সে বলল, বাড়িদুটো সামার হোম। এখন খালি। মালিক ছুটি-ছাটায় আসে।
আমরা গাড়ি থেকে নামি। অনেকক্ষণ গাড়িতে ছিলাম, লম্বা শ্বাস নিই। খুব ভালো লাগল। আরেকটি লম্বা শ্বাস নিই। বাতাস অনেক হালকা, একটা হালকা গন্ধ, সুবাস, মিষ্টি নয়, কিন্তু মিষ্টির মতো, অচেনা, কিসের গন্ধ বাতাসে? আমি বড়-বড় আরো কয়েকটা শ্বাস নিই। আমার দিকে খেয়াল করে সাজ্জাদ বলল, বাতাসটা নির্মল, তাই না? আমি ও আমার স্ত্রী মাথা নাড়াই। আমি জিজ্ঞেস করি, কিসের সুবাস? সাজ্জাদ উত্তর দিলো, অলিভের সুবাস। চারদিকের গাছগুলো, সব অলিভ গাছ। আমি বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি, বারবার। আমি ভাবতেই পারিনি এর আগে যে, পৃথিবীর বাতাস আজো এত নির্মল, সুবাসিত ও আমোদিত হয়ে কোথাও-কোথাও হারিয়ে গিয়ে বেঁচে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে কামাল বলল, ইযমির সারা টার্কি থেকে আলাদা। আমাদের কালচার এই যে, টার্কির হয়েও ঠিক টার্কির নয়, আমাদের নিজেদের স্বকীয়তা যুগ-যুগ ধরে সংরক্ষেত। আমরা একটু ‘লেইড-ব্যাক’, কিন্তু শ্রমের প্রতি নয়, জীবনের প্রতি নয়, কেবল জীবন-বন্দনার প্রক্রিয়ায়, এখানে আমরা আমাদের মতো। আমাদের 888sport live football, 888sport live chat, চিত্র, সংগীত, কিছুদিন থাকলেই খেয়াল করবে, এসবই, ইযমিরের রূপরসেরই নির্যাস। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোনো তাড়াহুড়া নেই। আমরা জীবনকে খুব অল্পতেই কষ্ট দিই না, যেন আমি এসবই শুনতে চাচ্ছিলাম। কামাল আরো বলল, ইযমিরকে বাইরের পৃথিবী জানে, ‘নিঃসঙ্গ লোকালয়’। কিন্তু আমরা নিঃস্ব নই। আমরা পিছিয়ে নেই নাগরিক অগ্রসরতায়। আমাদের ইযমির এখন চার মিলিয়ন লোকের আধুনিক মনমানসিকতায় নিত্যনতুন বিশ্ব দোলার চারণভূমি, আমরা পা ফেলছি পায়ে-পায়ে, পেছনে-পেছনে নয়। কামাল আবেগ-আপস্নুত হয়ে বলল, আমরা বাইরের সব গ্রহণ করেও আমাদের স্বকীয়তাটাই, আমাদের তো বটেই, বাইরের মানুষের কাছেও চোখে পড়ে প্রথম। এই বলে কামাল থামল। আমি ও আমার স্ত্রী নিজের জন্মভূমির প্রতি কামালের অগাধ ভালোবাসা দেখে অভিভূত হই। সাজ্জাদ বলল, কামালের সঙ্গে বন্ধুত্ব, একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এজন্যই, দিন-দিন বেড়েছে, সলিড মানুষের সলিড ভালোবাসা, সবার জন্য। কামাল ত্বরিত উত্তর দিলো, সাজ্জাদ 888sport appsি হলে কী হবে, ও আমার বন্ধু এবং ভাই, শুধু আমারই নয়, আমার পরিবারের সবারই প্রিয় মানুষ সে। আমি, যে-প্রশ্নটা আগেই করা উচিত ছিল তা করি এখন, তোমাদের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হলো কী করে? কামালই উত্তর দিলো, পেশায় আমি ইঞ্জিনিয়ার, টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির জন্য কনসালট্যান্সি করার সুবাদে 888sport app যাই, সাজ্জাদ তখন নিজেকে ‘আইটি’ মানে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক কোম্পানিকে একটা পাকাপোক্ত জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। আমাদের কোম্পানির ওর প্রয়োজন পড়ে। ব্যস, সেই পরিচয় বন্ধুত্বে গড়ায়।
– তার মানে তুমি 888sport appয় গিয়েছ? আমি জিজ্ঞেস করতেই ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে, বলে, ওদের বাড়িতে গিয়েছি, খেয়েছি, থেকেছি, অনেকবার। 888sport appsের লোকজন খুব ভালো। সাজ্জাদ বলল, কামাল বাংলা জানে। সঙ্গে-সঙ্গে যেন পাপ করে ফেলেছে, কামাল বলল, বাংলায় – ‘এই একটা-দুইটা’।
টার্কির পশ্চিম তীরের, ইযমিরের সামুদ্রিক বন্দরটি, এজিয়ান সুবাস নিয়ে পৃথিবীর সব ক্রুজ-শিপকে ডাকছে। সেই ডাক নিরাশ হয় না। তাই কাছের ‘এফেসুস’, রোমান সাম্রাজ্যের হাজার-হাজার বছরের স্থাপত্য888sport live chatের আশ্চর্যসব উদ্ধারকৃত অংশবিশেষ, আজো মনে করিয়ে দেয় সেলজুক অঞ্চলের নৌবন্দরের প্রাচীন সৌকর্য। খ্রিষ্টান যুগের সাক্ষী হয়ে ‘এফেসুস’ আজো টার্কির অন্যতম একটি পর্যটক-পক্ষপাতে সেরা স্থান। ‘হাউজ অব ভার্জিন মেরি’, কথিত আছে, তাঁর শেষ জীবন কেটেছে এখানেই, তেমনি ‘বেসিলিকা অব সেইন্ট জন’, তিনিও এখানে তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছেন। পাহাড়ের খাঁজে বিশাল ওপেন থিয়েটার – গ্যালারি, সামনে অগুনতি পিলার, কলাম, অনেক অনেক ‘রুইন্স’ লাইব্রেরি ইত্যাদি, রোমান সাম্রাজ্য হুড়মুড় করে বর্তমান হয়ে ওঠে।
আমরা এসব দেখে ফিরে যাচ্ছি ইযমিরে। হঠাৎ পথে বাঁক নিল কামাল। সরু পথ, পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে, পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে ওপরে উঠছে। একপাশে পাহাড়, আরেকপাশে গভীর খাদ। সর্বত্র মানুষ-মাথা অবধি উঁচু গাছের ডালপালা গোল হয়ে, ছড়িয়ে-ছড়িয়ে, পাতায়-পাতায় প্রশামিত্মর ছাতা মেলে রেখেছে। চোখ জুড়িয়ে যায়। অপূর্ব। অল্পক্ষণ পরেই পাহাড়ের উঁচুতে উঠে যায় গাড়ি। দেখি, সরু রাস্তার দুপাশে ছোট-ছোট ঘরবাড়ি, একটু ফাঁকা জায়গায় কিছু গাছপালা, ছোট-ছোট, সেই মাথা-উঁচু, প্রশামিত্মমাখা, তারপর কিছু দোকানপাট, পসরা, জিনিসপত্র দোকানের বাইরে পর্যন্ত সাজানো, একেবারে প্রায় রাস্তার ওপর। এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে গেছে রাস্তা, সরু রাস্তায় চারদিকে-ছেড়ে-দেওয়া-মনের বেশ মানুষজন, ভিনদেশি। প্রায় প্রতিটি বাঁকেই একটি-দুটি করে খোলা ক্যাফে, টেবিল, চেয়ার আর পাহাড়ি বাতাস নিয়ে আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে মানুষজনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দেখে-দেখে এক অচিন্তনীয় পুলকে আত্মহারা হচ্ছি, আর, আরো ওপরে উঠছি। আমার স্ত্রী বলল, নামব। মানুষের প্রায় গা-ছুঁয়ে ধীরে এগোচ্ছে গাড়ি, চারপাশে লোকজন, পেছনেও গাড়ি, কামাল বলল, অল্প দূরেই পার্কিং লট, আরেকটু।
গাড়ি পার্ক করে আমরা দোকানপাটের দিকে আসছি। দোকানপাট বলতে ছোট-ছোট ঘর, সরু রাস্তার দুপাশে। পায়ে- পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে প্রাচীন বিন্যাস, এমন একটি লোকালয়। এরা বলে ভিলেজ, কত বছর আগের, সেই ১৯২০ সালের একটি তুর্কি-গ্রিক সংস্কার এখনো তার রূপ রস গন্ধ নিয়ে, পাহাড়ের এই ওপরের ভাঁজে-ভাঁজে, অতীত নিয়ে, আমাদের বর্তমানের চোখে-ইন্দ্রিয়ে, আপন-অচিন-কাঙিক্ষত একটি স্বর্গসুখ রচনা করে আছে। মাত্র কিছুকাল আগে আবিষ্কৃত এই অগোচরে থাকা লোকালয়, তার ছোট্ট পরিসরে, পর্যটকদের জন্য তার সংস্কৃতি, চেহারা, ইশারা, আজো, এত বছর পরও, অপরিবর্তিত রেখেছে। নাম গ্রামটির ‘সিরিঞ্জে’। আমার স্ত্রী হঠাৎ, পাশের খোলা ক্যাফে দেখিয়ে বলল, চলো এখানে একটু বসি। নানা রকম ফল কাউন্টারের ওপর থরে-থরে সাজানো। আনার, কমলা, পিচ, আঙুর ইত্যাদি। কামাল বলল, আনারের ফ্রেশ জুস খেয়ে দেখুন, ভুলবেন না। সঙ্গে-সঙ্গে চারটি গস্নলাসে এইমাত্র বানানো ‘আনার-জুস’ এলো। জুস নিয়ে চারপাশে তাকাই, অপূর্ব এই পাহাড়ি শোভা, বাতাসে জলপাই-সুবাস, জলপাই গাছের ডালে আর পাতায় কাটা রোদ, কোমল-ফর্সা, নরম। গস্নলাসে একটু চুমুক দিই, তারপর আরেকটু, মনে হলো, এরকমটা আর হয়নি, একেই কি বলে অমৃতসুধা! এত সুন্দর ও স্বসিত্মতুষ্ট লাগছে সবকিছু, মনে হলো থেকে যাই, সময়ের কোনো হিসাব না করে, আরো কিছুদিন। কিছুদিন কেন, সারাজীবন। সাজ্জাদ আমাকে লক্ষ করে বলল, উঠতে মন চাইছে না, তাই না? প্রথমবার যখন এখানে কামাল নিয়ে আসে, আমারও মনে হচ্ছিল ‘সিরিঞ্জে’ই পাকাপাকি থেকে যাই। শামিত্মর জায়গা, কী বলেন?
বেলা পড়ে আসছে। সাজ্জাদ বলল, ইযমিরে গিয়ে লাঞ্চ করব, চলুন উঠি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাড়ির দিকে এগিয়ে যাই।
ফেরার পথ, লক্ষ করি, ভিন্ন, অন্যরকম শোভা হাইওয়ের। তাড়াতাড়ি ইযমিরে কিছু খেয়েদেয়ে আবার ইস্তাম্বুলের পথে রওনা দিতে হবে, সাত ঘণ্টার ড্রাইভ। রৌদ্রময়, জলজ ও প্রসন্ন প্রকৃতি ইযমিরে ফেরার যাত্রাকে ফুরফুরে করে তুলল। সাজ্জাদ একটু ন্যাপ নিচ্ছে। কামাল গাড়িতে গতি তুলে কথা বলছে। ওর, মনে হলো, কোনো কিছুতেই ক্লামিত্ম নেই। টানা কথা, টানা উচ্ছ্বাস, টানা টান। এই একটি দিনেই বুঝেছি, কামাল পরিশ্রান্ত হতে জানে না, কামালের থলেতে আনন্দ কখনো তলায় ঠেকে না। তাই সে অবিরল বিলিয়ে দিয়েও ফতুর হয় না। আমাদের মধ্যে যত কথা হচ্ছে তার সবটাই ইযমি-বন্দনা, আর তার মা, তার স্ত্রী, তার চলে যাওয়া বাবার কথা। আমি কামালের সান্নিধ্য শুরু থেকেই উপভোগ করছি। খোলা মানুষ, খোলা মন, খোলা-খোলা কথা।
ইযমিরে লাঞ্চ করি কামালের আশৈশবের পাড়ায়। রাস্তার ত্রিভুজে ছোট্ট, পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে ক্যাফে। ক্যাফের চারপাশে ফুলরাজি সমুদ্রস্নাত রোদ আর হাওয়া পেয়ে মহাখুশি। আমরাও এমন একটি জায়গায় লাঞ্চ করব ভেবে আনন্দ পাচ্ছি। কামাল ক্যাফের মালিকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, সাজ্জাদকে চেন, তাই না? তোমার এখানে আগেও কয়েকবার এসেছে। মালিক তুর্কিতে কিছু বলে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। কামাল অর্ডার দিলো। আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল কামালকে, এদের চা ভালো? কামাল উত্তর দিলো, খু-উ-ব, তুলনা হয় না। সেই প্রায় একই মেনু – সবজি, কাবাব, সালাদ, হামাস, মাঠা, রুটি; কেবল নতুন করে যোগ হলো বিফ ভুনা আর সবশেষে বাক্লাবা। তারপর চা। আমরা ভরপুর তৃপ্ত। আমার স্ত্রী চায়ের প্রশংসা গাড়িতে ফিরে এসেও অনেকক্ষণ বজায় রেখেছে। গাড়িতে উঠেই কামাল জিজ্ঞেস করল – আইসক্রিম? খেতে-খেতে সমুদ্র, জাহাজ, আরো কত কি দেখা! সময় নেই, আমি বলি, আরেকবার। কামালের চোখ-মুখ আনন্দে হেসে উঠল, বলল, আরেকবার আসবেন তো, সত্যি? বলি, আসব। তোমার সামার হোমটা দেখতে হবে তো! এখন ইযমির না ছাড়লে অনেক রাত হবে, সাজ্জাদের অনেক কষ্ট হবে।
ফেরার পথে বেশ কিছুক্ষণ আমরা চুপ থাকি। আমার থেকে-থেকেই মনে হচ্ছিল আরো একটু থেকে গেলেই পারতাম কামালের সঙ্গে। অমন মানুষ আর হয়? গাড়ি, নিসর্গ দু-ফাঁক করে-করে এগিয়ে যাচ্ছে। সূর্য সন্ধ্যার কোলে আশ্রয় নিচ্ছে। জানালা নামাই গাড়ির, সশব্দে ঢুকল হাওয়া, পাতলা, জলপাই হাওয়া।
ফেরিতে উঠে আবছা দেখি অনেক দূরে জাহাজ, বেশ কয়েকটি টিম-টিম আলো। তারও দূরে, ঊষাগামী রাত্রির প্রহরে, ঘুমুতে যাবে কি যাবে না, এ-ভাবনায় উসখুস করছে ইস্তাম্বুল।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.