যদি এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছে থাকে, তাহলে দয়া করে একটু জানাও। তোমার যে ভুলোমন, এখনই জানাও প্লিজ, নইলে ভুলে যাবে। – এই কথা লেখা ছিল চিঠিতে। নিচে নাম লেখা লুসিয়া। এই নামের কাউকে ঋভু চেনে না, যদিও তারই ঠিকানায় এসেছে চিঠিটি। অবশ্য একে চিঠি বলা যায় না, অন্তত কেউ আর চিঠি শব্দটি ব্যবহার করে না, এসেছে ই-মেইল ঠিকানায়, বাড়ির ঠিকানায় নয়, তবু তার কাছে এগুলো চিঠিই। এই ই-মেইল ব্যাপারটা চালু হওয়ার পর সেটি হয়ে দাঁড়িয়েছে নিছক প্রয়োজনীয় যোগাযোগের মাধ্যম, যার অধিকাংশই দাফতরিক ভাষায় লেখা, চিঠির আবেগ তাতে থাকে না, কিন্তু এই চিঠিটি যেন অন্যরকম। শুরুতে সম্বোধন করা হয়েছে ‘প্রিয় পারভেজ’ বলে, হ্যাঁ, ওটা তারই নামের অংশ, পারভেজ মাহমুদ তার নাম, বন্ধুরা ডাকে ঋভু বলে, তবু সে বিশেষ গুরুত্ব দিলো না। নির্ঘাত ভুল করে চলে এসেছে এখানে, কাকে-না-কাকে লিখেছে মেয়েটি তার নেই ঠিক, সে কী উত্তর দেবে? অবশ্য তার মনে হচ্ছিল, একটা কিছু লেখা দরকার, অন্তত এটুকু তো লেখা যায় – ‘আপনি যাকে খুঁজছেন আমি সে নই।’ কিন্তু তখনই ফোনটা বেজে উঠলো, রিসিভ করতে-না-করতে ওপাশ থেকে – ‘আজকে সন্ধ্যায় ফ্রি থাকিস। জরুরি দরকার।’ বললো অংশু। জহির হাসান ওরফে অংশু। বন্ধুরা অংশু বলেই ডাকে। ও ওভাবেই বলে, কুশলবিনিময়ের ধার ধারে না, ‘আজকে সন্ধ্যায় ফ্রি আছিস কি না’ ধাঁচের প্রশ্ন করার প্রয়োজনই মনে করে না, এমনকি ফোনের অপরপ্রান্তে যে আছে সে কথা বলার মতো অবস্থায় আছে, নাকি ঝামেলায় আছে, তাও জিজ্ঞেস করে না। ঋভু তাই অবাক হলো না, বললো – কী এমন দরকার শুনি?
সেটা টেলিফোনে বলা গেলে তো বলতামই, উল্লুক। সন্ধ্যায়ই জানতে পারবি। এখন রাখছি।
আরে শোন শোন।
বল।
তোর এই পুরনো গালিগুলো পাল্টা। অনেক নতুন নতুন গালি বাজারে চলছে।
তুমি আগে নতুন গালির যোগ্য হয়ে ওঠো, বালক। তারপর দেখা যাবে।
এইটা একটা কথা বললি? নতুন একটা গালি খাওয়ারও উপযুক্ত হইনি?
না হওনি হে বেল্লিক, পাঁঠা। আমার ফাও প্যাঁচাল পারার সময় নেই। রাখলাম।
লাইন কেটে দিলো অংশু। কী এমন জরুরি দরকার পড়লো হঠাৎ, একটু ভাবলো ঋভু। না, তেমন একটা ভাবার দরকার নেই, পরমুহূর্তেই মনে হলো তার। হয়তো মদ খাওয়ার জন্যই ডাকছে। অনেকদিন আড্ডা হয় না, সেজন্যে একটু ফুর্তি করার ইচ্ছে জেগেছে হয়তো। কিন্তু একটু যেন মনোযোগ কেটে গেছে ঋভুর, সে টের পেল। কী যেন একটা কাজ করার কথা, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। অথচ সকাল সকাল অফিসে এসেছে মিটিং শুরু হওয়ার আগে কাজটা সেরে ফেলতে। কিন্তু কাজটা কী?
সে শুরু থেকে ফের ভাবতে বসলো। এসেই রুটিনমাফিক ই-মেইল চেক করছিল সে, যেমন প্রতিদিন সকালে করে। সারাক্ষণ স্মার্টফোনে বা গাড়িতে আসার সময় ল্যাপটপ খুলে মেইল চেক করা বা ইন্টারনেট সার্ফিং করার বদঅভ্যাস তার হয়ে ওঠেনি এখনো। প্রয়োজনই নেই আসলে। কেন সবসময় অফিস বয়ে বেড়াতে হবে সঙ্গে? সত্যি বলতে কি, 888sport appর বাইরে গেলেই কেবল সে ল্যাপটপ সঙ্গে নেয়। বাসা থেকে অফিসে আসা-যাওয়ার পথে সে ওটা নেয়ই না। অফিসে ব্যবহার করে ডেস্কটপ, বাসার ল্যাপটপ বাসাতেই থাকে সবসময়। এসব ঝামেলা সর্বক্ষণ বয়ে বেড়ানো থেকে সে সচেতনভাবেই মুক্ত থাকে। একবার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে ফের আর এ নিয়ে ভাবে না, পরদিন সকালে এসে মেইল চেক করে। আজকেও তা-ই করছিল। দেখলো, আরো অনেক মেইলের সঙ্গে অচেনা ঠিকানা থেকে আসা একটা মেইল। অবশ্য এরকম প্রতিদিনই আসে। অধিকাংশই আজেবাজে, স্পামে জায়গা হওয়ার কথা, চলে আসে ইনবক্সে। কিন্তু এই মেইলটা অন্যরকম। সাবজেক্টে লেখে : ‘পারভেজ, ইটস মি, লুসিয়া।’ তার মানে, তাকেই লিখেছে কেউ, লুসিয়া নামের কেউ। অবশ্য পারভেজ নামটাও খুবই কমন, এই মেইলটাও ভুয়াই হতে পারে। কৌতূহল নিয়ে মেইল খুললো সে, দেখলো লেখা আছে – ‘প্রিয় পারভেজ, খুব শিগগির 888sport appsে আসছি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। অনেক ঝক্কি করে তোমার মেইল অ্যাড্রেস পেয়েছি, জানি না ঠিক কি না। যদি এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছে থাকে, তাহলে দয়া করে একটু জানাও। তোমার যে ভুলোমন, এখনই জানাও প্লিজ, নইলে ভুলে যাবে। – তোমার লুসিয়া।’
পাত্তা দেয়নি ঋভু। ‘তোমার লুসিয়া’ বলার মতো সম্পর্ক তার নেই কারো সঙ্গে, এই নামে কাউকে চেনেই না সে। 888sport appsে আসছে মানে দেশের বাইরে থেকে আসছে। তার কাছে আসার মতোও কেউ নেই। মেয়েটাই বা কেমন, নিশ্চিত না হয়ে কাকে-না-কাকে লিখছে ‘যে ধরনের ভুলোমন তোমার!’ আজব! কিন্তু কিছু একটা উত্তর যে দেওয়া দরকার, তাও তার মনে হচ্ছিল। কী লেখা যায়? ‘কে তুমি?’ বা ‘তুমি যাকে খুঁজছো, আমি সে নই?’
দিন শুরুই হয়নি, পরে উত্তর দেবে ভাবতে ভাবতে অংশুর ফোন এলো। তারপর … তারপর যেন কী? কী যেন একটা কাজ পড়ে আছে? সে মেইলের কথা ফের ভুলে গেল। মিটিংয়ের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। কলিগরাও এসে পড়েছে।
সারাদিন নানান ঝামেলায় কাটলো। অফিসে যেমন কাটে আর কি! সন্ধ্যা হতে-না-হতেই অংশুর ফোন।
এই তুই কই?
অফিসে।
এখনো অফিসে? বেরোবি কখন?
এই তো এখনই।
চলে আয়।
কোথায়?
কোথায় আবার! সবসময় যেখানে বসি।
আমরা কি এক জায়গায় বসি? নামটা বল।
উল্লুক পাঁঠা! তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। স্পেশাল অকেশন হলে কোথায় বসিরে গর্দভ?
গালাগালি না করে জায়গার নামটা বল না বাপ।
সোনারগাঁওয়ে আয়।
আচ্ছা আসছি।
দেরি করিস না কিন্তু। জরুরি।
আচ্ছা। আসছি।
পৌঁছতে বেশি সময় লাগলো না। লাউঞ্জে ঢুকতেই চোখাচোখি হলো অংশুর সঙ্গে। প্রবেশপথের দিকে মুখ করে বসেছিল সে। কিন্তু ওর উল্টোদিকে বসা মেয়েটি কে? এখান থেকে কেবল তার পিঠের অনাবৃত অংশ দেখা যাচ্ছে, তাও ওরকম ব্লাউজ পরেছে বলে। আজকাল তো মেয়েরা উদ্ভট সব ড্রেস পরে। এরকম পুরনো স্টাইলের ব্লাউজ বর্জন করেছে তারা। কিন্তু ওটুকু দেখে কি আর কাউকে চেনা যায়? অবশ্য চিন্তা করারও বেশি সময় পাওয়া গেল না। কাছে যেতেই ফিরে তাকালো মেয়েটি আর ঋভু চমকে উঠলো। সুসান! সুসানা রেজওয়ান ওরফে অবন্তি। বন্ধুরা ডাকে অবন্তি বলে, কেবল ঋভুই ডাকে সুসান। এতোদিন পর ও কোত্থেকে এলো? অংশু ওকে খুঁজেই বা পেল কীভাবে? কিন্তু বিস্ময় গোপন করলো সে, হাসিমুখে বললো – অনেকদিন পর সুসান। কেমন আছো?
এই মুহূর্তে ভালো। তুমি?
আমিও এই মুহূর্তে ভালো।
ঋভু বসতে যাচ্ছিল, অংশু বাধা দিয়ে বললো, চল পুলসাইডে যাই।
আচ্ছা, চল।
যেতে যেতে আলগোছে অংশুর কাঁধে হাত রাখলো ঋভু, অংশু মৃদু হেসে চুপ থাকার ইশারা করলো, ফিসফিসিয়ে বললো – সময়মতো সব বলবো।
উঁহু, তিনজনের সমাবেশে দুজনের ফিসফিসানি নিষেধ। – অবন্তি বললো।
হা-হা-হা করে হেসে উঠলো তিনজনই। এই নিয়মটি তাদের মধ্যে জারি ছিল সেই বিশ^বিদ্যালয় জীবনে, অংশুই ছিল সেই নিয়মের প্রবর্তক। অবশ্য দলের সদস্য888sport free bet তখন ছিল চার। বিশ^বিদ্যালয় থেকে বেরিয়েই সেই যে দেশ ছাড়লো জামিল, আর ফেরেনি। কোনো যোগাযোগও রাখেনি। অবন্তিও কয়েক বছর পর দেশ ছেড়েছিল, যোগাযোগ ছিল না ওর সঙ্গেও। দলটা ভেঙে গেছে সেই কবে! কেবল অংশু আর ঋভু রয়ে গেছে এখনো, গলায় গলায়। অথচ অংশু ছিল প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র, অন্য তিনজন 888sport app বিশ^বিদ্যালয়ের, সহপাঠী; কলেজে একসঙ্গে পড়ার সুবাদে ঋভুর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল অংশুর, সেখান থেকে বাকি দুজনের সঙ্গেও। কত মধুর সময় যে কাটিয়েছে চারজন মিলে! অবশ্য চারজন একেবারে নির্দিষ্ট ছিল তাও নয়, দলে এসে যোগ দিতো আরো কেউ কেউ, তবে এই চারজনের বন্ধুত্ব ছিল অন্য সুরে বাঁধা, সেখানে কেউ ততটা তাল মেলাতে পারতো না।
তারপর?
‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার।’
অংশুর পানের আয়োজন বেশ রাজকীয়। কেবল একটা বোতল আর কয়েকটা গ্লাস হলে তার চলে না। হরেক রকমের মুখরোচক খাবার থাকতে হয়; সোডা বা ফলের রস, বিট-লবণ, লেবুর রস ইত্যাদি নানা উপাদান মিশিয়ে একটা সুস্বাদু পানীয় তৈরি করে সে, তারপর পরিবেশন। খেতে বেশ লাগে।
কয়েক পেগ পেটে পড়তেই মুখ খুলে গেল অংশুর। বললো – শোন ঋভু, আমি জানি অবন্তিকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করার জন্য তোর বুক ফেটে যাচ্ছে। বলে ফ্যাল। ও কিছু মনে করবে না। করবি, অবন্তি?
নাহ। কী মনে করবো?
তুই কি অন্তর্যামী যে, আমার কী ইচ্ছে করছে তাও জেনে বসে আছিস? – বললো ঋভু।
না, অন্তর্যামী নই। কিন্তু আমার উল্লুক বন্ধুর মনে কী আছে, সেটুকু বুঝতে পারি।
আচ্ছা সুসান, তুমিই বলো, এই গাধাটা এখনো সেই পুরনো গালিগুলোই আমার জন্য বরাদ্দ রেখেছে। কত নতুন গালি এসেছে বাজারে, কোনো আপডেট নাই ওর। এটা কি ঠিক?
একবার না বললাম, নতুন গালির জন্য যোগ্য হয়ে ওঠো সোনা!
অবন্তি মৃদু হাসি ঠোঁটে নিয়ে ওদের কথা শুনছিল, এবার বললো, তোমরা কি আগের মতোই দুজন দুজনের পিছে লেগে থাকো?
পরস্পরের দিকে তাকালো ওরা, প্রথমে অর্থপূর্ণ মুচকি হাসি বিনিময় করলো, তারপর ফেটে পড়লো অট্টহাসিতে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো অবন্তি – এই কথায় এতো হাসির কী হলো?
তোমার মনে নেই সুসান? – জিজ্ঞেস করলো ঋভু।
কীসের কথা বলছো?
এই উল্লুক! মনে করিয়ে দিস না দোস্ত, প্লিজ। – অনুনয় করলো অংশু।
না, না, বলো। কী এমন কথা যে আমার মনে পড়লে সমস্যা?
না, সমস্যা না …
তাহলে বলো।
ওই যে তুমি তাড়া করেছিলে অংশুকে, কিলিয়ে ভূত ছাড়িয়ে দিয়েছিলে …
লজ্জামাখা হাসি দিয়ে অবন্তি বললো – মনে পড়েছে। কী ফাজিল যে ছিল অংশু!
ঘটনা হলো, একদিন অবন্তিকে খুব খেপাচ্ছিল অংশু, যেমন প্রায়ই খেপাতো। অবন্তি বিরক্ত হয়ে বলেছিল – তুই সবসময় আমার পিছে লেগে থাকিস কেন বল তো অংশু?
অংশু অমøানবদনে বলেছিল – যদি সামনে থেকে লাগতে দিস, তাহলে পিছনে লাগবো না, কসম!
বুঝে উঠতে একটু সময় নিয়েছিল অবন্তি, তারপর খেপে উঠে তাড়া করেছিল, দৌড়ে ধরেও ফেলেছিল অংশুকে, ‘তুই এত্ত বড় বদমাশ’ বলতে বলতে কিল শুরু করেছিল, আর অংশু হাসতে হাসতে বলছিল, কসম কেটেছি তো, তোর পিছে লাগবো না, একবার কেবল সামনে থেকে লাগতে দে …
ফাজিল ছিলাম? আমি ফাজিল ছিলাম? – অংশু চেঁচালো।
ছিলিই তো। মলির সঙ্গে কী করেছিলি মনে নেই?
মলির সঙ্গে? ওর সঙ্গে আবার কবে কী করলাম?
থাক অংশু, আর সাধু সাজতে হবে না তোকে। আমাদের সব মনে আছে। কম জ¦ালিয়েছিস মেয়েদেরকে? – ঋভু বললো।
কিন্তু মলির ঘটনাটা কী? আমার একদম মনে পড়ছে না।
সত্যি ভুলে গেছিস?
তাই তো মনে হচ্ছে।
ওই যে মলিকে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে ওর বুকের কাছে মুখ নিয়ে …
যাহ! মুখ নিইনি।
তাহলে কী করেছিলে তুমি, চান্দু?
মলি সেদিন কী যেন এক ডিজাইনের কামিজ পরে এসেছিল, মনে হয়েছিল জামা জুড়ে ছোট ছোট আয়না। তখন মনে পড়লো, সকালে চুল আঁচড়ানো হয়নি। ভাবলাম, মলির জামার আয়নায় চুলগুলো ঠিক করে নিই …
তাই বলে বুকের কাছে …
আহা, বুকের কাছের আয়নাটা একটু বড়ো ছিল তো!
মলি বেচারী কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল, চিৎকার করে বলেছিল – এই তুমি কী দেখো?
হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম, দেখি না, চুলটা ঠিক করে নিচ্ছি।
বললেই পারতি, সুযোগ পেয়ে তোমার বুকের দিকে …
তা বলবো কেন? মলির ওড়না তো কখনো বুকে থাকতো না, গলায় ঝুলিয়ে রাখতো। দেখার জন্য আয়োজন করতে হতো না …
এই তোরা থামবি? আমি যে বসে আছি, একটা জলজ্যান্ত মেয়ে, তোদের খেয়াল নেই?
থাকবে না কেন? তোকে সামনে রেখে এসব বলছি যেন তোকেও বলা যায়!
আবার মাইর খাবি কিন্তু অংশু।
দে না, প্লিজ দে একটা চড় বা কিল বা চিমটি বা চুমু … কতদিন তোর কাছ থেকে এসব পাই না!
হারামি, বদমাশ, ফাজিল …
দেখলি তো পুরনো গালি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলি না! খালি আমার দোষ! নাহ, জমছে না। একটু খালি করে আসি। – বলে অংশু উঠে গেল ওয়াশরুমের দিকে। হঠাৎই যেন নীরবতা নেমে এলো তখন। একটুক্ষণ দুজনেই চুপ, তারপর অবন্তিই বললো – কতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হলো, বলো তো!
প্রায় কুড়ি বছর। – বললো ঋভু।
কুড়ি বছর! ‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার, তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার-আমার!’
হলো তো!
হ্যাঁ, হলো। না-ও হতে পারতো। কখনো ভাবিনি, হবে।
কেন?
ওই যে জীবন গিয়েছে চলে …
হেঁয়ালি করো না।
তোমার কখনো ইচ্ছে হয়েছে, ঋভু?
কী?
দেখা করতে?
হ্যাঁ, হয়েছে।
চেষ্টা করেছো?
করবো কীভাবে? তুমি তো যোগাযোগই রাখোনি।
তুমি তো রাখতে পারতে!
তাই কি হয়? তুমি তো চাওনি …
কী করে বুঝলে যে চাইনি?
বোঝা যায়।
কীভাবে বোঝা যায়?
যাওয়ার সময় আমাকে বলে যাওনি তুমি। আমি জেনেছি অনেকদিন পর।
তা ঠিক। আমি তোমাকে না বলেই চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু …
এ প্রসঙ্গ থাকুক সুসান। অন্য কথা বলো।
অন্য কী কথা?
কেমন আছো তুমি? কী করছো? বিয়ে করেছ কি না, বাচ্চাকাচ্চা …
তোমাকে অংশু কিছু বলেনি, না?
নাহ! তোমার নামও উচ্চারণ করেনি।
হুম। আমিই বলেছিলাম না বলতে।
কেন?
ভেবেছিলাম, হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো। তুমি সারপ্রাইজড হওনি, না?
হয়েছি। দারুণ সারপ্রাইজড হয়েছি।
অথচ একটুও বোঝা গেল না। আগের মতোই নিজের অনুভূতি লুকিয়ে ফেলো তুমি, না?
ওরকম কিছু না।
তাহলে?
অংশু এসে গেল এই সময়, বললো – আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তোরা কী গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিস বল তো!
দুজনের কেউই কথা বললো না। অংশুর বুঝতে বাকি রইলো না, যে-হাস্যমুখর পরিবেশ সে রেখে গিয়েছিল তা পাল্টে গেছে। দুজনের মুখেই একটা আবছা বিষণ্নতা লেগে আছে। চেয়ারে বসতে বসতে অংশু বললো – আর নিবি তোরা, নাকি ক্লোজ করতে বলবো?
এখনই ক্লোজ করবি কেন? চলুক না! – বললো ঋভু।
অবন্তি, তুই?
মাথা নেড়ে সেও সায় দিলো। আরেক প্রস্থ অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলো অংশুও, ওদের দুজনের মতো। নীরবতাটা উপভোগও করছিল সে, যেন এই নীরবতার ভেতর দিয়েই ওরা অনেক না-বলা কথা ভাগ করে নিচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে। অবশ্য ওদের দুজনের মধ্যে কতটুকু কথা হয়েছে, অংশু জানে না; কিন্তু একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এই দুজনকে মুখোমুখি করিয়ে দিয়েছে সে, দুজনের কেউ আবার সেটা জানে না। জীবনের নানা দুর্যোগ পেরিয়ে, দু-একবার জিতলেও বারবার হেরে গিয়ে দুজনই এখন পোড়-খাওয়া মানুষ। দুজনেই একা-একা, সঙ্গী নেই, যদিও ছিল দুজনেরই। একসময়, সে বহুকাল আগের কথা, পরস্পরকে ভালোবাসতো ওরা, তারপর কী থেকে কী হলো, অংশু ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি; দুজনের পথ বেঁকে গেল দুদিকে, চিরদিনের জন্য। ঋভুর কী যেন হলো – ওর বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সঙ্গে কী একটা ব্যাপার নিয়ে খুব বড়ো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি চলছিল, খোলাসা করে কোনোদিন বলেনি সে। প্রায়ই আনমনা থাকতো, মাঝে-মধ্যে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতো, যখন ফিরতো তখনো ঠিকঠাক করে বলতো না – কী করেছে সে এতোদিন, কোথায় ছিল! ওদিকে অবন্তিও বুঝে উঠতে পারছিল না, কী করবে, ঋভু যেন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, এরকম অনুভূতি হতো তার। কোনো চূড়ান্ত বোঝাপড়া হয়েছিল কি না জানতে পারেনি অংশু, হঠাৎই একদিন শুনেছিল – অবন্তি দেশের বাইরে চলে গেছে। জামিলও গিয়েছিল আগেই, তবে বেশ ঘটা করে, বিদায়-টিদায় নিয়ে, অবন্তি গেল গোপনে। তারপর আর দুজনের কেউই যোগাযোগ রাখেনি। অনেক বছর পর অংশু জেনেছিল, জামিল আর অবন্তি বিয়ে করেছে, কিন্তু খবরটা জানায়নি ঋভুকে। জানাবেই-বা কেন? ঋভু আর কোনোদিন অবন্তির নামও উচ্চারণ করেনি। এমনকি ওর প্রসঙ্গ উঠলে নীরব হয়ে যেতো সে। বিয়ে করেছিল ঋভুও, মায়ের শেষ অনুরোধ রাখার জন্য। সংসারটা টেকেনি, ওর বউ চলে গেছে, তাও অনেক বছর হয়ে গেল। এই মাসখানেক আগে হঠাৎই অবন্তির ই-মেইল পায় অংশু, 888sport appsে আসছে ও, জানায়। ফোন নাম্বার বিনিময় হয়, কথাও হয় প্রচুর, অংশু জানতে পারে – জামিলের সঙ্গে অবন্তির সংসারও ভেঙে গেছে অনেক আগেই। আর তখনই তার মনে হয়েছিল, এবার ঋভু আর অবন্তিকে মিলিয়ে দিলে কেমন হয়? অবন্তি অনুরোধ করেছিল, ওর সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটা যেন ঋভুকে না জানায় অংশু। সে অনুরোধ রেখেছে, কিছুই জানায়নি। মাত্র পরশুই ফিরেছে অবন্তি, ওর সঙ্গে আলাপ করে আজই এই আকস্মিক দেখা হওয়ার আয়োজন করে রেখেছিল সে। ঋভু যে বিস্মিত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, যদিও হাবভাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এখন জিজ্ঞেস করেও লাভ হবে না, কিছুতেই দরজা খুলবে না ও, দেখতে দেবে না ওর ভেতরের আনন্দ, বিস্ময় অথবা বেদনাকে। পরে ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই ফিসফিস করে উঠলো অংশু – আসছে, আসছে এক ফাতরা লোক, সর্বনাশ!
অবন্তি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – কী বললি?
এক চুতিয়া আসছে এদিকে, তাই বললাম।
এটা আবার কোন ধরনের ভাষা? ছি! কে আসছে শুনি?
এখনই টের পাবি।
অবন্তি একজনের বাজখাঁই কণ্ঠস্বর শুনতে পেল – আরে জহির সাহেব, কী খবর?
মুখে গালাগালি করলেও অংশু করপোরেট কায়দায় হাসলো, বললো – এই আছি ভাই। আপনার খবর কী?
আমিও ওই আছি আর কি! তা, আপনি কি খুব ব্যস্ত?
পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। একটু ব্যস্তই।
বাহ্। বেশ বেশ। ঋভুর দিকে হাত বাড়িয়ে ‘আমি আরিফ চৌধুরী’ বলে নিজের পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক, ঋভুও করমর্দন করে নিজের নাম বললো। তারপর অবন্তির দিকে একটু ঝুঁকে, নিজের পরিচয় দিলে এবং অবন্তিও নিজের নাম বললে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন, পরিচিত হয়ে দারুণ খুশি হলাম। চলুন না, আমাদের সঙ্গে বসবেন। আড্ডাটা বড়ো হবে।
অবন্তি হেসে বললো, থ্যাংকস। বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন পর বসেছি তো …
আচ্ছা, আচ্ছা। ঠিক আছে। জহির সাহেব, আপনি না হয় একটু আসুন, আমার বন্ধুদের হ্যালো বলে যান।
ঠিক আছে চলুন।
যেতে যেতে পেছন ফিরে অবন্তির দিকে ভ্রু নাচিয়ে অংশু ‘কী, বলেছিলাম না, এইটা একটা ফাতরা?’ – গোছের একটা ভঙ্গি করলে অবন্তিও ‘ঠ্যালা সামলা’ গোছের একটা দুষ্টুমিমাখা হাসি দিলো। তারপর খেই হারিয়ে ফেলা আলাপের সুতো টেনে ধরে বললো – তাহলে অংশু কিছুই বলেনি তোমাকে?
উঁহু।
কেমন আছি জানতে চেয়েছিলে না? এই তো যেমন দেখতে পাচ্ছো!
ওটা তো দেখা যায় না।
যায় বোধহয়, যদি দেখার ইচ্ছে থাকে।
হুম, তা বলতে পারো। কিন্তু শুধু ইচ্ছে থাকলেও হয় না, দেখার চোখ লাগে।
তোমার চোখ নেই?
ছিল কখনো?
ছিল। এখনো আছে। আমি জানি, তুমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছো, আমি কেমন আছি। যাকগে, জানতে চেয়েছিলে বিয়ে করেছি কি না, বাচ্চাকাচ্চা আছে কি না! হ্যাঁ, বিয়ে করেছিলাম।
পাস্ট টেন্স?
হ্যাঁ।
ও!
ও মানে কী?
আমারও পাস্ট টেন্স। – অন্যমনস্কভাবে বললো ঋভু।
তোমারও? – ভীষণ অবাক হওয়া কণ্ঠে বললো অবন্তি।
হ্যাঁ। তুমি জানতে না?
জানবো কী করে?
অংশু বলেনি?
না।
জিজ্ঞেস করেছিলে?
হ্যাঁ, করেছিলাম। বলেনি।
আশ্চর্য তো! ও আমার কথা তোমাকে বলেনি, তোমার কথা আমাকে বলেনি, এর মানে কী?
আমার কথা বলতে না করেছিলাম।
ও হ্যাঁ, একবার বলেছো সে-কথা।
আর বাচ্চাকাচ্চা নেই। – পুরনো কথার খেই ধরে বললো অবন্তি।
হুম।
কাকে বিয়ে করেছিলাম জানতে চাইলে না?
আমি চিনবো তাকে?
হ্যাঁ চিনবে। ভালো করেই চেনো।
জামিল?
আন্দাজে বললে?
হ্যাঁ।
না, আন্দাজে বলোনি। তুমি নিশ্চিত হয়েই বলেছো।
ঋভু কিছু বললো না। ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে সে, কী যেন ভাবছে আপনমনে, অবন্তি খেয়াল করলো। বেশ কিছুক্ষণ সেও নীরবে অপেক্ষা করে রইলো, কিন্তু ঋভু যেন এ-জগতেই নেই। অবন্তি ডাকলো আবার, এই!
উঁ।
কী হলো তোমার?
না, কিছু না।
কী ভাবছিলে?
ভাবছিলাম … জামিলের সঙ্গে তুমি … কেন? কীভাবে সম্ভব?
হেসে ফেললো অবন্তি – অসম্ভব, না?
হ্যাঁ।
সেজন্যই তো একসঙ্গে থাকা হলো না।
কিন্তু এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে কেন?
সে অনেক কথা। পরে শুনো। অংশু আসছে।
অংশু এসেই গালি ঝাড়লো – শালা, খচ্চর।
কে রে লোকটা?
আমার ক্লায়েন্ট। বিল বাকি পড়ে রয়েছে ওর কাছে, ঘোরাচ্ছে। আবার বলে, চলেন আড্ডা দিই! বাদ দে।
হুম, আমরা তো বাদ দিয়েছিই, তুই দিলেই হয়।
আমিও দিয়েছি। শোন, রাত তো অনেক হলো। আজকে আরো বসবি?
তোর যেমন মর্জি।
নাহ, আজ আর জমবে না। কালকে আবার বসা যাবে।
কথা হচ্ছিল অংশু আর অবন্তির মধ্যে। ঋভু এতোক্ষণ একটা কথাও বলেনি। এবার বললো – আমি আরো কিছুক্ষণ বসবো।
কিন্তু অবন্তিকে পৌঁছে দিতে হবে তো!
তোরা যা। আমি কিছুক্ষণ বসি।
একা থাকবি!
হুঁ।
অবন্তির দিকে ‘কী হয়েছে ওর’ গোছের প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো অংশু, অবন্তি ‘আমি কী জানি’ গোছের ঠোঁট উল্টালো। তারপর ঋভুকে বললো – আমি দু-সপ্তাহের জন্য এসেছি। তোমাকে প্রতিদিন পাওয়া যাবে তো?
হ্যাঁ, যাবে।
ঠিক আছে। আজ তাহলে উঠি? কাল কি দেখা হবে?
ঋভু তাকালো অংশুর দিকে, অংশু হ্যাঁ-বোধক ইশারা করলো। ঋভু বললো – হ্যাঁ হবে। অংশু, তুই সময় ঠিক করে আমাকে জানাস।
আচ্ছা। যাই তাহলে।
আচ্ছা যা। কাল দেখা হবে।
দুই
ওরা চলে যাওয়ার পরও ঋভু একা একা বসে রইলো অনেকক্ষণ, একাই খেলো। তার অবশ্য ফেরার তাড়া নেই। বাসায় কেউ অপেক্ষা করে নেই, থাকে না কখনো। অবশ্য কথাটা পুরোপুরি ঠিক হলো না। মনসুর চাচা এই বুড়ো বয়সেও রাত জেগে অপেক্ষা করেন। সে না ফেরা পর্যন্ত চাচিও ঘুমান না। সেই ছোটবেলা থেকে এদেরকে দেখে আসছে ঋভু, একটা জীবন তারা কাটিয়ে দিলেন এই বাসায়। গ্রামের লোক, বাবা নিয়ে এসেছিলেন সেই কবে, আর ফিরে যাননি। অথচ ঋভু গ্রামে তাদের জন্য বড়োসড়ো একটা বাড়ি করে দিয়েছে নিজেদের জমিতেই। সেখানে থাকে চাচার দুই ছেলে, ঋভুদের ফসলি জমিগুলো চাষ করে, বাড়িটা দেখাশোনা করে; কিন্তু চাচা-চাচি যান না, কিংবা গেলেও দু-চারদিন পর চলে আসেন। ঋভু কতবার বলেছে যেতে, তাদের একটাই কথা – ‘আপনারে একলা রাইখা কেমনে যাই ছোট সাহেব!’ এই ছোট সাহেব ডাকটাও ফেরাতে পারেনি ঋভু। একসময় খুব অস্বস্তি হতো, এখন মেনে নিয়েছে। তো, এই চাচা-চাচির জন্যই বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে অস্বস্তি হয়। নইলে বাসায় না ফিরলেই-বা কী? আজকে অবশ্য চাচাকে আগেই ফোন করে বলেছে, ফিরতে দেরি হবে, বাইরে থেকে খেয়ে যাবে, তারা যেন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। সেজন্য অতো ভাবছে না, একটু দেরি করে ফিরলেও অসুবিধা নেই।
সে ভাবছিল অবন্তির কথা। অপ্রত্যাশিত এই দেখা হওয়া। সে তো প্রায় ভুলতেই বসেছিল। মাঝে-মধ্যে মনে পড়লেও বড়োজোর একটা দীর্ঘশ^াস বরাদ্দ করতো নিজের জন্য। নিজের জন্য, কারণ অবন্তিকে ধরে রাখার কোনো চেষ্টাই সে করেনি। যদি কোনো দায় থাকে, তা তারই, অবন্তির নয়। কেন চেষ্টা করেনি? কী হয়েছিল তার? সে কি ভালোবাসতো না অবন্তিকে? বাসতো, খুবই বাসতো, যদিও তার প্রকাশ খুব একটা ছিল না। অন্যসব বন্ধু ওকে অবন্তি নামে ডাকতো, ঋভু কখনো ডাকেনি সে নামে, ডেকেছে সুসান বলে। অন্যসব বন্ধুর মতো ‘তুই’ সম্বোধন করেনি কখনো, ‘তুমি’ই বলে এসেছে সবসময়। হয়তো এগুলোই তার ভালোবাসার প্রকাশ ছিল, কিংবা ছিল আরো বেশি কিছু, তবু কখনো ওকে বলা হয়নি কিছুই। তারপরও সম্ভাবনা ছিল প্রেম হওয়ার কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর এমন এক জটিলতায় পড়লো সে যে, কোনোকিছুই আগের মতো রইলো না। না, আর্থিক সংকট বা সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার মতো অতিপরিচিত সমস্যাগুলো তার হয়নি। বরং হয়েছিল উল্টোটাই। বাবা চলে গিয়েছিলেন বেশ অল্প বয়সেই, সে তখনো বিশ^বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোয়নি। আকস্মিকভাবে চলে গেলেন তিনি, সেই শোক আর শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে-না-উঠতেই নতুন এক জটিলতা দেখা দিলো। বাবা কোনো এক অজানা কারণে তাঁর সমস্ত টাকাপয়সা দুভাগে ভাগ করে গিয়েছিলেন, এক ভাগ তাঁর স্ত্রীর নামে, আরেক ভাগ ঋভুর নামে। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমানো টাকা, সঞ্চয়পত্র, এফডিআর, প্রভিডেন্ড ফান্ড – সবকিছুতেই নমিনি করা হয়েছে দুজনকে এবং পরিষ্কারভাবে সেখানে শতকরা কতভাগ কে পাবে তাও লেখা আছে। সোজা কথায় ঋভু পাবে অর্ধেক, তার মা পাবেন অর্ধেক। বাবা এই কাজটি কবে করেছিলেন বা কেন করেছিলেন, ঋভু এখনো জানে না। কিন্তু মা ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিলেন না। তাঁর যে সম্পদের লোভ ছিল তা নয়, কিন্তু কী কারণে যেন তিনি ভাবতে লাগলেন – ঋভুর বাবা তাঁর ওপর আস্থা বা বিশ^াস রাখতে পারেননি। তিনি মারা গেলে ঋভুর প্রাপ্য অংশ ওর মা আদৌ বুঝিয়ে দেবে কি না, এ নিয়ে তাঁর মনে নিশ্চয়ই সন্দেহ ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করতে শুরু করলেন – বাবার এই ভাগাভাগির ব্যাপারটা ঋভু জানতো, এতোদিন ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রেখেছিল। ঋভু কিছুতেই মাকে বিশ^াস করাতে পারলো না যে, সে এগুলোর কিছুই জানে না, টাকাপয়সা-ধনসম্পদ নিয়ে সে ভাবেইনি কোনোদিন, ভাবার প্রয়োজনও হয়নি। মায়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে লাগলো তখন, পালিয়েই বেড়াতো মায়ের চোখের সামনে থেকে। কেমন যেন ছন্নছাড়া এক ভাব এসেছিল তার মধ্যে। এরই ভেতরে কখন যে কী হলো, অবন্তির সঙ্গে সম্পর্কটা গভীর হওয়ার বদলে কেমন যেন আলগা হয়ে গেল।
এখনো আছিস তাহলে? – প্রশ্ন শুনে চমকে তাকালো ঋভু। সামনে অংশু দাঁড়ানো। এতো অন্যমনস্ক ছিল সে এতোক্ষণ, কখন যে ও এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারেনি।
আবার এলি যে!
তোকে একা রেখে গেলাম, ভালো লাগছিল না।
সুসান?
ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসেছি।
বসবি?
তুই কি আরো কিছুক্ষণ থাকবি?
হ্যাঁ।
তাহলে বসি।
বাসায় জানিয়েছিস?
হ্যাঁ জানিয়েছি।
এই যে এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকিস, অপলা কিছু বলে না?
কী আর বলবে? নতুন কিছু তো আর না। অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
হুম। হয় অপলা মেয়েটা সহনশীল অথবা তুই বুদ্ধিমান।
মানে?
মানে আর কি! দুটোর একটা না হলে ঝামেলা হতো।
এমনও তো হতে পারে, দুটোই একসঙ্গে।
তা পারে। তাহলে তো কথাই নেই।
একপক্ষীয় হলে হয়তো ঝামেলা হয় না কিন্তু অভিযোগ তৈরি হয়। দুই পক্ষের সায় থাকলেই সবকিছু সহজভাবে চলে।
হ্যাঁ, তুই সেটা পেরেছিস। আমি পারিনি।
ঋভুর পারিবারিক জীবন নিয়ে আলোচনার দিকে গেল না অংশু। বললো – সুসানের সঙ্গে কথা হলো?
তুই আবার ওকে এই নামে কবে থেকে ডাকা শুরু করলি?
ওহ! ওটা তো তোর কপিরাইট করা ডাক! ভুলে ডেকে ফেলেছি। বল না, কী কথা হলো!
এই টুকিটাকি। তুই কিছু বলিসনি কেন?
ইচ্ছে করেই বলিনি। নিজেরাই জেনে নেওয়া ভালো না?
তা ভালো।
কী বুঝলি?
কোন ব্যাপারে?
এখনো তোদের ভেতরে প্রেমটা আছে?
বোধহয় আছে। ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না।
সংশয়টা কোথায়?
এতোদিন পর দেখা হলো, কয়েকটা মাত্র কথা হলো, নিশ্চিত হই কীভাবে বল?
বোঝা যায় না?
উঁহু। বড়োজোর আন্দাজ করা যায়।
তা কী আন্দাজ করলি?
অনেক অভিযোগ আছে ওর।
সেটা কি স্বাভাবিক না?
উঁহু, স্বাভাবিক না।
কেন?
দ্যাখ, আমরা জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। জীবনকে উল্টেপাল্টে দেখেছি। অনেক কিছু জেনেছি, বুঝেছি। এই বয়সে এসে পুরনো বন্ধুর প্রতি অভিমান-অভিযোগ থাকার কথা নয়।
কিন্তু অনেক বিষয় যদি অমীমাংসিত রয়ে যায় …
যাবেই। এক জীবনে সবকিছুর মীমাংসা হয় না, তুই জানিস। আমরা কেবল অমীমাংসিত বিষয়গুলোকে মেনে নিতে শিখি।
হুম। শোন, অবন্তি তো সপ্তাহ দুয়েক আছে, তুই একটু কথাটথা বলে অভিমানগুলো দূর করে দে।
সে চেষ্টা আমি করবো না, তবে ও যদি কিছু জানতে চায়, বুঝতে চায় আমি জানাবো।
আচ্ছা ঠিক আছে, তাই করিস। আমার মনে হয়, ও বুঝতে চায়।
কী বুঝতে চায়?
কেন তুই ওকে এড়িয়ে গিয়েছিলি।
এড়িয়ে যাইনি তো!
ও তাই মনে করে যে!
তোকে বলেছে?
হ্যাঁ বলেছে।
তুই কী উত্তর দিয়েছিস?
আমি কিছুই বলিনি। জানলে তো বলবো!
তা ঠিক। তোরও তো জানার কথা না। আমি কখনো কিছু বলিনি এ-ব্যাপারে।
যাকগে, আজকে ওঠ। কাল তো আবার দেখা হচ্ছেই।
হ্যাঁ চল।
ড্রাইভ করতে পারবি? খেয়েছিস তো অনেক।
হা-হা-হা … এটা কোনো কথা বললি? আমার পা টলতে পারে, মাথা সোজা থাকে। ড্রাইভ করার জন্য মাথা ঠিক রাখাই জরুরি, বুঝলি গাধা?
বুঝলাম। চল উঠি এখন।
রাস্তায় বেরিয়ে ঋভু দেখলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, পথঘাট ভেজা, পানিও জমেছে কোথাও কোথাও। সম্ভবত বেশ প্রবল বৃষ্টিই হয়ে গেছে ইতিমধ্যে, ভেতরে বসে সে টের পায়নি। এখন এই তুষারপাতের মতো মৃদু বৃষ্টি দেখতেও বেশ লাগছে তার। ‘বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ^াস’ – বৃষ্টি দেখলেই তার এই লাইনটি মনে পড়ে। একটু পরে রিয়ার ভিউ মিররে চোখে পড়লো অংশুর গাড়িটা ওর পিছু নিয়েছে। মানে, বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেবে। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার। বন্ধু! একেই বন্ধু বলে। কোনোভাবেই যে ছেড়ে যায় না, বন্ধুর এতোটুকু বিপদের সম্ভাবনা থাকলেও ঝুঁকির ভেতরে একা ছেড়ে দিয়ে যে চলে যায় না। বন্ধুত্ব তো কতজনের সঙ্গেই হলো এ-জীবনে। স্কুলে, কলেজে, বিশ^বিদ্যালয়ে, পাড়া-মহল্লায়; এখনো অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, আড্ডা হয়; একেক সময় একেক গ্রুপের গেট টুগেদার হয়; কিন্তু অংশুর মতো বন্ধু একজনও নেই। তবু কেন ওর কাছে নিজের অর্গল খুলতে পারে না সে, কেন সব কথা বলতে পারে না? এতো দ্বিধা কেন তার, কেন এতো সংকোচ? নাকি দ্বিধা-সংকোচের প্রশ্ন নয় এটা, স্রেফ তার স্বভাবই এরকম? না বোধহয়। তার এই গুটিয়ে থাকার স্বভাব ছিল না শৈশবে বা কৈশোরে, এমনকি যৌবনের শুরুতেও। বরং বেশ হইহল্লা করা, প্রাণখোলা মানুষই ছিল সে। পরিবর্তনটা আসতে শুরু করেছে বাবার মৃত্যুর পর। না, বাবার আকস্মিক মৃত্যুতেও সে ভেঙে পড়েনি, বরং তার ভাঙন ধরেছিল মায়ের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি আর দূরত্ব তৈরি হওয়ায়।
বাসার কাছে এসে গাড়ির গতি কমালো ঋভু, পেছন থেকে অংশুর গাড়িটাকে সামনে আসতে দিলো, তারপর দুজন হাসি বিনিময় করলো। হাত নেড়ে চলে গেল অংশু, এবার হয়তো সে নিশ্চিত হয়েছে। শব্দ পেয়ে গেট খুলে দিলো করিম। তার মানে করিম ঘুমায়নি, ঘুমালে হর্ন বাজার আগেই গেট খুলতো না। এই মানুষগুলো তাকে প্রায় অতন্দ্র প্রহরায় রেখেছে। কত বছর হলো করিমের, এ-বাড়িতে দারোয়ানগিরির? পঁচিশ, না তিরিশ? বাবা বেছে বেছে ভারি বিশ^স্ত আর অনুগত মানুষগুলোকে নিয়ে এসেছিলেন।
গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে ঋভু এসে দেখলো বারান্দায় মনসুর চাচা দাঁড়ানো। ওই একই ব্যাপার। বলে-কয়েও ঘুম পাড়ানো যায় না এদের, অথচ রাত এখন আড়াইটা।
তোমরা এখনো ঘুমাওনি চাচা?
ঘুম আসতেছে না ছোটসাহেব।
আমি না বললাম ফিরতে দেরি হবে! চলো, এখন ঘুমিয়ে পড়বে।
আপনি খাবেন না?
না, খেয়ে এসেছি।
আপনার চাচি …
চাচিও ঘুমায়নি?
নিজের ঘরে যেতে যেতে ঋভু দেখলো – টেবিলে খাবার বাড়ছে চাচি। তার মানে, না খেয়ে উপায় নেই। কী আর করা! কাপড়-চোপড় ছেড়ে, হাত-মুখ ধুয়ে, ফ্রেশ হয়ে খেতে এলো ঋভু। না খেলেই ভালো হতো, কিন্তু কষ্ট দিতে ইচ্ছে করলো না। খেতে খেতে টুকটাক গল্পও করলো, তারপর নিজের ঘরে ফিরে শুয়ে পড়লো। ঘুম আর আসবে না, বুঝে গেছে সে। আজকে একটু বেশিই গিলেছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। ঘুম হোক আর না হোক, কালও যে হ্যাংওভার থাকবে, পরিষ্কার বুঝতে পারলো। তবু যদি একটু ঘুম আসতো! সে দেখেছে, যেদিন পান একটু বেশি হয়ে যায়, সেদিন যদি বাসায় ফিরে কাপড়-চোপড় না খুলে, এমনকি জুতা-মোজা পরেই, বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারে, সেদিন বেশ ভালো একটা ঘুম হয়। আর যদি আজকের মতো একদম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে, বাইরের পোশাক ছেড়ে ঘরের আরামদায়ক পোশাক পরে, খেয়েদেয়ে আয়েশ করে বিছানায় যায় তো ঘুম উধাও। ঘুমের এ কেমন আচরণ, সে বোঝে না। এটা অবশ্য কেবল পানাহারের সঙ্গেই যুক্ত না বোধহয়। ঘুমানোর আগে পরিচ্ছন্ন হওয়ার অভ্যাসটা তার ছোটবেলার। মায়ের কাছ থেকে শেখা। খাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ বই পড়ো বা টিভি দেখো, তারপর দাঁত ব্রাশ করো, হাত-পা-মুখ-চোখ ধোও, ঘরে এসে ঘুমের পোশাক পরো, চুল আঁচড়াও, মুখে ক্রিম লাগাও, গায়ে লোশন মাখো, ফুলবাবুটি হয়ে ঘুমাতে এসো। ঘুমের প্রস্তুতি হিসেবে এসব করতে করতেই তো এক ঘণ্টা পার। অথচ এ তার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন ঘুমানোর আগে এতো কাজ করতে হয় তাকে, না করলে মনে হয় – কী যেন করা হয়নি। কিন্তু এতোকিছু করেও ঘুম আসতে চায় না। মা খুব যত্ন করে বড়ো করেছিলেন তাকে। বড়ো আদর ছিল তাঁর, বড়ো মনোযোগ।
মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। আজকাল আর এতো সহ্য হয় না। হুইস্কিই বলো আর ভদকা কিংবা জিন, এমনকি বিয়ারও বেশি খেলে সহ্য হয় না, তা সে নরমালই হোক আর ডিলাক্স ব্র্যান্ডেরই হোক। অথচ একসময় কী আনন্দময়ই না ছিল এই পান করার ব্যাপারটা! পছন্দের ডিলাক্স ব্র্যান্ডের হুইস্কি বা ভদকা যেদিন পাওয়া যেতো, সেদিন যেন উৎসব লেগে যেতো। খাওয়ার পর মনে হতো, শরীরের ভেতরে হেমন্তের মিষ্টি রোদ চলাচল করছে। আর এখন দ্যাখো, মনে হচ্ছে মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। নাহ, এভাবে শুয়ে থাকা যায় না। কষ্ট বাড়ে তাতে। সে তাই উঠলো, দাঁড়ালো ব্যালকনিতে গিয়ে। এখনো বৃষ্টি ঝরছে। শরীর জুড়ানো হাওয়া বইছে দিক-বেদিক। বৃষ্টি না থাকলে ছাদে গিয়ে হেঁটে আসা যেতো, এখন রাতের এই শেষ প্রহরে ভেজার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। বেশ লাগছে এই হাওয়ামুখর বৃষ্টির রাত। প্রশান্তি নেমে আসছে শরীরে-মনে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাথাব্যথাও কমে এলো। কিন্ত চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। ঘুমহীন রাত কাটানো খুব কঠিন, আবার কিছু করারও নেই। তার বন্ধু-বান্ধবের অনেকেই নেট-আসক্ত হয়ে পড়েছে, প্রায় সারারাত জেগে নেটবাজি করে। তার ভালো লাগে না। এমনকি ফেসবুকের মতো উত্তেজনাময় সামাজিক মাধ্যমও তাকে টানে না। একটা অ্যাকাউন্ট আছে বটে, কিন্তু সেখানে ছ-মাসেও একটা পোস্ট দিতে ইচ্ছে করে না। এখন মনে হচ্ছে, আসক্তি থাকলে মন্দ হতো না, সময়টা কেটে যেতো। বৃষ্টিটা বেশ জোরদার হলো হঠাৎ করেই, আবার তার মনে পড়লো – বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ^াস। এতো সুন্দর সেই গল্পটা! ফের পড়তে ইচ্ছে করছে কিন্তু উঠে গিয়ে বইটা আনার মতো উদ্যম পাচ্ছে না। ‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো।’ – কী অপূর্ব শুরু গল্পটার। নাহ, বসে না থেকে বইটা নিয়ে আসা যাক। নিচে যেতে হবে। ওখানেই সব 888sport free bet login। সবাই ঘুমাচ্ছে, বাসাটা নিঝুম, সে সন্তর্পণে নিচে নামলো, আলমিরাগুলোর কাছে গিয়ে হাত বুলাতে লাগলো বইগুলোতে। প্রায় সবই বাবার সংগ্রহ, তার অল্পই। সংগ্রহের অভ্যাসটা ধরে রাখতে পারেনি সে, পড়ার অভ্যাসও আর আগের মতো নেই। বইগুলোর শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে সে বাবার গন্ধ পাচ্ছিল। বইটা খুঁজে পাওয়া গেল সহজেই। প্রথম গল্পই ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’।
‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তায় রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে ‘তাড়াতাড়ি করো বাহে, 888sport appর গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।’ আমার জানালায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারই জন্যে তৈরি এরকম লোনলি-লগ্ন আমি কতদিন পাইনি, কতকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এসব রাতে আমার ঘুম আসে না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস। এইসব রাতে কিছু পড়তে পারি না আমি, সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্তকাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের। চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়। ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলছে ভিজে আলো, আর চিনচিন করে ওঠে হঠাৎ, কতদিন আগে ভরা বাদলে আশিকের সঙ্গে আজিমপুর থেকে ফিরলাম সাতটা রবীন্দ্রসংগীত শুনে, ‘তুই ফেলে এসছিস কারে’, সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে। আমার ঘুম আসে না, আলোর মধ্যে একলা জেগে রই।’
একেবারে বুঁদ হয়ে যেতে হয়। কিন্তু পড়তে পড়তে সে থেমে গেল একটি লাইনে এসে – ‘আম্মার ঘরে কি যেন ফেলে এসেছি।’ গল্পের পুরোটা জুড়েই ওই ‘কী যেন ফেলে এসেছি।’
আম্মার ঘরে কী ফেলে আসে মানুষ? তার শৈশব? সারল্য? মমতা? অভিমান? ঋভু কী ফেলে এসেছে? গল্পটা আর শেষ করতে পারলো না ঋভু। বইটা হাতে নিয়েই মায়ের ঘরে এলো সে। অবশ্য শুধু মায়ের ঘর বললে ভুল হয়, বাবার ঘরও তো বটে। দুজন তো এক ঘরেই থাকতেন। বাবার মৃত্যুর পর অবশ্য অনেকগুলো দিন একাই থাকতে হয়েছে মাকে। ঘরটা আগের মতোই আছে। ঋভু এই ঘরে কাউকে হাত দিতে দেয়নি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটি চাচিই করেন, কিন্তু যেখানে যা ছিল, সেখানে তা-ই আছে। এ ঘরে কখনো তালা লাগানো হয় না, তবে দরজাটা ভেজানো থাকে। সাবধানে দরজা খুললো ঋভু, বাতি জ¦াললো, আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো ঘরটি। কিন্তু ভেতরে ঢুকলো না সে, দাঁড়িয়ে রইলো দরজায় হেলান দিয়েই। সেই বিছানা, বাবার চেয়ার-টেবিল, টেবিলে এখনো কিছু বই আর মায়ের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র, দুটো বসার চেয়ার, চেয়ারে ঝোলানো ভাঁজ করা জায়নামাজ – যেন এইমাত্র দুজন গেছেন কোথাও, চলে আসবেন কিছুক্ষণের মধ্যে। শূন্য ঘরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে যেন ঘোর লেগে গেল। মনে হলো, ওই তো বাবা শুয়ে আছেন আর মা ঝুঁকে পড়ে কী যেন বলছেন, দুজনের ঠোঁটে খুনসুটির হাসি। আবার দেখলো, মা শুয়ে আছেন একা, অসুস্থ, রিনি ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু তিনি কিছুতেই খাবেন না, তাকিয়ে আছেন দরজার দিকে, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ঋভু নিজেই। শেষের দিকে মা কী যে ছেলেমানুষ হয়ে উঠেছিলেন! সবকিছুতেই মর্জি। ওষুধ খাবেন না, ভাত খাবেন না, গোসল করবেন না, জামা পাল্টাবেন না। রিনি বুঝিয়ে-শুনিয়ে সব করাতো, ঋভুর কোনো অংশগ্রহণই ছিল না। সে সহজে ঢুকতে চাইতো না এই ঘরে, কেবল এসে দাঁড়াতো দরজায়, দাঁড়িয়েই থাকতো, মা ডাকতেন সবসময়, কিন্তু কাছে যেতে পা উঠতো না। কখনো গেলে মা বুকে টেনে নিয়ে আদর করতেন, ওই আদরটুকুই ছিল তার দুঃখপ্রকাশ, তার অনুতাপ-প্রকাশ, তিনি যে ঋভুকে ভুল বুঝেছিলেন সেটি স্বীকার করে নেওয়া। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল, সেই ভুল বোঝাবুঝির দিনগুলোতে ধীরে ধীরে এতোটাই দূরে সরে গিয়েছিল সে যে, আর কাছে ফেরা হয়নি। খারাপ লাগতো তার, বাবার সঙ্গে এমনিতেই একটু দূরত্ব ছিল, ভয় পেতো, বাবাও কখনো স্নেহ প্রকাশ করতেন না; যত-কিছু আহ্লাদ-আবদার তা তো ছিল মায়ের সঙ্গেই। সেই মায়ের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়ার দুঃখ সে বয়ে বেড়াচ্ছে কতকাল ধরে!
কেবল কি মায়ের কাছ থেকেই দূরে চলে গিয়েছিল সে? না, সে আসলে মায়ের কাছ থেকে পালানোর ছলে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল জীবন থেকেই। বাবার ওপর অভিমান হতো খুব। কেন যে তিনি ওই কাজটি করতে গেলেন! কী দরকার ছিল টাকাপয়সা ভাগাভাগি করার নির্দেশনা রেখে যাওয়ার? সে তো চায়নি এমন! সব যদি মায়েরই থাকতো তাহলেই বা কী এমন ক্ষতি হতো? তার থাকা আর মায়ের থাকা তো একই কথা। আলাদা সত্তা তো নয়, সে তো মায়েরই অংশ। এমনকি, তার মনে হয়, বাবা যদি সবকিছু ঋভুর নামেই উইল করে দিয়ে যেতেন তবু মা দুঃখ পেতেন না। একমাত্র ছেলের নামে সব রেখে যাওয়াই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ওই অর্ধেক-অর্ধেক ভাগাভাগি মা মানতেই পারেননি। তবু ভালো এই বাড়িটা ওরকম করে ভাগ করে দিয়ে যাননি, গেলে হয়তো মা এ-বাড়িতে থাকতেনই না।
ব্যাংকে কোটি টাকার ওপরে, এই কথাটি পারভেজের মনেই থাকতো না। অভ্যাসমতো হাতখরচের টাকা মায়ের কাছেই চাইতো, আর মা ঝংকার দিয়ে বলে উঠতেন – ‘তোর কি টাকার অভাব? বাপ না কোটি কোটি টাকা রেখে গেছে! আমার কাছে চাইছিস কেন?’ সে উত্তর দিতে পারতো না। টাকা দিয়ে কী করবে বুঝেও উঠতে পারতো না। তখনো তার ছাত্রজীবন শেষ হয়নি, শেষ পরীক্ষা তখনো বাকি, অথচ সে বিপুল সম্পদের মালিক।
মা যে ঠিক কখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই ভাগাভাগির ব্যাপারটা ঋভুর অজান্তেই ঘটেছে, সে জানে না। কিন্তু পাশ করে বেরুনোর কয়েক বছর পর তাকে বিয়ে করানোর জন্য অস্থির হয়ে গেলেন তিনি। রিনিকে সে বিয়ে করেছিল তাঁরই পছন্দে। রিনিও তার শাশুড়িকে খুব পছন্দ করতো। অভাবনীয় সেবাযত্ন করে বিদায় দিয়েছে সে তার প্রিয় মানুষটিকে। কিন্তু ঋভুর সঙ্গে ঠিক স্বাভাবিক ছিল না সম্পর্কটি। তাদের দাম্পত্যজীবন যেন আর দশটি দম্পতির মতো ছিল না। একটা নীরবতার কাঁটা ছিল দুজনের মধ্যে। ঋভু অনুভব করতো, তার যেন কোনো সংলগ্নতা নেই – একসঙ্গে থাকে তারা, একসঙ্গে খায়-ঘুমায়-বেড়াতে যায়, এমনকি সঙ্গমেও মিলিত হয়, কিন্তু কোথাও যেন থাকে না ঋভু। রিনি নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারতো। মা চলে যাওয়ার পর সেটি আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করা গেল। মাকে নিয়ে যে নিত্যব্যস্ততা তার অবসান ঘটলে রিনি বুঝতেই পারলো না, এই অনিচ্ছুক লোকটির সঙ্গে সে সারাজীবন থাকবে কী করে? সংসার টিকিয়ে রাখতে ঋভু হয়তো ঠিক অনিচ্ছুক ছিল না, কিন্তু উদ্যমীও ছিল না। হয়তো সেজন্যই রিনি ধীরে ধীরে নিজের জন্য অন্য এক জীবন বেছে নিল, জড়িয়ে পড়লো আরেকজনের সঙ্গে, একসময় চলেও গেল এ-বাড়ি ছেড়ে।
ঋভুর আর ভালো লাগছিল না এসব ভাবতে। মায়ের ঘরের বাতি নিভিয়ে, দরজা ভেজিয়ে, ফিরে এলো দোতলার ব্যালকনিতে। ভোর হয়ে এসেছে। বৃষ্টির দাপট কমেনি বলে এখনো রাতের অন্ধকার কাটেনি অবশ্য। ইজিচেয়ারে বসে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ঘুম পেল তার, একসময় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো।
তিন
অংশু বাসা থেকে সাধারণত বেরোয় সকাল দশটার দিকে। নিজের ফার্ম, যাওয়ার তাড়া নেই যদিও, তবু নিয়মটা সে মেনে চলে। অন্য স্টাফরা অবশ্য দশটার আগেই অফিসে ঢোকে। রাতেই ভেবে রেখেছিল, সকালে বেরোবার আগে অবন্তি আর ঋভুর সঙ্গে কথা বলে সন্ধ্যার আড্ডাটা চূড়ান্ত করে ফেলবে। কিন্তু ঋভুকে বহুবার ফোন করেও পাওয়া গেল না বলে সম্ভব হলো না। অবশ্য অবন্তিকে বলে রাখলো, ঋভুকে পাওয়ামাত্রই ওকে জানিয়ে দেওয়া হবে। একটু চিন্তাও হলো। কোনো কারণে ঋভু ফোন রিসিভ করতে না পারলেও মেসেজ দেয় বা পরে কল-ব্যাক করে, আজ তাও করেনি। কাল রাতে একটু বেশিই হয়ে গেছে। অতো রাত পর্যন্ত ঋভুকে বাইরে থাকতে দেওয়া উচিত হয়নি। কয় পেগ খেয়েছে কে জানে! বাসায় ফিরে কী অবস্থা হয়েছে, সেই খবরও জানা নেই। শরীর তো আর আগের মতো অনুমোদন করে না, রাশ টেনে ধরতেই হয়, তারা তা ধরেও, কালই কেবল অন্যরকম হয়ে গেল।
ঋভুর ফোন এলো সাড়ে বারোটার দিকে। অংশু স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ইয়ার্কি করতে গিয়েও নিজেকে সামলালো। মন বলছে, ঋভু ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। ফোন রিসিভ করে স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো – হ্যাঁ, দোস্ত বল।
অনেকবার ফোন করেছিলি, না?
হ্যাঁ। ব্যস্ত ছিলি?
না। এইমাত্র ঘুম থেকে উঠলাম!
মানে? তোর শরীর খারাপ নাকি?
আরে না। রাতে ঘুম আসছিল না। ভোরের দিকে ঘুমিয়েছি, কেউ ডাকেওনি, আমারও ঘুম ভাঙেনি।
কী কাণ্ড! অফিসে যাসনি?
নারে, যাইনি। এইমাত্র সিক-লিভের জন্য একটা মেইল পাঠালাম।
সিক লিভ! তুই ঠিক আছিস তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক আছি।
আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। আসবো আমি?
কোথায় আসবি?
কোথায় আবার, তোর বাসায়!
আরে না। এই অসময়ে বাসায় আসবি কেন?
তোর বাসায় আসার জন্য আবার সময়-অসময় আছে নাকি?
অবশ্যই আছে। কেবল ঘুম থেকে উঠেছি। গোসল করবো, নাস্তা করবো, আলসেমি করবো। অনেকদিন পর আচমকা ছুটি নিয়েছি, এই সুযোগ কদিনই-বা পাই? দুপুরে খেয়ে একটু ভাতঘুম দেওয়ার জন্য আজকেই তো উৎকৃষ্ট দিন। তাছাড়া আবহাওয়াটাও কী প্লিজ্যান্ট, কী আরামদায়ক! তুই এলে পুরোটাই মাটি হয়ে যাবে, বুঝলিরে গাধা!
ঋভুর সতেজ কণ্ঠ আর গালিটা শুনে অংশু একটু স্বস্তি বোধ করলো। হালকা গলায় বললো, ঠিক আছে, আমি না এলাম। অবন্তিকে, মানে তোর সুসানকে যেতে বলি। এরকম ঠান্ডা-ঠান্ডা দিন, জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে থাক।
তুই একটা ইতর। একজন ভদ্রমহিলা সম্পর্কে এসব কথা …
ভদ্রমহিলা আমার বন্ধু, ভুলে যাস না …
একজন ভদ্রলোক সম্বন্ধে …
ভদ্রলোকটি, যদিও কাপুরুষগোছের, তথাপি আমার বন্ধু … আমার যা ইচ্ছে তাই বলতে পারি।
শুয়োর। রাখলাম।
আরে শোন শোন। সন্ধ্যায় কোথায় বসবো?
একটু পরে জানাই দোস্ত?
আচ্ছা।
আজ আর বাইরে যাচ্ছে না ঋভু, বরং ওদেরকেই বাসায় আসতে বলবে, কিন্তু কথাটা বললো না অংশুকে। আজকে আলসেমিতে পেয়েছে, আলস্য করতে ভালো লাগছে। বাইরে যাওয়াই এখন বিরাট হ্যাপা।
ফোন ছেড়ে ঋভু গেল নাস্তার খোঁজে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে নাস্তার আগে গোসল সেরে নেওয়ার অভ্যাস তার, আজ না-হয় একটু অনিয়ম হোক। টেবিলে বসে চাচিকে ডাকলো জোর গলায়, যদিও দরকার ছিল না, নাস্তা সাজানোই আছে টেবিলে, চাচিও কিচেন টু ডাইনিংয়ে যাওয়া-আসার মধ্যে আছেন। মুশকিল হলো, টেবিলে একা বসে খেতে ভালো লাগে না। আজ পর্যন্ত চাচাকে কখনো একসঙ্গে টেবিলে বসানো যায়নি, কিন্তু চাচিকে বললে বসে। চাচার মতো ‘ছোট সাহেব’ সম্বোধন করে তাকে বিব্রতও করেন না। একটা মা-মা ব্যাপার আছে তাঁর মধ্যে। খুবই শান্ত মেজাজের মানুষ, চুপচাপ থাকেন, কথা বলেন মৃদুস্বরে, হাসেন দারুণ মিষ্টি করে। ঋভু বললো – এখানে এসে বসো তো চাচি।
চায়ের জন্য পানিটা বসিয়ে আসি?
না, আগে এসো।
তিনি এলেন, বসলেন, খাবার তুলে দিলেন ঋভুর পাতে। বেশি খাওয়ার ইচ্ছে অবশ্য নেই। বেলা একটার সময় কি নাস্তা খাওয়া যায়? এখন তো লাঞ্চের সময়। হোক, আজ একটু অনিয়ম হোক। ঋভু বললো – সন্ধ্যায় অংশু আর অবন্তি আসবে। ওই একটু হইহুল্লোড় করা আর কি! অবন্তিকে তোমার মনে আছে চাচি?
হ্যাঁ, আছে।
অনেকদিন পর দেশে এসেছে। ও যে বিদেশে চলে গিয়েছিল তোমাকে বলেছিলাম না?
বুবু বলেছিলেন।
বুবু মানে মা, ঋভু বুঝলো। মা তাহলে জানতেন, অবন্তির খোঁজ রাখতেন! সে তো বলেনি কোনোদিন, তাহলে কার কাছ থেকে খোঁজ পেতো মা? অংশু নাকি অন্য কোনো বন্ধু? উঁহু, মায়ের সঙ্গে ঋভুর কোনো বন্ধুর সম্পর্কই এতোটা সহজ ছিল না। সত্যি বলতে কি, মায়ের এতো দ্রুত মুড সুইং হতো তখন যে, তাকে ভয় পেতো প্রায় সবাই, এমনকি অবন্তিও। ওরা তো কখনো মায়ের কোমল-মায়াময়-অসহায় রূপটি দেখেনি, হয়তো সেজন্যই সেই রুদ্র রূপটি মাথায় গেঁথে আছে।
ওরা রাতে এখানে খাবে। আজকে ডিনারের মেন্যু কী? – ঋভু জানতে চাইলো।
এখনো ঠিক করি নাই। উনারা কী পছন্দ করেন জানলে …
তা তো আমিও জানি না। এক কাজ করো চাচি। মায়ের স্পেশাল কোনো রেসিপি রাঁধো।
আমি কি আর বুবুর মতো রানতে পারি?
তুমি তোমার মতোই রাঁধো।
আচ্ছা।
আর শোনো, নাস্তা করতে তো অনেক দেরি হয়ে গেল, লাঞ্চ আর করবো না।
এতোদিন পর বাসায় আছো, আমি তো রান্না করে ফেলছি।
অ! ঠিক আছে একটু দেরি করে খাবো। সন্ধ্যায় ওদেরকে কী নাস্তা দেবে একটু ভেবে রেখো। এখন আমাকে মগ ভর্তি করে চা দাও।
বেডরুমে গেল সে এবার। ভোরবেলায় ব্যালকনিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ঋভু, ইজিচেয়ারে শুয়ে। আশ্চর্য, এতো গভীর ঘুম! এমনিতে একটু শব্দ বা আলোতেই ঘুম ভেঙে যায় আর আজকে বারান্দার আড়ালহীন আলোতে, গাছে গাছে পাখির শব্দে, বাইরে ফেরিওয়ালার ডাকেও ঘুম ভাঙলো না তার! প্রায় সাত ঘণ্টা টানা ঘুমিয়েছে। আরো ঘুমাতো বোধহয়, কিন্তু স্বপ্নটা ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। একটা ছোট্ট মেয়ে, নয়-দশ বছর বয়স, পানিতে ডুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে, তার হাত দুটো ওপরে তোলা, যখন ভেসে উঠছে তখন সেই হাত নেড়ে চিৎকার করে ডাকছে – ভাইয়া, ভাইয়া, ভাইয়া …। এই স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে। কেন দেখে বোঝে না। নীতু, তার একমাত্র ছোট বোন, মারা গিয়েছিল ওই বয়সেই, কিন্তু পানিতে ডুবে নয়। কী একটা অসুখ হয়েছিল, দেশের চিকিৎসকরা বলেছিলেন বাইরে কোথাও নিয়ে যেতে, বাবা সবাইকে নিয়েই থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন, সেখানেই মারা যায় নীতু, হাসপাতালের শুভ্র বিছানায় শুয়ে। ঋভু তখন বারো বছর বয়সের কিশোর, সব মনে আছে। পানিতে ডুবে যাওয়ার কোনো ব্যাপারই ছিল না। তবু সে এই স্বপ্ন দেখে কেন? যাকে দেখে সে কি নীতুই? মেয়েটা কি ঋভুকেই ডাকে নাকি অন্য কাউকে? স্বপ্নটা যেদিন দেখে সে, সারাদিন মন খারাপ হয়ে থাকে। সময় কাটে কেমন এক আচ্ছন্নতার ভেতরে। আজো কি সেরকম কোনো দিন? চোখ মেলে প্রথমে বুঝতেই পারেনি ঋভু, সে কোথায়! কটা বাজে দেখার জন্য ঘড়ি-মোবাইল খুঁজে দেখে কোনোটাই নেই। তখন মনে পড়ে, রাতে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল আর ফেরেনি রুমে। ভেতরে ঢুকে দেখে বারোটা বেজে দশ! কী লজ্জার ব্যাপার! অফিসে যাওয়া তো হলোই না, এমনকি একটা ছোট্ট মেইলও করা হয়নি যে সে যেতে পারবে না। তার অবশ্য সে-কথা মনেই হয়নি। অফিসে না যাওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না। যা হোক, চট করে একটা এসএমএস করলো বসকে, জানালো, শরীর ভালো নেই, আজকে আসতে পারছি না। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো – ‘নো প্রবলেম। টেক কেয়ার, টেক রেস্ট।’ তারপরই ফোন করলো অংশুর কাছে। বেচারা বোধহয় সকাল থেকে খুঁজছে, অনেকগুলো মিসড কল হয়ে আছে।
কথাটথা বলে, নাস্তা সেরে, মগভর্তি চা নিয়ে নিজের ঘরে এলো ঋভু। আবার স্বপ্নটার কথা মনে পড়লো তার, আবার সেই আচ্ছন্নতা। আচ্ছা, নীতু যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে কি আমার জীবন অন্যরকম হতো? ভাবলো ঋভু। বাবা তখন সম্পত্তি ভাগ করতেন কীভাবে? নাকি আদৌ করতেন না? মায়ের সঙ্গে ঋভুর সেই বিশ^াসহীনতা আর সংকটের সময় নীতু কী করতো? নিশ্চয়ই দুপক্ষের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন হিসেবে থাকতো ও? নিশ্চয়ই দূরত্বটা তৈরি হতে দিতো না! কিংবা মায়ের মৃত্যুর পর ঋভু আর রিনির সেই নীরব সম্পর্কের সময় ও থাকতো সরব হয়ে, হয়তো ওর জন্যই সম্পর্কটাও স্বাভাবিক থাকতো, রিনিকে চলে যেতে হতো না। কিংবা এই নিঃসঙ্গ সময়ে নিশ্চয়ই ও পাশে এসে বসতো, কান্নাকাটি করতো, সেও দায়িত্ববশতই নীতুর খোঁজখবর নিতো। বোনেরা তো মায়ের ছায়া, ও থাকলে জীবন নিশ্চয়ই এরকম হতো না। তাহলে কি তাকে চিরকালের জন্য নিঃসঙ্গ করে দেওয়ার জন্যই নীতু চলে গিয়েছিল?
নাহ, এসব ভাবতে ভালো লাগছে না। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তারচেয়ে অন্য কিছু করা যাক। কিন্তু কী-ইবা করা যায়? তার তো কোনো কাজ নেই। তার সারাজীবনই ‘কর্মহীন পূর্ণ অবকাশ’! চিরকাল অবসর। এতো অবকাশ, এতো অবসর সে পারই করে আসতে পারছে না। কী করবো এখন, কী করবো ভাবতে ভাবতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ল্যাপটপটা টেনে নিল ঋভু। একটু মেইল চেক করা যাক। প্রতিদিনের অভ্যাস। হঠাৎ করে তো পাল্টানো যায় না। এবং মেইল বক্স খুলে প্রথমেই চোখে পড়লো সেই মেয়েটির ছোট্ট আরেকটি চিঠি – ‘তুমি যদি পারভেজ হও, প্লিজ সাড়া দাও। না হলেও জানাও। খুব জরুরি। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’ কালকের মতোই নাম লিখেছে ‘লুসিয়া’। এরকম একটা চিঠি যে সে পেয়েছিল, কিছু একটা উত্তর দিতে চেয়েছিল, তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল ঋভু। মেয়েটা যে-ই হোক, তার যে পারভেজ নামক কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সত্যিই খুব দরকার, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। এবার তাই আর আলসেমি করলো না সে। লিখলো, ‘আমার নাম পারভেজ, কিন্তু আপনি যাকে খুঁজছেন সেই পারভেজ কি না বুঝতে পারছি না। আমি লুসিয়া নামের কাউকে চিনি না। ধন্যবাদ।’ ওপাশ থেকে উত্তর এলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ‘আমার নাম লুসিয়া আরিয়ানা জিওভান্নি। ইতালি থেকে লিখছি। তুমি কি 888sport appsের পারভেজ মাহমুদ?’ এবার চিনে ফেললো পারভেজ। আরিয়ানা! এতোদিন পর সেই আরিয়ানা। নামটা লুসিয়া লিখছিল বলে বুঝতে পারেনি। ঋভু তাকে কখনো লুসিয়া বলে ডাকেওনি, ডেকেছে আরিয়ানা বলে, এই নামটিই ভালো লাগতো কি না! লুসিয়াও তাকে ডাকেনি ঋভু বলে। কে যে কাকে নামের কোন অংশ ধরে ডাকবে, তার কোনো নিয়ম কি আছে কোথাও!
ঋভু সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো – তুমি আরিয়ানা! আরিয়ানা! কী আশ্চর্য! আমার ঠিকানা কোথায় পেলে তুমি?
এবার মেইল ছেড়ে চ্যাটবক্সে এলো আরিয়ানা – সে অনেক গল্প। তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো, কী যে আনন্দ হচ্ছে! থ্যাংকস গড!
তোমাকে চিনবো না! তাই হয় নাকি?
কাল তো মেইলের উত্তরও দাওনি!
তখন চিনতে পারিনি।
আজকেও পারোনি।
হ্যাঁ, শুরুতে পারিনি। লুসিয়া নামটা ভুলে গিয়েছিলাম।
আমারই ভুল হয়েছে। তুমি তো আমাকে আরিয়ানা বলেই ডাকতে!
মনে আছে তাহলে!
মনে না থাকলে তোমাকে খুঁজে বের করি?
হুম। কীভাবে বের করলে ভেবে অবাক হচ্ছি।
বলবো বলবো, সব বলবো। তুমি কেমন আছো?
এই মুহূর্তে ভালো আছি। তুমি?
এই মুহূর্তে! তার মানে সবসময় ভালো থাকো না!
তার মানে হলো – যতক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকি ততক্ষণ ভালো থাকি!
থাক, আর বলো না। আমি এমনিতেই পাগল হয়ে আছি।
এখনো? পাগল তো হয়েছিলে বহুকাল আগে।
হ্যাঁ, এখনো।
তুমি কেমন আছো, বললে না তো?
এই মুহূর্তে নাচছি!
ইস্! মিস হয়ে গেল!
কী? কী মিস হলো!
তোমার নাচ! দেখা হলো না।
তাও দেখবে। বলেছি না, 888sport appsে আসছি!
ও হ্যাঁ, কালকে লিখেছিলে। সত্যিই আসছো নাকি?
সত্যিই আসছি। তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, মনে আছে?
হ্যাঁ আছে। বলেছিলে, জীবনে একবার হলেও 888sport appsে আসবে।
তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে, একবার হলেও ইতালিতে আসবে!
হয়ে ওঠেনি! সরি!
নাথিং টু বি সরি। আমি আসছি, এরপর তুমি আসবে।
কবে আসছো?
তারিখটা চূড়ান্ত করিনি। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ফাইনাল করবো ভেবে রেখেছিলাম। কখন এলে তোমাকে ফ্রি পাওয়া যাবে বলো তো!
ঋভু এক মুহূর্ত ভাবলো। অবন্তি দু-সপ্তাহ থাকবে। একই সময়ে আরিয়ানা আসুক তা সে চায় না। দুজনকে সময় সে দিতে পারবে না। তাই বললো – এ-মাসটা একটু ব্যস্ত। আগামী মাসের যেকোনো সময়ে এসো।
আচ্ছা। আমি তাহলে তারিখ ফাইনাল করে তোমাকে জানাবো।
জানিয়ো। সম্ভব হলে আমি ওই সময় ছুটি নেবো।
খুব ভালো হবে। এবার তোমার ফোন নাম্বারটা দাও। আর এইটা আমার নাম্বার : +৩৯৩২ …
আমার নাম্বার : +৮৮০১ …
ঠিক আছে। এখন নিশ্চয়ই তুমি অফিসে, পরে কথা হবে।
হ্যাঁ, কথা হবে। ভালো থেকো।
তুমিও ভালো থেকো।
কথাবার্তা শেষ করে ঋভু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এটা কীরকম ব্যাপার হলো? হঠাৎ করে আরিয়ানার আবির্ভাব হলো কীভাবে? তাও এমন এক সময়ে যখন অবন্তি ফিরে এসেছে বহুকাল পর! এ কোন ধরনের কাকতাল? প্রায় কুড়ি বছর আগেও এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল। অবন্তির সঙ্গে তখন এক নীরব টানাপড়েন চলছে। নীরব, কারণ, দুজনের কেউই কাউকে কিছু বলছে না, যদিও তখন কোনো একটা মীমাংসায় পৌঁছনোর কথা।
হয়তো মীমাংসা হয়েও যেতো, কিন্তু মায়ের সঙ্গে ঋভুর সম্পর্ক তখন ভীষণ দোদুল্যমান। বাবার ওই সম্পত্তিভাগকাণ্ডের পর মা যেন ছেলেকে বিশ^াসই করতে পারছেন না। ঋভু প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মাকে বোঝাতে, হঠাৎ পেয়ে যাওয়া টাকাপয়সা সব মায়ের হাতে তুলে দিতে চাইছে, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। ঋভু বুঝতে পারছে, সমস্যাটা টাকাপয়সার নয়, মায়ের প্রতি বাবার আস্থাহীনতাই তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। একদিন তো মা বলেই বসলেন – ‘তোর বাবা আমাকে বিশ^াস করেননি, কিন্তু আমি তো তাকে করেছি। আমার ব্যাংকেও তো কম টাকা নেই। তোর নানার সম্পত্তির অংশ থেকে যা পেয়েছি তা তোর বাবার চেয়ে কম নয়। কিন্তু আমি তো তাকেই নমিনি করে রেখেছি। একবারও তো ভাবিনি, আমি আগে মারা গেলে তোর বাবা আরেকটা বিয়ে করবে, এই টাকা দিয়ে ফুর্তি করবে, তোকে একটা পয়সাও দেবে না! আমার মনে যদি এইসব প্রশ্ন না এসে থাকে, তার মনে এলো কেন?’
এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাধ্য ঋভুর ছিল না। বাবা কেন এমন করেছেন তা তো জানতো না সে। ছোটবেলা থেকে মা-বাবার মধুর সম্পর্কই দেখেছে ঋভু, এমনকি কোনোদিন ঝগড়াঝাঁটিও হতে দেখেনি। মৃত্যুর পর কি না দুজনে এক অদ্ভুত ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছে! এই সমস্যার সমাধান সে কীভাবে করবে? আর মায়ের সঙ্গে এমন জটিল দ্বন্দ্ব চলতে থাকলে সে অবন্তির সঙ্গেই বা মীমাংসায় পৌঁছায় কীভাবে? মাকে তো অন্তত জানাতে হবে। ঋভুর কোনো কাজেই মায়ের এখন যেন কোনো আগ্রহ নেই। কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, বাসায় সময়মতো ফিরছে কি না, কিংবা আদৌ ফিরলো কি না, ঠিকমতো খেলো কি না, কিংবা আদৌ খেলো কি না, কোনোকিছুরই খোঁজ রাখছেন না। কিছুজজ্ঞেস করলে বলেন, ‘তোর যা ইচ্ছে তাই কর। আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?’ এই অবস্থায় কি অবন্তির কথা বলা যায়? বললে যদি একই উত্তর আসে, কী করবে সে?
এরকমই একটা সময়ে সে সিদ্ধান্ত নিলো, মায়ের কাছে আর থাকবেই না। কিন্তু ভাবলেই তো হয় না, যাবেই-বা কোথায়? দেশের যেখানেই যাক, দু-চারদিন পর ফিরতে হবেই। তাহলে কি বিদেশে চলে যাবে? হ্যাঁ, তা করা যায়। টাকাপয়সার সমস্যা যেহেতু নেই, বিদেশে যেতে বাধাও নেই। এতোদিন পর্যন্ত সে প্রায় কিছুই খরচ করেনি, প্রয়োজনই হয়নি খরচ করার, ফলে পুরোটাই রয়ে গেছে। এই টাকা রেখে সে করবে কী? তারচেয়ে উড়িয়ে দেওয়া ভালো। পরে যা হওয়ার হবে। কারো মাথায় যদি দেশ ছাড়ার ভূত চাপে, তাহলে তা যে স্থায়ী হয়ে যায়, সে সেবার বুঝেছিল। পুরনো পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। নীতুকে নিয়ে থাইল্যান্ড যাওয়ার ঘটনা তো এক যুগ আগের, তারপর আর কোথাও যাওয়া হয়নি। নতুন করে পাসপোর্ট তৈরি করলো সে, ট্র্যাভেল এজেন্সিতে গিয়ে নানান দেশে যাওয়ার সম্ভাব্যপরতা নিয়ে খোঁজখবর করতে লাগলো, ভিসা পাওয়ার কায়দাকানুন সম্বন্ধে জানতে শুরু করলো ইত্যাদি। মন ঠিক করে ফেলেছে সে, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনে হতে লাগলো, মাকে ছাড়া থাকতে পারবে তো? তাছাড়া, সামনেই মাস্টার্স পরীক্ষা, এই সময় চলে গেলে পড়াশোনাটা আর হবে না। দোটানায় পড়লো সে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো কয়েকদিন। তারপর ভাবলো কাছেপিঠের কোনো দেশে গিয়ে কয়েকদিনের জন্য ঘুরে আসা যাক। ভারত বা ভুটান বা নেপাল। নেপালকেই বেছে নিল সে, ভিসার জটিলতা নেই বলে। ট্র্যাভেল এজেন্সিতে গিয়ে বিমানের টিকিট কাটলো, কাঠমান্ডুর একটা হোটেলে রুম বুকিং দিলো, পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করে নিল, ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে ডলার কিনলো – মানে, যা যা দরকার সবই করলো। পুরো কাজটাই সে করলো গোপনে, একা একা। মাকে তো বললোই না, এমনকি জানলো না কোনো বন্ধুও। অংশু, অবন্তি, জামিল কেউই জানলো না কী করতে যাচ্ছে ঋভু।
যাওয়ার আগের রাতে মাকে কেবল বললো – মা, আমি কালকে দেশের বাইরে যাচ্ছি।
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে, এই প্রথম বোধহয় বলতে ভুলে গেলেন – যা ইচ্ছে তাই কর!
পরদিন মায়ের সামনে দিয়েই ‘আসি মা’ বলে বেরিয়ে গেল ঋভু।
না, কোনো অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ছিল না ঋভুর মনে। ছিল অপার বেদনা। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর মাকে আঁকড়ে ধরেছিল সে পরম নির্ভরতায়। ভেবেছিল, এভাবেই আঁকড়ে ধরে থাকবে সারাজীবন। মাকে ছেড়ে কোনোদিন কোথাও যাবে না, মাকেও একা থাকতে দেবে না, সে নিজেও একা থাকবে না। আর যাবেই বা কেন, মা ছাড়া তার আছেই বা কে? অথচ সেই মা-ই এখন অচেনা হয়ে গেছে। কেবল নিজের দিকটা দেখছে সে, বাবা তার ওপর কেন আস্থা রাখতে পারেনি সেই প্রশ্নে, বেদনায়, অপমানে মূহ্যমান। একবারও ভাবছে না, সেই একই অপমান সে করে চলেছে নিজের সন্তানকে, অবিশ^াস করে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে, কোনো পরিবর্তনই আসছে না তার। কেন থাকবে সে মায়ের কাছে? এসব ভাবতে ভাবতে সে এতোই কাতর হয়ে পড়েছিল যে, এক ঘণ্টার স্বল্প সময়ের 888sport slot gameে সে কেবল কেঁদেই চলছিল।
কাঠমান্ডু গিয়েও সে গুম হয়ে বসেছিল, কিছুই স্পর্শ করছিল না তাকে। প্রথম তিনদিন সে হোটেল থেকেই বেরোয়নি। খাওয়া-দাওয়ার জন্য ক্যাফেটেরিয়ায় এসেছে; কিন্তু বাকি সময় রুমে। চতুর্থ দিন একজন অচেনা লোক এসে বললো – আমি কি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
হ্যাঁ, পারেন।
আমার নাম অমৃত।
আচ্ছা। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। আমি ঋভু। বলুন কী বলবেন।
কিছু মনে করবেন না প্লিজ। কয়েকদিন ধরে আপনি এসেছেন কিন্তু একদিনও বাইরে যাননি …
অমৃতকে থামিয়ে দিয়ে ঋভু বললো – কোথায় যাবো?
দেখার মতো অনেক কিছু আছে এখানে …
আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না। তারচেয়ে বড়ো কথা, ভিড়ের মধ্যে যেতে ইচ্ছে করছে না।
আচ্ছা, বুঝলাম। আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?
888sport apps।
888sport app?
হ্যাঁ।
তাহলে কাঠমান্ডু আপনার ভালো লাগবে না। দুটোই ভিড়ের শহর।
আপনি 888sport appয় গিয়েছেন?
হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কিন্তু 888sport app আমার ভালো লাগেনি। ভালো লেগেছে বরিশাল।
আপনি বরিশালও গিয়েছেন?
হ্যাঁ, 888sport appsের এক বন্ধুর পরামর্শে গিয়েছিলাম। খুব ভালো লেগেছিল। এতো সুন্দর জায়গা আমি আর কখনো দেখিনি।
ঋভু এক মুহূর্ত ভাবলো, অমৃতের যে বন্ধু তাকে বরিশাল যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি নিশ্চয়ই ভাবুক প্রকৃতির মানুষ, কিংবা হয়তো কবি। নইলে কক্সবাজার বা রাঙামাটির মতো ট্যুরিস্ট স্পট থাকতে বরিশালের কথা বলবেন কেন?
আপনাকে একটা কথা বলি। – অমৃত আগের কথার রেশ ধরে বললো।
হ্যাঁ, বলুন।
আপনি পোখারা থেকে ঘুরে আসুন।
পোখারা কি বরিশালের মতো?
না। পোখারা পোখারার মতো। তবে বরিশালের সঙ্গে একটা মিল আছে।
কী সেটা?
বরিশালে গেলে যেমন মন শান্ত হয়, শান্তি শান্তি লাগে, পোখারায় গেলেও ওরকম লাগে। আপনার ভালো লাগবে, আমি নিশ্চিত।
ধন্যবাদ।
ঋভু পোখারার ব্যাপারে কিছুই জানতো না, নামও শোনেনি কোনোদিন, কীভাবে যেতে হয় তাও জানতো না। তবু ভাবছিল, ওখান থেকে ঘুরে আসা যাক।
যাবেন? – অমৃত আবার জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ যাবো। কিন্তু কীভাবে যেতে হয়?
ওসব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। সকালে এখান থেকে ট্যুরিস্ট বাস ছাড়ে। ভোরে উঠে ব্রেকফাস্ট করে নেবেন কিংবা পথেও করতে পারেন। রিসেপশনে আপনার জন্য বাসের টিকিট থাকবে। পোখারায় আপনার জন্য হোটেলও বুক করা থাকবে।
কিন্তু আপনি কে বলুন তো! আমার জন্য এতো কিছু করতে চাইছেন কেন?
আমি একজন ট্যুরিস্ট গাইড। নিজের দেশটাকে সবাইকে দেখাতে ভালো লাগে। আপনি আসার পর থেকে বেরোননি। মন খারাপ করে বসে আছেন। হয়তো মন খারাপ নিয়েই চলে যাবেন। এটা ভাবতে ভালো লাগছে না।
থ্যাংক ইউ।
ওয়েলকাম। আপনার জন্য আমি তেমন বেশি কিছু করছি না। এটা আমার পেশা, সেজন্য এটুকু করা আমার জন্য সহজ। গিয়ে ঘুরে আসুন, ভালো না লাগলে টিকিটের টাকা ফেরত দেবো।
ঋভু হেসে ফেললো। বললো, না, টাকা ফেরত দিতে হবে না। ভালো না লাগলেও আপত্তি নেই। আমি আসলে বেড়াতে আসিনি …
বলতে গিয়েও থেমে গেল ঋভু। অচেনা মানুষকে তো আর পারিবারিক সংকটের কথা বলা যায় না! একটু চুপ করে থেকে ফের বললো, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। পোখারা থেকে এসে আপনার সঙ্গে কাঠমান্ডু দেখবো।
নিশ্চয়ই। আপনি দেখতে চাইলে আমি নিজে ঘুরিয়ে দেখাবো।
অমৃতের অযাচিত পরামর্শ মেনে পোখারায় গিয়ে ঋভু দেখা পেয়েছিল দুই অলৌকিকের। অন্নপূর্ণায় অলীক সূর্যোদয় আর আরিয়ানা। অদ্ভুত সুন্দর সময় কেটেছিল আরিয়ানার সঙ্গে, যদিও পরিচয়টা নিছকই কাকতালীয়। কেবল অদ্ভুত বললে ভুল হয়, উদ্দাম সময়ও বটে। তার ওই বয়স পর্যন্ত এমন রঙিন সময় আর কাটেনি কখনো। তারপরও কি কখনো আর এসেছে তেমন দিন? আরিয়ানা তাকে সব অর্থেই পূর্ণ করেছিল, যদিও তা ছিল মাত্রই এক সপ্তাহের জন্য। প্রেমে, আনন্দে, খুনসুটিতে আর শরীরের অদম্য আগুনকে প্রশমিত করে দিয়েছিল সে তীব্র ভালোবাসায়। তখন ঋভু চব্বিশ বছরের তরুণ আর আরিয়ানা কুড়ি বছরের তরুণী। উদ্দাম প্রেমের জন্য এরচেয়ে উৎকৃষ্ট বয়স আর কী হতে পারে? কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা কি ঋভুর সর্বনাশও করেনি? নইলে কেন সে আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারলো না? এমনকি বিবাহিত জীবনেও কেন সে এমন উদাসীন হয়ে রইলো? সে কি রিনির ভেতরে নিজের অজান্তেই আরিয়ানাকে খুঁজেছে? তাই কি কখনো হয়? একজন মানুষকে কখনো অন্য মানুষ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় না, ঋভু তা জানে।
নিবিড়ভাবে এইসব ভাবছিল ঋভু। ফোনের শব্দে ঘোর ভাঙলো। ওপাশে যথারীতি অংশু – কিরে, তুই তো কিছু জানালি না?
কী জানাবো?
মানে?
মানে, কী জানতে চাস!
ও মা! সন্ধ্যায় কোথায় দেখা হচ্ছে, সেটা না তোর জানানোর কথা!
ও! জানাইনি তোকে, না? বাসায় আয় আজকে।
বাসায়?
হ্যাঁ। আজকে আমার বাসাতেই আড্ডা হোক।
একেবারে প্রথমদিনেই অবন্তিকে বাসায় নিয়ে তুলবি? – অংশু খোঁচা দিতে ছাড়লো না।
এটা অবন্তিরও বাসা হতে পারতো, ভুলে যাচ্ছো কেন বাছা!
ভুলে যাইনি। বরং এও মনে রেখেছি, ভবিষ্যতেও তা হতে পারে।
এতো আগাম কিছু ভাবিস না। সন্ধ্যায় আয়।
আচ্ছা ঠিক আছে। অবন্তিকে কি তুই বলবি?
না। তুই নিয়ে আসিস। আগে থেকে কিছু বলিস না। একটা সারপ্রাইজ থাকুক ওর জন্য।
ঠিক হ্যায়, তাই হবে।
চার
অবন্তি সত্যিই অবাক হলো। কালকেও যেমন জিজ্ঞেস করেনি কোথায় আড্ডা হবে, আজকেও করেনি। ওরা যে কোথায় আড্ডা দেয় তা তো আর জানে না সে। কুড়ি বছর আগে এই শহর ছেড়ে গেছে, তারপর কতকিছু বদলে গেছে, তার কিছুই সে চেনে না। কিন্তু তাই বলে একেবারে ঋভুর বাসায় এনে হাজির করবে অংশু, তাও ভাবেনি।
অনেকদিন আগে এই বাড়িতে একবার এসেছিল অবন্তি। আরো কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। তখন এটার চেহারাও অন্যরকম ছিল। একটা পুরনো ঢঙের ছিমছাম একতলা বাড়ি ছিল। এখন দোতলা, তাও দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন। এখনো অবশ্য অনেকখানি খালি জায়গা পড়ে আছে চারপাশে, বাগানটাও আছে, বেশ যত্নেই, যেমনটি ছিল আগে।
ঋভু দাঁড়িয়ে ছিল দোতলার ব্যালকনিতে, জহিরের গাড়ি থামতে দেখে নিচে নেমে এলো। গাড়ি ভেতরে এলো, অবন্তি নামলো, চারদিকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো, সেই বিস্ময়টা দেখতে ভালো লাগছিল ঋভুর। মনের ভেতরে গুনগুনিয়ে উঠছিল ‘তুমি এলে, অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’ কিংবা ‘তুমি এসেছ বহুদিন পর, আমি কাঁদলাম’ গোছের গানের কলি। তার হয়তো এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, বাসাটা যেহেতু তার, এই সৌজন্যটুকু তো করাই উচিত, কিন্তু সে দাঁড়িয়েই রইলো। অংশু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে অবন্তিকে, কী যেন বলছেও হাত নাড়িয়ে, সম্ভবত এই বাড়ি নিয়েই কোনো কথা, অবন্তি শুনছেও মন দিয়ে। লন পেরিয়ে বাগানেও একটু ঘুরে এলো ওরা দুজন, তারপর মোড় ঘুরতেই ঋভুর সঙ্গে চোখাচোখি হলো। হাসলো অবন্তি, ঋভু বললো – গান গাইতে জানলে ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো’ গেয়ে শোনাতাম।
না জানলেও গাইতে পারো। আমার আপত্তি নেই।
না থাক। এতো সুন্দর গানটার ইমেজ নষ্ট করতে চাই না। চলো ভেতরে।
বাড়ি তো একবারে বদলে ফেলেছো দেখছি।
সবই অংশুর কৃতিত্ব।
মানে? অংশুর ডিজাইন নাকি?
হ্যাঁ। ও ছাড়া আর কে করবে এতো যত্ন করে! বলেনি তোমাকে?
না তো! এতক্ষণ ধরে এতো কথা বললো …
ভেতরে চলো। আরো মুগ্ধ হবে।
নিচতলার খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি, দেখলো অবন্তি। কিন্তু ভেতরের দিকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলার যাওয়ার পথটা নতুন। মানে একতলাটা অক্ষুণ্ন রেখে ডুপ্লেক্স করা হয়েছে। দোতলায় গিয়ে সত্যিই চমৎকৃত হলো অবন্তি। এতো খোলামেলা, এতো স্পেস, এতো আলো-বাতাস! অবন্তি বললো – তোর কাজের প্রশংসা বিদেশে বসেও শুনেছি অংশু, এই প্রথম নিজের চোখে দেখলাম।
এখানে আমার তো তেমন কিছু করার ছিল না। ঋভু একতলাটা ভাঙতে দিলো না। ওটাকে ঠিক রেখে দোতলার ডিজাইন করতে হলো। ঠিক মনমতো কাজ করতে পারিনি।
মনমতো পারিসনি, তাতেই এতোখানি!
হয়েছে হয়েছে। আমার কাজ দেখার সুযোগ আরো পাবি। তখন বলিস।
কোথায় বসবি? রুমে নাকি ব্যালকনিতে? – ঋভু জানতে চাইলো।
ব্যালকনিতেই বসি। আবহাওয়াটা সুন্দর। রুমের ভেতরে বসে মিস করতে চাই না।
আচ্ছা, তোরা গিয়ে বস, আমি আসছি।
ঋভু একটু আড়াল হতেই অংশু ফিসফিসিয়ে অবন্তিকে বললো – তোর পছন্দ হয়েছে বাড়িটা?
হ্যাঁ, খুব পছন্দ হয়েছে।
যাক বেঁচে গেলাম। খুব টেনশনে ছিলাম।
কেন?
তোর পছন্দ হয় কি না ভেবে …
আমার পছন্দ-অপছন্দ এতো জরুরি হয়ে উঠলো কবে থেকে তোর কাছে?
না মানে, এই বাড়িতে যদি থাকতে চাস …
তোর মতলবটা কী শুনি?
মতলব আবার কী? তোর ইচ্ছে করতে পারে না?
মানে কী?
ধর তোর ইচ্ছে করলো, আর ফিরে যাবি না। এই বাড়িতেই থেকে যাবি।
এইসব বদমায়েশি চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরছিস, না?
না, মানে বললাম আর কি! কত কিছুই তো হতে পারে।
শোন তোকে একটা কথা বলি …
কিন্তু কথাটা আর বলা হলো না, ঋভু এলো ঠিক সেই মুহূর্তেই। পেছনে পানাহারের সরঞ্জাম নিয়ে করিম। অভ্যস্ত হাতে টেবিল সাজিয়ে দিয়ে গেল সে। এসব কাজ তার জন্য নতুন নয়। ছোট সাহেব একা খেলেও কাজটি তাকে করতে হয়, বন্ধুদের সঙ্গে খেলেও করতে হয়। তখন গেট তালা দিয়ে ওপরে আসতে হয়, থাকতে হয় আশেপাশেই। কোনোকিছুর দরকার হলে যে তারই ডাক পড়বে। ঋভু কখনো চাচা-চাচির সামনে এমনকি সিগারেটও খায় না, মদ্যপান তো দূরের কথা। সবই জানেন তারা, তবু একটু আড়াল রাখে সে। আফটার অল, বয়স্ক মুরুব্বি মানুষ! আজকের আয়োজনও হয়েছে দোতলায়। এখানে তাঁরা আসেন না, এই ফ্লোরটা সম্পূর্ণভাবেই ঋভুর নিজস্ব জগৎ। ড্রয়িং রুম, ডাইনিং, কিচেন, চাচা-চাচির বেডরুম সবই নিচে। দোতলায় কী হচ্ছে তারা যে বুঝবেন না তা নয়, কিন্তু এই আড়ালটুকু ঋভু রক্ষা করে চলে। অন্তত সামনাসামনি তো কিছু দেখছেন না তাঁরা! এসব পুরনো রীতি সে মেনে চলে, মানতে ভালো লাগে। সে অনেক ভেবে দেখেছে, যতই আধুনিক যুগে বাস করুক সে, পুরনো সব জিনিসই খারাপ নয়, বরং ভালো।
হালকা চালে দুষ্টুমি করতে করতেই আড্ডা শুরু হয়েছিল। অবন্তি একসময় অংশুকে জিজ্ঞেস করলো – এই যে প্রতিদিন মদ খেয়ে মধ্যরাতে বাসায় ফিরিস, বউ তোকে কিছু বলে না?
অপলার কথা বলছো? ও তো মহীয়সী 888sport promo code। কিছুই বলে না। – অংশু উত্তর দেওয়ার আগেই বললো ঋভু।
তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি? পরের বউকে তুমি সার্টিফিকেট দেওয়ার কে?
পরের বউ! হা-হা-হা …
ষাঁড়ের মতো হাসছো কেন?
ষাঁড় যে হাসতে পারে তাই তো জানতাম না। হাসছি ওই ‘পরের বউ’ শব্দদুটো শুনে।
অপলা পরের বউ না? তোমার বউ নাকি?
প্রায় …
এই খবরদার, বউ নিয়ে টানাটানি করবি না বলে দিলাম ঋভু! অবন্তি, ওর কথায় কান দিস না।
হ্যাঁ। তুই বল, বউ বকাবাজি করে না?
বকাবাজি করবে কেন?
এই যে প্রতিদিন …
তোর কি ধারণা আমি প্রতিদিন মদ খেয়ে বাসায় ফিরি? আমি তো ঋভুর মতো মদখোর না। কালেভদ্রে খাই।
তুই আমাকে মদখোর বললি! – ঋভু দুঃখিত স্বরে বললো।
মদখোরকে মদখোর বলবো না তো কী বলবো?
তুই সুসানের কাছে আমার ইমেজ নষ্ট করছিস! শোনো, সুসান, আমি মোটেই মদখোর না। ওর চেয়ে বেশি খাই, কিন্তু না খেলে যে চলেই না তা নয়। একা একা থাকি, কী করবো বলো!
তোমার কথা পরে শুনবো। অংশু তুই বল, সংসার করার গোপন সূত্রটা কী? আমি করতে পারলাম না, সেজন্য জামিলও পারলো না, ঋভু পারলো না, তুই পারলি কীভাবে?
কোনো গোপন সূত্র নাই।
এটা বিশ^াসযোগ্য না। কিছু একটা তোদের ভেতরে আছে যা আমাদের মধ্যে নেই বা ছিল না। সেটা কী?
অংশু একটুক্ষণ চিন্তা করলো, তারপর বললো – কী যে বলি! বিশেষ কী যে আছে আমাদের মধ্যে তা তো নিজেই জানি না। তবে একটা ব্যাপার বোধহয় থাকতেই হয়।
কী সেটা?
স্বচ্ছতা।
কীরকম?
দুজন দুজনের কাছে স্বচ্ছ থাকা। কিছু গোপন না করা।
এই সীমা কতদূর পর্যন্ত? মানে কতটুকু স্বচ্ছ থাকা যায়?
যতটুকু সম্ভব।
ধর, আমি তাকে ভালোবাসি না, এই কথাটি বলা যায়? কিংবা ধর, অন্য কারো প্রেমে পড়লে?
না, যায় না।
তাহলে?
সবকিছু তো বলা যায় না। কিন্তু ভালো না বাসার মতো অবস্থা তো একদিনে তৈরিও হয় না, ধীরে ধীরে হয়। ওই পর্যন্ত না যাওয়ার জন্যই স্বচ্ছতাটা জরুরি।
আমি তো সেটাই জানতে চাইছি, কতটুকু স্বচ্ছতা সম্ভব? উদাহরণ দিয়ে বল।
উদাহরণ তো অনেক দেওয়া যায়। কোনটা যে দিই! আচ্ছা, একটা দিচ্ছি। বিয়ের পর অপলা বেশ সহজ-স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগলো, ততই বিষণ্ন হতে লাগলো। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কী হয়েছে, আমাকে মন খুলে বলো। কোনো সংকোচ করো না, যতই জটিল ব্যাপার হোক, আমি সহজভাবেই নেবো। আমি ভেবেছিলাম, আমার পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হচ্ছে, কারো সঙ্গে হয়তো আমার অজান্তেই মনোমালিন্য হচ্ছে, কিংবা আমার প্রতিই হয়তো কেনো কারণে অভিমান বা ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। কিন্তু ও যা বললো তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।
কী বললো?
বললো, আমি এখন বাচ্চা নিতে চাই।
খুবই স্বাভাবিক চাওয়া।
ওটা তো আসল ব্যাপার না।
তাহলে?
সেটাই তো বলছি। আমি বললাম, ঠিক আছে চলো বাচ্চা নিয়ে নিই। ও বললো, কিন্তু তার আগে একটা ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। কোন ব্যাপার – জানতে চাইলাম। ও বললো, চাকরিটা আমি করবো কি না সেই সিদ্ধান্ত!
মানে? বাচ্চার সঙ্গে চাকরির কী সম্পর্ক? – অবন্তি অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
আহা শোন না! আমি বললাম, কেন অফিসে তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? ও বললো, না, অফিসে সমস্যা না। সমস্যা আমার নিজেরই। আমি চাকরিটা ছেড়ে দিতে চাই। ভীষণ অবাক হলাম আমি। সরকারি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার সে, সামনে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার পড়ে আছে। সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, এজিএম, ডিজিএম, জিএম – এরকম একটা চাকরি ও কেন ছাড়তে চায়?
তাই তো! বোকা নাকি মেয়েটা?
পুরোটা না শুনে গাধার মতো ফোড়ন কাটিস না তো অবন্তি!
ওরে আমার পত্নীপ্রেমরে! আচ্ছা বল!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন ছাড়তে চাও চাকরিটা? ও বললো, তোমাকে পরিষ্কার করেই বলি। আমার মা-বাবা দুজনেই চাকরিজীবী। আমরা ভাইবোনেরা যে কত কষ্ট করে বড়ো হয়েছি তা কেবল আমরাই জানি। আমার বাচ্চাও একইভাবে বড়ো হোক আমি তা চাই না। ওর যেন স্কুল থেকে ফিরে মনে না হয় – ওর মা নেই বলে …
আশ্চর্য!
হ্যাঁ, আশ্চর্য! কার মনে যে কী দুঃখ থাকে, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তারপর ও অনেক ঘটনা বললো, মা-বাবা বাসায় না থাকার ফলে কীসব যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে ওকে যেতে হয়েছে, বললো। শুনেটুনে আমি বললাম, ঠিক আছে তুমি চাকরি ছেড়ে দাও। ও খুব অবাক হয়ে বললো – তুমি মন থেকে বলছো? বললাম, হ্যাঁ, মন থেকেই বলছি। ও বললো, কিন্তু আমি যে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না! জানতে চাইলাম, কেন? ও বললো, এতো ভালো একটা চাকরি! তাছাড়া সংসারের এতো খরচ … তুমি একা সামলাবে কী করে? আমি বললাম, চিরজীবন এক অবস্থা থাকবে নাকি আমার? দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।
তুই সত্যিই মন থেকে বলেছিলি?
হ্যাঁ, সত্যিই। এ-কথা ঠিক, দুজনের আয়ে যেভাবে চলছিলাম, সেটা যে হোঁচট খাবে তা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, ওর সাপোর্টটা আমার দরকারও ছিল। তাছাড়া, ওর ক্যারিয়ারের ব্যাপারটাও আমাকে ভাবাচ্ছিল, তবু আমার মনে হচ্ছিল, ওকে সাপোর্ট দেওয়া দরকার।
তারপর?
তার আর পর কী? ও কনসিভ করার পরপরই চাকরি ছেড়ে দিলো!
বাব্বাহ! কী সাহস! তোর সঙ্গে সংসার যদি না টিকতো!
ও সেটা ভাবেইনি!
কেন ভাবেনি? হতে কি পারতো না!
পারতো। কিন্তু ও বোধহয় আমাকে চিনে ফেলেছিল। বুঝেছিল, আমি ঠিক ছেড়ে যাওয়ার মানুষ না।
হুম। এটা অবশ্য বোঝা যায়। আমি যেমন বুঝেছিলাম, জামিলের সঙ্গে বেশিদিন থাকতে পারবো না।
বিয়ের কতদিন পর বুঝেছিলি?
বেশিদিন লাগেনি।
কীভাবে বুঝলি?
সেটা বোঝানো মুশকিল। আমাদের এতোদিনের বন্ধুত্ব, ভেবেছিলাম ওকে তো অন্তত চিনি, মানিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু বাইরের চেনা আর ঘরের চেনা যে একরকম নয়, সেটা বুঝতে পারিনি।
অন্যরকম কী দেখলি?
অতো ডিটেইল বলা ঠিক হবে নারে। আফটার অল, ও আমাদের সবারই বন্ধু ছিল, সব কথা বললে তোদের মনে হবে আমি ওর কুৎসা গাইছি।
তা হবে কেন? আমরা তো একে-অপরকে নিয়ে বলিই। আড়ালে যা বলি, সামনাসামনিও তাই বলি।
তা বলি। কিন্তু ওর সঙ্গে যে আমি সংসার করেছি!
এতো ধানাইপানাই না করে বলে ফেল তো!
ওর মধ্যে সবচেয়ে অভাব ছিল যে জিনিসটার তা হলো সম্মানবোধ বা 888sport apk download apk latest versionবোধ। দুনিয়ার কাউকেই সে সম্মান করতে জানে না। সবাইকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, নিজেকে ভাবে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
হা-হা-হা … এটা তো নতুন কিছু না। আমরা তো জানিই …
আমি কিন্তু জানতাম না।
হুম, হয়তো তোর সামনে সেটা প্রকাশ করতো না। আমরা জানতাম। সবাইকে আন্ডারএস্টিমেট করার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল ওর।
ও! এটা ওর পুরনো স্বভাব বলছিস?
হ্যাঁ।
আমি সত্যিই জানতাম না। প্রথম ধাক্কাটা খেলাম ওখানেই। আমাকে তো উঠতে-বসতে খোঁটা দিতো, বলতো আমি নাকি রূপ দেখিয়ে এতোদূর এসেছি, মাথায় টোকা দিলে ঠনঠন করে বাজে; আমার ফ্যামিলি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউই এসব কথা থেকে বাদ যেতো না। এমনকি তোরাও না।
অংশু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো – তোকে ওই কথা বলেছে?
কোনটার কথা বলছিস?
ওই যে, তুই রূপ দেখিয়ে …
হ্যাঁ, কতবার! ঘরের মধ্যে তো বলতোই, একবার এক পার্টিতে অনেকের সামনেই বলেছিল …
তুই ঘুসি মেরে ওর নাক ফাটিয়ে দিসনি কেন?
হাসিতে ভেঙে পড়লো অবন্তি, বললো, কী বলিস এসব? আমি কি ঘুসি মারার মানুষ?
শেখা উচিত ছিল।
মেয়েরা কি তোদের মতো গুণ্ডামি করে বেড়ায়?
খালি গুণ্ডামির জন্য না, বদমাশগুলোকে সাইজ করার জন্য ঘুসি প্র্যাকটিস করা দরকার।
হা-হা-হা …
আমার কী মনে হয় জানিস?
কী?
ও এসব বলতো ইনফিরিওটি কমপ্লেক্স থেকে। ও কখনোই নিজেকে তোর যোগ্য বলে ভাবতে পারেনি, বারবার তোর কাছে হেরে গেছে …
কী যে বলিস! আমাদের ব্যাচে ও ফার্স্ট হয়েছিল, ভুলে গেছিস?
তাতে কি আর কমপ্লেক্স যায়? ও সবসময় জানতো তুই ঋভুকে পছন্দ করিস …
এতোক্ষণ ধরে অংশু আর অবন্তির মধ্যেই কথাবার্তা চলছিল, ঋভুর দিকে ওদের নজরই ছিল না, সত্যি বলতে কি, ঋভুও বহুক্ষণ ধরেই ওদের কথাবার্তা শুনছিল না। এবার দুজনেই তাকালো ওর দিকে, দেখলো দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে সে। চোখাচোখি হলো ওদের, কিছু বললো না কেউই। ঋভু ভাবছিল, ওরা যদি জিজ্ঞেস করে, কী সমস্যা ছিল রিনির সঙ্গে তার, কী জবাব দেবে? কোনো সমস্যা তো ছিল না। কিংবা সমস্যা ছিল কি না সে জানেই না। সে স্রেফ নির্লিপ্ত ছিল। এমনকি রিনি যেদিন প্রথম বলেছিল, তোমার সঙ্গে আমি আর থাকতে চাই না, সে নির্লিপ্ত কণ্ঠে ‘আচ্ছা’ বলেছিল। কোনো চেষ্টাই করেনি অবস্থা পরিবর্র্তনের। তার আগেই অবশ্য অনেক কিছু ঘটে গেছে। সমস্যাটা শুরু হয়েছিল মা মারা যাওয়ার পর। মায়ের জন্য রিনির যেটুকু ব্যস্ততা ছিল, সেটুকুও শেষ হয়ে গেলে এই বাসায় তার করার মতো কোনো কাজই রইলো না। এমনকি রইলো না কথা বলার মতো কোনো মানুষও। সে-সময় কী যে হয়েছিল ঋভুর, কথা বলতে ইচ্ছেই করতো না। কারো সঙ্গেই না। এমনকি বিয়ের দু-বছর পরও রিনির সঙ্গে কথা বলার মতো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। মা থাকতে তবু প্রয়োজনীয় কথাবার্তাটুকু হতো, সেই প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেল। ঋভুর কেবলই মনে হতো, যে-জীবন সে যাপন করছে, সেটি তার নয়। খুব একা থাকতে ইচ্ছে করতো। মনে হতো, এই বাড়িতে যদি আর কেউ না থাকতো কিংবা এমন কোথাও যদি সে চলে যেতে পারতো যেখানে কেউ তাকে চিনবে না, সে সুখী হতো। হয়তো তার দীর্ঘ নীরবতা এবং নির্লিপ্ততা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল রিনি। হওয়াই স্বাভাবিক, ঋভু রিনির কোনো দোষ খুঁজে পায় না, পায়নি কখনো। মেয়েটা সব অর্থেই ভালো ছিল, অনায়াসে একটা সুন্দর-প্রাণবন্ত দাম্পত্যজীবন হতে পারতো তাদের, কিন্তু ঋভু তো তা চায়ইনি। মায়ের ইচ্ছে পূরণের জন্য বিয়ে করার ব্যাপারটাকেই সে ভুল কাজ বলে মনে করতো। নিজের ওপর অন্যায় করেছে সে, রিনির ওপরে তো বটেই – এরকম মনে হতো তার। হয়তো এরকম এক সময়েই রিনি আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে থাকে। কিংবা ঋভু আসলে জানেও না, ঠিক কখন এর সূত্রপাত। জানতে পারতোও না কোনোদিন, যদি রিনি নিজেই না জানাতো। জানানোর পর তীক্ষèচোখে তাকিয়েছিল ও, যেন ঋভুর মন পড়ে নিতে চায়। কিন্তু ঋভুর কিছুই মনে হয়নি। ঈর্ষা নয়, দুঃখ নয়, বিস্ময় নয়, এমনকি অস্বস্তিও নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছিল সে খবরটিকে আর রিনি দারুণ ভেঙে পড়েছিল। সেটি দেখে ঋভুর মনে হয়েছিল, হয়তো তাকে শাস্তি দিতেই এই সম্পর্কে জড়িয়েছে রিনি, একধরনের জেদ আর প্রতিশোধস্পৃহা থেকে। কিন্তু ও জানতো না, ওতে কিছু হবে না। অবশেষে রিনি একদিন চলেই গেল। একা গেল নাকি সেই লোকটির সঙ্গে গেল, তাও জানে না ঋভু। এমনকি ও যাওয়ার পর একটু মন খারাপও হয়নি তার, বরং এক ধরনের স্বস্তি আর মুক্তির আনন্দই যেন পেয়েছিল সে। একা থাকার আনন্দে কিছুদিন বুঁদ হয়ে ছিল ঋভু; কিন্তু বুঝতে বেশি সময় লাগেনি যে, একা থাকলেও তার জীবনযাপনে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি, যে-জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সেটিই যাপন করে চলেছে। আর তখন এক ধরনের অনুতাপ তাকে পেয়ে বসেছিল, মনে হতো – রিনির প্রতি সে অন্যায় করেছে।
চিন্তার সুতো কেটে গেল অংশুর ডাকে – এই তোর হলো কী? সবার গ্লাস তো খালি।
ভরে নিতে পারিস না ইডিয়ট? – হাসিমুখে বললো সে।
তাই কি হয়? তুই তো সবসময়ের জন্য আমাদের সাকি!
সুরাটা কে?
অবন্তি, ইয়ে মানে, আজকের জন্য তুই কি সুরা হবি?
দ্যাখ অংশু, তোদের এইসব সান্ধ্যভাষা আমি বুঝি না। সুরা হবো মানে কী? – অবন্তি খেপে গিয়ে বললো।
মানে প্রেমিকা হবি?
দুজনেরই? তাও কেবল আজকের জন্য?
হ্যাঁ। দুজনই তো আছি।
আমাকে পাগল ঠাউরেছিস?
কেন? কী সমস্যা?
একসঙ্গে দুজনের প্রেমিকা হতে পারবো না।
দুঃখ পেলাম।
কেন?
মানে, অন্তত একজনকে স্যাক্রিফাইস করতে হবে আজকে। কিন্তু আমি রাজি না, ওদিকে ঋভুও ছাড়বে না।
ছাড়বো কেন? – ঋভু বললো – প্রতিদিন কি এমন জলজ¦্যান্ত প্রেমিকা পাওয়া যায়?
এসবের মানে কী? – অবন্তি বিভ্রান্ত স্বরে বললো।
শোন শোন। আমরা মদ খেতে বসলেই কারো-না-কারো সঙ্গে প্রেম করি। বাস্তব প্রেমিকা তো আর পাওয়া যায় না তাই কল্পনায় …
তোদের প্রেম করার শখ এখনো মেটেনি?
মিটবে কীভাবে বল। প্রেম তো করাই হলো না, তার আগেই বিয়ে করে ফেললাম। আমার চেয়ে ঋভুর অবস্থা আরো খারাপ। তুই দাগা দিয়ে চলে গেলি …
আমি দাগা দিয়েছিলাম?
আহ, অংশু, তুই থামবি? – ঋভু গলা চড়ালো।
না, থামবো না। এই বিষয়টা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তোরা কে কাকে দাগা দিয়েছিলি সেটা আজ মীমাংসা হয়ে যাক।
ঋভু-অবন্তি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর অবন্তিই বললো – হবে নাকি মীমাংসা?
তোমার কী মত?
হয়ে যাক।
ঝগড়া হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
শতভাগ।
তাহলে থাক।
কেন? ঝগড়া করতে পারবে না?
আজ পারবো না। এরকম বৃষ্টিভেজা হাওয়ামুখর সুন্দর একটা রাত, আজকে ঝগড়া জমবে না।
তাহলে? কবে হবে?
যেদিন খুব রোদ থাকবে।
এভাবে কথার পিঠে কথা হয়তো চলতেই থাকতো, কিন্তু করিম এসে দাঁড়ালো অনুগত ভঙ্গিতে। ঋভু জানে, যতক্ষণ না ওকে কিছুজজ্ঞেস করা হবে ততক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়েই থাকবে, তাই বললো – কিছু বলবে করিম?
জি¦, আপনাদের খাবার দেওয়া হইছে।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে যাও, আমরা আসছি।
এগারোটার সময় খাবার দেওয়ার কথা ঋভু আগেই বলে রেখেছিল, চাচা-চাচিকে জাগিয়ে রাখতে চায়নি বলে। কিন্তু কখন যে এতো রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। আড্ডার সময়গুলো আসলে দ্রুত গড়িয়ে চলে। অংশু বললো, এতো তাড়াতাড়ি খাবো? আড্ডা তো এখনো জমলোই না।
হ্যাঁ খাবি। আমরা না খেলে চাচা-চাচিও খাবেন না, ঘুমাবেনও না। বুড়ো মানুষ।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে। চল।
খাওয়ার টেবিলের আয়োজন দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল অবন্তির – করেছো কী ঋভু! এতো পদের খাবার খাবো কীভাবে?
আমি কিছু করিনি। সব চাচির আইডিয়া। এই ডিপার্টমেন্টে আমার কোনো হাত নেই।
ভালোই আছো তুমি। সব রেডিই থাকে। – ফিসফিসিয়ে বললো অবন্তি।
তুমি কি ভালো নেই?
সেটা এখন বলবো না।
খুব বেশি খাওয়া গেল না, তবু অবন্তিকে ভীষণ তৃপ্ত আর আনন্দিত দেখা গেল। অংশুও বললো, চাচির রান্নার ভেতর একটা মা-মা গন্ধ আছে। কী যে ভালো লাগে! এই স্বাদ আর কোথাও পাই না।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফের আড্ডা শুরু হবে কি না এ নিয়ে দোনোমনায় ভুগছিল তারা। একবার শুরু হলে তো শেষ হতে চায় না। এমনিতেই রাত বারোটা পার হয়ে গেছে। অন্তত অবন্তির আর দেরি করা ঠিক হবে না। কিন্তু অবন্তি ভ্রুক্ষেপহীন। ঘুরে ঘুরে দেয়ালজুড়ে সাজানো পেইন্টিংগুলো দেখছিল সে। মনে মনে ঋভুর রুচির প্রশংসা না করে পারলো না। বিভিন্ন 888sport live chatীর আঁকা, বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন ধরনের। কিন্তু কোথায় যেন এক ঐক্যসূত্র আছে, যেন সবগুলো ছবি মিলে একটি গল্প হয়ে উঠেছে। ইঙ্গিতময় গল্প, যার অর্থ নিজেকেই বুঝে নিতে হয় এবং যে যেভাবে ভেবে নেয় সেটিই সত্যি হয়ে ওঠে। অবন্তি যেমন ভেবে নিলো, এ এক নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প। নিঃসঙ্গ কিন্তু বিষণ্ন নয়, জীবনের সঙ্গে ভীষণভাবে লিপ্ত হয়ে আছে। ধুধু প্রান্তরে সে একা, কিন্তু নিঃসঙ্গ নয়। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে নিসর্গ। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিল বলেই হয়তো বাকি দুজনের আলাপ শুনতে পায়নি সে, কিন্তু একসময় নিশ^াসের শব্দ পেলো খুব কাছেই। ফিরে দেখলো ঋভু দাঁড়িয়ে।
পছন্দ হয়েছে? – জিজ্ঞেস করলো সে।
হুম। খুউব।
চলো আরো দেখবে।
কোথায়?
চলোই না।
বেডরুমে নিয়ে যাবে না কিন্তু!
হঠাৎ এই কথায় হচকচিয়ে গেল ঋভু, কিন্তু সামলে নিলো দ্রুত, বললো – কেন? ভয় পাও?
উঁহু।
তাহলে?
ওখানে আরেকজনের 888sport sign up bonusচিহ্ন আছে। আমি সইতে পারবো না।
আরেকবার ধাক্কা লাগলো ঋভুর বুকে, সইতে পারবে না মানে কী! কিন্তু এবারো বুঝতে দিলো না, বললো – রিনির কথা বলছো?
হুঁ।
ও তো এই ঘরে থাকতো না।
থাকতো না! তাহলে কোথায় থাকতো! তোমরা কি একসঙ্গে থাকতে না?
একসঙ্গেই থাকতাম। কিন্তু এই ফ্লোরটা তৈরি হয়েছে ও চলে যাওয়ার পর।
ওহ!
এখন তো যাবে?
উঁহু।
কেন?
পরপুরুষের বেডরুমে যেতে পারবো না।
ভয় তো পাও না, তাহলে সমস্যা কোথায়?
যদি লোভ হয়?
ঋভুর হঠাৎ মনে হলো, অবন্তি কি একটু প্রগলভ হয়ে উঠেছে? সেটি কি সচেতনভাবে নাকি দ্রব্যগুণের প্রভাবে? ঋভু হেসে বললো – আচ্ছা ঠিক আছে। ব্যালকনিতে চলো। অংশু আগেই গেছে বিড়ি টানতে। আর হ্যাঁ, আমি তোমাকে বেডরুমে নিতে চাইনি।
চাওনি?
না।
কিন্তু আমি যাবো।
কোথায়?
কোথায় আবার! তোমার বেডরুমে।
ঋভু আবার হাসলো। অবন্তির এই জেদের সঙ্গে তার পরিচয় আছে। বললো, ঠিক আছে চলো।
রুমে ঢুকেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু-হাতে তার গলা পেঁচিয়ে ধরলো অবন্তি। বললো, আমাকে একটা চুমু দাও।
তোমার সঙ্গে কি আমার চুমুর সম্পর্ক হয়েছিল?
হয়নি। কিন্তু একটা অসমাপ্ত চুম্বন আমার পাওনা রয়ে গেছে।
অসমাপ্ত!
হ্যাঁ। তোমার মনে নেই?
মনে পড়লো ঋভুর। ক্যাম্পাসজীবনে একবার দুজনে রিকশায় যাচ্ছিল কোথাও। হঠাৎ বৃষ্টি এলে রিকশাওয়ালা হুড তুলে দিয়ে পর্দা এগিয়ে দিলো দুজনের দিকে। স্বাভাবিকভাবেই দুজনের দূরত্ব কমে এলো, হুডখোলা রিকশা আর হুডতোলা রিকশার পার্থক্য তো থাকেই, তার ওপর বৃষ্টি! নিশ^াস ঘন হয়ে আসছিল দুজনের, তাকিয়ে ছিল পরস্পরের দিকে, কখন যেন নিজেদের অজান্তেই দুজনের ঠোঁট এগিয়ে যাচ্ছিল একে-অপরের দিকে। কিন্তু স্পর্শ করার আগেই বিকট শব্দে ফেটে পড়েছিল কাছাকাছি কোনো ট্রান্সফর্মার। ওরকম আকস্মিক শব্দে চমকে উঠেছিল দুজন, তারপর আবিষ্কার করেছিল, রিকশা থেমেছে, তারা পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। নামার আগে মৃদুস্বরে ঋভু বলেছিল, পাওনা রইলো।
মনে ছিল না এতোদিন আগের সেই দেনাপাওনার কথা, কিন্তু অবন্তি মনে করিয়ে দিলো। আজো বৃষ্টির দিন, রিকশায় বসে নেই বটে, কিন্তু আছে নিরাপদ স্থানে, পরস্পরের গা ঘেঁষে। ঋভু নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলো অবন্তিকে, ঠোঁট রাখলো ওর অধরে। দীর্ঘ চুম্বন শেষ হলে দেখলো, অবন্তির চোখে জল। বললো – আই হ্যাড বিন ওয়েটিং ফর দিস মোমেন্ট ফর টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স!
ঋভু আলতো করে অবন্তির চোখ মুছিয়ে দিলো। বললো – চলো। অংশু একা বসে আছে।
হ্যাঁ, চলো। (চলবে)


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.