জয়নুলের হাতে অন্য তুলি

কাইয়ুম চৌধুরী

তখনো আমি স্কুলের ছাত্র। ওপরের ক্লাসের। প্রথম জয়নুল আবেদিনের ছবি দেখি ওই সময়ে। ছাপা ছবি। কোন পত্রিকায় আজ আর তা মনে নেই। সাদাকালোতে ছাপা ছিল ছবিটি। নাম ছিল ‘অপেক্ষা’। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নৌকোর জন্যে ফেরিঘাটে অপেক্ষমাণ যাত্রী। নদীর ওপারে কুয়াশাবিলীন অস্পষ্ট তটরেখা। একঝাঁক পাখি আকাশে উড্ডীয়মান। নদীর মাঝখানটায় একফালি চর। চরে একসার নৌকো বাঁধা। এপারে যাত্রীদ্বয় উবু হয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসা, পিতাপুত্র। শীতের সকাল। পিতার ডানপাশে তৈজসপত্রে ঠাসা বেতের ঝাঁকা। পুত্রের বাঁ-পাশে দুটি তেলের বোতল ও দুধের ঘটি। কালো রেখায় অঙ্কিত ফিগরে শুধু ক্লান্তির ছাপ। নৌকো বাঁধার জন্যে বাঁশের খুঁটি। আঘাতে আঘাতে মাথা চ্যাপ্টা-চতুর্দিকে অাঁশ বেরুনো। ওপারে রৌদ্রালোকিত নদী, ঝকঝকে। মাঝখানে চর-বরাবর মেঘের ছায়া। এ-পারে নদীকূল রৌদ্রমাখানো – ফিগরদুটি রৌদ্রে উজ্জ্বল। ছবিটি আমাকে কোনো এক গাঢ় অনুভূতিতে পৌঁছে দিত – অব্যক্ত বেদনায় যেন হাহাকার। কীসের প্রতীক্ষায় পিতাপুত্র? শুধু কি নদী পারাপার? ফেরির জন্যে? না। ওপারে আশার প্রতীক। নির্ভাবনার আশ্রয়স্থল। রৌদ্রালোকিত।

আমাকেও আলোকিত করেছিল, আমার 888sport live chatসত্তাকেও জাগিয়ে তুলেছিল তাঁর এই অসামান্য ড্রইং। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তুলির বলিষ্ঠ অাঁচড়ে অাঁকা শ্রমজীবী মানুষ  সাদা-কালোতে, গ্রাম্যবধূ, নদী, নৌকো, ধানক্ষেত, পালকিতে নাইওর কী অপরূপ রূপে উদ্ভাসিত হতো তাঁর ছবিতে, রঙের মেলা ছড়িয়েও সেই রূপ ফোটানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। রেখার পরিমিতি, তুলির সাবলীল গতির মধ্যে দূরনিকটের অভিঘাত অদ্ভুত বঞ্চনার জন্ম দেয়। 888sport appsের গ্রামজীবনের নানা টুকরো ছবি তাঁর এসব ড্রইংয়ে ধরা দিয়েছে জাপানি হাইকুর মতো। পাকিস্তানি আমলে ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশন্সের মাসিক পত্রিকা মাহেন ও পাকিস্তান কোয়ার্টারলির পাতায় তাঁর ছবি দেখতাম নিয়মিত। মোটা তুলির অাঁচড়ে, সরু তুলির রেখায় স্পন্দিত হতো ছবির বিষয়বস্ত্ত। সংগীতের মতো আবহ তৈরি হতো রেখার ছন্দে, স্পন্দিত হতো বিষয়বস্ত্ত যার রেশ সহজে মিলিয়ে যেত না। চোখের সামনে ভেসে উঠত দূরগ্রামের সীমান্তরেখায় দুটি তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে। সামনে বিস্তৃত ধানক্ষেত জ্যেষ্ঠের বাতাসে আন্দোলিত, ক্ষেতের আল বেয়ে শাড়ির অাঁচল উড়িয়ে ছুটে-যাওয়া গ্রাম্য-বালিকা শুধু দুটি তুলির টানে ম্যাজিক বলে প্রতীয়মান হতো। ভারতীয় রীতির রৈখিক অভিব্যক্তির সঙ্গে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক ড্রইংয়ের সাযুজ্য ঘটিয়েছিলেন তাঁর ড্রইংয়ে। গভীরভাবে দেখতেন তিনি, অনুভব করতেন বিষয়বস্ত্তকে, মেলাতেন প্রকাশক্ষমতার সঙ্গে এ দুয়ের। দেখার প্রত্যুত্তর কাগজের ওপর বলিষ্ঠভাবে ফুটে উঠত কালো কালির অাঁচড়ে। রঙের রানি বলা হয় কালো রংকে। জয়নুল আবেদিন নিঃসন্দেহে সেই কালো রঙের কবি। কালো রঙের সুষমায় ড্রইংয়ের লালিত্যকে এমন দৃষ্টিনন্দনভাবে উপস্থাপন আমি আর কারো ছবিতে দেখিনি। এমনকি ব্যবহারিক 888sport live chatেও তাঁর ড্রইংয়ের সুষমা তিনি বজায় রেখেছিলেন। শামসুদ্দিন আবুল কালামের 888sport alternative link কাশবনের কন্যার ইলাস্ট্রেশন এর উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ঝালকাঠি বন্দরে বর্ষাস্নাত রাতে টিপটিপ বৃষ্টিমাঝে ঘাটে বাঁধা নৌকোর ছবি, বৃষ্টির শব্দ, নদীস্রোতের বয়ে-যাওয়া ধ্বনি অন্তরে অনুভব করিয়ে দেয়। 888sport appsের নৈসর্গিক দৃশ্যের মাধুরিমায় জয়নুল ছিলেন আবিষ্ট। ছাত্রজীবনে তাঁর মনে ঝড় তুলেছিল সাঁওতাল পরগনার দুমকা, ময়ূরাক্ষী নদী আর সাঁওতালদের ছন্দময় জীবনযাত্রা। তেমনি ব্রহ্মপুত্রের দুকূল-ছাপানো স্রোতধারা। শুধু সুন্দরই নয়, অসুন্দরকেও ধরেছেন তিনি তাঁর বলিষ্ঠ তুলির অাঁচড়ে। সুন্দরের সাধনার মাঝে যতি টেনে দিয়েছিল পঞ্চাশের মন্বন্তর। ত্রিশের দশকে অর্থনৈতিক মন্দা সারা পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত। তার ওপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিস্ট বাহিনীর উপমহাদেশে উপস্থিতি, শ্বাসরুদ্ধকর কলকাতা। জয়নুল ফিরে গেলেন ময়মনসিংহে। তখন একশ্রেণির কালোবাজারির সহায়তায় বাজার থেকে ধান-চাল উধাও হয়ে গেল অধিক মুনাফা লাভের লালসায়। দেখা দিলো খাদ্যাভাব। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যেতে লাগল অসহায়ের মতো। জয়নুল চলে এলেন কলকাতায়। পিছু পিছু ধেয়ে এলো তাঁর ছবির সুখী, সমৃদ্ধ চরিত্ররা – কৃষক, শ্রমিক, জেলে – অস্থিচর্মসার – খাদ্যের সন্ধানে রাজধানী কলকাতায়। খাবার-দোকানে সজ্জিত খাবারের দিকে তাকিয়ে ফুটপাতে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে মৃত্যুবরণ করল। খাবার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতেও পারল না। জয়নুল আবেদিন পাথর হয়ে গেলেন। চোখের সামনে তিনি দেখলেন তাঁর গ্রামের প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন বেঘোরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে। মনুষ্যসৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষকে তিনি দলিল করে রাখতে চাইলেন। যুদ্ধের বাজারে কাগজের দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্যের কারণে তিনি বেছে নিলেন ঈষৎ  হলুদ রঙের মোটা প্যাকেজিং কাগজ। মোটা তুলিতে কালো রঙে তিনি অাঁকলেন অভুক্ত মৃত প্রতিবেশীদের। শীর্ণ অস্থিচর্মসার দেহগুলো লম্বাটে আকার নিল, এলগ্রেকোর ফিগারের মতো। রেখার লালিত্য গেল মুছে। ফিগরের কালোরেখা স্থানে স্থানে ভঙ্গুর। শুকনো তুলির টানে ছায়া ঘনায় ফিগরে। মনুষ্যসৃষ্ট ইতিহাসের এই জঘন্যতম ঘটনাকে চিত্রায়িত করলেন মোট কুড়িখানা ছবিতে। জয়নুল আবেদিনের চোখে তখন রং নেই। শুধু মৃত্যুর কালো ছায়া। ড্রইংয়ের অসাধারণ পরিমিতিবোধ, আলোছায়ার সাযুজ্য এবং স্পেসের বিভাজনে ছবিগুলো হয়ে উঠল গভীর, বাঙ্ময়। ফুটপাত, ডাস্টবিনসর্বস্ব কলকাতা। প্রয়োজনাতিরিক্ত কোনো কিছু নেই। খাদ্যাভাব প্রকট, মানুষে-কুকুরে লড়াই। কাকের উপস্থিতি। ব্যঞ্জনাময় প্রকাশভঙ্গি। সারাবিশ্ব শিহরিত হলো তাঁর সৃষ্ট ম্যাডোনা দেখে। ঊর্ধ্বাকাশে শূন্যে দৃষ্টি মেলে অর্ধশায়িতা মাতা, যার একহাত রক্ষিত শূন্য থালা, কোলে হাড্ডিসার শিশু, শুকনো স্তনের প্রতি তার আকুতি – রাফায়েল, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ম্যাডোনাকে যেন ব্যঙ্গ করে। দুর্ভিক্ষের এই চিত্রমালার মাধ্যমেই জয়নুল বিশ্বপরিচিতি লাভ করেন। কলকাতায় এ-ছবির প্রদর্শনীতে এসেছিলেন 888sport live chatপতি বিড়লা। ছবিগুলো দেখে তিনি দুহাতে চোখ ঢেকে চিৎকার করে উঠেছিলেন। সরিয়ে নাও ছবিগুলো। কারণ এ-দুর্ভিক্ষ তো তাদেরই সৃষ্টি। প্রখ্যাত ব্রিটিশ চিত্র-সমালোচক এরিখ নিউটনের ভাষায় : ‘এ ছবিগুলো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় যা অনেকের কাছে অসাধ্য মনে হতে পারে।’

দুর্ভিক্ষের এ-চিত্রগুচ্ছ জয়নুল আবেদিনের খুবই প্রিয় ছিল। একটি ছবিকেও তিনি হাতছাড়া করেননি। এ-ছবিগুলো অাঁকার সময় কামরুল হাসান ছিলেন তাঁর নিত্যসঙ্গী। কাগজ-কালি ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে যেতেন জয়নুল আবেদিনের পিছু পিছু। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র স্বাধীনতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেশকিছু ছবি। কুড়িখানা ছবি থেকে বারোখানা ব্যবহৃত হয়েছে ইলা সেন-রচিত সুশীল গুপ্ত-প্রকাশিত ডার্কেনিং ডেজ নামক বইয়ে। বইটির দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল বিং অ্যা ন্যারেটিভ অব ফেমিন-স্ট্রিকেন বেঙ্গল। উইথ ড্রইংস ফ্রম লাইফ বাই জয়নুল আবেদিন। ইলাস্ট্রেশন শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়নি।

আর্টস্কুলে যাওয়ার আগেই আমার ব্রহ্মপুত্রদর্শন। জয়নুল আবেদিনের ছবির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র আমার কাছে মোহনীয়। সরকারি ডাকবাংলো আর বর্তমান জয়নুল সংগ্রহশালা, যা একসময়ে নলিনীরঞ্জন সরকারের বাড়ি ছিল, তার পাশেই ব্রহ্মপুত্র। ধারঘেঁষে হাঁটার জন্যে রাস্তা। সেই রাস্তার একধারে শশীভূষণ লজ। অতিসুন্দর স্থাপত্য-নিদর্শন। বিকেলের দিকে সারা ময়মনসিংহ শহর ওখানে ভেঙে পড়ে। নদীর নীলাভ জল বয়ে যায় কুলকুল। মধ্যিখানে ছোট্ট চর। সাদা বালি রুপোর মতো ঝকঝকে। তারপরই কাশবন – সাদাফুলে শরতের বাতাসে আন্দোলিত। জয়নুল আবেদিন ছবি এঁকেছেন এ-নদীর। তাঁরই বর্ণনায় সকালের রৌদ্ররঙে নদীজল উজ্জ্বল। জেলেরা নৌকো নিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত। তারই মাঝে কাশবনের একান্তে জয়নুলের ছবি অাঁকা তাদের উৎসুক করে তোলে। আগ্রহ নিয়ে ছবি দেখে। বলে, ‘এখানে নদীর রং এমন কী নীল, একটু সামনে আউগান, দ্যাখবেন নদীর রং দ্যতের কালির মতো নীল।’

জয়নুল আবেদিনকে তখনো চাক্ষুষ করিনি। ময়মনসিংহের আকুয়ায় দূরবর্তী রেলওয়ে সিগন্যালের কাছেই – জামালপুর যাওয়ার দিকটায় তাঁর পিতার আবাস। জয়নুল আবেদিন তখন সরকারি চাকুরে। করাচিতে পাকিস্তান সরকারের live chat 888sport ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান 888sport live chatী। আমি তখন পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি। আকুয়াতেই বসবাস। জয়নুল আবেদিনের ছোটভাই জুনাবুল ইসলাম আমার বড়ভাইয়ের সহপাঠী আনন্দমোহন কলেজে। তাঁর কাছে শোনা গেল, জয়নুল আবেদিন করাচির চাকরি ছেড়ে চলে আসছেন ময়মনসিংহে। 888sport appয় আর্টস্কুল হবে।

আশায় বুক বাঁধি। শেষ পর্যন্ত আর্টস্কুলে পড়তে পারব। কলকাতা আর্টস্কুলে পড়াবার সামর্থ্য পিতার ছিল না। আর  সে-সময়েই ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে। কলকাতা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বিচিত্র পরিবেশে জয়নুল আবেদিনকে চাক্ষুষ করলাম। আকুয়ার মসজিদপুকুরে কানে আঙুল দিয়ে ডুব দিচ্ছেন গোসলরত অবস্থায়। পিতার আমন্ত্রণে বিকেলে বাসায় এলেন। আমার কাজ দেখলেন। বললেন, 888sport appয় আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। ব্যস, আর্টস্কুলের ছাত্র হয়ে গেলাম।

আর্টস্কুলে জয়নুল আবেদিনের সান্নিধ্য, তাঁর পদপ্রান্তে 888sport live chatশিক্ষা, পুরো দৃষ্টিভঙ্গিটাই আমার পালটে গেল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, এ-কি নতুন জন্ম, নতুন জন্ম, নতুন জন্ম আমার। জন্মভূমিকে অবলোকন করলাম গভীর মমতায়। মানুষের সঙ্গ নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিল। সমগ্র হৃদয় এক নতুন রসে সিঞ্চিত হলো। তখন কত বয়স জয়নুল আবেদিনের? মাত্র বত্রিশ। সেই বয়সে তাঁর গভীর জীবনবোধ, আমাদের জীবনটাকেই পালটে দিলো। কী ঐশ্বর্যে আমরা ভূষিত হলাম তা পরবর্তীকালে আমার উপলব্ধিতে এসেছে। শুধু তো 888sport live chatী তৈরি করা নয়, একজন আলোকিত মানুষ তৈরি করাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। ছবি আঁকার সঙ্গে সঙ্গে শেকড়ের সন্ধান দিলেন – কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সেই শেকড়কে অটুট রেখে আমাদের কোথায় যেতে হবে। নিসর্গ-অবলোকনে যে-শিক্ষা, যে-সৌন্দর্যের উপলব্ধি, সে-উপলব্ধি জাগিয়ে তুললেন আমাদের ভেতরে। সাধারণ মানুষ তো সুন্দর দেখতে পায় না। 888sport live chatীর কাজ হচ্ছে সে-সুন্দরকে তাদের চোখে পরিস্ফুট করা।

লোক888sport live chatের একটি ভালো সংগ্রহ ছিল জয়নুল আবেদিনের। তাঁর বিশ্বাস ছিল, আমাদের 888sport live chatের ঐতিহ্য হচ্ছে আমাদের লোক888sport live chat। এই 888sport live chatের বিভিন্ন রূপকে ভেঙে নতুন রূপের সৃষ্টি চিত্র888sport live chatে একটি নতুন শৈলীর জন্ম দেবে। সে-চেষ্টাই তিনি করেছিলেন বিদেশ থেকে ফিরে এসে। ময়মনসিংহের হাতে-টেপা পুতুলের লম্বা গলা তাঁর ছবিতে নতুন মাত্রা এনেছিল। সেই পুতুলের গায়ের নকশা একটি নতুন দ্যোতনা এনে দিয়েছিল তাঁর ক্যানভাসে। একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে গিয়ে তিনি তাঁর কাজের সময় সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছিলেন, যার জন্যে গুটিকয় কাজে শুধু তার সম্ভাবনাটাই আমরা দেখতে পেলাম। আমার বিশ্বাস, যদি ক্যানভাসের পেছনে তিনি পুরো সময়টি ব্যয় করতে পারতেন, তাহলে আধুনিক চিত্রকলায় একটি নতুন শৈলীসৃষ্টির কৃতিত্ব তাঁর করায়ত্ত থাকত। তাঁর সংগ্রহে 888sport appsের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্নরকম মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল, শখের হাঁড়ি, নকশিকাঁথা, লক্ষ্মীর সরা, নকশিপিঠা, নকশিপাখার সমারোহে আমরা মুগ্ধ ও বিস্মিত। তিনি আমাদের তাঁর সংগ্রহ যত্নের সঙ্গে দেখাতেন। বোঝাতেন, মাধ্যমের সীমাবদ্ধতার কারণে তার সংক্ষিপ্তকরণ যে-নতুন কাঠামোর জন্ম দিয়েছে এটাই হচ্ছে সৃষ্টি। একটি ঐশ্বর্যের ওপর সে-সৃষ্টি আরেকটি নতুন ঐশ্বর্য ধারণ করে আছে। অথচ এই সৃষ্টির মুহূর্ত কত সরলভাবে তৈরি। কুমোরের হাতে যখন কাজ থাকে না, অবসর সময়ে শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্যে, বিশেষ করে দরিদ্র শিশুদের, অল্পদামে বিক্রি এবং 888sport live chatীর বাড়তি রোজগারের একটি পথ তৈরির মধ্যেই এই ঐশ্বর্যের জন্ম। সৌন্দর্যপিপাসু একজন 888sport live chatীর চোখ আর শিশুর মনভোলানো রূপের এই মিশ্রণ অবাক করার মতো। বেগম আবেদিনের একটি অভিজ্ঞতা এখানে বর্ণনা করি। বাড়িতে কাজের বুয়া  –  ঘর মোছে, কাপড় কাচে  –  সঙ্গে তার শিশুসন্তানটি। সেই লোক888sport live chat-সংগ্রহের আলমারির সামনে সন্তানের আকুতি, পুতুলটি তার চাই। আবেদিন-গিন্নি জিভ কাটেন। সর্বনাশ, বলে কী? এসব বড় সাহেবের। এগুলো চাওয়া বারণ। কাজের বুয়া, পাইন্যার মা অবাক বনে যায়। তার ছেলে যে-পুতুল চায়, বাড়ির সাহেবও সে-পুতুল চায়।

ছবির গড়নের ক্ষেত্রে আয়তন, আকারের গুরুত্ব ছবির কাঠামোর ওপরই নির্ভরশীল। সুন্দর একটি উপমা আমাদের উপহার দেন জয়নুল আবেদিন। তাঁর ভাষায় – কুমোররা  যে-হাঁড়ি তৈরি করে তার নানারকম আকার ও গড়ন। উঁচু ডৌলে তৈরি ভাতের হাঁড়ি, চাল সেদ্ধ হওয়ার সময়ের প্রয়োজনে ফুটন্ত পানির পরিমাণের ওপর তার গভীরতা। তেমনি বড় মাছ রান্না করার হাঁড়িটিও মাঝারি ডৌলের। আবার ছোট মাছ সাঁতলানোর জন্যে চাই চ্যাতালো হাঁড়ি। আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়।

শুধু ছবির সঙ্গেই আমাদের পরিচয় ঘটাননি জয়নুল আবেদিন। 888sport live football ও সংগীতের রাজ্যেও আমাদের প্রবেশ ঘটান। সংগীতের সুরলহরী কীভাবে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় – বিশেষ করে লোকসংগীতের সুর 888sport appsের মর্মমূলে কেমন করে পৌঁছে দেয়, তার সঙ্গে পরিচয়ে তাঁর আগ্রহের কথা ভুলে যাওয়ার নয়। আর্টস্কুলের যে-কোনো অনুষ্ঠানে সংগীতের আসর, বিশেষ করে লোকসংগীত অপরিহার্য ছিল। মমতাজ আলী খান, আবদুল আলীম, কানাইলাল শীলের সঙ্গে ছাত্রাবস্থাতেই আমাদের পরিচয় ঘটেছিল। একটা সময়ে জয়নুল আবেদিন কানাইলাল শীলের কাছে দোতারার তালিমও নিয়েছিলেন। শুধু লোকসংগীত নয়, সুযোগের সদ্ব্যবহারে তাঁর জুড়ি ছিল না। সেই সময়ে ইউ.এস.আই.এস-এ ক্লদ কলভিন নামে একজন কালচারাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার এসেছিলেন। তিনি নিগ্রো স্পিরিচুয়াল খুব ভালো গাইতেন। আর্টস্কুলে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি আমাদের জানালেন নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের পশ্চাৎপট, গিটার-সহযোগে উদাহরণ পেশ। এতো সুন্দর অনুষ্ঠান আমি এখনো ভুলতে পারিনি। পরবর্তীকালে নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের একটি লং-প্লে রেকর্ড সংগ্রহ করেছিলাম, যার মধ্যে ক্লদ কলভিনের গাওয়া জেরিকো গানটিও ছিল। এসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন 888sport appর বিদগ্ধজনেরা। কবি, 888sport live footballিক, সংগীত888sport live chatী, live chat 888sportকার, অভিনেতা – এঁরা সবাই আসতেন। আমরা পেতাম তাঁদের দুর্লভ সান্নিধ্য। শুনতাম তাঁদের জীবনের 888sport app download for androidীয় সব ঘটনা। সৃষ্টির পেছনের নানা সমস্যার কথা এবং সমাধানের উপায় খুঁজে বেড়ানোর নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ভাবা যায়, আর্টস্কুলের এক বনভোজনে কবি জসীম উদ্দীনের সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান। আমরা গিয়েছি ময়মনসিংহের মধুপুরে। সময়টা গ্রীষ্মের ছুটির অবকাশে। 888sport appsের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীদের বাড়িতে আমাদের ডেরা। মধুপুরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সে কী তুমুল বৃষ্টি! সবাই আমরা গৃহবন্দি। ছবি-অাঁকা মাথায় উঠেছে। সারাদিন গল্পগুজব আর গান-শোনা। সঙ্গে ছিলেন জসীম উদ্দীনের শিষ্য হারমোনিয়াম কাঁধে আবদুল আলীম। জসীম উদ্দীনের কাছ থেকে গান তুলছেন আবদুল আলীম। জসীম উদ্দীন ভাঙাগলায় এক লাইন গেয়ে যান, আবদুল আলীম সেটি গলায় তুলে নেন। সেই আবদুল আলীমের সঙ্গে আমাদেরও গান গাওয়া। বৃষ্টির দাপটে খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেও একঘেয়েমি এসেছে। লালচালের ভাতের সঙ্গে বেগুনভর্তা আর মাষকলাইর ডাল। দুবেলা। সিগারেটপ্রেমীদের হাতে হুঁকা ঘুরছে। সিগারেট ফুরিয়েছে। এমনি এক অবস্থার মধ্যে জসীম উদ্দীন প্রস্তাব করলেন কবিগান হোক। সবাই একমত, হোক। আমাদের মধ্যে রশিদ চৌধুরীর মোটামুটি একটা ধারণা ছিল কবিগান সম্পর্কে। তাঁর নেতৃত্বে আমরা কজন বন্ধু-বান্ধব, আর কবি জসীম উদ্দীনের নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ। এর মধ্যে জয়নুল আবেদিন এসে ব্যাপারটি দেখলেন। হেসে আমাদের বললেন, ‘কবিকে তোমরা সম্বোধন করবে, ও সাধের পল্লী কবি রে – বলে। তাঁর সম্মানটা রাখবে।’ আমরা মাথা নেড়ে সম্মতি দিই। জসীম উদ্দীন মূল গায়েন। তিনি শুরু করলেন, ‘মরি হায়রে হায়, এই ছিল কপালে, পাঁচশো টাকার বাগান খাইলো পাঁচসিকার ছাগলে।’ পেছনের সঙ্গীরা ধুয়া ধরে। জবাবে রশিদের সঙ্গে আমরা ধুয়া ধরি – ‘ও বগা, ঠগা কলে ঠোক দিও না।’ বেশ জমে উঠেছে গান। গাইতে গাইতে জসীম উদ্দীন উঠে দাঁড়ান। আমরাও দাঁড়াই। আস্তে আস্তে নাচা শুরু করলেন, আমরাও নাচি। কবি নাচতে নাচতে মৃদু মৃদু ধাক্কা দেন। আমরা ভাবি ব্যালেন্স রাখতে পারছেন না। ওমা, তারপর দেখি ধাক্কাটা জোরে হচ্ছে এবং ইচ্ছাকৃত। আর আমাদের পায় কে! আবেদিন স্যারের উপদেশ ভুলে কবিকে রামধাক্কা। কবি চিৎপটাং। লুঙ্গিটুঙ্গি খুলে একাকার। আবেদিন স্যার দৌড়ে এলেন। বকাবকি আমাদের। জসীম উদ্দীন হাসতে হাসতে বলেন, ‘আরে না, না, তোমার ছেলেরা খুব ভালো – আমিই  তো -’, বলে আরেক দফা হাসি। এই যে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা – আবেদিন স্যার ঘটাতেন, পরবর্তীকালে আমাদের খুব কাজে লেগেছিল। আমরা সান্নিধ্য পেয়েছিলাম নাজির আহমেদ, ফতেহ লোহানী, আবদুল আহাদ, অজিত গুহ, জহুর হোসেন চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দিন, আবদুল গণি হাজারী, সরদার জয়েনউদ্দিন, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, আহসান হাবীব প্রমুখের, যাঁদের কথা আমার 888sport sign up bonusর মণিকোঠায় এখনো উজ্জ্বল।

একজন 888sport live chatী শুধু ছবিই অাঁকবে না, ছবির সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরেরও সাধনা করবে। পরিবেশ-সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। একটি জাতির সৌন্দর্য-চেতনায় অবদান রাখবে। রুচি-গঠনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে, যার জন্যে আমার গ্রাফিক কাজে তিনি খুব উৎসাহ দিতেন। বলতেন, ‘আমাদের দেশ অতীব সুন্দর। দেশের মানুষেরা সোনার মানুষ, মোটা ভাত মোটা কাপড়ে সন্তুষ্ট। কোনোকিছুর অভাব নেই। অভাব শুধু রুচির। বিশেষ করে শহুরে মানুষ, যারা সমাজের মাথায় বসে আছে তাদের মাঝেই রুচির দুর্ভিক্ষ।’ এই দুর্ভিক্ষ-নিরসনে সমাজে 888sport live chatীদের ভূমিকাকে তিনি গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশকে ভালো না বেসে, দেশের মানুষকে ভালো না বেসে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। সচিবালয়ের উঁচু সরকারি কর্মকর্তা যে-সমাদরে তাঁর বৈঠকখানায় সমাদৃত, তেমনি ডেমরার জামদানি কারিগরও সমান সমাদৃত। তিনি দেশের মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। এদেশের বিপুল সম্ভাবনার প্রতি ছিল তাঁর অবিচল আস্থা। এদেশ একদিন উঠে দাঁড়াবে, একটি সুখী সুন্দর দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে বিশ্বদরবারে। রৌদ্রালোকিত নদীর ওপারে পৌঁছানোর জন্যে ব্রহ্মপুত্র নদের খেয়াযাত্রীর মতোই ছিল তাঁর প্রতীক্ষা। আমরাও অপেক্ষা করে আছি রৌদ্রালোকিত ওপারের জন্য, অপেক্ষায় থাকব।