জয় গোস্বামীর সঙ্গে গান আর 888sport app download apk নিয়ে …

শুচিশ্রী রায়

৮ জুন ২০০৮। তখন বিকেল সাড়ে চারটে হবে। টেলিফোনের পথনির্দেশ অনুযায়ী যাদবপুরের বেঙ্গলল্যাম্প স্টপেজের পাশ দিয়ে ঠিকঠাক গলিতে ঢুকে পড়েছি কিন্তু গোলমাল এই যে, ঠিক বাড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না। যাই হোক বারান্দাওয়ালা বাড়ি খুঁজতে শুরু করলাম যেই, দেখি কবি একদম সামনের বাড়ির গেটের তালা খুলছেন ‘এইমাত্র আপনাকে দেখেই দরজা খুলতে এলাম’। আমার সঙ্গে জয় গোস্বামীর একবারই মাত্র দেখা হয়েছে, তাও প্রায় বছর পাঁচ ছয় কি তারো কিছু বেশি আগেই। কুমারমামার বাড়িতে। সেদিন মনে হলো সামান্য স্বাস্থ্য ফিরেছে। ছোট বসার ঘরটি ছিমছাম সাজানো। ঢুকতেই বারান্দায় বেশকিছু টবে ঘরোয়া গাছ। বারান্দা আর ঘরের মাঝে বড় চওড়া কাঠের ফ্রেমের দরজা কাচে মোড়া। ঘরে ঢুকেই ডানহাতে একটি বড়সড় আরাম কেদারায় অবিন্যস্ত বেডকভার। আন্দাজ করলাম কবি এখানেই কাটাচ্ছিলেন সময়। বাঁদিকে অল্প জায়গা নিয়ে ইংরেজি এল-এর মতো গদিওয়ালা বসার জায়গা। ডানদিকের দেয়ালে নীলের প্রাধান্যসমেত এক 888sport promo codeর কোমর পর্যন্ত হাতে আঁকা ছবি। দরজার পাশে কম্পিউটারের সিডি বা ফ্লপি ঢোকানোর অংশ খুলে রাখা আছে। কবি হলদে গেরুয়া খদ্দরের, হাঁটুর নিচ অবধি পাঞ্জাবি পরা। এটি বাড়িরই একতলা, ফ্ল্যাট নয়। অতিথিদের বসার জায়গা থেকে বাইরে তাকালে বেশ গাছ-গাছ সবুজ দেখা যাচ্ছে। এই ঘরের মধ্যেও ছোট ছোট টবে দু-একটি গাছ রয়েছে। জয়ের স্ত্রী কাবেরী বউদি আমাকে চিনলেন। ঘরে আরো দুজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা ছিলেন। কাবেরী বউদি বললেন, ‘এঁদের নিয়ে ভেতরে যাই, তোমার তো ইন্টারভিউ চলবে।’

জয় – আরে না না, ইন্টারভিউ নয়। ওই একটু কথা বলব ওঁর সঙ্গে। তোমরা ভেতরেই যাও।

শুরুটা একটু অপ্রস্তুতেই কাটল আমার। সাধারণ কিছুটা অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ, এই এ-বাড়িতে কতদিন এলেন, আমি এখন যাদবপুরেই, কুমারমামা তো চলে গেলেন, এইসব। খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আমি আমার আসার কারণ ও কাজের ভাবনার কথা জানালাম।

জয় – (চুপচাপ। একটু যেন বিরক্ত, কিছুটা সন্দেহী) আমি কী বলব বলুন তো এ-ব্যাপারে। ওই আপনি যা যা বলছেন সবই ভীষণ সত্যি বলছেন। এই রাগ মানে একটি মানুষ… আমিও ওইভাবেই ভাবি।

শুচিশ্রী – একটা অনুরোধ, একটু রেকর্ডারটা চালিয়ে দিই? আপনার ভাষা আর আমার ভাষা তো এক নয়, তাই।

জয় – না না, শুনুন। বলতে বাধা নেই, আপনার মতো এত প্রস্তুত কোনো মানুষকে আমি এর আগে ইন্টারভিউ দিইনি। সেদিন ফোনে আপনি বিষয়টি বলতে চেয়েছিলেন। আমি অফিসের তাড়ায় ছিলাম, শোনা হয়নি। এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি। খানিকটা তৈরি হয়ে থাকতে পারতাম। যাঁরা আমার ইন্টারভিউ নিতে সচরাচর আসেন, তাঁরা আমার পরই কোনো গমচাষির ইন্টারভিউ নেবেন, মুদির নেবেন হয়তো, তারপর কোনো অভিনেতার নেবেন। আমার সম্বন্ধে কাগজে যা কিছু বেরোচ্ছে, একটু দেখে-টেখে আমাকে প্রশ্ন করেন তাঁরা। আমার বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করেন সেই বিষয়ে কিছু না জেনেই। আমার তাতে তাই কোনো সমস্যা হয় না। আপনার ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। আর গানটা তো আমার বিষয় নয়, টেকনিক্যাল দিক দিয়ে –

শুচিশ্রী – আমি টেকনিক নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আপনি ভিন্ন মাধ্যমের মানুষ এবং আমি জানি আপনি আদ্যোপান্ত একটি গানময় মানুষ (ওঁর ‘মারোয়া’ আর ‘পুরিয়া ধানেশ্রী’ থেকে অংশবিশেষ বলি)।

জয় – আপনি এগুলো খুঁজে বের করেছেন? আশ্চর্য!

শুচিশ্রী – আপনার অনুভবের কথা জানতে চাইছি।

জয় – বলুন কী জানতে চান?

শুচিশ্রী – একটু টেপ করি?

জয় – না, শুনুন, আজ আমরা এমনি কথা বলি। এই মুহূর্তে কয়েকজনের সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার। তারা যদি এই আলোচনা শুনতো, কত যে উপকৃত  হতো। আজকের কথা আপনি শুনুন। আপনি এত সত্যি বলছেন, আপনাকে তো আমি মিথ্যে কিছু জানাতে পারব না! আর অনুভূতির কথা বলতে গেলে অনেক উদাহরণ এসে যাবে। তার মধ্যে যা কিছু আপনার পছন্দ হবে, প্রয়োজনীয় মনে হবে, পরের দিন আমাকে মনে করিয়ে দেবেন, আমি সেগুলোই আবার বলব, তখন আপনি রেকর্ড করে নেবেন, আজ নয়।

(এর মধ্যে চা এলো। বেশ বড় কাপে। জয়ের কাপটি নীল। কবি আরাম চেয়ার ছেড়ে আমার প্রায় তিন হাতের মধ্যে এসে বসেছেন। গোড়ার আড়ষ্ট ভাবটা অনেক কেটে গেছে। অনেক সহজ এখন। মনে হলো কবি খোলসটি ছেড়েছেন।)

শুচিশ্রী – গান, রাগসংগীত যখন শুনতে শুরু করেন তার কাছে আপনার কী চাহিদা থাকে? এই যে আপনার লেখায় দুটি রাগ, কেনই বা পুরিয়া ধানেশ্রী, কেনই বা মারোয়া? আপনি সংগীতচর্চা করেননি বলে ধরেই নিতে পারি, রাগের গ্রামার সেভাবে আপনি জানেন না। তবে কোনটি আপনাকে ভাবায়?

জয় – আপনার এই প্রশ্নের উত্তরে আমাকে একটি গল্প বলতেই হবে, মানে সত্যি ঘটনা। এক কবি তাঁর এক পাঠিকার কাছ থেকে চিঠি পান। চিঠিটি আসে সুদূর শিলচর থেকে। খুব ঘন ঘন যে পান তা নয় তবে বছরে একবার তো পান-ই। কবির প্রত্যেকটি লেখাই ওই পাঠিকা পড়েন এবং সে-বিষয়ে লেখেন। তারপর হঠাৎই চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন যাবৎ। এর মধ্যে কোনো একটি ছেলে কবির সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে ফোন করে। তা এমন ঘটনা তো নতুন কিছু নয়, তাই স্থির হয়, কোনো এক রবিবার ছেলেটি আসবে সকাল এগারোটায়। সেই দিন কবি অপেক্ষায় আছেন। ডোরবেল বাজে। কবি দরজা খোলেন। সামনে একটি কমবয়সী ছেলে আর তার পিছনে একজন মহিলা। বয়স খুব যে বেশি তা নয়। কপালের ওপর থেকে দু-তিনটি সাদা চুলের গোছা পিছনে চলে গেছে (জয় আঙুল নিজের কপালের ওপর থেকে মাথার পেছন দিকে নিয়ে গিয়ে দেখান)। এই সাদাটা অকালের সাদা বলেই মনে হলো। মহিলা বললেন, উনি শিলচরে থাকেন। কবি বললেন, ‘আপনিই তবে চিঠি লেখেন?’ ‘হ্যাঁ’। ‘তা বহুদিন লিখছেন না যে!’ এরপর অনেক কথা হলো। তারপর ধীরে ধীরে জানা গেল মহিলা কাজ করতেন কোন এক পোস্টঅফিসে। ওঁর মাথায় কিছু সমস্যা দেখা দেয়। তা থেকে তাঁর দৃষ্টিশক্তি কমে আসে। অফিসের কাজকর্ম সহকর্মীদের সহৃদয়তায়ই চলতে থাকে। কিন্তু 888sport app download apk পড়া বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে অবশ্যই লেখাও। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্থির হয়,  অপারেশনের দরকার। এখন সব তৈরি। অপারেশন হবে মাদ্রাজে (চেন্নাইয়ে)। উনি তাই এসেছেন কলকাতায় আত্মীয়স্বজন সবাইকে একবার দেখতে। সঙ্গের ছেলেটি ওঁর ভাইপো। কবির হাতে দিলেন একটি পাজামা-পাঞ্জাবির প্যাকেট। শেষে বললেন, ‘আসলে ডাক্তার বলেছে অপারেশনের পর পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। প্রিয় কবিকে দেখিনি কোনোদিন, আর তো দেখতেও পাব না তাহলে, তাই ভাইপোকে সঙ্গে নিয়ে একবার দেখে গেলাম।’ শুচিশ্রী, জানালা দিয়ে বাইরে চেয়েছিলাম। দুপুরের রোদে সারা প্রকৃতি ধুয়ে যাচ্ছে। তখন তো সারঙের সময়, তাই না? কিন্তু আমি যেন চারপাশে মারোয়াকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। এই তো আমার গানের থেকে পাওয়া।

শুচিশ্রী – রবীন্দ্রনাথ সেই যে বলেছিলেন, বর্ষার অনেক গানেই বর্ষার রাগে সুর দিতে পারেননি তিনি। সেও বোধহয় এমনই কোনো একটা জায়গা থেকে। আচ্ছা, আপনাদের লেখার ক্ষেত্রে পোয়েটিক ফ্রেঞ্জি বলে একটা কথা আছে। যেন আপনি নিজে লিখছেন না। কেউ একটা ভর করেছে আপনার ওপর আর সে-ই আপনার হয়ে লিখে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস, মহান গাইয়ে-বাজিয়ের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়।

জয় – হয় হয়। তবে সবার যে হবে এমন নয়। আর প্রায়ই যে হবে তাও নয়। আমার একটি 888sport alternative link আছে সঁাঁঝবাতির রূপকথা। আটাশ দিনে একটানা লেখা। তখন আমার এরকম হয়েছিল। তাতে বহু জায়গা এমন আছে যেমনটা আমি লিখতে চাইনি কিন্তু লেখা হয়ে গেছে।

শুচিশ্রী – শক্তির অনন্ত নক্ষত্রবীথির মতো…

জয় – ওহ্, আপনি এসব জানেন! কী কা-! প্রলাপের মতো! স্টাইলটা অনেকটা প্রলাপের মতো।

শুচিশ্রী – যেমন কুমার গন্ধর্বের গান। আচ্ছা, আপনার কি  মনে হয়, খুব সচেতন হয়ে 888sport live chatকর্ম হয় না? সে গান-ই হোক বা 888sport app download apk?

জয় – দেখুন (খুব উত্তেজিত হয়ে) আমাদের বাংলা ভাষা দুজন মহান কবি পেয়েছে, একজন রবীন্দ্রনাথ আর দ্বিতীয় জীবনানন্দ। আপনি যদি দুজনের পা-ুলিপি দেখেন! ওহ! কেটে-কেটে শতচ্ছিন্ন করা। এত কাটা! এত কাটা! রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা খুব সুন্দর তাই বোঝা যায় আর জীবনানন্দের খারাপ বলে বোঝা যায় না। রক্তকরবী লেখার চার বছর আগে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়ে গেছেন। অতএব তিনি স্বীকৃত কবি। তিনি তখন যাই লিখুন না কেন, মানুষ পড়বে। রক্তকরবী লেখার পর এগারোতম প্রুফে গিয়ে সেটি ছাপা হলো। ভাবতে পারেন? অতবার উনি কেটেছেন। সংশোধন করেছেন। কেন? যদি সচেতনেই লেখা হতো, তবে তো সংশোধনের প্রশ্নই উঠত না। জীবনানন্দের ধূসর পা-ুলিপির স্ক্রিপ্ট যদি দেখেন, এক জিনিস। কেটে-কেটে ছিন্নভিন্ন। ওই একই কারণে। (এই পর্যায়ে আসার পর আমার বলার অংশ কমে আসছিল। কবি এতটাই উত্তেজিত, অনুভূতি-আবেগে আবিষ্ট, যে ক্রমাগত বলেই চলছিলেন আর এমনটাই তো আমি চেয়েছিলাম।)

আপনাকে বলাই যায়, মানে আপনাকে বলতেই হবে (মাথা নেড়ে, খুব উত্তেজিত)। না না, আপনাকে মিথ্যে বলা যাবে না আর আমার ভয়-ই বা কিসে? আমি তো গান গাই না আর গান আমার বিষয় নয়। আবার একটা ঘটনার কথা বলছি। এতে হয়তো প্রসঙ্গটা অনেক বড় হয়ে যাবে অহেতুক কিন্তু এভাবে না বললে আপনাকে বোঝাতেও পারব না। আপনি হাততালি দেওয়া বাবা-মা-র নাম শুনেছেন।

শুচিশ্রী – হাততালি দেওয়া! না তো!

জয় – সে কি? শুনুন আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। একজন নামি অল্পবয়সী 888sport live chatী গান করছেন কলকাতার কোনো একটি বিশেষ হলে। তান শুরু করেছেন। একবার একটি তান করলেন আর হলের অধিকাংশ মানুষ হাততালি দিয়ে উঠল। দ্বিতীয়বার আবার করলেন, আবারো হাততালি। তৃতীয়বারও তাই। এবার চতুর্থবারে উনি তানটি নিয়ে উঠলেন এবং একটি পর্দায় দাঁড়িয়ে গেলেন। শেষ করলেন না। মানে আর আগের মতো ফিরে এলেন না। হাততালির দল একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। কেউ দিলো, কেউ দিলো না। এই দলটিই হলো সেই দল। এঁদের সন্তানরা বিশেষ নামি-দামি সংগীতের স্কুলে গান শিখতে যায় আর এঁরা বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ওই হাততালিটুকু শেখেন। একজন খুব বিখ্যাত 888sport live chatী, শাস্ত্রীয় গানের, প্রথম যখন শুনি তাঁর গান, আহা, কি অসাধারণ কণ্ঠ! কী যে ভক্ত ছিলাম তাঁর। কোথায় কোথায় না গেছি তাঁর গান শুনতে! তাঁর প্রথম রেকর্ড, আহা খুব শুনেছি, খুব। এবার শুনুন। বলব আপনাকে। আপনাকে বলতেই হবে! একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তিনি গাইবেন। আমি শুনতে গেছি। গাইছেন শুদ্ধ কল্যাণ। না না, উনি হারমোনিয়াম বাজিয়েই গাইছিলেন, কী যেন! যাই হোক, ওই বাবা-মায়েরা অনেকেই অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে দাঁড়িয়ে। আমি একপাশে বসে আছি। বেশ লাগছে। সুর ধরেছেন। আমার মনে হচ্ছে ওই রাগ আসছে, ওই রাগ আসছে। তারপর হারমোনিয়াম বাজতে শুরু করল আর তারপরই উনি তান ধরলেন। না না, সরগম শুরু হলো। আমি একটু অসহায় বোধ করছি। ওই বাবা-মায়েরা হাততালি দিচ্ছেন প্রথাগত। বুঝলেন, হঠাৎ, ভাবুন, ভেবে দেখুন (জয় খুবই উত্তেজিত, দুই হাত সামনে এগিয়ে), বললেন, ‘এবার দেখুন, একটাও মিস হবে না।’ শুচিশ্রী! (সোফার পিঠে হতোদ্যম পিঠ এলিয়ে দিলেন কবি) আমি কতখানি হতাশ। আপনি বুঝতে পারছেন? পারছেন তো কি বলতে চাইছি আমি? এতগুলো বছর গানের সঙ্গে থাকার পর তার নির্যাস হলো এই যে, একটাও মিস হবে না। আর ভাবতে পারছি না। না না। মানুষ প্রতিষ্ঠা দেখে বুঝলেন? প্রতিষ্ঠা মানে অর্থ। আর তাই অল্পবয়সীরা ওই গানটিকেই মোক্ষ করেছে। আচ্ছা, আমার আগের বাড়িতে আপনি গিয়েছিলেন না?

শুচিশ্রী – না। আপনার বাড়ি এই প্রথম এলাম।

জয় – আপনার সঙ্গে তাহলে কোথায় যেন দেখা?

শুচিশ্রী – কুমারমামার শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে। সেই প্রথম আর আজ দ্বিতীয়।

জয় – আসলে আমার না মাঝে মাঝে সব অন্ধকার হয়ে যায়। হয়, এরকম হয়। আমি সব গোলমাল করে ফেলি। কখনো কখনো এটা কিছুদিন ধরেই চলতে থাকে। তখন ফোনটাও বন্ধ রাখি। তো যা বলছিলাম। আমি বড় হতাশ! খুবই। আমাদের 888sport app download apkর ক্ষেত্রেও জানেন, এখন বহু কবিই খুব মেপে-জুখে লেখেন। গুনে গুনে। বেছে দেখে। সে সমস্ত লেখাই খুব পরিষ্কার, পরিমার্জিত। যতœ করে লেখা। মানে যে-কোনো ভালো কাগজই প্রকাশ করতে চাইবে এমন 888sport app download apk, কিন্তু ওগুলো ঠিক 888sport app download apk নয়। 888sport app download apk হয়ে উঠছে না, এই একই রকম। ওহ শুচিশ্রী আমার যে কতজনের কথা মনে হচ্ছে যাদের আজ এখানে থাকা খুব দরকার ছিল, খুব!

শুচিশ্রী – সেই আবেগতাড়িত গানের প্রসঙ্গে আসি। আপনার কি এভাবে মনে হয় যে, যে-মানুষটা গাইছেন, গায়কির মধ্যে দিয়ে তাঁরই ব্যক্তিত্বের একটা প্রকাশ পাওয়া যায়?

জয় – সবসময় সেটা প্রকাশ পায় না বোধহয়। সামাজিক জীবনে আমরা অনেক সময়ই এটা করে থাকি, মানে বাধ্য হই, এমন একটা পরিস্থিতি, পরিবেশ, অবস্থার মধ্যে গিয়ে পড়েছি যেখানে আমার মনের ইচ্ছা না থাকলেও হাসিমুখে একটা সৌজন্য বজায় রাখছি। কিন্তু যখন আমরা কোনো 888sport live chatের কাছে আসি, তখন সেই ধরনের সৌজন্য বজায় রাখার কোনো চাপানো দায় থাকার কথা নয়। দুটো জিনিস ঘটতে পারে। এক হলো, দক্ষতাকে কোনো 888sport live chatী মনে করতে পারেন প্রধান। অর্থাৎ সেই 888sport live chatের যে টেকনিক্যাল দিকগুলো আছে তার ওপর যথেষ্ট দখল প্রস্তুত করার জন্য আর দক্ষতার চিহ্নগুলো পরিষ্কার করতেই তাঁরা প্রধানত রেয়াজটা করেন আর আসরে গিয়ে সেইগুলোরই প্রকাশ ঘটাতে থাকেন। এর ফলে আপনি যে-ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টি প্রত্যাশা করছিলেন, সেটা আর কোথাও পরিস্ফুট হলো না। আর অন্যপক্ষে যেটা হতে পারে, এমন দক্ষতাসমৃদ্ধ গান শুনে কেউ মনে করতে পারেন যে, এইটেই হলো গান গাইবার প্রধানতম উপায়। এই দক্ষতার দু-তিনটি ধাপকেই পথ মেনে নিয়ে তিনি চললেন। এ হলো অন্যের প্রদর্শিত পথ। নিজের কোনো খোঁজই সেখানে রইল না। একপক্ষ গেলেন দক্ষতার পথে আর একপক্ষ শুধু কেউ খ্যাতিমান বা প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর অনুসরণ করেই চললেন। ব্যক্তিমানুষটির থেকে আমরা যা চাই কোনো ক্ষেত্রেই তা পেলাম না। আমার ধারণা, যে-কোনো 888sport live chatে – তা নাট্য888sport live chat, কাব্য, সংগীত সবই হতে পারে – দক্ষতাটিকেই 888sport live chatপথের শেষ গন্তব্য বলে অনেকেই ধরে নেন। যিনি যত দক্ষতা প্রদর্শনে সমর্থ, তিনি তত বড় 888sport live chatী।

শুচিশ্রী – সেই 888sport live chat কি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়?

জয় – এইটা আমরা বলতে পারি না, তবে এটুকু নিশ্চিত জানি যে, দক্ষতার বৃত্তে যে-888sport live chat ঘুরে মরে, সে আর বৃদ্ধি পায় না। আসলে দক্ষতার বিষয়গুলো আমার 888sport live chat-প্রকাশের পথে যখন যেভাবে যেখানে দরকার হবে আমি তুলে নেব, নিয়ে আমার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাব, এটাই হওয়া উচিত।

শুচিশ্রী – চিত্র888sport live chatীর তুলির মতো।

জয় – হ্যাঁ। আমি গাড়িতে করে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি, একটা পথে যাচ্ছি, যদি পথের চাইতে, গন্তব্যের চাইতেও গাড়ি আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট হয়, তবে তো আমার যাওয়া হলো না আর। গাড়িতেই বসে রইলাম তবে। যেহেতু চমৎকৃতি অর্থাৎ অন্যকে, আপাতভাবে সর্বসাধারণকে মুগ্ধ করবার ক্ষমতা দক্ষ 888sport live chatীর থাকে তাই যারা 888sport live chatযশপ্রার্থী বা যারা 888sport live chatে নাম করতে চান, তাদের মনটা ওইদিকেই চলে যায়। মনে করেন এই চমৎকৃতিই হলো সংগীত।

শুচিশ্রী – এখন কি গান শুনে বা লেখা পড়ে মনে হয় একই জিনিস হচ্ছে ঘুরেফিরে?

জয় – জানেন, কেউ কেউ সংগীতচর্চার মধ্যে ঢুকে বারবার ভাবতে থাকেন, আমার নিজের জন্য অন্য কোনো পথ দরকার। তখন আমি 888sport app ঘরানা থেকে কিছু কিছু নিলাম। নিয়ে নিজের একটা পথ তৈরি করলাম। পুরনো বড় 888sport live chatীরা অনেকেই কিন্তু এমন করেছেন। আমরা আমীর খাঁ সাহেবের কথা বলতেই পারি। আমার ছোট মুখে বড় কথা শোনালেও আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব যা বাজাতেন ঠিক সেই বাজনাটাই কিন্তু আলি আকবর খাঁ বাজান না। বাজান না বলেই কিন্তু উনি চলে গেছেন আরো অনেকদূর। গুরু পথটা শুরু করে দেন, তারপর শিষ্যকে খুঁজতে হয়। দক্ষতা একটা জানা জিনিস আর সংগীতের পথ একটা অজানা জিনিস। যখন একজন 888sport live chatী রাগের বিস্তার করছেন, তখন তাঁর কাছে নতুন জিনিস আসছে। ওই পথটা কেবল তখনই দেখা যাচ্ছে। এই যে তক্ষুনি তক্ষুনি সৃষ্টি হওয়া, এই যে আশ্চর্য, এই যে অপ্রত্যাশিতের আবির্ভাব, এইটি থাকে বলেই সংগীত এত আশ্চর্য! এত সুন্দর। দক্ষতার মধ্যে প্রত্যাশিতের চমক আছে। তার সীমাও আছে। কিন্তু 888sport live chatের মধ্যে দিয়ে যে যায় সে অজানার মধ্যে দিয়ে যায়। নতুন রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ কিছু খুঁজে পেলেন, আবার নাও পেতে পারেন। এই যে খুঁজতে যাওয়ার ঝুঁকি তার চাইতে দক্ষতার নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাকে অনেক শ্রেয় বলে মনে করেন অনেক 888sport live chatী। সেই একটা কারণও হতে পারে যে, সকলের গান শুনেই মনে হয় একইরকম শুনছি তারা ভাবেন অন্যের গান শুনে। বিভিন্ন কলাকৌশল আর চমৎকৃতি দেখে ভাবেন আর পথ খোঁজাখুঁজিতে গিয়ে কাজ নেই, যা প্রতিষ্ঠিত তাই করি।

শুচিশ্রী – আপনার 888sport app download apk ও আপনি কীভাবে রাগসংগীত দ্বারা প্রভাবিত? আপনার ‘মারোয়া’ 888sport app download apkটিতে রাগ মারোয়ার বিষাদ এত প্রগাঢ়ভাবে এসেছে। আপনার 888sport app download apkর ছত্রে ছত্রে গান। শাস্ত্রে রাগের একটা চেহারা দেওয়া থাকে। আমরা যখন শিখতে শুরু করি, যদি আমার ভেতরের বোধ ঠিক জেগে থাকে, তাহলে সেই গিভন্ ছবি নিয়ে রাগের রূপ সম্বন্ধে আমাদের একটা ভাবনা শুরু হয়। আপনার মতো একজন দক্ষ শ্রোতার কাছে কোনো একটি রাগ আপনার ভাবনা-অনুযায়ী মূর্ত হয় নিশ্চয়ই? আপনি গান শেখেননি তাই ধরেই নিতে পারি, শাস্ত্রে লেখা রাগের রূপ আপনি জানেন না, তাহলে কীভাবে মারোয়ার বিষাদ আপনি এত নিবিড় করে অনুভব করছেন? আর এটা কি মনে হয় যে, সুরের চর্চা যারা করেন তাঁরা অন্য মাধ্যমের কাছাকাছি বড় একটা আসেন না? কেন?

জয় – এটাও একটা অজানা জিনিস আর আমার যে বেঁচে থাকা তার মধ্যে গান আছে আর এই বেঁচে থাকাটা থেকেই আমি কোনো 888sport app download apk লেখার চেষ্টা করি। এমন নয় যে, আজই একটা ঘটনা ঘটল আর আমি লিখলাম। যে-ঘটনাগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে আছে মনের মধ্যে তা থেকেই 888sport app download apk লেখা হয়। জীবনে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকেই লিখতে চেষ্টা করি আর তার মধ্যে গানও থাকে। আর দ্বিতীয় হলো গান যা পারে 888sport app download apk সেটা কিছুতেই পারে না। কিছুতেই পারে না। গান কী পারে? মনটাকে ওইখানে নিয়ে যেতে পারে। আমার মনে হয় শব্দ যে-সমুদ্রতীরে গিয়ে নিজেকে সাঙ্গ করে বা থেমে যায়, বিশ্রাম নেয়, সেই বেলাভূমি থেকে শুরু হয় সুরের যাত্রা। সুর হলো সমুদ্রযাত্রী। এই প্রসঙ্গে আমার অন্য একটা কথা বলার আছে। আপনি যদি সমস্ত 888sport live chatের মহান 888sport live chatীদের মুখচ্ছবি পাশাপাশি রাখেন, দেখবেন যাঁরা সংগীতের চর্চা করেছেন তাঁরা যেন একটা উড়ানের মধ্যে রয়েছেন। অলওয়েজ ইন ফ্লাইট। যেন এই পৃথিবীর যাবতীয় নোংরা ধুলো ধোঁয়া থেকে তাঁরা উড়ে গেছেন বহুদূর। একমাত্র বিথোভেনের চোখে সেই আগুনটা দেখা যায়। এই যে এত শান্ত কবি রিল্কে, ওঁর চোখেও দেখবেন একটা তীক্ষèতা। কুঞ্চিত ভুরুর মধ্যে কোথাও একটা অসন্তোষ। সুর ছাড়া অন্য মাধ্যমের 888sport live chatীদের কক্ষনো প্রসন্নভাবে পাবেন না। সুরের 888sport live chatীরা মাটি ছেড়ে উঠে যেতে পেরেছেন আর বাকিরা, শব্দের, রং-রেখার, ধাতু-পাথরের 888sport live chatীরা, সবসময়ই এই মর্ত্যরে মধ্যে অর্ধেক গ্রথিত। পোঁতা রয়েছেন অর্ধেকটা আর যন্ত্রণা পাচ্ছেন। এই যন্ত্রণার ছবিই তাঁদের মুখে দেখা যায়। একজনমাত্র কবি আছেন, যাঁর মুখ দেখলে তাঁকে একজন সংগীত888sport live chatী বলেই মনে হয়, 888sport app সুরের 888sport live chatীদের থেকেও অনেক বড় প্রশান্তি তাঁর মুখে ছড়িয়ে আছে, তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ।

শুচিশ্রী – রবীন্দ্রনাথ।

জয় – ঠিক। আমি ভেতরে ভেতরে রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বড় শব্দ888sport live chatী মনে করলেও আমি বিশ্বাস করি, উনি আদতে একজন সুরের 888sport live chatী ছিলেন। এই গীতস্রোত, সংগীতের এই ধারা তাঁকে সবসময়ই শোক থেকে, যন্ত্রণা থেকে, আঘাত নিন্দাবাদ থেকে উত্থিত করে দিয়েছে। সুতরাং সংগীতের মানুষরা শব্দের কাছে আসবেন না, এটা আমার কাছে স্বাভাবিক আর আমরা যে দুর্ভাগা, এটাও মনে হয়।

শুচিশ্রী – যাঁদের কথা আপনি বলছেন স্বর্গীয় সেই সুরের স্বাদ পেয়ে গেছেন তাঁরা। কিন্তু আমার মতো যাদের এখনো পথচলা শুরুই হয়নি তাদের কী হবে? সুর আর শব্দের মধ্যে যে-ফারাক তাকে অন্তরে নিতে পারলে তবেই না তাকে পেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন? আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীতে রঙের গুরুত্ব অপরিসীম। সাত সুরের সাত রং আর তার স্বরস্থানের উল্লেখ আছে সেখানে। বন্দিশে আছে 888sport live football। গায়কিতে নাটক। আমরা যদি নিজের মাধ্যমকে আলাদা করেই রাখি অন্য 888sport live chatের স্পর্শ থেকে, তাহলে তা সম্পূর্ণ হবে কি?

জয় – দেখুন, একটা মানুষের জীবনে সব অভিজ্ঞতা হয় না। রবীন্দ্রনাথ যেমন অনেক মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করেছেন, সবাই তো তা পারে না। অন্য 888sport live chatের কাছে গেলে অভিজ্ঞতার পরিমাণ বাড়ে। ধরুন, যে-প্রেম আমার জীবনে কখনো আসেনি, আসবে না, যেমন ৭৩ বছর বয়সে গ্যেটে প্রেমে পড়লেন এবং তিনি যে-888sport app download apk লিখলেন,  কিংবা পিকাসো খুব বেশি বয়সে প্রেমে পড়ে যে-ছবি আঁকলেন তা দেখলে বা পড়লে আমার সেই অভিজ্ঞতার একটা ধারণা হতে পারে। মানুষ হিসেবে এই অভিজ্ঞতাপ্রাপ্তি জরুরি। আমার ভেতরে একটি ভাববস্তু আছে আর সেই ভাববস্তু থেকেই তো 888sport live chatটি এগোচ্ছে! সেই ভাববস্তুর সঙ্গে চেনা-অচেনা সব অভিজ্ঞতা যোগ হলে তা আরো নড়েচড়ে ওঠে। আমি একটা গল্প বলছি আপনাকে। আমি একটা 888sport app download apk লিখেছিলাম ‘স্নান’ বলে। তাতে একটা লাইন ছিল, ‘জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোৎস্নার ধারণা দেব বলে এখনো রাত্রির এই মরুভূমি জাগিয়ে রেখেছি’ এটা লিখেছিলাম আমি একটা ঘটনা থেকে। অনেকে ভাবে, এটা আমারই প্রেমের 888sport app download apk। বিথোভেনের একজন বন্ধু ছিলেন, যার ১৮ বছরের মেয়ে ছিল জন্মান্ধ। সেই মেয়ে বিথোভেনকে জিজ্ঞেস করেছিল, জ্যোৎস্না কি? বিথোভেন তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে পারলেন না। তখন বাড়ি ফিরে গিয়ে রাত জেগে তিনি বানালেন ‘মুনলিট সোনাটা’।

সেইটা আমি আমার 888sport app download apkর মধ্যে আনার চেষ্টা করেছি। একদিন আমি আমার লেখার ঘরে বসে আছি, আমার মেয়ে তখন খুব ছোট, সে ছবি আঁকছিল। হঠাৎ আমার কাছে এসে বলল, ‘দেখো আমি ঠাকুর এঁকেছি, তার সামনে ফুল এঁকেছি, ধূপ এঁকেছি, ধূপের ধোঁয়া এঁকেছি কিন্তু আমি ধূপের গন্ধ আঁকবো কী করে?’ এই যে প্রশ্নটা, বিথোভেনের কাছেও এটা ঠিক এভাবেই গেছিল, ‘জ্যোৎস্না কি?’ এখন এটা একটা জনশ্রুতি হতে পারে। আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, এটা কি বিথোভেনকে বোঝার পথ? হতেও পারে, এটা শুধুই একটা গল্প, তবু কী সুন্দর এই গল্প।

শুচিশ্রী – আমাদের সংগীতের ধারাটাই তো বয়ে গেছে গল্পের ওপর। আমরা সত্যাসত্য জানিই না বহু কাহিনির।

জয় – এই কিংবদন্তি বা এই জনশ্রুতি যদি সত্য নাও হয়, তবে এর চেয়ে শুভ্র মিথ্যা আর কিছু নেই। এই গল্প মিথ্যা হলেও জনে জনে কানে কানে আমরা বলে বেড়াব। কারণ এটা সুন্দর। আর 888sport live chat সৌন্দর্য রচনা করতেই চায়। তাই এটা মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক যে, অন্য মাধ্যমের 888sport live chat বা 888sport live chatীর কাছে আমি গেলে তা আমাকে সমৃদ্ধ করবে ভাবনায়, অভিজ্ঞতায়।

শুচিশ্রী – এমন কি মনে হয় যে, বিবাদী স্বর, সেটা রয়ে গেছে কেবল 888sport live chatীকে মুক্তির স্বাধীনতা দিতে? কি প্রয়োজন বিবাদী স্বরের? বিবাদীই যখন তখন তো সে ব্রাত্য। আমরাই তিলক কামোদ শিখেছি বিবাদী পর্দা কোমল গান্ধার দিয়ে। (জয় দেশ রাগের ওপর একটি বন্দিশ গুনগুন করলেন ‘মেহা রে বন বন ডারে’।)

জয় – এই বন্দিশটি আপনি জানেন? খুব চেনা গান। একটু খেয়াল করুন।

শুচিশ্রী – না। এটা আমি জানি না।

জয় – আচ্ছা দাঁড়ান, দিদিকে একবার ফোন করি। শুনুন, আমি একজনকে এক্ষুনি গানটা গাইতে বলছি।  আপনি ফোনে শুনে নিতে পারবেন তো? (মোবাইলে নম্বর ডায়াল করতে থাকেন। ফোন কানে) হ্যাঁ দিদি, জয়। এক্ষুনি আমার দেশের ওই মেহারে গানটা শুনতে ইচ্ছে করছে। ও ভাঙা গলাতেই চলবে। আপনি গান। খুব খুব খুউব শুনতে ইচ্ছে করছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, (ফোনটি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। অপর প্রান্তে একটি বয়স্ক অভিজ্ঞ মার্জিত মহিলাকণ্ঠে দেশরাগে তিনতাল মধ্যলয়ের বন্দিশ শুরু হলো। গলায় চোট আছে। বেশ ধরা ধরা আওয়াজ। তবু আমার অভিজ্ঞ কান অন্তরার পাপিহা শব্দটিতে কোমল গান্ধারের সচেতন প্রয়োগ ঠিক শুনে নিল। গান শেষ হলে সামান্য কুশল বিনিময় দিয়ে কবি ফোন বন্ধ করলেন। পরে আলাপ হয়েছিল, ইনি গৌরীদি।)

জানেন, শান্তিনিকেতনে একটি বাড়ির দোতলায় এক কবি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দুপুর যায় যায়। আকাশে বর্ষার মেঘ নিচ থেকে গাছের পেছন দিয়ে উঠে এসে মানুষটির মাথার ওপর অবধি এসে গেছে। সে এক অপূর্ব রূপ। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি পাখি, সেটা পাপিয়া নয় কিন্তু, এ-ধার থেকে উড়ে ও-ধারে চলে যেতে থাকল আর হঠাৎ-ই কবির পেছনে দরজায় আপনজন এসে ডাক দিলো ‘খেতে চলুন আড়াইটে বেজে গেল!’ বুঝলেন, এই যে বিবাদী কোমল গান্ধার তা ওই পাপিয়ার কপালে কীভাবে লাগল? বুঝলেন তো? ওই যে পাপিহা, বিবাদী পাপিহা (অসম্ভব উত্তেজিত। এত উচ্ছ্বসিত এত সর্বাঙ্গে প্রকাশ তার, যেন নতুন আবিষ্কারের কথা জানাচ্ছেন। চোখমুখ উদ্ভাসিত। খানিক আগে কথার মাঝখানেই সামনের বাড়ির শাটার নামানোর কর্কশ শব্দ হতেই আমার মুখে বিরক্তির ছাপ পড়েছিলো আমার অজান্তেই।)

জয় – ওই যে আপনার বিরক্তি হলো, ওই শব্দে।

শুচিশ্রী – আমার? শব্দ? বুঝতে পারছি না তো?

জয় – ওই যে দরজা নামানোর?

শুচিশ্রী – ও হ্যাঁ হ্যাঁ, হঠাৎ একটা বিশ্রী শব্দ। আপনি বুঝলেন কীভাবে?

জয় – আপনার অসুবিধা হলো তো? আপনি তো গানের সঙ্গে থাকেন আর আমি নন-মিউজিক্যাল মানুষদের সঙ্গে থাকি তাই বুঝতে পারছি আপনার সমস্যা। আমারও হয় কিনা। তা একটাও মিস হবে না দিয়ে এসব কী করে বোঝা যাবে! লাহাবাড়িতে অনুষ্ঠান শুনে ফিরছি, বুঝলেন? অনেক রাত হয়ে গেছে। হোলির অনুষ্ঠান। সে-দিনটি দোলের পরের দিন। ভারি সুন্দর অনুষ্ঠান হয়েছিল। কাফি হোরি হয়েছিল। আর হ্যাঁ হ্যাঁ, ভারি ভালো বাহার হয়েছিল। তা ফিরছি। রাস্তায় কোনো একটি বাড়ির সামনে দুটি বড় বড় গাছ। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। যে-পাতাগুলো এরকম থাকে (হাত নিচের দিকে আড়াআড়ি নামালেন। আন্দাজ করলাম দেবদারুর কথা বলছেন)। আকাশে ভরা জ্যোৎ¯œা। তার আলো গাছদুটির সর্বাঙ্গে চুঁইয়ে পড়ছে। ঝলসাচ্ছে না কিন্তু? খুব শান্ত। আমার হঠাৎ-ই মনে হলো ওই গাছদুটোই বাহার। আহা! (পরম পরিতৃপ্তি দেখা গেল মুখে)। (ফোন এলো। বিরক্ত। আর ফোন ধরব না। ফোন বন্ধ করে দিলেন।)

আমার পরিচিত একটি ছেলে গানটান রেকর্ড করে বুঝলেন? তা সানি টাওয়ারে একবার ভীমসেন জোশীর গান হয়েছিল। সে সেটি রেকর্ড করে রেখেছিল। আমি ভালোবাসি বলে আমাকে সে এসব শোনায়। তা একদিন সেটি শুনতে ছুটলাম তার বাড়ি। ক্যাসেটের ওপর সময় লেখা ছিল আর অমুক রাগ চৌত্রিশ মিনিট এসব লেখা ছিল। মাঝ খামাজের একটি ঠুমরি সেদিন উনি গেয়েছিলেন। আপনি জানেন। বহু 888sport live chatীই সে-গান গেয়েছেন, ‘অব তো শাবন ঘর আজা’। সেটি এই সতেরো মিনিটের মতো হবে। এখন বুঝলেন, না থাক, আপনাকে বলা ঠিক হবে না। ভীমসেন, মানে ঠুমরি, না থাক।

শুচিশ্রী – কোনো অসুবিধা নেই, আপনি বলুন। 888sport live chatী যখন কোনো রাগ গাইছেন সেটি তাঁর আত্মীয়। অনুভবী শ্রোতাও ঠিক সেই অধিকার নিয়েই গান শুনবেন। সেই গান, রাগ তখন আপনার। তাই আপনার পছন্দ-অপছন্দের কথা তো আসবেই।

জয় – ঠিক! উনি আসলে খেয়ালিয়া তো! আমি ওনার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত কিন্তু খেয়াল যতটা আগ্রহ নিয়ে শুনি, ঠুমরি ততটা নয়। বুঝতে পারছেন কী বলতে চাইছি? তা উনি গাইছেন। সুন্দরভাবে ঠুমরি গাইছেন। হঠাৎই নিচের দিকে, নিচের স্বরে নেমে এলেন। তারপর কোমল শুদ্ধ দুটি নি এমনভাবে একবার লাগালেন যে আমার শিহরণ হলো। মিয়াঁ মল্লার যেন! কীভাবে এলো? তারপর আর একবার মাত্র ওইটি করলেন, পুরো গানটিতে আর একবারও করলেন না। আমার যেন অপেক্ষা রয়ে গেল। আমি ছেলেটিকে বারবার ব্যস্ত করতে লাগলাম ওই যে অত মিনিটে মিয়াঁ মল্লার আছে ওইটা আবার দাও। কী বিস্ময় যে অনুভূত হচ্ছিল তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। ছেলেটি বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ ওরকম তো হয়ই! আসতেই পারে মিয়াঁ মল্লার! কিন্তু আমার কেন এরকম হচ্ছে! আমার আর এক 888sport live chatীবন্ধুকে বলতে তিনিও তাঁর মতো করে বোঝাতে লাগলেন। আমার আর এক পরিচিত মানুষ জোগ সাহেবের কাছে শিখেছেন। উনি তো যন্ত্র বের করে বাজাতে শুরু করলেন এবং খানিক পরে বাজিয়েও ফেললেন!। আসলে দীর্ঘ সাধনার ফলে টেকনিকটা তো রপ্ত হয়ই, কী বলেন? কিন্তু আমার প্রশ্ন অনুত্তরেই রয়ে গেল। তারপর বহু বছর কেটে গেছে বুঝলেন? সেই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পূর্বে লেখা শেষ 888sport app download apk ‘প্রথম রবি’। তারপর বিরতির পর বছর বছর পার হলো। ধরুন আপনি ডানকুনি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। একটি দূরপাল্লার ট্রেন আস্তে আস্তে আপনাকে অতিক্রম করছে। আপনি চলন্ত ট্রেনটিতে দুটি চোখ দেখতে পেলেন। ক্রমশ তা অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর আপনিও ভুলে গেলেন, বিস্মৃত হয়ে গেলেন আর কী। আমার ক্ষেত্রেও সেই মিয়াঁ মল্লার তেমনই হারিয়ে গেল। তারপর তখন আমি আনন্দে চাকরি করি। গড়িয়ায় থাকি তখন। বাড়ি ফিরছি। বেশ রাত হয়েছে। একটি বাসে উঠেছি। বসেছি জানলার ধারে। বাসটি ফাঁকা ফাঁকা। ক্যাথিড্রাল রোডের কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ হাওয়া দিলো। আসন্ন বৃষ্টির হাওয়া অথবা বৃষ্টি-ভেজা হাওয়া। কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে, সেই খবর নিয়ে এলো। আমার মনে হলো ছাতা আনা হয়নি। বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হবে জল এলে। ভিজে যাব। আচমকাই সে-ই মিয়াঁ মল্লার দুই নিষাদ নিয়ে এসে দাঁড়ালো। ‘শাবন ঘর আজা’। বৃষ্টির প্রত্যাশা! ঘরে ফেরার প্রত্যাশা! ঘরের মানুষ ফিরে এসো। আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, কেন ওই ঠুমরিতে ওই পর্দা লাগল। ভীমসেন তো 888sport live chatী! উনি তো বুঝেছিলেন! তাই। বুঝলেন, গানের কাছ থেকে এই আমার পাওয়া।

(কবি ছোট টুলে রাখা চায়ের কাপটি নজর করে আহ্লাদিত হয়ে পড়লেন)। বাহ এতে এখনো একটু চা আছে! ইস আমি ভাবতেও পারি না… থাকবে। ওহ কী আনন্দ! (ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন।)

আমি তেজেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কাজ করেছি। উল্লাসজির সঙ্গেও। উল্লাসজির সঙ্গের অনুষ্ঠানটার স্ক্রিপ্ট ছিল আমারই করা। মীনা ব্যানার্জি খুব সাহায্য করেছিলেন। উল্লাসজিকে পড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। উল্লাসজিও অনুভবী মানুষ। খুব ভালো কাজ হয়েছিল। জানেন, তাতে মারোয়া ছিল। শ্রী ছিল। শঙ্করার একটি বন্দিশের আগে উনি ওই রাগে আওচার করছিলেন। আমার এত আনন্দ হচ্ছিল, এত শান্তি হচ্ছিল যে, ওই গান আমি উপস্থিত থেকে শুনতে পাচ্ছি! কিন্তু মারোয়া, বুঝলেন, উনি তো মারাঠিদের মতো অপূর্ব বহেলওয়া করে গাইছেন আর আমি চাইছি স্পেস! ধৈর্য! আমার কান আর মন তো অন্য মারোয়া শুনে অভ্যস্ত! আমীর খাঁ শুনে অভ্যস্ত! বুঝলেন না, কেমন অস্থির লাগছিল। তবে ওঁর গান আমার খুউব ভালো লাগে। যেমন ওই শ্রী কি আর ঝাঁপতালের দুলকি চালে তেমন খোলে? (শ্রীর প্রসঙ্গে কবি বলছিলেন, কেমন পঞ্চম থেকে রেখাবে এসে আবার পঞ্চমে ফিরছিল মীড়। আমি অবাক! এত ডিটেইলে উনি গানটা বোঝেন।)

শুচিশ্রী – ভাবছিলাম জানতে চাইব কেমন গান আপনার পছন্দ? বলুন না যা বলছিলেন -।

জয় – তেজেন্দ্রর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি, বুঝলেন? ও জানে না যে, আমি শিখেছি। ওর কাছে পট বেহাগে ফইয়াজ খাঁর একটা বন্দিশ আছে।

শুচিশ্রী – হ্যাঁ, ‘ঝন ঝন ঝন ঝন পায়েল বাজে।’

জয় – তেজেন্দ্ররা ওটা একটু অন্যভাবে বাজায়। একটি অনুষ্ঠানে আমি অনুরোধ করেছিলাম ওটা বাজাতে। প্রথমে কী একটা রাগ বাজানোর পর তেজেন মুখটি ধরলেন। তবলায় ছিলেন এক প্রথিতযশা 888sport live chatী। সামান্য সুযোগটাই তিনি ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছিলেন আর অনেক কিছু বাজিয়ে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিয়ে সমে  ফিরছিলেন আবার একটুও দম না নিয়েই; আবারও ওই একইভাবে বাজাচ্ছিলেন। আর হলে তাঁর ছাত্র ও ভক্ত888sport free betই বেশি ছিল। তারা গুনতে গুনতে নাজেহাল হয়ে পড়ছিল। আমি সুরটুকু শুনবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ছিলাম। বুঝলেন অবশেষে উনি একটা প্রকা- (মাথার ওপর গোল করে হাত ঘুরিয়ে) চক্রধার নিয়ে এসে শেষ করলেন। আশ্চর্য কী জানেন, তেজেন ওই পুরো সময়টায় বন্দিশটি বাজাতে লাগলেন ঠিক গোড়ায় যে-ছন্দে ধরেছিলেন ঠিক তাতেই! ফেরার পথে আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আচ্ছা আপনি ধৈর্য রাখছিলেন কীভাবে? ওই অসম্ভব শব্দ!’ তেজেন বললেন, ‘আমার ওস্তাদ আমাকে একটা কথা বলেছিলেন যে, এরকম অবস্থায় বন্দিশের মুখটি জপ করবে, তা আমি তাই করছিলাম।’ এ আমার এক বিরাট শিক্ষা শুচিশ্রী। আমার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, কষ্ট-দুঃখের প্রতিটি মুহূর্তে আমি ওই সুরটি জপ করতে শিখলাম। ভুল তো অনেক করেছি জীবনে! প্রচুর না হলেও করেছি। গান আমাকে সেসব কথা 888sport app download for android করিয়ে দেয়। শাস্ত্রীয় সংগীত ধৈর্যশীল হতে শেখায়। স্পেস বুঝলেন? অপেক্ষা। ওই পর্দাটি কখন লাগবে তার জন্যে অপেক্ষা। আমীর খাঁর গানে আমি এটি পাই। কত সময় নিয়ে, কত শান্তিতে উনি একটার পর আর একটা নোটে যাচ্ছেন। অসাধারণ! রশিদ খানের একটি ক্যাসেট আছে আমার কাছে শ্যামকল্যাণের। তাতে ওই কড়ি মধ্যমটি লাগানোর জন্যে যে-সময়টুকু উনি নিচ্ছিলেন তা আমার খুব ভালো লাগে। এতে আমার ভেতরেও তো অপেক্ষা তৈরি হচ্ছে! অস্থিরতা নয় কিন্তু, অপেক্ষা। কারণ আমি জানি, কড়ি মধ্যম এলেই শ্যামকল্যাণ জীবন্ত মূর্ত হবে। রশিদ খান ওই বিশেষ বঢ়হতটি রপ্ত করেছেন, বলুন? সুরবাহারের আলাপও শোনার মতো। আমার কাছে ইমরাত খানের একটি রেকর্ড আছে। এরকমই সুন্দর। রবীন্দ্রনাথের ওই শেষ 888sport app download apkটির কথা বলছিলাম না? ওখানেও ওই যে প্রথম কটি লাইনের পর স্পেস, বুঝলেন। অপেক্ষা। প্রস্তুতি।

শুচিশ্রী – এক সময় এরকম নিয়ম ছিল জানেন যে, বিশেষ বিশেষ রাগের মধ্যলয় বহেলওয়া পর্যন্তই তালিম হতো। দ্রুত তান গাওয়াই হতো না। যেমন ধরুন ভৈরব, শ্রী। ওই ধরনের রাগে দ্রুত তান করার অনুমতিই ছিল না। কোন উপলব্ধি থেকে এমন ভাবনা ভাবুন আর আজ কেনই বা আমরা সেসব বিস্মৃত!

জয় – এমন ব্যাপার ছিল? আশ্চর্য!

জয় – বুঝলেন, গানবাজনা নিয়ে যাঁরা লেখালিখি করেন, যাঁরা এই বিষয়টিকে ঘিরে রয়েছেন, কুমারবাবু খুব ভালো বলতেন যে, এঁদের অন্তরে রস নেই। অত্যন্ত নন-মিউজিক্যাল মানুষ এঁরা। আমি এরকম কারোর কারোর সঙ্গে কাজ করেছি তো বহু বছর, তাই জানি। তবে এঁদের মধ্যে কেউ কেউ খুব বড় শ্রোতা সে-কথা অনস্বীকার্য। আর খবরকাগজের লোকজন কেবলই অন্যকে তাতিয়ে দিতেন। এঁরা কেবলই হাতা গুটোতে শেখাতেন। খালি লড়াই করাবার জন্যে একে তার সঙ্গে লাগিয়ে দিতেন। তা আলি আকবর খাঁ সাহেব (মাথা নাড়তে নাড়তে আহা আহা বলছেন) এসেছিলেন বাজাতে, কলামন্দিরে, এই ’৯৫ সাল হবে। আমি শুনতে গেছি। মারোয়া বাজালেন। খাঁ সাহেবের ’৫৫ সালের একটি রেকর্ড ছিল মারোয়ার। তা কোনো এক বিখ্যাত সমালোচক সেই বাজনাটির সঙ্গে এবারের বাজনার তুলনা করে এবারের মারোয়াটি যে কতটা খারাপ হয়েছে তা বেশ ফলাও করে লিখলেন। যাই হোক খাঁ সাহেব তো বাজিয়ে চলে গেছেন আমেরিকা। এবার অন্য আর এক সমালোচক যার আবার আগেরজনের ওপর বেজায় রাগ, উফ্ এক্কেবারে নন-মিউজিক্যাল লোক, হাঁটাচলা কথাবার্তাতেই বুঝবেন আপনি, পরেরবার যখন খাঁ সাহেব আবার এলেন, তখন তাঁকে ওই মারোয়া বিষয়ে উসকে দিতে চেষ্টা করলেন। খাঁ সাহেব কী করলেন জানেন? ওহ কীভাবে বলি? গাভাস্কার, বুঝলেন, সেই খেলাটি। এভাবে না বললে আর বোঝাতে পারব না। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা। গাভাস্কার খেলছিলেন। ১১ রানে আউট হয়ে গেলেন। ইমরান বল করছিলেন। তারই বলে আউট আর এক্সপার্ট কমেন্ট্রিতে আসিফ ইকবাল। ইমরানের একটি বল গাভাস্কারের বুকের কাছে এলো, কিন্তু বলটি গাভাস্কার ছেড়ে দিলেন। জাস্ট ছেড়ে দিলেন। সে কি অপূর্ব দৃশ্য! আউট হলেন যে বলে সেটি বাদ দিয়ে বারবার ওইটি দেখানো হতে লাগল। (জয় দাঁড়িয়ে পড়লেন। বুকের কাছে ব্যাটের হাতল ধরা জোড় হাতে কাল্পনিক বল ছেড়ে দেখালেন। অনবদ্য পজিশন। ক্রিকেট খেলাটা একসময় আমারও নেশা ছিল তাই শ্যাডো প্র্যাকটিস অল্পস্বল্প বুঝি।) একে বলে অন দ্য টস, বুঝলেন? ঠিক সেভাবে আলি আকবর বলটি ছেড়ে দিলেন। জাস্ট ছেড়ে দিলেন। প্রশ্নটা নিলেনই না। ওহ! বললেন, ‘এরকম বাজিয়েছি? হবেও বা! ’৫৫ সালের মারোয়া আর আজ ’৯৫! কত দিন চলে গেছে! আজকের মারোয়া কি সেই মারোয়া আছে? দিন কত বদলেছে! আমি-ই কি সেই আমি আছি?’ ভাবুন! ইনি হলেন 888sport live chatী। একটাও মিস হবে না দিয়ে তো এর হিসাব মিলবে না! আমি নিজে শুনেছি, বাজাতে বসে বাজনার শেষে উনি মাথা নাড়ছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন, ‘আজ বাজনা হয়নি। আজ বাজনা হলো না। আজ বাজনা হয়নি।’ মানুষ যে শুনতে পাচ্ছে এতে ওঁর কিছুই যায় আসে না। সংগীত যে সামান্য খুঁত ধরা বা ভুল হওয়ার চেয়েও অনেক মহৎ! তবে হ্যাঁ, একেবারে যারা নবীন তাদের জন্যে এ বিষয় নয়। আমারও মাঝে মাঝে হয়, জানেন, তাই আমি বুঝতে পারি। লিখলাম কোনোদিন কিন্তু কিছুতেই লেখা হলো না। জোট বাঁধল না শব্দ। আবার কোনো কোনো দিন যেন ছবির মতো লাইন ধরে লেখা আসতে থাকে। দুটি মানুষ, বুঝলেন, আলাদা, কোনো মিল নেই আপাতদৃষ্টিতে কিন্তু একটি জায়গায় অদ্ভুত মিল বলে আমি বিশ্বাস করি। শম্ভু মিত্র আর আলি আকবর খান। একজন অসম্ভব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারেন আর অন্যজন একেবারেই গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। কথা শুরু করে শেষও করেন না। মাঝপথেই থেমে যান। কিন্তু যে-বিষয় নিয়েই কথা বলুন তাঁরা, তাঁরা কিন্তু কবি। শম্ভু মিত্র নাটক নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেও (হাতদুটি মাথার ওপর লম্বালম্বি তুলে দিয়ে পাটাতনের আকৃতিতে তালু পাতলেন) যেখানে উঠে থামছেন সেটা 888sport app download apk, আর আলি আকবরও তাই। আরেকজন খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারতেন, তিনি (একটু যেন 888sport sign up bonusবিজড়িত হয়ে পড়লেন) সুভাষদা। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অথচ এইসব মানুষকে যেসব প্রশ্ন করা হয়, উফ্, আপনি তো কত নতুন রাগ তৈরি করেছেন, কোনটা আপনার সবচেয়ে প্রিয়? আলি আকবর বলেছেন, ‘আপনার তো দুটি চোখ, বলতে পারেন কোনটা আপনার বেশি প্রিয়?’ দেখুন! দেখুন! কোন জায়গা থেকে লোকটা উত্তর করছে। কিন্তু এরা বুঝলে তো! কতগুলো রাগ বানালেন? কীভাবে বানালেন? খাঁ সাহেব বলছেন, ‘হাজার হাজার রাগ আছে, এটা-ওটা থেকে নিয়েই তো বানিয়েছি! আমি কি আর বানিয়েছি!’ এঁরা তো 888sport live chatী, তাই সংগীত এঁদের কাছে প্রতিদিনের একটা আবিষ্কার। আজীবন সঙ্গ করেছেন রাগের। সুরের। সামান্য ভুল-ঠিক দিয়ে কি এর বিচার হয় নাকি? পুরো বিষয়টাই আনপ্রেডিকটেব্ল। নিজেই জানেন না, কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে নিজের জন্য। সেই যে সমালোচকের কথা বলছিলাম, তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘যখন বাজাতে বসেন সামনে এত সমালোচকেরা বসে থাকে, ভয় করে না?’ স্পর্ধা ভাবুন! আরে, উনি তো রবিশঙ্কর নন! রবিশঙ্কর মনে মনে প্রস্তুত থাকতেন যে, বাজনাও থাকছে আর আমি, রবিশঙ্করও, মঞ্চে থাকছি। একবার বাজনার মাঝে ওনার হাতের টিপ কোন কারণে মিস্ হয়েছিল। উনি সঙ্গে সঙ্গে বাজনা থামিয়ে সামনের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘কাগজের লোকেরা লিখে নিন দশ মিনিট অত সেকেন্ডের মাথায় রবিশঙ্করের টিপ মিস্ হয়েছে।’ বলে আবার বাজাতে শুরু করলেন। আলি আকবর তো তা নন! উনি বললেন, ‘ভয়? ভয় আর কি করবে? ভুলই বা আর কী হবে? গোড়ায় যখন বাড়িতে বাজাতাম, বাবা সামনে বসে থাকতেন বেতের ছড়ি হাতে নিয়ে। প্রতি মিনিটে একটা করে ভুল  হতো, বাবা আঙুলে মারতেন, ভয়ে ভয়ে বাজাতাম। তারপর প্রতি এক ঘণ্টায় একটি করে ভুল হতো। তারপর প্রতি এক সপ্তাহে একটা। তারপর প্রতিমাসে, এই আর কী! তারপর যখন স্টেজে বাজাতাম, বাজাতাম মাথা নিচু করে, ভয়ে ভয়ে, কারণ জানতাম বাবা উইংসে চাদর পেতে বসে আছেন। পাছে ভুল হয় সেই ভয়ে মাথাই তুলতে পারতাম না। তারপর একদিন দেখলাম বাবা উইংসে বসে কাঁদছেন। আজ আর কী ভয় হবে? ভুলই বা কী হবে।’ বুঝলেন, শুচিশ্রী, সবটাই কিন্তু শিশুর মতো স্বগতোক্তি। এতে বিন্দুমাত্র অহংকারের প্রকাশ নেই। শেষে সমালোচক জানতে চেয়েছেন, ‘বাজাতে বসেন যখন, সামনে এত লোক দেখে কেমন লাগে?’ খাঁ সাহেবের উত্তর ছিল, ‘প্রথম যখন বসি তখন সামনে লোকজন দেখি বটে, তারপর তো আমি আর যন্ত্র, যন্ত্র আর আমি, আর কিছুই জানি না।’ বুঝলেন, শুচিশ্রী, ছুটলাম সেই সমালোচকের কাছে। বললাম অসাধারণ লেখা হয়েছে ভাই। খুব সুন্দর খুব সুন্দর। সে তো পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়েই আছে, ‘দারুণ হয়েছে না? আরে উনি তো আরো অনেক কিছু বলেছিলেন। ওই শেষটায় বলেন কী, যন্ত্র আর আমি আমি আর যন্ত্র, আর কেউ নেই। বাতাসে প্রেম ভাসছে। ওইটা প্রচুর অ্যাবস্ট্ররক্ট হয়ে যাচ্ছিল ভাই, তাই আমি বাদ দিয়ে দিয়েছি।’ হায় ভগবান! (বাস্তবিক কপাল চাপড়ান জয়) শুচিশ্রী, বাতাসে প্রেম ভাসছে, এই কথা বলেছে লোকটা! আর ও সেটা বাদ দিয়ে দিয়েছে! ওহ্। ভাগ্যিস আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তবে না এটা জানতে পারলাম? এই কথাটি আমার সারাজীবনের সম্পদ হয়ে রইল। জীবনানন্দের বনলতা সেন, এইভাবেই বলা যায়, জীবনানন্দকে প্রকাশ্যে আনেন বুদ্ধদেব বসু। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। বনলতা সেনের পর বহুবছর কেটে গেছে। যুদ্ধ হয়েছে। মহামারী হয়েছে। জীবনানন্দের পরবর্তী লেখার প্রবল সমালোচনা করলেন বুদ্ধদেব বসু নিজেই। ওঁর চাহিদা ছিল বোধহয় আবার একটা বনলতা সেনই লেখা হবে। লেখা উচিত। যেন লেখাটি একটি ছাঁচ। বছর বছর পরেও অপরিবর্তিত সেই ছাঁচই থাকবে! সেই ’৫৫ সালের মারোয়ার মতো। জীবনানন্দও তো বদলেছেন। বদলেছে সময়, মানুষ, প্রকৃতি। এই সময় তিনি একটি লাইনকে দীর্ঘ করতে লাগলেন। একটু টেকনিক্যাল কথা বলি। আগে মূলত ১৮ শব্দে লিখতেন, এখন ২০, ২৪, ৩০ এমনকি ৩৪ অবধি দীর্ঘ করলেন এবং তা স্পেস দিয়ে দিয়ে। এটিই 888sport live chatীর স্বভাব।

শুচিশ্রী – আচ্ছা আপনার কোন রাগ ভালো লাগে বলুন তো? সবচেয়ে বেশি?

জয় – আমার? আসলে… সহজ রাগ…

শুচিশ্রী – বলুন না, আমার যেমন শুদ্ধ পর্দার প্রাধান্য যেসব রাগে, সেসব রাগ বেশি প্রিয়। এই যেমন আলাহিয়া বিলাবল।

জয় – ওহ্, শুচিশ্রী, আমি এক্ষুনি আপনাকে বিলাবলই বলতে যাচ্ছিলাম। কী সুন্দর। কী অপূর্ব। সহজ রাগ আমার বেশি ভালো লাগে।

শুচিশ্রী – এই যে ঘরানা বস্তুটি, এই যে একটি রাগেরই ভিন্ন ঘরানার ভিন্ন ভিন্ন ইন্টেরপ্রিটেশন, আমার মনে হয়, ঘরানাদার 888sport live chatীরা পারিবারিক বা তালিমের সংস্কার হিসেবে এই দর্শন বা রাগবোধকে পেতেন। কিছু না বুঝেই, না জেনেই প্রশ্নাতীতভাবেই দাদাজি বা নানাজির গায়কি অনুসরণ করে যেতেন আর তাতেই সেই ঘরানার রাগের একটা নিজস্ব চেহারা অদ্ভুতভাবে প্রকাশ পেত। এখন তো আর ঘরানা নেই, যতই না কেন আমরা ঘরানাদার বলে নিজেদের প্রমাণ করতে চাই। আপনার কি মনে হয় যে, সাংগীতিক বোধ বা সংস্কার পারিবারিক বা উত্তরাধিকারসূত্রে না পাওয়ার যে অভাব তা আমরা কিছুটা মেটাতে পারি অন্য মাধ্যমের 888sport live chatের সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে? মানে ছবি, 888sport app download apk, 888sport live football, ফিল্ম – এরা আমাদের উপলব্ধির অভাবের গোড়ায় জল আর সার দিতে পারে কিন্তু আমরা সেটা উপেক্ষা করছি?

জয় – ঠিক বলেছেন। একদম ঠিক। আমার ভয় হচ্ছে আপনার জন্য, জানেন, কারণ আপনি মারাত্মক সত্যি বলছেন আর দলছুট ভাবনা ভাবছেন। আপনার আশেপাশের মানুষ কিন্তু এভাবে ভাবছেই না। জীবনসঙ্গী ছাড়াও মানুষ বাঁচে কিন্তু চিন্তাসঙ্গী ছাড়া বাঁচে না, শুচিশ্রী। জানেন, ট্রুথ এক জিনিস আর রিয়্যালিটি আর এক জিনিস, অথচ দুটিই চরম। যেমন এখন অন্ধকার। সূর্য নেই তাই তো? এটা রিয়্যালিটি; কিন্তু সূর্য যে রয়েছে তা তো সত্য! সেটা ট্রুথ। আপনি যা বলছেন, তা একসঙ্গে ট্রুথ এবং রিয়্যালিটি। আপনার সঙ্গে কয়েকজনের আলাপ হওয়া এই মুহূর্তেই যে কত জরুরি ছিল!

শুচিশ্রী – আমরা মাঝে একটা প্রসঙ্গ ফেলে এলাম। মারোয়া নিয়ে কথা বলছিলেন আপনি। কেনই বা মারোয়া? (প্রসঙ্গত এটি দ্বিতীয় দিনের আলাপচারিতায়। কবি সেদিন একটু মনখারাপে ছিলেন কোনো কারণে, বা হয়তো অকারণেই)।

জয় – আজকে আমি ঠিক নেই। আজকে আমি মারোয়া ঠাটের বসন্ত বুঝেছেন? শুদ্ধ বসন্ত আছে না? আজ আমি তাই। এমন বসন্ত যাতে পঞ্চমই নেই (হাসি)। খামাজ আমার খুব ভালো লাগে, জানেন! আজো আপনাকে একটা গল্প বলছি তবে সেটা খামাজ নয়, মারোয়া সম্পর্কে। আমার অন্যতম প্রিয় রাগ। ’৭৭ সালে দেশ পত্রিকা যখন অফসেট হলো, তখন তাতে নিয়মিত বেরোতে লাগলো রবিশঙ্করের ‘রাগ-অনুরাগ’ আর তাতে উনি দুটি 888sport free betয় পরপর আমীর খাঁর মারোয়ার রেকর্ডটার খুব প্রশংসা করলেন। সেটা ’৭৮ সাল। আমার মাথায় ঢুকল যে, ওই মারোয়া শুনতে হবে। তার আগে আমি ওটা কখনো শুনিনি, তাই আমার কোনো ধারণাই নেই। আমি সুবদ্ধ সংগীত শুনতাম। রেডিওতে বড় বড় ক্ল্যাসিক্যাল রিসাইটেল হতো, তা শুনেছি। আমাদের রানাঘাটে গানের খুব চর্চা হয় কিন্তু মারোয়াটা কখনো শুনিনি। আর এই শোনা বলতে কী বোঝায়, জানেন তো, মানে যত বয়স বেড়েছে আমি শোনার তীব্রতাটা অনুভব করেছি। আমার রক্তের মধ্যে এই গান শোনাটা ঢুকে পড়েছে। তা আমি মারোয়া শোনার জন্য পাগল হলাম। আমি ভাবছি এটা একটা দারুণ আনন্দের কিছু হবে, মানে ধরুন, পবন দিওয়ানি কিংবা নট বেহাগের ওই গানটা, মানে যা আপনাকে একেবারে মাতিয়ে দেয়। খুঁজে খুঁজে একটা ছেলে পেলাম যার বাড়িতে ওই মারোয়ার রেকর্ড আছে। সে থাকে কাঁকিনাড়ায়, আমাদের রানাঘাট থেকে ৫০ মিনিটের ট্রেনের পথ। শীতকালে, ডিসেম্বর মাসে আমরা তিন বন্ধু দুপুর একটা চল্লিশের ট্রেনে রওনা দিলাম। নৈহাটি স্টেশনে এসে ট্রেন থেমে গেল, থেমেই রইল। ওভারহেডে কারেন্ট নেই। ধৈর্য আর নেই। উৎসাহের চোটে ট্রেন থেকে নেমে আমরা লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। অনেক খুঁজে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট হেঁটে ক্লান্ত হয়ে শেষে ছেলেটির গঙ্গার ধারের বাড়ি পৌঁছলাম। সে আমাদের বাড়িতে ডেকে ঘরে বসাল। তখন ঠিক সাড়ে চব্বিশ বছর বয়স। ছেলেটি ঘরে এলো এবং রেকর্ডটি চালাল। আপনি হয়তো ভাবছেন এত ডিটেইলে বলার কী দরকার? দরকার আছে, শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন। হ্যাঁ, ছেলেটিকে একটি মেয়ে ডাকতে এলো। আমরা যে-জায়গায় বড় হয়েছিলাম সেই জায়গায় সেই সময় বান্ধবী থাকা মানে একটা সাংঘাতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠা। স্বীকৃতি। ও বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলছে। হাসিঠাট্টা করছে। পর্দা একটু সরানো। আমরা ভেতরে বসে সব দেখছি। মেয়েটাও খুব খুশি যে, ঘরে তিনটে ছেলে রয়েছে এবং তাকে দেখছে। ছেলেটিও খুশি যে, ওর বন্ধুদের সে দেখাতে পারছে যে, তার একজন বান্ধবী আছে। খানিকক্ষণ কথা বলার পর ভেতরে এসে রেকর্ডটা চালিয়ে দিয়ে আবার চলে গেল। গানটা শুরু হলো। তখন সন্ধে সোয়া পাঁচটা হবে। এবার আমি গানটা শুনছি আর ভাবছি এটা কী রে? এর জন্য এতখানি কষ্ট করে এলাম! ছিঃ ছিঃ! ২০ মিনিটের সেই রেকর্ড শেষ হলো। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি এসে জিজ্ঞেস করল ‘কি, আবার দেব?’ আমাদের মধ্যে একজন অত্যুৎসাহী বলে উঠল ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দাও না, দাও।’ বাজতে শুরু করল আবার। বসে বসে শুনতে লাগলাম। অত্যন্ত হতোদ্যম। দারবারি কানাড়াটা কিছুটা ভালো লাগল। ফিরে আসবার পথে কেউ একজনও ওই মারোয়া সম্বন্ধে একটা বাক্যও বললাম না। ভাবুন, এক বছর ধরে খোঁজ চলছিল সেই মারোয়ার! এই বিশ বছর পরে ’৯৯ সালে আমি বুঝতে পারলাম! আস্তে আস্তে বুঝলাম। আপনি সেই সময়টা, সেই অবস্থার কথা ভাবুন। আমরা অতখানি পথ হেঁটেছি! তারপর গঙ্গার ধারে গেছি! তারপর, একটা ২৪ বছরের ছেলে আমি, তার কোনো বান্ধবী নেই এবং হবার সম্ভাবনাও নেই, সে দেখছে ওই ছেলেটির সৌভাগ্য! ওই ছেলেটির বাবা ছিলেন বড় অফিসার আর এসব তার গর্বের ব্যাপার ছিল যে, সেই সময় তার বাড়িতে সব ভালো ভালো রেকর্ড আছে! আমরা অত ক্লান্তি নিয়ে বসলাম। ওর বাড়ির ওই অবস্থাপন্ন অবস্থা, ওই মেয়েটির আসা, ওদের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া। এবং শীতের ওই বিকেলের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে হালকা হয়ে এসেছে। ঈশ্বর আমাকে মারোয়াটা সারাজীবনের মতো বোঝাবেন বলে প্রথমেই ওইরকম একটা অবস্থা তৈরি করে দিয়েছিলেন। বুঝেছেন, বিষাদের সমস্ত উপকরণ সেখানে উপস্থিত ছিল। ওই যে অবসাদটা আমার আসছে, ওই যে ধা-এর সঙ্গে কড়ি মধ্যম আর কোমল রে – এদের মিশ্রণ যখন হয়, তখন শরীরের মধ্যে কী রকম তীব্র একটা অবসাদ আসে না! মনে হয় শরীরটা এখুনি পড়ে যাবে! এই জিনিসগুলোই তখন ওখানে ঘটছিল আর আমি ভাবছিলাম এটা কী শুনছি!!! আর আমীর খাঁর বড়হত তো জানেনই। একটা সুরে পুরো একদিন দাঁড়িয়ে। পরের সুরে যেতে আবার ঠিক ততক্ষণই। একটা নতুন লোকের পক্ষে এটা নিতে পারা! সে ভাবছে, এ বাবা, এর জন্য এত কিছু করলাম! আজ ২০ বছর পর আপনি আমার লেখায়, কথায় কথায় মারোয়া দেখতে পাবেন। মা যখন বীজটা শরীরে ধারণ করেন, মা-ই মাত্র বুঝতে পারেন। পিতাও বুঝতে পারেন না। মা গ্রহণ করেন। রেখে দেন। আগলে আগলে রাখেন, ‘বাঁচাতে হবে।’ এই এত বছর ধরে বাঁচানোর পর এখন মারোয়া আমার সামনে, আমাকে ফল দিচ্ছে। এখন আমি মারোয়া শুনতে পারি। আগে শুনতেই পারতাম না! এত কষ্ট হতো! ঠিক যেমন শ্রী-র ওই পড়ে যাওয়াটা। পঞ্চম থেকে রেখাবে পড়ে, পড়ে আবার ওঠে। ও আমি একদম সহ্যই করতে পারতাম না! আমার এক বান্ধবী বলল, এই অশ্বিনীভিড়ে শ্রী গাইলেন, শুনে এলাম। আমি বললাম ‘শ্রী? শুনলেন? ভালো লাগল’? উনি বললেন ‘খুব ভালো লাগল!’ আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এ কিছুতেই ঠিক হতে পারে না। এরা আসলে শ্রীর ওই ব্যাপারটা জানে। এ যদি খামাজ  গাইত কখনো বলত না যে ভালো লাগল। এই শ্রী রাগের আসলে একটা –

শুচিশ্রী – দর আছে। রাগ যত জটিল আর কঠিন হবে তার গুরুত্ব তত বেশি। –

জয় – হ্যাঁ। হাসিল করা শক্ত, অতএব একটা দারুণ দামি ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করি, সংগীতের সঙ্গে নিয়তির একটা সম্পর্ক আছে। সে যদি মনে করে, আপনাকে মিউজিশিয়ান করবে তাহলে সে আপনিই করবে। ওইরকম জায়গা দিয়েই নিয়ে যাবে জীবনে, যাতে আপনি ভাবতে বাধ্য হন। ওই যে মারোয়াটা আমার ভেতরে ঢুকল, যার বাড়িতে শুনতে গিয়েছিলাম তার কিন্তু কিছুই হলো না! আসলে একটা গানের মধ্যে, রাগের মধ্যে ঢুকতে আমার অনেক সময় লাগে। এই যে রাগগুলোর কথা আপনাকে বলছি এগুলো শুনে উঠতে আমার অনেক সময় লাগে। ধরুন পুরিয়া, শ্রী, মারোয়া, সকালের দিকে বাটিয়ার, আমার শুনতেই ইচ্ছে করে না! কিন্তু তা বলে শোনা বন্ধ করি না! আমি জানতে চেয়েছি, কেন শুনতে পারি না! ওই রাগের ভেতর একটা অন্য রস আছে। জীবন তো এরকম নয় যে, কেবল আনন্দ? এমনও নয় যে, সবসময় বৃষ্টি পড়ছে বা সবসময় সকাল হচ্ছে। জীবনে অন্য সময়গুলোও আছে। দুঃস্বপ্নের সময়, কষ্টের অবসাদের সময়গুলোও আছে। আজ এই প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছে সেগুলো আমি শুনতে পারি। দেখলেন ওই মারোয়ার মতো এতক্ষণে সা-তে ফিরে এলাম। এই কথাগুলো কিন্তু আমি আমার জীবন থেকেই বলছি। এটা কিন্তু টেকনিক থেকে আসে না। আগের দিন আপনি আমাকে সারংয়ের অবস্থায় দেখেছেন আর আজ মারোয়ায়। মারোয়ার ভেতরের যে-কষ্ট তা কিন্তু বুক মোচড়ানো কষ্ট নয়! আত্মীয় মারা গেল, বন্ধুবিচ্ছেদ হলো, প্রেমিকা ছেড়ে গেল, ভীষণ কষ্ট! অসহ্য ছটফট ছটফট। সেই কষ্ট নিয়েছি। নিতে পারি। কিন্তু এই কষ্ট হলো ধীরে ধীরে নেমে আসা অবসাদ। যেভাবে সূর্যটা আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে, দিনটা মরে আসছে। ওই অবরোহণটা ভাবুন! কতদিন লাগে আমার ওই অবরোহণটা বুঝতে। ওই কষ্টটা। এভাবেই গানটা আসে। এই আর কী।

শুচিশ্রী – মারোয়াকে আপনার জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন আপনি, এমনই অসম্ভব এর প্রভাব!

জয় – মেলাতে পারি কিন্তু চাই না, কারণ ওই যে বিষাদ, অবসাদ, ওইটা আমার জীবনের একটা অংশ, যেন প্রত্যেকটা দিনের অংশ।