টেডিচাচি

‘চিইইইইইইই’ বলে বুড়ি না ছুঁতেই আমাদের ছি-বুড়ি খেলা যখন মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যেত, সেরকম এক সিঁদুররাঙা সন্ধ্যায় আমাদের পাশের বাসার সামনে আসবাবপত্রভর্তি একটা ট্রাক এসে দাঁড়ালো। আমরা তিন বোন আর প্রতিবেশী বন্ধুরা হাঁ করে আসবাবপত্র নামানো দেখতে লাগলাম। আমাদের কারো বাসায় ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল, শোকেস ছিল না। আমাদের যে প্লাস্টিকের পুতুল, হাঁস, মাছ, ফুলদানি, মাটির পাখি, টিনের মোটরগাড়ি, উড়োজাহাজ, খেলনাপাতি ছিল তা একটা পুরনো বেতের ঝুড়িতে রাখতাম। মায়ের হাতের কাজ করা টিনের বাক্স 888sport app ঝাড়নের ওপর আমি আর বুলি মানে আমার ছোট বোন মাঝে মাঝে ওগুলো সাজিয়ে রাখতাম। মা বাক্স খুলতে গেলেই খেলনাগুলো পেছনদিকে পটাপট পড়ে যেত। আমরা বড় দু-বোন কোনোকিছুর আবদার করতাম না। কিন্তু বুলি বেশি আদুরে ছিল বলে ও আব্বাকে একটা শোকেসের কথা বলেছিল। আব্বা বলেছিলেন – ‘সবার আগে দুটো নকশা করা খাট দরকার। শোকেস ফুটানি কা ডিব্বা। খাট বানাতে দেওয়া হয়েছে। তোমরা খাটে বসে আমার পাকা চুল তুলে দেবে। এক একটা পাকা চুলের জন্য এক আনা।’

সেই খাট আসার আগেও আমরা আব্বার পাকা চুল তুলতাম। সবচেয়ে ভালো পারতো বুলি। বড় আপার খুব আগ্রহ ছিল না। চুল তুলে আব্বাকে দেখাতে হতো। আব্বার একমাথা কোঁকড়া চুলের মধ্যে পাকা চুল খুব কমই ছিল। বুলি যেন কেমন করে খুঁজে পেত। পয়সা পেয়ে মাটির ব্যাংকে রেখে দিত। যখন পাকা চুল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন আমি আর বুলি পরামর্শ করে কাঁচা চুল তুলে সাদা বিছানার চাদর থেকে সরু সাদা সুতো আব্বাকে দেখাতাম। আব্বা আমাদের চালাকি ধরে ফেললেও পয়সা দিতেন। বলতেন – ‘আর দরকার নেই মা, এবার খেলতে যাও।’ কারণ কাঁচা চুল ওঠানোর ব্যথায় আব্বার অবস্থা কাহিল।

আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরা আর আমরা যে যার বাড়িতে শীতলপাটি বিছিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতাম। আমার আব্বা মাঝে মাঝে খাটের ওপর দস্তরখানা বিছিয়ে খেতেন। ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খায় বড়লোকেরা – আমাদের এমন ধারণা ছিল। বড় আপা সিক্সে উঠে পুতুল খেলা ছেড়ে দিয়েছিল। আমি আর বুলি পুরনো খাতার শক্ত কভার কেটে কাগজের পুতুলদের জন্য ডাইনিং চেয়ার-টেবিল বানাতাম। আমাদের পুতুলরা খুব ধনী ছিল। ওদের নাম ছিল লাডলি, গোরি আর ভিক্টোরি। ওই নামগুলোও আমরা রেখেছিলাম আমাদের শহরের একমাত্র বড় সাদা দোতলা বাড়িতে 888sport app থেকে গরমের ছুটি কাটাতে আসা প্রজাপতির মতো মেয়েদের নামে। ওরা মোটরগাড়ি চেপে আসতো। চলে যাওয়ার সময় ওদের মোটরের পেছনে ওড়ানো ধুলা মাখার জন্য আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম। তো আমরা সেদিন সন্ধ্যায় খেলা ফেলে ট্রাক থেকে নামাতে দেখলাম ডাইনিং টেবিল-চেয়ারও। প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে আমরা ফিসফিস করে যারা আসছে তাদের নিয়ে কথা বললাম।

‘এ-বাসায় যদি আমাদের মতো কোনো মেয়ে আসে তার সঙ্গে আমি সই পাতাবো’ – বললো সাব-রেজিস্ট্রারের পাকা মেয়ে শানু। বুলি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ – ‘ই হি রে! আমাদের পাশের বাসা আর উনি সই পাতাবে! তোমাদের বাসা তো একটু দূরে। আর দারোগার মেয়ে তো তোমার সই আছেই।’

‘ওর সঙ্গে আমার আড়ি চলছে। ও আমাকে কাশ্মিরি আমের আচার দেবে বলেও দেয়নি।’

এসব যুক্তিতক্কো করতে করতে আমাদের বাসায় ঢোকার সময় হলো। শানুর বড় ভাই এসে ওকে বকতে বকতে নিয়ে গেল।

আমরা বাসায় ঢুকে দেখলাম মা আলমারির পাল্লায় লাগানো আয়নার সামনে টুল টেনে বসে চুল আঁচড়িয়ে খোঁপা বাঁধছে। বললাম – ‘আম্মা জানেন আমাদের পাশের বাসায় যারা আসবে তারা খুব বড়লোক। সোফা, ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল সব ট্রাক ভরে আজ চলে এসেছে। ওরা মনে হয় কাল আসবে।’

‘আম্মা কাল আমি স্কুলে যাবো না, ওদের যদি আমার মতো মেয়ে থাকে তার সঙ্গে আগেই সই পাতাবো। না হলে শানু নিয়ে নেবে’ – বলে বুলি আমাদের রোজকার বিকেলের নাশতার একঘেয়ে দুধের গ্লাসে টোস্ট ডুবিয়ে খেয়ে নিল। আপা পড়ার টেবিল থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো – ‘আর যদি ওদের ছেলে থাকে তো তোর সঙ্গে বিয়ে দেবো।’

বুলি ছুটে গিয়ে আপার চুলের বেণি ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ‘তুমি বড়, তোমার আগে বিয়ে হবে।’

তারও তিনদিন পর দুপুরবেলা আমি আর বুলি ঘুমালে পাশের বাসার প্রতিবেশীদের গৃহপ্রবেশ হয়। আপা দেখেছে।

‘বাপরে কি ডাটিশ! শাড়ি পরেনি। চোস্ত পাজামা, টাইট কামিজ, গলায় চুনট ওড়না। খুব টেডি।’

‘ছেলে-মেয়ে?’ – বুলির সই পাতানো হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক।

আপা কান মলে দিয়ে বললো, ‘সে গুড়ে বালি। টেডিদের বাচ্চা হয় না।’

আমরা দু-বোন লাফিয়ে উঠে টেডিচাচিকে দেখার জন্য ছুটলাম। গিয়ে দেখি শানু প্রাণপণে টেডিচাচিদের বন্ধ জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছে। আমি পেছন থেকে ওর ফ্রক ধরে টানলাম। ও চমকে ফিরে তাকালে বুলি দু-হাত উল্টেপাল্টে গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে দিলো – ‘টেডিদের বাচ্চা হঅঅঅয় না।’

এরই মধ্যে একদিন বিকেলে আমরা ওপেনটি বায়োস্কোপ খেলার জন্য দুজন হাত দিয়ে গেট বানিয়েছি তখনই রিকশা থেকে এক লাফে টেডিচাচি নেমে এসে আমাদের হাত উঁচু করা গেটের মধ্যে মাথা গলিয়ে দিলো। আমরা লজ্জায় বললাম না ‘যার নাম রেণুবালা, তার গলায় মুক্তাআআআর মালা।’ টেডিচাচি বললো খেলা শেষ হলে যেন আমরা তার বাসায় যাই। শানু তক্ষুনি যেতে রাজি। আমাদের সেদিনের খেলা আর জমলো না। কিন্তু রিকশায় টেডিচাচাকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। লাকি বললো – ‘এ মা! টেডিচাচির বর অমন বিটকেলে কেন?’

শানু পাক্কুটা ফটাস করে বলে বসলো, ‘বড়লোকরা বিটকেলই হয়। আমার ডলি খালার বরও বিটকেল। মা বলে তাতে কী? এ বছর খালু নাকি মোটরগাড়ি কিনবে।’

ঘরকেও যে এমন নান্দনিক করে তোলা যায় তা আমাদের প্রথম দেখা। আমাদের বাসার দেয়ালে একমাত্র ক্যালেন্ডার ছাড়া আর কিছু নেই। তাও অনেক পুরনো। ওতে কাবা শরিফের ছবি ছিল বলে মা ওটা ফেলে দেননি। পাপ হবে। টেডিচাচির দেয়ালে ময়ূর, প্রজাপতি আর পাহাড়ের পেছনে ডুবন্ত সূর্যের ফটো। সবগুলো হাতে সেলাই করে ফ্রেমে বাঁধানো। এক দেয়ালে টেডিচাচি আর চাচার ফটো। মনে হয় বিয়ের সময়ের ছবি। চাচার মাথাভর্তি চুল। চাচির কপালে টিকলি। ঘাড়ের ওপর শিথিল ঘোমটা। আমি হাঁ করে দেখছিলাম। শোকেসের ওপর নকশা করা চিনেমাটির ফুলদানিতে টাটকা মানিপ্ল্যান্ট। আমি তখনই ভেবে রেখেছিলাম বাসায় গিয়ে কানা ভাঙা কাঁচের গ্ল­াসে পানি ভরে একটা পাতাবাহারের ডাল বসিয়ে দেবো। কিন্তু রাখবো কোথায়? একটা তাকে মা ছোট আয়না রাখেন। ওটা সরিয়ে রেখে দিলেই বেশ দেখতে লাগবে।

‘জুড়িয়ে যাবে। খাও না’ – বলে টেডিচাচি সবার প্লেটে কচুরি তুলে দিলেন। প্লেটগুলোর পাশে একটা করে রুমাল। ক্রসস্টিচের কাজ। সেলাইটা মা টেডিচাচির কাছ থেকে পরে শিখে নিয়েছিলেন। খাবার পর বুলির হাতে একটা কাপড়ের পুতুল দিয়ে বলেছিলেন – ‘তোমাদের মধ্যে ও সবচেয়ে ছোট। তাই ওকে দিলাম। আবার শানু ঠোঁট উল্টে বললো – ‘আমার তাজুমামা করাচির পুতুল পাঠাবে। সে-পুতুল নিজে নিজেই হাসে-কাঁদে।’

টেডিচাচি আমার মায়ের সঙ্গেই একটু-আধটু মিশতেন। প্রতিবেশী চাচিরা তাকে নিয়ে সমালোচনায় মুখর। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের শাড়ি পরতে হয়, বাচ্চাকাচ্চা হয় না, বাঁজা, পরপুরুষের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলে, মাথায় কাপড় তুলে দেয় না – এরকম মুখরোচক আলাপে চাচিদের সন্ধ্যা জমে উঠতো। যে যা-ই মুখে বলুক সবার মনে মনে একটাই দুঃখ ছিল, টেডিচাচি সুন্দরী। পথে দেখা হলে প্রতিবেশী চাচারা আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যেতেন। চাচির বরকে মনে মনে খুব ঈর্ষা করতো। আব্বা আমাদের বলতেন – ‘মিসেস চাকলাদার স্মার্ট মেয়ে। তোমরা তার কাছ থেকে হাতের কাজ শেখো।’

মা ওকে কুমড়োর মোরব্বা বানানো শিখিয়েছিলেন। আপা একদিন সারা দুপুর টেডিচাচির বাসায় বসে আমাদের পুতুলের জন্য সোফা বানিয়ে এনেছিল। ওটা ওর স্কুলের হাতের কাজ ছিল। স্কুলে দেখিয়ে এনে আমাদের দিয়ে দিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিল আপা। টেডিচাচির কামিজ বানিয়ে বেচে যাওয়া ছিট কাপড় কেটে দেশলাইয়ের বাক্সের ওপর তুলো বিছিয়ে সেটা টাইট করে সেলাই করে দিয়েছিল। আর সোফার পেছন দিকটা শক্ত কাগজ চাঁদার মতো কেটে ওই কাপড়ে মুড়ে সেলাই করা। একটা সোফার মধ্যে একটা দেশলাইয়ের কাঠি থেকেই গিয়েছিল। বুলি খেলতে বসে ওটা প্রথমেই ঝাঁকিয়ে নিত। টেডিচাচি আরো অনেক কিছু বানাতেন। আমরা ছুটির দিনে দুপুরের পর টেডিচাচির বাসার পাশ দিয়ে হাঁটতাম। সেলাই মেশিনের একটানা মিষ্টি শব্দ শুনে আমরা দাঁড়িয়ে পড়তাম আর ফিসফিস করে বলতাম – ‘টেডিচাচির একটা মেয়ে হলে আমরা তার নাম রাখবো অ্যাঞ্জেলিনা।’ পাকা শানু বলতো – ‘অ্যাঞ্জেলিনা আবার কী? আমার ভাইয়ার বন্ধুর বোনের নাম অঞ্জলি।’

টেডিচাচির একটা বাচ্চার খুব শখ ছিল। আম্মাকে বলতেন। আমাদের সে-সময় ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিষেধ ছিল। তখন কেবলই পরিবার পরিকল্পনার লোকজন বাড়ি বাড়ি আসা শুরু করেছে। শানুরা ছয় ভাইবোন ছিল। কিন্তু ওই লোকেরা ওদের বাসার সামনে গেলেই চাচি দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিতেন। একদিন লাকি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমাকে বললো – ‘ও বাবারে! পরিকল্পনার লোক পরিকল্পনার লোক’

‘কোথায়?’

‘টেডিচাচির সঙ্গে কথা বলছে।’

বেশিরভাগ বাসার লোকজন পরিবার পরিকল্পনা অফিসের প্রচারকদের ‘কমিউনিস্ট’দের মতো ঘৃণা করতো। শুধু আমাদের বন্ধু শিখার মা ওদের সঙ্গে কথা বলতেন আর ওরা ঝুলি থেকে কী সব বের করে দিলে তিনি তা শাড়ির নিচে লুকিয়ে ফেলতেন।

টেডিচাচি বাদে আমাদের মা বা প্রতিবেশী চাচিরা চাচাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় ছাড়া বিশেষ কথা বলতেন না। আমাদের মহকুমা শহরে সন্ধে নামার পর মায়েরা মাঝেমধ্যে একে অন্যের বাসায় বেড়াতে যেতেন। মায়ের সঙ্গে সাধারণত আমি আর বুলি যেতাম। আপা টেবিলে মুখ গুঁজে পড়তো। চাচিরা সেমাই বা সুজি রান্না করে কখন আমাদের সামনে দেবেন, সে অপেক্ষায় মায়েদের সাংসারিক আলাপ অসহ্য লাগতো। ফেরার পথে বাইরের দরজা অবধি এসেও মায়েদের কথা শেষ হতো না। আমরা নিজেদের মধ্যে বলতাম – ‘এই গল্পগুলো কেন মায়েরা ঘরে বসেই শেষ করে না?’ বাসায় ফেরার পথে তখন গলির দুপাশের ঘন ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকারা তারস্বরে গান গেয়ে চলেছে। লাকিদের বাসা থেকে লাকির বড়ভাইয়ের সুর করে ভুল উচ্চারণে পাঠ্যবইয়ের 888sport app download apk মুখস্থ করতে শোনা যাচ্ছে – ‘ঘাম ঝরে ধড়ধড় গ্রীষ্মের দুপুরে/ খালবিল চৌচির জল নেই পুকুরে।’ টর্চের আলোয় তখন আমাদের ছায়া রণপার মতো লম্বা হয়ে আগেই আমাদের বাসার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। আব্বা আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। ছায়ায় বুলির কোঁকড়া চুলের মাথা আমার বাংলা বইয়ের কাজী নজরুলের মতো লাগছে।

মহকুমা পর্যায়ের পাতি অফিসার আমাদের আব্বা আর প্রতিবেশী চাচাদের জাতীয় উৎসব ছিল দুটো। একটা ১৪ই আগস্টের স্বাধীনতা দিবস আর একটা জেলা থেকে আসা তাদের হেড অফিসারের অফিস পরিদর্শনে আগমন। হেড অফিসারের আগমনে সেবারও আমাদের অফিসসংলগ্ন বাসায় খুব রান্নাবাড়া হলো। আব্বার পিয়ন নিয়ামতচাচা তার ছেলে কাসেম আলীকে সঙ্গে এনে আম্মাকে অনেক সাহায্য করছিলেন। টেডিচাচি নার্গিস-ই-কোপ্তা বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন আর লন্ডন থেকে তার মামার পাঠানো অতি চমৎকার টি-সেট কাসেম আলীকে দিয়ে। সঙ্গে আসার পথে আব্বা হেড অফিসারের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন – ‘মিসেস চাকলাদার। ফুড ইন্সপেক্টরের ওয়াইফ। আমাদের ছোট বোনের মতো।’ মানে এরকম একজন অতি আধুনিকা সুন্দরী আব্বার নিকট প্রতিবেশী সেটাও যেন আব্বার এক ধরনের যোগ্যতা হিসেবেই বিবেচনা করেন হেড অফিসার। নায়ক বসন্ত চৌধুরীর মতো হেড অফিসার বেশ গদগদ হয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘নাইস টু মিট ইউ।’

বছরখানেক পর এক সন্ধ্যায় আবার আমাদের কুমির কুমির খেলা মাঝপথে থেমে গেল। ট্রাক এসে টেডিচাচির আসবাবপত্র তুলে নিচ্ছে। চাকলাদার চাচা আমাদের সবার হাতে লজেন্স বিলি করলেন। বললেন – ‘তোমরা সবাই মিলেমিশে থেকো। আমরা চলে যাচ্ছি।’

চাচা চলে গেলে পাকনা শানু ফিসফিস করে বললো – ‘টেডিচাচির মনে হয় ছেলে হবে।’

লাকিও কম যায় না। সে বলে দিলো – ‘ছেলে হলে পেট মোটা হবে না?’

পিচ্চি রুনু ভেবেচিন্তে বললো – ‘আমার আব্বার তো কতদিন থেকে পেট মোটা। ছেলে হয় না তো!’

বাসায় গিয়ে দেখি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে টেডিচাচি কাঁদছেন। আম্মা বললেন, ‘বদলির চাকরি। এই তো আমাদের জীবন ভাই।’ আপার হাতে কতগুলো গল্পের বই দিয়ে টেডিচাচি চলে গেলেন। পাশাপাশি বাসা বলে টেডিচাচি যেন আমাদের সম্পত্তি ছিলেন। বন্ধুরা খুব ঈর্ষা করতো আমাদের। ওরা যেন একটু খুশিই হলো।

মাঝে বাসাটা অনেকদিন খালি ছিল। তারপর যে চাচি এলেন তাকে আমরা ‘নতুন চাচি’ বলে ডাকতাম। বৈশিষ্ট্যহীন সাধারণ ঘরোয়া 888sport promo code। আমার বয়সী দুটো যমজ ছেলে ছিল ওদের। দুনিয়ার বিচ্ছু। সকাল-সন্ধ্যা নতুন চাচি ওদের রুটি বেলা বেলনি দিয়ে পেটাতেন। ওদের খুনশুটি, হাসি আর চিৎকার খুবই বিরক্তিকর ছিল। বিকেলে ওরা দুই ভাই আমাদের সঙ্গে খেলতে চাইতো। আমরা প্রথম প্রথম নিয়েওছিলাম। কিন্তু একদিন বুলির হাত মুচড়ে দিয়েছিল বলে ওদের আর খেলায় নিইনি। ওরা আমাকে তাসের খেলা শিখিয়েছিল। তাস মানে সিগারেটের প্যাকেট। ফেলে দেওয়া সিগারেটের প্যাকেট জোগাড় করে ভাঙা মাটির হাঁড়ির টুকরোকে ঘুঁটি বানিয়ে খেলতে হতো। যে সিগারেটের প্যাকেট দামি বা দুষ্প্রাপ্য সেটার মূল্যমান ছিল দশ টাকা। যেটা সুলভ ও সস্তা, সেটার এক টাকা। একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে ঘুঁটি দূরে চেলে দিয়ে প্রতিপক্ষকে তার ঘুঁটি চেলে সেটা ছুঁতে বলতে হতো। কাছে হলে স্টার সিগারেটের একটা প্যাকেট যার মূল্যমান এক টাকা সেটার বাজি, দূরে বা দুর্গম অবস্থানে হলে ক্যাপস্টানের প্যাকেট – দশ টাকা। সিজার সিগারেট দুই টাকা। আমার ওসব কুমির কুমির, গোল্লাছুট, ছি-বুড়ি আর ভালো লাগতো না। দুপুরে সবাই ঘুমালে আমরা তিনজন গলির মোড়ে তাস খেলতাম। খেলাটা ভদ্রজনোচিত ছিল না বলে আপা একদিন আমাকে কান ধরে বাসায় ঢুকিয়েছিল। তারপর একদিন দুপুরে লক্ষ্মীনারায়ণ কুণ্ডুর ভিটেবাড়ির ভাঙা চওড়া পাঁচিলের ওপর আমি ঘুঁটি চেলে দিয়ে বললাম – ‘নে খেল এবার। বেনসন। কুড়ি টাকা।’ 888sport app থেকে আমার তালেব মামা এসেছিলেন। মামা কাস্টম অফিসার। দুটো বেনসনের প্যাকেট শেষ করে রেখে গিয়েছিলেন। একটার মধ্যে মাত্র একটা পড়ে ছিল। আমি লুকিয়ে নিয়ামতচাচাকে দিয়েছিলাম।

ওরা তো বেনসনের লোভে আমার হাতের দিকে জুলজুল করে তাকাচ্ছিল। ওরা বেনসনের নামই শুনেছে। চোখে দেখেনি। খেলায় আর একটা অপশন ছিল, যদি প্রতিপক্ষ অফারে রাজি না হয় তাহলে তারা ডাবল ডেকে ফিরে আসতে বলে। ওদের কাছে যেহেতু বেনসন নেই তাই ওরা বললো – ‘ফিরে আয়। চল্লিশটা স্টার।’ মানে দুটো বেনসনের সমতুল্য।

আমি গেছো মেয়ে। তরতর করে ভাঙা দেয়ালের ইটে ইটে পা দিয়ে উঠছি। বিচ্ছু দুটো পা ধরে দিলো হ্যাঁচকা টান। পুরো শরীরটা কাত হয়ে ডান হাতের ওপরে গিয়ে পড়লো। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলে ওরা হকচকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একজন ছুটে গিয়ে আব্বাকে ডেকে আনলো। আব্বা ত্বরিত আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বাসার মধ্যে ঢুকলেন। আমি তার আগেই আব্বার ঘাড়ের ওপর বমি করে দিলাম। গামছা ভিজিয়ে আম্মা আপা অনেক রাত অবধি আমার শুশ্রƒষা করতে লাগলো। বুলি টেডিচাচির দেওয়া পুতুলটা আমাকে দিয়ে দিতে চাইলো। কেউ বকা দিলো না, কারণ বিচ্ছু দুটো বলেছিল ওদের ঘুঁটি পাড়তে গিয়ে আমি পড়ে গেছি। ওরা বেনসনসহ আমার সব তাস রেখে গিয়েছিল।

সারারাত তীব্র ব্যথায় কান্নাকাটি করার পর আব্বা সকালে আমাকে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সেই প্রথম আমি এক্স-রে মেশিন দেখলাম। এক্স-রে কী আমি জানতাম না। আমাকে এক্স-রে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিয়ে বললো চোখ বন্ধ করতে। একটা সরু ঝকঝকে রডের মতো কী যেন আমার বুক বরাবর নেমে আসছিল। আমার বন্ধ চোখের কোল বেয়ে পানির ধারা। আমার মনে হলো, আব্বা আমাকে তাস খেলার জন্য শাস্তি দিতে মেরে ফেলতে এনেছেন। খুব বুলির কথা মনে হচ্ছিল। যদি বাসায় ফিরতে পারি তাহলে ওকে আর কোনোদিনও বকা দেবো না। আব্বার পাকা চুল তোলা পয়সা বুলি আমার কাছে রেখেছিল। আমি আমারগুলোসহ সব পয়সা দিয়ে ওকে মেলা থেকে ছোট্ট পিঁড়ি-বেলন কিনে দেব। ভিক্টোরি পুতুলের চুল বানানোর জন্য আম্মার টার্সেল লুকিয়ে রেখেছিলাম। ওটা আম্মাকে ফেরত দেব। আপাকে বলবো – আপা তোর কদুর তেলের বোতল থেকে আমি নিয়ামতচাচার মেয়ের জন্য একটা খালি কালির দোয়াতে তেল ভরে দিয়েছিলাম। আমি আর না পেরে চোখ বন্ধ করেই ভ্যা করে কেঁদে দিলাম। ওরা বললো – ‘হয়ে গেছে। তোমাকে তো আমরা ব্যথা দিইনি। কাঁদছ কেন সোনামণি?’

আব্বা সঙ্গে সঙ্গে কোলে তুলে নিলেন। আমি আব্বার শার্টের ঘাড়ের ওপর মুখ গুঁজে ফোঁপাতে লাগলাম। তারপর প্লাস্টার করার সময় আমি আর কাঁদিনি। বাসায় ফেরার জন্য অস্থির লাগছিল। কিন্তু ডাক্তার দুদিন থাকতে বললেন। আমি হাসপাতালের খাবার একদম খেতে পারছিলাম না। কেমন যেন স্বাদহীন, পানি পানি মুরগির ঝোল আর পাথরের মতো শক্ত ভাত। আব্বা প্রথম দিন বাইরে গিয়ে ফিরতে দেরি করলেন। ফিরলেন সঙ্গে কেক, পাউরুটি, রসগোল্লা, ডালমুট, নাবিস্কো বিস্কুট নিয়ে। আমি বুলির জন্য কেক রেখে দিলাম। পরদিন বিকেলে ছেড়ে দেবে। সেদিন দুপুর বারোটার মধ্যে স্টিলের খোপকাটা ট্রেতে করে আবার সেই বিস্বাদ খাবার দিয়ে গেল। আমি পাউরুটি খাচ্ছিলাম বাঁ হাত দিয়ে রসগোল্লার রসে ডুবিয়ে। ডান হাতে শক্ত প্লাস্টার। চোখ তুলে দেখলাম আব্বা ইয়া বড় চার বাটির টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে আসছেন, মুখে বিনয়ের হাসি। পেছনে আব্বার সেই বসন্ত চৌধুরী হেড অফিসার। তার পেছনে ঝাঁকড়া চুলের ফুটফুটে পুতুলের মতো মেয়ে কোলে আমাদের টেডিচাচি। মাইশোর সিল্কের শাড়ি পরা, বুকের একপাশে কালো বেণি। কী সুন্দর লাগছে! আমি কোনোকিছুই মেলাতে না পেরে একেবারে হাঁ। বসন্ত চৌধুরী বললেন – ‘ইন্সপেক্টর সাহেব, আপনার মেয়ে কি আমাদের রান্না খেতে পারবে? আপনার ওয়াইফের রান্না তো এক্সিলেন্ট!’ আব্বা বিনয়ে একেবারে আধমরা। টেডিচাচি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম আব্বার হেড অফিসারের ফিনফিনে সাদা সিল্কের হাফশার্টের বুকপকেটে একটা ডানহিলের প্যাকেট।