তর্জনীটি বাতাসে দুলে উঠলে

গলিপথে স্লোগান শুনে রান্নাঘরের জানালা থেকে উঁকি দিলো রাত্রি। মিছিল যাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করল বারান্দায় গিয়ে গলির সেই শেষ মাথা পর্যন্ত লম্বা মিছিলটা দেখে। ‘জেলের তালা ভেঙেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি’ বলতে বলতে হাঁটছে মিছিল। সেøাগানের আওয়াজে পাড়ার গলিটা যেন গমগম করছে।

কালকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আজ রেসকোর্স ময়দানে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ বড় বড় ব্যানার নিয়ে মিছিল করে যাচ্ছে সেই অনুষ্ঠানে। মিছিল নতুন কোনো সেøাগান দেয় কি না শোনার জন্য কান পেতে রেখে সে কড়াইয়ের গরম তেলে গোলানো ডিম ঢেলে দিলো। চড়চড় শব্দে ডিম ফুলে উঠছে। মিছিলের লেজটা জানালা পার হয়ে গেলে রাত্রি ডিম ভাজা, আলু ভাজা আর রুটি নিয়ে রাখল হাবীবের সামনে।

একবারে রুটির অর্ধেকটা ছিঁড়ে নিয়ে একসঙ্গে আলু ডিম ভাজি জড়িয়ে মুখে পুরতে পুরতে হাবীব ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘দাও, চা-টা দাও। বানানো হয়েছে তো নাকি? দেরি করিয়ে দাও রোজই।’

রাত্রি রান্নাঘরে ঢুকে হলুদ রঙের দুটো অ্যানামেলের কাপে চা ঢালল। কাপ দুটোর রং চটা ধরে উঠে গেছে। দেখতে ভালো লাগে না। দুটো কাচের কাপ কিনতে চায় রাত্রি, কিন্তু সংসারের কোনো কাজ করার সময়ই নেই হাবীবের। কোনোরকমে সকালে বাজার করে দিয়ে যায়। তাও মাঝে মাঝে বাদ পড়ে। বাসি বাজার দিয়ে চালিয়ে নিতে হয়। রাত্রি রান্নাটা এখনো ভালোমতো পারে না। কী দিয়ে কী রান্না করতে হয় তাও বোঝে না। বাসি বাজার হলে আরো মুশকিল হয় তার। মাঝে মাঝে মনে হয়, সংসারে শাশুড়ি থাকলে ভালো হতো। ঘরের কাজকর্ম শিখতে পারত। কথা বলার একজন সঙ্গী থাকত।

চা টেবিলে রাখতে না রাখতে কাপটা তুলে নিয়ে হাবীব ঢকঢক করে গলায় চালান করতে শুরু করল দেখে রাত্রি ভাবল কথাটা বলেই ফেলবে কি-না। খুব তাড়ার মধ্যে রয়েছে হাবীব, অন্য কিছু ভাবার সময় নেই, হয়তো রাজি হয়ে যেতেও পারে।

হাবীব পায়ে জুতো পরতে পরতে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, রাত্রি ঝপ করে বলে উঠল, ‘আমাকে নিয়ে যাবে?’

‘কোথায়?’

‘মিটিংয়ে।’

‘মিটিংয়ে?’ খুব চমকে গিয়ে হাবীব জিজ্ঞেস করল, ‘মিটিংয়ে গিয়ে কী করবে তুমি?’

‘ওনার বক্তৃতা শুনব। শেখ মুজিব আজ বক্তৃতা দেবেন বলছিলে। তাঁর কথা শুনব। আমার শোনার খুব ইচ্ছে।’

‘ও।’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হাবীব বলে, ‘মাঠে গিয়ে বক্তৃতা আর শোনার কী আছে? কাল পেপারে পড়ে নিও।’

‘তাহলে তুমি যাও কেন?’

বিস্ফারিত চোখে রাত্রির দিকে তাকিয়ে থেকে হাবীব বলল, ‘আমি কি নেত্রী বিয়ে করলাম, হ্যাঁ? আমার সঙ্গে তোমাকে তুলনা করলে!’

রাত্রি চুপ করে তাকিয়ে দেখে বিদ্রƒপভরা মুখটা।

হাবীব বেরিয়ে যায়। রাত্রি রয়েসয়ে চা শেষ করতে থাকে আর নিজেকে বলে, সত্যিই তো হাবীব যা করতে পারে তা কি সে করতে পারে? সে ওরকম কথা বললই বা কীভাবে! এত সাহস আজ কোথা থেকে পেল!

অথচ তার ভয়টা তো এখনো কাটেনি। হাবীবকে সে খুব ভয় পায়। একদম অচেনা একটা মানুষের সঙ্গে একা থাকবে – এরকম কোনোদিন সে ভাবেনি। বিয়ের সময় জানত না, হাবীব – যাকে সে এখন পর্যন্ত কোনো সম্বোধন করে উঠতে পারেনি – সংসারে একদম একা থাকে। আব্বা-আম্মা, ভাই-বোনদের ছেড়ে দূরে 888sport appয় যেতে হবে, সেই শুনেই কী মন খারাপ তখন রাত্রির! নতুন সংসারে পৌঁছে দিতে তার সঙ্গে বড় ভাই মাসুদ এসেছিল। মাসুদ ভাই কয়েকদিন থাকবে জানত রাত্রি। কিন্তু কেন যেন একদিন থেকেই চলে গেল। মাসুদ ভাইও হাবীবের সামনে যেন ভয়ে ভয়ে ছিল। তারপর থেকে সে আর তার স্বামী দোতলার এই বাসায় সংসার করছে। এমন যে সংসার হয় তাও কি জানত রাত্রি! সংসারে শ্বশুর-শাশুড়ি-দেবর-ননদ থাকবে না? শুধু স্বামী আর স্ত্রী মিলে সংসার!

আর রাত্রির স্বামী এক সরকারি অফিসের অফিসার হলেও আসল কাজ তার পার্টি করা। অফিসে কতক্ষণ থাকে রাত্রি জানে না। সকালে সময়মতো অফিসেই রওনা হয় বটে কিন্তু ফেরার তার কোনো ঠিক নেই। বাসায় রাত্রি নামে যে একজন মানুষ আছে তা বোধকরি তার মনে থাকে না। রাতে যখন ফেরে তখন সে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। অধিকাংশ দিনই এমন হয়।

হাবীবের সঙ্গে প্রায় মাস তিনেক হলো 888sport appয় সংসার করছে রাত্রি। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বিয়ে হয়েছে। কলেজে পড়তে চায় রাত্রি; কিন্তু হাবীবকে লজ্জায় পড়ার কথা বলতে পারেনি। হাবীব নিজেও কিছু বলেনি। হয়তো খেয়ালই করেনি। সারাদিন একা থাকার সময় বারবার ঠিক করে কলেজে ভর্তির কথাটা হাবীবকে বলবে, কিন্তু সদাব্যস্ত মানুষটাকে কোনোভাবেই বলে উঠতে পারে না। সাহসের অভাব, তার সঙ্গে সংকোচও।

ছোট আলমনগর শহরের মেয়ে রাত্রি। সেখানে কিছু লোক রাজনীতি করে। তারা মিটিং-মিছিল করে। সে ওই বাজার এলাকায় হয়। রাত্রির আব্বা কোনোদিন সে-সবে যায় না। মাসুদ ভাইও যায় না। তারপরও ছুটির দিনে আব্বা আর মাসুদ ভাই রাজনীতি নিয়ে কথা বলে। আব্বা আর মাসুদ ভাই দুজনের দুরকম মত। একটু ঝগড়ামতো করে দুজনে। তবে বেশি নয়। রাত্রি কোনোদিন মনোযোগ দেয়নি। শুধু জানে, মাসুদ ভাই ছাত্রলীগের ছেলেদের পছন্দ করে না। সে ঘোরে অন্য দলের ছেলেদের নিয়ে। তারা আলাদাভাবে মিছিল করে। সেই ছেলেরা মাঝে মাঝে রাতে এসে মাসুদ ভাইকে ডেকে নিয়ে যায় দেয়ালে চিকা মারতে। মাসুদ ভাইয়ের হাতের লেখা সুন্দর। স্কুলে কিংবা রেলস্টেশনে যাওয়ার পথে বাড়ির দেয়ালে মাসুদ ভাইয়ের লেখা দেখে রাত্রিও মুগ্ধ।  মাসুদ ভাই খানিকটা নিজের মধ্যে থাকে। অন্য ভাইবোনের সঙ্গে তার সম্পর্ক একটু দূরের। রাজনীতি বা অন্য কোনো বিষয় নিয়েই মাসুদ ভাই তাদের সঙ্গে কখনো আলাপ করে না। মাসুদ ভাইকেও রাত্রি ভয় পায়। গম্ভীর মানুষকেই রাত্রির ভয় লাগে।

ম্যাট্রিক দিয়ে দম ফেলতে না ফেলতে বিয়ের সম্বন্ধ এলো। বিয়েও হয়ে গেল হুট করেই বলা যায়। ভেবেছিল আরেকটু পড়বে। অন্তত বিএ পাশ করবে। তা হলো না, মাকে বলেছিল, আব্বাকে বলতে পারেনি; কিন্তু মা সে-কথা কানে তোলেনি। এক রাতে কয়েকজন লোক গেল বাড়িতে। মৌলভি এলেন। কলমা পড়ে রাত্রিকে কবুল বলতে বললেন। তিনবার কবুল বলতে হলো। তখন পর্যন্ত যার সঙ্গে তার বিয়ে তাকে একবারও দেখেনি। মা আর ফুপু আড়াল থেকে দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল – ছেলেডা উঁচা লম্বা আছে। আর ছোট বোন কানে কানে বলেছিল, ‘আপা, তোমার বর অনেক ফর্সা।’ সেই উঁচা লম্বা ফর্সা বরকে সে দেখল পরদিন সকালে ট্রেনে। 

তারপর হাবীবের সঙ্গে 888sport appয় সংসার করা। বিয়ের আগে এ-বাসাতেই ছিল হাবীব। তার নিজের বাবা-মা কেউ নেই। বিয়ের সময় সম্পর্কিত দু-একজন আত্মীয়, যারা আলমনগর গিয়েছিল, তারা সেখান থেকে ফিরে গেছে। তাদের সঙ্গে রাত্রির ভালো করে পরিচয়ও হয়নি। হাবীব একা থাকতে অভ্যস্ত। কিন্তু রাত্রির সময় কাটে না। আলমনগরের চাপাচাপির বাসাটার কথা মনে পড়ে। পড়াশোনা ছাড়া মায়ের হাতের কাজ করতে হতো। পড়ার সময় এক টেবিলে তিনজনে কতবারই না বই ঠেলাঠেলি আর গণ্ডগোল করেছে। এমনকি হাতাহাতিও হয়ে যেত। তার মধ্যেই দিন কোথা দিয়ে শেষ হতো কোনোদিন খেয়াল করতে হয়নি। এখানে এই সংসার সামলেও হাতে তার অফুরান সময়। সে পড়াশোনা অনায়াসে করতে পারে। সেটা হচ্ছে না বলেই রাত্রির যা একটু কষ্ট। একা একা খুব বাজে কাটে সারাদিন। দুজনের সংসারে কাজই বা কী আর তা করতে কতক্ষণই বা লাগে! শুয়ে-বসে বিরক্ত হয়ে গেছে সে।

888sport app আসার মাসখানেক পর একবারই মাসুদ ভাই এসে তাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল, ওই যে বিয়ের পর ‘ফিরানি’ যাকে  বলে সেটা। তবে সবাই স্বামীসহ ফিরানিতে গেলেও রাত্রির সঙ্গে হাবীব যায়নি। পার্টির কাজ ফেলে কোথাও যাওয়ার তার সময় নেই।

বাড়ি গিয়ে মাকে বলেছিল রাত্রি, ‘এবার আমি কলেজে ভর্তি হবো, মা। কিন্তু তোমার জামাইয়ের তো কোনো আগ্রহই নেই।’

মায়ের কাছে রাত্রি আর হাবীব রাজযোটক জুড়ি। মা রাত্রির গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছে, ‘জামাই যদি না চায় তাহলে বাদ দে পড়া। চাকরি-বাকরি তো আর করতে হবে না তোকে।’

‘মা, চাকরি করি না করি, পড়াশোনাটা শেষ করব না? তাছাড়া সারাদিন একা বাসায় খুব খারাপ লাগে।’

মা হাসে। ‘পাগল মেয়ে, কদিনই আর একা থাকবি? কোল ভরে যাবে তো কদিন  পরেই।   তখন   সময়   পাবি   না   নাওয়া-খাওয়ার। এখন কদিন আরাম করে নে। জামাইকে বলিস সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে।’

রাত্রির মা মাসে একবার স্বামীর সঙ্গে নাইট শো সিনেমা দেখে। সারামাস সেই সিনেমার গল্প করে খুব আনন্দ নিয়ে। অল্প আয়ে টেনেটুনে চলেও তার যেন কোনো দুঃখ নেই। মেয়ে নির্ঞ্ঝাট সংসার পেয়েছে, জামাইয়ের আয়-রোজগার ভালো – এর বেশি আর কী চায় কোনো মেয়ের মা! মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে-কথাই বোঝায় রাত্রিকে।

চায়ের কাপ রান্নাঘরে রেখে ফিরে আসে রাত্রি। একটু পরে আবার ফিরে যায় রান্নাঘরে। একটা কৌটা খুলে জিন্নাহর ছবিওয়ালা একটা একশ টাকার নোট বের করে। আসার সময় মা হাতে গুঁজে দিয়েছিল। যদি লাগে খরচ করিস। টাকাটা হাবীবকে দেখায়নি। কেমন যেন সংকোচ হয়েছে। মাত্র একশ টাকা দেখে কিছু যদি ভাবে। মানুষটাকে তো সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না পুরোপুরি। একবার মনে হচ্ছে, ভালো। আবার মনে হচ্ছে, ভালো যদি হয় তাহলে তার প্রতি এত উদাসীন কেন? সে তো দেখতে খারাপ নয়।

টাকাটা খরচ করতে লাগেনি। সংসারে যা লাগে আর যা লাগে না, তাও আছে এ-বাসায়। টাকাটা হাতে নিয়ে রাত্রি বসে থাকে। সে যেটা চিন্তা করছে তাতে কত টাকা লাগবে জানে না। তবু বেশ ভরসা পাচ্ছে। গিয়ে তো দেখা যাক।

রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালা হেঁকে যায় – কালা সাবুন লিবেন? কালা সাবুন …

শুনতে শুনতে রাত্রির মনে হয় কোনো কিছু নিয়ে সে-ও বেরিয়ে পড়ে ফেরি করতে। ঘুরতে ঘুরতে 888sport app শহরটা দেখবে। মিছিল দেখবে। শেখ মুজিবকে দেখবে। রাজনীতিতে হাবীবের নেশা দেখে রাত্রিও যেন কখন রাজনীতির দিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। রাস্তা দিয়ে যখন মিছিল যায় তখন সে মনোযোগ দিয়ে দেখে মিছিলের উদ্দীপ্ত মুখ। তেজোদ্দীপ্ত সেøাগান উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখের মানচিত্র কীভাবে বদলে বদলে যায়। শোনে সেøাগানের বাণী। তার মধ্যেও এক অচেনা উত্তেজনা টের পায় সে। ইচ্ছে করে মিছিল হতে। প্ল্যাকার্ড হাতে সেøাগান তুলতে।

পরদিন হাবীব চলে যাওয়ার পর রাত্রি খবরের কাগজ ইত্তেফাক নিয়ে বসে। এখানে এসে তার খবরের কাগজ পড়ার অভ্যেস হয়েছে। খানিকটা সময় কাটে। প্রায় আদ্যোপ্রান্ত সে পড়ে কাগজের। আজ গতকালের মিটিংয়ের খবরটাই আগে পড়া শুরু করল। হাজার হাজার মানুষ আইয়ুব খানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামের রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়া শেখ মুজিবকে ফুলের মালা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। তাঁকে নতুন উপাধি দিয়েছে – বঙ্গবন্ধু।

রাত্রি কয়েকবার উচ্চারণ করল – বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু …

খুব ভালো লাগল তার এই উপাধি। সে ঠিক করল এখন থেকে আর শেখ মুজিব বলবে না।

পরক্ষণে হেসে ফেলল। আশ্চর্য আজ পর্যন্ত মানুষটাকে একবারও দেখা হলো না তার! এই শহরেই তিনি থাকেন। ধানমণ্ডি তাঁর বাড়ি। সে নাকি মহাখালী থেকে বেশি দূরেও নয়। আহ্, একদিন যদি যেতে পারত রাত্রি! কিন্তু গেলেই কি আর তাঁর দেখা পাওয়া যাবে? কত ব্যস্ত মানুষ তিনি। তাঁর বাড়িতেই বা রাত্রিকে ঢুকতে দেবে কেন? রাত্রি কে? কোন পরিচয়ে যাবে সে? রাত্রি রাজনীতি করে না। এমনকি রাজনীতির প্রায় কিছুই বোঝে না। ইদানীং ছয় দফা, এগারো দফা, স্বায়ত্তশাসন শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় চিন্তার জগৎটা একটু মাঝে মাঝে ঝাঁকি খাচ্ছে; কিন্তু সে তার একান্ত ভাবনা। সত্যি সে রাজনীতি করতে যাচ্ছে না। শুধু কেন যেন শেখ মুজিব নামটা মনে পড়লেই মনে হয় খুব প্রিয় কেউ। কী যেন দেবেন তিনি রাত্রিকে!

রাতে হাবীব ফিরল উত্তেজিত হয়ে। আজ নেতা তাকে দেখে ডেকে কাছে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কি রে হাবীব, এলাকায় কাজ-টাজ কিছু করস তো? লেগে পড় লেগে পড়। ইলেকশন করতে হবে তো?’

– ‘বঙ্গবন্ধু তোমাকে চেনেন?’ রাত্রি ঔৎসুক্য নিয়ে প্রশ্ন করে।

হাবীব উত্তর দিতে গিয়ে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে রাত্রির মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পর বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বললে তুমি? বঙ্গবন্ধু? বঙ্গবন্ধু বললে?’

রাত্রি আনন্দ পায়, উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসে। হাবীব তাকে জাপটে ধরে উঁচু করে দু-পাক খেয়ে বলে, ‘বউ, তোমার মুখে খুব ভালো শোনাল ডাকটা।’

সেদিন থেকে হাবীব আর আগের মতো রাত্রিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে না। পার্টির কথা কিছু হলেও বলে, বিশেষত রাতে খাওয়ার সময়। রাত্রি যে গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে সেটা সে বোঝে। হাবীব মানুষটা এমনিতে খারাপ না। দলে একটু ভালো জায়গা করার জন্যে চেষ্টা করছে। সেজন্য খাটছেও প্রচুর।

দেখতে দেখতে শহরের চেহারা কেমন বদলে যাচ্ছে। মিছিল আর মিছিল। আইয়ুব খান গদি ছাড়ো, নির্বাচন দিতে হবে – দাবি করে মিছিল। শেষে ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আইয়ুব খান গদি ছাড়ল। বিশ্রী দেখতে ইয়াহিয়া খান এসেই দিলো কারফিউ। কারফিউর মধ্যেই গলিতে হুট করে কয়েকজনের মিছিল চেঁচিয়ে ওঠে – সামরিক শাসন মানি না।

সেদিন হাবীব বলে, ওই পশ্চিম পাকিস্তানি হারামিদের সঙ্গে আমাদের আর থাকা সম্ভব নয়। আইয়ুব খানের চেয়েও খারাপ এই শালা ইয়াহিয়া। কিন্তু ও শালা আমাদের চেনে না। চিনিয়ে দেবো একদিন। সেদিন দেখবি শালা কত ধানে কত চাল হয়!

এ-কথার পিঠে কী কথা বলা ঠিক – রাত্রি জানে না। সে চুপ করে থাকে। 

এর মধ্যে একদিন হাবীবকে না জানিয়ে পাড়ার কাছেই জিন্নাহ কলেজে ভর্তি হয়ে এসেছে রাত্রি। ক্লাসে যাওয়ার সাহস এখনো করে উঠতে পারেনি। হাবীবকে কয়েকবার নানাভাবে পড়াশোনার কথা বলে কোনো উত্তর পায়নি। তাকে না জানিয়ে ভর্তি হওয়া কীভাবে নেবে ভেবে অস্থির লাগে রাত্রির।

রাত্রি যা ভাবছিল তেমনটা হলো না। হাবীব খানিক বিরক্ত হলো। আবার বলল, ‘তো ভর্তি যখন হয়েই গেছো, শুরু করে দাও পড়াশোনা। তবে কলেজের নামে বাইরে কোথাও ঘোরাঘুরি করতে পারবে না। আমাকে যেন কখনো খারাপ কথা না বলতে হয় খেয়াল রেখো।’

রাত্রি মেনে নেয়। তার মূল লক্ষ্য পড়াশোনা করা। এখন সে 888sport app ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কথা ভাবে। তাই মন ঢেলে দেয় পড়াশোনায়। তবে কলেজে ক্লাস নিয়মিত হয় না। কখনো স্যার আসেন না, কখনো ছাত্ররা আসে না। অল্প কয়েকজন ছাত্র নিয়মিত ক্লাস করে। তারা কোনো কোনোদিন স্যারকে টিচার্সরুম থেকে ডেকে আনে ক্লাসের জন্য। টিচার্সরুমে টিচাররাও  নাকি  খুব  রাজনীতি  নিয়ে  তর্ক-বিতর্ক করেন। নির্বাচন দেওয়ার দাবি এখন সবার। আবার স্বাধিকারের কথাও উঠছে। শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসনের ভেতরেই রাজনীতির দরজা খুলে দিলেন। তখন আর পায় কে! সেই সাতচল্লিশ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এতদিন আর্মির হাতেই রয়ে গেছে দেশের শাসনক্ষমতা। মানুষ আর সামরিক শাসন চায় না। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হবে। কথা বলার অধিকার থাকবে। সরকার, রাষ্ট্র, রাজনীতি, গণতন্ত্র – এসব শব্দ আরো গভীরভাবে বুঝতে চায় রাত্রি। ক্লাসের পড়ার মধ্যে রাষ্ট্র888sport apk বিষয়টা রাত্রির পড়তে ভালো লাগছে। এ-বিষয় নিয়েই সে উচ্চতর পড়াশোনার স্বপ্ন দেখছে। 

দেখতে দেখতে চলে এলো অনেক চাওয়ার নির্বাচন। শহরজুড়ে নির্বাচনী উত্তেজনা তুঙ্গে। এই প্রথম দেশে সাধারণ নির্বাচন হবে। মানুষ যেন উৎসাহে ফুটছে খইয়ের মতো। প্রায় প্রতিদিনই মিছিলের মুখোমুখি হয় রাত্রি। তার খুব ইচ্ছে করে মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে।

শেখ মুজিব মানুষটা যেন জাদু করেছে বাঙালিকে। সবখানে মানুষ তাঁর কথা আলোচনা করে। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে সারাদিন মানুষের জটলা থাকেই। কলেজে যেতে যেতে সে-আলোচনা রাত্রির কানেও কিছু কিছু যায়। শেখ মুজিবের নাম সবার মুখে মুখে। যেন তিনি একটা সোনার জাদুকাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছেন সবার গায়ে, সবার খুব সাহস বেড়েছে।

মানুষটাকে দেখার জন্যে তার ভেতরে তীব্র তাড়না তৈরি হতে থাকে। শুধু হাবীবকে দেওয়া ওয়াদা সে ভঙ্গ করবে না বলে নিজেকে সংযত করে। তবে তার মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, অবশ্যই কোনো একদিন মানুষটাকে স্বচক্ষে দেখবে। নিজ কানে শুনবে তাঁর জাদুকরি কথামালা।

রাত্রির ইচ্ছার আংশিক পূর্ণ হয় এর কয়েকদিন পরেই। রাত্রিকে হাবীব তার এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে গিয়েছিল দাওয়াতে। সেখান থেকে ফিরতে রিকশার জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছিল তারা। হঠাৎ হাবীব উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, ‘রাত্রি ওই দেখো, ওই যে বঙ্গবন্ধু।’

একটু দূরের একটা বাড়ির সামনে থেকে তিনি গাড়িতে উঠছেন। হতভম্ব রাত্রির চোখে পড়ল সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরা ঋজু একটা শরীর। রাস্তার মিয়ানো আলোয় চেহারা ভালো দেখা গেল না। হাবীব পা বাড়ানোর আগেই গাড়ি ছুটতে শুরু করল। হাবীব হতাশ হয়ে বলল, ‘ইস্, একটু আগে খেয়াল করলাম না!’

একটা ঘোরের মধ্যে রাত্রি ঘটনাটা বারবার ফিরে ফিরে দেখতে লাগল। অদ্ভুত এক বেদনাবোধ তাকে ঘিরে থাকল কয়েকদিন। এত কাছে ছিলেন, তবু দেখা হলো না!

হাবীব এখন আরো ব্যস্ত। রাতে বাসায় ফিরে গোসল-খাওয়া সেরে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। তবে সে রাত্রিকে একটা চমৎকার জিনিস উপহার দিয়েছে। একটা রেডিও। মারফি ব্র্যান্ডের বেশ বড় আর ভারি সেটা। আর কী সুন্দর তার আওয়াজ! আটটা ব্যাটারি লাগে চালাতে। হাবীব সকালবেলাতেই রেডিও ছেড়ে খবর শোনে। তখন রাত্রি ব্যস্ত থাকে সংসারের কাজে। সে খবর শোনে দুপুরে। দুটোর খবর।

এখন দেশজুড়ে খবর আর মিছিল। মিছিলের কাঁধে ছোট বড় নৌকা আর নৌকা। রাত্রিও খাতার পাতা ছিঁড়ে একটা নৌকা বানিয়েছে। পড়ার টেবিলে রেখেছে। নির্বাচন হবে। ভোট দেবে মানুষ। উৎসুক হয়ে আছে সবাই। শেখ মুজিব দেশময় ছুটে বেড়াচ্ছেন। তাঁর কথা শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে লোক ছুটে যায়, যেখানেই যান তিনি। খবরের কাগজে তাঁর ভাষণের প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে পড়ে রাত্রি।

এত আকাক্সক্ষার নির্বাচন তা হয়েও যেন হয় না। তারিখ ঠিক হয় আবার পিছায়। এই করে দু-দুবার তারিখ পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলো, নির্বিঘ্নে। মানুষ সেজেগুজে ভোটকেন্দ্রে গেল ভোট দিতে। 888sport promo codeরাও ভোট দিলো দলে দলে। সারাদেশে উৎসবের আমেজ। সরকার বলল, প্রায় ৬৫ শতাংশ লোক ভোট দিয়েছে। রাত্রি নিজেও ভোট দিয়েছে।

নৌকা মার্কা জিতে গেল নির্বাচনে। যে সে জেতা নয়, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের তিনশো আসনের মধ্যে একশ ষাটটি আসনে জিতে গেল বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। রাত্রির খুব আনন্দ হলো। যাক, এবার সব শান্ত হবে। এবার কলেজ হবে ঠিকমতো। ইন্টারমিডিয়েট যেন শেষই হচ্ছে না। পড়াশোনায়ও মন বসেনি এতদিন। এবার জোর লাগিয়ে পড়া শুরু করতে হবে। ভালো রেজাল্ট না হলে 888sport app ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া হবে না। 

কিন্তু কই আর কলেজে ঠিকমতো ক্লাস হলো! শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা দিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া টালবাহানা করছে শোনা গেল। মানুষ বিরক্ত – ফাজলামো নাকি! নির্বাচনে জিতেছে যে তার কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে – এ তো নিয়মের কথা, এর মধ্যে গুড় পাকানোর কী হলো! 

বাসায় এখন প্রায়ই হাবীবের বন্ধুরা আসে। নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তারা। ক্ষমতা না দিয়ে ইয়াহিয়া শালা যাবে কোথায়? ভুট্টো যতই ঘোট পাকাক কোনো কাজই হবে না। পূর্ব পাকিস্তানকে আর কলোনি বানিয়ে রাখা যাবে না বাপধন, আমরা আমাদের অধিকার বুঝে নিয়েই ছাড়ব। আর যদি নাই দিতে চাস … কী করে টিকে থাকিস দেখে নিস ব্যাটারা। মনের রাগ মেটাতে গালাগাল করে বটে, তবে বেশির ভাগ সময় পরবর্তী করণীয় নিয়েই আলোচনা হয়। শেষ পর্যন্ত ‘দেখা যাক, বঙ্গবন্ধু কী বলেন’ বা ‘বঙ্গবন্ধু কী করেন’-এ এসে থেমে যায় সবাই।

রাত্রি বিস্মিত হয়ে ভাবে, আশ্চর্য শক্তির এক মানুষ বটে তিনি! পুরো বাঙালি তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে। তিনি হ্যামিলনের মতো বাঁশি বাজালে কোনোদিকে না তাকিয়ে সবাই তাঁর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যাবে কিছু না ভেবেই।

সাধারণ  পরিষদের  অধিবেশন  মুলতবি  ঘোষণা  করায় রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ছে মানুষ। পরদিন 888sport appয় হরতাল হলো। তার পরদিন সারাদেশে। পল্টন ময়দানে এলেন শেখ মুজিব। তিনি বললেন – আজ থেকে অফিস-আদালত সবকিছু বন্ধ।

কিন্তু তাতে কেউ খুশি না। সেøাগান সেøাগানে বাতাস কাঁপতে লাগল – জয় বাংলা। এক দফা এক দাবি – স্বাধীনতা, স্বাধীনতা।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর নয়। সবাই তাকিয়ে আছে একজনের দিকে, তিনি একবার শুধু ডাক দেবেন স্বাধীনতার। কী করে দেশ স্বাধীন করতে হয় তা দেখিয়ে দেবে তারা।

হাবীবদের আলোচনায় বারবার কথাটা ওঠে – শেখ মুজিব স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করবেন কি করবেন না। চারদিক থেকে প্রচণ্ড চাপে আছেন তিনি; কিন্তু তবু তাঁর মনোভাব পরিষ্কার করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অফিস-আদালত-স্কুল-কলেজ বন্ধ, এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এক এক করে দিন যাচ্ছে। কেমন যেন দমবন্ধ অবস্থা। বাজারে রেডিও বিক্রি বেড়ে গেছে। রেডিওর খবর শোনা দিনের অন্যতম কাজ সবার।

হাবীবরা বিরক্ত শেখ মুজিবের ওপরে। তিনি কেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের এখনো বিশ্বাস করছেন? কেন বিশ্বাস করছেন ভোটের রায় তারা মেনে নেবে? ভুট্টোর মতো কুচুটে লোকটা কোনো ষড়যন্ত্র করছে না, তা মনে করা ভুল। দিনরাত মদে ডুবে থাকা মাতাল ইয়াহিয়া কী করতে কী করে বসে তার ঠিক নেই। তার ওপর কোনো ভরসা করাই ঠিক না।

যুবনেতারা এতটাই উত্তেজিত যে, শেখ মুজিব ঘোষণা না দিলে তারা নিজেরাই স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে দেবে এমন। 

কঠিন অস্বস্তিকর দিন পার হওয়ার পর জানা গেল ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বিশেষ ভাষণ দেবেন। হাবীবরা মহা উত্তেজিত। দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে সেই সময়ের। খানিকটা সংশয় মেশানো অপেক্ষা। সত্যি কি তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু বলবেন?

প্রায় শেষ রাতের দিকে শুয়েও হাবীব সাতটা বাজার আগেই তৈরি হলো বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে। এ যেন সেই অতি কাক্সিক্ষত বাঁশির ডাক! সকাল থেকে সেøাগানে সেøাগানে 888sport app শহর থরথর করছে। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেøাগানের উদ্যম। রাত্রির ভেতরে অদ্ভুত আলোড়ন হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, আজ একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটবে। যে-ঘটনা পৃথিবীতে আর কখনো ঘটবে না। আর সেই ঘটনাটা সে প্রত্যক্ষ করবে নিজের চোখে। সেটা ভেবেই ব্যাখ্যাতীত আনন্দে ভরে যাচ্ছে তার মন। সে বেসুরো গলায় গান করল, নোঙ্গর তোলো তোলো সময় যে হলো হলো।

হাবীব বিস্মিত হলো তার গুনগুনানি শুনে। এমন সময়ে রাত্রি গান করছে কেন? সে কি জানে না কী প্রচণ্ড উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে হাবীব। বলা ভালো সে নয়, তারা। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। নেতাকে তাদের পাশে পেতে আজকে তারা শেষ চেষ্টা করছে। জানে না ফল কী হবে। কিছু জরুরি কাগজপত্র নিয়ে হাবীব বেরিয়ে যাওয়ার আগে আগে রাত্রি বলে ওঠে, ‘আমিও যাব।’

হাবীব আজ রেগে উঠল না। খানিকটা বোঝানোর মতো করে বলল, ‘আমরা এই মিটিংয়ে কয়েক লক্ষ লোক আসবে আশা করছি। ওই ভিড়ের মধ্যে না গিয়ে বাসায় রেডিওতে শোনাই ভালো হবে, ভাষণ সরাসরি প্রচার করা হবে। আর আমি কোথায় থাকব না থাকব তার ঠিক নেই। তুমি ওখানে গিয়ে সামলাতে পারবে না। কোনোদিন তো মিটিংয়ে যাওনি। তাছাড়া সরকারই বা কী করে তারও ঠিক নেই। যদি মিটিং ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে ম্যাসাকার হবে বড় ধরনের। প্লিজ, রাত্রি, তুমি আজ অন্তত যেও না। ’

কথা কটা বলে হাবীব বেরিয়ে যেতেই রাত্রি ঠিক করল আজ সে প্রতিজ্ঞা ভাঙবে। ভাঙতেই হবে। একটা অদৃশ্য টান প্রবলভাবে তাড়িত করছে তাকে বের হতে। শাড়ি পালটে বেরিয়ে পড়ল অচেনা রেসকোর্স ময়দানের দিকে। অবশ্য চেনার কোনো চেষ্টাই করতে হলো না। যেন মানুষের স্রোতে ভেসেই সে পৌঁছে গেল রেসকোর্স ময়দানে। তখনো বঙ্গবন্ধু আসেননি। মঞ্চে বক্তৃতা করছেন দলীয় নেতারা। কিন্তু তাঁদের কথা শোনা যাচ্ছে না। উপস্থিত জনতা মুহুর্মুহু সেøাগানে আকাশে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, 888sport apps স্বাধীন করো। জয় বাংলা। রাত্রি উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকায়। চারপাশে কেবলই প্রতিজ্ঞাদৃঢ় মুখ। সব মিলেমিশে গেছে। যেন আলাদা করা যায় না। এত মানুষ! একজন মানুষের কথা শোনার জন্য এত মানুষ এসেছে! 

রাত্রি দেখে কিছু বিদেশি লোক ক্যামেরা নিয়ে খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে আছে। তারা ঘুরে ঘুরে সমাবেশের ছবি তুলছে। সেøাগান কোলাহলে মুখর রেসকোর্সে প্রতিটি পল কাটে উৎকণ্ঠায়। তিনি আসবেন তো? সময় যত যাচ্ছে তত উৎকণ্ঠা বাড়ছে। রাত্রি খেয়াল করে সে-ও আশা করছে আজ তিনি সবার প্রত্যাশা পূরণ করবেন। কিন্তু তিনি যদি না আসেন? এমন শঙ্কায় রাত্রি কেঁপে উঠতেই মাইকে ঘোষণা হলো – তিনি আসছেন। চারদিক কাঁপিয়ে সমাবেশ চিৎকার করে ওঠে – জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

রাত্রি উদ্বেগ নিয়ে মঞ্চের দিকে তাকায়। সাদা পাঞ্জাবি, কালো ফ্রেমের চশমা ছাড়া আর কিছু নজরে আসে না। তিনি কী বলছেন তাও শুনতে পায় না। রাত্রির চোখ জলে ভরে আসে। জলভরা চোখেই দেখে তাঁর উদ্যত তর্জনীটি বাতাসে দুলে উঠলে হর্ষের উত্তাল ঢেউয়ে ভেঙে পড়ে জনতার সমুদ্র।

চোখ মুছে রাত্রিও চিৎকার করে ওঠে – জয় বাংলা।