তিনি ছিলেন মঞ্চের যুবরাজ

অলোক বসু

৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩। সন্ধ্যা ৭টা। 888sport live chatকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটারে হলভর্তি দর্শক। নাট্যধারার নতুন নাটক গররাজি কবিরাজের প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সাধারণত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য বয়োবৃদ্ধ কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির ডাক পড়ে; কিন্তু নাট্যধারা আমন্ত্রণ জানিয়েছে এমন একজনকে যিনি বয়োবৃদ্ধ নন, কিন্তু প্রজ্ঞায় অগ্রসরমান এক ব্যক্তিত্ব। তিনি খালেদ খান। ডাকনাম যুবরাজ। আমাদের মঞ্চের যুবরাজ। নাটকের উদ্বোধনী সন্ধ্যায় বেশি কথা বলার সুযোগ থাকে না, খালেদ খান বেশিক্ষণ বলেনওনি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে তিনি আমাদের সাম্প্রতিক নাট্যচর্চার হাল-হকিকত তুলে ধরে এক মনোগ্রাহী বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি যেটুকু বলেছিলেন, তাতে বাঙালির সংস্কৃতিমনস্কতা, মননশীলতা ও সৃজনশীলতার রূপরেখা ফুটে উঠেছিল। উপস্থিত সকলের কাছে তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। বলা যেতে পারে, নাটকের থেকেও তাঁর বক্তব্য বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। খালেদ খানের বিশেষত্ব হলো, তিনি যে-বিষয় নিয়ে কথা বলেন বা কাজ করেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তাঁর দখলে থাকে। তিনি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেন এবং স্বতন্ত্র বিশেস্নষণ উপস্থাপন করেন।

তাঁর বিচরণ যে সবসময়ই বিষয়ের গভীরে তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি। ১৯৯২ সালের শেষের দিকের ঘটনা। আবৃত্তি সংগঠন ক’জনায় বিদ্রোহী কৈবর্ত কাব্যনাটকের মহড়া চলছে। সত্যেন সেনের 888sport alternative link থেকে কাব্যনাট্যরূপ দিয়েছেন অনিমেষ আইচ (উদীচীকর্মী)। আর নির্দেশনার দায়িত্বে খালেদ খান। একজন পারফরমার কিছুতেই তার একটি দীর্ঘ রোমান্টিক সংলাপ যথাযথভাবে প্রক্ষেপণ করতে পারছিলেন না। নির্দেশক খালেদ খান নানাভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন কয়েকদিন ধরে কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। একপর্যায়ে মহড়াকক্ষের আলো নিভিয়ে দিয়ে সকলকে নীরব থাকার অনুরোধ জানালেন তিনি। ঘরের মধ্যে অখন্ড নিস্তব্ধতা। খালেদ খান গেয়ে উঠলেন – ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না/ ভালোবাসায় ভোলাব। আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলবো নাগো/ গান দিয়ে দ্বার খোলাবো।’ অপার মুগ্ধতা নিয়ে উপস্থিত সকলে তাঁর কণ্ঠে শুনলেন রবীন্দ্রনাথের এ-গানটি। এমন দরদ দিয়ে তিনি গানটি করলেন, যা ওই পারফরমারের অনুভূতির দরজা খুলে দিলো।  সেদিনের মহড়ার পরে ওই পারফরমারকে আর কিছু বুঝিয়ে দিতে হয়নি খালেদ খানের। খালেদ খানের এমন বিরল প্রতিভার কথা আমাদের সবারই জানা। তিনি তাঁর প্রতিভার সোনার কাঠি দিয়ে লোহাকেও সোনায় পরিণত করতে জানতেন।

অভিনয়, নির্দেশনা, সংগীত কিংবা মননশীল সৃজনশীলতায় তাঁর প্রতিভার নানারকম স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তাঁর কাজ দিয়ে। সেসব কাজ যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরাই উপলব্ধি করেছেন সেসব কতটা হৃদয়স্পর্শী ও প্রভাববিস্তারী ছিল।

থিয়েটারের নানাবিধ কাজ, সে অভিনয়-নির্দেশনা থেকে শুরু করে ক্লাস নেওয়া, কিংবা বৈঠকি ঢংয়ে নাটকের বিশেস্নষণ-সমালোচনা করা সব ব্যাপারেই তাঁর তুলনা তিনি নিজে। তিনি তাঁর নিজস্ব ঢংয়ে গত প্রায় ৩৫ বছর ধরে থিয়েটারের কাজ করে  সকল প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন মঞ্চের যুবরাজ। 888sport appsের তরুণ প্রজন্মের নাট্যকর্মী ও আবৃত্তিকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন সত্যিকারের যুবরাজ। তিনি ছিলেন হাজারো নাট্যকর্মীর অনুপ্রেরণা। বাতিঘরের মতো তিনি পথ দেখিয়েছেন তাদের।

মাত্র ১৮-১৯ বছর বয়সেই খালেদ খান যুক্ত হয়েছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মতো একটি খ্যাতিমান নাট্যসংগঠনে। নাগরিক মানেই দেশের সেরা সেরা নাট্যব্যক্তিত্বের সৃজনভূমি। খ্যাতিমান আর সৃজনশীলদের সমন্বয়ে অসাধারণ সব মঞ্চ প্রযোজনার জন্য নাগরিকের নামডাক ততদিনে ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। আলী যাকের, আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, ড. ইনামুল হক, জামালউদ্দিন হোসেন, রওশন আরা হোসেন,  লাকী ইনাম, সারা যাকের – এসব থিয়েটার ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে খুব কম সময়ের মধ্যেই খালেদ খান নিজের প্রতিভাগুণে তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠলেন। একের পর এক অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মন জয় করে চললেন খালেদ খান। তাঁর জাদুকরী অভিনয়গুণের প্রশংসা করতে গিয়ে বর্ষীয়ান নির্দেশক আতাউর রহমান বলেন, ‘খালেদ খান আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যখন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়-প্রযোজিত, আলী যাকের-নির্দেশিত অচলায়তন নাটকের মুখ্য চরিত্র ‘পঞ্চকে’র ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখি। এই নাটকে রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর কণ্ঠে ভিন্ন দ্যোতনা পেত, তেমনি তাঁর চঞ্চল-মজার-গভীর অভিনয় দেখে আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বিমুগ্ধতার কারণে আমার অভিনীত চরিত্র ‘আচার্যে’র সংলাপ ভুলে যেতাম।’

খালেদ খান যখনই যে-নাটকে অভিনয় করেছেন, তাঁর অভিনীত চরিত্রটি ভিন্নমাত্রা পেয়ে যেত। অন্য সবার থেকে আলাদা করে চোখে পড়তো তাঁর অভিনয়। তিনি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য করে তাঁর অভিনীত চরিত্রটি মঞ্চে উপস্থাপন করতেন। সংলাপ প্রক্ষেপণে ছিল তাঁর অসামান্য দক্ষতা। কণ্ঠের মিষ্টতা, সেই সঙ্গে মডিউলেশন, আবেগ-রস ও যতির ব্যবহারে তাঁর মতো ওস্তাদ অভিনয় কিংবা বাচিক888sport live chatী সত্যিই বিরল। মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি দ্যুতিময় হয়ে উঠত। গ্যালেলিও নাটকের আন্দ্রিয়ার, দর্পণ (শেক্সপিয়রের হ্যামলেট অবলম্বনে) নাটকের নামভূমিকায় কিংবা রক্তকরবীর বিশু – সবখানেই অভিনয়ে উজ্জ্বল রশ্মি ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। অভিনেতা হিসেবে তাঁর বিশালত্বের জায়গাটি তিনি তৈরি করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক-রচিত ও আতাউর রহমান-নির্দেশিত ঈর্ষা নাটকের যুবক চরিত্রে অভিনয় করে। মাত্র সাতটি দীর্ঘ সংলাপে কাব্যের বাঁধনে অাঁটা এ-নাটকে খালেদ খানের দুর্দান্ত অভিনয় দেখে নাট্যাচার্য শম্ভু মিত্রও অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন তাঁর। অভিনয়ে যদি কণ্ঠসংগীতের ব্যবহার থাকত কোনো নাটকে, সে-নাটকে খালেদ খানের অভিনয় অবধারিতভাবে হয়ে উঠত দর্শকের বাড়তি আগ্রহের বিষয়। অচলায়তনের পঞ্চক কিংবা রক্তকরবীর বিশুই তার প্রমাণ। অসুস্থ শরীর নিয়েও যখন তিনি বিশু চরিত্রে অভিনয় করতেন, তখন তাঁর শারীরিক সমস্যাকে তিনি আড়াল করে দিতেন তাঁর জাদুকরী বাচিক অভিনয় আর ভাবরসে-পূর্ণ সুরেলা কণ্ঠের সংগীত দিয়ে।

তাঁর সংগীত প্রতিভার কথা আগেই উলেস্নখ করেছি, তাঁর নির্দেশনায়ও একটা গীতল ভাব লক্ষ করি আমরা। অসাধারণ সংগীত যেমন সৃষ্টি হয় কথা ও সুরের সমন্বিত চলনে, তাঁর নির্দেশিত নাটকেও এ প্রভাবটি লক্ষণীয়। নাটকের টেক্সট নির্বাচনে তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রে অবস্থান করত ধ্রুপদিমানের রচনা। টেক্সটকে তিনি মঞ্চের সঙ্গে ব্লেন্ড করে দিতেন তাঁর অসাধারণ নির্দেশনা নৈপুণ্য দিয়ে। প্রপস, মঞ্চ, আবহ, আলোর ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দারুণভাবে মাত্রাজ্ঞান ও সূক্ষ্মমেধাসম্পন্ন। কালসন্ধ্যা, রূপবতী, ক্ষুধিত পাষাণ, পুতুল খেলা এরকম বেশকিছু নাটকের মধ্য দিয়ে নির্দেশক হিসেবে তাঁর দক্ষতার প্রমাণ তিনি দিয়ে গেছেন। তবে তাঁর কাছে দর্শকদের যে পরিমাণ প্রত্যাশা ছিল, তা তিনি পূরণ করে যেতে পারেননি অকালে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য – এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য গ্রুপ থিয়েটারে অাঁটোসাঁটো নিয়ম-কানুন ও সুযোগের অভাবের কারণে।

তিনি একজন বড়মাপের নাট্য ও বাচিক888sport live chat শিক্ষকও ছিলেন। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিল অত্যন্ত গভীর। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন বিশ্বমানব ও পরিপূর্ণ বাঙালি। তাঁর মতো প্রকৃত সংস্কৃতিবান মানুষ আমরা খুব কমই দেখেছি। তার সমস্ত কথায়, চালচলনে, ব্যবহারে আমরা এক বিশুদ্ধ সংস্কৃতিবান মানুষের প্রতিকৃতি দেখতে পাই।  মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন নির্ভেজাল, খাঁটি একজন মানুষ। নিজেকে সবসময় লোভ-লালসা-সুবিধাবাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন।

দীর্ঘদিন মোটর নিউরন রোগে ভুগে গত ২০ ডিসেম্বর খালেদ খান চলে গেলেন আমাদের থেকে অনেক দূরে, যেখান থেকে আর কোনোদিনই ফিরবেন না তিনি। তাঁর এই চলে যাওয়ায় আমাদের মঞ্চ হারাল সত্যিকারের এক যুবরাজকে, যিনি আর কখনো তাঁর শানিত কণ্ঠের সংলাপ দিয়ে আমাদের মঞ্চকে আবেশিত করে তুলবেন না। যুবরাজকে হারিয়ে 888sport appর মঞ্চ সত্যিই স্বজনহারা হয়ে পড়ল।

মঞ্চের যুবরাজ চলে গেলেন কিন্তু আমরা কি কখনো ভুলতে পারব তাঁর ক্ষুরধার বহুমাত্রিক প্রতিভার কথা, তাঁর সৃজিত 888sport live chatের ভুবন?

আমাদের সংস্কৃতির পুণ্যভূমিতে খালেদ খান যুবরাজের মতোই বেঁচে থাকবেন 888sport sign up bonusতে, দ্যুতিময় 888sport live chatসৃষ্টিতে।