বদরুন নাহার
আমার পা ক্রমশ শ্লথ হয়ে আসে, অথচ এতক্ষণ রেজওয়ানের আগে আগে হাঁটছিলাম। থেমে যাওয়ায় ও পেছন ফিরে এক ঝলক দেখে কোনো প্রশ্ন না ছুড়েই একা একা এগিয়ে গেল জামে মসজিদের অসংখ্য সিঁড়ি পেরোতে। সাধারণত এসব স্থানে থেমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক জেনে এসেছি।
সেই ছেলেবেলায় আমপারা পড়তে ঢুকেছিলাম মসজিদের বারান্দায়। ছোট হুজুর পড়াতেন আলিফ … বা… তা… ছা…। পাড়ার সব ছেলেমেয়ের হাতেখড়ি হতো সেখানে। বারান্দা থেকে দেখা যায় ভেতরে সারি সারি জায়নামাজ, তা পেরিয়ে মেহরাবে বসে বড় হুজুর কোরান শরিফ পড়ছেন। বড় হুজুরের কাছে যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছা, কিন্তু কাকে বলি। মসজিদ ও হুজুর প্রসঙ্গে কেউ বাড়তি কথা বলে না, আমি বরং একপাতা ছিপারা দ্রুত পড়ে পরের পাতায় যাওয়ার চেষ্টা করতাম। যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয় আর কোরান শরিফ হাতে সোজা চলে যাওয়া যায় বড় হুজুরের কাছে, দুলে দুলে কোরান পড়তে। কিন্তু কিছুদিন বাদেই আমাদের পাড়ার তন্দ্রা আপাকে ছিপারা হাতে আসতে না দেখে জানতে পারি, মেয়েদের শরীর খারাপ হয়, মেয়েদের শরীরের গোপন রক্ত ঝরে পড়ে। আর তা ভীষণভাবে লুকিয়ে রাখার। যেন সে-রক্তের গন্ধে দৈত্য-দানব ছুটে আসবে, খেয়ে ফেলবে! তারা আর মসজিদে আসতে পারে না। আমারও আর মেহরাবের ভেতর বসে দুলে দুলে কোরান পড়া হয় না। তখন থেকেই মসজিদের সামনে যেতে হলে পা ভারী হয়ে আসত। বড় হতে হতে আমার ভেতরের কিছু বিষয় আতঙ্কসহকারে বেড়ে উঠতে লাগল! আরো পরে যখন বুঝতে শিখলাম যে এসব তেমন ভয়ের না, এমনকি তাত্ত্বিক নানা বিশ্লেষণ আমি নিজেও বলতে পারছি, তখনো বহুদিনের অভ্যস্ততায় সেসব ভয়ে প্রায়ই হৃদয় ছলাৎ করে ওঠে।
এসবের মধ্যে মসজিদ যেমন ছিল, তেমনি ছিল কবরস্থান। কবরস্থানের সামনে দিয়ে যেতেও সে কী যে ভয় আর আড়ষ্টতা জেগে উঠত। আসসালামু আলাইকুম ইয়া হালাল কুবুরে বলতে বলতে বুকে ফুঁ দিয়ে জায়গাটা পেরোতাম। বিষয়টা এমন হলো, জায়গাটা দৌড়ে পেরোতে পারলে ভালো; কিন্তু তখন পা-গুলো খুব ভারী লাগত, দৌড় দেওয়া হয়ে উঠত না। এমনকি পায়ে যেন জোরে শব্দ না হয়, তাও মাথায় থাকত। আমার কিন্তু কোনো ভূতের ভয় ছিল না। কবরস্থান মাথায় চেপে বসায় পরবর্তী জীবনে কতবার হাস্যকর ঘটনা ঘটেছে।
888sport app শহরে মফস্বলের মতো যত্রতত্র কবরস্থান খুঁজে পাওয়া যায় না, তবে ময়লার ঢিবি এখানে-সেখানে। গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না একবারেই, তাই সে-বিষয়েও ছিল আতঙ্ক। 888sport appর অগণিত ডাস্টবিনের সম্মুখীন হয়ে আমি যেন কবর পাড়ি দেওয়ার মতো আতঙ্কিত হই! এবং অসংখ্যবার তাড়াহুড়ো করে নাকে কাপড় টেনে ডাস্টবিন পেরোতে পেরোতে বিড়বিড় করে আসসালামু আলাইকুম পড়ে ফেলতে গিয়ে খেয়াল হতো, এটা কী করছি! নিজেকে নিয়ে নিজেই হাসতাম, আতঙ্ক ব্যাধি। ব্যক্তিগত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে চলাফেরা শুরুর পর আমার সে-ভয় কেটে গিয়েছিল। যা বলছিলাম, মসজিদ বিষয়ে নিয়মটা দীর্ঘদিনের লালনের ফলে আজো তাই হলো। ভারতে এসে মুঘল ঐতিহ্যের স্থাপত্য নিদর্শন দেখতে বেরিয়েছি, মসজিদ তাদের 888sport live chatবোধ অবলোকনের অন্যতম জায়গা। জামে মসজিদের সুুদীর্ঘ সিঁড়ির সারিতে গিয়ে আমি থেমে যাই। আর ঠিক তখনই দেখতে পেলাম সকল ধাপ পেরিয়ে কিছু 888sport promo code মসজিদের তোরণ-সদৃশ খিড়কি দুয়ার পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নামাজ পড়া হলেও এখন এটা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।
এবার আমিও উঠতে শুরু করলাম। সেখানেই আমাদের সঙ্গে দেখা হয় এখলাসের। সে মসজিদে প্রবেশকারীদের জুতা সংরক্ষক। এখলাসকে কিছু না বলতেই সে নিজে থেকে বলে – আপনারা 888sport apps থেকে আসছেন?
এ-কথায় সহসা আমোদিত বোধ হলো, যেন কতটা আপন, চিনে ফেলেছে! যদিও তার কথার উচ্চারণে নন-বেঙ্গলি টোন আছে। আর সে-বোধের ধারা বেশিক্ষণ প্রবাহিত হয় না, যখন সে জানায় যে, সে 888sport apps ছেড়েছে একাত্তরে। তখন করুণা জাগে এবং পরবর্তীকালে আমাদের মনে রাগ ও ঘৃণার অনুভূতি ঢুকে পড়ে যখন এখলাস জানায় যে, সে মূলত বিহারি। তখন আমি তার মধ্যে পাকিস্তানি গন্ধ পেতে থাকি, যে-গন্ধটা বরাবরই কটু ও বীভৎস। এবং ততক্ষণে অনুভব করি যে, আমাদের এখলাসের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, জুতা জমা দিতেও আমার বাধো বাধো লাগে। ফলে দ্রুততার সঙ্গে তা জমা দিয়ে আমরা পবিত্র মসজিদে প্রবেশ করি।
সে-পরিবেশে অজস্র জালালি কবুতর দেখেও মন ভালো হয় না। 888sport sign up bonus-আক্রান্ত হয়ে যাই, বেড়ে ওঠার জীবনে চিহ্নিত শক্র হিসেবে মনে পড়ে বিহারিদের কর্মকথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের ওপর নৃশংসতা চালায় তারা, মনে মনে এখলাসের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে থাকি। আমি যেন একটু বেশিই প্রতিক্রিয়াশীল, যতটা রেজওয়ান নয়। খানিকটা গজগজ করে তিক্ততা প্রকাশ করি। রেজওয়ান সবটুকু শুনে বলে – সব ঠিক আছে, কিন্তু তুমি এখলাসকে পাকিস্তানি ভাবছো কেন? ও তো বিহারি, বিহারিরা তো পাকিস্তান থেকে আসেনি। ওরা তো ভারতের বিহার থেকে পূর্ব পাকিস্তান গিয়েছিল।
– হ্যাঁ, তাই তো! কী আশ্চর্য, আমি তো সারাজীবন বিহারি মানে পাকিস্তানি ধারণা করে বসে আছি।
রেজওয়ানের সবসময় যে-কোনো বিষয় নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করার প্রবণতা। আর আমি যখন ‘তাই তো’ বলে ফেলি, তখন ও যেন সেই সুযোগটাই নিতে চায়, বলে – ক্ষোভ জাগুক আর যা-ই হোক বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে জানতে হবে, বিহারি যে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় অভিবাসী, এটা ভুললে তো চলবে না।
– থাক, হয়েছে। এসব নিয়ে এখন আলোচনায় না মাতি, বরং চলো মেহরাবের ভেতরটা দেখে আসি।
সে তবু বলতে থাকে – আসলে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিভাজনটা বুঝতে…
– তুমি থামবে? যা দেখতে এসেছি তাই দেখি…
এবার তার কণ্ঠ আরো শান্ত ও নিরীহ হয়, যা অবজ্ঞা করা যায় না। সে বলে – হ্যাঁ, তাই দেখা উচিত, কিন্তু তুমি তো মনের ভেতর থেকে জিনিসটা দূর করতে পারছ না। ভালো করে দেখবে কেমনে?
আমি নিজেকে পাল্টে ফেলি, মসজিদের চত্বর দেখিয়ে উচ্ছল ভঙ্গিতে বলি – এক কাজ করি, আমি কবুতরগুলোর ভেতরে দৌড়ে যাই, তুমি বিখ্যাত একটা ছবি তুলো।
এবং আমরা পর্যটকদের সস্তা পদ্ধতিতে উচ্ছলতায় ডুব দিই। শান্তির পায়রা উড়িয়ে 888sport slot game-আনন্দে ফিরি। কত নান্দনিক আর বিশাল অস্তিত্ব নিয়ে বসে আছে প্রার্থনালয়। চারপাশে তার রাজকীয় মোড়ক।
কিন্তু আমাদের জন্য গচ্ছিত জুতা নিয়ে অপেক্ষা করে এখলাস। তার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও নগ্ন পায়ে তো বেরিয়ে পড়া যায় না। আর তখন আমরা পরিচিত হই আছিয়া খাতুনের সঙ্গে। সে এখলাসের স্ত্রী, দ্বিতীয় শিফটের ডিউটি দিতে এসেছে। এখলাস তখনো বিদায় নেয়নি, সে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
বয়স্ক এখলাসের কথায় চমকে উঠি। সে বলে – সৈয়দপুরে আমাদের গ্রামে মুক্তিবাহিনী আসেনি, তাই আমি আর মা ও দুই বোনকে নিয়ে পালিয়ে বেঁচে আছি।
মুক্তিবাহিনী এলাকায় না আসাটাকে কেউ যে সৌভাগ্যের মনে করছে, ভাবতেই পারি না। মুক্তিবাহিনী, বিচ্ছু বাহিনী দেশ ও স্বাধীনতার প্রতীক। আমার উসখুস ভাব দেখে রেজওয়ান হাত ধরে চুপ থাকার ইঙ্গিত করে। এবং এখলাস জানায়, তার ভাইয়েরা নীলফামারীতে মেসে থাকত, সেখানে তাদের দুই ভাইকে মেরে ফেলা হয়। ওই একাত্তরে।
লক্ষ করি, সে বলে তার ভাইয়েরা একাত্তরে মারা গিয়েছিল, আমাদের কেউ মারা গিয়ে থাকলে আমরা বলি যুদ্ধে মারা গিয়েছে। কারণ যুদ্ধটা আমাদের জন্য জরুরি ছিল, ওদের নয়। এখলাস যতটা শোকাবহ কণ্ঠে কথাগুলো বলুক না কেন, আমার ভেতর সে-মৃত্যুর প্রতি কোনো সহানুভূতি সহসা জেগে ওঠে না। বরং মনে পড়ে একাত্তরের সময় মিরপুরের বাস থেকে নামিয়ে কত নিরপরাধী বাঙালিকে বিহারিরা নৃশংসভাবে মেরেছিল। আমি তো নিশ্চিত নই যে এখলাসের ভাইয়েরা মারা যাওয়ার আগে কতজনকে মেরেছে। মনের ভেতর তুমুল তোলপাড় নিয়েই তাদের উদ্বাস্তু হওয়ার গল্প শুনি। সে বলে, সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় তাদের পরিবার বিহার ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের সৈয়দপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করে। তার বাবার সেখানে ছোট্ট মুদিখানা ছিল। তখন এখলাসের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। সৈয়দপুরে তার উনিশটি বছর কেটেছে, তারপর একাত্তরে তারা আবার ভারতে ফিরে আসে। আমি সহসা বলে উঠি – ভালোই তো, আপনি তো আপনার দেশেই ফিরে এসেছেন।
এ-কথায় এখলাস অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বলে – এটাও আমার দেশ না।
– কেন? বিহারে আপনাদের কিছু ছিল না?
সে জানায়, বিহারে এসে তারা তাদের কোনো কিছু ফিরে পায়নি। এমনকি সে আমার দিকে চেয়ে বলে – সৈয়দপুরে গেলেই কি ভিটামাটি ফিরে পাব?
আমি কোনো উত্তর খুঁজে পাই না, কিন্তু মনে মনে তীব্র জাতীয়তাবোধে আক্রান্ত হই আর ভাবি, আপনি তো 888sport appsে জন্মাননি, আপনার দেশ তো ভারত, বিহার। কিন্তু কোথায় যেন বিষয়টি বলতে সংকোচ বোধ হয়। মুখে কিছু বলতে পারি না। যুদ্ধের ক্যাজুয়ালিটির সঙ্গে মানুষ এক জীবনে কতবার উদ্বাস্তু হতে পারে? তাই ভাবছি।
এখলাস হয়তো জানত, আমি কোনো উত্তর দিতে পারব না। তাই আর অপেক্ষা করে না। সে তার মতো যা বলে তা যেন ইতিহাসের পাতা থেকে পাঠ করা জীবন-888sport live chat। তার বড় বোন এখনো 888sport appsেই আছে, 888sport appর মিরপুরে থাকে। আমার মনের কোনো গোপন চিন্তা কি আছিয়া খাতুন পড়ে ফেলেন, কোনো বিতৃষ্ণা। এতক্ষণ নীরব শ্রোতা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি জানান – আমি কইলাম পূর্ব পাকিস্তান মানে, আপনেগো 888sport appsের মেয়ে।
তিনি কি আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন? ধুর.. এসব কি ভাবছি! ব্যক্তিগত আক্রান্ত হচ্ছি কেন? আমিও তো চাইলে কতশত বিহারির অপকর্মের গল্প বলা শুরু করতে পারি। তারা যে পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসিত হয়ে আমাদের আপন করার চেষ্টা করেনি, পশ্চিম পাকিস্তানের হয়ে উঠেছিল। আছিয়া খাতুনকে কি এখলাসের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখব? আন্তরিক হব, আমার জাতীয়তাবোধের কাছে কোনো উত্তর মেলে না। কিন্তু তারা কোনো সামগ্রিক কথা বলছে না, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প করছে। কেনই বা করছে? বাংলায় কথা বলি দেখে? আমার নামের আগে বেগম আর রেজওয়ানের নামের আগে মোহাম্মাদ আছে বলে? না-কি নতুন করে তাদের জীবনে সংশয় এবং উদ্বাস্তু সংকট ঘনিয়েছে বলে।
এখলাস তখন জানায় একাত্তরে আছিয়া খাতুনের বয়স মাত্র দশ-এগারো হবে। মা আর দুবোনকে নিয়ে পালাবার পথে সীমান্তবর্তী এক গ্রামে আছিয়াকে পায়। সদ্য পাকিস্তানি সৈন্যরা অপারেশন শেষ করে ফিরে গেছে সে গ্রাম ছেড়ে, অসংখ্য লাশের পাশে রক্তাক্ত আছিয়া খাতুনকে তারা খুঁজে পেয়েছিল। সেই থেকে তাদের সঙ্গেই ছিল। আছিয়া খাতুনের কি সৌভাগ্য! সে বেঁচে ছিল, সে পালাতে পেরেছে। আমি তার মুখের দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতে চাই, কিন্তু সরাসরি তাকাতেও পারি না। যেসব মানুষের গল্প শুনেছি তারা দেখতে কেমন হয় আমার জানা ছিল না। তারা যে নতুন করে শঙ্কায় আক্রান্ত হয়ে আছে তা নজর এড়ায় না। যে-আশঙ্কার খবর 888sport appsের মানুষের মুখেও আলোচিত হচ্ছে। ভারতের নির্বাচন প্রসঙ্গে।
রেজওয়ান বরং প্রশ্ন করে – আপনার বাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই?
তিনি জানান তার গ্রামের সবাই জানে আছিয়া খাতুন একাত্তরে মারা গেছে। তাদের সেই অতীত গল্পের মাঝে বর্তমান এসে দাঁড়ায়। এখলাসের একমাত্র পুত্র খালিদ। তেমন একটা বাংলা কথা বলে না, সে বাবা-মাকে কোনো এক বিষয়ে তাড়া দিতে এখানে এসেছে। সে বুঝতে পারে, এখলাস আর আছিয়া কী প্রসঙ্গে কথা বলছে, হিন্দি এবং বাংলার মিশ্রণে সে যা বলে তা তাদের বর্তমান অস্থিরতার কথা। সে আমাদের জানায়, তার বাবা-মা অকারণে ভয় পাচ্ছে, এমনকি তারা বাড়িতে ব্যাগ গুছিয়ে রেডি করে রেখেছে, নির্বাচনের পরে মোদি সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের যদি 888sport appsে ফেরত পাঠায়। খালিদ হাসতে হাসতে বলে যে অযথা টেনশন করছে, সে নিজে এমন ভয় পায় না। নিজের জন্মভূমি থেকে কি কাউকে তাড়ানো যায়?
এখলাসের মতে খালিদ চ্যাংড়া ছেলে, সে জীবনের ভয়াবহতা বোঝে না। দেশ বলতে সে ইন্ডিয়া ছাড়া কিছু বোঝেও না। এখলাসের বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে – দেশ কী তা আমরা জানি, আমাদের কোনো দেশ নাই।
খালিদ চলে যায়, অন্যদিকে আছিয়া খাতুনও নিশ্চিত নয় ফিরে গেলে বেঁচে থাকা ভাইবোন, জ্ঞাতিগোষ্ঠী তাকে ঠাঁই দেবে কি-না। তাদের চোখেমুখে প্রচণ্ড অনিশ্চয়তা খেলা করে। এখলাস বলে জীবনে সে কত পরিবারকে টুকরো টুকরো হতে দেখেছে। তার নিজের পরিবার-জ্ঞাতি কেউ ভারতে, কেউ 888sport appsে আর কেউ বা পাকিস্তানের কোনোখানে। তাদের আর দেখা-সাক্ষাৎও হয় না। কাঁটাতার তাদের ঘিরে রেখেছে।
এখলাস আরো বলে – এই হিন্দুরাই তো ভ্যাজালটা বাধাল।
এতক্ষণের উদ্বাস্তু বিহ্বলতাকে কাটিয়ে আমি তার এ-কথায় আবার সতর্ক হয়ে উঠি। তার কথায় সাম্প্রদায়িক শত্র“র বিষয়টিই মুখ্য হয়ে থাকে। ভাবলাম, এরা সেই একই অবস্থান থেকেই বিষয়গুলো ভাবছে। তাদের কাছ থেকে দিল্লির মসনদ, বার্মিংহাম প্যালেস, ক্রেমলিন, হোয়াইট হাউস বহু দূর! ক্ষমতায়ন, ক্ষমতার ডিস্ট্রিবিউশন আর তার খেলায় তারা নেই, তাদেরকে খেলতে দেওয়া হয়েছে ধর্মের দোহাই।
কথাটা তাদের আর বললাম না, আমরা পারস্পরিক কথা কখনো বলি না। ফেরার পথে রেজওয়ানকে বলতেই ও বলল – তুমি নিজেই কি ওদের কথা শোনার জন্য তৈরি ছিলে? 888sport appsেও তো হিন্দু প্রসঙ্গে একই ভাবধারা চালু রয়েছে।
নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। ও বুঝতে পারল এখন আমার কোনো আলোচনার মুড নেই। সদ্য শ্র“ত ঘটনাটাকে ওলটপালট করে দেখছি হয়তো। রেজওয়ানেরও বোধহয় তেমনি অবস্থা, ও আর কথা বাড়ায় না। আমরা হোটেলে ফেরার পথটাতে নিশ্চুপ মগ্নতায় কাটায়। পাশ কেটে চলে যায় রতন-টাটা, বিলবোর্ডে শিশুদের বেড়া ওঠার নিউট্রিশনের হাতছানি।
আমার মনে পড়ে কুতুব মিনারের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াবার কথা, এবং সেখানে মুঘল নকশার কারুকাজ ভেঙে দু-এক জায়গায় নৃত্যরত রমণীর নগ্নরূপ। এইখানে পুরোহিতের ধূপ-ধুনোর দিন শেষে একদিন নতুন পলেস্তারায় সেজেছিল মসজিদের মেহরাব, কোথাও বা মন্দিরের ভাঙা ইটে জেগে ওঠে আরবি হরফ। সবচেয়ে সহজে মানুষের মনে ভয় ঢুকে যায়, সবচেয়ে সহজে মানুষ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আমার মন উদ্বাস্তু হয়। আমি তাহলে আছিয়া খাতুনের জন্য চিন্তিত! রেজওয়ান একসময় বলতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাপনা, কলোনিয়াল ডিভাইস আর মানুষের এই ক্রাইসিসটা শুধু এই উপমহাদেশেই নয়, রাশিয়া, লাতিন আমেরিকা কোথায় নেই। বিশ্বাস-ধর্ম-মূল্যবোধ তো বহু আগে পণ্যের ঝুড়িতে বিক্রি হচ্ছে।
কথাগুলো যেন আমাকেও বলে না, নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। আমাদের 888sport slot game শেষ পর্যন্ত একলাস আর আছিয়া ভাবনায় ঠেকে। এমনকি আমরা তাজমহলের রূপের কথা বলি না।
কত কথাই না হয় রাতে। আমি রেজওয়ানকে নাদিরা বেগমের গল্প বলি। আমার বাবার বন্ধু রুইস উদ্দিনের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। রাজবাড়ী রেলের স্টেশন মাস্টারের মেয়ে নাদিরা বেগম, তার গৃহশিক্ষক ছিলেন রুইস উদ্দিন। নাদিরা বেগমের মা বিষয়টা জেনে ফেললে রুইস উদ্দিন খুব ভীত হয়ে পড়ে। এটা উনিশশো ঊনসত্তরের ঘটনা। কিন্তু নাদিরা বেগমের বাবা বিহার থেকে আসা আলি আসগর নিজে রুইস উদ্দিনকে ডেকে কথা বলেন। রুইস উদ্দিন তার বন্ধুদের জানায় আলী আসগর বলেছেন যে তুমি যেহেতু নাদিরাকে পছন্দ করো, আমরা ঠিক করেছি তোমার সঙ্গেই নাদিরার বিয়ে দেবো। তিনি এটাও বলেন যে নাদিরার বিয়ে 888sport appতে হবে, কেননা তার দাদা-দাদিরা 888sport appয় থাকেন। রুইস উদ্দিন মেস ছেড়ে গ্রামে ফিরে বাবা-মার কাছে বিষয়টি জানায় এবং পরের বছর তাদের বিয়ের প্রস্তুতি চলে। কিন্তু তারপর থেকে দীর্ঘদিন তার বন্ধুরা রুইস উদ্দিনের কোনো খোঁজ পায় না। রেলের মাস্টারও বদলি হয়েছে শুনতে পাওয়া যায়। 888sport app শহর থেকে তাদের আরেক বন্ধু আলী আকবর জানায় যে রুইস 888sport appয় তার মেসে উঠেছিল। সেখানে থেকে সে বিয়ের জন্য নানা কেনাকাটাও করেছে। নাদিরা বেগমের প্রেম এবং বিয়ের কাহিনি গল্প হয়ে যায় তারও কয়েক দিন বাদে, যখন 888sport app শহরের এক বাক্সবন্দি লাশ রুইস উদ্দিনের বলে শনাক্ত হয়। আলী আকবর জানায়, খবর পেয়ে সে লাশ দেখতে গিয়েছিল এবং লাশভর্তি বাক্সটি রেলের ছিল বলে তার মনে হয়েছে। সে নাদিরা বেগমের ঠিকানায় খোঁজ নিতে গেলে সেখানে তাদের পায় না। রেজওয়ান গল্পটি শুনে কোনো মন্তব্য করে না। বরং সকাল সকাল উঠতে হবে বলে ঘুমাবার তাড়া দেয়।
আগামীকাল ভোরের বাসে আমরা সীমান্ত পেরোব, দেশে ফিরব, স্বজনদের সঙ্গে দেখা হবে, ভেতরে ভেতরে যেন একটু বেশিই উতলা ছিলাম। ফেরার পথটা অনেক দীর্ঘ মনে হয়। আসার সময় এমনটা হয়নি। আমার মনে কি বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়!
ঘুমটা ততটা মসৃণ হলো না। ভোররাতে খুব খারাপ একটা স্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, একজন 888sport promo code সৈয়দপুরের রেললাইনের ওপর ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে আমার মনে হয় নাদিরা বেগম, কিন্তু আমি স্বপ্নের মধ্যেও দেখতে পাই আছিয়া খাতুনকে। কেননা, আমার সঙ্গে নাদিরা বেগমের কখনো দেখা হয় নাই। আছিয়া খাতুনের হাতের ব্যাগটা ভীষণ ভারী এবং তা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত!
জেগে উঠি, পাশে তাকিয়ে দেখি রেজওয়ান আছে কি-না, ও নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, অকারণে গুছিয়ে রাখা ব্যাগটাও এক ঝলক দেখে নিই! ভোরের আলোয় নিজেকে গোছাতে থাকি। ভাবি এই ভয়াবহ স্বপ্ন আর দেখতে চাই না। আর তাই সিদ্ধান্ত নেই এ-স্বপ্নের কথা আমি কাউকে বলব না।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.