দুপুর রাতের দিন

পারভীন সুলতানা
কী দ্রুতই না পার হচ্ছি শহর-নগর-গঞ্জ, গ্রাম, হাট-বাজার, নদী-খাল আর সারবাঁধা ক্ষেতিখলা। সবকিছুই ঘুমন্ত এখন। মাঝরাতের ট্রেন ঘুমকাতর আধবোজা স্টেশনে কিছু কিছু মানুষ নামাচ্ছে বা তুলছে। ট্রেনের ভেতর যাত্রীরাও ঘুমে লতোপতো। ছুটে-চলা অধৈর্য ট্রেনটার ওপর রাগ হয় আমার। কাকচোখ জ্যোৎøায় ভেসে যাচ্ছে বাইরের দুনিয়া। কিন্তু দেখার উপায় কই! দুরন্ত গতির তোড়ে কী নদী, কী শস্যের ক্ষেত, ঝাঁকড়া শিলকড়ইয়ের ঢুলুঢুলু পাতা, আম-জাম কিংবা ঠ্যাঙা তালগাছের সারি চোখের পলকে হারিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। নির্ঘুম রাত রচনা করে জেগে থাকি। একটা ছোটমোটো স্টেশনে থামে রেলগাড়ি। জানালার কাঁচ ওঠাই। ক্রসিং হবে এখানে। দুধেল জ্যোৎøা এতক্ষণে আমার চোখে জুতমতো ধরা দেয়। ট্রেন থামায়, স্টেশনের নামটা জানার জন্য জানালা
দিয়ে গলা বাড়াই। নাহ্, দেখার উপায় নেই। ট্রেনের শেষ প্রান্তের লেজে আমার বগি। নাকে একটা বুনো গন্ধ পাই। চোখের সামনেই গাছপালা ঠাসা একটা জঙ্গল। চাঁদের ফর্সা আলোয় ফণীমনসার বেটেখাটো একটা ঝোপে একঝাঁক হলুদ প্রজাপতি দেখি। স্ফটিকের মতো চনমনে জ্যোৎøালোকে রঙিন পতঙ্গগুলো পর্যন্ত বিভ্রমে পড়েছে দেখি। কৈশোরে একটা রাশান বইয়ে মজার গল্প পড়েছিলাম। গল্পটার নাম ছিল ‘মধ্যরাতের দুপুর’। এই রকম ছলকানো জ্যোৎøায় একদল লোক হিমশীতের চান্নিপশর রাতে বনে গিয়েছিল ম্যাপলগাছের রস সংগ্রহ করতে। বনে গিয়ে তো লোকগুলো অবাক – আছড়েপড়া জ্যোৎøায় বরফের কুঁচিগুলো হয়ে গিয়েছে সব মুক্তো…। আমার মনে হয় জায়গাটা সম্ভবত গাজীপুর, মাওনা, টঙ্গী বা শ্রীপুর এলাকায় হবে। চোখের সামনে শালবন। জানালার কাছে বসেই হেতাল, হরকোচ, সেয়াকুল পাতার ঘ্রাণ পাই। দেখি শালের শক্ত ডাল ধরে পাছালাল বানর ঝুলছে। ট্রেনের হুইসেলে কয়েকটা আবার এ-ডাল থেকে ও-ডাল করে। হঠাৎ একটা কাঠবিড়ালিকে তড়–ক তড়–ক করে পালাতে দেখি। নির্জন রাতে কানে আসে খাটাশের ডাক, পাতাঝরার শব্দ। একটা টাটকা জঙ্গুলে গান শুনি অনেকদিন পর। রাত হলেও জ্যোৎøার দাপটে বন এখনো ওম ঘুমে ডুবতে পারছে না। ঝাঁকুনি দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে বিশ্বাসঘাতক ট্রেনটা আবার ছুটতে শুরু করে। বিরক্তিতে একসময় ক্লান্তি আসে। চান্নিপশর সত্ত্বেও ট্রেনের ছুটে চলা একরোখা মেজাজে চোখের আওতায় বিছানো নদী-মাঠ-খাল-ক্ষেত সব একাকার হয়ে যায়। দুরন্ত গতির চাতুর্যে লেপ্টে যায় সবকিছু। আমিও ঘুমিয়ে পড়ি। ‘মধ্যরাতের দুপুর’ আর দেখা হয় না আমার।
ঘণ্টা তিনেক পর হুইসেল, কুলির ডাকাডাকিতে জেগে উঠি। ময়মনসিংহ জংশন। ট্রেনের শব্দে ঝিমানো প্লাটফরমে শোরগোল শুরু হয়।
ফেরিওয়ালা আর কুলির দল, ঘুমন্ত ভিক্ষুক, অপেক্ষাক্লান্ত যাত্রীর বিশ্রামে ফাটল ধরিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। যদিও রাতের ক্লান্তি ওদের চোখের নিবিড় পাতায়, হাত-পায়ের ভাঁজে, ভাঙা গলার স্বরে মিহি-মিহি লেগে আছে। তবু এদের কাছে এক-একটা ট্রেন রোজগারের নির্ভরশীল ভরসা। আমিও নামব এখানে। আমার ঘুমভাঙা চোখ আর শরীর প্লাটফরমের ছককাটা আলো-আঁধারিতে একটু একটু থিতু হতে থাকে। ট্রেন বদলাতে হবে। সেই ট্রেন শম্ভুগঞ্জ, বিশকা, সোহাগী, গৌরীপুর, নান্দাইল, মুসুল্লি, কিশোরগঞ্জ স্টেশন ভিঙিয়ে আমাকে পৌঁছে দেবে নীলগঞ্জ স্টেশনে। নীলগঞ্জ থেকে রিকশায় যাব তাড়াইল। সেখান থেকে আমার মাতুলালয় বলাইশিমুল। দীর্ঘ ১৯ বছর পর আমি সেখানে যাচ্ছি একটা ‘দুপুর রাতের দিন’ দেখার দুর্মর কাক্সক্ষায়। এত বছর পর এলেও ময়মনসিংহ জংশনকে সেই আগের চেহারায় পাই। প্লাটফরমের মেদহীন, জৌলুসহীন নেভা-নেভা চেহারা। নতুন কোনো স্থাপনা নেই। সেই রংহীন পুরনো টিকেট ঘর, প্লাটফরমের অমসৃণ পাটাতন…। লাইনে ট্রেন থাকলেও তাতে প্রাণ নেই। ইঞ্জিন জোড়া লাগতে এখনো ঘণ্টাখানেক লাগবে। টিকিট কাটতে গিয়ে জানলাম। রাতের বয়স বেড়ে যাওয়ায় ফকির, ছিঁচকে চোর, টোকাই, এমনকী চা দোকানদাররা পর্যন্ত ঘুমের আয়েশি জগতে ডুবে।
স্টেশনের প্রথম শ্রেণি বা দ্বিতীয় শ্রেণি কোনো বিশ্রামাগারই পছন্দ নয় আমার। চার দেয়ালের বন্দিত্বকে স্রেফ জীবন ও জীবিকার কারণে মেনে নিলেও সুযোগ পেলে তাকে স্পর্ধাভরে প্রত্যাখ্যান করি আমি। প্লাটফরমের সিমেন্ট বাঁধানো আধভাঙা একটা বেঞ্চে বসি। চারপাশজুড়ে রচিত জীবনের চালচিত্র সাবলীল দৃশ্যমান হয় চোখে। তখনই এক কিশোর মুচি উদয় হয় সামনে। ওর ডান কব্জিতে ভ্রাম্যমাণ পসরা। সম্ভবত আমার পায়ের কালো জুতো জোড়াই ওকে এখানে আসতে প্ররোচিত করেছে – স্যার জুতা কালি লাগাব? কখনো কখনো এদের সান্নিধ্যও পছন্দ করি। বলি – ঘুম আসে না? এই মধ্যরাতেও তোর জুতা কালি করতে হবে? সম্ভবত এরকম প্রশ্ন শুনে ও অভ্যস্ত নয়। খামোখা দাঁত বের করে হাসে ও – ঘুমাইছিলাম স্যার, পুলিশের বাড়ি খাইয়্যা উইট্টা পড়ছি। অবাক হই না। সরকারি জায়গায় বিনা ট্যাক্সে ঘুমিয়ে পড়লেই হলো? পুলিশ তো তাদের মহান দায়িত্ব পালন করবেই। কত আর বয়স ছেলেটার। তেরো কী চৌদ্দ। জুতা কালির তেমন দরকার নেই আমার। তবু বলি – ভালোই হলো তোকে পেয়ে, কুটুমবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। সুন্দর করে কালি কর। একদম আয়নার মতো ঝকমকা। ছেলেটা ওর গুরুত্বে খুশি হয়ে ওঠে।
একটা সুরেলা 888sport promo codeকণ্ঠ ঘোষণা করে – ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জগামী এগার সিন্ধু ট্রেনটি কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই নম্বর প্লাটফরম থেকে ছেড়ে যাবে…। আমার সঙ্গে ভারি কোনো মালামাল নেই। দ্রুত পায়ে নির্দিষ্ট প্লাটফরমের উদ্দেশে ছুটি।
এই প্রথম একা একা বলাইশিমুল যাচ্ছি আমি। আগে শুধু আমাদের পরিবারই নয়, সঙ্গে থাকতো খালা, মামা আর ভাইবোনরা। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মায়েরাও তাদের সংসার থেকে কিছুদিনের জন্য ছুটি পেত। তখন বেশ কিছুদিনের জন্যেই মামাবাড়ি যেতাম আমরা। সাধারণত অগ্রহায়ণের শেষের দিকেই যাওয়া হতো। নতুন ফসল ওঠার আনন্দে গ্রামজুড়ে থাকত উৎসবের আমেজ। ফসলশূন্য ক্ষেতগুলো কিন্তু খালি পড়ে থাকে না। কিছুদিনের মধ্যেই বাচ্চাদের হুটোপুটিতে হয়ে ওঠে দাড়িয়াবান্ধার কোট, ছি-বুড়ি, হা-ডু-ডু বা ডাঙ্গুলি খেলার মাঠ। আর একটা বড় আকর্ষণ ছিল, নানাদের বিশাল উঠানে সারসার হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে পুঁথিপাঠের আসর বসত। তবে খামোখা হ্যাজাক জ্বালানো হতো। ভরা জ্যোৎøায় পুঁথির আসর জমতো। ফক্ফকা জ্যোৎøায় ওসমান মুসল্লি যখন দরদি গলায় সুরেলা বয়ানে পড়তো –

হায় হায় গো কান্দে ফাতেমা
আরশ আঁকড়াইয়া
ইমাম উছেন হইছেন শইদ
কারবালাতে গিয়া।
আল্লা, দারুণ কার্তিক মাসে জাদু
যায় গো আহরণে
আসিবে কি না আসিবে
চিন্তিত মনে…
তখন বদমেজাজি বলে খ্যাত মেজোমামাও পাঞ্জাবির লম্বা হাতায় লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ মুছত। তবে ওসমান মুসল্লির এক ডিগ্রি ওপরে ছিল নসুর বাপ। তার গলা ওসমানের মতো সুরেলা না হলে কী হবে, পাঠপূর্ব ভনিতায় নসুর বাপ তার বক্তব্যের ভেতর মরমি আকুলতা তৈরি করে একটা প্রাক্কালীন শোকগাথনের আয়োজন সম্পন্ন করে শুরু করত –
আহারে উছেন আহারে উছেন
বুকের কাইলজা ছিঁড়া ধন
তুমারে বিনা তো বাপধন
না যাইব জীয়ন…।
ফাতেমারও কান্দনে কান্দে
সপ্ত আসমান
আরশও ফাটিয়া যায়
শুনো বন্দেগান…
নসুর বাপের বিষাদ উদ্রেককারী প্ররোচণায় শ্রোতৃমণ্ডলী সম্ভবত জীবিত শরীরেই ইহলোক ত্যাগ করে সপ্তম আকাশে ধাবিত হয়। উপস্থিত কারো চোখ আর শুষ্ক থাকে না। অন্দরে বসে থাকা মহিলাদের ফোঁপানোর আওয়াজ উঠানেও উড়ে আসে কিছু কিছু। ময়-মুরব্বি আর বৃদ্ধদের গণ্ড উঁচু তোবড়ানো গালের চাপদাড়ি বেয়ে ঝরঝর করে অশ্র“ পড়ে। মা-খালাদের মিহি করে সুপারি কাটার শব্দ আসে। তবে পুঁথির লম্বা লম্বা চরণে ছোটদের মন থাকত না। হোক না সুরেলা বা যতই দিল দুখানিয়া। ধুন্ধুমার চান্নিপশর রাতে আমরা দলবেঁধে গোপাটে চলে যেতাম। পথপাশের ঝোপঝাড়ে ফড়িং আর প্রজাপতির ঝাঁক উড়তে দেখা যায়। এমনকী চান্দের আলোর প্ররোচনায় কিছু পাখিও বেরিয়ে ডানা ঝাপটায়, এ-ডালে ও-ডালে ওড়াউড়ি করে। মামাদের শানবান্ধা পুকুরপাড়ে গালগল্পে মেতে উঠি মামাত, খালাত সমবয়সী ভাইবোনদের দল। রাতটা তখন আমাদের কাছে ‘দুপুর রাতের দিন’ হয়ে যায়। শৈশব, কৈশোরের প্রতিটি বছর আমরা এই উৎসব রচনা করতে ছুটে যেতাম। আকুল হয়ে বছর শেষের এই ছুটির জন্যে অপেক্ষায় থাকতাম। কিশোরগঞ্জগামী ট্রেনে বসে আমি আবার 888sport sign up bonusভারাতুর হয়ে পড়ি। নির্ধারিত সময়েই নীলগঞ্জ স্টেশনে ট্রেনটি যখন আমাকে নামিয়ে দেয় তখন ভোর হচ্ছে। মিহি অন্ধকার ফেটেফুটে ফর্সা হতে থাকা ভোরের আকাশ, আকাশের তলে শুয়ে থাকা পৃথিবী ধীরে ধীরে চোখ মেলতে শুরু করলে অভিভূত হই। শিশিরøাত ঘাস আপন সৌন্দর্যে যোগ করে উদিত সূর্যের সোনালি কুঁচি। হাত-পা খোলা প্রান্তরে ছককাটা নানা সবুজের সমারোহ। দিগন্তরেখায় উদ্ভাসিত সূর্যকে দেখে মনে হয় যেন মোগল হেরেম থেকে নেমে আসা কোনো বাদশাহজাদা। নমনীয় তেজ অথচ কী তার আলোকিত মহিমা।
খুব সহজে পৌঁছে যাই নানাবাড়ি বলাইশিমুল। মাটির রাস্তা পাকা হয়েছে। বাস, টেম্পো, রিকশা সবই চলে। অনেকদিন পর এলাম, না জানিয়ে হুট করে। কত বদলে গেছে বাড়ি। টিনের চৌচালা এখন রীতিমতো দলদালান। নানা, নানু বেঁচে নেই। পাঁচ মামার চারজনই শহরবাসী। বাড়িতে শুধু মেজোমামা, মামি থাকেন। শহরে থাকলে কী হবে, বিশাল উঠান ঘিরে ঘিরে পাঁচ মামাই বাড়ি তুলেছেন। মানুষ নেই শুধু দালানকোঠা গিজগিজ করছে। মেজোমামার দুছেলেই গ্রামে থাকে। এরা ছিল আমার খেলার সাথি। আমি সতেরো বছর কানাডা থাকায় এদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। দীর্ঘদিন পর দেখা হলেও কেউ কাউকে চিনতে পারি না। মেজোমামার ঘরে বসি। বসার সঙ্গে সঙ্গে কোমল পানীয়র বোতল আসে। বলি – পেপসি কেন, গাছ থেকে ডাব পাড়লেই হতো। গাছ কী আর আছে বেটা, ঘর তুলবার গিয়া সবই কাটা পড়ছে। মামি বিরস মুখে জানায়। তার এই মনোবেদনা আমাকেও তাড়িত করে। মনে পড়ে, বাড়ি এলে সবার জন্য ডাব পাড়ার ধুম পড়ে যেত। ময়জুদ্দিন মামু গাছে দাবড়িয়ে উঠে পড়ত। যেন নারকেল গাছ না, সুপারি গাছে উঠছে। হ্যাঁ, এসব 888sport sign up bonus এখনো তারার মতো ফুটে আছে মনে। তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে অগত্যা পেপসির স্ট্র চেপে ধরি। লাঠিতে ঠুকঠুক আওয়াজ তুলে এ-সময় কুঁজো মতন যে বুড়ো মানুষটা এসে আমার পাশে বসে তাকে চিনতে ভুল হয় না আমার। আফসোস তার বুড়ো কানেও যে পৌঁছে সেটা বুঝতে পারি উনার কথায় – বাপ্রে তুমার ময়জুদ্দিন মামু বুড়া হয়্যা গেছে, শইল্লে তাগদ নাই গাছে উডনের। গেরামেও আইজকাইল এইতা কুকটুক দিয়াই মেমানদারি অয়। আমি শঙ্কিত গলায় বলি – আজ রাতেই তো পূর্ণিমা। এখন কি পুঁথিপাঠের আসর বসে না? ওসমান মুসল্লি, নসুর বাপ…। ময়জুদ্দিন মামুই উত্তর দেয় – ধন রে, তুমি কুন বিটিশ আমলের কতা কও? তেনারা দুইজনই ইন্তেকাল হইছেন, গেরাম কী সেই গেরাম আছে? ময়জুদ্দিন মামুর সঙ্গে তাল মেলায় মামাত ভাই ফরিদ – কারেন্ট আসার পরে এহন ঘরে ঘরে টেলিভিশন, এমনকি ডিশের লাইনও আইসা পড়ছে, এখন আর পুঁথিপাঠের আসর বসে না ভাইজান…।
মনটা খারাপ হয়ে যায়। কত প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিলাম। দুপুর রাতের দিন দেখব বলে। তারপরও পুরনো মানুষজনের টানে দিন চারেক থেকে আবার 888sport appয় ফিরে আসি।
কানাডা যাওয়ার আগে যে 888sport appকে রেখে গিয়েছিলাম, সেই 888sport appই কী আগের স্বভাবে আছে! অসহনীয় যানজট, কিলবিলানো দালানকোঠা, লোডশেডিং…। এর ওপর রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভের রাজনীতি। দম বন্ধ হয়ে আসে।
নিরাপত্তা, ভালো চাকরি, বেতন, গোছানো নাগরিক জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে গোঁয়ারের মতো চলে এসেছি। হ্যাঁ, স্রেফ মাটির টানেই। নয়তো আর কী! আহা গো দেশের টান! টানা হরতাল আর অবরোধে মনে জং ধরে যাওয়ায় বাইরে বেরোনোর ছুতো খুঁজছিলাম। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ এ যুগে আর কঠিন কিছু নয়। মোবাইল, মেইল, ফেসবুক, টুইটারের কল্যাণে ওদের সঙ্গে পরাবাস্তব গল্পবাাজি চলে। এই অস্থির রাজনৈতিক বাতাসে স্টেডিয়ামে একেবারে বিশুদ্ধ দেশপ্রেমের হাওয়া বইছে। চলছে 888sport apps নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট খেলা। ক্রিকেটের নামে আমি উন্মাদ প্রায়। মিরপুর স্টেডিয়ামে 888sport apps আর নিউজিল্যান্ডের ম্যাচ হচ্ছে ২৯-১০-২০১৩ তারিখে। চেষ্টা করেও টিকিট না পেয়ে টিভিকে ভরসা করে খেলা দেখায় মনকে যখন বশীভূত করে ফেলেছি তখন সেদিন সকাল ৯টাতে বন্ধু শমসেরের ফোন 888sport appsের ছক্কা হাঁকার আনন্দ নিয়ে উড়ে এলো। শমসেরের স্ত্রী কাস্টমসের বড় কর্মকর্তা। খুব ফেয়ার। আমার খেলা দেখার আহাজারি শমসের সম্ভবত বউয়ের সঙ্গে শেয়ার করেছে। দুটো টিকিটের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তাতে আমি বিশেষ লজ্জিত তো হই-ই না বরং ফোনে জানাই – ভাবি আমার জন্য এতটুকু দুর্নীতি করলে দুদক পর্যন্ত খবর পৌঁছাবে না।
খেলা শুরু হবে ১টায়। তবে আমার মাঠে সরাসরি খেলা দেখার আনন্দ শুরু হয়ে যায় ১০টাতেই। শমসেরও যাবে সঙ্গে। ওকে জানাই আমার দায়িত্বে ওর সারাদিন কাটবে। বাসা থেকে পিক করা থেকে আরম্ভ করে দুপুরের লাঞ্চ মায় ডিনার পর্যন্ত সব আমার কাঁধেই ভর দিয়ে সারবে ও। ফোনের ওপাশে শমসের হা-হা করে ওঠে – প্রাইভেট কার একদম না, শালা, বাইরে থাইকা 888sport appsের কালচার ভুইল্লা গেছ? দিব, তুমার ‘এলিয়ন’রে কয়লা বানায়া। পেট্রল বোমা মাইরা…। সঙ্গে আমরাও ম্যান ফ্রাই…। যাইতে হইব রিকশায়। পরিবেশবান্ধব বাহনে চইড়া…।
সাড়ে ১১টায় বাসা থেকে বের হই। আমার বাসা 888sport app কলেজের বিপরীতে। একেবারে বাঘের খাঁচার সামনে। কিছু কর্মসূচি হলেই বিশাল বিশাল সব মিছিল বেরিয়ে পড়ে। আজ ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর। মিরপুর স্টেডিয়ামে 888sport apps মুখোমুখি হবে কিউইদের সঙ্গে ক্রিকেট যুদ্ধে। আর বাইরে 888sport appsের দুই রাজনৈতিক শক্তির কর্মসূচি। অবরোধ চলছে টানা। দিনের পর দিন। সায়েন্স ল্যাবের মোড় থেকে শুরু করে ধানমণ্ডি দুই পর্যন্ত হেলমেট মাথায় সার-সার পুলিশ। কখন কার মাথায় ইটের গুলি লাগে, কী সত্যিকারের গুলি! ওদের পাশ কাটানোর সময় ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ে। হেঁটেই শমসেরের বাসায় চলে আসি। কলাবাগান। মিরপুর এখান থেকে বেশ দূরের পথই। রিকশায় গেলে দেরি-ই না হয়, চিন্তায় পড়ি খানিকটা। খেলার শুরুটাও মিস করতে চাই না। শমসেরকে বলি – বাস চলছে দু-চারটা, চল একটাতে আল্লাহর নাম নিয়ে উঠে পড়ি। সময়টা কাভার হবে। শমসের বলে কথা! এক ধাক্কায় আমাকে একটা রিকশাতে ঠেসে তুলে নিজেও উঠে বসে, তারপর বলে – খেলা দেখার আগেই কাবাব হতে হবে, রিকশায় ওঠ। আমাকে অবাক করে দিয়ে রিকশাটা প্রায় উড়তে থাকে। যেন দুটো পাখাও আছে ওটার। আমার বিস্ময় দেখে শমসের তো শমসের রিকশাওয়ালা পর্যন্ত কান বিস্তৃত হাসি দেয়। স্টেডিয়ামের কাছাকাছি বাহন থামলে রিকশাওয়ালা আসল রহস্য জানায় – এটি ব্যাটারিচালিত রিকশা। সাধারণ রিকশার চেয়ে এর গতি অনেক বেশি।
স্টেডিয়াম এলাকায় এসে আমার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে, কানায় কানায় হাজার হাজার মানুষ। 888sport appsকে কেবল হৃদয়ে ধারণ করেই যে এরা সন্তুষ্ট নয়, তা নানা প্রতীকী ভাষায় প্রকাশ করতে ব্যস্ত সবাই। বিশাল আকৃতির জাতীয় পতাকা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ২০-২৫ জনের একটা দল। অনেকের গায়ে লাল-সবুজ পতাকার টি-শার্ট। গালে আঁকা জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার। লাল-সবুজ ক্যাপ, মাথা ও কপালজুড়ে সবুজ চওড়া কাপড়ের ঘেরে জ্বলজ্বল করছে লাল সূর্য। নানা আকৃতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবন ছেড়ে মিরপুর স্টেডিয়ামের চত্বরে হালুম করার অপেক্ষায় অনেকের কোলজুড়ে রয়েছে। কেউ কেউ নিজেরাই জ্যান্ত রয়েল বেঙ্গল হয়ে ঘোরাফেরা করছে। সব ঠোঁট কেবল একটি শব্দে মুখর ‘888sport apps’ ‘888sport apps’। এদের কোনো হরতাল নেই, অবরোধ নেই, বিক্ষোভ নেই। এদের একটাই দল, একটাই ভালোবাসা, সে-দল আর ভালোবাসার নাম 888sport apps।
গ্যালারিতে নির্দিষ্ট আসন খুঁজতে গিয়ে কানে আসে দর্শকদের প্রত্যাশা আর উদ্বেগ।
আহা রে সাকিবের ডেঙ্গু, সাকিব ছাড়া জিতব তো? একটা গলায় হতাশা ঝিলিক দিতেই দশটা গলা থামায় ওকে – আরে রহিম, মাশরাফি, সোহাগ গাজি, রুবেলরা আছে না? সব কয়টা বাঘের বাইচ্চা, আজকে আমরা দেখায়া দিমু…।
খেলা শুরুর সময় বাঘের বাচ্চারা কিছুক্ষণ মাত্র ‘হালুম’ করেই এক্কেবারে চুপ মেরে যায়। মাত্র ১৮ রানের কাছাকাছি ব্যবধানে তিন-তিনটা উইকেট পড়ে যাওয়ায় পুরো স্টেডিয়ামে মাঝরাতের নীরবতা নেমে আসে। চুপসে যাওয়া গ্যালারিতে আবার মেক্সিকান ওয়েভ এনে দেয় নাঈম ইসলাম আর মুশফিকুর রহিম। নাঈমের ৮৪ আর মুশফিকের ৯০ রানে নিভে যাওয়া মশালে প্রত্যাশার দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে। আজকে সবকিছুই চলছে নাটকীয়। রোদ-উজ্জ্বল দুপুরের আকাশে একদল ভ্রাম্যমাণ মেঘও উড়ে আসে খেলা দেখতে। স্টেডিয়ামের বিলবোর্ডে 888sport appsের স্কোর তখন ২৬৪। নাহ্, মেঘেরা আকাশে থেকেই সন্তুষ্ট থাকে না। খেলা দেখা বা পণ্ড করার দুরভিসন্ধি নিয়ে স্টেডিয়ামে নেমেই আসে মেঘবালিকারা। বৃষ্টির কারণে নিউজিল্যান্ডের টার্গেট করে দেওয়া হয় ২০৬। ওভারও কমিয়ে আনা হয়। ২০৬ রান ৩৩ ওভারের মধ্যেই অর্জন করতে হবে। খেলা আবার শুরু হবে তো? এ অনিশ্চয়তার মধ্যেই লাঞ্চ আর কয়েক দফা চিপস, ঝালমুড়ি সঙ্গে দু-তিন কাপ চা-কফিও সাবাড় করি। বৃষ্টি থামে, কিন্তু এ তো আর ফুটবল খেলা নয়! কাদামাটিতেই দাপাদাপি শুরু করো বল নিয়ে! ‘ক্রিকেট’ বলে কথা। শুকাও মাঠ, সাজাও পিচ। যদিও টিপটিপ শুরু হতেই বিশাল বিশাল ত্রিপল দিয়ে সবার আগে পিচ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। যথাসম্ভব মাঠকেও বিশাল বড় বড় রেইন পেপার দিয়ে 888sport appর চেষ্টা চলছে। বৃষ্টি কমার সঙ্গে সঙ্গে মাঠ খেলার উপযোগী করে তোলার তৎপরতা শুরু হয়। বড় বড় দুটো ওয়াটার সাকিং মেশিন মাঠের পানি শুষতে ব্যস্ত হয়। বৃষ্টির তোড়ে ছাদহীন গ্যালারি দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছিল। মৌমাছির মতো আবার শূন্য গ্যালারির চাকে জমতে শুরু করে কালো মাথাগুলো। এরপর শুরু হয় চমক। স্টেডিয়ামের সবকটা ফ্লাশলাইট একসঙ্গে জ্বলে উঠলে মিরপুরের বিশাল বৃত্তাকার একটা মাঠে ‘দুপুর রাতের দিন’ নেমে আসে। একদিকে রুবেলের জাদুকরী ঘূর্ণি বলটা উইকেট ফেলার আনন্দে নাচছে, অন্যদিকে তুমুল উল্লাসে মেক্সিকান ওয়েভে নৃত্য জুড়েছে পুরো গ্যালারি। পরপর বিরতিহীন তিনবার উইকেট ফেলে বলটা হয়তো-বা ক্লান্ত! কিন্তু ক্লান্তি নেই গ্যালারির রয়েল বেঙ্গলদের। ভুভুজেলা, ড্রাম পেটার শব্দ ছাপিয়ে মাঠে খেলা দেখতে আসা দর্শকদের ঠোঁট উল্লাসে ফেটে পড়ছে – রু-বে-ল, রু-বে-ল, 888sport apps, 888sport apps। আবার রচিত হয় আলোক রাত্রি, আবার রচিত হয় ‘দুপুর রাতের দিন’। হাজারো গলায় ওসমান মুসল্লি আর নসুর বাপের পুঁথিপাঠের সুর ওঠে যেন। বিভোর হয়ে সেই সুরে আমিও ঠোঁট মেলাই।
খেলা শেষে নিচে নামতে নামতে দেখি বিজয়ী 888sport appsকে অভিনন্দন জানাতেই যেন আলোকিত শূন্যতায় ঝাঁক ঝাঁক শ্বেত কপোত উড়ছে। ওদের রুপালি পাখায় শুনতে পাই শান্তি আর বিজয়ের সুললিত ছন্দ। সাদা পালকের গান শুনতে শুনতে জয়ের আনন্দে তৃপ্ত মানুষের সারিতে মিশে ‘দুপুর রাতের দিনে’ আমিও আনন্দ মিছিলে যোগ দিই।