সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অনেক বছর আগে, তা চার দশকেরও বেশি হবে, নজরুল সম্পর্কে আমি একটি 888sport live লিখেছিলাম, নাম দিয়েছিলাম ‘উন্মুক্ত পথের স্বচ্ছন্দ যাত্রী’। শিরোনামটি তখন যথার্থই যথার্থই মনে হয়েছিল, নইলে দিলাম কেন? এত বছর পরে এসে নজরুলকে নতুন করে পড়ে এবং তাঁর সম্পর্কে ভেবে আমার ধারণা কি বদলে গেছে? কিছুটা গেছে বটে তবে খুব অল্প। তিনি অবশ্যই একজন যাত্রী, নিরুদ্দেশের যাত্রী নন, উদাস পথিক নন, তাঁর যাত্রার একটা লক্ষ্য ছিল, সেদিকেই তিনি চলেছিলেন, কিন্তু একপর্যায়ে তাঁকে থেমে যেতে হয়েছে। গন্তব্যটা ছিল ধ্রুব, কিন্তু দৈবক্রমে তিনি পতিত হয়েছিলেন নানাবিধ বিপদ-আপদে, যে জন্যে চলেছেন ঠিকই, এগিয়েছেনও অনেক দূর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে থামতে হয়েছে, বলা যায় থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। পথটা মোটেই স্বচ্ছন্দ ছিল না, ছিল অত্যন্ত দুর্গম, সেই পথে চলতে গিয়ে তিনি রীতিমতো রক্তাক্ত হয়েছেন; কিন্তু দুর্গম জেনেও তিনি ওই পথেরই যাত্রী ছিলেন, তাঁর পক্ষে ভিন্নপথে চলাটা ছিল অসম্ভব।
তাঁকে আমরা নানা পরিচয়ে চিনি; তিনি বিদ্রোহী ছিলেন, আবার ছিলেন প্রেমিকও; এক হাতে তাঁর বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য এই ঘোষণা তো নিজেই দিয়ে গেছেন। আরো অনেক ভূমিকা ছিল তাঁর, প্রায় রবীন্দ্রনাথের মতোই, যদিও রবীন্দ্রনাথের তুলনায় তিনি অবশ্যই অনেক পেছনে। রবীন্দ্রনাথ যে-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, ছবি এঁকেছেন, 888sport slot game করেছেন বহুদেশ, সে-কাজগুলোও তিনি করতে পারেননি। সম্ভব ছিল না করা। তাঁর হাতে সময় অল্প, সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু তবু তিনি চলেছেন। কোন দিকে? এক কথায় বলতে গেলে বিপ্লবের অভিমুখে। তিনিই আমাদের প্রথম বিপ্লবী কবি। বিদ্রোহী নন, আসলে বিপ্লবী। সমাজ ও রাষ্ট্রে একটা বিপ্লব চেয়েছেন। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়, পৃথিবীটাকে সুন্দর করার জন্যে। সেজন্যেই তিনি একই সঙ্গে প্রেমিক ও বিদ্রোহী।
তাঁর সমসাময়িক কবিরা কেউ কেউ বিদ্রোহ করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে, নজরুলকে তা করতে হয়নি, কেননা স্বভাবতই তিনি ছিলেন রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে, যদিও রবীন্দ্রনাথের গান ছিল তাঁর প্রিয় সঙ্গী এবং রবীন্দ্রনাথের অনেক 888sport app download apk তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। কবি ও 888sport live footballিকরা তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন, তিনি তাদের মতো নন বলে। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তো আপত্তি করেছেন তাঁর ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে, যদিও কেবল খুন নয়, অসংখ্য দেশীয় এবং ফার্সি-আরবি শব্দ তিনি তাঁর 888sport app download apkয় অত্যাশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে বাংলা কাব্যকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছেন। 888sport live footballিকদের ভেতর কেউ কেউ তাঁর প্রশংসা করেছেন প্রথম দিকে, তাঁদের ভাবটা ছিল পিঠ চাপড়ে দেওয়ার, পরে অবশ্য তাঁরা ক্ষান্ত হয়েছেন, এবং দু’য়েকজন তাঁকে ব্যঙ্গ করে 888sport app download apkও লিখেছেন। তাতে নজরুলের কোনো ক্ষতি হয়নি, বরঞ্চ তাঁর যশ-খ্যাতি বৃদ্ধি পেয়েছে। একেবারে শুরুতেই 888sport app download apkর ক্ষেত্রে তিনি এমন বিশেষ একটা কাজ করেছিলেন যার কথা আগে কেউ ভাবতেই পারেননি। 888sport app download apkয় তিনি কোরাসে লেফট-রাইট আওয়াজ নিয়ে এলেন, লিখলেন ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই’, এবং সেই সঙ্গে –
মার দিয়া ভাই মার দিয়া
দুশমন সব হার গিয়া
কিল্লা ফতে হো গিয়া
পরওয়া নেহি, যা নে দো ভাই যো গিয়া
কিল্লা ফতে হো গিয়া।
পরওয়া শব্দটি পরে নতুনভাবে ফিরে এসেছে তাঁর 888sport app download apkয় যখন তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই ভবিষ্যতের নহি নবি/ পরোয়া করি না বাঁচি না বাঁচি যুগের হাওয়া কেটে গেলে।’ তাঁর ভাষা দোভাষী পুঁথির নয়, কেননা তাঁর শব্দব্যবহার সবসময়েই যৌক্তিক এবং 888sport live chatসম্মত। তদুপরি তিনি লিখেছেন সামনে যাওয়ার জন্য। অতীতকে নিয়েও অবশ্যই লিখেছেন, তাঁর বর্তমানে অতীতের অবস্থান নিঃসংশয়, কিন্তু যাবেন তিনি সামনের দিকেই। তাঁর ‘কামাল পাশা’ খিলাফতি নয়, বরং খিলাফতবিরোধী।
কিন্তু তাঁর বৈপ্লবিক আকাঙ্ক্ষাটা তো কেবল 888sport live footballিক ছিল না। সেই সঙ্গে সেটি ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক। সমাজে তিনি শ্রেণীশোষণের অবসান ঘটিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। যেটি অন্য কোনো বড়মাপের বাঙালি 888sport live footballিক তাঁর আগে করেননি, পরে যে করেছেন তেমনও বলা যায় না। আর পরাধীন ভারতবর্ষকে তিনি চেয়েছিলেন সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হিসেবে দেখতে। যেজন্যে সামাজিক নিগ্রহ এবং রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণ উভয়েরই তিনি মুখোমুখি হয়েছেন। পথটা বিশেষভাবে দুর্গম ছিল এই সামাজিক ও রাজনৈতিক বিরূপতার কারণেই। তাঁর নিজের ভেতরে স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো অভাব ছিল না, কিন্তু সেটা তাঁর অন্তরের বিষয়, বাইরে ছিল বহুরকমের আক্রমণ।
দুই
সমাজের ব্যাপারটাই প্রথমে দেখা যায়। তিনি পুরনো সমাজকে ভেঙে সেখানে নতুন একটি সমাজ গড়ার জন্য লিখছেন; তাঁর ফলে স্বভাবতই কায়েমি স্বার্থের যারা ধারক ও বাহক তারা ক্ষুব্ধ, বিচলিত, ক্রুদ্ধ ইত্যাদি হবেনই। এবং সেটা তারা হয়েছেনও।
হিন্দুসমাজ তাঁকে উপেক্ষা করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের ভেতরও বিদ্বেষ ছিল, বিশেষ করে এই কারণে যে, তিনি একজন ব্রাহ্ম মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন এবং স্ত্রীর বিধবা মাতাই অনেককাল ধরে ছিলেন তাঁর সংসারের পরিচালক। রুচিবান হিন্দুরা তাঁর গান খুব পছন্দ করতেন, তাঁরা কখনো কখনো তাঁকে গৃহে এবং অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ নয় জেনে নজরুলের উপস্থিতিতে অন্যরা অস্বস্তি বোধ করতেন। আর তিনি যে ভগবান-বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন, ধর্মপ্রাণরা তাতে প্রীত হননি।
কিন্তু বড় রকমের আপত্তিটা এসেছিল মুসলমান সমাজের কাছ থেকেই। দুই কারণে। প্রথমত, তিনি ওই সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, মুসলমান সমাজ ছিল অনেকটা পিছিয়ে। তৃতীয় একটা কারণও ছিল। সেটা হলো, নজরুলের প্রতিভা। নজরুল ‘মহররম’, ‘ফাতেহা দোয়াজদাহাম’, ‘ফাতেহা ইয়াজদাহাম’, ‘কোরবানী’, ‘সাতিল আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’র মতো অসামান্য 888sport app download apk লিখেছেন; ইসলামি গান লিখেছেন অসংখ্য; ফার্সি-আরবি শব্দকে বাংলা 888sport live footballে চালু করে দিয়েছেন, সেই কবিই কী না আবার এমনসব 888sport app download apk লিখলেন যেগুলো পড়লে মনে হয়, তিনি ইসলামবিরোধী তো অবশ্যই, বোধকরি নাস্তিকও। লিখলেন হিন্দুয়ানি 888sport app download apkও।
রক্ষণশীল অংশ তাঁকে যাচ্ছেতাই রকম গালাগাল করেছে। শয়তান, অনাচারী, নরাধম, ফেরাউন, নমরুদ, খোদাবিরোধী, ধর্মজ্ঞানশূন্য বুনো বর্বর, কুলাঙ্গার ইত্যাদি বলেছে। নজরুল নিজেই মন্তব্য করেছেন, ‘এই গালির গালিচাতে বোধ হয় আমি একালের সর্বশ্রেষ্ঠ শাহানশাহ।’ কেউ কেউ তাঁকে বুঝতেই পারেনি, খেয়াল করেনি যে, নজরুল যা লিখেছেন তা সমাজের উপকারের জন্যেই। তাঁর লেখা গজল ও তথাকথিত ইসলামবিরোধী রচনার মধ্যে কোনো বৈরিতা নেই, উদ্দেশ্য একই – সমাজকে আন্দোলিত করা এবং তাকে আনন্দলাভের পথে পরিচালিত করা। তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত্ত ছিল ধর্মব্যবসায়ী ও ভন্ডরা, সরল বিশ্বাসী মানুষেরা নন। এমন কী এস ওয়াজেদ আলীর মতো অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত এবং বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত 888sport live footballিকও একসময়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, নজরুলের পক্ষে উচিত কাজ হতো মুসলিম সংস্কৃতির ভেতরে থেকেই 888sport live footballরচনা করা এবং তার বাইরে না যাওয়া।
কলকাতায় যখন নজরুলের নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় তখন নজরুলের বয়স মাত্র ৩০। এই সংবর্ধনার বিরুদ্ধে মুসলমান 888sport live footballসেবীদের একাংশ বেশ সক্রিয় ছিল। আয়োজকদের ভেতর প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। 888sport app থেকে ‘বুদ্ধির মুক্তি’র আন্দোলনের সদস্যরা এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানান। এই প্রসঙ্গে আবুল হুসেনের একটি উক্তি তাৎপর্যপূর্ণ। 888sport appর রায়সাহেবের বাজার থেকে তিনি লিখেছেন :
আপনারা যে আয়োজন করতে পেরেছেন এতেই আশ্চর্য হচ্ছি, কারণ বর্তমান বাংলার মুসলমান সমাজ প্রতিভার কদর করতে শেখেইনি, বরং প্রতিভাকে মেরে ফেলেই তারা ইসলাম ও তার প্রবর্তকের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়। (উদ্ধৃত, হাবিব রহমান, বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব, 888sport app, ২০১২, পৃ ১৩৭)
কথাটা মিথ্যা নয়। আবুল হুসেন নিজেও এ-ধরনের ‘হত্যা প্রচেষ্টার’ ভুক্তভোগী হয়েছিলেন, যেজন্যে তাঁকে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় গিয়ে ওকালতি পেশাতে যোগ দিতে হয়েছিল।
তুলনায় নজরুলের অনুরাগী, ভক্ত ও সমর্থকের 888sport free bet অবশ্য ছিল বিপুল। বিশেষ করে তরুণদেরকে তো তিনি অত্যন্ত উদ্বেলিত করে তুলেছিলেন। তিনি তাদের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিলেন। তাই বলে নজরুল যে কেবল যুগের হাওয়ায় পাল খাটিয়েছিলেন তা নয়, 888sport live chatী হিসেবে অবশ্যই তিনি ছিলেন কালোত্তীর্ণ। তাঁর রচনায় বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, সে-বক্তব্য বিপ্লবের পক্ষে, কিন্তু বক্তব্যকে তিনি মুখ্য করে তোলেননি, সেটি থেকেছে 888sport live chatের ভেতরেই এবং শৈল্পিক সৌন্দর্যের সঙ্গে একেবারেই অঙ্গীভূত অবস্থায়, যেজন্যে তাঁর আবেদন ছিল একাধারে ব্যাপক ও গভীর। বয়সে আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছিলেন নজরুলের চেয়ে দু’বছরের বড়; নজরুলকে তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা যথার্থরূপে চিনেছিলেন তিনি তাঁদের একজন। দ্বিধাহীনভাবেই নজরুলকে তিনি বলেছেন ‘যুগ-প্রবর্তক’ কবি। কথাটা সত্য। বাংলা কাব্যে নজরুল এক নতুন যুগের প্রবর্তন করেন বইকি, একদা যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত করেছিলেন। মধুসূদনের মধ্যেও একজন বিপ্লবী ছিলেন। 888sport live footballে মধুসূদন নতুন যুগের সূচনা করেন। তাঁর ভেতরে ছিল গভীর দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবোধ। বুদ্ধিজীবী মহলে এই চেতনাগুলো তখনো পুরোপুরি বিকশিত হয়নি, কিন্তু তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য ও কৃষ্ণকুমারী নাটকে প্রাথমিক স্তরের ওই চেতনা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই রয়েছে। মধুসূদনের একেই কি বলে সভ্যতা প্রহসনটিতে সেই ইয়ং বেঙ্গলকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা হয়েছে যাদের ভেতর ইংরেজানুকরণ ভিন্ন অন্য কোনো সারবস্ত্ত নেই। বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁতে অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধে মুসলমান কৃষক হানিফ গাজী ও দরিদ্র হিন্দু ব্রাহ্মণ পঞ্চান্ন বাচষ্পত্তি একত্র হয়ে প্রতিরোধ পড়ে তোলে এবং জমিদারকে জব্দ করে।
তিন
এই প্রতিরোধ ও ব্যঙ্গবিদ্রূপ নজরুলের 888sport app download apkয় এবং গদ্য রচনাতে অনেক বেশি তীব্র। এবং তা প্রধানত ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধেই, যেজন্যে নজরুলের লেখা রাষ্ট্রের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। তাঁর অনেক বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। এই বইগুলোর মধ্যে রয়েছে যুগবাণী (১৯২২), ভাঙার গান (১৯২৩), বিষের বাঁশি (১৯২৪), দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬), প্রলয়শিখা (১৯৩০) ও চন্দ্রবিন্দু (১৯৩১)। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবি ছিল স্বাধীনতার পক্ষের 888sport alternative link, এবং সেখানে পথের যে-নির্দেশ ছিল সেটাও আপসরফার নয়, সশস্ত্র ‘বিপ্লবে’র। যেজন্যে সরকারের পক্ষে ওটিকে সহ্য করা সম্ভব হয়নি, 888sport alternative linkের বিতরণ, মুদ্রণ, সংরক্ষণ সবই তারা নিষেধ করে দিয়েছিল; যার ফলে গোপনে এবং হাতে লিখে পথের দাবি বিতরণ চলেছিল। কিন্তু শরৎচন্দ্রের শুধু একটি বই-ই বাজেয়াপ্ত হয়েছে, নজরুলের হয়েছে একে একে ছয়টি, কেবল তাই নয়, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে কবির সশ্রম কারাদন্ড হয়েছে। এক বছরের ওপরে তিনি কারাবন্দি ছিলেন। দ্বিতীয়বারও তাঁর কারাদন্ডাদেশ হয়েছিল, কিন্তু সেটি কার্যকর হয়নি গান্ধী-আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার দরুন। ব্রিটিশ রাজের জন্য এই কবি এতটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে তিনি তুলনাবিরহিত। অন্যকোনো ভারতবর্ষীয় কবি সরকারকে এমনভাবে ক্ষিপ্ত করতে পারেননি।
১৯২৯-এর সেই নাগরিক সংবর্ধনায় সুভাষচন্দ্র বসু উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বক্তৃতাতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনো তার গান গাইব।’ এ ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি। যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে তেমনি কারাগারে নজরুলের গান গাওয়া হয়েছে বইকি।
তাঁর অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকায় ‘ধূমকেতু’ নামের 888sport app download apkয় নজরুল বলেছেন,
আমি জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি সৃষ্টির ঐ চাতুরী
তাই বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে ঠুকি বিধাতার বুকে
হাতুড়ি।
আমি জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তা’ও
তাই বিপ্লব মানি, বিদ্রোহ করি,
নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও।
এই ধূমকেতু অশুভের পূর্বাভাস নয়, শুভের আগমন সংবাদ বটে। এই ধূমকেতু বিদ্রোহ করে, কিন্তু এর উদ্দেশ্য বিপ্লব আনা। ধূমকেতুর প্রথম বর্ষ ১৩ 888sport free betয় (১৩ অক্টোবর, ১৯২২-এ) বলা হয়েছে :
সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা একথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীদের অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।
888sport app download for androidীয় যে, এমন কথা সেই ১৯২২-এ খুব কমই শোনা গেছে। শুভাষ বসু ও জওহরলাল নেহেরু এক হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন ১৯২৮ সালে, এবং সে-দাবিকেও গান্ধী শেষ পর্যন্ত তাঁর অতিপ্রিয় স্বপ্নপূর্ণ স্বরাজে পরিণত করেছিলেন, যে-স্বরাজের পরিপূর্ণ অর্থ কেউ কখনো বোঝেনি। বলা বাহুল্য, নজরুল যে-স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন সেটি কংগ্রেস ও লীগের ক্ষমতালিপ্সু ভাগাভাগিওয়ালাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব ছিল না; সম্ভব ছিল কেবল সমাজতন্ত্রীদের পক্ষেই, যাদের পক্ষে এবং যাদের একজন হয়ে নজরুল লিখেছেন এবং নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা আসেনি, এসেছে ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত হওয়া ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস, যার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতবর্ষকে রক্তাক্ত পন্থায় দ্বিখন্ডিত করে এই উপমহাদেশের মানুষের স্থায়ী সর্বনাশ ঘটিয়ে গেছে। ১৯৪৭-এ নজরুল সবাক ছিলেন না, থাকলে পাকিস্তানে যে আসতেন না সেটা নিশ্চিত; এটাও তেমনি নিশ্চিত যে, হিন্দুস্থানের অবস্থা দেখেও তিনি মর্মান্তিক দুঃখ পেতেন। নজরুল তো বিত্তবান ব্রিটিশভক্তদের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর চাননি, তিনি যা চেয়েছিলেন তা হলো সমাজবিপ্লব। কিন্তু যা ঘটলো তা তো দুই দিকে দুই দল ইংরেজ অনুচরের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দেওয়ার চেয়ে উন্নততর কিছু নয়। মেহনতি মানুষ সেখানেই রয়ে গেল যেখানে তারা ছিল। নজরুল এমনটা চাননি।
আবুল কালাম শামসুদ্দীন ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন, নজরুল ছিলেন বেদনার কবি। বেদনার্ত মানুষের দুঃখ ঘোঁচাবার জন্যে তিনি 888sport app download apk লিখেছেন, গান রচনা করেছেন ও গেয়েছেন, সম্পাদনা করেছেন দৈনিক ও অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা, যোগ দিয়েছেন রাজনৈতিক সভাতে, সমাজতন্ত্রীদের রাজনৈতিক দল গঠনে সক্রিয় সহায়তা দান করেছেন, এমন কী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন সাধারণ নির্বাচনে। বেদনার্ত মানুষের পক্ষে অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু নজরুল যেমনভাবে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন, তাদের দৃষ্টিতে জগৎটাকে দেখতে চেয়েছেন, এবং তাদেরকে উঠে ও রুখে দাঁড়াবার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন, তেমনটি তাঁর আগে কোনো বাঙালি লেখক করতে পারেননি – পরেও নয়। এমন কী শ্রেণীচ্যুত হয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বামপন্থীরাও অনেক ক্ষেত্রে মেহনতি মানুষের আপনজন হয়ে যেতে পারেননি, নজরুল যেমনটি পেরেছিলেন। তার কারণ তিনি হৃদয় ও বুদ্ধি দিয়ে বেদনার্ত মানুষদের কষ্টটা বুঝেছেন; কেবল হৃদয় বা শুধু বুদ্ধিকে ব্যবহার করেননি। তদুপরি তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন এবং তা তাঁর লেখায় নিয়ে এসেছেন – সে-ভাষা যেমন মুখের, তেমনি বুকের। ওই যে তাঁর ‘বিদ্রোহী’ 888sport app download apk সেটা যে নৈরাজ্যসৃষ্টির উদ্দেশ্যে রচিত নয়, সেটি যে কেবল একজন ব্যক্তির কথা তা নয়, যুগেরও নয় শুধু, ওই বক্তব্য একাধারে স্থানীয়, আন্তর্জাতিক ও সর্বকালীন – সেই সত্যকে না জানলে 888sport app download apkটির মর্মোপলব্ধি অবশ্যই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। ‘বিদ্রোহী’ 888sport app download apkর শেষের সেই স্তবকটি যেন না ভুলি যেখানে কবি বলছেন যে, তাঁর বিদ্রোহী সেই দিনই হবে শান্ত, ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না -।’
তাঁর ইতিবাচক কথাগুলো যেমন প্রবাদ ও প্রবচনে পরিণত হয়েছে, তেমনি ব্যঙ্গাত্মক রচনাগুলোও কম কার্যকর ছিল না। নজরুলের কৌতুকবোধ ও বাগবৈদগ্ধ দুটোই ছিল অতুলনীয়। ইতিবাচক বক্তব্যে যেমন ধ্বংসের ইচ্ছার পেছনে সৃষ্টির আগ্রহ তৈরিতে কাজ করতো, ব্যঙ্গরচনার ক্ষেত্রেও তেমনি লক্ষ্যবস্ত্তকে তিনি হাস্যকর করে তুলতে পছন্দ করতেন, মঙ্গলজনক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে ভেতরে ভেতরে ধারণ করে। তাঁর ব্যঙ্গ888sport app download apk তেমন সুপরিচিত নয়, কিন্তু সেগুলো অবশ্যই 888sport app download for androidীয়। দেখা যাবে তিনি তুচ্ছতা ও অল্পেসন্তোষকে কেমন অমার্জনীয় অপরাধের পর্যায়েই ফেলতেন। ধরা যাক, ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস নিয়ে তাঁর কৌতুক 888sport app download apkর কথা। মা স্বাধীন হবেন আশা করছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশের একটি ডমিনিয়নে পরিণত হবেন। কবির বক্তব্য –
বগল বাজা দুলিয়ে মাজা
বসে কেমন অমনি রে
ছেঁড়া ঢোলে লাগাও চাটি
মা হবেন আজ ডোমনী রে।
ডোমনী চর্যাপদের সেই ডোমিনীর কথাও মনে ধরিয়ে দেয়।
888sport app download apkটিতে আরো আছে –
রাজা শুধু রাজাই হবেন
পাগার পারে নির্বাসন
রাজ্য নেবে দুভাই মিলে
দুর্যোধন ও দুঃশাসন।
এ-888sport app download apk লেখা হয়েছে ১৯৩০-৩১-এ। দুর্যোধন আর দুঃশাসনের রাজত্বে দেশবাসীর অবস্থাটা কেমন হবে নজরুল তা দেখতে পেরেছেন; রাজনৈতিক নেতারা পাননি। ১৭ বছর পরে দুর্যোধন ও দুঃশাসন রাজত্ব পেয়েছে, ইংরেজের কোনো ক্ষতি হয়নি, অনায়াসে তারা পাগার পার হয়েছে।
নজরুল বলেছেন,
অনেক কিছু সয়ে গেছে,
গন্ধটা আর সইবে না?
কি ক’স? গলা বন্ধটা? এও
দুদিন বাদে রইবে না।
আশ্চর্য, ১৯৪৭-এ ঠিক ওই যুক্তিই দিয়েছিলেন নেহেরু এবং প্যাটেলরা। বলেছিলেন, আপাতত ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস বটে, কিন্তু কদিন পরেই স্বাধীন হয়ে যাবো, গায়ের গন্ধ, গলার টাই সবকিছুই বদলে যাবে, গায়ে-গতরে পোশাকে-আশাকে আমরা ভারতীয় বনে যাবো। পাকিস্তানের দাবিদার জিন্নাহর অবশ্য কোনো বিকারই ছিল না, তিনি ডমিনিয়ন স্ট্যাটাসেই মহাসন্তুষ্ট ছিলেন। এমনও কী হতে পারে যে, ডমিনিয়ন স্ট্যাটাসকে নজরুল গলায় বেল্ট বাঁধা পোষা কুকুরের সঙ্গে তুলনা করছেন। কথাকথিত ওই স্বাধীনতাপ্রাপ্তিকে বিদ্রূপ করতে নজরুলের ক্লান্তি নেই। বলেছেন :
ঠুঁটো হলেও হাত পেলিত।
ছিলি যে একদম বে-হাত
একেবারেই ঠ্যাং ছিল না,
পেলি ত এক ঠ্যাং নেহাত।
ভিক্ষার চাল কাঁড়াই হোক – আর
আকাড়া – তাই ঝোলা ভর
ফেনও পাবি অতঃপর।
কেক-বিস্কুটও পাওয়া যাবে
আজ তবু কেক বিস্কুট খাস,
হয়েও গেলি প্রায় রাজাই।
গাল বাজাই আয় কানাডা আর
অস্ট্রেলিয়ার ভায়রা ভাই।
(‘ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস’)
এ-ধরনের রচনা সহ্য করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি, তারা যে-বইতে 888sport app download apkগুলো ছিল সেই চন্দ্রবিন্দুকে অচিরেই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। চন্দ্রবিন্দুতে বাঙালি মধ্যবিত্তকে নিয়ে যথার্থ ব্যঙ্গ করা হয়েছে। যেমন, পলায়ন দক্ষতাকে চিহ্নিত করে লেখা –
থাকিতে চরণ মরণে কী ভয় নিমেষে যোজন ফরসা
মরণ হরণ নিখিল শরণ জয় শ্রীচরণ ভরসা।
বপু কোলা ব্যাং, রবারের মতো ঠ্যাং;
প্রয়োজন মতো বাড়ে গো,
সামনে আদাড়ে বনে ও বাদাড়ে
পাগারের পুকুর পাড়ে গো
লখিতে চকিতে লঙ্ঘিয়া যায়
গিরি দরী বন সিন্ধু
এই এক পথে মিলিয়াছি মোরা
সব মুসলিম হিন্দু।
(‘শ্রীচরণ ভরসা’)
অন্য একটি কোরাস সংগীতে আছে :
কে বলে মোদের ল্যাভাগ্যাপাচার এ আমরা সিভিল গাড়
অরাজক এই ভারত মাঠে হে আমরা উদমো ষাঁড়
(‘ল্যাবেন্ডিশ বাহিনীর বিজাতীয় সঙ্গীত’)
১৯২৮ সালে ভারতবর্ষীয়দের কোনো ছাড় দেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে তদন্ত করার জন্য সাইমন কমিশন এসেছিল। ওই কমিশনের বিরুদ্ধে প্রবল জনবিক্ষোভ হয়েছে। নজরুল কমিশনের আগমনকে ব্যবহার করেছেন ভিন্ন এক আঙ্গিকে। বিদ্রূপ করে তিনি লিখেছেন :
সাইমন কমিশনের রিপোর্ট
(প্রথম ভাগ)
[ভারতে যা দেখিলেন]
এদেশের 888sport promo code বেজায় অনাড়ী
পুরুষের হাতে তবলা।
তবলাতে চাটিটি মারিলে সে কাঁদে,
ইহারা কাঁদে না, অবলা।
এটা হলো মেয়েদের দশা, ছেলেরা কেমন আছে?
ইসকুলে, প্রেমে, জ্বরে পুড়ে হাঁড়ে
জীবন কাটায় ছেলেরা;
মাঝে মাঝে করে শান্ত শিষ্ট
শান্তে লেনিন ভেলেরা\
তবু সাইমন কমিশন বিক্ষোভ যেহেতু দেখেছে তাই শেষ পর্যন্ত এইটুকু বলতে বাধ্য হয়েছে :
কালা চামড়ার ভিতরে ওদের আমাগের মত রক্ত,
এ যদি না হত শাশ্বত হত
ও-দেশে মোদের তক্ত।
এই রক্তটুকুকেই যা ভয়। নজরুলের আবেদনও ছিল ওই রক্তের কাছেই।
সে-কালে হিন্দু-মুসলিম মিলনের আশায় প্যাক্ট হতো। চিত্তরঞ্জন দাশও একটি প্যাক্ট করেছিলেন। নজরুল এই সকল প্যাক্টের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা উন্মোচিত করে দিয়ে ‘প্যাক্ট’ নামে যে ব্যঙ্গ 888sport app download apkটি লিখেছেন সেটি কেবল তাঁর পক্ষেই লেখা সম্ভব ছিল।
কিন্তু এই কবি সবসময়েই ছিলেন আশাবাদী। তাঁর বিশেষ ভরসা তরুণদের ওপরই। তবু তারুণ্যই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনও। আন্দোলনই ঐক্য আনবে হিন্দু-মুসলমানের, মধ্যবিত্তের সঙ্গে মেহনতি মানুষের। তবে তিনি জানতেন, ওই আন্দোলনকে অবশ্যই হতে হবে সমাজতান্ত্রিক। কংগ্রেস ও লীগের আন্দোলনের ওপর তাঁর কোনো আস্থা ছিল না।
তাঁর আশাবাদ বহু স্থানে ব্যক্ত হয়েছে। এগুলো আমাদের খুবই পরিচিত। তবু কয়েকটিকে 888sport app download for android করা যাক।
১. এই যৌবন-জল-তরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া
বালির বাঁধ?
কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে
যখন উঠিছে চাঁদ?
(‘যৌবন-জল-তরঙ্গ’)
২. এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল।
এই শিকল-পরেই শিকল তোদের করব যে বিকল।
(‘শিকল পরার গান’)
৩. (ঐ) বিশ্ব ছিঁড়ে আনতে পারি, পাই যদি ভাই তোদের প্রাণ।
(তোরা) মেঘ-বাদলের বর্ষ বিষান (আর) ঝড় তুফানের
লাল নিশান
(‘মিলন গান’)
৪. কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল, কররে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল পুজোর পাষাণ বেদী
(‘ভাঙার গান’)
গান্ধীর রাজনৈতিক প্রভাব যখন অত্যন্ত প্রবল, নজরুল তখনকার কবি। গান্ধীর প্রভাব এই তরুণের ওপরও পড়েছিল বইকি; কিন্তু তিনি কখনই গান্ধীবাদী হয়ে ওঠেননি। অহিংসায় তাঁর আস্থা ছিল না, কেননা রাষ্ট্রের সহিংস চরিত্র সম্পর্কে তিনি সর্বদাই সচেতন ছিলেন। গান্ধীর চরকাকে তিনি যেভাবে দেখেছেন অন্যকেউ সেভাবে দেখেছেন বলে মনে হয় না। স্বয়ং গান্ধীও হয়তো দেখেননি। নজরুল চরকাকে দেখেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একটি ক্ষেত্র হিসেবে, এবং ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনবিরোধী একটি অস্ত্র হিসেবেও। চরকাকে উদ্দেশ করে তিনি লিখেছেন :
১. তুই ঘোর ঘোর ঘোর
আবার তোর মহিমায় বুঝল দুভাই
মধুর কেমন মায়ের ক্রোড়।
২. তুই ভারতবিধির দান,
এই কাঙাল দেশের প্রাণ,
আবার ঘরের লক্ষ্মী আসবে ঘরে শুনে তোর ঐ গান।
আর লুটতে নারবে সিন্ধু-ডাকাত বৎসরে পঁয়ষট্টি জোড়
ঐ সাত রাজারই ধন
দেশ মা’র পরশ রতন।
(‘চরকার গান’)
বিপ্লবের পক্ষে বারবার বলেছেন। যেমন, ‘ঝড়’ 888sport app download apkয় :
বিপ্লবের লাল-ঘোড়া ঐ ডাকে ঐ
ঐ শোনো, শোনো তার হ্রেষার চিকুর।
আবার ‘রক্তপতাকার’ গানে
ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।…
দুলাও মোদের রক্ত পতাকা।
‘সাম্যবাদী’ 888sport app download apkয় আছে :
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে
সব বাধা ব্যবধান
আধুনিক 888sport promo codeবাদী আন্দোলন পুরুষ ও 888sport promo codeতে সাম্য চায়, নজরুল ছিলেন আরো এগিয়ে, তিনি বলেছেন, তাঁর চোখে পুরুষ ও 888sport promo codeতে কোনো ভেদাভেদ নেই। মানুষের মুক্তির পথে প্রধান অন্তরায় যে শ্রেণীবিভাজন সেটি তিনি যেভাবে জানতেন এবং জানিয়েছেন সেটি অন্য কোনো বাঙালি কবি তা করতে পারেননি। কিন্তু ধূর্ত ব্রিটিশ শাসকের প্ররোচনায় এবং একদিকে হিন্দু অন্যদিকে মুসলিম মধ্যবিত্তের তৎপরতায় শ্রেণীশোষণকে আচ্ছাদিত করে দেওয়া হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার রক্তাক্ত আবরণে, নজরুল ওই আবরণটি ছিন্ন করে হিন্দু-মুসলমানকে এক করতে চেয়েছিলেন। এজন্যে আবশ্যক ছিল আন্দোলনের, যার কথা তিনি বলেছেন। ওদিকে নিজের 888sport live footballে হিন্দু-পুরাণ ও মুসলিম-ঐতিহ্যকে এক স্রোতে প্রবাহিত করে দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐক্যের সত্যটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। যেমন ধরা যাক, ‘বন্দনা গানে’র এই পঙ্ক্তি দুটি :
জাগে সত্য ভগবান যে রে আমাদেরি এই বক্ষমাঝ
আল্লার গলে কে দেবে শিকল, দেখে নেবো তাহাই আজ।
ভগবান ও আল্লাহ একত্র হয়ে গেছেন – কৃত্রিমভাবে নয়, দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। ত্রিশ কোটি মানুষ এক হয়ে যাবে মুক্তিসংগ্রামের স্রোতধারায়।
নজরুল মধ্যপ্রাচ্যের 888sport live footballিক ঐতিহ্যের অনেক বৈশিষ্ট্যকে বাংলায় নিয়ে এসেছেন। ফলে বাংলা 888sport app download apk সমৃদ্ধ হয়েছে কেবল যে নানন্দিকভাবে তা নয়, বিষয়-বৈচিত্র্যের দিক থেকেও। যেমন, হাফিজের গজলের ভাবছায়ায় লিখিত ‘বোধন’ 888sport app download apkয় দেখি,
দুঃখ কি ভাই হারানো সুদিন ভারতে
আবার আসিবে ফিরে
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ হয়ে গুলিস্তা
হাসিবে ধীরে।
দু’দিনের তরে মহা-ফেরে তাই সব আশা যদি
না হয় পূর্ণ,
নিকট সেদিন, রবে না এদিন, হবে জালিমের গর্ব চূর্ণ।
হুইটম্যানকে এনেছেন, এনেছেন হাফিজকে, উদ্দেশ্য অভিন্ন, 888sport app download apkর মধ্যে দিয়ে মানুষকে উদ্দীপিত ও আশান্বিত করে তোলা। তিনি চান সত্য কথাটা বলা হোক। সত্য হচ্ছে বৈষম্য, প্রতিষ্ঠা চাই সাম্যের। বলেছেন :
দোহাই তোদের! এবার তোরা সত্য বল্।
ঢের দেখালি ঢাক ঢাক গুড় গুড়, ঢের মিথ্যা ছল
এবার তোরা সত্য বল।
(‘বিদ্রোহী বাণী’)
প্রথাগত সত্য-মিথ্যার ভেদাভেদ তিনি মানেন না। তাঁর কাছে আসল সত্য হচ্ছে অন্তরের, সেটা থাকলে বাইরের প্রকাশটিতে কিছু আসে-যায় না। ‘মিথ্যাবাদী’ নামের 888sport app download apkটিতে সুদৃঢ়ভাবে বলেছেন :
মিথ্যা বলেছ বলে তোমায় কে দিল মনস্তাপ?
সত্যের তরে মিথ্যা যে বলে স্পর্শে না তারে পাপ।
বাটখারা আর রশি নিয়ে সত্যের পিশি-মাসি,
মাপিয়া মাপিয়া ভরিল বস্তা গুণে গুণে বাছে খাসি।
বন্ধু শুনো না ঝুট তর্কের যত হাতি ঘোড়া উট
সত্যনিষ্ঠা থাকে যদি প্রাণে, বেপরোয়া বল ঝুট।
সত্যনিষ্ঠাকে বুকের ভেতর লালন করেছেন বলেই নজরুল অমন দুঃসাহসী হতে পেরেছেন, পরোয়া করেননি নিন্দা-প্রশংসার।
তাঁর 888sport live footballিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কাজের একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছিল। সংবর্ধনা সভায় সুভাষ বসু বলেছিলেন, ‘আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়াই; বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, কিন্তু নজরুলের দুর্গম গিরি কান্তার মরুর মত প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।’ কেবল ওই গানে নয়, তাঁর সকল রচনাতেই অত্যন্ত আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্ত আহবানটি ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের। সেই সঙ্গে বিশ্বের যেখানে যা কিছু মহৎ সৃষ্টির সন্ধান পেয়েছেন তাদের নিয়ে আসতে চেয়েছেন বাংলার 888sport live footballধারাতে। এমন কী নিতান্ত অমনোযোগী পাঠকও লক্ষ করবেন কেমন দক্ষতা ও আগ্রহের সঙ্গে তিনি তাঁর লেখাতে হাইফেন ব্যবহার করেছেন। এই ব্যবহার তাৎপর্যহীন নয়; তিনি ছিলেন মিলনের কবি, মানুষের বেদনাকে দূর করার জন্য যে ঐক্য একান্ত অপরিহার্য সেটি ছিল তাঁর অন্বিষ্ট।
সংবর্ধনা সভার সভাপতি বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মোটেই বাড়িয়ে বলেননি, যখন তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘আজ আমি এই ভাবিয়া বিপুল আনন্দ অনুভব করিতেছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানদের কবি নন, তিনি বাংলার কবি। কবি মাইকেল মধুসূদন খ্রিষ্টান ছিলেন, কিন্তু বাঙালি জাতি তাহাকে বাঙালিরূপেই পাইয়াছিল। আজ নজরুল ইসলামকেও জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সকলেই 888sport apk download apk latest version নিবেদন করিতেছেন।’ একই কথা বলেছেন অন্য একজন বক্তা, তখনকার দিনের প্রভাবশালী প্রবীণ 888sport live footballিক জলধর সেন। (উদ্ধৃত, হাবিব রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ ১৩৯)।
চার
উদারভাবে সকলকে গ্রহণ করার অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর ছিল। তাঁর দৃষ্টিতে কেবল স্বদেশিকতা ছিল না, ছিল আন্তর্জাতিকতাও। মগ্ন অধ্যয়নের তো নয়ই, এমন কী স্থির হয়ে বসবার মতো অবকাশও তাঁর ছিল না, কিন্তু ক্ষমতা ছিল যেখানে যা কিছু ভালো পেয়েছেন তাকে নিজের করে নেবার। এমন ক্ষমতা বড়মাপের প্রতিভারই থাকে, যেমন ছিল নজরুলের। কিন্তু তিনি আবার খাঁটি বাঙালিও। বাঙালির দু’টি সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য তাঁর 888sport live footballে অত্যন্ত অকর্ষণীয় ও পরিচ্ছন্নরূপে ধরা দিয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে মাতৃপ্রেম, অপরটি অভিমান।
বাঙালির জীবনে মায়ের স্থান অতি উচ্চে না হোক, অবশ্যই অতি গভীরে। পিতা কর্তা বটে, কিন্তু সন্তানের জীবনে নীরব ও প্রধান প্রভাব, এমন কী কর্তৃত্বও মাতারই। পিতা অনেকটা রাষ্ট্রের মতো, সেক্ষেত্রে মাতা হলেন সমাজ, বাঙালি রাষ্ট্রের আধিপত্য মানে, বাধ্য হয় মেনে নিতে, কিন্তু বসবাস করে সমাজে। অবশ্য সমাজকে মাতা বলা যাবে কেবল তুলনামূলক অর্থেই; কেননা সমাজেও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব থাকে বইকি, অতীতে ছিল, এখনো রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে তো ছিল বিশেষভাবেই।
নজরুলের নিজের মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের একটা টানাপড়েন ছিল বলে মনে হয়। বিশেষ করে যে অভিমান বাঙালি অনেকের সঙ্গেই করে, প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে তো অবশ্যই করে থাকে, তবে বিশেষভাবে করে মায়ের সঙ্গে, নজরুল তাঁর নিজের মায়ের ব্যাপারে সেটা করেছেন। মা’কে বাঙালি অনেক কিছু দেবে বলে আকাঙ্ক্ষা রাখে, এবং বিনিময়ে নয়, তবে স্বাভাবিক সম্পর্কবশত যা দেবে তার চেয়ে বেশি পাবে বলে আশা রাখে। নজরুলের বেলাতে এটা কীভাবে ঘটেছিল, কেমন ছিল প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান, তা আমরা জানি না, তবে নজরুল যে তাঁর আপন মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন সেটা একটা দুঃখজনক সত্য।
মাতৃস্নেহের ব্যাপারে এই কবি কতটা কাতর ছিলেন তার প্রমাণ আছে তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে। বিষের বাঁশী তিনি উৎসর্গ করেছেন ‘অগ্নি-নাগিনী মেয়ে মুসলিম মহিলা-কূল গৌরব আমার জগজ্জননী স্বরূপা মা মিসেস এম রহমান সাহেবার চরণারবিন্দে’। এ-মহিলা সম্পর্কে আমাদের সাধারণ জ্ঞানটা অল্প, কিন্তু সন্দেহ নেই যে, নজরুল এঁর কাছ থেকে অত্যন্ত গভীর স্নেহ পেয়েছিলেন, যে-স্নেহ নজরুল কামনা করতেন, এবং প্রত্যাশিত জনের কাছ থেকে না-পেলে তাঁর অভিমান হতো। চিত্তনামা উৎসর্গ করা হয়েছে চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রীর নামে; বলা হয়েছে, ‘মাতা বাসন্তী দেবীর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দে’। সর্বহারার উৎসর্গপত্রে রয়েছে, ‘মা (বিরজাসুন্দরী) দেবীর শ্রীচরণবিন্দে’।
সন্তানের সঙ্গে মাতৃস্নেহই বড় করে এসেছে তাঁর 888sport app download apkয়, পিতৃস্নেহের তুলনায়। মাতা ও সন্তানকে আমরা বড় অন্তরঙ্গভাবে পাই তাঁর শিশু-কিশোর বিষয়ক 888sport app download apkবলিতে। ‘ঝিঙে ফুলে’ কবি লিখেছেন –
আয় তবে ভাই বোন,
আয় সবে আয় শোন,
গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা’র
মা’র বড় কেউ নাই
কেউ নাই কেউ নাই
নত করে বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!’
সাতভাই চম্পা জানাচ্ছে বোন পারুলকে যে, সে হবে সকালবেলার পাখি, সবার আগে কুসুমবাগে সে উঠবে জাগি। মা বলবেন, হয়নি সকাল ঘুমো, শিশু বলবে, আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাকো, হয়নি সকাল তাই বলে কী সকাল হবে নাকো? জানাচ্ছে, তারা জাগলে তবেই তো সকাল হবে, তবেই তো রাত পোহাবে। আর সেটাই এই শিশু করতে চায়। কোনো সন্দেহ থাকে না যে, এই শিশুটি হচ্ছেন কবি নিজে।
কিন্তু মা’কে আমরা সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষভাবে পাই ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ 888sport app download apkতে। সেখানে রয়েছে আমাদের সেই অতিপরিচিত লাইনগুলো :
অসহায় জাতি ডুবিছে মরিয়া জানে না সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’ ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।
এই লাইনগুলো নজরুলের ভূমিকাকে স্পষ্ট করে তোলে। তুলনায় ‘বন্দে মাতরমে’র রণধ্বনি অনেক বেশি অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে সন্দেহ কী! কিন্তু ওই সৃষ্টির ভেতরই রয়েছে ‘বন্দে মাতরম’ গানটির দুর্বলতা। বন্দে মাতরমে যে মাতৃমূর্তি ফুটে উঠেছে সেটা নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মাতার নয়। মূর্তিটি একজন দেবীর, যে-মূর্তিকে মুসলমানদের পক্ষে দেশমাতৃকা হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, বরঞ্চ তাদেরকে উত্তেজিত করে তুলেছে ‘আল্লা হো আকবর’ রণধ্বনি তুলতে। ফলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন উস্কানি পেয়েছে সাম্প্রদায়িকতায় পরিণত হতে, যে-সাম্প্রদায়িকতা পরে দেশভাগকে অনিবার্য করে তুলেছে।
নজরুলের 888sport app download apkটিতে আছে সম্মুখযাত্রা। রয়েছে বিপন্ন মাতার সন্তানদেরকে বাঁচাবার জন্যে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের প্রতি আহবান। সে-আহবান ‘বন্দে মাতরমে’ নেই। বন্দে মাতরম পেছনদিকে যায়। পরিণত হয় হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের রণধ্বনিতে, এবং ঐক্য সৃষ্টি না করে উৎসাহ দেয় বিভেদকে। নজরুলের মাতৃমুক্তিপণ যদি জয়ী হতো তাহলে এই উপমহাদেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। কিন্তু তেমন সুযোগ তো ছিল না।
দেশমাতৃকার দেবীমূর্তি নজরুলের 888sport app download apkতেও আছে। ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’র জ্বলে পুড়ে খাক শ্বেতবসন, নয়নে জ্বলে উঠুক ধূমকেতু জ্বালা, হাতে বাজুক তরবারি ঝনঝন – এ ছবি নজরুলের লেখায় আমরা পাই, কিন্তু ওই মা নিজেই যুদ্ধে নেমেছেন, সন্তানদেরকে তিনি বিভক্ত করেননি। অন্যত্র মা আছেন বন্দিশালাতেও। সেজন্যে অনেকেই তাকে খুঁজে পায় না।
(হায়) মাকে খুঁজি? চাকরানী সে, জেলখানাতে ভানছে ধান
(মা’র) বন্ধ ঘরে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয় দুই নয়ান।
(তোরা) শুনতে পেয়েও শুনলি নে এ’ মাতৃহন্তা কুসন্তান।
মাতাকে মুক্ত করতে হবে। সাম্প্রদায়িকভাবে তা করা যাবে না, করতে হবে সমষ্টিগত ও অসাম্প্রদায়িক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে; এই সহজ সত্যটি তরুণ নজরুলের পক্ষে বুঝে নিতে কালবিলম্ব ঘটেনি, কিন্তু প্রাজ্ঞ নেতাদের অধিকাংশই সেটা একেবারে শেষ স্তরে পৌঁছেও বুঝতে পারেননি। আসলে বুঝতে চাননি, কেননা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সঙ্গে তাঁদের কায়েমি স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। নজরুলের দেশমাতার সঙ্গে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কোনো বিরোধ ছিল না, প্রশ্নই ওঠে না বিরোধের; তাঁর দেশমাতা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী, বন্দে মাতরমের মাতার মতো মোটেই মুসলিমবিরোধী ছিলেন না।
ভগবানের কাছে এই কবি প্রশ্ন করেন না, উত্তর চান। দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য আছে বইকি। ‘ফরিয়াদ’ 888sport app download apkর এই পঙ্ক্তিগুলো পড়লে ব্যাপারটা বোঝা যায় :
এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান
মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও আদি-পিতা ভগবান।
সেই সঙ্গে ঘোষণা করেন
শত শতাব্দীতে ভাঙেনি যে হাঁড়, সেই হাঁড়ে ওঠে গান
‘জয় নিপীড়িত জনগণ জয় জয় নব উত্থান
জয় জয় ভগবান।’
অভিমানের কথা বলছিলাম। নজরুলের 888sport app download apkয়, গানে, গল্পে, 888sport alternative linkে অভিমানের বহু উল্লেখ ও ছবি পাবো; সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে গেলেও সেটা দীর্ঘ হতে বাধ্য। তবে যেটা তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, যিনি বিপ্লবী তিনিই আবার অভিমানী। এর কারণ হলো এই যে, যিনি ভালোবাসেন তার পক্ষেই অভিমান শোভা পায়। এই কবি ভালোবাসেন অসম্ভবকে, ভালোবাসতে গিয়ে আঘাত পান, এবং ফিরে আসেন মায়ের কাছে, কিন্তু তাতে ভালোবাসার ঘাটতি পড়ে না, এবং তিনি একাধারে বিপ্লবী ও যথার্থ বাঙালি রয়ে যান।
পাঁচ
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আবার ফিরে যাই। বক্তাদের বক্তৃতার পর নজরুল যে-প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন তাঁর অংশবিশেষ এই রকমের, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনাময় যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান-সেনাদলের তূর্যবাদকদের একজন আমি – এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি জানি, এই পথের পাকে পাকে বাঁকে বাঁকে কুটিল-ফণা ভূজঙ্গ প্রখরদর্শন শার্দুল পশুরাজের ভ্রুকুটি এবং তাদের নখর-দংশনের ক্ষত আজো আমার অঙ্গে অঙ্গে। তবু ওই আমার পথ ওই আমার গতি, ওই আমার ধ্রুব।’ স্পষ্ট করে বলেননি ঠিকই, তবে পথটা ছিল বিপ্লবের। সেটাই ছিল তাঁর জন্যে ‘ধ্রুব’। তিনি আরো বলেছেন, ‘যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ তিনি একটি বিপন্ন ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেটা ছিল দৈব। কিন্তু ধ্রুব সত্য ছিল এই যে, তূর্যবাদক হিসেবে তিনি সঙ্গে ছিলেন অগ্রপথযাত্রীদের। বিংশ শতাব্দী ছিল বিপ্লবের যুগ। তিনি সে-যুগের একজন অগ্রসর মানুষ। নিজের পরিবেশের সামান্যতাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছিলেন বলেই তিনি অত বড় কবি হয়েছিলেন, নইলে কোথায় হারিয়ে যেতেন নামহারাদের দলে।
সংবর্ধনা সভায় প্রফুল্লচন্দ্রের বক্তৃতার একটি অংশ আমরা উদ্ধৃত করেছি, অন্য অংশটিও কম উল্লেখযোগ্য নয়। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আগামী সংগ্রামে কবি নজরুলের সঙ্গীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রীমান সুভাষের মতো তরুণ নেতাদের অনুসরণ করিব। ফরাসি বিপ্লবের একখানি বই পড়িতেছিলাম। তাহাতে লেখা দেখিলাম, সে সময় প্রত্যেক মানুষ অতি-মানুষে পরিণত হইয়াছিল। আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের 888sport app download apk পাঠে আমাদের বংশধরেরা এক একটি অতি-মানুষে পরিণত হইবে।’
এ-বক্তব্যের প্রথমাংশ অবশ্যই সত্য। ফরাসি বিপ্লবের সময় ওই দেশের মানুষেরা অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। একাকী নয়, সকলে, সমবেত হয়ে। সেজন্যেই তখন সেখানে বিপ্লব ঘটেছে। ভারতবর্ষেও একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটেছিল ১৮৫৭ সালে। সে-বিপ্লব দমন করা সম্ভব হয়েছিল কারণ মধ্যবিত্ত তাতে যোগ তো দেয়ইনি, বরঞ্চ তার বিরোধিতা করেছে। পরবর্তীকালেও মধ্যবিত্তের বিপ্লব-বিরোধিতা যাতে অব্যাহত থাকে সেটি নিশ্চিত করার জন্যই ব্রিটিশ শাসকেরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে দাঁড় করিয়েছিল। এর কিছু পরে বিপ্লবের সম্ভাবনাকে সমূলে বিনষ্ট করার অভিপ্রায়ে মুসলিম লীগ গঠন করা হয়েছিল। তার পেছনেও ছিল ব্রিটিশের উস্কানি। তারা যা চেয়েছিল তা-ই ঘটলো। কংগ্রেস ও লীগে প্রথমে বিরোধ, পরে দাঙ্গা, এবং আরো পরে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়ে স্বাধীনতার পরিবর্তে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীনে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস প্রদান করে শাসকেরা তাদের অনুগত নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছালো। ভাগ হয়ে গেল দেশ। অবলুপ্ত হলো বিপ্লবের সম্ভাবনা।
বিপ্লবের জন্যে মেহনতি মানুষের সংগঠনের প্রয়োজন ছিল। সে-সংগঠন গড়বার উদ্যোগ যাঁরা নিয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে নজরুলও নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। মেহনতি মানুষের দল কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করেছে, তাদের আত্মত্যাগ সামান্য নয়, কিন্তু বিপ্লব ঘটেনি। কেননা দেশ ছিল পরাধীন; আর স্বাধীনতার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছিলেন তাঁরা বিপ্লব তো চানইনি, বরঞ্চ বিপ্লবীদেরকে ব্রিটিশের চাইতেও বড় শত্রু জ্ঞান করেছেন। তাঁরা বৈপ্লবিক পরিবর্তন চাননি, চেয়েছেন গদিদখল। আর বিপ্লব যদি সত্যি সত্যি ঘটতো তাহলে তাঁদের গদিদখলের স্বপ্নটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো। বস্ত্তত গদি বলে কোনো কিছু থাকতোই না। এমনটা তাঁদের চাইবার কথা নয়, চানওনি, বরঞ্চ বিপ্লবীদেরকে নির্যাতিত করেছেন। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ, কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। স্বভাবতই কবি কাজী নজরুল ইসলামও নিগৃহীত হয়েছেন। রাষ্ট্রের হাতে তো অবশ্যই, সমাজের হাতেও। প্রফুল্লচন্দ্রের স্বপ্ন সফল হয়নি; অতি-মানুষ কমই পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে কেবল ক্ষুদ্র মানুষের ভিড়, যাদের জন্য পলায়ন-অভ্যস্ত পদযুগল ছিল প্রধান ভরসা।
বিপ্লব যে কত কঠিন তার একটি অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রায়-বৈপ্লবিক ভূমিকা ভুলবার নয়। এই বেতার কেন্দ্রের কাজ শুরু হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামে। কিন্তু নামটি একদিনের বেশি টেকেনি। দু’দিন পরেই ‘বিপ্লবে’র বোঝা কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে কেন্দ্রটি কেবলমাত্র ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ই রইলো। তারপরে দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন নামের ‘স্বাধীন’ অংশও আর রইলো না, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে তার নাম দাঁড়ালো 888sport apps বেতার। মাঝখানে আমার চেষ্টা হয়েছিল রেডিও পাকিস্তানের আদলে রেডিও 888sport apps নাম চালু করবার। সেটা অবশ্য সফল হয়নি; কিন্তু রাষ্ট্রীয় সাফল্য অদৃশ্য হবার নয়, সেটি ঠিকই ফিরে এসেছে। পাকিস্তান আমলের চেয়েও আজকের 888sport apps বেতার অধিক রাষ্ট্রশাসিত বললে ভুল বলা হবে না। ‘বিপ্লবী’ সম্ভাবনা কীভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এটি তার একটি দৃষ্টান্ত বটে। আশা করা গিয়েছিল যে, 888sport appsে একটি সমাজ বিপ্লব ঘটবে। সেটা ঘটেনি। যদিও নজরুল, যিনি বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন, তাঁকে এ-রাষ্ট্রের জাতীয় কবি করা হয়েছে।
কিন্তু বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বপ্নটা আছে। আর সেই স্বপ্নের সঙ্গে নজরুলও থাকবেন। কেবল স্বপ্ন দেখেছিলেন এই দাবিতে নয়, অসাধারণ একজন 888sport live chatী ছিলেন বলেই। আসলে দুটি মিলেই তিনি এক, অভিন্ন এক সত্তা। তিনি আছেন এবং থাকবেন। ইতিমধ্যে আমরা 888sport app download for android করবো যে, তাঁর পথটি ছিল দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল, যেজন্যে তাঁকে দুর্গম পথের দুঃসাহসী যাত্রী বলাটা মোটেই অসংগত নয়।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.