উনিশশো ছিয়ানব্বই সালের প্রথমদিকে ফ্রান্স তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন, রেনে দেকার্তের (১৫৯৬-১৬৫০) চারশোতম জন্মবার্ষিকী সাড়ম্বরে উদ্যাপন করেছে। বার্ষিকীটি পালিত হয়েছে বক্তৃতা-বিতর্ক,
সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, প্রদর্শনী ও পুস্তক প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। এ-সময়ে ফ্রান্স জুড়ে যে ‘দেকার্তে উৎসব’ চলেছে, তা পরিণত হয়েছিল দেকার্তে ক্রেজে এবং দেকার্তে ফ্যাশনে। সে-বছর তাঁর ওপর ফ্রান্সে প্রকাশিত কয়েক ডজন 888sport free bet loginের মধ্যে রয়েছে নবপ্রজন্মের দার্শনিক আদ্রেঁ গ্লুকস্মানের বহুল সমাদৃত বই দেকার্তে মানে ফ্রান্স।
বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের (Scientific reasoning) অন্যতম প্রবক্তা রেনে দেকার্তের জন্ম খ্রিষ্টীয় চার্চের অনুশাসনে আবদ্ধ ফ্রান্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। দেকার্তে জন্মেছিলেন ১৫৯৬ সালে, যখন ইংল্যান্ডে শেক্সপিয়র তাঁর হ্যামলেট লিখছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন ব্রিটানি পার্লামেন্টের একজন কাউন্সিলর এবং বেশ কিছু ভূসম্পত্তির মালিক। দেকার্তে অবশ্য তাঁর পিতার মৃত্যুর পর সে ভূসম্পত্তি বিক্রি করে তা বিনিয়োগ করে কিছুটা আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। দেকার্তের জন্ম যে-সমাজে, তা পরিচালিত হতো ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে ভিত্তি করে। মুক্তবুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির কোনো মূল্য তো সেখানে ছিলই না, অধিকন্তু তাকে চিহ্নিত করা হতো অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে। রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিধান অনুযায়ী এ-ধরনের বিপজ্জনক চিন্তাবিদদের ইনকুইজিশনের আগুনে পুড়িয়ে মারাই ছিল একমাত্র উপায়। এরকম সমাজব্যবস্থার মধ্যেই দেকার্তে শুরু করেন তাঁর শৈশব ও কৈশোরের শিক্ষা এবং ক্রমশ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন গণিত, জ্যামিতি, দর্শন ও কয়েকটি প্রাচীন ভাষায়। এভাবেই তিনি পরিণত হন একজন প্রথম শ্রেণির গণিতজ্ঞে, যাঁর জ্যামিতি আজো ‘কার্তেসীয় জ্যামিতি’ নামে সুপরিচিত।
ষোলোশো ষোলো সালে আইনে ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, যে-যুদ্ধ ধর্মের ভিত্তিতে সারা ইউরোপকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছিল। নিজে ক্যাথলিক হলেও তিনি অবশ্য সেই যুদ্ধে উভয় পক্ষেই যুদ্ধ করেছেন – প্রথমে বিনা বেতনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রোটেস্ট্যান্ট ‘প্রিন্স অব অরেঞ্জ’ এবং পরে ক্যাথলিক ডিউক ব্যাভেরিয়ার ম্যাক্সিমিলানের সেনাদলে। যুদ্ধ চলাকালেই তিনি একদিন রাতে স্বপ্ন দেখেন যে, ‘দর্শন’ তাঁকে ডাকছে, যে-স্বপ্ন তাঁর কাছে ছিল ঈশ্বরের বার্তাপ্রচারকের কাছে আসা ঐশী বাণীর মতো। যুদ্ধের পর তিনি জার্মানি, হল্যান্ড ও ইতালি 888sport slot game করেন – যেখানে তিনি হরেকরকম অভিজ্ঞতা লাভ করেন, যেমন জুয়া খেলা, পতিতাগমন এবং একটি ঘটনায় প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ডুয়েল লড়া। ফ্রান্সে ফিরে আসার কিছুদিন পর ধর্মীয় গোঁড়ামি ও পশ্চাৎপদতার প্রতিনিধি খ্রিষ্টীয় চার্চের বিরুদ্ধবাদিতার মুখোমুখি হয়ে দেকার্তে আবিষ্কার করেন যে, তিনি স্বদেশ ফ্রান্সে তাঁর কাজকর্ম চালাতে অক্ষম। সুতরাং তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অপেক্ষাকৃত মুক্ত সমাজে স্বেচ্ছানির্বাসনের। এজন্যে তিনি বেছে নিলেন ইউরোপের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও মুক্ত সমাজের একটি হল্যান্ডকে। তিনি ১৬২৮ সালে হল্যান্ডে চলে যান এবং তাঁর জ্ঞান-888sport apk চর্চার একটা বড় অংশ তিনি সেখানে অবস্থানকালেই করেছেন। তিনি প্রায় আমৃত্যু, ১৬৪৯ সাল পর্যন্ত সেখানেই থাকেন, কিছুদিনের জন্য সুইডেনের রানী ক্রিস্টিনার আমন্ত্রণে বেড়াতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে দুঃখজনকভাগে মৃত্যুবরণ করার আগে পর্যন্ত। হল্যান্ডেই তাঁর একটি অবৈধ কন্যা, ফ্রাঙ্কিন, জন্ম নেয় – মাত্র পাঁচ বছর বয়সে যার মৃত্যুতে তিনি তীব্র শোকাহত হন। প্যারিস থেকে হল্যান্ডে আসার সময় তিনি অল্প কয়েকটি বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, যার মধ্যে ছিল থমাস একুইনাসের সুম্মা থিয়োলগিয়া। তবে তিনি গর্ব করে বলতেন যে, এসব বই তিনি বিশ বছরেও একবার ছুঁয়ে দেখেন না। তাঁর বাসায় আগেও কোনো এক অতিথি তাঁর লাইব্রেরিটি দেখতে চাইলে তিনি তাঁকে একটি ঘরে নিয়ে যান, যেখানে একটি বাছুরের অর্ধ-ব্যবচ্ছেদকৃত শবদেহ রয়েছে। সেটি দেখিয়ে তিনি বলেন যে, এটিই হচ্ছে আমার লাইব্রেরি। আলোকবিদ্যা বিষয়ে তাঁর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য তিনি নিজেই কাচ ঘষে পরকলা বানিয়ে নিতেন।
রেনেসাঁস-পরবর্তী দার্শনিকরা পুরনো যুগের, মূলত গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনাকেই পুনঃআবিষ্কার করেন। কিন্তু দেকার্তেই সম্ভবত প্রথম দার্শনিক, যিনি সে-পথ অনুসরণ না করে সচেষ্ট হন নতুন কিছু আবিষ্কার করতে এবং মানুষ ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে কিছু সত্য আবিষ্কারও করেন। দেকার্তে বিশ্বাস করতেন, মানুষের জ্ঞানে সন্দেহাতীত স্বতঃসিদ্ধ বলে কিছু নেই – জ্ঞান লাভ সম্ভব একমাত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তির মাধ্যমে। যে-কোনো ধরনের প্রতিপাদ্য বৈজ্ঞানিক যুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধ না হলে তাকে পরিত্যাগ করা উচিত। চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের খ্রিষ্টান ধর্মযাজক সেন্ট অগাস্টিনের মতো তিনিও সন্দিগ্ধচিত্তে দর্শন নিয়ে চিন্তা শুরু করেন – আমি সকল জাগতিক বস্তুকেই সন্দেহযোগ্য বলে মনে করি, কিন্তু আমার নিজেকে নয়। কেননা, আমি চিন্তা করছি, সুতরাং আমি আছি। Cogito, ergo sum! সুতরাং আমরা যাকে সন্দেহাতীত ও স্পষ্টরূপে প্রমাণ করতে পারি, একমাত্র তাই সত্য। দেকার্তের মতে, সেরকম সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণযোগ্য ও স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত 888sport free betয় অতি নগণ্য। তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন, যে-কোনো প্রতিপাদ্য, যাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যায় না – তাকে বর্জন করতে, অন্ততপক্ষে তাকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে। এভাবেই দেকার্তের শিক্ষণ সাহায্য করেছিল ‘বিশ্বাস’কে সিংহাসনচ্যুত করে সেখানে ‘যুক্তি’কে অভিষিক্ত করতে। সারাজীবন তিনি কাটিয়ে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা একটি ভদ্র ও শান্ত জীবন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেননি – যদিও তাঁর সেই যোগ্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোও অন্য বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীদের মতো ল্যাটিনে নয় – সহজ ঝরঝরে ফরাসি ভাষায় লেখা। দেকার্তে যা লিখেছেন, তা একজন শিক্ষক হিসেবে নয়, বরং একজন 888sport slot gameকারী আবিষ্কারক হিসেবে, যিনি উৎসুক ছিলেন তাঁর আবিষ্কার সবাইকে অবহিত করতে।
গ্যালিলিও যখন তাঁর সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে লেখা বই Dialogue on Two World System ১৬৩২ সালে প্রকাশ করেন, তখন তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই চার্চ কর্তৃক সমালোচিত হয়ে ইনকুইজিশনের সামনে হাজির হন। গ্যালিলিও যদিও চার্চের কাছে ক্ষমা চেয়ে এবং ভুল স্বীকার করে তাঁর নিজের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হন; কিন্তু এই উদাহরণ দেখে দেকার্তে সতর্ক হয়ে যান। একই বছরে দেকার্তেও তাঁর একই সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে লেখা বই The World নামে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন; কিন্তু বিপদ বুঝতে পেরে তিনি তা প্রেস থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সেটি কখনো আর ছাপার মুখ দেখেনি, যদিও তার অংশবিশেষ তিনি তাঁর পরবর্তী বই Principles of Philosophy-তে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এরপর জ্যামিতি, আলোকবিদ্যা ও আবহাওয়াতত্ত্ব নিয়ে তাঁর বই Discourse on Method প্রকাশিত হয় ১৬৩৭ সালে, যা দর্শনের ওপর একটি অতি জনপ্রিয় ধ্রুপদী পুস্তক। এই বইটিকে অনেকে প্লেটোর রিপাবলিক, অথবা কান্টের ক্রিটিক অব পিওর রিজন – দর্শনশাস্ত্রের এ-দুটো যুগান্তকারী বইয়ের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। তবে দেকার্তের এই বইটি আরো সংহত ও সহজপাঠ্য – দেকার্তে নিজেও বলতেন যে, তাঁর বই ‘888sport alternative linkের মতো সুখপাঠ্য’।
এরপর ১৬৪১ সালে প্রকাশিত হয় দেকার্তের অধিবিদ্যাবিষয়ক বই Meditation বা ‘অনুধ্যান’। ‘অনুধ্যান’ ছাপা হওয়ার আগেই তিনি বন্ধুবান্ধবকে এর কপি দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে সমালোচনা আহ্বান করেন। বন্ধুদের কাছ থেকে ছয়টি সমালোচনা পেয়ে দেকার্তে সেগুলোর উত্তর প্রস্তুত করেন এবং বইটি ছাপার সময় তাতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তাই এটিই ইতিহাসে Peer-review হয়ে ছাপা হওয়া দর্শনবিষয়ক প্রথম গ্রন্থ। উট্রেকট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর গিসবার্ট ভয়েসিয়াস বইটি পড়ে এটিকে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করেন এবং মারাত্মক নাস্তিকতা ছড়ানোর অভিযোগে দেকার্তেকে গ্রেফতার করার সুপারিশ করেন। ক্ষমতাবান কিছু প্রগতিমনস্ক ব্যক্তির সহযোগিতাতেই দেকার্তে সেই বিপদ থেকে রক্ষা পান। এরপর ১৬৪৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর Principles of Philosophy এবং ১৬৪৯ সালে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয় Treaties on the Passion, যা ‘ইথিক্যাল ট্রিটিজ’ নামেও পরিচিত। এর মধ্যে তাঁর Passions বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বোহেমিয়ার প্রিন্সেস এলিজাবেথকে এবং Passions করেছিলেন সুইডেনের রানী ক্রিস্টিনাকে।
প্যারিসের রাস্তায় অটোমাটন বা স্বতশ্চল যন্ত্র দেখে মন ও দেহ – এ দুটোর মধ্যে সম্পর্ক কী, তা আবিষ্কার করতে দেকার্তে আকৃষ্ট হন। দেহ ও মন পরস্পরের যোগসাজশে কীভাবে কাজ করে, সেই রহস্যও তিনি উদ্ঘাটন করতে চান। এভাবেই তাঁর মাধ্যমে বেরিয়ে আসে দেহ ও মনের দ্বৈতক্রিয়া, যা কার্তেসীয় ডুয়ালিজম নামে পরিচিত। 888sport apkীদের মধ্যে যাঁরা প্রথম এই বিশ্বাস স্থাপন করেন যে, আত্মাকেও বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা যায়, দেকার্তে ছিলেন তাঁদেরই একজন। এর ফলে ধর্মযাজকরা দেকার্তের বইকে বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করেন। দেকার্তে বিশ্বাস করতেন যে, আমাদের মস্তিষ্ক একটি যন্ত্রের মতোই কাজ করে এবং তাঁর সমসাময়িক অধিকাংশ দার্শনিকের মতের বিপরীতে তিনি মনে করতেন যে, গণিত ও বলবিদ্যা মিলে আমাদের মনের অভ্যন্তরের রহস্যজনক ক্রিয়াকলাপও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীতে অ্যালান ট্যুরিং পরিগণন 888sport apk বা Computer Science-কে গাণিতিক জীববিদ্যা (Mathematical Biology) হিসেবে উন্নীত করেন – যে-ধারণাটি তিনি দেকার্তের লেখা থেকেই পেয়েছিলেন। শারীরবিদ্যায় তাঁর কাজ থেকেই প্রায় দুশো বছর পর জন্ম নেয় পরাবর্ত ক্রিয়া বা জবভষবী-এর ধারণা। দেকার্তের শারীরবিদ্যাবিষয়ক রচনাগুলো পাঠ করেই প্রখ্যাত রাশিয়ান শারীরতত্ত্ববিদ ইভান পাভলভ হয়ে ওঠেন তাঁর ভক্ত। হার্ভে যখন রক্তসঞ্চালন পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন, তখন দেকার্তে তাকে স্বাগত জানান। চিকিৎসাবিদ্যায়ও তিনি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে তিনি সফল হননি।
তবে আসল প্রশ্ন – প্রকৃতি সম্বন্ধে সত্য কীভাবে প্রতিভাত হয়? সত্য উপলব্ধির এই প্রশ্নটি নিয়ে প্লেটো-অ্যারিস্টটল থেকে আরম্ভ করে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বহু বিচক্ষণ দার্শনিক চিন্তা করেছেন। দেকার্তে নিজে এই বিষয়ে দীর্ঘ বারো বছর চিন্তাভাবনা করেছেন। এই দীর্ঘ চিন্তার ফল রয়েছে তাঁর বই Discourse on Method-এ, বৈজ্ঞানিক চিন্তার ইতিহাসে যা এক অমূল্য সম্পদ। কলেবরে একটি ছোট বই হলেও এর প্রভাব ইউরোপের চিন্তাজগতে সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়েছিল পরবর্তী অন্তত দুশো বছর ধরে। প্রাকৃতিক 888sport apkকে যুক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে দেকার্তেই ছিলেন অগ্রণী দার্শনিক। পরবর্তীকালে নিউটন ও লাইবনিজ যে-ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন, তার ভিত্তি ছিল দেকার্তে। দেকার্তে তাঁর Principles of Philosophy-তে গতির তিনটি সূত্রের কথাও উল্লেখ করেন, যার ওপর ভিত্তি করেই নিউটনের গতিসূত্র তিনটি গড়ে উঠেছিল। তাঁর হাত ধরেই আলোকবিদ্যা (Optics) এগিয়ে যায় – প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্র এবং সূর্যালোকের সঙ্গে রংধনু যে ৪২০ কোণে দৃশ্যমান হয়, তা-ও আবিষ্কার করেন দেকার্তে। তরুণ নিউটনের ওপর সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ছিল দেকার্তে ও গ্যালিলিওর প্রভাব। অবশ্য মহাবিশ্বের গতি ও পদার্থের বিবিধ ধর্মব্যাখ্যায় দেকার্তে এক অতীন্দ্রিয় ঘূর্ণাবর্তের (Vortices) কল্পনা করেন, যা কোনো পরীক্ষায় নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
সুপ্রাচীন অতীতের গ্রিক দার্শনিকদের সঙ্গে তাঁর নিজের চিন্তাভাবনার সমন্বয় সাধন করে তিনি অস্তিত্বের গাণিতিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সর্বোচ্চ শিক্ষালাভ ও বিদ্যার্জনের পরও দেকার্তের মনে হলো যে, তিনি যতই পড়ছেন, ততই তাঁর সন্দেহ ও অবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। দর্শন সম্পর্কে তিনি বলেন যে, এই শাস্ত্রের সবকিছুই অনিশ্চিত ও বিতর্কমূলক, সুতরাং এর মাধ্যমে কোনো সত্য নিরূপণের চেষ্টা করা বৃথা। কেবল গণিতের অভ্রান্ততা নিয়ে তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহ। বীজগণিত ও জ্যামিতির সমন্বয় সাধন করে তিনি গণিতের যে নতুন বিভাগ, ‘কো-অর্ডিনেট জ্যামিতি’ আবিষ্কার করেন, তা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিশেষ সহায়ক হয়েছে। তিনি দেখালেন যে, এই বিশ্ব শুধু কিছু অধিবিদ্যাগত মূল্যবোধ দিয়ে পরিচালিত হয় না, বরং তার ভিত্তিমূলে রয়েছে সুশৃঙ্খল বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন। তাঁর যুক্তির পথ ধরেই পদার্থবিদ্যা জন্ম দিতে সক্ষম হয় নিউটন, ম্যাক্স প্লাঙ্ক, আইনস্টাইনের মতো বড়মাপের পদার্থবিদের। আধুনিক যুগে আধ্যাত্মিকতার যে ভগ্নস্তূপের ওপর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সৌধমালা গড়ে উঠেছে, তার মূলে অবদান রয়েছে দেকার্তের যুক্তিবাদী দর্শনের। যদিও অনেকের অভিযোগ রয়েছে যে, দেকার্তের দর্শন সহায়তা করেছে নৈরাজ্যবাদী ও নিহিলিস্ট চিন্তাভাবনাকে, যে দর্শন বিলুপ্ত করতে চেয়েছে ভালো-মন্দের সীমানা এবং স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নিয়েছে একমাত্র অস্তিত্বের যান্ত্রিক ব্যাখ্যাকে। তবে তাদের 888sport free bet নগণ্য।
সুইডেনের তরুণী সম্রাজ্ঞী ক্রিস্টিনা, যাঁকে দেকার্তে তাঁর চধংংরড়হং ড়ভ ঃযব ঝড়ঁষ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন – একদিন ভাবলেন যে, এই চিন্তাশীল মানুষটির চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে তাঁর সময় অপচয় করার অধিকার তাঁর রয়েছে। তাই তিনি তাঁকে পেতে চাইলেন, যাতে তিনি দেকার্তের কাছে দর্শন শিক্ষা করতে পারেন। দেকার্তের যাত্রাপথে তাঁকে এগিয়ে নিতে পুরোদস্তুর একটি নৌবহর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সম্রাজ্ঞী। তাঁর ব্যস্ত দৈনন্দিন কার্যসূচি বজায় রেখে দর্শন শিক্ষার জন্য সময় নির্ধারিত হয় ভোর পাঁচটা। সুইডেনের চরম শীতে এ-সময়েই দেকার্তে পড়াতে যেতেন রাজপ্রাসাদে এবং এভাবেই আক্রান্ত হন ফুসফুসের সংক্রমণে। এভাবেই অসুস্থ হয়ে কিছুদিন পর দেকার্তে ৫৪ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন ১৬৫০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। তবে মৃত্যুর আগেই তিনি তাঁর সমাধির জন্য এপিটাফ রচনা করে গিয়েছেন – ‘মৃত্যু তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না, সারা পৃথিবী যাকে চেনে – যদিও সে নিজে তাকে চিনতে শেখেনি।’ বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরই তরুণী সম্রাজ্ঞী, দেকার্তে যাঁকে আমৃত্যু শিক্ষা দিয়েছিলেন জ্ঞানকে ধর্মবিশ্বাসের ওপরে স্থান দিতে, তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা ভুলে খ্রিষ্টীয় ক্যাথলিক ধর্মমতে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
দেকার্তের মৃত্যুর পর তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল স্টকহোমের এক সাধারণ সমাধিক্ষেত্রে। কিন্তু ১৮১৯ সালে তাঁর সমাধি খুঁড়ে দেহাবশেষ স্থানান্তর করা হয় ফ্রান্সে, এবং তাঁর দেহাস্থি আবার সেখানে সমাহিত করা হয়। সেখান থেকে তাঁর কোনো এক অনুরাগী সংগ্রহে রাখার জন্য দেকার্তের করোটি সংগ্রহ করেন, যা বেশ কয়েকবার হাতবদল হয়ে মূল্যবান অ্যান্টিক হিসেবে ইউরোপে সমাদৃত হয়েছিল। এরপর ১৮২৫ সালে ফরাসি সরকার তা একজন সংগ্রাহকের কাছ থেকে কিনে নেয় পাঁচশো ডলারের বিনিময়ে। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের জনক দেকার্তের সেই করোটি এখনো শোভা পাচ্ছে প্যারিসের মানবজাতি মিউজিয়ামে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.