দেহমাজারে যখন কান্না রচিত হয়

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

যে-জীবনে শুধু সুমিত নাথের ভাগ থাকে না, তাতে হয়তো অনেক-অনেক সোলেমান চৌধুরীও ভাগ বসায়; আমরা এমনই জীবনের গাঁথা রচনা করব, – কারণ যাপিত জীবনে তো জীবনের গপসপ থাকেই! তো, এখন আমরা সুমিতের জীবনের যে-ইতিবৃত্তে যাবো, তারও আগে সুমিতকেই অনেক জীবন পার করতে হয়েছে। সুমিতকে তখন আমরা সুমিত বলে নাও চিনতে পারি। তবে সুমিতের মা বারবার আমাদের 888sport app download for android করায় যে, এ-ই প্রকৃত সুমিত। সুমিত বারবার নানান সুমিতের ভেতর দিয়ে যেতে থাকলেও একেই সুমিত বলে শনাক্ত করা দরকার বলে তার মা জানায়। তবে এখানে মিলন শব্দটি আমরা খেয়াল করতে বাধ্য হবো। কারণ শব্দটি নিয়ে দুজন মানবসন্তান নানান কৌশলের ভেতর থাকতে পারে কিংবা তারা গ্যাঞ্জামে পড়ে হয়তো, – তাতে যে-সত্য থাকে, এ নিয়ে দুজনের ভেতর কথাবার্তা, কাইজা-ফ্যাসাদ চলে, তা আমরা পরম যতনে খেয়াল করতে-করতে এগোব। এখানে সুমিত নাথ আর সোলেমান চৌধুরী জীবন খরচ করে-করে দুজন হয়। এরই ভেতর তাদের কিছু শব্দ, কিছু জীবন আমাদের মনোজগতে আসে। আমরা শব্দের এ-জীবন লালন করার কথা বলি। মিলন এমনই এক শব্দ, যা সেবা দান আর প্রতিদানের ভেতর ঘুরপাক খায়! এ-শব্দ কী করে সুমিত নাথ বা সোলেমান চৌধুরীর জীবনে মায়া রেখে যায়, তা-ই সুমিতকে ভাবতে হচ্ছে। সেই ভাবনায় ব্যাকুলতা ছিল কি-না আমরা জানি না, তবে এটুকু সুমিত মনে করতে পারে, এ-মুহূর্তে সোলেমানদা সেলফোনে তাকে দুই-দুইটা জরুরি মেসেজ পাঠিয়েছেন। সোলেমানদার এই বেহুঁশ-বেহুঁশ আচরণ ওর কী যে ঝামেলার লাগে! রাত যখন রাতের বয়স বাড়ানো শুরু করে, তখন যেদিন ফেসবুকের ভেতর কোলাহল বাড়তে থাকে, তখন সবকিছু ছাড়িয়ে ফেসবুককে তার অদ্ভুত এক জগৎ মনে হয়। যেন জীবন এখানে সাধারণের নয়। খানিক মোহ, খানিক স্বেচ্ছামুখরতা এখানে যুক্ত হয়। কম্পিউটারের কিবোর্ডে নিয়োজিত অনেকেই তখন নিজের সত্য, নিজের তর্ক, এমনকি নিজের বিশ্বাসকেই শুদ্ধ করে দেখতে চায়! তখন এ-জগৎকে সুমিতের এক সমৃদ্ধ বেশ্যাপাড়ার মতোই লাগে; আমরা তখন বুঝে নিতে বাধ্য হবো, সোলেমান চৌধুরী তখনই নিজের ভেতর আলাদা জগৎ বানায়, – মেসেজের রায়ট লাগায় তখন। মেসেজের চরিত্রেই বোঝা যায়, সোলেমানদা তার শরীরে নানা নেশার আসর বসিয়েছেন। তাকে ভিন্নরকম লাগে, রাত বাড়লে তার স্কাইপও সচল হয়। এ চাওয়া-পাওয়া হয়তো তিনি তখন একা-একা বহন করতে পারেন না। যাতনায় যাতনা কাটাকাটি করা যায় কি-না সুমিত বুঝতে পারে না; তবে এ-শরীরী কোলাহলের সঙ্গে সোলেমানদার নিজের এক বাসনা আছে। তাতে সোলেমান চৌধুরীর বউয়ের কোনো সংশ্রব আছে বলে মনে হয় না। সুমিতেরও সময় পার হয়, সময়ের ভেতর আরো সময় ভর করে, – এক আনন্দ-সুর তার সারা শরীরে মাখিয়ে-মাখিয়ে কাঁপিয়ে নাড়িয়ে যায়। সোলেমানদার গন্ধ যেন কোত্থেকে আসে! তার শরীর ফের নাড়িয়ে দেয়!

এই সকালে সুমিতের বুকের ভেতর ধপধপ করছে, এবং ক্রমাগত তা বাড়ার কারণও আছে। এই যে মেসেজ, এই যে সোলেমানদা কর্তৃক তার বাসায় হাজিরা দেওয়ার আকুতি, তা যদি অক্ষরার মা বুঝতে পারে, তাহলে সুমিতকে সামাল দেবে কে? সংসারের এত ঝামেলা সুমিতের আর ভালো লাগে না। তার এ ভালো না-লাগার ভেতরই সোলেমানদার মিলনপিপাসু মিস্ড কল পুতপুত করতে-করতে আবারও মিলিটারির মার্চপাস্টের মতো চিৎকার করে ওঠে। এখন তো মোবাইল ফোনটাকে সাইলেন্ট না-করলে আর চলছে না। কারণ সোলেমানদার যা গতিবিধি, তাতে এটা স্পষ্ট যে, তিনি এখনই একটা ভয়েজ-মেল পাঠাবেন। তাতে বলা থাকবে – আবারও তোমায় মনে করায়ে দিতে হবে যে তোমার ভাবিজান বাসায় নাই? ডাকাতের মতো আর্তনাদ তিনি করতেই থাকবেন! এ পাগলামি মনে করতে-করতে সুমিতের ভেতরে কী-কী যেন হতে থাকে। মেঘলা আকাশের রং আরও মেঘলা হতে থাকে। ঝুমঝুম করে একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। আজ শুক্কুরবার, ওষুধের দোকানে জুমার নামাজ পড়ে গিয়ে তদারকি করলেও চলবে, কিন্তু এই সময়ের বৃষ্টির বিষয়টা সোলেমানদার বিবেচনায় থাকবে না? আবারও তার মেজাজ কিড়কিড়ে হতে থাকে। বৃষ্টির ছোপ বাড়ছেই। বৃষ্টি যেন ঘাতকের মতো তার ভেতরটা ফালাফালা করতে থাকে। অনেক-অনেক শরীরী যন্ত্রণাকে সে ক্রমাগত সেলাই করে যায়। সোলেমানদার শরীরের ঘ্রাণ আর মায়াময় সজীব শরীরের আমন্ত্রণে তার শ্বাস ছোট থেকে ছোট হতে থাকে। তাতে শুষ্ক ঘামের দাগ পড়ে। বৃষ্টির চরিত্রেও মনে হয় এ-দাগ লেগে গেছে। বেতাল অবস্থা! সোলেমানদার সঙ্গে বুদ্ধি-পরামর্শ করে প্রকৃতির এ অবস্থা হলো কী না কে জানে! তার ভাবনা কখনো দশ তালের দিকে যায় না, নাথ সম্প্রদায়ের দরুন বারো মাসে তেরো পার্বণও তার সহ্য হয় না। পরম পুরুষ কৃষ্ণেই তাদের চোদ্দগোষ্ঠীর ভরসা। রক্ষা করো ভগবান।

বৃষ্টির ছাঁট ক্রমাগত আসছে, আসছেই ক্রমাগত, এসেই তার সর্বাঙ্গে ছোঁয়া রেখে যাচ্ছে। যেন সারা অঙ্গে আলাদা এক জগৎ তৈরি করে দিচ্ছে। বৃষ্টির প্রতি সুমিতের এ-টান অক্ষরার মা একসময় প্রাণ শরীর লাগিয়ে বাসনা করত। তাকে বৃষ্টিপাগল মানুষ বলে খেয়াল-ঠাট্টা করতে করতে খেয়াল-ঠাট্টার ভেতরই জড়িয়ে রাখতে চাইত। সেই আরাধনা এখন আর নাই। তা নাই মানে একেবারে লুটপাট হয়ে গেছে। এই যেমন এখন যদি সে বৃষ্টি-দেখার-আবদার নিয়ে অক্ষরার মার পানে চায়, তাতে একটা বিপুল ঝাপ্টার কবলে তাকে পড়তে হবে, সুমিতের মায়া-মমতা ধরে টানাহেঁচড়া করবে, সে বলতেই থাকবে, সারাজনমের পুংটামি গেল না। এমনকি পুংটামি শব্দটার ওপর এত জোর দেবে যে সুমিত নাথের নাম যে সুমিত নাথ তাই মুছে দিতে চাইবে। যেন মানুষ সুমিত নাথ ভিন্ন এক নামের তরিকায় আছে। তবু সুমিত বৃষ্টির ছাঁট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় না। এবং সে শুধু তথায় দাঁড়িয়েই থাকে না, গহিন-ঘন বাতাসের ভেতর থেকে আরো এক বাতাসের চলাচল তার শরীরে জড়িয়ে নেয়। তার অঙ্গে বোশেখের এই চরম-সকালের মায়া দিয়ে তার সময় পার করে। তাতে শরীরের তীব্র মায়াময় প্রলেপ আরো গভীরে নামে। সে সেলফোন-স্ক্রিনে খেয়াল করে, এর মধ্যে আরো দুইটা মেসেজ অবিরত উঁকি মারছে। বৃষ্টির মায়ায় কি সোলেমানদার মাথা খারাপ হয়ে গেল? মানুষটাকে নিয়ে আর পারা গেল না! তার বউটা যদি এখন বাসায় থাকত, তাহলে তিনি নিশ্চিত তার বউকে দিয়ে সোহনপুরের বৃষ্টিপাতকে 888sport app download for androidে রাখার জন্য সরিষার তেল আর পেঁয়াজের সঙ্গে ঝাল চানাচুর মিশিয়ে চাল-ভাজা খেত! এখন কোথায় পাবে চাল-ভাজা, কোথায় পাবে তার বউ মিসেস মায়ানুর বানুকে আর কোথায় তার সোহনপুর! তার এখন প্রয়োজন সুমিতকে। সুমিত নিশ্চিত যে, এখন কথা বললেই তাকে সোলেমানদা বিছানার চাদরের কথা বলবে, বালিশের কথা বলবে, স্পেশাল স্প্রে দিয়ে রুমটাকে জুঁই ফুলের গন্ধে ভরিয়ে রাখার নেশা দেখাবে।

আবার তাকে বৃষ্টিতেই মন লাগাতে হয়, জিভে যে জলের ধারা নামে! জিভের নেশা তার সারা অঙ্গে লাগে। এমনকি সে যে মেয়েলি বিশেষ নেশার ভেতর বড়ো হতে বাধ্য হয়েছে তাও সে 888sport app download for android করে। এত 888sport app download for androidের ভেতর থাকলে কিছুই তো ভালো লাগার কথা নয়। হঠাৎই তার বাঁ-কানের কাছে যেন মার্চপাস্টের বাড়ি পড়ে, খ্যাক-খ্যাক করতে-করতে অক্ষরার মা রায় পড়ার মতোই বলে, ‘পূজা-অর্চনা বাদ দিয়ে কী করো তুমি!’ তাই তো আজ তো পূজায়ও আসন দেওয়া হলো না। পূজায় বসবে কী স্নানই তো করা হয়নি তার! অথচ সূর্য ওঠার আগেই, ব্রাহ্মমুহূর্ত ধরে সে স্নান করে নেয়। বাবার দেওয়া ধুতিটা পরে খালি গায়ে ভগবান কৃষ্ণের চরণে গঙ্গাজলসহযোগে পুজো দেয়। অন্তত দশটা মিনিট গীতা থেকে শ্লোক পাঠ করে। মন ভালো থাকলে গীতা পাঠ করতে-করতে কোন দিক দিয়ে ঘণ্টাখানেক সময় চলে যায়। সাধনা কি আর মুখের কথা গো, দীক্ষা লাগে, শিক্ষাও লাগে। তার বয়স যখন সাত, তখনই গোসাই বাবাজির কাছ থেকে সে দীক্ষা নেয়। পাঁচ-পাঁচজন গোসাইজির মধুর মন্ত্রাসনে দীক্ষা নেয়, কানে মুখ যুক্ত করেই মন্ত্র বলেন আসল গোসাই। তারা তখন থাকে নামাবলি-অঙ্কিত একই চাদরের নিচে! তারপর থেকে বাবার সঙ্গে বা নিজেই পুজো-অর্চনা দেয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে প্রতিটা ক্ষণই তো সঁপে দিয়ে রেখেছে সে। আজ যে শুক্কুরবার এ-কথাটাই সে ভুলে বসে আছে। অক্ষরার মাও তো বলল না! অথচ বিয়ের পর বৃষ্টির এ-মুহূর্তে অক্ষরার মা তাকে ঠিকই পাঠ করতে পারত। এখন আর তাকে পাঠ করা নেই, আছে শুধু তার খুঁত ধরার তালে। এখন তার চালভাজা খাওয়ার কথা মনে পড়ে। সেই চালভাজা ধরে জিভে শুধু লালাই নিঃসৃত হয় না, সোলেমানদার শক্ত-সামর্থ্য দেহটা তার চোখের সামনে ভাসে। তা ভাসতে ভাসতে তার মনোজগতের যাবতীয় কোলাহলে চওড়া কাঁধ, ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁটের ওপর হালকা নদীর মতো প্রবাহিত গোঁফের মাঝে ভরাট মুখটা ভাসে। সেই মানুষ শ্বাস তো নেন না, যেন সারাটা সত্তা হইহই করে ওঠেন।

তখনো আকাশের মেঘ চারপাশটা ছাড়িয়ে মুহুর্মুহু বিদ্যুতের চমকে দশদিক রাঙিয়ে দিচ্ছে। বোশেখের শেষ দিনগুলিতে হঠাৎ এমন মেঘের আনাগোনা সুমিত নাথকে  আনমনা করে দেয়। ওর বুকের ভেতরটা কী যে ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। বৃষ্টি তো নয়, যেন জীবনের কান্না এসে চোখে জমা হচ্ছে। বৃষ্টির ভেতর তাকে দেখে কেউ আন্দাজই করতে পারবে না যে, সে কোনোদিন একা নয়, কান্নাই তার সারথি হয়ে আছে। তার বাবা, বা তারও বাবার বাবা 888sport app download for android করিয়ে রেখেছে, কান্না বিনে তোমার জীবন পূর্ণ হবে না। শেখ বেটাদের দেশে তোমার কান্না, বুকের হাহাকার তোমার জীবনের অংশ, এর ভেতরই বুদ্ধি খরচ করা লাগবে। তোমার বুদ্ধিই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। তোমার বুদ্ধি নাই তো তোমার জীবন নাই। এখন যদি তার আশেপাশে, এমনকি রক্তের ভেতর যদি কান্না না থাকে, তাহলে তো সে একা মানুষই। একা একটা মানুষ এতবড় দুনিয়াতে চলবে কী করে! তাই তো সে বুদ্ধি দিয়ে জীবন গড়ার তালে আছে। তাদের হিন্দু-সমাজের অনেকের সঙ্গে সে গুজুর-গুজুর করে। ভালো লাগলেও করে, না লাগলে তো আরো বেশি করে করে। রাজসিক, তামসিক, স্বাত্ত্বিক অর্থাৎ শরীর, উন্মন আর মায়ার জগৎকে একসঙ্গে জোড়াতালি দিয়ে সে জীবন সাজায়। এই যে এখন সোলেমানদার কথা সে শুনছে, মেঘের আড়ালে যে একটু একটু রোদের নেশা পাচ্ছে, সেই নেশায় যে ভালোলাগা আছে, তাতে কি একা মানুষটাকে সাজানোর নেশা নেই? আছে আছে, এও বলতে গেলে একধরনের ভালোবাসাই। ভালোবাসার বাইরে জীবন নেই। ভালোবাসার বাইরে ভগবান কৃষ্ণ নেই। রোদের এখন কী দরকার – প্রকৃতি কি তার কান্না সরাতে চায়! সোলেমানদার কাছে যাওয়ার রাস্তা সে করে দিতে চায়? কী জানি কী চায়। রোদ, বৃষ্টি, গাছ-গাছালির গা ঝাড়া দেওয়ার ভেতর কি মাহাত্ম্য আছে তা তারাই ভালো জানবে!

তবে কৃষ্ণের মায়া আছে, আছে মিলনের লীলা। মিলনের যে-পিপাসা, যে-ব্যাকুলতা, নিজেকে দেখার যে রাস্তা তা কৃষ্ণ বিনে কী করে হয়? এ তো শুধু সে যে নাথ সম্প্রদায়ের মানুষ তার জন্য নয়, সকাল-সন্ধ্যা, এমনকি অষ্টপ্রহর যে তার নাম সে নেয়, তাও নয়, – কী এক লীলা, যেন ভগবান কৃষ্ণের মায়ালীলায় আছে। ওহে নাথ, ওগো জগতের প্রেমিক, আমায় দেখা দাও গো প্রভু!  জড়-জীবনের কী মূল্য আছে? জড় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ভেতর কি এক পয়সার আনন্দ আছে? তার কোনো ভ্যালু আছে? মায়ার বাঁধনই জগতের এক নম্বর বাঁধন, এই লীলার ওপরে লীলা নেই। তাই কৃষ্ণ তার সখা, কৃষ্ণ তার প্রেম, সে এক লীলা। সেই লীলার পরশে সুমিত জগতের যাবতীয় লীলাকে স্পর্শ করতে চায়। রোদনে রোদনে, ব্যথায় ব্যথায় জীবনের আর কতটুকু সে পার করতে পারবে! ভক্তি আর ভালোবাসার আলাদা এক জগৎ থাকে। কে যেন বলেন, জীবনের মায়া আছে জলে, স্থলে, পাতালে, এমনকি আকাশে। রজোঃ, তমো আর স্বত্ত্বর সবই মানব অঙ্গে আছে। সব দেব-দেবতা কী আর সাধে মানবজন্ম চায় – হা-হা-হা। সে-জগৎই সোলেমানদা কী করে যেন চিনে নেয়; তিনি তাকে বলেন, ‘মায়ার বন্ধনই আসল বন্ধন রে পাগল। জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ হয় কী করে? সবই মায়া। চিন্ময়-জগতের ভেতর রূপের লীলা নামলেই তো জীবনের বৈচিত্র্য টের পাওয়া যায়। বীজের প্রকাশ মমতায় নিহিত।’ সোলেমানদা যখন এসব বলেন, তখন তার ভেতর আলাদা এক জগতের গন্ধ পাওয়া যায়। তার ভাষা বদলে যেতে থাকে। কোত্থেকে কী কী সব বচন আসে, সেই বচনে তাকে একেবারে ভাসিয়ে নেয়। গলার স্বর বদলে দেন তখন। সেই বীজের কথা সেদিন বলছিলেন, তখন তিনি তাদের ধর্মের রূপ-বৈচিত্র্যে যান। মায়ার বন্ধন বলে কথা, তিনি বলেন, তুই কি মনে করোস আমাদের ধর্মে খালি তলোয়ারবাজি আছে (এই স্থলে সোলেমানদা জান ফাটিয়ে হাসেন। হাসতে হাসতে আবার কথা শুরু করেন)। আরে শোন পাগলা, আদম বেহেশতে ঘুরে-ঘুরে বেড়ান, একা-একা থাকেন, বেহেশতের মজা নেন, কিন্তু সেই মজাতে তার মজা শেষ হয় না। তার মন খারাপ থাকে। তখনই তার মনখারাপের দাওয়াই হিসেবে, তার মিলনের তৃষ্ণাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে, মহান রাববুল আল-আমিন হাওয়াকে তৈরি করেন। কোত্থেকে তৈরি করেন? এই যে এই পাঁজর থেকে, – এটুকু বলে সুমিতের বাঁ-পাঁজরে তিনি হাতের ছোঁয়া রাখেন। যেন লীলার এক পরশ রেখে যান। তাই সুমিত এখন ভাবছে মানুষটা মানুষের ভেতরকার লীলাও পড়তে পারে। এত পাঠ তিনি কেমন করে করেন? এ যে ভালোবাসার স্বরূপ উপলব্ধি। কীভাবে যেন তাদের ভেতর এক আচানক মায়া জমে। এসব সে অক্ষরার মাকে বলতে চায় না, বলতে পারে না, মানুষে মানুষে মায়ার কথা বললেই সে শুয়োরের মতো খ্যাকখ্যাক করতে থাকে – তোমার ছিনালি আমি জানি না মনে করছ। তোমার মায়ের পেটের বোনই তোমার মাইয়া মানুষের রংঢং লইয়া হাসাহাসি করতে করতে ঘর ফাটাইয়া ফেলে। আরে তুমি তো পুরুষ সমাজের কলঙ্ক! কোনদিন না-জানি আমার পিতৃকুলে এই খবর পৌঁছে!

সুমিত সব সহ্য করতে পারে, বউয়ের ধাতানিও হজম করে; কিন্তু সময়কে সময়ের নানান বাঁকে যে তার জীবন আছে, জীবনের ইতিহাস আছে, তা তো বিনাশ করতে পারে না। তবে তার এটুকু মনে আছে, তার শরীরের সঙ্গে মেয়েলি একটা আচরণ, আচার-ব্যবহার, চলাফেরার ধরনে কী যেন একটা ছিল। তাই তো অনেকেই খেয়াল করেছে, এমনকি তাকে নিয়ে হাসাহাসি গা-ঠেলাঠেলি করে। কত রঙের গা টিপাটিপিও তাকে মেনে নিতে হয়েছে। ও নিজেকে নিয়েই শুধু থাকে না, আসল মেয়েদের দেখে, ভাবে, – সে যে এটুকু ছেলে, পুরুষের কাতারে নাম লেখা পরিপূর্ণ একটা ছেলেকে কতভাবে পুরুষেরই নজর হজম করতে হয়, তাহলে তার বয়েসি মেয়েদের কপালে কী আছে! তার বয়সের মেয়েদের নিয়তি যোগ করে অদ্ভুত এক আতঙ্কে থাকে সে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ের একটা ঘটনা তার জীবনের সঙ্গে একেবারে লেগে আছে। জীবনের অনেক ঘটনা দিয়েও এ-ঘটনা থেকে সে মুক্তি পায় না। দুর্গাপূজার নবমীর দিন সে তার খুড়াতো ভাইয়ের মামাবাড়ি যায়। এই যাওয়াটা ছিল তাদের অনেকদিন আগেরই প্ল­্যান। সুমিতের মা তাকে বারবার নিষেধ করলেও সে যায়। সেই দিন রাতেই পাড়ার কতক ছেলের নজরে তাকে পড়তে হয়। গ্রামের মাতববর একরামুল্লার ছেলের লিডারশিপে চারটা ছেলে তার খুড়াতো ভাইয়ের মেজোমামাকে সরাসরি বলে, কাহা, মজা খালি আফ্নেরাই করবেন? মেজোমামা তখন তাদেরও দাওয়াত দেয়, মিষ্টি খাওয়ার কথা বলে। কিন্তু একরামুল্লার ছেলে তার ধারেকাছে যায় না – বলে – মূর্তি-উর্তি লইয়া আমোদ করবাইন, করুইন। আফ্নের ভাইগ্নারে দেইন, আমরার লগে একটু ঘোরাঘুরি করুক, বেড়াক। মেজোমামা হাঁ-করে তাকিয়ে থাকে, তার মুখ থেকে কথা বেরোয় না। আবারও একরামুল্লার ছেলের দল আমোদ-প্রমোদের বন্দোবস্তের দিকে কথা ঘোরাতে থাকে। সেই 888sport sign up bonus, তাদের সঙ্গে রাত্রিযাপনের সে-888sport sign up bonus তার জীবনের সঙ্গে খোদাই হয়ে আছে। কারণ তা আর যাওয়ার নয়। এমন ঘটনায় তাকে কতবার কতবার পড়তে হয়েছে! একপর্যায়ে তার মনে হয়, – এভাবে তো জীবনের আরেক দিক রচিত হয়ে যাচ্ছে, এমনকি তার জীবনের বাঁকে বাঁকে জীবনের নানান বাঁক নিচ্ছে। একসময় সে শুধুই আনন্দ দিত; কিন্তু সময়ের চাহিদায় তাকে আনন্দ আদায়ও করতে হয়! কারণ এখানে আনন্দ দেওয়া আর আনন্দ নেওয়ার নানান ক্রিয়া আছে। সেভাবেই জীবনের অনেক ঘটনার সঙ্গে সোলেমানদা যুক্ত হন। যে-জীবন দখলে-দখলে ভরপুর হয়, দমনে-অবদমনে-ত্রাসে দখলদার বাহিনীর মতো যেখানে শাসন থাকে, সেখানে তিনি সুমিতকে স্বপ্নের করতলে নিতে থাকেন। সেখানে সমাজের কেউ কেউ তাকে শয়তান বলে থুথু ছিটাতে থাকলেও তিনি একে স্বপ্নের জগৎ বলে রায় দিতে থাকেন। দেহমাজারের এ এক সাধনা বটে! সুমিতের দেহমাজারে যে কথকতা জমা হয়, যেখানে নিজের ওপর যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, – সেখানে আইন, পুলিশ, ঈশ্বর, এমনকি সমাজের সীমারেখা একাকার হয়ে যায়।

বোশেখের শেষ দিকের দুপুরটা যে দেখবে তার আর পথ কোথায়? সোলেমানদা শুধু ফোন করেই খালাস নন, মেসেজও পাঠাচ্ছেন। এ ধরনের মেসেজ বা ফোন যে ভয়ানক ধরনের কিছু একটা কথা না-বলেও তা অক্ষরার মা পর্যন্ত বুঝতে পারছে। অক্ষরার মা সুমিতের একেবারে মুখের কাছে এসে ষড়যন্ত্র করার মতোই ধীরে ধীরে কথা বলে, সোলেমান চৌধুরীর এমন তৎপরতার কী কারণ তা জানতে চায়। সুমিত শুধু জানায়, রাধা-মাধব মন্দিরের পেছনের ৫ শতাংশ জমি নিয়ে ম্যালা ঝামেলা হচ্ছে। এ নাকি শত্রুসম্পত্তি! অক্ষরার মায়ের মুখেও কথা সরে না। এতদিন পর দেবোত্তর সম্পত্তি কী করে শত্রুসম্পত্তি হয়! কী করে যে হয় তা তো সুমিতও জানে না। সোলেমান চৌধুরীর চাচাতো ভাইয়েরা নাকি দলিল দেখাচ্ছে, রেকর্ডে যে তাদের নামে তা ডিক্লেয়ার করা আছে তাও সরেজমিন দেখে নেওয়ার উদাত্ত আহবান জানিয়ে রেখেছে। সোলেমান চৌধুরীর চাচাতো ভাই সোলেমানকে ঠেস দিয়ে কথা বলে, পাকনা-জিনিস নিয়ে আর কত সময় পার করবেন, চারপাশে কি নাগরের অভাব আছে! সুমিতকে দুই-চার কথা বুঝ দিয়ে বলার জন্য তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। এইটুকু যদি সোলেমান চৌধুরী করতে না-পারে তবে এতদিনের খাতির-প্রণয়ের কি ভ্যালু থাকে! এরপরই সোলেমান চৌধুরীর চাচাতো ভাই সোলেমান চৌধরীকেই সাক্ষী মানে, নথিপত্র দেখায়, – দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর, ম্যাপ চেনায়।

তখনো দুপুরের বারান্দায় একমনে দাঁড়িয়ে আছে সুমিত। রোদের মমতা পেয়ে চোখের সামনের কামিনী, হাস্নাহেনা, বেলি, রক্তজবার একরোখা ভাব নরম মনে হয়। কত যে হাস্নাহেনা ধরেছে। কিন্তু দিনের বেলায় এরা এক ফোঁটা গন্ধ দেয় না। রাতের বেলায় এরাই যেন পাগল হয়ে যায়। তাদের বাসায় গন্ধঅলা ফুলের আলাদা নেশা যেন আছে। কী যে তেজ নিয়ে ফুটতে থাকে এরা। আবারও মেসেজ আসে। এমন এক-একটা পাগল-পাগল মেসেজ সে সোলেমানদার কাছ থেকে আশা করে আবারও নিরাশার অতল গহবরে তলিয়ে যাওয়ার বাসনা হয়।

কখন কীভাবে যে সে সোলেমানদার বাসার একেবারে গেটের কাছে  চলে এসেছে! সোলেমানদার বউ যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে বোঝা যায়, তার এখন গ্যাঞ্জামের ভেতর নিমজ্জিত হওয়ারই সময় নয়। আধা ঘণ্টাখানেক আগে সোলেমানদার অন্দরমহলের খবর যদি পেত তাহলে সে অন্তত এইটুকু বুঝতে পারত যে, মন্দির বিষয়ে তাদের কাছে থাকা নথিপত্রের হিসাব-নিকাশ তারা এইবার করেই ফেলেছে, – এখন শুধু সুমিতদের তা বুঝিয়ে বলার পালা। কদ্দুর বাড়বে সে, এমপি সাহেবও তো তারা নোটিশ দিয়েই রেখেছেন। সোলেমান চৌধুরীর বউয়ের একটাই যুক্তি, – একাত্তরের যুদ্ধের পর, বাবরি মসজিদ ভাঙার পর, এমনকি আল্ল­ামা সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর যে গন্ডগোলটা দেশে লাগল, তারপরও তারা এদেশে আছে কী করে! তাদের পাওনা জমিটা বুঝিয়ে না-দেওয়ার অর্থ তো একটাই, সুমিতদেরকে যতই সোজা মানুষ মনে করা হোক, আসলে তাদের মনে ক্যাচাল আছে। তাই এখন সুমিতকে তারা বোঝায়, মৃদুলয়ে ধমকও দেয়; কথাবার্তা সব সোলেমান চৌধুরীর সামনেই চলে। সুমিত একটা কথাও বলে না। এখন তার কথা শোনার সময়, – চোখ মেঝের দিকে দিয়ে, নখ দিয়ে মেঝে খুঁটতে-খুঁটতে সে কথা শুনছে। এবার সোলেমান চৌধুরীই মুখ খোলেন, এই সুমিত, কিছু বল?

কী বলব! আপনিই কিছু বলেন!

আরে আমি কী জানি, কী বলিস? আমি আবার কী জানি?

জানেন না, আপনি জানেন না? সবকিছু আপনি জানেন না?

না, জানি না। তোর কথা আমি জানার কে?

কী বলেন, আপনি কোন বিষয়টা না-জানেন?

আরে মালাউনের বাচ্চা, তুই তোর কথা ক!

সুমিতের জীবনে তখনই কী একটা ঘটনা ঘটে; তা কোন জীবনের তা আমরা জানি না! কারণ আমরা তার মূল নির্ণয় করতে পারব না হয়তো! তবে এইটুকু আমরা বলতে পারি, তার ব্যক্তিত্বের কোথায় যেন কী সব সূত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। আমরা তার কিছুই মেলাতে পারি না। অথবা এখানে তা মেলানোর কোনো বিষয় আছে কিনা বুঝতে পারি না। মিলনবিষয়ক এক কুয়াশা সুমিত নাথকে সর্বপাশে ঘিরে রাখে। ম্যালা সময় তার পার হয়। সামনে যে-সোলেমানদা আছে তাকে চেনার জন্য অনেক সময় সমূলে বিনাশ হয় তার। অথবা সময় ঠিকই থাকে, নিজের ভেতর সে নিজেকেই পার করতে থাকে। এবং চোখ তার কী যে কড়কড়ে লাগে! কেমন ভেজা-ভেজা হয় তা, আবার কীভাবে শুকিয়ে গেল! একজোড়া চোখের কত কাজ, –  চোখ শুধু দেখে না, ভেজে না, চমকায় না, শুকিয়ে কাঠও হয়!